সম্মান ও বরকত প্রদান


সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) যে জিনিস স্পর্শ করেছেন, যাকে সাহচর্য ও নৈকট্য দানে ধন্য করেছেন, সেই জিনিস এবং সেই ব্যক্তি সম্মান ও বরকতের অধিকারী হয়েছেন। এ প্রসেঙ্গ বহু সহীহ্ হাদীছ রয়েছে।


হজরত আসমা বিনতে আবু বকর (رضي الله عنه) একদা একটি জুব্বা বের করে বললেন, এই জুব্বা মোবারক রসুলেপাক (ﷺ) ব্যবহার করেছেন। আমরা রুগ্ন ব্যক্তিকে এ জুব্বা মোবারকের এক কোণা ধৌত করে পানি পান করিয়ে দেই। সঙ্গে সঙ্গে সে সুস্থ হয়ে যায়।


রসুলেপাক (ﷺ) এর ব্যবহৃত একখানা পেয়ালা ছিলো। তাতে কেউ পানি নিয়ে পান করলে রোগমুক্ত হয়ে যেতো।


হজরত খালেদ ইবনে ওলীদ (رضي الله عنه) এর টুপীতে নবী করীম (ﷺ) এর কয়েকখানা চুল লাগানো ছিলো। তিনি সে টুপীখানা পরিধান করে যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন, সে যুদ্ধেই বিজয়ী হতেন।


হজরত আনাস (رضي الله عنه) এর কূপে নবী করীম (ﷺ) এর মুখের লালা মোবারক ঢেলে দেয়া হয়েছিলো। মদীনায় তাঁর কূপের পানির চেয়ে মিষ্টি পানি আর ছিলো না। এক সময় যমযম শরীফের এক বালতি পানি রসুলেপাক (ﷺ) এর সামনে আনা হলো। তিনি তাতে মুখের লালা মিশিয়ে দিলে তা মেশক আম্বরের চেয়ে অধিক সৌরভ ছড়াতে লাগলো।


একদা হজরত ইমাম হাসান (رضي الله عنه) ও ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) পিপাসায় কাতর হয়ে কাঁদছিলেন। নবী করীম (ﷺ) তাঁর জিহ্বা মোবারক তাঁদের মুখে দিলেন। তাঁরা চুষতে লাগলেন। মুহূর্তে তাঁদের কান্না থেমে গেলো। তিনি দুগ্ধপোষ্য শিশুর মুখে তাঁর মুখের লালা দিলে, সে শিশুর রাত পর্যন্ত আহারের দরকার হতো না। হজরত মালেক (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন, তাঁর একটি ঘিয়ের কৌটা ছিলো। সেটিতে করে তিনি নবী করীম (ﷺ) এর জন্য ঘি পাঠাতেন। সেই কৌটা থেকে ঘি নিংড়িয়ে বের না করলে ফুরাতো না। তিনি সব সময় ওই কৌটা থেকে ঘি বের করতে পারতেন।


নবী করীম (ﷺ) এক ইহুদীর জন্য স্বহস্তে একটি খেজুর গাছ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সে বৎসরই তাতে ফল ধরেছিলো। হজরত সালমান ফারসী (رضي الله عنه) এর ইসলাম গ্রহণ করার ঘটনায় বর্ণিত হয়েছে, হজরত সালমান ফারসী (رضي الله عنه) কে এক ইহুদী চুক্তিবদ্ধ গোলাম হিসেবে ক্রয় করেছিলো। তাঁর সঙ্গে চুক্তি ছিলো, যেদিন তিনি চল্লিশ আওকিয়া স্বর্ণ আর তিনশ খেজুর গাছ উৎপাদিত করে তা থেকে ফল ফলিয়ে এনে দিতে পারবেন, সেদিন তাঁকে মুক্তি দেয়া হবে। তিনশ’ গাছের মধ্যে একটি খেজুরগাছ ছাড়া সব কয়টিতেই ফল এলো। সেই গাছটি রসুলেপাক (ﷺ) লাগিয়ে দেননি। অন্য কারও হাতে সেটি লাগানো হয়েছিলো।


