ফেরেশতার উপর মানুষের মর্যাদা
ফেরেশতাকুলের উপর মানব জাতির প্রাধান্য প্রসঙ্গে জমহুরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতবাদ হচ্ছে, খাওয়াসসুল বাশার বা বিশেষত্বপ্রাপ্ত মানব অর্থাৎ আম্বিয়া (عليه السلام) খাওয়াসসুল মালায়েকা বা বিশেষত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতা তথা হযরত জিব্রাইল (عليه السلام), হযরত মিকাইল (عليه السلام), হযরত ইসরাফীল (عليه السلام), হযরত আজরাইল (عليه السلام) এবং আরশ বহনকারী ফেরেশতা বৃন্দ, মুকাররবীন ফেরেশতাবৃন্দ ইত্যাদি ফেরেশতাগণের উপর প্রাধান্য রয়েছে।
মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাব এরকম ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এসম্পর্কে আকায়েদে নসফি এবার এরকম, মানবজাতির রাসূলগণ ফেরেশতাবৃন্দের রসূলগণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ফেরেশতাদের রাসূল বলতে ফেরেশতাগণের ঐ জামাআত যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা সকলেই ফেরেশতাকুলের জন্য রাসূল। কেননা এ রাসূলগণ ফেরেশতাবৃন্দের মধ্যে আহকামে ইলাহীর সংবাদ প্রদান করে থাকেন তালিম দিয়ে থাকেন। আর যারা আওয়ামুল বাশার অর্থাৎ আউলিয়া, আতকিয়া, ও সুলাহা, তারা আওয়ামুল মালায়েকা (যারা ফেরেশতাকুল রাসূল নন) এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
শুআবুল ঈমান মানুষের মধ্যে যারা গােনাহগার, ফাসেক তাদেরকে আওয়ামুল বাশার থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। উক্ত কিতাবের বক্তব্য এখানে উদ্ধৃত হলাে। সেখানে বলা হয়েছে, ফেরেশতা এবং মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পূর্বেকার এবং অধুনাকালের জ্ঞানীগণ বিতর্ক করে থাকেন। কাজেই এক্ষেত্রে এই সমাধানই কাম্য যে, মানুষের মধ্যে যারা রাসূল তারা ফেরেশতাগণ রাসুলের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। জমহুরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআত বলে থাকেন যে, আশআরী সম্প্রদায়ের কেউ কেউ ফেরেশতাকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানে বিশ্বাসী। কাযী আবু বকর বাকেল্লানী যিনি এই মাযহাবের উত্তম কামেল ব্যক্তি এবং শায়েখ আবুল আশআরী (رحمة الله) এর শাগরেদ তার নিকটও এ মতটি পছন্দনীয়। আব্দুল্লাহ হালীমীও এ মতের দিকে রয়েছেন। ইমাম গাযযালীর বক্তব্য থেকেও কোনাে কোনাে স্থানে এ ধরনের মতের আভাস পাওয়া যায়। কারও কারও মাযহাব আবার এরকম যে, নিছকতা ও নৈকট্যের দিক দিয়ে ফেরেশতাগণ উত্তম। আর ছওয়াবের পরিমাণের দিক দিয়ে মানুষ উত্তম। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত যে মানুষকে উত্তম বা শ্রেষ্ঠ বলে থাকেন, সেও ছওয়াবের পরিমাণের দিক দিয়েই। যেমন রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাহাবীগণ সম্পর্কে বলা হয়েছে।
শায়খ তাজুদ্দীন সুবকী (رحمة الله) যিনি শাফেয়ী মাযহাবের আলেমগণের ভিতর উঁচু মর্যাদার অধিকারী একজন আলেম— তিনি বলেন, কোনাে ব্যক্তি যদি শ্রেষ্ঠত্ব প্রসঙ্গে নিজকে সংকটাপন্ন না করে অর্থাৎ ফেরেশতা ও মানুষের মধ্যে কাউকেই প্রাধান্য না দেয়, তাহলে আমি আশাবাদী যে কিয়ামতের দিন এ ব্যাপারে তাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসাই করা হবে না।
ফেরেশতাবৃন্দের মধ্যেও পারস্পরিক মর্যাদার তারতম্য রয়েছে। তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন হজরত জিব্রাইল (عليه السلام)। তাঁকে রুহুল আমীন বলা হয়ে থাকে। তিনি এলেম বহিঃপ্রকাশকারী এবং ওহী বহনকারী। তার পরে আরও তিনজন ফেরেশতা রয়েছেন। তারা অন্যান্য ফেরেশতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। রসূলগণ নবীগণের চাইতে শ্রেষ্ঠ। আবার কোন কোন রাসূল অপর রাসূলের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। হুজুর আকরম মোহাম্মদ মােস্তফা আহমদ মুজতবা (ﷺ) সমস্ত আম্বিয়া মুরসালীনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তিনি সাইয়্যেদুল মুরসালীন বা নবীগণের সরদার। খাতামুন্নাবিয়্যীন বা নবীগণের সিলমোহর এবং সমস্ত মাখলুকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের সংখ্যার ব্যাপারেও মতানৈক্য রয়েছে। এ সম্পর্কে হজরত আবু যর (رضي الله عنه) এর হাদীস খানা উল্লেখযােগ্য। যে হাদীছখানা ইবন মারদুভী স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। হজরত আবু যর (رضي الله عنه) বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ আম্বিয়া কেরামের সংখ্যা কতাে? ছজুর পাক (ﷺ) বললেন, এক লক্ষ চব্বিশ হাজার। আমি আর করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ রসূলের সংখ্যা কত? তিনি বললেন, তিনশ' তের। (প্রকৃত এলেম আল্লাহতায়ালার নিকট)।
যেসমস্ত নবীর নাম কুরআনে কারীমে উল্লেখ আছে, তারা হচ্ছেন হযরত আদম (عليه السلام), হজরত ইদ্রিস (عليه السلام), হজরত নূহ (عليه السلام), হজরত হুদ (عليه السلام), হজরত সালেহ (عليه السلام), হজরত ইব্রাহিম (আ), হজরত লুত (عليه السلام), হজরত ইসমাইল (عليه السلام), হজরত ইসহাক (عليه السلام), হযরত ইয়াকুব (عليه السلام), হজরত ইউসুফ (عليه السلام), হজরত আইয়ুব (عليه السلام), হজরত শােআয়েব (عليه السلام), হজরত মুসা (عليه السلام), হজরত হারুন (عليه السلام), হজরত ইউনুস (عليه السلام), হজরত দাউদ (عليه السلام), হজরত সুলায়মান (عليه السلام), হজরত ইলইয়াস (عليه السلام), হজরত আলইয়াসা (عليه السلام), হযরত যাকারিয়া (عليه السلام), হজরত ইয়াহইয়া (عليه السلام), হজরত ঈসা (عليه السلام) ও সাইয়্যেদুল মুরসালীন মোহাম্মদ মােস্তফা আহমদ মুজতবা (ﷺ)।
অধিকাংশ মুফাসসিরীন মতে যুলকিফল একজন নবী। কুরআনে মজীদে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ফরমান, এমন আছে যাদের বর্ণনা আমি আপনার কাছে পেশ করেছি, আবার এমনও আছে যাদের বর্ণনা আমি আপনার কাছে পেশ করিনি। এ থেকে বুঝা যায় যে, হুজুর আকরম (ﷺ) এর কাছে সমস্ত নবীগণের বর্ণনা প্রদান করা হয়নি।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]
© | সেনানী এপ্স |