কর্মশক্তি ও চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগানো
🖋Nusaifa Jannat Tahera
মানুষের চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তি আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। এই নিআমতের শোকরগোযারি করা কর্তব্য। শোকরগোযারির প্রথম ও বড় দিক হচ্ছে, নিআমতটি যে আল্লাহর দান এই বিশ্বাস রাখা। মানুষের মেধা, মনন, চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তি মানুষের নিজের সৃজন নয়, বিনা স্রষ্টায় সৃষ্ট বস্তুও নয়, তা আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহর দান। এই দান স্বীকার করা শোকরগোযারির প্রথম শর্ত।
আমাদের মনীষীগণ শোকর সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তাতে এ বিষয়টি স্পষ্ট।
আল্লামা ইবনে মানযূর (রাহঃ) শোকরের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে-
الشّكْرُ: عِرْفانُ الإِحسان ونَشْرُه.
শোকর হচ্ছে অনুগ্রহ উপলব্ধি করা এবং তা প্রচার করা। -লিসানুল আরব ৪/২৩০৫
আল্লামা ফাইরোযাবাদী (রাহঃ) বলেন, শোকর পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় : শোকরকারী যার শোকর করছে তার প্রতি বিনীত হওয়া, তার প্রতি প্রীতি ও ভালবাসা পোষণ করা, তার অনুগ্রহ স্বীকার করা, তার প্রশংসা করা এবং প্রদত্ত বিষয়টিকে তার অপছন্দের ক্ষেত্রে ব্যবহার না করা। এর কোনো একটি না থাকলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে শোকর পূর্ণ হয় না। -বাসাইরু যাবিত তাময়ীয ৩/৩৪, ৩৩৪
কুরআন মাজীদের পাতায় পাতায় আল্লাহর নিআমতসমূহ স্মরণ করানো হয়েছে এবং জানানো হয়েছে যে, মানুষের যা কিছু প্রাপ্তি সব আল্লাহর দান-
وَمَا بِكُمْ مِّنْ نِّعْمَةٍ فَمِنَ اللّٰهِ
তোমাদের মাঝে যে নিআমত আছে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। -সূরা নাহল: ৫৩
আমাদের সচেতন হতে হবে যে, আমাদের চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তি আল্লাহর দান। এই উপলব্ধি আমাদের আল্লাহমুখী হতে এবং চিন্তা ও শক্তিকে সঠিকভাবে সঠিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে সহায়তা করবে।
আল্লাহর এই দানকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। এই দানকে অবহেলা করা, এই শক্তি ও যোগ্যতাকে ব্যবহার না করা কিংবা অন্যায় ক্ষেত্রে ব্যবহার করা না-শোকরির বিভিন্ন রূপ। কাজেই একজন মুমিন ঈমানের প্রেরণা থেকেই যে বিষয়গুলো অর্জন করবেন তা হচ্ছে-
👉ক. নিজের চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তিকে আল্লাহপ্রদত্ত যোগ্যতা ও আল্লাহর নিআমত বলে বিশ্বাস করবেন।
👉খ. এই গুণ ও যোগ্যতার বিষয়ে অবহেলা করবেন না এবং একে অকার্যকর করবেন না।
👉গ. অন্যায় ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করবেন না।
👉ঘ. সত্য-ন্যায়ের ক্ষেত্রে এবং শরীয়তসম্মত উপকারী ক্ষেত্রগুলোতে তা ব্যবহার করবেন।
হাদীস শরীফে কী তাকীদের সাথে এই বিষয়টি শেখানো হয়েছে!
বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْمُؤْمِنُ الْقَوِيّ خَيْرٌ وَأَحَبّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضّعِيفِ، وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ، احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ، وَاسْتَعِنْ بِاللهِ وَلَا تَعْجَزْ، وَإِنْ أَصَابَكَ شَيْءٌ، فَلَا تَقُلْ لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا، وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ، فَإِنّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشّيْطَانِ.
দুর্বল মুমিন অপেক্ষা সবল মুমিন শ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়। (তবে) প্রত্যেকের মাঝেই কল্যাণ আছে। তোমাকে যা উপকার দিবে সে বিষয়ে লালায়িত হও, আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো। অক্ষম অকর্মণ্য হয়ো না। কোনো (অবাঞ্ছিত) বিষয়ে আক্রান্ত হলে বলো না- যদি আমি এই করতাম তাহলে এই এই হত; বরং বলবে, আল্লাহর ফয়সালা; তিনি যা চান তা-ই করেন। কারণ, ‘যদি’ কথাটা শয়তানের কাজের পথ খুলে দেয়।” -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৬৪
একটু মন দিয়ে চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, এই হাদীসে চিন্তা ও কর্মশক্তিকে কাজে লাগানোর কী গভীর শিক্ষা আছে। একই সাথে কতইনা ভারসাম্যপূর্ণভাবে গোটা বিষয়টি উম্মতের চিন্তা-চেতনায় উপস্থিত করা হয়েছে! বলা বাহুল্য হবে না যে, এটি একমাত্র নবী-শিক্ষারই বৈশিষ্ট্য। চলুন, হাদীস শরীফের কথাগুলো একটি একটি করে বোঝার চেষ্টা করি।
📓প্রথম কথা :
الْمُؤْمِنُ الْقَوِيّ خَيْرٌ وَأَحَبّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضّعِيفِ، وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ .
দুর্বল মুমিন অপেক্ষা সবল মুমিন শ্রেষ্ঠ ও আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়। তবে উভয়ের মাঝেই কল্যাণ আছে।
এখানে প্রথমে বুঝতে হবে, ‘দুর্বলতা’ ও ‘সবলতা’র দিকগুলো। হাদীসের ভাষ্যকারগণ বিভিন্ন দিক আলোচনা করেছেন। একেক জনের আলোচনায় একেকটি দিক উঠে এসেছে।
ইমাম নববী (রাহঃ) বলেন-
المراد بالقوة هنا عزيمة النفس والقريحة في أمور الآخرة فيكون صاحب هذا الوصف أكثر إقداما على العدو في الجهاد وأسرع خروجا إليه وذهابا في طلبه وأشد عزيمة في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر والصبر على الأذى في كل ذلك واحتمال المشاق في ذات الله تعالى وأرغب في الصلاة والصوم والأذكار وسائر العبادات وأنشط طلبا لها ومحافظة عليها ونحو ذلك.
এখানে কুওত ও শক্তি অর্থ, আখিরাতের বিষয়াদিতে উদ্যমী ও কর্মতৎপর স্বভাব। এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তি দুশমনের সাথে জিহাদে অধিক আগুয়ান হয়, অন্যদের আগে বের হয় ও দ্রুত অগ্রসর হয়। আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারের ক্ষেত্রে এবং এইসকল বিষয়ে কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করা ও আল্লাহর জন্য কষ্ট ও শ্রম স্বীকার করার ব্যাপারে অধিক শক্তি-সাহসের পরিচয় দেয়। সালাত, সাওম, যিকির-অযীফা ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে সে হয় বেশি আগ্রহী ও তা পালনে বেশি তৎপর এবং ধারাবাহিকতা রক্ষায় অধিক সক্ষম ইত্যাদি। (দ্র. শরহে মুসলিম, নববী)
ইমাম নববী (রাহঃ) যে শক্তির কথা বলেছেন তা মূলত চিত্ত ও স্বভাবের শক্তি। ভালো কাজে উদ্যম, উদ্দীপনা। এই শক্তির অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমে এমন এমন কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়ে থাকেন, যা তার চেয়ে বহু গুণ বেশি দৈহিক শক্তির অধিকারী ব্যক্তির পক্ষেও সম্ভব হয় না।
কর্মক্ষেত্রে এই চিত্তশক্তির ফলাফল- জিহাদ ও আমর বিল মারূফ-নাহি আনিল মুনকারের বিস্তৃত অঙ্গনের বিভিন্ন কাজে উদ্যম ও সাহসিকতার সাথে অগ্রসরতা। পাশাপাশি ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-তিলাওয়াত, ইসলাহে নফস ইত্যাদি বিষয়েও উদ্যমী ও তৎপর হওয়া। বলা বাহুল্য যে, এ প্রত্যেকটি কাজই আলাদাভাবে কর্মশক্তির একেকটি উদাহরণ।
ইমাম নববী (রাহঃ) এই হাদীসের ব্যাখ্যায় أمور الآخرة বা ‘আখিরাতের বিষয়াদি’ বলে যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন তাকে সঠিকভাবে বোঝা প্রয়োজন। সঠিকভাবে বুঝলে হাদীসের মর্মের বিস্তৃতি ও গভীরতা বোঝাও সম্ভব হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মুমিন জীবনের সকল কাজই ‘উমূরে আখিরাহ’ বা আখিরাতের কাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যদি তা আল্লাহ ও রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয় এবং শরীয়তের বিধান অনুসারে হয়।
মুমিনের জীবন তো শরীয়তের বিধান অনুসারেই হতে হবে। এটা তার কাছে তার ঈমানের দাবি। ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে আয়-উপার্জন, লেনদেন, দাম্পত্য, সামাজিকতা, শিক্ষা-দীক্ষা, পর্ব-উৎসব সব কিছুই ‘উমূরে আখিরাহ’ বা আখিরাতের বিষয়াদির প্রশস্ত ক্ষেত্র। কারণ এই সবক্ষেত্রেই আছে শরীয়তের বিধি-বিধান, শিক্ষা ও নির্দেশনা।
তেমনি জীবনের সকল অবস্থা- সুখ-দুঃখ, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, সুস্থতা-অসুস্থতা, সফলতা-ব্যর্থতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-নিরানন্দ ইত্যাদি সবই ‘উমূরে আখিরাহ’-আখিরাতের বিষয়াদির ক্ষেত্র। এই সকল অবস্থার বিশেষ বিধান পালনের মাধ্যমে আখিরাতের সঞ্চয় সমৃদ্ধ হয়।
