কুরআন মজীদের কতিপয় মুবহাম আয়াত থেকে সন্দেহের অপনোদন


কুরআন মজীদের কিছু মুবহাম আয়াত থেকে সৃষ্ট সন্দেহ দূর করণার্থে এখন আলোচনা করা হবে। কোন কোন অজ্ঞ-মূর্খ অথবা বক্রতা ও কুটিলতা পূর্ণ অন্তরের অধিকারী ব্যক্তির বাহ্যিক দৃষ্টিতে ঐ আয়াত দেখে রাসূল কারীম (ﷺ) এর উচ্চ মর্যাদায় বিভিন্ন রকম ত্রুটি সৃষ্টি করা এবং সন্দেহ সৃষ্টি করার প্রয়াস পায়। এ আয়াতগুলি প্রকৃতপক্ষে আয়াতে মুতাশাবেহাত এর পর্যায়ভুক্তই। ওলামায়ে কেরাম এ সমস্ত আয়াতের যথাযথ ও সমীচীন তাবীল এবং উপযুক্ত অর্থ করেছেন।


ঐ সমস্ত আয়াত সমূহের মধ্যে অন্যতম আয়াত হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে পথহারা অবস্থায় পেয়েছেন, অতঃপর তিনি পথ দেখিয়েছেন—এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে মূর্খেরা এটাই বুঝাতে চায় যে, নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে রাসূল করীম (ﷺ) এর মধ্যে ضلالت 'দালালাত' বা গােমরাহী ছিলাে। আর সেই গােমরাহীকেই দূর করেছেন আল্লাহ তায়ালা هدايت 'হেদায়েত' বা পথপ্রদর্শনের মাধ্যমে। অথচ ওলামায়ে কেরামের একথার উপরে ঐকমত্য রয়েছে যে, হুজুর আকরম (ﷺ) নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বেই হােক বা পরেই হােক কখনও তাকে গােমরাহী দ্বারা দূষিত করা যাবে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা কাকে সৃষ্টি করেছেন, প্রতিপালন করেছেন, তৌহিদ দান করেছেন, ইমাম দান করেছেন— এসবই তারে ইসমত বা হেফাজতের মধ্যে রেখেই করেছেন। আর সমস্ত আম্বিয়াগণের বেলায়ও একই অবস্থা। যে মহান ব্যক্তিদের আল্লাহ তায়ালা নবুওয়াত, রিসালাত, এস্তফা ও ইজতেবা (পছন্দ ও মনোনীত) এর দ্বারা ধন করলেন, কোনাল ইতিহাসবেত্তা তাদের সম্পর্কে প্রমাণ করতে পারেনি যে তারা ইতিপূর্বে কুফুরী, শিরকী ও গােমরাহীতে লিপ্ত ছিলেন।


তবে হাঁ, একথাটির মধ্যে অবশ্য মতভেদ রয়েছে যে, আকলগতভাবে জায়েয কি না। মুতাযিলাদের নিকট আকলগতভাবে জায়েয নয়। কেননা এটা অপছন্দনীয় মা এবং দূরবর্তী তাকে নির্দেশ করে। তবে আমাদের আসহাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নিকট আকলগতভাবে তা জায়েয। হক তায়ালা কাউকে দালালাত এর কূপ থেকে বের করে হেদায়েত দান করে নবুওয়াতের মর্তবায় পৌছিয়ে দিয়ে থাকেন। তবে বিভিন্ন উদ্ধৃতি ও শ্রুতিগত দলীল এটাই প্রমাণ করে যে, এ ধরনের ঘটনা এ বাস্তব জগতে কখনও ঘটেনি