ইবনে আবদুল বার বর্ণনা করেছেন, সম্ভবতঃ ওই গাছ হজরত ওমর (رضي الله عنه) লাগিয়েছিলেন। ইমাম বোখারী বলেন, গাছটি হজরত সালমান ফারসী (رضي الله عنه) নিজেই লাগিয়েছিলেন। এমনও হতে পারে যে, দুজনে মিলেই লাগিয়েছিলেন। যাহোক, নবী করীম (ﷺ) খেজুর গাছটি যমীন থেকে উঠিয়ে পুনরায় স্বহস্তে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আর সে বৎসরই তাতে ফল ধরেছিলো। শুধু তাই নয়, মুরগীর ডিমের মতো বড় স্বর্ণের টুকরো ভর্তি একটি পাত্র তিনি নিয়ে গেলেন। হজরত সালমান ফারসী (رضي الله عنه) সেগুলোতে মুখ লাগিয়ে চুম্বন করে চল্লিশ আওকিয়া স্বর্ণ এনে ইহুদীকে দিয়ে দিলেন এবং আযাদ হয়ে গেলেন। চল্লিশ আওকিয়া স্বর্ণ দেয়ার পর উক্ত পাত্রে আরও চল্লিশ আওকিয়া স্বর্ণ রয়ে গিয়েছিলো। এভাবে হজরত সালমান ফারসী (رضي الله عنه) গোলামীর চুক্তি থেকে মুক্ত হয়েছিলেন।


হানশ ইবনে আকীল (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, একদিন রসুলেপাক (ﷺ) আমাকে ছাতুর শরবত পান করতে দিলেন। তা থেকে প্রথমে তিনি নিজে কিছু পান করেছিলেন এবং শেষে আমাকে পান করতে বললেন। ওই শরবত পান করার পর থেকে আমার অবস্থা এই হয়েছিলো যে, যখনই আমার ক্ষুধা অথবা পিপাসা হতো, আমি ঘটনাটি স্মরণ করতাম, আর তখনই ক্ষুধা দূর হয়ে যেতো এবং নিজের মধ্যে শীতলতা অনুভব করতাম।


রসুলেপাক (ﷺ) এর বরকতে বকরীর দুধ বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা রয়েছে। যেমন উম্মে মাবাদ ও হজরত আনাস (رضي الله عنه) এর বকরী, নবী করীম (ﷺ) এর দুধমাতা হজরত হালীমা সাদিয়া (رضي الله عنه) এর বকরী এবং উট, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) এর বকরী। আর সেটা তো তখন পর্যন্ত গর্ভধারণই করেনি। তৎসত্ত্বেও দুধ এসেছিলো। হজরত মেকদাদ (رضي الله عنه) এর বকরীর অবস্থাও ছিলো সেরকমই। নবী করীম (ﷺ) একদিন তাঁর কতিপয় সাহাবীর জন্য সফরের সামগ্রী হিসেবে একটি মশকের মুখ বন্ধ করে দিয়ে তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এবং দোয়া করেছিলেন। পথে নামাজের সময় হলো। তাঁরা বাহন থেকে নেমে মশকের মুখ খুললেন। দেখা গেলো, অতি মিষ্টি দুধে মশকটি ভর্তি।


হজরত ওমর ইবনে সাআদ (رضي الله عنه) এর মাথায় হাত রেখে নবী করীম (ﷺ) একদিন দোয়া করেছিলেন। আশি বৎসর বয়সেও তিনি ছিলেন পূর্ণ যুবক এবং যৌবন অবস্থাতেই তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। আশশেফা কিতাবের লেখক বলেন, এ ধরনের বেশুমার ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। কায়স ইবনে যায়েদ জুযামী (رضي الله عنه) এর মাথায় হাত রেখে নবী করীম (ﷺ) দোয়া করেছিলেন। একশ বৎসর বয়সে যখন তাঁর মাথার সমস্ত চুল শাদা হয়ে গিয়েছিলো, তখনও ঐ স্থানটুকুর চুল সম্পূর্ণ কালো ছিলো, যেখানে নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র হাতের স্পর্শ লেগেছিলো।