রোগ-শোক, বিপদাপদ, ভীতি-শঙ্কা প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলোতেও আছে মুমিনের জন্য বিশ্বাসগত ও কর্মগত নানা নির্দেশনা, যা পালন করা দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ ও সাফল্যের উপায়। কাজেই ইমাম নববী রাহ.-এর ‘উমূরুল আখিরাহ’ বা ‘আখিরাতের বিষয়াদি’ শব্দটিকে দুনিয়ার কল্যাণকর ও শরীয়ত অনুমোদিত কাজকর্মে অনীহা ও অলসতা প্রদর্শনের পক্ষে যুক্তি হিসেবে নয়; বরং এইসকল কাজে উদ্যম ও তৎপরতার পাশাপাশি সেগুলোকে সঠিক নিয়ত ও সঠিক কর্মপন্থার মাধ্যমে আখিরাতের কাজে পরিণত করার ইসলামী চেতনাই গ্রহণ করতে হবে।
তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সাধারণ ‘মোবাহ’ বা ‘বৈধ’ পর্যায়ের কাজকর্মের চেয়ে শরীয়তের ‘মামূরাত’ বা ‘করণীয়’ কাজের গুরুত্ব অনেক বেশি। আর সেকারণে মানুষের চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তি ব্যবহারের অগ্রগণ্য ক্ষেত্রও সেটি।
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা সিন্দির আলোচনায় আরো কিছু দিক এসেছে। সুনানে ইবনে মাজাহর টীকায় তিনি লেখেন-
قَوْلُهُ (الْمُؤْمِنُ الْقَوِيّ) أَيْ عَلَى أَعْمَالِ الْبِرِّ وَمَشَاقِّ الطّاعَةِ، وَالصّبُورُ عَلَى تَحَمّلِ مَا يُصِيبُهُ مِنَ الْبَلَاءِ، وَالْمُتَيَقِّظُ فِي الْأُمُورِ الْمُهْتَدِي إِلَى التّدْبِيرِ وَالْمَصْلَحَةِ بِالنّظَرِ إِلَى الْأَسْبَابِ وَاسْتِعْمَالِ الْفِكْرِ فِي الْعَاقِبَةِ وَيُؤَيِّدُهُ مَا رَوَى أَبُو دَاوُدَ فِي كِتَابِ الْقَضَاءِ عَنْ عَوْفِ بْنِ مَالِكٍ أَنّهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَضَى بَيْنَ رَجُلَيْنِ فَقَالَ الْمَقْضِيّ عَلَيْهِ لَمّا أَدْبَرَ حَسْبِي اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ فَقَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنّ اللهَ تَعَالَى يَلُومُ عَلَى الْعَجْزِ وَلَكِنْ عَلَيْكَ بِالْكَيْسِ، وَالْكَيْسُ بِفَتْحِ الْكَافِ هُوَ التّيَقّظُ فِي الْأُمُورِ.
‘সবল মুমিন’ অর্থ, যে ভালো কাজ ও ইবাদত-বন্দেগীতে শ্রম স্বীকারে সমর্থ এবং বিপদাপদ সহ্য করতে সক্ষম। যে জীবনের কাজ-কর্মে সজাগ ও যথার্থ পন্থা ও উপযুক্ত উপায়-উপকরণ ব্যবহারে পারদর্শী এবং পরিণাম সম্পর্কে দূরদর্শী। এই অর্থের সমর্থন পাওয়া যায় আবু দাউদের একটি হাদীস থেকে, যা সুনানে আবু দাউদের কাযা পরিচ্ছেদে হযরত আওফ ইবনে মালিক রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই ব্যক্তির মাঝে একটি বিচারে রায় প্রদান করলেন। রায় যার বিরুদ্ধে গেল তিনি যেতে যেতে বললেন-
حسبى الله ونعم الوكيل
(অর্থাৎ আল্লাহই আমার জন্যে যথেষ্ট, তিনিই উত্তম কর্মবিধায়ক)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাকে বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা অকর্মণ্যতা পছন্দ করেন না। তোমার কর্তব্য কাজকর্মে সতর্কতা অবলম্বন করা।’
আল্লামা সিন্দি (রাহঃ) সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত হাদীসের আলোকে আলোচ্য হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় শেষ যে দিকটি উল্লেখ করেছেন সেক্ষেত্রে বর্তমান মুসলিম-সমাজে ছোট-বড় অনেক প্রকারের গাফলতি রয়েছে। অনেকে দৈনন্দিন জীবনের ও পেশাগত জীবনের সাধারণ কাজকর্মে চৌকশ হওয়াকে দুনিয়াবী বিষয় মনে করেন। অথচ এটা সবক্ষেত্রে দুনিয়াদারি নয়; হাদীস শরীফে যে কোনো কাজ নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গর্হিত ও না-জায়েয কাজে লিপ্ত হওয়া মুমিনের শান নয়। না-জায়েয কাজ তো করাই যাবে না, সেখানে নিখুঁত-অনিখুঁতের প্রশ্নই অবান্তর। যেসকল কাজ শরীয়তে অনুমোদিত এবং যাতে মুমিনের সময় ব্যয় হবে, সাধ্যমত ঐ কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা ইসলামের শিক্ষা। হাদীস শরীফের ইরশাদ-
إِنّ اللهَ يُحِبّ إِذَا عَمِلَ أَحَدُكُمْ عَمَلًا أَنْ يُتْقِنَهُ.
তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজ করবে তখন তা ভালোভাবে করা আল্লাহ পছন্দ করেন। -মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৪৩৮৬; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী ৮৯৭; শুআবুল ঈমান, বাইহাকী হাদীস ৫৩১২
হাদীসের ভাষ্যকারগণ এই হাদীসের যে ব্যাখ্যা করেছেন তাতে ইবাদত-বন্দেগী ও সাধারণ কাজকর্ম সবই অন্তর্ভুক্ত।
আল্লামা মুনাভী (রাহঃ) এই হাদীসের ব্যাখ্যায় লেখেন-
فعلى الصانع الذي استعمله الله في الصور والآلات والعدد مثلا أن يعمل بما علمه الله عمل إتقان وإحسان بقصد نفع خلق الله الذي استعمله في ذلك ولا يعمل على نية أنه إن لم يعمل ضاع ولا على مقدار الأجرة بل على حسب إتقان ما تقتضيه الصنعة...
অনুবাদ : যাকে আল্লাহ কারিগর বানিয়েছেন এবং বিভিন্ন বস্তুসামগ্রীর নির্মাণে নিয়োজিত করেছেন তার কর্তব্য, আল্লাহপ্রদত্ত বিদ্যা ও কুশলতা আল্লাহর সৃষ্টির সেবার উদ্দেশ্যে নিখুঁতভাবে ব্যবহার করা। এই উদ্দেশ্যে নয় যে, কাজ না করলে সে ধ্বংস হয়ে যাবে কিংবা পারিশ্রমিক অনুপাতে কাজ করবে; বরং কাজটি যে পর্যায়ের যত্ন দাবি করে সে অনুযায়ী কাজ করবে। -ফয়যুল কাদীর, ২/২৮৬, হাদীস ২৭৬১, ২৭৬২
বর্তমান সময়ের একজন বিখ্যাত আরব লেখক শায়খ মুহাম্মাদ আল গাযালী বলেন-
إن الإحسان ليس علما عاديا ولا عملا عاديا، إنما هو الشأو البعيد، الذى تبلغ الأشياء فيه تمامها، وتزهى فيه بجودتها ونقاءها.
والمسلم مخاطب بنشدان هذه المنزلة فى كل ما يمس من عمل. العادات، والعبادات فى ذوقه وفقهه سواء...
অনুবাদ : (ইসলামে ‘ইহসান’ কাম্য) কিন্তু ‘ইহসান’ মামুলী জ্ঞান বা মামুলী ধরনের কাজের নাম নয়। ইহসান হচ্ছে যে কোনো বিষয়কে পূর্ণতায় পৌঁছানো এবং নিখুঁত ও উন্নত করে সম্পন্ন করা। মুসলিম সমস্ত কাজেই এই পর্যায়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে- এটাই কাম্য। জাগতিক কাজকর্ম এবং ইবাদত-বন্দেগী দুটোই এক্ষেত্রে তার কাছে সমান। -আলজানিবুল আতিফী মিনাল ইসলাম ১/৫৫
দ্বিতীয় বাক্য "وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ"
তবে এদের প্রত্যেকের মাঝেই আছে কল্যাণ। অর্থাৎ সবল মুমিন ও দুর্বল মুমিন উভয়ই কল্যাণের অধিকারী।
ইমাম নববী (রাহঃ) বলেন-
"لاشتراكهما في الإيمان مع ما يأتي به الضعيف من العبادات"
কারণ, উভয়েই ঈমানের অধিকারী। তাছাড়া দুর্বল মুমিনও তো বিভিন্ন ইবাদত ও নেক আমল করে থাকেন। -শরহে মুসলিম, নববী
এটি হাদীসের শিক্ষার যথার্থতা ও ভারসাম্যের একটি দৃষ্টান্ত। সবল মুমিনের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার সময়ও দুর্বল মুমিনকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে না; বরং তাকেও স্বস্থানে রাখা হচ্ছে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই ভারসাম্য ও ন্যায়পরায়ণতা ইসলামের শিক্ষা।
কখনো কখনো মুসলিমসমাজেও এরকম দৃষ্টান্ত দেখা যায় যে, মুমিন মুসলমানের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তার ঈমানী বৈশিষ্ট্য স্মরণ রাখা হয় না। ব্যক্তি ও সমাজের ত্রুটি থাকে। সে হিসেবে মুসলিম ব্যক্তি ও সমাজেরও নানাবিধ ভুল-ত্রুটি ও দুর্বলতা আছে- এটি কেউ অস্বীকার করে না, ঈমানী দুর্বলতা ও ইসলামী শিক্ষা থেকে দূরে সরে আসাই আমাদের এই দুর্বলতার বড় কারণ, একথাও সত্য, কিন্তু সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি দুর্বলতা সত্ত্বেও এখনো মুসলিম ব্যক্তি ও সমাজে ঈমানের বদৌলতে যে খাইর ও কল্যাণ রয়েছে তা-ও একেবারে কম নয়। ন্যায়নিষ্ঠ তুলনায় এই সত্য প্রকাশিত হতে বাধ্য। সর্বোপরি মুমিনের ঈমানই তো এমন বৈশিষ্ট্য, যার সাথে অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যের তুলনাই হতে পারে না।