কেননা সমস্ত আম্বিয়া কেরাম নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্ব থেকেই আল্লাহ তায়ালার জাত ও সিফাত সম্পর্কে অবহিত হওয়া বা শক সন্দেহ করা থেকে পবিত্র ও মাসুম ছিলেন। তারা সকলেই কুফুরী, গােনাহ এবং এমন প্রত্যেকটি কাজ যা ক্ষতিকর ও ঘৃণিত সবকিছু থেকে সুরক্ষিত ছিলেন। নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে এবং পরে ভুল-ভ্রান্তি, আবেগতাড়িত হয়ে কোনাে প্রকারের গাফলতী করে ফেলা, রাগত অবস্থায় কোনাে অন্যায় করে ফেলা এবং মিল্লাতের শরীয়ত ও দ্বীন-প্রচারের সাথে জড়িত এমন কোনাে কাজের ত্রুটি করা, সাধারণতঃ কবীরা গুনাহ এবং ইচ্ছাপূর্বক সগীরা গুনাহ থেকে মাসুম ও মামুন ছিলেন। বিশেষ করে সাইয়্যেদুল আম্বিয়া (ﷺ) এর ক্ষেত্রে তার ইসমত বা মাসুম থাকা সর্বাধিক পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ । তার মর্তবা অধিকতর উন্নত। যে ব্যক্তি তাঁর শানে আদবের খেলাফ ব্যক্তিগত অনুসারে কোনো মন্তব্য করবে, সে পরিত্যাজ্য হবে সন্দেহ নেই। নিঃসন্দেহে সে মূর্খতার নিম্নতম অন্ধকারের গভীরতম গহ্বরে নিমজ্জিত আছে। হুজুর আকরম (ﷺ) এর পবিত্র সত্তা তাে প্রথম থেকেই এমন পবিত্র এবং সুসজ্জিত ছিলাে যে, কোনো রকম দোষক্রটি হস্ত তাঁর ইযযত ও বুযুর্গী আঁচল স্পর্শ করতে পারেনি।


যেমন কবি বলেছেন, তালীম ও আদব গ্রহণ করার তাে তার কোনাে প্রয়োজন নেই। কেননা, তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আদব শীল হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও হকতায়ালার প্রতিপালন ও শিক্ষায় ধীরে ধীরে কুরআনে পাক সন্নিবেশিত হওয়ার মাধ্যমে যে সাহায্যপ্রাপ্ত হলেন, তাই এক সময় শক্তি থেকে কার্যের রূপ পরিগ্রহ করে। এমনকি আল্লাহতায়ালার ঐ সমস্ত প্রতিশ্রুতি যা তার জন্য দেয়া হয়েছিলাে, যখন এক এক করে সেগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটতে লাগলে, তখন তাকে তার মাধ্যমে তিনি পূর্ণ প্রত্যয় এবং পরিপূর্ণ উন্মােচন অর্জন করলেন। কাজেই আল্লাহ তায়ালার কুদরত প্রত্যক্ষ করা এবং মাজেজা প্রকাশিত হওয়ার সময় প্রায়শঃই তিনি এরূপ বলতেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি আল্লাহর রসূল। কেউ যদি এরকম প্রশ্ন করে, প্রত্যেক কামেল লোকের অবস্থাতেই এরকম যে, কোনাে গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্য এবং যােগ্যতা ব্যক্তিসাধারণের মধ্যে সৃষ্টি করা হয়, সেগুলি তরতীব অনুসারেই তাঁর মধ্যে আত্মপ্রকাশ লাভ করে থাকে। তাহলে হুজুর আকরম (ﷺ) এর ক্ষেত্রে বিশেষত্ব কোথায়? উত্তরে এই বলা হবে যে, যােগ্যতা, নিকট ও দূরত্বের তারতম্য অনুসারে হবে । কেননা কোন বা-কামেল ব্যক্তির মধ্যে যে কামালিয়াত আসে তা কসব ও রিয়াযত (অর্জন ও সাধনা) এর মাধ্যমে বাস্তবে রূপলাভ করে থাকে। কিন্তু হুজুর পাক (ﷺ) এর বেলায় সবই তা সতত বিদ্যমান, সতত প্রস্তুত। কিন্তু সেটা পর্দার অন্তরালে আচ্ছাদিত থাকে অর্থাৎ আলেমে গায়বের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। যার বহিঃপ্রকাশ সময়ের সাথে সম্পৃক্ত। কুরআন নাযিল অনুষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে অর্জন, সাধনার কারণ ব্যতিরেকেই আত্মপ্রকাশ ঘটে। কথার সার এই যে, কুরআন কারীম হুজুর পাক (ﷺ) কে মার্জিত করেছে, আদব-শিখিয়েছে কথাটার অর্থ এই নয় যে, দোষ ত্রুটি থেকে পূর্ণতার দিকে এসেছেন, অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বের দিকে এসেছেন।


