সূরা ফাতহ
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হুজুর পাক (ﷺ) এর প্রতি পরিপূর্ণ নেয়ামতাজী, পূর্ণ কামালীয়াতময় বুযর্গী, কারামাত, বারকাত ও মর্যাদার বর্ণনা এসেছে সূরা ফাতহ এর বিবরণে। এখানে আল্লাহতায়ালা হুজুর পাক (ﷺ) এর প্রশংসায় যে ভূমিকা পেশ করছেন তা এইরূপ এ -
انا فتحنا لك فتحا مبينا-ليغفر لك الله ما تقدم من ذنبك وما تاخر ويتم يعمته عليك ويهديك صراطا مستقيما وينصرك الله نصرا عزيزا-
অর্থঃ নিশ্চয়ই আমি আপনাকে প্রকাশ্য বিজয় দান করেছি এজন্য যে, আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের ত্রুটি বিচ্যুতি সমূহ আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দিবেন এবং তার নেয়ামতে সম্ভার আপনার উপর পরিপূর্ণ করে দিবেন। আর আপনাকে সরল পথ প্রদর্শন করবেন। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা আপনাকে প্রবল সাহায্য প্রদান করবেন। এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হুজুর আকরাম (ﷺ) এর উপর যে সমস্ত আকৃতিগত ও আকৃতি বিহীন বিজয় ও ফয়েযসমূহ, যাহেরী ও বাতেনী কামালাত ও বারকাত বর্ষিত হয়েছে তা সীমাহীন, সংখ্যা ও গণনাবহির্ভূত। এ সমস্ত ফয়েয ও নেয়ামত লাভের একটি দিক হচ্ছে শহর বন্দর সমূহ জয় করা। আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহ তায়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করা, গনীমত সমূহ অর্জন, দ্বীনের দৃঢ়তা অর্জন, উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধি। ইসলামের নির্দেশাদির প্রসার ও সর্বোপরি মক্কা মুয়াযযাম বিজয়। কেননা মক্কা বিজয়ের পর দেখা গেল, আরবের বিভিন্ন দেশ ও বিভিন্ন জনপদের লােকেরা দলে দলে এসে আল্লাহর দ্বীনে দাখিল হতে লাগলো। এবং হুজুর আকরাম (ﷺ) এর দিকে সকলেই ধাবিত হতে লাগলাম। এই সূরায় উক্ত প্রতিশ্রুতি বাণী নবী করিম (ﷺ)কে শুনানাে হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিজয় যে অবশ্যম্ভাবী একথা বুঝানাের উদ্দেশ্য ফেলে মাযী বা অতীত কালের ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে এবং সন্দেহাতীত বিজয়কে বুঝানো উদ্দেশ্যে ফাতহে মুবিন বা প্রকাশ্য বিজয় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যেহেতু এ বিজয় প্রকাশ্যেই সংঘটিত হয়েছিলাে এবং ইসলামের শান শওকত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটা ছিলাে একটি নিশ্চিত বিজয়। তাই আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এর নাম দেয়া হয়েছে ফাতহে মুবীন। ফাতহে মুবীন এর আরেক অর্থ সম্মান ও মহিমা প্রকাশকারী ও দ্বীন ইসলামকে প্রবলকারী বিজয়।
আয়াতে কারিমা
الغفر لك الله ما تقدم من ذنبك وما تاخر