হাদীস শরীফের "وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ" বাক্যটিতে চিন্তার দিগন্ত উন্মোচনকারী যে শিক্ষা আছে তা যদি উপলব্ধি করা যায় তাহলে বর্তমান যুগের অনেক মুমিন, মুসলমান নিজেরাও যেমন হীনম্মন্যতা থেকে নিষ্কৃতি পাবেন তেমনি অন্যরাও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা রক্ষার প্রেরণা খুঁজে পাবেন।
হাদীস শরীফের এই বাক্যটি মূলত প্রথম কথাটিরই পরিশিষ্ট। দুটো বাক্যের দ্বারা একটি বিষয়বস্তু পূর্ণ হয়েছে।
📓দ্বিতীয় কথা
এরপর তৃতীয় বাক্যে বলা হয়েছে-
احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ، وَاسْتَعِنْ بِاللهِ وَلَا تَعْجَزْ
“যা কিছু তোমাকে উপকৃত করে তার ব্যাপারে লালায়িত হও। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো। অক্ষম হয়ো না।”
হাদীস শরীফ আমাদেরকে ‘উপকারী সকল বিষয়ে’ আগ্রহী হওয়ার, শুধু আগ্রহী হওয়া নয়; বরং ‘লালায়িত হওয়া’র আদেশ করেছে।
উপকারী বিষয় কী? মুমিনের কাছে উপকারী বিষয়ের তালিকা অনেক দীর্ঘ। উপকার-অপকারেরও তার রয়েছে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। মুমিনের কাছে ঐ বস্তু ও বিষয়ই উপকারী, যা আল্লাহ তাআলার ফরমাবরদারী অনুসারে হয়। আল্লাহ তাআলার নাফরমানীর দ্বারা পার্থিব কোনো উপকার হাসিল হলেও বাস্তবে সেটা উপকার নয়।
ইসলাম যেহেতু আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আগত দ্বীন তাই ইসলামের শিক্ষা মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রে বিস্তৃত। জীবনের সকল প্রয়োজন পূরণের এবং সকল কল্যাণ অর্জনের অবকাশ ইসলামে আছে, যদি বাস্তবেই তা প্রয়োজন হয় এবং কল্যাণের বিষয় হয়।
আর এ কারণেই মুমিনের কাছে উপকারী বিষয়ের তালিকা অনেক দীর্ঘ, যা জীবন ও জগতের এবং দুনিয়া-আখিরাতের সকল উপকারী বিষয়কে শামিল করে। ইতিপূর্বে আল্লামা সিন্দির আলোচনায় আমরা তা কিছুটা দেখে এসেছি। তবে এই সবকিছুর মূল কথা ও সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আল্লাহর ফরমাবরদারী ও আল্লাহর কাছে আজর-সওয়াব লাভের প্রত্যাশা। জীবনের সকল কাজে এই পন্থা ও প্রেরণা অনুসরণ করতে হবে।
ইমাম নববী (রাহঃ) হাদীস শরীফের উপরোক্ত বাক্যের ব্যাখ্যায় বলেছেন-
معناه احرص على طاعة الله تعالى والرغبة فيما عنده
এর অর্থ হচ্ছে, (সব কাজে) আল্লাহর ফরমাবরদারীর ব্যাপারে লালায়িত হও এবং আল্লাহর কাছে (ফরমাবরদার বান্দাদের জন্য) যা আছে তার আগ্রহ পোষণ কর।
📒দ্বিতীয়ত. এখানে দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ লাভের উপায়ও শেখানো হয়েছে।
ইমাম আবুল আব্বাস কুরতুবী (রাহঃ) হাদীস শরীফের এই বাক্যের ব্যাখ্যায় লেখেন-
استعمل الحرص والاجتهاد في تحصيل ما تنتفع به في أمر دينك ودنياك التي تستعين بها على صيانة دينك، وصيانة عيالك، ومكارم أخلاقك، ولا تفرط في طلب ذلك، ولا تتعاجز عنه متكلا على القدر، فتنسب للتقصير وتلام على التفريط شرعا وعادة. ومع إنهاء الاجتهاد نهايته، وإبلاغ الحرص غايته، فلا بد من الاستعانة بالله، والتوكل عليه، والالتجاء في كل الأمور إليه، فمن سلك هذين الطريقين حصل على خير الدارين.