ঐ সম্প্রদায়ের কিছু কিছু লােক হুজুর পাক (ﷺ) এর পবিত্র সত্তায় সিফাতে বাশারিয়াত অর্থাৎ মানবীয় বৈশিষ্ট্যের বিদ্যমান থাকা এবং স্বভাবের ও প্রবৃত্তির বিধান বিদ্যমান থাকা সাব্যস্ত করে। তারা তার মধ্যে অধৈর্য ও অস্থিরতা, যেমন কার্যাবলীর উৎস ও উদ্দেশ্য সাব্যস্ত করে। শরিয়তের হেকমত এবং এতে বার মর্যাদা সম্পর্কে প্রশ্ন করা সেটার কারণ মনে করে। কুরআন অবতরণ তাঁকে মার্জিত করার এবং প্রবৃত্তিকে দূরীভূত করার কারণ মনে করে। এরা তাদের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও অনুভূতি অনুসারে সাইয়েদুল কাউনাইন (ﷺ) এর অবস্থা সম্পর্কে অবহিত আছে বলে দাবি করে। হুজুর পাক (ﷺ) এর শানে এমন ধারণা করে, এমন কথা বলে যা এ অধমের (মাদারেজুন নবুওয়াত এর গ্রন্থকার) বিশ্বাসের রুচি বহির্ভূত। প্রকৃতপক্ষে এরা নিজের অবস্থার মাপকাঠিতে অন্যকে বিচার করে। এটা একেবারেই বৈধ নয়।


এ আলোচনার কিছু অংশ যেহেতু নবী করীম (ﷺ) এর আখলাক শরীফের অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা হয়েছে, এজন্য তার পুনরুল্লেখ প্রয়োজন নেই। স্থানে শুধু এই কথাগুলো আলােচনা করা হবে, যেগুলোর কারণে পথভ্রষ্ট ও বক্রচিন্তার অধিকারী লােকেরা সন্দেহের মধ্যে নিপতিত হয়। এ বিষয়গুলো আলোচনা করে এ মিসকীনের (মুহতারাম গ্রন্থকার মরহুম) ভাষা অপারগ। যদিও তাদের সন্দেহ উপাদানকল্প এ কাজটি একটি বিধি সম্মত কাজ। তথাপিও অসন্তুষ্টি থেকে মুক্ত মনে হয় না। কিন্তু যেহেতু ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে অগ্রসর হয়েছেন এবং এর মধ্যে মুসলেহাতও দৃষ্টিগােচর হচ্ছে। কাজেই আমিও বাধ্য হয়ে তাদের অনুসরণ করছি। আশা রাখি হয়তো পরিণাম ভালো হবে।


বাহ্যিক দৃষ্টিতে যে সমস্ত আয়াত দ্বারা নবী করীম (ﷺ) এর শানের খেলাফ কোন ধারণা আছে, এই আয়াতের মর্মার্থ উদঘাটনের জন্য কোন কোনাে সুফী ও মুহাক্কেক ব্যক্তিগণ যেমন মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন, সেগুলিকে স্মরণ রাখতে হবে এবং তার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। তাহলে জটিলতার নিরসন হবে, আবার ক্ষতি থেকে নিরাপত্তাও লাভ হবে। সেই আদব ও মূলনীতিমূলক ব্যাখ্যাগুলি হচ্ছে এই - 