এর তফসীর ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মত ও বক্তব্য রয়েছে। তম্মধ্যে একটি মত এরূপ—হুজুর পাক এর ত্রুটি বিচ্যুতি মাফ করার অর্থ। তার নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে জাহেলী জামানার যা সংঘটিত হয়েছিল। ইমাম সুবকী বলেন, একথাটি পরিত্যাজ্য। কেননা হুজুর পাক (ﷺ) এর জাহেলী যুগে জাহেলী কাজকর্ম করা তাে দূরের কথা জাহেলী হাওয়া পর্যন্ত তার শরীর স্পর্শ করতে পারেনি। এটা সত্য যে, তিনি নবুওয়াতের পূর্বে ও পরে সর্বাবস্থায় মাসুম (নিষ্পাপ) ছিলেন। মুজাহিদ (رحمة الله) বলেন, মাতা খাদ্দামা থেকে মারিয়ায়ে কিবতিয়ার (رضي الله عنه) এর ঘটনা এবং মাতায়াখখারা থেকে হজরত যায়েদ (رضي الله عنه) এর স্ত্রীকে বিবাহ করার ইচ্ছা করার ঘটনা বুঝতে হবে, যা আল্লাহ পাক মাফ করে দিয়েছেন। ইমাম সুবকী বলেন, কথাটা বাতিল। কেননা মারিয়ায়ে কিবতিয়া (رضي الله عنه) এর ঘটনা এবং যায়েদ (رضي الله عنه) এর স্ত্রী সম্পর্কে মূলত কোনাে গােনাহই হয়নি। তাদের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হুজুর পাক (ﷺ) গােনাহু করেছিলেন বলে যারা আকীদা পােষণ করে, তারা অন্যায় করে থাকে। তাফসীরে কাশশাফ যামাখশারী ও তাবিয়াত কিতাবে ইমাম বায়াযাভী বলেছেন, এর অর্থ শাস্তিযােগ্য অপরাধ। ইমাম সুবকী (رحمة الله) বলেন, একথাটিও পরিত্যাজ্য। কেননা আম্বিয়া কেরামের ইসমত হওয়ার ব্যাপারটি সুসাব্যস্ত। তবে হাঁ, মিন যাম্বিকা থেকে উদ্দেশ্য এই হতে পারে যে, এমন সগীরা গুনাহ যা শান ও মর্তবাকে লাঘব করে না। এমতটি নিয়েও মতানৈক্য রয়েছে। মুতাজিলা সম্প্রদায় এমন কি, অনেক অমুতাযিলাও এ মতের সমর্থন করেছেন। আবার কারও কারও নিকট পছন্দনীয় মত এটাই যে, সগীরা গোনাহুও হুজুর পাক (ﷺ) এর শানে নিষিদ্ধ। কেননা আম্বিয়া কেরামের কথা ও কাজের পায়রুবী করার জন্য আমাদেরকে হুকুম প্রদান করা হয়েছে। কাজেই তাদের মাধ্যমে এমন কাজ কেমন করে সংঘটিত হতে পারে যা অশালীন ও অসুন্দর?
হাশভীয়া সম্প্রদায় আম্বিয়া কেরাম সম্পর্কে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে থাকে। তারা কোনােরকম কয়েদ বা সীমাবদ্ধতা ব্যতীতই আম্বিয়া কেরাম থেকে গোনাহ সংঘটিত হওয়া বৈধ মনে করে থাকে। ঐ সমস্ত হাশভীয়া দের নিকট উহা যদিও বৈধ হয়ে থাকে, তবুও তা বিশুদ্ধতার যােগ্যতা রাখে না। কেননা উম্মতের এজমা রয়েছে এ মতের বিপরীতে। আম্বিয়া কেরামগণের জন্য সগীরা গুনাহ করা জায়েজ বলে যারা মনে করে থাকে, তাদের নিকট কিন্তু কোনো পথ নেই, কোনো দলিল নেই। বরং তারা এই আয়াতকে বা এজাতীয় অন্য কোন আয়াতকে গ্রহণ করে থাকে। আর বৈধতার ক্ষেত্রে এই আয়াতের যদি দলিল হিসাবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তার উপযুক্ত উত্তর তারে অতি সুন্দর ভাবে দেওয়া হয়েছে।
সগীরা গুনাহ কি রজিলা বা নিকৃষ্ট ধরনের নয়, এমন গুনাহভনবীগণের জন্য বৈধ কি না? এ সম্পর্কে ইবনে আতিয়া প্রশ্ন উত্থাপন করেন, নিকৃষ্ট নয় এমন সগীরা গুনাহ হুজুর পাক (ﷺ) থেকে সংঘটিত হয়েছিলাে কি? এ প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এখতেলাফও করেছেন। তবে বিশুদ্ধ মত এটাই দিয়েছেন যে, ঐ জাতীয় গুনাহ থেকে কিছুই সংঘটিত হয়নি। ইমাম সুবকী (رحمة الله) বলেন যে, হুজুর পাক (ﷺ) এ জাতীয় কোনাে গােনাহ করেননি, এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে যেয়ে স্বয়ং আল্লাহ রব্বল ইযযত বলেছেন
ما ينطق عن الهوى أن هو الا وحی وحی
কাজেই বাণী ও অবস্থার বিপরীত কোন ধারণা বা সন্দেহ কেমন করে করা যেতে পারে?
