আল্লাহ্তায়ালার দীদার সম্পর্কে সলফে সালেহীনের মতানৈক্য


সাহাবা কেরাম, তাবেঈন ও পরবর্তী সলফে সালেহীনের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্তায়ালার দীদার সম্পর্কে মতানৈক্য করেছেন। এমর্মে হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) সহ কিছু সাহাবী ও সলফে সালেহীনের একদল না সূচক মত পোষণ করেছেন। ইমাম বোখারী (رحمة الله) হজরত মাসরুক (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে মাতা! রসুলেপাক (ﷺ) কি আল্লাহ্তায়ালার দর্শন লাভ করেছিলেন? 


হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বলেছিলেন, তোমার কথা শুনে আমার শরীরের পশম খাড়া হয়ে গিয়েছে। কেউ যদি বলে, রসুলেপাক (ﷺ) আল্লাহ্তায়ালাকে দেখেছেন, তাহলে নিশ্চয়ই সে মিথ্যা বলেছে। এরপর তিনি এই আয়াতে কারীমা তেলাওয়াত করেছিলেন, ‘কোনো চক্ষু তাকে ধারণ করতে পারে না। তিনিই চক্ষুসমূহকে ধারণ করেন, তিনি সূক্ষ্ম’। খবরদার! মুসলিম শরীফের বিবরণে আছে, হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বলেছেন, কেউ যদি বলে, মোহাম্মদ তাঁর রবকে দেখেছেন, তাহলে সে খুব জঘন্য কথা বলেছে। 


ইমাম নববী ও ইবনে খুযায়মা (رحمة الله) বলেন, হজরত আয়েশা সিদ্দীকা যে হাদীছ দ্বারা দীদারকে অস্বীকার করেছেন, তা কোনো মারফুু হাদীছ নয়। হাদীছ যদি মারফু হতো তবে তিনি তা বলে দিতেন। তদুপরি তিনি উপরোক্ত আয়াত দ্বারা দলীল দিয়েছেন এবং তার উপর নির্ভর করেছেন। অবশ্য কোনো কোনো সাহাবী তাঁর এই অভিমতের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। নিয়ম হচ্ছে কোনো সাহাবী যদি কোনো ব্যাপারে মত পেশ করেন এবং অন্য কোনো সাহাবী তার বিরোধিতা করেন, তাহলে ওই মতটি সর্বসম্মতিক্রমে দলীল হিসেবে গৃহীত হয় না। আর যে আয়াতে কারীমা পেশ করা হয়েছে তার কয়েকটি অর্থ হতে পারে। 


এদরাক এটি রুইয়াত থেকে খাস, বিশেষতর। এদরাকের অস্বীকৃতি দ্বারা স্বপ্নদর্শনের অস্বীকৃতি বুঝায় না। এদরাক হচ্ছে হাকীকতের মারেফত। আর এটা অবশ্য নেতিবাচক। যেমন চন্দ্রকে কেউ দেখতে পারে, কিন্তু তাই বলে তার হাকীকত ও রহস্য তো লাভ করতে পারে না। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এদরাকের অর্থ এহাতা বা বেষ্টন। বেষ্টন না করা দর্শন না করাকে বুঝায় না। যেমন কোনো জিনিসের এলেমকে কেউ বেষ্টন করতে না পারলে এটা বুঝায় না যে, তার এলেম নেই। যেমন হাদীছ শরীফে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, হে আল্লাহ্! আমা থেকে তোমার এমন প্রশংসা হতে পারে না, যেমন তুমি তোমার প্রশংসা করেছো। এদ্বারা এটা বুঝায় না যে, নবী করীম (ﷺ) আল্লাহ্তায়ালার, হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এবং তাবেয়ীগণ আল্লাহ্তায়ালার দর্শনকে প্রমাণ করেছেন। হজরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি এক সময় কোনো একজনকে হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর নিকট একথা জানতে চেয়ে প্রেরণ করেছিলেন যে, রসুলুল্লাহ (ﷺ) কি আল্লাহ্তায়ালাকে দেখেছেন? হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) উত্তরে বলেছিলেন, হ্যাঁ। তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহ্তায়ালা হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام) কে খলীল নির্ধারণ করে, হজরত মুসা (عليه السلام)কে কলীম বানিয়ে এবং আমাদের পয়গম্বর (ﷺ) কে রুইয়াত বা দর্শন দিয়ে ধন্য করেছেন। 


