হযরত শুআইয়া (عليه السلام) এর সহীফা


হযরত শুআইয়া (عليه السلام) এর সহীফায় হুজুর আনওয়ার (ﷺ) এর সম্পর্কে এরকম আলোচনা করা হয়েছে। হক তায়ালা ফরমান যে, বান্দা অর্থাৎ হুজুর পাক (ﷺ) আমার প্রিয়পাত্র, আমি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তিনি আমার মনোনীত, তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট। আমি তাঁর প্রতি আমার পক্ষথেকে রুহ বর্ষণ করি। আমি তাঁর কাছে আমার ওহী অবতীর্ণ করবো, তখন উম্মতের উপর উক্ত ওহীর আকৃতি প্রকাশিত হবে। উক্ত বান্দা আমার এমন বান্দা যিনি কোনোদিন অট্টহাসি হাসবেন না, বাজারেও তাঁর উচ্চবাচ্যশোনা যাবে না। আমার সে বান্দা অন্ধদেরকে দৃষ্টিশক্তি দান করবেন, বধিরদের কর্ণ খুলে দেবেন এবং মৃত অন্তরকে জীবন দান করবেন। আমি তাঁকে এমন জিনিস দান করবো, যা অন্য কাউকে প্রদান করিনি। আমার সেই বান্দা হবেন আহমদ। তিনি তাঁর প্রতিপালকের প্রাণজ প্রশংসা আদায় করবেন। কেউ তাঁকে দুবর্ল করতে পারবে না। কেউ তাঁকে পরাভূত করতে পারবে না। তিনি তাঁর প্রবৃি ত্তর অনুসরণ করবেন না। সৎ অথচ দুর্বল যাঁরা তাদেরকে তিনি নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত মনে করবেন না। তিনি সিদ্দীকগণকে শক্তিশালী করবেন। তিনি তাওয়াযু ও বিনয় প্রকাশকারী লোকদের জন্যস্তম্ভ স্বরূপ। তিনি আলাহ্তায়ালার নূর। সে নূরকে কেউ কক্ষণও নির্বাপিত করতে পারবে না। তাঁর মাধ্যমে আমার সম্মান প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর মাধ্যমে টালবাহানার দরজা বন্ধ হবে যাবে। তাঁর কিতাব অর্থাৎ কুরআন মজীদ তেলাওয়াতের মাধ্যমে জ্বীন ও ইনসান আনুগত্যশীল হবে। 


এছাড়া হজরত শুআইয়া (عليه السلام) নবী করীম (ﷺ) সম্পর্কে নিজে যা আলোচনা করেছেন তা এরূপ তিনি বলেছেন, আলাহ্তায়ালা বলেন, হে মোহাম্মদ (ﷺ)! আমি সেই আলাহ্ যিনি আপনাকে সত্যের মাধ্যমে মহান ও শক্তিশালী বানিয়েছেন এবং আপনাকে এমন এক নূর বানিয়েছেন যার মাধ্যমে আপনি আপনার অন্ধ উম্মতদেরকে দৃষ্টিশক্তি প্রদান করতে সক্ষম হবেন। আর আপনি এমন এক দলীল হবেন যার মাধ্যমে  প্রবৃত্তিপরায়ণতার অন্ধকার থেকে মানুষকে নূরের দিকে নিয়ে যেতে পারবেন। 


হজরত শুআইয়া (عليه السلام) এর কিতাবে আরও আছে। তিনি বলেন, আলাহ্তায়ালা আমাকে এরশাদ করেছেন, হে শুআইয়া! ওঠো এবং দেখো। যা কিছূু তোমার দৃষ্টিগোচর হয়, সে সম্পর্কে মানুষদেরকে জানিয়ে দাও। তখন আমি উঠলাম এবং দেখলাম দু’জন আরোহী সামনের দিক থেকে আমার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তন্মধ্যে একজন গাধার উপর আরোহণ করেছেন। অপরজন উটের উপর। আরোহীদ্বয় একে অপরকে বলছেন, বাবেল শহর ধ্বংস করে দাও এবং অই শহরের অই সকল স্মৃতিকেও ধ্বংস করে দাও যেগুলি এর অধিবাসীরা খোদাই করে বানিয়েছে। ইবন কুতায়বা, যিনি ওলামায়ে উম্মতের অন্যতম এবং আসমানী কিতাবসমূহের এলেমের একজন প্রখ্যাত আলেম ছিলেন, তিনি বলেন, উক্ত বর্ণনায় গাধার উপর আরোহী ব্যক্তি ছিলেন হজরত ঈসা (عليه السلام)। এ সম্পর্কে নাসারাগণের ঐকমত্য রয়েছে। সুতরাং উটের উপর আরোহী ব্যক্তিনিঃসন্দেহে সাইয়্যেদে আলম মোহাম্মদুর রসূলুলাহ্ (ﷺ)। কেননা বাবেল শহরের পরাজয় ও তথাকার মূর্তির ধ্বংস সাধন হুজুর পাক (ﷺ) এর পবিত্র হস্ত মুবারক দ্বারাই সংঘটি হয়েছিলো। হজরত ঈসা (عليه السلام) এর হাতে নয়। বাবেল অঞ্চলে হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام) এর যমানা থেকেই সর্বদা সেখানকার বাদশাহ্ মূর্তিপূজা করে আসছিলো। আর হজরত ঈসা (عليه السلام) এর গাধায় সওয়ার হওয়া আর হুজুর আকরম (ﷺ) এর উষ্ট্রে আরোহণ করা এটা তো খুবই প্রসিদ্ধ ব্যাপার। 