এখন হুজুর পাক (ﷺ) এর পবিত্র কার্যাবলী সম্পর্কে আলোচনায় আসা যাক। তার কার্যাবলী সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের ইজমার ভিত্তিতে জানা যায় যে, সকলেই তার অভ্যাস ও আচরণকে হুবহু অনুকরণ করতেন। হুজুর পাক (ﷺ) থেকে যে কোনো কাজ প্রকাশ হতে চাই তা ছােট হােক বা বড় অল্প হোক বা অধিক সাহাবাগণ তার অনুকরণ করতেন। এমনকি হুজুর পাক (ﷺ) নির্জন নিরিবিলিতে যা করতেন, সে সম্পর্কেও অবহিত হওয়ার জন্য সাহাবায়ে কেরাম লালায়িত হয়ে থাকতেন এবং তার অনুকরণ করার চেষ্টা করতেন। চাই হুজুর পাক (ﷺ) সে ব্যাপারে অবহিত হতেন বা নাই হতেন। হুজুর পাক (ﷺ) এর অনুকরণে সাহাবায়ে কেরাম যা করতেন, সে সমস্ত কাজের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা ফিকির করলে চমৎকারভাবে হুজুর পাক (ﷺ) এর আমল এর প্রকৃতি সম্পর্কে জানা সম্ভব। আর যখন কোনাে ব্যক্তি হুজুর আকরম (ﷺ) আহওয়াল মুবারকা সম্পর্কে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অবহিত হয়ে যাবে এবং তার মুশাহাদা হাসিল হয়ে যাবে, তখন সে ব্যক্তির পক্ষে হুজুর পাক (ﷺ) সম্পর্কে উক্তরূপ বাক্য প্রয়োগ করা বা ধারণা করা আদৌ সম্ভব হবে না। এ ধরনের বাক্য প্রয়োগ করতে বা সেরূপ কল্পনা করতেও সে লজ্জাবােধ করবে।
ইমাম সুবকী (رحمة الله) বলেন, হুজুর পাক (ﷺ) কর্তৃক গোনাহ সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে কোনাে আলােচনা যদি না হতাে তা হলে আমি এ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতাম না। উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে যমখশরী যে উক্তি করেছিলেন, আমি তাতে শুধু সন্তুষ্ট নই, বরং তার জন্য আমি আল্লাহপাকের দরবারে ইনসাফ চাই। উপরোক্ত কথাগুলো যামাখশারীর কথাকে খন্ডন করার জন্য ইমাম সুবকী (رحمة الله) বলেছেন। আর তা আল্লামা সুয়ুতী (رحمة الله) আপন গ্রন্থসমূহে উপস্থাপন করেছেন। এছাড়াও তিনি যামাখশারীর প্রতিবাদে আরও কথা বলেছেন। উক্তি প্রতিবাদ মূলক বক্তব্য সংখ্যা এগারোটি, বরং তার চেয়েও অধিক হবে। আর এগুলোকে ইমাম সুবকী (رحمة الله) তার তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, আমি যখন আয়াতে কারীমা (আরবি আয়াত) নিয়ে চিন্তা ভাবনা করি, তার পূর্বাপর অবস্থা সম্পর্কে গবেষণা করি, তখন একটি মাত্র কারণ ছাড়া আর কোনো কারণ আমি দেখতে পাই না যে, আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব (ﷺ) এর শানে একথা কেননা বললেন? সে কারণটি হলাে, এর মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা তার হাবীব (ﷺ) এর তাকরীম করেছেন। এছাড়া এখানে কোনো গুনাহ বলে আমি কিছু কল্পনা করতে পারিনা। ইমাম সুবকী (رحمة الله) বলেন, আমি যখন উক্ত আয়াতের মর্মার্থ এইরূপ বুঝতে পারলাম, তখন ইবন আতিয়ার আমার এই মতের প্রবক্তা দেখতে পেলাম। তিনি বলেন, এই আয়াতের অর্থ তার হুকুম সহকারে হুজুর পাক (ﷺ) এর শরাফত বুযুর্গী প্রকাশ করা ব্যতীত আর কিছুই নয়। এমন গুনাহ বলতে কিছু কল্পনাই করা যায় না। ইবনে আতিয়া (رحمة الله) যে এরূপ যথার্থ মন্তব্য করতে পেরেছে, তা কেবল আল্লাহ তায়ালার তৌফিক সম্ভব হয়েছে।
