মহানবী (ﷺ) এর দরবারে উচ্চ আওয়াজের নিষিদ্ধতা


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বসমূহের মধ্যে অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে, তাঁর হাদীছ পাঠকালে গোসল করা এবং সুগন্ধি ব্যবহার করা মোস্তাহাব। রসুলে করীম (ﷺ) এর হাদীছ শরীফ পাঠের সময় আওয়াজ সংযত করা উচিত। যেমন তাঁর জীবদ্দশায় তিনি যখন কথা বলতেন, তখন অন্যান্যদের আওয়াজকে নীচু করা হতো। এমর্মে আল্লাহ্তায়ালার এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ইমানদারগণ! নবীর আওয়াজের উপর তোমাদের আওয়াজকে উচ্চ করো না। হাদীছ শরীফ তো নবী করীম (ﷺ) এরই কালাম, যা বর্ণনার মাধ্যমে আমাদের কাছে পেশ করা হয়েছে। এই হাদীছের সম্মান ও উচ্চ মর্যাদা তাঁর আপন যবান মোবারক থেকে নিঃসৃত শব্দের মতই। আর হাদীছ পাঠ করার সময় কোনো উঁচু জায়গায় রেখে পাঠ করা অপরিহার্য। হজরত মুতরিক (رحمة الله) থেকে বর্ণিত আছে, কেউ ইমাম মালেক (رحمة الله) এর সাক্ষাৎ কামনা করলে তিনি প্রথমে বাঁদীকে পাঠিয়ে দিয়ে জেনে নিতেন, তারা কি কোনো 

হাদীছ শুনতে এসেছে? নাকি শরীয়তের কোনো মাসআলা জানার জন্য এসেছে? লোকেরা যদি মাসআলা জানার জন্য এসেছে বলতো, তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসতেন এবং তাদেরকে মাসআলা মাসায়েলের তালিম দিতেন। 


অন্য এক বর্ণনায় আছে, তিনি ভিতর থেকেই মাসআলার জবাব দিতেন। আর যদি লোকেরা বলতো, তারা হাদীছ শরীফ শোনার জন্য এসেছে, তখন তিনি গোসলখানায় যেতেন এবং গোসল করে শাদা পোশাক পরতেন, পাগড়ি বাঁধতেন, চাদর গায়ে দিতেন, খোশবু লাগাতেন। কুরসী প্রস্তুত করা হতো। এরপর তিনি বাইরে এসে কুরসীতে উপবেশন করতেন। আউদ ও আম্বরের আগরবাতি জ্বালানো হতো। এরপর অত্যন্ত বিনয় ও তাযীমের সাথে তিনি হাদীছ শরীফ বর্ণনা করতেন। হাদীছের পাঠদান ছাড়া অন্য কোনো সময় তিনি কুরসীতে উপবেশন করতেন না। উলামা কেরাম বলেন, ইমাম মালেক (رحمة الله) এই পদ্ধতি হজরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (رضي الله عنه) থেকে গ্রহণ করেছিলেন। হজরত কাতাদা ও ইমাম মালেক (رحمة الله) প্রমুখ হজরতগণের এক জামাত বেঅজু অবস্থায় হাদীছ পাঠ করাকে মাকরুহ মনে করতেন। হজরত আ’মাশ (رضي الله عنه) এর তো এরূপ অভ্যাস ছিলো যে, তিনি যখন বেঅজু হয়ে যেতেন, সঙ্গে সঙ্গে তায়াম্মুম করে নিতেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই, রসুলে আকরম (ﷺ) এর আলোচনা, তাঁর হাদীছ শরীফ পঠন পাঠন, তাঁর পবিত্র নামের ও পূতঃ জীবনচরিতের আলোচনা করা ও শোনার সময় ওই রকমই তাযীম সম্মান করা জরুরী, যেরকম তাঁর ইহকালীন জীবনে তাঁর উপস্থিতিতে করা জরুরী ছিলো। হাদীছ শরীফ পাঠকালে কোনো ব্যক্তির আগমনে তার সম্মানার্থে দ-ায়মান হওয়া উচিত নয়। কেননা এতে রসুলেপাক (ﷺ) এর চাইতে অন্যের সম্মানকে প্রাধান্য দেয়া হয় এবং অন্যের প্রতি মনোনিবেশ করার ফলে হাদীছ শরীফের মাধ্যমে নবী করীম (ﷺ) এর ফয়েজ প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে কোনো ফাসেক ফাজের ও বেদাতীর সম্মানে দ-ায়মান হওয়া কক্ষণো সমীচীন নয়। সলফে সালেহীনের তো এরকম নীতি ছিলো যে, নবী করীম (ﷺ) এর হাদীছের সম্মানার্থে হাদীছ অধ্যয়নের ধারাকে তাঁরা ছিন্ন করতেন না। নড়াচড়াও করতেন না, দেহের উপর সাংঘাতিক কোনো বিপদ ও ক্ষতি নেমে এলেও। কথিত আছে, একবার হাদীছ শরীফ অধ্যয়নকালে ইমাম মালেক (رحمة الله) এর শরীরে একটি বিচ্ছু এসে সতেরোটি দংশন করেছিলো। তবুও তিনি পার্শ্ব পরিবর্তন করেননি। তিনি কায়মনোবাক্যে অধ্যয়নেই রত ছিলেন। হাদীছতো নবী করীম (ﷺ) এর। তাই তাঁর সম্মানার্থে সেই হাদীছের পাঠ বন্ধ করেননি। এই ঘটনাটি ইবনুল হাজ্জ আলমাদ খাল নামক কিতাবে বর্ণনা করেছেন। 


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, এক মুহূর্তের দর্শন পেলে অথবা মোবারক মজলিশে উপবেশন করলে তাঁর জন্য সাহাবিয়াত সাব্যস্ত হবে। মুহূর্তের সাহচর্যে বা দর্শনে সাহাবীর গৌরব লাভ রসুলেপাক (ﷺ) এর বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভূত। সাধারণতঃ দীর্ঘকাল কারও সাহচর্যে অবস্থান করাকে সোহবত বা মোসাহেবাত ধরা হয়ে থাকে। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে এক মুহূর্ত বা একটি দৃষ্টিপাতই যথেষ্ট। বিশুদ্ধ ও পছন্দনীয় মত অনুসারে এরকম ব্যক্তিকেই সাহাবী বলা হয়। 


উলামা কেরাম এধরনের বৈশিষ্ট্যের অনেক আলোচনা করেছেন, যা নবী করীম (ﷺ) সহ অন্যান্য আম্বিয়া কেরামের মধ্যে ছিলো। যেমন নিদ্রায় অজুভঙ্গ না হওয়া, শয়তান নবীর আকৃতি ধারণ করতে অক্ষম হওয়া, হাই না আসা ইত্যাদি। তবে নবী করীম (ﷺ) এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এই যে, কেউ একবার তাঁর সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে এবং সাহচর্যে এলে সেই ব্যক্তির নূরানিয়াত ও কামালিয়াত হাসেল হয়ে যেতো। ওই গুণাবলী তার মধ্যে প্রকাশিত হতো। যেমন বলা হয়ে থাকে, নবী করীম (ﷺ) এর একটি দৃষ্টিপাতের প্রভাবে মূর্খ ও নির্বোধ জ্ঞানী হয়ে যেতো এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা বলা শুরু করতো। কুওয়াতুল কুলুব নামক কিতাবে আছে, হজরত সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) এর জামাল মোবারকের উপর একবার দৃষ্টি পড়লে এমন কাশফ জারী হতো, যা বহুবার মোরাকাবা করেও হাসিল হয় না। এটা রসুলেপাক (ﷺ) এর একটি স্বতন্ত্র মোজেজা, যা কেবল তাঁরই বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো নবী এর অংশ পাননি। 


মহানবী (ﷺ) এর আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, তাঁর সাহাবীগণ সকলেই আদেল বা ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। তাঁদের ন্যায়পরায়ণতার প্রশংসা কিতাবুল্লাহ্ ও হাদীছ শরীফে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের আদালতের ব্যাপারে কারও কোনো কটুক্তি নেই। হাদীছের সনদে রাবী বা বর্ণনাকারীর সংখ্যা একজনে এসে দাঁড়ালে ওই মোহাদ্দেছকে মুনফারেদ বা গরীব বলা হয়। কিন্তু সাহাবীর ক্ষেত্রে এরকম হলে উক্ত হাদীছকে মুনফারেদ বা গরীব বলা হয় না। সকল সাহাবী আদেল বা ন্যায়নিষ্ঠ এ ব্যাপারে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের ঐকমত্য রয়েছে, যদিও তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ফেতনা ও রাজনৈতিক বিশৃংখলার শিকার হয়েছিলেন। আহলে সুন্নত ওয়াল জামআত তাঁদের সম্পর্কে সুধারণা পোষণপূর্বক বলে থাকেন, তাঁদের সময় সৃষ্ট রাজনৈতিক বিশৃংখলাগুলো এজতেহাদী ভুল হিসেবে সংঘটিত হয়েছিলো। তাঁদের ফযীলত ও কামালত সম্পর্কে সন্দেহের সূত্রপাত হতেই পারে না। কেননা তাঁরা রসুলেপাক (ﷺ) এর আদেশ নিষেধ পালনের ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। চূড়ান্ত নিষ্ঠার সাথে তাঁরা আদেশ বাস্তবায়ন করতে যতœবান হতেন। তাঁরা সর্বদাই রসুলেপাক (ﷺ) এর সংসর্গে কালাতিপাত করতেন। বিভিন্ন যুদ্ধে নবীকরীম (ﷺ) এর সঙ্গী হতেন। বিভিন্ন এলাকা, রাজ্য ও অঞ্চল বিজয়ে অংশগ্রহণ করতেন। হেদায়েতের কার্যে আত্মনিয়োগ করতেন। নামাজ, রোজা ও যাকাত ইত্যাদি ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তাঁদের মতো বীরত্ব, সাহসিকতা, দানশীলতা ও প্রশংসনীয় গুণাবলী পূর্ববতী কোনো উম্মতের মধ্যে পাওয়া যায় না। জমহুর উলামার মাযহাব এই যে, সাহাবা কেরাম (رضي الله عنه) সকলেই উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং মিল্লাতের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত। তাঁদের পরবর্তীরা তাঁদের মতো মাকাম ও মর্তবা লাভ করতে পারে না। কোনো কোনো আলেম, যেমন প্রখ্যাত মোহাদ্দেছ হজরত ইবনে আব্দুল্লাহ্ ও তাঁর মতো আরও অনেকে এরকম মন্তব্য পেশ করেছেন যে, একালে এ সমাজে এমন কে হতে পারেন, যিনি সাহাবীগণের পর তাঁদের মতো? এলেম ও আমলের ফযীলতের দিক দিয়ে তাঁদের মতো মর্যাদাবান কে? কোনো সাহাবী কখনও কবীরা গোনাহ্ করে ফেললেও তার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না। কবীরা গোনাহ্র জন্য তাঁদের উপর শরীয়তের হদও কায়েম করা হয়েছিলো। আল্লাহ্তায়ালা তাঁদেরকে মাফ করে দিয়েছেন। ইবনে আব্দুল্লাহ্ ওই সকল হাদীছের মাধ্যমে দলীল গ্রহণ করেছেন, যা আখেরী উম্মতের ফযীলত বা মর্যাদার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছে। কোনো কোনো মোহাদ্দেছ অবশ্য বলে থাকেন, সাহাবা কেরামের মর্যাদা প্রযোজ্য হবে তাঁদের বেলায়, যাঁরা দীর্ঘকাল ধরে নবী করীম (ﷺ) এর সংসর্গে ছিলেন এবং বহুবিধ ফয়েজ লাভ করে উপকৃত হয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে প্রথম মতটিই সর্বাধিক পছন্দনীয়। সবচাইতে সত্য ও বড় কথা, তাঁরা নবী করীম (ﷺ) এর দর্শন লাভ করেছিলেন। প্রত্যক্ষ ইমান দ্বারা ধন্য হয়েছিলেন। এই মর্যাদা কেবল তাঁদের জন্যই নির্ধারিত। অন্য কেউ এরকম ফযীলতের অধিকারী হতে পারেন না। আখেরী উম্মেতের ফযীলত সম্পর্কিত হাদীছের প্রেক্ষিত অবশ্য ভিন্ন। সাহাবা কেরামের ইমান ছিলো ইমান বিল গয়িব। যা ‘ইউমিনুনা বিল গয়িব’ আয়াতে কারীমার তাফসীরের ক্ষেত্রে মুফাস্সিরগণ বর্ণনা করেছেন। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 



নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, মুসল্লী নামাজ আদায়কালে তাশাহ্হুদের মধ্যে অথবা নামাজের বাইরে দরূদ ও সালাম পেশ করার সময় নবী করীম (ﷺ) কে ‘আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবিয়্যু’ বলে। তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে এভাবে সম্বোধন করা হয় না। সম্বোধন দ্বারা রসুলেপাক (ﷺ) ছাড়া অন্য কারও উপর সালাম প্রেরণ করা যদি উদ্দেশ্য না হয়, তাহলে তা হবে হজরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছের অনুরূপ। ওই হাদীছে তিনি বলেছেন, আমরা রসুলেপাক (ﷺ) এর সঙ্গে নামাজ আদায়কালে বলতাম, আস্লালামু আলাল্লাহ্ আস্সালামু আলা জিব্রাইল, আসসালামু আলা মিকাইল। আসসালামু আলা অমুক ইত্যাদি। রসুলেপাক (ﷺ) নামাজ থেকে ফারেগ হয়ে আমাদের দিকে ফিরে বললেন ‘তোমরা আস্সালামু আলাল্লাহ্ বোলো না। কেননা আল্লাহ্তায়ালাতো নিজেই সালাম। অর্থাৎ যাবতীয় ত্রুটি ও ভীতি থেকে তিনি তো সালেম বা নিরাপদ এবং সুরক্ষিত। বান্দাকে ত্রুটি ও ভীতি থেকে নিরাপত্তা দান করেন তিনিই। কাজেই ভয় ও মুখাপেক্ষিতার ধারণা সৃষ্টি করে এমন সালাম তাঁর উপর পেশ করা অর্থহীন। এখন থেকে নামাজের বৈঠকে বসলে পাঠ করবে ‘আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস্সলাওয়াতু ওয়াত্তইয়িবাত। আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান্নাবিয়ু ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু। আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস্ সলিহীন।’ বান্দা এই তাশাহহুদ শরীফ পাঠ করলে আল্লাহ্তায়ালা সালামতী দান করবেন। আল হাদীছ।


সুতারং দেখা যায় বিশেষত্বের সাথে রসুলেপাক (ﷺ) কে সালাম প্রদান করাই প্রকৃত কথা। অন্যান্যদেরকে সাধারণ পর্যায়ে রাখা হয়েছে। আত্তাহিয়্যাতোর মধ্যে আস্সালামু আলাইকা বলে নবী করীম (ﷺ) কে সম্বোধন করা হয়েছে। অথচ দৃশ্যতঃ তিনি অনুপস্থিত। এটাও তাঁর একটা বিশেষত্ব। এর কারণও রয়েছে। উলামা কেরাম বলেন, মেরাজ রজনীতে আল্লাহ্ রব্বুল ইয্যত তাঁর হাবীব (ﷺ) কে এভাবেই সম্বোধন করেছিলেন। এরপর আল্লাহ্তায়ালার উক্ত কালামটিকে হুবহু রেখে দেয়া হয়েছে। বোখারীর শরাহ কেরমানীতে বলা হয়েছে নবী করীম (ﷺ) এর অন্তরাল গ্রহণের পর সাহাবাগণ আসসালামু আলান্নাবিয়্যি বলতেন। আসসালামু আলাইকা বলতেন না। 


কোনো কোনো আরেফ বলেছেন, আত্তাহিয়্যাতোর মধ্যে রসুলেপাক (ﷺ) কে সম্বোধন করা হয় তাঁর রূহ মোবারকের মুশাহাদার (দর্শনের) পরিপ্রেক্ষিতে। সমস্তবিদ্যমান বস্তুর মধ্যে বিশেষ করে নামাজী ব্যক্তির আত্মার মধ্যে তাঁর পবিত্র রূহের সূক্ষ্মসত্তাসমূহ উদ্ভাসিত হয়। নামাজের সময় রসুলে আকরম (ﷺ) এর শুহুদ (আত্মিক দর্শন) এবং ওজুদের উদ্ভাসন থেকে বেখবর হওয়া উচিত নয়। রসুলেপাক (ﷺ) এর রূহানী ফয়ুজাত কামনা করা উচিত। 


রসুলেপাক (ﷺ) এর আরো একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি কাউকে আহ্বান করলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ডাকে সাড়া দেয়া এবং তথায় উপস্থিত হয়ে যাওয়া ওয়াজিব হয়ে যাবে। নামাজরত থাকলেও নামাজ ছেড়ে হাজির হতে হবে। হজরত সাঈদ ইবনে মুআল্লা (رضي الله عنه) এর হাদীছ তিনি বর্ণনা করেছেন, আমি একদা নামাজে রত ছিলাম। এমতাবস্থায় রসুলেপাক (ﷺ) আমাকে ডাকলেন। আমি উত্তর করিনি। নামাজান্তেরসুলেপাক (ﷺ) এর দরবারে যেয়ে নিবেদন করলাম, ইয়া রসুলাল্লাহ্! আমি নামাজে ছিলাম, জবাব দিতে পারিনি। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, আল্লাহ্তায়ালা কি এরশাদ করেননি, ‘তোমরা আল্লাহ্ ও রসুলের ডাকে সাড়া দাও, যখন তাঁরা তোমাদিগকে উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে আহ্বান করবেন।’ কাজেই রসুলেপাক (ﷺ) এর ডাকে সাড়া দেয়া ওয়াজিব এবং এরকম না করলে গোনাহ্গার হতে হবে। প্রশ্ন জাগে নামাজরত অবস্থায় নবী করীম (ﷺ) এর ডাকে সাড়া দিয়ে সেখানে উপস্থিত হলে নামাজ বাতিল হবে কিনা? এ সম্পর্কে মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ার গ্রন্থকার বলেন, শাফেয়ী মতাবলম্বী আলেমসহ আরও কতিপয় আলেম এ সম্পর্কে মত পোষণ করেন, এতে নামাজ নষ্ট হবে না। কিন্তু কোনো কোনো আলেমের মতে নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্য উক্ত হাদীছের মাধ্যমে এ সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু বুঝা যায় না। ওয়াল্লাহু আ’লাম।