অর্থাৎ তোমার দ্বীনদারির জন্যে যা কিছু উপকারী তা অর্জনে এবং দুনিয়ার যা কিছু তোমার দ্বীনদারি রক্ষায়, তোমার পরিবার-পরিজনের সুরক্ষায়, উত্তম আখলাকী কাজকর্মের ক্ষেত্রে (যেমন দানশীলতা, বদান্যতা, মেহমানদারি ইত্যাদিতে) সহায়ক হয় তা অর্জনে আগ্রহী ও পূর্ণ তৎপর হও।
‘এক্ষেত্রে অলসতা ও ত্রুটি করো না, তাকদীরের বাহানা দিয়ে অক্ষম সেজো না। সেক্ষেত্রে শরীয়ত ও সমাজ উভয় দৃষ্টিতে তুমি অবহেলাকারী সাব্যস্ত হবে। তো এভাবে সাধ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত চেষ্টা-প্রচেষ্টার সাথে অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে এবং তাঁরই উপর ভরসা করতে হবে আর সব বিষয়ে তাঁরই শরণাপন্ন হতে হবে।
‘তো যে বান্দা এই দুই উপায় অবলম্বন করবে সে দো-জাহানের কল্যাণ লাভে সমর্থ হবে।’ -আল মুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখীসি কিতাবি মুসলিম, কিতাবুল কদর ৬/৬৮২
হাদীস শরীফের শিক্ষার কী সুন্দর ভাষ্য এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। লক্ষণীয় একটি বিষয় হচ্ছে, এখানে অল্প কথায় আগ্রহ ও কর্ম-প্রচেষ্টার ক্ষেত্র নির্দেশ করা হয়েছে। প্রথম ক্ষেত্র হচ্ছে দ্বীনদারি অর্জন ও রক্ষার প্রচেষ্টা। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্র হচ্ছে, নিজের দ্বীনদারি রক্ষা, পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণ ও দানশীলতা, বদন্যতা, মেহমানদারি, প্রভৃতি উন্নত আখলাকী কাজকর্মের সহায়ক হিসেবে পার্থিব উপায়-উপার্জনের চেষ্টা-প্রচেষ্টা।
এরপর আলস্য ও কর্মবিমুখতা বর্জনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘তাকদীর’কে বাহানা হিসেবে ব্যবহার করে অক্ষম না হয়েও অক্ষম সাজতে নিষেধ করা হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভাষ্যকার শুধু কর্মতৎপরতার শিক্ষাই এই হাদীস থেকে গ্রহণ করেননি; বরং কর্মবিমুখতার পক্ষে বাহানা হিসেবে তাকদীরের ব্যবহারও খ-ন করেছেন।
সবশেষে চূড়ান্ত চেষ্টা-প্রচেষ্টার সাথে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা এবং আল্লাহর উপর ভরসা করার শিক্ষা বয়ান করেছেন।
দুনিয়াদারদের আয়-উপার্জন আর কামিল মুমিনের আয়-উপার্জনের বড় পার্থক্য এই বিষয়টি। দুনিয়াদারও চেষ্টা করে, মুমিনও চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে তবে দুনিয়াদার নিজের চেষ্টা-প্রচেষ্টার উপর ভরসা করে, পক্ষান্তরে মুমিন সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টায় আল্লাহর উপর ভরসা করে।
এ থেকে আরো বোঝা যাচ্ছে যে, চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও তাওয়াক্কুলের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই। তাওয়াক্কুল অর্থ চেষ্টা-তদবীর ত্যাগ করা নয়; বরং শরীয়তসম্মত পন্থায় সর্বোচ্চ চেষ্টা-তদবীরের পরও আল্লাহর উপর ভরসা করা। মানুষের চেষ্টা-তদবীর উপায় মাত্র। এই উপায় দ্বারা উদ্দিষ্ট সুফল তখনই পাওয়া যাবে যখন আল্লাহ তাআলা সেই সুফল দান করবেন। কাজেই ফলাফলের জন্য অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে।
এখানে আরো যে বিষয়টি বোঝা যায় তা হচ্ছে, মুমিনের সকল চেষ্টা-তদবীর হতে হবে শরীয়তের গ-ির ভিতরে। কারণ, আল্লাহর বিধান অমান্য করে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া এবং আল্লাহর উপর ভরসার কথা বলা শুধু হাস্যকরই নয়, বেআদবীও বটে। দুনিয়াদারের চেষ্টা-তদবীর আর ঈমানদারের চেষ্টা-তদবীরের মধ্যে আরেক পার্থক্য এটা। দুনিয়াদার চেষ্টা-তদবীর করে কিন্তু সেক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানের, জায়েয-নাজায়েযের পরোয়া করে না; পক্ষান্তরে ঈমানদারও চেষ্টা-তদবীর করেন কিন্তু তিনি আল্লাহর বিধানের অনুগত থাকেন, জায়েয-নাজায়েযের সীমানার ভেতরে থাকেন। কেন তিনি চেষ্টা-তদবীরের ক্ষেত্রে এই সীমানা লঙ্ঘন করবেন? তার তো বিশ্বাস আমার চেষ্টা-প্রচেষ্টা উপায়মাত্র। ফলাফল তা-ই হবে, যা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা। কাজেই কেন আমি চেষ্টা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলাকে নারাজ করব?