উপরোক্ত মতামতটি সংক্ষিপ্ত। বিস্তারিত ব্যাখ্যা হবে এরকম, কোন মনিব যদি তার গোলামদেরকে কোন খাছ ও নৈকট্য ভাজন লােকের মাধ্যমে ক্ষমা করতে চান এবং তাদেরকে কিছু পুরস্কার দিতে চান, তখন মনীব সে নৈকট্যভাজন লােকদেরকে এইরপ বলে থাকেন যে, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। তোমাদের পূর্বাপর সমস্ত অপরাধ মাফ করে দিলাম। অথচ মনীবের খুব ভালোভাবে জানা আছে যে, ঐ নৈকট্য ভাজন লােকগুলি কোনকালেই কোন গুনাহ বা অন্যায় অপরাধ করেনি এবং করবেও না। মনীবের এভাবে কথা বলা দ্বারা গােলামদের মর্যাদা বৃদ্ধির ও গৌরবের কারণ হবে সন্দেহ নেই।
কোনাে কোনাে মুফাসসেরীন এরকম বলেন, এই আয়াতে মাগফেরাত শব্দের কেনারা স্বরূপ অর্থ হবে ইসমত। তখন তার অর্থ হবে।
ويعصمك الله فيما تقدم من عمره وفيما تاخر منه
অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা আপনাকে আপনার অতীত ও ভবিষ্যত জীবনকে মাসুম রাখার জন্য ফতহে মুবীন দান করেছেন। এরূপ বক্তব্য অবশ্য চূড়ান্ত পর্যায়ের শিষ্টাচারসম্ভুত।
বালাগাত শাস্ত্র বিদগণ কোরআনে পাকের রীতি পদ্ধতির বালাগতের পর্যায়ভুক্ত হিসেবে পরিগণিত করেছেন। বালাগাত শাস্ত্রের রীতি অনুসারে কোন জিনিসের গুরুত্বহীনতা ও অপ্রতুলতা বোঝানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে মাগফেরাত। ক্ষমা এবং তওবা ইত্যাদি শব্দ। যেমন কিয়ামে লাইলের গুরুত্ব কমিয়ে দিতে গিয়ে আল্লাহপাক বলেন, হে মুসলমানগণ! আল্লাহ তায়ালা জেনেছেন যে, তােমরা কক্ষণও রাতের গণনা করতে পারা না, কাজেই আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানী করে আমাদের উপর মনোনিবেশ করলেন (অর্থাৎ কিয়ামত লাইলকে মাফ করে দিয়েছেন)। এখন কুরআন থেকে যতটুকু তােমাদের জন্য সম্ভব হয় নামাজে ততটুকুই পাঠ করো।
নবী করীম (ﷺ) এর সাক্ষাৎ প্রার্থীদের জন্য হাদিয়া দেয়ার বিধান করা হয়েছিলাে। সাহাবাগণের পক্ষে অনেকের জন্য তা কঠিন হয়ে যাওয়ায় তার হুকুম রহিত করা হলাে। সাহাবীগণের অক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা 'তার' শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান, যখন তোমরা (হাদিয়া দান করতে) পারে না; কাজে আল্লাহ তায়ালা দয়া করে তা মাফ করে দিয়েছেন। আগে ভাগে হাদিয়া প্রেরণ করার বাধ্যবাধকতা রহিত করে দিলেন। রমজান মাসে রাতের বেলা স্ত্রী সহবাস করা নিষিদ্ধ ছিলাে। সাহাবা কেরামগণ তার উপর আমল করতে পারছিলেন না। কাজেই আল্লাহ তায়ালা তার হুকুম রহিত করে দিয়ে ঘােষণা করলেন, এখন থেকে রমজান মাসে রাতের বেলা স্ত্রী সহবাস করা তােমাদের জন্য হালাল করে দেয়া হলাে। সুতরাং তিনি তােমাদের তওবা কবুল করেছেন এবং আমাদেরকে মাফ করে দিয়েছেন, এখন তোমরা তাদের সাথে সহবাস করতে পারো।