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, তাঁর উপর মিথ্যা অপবাদ আনয়ন করা অন্যের উপর অপবাদ আরোপ করার চেয়ে জঘন্যতর। রসুলে আকরম (ﷺ) এর উপর মিথ্যা অপবাদ উপস্থাপনকারীর বর্ণনা কক্ষণো গ্রহণ করা হয় না। মিথ্যারোপ করা থেকে সে ব্যক্তি যদি তওবা করে, তবুও তার বিবরণ গ্রহণ করা যাবে না বলে একদল হাদীছবেত্তা মত পোষণ করেছেন। হজরত সাঈদ ইবনে জুবায়র (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রসুলেপাক (ﷺ) এর নামে মিথ্যা রটনা করেছিলো। রসুলেপাক (ﷺ) হজরত আলী (رضي الله عنه) ও হজরত যোবায়ের (رضي الله عنه) কে নির্দেশ দিলেন, যাও, ওকে পেলে হত্যা করো। শায়েখ মোহাম্মদ জুওয়ায়নী যিনি ইমামুল হারামাইনের পিতা ছিলেন তাঁর মত হচ্ছে, রসুলে আকরম (ﷺ) এর উপর মিথ্যা আরোপকারী কাফের। কিন্তু আয়েম্মায়ে কেরাম তাঁর এই মতের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেননি। তবে এ ব্যাপারে সঠিক কথা এই যে, রসুলেপাক (ﷺ) এর উপর মিথ্যা আরোপ করা জঘন্য অপরাধ এবং কবীরা গোনাহ্। তবে এতে কাফের হবে না, যদি সে এ কাজকে হালাল হিসেবে মনে না করে। এরপর যদি ওই অপরাধী বিশুদ্ধ তওবা করে এবং তার তওবার প্রতিক্রিয়া বাস্তব জীবনে পরিলক্ষিত হয়, তবে তার কথা গ্রহণযোগ্য হবে। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, তিনি সগীরা, কবীরা, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত সর্বপ্রকার গোনাহ্ থেকে পবিত্র ছিলেন। এটাই পছন্দনীয় মাযহাব। তিনি ছাড়া অন্যান্য আম্বিয়া কেরামের পবিত্রতার ব্যাপারেও এই একই মত। এর বিস্তারিত আলোচনা এলমে কালামের কিতাবাদিতে আছে। তাঁর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, পাগল, মাতাল ও দীর্ঘস্থায়ী বেহুঁশীর সম্পর্ক তাঁর শানে আরোপ করা যাবে না। কেনোনা এগুলোও দোষত্র“টির অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য আম্বিয়া কেরামের শানেও এগুলো আরোপ করা যাবে না। আল্লামা সুবকী (رحمة الله) বলেছেন, আম্বিয়া কেরামের বেহুঁশী অন্যান্যদের বেহুঁশী থেকে ভিন্ন। তাঁদের ব্যথা যন্ত্রণার প্রাবল্য তাঁদের জাহেরী অনুভূতির উপর প্রতিফলিত হয়ে থাকে। অন্তর থাকে প্রভাবহীন। এ মর্মেই হাদীছ শরীফে উক্ত হয়েছে, আমার নেত্রদ্বয় নিদ্রিত হয়। হৃদয় নয়। হৃদয়কে নিদ্রা থেকে হেফাজত রাখা হয়েছে, যা বেহুঁশীর তুলনায় অনেক শক্তিশালী। সুতরাং বেহুঁশী দ্বারা আক্রান্ত না হওয়াটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। আল্লামা সুবকী (رحمة الله) আরও বলেন, আম্বিয়া কেরামের জন্য দৃষ্টিহীনতা বৈধ নয়। কেনোনা এটাও একটি ত্র“টি। পৃথিবীতে এমন কোনো নবীই আগমন করেননি, যিনি অন্ধ ছিলেন। তবে হজরত শুআইব (عليه السلام) এর অন্ধত্ব সম্পর্কে যা শোনা যায়, তা কিন্তু প্রমাণিত নয়। আর হজরত ইয়াকুব (عليه السلام) এর অন্ধত্বের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, তিনি তো মূলত অন্ধ ছিলেন না। পুত্রশোকে রোদন করতে করতে পবিত্র চোখের উপর ছানি পড়ে গিয়েছিলো, যা তাঁর দৃষ্টিকে সাময়িক আচ্ছাদিত করেছিলো। ‘তাঁর চোখ দুটি চিন্তার কারণে শাদা হয়ে গিয়েছিলো’- এই আয়াতে কারীমার তাফসীরের সঙ্গে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (رحمة الله) বলেন, মাতম ও বিলাপের প্রাবল্যের সময় তাঁর চোখ দিয়ে অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হতো। অত্যধিক পানি প্রবাহের কারণে মনে হতো যেনো চক্ষুদ্বয় শুভ্র হয়ে গিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ওই শুভ্রতা পানির কারণেই পরিলক্ষিত হতো। এটি উপরোক্ত মতের বিশুদ্ধতার দলীল। কেনোনা, ক্রন্দনের প্রাবল্যের মধ্যে চিন্তা এসে অন্ধত্বকে অধিক ক্রিয়াশীল করে তোলে। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (رحمة الله) বলেন, তিনি সার্বিকভাবে দৃষ্টিহীন হয়ে গিয়েছিলেন কিনা, এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মতানৈক্য রয়েছে। পরবর্তী ঘটনা এরকম, আল্লাহ্তায়ালা হজরত ইউসুফ (عليه السلام) এর পবিত্র জামা তাঁর মস্তকে স্থাপনের পর তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরে এসেছিলো। কেউ কেউ বলেন, তিনি অন্ধ হয়েছিলেন একথা ঠিক নয়। অত্যধিক ক্রন্দন ও দুশ্চিন্তার কারণে দৃষ্টিশক্তিতে দুর্বলতা এসেছিলো এবং এই দুর্বলতাকেই তিনি দৃষ্টিহীনতা মনে করতেন। এরপর যখন হজরত ইউসুফ (عليه السلام) এর জামা তাঁর চেহারায় স্থাপন করা হয়েছিলো, তখন দৃষ্টিশক্তিতে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছিলো। আল্লামা সুবকী (رحمة الله) আম্বিয়া কেরামের মধ্যে অন্ধত্ব জায়েয না হওয়ার কারণ এই বলেছেন যে, এটা দোষ এবং ত্রুটি। আম্বিয়া কেরামের এমন রোগে আক্রান্ত হওয়া যা দোষ ও ত্রুটির কারণ, তার দ্বারা তাঁদের নবুওয়াতও ত্রুটিযুক্ত মনে হওয়া সম্ভব। যেমন হজরত আইয়্যুব (عليه السلام) এর উপর পরীক্ষাস্বরূপ অসুস্থতা আপতিত হয়েছিলো। এ জাতীয় অন্যান্য অসুখ, যেমন কুষ্ঠরোগ, শ্বেতী, অন্ধত্ব ইত্যাদির সঙ্গে কোনো নবীর সম্পর্ক রাখা জায়েয নয়। এগুলো নবুওয়াতের শানের পরিপন্থী। এগুলো ঘৃণার উদ্রেক করতে পারে অথচ আম্বিয়া কেরাম এ সমূহ থেকে পবিত্র। হজরত শুআয়েব (عليه السلام) অন্ধ হয়েছিলেন বলে কিস্সা আছে। কিন্তু ওই কিস্সা দলীল প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত হয়নি। কাজেই এজাতীয় কথা দ্বারা তাঁর শানের প্রতি কেবল বিদ্রুপ এবং ধৃষ্টতাই প্রদর্শন করা হয়। অবশ্য হজরত ইয়াকুব (عليه السلام) এর দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার ঘটনা সঠিক। কেনোনা, আল্লাহ্তায়ালা এ মর্মে নিজেই ঘোষণা করেছেন, ‘সুতরাং তাঁর দৃষ্টি ফিরে এলো।’ হজরত মুকাতিল বারী বর্ণনা করেছেন, হজরত ইয়াকুব (عليه السلام) ছ’মাস দেখতে পাননি। পরবর্তীতে হজরত ইউসুফ (عليه السلام) এর জামা মোবারকের ওসীলায় দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছিলেন। একটি কথা প্রচলিত আছে, কোনো নবীই বোবা ছিলেন না, তবে হয়তো কেউ সাময়িক অন্ধ ছিলেন। 


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, তাঁর নিন্দাকারীকে হত্যা করা ওয়াজিব। এতে সকল ইমামের ঐকমত্য রয়েছে। মতানৈক্যের দিকগুলো হচ্ছে, হত্যা কি হদ হিসেবে করা হবে? সঙ্গে সঙ্গে করতে হবে? নাকি তওবা করার সুযোগ দেয়া হবে? সে কি মুরতাদ? এ সমস্ত ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। কিন্তু কতল করার ব্যাপারে মতানৈক্য নেই।


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, বিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব এখতিয়ার রয়েছে। তিনি যা নির্ধারণ করতে চাইতেন, সেটাই বিধানে রূপলাভ করতো। এ ব্যাপারে দু’টি বক্তব্য রয়েছে। তন্মধ্যে একটি এই যে, রসুলেপাক (ﷺ) এর কাছে আহকাম সোপর্দ করা হতো। তিনি যা ভালো মনে করতেন, সে সম্পর্কেই বিধান আরোপ করতেন। দ্বিতীয় বক্তব্যটি হচ্ছে, আহকামের ব্যাপারে আলাদা ওহী নাযিল হতো। সুতরাং দেখা যায়, হজরত খুযায়মা ইবনে ছাবেত (رضي الله عنه) এর ব্যাপারে হুকুম দেয়া হলো, তাঁর একার সাক্ষ্যই দুজনের সাক্ষ্যের সমতুল্য হবে। 


ঘটনাটি হচ্ছে, একদা রসুলেপাক (ﷺ) এক বেদুইনের নিকট থেকে একটি ঘোড়া ক্রয় করেছিলেন। পরে ওই বেদুইন একথা অস্বীকার করে বসলো। বললো, আপনি সাক্ষী উপস্থিত করুন। মুসলমানেরা বেদুইনকে বললো, আল্লাহর নবী সত্য বলেছেন। বেদুইন কারও কথা মানলো না। এমতাবস্থায় হজরত খুযায়মা (رضي الله عنه) উপস্থিত হয়ে বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমি ঘোড়া বিক্রি করেছো। রসুলে আকরম (ﷺ) বললেন, তুমি কেমন করে সাক্ষ্য দিচ্ছো, আমিতো তোমাকে সাক্ষী নিযুক্ত করিনি। হজরত খুযায়মা (رضي الله عنه) বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ্! আমরা আপনার সকল কথা বিশ্বাস করি, আর এই বেদুইনের ব্যাপারে আপনাকে অবিশ্বাস করবো? এই ঘটনার পরপ্রেক্ষিতে রসুলে করীম (ﷺ) হজরত খুযায়মার একার সাক্ষ্যকে দু’জনের সাক্ষ্যের সমতুল্য সাব্যস্ত করলেন। আর এহেন ফযীলত লাভের ব্যাপারে তিনি হজরত খুযায়মাকে বিশিষ্ট করে দিলেন। 


খাত্তাবী বলেন, এই হাদীছটিকে অনেকে অস্থানে ব্যবহার করে থাকে। আর বেদাতীদের একটি দলতো এই হাদীছের দৃষ্টিকোণ থেকে মনে করে থাকে, কোনো একজন চেনা জানা লোককে সাক্ষী বানালেই চলবে। কথাটির তাৎপর্য এই যে, তাদের মতে, ওই ব্যক্তি চেনা জানা সেই সাক্ষীর ব্যাপারে কিছু দাবি করবে, আর তার দাবি গৃহীত হবে। অথচ হাদীছ শরীফের ওরুদের কারণ হচ্ছে, রসুলেপাক (ﷺ)। বেদুইনটির এলেম মোতাবেক তার উপর বিধান প্রয়োগ করার জন্য এখানে নবী করীম (ﷺ) হজরত খুযায়মার সাক্ষ্যকে নিজের কথার পক্ষে জোর প্রদানার্থে এবং প্রতিপক্ষের উপর প্রাবল্য অর্জনের উদ্দেশ্যে এনেছেন। তাই হজরত খুযায়মা (رضي الله عنه) দুই সাক্ষীর সমমর্যাদার অধিকারী হয়েছেন। হজরত উম্মে আতিয়া (رضي الله عنه) যিনি মর্যাদাশীলা মহিলা সাহাবীগণের অন্যতমা ছিলেন, তাঁর ব্যাপারেও রসুলেপাক (ﷺ) স্বতন্ত্র বিধান দিয়েছেন। 


নবী করীম (ﷺ) পুরুষগণের বায়াত সম্পাদনান্তে যখন মহিলাদের বায়াত গ্রহণ করছিলেন, তখন তাঁদেরকে লক্ষ্য করে আল্লাহর বাণী ‘নারীরা যেনো ভালো কাজে আপনার নাফরমানী না করে’ বলা হলো। নবী করীম (ﷺ) বিভিন্ন ভালো কাজ বাস্তবায়ন ও মন্দ কাজ পরিহার সম্পর্কে তাঁদেরকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করলেন। তাঁদের একটি মন্দ কাজ ছিলো, বিলাপ করা। নবী করীম (ﷺ) অঙ্গীকার আদায় করলেন, নারীরা কারও মৃত্যুতে যেনো বিলাপ না করে। তখন হজরত উম্মে আতিয়া (رضي الله عنه) নিবেদন করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ্! অমুক জনপদের লোক জাহেলী যুগে বিলাপ করার ব্যাপারে আমার সহযোগী হতো। এখন এ কাজে তাদের অনুসরণ না করে যে আমি পারছি না। রসুলেপাক (ﷺ) একথা শুনে হজরত উম্মে আতিয়া (رضي الله عنه) কে উক্ত কবীলার খাতিরে বিলাপ করার ব্যাপারে অনুমতি দিলেন।

 

ইমাম নববী (رحمة الله) বলেন, উম্মে আতিয়া (رضي الله عنه) কে বিলাপ করার অনুমতি প্রদানে প্রমাণিত হয় যে, তিনি (ﷺ) যার ব্যাপারে যা চাইতেন, তা নির্ধারণ করে দেয়ার ক্ষমতা তিনি আল্লাহ্পাকের তরফ থেকেই পেয়েছিলেন। হজরত আসমা বিনতে উমায়স (رضي الله عنه)কেও শোক পালন করার ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী ছিলেন হজরত জা’ফর ইবনে আবী তালেব (رضي الله عنه)। তিনি ইনতেকাল করলে, নবী করীম (ﷺ) হজরত আসমা বিনতে উমায়স (رضي الله عنه)কে বললেন, তুমি তিন দিন পর্যন্তমাতমী লেবাস পরিধান করো এবং শোক যাপন করো। এরপর তোমার যা অভিপ্রায়। 