# ব্যাখ্যা ১  

মহান ও বরহক আল্লাহ জাল্লা শানুহু তরফ থেকে যে সমস্ত খেতাব বা সম্বোধন, কোনাে অসন্তোষ, কোনো শান শওকত, প্রাবল্য, কোন এস্তেগফার বা কোনো বড়ত্ব প্রকাশকারী শব্দ যেমন ('আপনি হেদায়েত করতে পারবেন না) (অবশ্যই আপনার আমল ধ্বংস হয়ে যাবে)' (কারও ব্যাপারে আপনার উপর কোনাে যিম্মাদারী নেই)' (আপনি দুনিয়ার জীবনের চাকচিক্য কামনা করেন) বা এজাতীয় আরও অন্য কোনো শব্দ বা বাক্য নবী করীম (ﷺ) এর শানে পাওয়া যায়। অথবা নবী করীম (ﷺ) এর পক্ষ থেকে বন্দেগী, আজেযী, এনকেছারী, বিনয়, মুখাপেক্ষিতা, দারিদ্র ইত্যাদি প্রকাশকারী কোনাে শব্দ-বাক্য পাওয়া যায়, যেমন, (আমি তােমাদের মতই মানুষ) (অন্যান্য বান্দারা যেমন রাগ করে আমিও সেরকম রাগান্বিত হই)' (আমি জানি না আমার সঙ্গে এবং তাদের সঙ্গে কি রকম আচরণ করা হবে।) (আমি জানিনা এই দেয়ালের পেছনে কি আছে)' এ জাতীয় আরও বিভিন্ন কথা যা বাস্তবে এসেছে, সে সবের তাৎপর্য উদঘাটনের ব্যাপারে আমাদের উপর অপরিহার্য নয় এবং আমাদের সেই মাকামও নেই যে আমরা তাতে বাগড়া দেবে, অংশীদারিত্ব তালাশ করবে এবং উল্লাস প্রকাশ করবে। বরং আমাদের জন্য উচিত হবে আদব, শালীনতা ও নীরবতার সীমানায় অবস্থান করে উদাসীন এবং মূক হয়ে থাকবে।


মাবুদের সম্পূর্ণ হক বা অধিকার রয়েছে তার বান্দার ব্যাপারে তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য প্রকাশ করার সম্পূর্ণ অধিকার তার রয়েছে। তার দিকে বান্দা সাধারণত মাবুদ বা মনিবের দ্বারে আজিযী, এনকেছারী করে থাকে। অন্যের কি অধিকার আছে দু'জনের মধ্যে প্রবেশ করার এবং অনধিকার চর্চা করার? আদবের পরিসীমা লংঘন করার? এ হচ্ছে অজ্ঞ লােকের অই মাকাম যেখানে অনেক দুর্বল ও জাহেলের পদস্থলন হয়েছে এবং নিজেরই ক্ষতি সাধিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকেই হেফাজত ও সাহায্য।


এখন আলোচনায় আসা যাক আয়াতে কারীমা ওয়া ওয়াজাদাকা দাল্লান ফাহাদা এর প্রকৃত অর্থ কি? মুফাসসেরীনে কেরাম এই আয়াতের তাফসীর ও তাবীল সম্পর্কে বিভিন্ন মত পেশ করেছেন। তম্মধ্যে একটির অর্থ এরকম যে, আল্লাহতায়ালা আপনাকে নবুওয়াতের জ্ঞান এবং শরীয়তের আহকাম সম্পর্কে অনবহিত অবস্থায় পেয়েছেন। অতপর তিনি ওয়াকেফহাল করে দিয়েছেন। এ অর্থ সমর্থন করেছেন হজরত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), হাসান, যেহাক প্রমুখ মুফাসসিরগণ। তাদের সমর্থিত উক্ত অর্থের সত্যায়ন করছে কুরআনে কারীমের এই আয়াতখানা, আপনি কিতাব ও ইমান সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। মর্মার্থ হচ্ছে এই যে, ওহীপ্রাপ্তির পূর্বে আপনি কুরআনে কারীম পাঠ করা এবং মাখলুককে ঈমানের দাওয়াত দেয়ার ব্যাপারটা জানতেন না।


কেউ কেউ বলেন, ইমানের অর্থ হচ্ছে শরীয়তের বিধান এবং ফরজ সমূহ। কেননা হুজুর আকরম (ﷺ) তাে ওহীর পূর্বেও তাওহীদে হকের উপর ইমান রাখতেন। আর তারপর তার তার উপর আহকাম ও ফরজ সমূহ নাযিল হলাে, যে ব্যাপারে তার ইতিপূর্বে জানা ছিলােনা। অথবা এ-ও হতে পারে যে, ঈমানের পর আবার ইমান সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে ইমানের অর্থ হচ্ছে শরীয়তের তফসীলাত (বিস্তারিত শরীয়ত) বা নামাজ। ইমান অর্থ যে নামাজ তার সমর্থনে দলিল হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার বাণী— আল্লাহ এমন নন যে, তােমাদের ইমান অর্থাৎ নামাজকে নষ্ট করে দেবেন।মর্মার্থ হচ্ছে যে নামাজ কেবলা পরিবর্তনের পূর্বে বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে লক্ষ করে আদায় করা হয়েছে, আল্লাহতায়ালা সে গুলি নষ্ট করে দেবেন না। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হুজুর আকরম (ﷺ) আল্লাহতায়ালার তাওহীদ বাস্তবায়িত করেন। মূর্তি দুশমন মনে করতেন। জাহেলী যুগেও হজ ও ওমরা আদায় করতেন। হাদীছ সমূহে এসেছে, হুজুর আকরম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমি কখনও শারাব পান করিনি, কখনও প্রতিমা পূজা করিনি, আর আমি এটা ভালােই জানতাম যে, কুরাইশরা কুফুরীর উপর রয়েছে। তিনি এ সমস্ত কথা বলতেন, অথচ ঐ সময় ইমানের তাফসীলাত সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। এমনও বর্ণিত আছে যে, কুরাইশরাও দ্বীনে ইসমাইলীর কিছু কিছু আহকামের উপর আমল করতাে। যেমন হজ, খতনা, কবর, গোসল ইত্যাদি।