📓তৃতীয় কথা :
‘কোনো (অবাঞ্ছিত) বিষয়ের শিকার হলে বলো না, যদি আমি (এমন) করতাম তাহলে এমন এমন হত...’
ইমাম সুবকী (রাহঃ) এ বিষয়ক হাদীসসমূহের ব্যাখ্যায় বলেন-
وَقَدْ تَأَمّلْتُ اقْتِرَانَ قَوْلِهِ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ بِقَوْلِهِ "وَإِيّاكَ وَاللّوْ" فَوَجَدْتُ الْإِشَارَةَ إِلَى مَحَلِّ لَوِ الْمَذْمُومَةِ، وَهِيَ نَوْعَانِ: أَحَدُهُمَا فِي الْحَالِ مَا دَامَ فِعْلُ الْخَيْرِ مُمْكِنًا، فَلَا يُتْرَكُ لِأَجْلِ فَقْدِ شَيْءٍ آخَرَ، فَلَا تَقُولُ: لَوْ أَنَّ كَذَا كَانَ مَوْجُودًا لَفَعَلْتُ كَذَا، مَعَ قُدْرَتِهِ عَلَى فِعْلِهِ وَلَوْ لَمْ يُوجَدْ ذَاكَ بَلْ يَفْعَلُ الْخَيْرَ وَيَحْرِصُ عَلَى عَدَمِ فَوَاتِهِ.
وَالثّانِي مَنْ فَاتَهُ أَمْرٌ مِنْ أُمُورِ الدّنْيَا فَلَا يَشْغَلْ نَفْسَهُ بِالتّلَهّفِ عَلَيْهِ لِمَا فِي ذَلِكَ مِنَ الِاعْتِرَاضِ عَلَى الْمَقَادِيرِ وَتَعْجِيلِ تَحَسّرٍ لَا يُغْنِي شَيْئًا، وَيَشْتَغِلُ بِهِ عَنِ اسْتِدْرَاكِ مَا لَعَلّه يجدي، فالذم رَاجع فِيمَا يؤول فِي الْحَال إِلَى التّفْرِيط وَفِيمَا يؤول فِي الْمَاضِي إِلَى الِاعْتِرَاضِ عَلَى الْقَدْرِ وَهُوَ أَقْبَحُ مِنَ الْأَوّلِ.
আমি হাদীস শরীফে ‘উপকারী বিষয়ে আগ্রহী হওয়ার’ আর ‘লাও’ (যদি) শব্দের ব্যবহার থেকে বিরত থাকার শিক্ষা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছি। আমার মনে হয়েছে, ‘যদি’ শব্দ ব্যবহারের বর্জনীয় ক্ষেত্র দুটি : এক. যখন কোনো ভালো কাজ করা সম্ভব থাকে তখন কোনো কিছুর অভাবের কারণে সেই কাজটি ত্যাগ না করা উচিত। কাজেই এক্ষেত্রে যদি কেউ বলে, ‘যদি ঐ বিষয়টি পেতাম তাহলে এই কাজটি করতাম।’ অথচ সেটা ছাড়াও এই কাজ করা সম্ভব। এই ‘যদি’ নিন্দিত ‘যদি’। বরং ঐ বস্তু ছাড়াই কাজটি সম্পন্ন করবে এবং উপকারী কাজের ক্ষেত্রে আগ্রহী ও উদ্যমী থাকবে।
দুই. কেউ যখন দুনিয়াবী কোনো কাম্যবস্তু লাভে ব্যর্থ হয় তখন সেই বিষয়ের দুঃখ ও আফসোসে নিজেকে ব্যস্ত করবে না। কারণ এতে একে তো তাকদীরে অসম্মতি প্রকাশ করা হয়, দ্বিতীয়ত এই দুঃখ-আফসোসে কোনো উপকারও নেই। বরং এ কারণে অপ্রাপ্তির ক্ষতিপূরণ হত এমন উপকারী কাজ থেকেও বঞ্চিত হতে হয়। তো সারকথা এই যে, ‘যদি’ ব্যবহারে যদি বর্তমানের কোনো ভালো কাজের ক্ষেত্রে অবহেলা হয় কিংবা অতীতের কোনো ব্যাপারে তাকদীরে অসম্মতি প্রকাশ করা হয় তা হবে নিন্দনীয় ও বর্জনীয়। আর দ্বিতীয়টা প্রথমটার চেয়েও অধম।”
ইমাম সুবকী রাহ.-এর এ বক্তব্যে শুধু আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যাই নয়, এ বিষয়ক অন্যান্য হাদীসের সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও পাওয়া গেল। তবে সহীহ মুসলিমের আলোচ্য হাদীসে প্রধানত দ্বিতীয় শিক্ষাটি পাওয়া যায়। যার সারকথা হচ্ছে, মুমিন দ্বীন-দুনিয়ার কাম্য ও উপকারী বিষয়টি অর্জনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে, অবাঞ্ছিত ও ক্ষতিকর বিষয়াদি থেকে আত্মরক্ষার সযত্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু এর পরও ফলাফল যদি অন্যরকম কিছু হয় তাহলে একে আল্লাহর হুকুম বলে মেনে নেবে। সুবহানাল্লাহ! কর্ম-প্রচেষ্টার এর চেয়ে সুন্দর, বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা আর কী হতে পারে?