হজরত আবু বুরদা ইবনে নিয়ায (رضي الله عنه) এর কোরবানীর ক্ষেত্রেও নবী করীম (ﷺ) স্বাধীন হুকুম দিয়েছিলেন। বকরীর বয়স এক বৎসর পুরা না হওয়া পর্যন্ত কোরবানী করা বৈধ নয়। কিন্তু নবী করীম হজরত আবু বুরদা ইবনে নিয়ায (رضي الله عنه) এর জন্য বৈধ করে দিয়েছিলেন। ঘটনাটি হচ্ছে, তিনি (ﷺ) একদিন বললেন, ঈদের নামাজের আগে কোরবানী করলে কোরবানী হবে না। একথা শুনে হজরত আবু বুরদা (رضي الله عنه) বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ্! আমার একটিই বকরী ছিলো। ঈদের নামাজের আগেই আমি বকরিটি জবেহ্ করে ফেলেছি। আমি মনে করেছিলাম, আজকের দিনটাতো খানা পিনারই দিন। তাই তাড়াতাড়ি জবাই করে পরিবার পরিজন এবং প্রতিবেশীদেরকে নিয়ে আনন্দ করে খেয়েছি। এখন এক বৎসরের কম বয়সের একটি বকরীর বাচ্চা ছাড়াতো আমার আর কোরবানী দেয়ার মতো কিছু নেই। তবে বাচ্চাটি বেশ মোটা তাজা এবং দুম্বার মতই মাংসল। বাচ্চাটি দিয়ে কি কোরবানী হবে? রসুল (ﷺ) এরশাদ করলেন, হাঁ, তোমার ক্ষেত্রে হবে। 


এক রমণীর বিয়ের মহর সংক্রান্ত ব্যাপারেও রসুলেপাক (ﷺ) স্বতন্ত্র নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। মহর আদায়ের পরিবর্তে পুরুষটি উক্ত মহিলাকে কোরআন মজীদ শিক্ষা প্রদান করবে এরকম হুকুম দিয়েছিলেন। ঘটনাটি কোরআন মজীদে এভাবে উক্ত হয়েছে ‘একজন রমণী রসুলেপাক (ﷺ) এর খেদমতে নিবেদন করলো, আমি নিজেকে রসুল (ﷺ) এর জন্য সম্প্রদান করছি। এভাবে কোনো মহিলা নিজেকে রসুল (ﷺ) এর জন্য সম্প্রদান করলে তাঁকে গ্রহণ করা রসুলেপাক (ﷺ) এর জন্য জায়েয ছিলো। কিন্তু রসুলেপাক (ﷺ) তাঁকে গ্রহণ করলেন না। পাশেই উপবিষ্ট এক দরিদ্র সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ্! রমণীটি যদি আপনার উপযোগী না হয়, তাহলে আমার সঙ্গে তার বিয়ে দিন। তিনি (ﷺ) বললেন, মহর আদায় করার মতো কী আছে তোমার? তিনি বললেন, পরনের লুঙ্গিখানা ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। রসুল (ﷺ) বললেন, তালাশ করে দেখো, কিছু জোগাড় করতে পারো কিনা। অন্ততঃপক্ষে একটি লোহার আঙটি হলেও চলবে। তিনি বললেন, কোরআন মজীদের অমুক অমুক সুরা আমার মুখস্থ আছে, আর কিছু নেই। রসুল (ﷺ) বললেন, কোরআনের যে অংশটুকু তোমার মুখস্থ আছে, তার বিনিময়ে তুমি তাকে বিয়ে করো। তুমি তাকে সেই অংশটুকু শিক্ষা দিবে এবং সেটাকে মহর হিসেবে নির্ধারণ করে নিবে। তবে তুমি ছাড়া অন্য কারও জন্য এই বিধান গ্রহণযোগ্য হবে না। কোরআন কখনও কারও জন্য মহর হতে পারে না।

 

মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি অন্যতম দিক হচ্ছে, তাঁর গায়ে যখন জ্বর উঠতো, তখন দু’জন মানুষের জ্বর হতো, যাতে তিনি দ্বিগুণ সওয়াব লাভ করতে পারেন। একদা তিনি অসুস্থ হলে হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) সেবা শুশ্রূষা করা এবং অবস্থা জানার জন্য নবী করীম (ﷺ) এর কাছে তিনবার উপস্থিত হয়েছিলেন। নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, তাঁর ইনতেকালের পর তাঁর জানাযা আদায় করা হয়েছিলো ইমাম ছাড়াই। মুসলমানেরা দলে দলে এসে জানাযা আদায় করেছিলেন। মৃত্যুর তিন দিন পর তাঁকে দাফন করা হয়েছিলো, আর তাঁর কবর শরীফে ওই মখমলের চাদরখানা বিছিয়ে দেয়া হয়েছিলো, যা তাঁর দেহ মোবারকের নীচে বিছানো ছিলো। অথচ এ দুটি কাজ অন্য কারও জন্য বৈধ নয়। 


এই ঘটনা সম্পর্কে অবশ্য ভিন্ন রকম বর্ণনাও রয়েছে। তা হচ্ছে, তাঁর কবর শরীফে যে মখমলের চাদর বিছানো হয়েছিলো তাঁর এক গোলাম, যার নাম ছিলো শকরবান, তিনি সাহাবীগণের অজান্তে সেটা বিছিয়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, রসুলেপাক (ﷺ) এর দেহ মোবারকের নীচে বিছানো এই চাদরটি পরে অন্য কারও দেহের নীচে যেনো বিছানো না হয়। নবী করীম (ﷺ) এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে, তাঁর ইনতেকালের পর পৃথিবীতে অন্ধকার নেমেছিলো। এর বিস্তারিত বর্ণনা যথাস্থানে করা হবে ইনশাআল্লাহ্। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, মাটি তাঁর পবিত্র শরীরকে ভক্ষণ করতে পারেনি। অন্যান্য আম্বিয়া কেরামের পবিত্র শরীরও মাটিতে মিশে যায়নি। যদিও এ বিশেষত্ব সকল নবীর মধ্যে ছিলো, তৎসত্ত্বেও এটাকে উলামায়ে কেরাম নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আর কেবল আম্বিয়া কেরাম কেনো, নবী করীম (ﷺ) এর উম্মতের আউলিয়া কেরামের বেলায়ও এরকম বর্ণনা রয়েছে।



যেমন শায়েখ আলী মুত্তাকী (رحمة الله) এর কবর বিশেষ কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খোঁড়া হয়েছিলো। কবর খোঁড়ার পর দেখা গেলো, কাফন সহকারে তাঁর পবিত্র লাশ সম্পূর্ণ অক্ষত ও অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। ঘটনাটি ছিলো এরকম, তাঁর এক নওজোয়ান এবং নেককার ভ্রাতুষ্পুত্র কামনা করলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে যেনো তাঁর চাচার কবরে দাফন করা হয়। আর মক্কা মুআযযমায় তখন এরকম ধারণা ছিলো যে, মৃতকে কোনো বুযুর্গ ব্যক্তির কবরে দাফন করলে তাতে বরকত লাভ হয়। যমীন কর্তৃক নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র শরীর ভক্ষিত না হওয়া হায়াতে তাইয়্যেবার বাহ্যিক নিদর্শন। আর এই হায়াত অর্থাৎ বরযখী জীবন নবী করীম (ﷺ) এবং অন্যান্য আম্বিয়া কেরামের জন্য বিশিষ্ট।

 

নবী করীম (ﷺ) এর আরেকটি অন্যতম বিশেষত্ব এই ছিলো যে, তাঁর উত্তরাধিকার সম্পত্তি তাঁর জাগতিক হায়াত ও বিদ্যমানতার উপর ভিত্তি করে সাব্যস্ত হতো না। তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তির মালিক তিনিই। কেউ কেউ বলেন, তাঁর সম্পত্তি তাঁর ইহকালীন জীবনের সমাপ্তির পর সদকা হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছিলো। যেমন হাদীছ শরীফে উক্ত হয়েছে, ‘আমি যা রেখে যাবো তা সদকা হবে।’ সে সমস্ত সদকা ওই সকল খাতে ব্যয়িত হবে, যে সকল খাতে তিনি নিজে ব্যয় করে থাকতেন। যেমন রসুলেপাক (ﷺ) এর খরচের খাতগুলো ছিলো নিজের আহল ও আয়াল আওলাদ, ফকীর এবং সাধারণ মুসলমানের জন্য কল্যাণকর কাজ। তাঁর ইহকালীন জীবনে তিনি যেভাবে এসকল খাতে ব্যয় করতেন, তেমনি ইনতেকালের পর রেখে যাওয়া সম্পত্তিকে সেসকল খাতেই খরচ করতে হবে। তাঁর উত্তরাধিকার সম্পত্তির বেলায় অবশ্য তাঁর জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিলো যে, তিনি ইচ্ছে করলে তাঁর পুরো সম্পত্তিকে কারও নামে ওসিয়ত করে যেতে পারতেন। অথচ অন্য কারো জন্য এক তৃতীয়াংশের অধিক কারো ব্যাপারে ওসিয়াত করা বৈধ নয়।।

 

এই বিধান অন্যান্য নবীর উত্তরাধিকার সম্পত্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাঁদের ইনতেকালের পর কোনো ওয়ারিছ হতো না। তবে আল্লাহর বাণী, ‘হজরত সুলায়মান হজরত দাউদ এর ওয়ারিছ হয়েছিলেন’ এবং ‘হে আমার রব! তুমি আমার জন্য তোমার পক্ষ থেকে ওলী বানাও যে আমার ওয়ারিছ হতে পারে’—আয়াতদ্বয়ের দ্বারা ওয়ারিছি সাব্যস্ত হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জবাব হচ্ছে, উক্ত ওয়ারিছি দ্বারা জাগতিক ধনসম্পত্তি লাভের ওয়ারিছি বুঝানো হয়নি। বুঝানো হয়েছে নবুওয়াত ও এলেমের ওয়ারিছিকে। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি অন্যতম দিক হচ্ছে, তিনি তাঁর রওজা শরীফে জীবিত আছেন। অন্যান্য নবীগণও তাই। রসুলেপাক (ﷺ) শুধু জীবিত আছেন, তাই নয়। বরং আযান ও একামতের সাথে নামাজও আদায় করে যাচ্ছেন। ইবনে যাবালা এবং ইবনে নাজ্জার বর্ণনা করেন, আইয়্যামে হুররার সময়



মসজিদে নববীতে তিন দিন পর্যন্ত আযান হয়নি। আইয়ামে হুররা বলা হয় ইয়াযিদী বর্বতার সময়কে। তখন কুখ্যাত ইয়াযিদী বাহিনী মদীনা মুনাওয়ারায় হামলা করে শতশত সাহাবীকে শহীদ করেছিলো। নারীদের সম্ভ্রম নষ্ট করেছিলো। মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে গাধা ঘোড়া বেঁধেছিলো (নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক)। তখন নরপিশাচ ইয়াযিদী বাহিনীর আতংকে মানুষ মদীনা মুনাওয়ারা ছেড়ে বাইরে চলে গিয়েছিলো। কেবল হজরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (رضي الله عنه) মসজিদে নববীতে উপস্থিত ছিলেন। 


তিনি বর্ণনা করেন, যোহরের ওয়াক্ত হলে আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নবী করীম (ﷺ) এর রওজা শরীফের কাছে চলে গেলাম। সেখানে পরিষ্কার আযানের আওয়াজ শুনতে পেলাম এবং সেখানেই যোহরের নামাজ আদায় করলাম। তারপর থেকে প্রত্যেক নামাজের সময়ই রওজা শরীফ থেকে আজান ও একামতের শব্দ শুনতাম। এমতাবস্থায় তিন রাত অতিবাহিত হয়েছিলো। এরপর যখন মানুষেরা মদীনা শরীফে ফিরে এলো, তখন তারাও রওজা শরীফ থেকে আযান শুনতে পেলো, যেরূপ আমি শুনেছি। 


দুনিয়া থেকে প্রস্থানের পর নবী করীম (ﷺ) যে জীবিত অবস্থায় রয়েছেন, এ সম্পর্কে একমত হলেও আরেকটি ব্যাপারে উলামা কেরাম মতানৈক্য করেছেন। সেটি হচ্ছে, তিনি জীবিত আছেন ঠিক, কিন্তু কোথায় আছেন? তিনি রওজা শরীফে জীবিত? নাকি কোনো বিশেষ স্থানে? জান্নাতে? আসমানে?