# ব্যাখ্যা ২

মরফু হিসাবে বর্ণিত আছে যে, হুজুর আকরম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমি বাল্যবয়সে একদিন আমার দাদা আব্দুল মুত্তালিবের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলাম। ক্ষুধার কারণে আমি প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। তখন আমার রব আমাকে রাস্তা দেখিয়েছিলেন। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী এরকম উল্লেখ করেছেন। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাব এরপর বর্ণিত আছে। এখানে প্রসিদ্ধ যে ঘটনাটি তা হচ্ছে— দুধমাতা হজরত হালীমাতুস সাদিয়া রাসূল কারীম (ﷺ) কে নিয়ে এসেছিলেন দাদা আব্দুল মুত্তালিবের কাছে অর্পণ করার জন্য। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন।


# ব্যাখ্যা ৩

আয়াতে কারীমায় যে ضالا ‘দাল্লান' শব্দ রয়েছে তা ضل الماء في اللبن  ‘দাল্লান মাউ ফিল্লাবানে' (দুধে পানি মিশিয়েছে)' একথাটি থেকে এসেছে। তখন আয়াতের মর্মার্থ হবে এরকম, আল্লাহতায়ালা তাকে পেয়েছেন যে সময় তিনি পানিকে দুধের মধ্যে মিশিয়ে দিয়ে পানিকে দুধের মধ্যে ধরে রাখতেন। (আরব দেশে সাধারণত মিঠাই বা লাচ্ছি তৈয়ার করার সময় দুধের মধ্যে অধিকাংশ সময় পানি মিশাননা হতাে। পানিকে দুধের মধ্যে মিশ্রিত করার অর্থ হচ্ছে, তিনি মক্কার কাফেরদের কাছে মাগলুব বা পরাস্ত অবস্থায় ছিলেন। ঐ কাফেররা ছিলাে গালেব বা বিজয়ী। তখন আল্লাহতায়ালা তাকে শক্তি প্রদান করলেন, যাতে করে তিনি আল্লাহর দ্বীনকে গালেব ও বিজয়ী করে দিতে পারেন।


# ব্যাখ্যা ৪

আরবদেশে মরুভূমিতে একটি গাছ জন্মে যা বিলকুল একাকী ও নিঃসঙ্গ অবস্থায় থাকে। সে গাছটিকে আরববাসীরা - ضلالة ‘দালালাহ' বলে ডাকে। এখানে আয়াতের অর্থ এরকম, যেননা আল্লাহতায়ালা তার হাবীব (ﷺ) কে ডেকে বলছেন, হে আমার হাবীব, আপনি এই নগরীতে (দালালাহ) বৃক্ষের ন্যায় নিঃসঙ্গ ও একাকী অবস্থায় আছেন। আপনি ইমান ও তাওহীদের ফল দ্বারা উক্ত বৃক্ষকে সুশােভিত করে তুলবেন। তাই আপনাকে আমি হেদায়েত দান করলাম। এমনিভাবে আল্লাহতায়ালা তার হাবীব (ﷺ) এর দিকে মাখলুকাতকে রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। যাতে করে এ ফলদায়ক রাস্তা পেয়ে তারা উপকৃত হতে পারে–ধন্য হতে পারে।


# ব্যাখ্যা ৫

কখনও কোনাে কাওমের সরদারকে সম্বােধন করে কিছু বলা হয় কিন্তু উদ্দেশ্য থাকে কাওমের লােকসকল। অর্থাৎ আয়াতে কারীমার অর্থ হবে এরকম, আপনার কাওমকে আমি গােমরাহ পেয়েছি, তাই আমি আপনার মাধ্যমে তাদেরকে শরীয়তের সাথে হেদায়েত দান করলাম। 


# ব্যাখ্যা ৬

ضال

‘দাল্ল’এর অর্থ মহব্বতে অন্ধ । অর্থ এই যে, হে বন্ধু!