মুফাসসিরীন কেরাম এরকম বলেন, আল্লাহ তায়ালা কুরআনে পাকে যেখানে কোনাে নবীর তওবা ও মাগফেরাতের কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানে তাদের থেকে প্রকাশিত ত্রুটি সমূহ উল্লেখ করে দিয়েছে। যেমন হজরত আদম (عليه السلام) সম্পর্কে বলেছেন, আদম (عليه السلام) স্বীয় প্রভুর নাফরমানী করবে। হযরত নূহ (عليه السلام) সম্পর্কে বলেছেন, আমিই তোমাকে নসীহত করছি, তুমি ছিলে অজ্ঞ লােকদের অন্তর্ভুত। হজরত ইউনুস (عليه السلام) এর ঘটনায় বলা হয়েছে, সে তাে ধারণা করেছিলাে আমি বুঝি কক্ষণও তার উপর সক্ষম হবাে না। হজরত দাউদ (عليه السلام) সম্পর্কে বলেছেন, তুমি স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। হযরত মুসা (عليه السلام) এর ঘটনায় বলা হয়েছে فو كزه موسى ا ইত্যাদি। কিন্তু সাইয়্যেদুল মুরসালীন (ﷺ) এর ক্ষেত্রে দেখা গেল যে, আল্লাহ তায়ালা ফাতাহ বা বিজয় কথাটি অগ্রে উল্লেখ করেছেন এবং এরপর অতীত ও ভবিষ্যতের গুনাহ মাফের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সে গুনাহ কি তা কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অপ্রকাশিত রেখে দিয়েছেন।
শায়খ আযীযুদ্দীন আব্দুস সালাম স্বীয় কিতাব নেহায়াতুল সুউল ফিমা সেখিস্মিন তাফাসীর রাসূল কি বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা আমাদের নবী পাক (ﷺ) কে অন্যান্য সমস্ত নবীগণের উপর অনেক দিক দিয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন। এরপর তিনি সে দিক সমূহের মধ্যে থেকে একটি দিকের কথা উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহতায়ালা প্রথমেই হুজুর পাক (ﷺ) এর ভবিষ্যত ও অতীতের সমস্ত গুনাহ খাতা মাফ করে দিয়েছেন বলে খবর দিয়েছেন। অথচ দেখা যায় আল্লাহ তায়ালা আর অন্য কোন নবীকে এরকম কোন খবর প্রদান করেননি। বরং এটা স্পষ্ট কথা যে, তাদের পূর্বে কোনাে প্রকারেই অবহিত করা হয়নি। হাশরের ময়দানে যখন তাদের উম্মতগণ বিভিন্ন সময়ে তাদের কাছে শাফাআতের জন্য ধনা দিবে, তখন তারা আপন আপন ভুলভ্রান্তির কথা প্রকাশ করবেন। আর সে স্থানের ভয়াবহতার কারণে তখন কেউ শাফায়াত করার মতো কোনো রূপ ইচ্ছা ও আগ্রহ প্রকাশ করবেন না। অবশেষে সমস্ত মানুষ যখন উক্ত মাকামে হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে শাফাআত করার জন্য দরখাস্ত নিয়ে আসবে, তখন তিনি বলবেন, হাঁ, এটা আমারই কাজ।
উক্ত আয়াতে কারীমার বিস্তারিত অর্থ এই যে, হকতায়ালা হুজুর পাক (ﷺ) এর জন্য প্রথমে ফাতহে মুবীন সাব্যস্ত করে নিলেন। এরপর গােনাহর মাগফেরাতের উল্লেখ করলেন। অতঃপর নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করে দেয়া, সীরাতুল মুস্তাকিমের হেদায়েত প্রদান করা, নসরে আযীয বা প্রবল বিজয় দান করা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। সুতরাং সমস্ত থেকে এটি সাব্যস্ত হলে যে, আয়াতের বর্ণনা উদ্দেশ্য গুনাহ মাফ করা নয়, বরং তার বিপরীত (অর্থাৎ গােনাহ সংঘটিত হতে না দেয়া)। বুঝ ও আল্লাহ তায়ালার কাছে সার্বিক বোঝার জন্য তাওফিক চাও। এসবই আল্লামা সুয়ুতী (رحمة الله) আলোচনা করেছেন। এরপর আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, তার নেয়ামত সমূহ আপনার উপর পরিপূর্ণ করে দেয়ার জন্য বিজয় দান করেছি। এখানে অস্পষ্টতা থাকা উচিত নয় যে, ফাযায়েল, কামালাত, কারামাত ও বারকাত এর যত প্রকার রয়েছে, তা সবই এই আয়াতে সন্নিবেশিত আছে। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে হুজুর পাক (ﷺ) কে দেয়া খাছ ও আম নেয়ামতসমূহের মধ্যে যতটুকু আলােচনা করা যায় বা কল্পনা ও খেয়াল করা যায়, তা কেবল কল্পনা ও ধারণাই করা যাবে। সংখ্যায় গণনা করা যাবেনা। উক্ত নেয়ামতের বহিঃপ্রকাশ বা বর্ণনায় যতটুকু পাওয়া যায়, তাতাে মােটামুটি ও সংক্ষিপ্ত এক অবস্থা মাত্র। তার তফসীল বা বিস্তারিত বর্ণনা করা মানুষের ক্ষমতার বাইরে।
যেমন কবি বুসিরীর ভাষায়—
فان فضل رسول الله ليس له
حد فيعرب عنه ناطق بفم
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ফযীলত ও মর্যাদার এমন কোনাে সীমা নেই যাকোন ভাষাভাষী তার ভাষার মাধ্যমে বর্ণনা করতে পারে। এ মর্মে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, হে রাসূল! আপনি বলে দিন যে, সাগরের জলরাশি যদি কালি হয় আমার রবের কলেমা লিপিবদ্ধ করতে, তাহলে সে সাগর শুকিয়ে যাবে কিন্তু আমার প্রভুর কলেমা লেখা শেষ হবে না। এর সঙ্গে যদি পুনরায় ঐ পরিমাণ সাগরও বানিয়ে নেয়া হয়, তবু সম্ভব হবে না। জমিনে যত বৃক্ষ আছে সবই যদি কলম হয় আর সাত সাগরের জলরাশি যদি কালি হয় (আর তা দিয়ে আল্লাহ তায়ালার কলেমা লিপিবদ্ধ করা হয়) আল্লাহর কলেমা সমাপ্ত হবে না।
মুহাকেকীনগণের নিকট উক্ত কালেমার অর্থ আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে যে সমস্ত ফযীলত, কামালাত, হাকীকত ও মারেফত পবিত্র দরবারের বান্দাগণের নিকট বর্ষিত হয়। যেমন আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সুফিয়ায়ে কেরাম বিশেষ করে সাইয়্যেদে আম্বিয়া ও সনদে আসফিয়া হজরত মোহাম্মদ মােস্তফা (ﷺ) এর উপর যা বর্ষিত হয়। উক্ত কলেমার অর্থ তাই। নতুবা আল্লাহ তায়ালার যত সিফাত ও শুয়ুনাত রয়েছে তার তার কোনো মিছাল হতে পারে না। দৃষ্টান্ত হওয়া থেকে তা সম্পূর্ণ পবিত্র। তার কোনাে দৃষ্টান্ত হতেই পারে না। আম নেয়ামতের বর্ণনা করে তারপর দুনিয়া ও আখেরাতের সমন্বিত নেয়ামত সমূহের বর্ণনা করলেন আল্লাহপাক। এরপর তিনি বিশেষত্বের সাথে দুটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করলেন। তম্মধ্যে একটি হলাে সীরাতে মুস্তাকিমের হেদায়েত। আর এটি হচ্ছে নেয়ামতের মূল সমূহের অন্যতম এবং সার্বিক কৃতকার্যতার ফল দানকারী। কেননা রেসালতের মূল উদ্দেশ্য এটাই। আর অপর নেয়ামতটি হচ্ছে দুনিয়াবী। অবশ্য এটার উদ্দেশ্যও আগেরটির মতে দ্বীনই। আর এ নেয়ামতটি জগতকে সংশোধিত রাখা এবং শৃঙ্খলার সাথে সৃষ্টিজগত পরিচালনা করার জন্য জরুরী। সুতরাং এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
(ফতহে মুবিন দান করলেন) আপনাকে সীরাতে মুস্তাকীম প্রদর্শন করার জন্য এবং আল্লাহতায়ালা এজন্য আপনাকে এক প্রবল সাহায্য দান করবেন। ইবন আতা বলেন, ঐ অবস্থায় হুজুর আকরাম (ﷺ) এর জন্য বিভিবিজয়ন্ন বড় বড় নেয়ামতসমূহ সমন্বিত করা হয়েছিল। তার মধ্যেঃ —
প্রথমত— হচ্ছে প্রকাশ্য বিজয় যা আল্লাহপাকের দরবারে হুজুর পাক (ﷺ) এর প্রার্থনা কবুলের নিদর্শনস্বরূপ হয়েছিলাে।
দ্বিতীয়—মাগফেরাত যা মহব্বতের আলামত সমূহের অন্যতম।