 

কেউ কেউ বলেন, আমরা নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র দেহ রওজা শরীফে দেখেছি। সেখান থেকে তাঁর দেহ মোবারক অন্য কোথাও স্থানান্তরিত করার দলীল আমাদের কাছে নেই। সুতরাং এটাই প্রমাণিত যে, তাঁর দেহ মোবারক ওই নূরানী মাটিতেই সমাহিত অবস্থায় আলোকময় হয়ে আছে। কেউ যদি বলেন, কবর তো সংকীর্ণ স্থান। এরূপ সংকীর্ণ স্থানে নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র দেহ আবদ্ধ থাকা সমীচীন নয়। জবাবে আমরা ওই হাদীছটি পেশ করতে চাই, যে হাদীছে বলা হয়েছে, মুমিনের কবরকে চারিদিকে সত্তর গজ করে প্রশস্ত করে দেয়া হবে। একজন মুমিনের কবরের অবস্থা এরকম হলে রসুলে আকরম (ﷺ) এর কবর শরীফের প্রশস্ততা কতো হতে পারে? অনুমান করা যায়? যদি কেউ এরকম বলে, রসুলে আকরম (ﷺ) এর ওফাতের পর তাঁর বরযখী জীবনের জন্য কবর শরীফের মাটির চেয়ে ফেরদাউসে আ’লাই তো বেশী উপযোগী। এমতো বক্তব্যের জবাবে বলবো, তার কবর শরীফের চেয়ে উত্তম জান্নাত কোথায়? জান্নাত তো রসুল (ﷺ) এর গোলামদের বসবাসের জায়গা। এই মর্মে ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী (رحمة الله) এর উক্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, ভূখ-ের যে অংশের সাথে রসুলেপাক (ﷺ) এর পবিত্র শরীর মিলিত আছে, সে অংশকে যদি পৃথিবীর সমস্ত জায়গা, এমনকি পবিত্র কাবার উপরেও অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়, তবে মনে হয় না কোনো মুসলমান আপত্তি করবে। হজরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত ‘আমি কবর শরীফ থেকে নবী করীম (ﷺ) এর আযানের আওয়াজ শুনেছি’ এ হাদীছখানা শবে মেরাজ সম্পর্কিত নবী করীম (ﷺ) এর উক্ত হাদীছের সমর্থক। 


মেরাজের বর্ণনায় নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমি মুসা (عليه السلام) কে তাঁর কবরে নামাজ পড়তে দেখেছি। এখন প্রশ্ন আসে, মেরাজ সম্পর্কিত হাদীছে এরকম বর্ণনাও রয়েছে যে, নবী করীম (ﷺ) আম্বিয়া কেরামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বিভিন্ন আকাশে। আবার আরেক বর্ণনায় আছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমি হজরত মুসা (عليه السلام) কে সত্তর জন বনী ইসরাইলের সঙ্গে হজ্ব করতে এবং তালবিয়া পাঠ করতে দেখেছি। এই জটিলতার জবাব হচ্ছে, এহেন দর্শন সংঘটিত হয়েছে স্থানের ব্যাপকতার প্রেক্ষিতে। 


কেউ যদি প্রশ্ন করে, কোরআন মজীদ তো নবী করীম (ﷺ) এর মৃত্যুর ঘোষণা দিয়েছে। যেমন আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন ‘নিশ্চয়ই আপনি মৃত্যুবরণকারী এবং তারাও মৃত্যুবরণকারী।’ নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন ‘আমি মৃত্যুবরণকারী একজন পুরুষ।’ নবী করীম (ﷺ) এর ইনতেকালের পর হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) বলেছিলেন, নিঃসন্দেহে মোহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেছেন। তাছাড়া নবী করীম (ﷺ) এর মউত ও প্রস্থান গ্রহণের উপর উম্মতের ঐকমত্য রয়েছে। উত্তর এই যে, রসুলেপাক (ﷺ) মৃত্যুর স্বাদ অবশ্যই গ্রহণ করেছেন এবং দুনিয়া থেকে প্রস্থান করেছেন। কিন্তু তারপর আল্লাহ্তায়ালা তাঁকে জীবিত করে দিয়েছেন। যেমন হাদীছ শরীফে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ্তায়ালা আমাকে কবরের মধ্যে চল্লিশ দিনের চেয়ে অধিক সময় রাখবেন, এর চেয়েও আমি তাঁর নিকট অধিকতর সম্মানিত। হাদীছ শরীফে আরও এসেছে, আল্লাহ্তায়ালা কোনো নবীর দেহ ভক্ষণ করাকে মাটির জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। সুতরাং নবী করীম (ﷺ) এর যেমন জিসমানী, দুনিয়াবী ও বদনী হায়াত ছিলো এখনো ঠিক তেমনই আছে। এই হায়াত শহীদগণের হায়াতের চেয়ে অধিকতর পরিপূর্ণ। কেনোনা শহীদগণের হায়াত রূহানী ও পরকালীন হায়াত। আর পরকালীন হায়াত রূহের জন্য নির্ধারিত। জগতে যে দেহ নিয়ে তাঁর জন্ম হয়েছিলো সেই দেহের মেছাল বানিয়ে আল্লাহ্তায়ালা শহীদগণের আত্মা সেখানে সংস্থাপন করতে পারেন। অথবা কোনো এক প্রকার দেহ যা আত্মাকে ধারণ করতে পারে, আল্লাহ্তায়ালা তাই সৃষ্টি করে তার সঙ্গে শহীদের আত্মা সংশ্লিষ্ট করতে পারেন। যেমন হাদীছ শরীফে এসেছে, আল্লাহ্তায়ালা শহীদগণের আত্মা সবুজ বর্ণের এক প্রকারের পাখির মধ্যে আমানত রেখে দিয়েছেন। পাখিগুলো আরশের ঝাড়বাতির নীচে অথবা জান্নাতে উড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আম্বিয়া কেরামের পবিত্র আত্মা তাঁদের ওই পবিত্র দেহের মধ্যেই ফিরিয়ে দেয়া হয়, যে দেহ দুনিয়াতে ছিলো। তাঁদের পবিত্র দেহ পঁচে যায় না, মাটিতেও মিশে যায় না। আল্লাহ্তায়ালা দেহ ছাড়াও আত্মাকে সংরক্ষণ করতে সক্ষম। তবে আম্বিয়া কেরামের পার্থিব দেহেই তাঁদের আত্মাকে সংরক্ষণ করা হয়েছে বলে উদ্ধৃতি রয়েছে। যেমন হজরত মুসা (عليه السلام) এর কবরে নামাজ আদায় করার বর্ণনা। নামাজ আদায় করা পার্থিব দেহের কাজ। শবে মেরাজের ঘটনায় আম্বিয়া কেরামের যে সকল গুণের কথা বলা হয়েছে সেগুলো দেহের সাথে সংশ্লিষ্ট। এ কথার দ্বারা দুনিয়ায় তাঁদের যে জীবন ছিলো, হুবহু ওই জীবনকে বুঝতে হবে, তা নয়। পানাহার এবং দৈহিক প্রয়োজনাদি ইহকালীন জীবনে হয়ে থাকে। বরযখী জীবনে এসবের প্রকার ও প্রকৃতি ভিন্ন। পানাহার এবং অন্যান্য দৈহিক প্রয়োজনাদি মানুষের অভ্যাসগত কাজ। আর ওই জগতের অবস্থাতো জাগতিক অভ্যাসের বিপরীত। বরযখী জীবনের অবস্থা এমনও তো হতে পারে যে, সেখানকার হিমেল সুঘ্রাণ, নারী, বিভিন্ন প্রকারের রিযিক ইত্যাদি রূহানীভাবেও হতে পারে। যেমন শহীদগণের মর্যাদার্থে বলা হয়েছে ‘তাদেরকে কবরের জীবনে রিযিক দেয়া হচ্ছে। তারা আনন্দিত। তাঁদেরকে প্রদত্ত আহার্য জান্নাতী হলেও বিস্ময়ের কিছু নেই। হাদীছ শরীফে তো এরকম বর্ণনাও এসেছে, তিনি আমাকে আহার করাচ্ছেন, পান করাচ্ছেন। 


এখন একটি প্রসঙ্গ বাকি রইলো। তা হচ্ছে, নবী করীম (ﷺ) রওজা শরীফে শুয়ে উম্মতের ব্যাপারে কিছু জানতে পারেন কিনা এবং উম্মতের কোনো কথা শুনতে পান কিনা। এ ব্যাপারে বলতে হয়, শুধু তিনি নন, সকল নবীর বেলায় এটা নিঃসন্দেহভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি বিষয়টির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে উলামা কেরাম তো এই মতে উপনীত হয়েছেন যে, সকল মৃতব্যক্তির বেলায় এরকম হওয়া সম্ভব। হাদীছ শরীফে এসেছে, কবরের মধ্যে মৃতগণ নামাজ পাঠ, তালবিয়া পাঠ, জিকির ও তাসবীহ পাঠ ইত্যাদি করে থাকেন। 


কেউ যদি প্রশ্ন উত্থাপন করে, বরযখ তো কোনো দারুল আমল (আমলের জগত) নয় এবং সেখানে শরীয়তের বিধান বাধ্যতামূলকও নয়। তাহলে কবরবাসীরা আমল করবে কেনো? উত্তরঃ আলমে বরযখে সওয়াব ও পুরস্কারের সোপান তৈরী করা হয়। দুনিয়ার আমলের বিধান মোতাবেকই তা হয়ে থাকে। আবার অধিকাংশ সময় সেখানকার আমল স্বইচ্ছায় হয়ে থাকে। অর্থাৎ আল্লাহ্তায়ালার পক্ষ থেকে তা আরোপিত নয়। বরং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে উদ্দীপনা ও আগ্রহ সহকারে মনের আনন্দে কবরবাসীরা তা করে থাকে। যেমন, দুনিয়াতে নফল ইবাদত বন্দেগী করা হয়। যেমন বেহেশতীরা বেহেশতে তসবীহ পাঠ করবে, কোরআন তেলাওয়াত করবে। হাদীছ শরীফে আছে, কোরআনের পাঠক বেহেশতে প্রবেশ করলে আল্লাহ্তায়ালা আদেশ করবেন, ‘তরতীলের সাথে কোরআন পাঠ করো এবং উন্নত হও। রসুলেপাক (ﷺ) কিয়ামতের দিন শাফায়াতের দরজা খোলার নিমিত্তে যে সেজদা করবেন, তাও এ পর্যায়েরই আমল। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি অন্যতম দিক হচ্ছে, দুনিয়া থেকে প্রস্থানের পরও তাঁর সম্পদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত থাকে। আর তাঁর পরিবার পরিজনের নফকার ব্যবস্থা আল্লাহ্পাক করবেন বলে অঙ্গীকারও করেছেন। ইমামুল হারামাইন একে রসুলেপাক (ﷺ) এর বিশেষত্বের অন্তর্গত বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, রসুলেপাক (ﷺ) যা কিছু রেখে গেছেন, তার উপর তাঁর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সাইয়্যেদুনা হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) যখন খলীফা নির্বাচিত হলেন, তখন তাঁর খেলাফতের নীতিনির্ধারণীর মধ্যে এটাও স্থির করে নেন যে, রসুলেপাক (ﷺ) এর আহল ও আয়াল, খাদেমসমূহ এবং অন্যান্য খাতে বাইতুলমাল থেকে খরচ বহন করা হবে। হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) জানতেন, রসুলেপাক (ﷺ) এর মাল তাঁরই মালিকানায় রয়েছে। এই মাসআলাটি দ্বারা এটাই সাব্যস্ত হয় যে, দুনিয়াবী বিধানের ক্ষেত্রেও তাঁর হায়াতকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সুতরাং শহীদগণের হায়াতের তুলনায় তাঁর হায়াত অধিকতর উঁচুমানের। অবশ্য কেউ কেউ নবী করীম (ﷺ) এর ওফাতের পর তাঁর মালিকানা রহিত হয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। উভয় প্রকার মতের অনুসারীরাই রসুলেপাক (ﷺ) এর বাণী ‘রেখে যাওয়া সম্পত্তি হচ্ছে সদকা’ দ্বারা হেদায়েত গ্রহণ করতে পারে। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