হজরত হাসান বসরী (رحمة الله) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি কসমের সাথে বলতেন, রসুলে করীম (ﷺ) আল্লাহ্তায়ালার দর্শন লাভ করেছিলেন। হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, রসুলেপাক (ﷺ) আল্লাহ্তায়ালাকে দেখেছেন। ইবনে খুযায়মা হজরত ওরওয়া ইবনে যুবায়র (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, রুইয়াতে বারী তায়ালার মাসআলা হজরত কাআব, হজরত যুহরী, হজরত মুসাম্মার (رضي الله عنه) এবং আরও অনেক সাহাবী দৃঢ়তার সাথে প্রমাণ করেছেন। আশআরীর মতও তাই। 


ইমাম মুসলিম হজরত আবু যর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি রসুলেপাক (ﷺ)কে আল্লাহ্তায়ালার দর্শন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘তিনি তো নূর, আমি কিভাবে তাঁকে দর্শন করবো?’ এই হাদীছখানা ওই হাদীছের বিপরীত যেখানে বলা হয়েছে, ‘আমি নূর দেখেছি।’ ইমাম আহমদ (رحمة الله) থেকে দর্শনের পক্ষে মত রয়েছে। লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করতো, হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর উক্তিকে আমরা কিসের মাধ্যমে খ-ন করবো? তিনি বলেছিলেন, নবী করীম (ﷺ) এর বাণী দ্বারা, তিনি বলেছেন, ‘আমি আমার প্রভুকে দেখেছি।’ নবী করীম (ﷺ) এর বাণী হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর উক্তি থেকে উচ্চে। 


নাক্কশ ইমাম আহমদ (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন, লোকেরা যখন ইমাম আহমদ (رحمة الله) কে কথিত প্রশ্ন করেছিলো, তখন তিনি বলেছিলেন,আমি হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর হাদীছ দ্বারা জওয়াব দেবো। হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) শেষ নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়া পর্যন্ত বলে গিয়েছেন, তিনি তাঁকে দেখেছেন। একদা কিছু লোক হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) কে জিজ্ঞেস করলো, রসুলেপাক (ﷺ) কি আল্লাহ্তায়ালাকে দেখেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এ ব্যাপারে সলফে সালেহীনের একটি জামাত মৌনতা অবলম্বন করেছেন। তাঁরা বলেছেন, হ্যাঁ বা না কোনোটাই আমরা জোর দিয়ে বলবো না। কুরতুবীও এই মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কোনো পক্ষেরই সর্ববাদীসম্মত দলীল নেই। তাঁদের দলীলগুলো পরস্পরবিরোধী। সমন্বয় করার মতো নয়। ব্যাপারটি কোনো আমল সংক্রান্তও নয় যে, দলীলে যন্নীকে যথেষ্ট বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। মাসআলাটি আকীদা বিষয়ক। এক্ষেত্রে অকাট্য দলীলের উপর তাকে প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে। ওয়াল্লাহু আ’লাম।


এ ব্যাপারে একটি সম্প্রদায়ের মত এই— আল্লাহর দীদার অন্তরের চোখে হয়েছে। চর্মচোখে নয়। অন্তরচোখের দর্শন বলতে ‘কেবল উপলব্ধি বা অনুভবজাত জ্ঞান’ মনে করা যাবে না। কেনোনা এরকম জ্ঞান তো তাঁর সর্বদাই ছিলো। বরং কথাটির তাৎপর্য এই যে, হক তায়ালা রুইয়াত বা দর্শনকে নবী করীম (ﷺ) এর অন্তরে সৃষ্টি করেছিলেন। যেমন চোখে সৃষ্টি করেছেন দৃষ্টি। কাজেই অন্তরের জানা এক জিনিস, আর দেখা আরেক জিনিস। এ সম্প্রদায়টি হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) ও হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর বিপরীত বিবরণদ্বয়ের এমনভাবে সমাধান টেনেছেন যে, মতানৈক্য আর থাকে না। 