আপনার ভালোবাসায় অন্ধ দিকভ্রান্ত পথিকের ন্যায় পেয়েছি। কাজে আমি আপনাকে আমার ভালোবাসার পথ প্রদর্শন করেছি। محب 'মুহিব্বু' প্রেমিককে দাল্ল বলার অধিক প্রচলন রয়েছে। কেননা মহব্বত নিজ সত্তা সম্পর্কেও মানুষকে বেখেয়াল বানিয়ে দেয়। নিজের সুখ শান্তির কথা ভুলিয়ে দেয়। এর ফলে এমন হয় যে, কখনও সচেতন অবস্থায় সে কায়েম থাকিতে পারে না। যেমন আল্লাহতায়ালা ইরশাদ ফরমান, নিশ্চয়ই আমি তাকে প্রকাশ্য অন্ধত্বের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। আরও এরশাদ করেন নিশ্চয়ই তুমি পুরানাে অন্ধত্বের মধ্যে অবস্থান করছে।' এরূপ ব্যাখ্যা বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত আতা (رحمة الله) থেকে সংকলিত।


# ব্যাখ্যা ৭

আমি আপনাকে বিস্মৃত অবস্থায় পেয়েছি। তারপর আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। এরূপ ব্যাখ্যা শবে মেরাজের অবস্থার উপর প্রযােজ্য হয়। উক্ত মাকামের বিস্ময়কর অবস্থাদৃষ্টে হুজুর পাক (ﷺ) এর মধ্যে আত্মবিস্মৃতি দেখা দিয়েছিলাে। তিনি বিহবল হয়ে পড়েছিলেন এই ভেবে যে, তিনি হক তায়ালার কাছে কি এবং কি ভাবে নিজের আরয পেশ করবেন? হক তায়ালার হামদ ও ছানা কিভাবে প্রকাশ করবেন। তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পথ প্রদর্শন করলেন এবং কিভাবে হামদ ও ছানা প্রকাশ করবেন তার পদ্ধতি জানিয়ে দিলেন। তখন জনাব রসূলে মকবুল (ﷺ) আর করেছিলেন, হে আমার রব! আপনার উপর ছানা প্রকাশ করা আমার ক্ষমতার বাইরে। মুফাসসিরীনে কেরাম এরকম বর্ণনা করে থাকেন। তবে এরকম অর্থ করা যাবে না যে, হুজুর পাক (ﷺ) এর মধ্যে মেরাজের ঘটনা ব্যতীত অন্য সময়েও ভুল ও বিস্মৃতির আবির্ভাব হতাে। যেমন হুজুর পাক (ﷺ) এর খাতায়ে ইজতেহাদী সম্পর্কিত ব্যাপারে কোন কোন লোক মনে করে থাকে যে, হুজুর পাক (ﷺ) এর মধ্যেও ভুল ও বিস্মৃতির উদ্ভব হওয়া বৈধ। যখন এরকম কোনাে ভুলভ্রান্তি বা বিস্মৃতির আবির্ভাব ঘটতাে, তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে হুশিয়ার করে দিলেন এবং সঠিক তার উপর প্রতিষ্ঠিত করে দিতেন। এই আয়াত সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে। ওয়াল্লাহু আ’লাম।