এই মাসআলাটি রসুলেপাক (ﷺ) এবং অন্য নবীগণের হায়াত সংক্রান্তআলোচনায় এসে গেছে। এছাড়াও এই কিতাবের শেষের দিকে ওফাতুন্নবী নামক পরিচ্ছেদে এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র আলোচনা আসবে। আলোচনাটি পুনরাবৃত্তি মনে হলেও দোষের কিছু নেই। কারণ এতে করে ব্যাপারটি আরও পরিষ্কার ও সুদৃঢ় 

হবে। 


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বসমূহের মধ্যে আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, তাঁর রওজা শরীফে ফেরেশতারা নিয়োজিত রয়েছে। তাদের কাজ হচ্ছে, জিয়ারতকারীদের সালাত ও সালাম রসুল (ﷺ) এর কাছে পেশ করা। এই হাদীছটি নিম্নোক্ত ভাষ্যের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। ভাষ্যটি এই— আল্লাহ্তায়ালার এমন কতিপয় ফেরেশতা আছে, যারা যমীনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। আমার উম্মতের তরফ থেকে তারা আমার নিকট সালাম পৌঁছে দেয়। হজরত আম্মারা (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে আছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ্তায়ালার একজন ফেরেশতা আছেন। তাঁর শ্রবণশক্তি এতো অধিক যে, এমন শ্রবণশক্তি অন্য কাউকে দেয়া হয়নি। যে কোনো স্থান থেকে আমার উপর সালাত ও সালাম পেশ করা হোক না কেনো, উক্ত ফেরেশতা সেই সালাত ও সালাম সঙ্গে সঙ্গে আমার নিকট পৌঁছে দেয়।


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক, উম্মতের আমল তাঁর নিকট পেশ করা হয়। রসুল (ﷺ) তা দেখে উম্মতের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতে থাকেন। ইবনে মোবারক হজরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, এমন কোনো দিন নেই যে, সকাল সন্ধ্যা উম্মতের আমল রসুলেপাক (ﷺ) এর নিকট পেশ করা না হয়। রসুলেপাক (ﷺ) কিয়ামতের দিন উম্মতের কপাল এবং তাদের আমল দ্বারা উম্মতকে চিনে নিবেন। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমার কাছে উম্মতের আমল পেশ করা হয়। তন্মধ্যে বদআমলগুলো আমি আড়াল করি। আর নেক আমলগুলো আল্লাহ্পাকের নিকট পেশ করি। আড়াল করার অর্থও এখানে পেশ করা। আল্লাহ্তায়ালার বিধানই যেনো এরকম। পেশ করার পর আমল সাব্যস্ত হয়। আর যেসব আমল পেশ হয় না, সেগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। 


কাব আহবার কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে আছে, রসুলেপাক (ﷺ) এর রওজা শরীফে দৈনিক সত্তর হাজার ফেরেশতা নেমে এসে ঘাড় দুলিয়ে কবর শরীফ তওয়াফ করতে থাকে। নবী করীম (ﷺ) কিয়ামতের দিন যখন আপন কবর শরীফ থেকে বেরিয়ে হাশরের ময়দানে উঠবেন, তখন ওই সকল ফেরেশতা সমভিব্যহারেই উঠবেন। তখন নবী করীম (ﷺ) কে নিয়ে ওই ফেরেশতাবৃন্দ যেফাফের মতো মিছিল করে যাবেন। যেফাফের অর্থ দুলহানকে দুলহার গৃহে নিয়ে আসা। তবে এখানে লাযেমী অর্থ গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ মাহবুব (প্রেমাস্পদ)কে মোহেব (প্রেমিক) এর কাছে নিয়ে যাওয়া। মোটকথা ফেরেশতাবৃন্দ মিছিল সহকারে অভিবাদন করতে করতে তাঁকে বারেগাহে এলাহীতে নিয়ে যাবেন। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের অন্যতম দিক হচ্ছে, তাঁর পবিত্র মিম্বর তাঁর হাউযের উপর অবস্থিত। হাদীছ শরীফে এরকমই বর্ণিত হয়েছে। অন্য এক বর্ণনায় আছে, আমার মিম্বর জান্নাতের তরআসমূহের মধ্যে একটি তরআ। তরআ শব্দের অর্থ দরজা বা ফটক। কেউ অর্থ করেছেন স্তর। আবার কেউ অর্থ করেছেন, উদ্যানের উঁচু স্থান। হাদীছ শরীফে এসেছে, একদিন সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) মিম্বর শরীফে দ-ায়মান হয়ে বললেন, এই মুহূর্তে আমার পা জান্নাতের তরআসমূহের একটি তরআর উপরে রয়েছে। অন্য এক বর্ণনায় আছে, তিনি এরশাদ করেছেন, আমার মিম্বার আমার হাউযের উপরে অবস্থিত। অন্য হাদীছে এসেছে, তিনি এরশাদ করেছেন, এখন আমি আমার হাউযের ইকরে দাঁড়িয়ে আছি। ইকর ওই স্থানকে বলা হয়, যেখান থেকে হাউযের মধ্যে পানি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ‘হাউযের উপর মিম্বর অবস্থিত’ কথাটির তাৎপর্য বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন এর অর্থ হবে মিম্বরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া, তা থেকে বরকত লাভ করা, তার সম্মুখে সর্বদাই আমলে সালেহা পালন করা ইত্যাদি। তাহলে এর দ্বারা উম্মত হাউযে নবী (ﷺ) তথা হাউযে কাউছারের কাছে আসতে পারবে এবং তা থেকে জীবনরক্ষাকারী পানি পান করতে পারবে। 


এটাও সম্ভব, নবী করীম (ﷺ) স্বীয় মিম্বরকে যেরূপ মর্যদা দান করেছেন, কাল কিয়ামতের দিন সমস্ত মাখলুকাতের রঙে রঞ্জিত করে হাশরের ময়দানে আল্লাহ্পাক তাঁকে উত্থিত করবেন এবং হাউযে কাউছারের পাশে রাখবেন। 


জান্নাতের তরআ মানে বেহেশতের দরজা। এর অর্থ, রসুলেপাক (ﷺ) এর মহিমা প্রকাশার্থে আল্লাহ্তায়ালা কিয়ামতের দিন তাঁর মিম্বর শরীফকে জান্নাতের দরজা হিসেবে সংস্থাপন করবেন। কেউ আবার এরকম ব্যাখ্যা করেন, এখানে মিম্বর বলতে ওই মিম্বরকে বুঝানো হয়েছে, যা নবী করীম (ﷺ) এর জন্য কিয়ামতের দিন কায়েম করা হবে। এই মিম্বর বলতে মসজিদে নববীর মিম্বরকে বুঝানো হয়নি। কিন্তু এ ধরনের ব্যাখ্যা হাদীছ শরীফের বাক্যের ভাব ও চাহিদা থেকে বহু দূরে। কেনোনা, হাদীছ শরীফের বর্ণনা, আমার হুজরা এবং মিম্বরের মধ্যবর্তীস্থানে জান্নাতের বাগানসমূহের মধ্য থেকে একটি বাগান রয়েছে, আর আমার মিম্বর আমার হাউযের উপর অবস্থিত। হাদীছের বাণীবিভা ঝুঁকে আছে এই মিম্বর শরীফের দিকেই, যা রওজায়ে মুকাদ্দাসার তাহদীদের জন্য আলোচনা করা হয়েছে। তারিখে মদীনাতে এরকমই উল্লেখ করা হয়েছে। 


মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবের লেখক বলেছেন, কোনো একজন আলেমও উল্লিখিত হাদীছের যাহেরী অর্থ গ্রহণ করতে দ্বিমত করেননি। আর এটাই সত্য। কেনোনা সত্যসংবাদদাতা (ﷺ) অদৃশ্য জগতের যা কিছু সংবাদ দিয়েছেন, তার উপর ইমান আনা ওয়াজিব। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, তাঁর মিম্বর এবং কবর শরীফের মধ্যবর্তীস্থানে বেহেশতের বাগানসমূহের কোনো একটি বাগান রয়েছে। এই হাদীছখানা ইমাম বোখারী (رحمة الله) ‘মা বাইনা বাইতী ওয়া মিম্বারী’ এই বাক্যে বর্ণনা করেছেন। এ সম্পর্কেও উলামা কেরাম বিভিন্ন আলোচনা পর্যালোচনা করেছেন। কেউ বলেছেন, ‘রওজায়ে জান্নাত’ বা বেহেশতের বাগান দ্বারা মধ্যবর্তীস্থানটিকে বুঝানো হয়েছে। কেনোনা সেখানে বসে জিকির আজকার মোরাকাবা মোশাহাদা ও ইবাদত বন্দেগী করলে ওই কাজগুলো রহমত নাযিলের কারণ হবে, সৌভাগ্য লাভের ওসীলা হবে। যেমন মসজিদকেও রিয়াযুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগান বলা হয়েছে। 


নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন ‘ইযা মারারতুম বিরিয়াযিল জান্নাতি ফারতাউ’ অর্থাৎ তোমরা যখন বেহেশতের বাগানসমূহের নিকট দিয়ে যাবে, তখন তা থেকে ফল আহরণ করে নিও।


বিশেষ করে রসুলেপাক (ﷺ) এর জামানায় সৌভাগ্য লাভই তার বাস্তব নিদর্শন। সেখান থেকেই সকলে এলেমের ফল, জিকিরের নূর এবং জান্নাতের নিদর্শন লাভে ধন্য হতেন। কেউ কেউ রওজাতুল জান্নাতের অর্থ এইভাবে করেন যে, নবী করীম (ﷺ) এর ঘর ও মিম্বরের মধ্যবর্তীস্থান বেহেশতের বাগান এই হিসেবে যে, সে স্থানে আনুগত্য ও ইবাদত প্রতিষ্ঠিত করলে তা জান্নাতে পৌঁছার কারণ হবে। 