হজরত আবেদ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) হুনায়নের যুদ্ধের দিন আঘাত পেয়েছিলেন। রসুলেপাক (ﷺ) তাঁর চেহারাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করেছিলেন। এরপর তাঁর চেহারা সবসময় চমকিত থাকতো। যে কারণে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিলো গোরা (উজ্জ্বলমুখ)। আরেকজনের চেহারাতেও রসুলেপাক (ﷺ) এর পবিত্র স্পর্শ লেগেছিলো। তাঁর চেহারা সবসময় নূরানী থাকতো। আবুদর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে খাত্তাব বেঁটে ধরনের ছিলেন। অথচ তাঁর পিতা ছিলেন দীর্ঘকায় পুরুষ। রসুলেপাক (ﷺ) একদিন তাঁর মাথায় হাত রেখে বরকতের দোয়া করেছিলেন। তারপর তিনি অন্যান্য লোকের তুলনায় অধিক লম্বা ও সুন্দর হয়েছিলেন।


সাইয়্যেদা যয়নব বিনতে উম্মে সালাম (رضي الله عنه) এর চেহারার উপর রসুলেপাক (ﷺ) একদিন পানির ছিটা মেরে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে তাঁর চেহারার লাবণ্য এমন বৃদ্ধি পেলো যে, তিনি অপূর্ব সুন্দরী হয়ে গেলেন। বলা হয়, তিনি এই পানির ছিটা মেরেছিলেন রসিকতা করে। সুবহানাল্লাহ্।


নবী করীম (ﷺ) এর রসিকতারই যখন এই হাল, তখন গুরুত্ব দিয়ে যদি কারও প্রতি তাওয়াজ্জুহ্ প্রদান করেন, তবে তার অবস্থা কোন পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছতে পারে। সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হজরত হানযালা ইবনে জুযায়ম (رضي الله عنه) এর মাথায় হাত রেখে নবী করীম (ﷺ) বরকতের দোয়া করেছিলেন। তারপর তাঁর এমন হাল হয়েছিলো যে, কোনো মানুষের চেহারা অথবা কারও বকরীর স্তন ফুলে গেলে তিনি সেই ফুলা স্থানে তাঁর মাথার স্পর্শ লাগালে সঙ্গে সঙ্গে ফুলা দূর হয়ে যেতো। রসুলেপাক (ﷺ) এক বাচ্চার মাথায় হাত বুলিয়েছিলেন। বাচ্চাটির মাথায় ছিলো টাক। হাত বুলানোর পর তার মাথায় চুল গজিয়েছিলো। কোনো বাচ্চা অসুস্থ বা উন্মাদ হলে অথবা বদআত্মার প্রভাবে পেলে নবী করীম (ﷺ) তার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়া মাত্র সমস্যা দূর হয়ে যেতো।


হজরত উৎবা ইবনে ফারকাদ (رضي الله عنه) এর কয়েকজন স্ত্রী ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই খুব খোশবু ব্যবহার করতেন। কিন্তু হজরত উৎবার খোশবু তাদের সকলের খোশবুকে ম্লান করে দিতো। কারণ এই ছিলো, রসুলেপাক (ﷺ) তাঁর পেটে এবং পিঠে পবিত্র হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন থেকে তাঁর শরীর হতে খোশবু বের হতো। তাঁর পবিত্র হাতের সবচেয়ে বড় মোজেজা ছিলো, হুনায়ন যুদ্ধের দিন তিনি এক মুঠো মাটি কাফেরদের দিকে নিক্ষেপ করেছিলেন। সে মাটি গিয়ে পড়েছিলো তাদের চোখে এবং মুখে। হুনায়ন যুদ্ধে কাফেরেরা সাময়িক বিজয় লাভ করেছিলো, কিন্তু তাঁর এই মোজেজার কারণে পরবর্তীতে তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করতে হয়েছিলো।