তৃতীয়—নেয়ামত পরিপূর্ণ করে দেয়া, যা কাউকে বিশেষিত করার নিদর্শন সমূহের অন্তর্গত।
চতুর্থ—হেদায়েত প্রদান করা যা বেলায়েতের নিদর্শন সমূহের অন্তর্গত। সুতরাং মাগফেরাত কথাটি সমস্ত দোষত্রুটি থেকে পবিত্র করার দিকে ইঙ্গিত বহন করে থাকে। আর সেখানে নেয়ামত পরিপূর্ণ করার অর্থ রেসালাতের প্রচার প্রসার পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার যোগ্যতা দান করা। হেদায়েত ও মুশাহাদা দিকে দাওয়াত দেয়ার যােগ্যতা প্রদান করা। এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা হুজুর পাক (ﷺ) এর শান এতাে বুলন্দ করে দিলেন যে, হক তায়ালার নৈকট্য লাভের দিক দিয়ে এতাে উঁচু মর্যাদা আর কারও বেলায় কল্পনাও করা যায় না। আল্লাহ তায়ালা তাকে এতাে উঁচু স্তরে নিয়ে গেলেন যেখানে আল্লাহ পাক এরূপ ঘােষণা প্রদান করলেন—
ان الذين يبايعونك انما یبیعون الله
يد الله فوق ای دهم
যারা আপনার কাছে বায়াত হয়েছে নিশ্চয়ই তারা আল্লাহপাকের কাছে বায়াত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার হাত (কুদরত, রহমত) তাদের হাতে উপর। আল্লাহ তায়ালা এরূপ আরও ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রাসূল (ﷺ) এর আনুগত্য করলো, সে যেন আল্লাহ তায়ালারই আনুগত্য করলো। যদিও উক্ত আয়াতের মর্মার্থ কি আহলে আরব রূপক অর্থ হিসাবে ধরে থাকেন। তবে আহলে হাকীকত যারা তারা অবশ্য জানেন এই আয়াতের মধ্যে কি রহস্য বিদ্যমান। আল্লাহপাক অধিক অবগত।
উপরোক্ত নেয়ামতসমূহের বর্ণনা পর আল্লাহ তায়ালা মুমিনণের উপর যে আত্মিক প্রশান্তি ও স্বস্তি নাযিল করেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। সূরার শেষের দিকে হুজুর আকরাম (ﷺ) এর সোহবতে ফজিলত যে সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম ধন্য হয়েছেন, আল্লাহতায়ালা তাদের প্রশংসা করেছেন। মহব্বতের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম এরকমই। সাহাবায়ে কেরাম কাফের সম্প্রদায়ের প্রতি কঠোরতা অবলম্বন করেছেন, তাদের মত ও পথের বিরুদ্ধে চলেছেন। আর মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে যে প্রেম প্রীতি ও মহব্বতের আচরণ করেছেন তাতাে ছিলাে দ্বীন ও মিল্লাতের শৃংখলার জন্যই। কাজেই আল্লাহতায়ালা তাদের প্রশংসা করেছেন এবং তাদের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যগুলিকে 'ইউহিব্বুহুম ওয়া ইউহিব্বুনাহুম' 'আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মহব্বত করেন আর যারা আল্লাহ তায়ালাকে মহব্বত করেন' আয়াত আলােকে সুস্পষ্ট করেছেন। তাদের প্রশংসায় সূরা মায়েদাতেও উল্লেখ হয়েছে, তারা মুমিনগণের প্রতি বিনম্র আর কাফেরদের প্রতি কঠোর।' তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে মাগফেরাত ও মহান পুরস্কার প্রদানের ওয়াদা করা হয়েছে। সব কিছু আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ ও হুজুর পাক (ﷺ) এর ফযীলত ও মর্যাদা বুঝানাের জন্য বর্ণনা করা হয়েছে।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]
© | সেনানী এপ্স |