যেমন নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন ‘জান্নাত তরবারীর ছায়ার তলে অবস্থিত।’ তিনি আরও এরশাদ করেছেন, ‘মায়ের পদতলে জান্নাত।’ রিয়াযুল জান্নাতের ব্যাখ্যায় দুটি মত পেশ করা হয়েছে। দুটিই নেহায়েত দুর্বল এবং সত্য থেকে দূরে। কেনোনা রিয়াযুল জান্নাতের অর্থ যদি রহমত নাযিল হওয়া, জান্নাতী বাগানে পৌঁছা এবং এর উপর ছওয়াব নির্ভর করা, ইত্যাকার অর্থ হয়, তাহলে তো তা সমস্ত মসজিদ এবং অন্যান্য কল্যাণকর স্থানেও হতে পারে। তাহলে উক্ত স্থানের বিশেষত্বটি আর রইলো কোথায়? এরূপ সুসংবাদ শুধুমাত্র মসজিদে নববী এবং মিম্বর মোবারকের সাথে বিশিষ্ট নয়। আবার উক্ত স্থানকে খাস রহমত এবং জান্নাতের বিশেষ প্রকারের একটি বাগান - এরূপ অর্থ যদি করা হয়, তবু তা সত্য থেকে দূরেই থাকবে। 


এ প্রসঙ্গে হক কথা এটাই যে, রসুলেপাক (ﷺ) এর বাণীর মর্মার্থ, যথার্থতা বাস্তবসম্মতভাবেই করতে হবে। হুজরা শরীফ এবং মিম্বর শরীফের মধ্যবর্তী স্থানটি প্রকৃত পক্ষেই জান্নাতের একটি বাগিচা। কিয়ামতের দিন একে জান্নাতে রূপান্তরিত করা হবে। যমীনের অন্যান্য স্থানের মতো তা নিশ্চিহ্ন হবে না। ইবনে ফরহুন এবং ইবনে জওযী হজরত ইমাম মালেক (رحمة الله) থেকে এরূপ বর্ণনা করেছেন। আর আলেমগণের ঐকমত্যকে এর সাথে শামিল করেছেন। শায়েখ ইবনে হাজার আছকালানী এবং অধিকাংশ মোহাদ্দেছ এই মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মালেকী মতাবলম্বী উলামাদের মধ্য থেকে ইবনে আবী জুমরাহ (رحمة الله) বলেছেন, ওই অংশটি স্বয়ং জান্নাতের বাগিচার অংশবিশেষ হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে, যে অংশটুকু আল্লাহ্তায়ালা সেখান থেকে দুনিয়ার এই স্থানে স্থাপন করেছেন। হাজারে আসওয়াদ যেরকম মাকামে ইব্রাহীমের স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। কিয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার পর তাকে আবার স্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। বান্দার উপর রহমত নাযিল হওয়া, জান্নাতের অধিকারী হওয়া, এ স্থানের ফজল ও উচ্চ মর্যাদার কারণেই হয়। 


কবর শরীফকে রিয়াযুল জান্নাত বলার অন্য আরেকটি দৃষ্টিকোণও থাকতে পারে। যেমন হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام) কে জান্নাতে একখানা বিশেষ পাথর দ্বারা মর্যাদাম-িত করা হয়েছিল। তদ্রুপ হাবীবে খোদা (ﷺ) কে রওজাতুন মিন রিয়াযিল জান্নাত দ্বারা বিশেষিত করা হয়েছে। যমীনের এই খ-টুকু বাহ্যিক দৃষ্টিতে পৃথিবীর মাটির মতো দেখা গেলেও ক্ষতি নেই। কেনোনা মানুষ যতক্ষণ এ পৃথিবীতে স্বভাবের ঘন পর্দা এবং মানবীয় আদত ও খাসলতের দ্বারা আচ্ছাদিত থাকবে, ততক্ষণ তার নিকট বস্তুর হাকীকত উন্মোচিত হওয়া এবং আখেরাতের কার্যাবলী অনুভব করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে এরকম ধারণাও ঠিক নয় যে, এই স্থানের হাকীকত যখন রওজাতুন মিন রিয়াযিল জান্নাত, তখন এস্থান থেকেও তৃষ্ণা এবং দিগম্বরত্ব দূর হওয়া উচিত। কেনোনা এগুলোতো জান্নাতের রীতি এবং আনুষংগিক ব্যাপার। 


যেমন আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই বেহেশতের মধ্যে পিপাসা হবে না এবং তুমি দিগম্বর হবে না।’ সম্ভবতঃ জান্নাতের আনুষংগিক বস্তুসমূহকে এই স্থান থেকে বের করে দিয়ে তারপর হয়তো রূপান্তরিত অবস্থায় পৃথক আকারে আনা হয়েছে। হাজারে আসওয়াদ এবং মাকামে ইব্রাহিমীর বেলায়ও তেমন। কেউ যদি প্রশ্ন উত্থাপন করে, এ ধরনের ব্যাপারে শ্রুতিগত দলীল ও হাদীছ ছাড়া কোনো যুক্তি গ্রহণ করা যায় না। রুকন অর্থাৎ হাজারে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহীমের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। কাজেই সেগুলোর প্রতি ইমান আনা ওয়াজিব। উত্তরে আমরা বলবো, এ ব্যাপারেও দলীল এবং রসুল (ﷺ) এর হাদীছের সাক্ষ্য আছে। হাজারে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহীমের হাকীকত সাদেক মাসদুক (ﷺ) এর খবর দ্বারাইতো জানা গেছে। তেমনি রওজা শরীফ ও মিম্বর শরীফের অবস্থাও জানা গেছে। রূপকতার আশ্রয় নিলে উভয়ক্ষেত্রেই নিতে হবে। আর যদি হাকীকতের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়, তাও উভয়ের বেলায় প্রযোজ্য হবে। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম তাঁর কবর শরীফ বিদীর্ণ হবে এবং সকলের পূর্বে তিনি বাইরে তশরীফ আনবেন। সর্বাগ্রে তিনিই উত্থিত হবেন। এর অর্থ হচ্ছে কিয়ামতের সমাবেশস্থলে তিনিই প্রথম ব্যক্তি হবেন, যিনি জান্নাতের দরজায় করাঘাত করবেন। 


হাদীছ শরীফে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমি কিয়ামতের দিন জান্নাতের দরজা খুলবো। জান্নাতের রক্ষী ফেরেশতা বলবে ‘বিকা উমরতু লা-আফতাহু লিআহাদিল কাবলাকা’ আপনার ব্যাপারেই আমাকে হুকুম করা হয়েছে। আপনার পূর্বে কারো জন্যই জান্নাতের দরজা খুলবো না। এখানে বিকা শব্দটির মধ্যে যে ‘বা’ অক্ষর রয়েছে তা কসমের অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। তখন তার অর্থ হবে ‘আপনার কসম, আপনার পূর্বে অন্য কারও জন্য খুলবো না।” এরকম অর্থ অধিকতর সুন্দর আর মহব্বতের আস্বাদনে স্বাদু। তিনিই সকলের পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। আর তিনিই সকলের পূর্বে শাফায়াতের দরোজা উন্মুক্ত করবেন।


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি অন্যতম দিক হচ্ছে, তিনি বোরাকের পিঠে সওয়ার হয়ে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবেন। তাঁকে বেহেশতের সবচেয়ে উন্নতমানের জোড়া লেবাস দান করা হবে। অন্য এক হাদীছে আছে, কিয়ামতের দিন মানুষ একত্রিত হবে। তখন আমি এবং আমার উম্মত উঁচুস্থানে দ-ায়মান হবো। আল্লাহ্তায়ালা আমাকে জোড়া লেবাস পরিধান করাবেন। তিনি (ﷺ) তখন সময় আরশের মাকামের এমন একটি স্থানে দ-ায়মান হবেন, যেখানে কেউই দ-ায়মান হতে পারেনি। আর সেস্থানটিতে দাঁড়ানোর জন্য পূর্বাপর সকলেই আকাংখা পোষণ করবে। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, তাঁকে মাকামে মাহমুদ দান করা হবে। তাফসীর শাস্ত্রের ইমাম হজরত মুজাহিদ (رحمة الله) বলেন, তিনি (ﷺ) মাকামে মাহমুদ বা প্রশংসিত স্থান লাভ করবেন, তার মানে আরশের উপর আসন গ্রহণ করবেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি কুরসীর উপর আসন গ্রহণ করবেন। তাফসীরে বায়যাবীতে বলা হয়েছে, মাকামে মাহমুদ এমন একটি স্থান, যেখানে গেলে সকলেই নবী করীম (ﷺ) কে চিনতে পারবে। সবাই তাঁর প্রশংসা করবে। তাফসীরে বায়যাবী শরীফের কথাটি সাধারণতঃ সকল স্থানের জন্যই প্রযোজ্য। কেনোনা নবী করীম (ﷺ) যে স্থানে দ-ায়মান হবেন, সে স্থানই তাঁর ওসীলায় মর্যাদা ও বুযুর্গী লাভ করবে। কাজেই একথার দ্বারা মাকামে মাহমুদের কোনো বিশেষত্ব প্রমাণিত হয় না। তবে এ সম্পর্কে মশহুর কথা এই যে, এ মাকামটি শাফায়াতের মাকাম। 


সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি অন্যতম দিক হচ্ছে, কিয়ামতের ময়দানে যারা বিচারের জন্য দ-ায়মান হবে, তাদের মধ্যে তাঁকে বিরাট শাফায়াতের অধিকার প্রদান করা হবে। হাশরবাসীরা তাঁর শরণাপন্ন হবে। তিনি তাঁর শাফায়াতের মাধ্যমে কোনো জামাতকে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আবার বেহেশতের মধ্যে কারও মর্যাদা বৃদ্ধি করিয়ে দিবেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা যথাস্থানে করা হবে ইনশাআল্লাহ্। মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, কিয়ামতের দিন তাঁকে প্রশংসার ঝা-া দান করা হবে। কিয়ামতের দিন হজরত আদম (عليه السلام) সহ সকল নবী ওই ঝা-ার নীচে অবস্থান করবেন। আর ওসীলা জান্নাতের যে একটি সর্বোন্নত স্তর, তাও বিশেষ করে নবী করীম (ﷺ) কে প্রদান করা হবে। মোট কথা, আল্লাহ্তায়ালার নিকট নবী করীম (ﷺ) হচ্ছেন সমস্ত মাখলুকের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সম্মানিত ও মর্যাদাম-িত। তাই কিয়ামতের দিন তিনিই হবেন সকলের অগ্রণী।


যেমন তিনি (ﷺ) এরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন আমি বনী আদমের সরদার হবো এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তীগণের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত হবো। আর সেদিন আমার হাতে থাকবে প্রশংসার ঝা-া। এতে আমার কোনো অহংকার নেই। আদমসহ সকল নবী আমার ঝা-ার তলে আশ্রয় গ্রহণ করবেন। 