 হজরত তালহা (رضي الله عنه) এর ঘোড়ার উপর নবী করীম (ﷺ) আরোহণ করার বরকতে তার মধ্যে শক্তি ও ক্ষিপ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছিলো। পূর্বে ঘোড়াটি ছিলো একেবারেই দুর্বল ও অলস প্রকৃতির। পরে এতোবেশী তেজস্বী ও দ্রুতগামী হয়ে গিয়েছিলো যে, অন্য কোনো ঘোড়াই তার সমকক্ষ হতে পারতো না। হজরত জাবের (رضي الله عنه) এর ঘোড়াটি এক সময় খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। রসুলেপাক (ﷺ) গাছের একটি তাজা ডাল তাকে খাইয়ে দিয়েছিলেন। এতে ঘোড়াটি এতো দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়েছিলো যে, লাগাম ধরে তাকে টেনে ধরে রাখা যেতো না।


হজরত সাআদ ইবনে উবাদা (رضي الله عنه) এর গাধার অবস্থাও ছিলো ওইরূপ। নবী করীম (ﷺ) যখন তার উপর আরোহণ করলেন, তখন সে তুর্কী ঘোড়াকে হার মানিয়ে দিলো। কোনো প্রাণীই তার মোকাবেলা করতে পারতো না। হজরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ বাজলী (رضي الله عنه) ঘোড়ার পিঠে বসতে পারতেন না। রসুলেপাক (ﷺ) তাঁর বুকে হাত রাখলেন। তারপর তিনি বিখ্যাত অশ্বারোহী হয়ে গিয়েছিলেন। বদর যুদ্ধের দিন হজরত ওকাশা (رضي الله عنه) এর তলোয়ার ভেঙে গিয়েছিলো। নবী করীম (ﷺ) তাঁকে গাছের একটি ডাল ভেঙে দিয়েছিলেন। সেই ডালখানাই হয়ে গিয়েছিলো তলোয়ার। এরপর সব যুদ্ধেই হজরত ওকাশা বীরদর্পে যুদ্ধ করেছেন। সবশেষে মুরতাদদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি শাহাদতবরণ করেছিলেন। তাঁর সেই তরবারীর নাম রাখা হয়েছিলো আউন অর্থাৎ রসুল (ﷺ) এর সাহায্য।


উহুদযুদ্ধে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (رضي الله عنه) কেও খেজুরের ডাল দেয়া হয়েছিলো। আর তিনি সেই ডাল দিয়ে যুদ্ধ করে তরবারীবিশিষ্ট যোদ্ধাদেরকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্ধকার রাতে পথ চলার জন্য তিনি (ﷺ) হজরত কাতাদা (رضي الله عنه) এর হাতে একখানা খেজুরের ডাল তুলে দিয়েছিলেন। তিনি যখন রাস্তায় নামলেন, তখন ডাল থেকে আলো বিকিরিত হতে লাগলো। নবী করীম (ﷺ) তাঁকে বলে দিয়েছিলেন, ঘরে যখন পৌঁছবে, তখন ডালাটির এক অংশ কালো দেখতে পাবে। কালো অংশটুকু ফেলে দিও। কেনোনা সেটি হচ্ছে শয়তান। তিনি ঘরে পৌঁছলে লাঠিতে ঠিকই কালো অংশ দেখতে পেলেন এবং সেটুকু ঝেড়ে ফেলে দিলেন।


হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) নবী করীম (ﷺ) এর নিকট তাঁর স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার অভিযোগ করেছিলেন। তিনি (ﷺ) তখন একখানা চাদর বিছাতে বললেন। রসুলেপাক (ﷺ) তাঁর পবিত্র হাতখানা চাদরের উপর রাখলেন। তারপর চাদরটাকে বুকে জড়িয়ে নিতে বললেন। নবী করীম (ﷺ) এর দস্ত মোবারকের বরকতে তাঁর স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিলো।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 





© | সেনানী এপ্স |

Top