# ব্যাখ্যা ৮

উক্ত আয়াতের অর্থ এরকম হতে পারে যে, আল্লাহতায়ালা তাকে গােমরাহ কাওমের মধ্যে পেয়েছেন। তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে তাদের গােমরাহী থেকে মাসুম রেখে ইমান, এরশাদ ও হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত করলেন। আমাদের নিকট এরকম ব্যাখ্যাই পছন্দনীয়। কেননা হুজুর পাক (ﷺ) যখন সেই গােমরাহ কাওমের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন এবং তাদের সােহবত এখতেয়ার করতেন, তখন বলা হতাে এবং ধারণা করা হতাে যে হুজুর পাক (ﷺ) হয়তাে উক্ত গােমরাহীর মধ্যে পতিত হয়ে গেছেন। মূর্খতা ও ক্ষতির ঘূর্ণাবর্তে ফেঁসে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে গেছেন বলে মনে করা হাতে। যদি আল্লাহ তায়ালার ইসমত ও হেফাযত স্থায়ী না হলে। যেমন আল্লাহপাক এরশাদ করেন, আপনাকে ফেতনায় ফেলে দেয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিলে।' এবং আল্লাহ পাক আরো এরশাদ করেছেন, আপনি তাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি স্খলনের মধ্যে নিপতিত হননি, বরং তার আগেই আল্লাহপাক হেফাযত করে নিলেন এবং সেই অনুগ্রহ টুকুই মুবালাগার ভঙ্গিতে আয়াতের মধ্যে বিবৃত হয়েছে।


# ব্যাখ্যা ৯

কিতাবে এলাহীর যা কিছু হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে নাযিল করা হলাে, তা বর্ণনা করতে তিনি হয়রান ছিলেন, আল্লাহ এরূপ অবস্থায় তাকে পেলেন। তখন আল্লাহ তাকে তা বয়ান করার হেদায়েত প্রদান  করলেন এবং বললেন, তা বয়ান করা আমার যিম্মায়। আরও বললেন আমি আপনার উপর যিকর বা নসীহত বাণী নাযিল করেছি। এ ব্যাখ্যা হজরত জুনায়েদ বাগদাদী (رضي الله عنه) থেকে সংকলিত।


# ব্যাখ্যা ১০

সাইয়্যেদুনা হযরত আলী মুর্তজা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে,হুজুর আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, “আমি জীবনে দু'বার ব্যতীত কখনো জাহেলী যুগের কার্যকলাপের প্রতি মনোযোগী হয়। সে দু'বারের প্রত্যেক বারই আল্লাহ তায়ালা তার অনুগ্রহ মাধ্যমে আমাকে তা থেকে বিরত রেখেছেন। আর আমার ইসমত, আমার ও আমার ইচ্ছার মধ্যে প্রতিবন্ধক হয়ে গিয়েছিলেন, এরপর জীবনে আর কখনো আমি এই ধরনের কাজের প্রতি আগ্রহ করিনি। এমনকি আল্লাহতায়ালা আমাকে রেসালতের মাধ্যমে ধন্য করেছেন। তিনি বর্ণনা করলেন, 'একদা কুরাইশ বংশের এক গােলাম আমার সঙ্গে মিলিত হলাে। সে মক্কার বিভিন্ন পাহাড়ে আমার সঙ্গে বকরী চরাতাে। আমি তাকে বললাম, তুমি যদি আমার বকরীগুলি একটু দেখাশােনা করতে তাহলে আমি মক্কায় যেয়ে একটু কিসসা কাহিনী শুনে আসতাম, যেমন মক্কার অন্যান্য যুবকেরা করে থাকে। আমি চারণভূমি থেকে বের হয়ে মক্কায় উপস্থিত হলাম এবং যে সমস্ত ঘরের কিসসা কাহিনী আসর জমে, তাদের কোনাে একটি ঘরে পৌছলাম। সেখানে যেয়ে আমি দেখলাম, তারা গান বাজনা, নাচানাচি ও খেল তামাশা করছে। আমি সেখানে বসে গেলাম এবং তাদের আসর দেখতে লাগলাম ।এরপর আল্লাহ তায়ালা আমার উপর ঘুমের প্রাবল্য এনে দিলেন। সেখানে আমি ঘুমিয়ে রইলাম, যতক্ষণ না আমার মাথার উপর সূর্যের প্রখরতা অনুভব করলাম। দ্বিতীয় রাতেও এমন হলো। এরপর আর কোনোদিন আমি তাদের দিকে ধাবিত হয় এবং কোন খারাপ কাজের ইচ্ছা করে না। এমন কি আল্লাহ তায়ালা আমাকে রেসালত প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করলেন। আয়াতের দ্বারা সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ পাক ভালো জানেন।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 


© | সেনানী এপ্স |

Top