দুনিয়ার এ ঘরকে আল্লাহ যেহেতু কর্ম ও প্রচেষ্টার ঘর বানিয়েছেন তাই বান্দাকে কর্মতৎপর থাকতে হবে। কর্মের শক্তিও তো আল্লাহ তাআলাই দান করেছেন। কাজেই কর্মবিমুখ হওয়া এই নিআমতের না-শোকরিও বটে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ফলাফলের ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা উপায় মাত্র, তাই বান্দা সকল প্রচেষ্টার পরও আল্লাহর উপর ভরসা করবে এবং ফলাফল ভালো হলে আল্লাহর শোকর করবে। ফলাফল ভিন্ন কিছু হলে সবর করবে ও তাকদীরের ফয়সালায় সম্মত থাকবে। বলা বাহুল্য যে, এই শিক্ষাকেই বলা যায় কর্মপ্রচেষ্টার উৎসাহদানের সঠিক ও সম্পূর্ণ শিক্ষা।
ইসলামের এই সমগ্র শিক্ষাটি স্মরণে রেখে যদি অন্যান্য মতবাদের কর্ম-তৎপরতার শিক্ষাকে মূল্যায়ন করা হয় তাহলে সেইসব চিন্তা-দর্শনের খ-িত ও প্রান্তিকতাপূর্ণ হওয়া দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যেমন মানুষকে যদি শুধু কর্ম-তৎপর হতে বলা হয়, কিন্তু কর্ম ও তৎপরতায় বৈধ-অবৈধের বাছ-বিচারের চেতনা দান না করা হয়, কিংবা বৈধ-অবৈধের ক্ষেত্র ও বিধান না শেখানো হয় তাহলে এই কর্মতৎপরতার শিক্ষাই কি ব্যক্তি ও সমাজের জন্য নানাবিধ সঙ্কট তৈরি করবে না?
কর্ম-তৎপরতার শিক্ষা দেয়া হল, কিন্তু এই বাস্তবতা জানানো হল না যে, প্রচেষ্টাই সবকিছু নয়, এটি উপায় মাত্র, ফলাফল আল্লাহর ইচ্ছায়ই হয়ে থাকে। কাজেই তাঁরই উপর ভরসা করা উচিত, তাঁর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তাহলে তো মানুষের মাঝে একদিকে যেমন দম্ভ-অহংকার সৃষ্টি হবে, যা সমাজ-সংসারের সকল অশান্তির মূল, অন্যদিকে দুঃখ-মনস্তাপও সীমা অতিক্রম করবে, যা জীবনের শান্তি-সুখ জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিবে। সর্বোপরি মানবসমাজে বিরাজ করবে আল্লাহ-বিস্মৃতি ও আত্ম-বিস্মৃতির ভয়াবহ পরিবেশ।
তো উপরের হাদীস শরীফে আমরা দেখতে পেলাম, ইসলাম আমাদের কত তাকীদের সাথে ভালো কাজে ও ভালো বিষয়ে উৎসাহিত হওয়ার নির্দেশনা দান করেছে! দ্বীন-দুনিয়ার উপকারী বিষয়াদিতে কর্ম-তৎপর হওয়ার কী বাস্তবসম্মত শিক্ষা দান করেছে! ইসলামের এই শিক্ষাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করে আমরা যদি তার যথার্থ অনুসরণ করতে পারি তাহলে ইনশাআল্লাহ দ্বীন-দুনিয়ার কামিয়াবি ও সফলতা অর্জনে আমরা সক্ষম হব। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।