বান্দা মিসকীন (শায়েখ মুহাক্কেক আবদুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী) বলেন, দালায়েল, আখবার ও আছারসমূহে দৃষ্টিপাত করার পরে উলামা কেরামের উপরে বর্ণিত মতটিই সাব্যস্ত হয়েছে। একটি সন্দেহ তবু থেকেই যায় যে, মেরাজ যা নবী করীম (ﷺ) এর সবচেয়ে পরিপূর্ণ মাকাম ও চূড়ান্ত কামালাত, যাতে অন্য কোনো নবী অংশীদার নন। আর এ মাকামের অংশ পাওয়ার সুযোগও কারো নেই। মানুষের জন্যও নেই, ফেরেশতার জন্যও নেই। তাজ্জবের ব্যাপার, হাবীব পাক (ﷺ)কে নির্জনে নিয়ে যাওয়া হলো, নিকটে নেয়া হলো। কিন্তু মূল ব্যাপার হচ্ছে দীদার, আর সেই দীদার দিয়ে তাঁকে ধন্য করা হবে না, অথবা রসুলেপাক (ﷺ) দীদার না পেয়ে সন্তুষ্ট হবেন, এ কেমন কথা? যদিও বন্দেগীর পূর্ণতা এবং আল্লাহ্তায়ালার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমার পরিপ্রেক্ষিতে যাচ্ঞা না করাই আদব। আলাপনের আস্বাদে মত্ত হয়ে উল্লাস প্রকাশ করা এবং দীদারের বাসনা করা, যেমন মুসা (عليه السلام) করেছিলেন। কিন্তু কামালে মহব্বত ও মাহবুবিয়াতের ক্ষেত্রে কী এমন বাধা থাকা সম্ভব যে, মধ্যখানে যবনিকা অবস্থান করবেই? এ দৌলত তো প্রয়াসসাধ্য নয়। এটা মহব্বতের দৌলত। উলামা কেরাম বলেন, হজরত মুসা (عليه السلام) এর প্রচেষ্টা ও প্রার্থনাই দীদারে এলাহীর অন্তরায় ছিলো। কেনোনা এমনও হয়, কখনও না চাইলেও দেয়া হয়। আবার চাইলেও দেয়া হয় না। এ ব্যাপারে একটি অদ্ভূত কথা এই যে, হজরত মুসা (عليه السلام) আল্লাহ্তায়ালার দীদার চেয়েও পাননি। 


তিনি বেঁহুশ হয়ে পড়েছিলেন। আর সেই সময় তিনি তাজাল্লী দেখেছেন যা দেখা সম্ভব ছিলো না। এই দান তিনি তাড়াহুড়া ও অস্থিরতার কারণেই পেয়েছিলেন। হজরত মুসা (عليه السلام) এর এ দীদার না পাওয়ার প্রকৃত কারণ ছিলো এই যে, তখনও সাইয়েদুল মাহবুবীন (ﷺ) দীদার পাননি। উলামা কেরামের এ ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে যে, দুনিয়াতে আল্লাহর দীদার সম্ভব নয়। কিন্তু মেরাজ প্রকৃতপক্ষে আখেরাতের অন্তর্ভূত। দুনিয়ার নয়। আখেরাতে নবী করীম (ﷺ) যা দর্শন করবেন এবং পাবেন তা আগেই দেখে নিলেন এবং দীদার লাভ করলেন। আর প্রত্যক্ষ দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি উম্মতদেরকে আহ্বান করবেন, এটাই সমীচীন।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 




© | সেনানী এপ্স |

Top