হজরত শুআইয়া (عليه السلام) এর কিতাবে আরও উলেখ আছে - আলাহ্ বলেন, আলে কায়দারের মহলা দিয়ে আমি বনাঞ্চল ও শহরাদি ভরে দেবো। তাঁরা সর্বদাই তসবীহ পাঠ করবে, পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় আযানের ধ্বনি উচ্চারণ করবে। এরা এমন লোক হবে যারা আলাহ্- তায়ালার মহত্ব ও বুযুর্গী বর্ণনা করবে। তারা প্রতিটি জল ও স্থলভাগে আলাহ্তালায়ার পবিত্রতা ও তাঁর তসবীহ্ ঘোষণা করবে। তাঁরা পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পযন্তর্  তকবীরধ্বনি সমুন্নত করতে করতে অত্যন্ততেজোদ্দীপ্ততার সাথে এগিয়ে আসবে। চারুশিল্পীরা যেমন শিল্পকর্মের জন্য মাটি ভেঙে পিষে খান খান করে পদদলিত করে কর্দম তৈয়ার করে, তেমনি তাঁরা অহংকারীর দম্ভ চূর্ণ করে পৃথিবী দলিত মথিত করে এগিয়ে আসবে। 


উপরোক্ত ভাষ্যের মর্মার্থ এই যে, তারা আলাহ্র ভালোবাসায় পাগোল পারা হয়ে তেজোদ্দীপ্ততার সাথে এগিযে আসবে, হজ সম্পাদনের জন্য দ্রুত গতিতে আসবে, আওয়ায উচ্চ করতে করতে আসবে, তলবীয়া পড়তে পড়তে আসবে, তওয়াফের সময় যমী ও রমল করবে ইত্যাদি।ইবন কুতায়বা বলেন যে, আলে কায়দারের অর্থ হচ্ছে আহলে আরব। কেননা এতে ঐকমত্য রয়েছে যে, হজরত ইসমাইল (عليه السلام) এর নাতির নাম ছিলো কায়দার। ইবন কুতায়বা বর্ণনা করেন, হজরত শুআইয়া (عليه السلام) এর কিতাবে মক্কা মুকাররমা, খানায়ে কাবা এবং হাজারে আসওয়াদ সম্পর্কেও আলোচনা রয়েছে। 