মহানবী (ﷺ) এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি যখন জান্নাতের দরোজা খোলার জন্য এগিয়ে যাবেন, তখন তাঁর সম্মানার্থে জান্নাতের রক্ষী দ-ায়মান হবে এবং তাঁকে স্বাগতম জানিয়ে দরোজা খুলে দিবে। রক্ষী ফেরেশতা বলবে আমি আপনার পূর্বে কারও জন্য দরোজা খুলিনি। আর আপনার পর আর কারও জন্য দাঁড়িয়েও থাকবো না। এর দ্বারা নবী করীম (ﷺ) এর মর্যাদার আধিক্যই প্রকাশ পাবে। নতুবা জান্নাতের রক্ষী ফেরেশতাগণ তো তাঁরই খাদেম। আর আল্লাহর হুকুমে বেহেশতে তিনি বাদশাহ্তুল্য হবেন। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, আল্লাহ্তায়ালা তাঁকে হাউযে কাউছার দিয়েছেন। হাউযে কাউছারের পানি মধুর চেয়ে মিষ্ট এবং দুধের চেয়ে শুভ্র। অন্য এক বর্ণনায় আছে, রবফের চেয়ে শাদা। আর তার পেয়ালার সংখ্যা হবে আকাশের তারকার চেয়েও বেশী। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, আখেরাতে নবীগণের জন্য এক একটি হাউয হবে যা হবে তাঁদের আপন আপন মর্যাদা অনুসারে। আর নবী করীম (ﷺ) এর হাউযে কাউছার হবে সেগুলোর চেয়ে অধিকতর প্রশস্ত এবং সম্মানিত। 


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, আল্লাহ্তায়ালা কোরআন মজীদে আম্বিয়া কেরামের তওবা, ক্ষমা এবং তাঁদের দ্বারা সংঘটিত বিভিন্ন ভুল ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নবী করীম (ﷺ) এর বেলায় আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন ‘নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রকাশ্য বিজয় দান করেছি এজন্য যে, আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের ভুলত্রুটিগুলো আল্লাহ্তায়ালা মাফ করে দিবেন এবং তাঁর নেয়ামতসম্ভার আপনার উপর পরিপূর্ণ করে দিবেন।’ এখানে দেখা যায়, আল্লাহ্তায়ালা ফাতাহ বা বিজয়ের কথাটি আগে উল্লেখ করেছেন। তারপর অতীত ও ভবিষ্যতের ভুল ক্ষমা করার কথা বলেছেন। এখানে ভুলটি কী তা কিন্তু অস্পষ্ট। এই আয়াতের যথার্থ ব্যাখ্যা প্রথম খন্ডে একটি অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, অন্যান্য নবী (عليه السلام)গণ আল্লাহ্তায়ালার কাছে চাওয়ার পর পেয়েছেন। আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন নবী করীম (ﷺ) কে না চাইতেই দিয়েছেন। হজরত আদম (عليه السلام) আল্লাহ্তায়ালার কাছে নিবেদন করেছেন ‘যে দিন মানুষকে উঠানো হবে সে দিন আমাকে লাঞ্ছিত করবেন না।’ অথচ রসুলেপাক (ﷺ) এবং তাঁর উম্মতের শানে আল্লাহ্তায়ালা ঘোষণা দিয়েছেন ‘সে দিন আল্লাহ্তায়ালা তাঁর হাবীবকে এবং তাঁর সঙ্গে যাঁরা ইমান এনেছেন তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন না।’ হজরত মুসা (عليه السلام) আল্লাহ্তায়ালার কাছে নিবেদন করলেন, ‘হে আমার প্রভু! আমার বক্ষ সম্প্রসারিত করে দিন।’ আর নবী করীম (ﷺ) এর ব্যাপারে আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন ‘আমি কি আপনার বক্ষকে সম্প্রসারিত করে দিইনি।’ মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি অন্যতম দিক হচ্ছে, আল্লাহ্তায়ালা তাঁকে মহব্বতের মাকাম প্রদানে ধন্য করেছেন। আর হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام) কে খিল্লতের মাকাম দ্বারা বিশেষিত করেছেন। 


মহব্বতের মাকাম খিল্লতের মাকামের চেয়ে উন্নত। কোনো কোনো আরেফীন উলামা খলীল ও হাবীব শব্দের পার্থক্যের ব্যাপারে সূক্ষ্ম আলোচনা করেছেন। বলেছেন, খলীল শব্দের উৎপত্তি খিল্লত থেকে। অর্থ হাজত বা প্রয়োজন। হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام) আল্লাহ্তায়ালার প্রতি আপাদমস্তক মুখাপেক্ষী ছিলেন। আল্লাহ্তায়ালা তাঁকে খলীল আখ্যা দিয়েছেন। আর হাবীব শব্দটি ফাঈল এর ওযনে এসেছে, যার অর্থ হবে মাফউল। সুতরাং রসুলে আকরম (ﷺ) কোনো মাধ্যম ব্যতিরেকেই মোহেব (প্রেমিক), আবার মাহবুব বা প্রেমাস্পদ। 


আরেফগণ বলেন, খলীলের কাজ আল্লাহ্তায়ালার রেজামন্দির জন্য হয়ে থাকে। আর হাবীবের রেজামন্দির জন্য হয় আল্লাহর কাজ। এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে ওই কেবলার দিকে ফিরিয়ে দেবো যা আপনি পছন্দ করেন।’


 আল্লাহ্তায়ালা আরও ঘোষণা করেন ‘অচিরেই আপনার প্রভু আপনাকে এতোবেশী দান করবেন যে, আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।’ খলীলের আরেকটি বিশেষত্ব হলো, মাহবুবের মোলাকাতের জন্য তিনি কখনও তাড়াহুড়া করবেন না। যেমন বর্ণিত আছে, হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام) এর কাছে তাঁর রূহ কবয করার জন্য মালাকুল মউত এলে তিনি তাওয়াককুফ বা মৌনতা অবলম্বন করেছিলেন। একটু পরে তিনি জিব্রাইল (عليه السلام) কে বলেছিলেন, বরং পরওয়ারদেগারে আলমের কাছে জিজ্ঞেস করুন, দেখা যাক তিনি কী হুকুম দেন, এখনই কি হাযির হতে হবে? নাকি কিছু বিলম্ব করলেও চলবে? কিন্তু নবী করীম (ﷺ) এর বেলায় দেখা যায়, তিনি বলেছিলেন, ‘আমি রফীকে আ’লা বা সর্বোন্নত বন্ধুকেই গ্রহণ করলাম। ’ তিনি বিভিন্ন দোয়ায় বলতেন, হে আল্লাহ্! যে দৃষ্টি তোমার চেহারার বুযুর্গীর দিকে ধাবিত, আমি তোমার কাছে এমন দৃষ্টি প্রার্থনা করি। আর প্রার্থনা করি দীদারের আগ্রহ। খলীলের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কিয়ামতের দিন মাগফেরাতের আকাক্সক্ষা তাঁর থাকবে। যেমন বলা হয়েছে ‘ওই ব্যক্তি যিনি এই আকাক্সক্ষা করবেন যেনো কিয়ামতের দিন তাঁর গোনাহ্ মাফ করে দেয়া হয়।’ আর হাবীবের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাঁর মাগফেরাত হবে রব্বুলআলামীনেরই কামনা।


যেমন আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘আমি আপনাকে ফাতহে মূবীন দান করেছি, আপনার মাগফেরাতের জন্য।’ খলীল আল্লাহর নিকট দোয়া করেন ‘পুনরুত্থানের দিন আমাকে লাঞ্ছিত করবেন না।’ আর হাবীব বা মাহবুব সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন ‘ওই দিন আল্লাহ্তায়ালা নবীকে লাঞ্ছিত করবেন না।’ হাবীবের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে ‘ওই সকল লোক যারা তাঁর সঙ্গে ইমান এনেছেন।’ 


খলীল তিনি, যিনি বলেছেন, ‘আমি আমার প্রভুর দিকে গমনকারী। অচিরেই তিনি আমাকে পথপ্রদর্শন করবেন।’ আর তিনিই হাবীব যাঁর সম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন, ‘আপনার প্রভু তো আপনাকে বেভুল পেয়েছিলেন। তাই পথ দেখিয়ে 

দিয়েছেন।’ খলীল বলেছেন ‘পরবর্তীদের মধ্যে আমার জন্য সত্য ভাষণ প্রস্তুত করে দিন।’ আর হাবীবের শানে আল্লাহ্তায়ালা নিজেই বলেছেন ‘আমি আপনার আলোচনাকে সমুন্নত করেছি।’ খলীল আল্লাহ্তায়ালার কাছে চেয়েছেন ‘আমাকে জান্নাতে নাঈমের উত্তরাধিকারীদের অন্তর্গত বানিয়ে দিন।’ আর হাবীবের শানে আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন ‘আমি আপনাকে কাউছার দান করেছি।’ খলীল আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন ‘আমাকে এবং আমার সন্তান-সন্তুতিকে মূর্তি পূজা থেকে রক্ষা করুন।’ আর হাবীব সম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহ্তায়ালাতো তোমাদের থেকে, নবীর পরিবারবর্গ থেকে অপবিত্রতা দূর করে দিতে চান এবং তোমাদিগকে খুব ভালোভাবে পবিত্র করে দিতে চান।’ এ সকল আয়াতে কারীমার দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, হাবীবের মহব্বত আর খলীলের খিল্লত এর মর্যাদার মধ্যে তারতম্য আছে। 


মহানবী (ﷺ) এর মর্যাদার আরেকটি দিক হচ্ছে, তিনি নফল নামাজ বসে পড়লে দাঁড়িয়ে পড়ার ছওয়াব লাভ করতেন। কিন্তু অন্যদের বেলায় তা নয়। এমর্মে নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি বসে নামাজ পড়বে, সে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায়কারীর অর্ধেক ছওয়াব পাবে। 


এই হাদীছের প্রকাশ্য অর্থ দ্বারা সাধারণভাবে সকলকে বুঝায়। নবী করীম (ﷺ) কিন্তু ব্যতিক্রম। সহীহ্ মুসলিম শরীফে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, একদা আমি নবী করীম (ﷺ) কে বসে নামাজ পড়তে দেখলাম। নিবেদন করলাম, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমি তো শুনেছি বসে নামাজ আদায়কারীর নামাজ দাঁড়িয়ে আদায়কারীর অর্ধেক। তিনি বললেন, হাঁ। আমার এরশাদ এরকমই। তবে আমি তো অন্য কারও মতো নই। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষ আরেকটি দিক হচ্ছে, আদম (عليه السلام) এর কাল থেকে প্রথম সিঙ্গা ফুৎকার পর্যন্ত দুনিয়াতে যা ঘটেছে এবং ঘটবে, সবকিছুই আল্লাহ্তায়ালা তাঁর হাবীব (ﷺ) কে জানিয়ে দিয়েছেন। এমনকি অতীতের, ভবিষ্যতের সকলের অবস্থা সম্পর্কেও আল্লাহ্তায়ালা তাকে জ্ঞাত করেছেন। আর সেগুলো থেকে কারো কারো অবস্থা তিনি সাহাবা কেরামকেও অবহিত করেছেন। জনৈক আরেফ ব্যক্তি এরকম একটি কিতাব রচনা করেছিলেন যার মধ্যে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, সমস্ত উলুমে এলাহী রসুলেপাক (ﷺ) কে শিক্ষা দান করা হয়েছে। এ কথাটি অবশ্য বাহ্যিকভাবে অনেক দলিল প্রমাণের বিপরীত পরিদৃষ্ট হয়। তবে এর প্রবক্তা কী উদ্দেশ্যে এ কথা বলেছেন, তার হাকীকত আল্লাহ্তায়ালাই ভালো জানেন। 


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 




© | সেনানী এপ্স |

Top