হাজারে আসওয়াদ সম্পর্কে এরকম কথা আছে যে, মানুষ এসে উক্ত পাথর মুবারক চুম্বন করবে। হজরত শুআইয়া (عليه السلام) এরকম বলেছেন, আলাহ্তায়ালা এমর্মে এরশাদ করেছেন, তোমরা শুনে রাখো। আমি সীহুন অর্থাৎ মক্কা মুকাররমায় স্বীয় গৃহ (বাইতুলাহ্) নির্মাণ করবো, যার এক কোণে থাকবে হাজারে আসওয়াদ। উক্ত পাথরকে মহত্ব ও সম্মান প্রদান করা হয়েছে। লোকেরা তাকে চুম্বন করবে। আলাহ্তায়ালা মক্কা মুকাররমাকে সম্বোধন করে বলেছেন, হে আকের (নিঃসন্তান)! তুমি খুশি থাকো এবং তসবীহ্র সাথে সাক্ষ্য প্রদান করো। শোনো! তোমার আহল (মান্যকারী) আমার আহলের চেয়ে বেশী হবে। আমার আহল বলতে বাইতুল মুকাদ্দাসের অধিবাসী অর্থাৎ বনী ইসরাইলদেরকে বুঝানো হয়েছে। আর নবী করীম (ﷺ) এর উম্মত যাঁরা মক্কায় হজ ও ওমরা পালন করতে আসবে তাঁদের সংখ্যা বনী ইসরাইলদের তুলনায় অধিক হবে। হকতায়ালা মক্কা মুকাররমাকে আকের বা নিঃসন্তান বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার প্রেক্ষিতটি হচ্ছে এই যে, হজরত ইসমাইল (عليه السلام) এর পূর্বে এখানে কোনো আবাদ ছিলো না এবং এখানে কোনো কিতাবও নাযিল হয়নি। কিন্তুবাইতুল মুকাদ্দাসের অবস্থা ছিলো ভিন্ন। সেখানে অনেক আম্বিয়া কেরাম আবির্ভূত হয়েছিলেন। সে স্থান সর্বদাই ওহী নাযিলের ক্ষেত্র ছিলো।


হজরত শুআইয়া (عليه السلام) এর কিতাবে আরও রয়েছে, হকতায়ালা মক্কা মুকাররমাকে লক্ষ্য করে বলেছেন, আমার যাতে পাকের কসম, যে রকম কসম আমার উপযোগী, নূহ (عليه السلام) এর যমানায় আমি প্রলয়ের মাধ্যমে পৃথিবীবাসীকে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। তোমার সম্পর্কে আমি আমার যাতে পাকের কসম করে বলছি, আমি তোমার প্রতি কখনও অসন্তুষ্ট হবো না এবং আমি তোমাকে কখনও পরিত্যাগও করবো না। যতক্ষণ সমস্তপবর্তরাজি আপন আপন স্থান থেকে বিচ্যুত ও উৎপাটিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার নেয়ামতসমূহ তোমার উপর থেকে অপসারণ করবো না। হে কাবা! তুমি জেনে রেখো যে, আমি তোমার ভিত্তিগুলিকে চূনা ও পাথর দিয়ে নির্মাণ করিয়ে দেবো। তোমাকে আমি মণিমুক্তা দ্বারা সজ্জিত করে দেবো। তোমার ছাদকে সিক্ত মোতি দ্বারা, তোমার দরোজাকে যবরযদ পাথর দ্বারা সাজিয়ে দেবো। তোমা থেকে অনাচারকে বহু দূরে রাখা হবে। তোমাকে কোনো গোনাহ্গার স্বীয় গোনাহ্ দ্বারা ক্ষতি করতে পারবে এমন ভয় করো না। ওঠো, উজ্জ্বল হও। তোমার নূরকে পৌঁছিয়ে দেয়ার সময় নিকটবর্তী হয়ে গিয়েছে। আলাহ্তায়ালার মহত্ব ও সম্মান তোমারই উপর নিপতিত এর মধ্যে খাতেমুল আম্বিয়া (ﷺ) এর নূরের বহিঃপ্রকাশের সুসংবাদ রয়েছে। এমনিভাবে হেরেম শরীফ সম্পর্কে উলেখ করা হয়েছে। এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভেড়া ও বকরী একস্থানে বিচরণ করবে। তাদের রাখাল সম্পর্কে যে মাহাত্ম্য ও মহিমার কথা উলেখ করা হয়েছে, তা লিপিবদ্ধ ও বর্ণনা করা ক্ষমতার বাইরে। 


 মোটকথা এই যে, সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) এর গুণাবলী ও অবস্থা সম্পর্কে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে কোথাও কোথাও এর চেয়েও বেশী আলোচনা করা হয়েছে। এসব আলোচনায় কোনরূপ অস্পষ্টতা এবং সন্দেহের লেশমাত্র নেই। তবে হাঁ, দ্বীনের দুশমনেরা ওসব গুণাবলী, অবস্থা ও বৈশিষ্ট্যসমূহ রূপান্তরিত করেছে। তা সত্ত্বেও বিস্তর দলীলসমূহ ও সাক্ষীপ্রমাণসমূহ সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। 


‘কাফেররা চায় মুখের ফুৎকার দ্বারা আলাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে অথচ আলাহ্তায়ালা তাঁর নূরকে পূর্ণতা প্রদান করবেন, যদিও কাফেররা এটাকে অপছন্দ করে।’ সূরা সফ। 


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 



© | সেনানী এপ্স |

Top