আউলিয়া কেরাম
উম্মতে মোহাম্মদীর আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, এই উম্মতের মধ্যে আকতাব, আওতাদ, নুজাবা এবং আবদাল পয়দা হবেন। সাইয়্যেদুনা হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, পৃথিবীতে চল্লিশ জন আবদাল থাকবেন। এই চল্লিশ জন থেকে কোনো একজনের ইনতেকাল হলে আল্লাহ্তায়ালা সেস্থানে অন্য একজনকে আবদাল হিসেবে নিযুক্তি দেন। এই হাদীছটি ইবনে খেলাল ‘কারামাতুল আউলিয়া’ নামক বিতাবে উল্লেখ করেছেন। তিবরানী স্বীয় আউসাত নামক গ্রন্থে হাদীছটি উল্লেখ করেছেন এভাবে— পৃথিবী এধরনের চল্লিশ জন আবদাল থেকে কখনও শূন্য হবে না। তাঁরা হজরত ইব্রাহীম খলীল (عليه السلام) এর বেলায়েতের ন্যায় বেলায়েতধারী হয়ে থাকেন। যমীন তাঁদের সঙ্গে কায়েম থাকে। তাঁদের বরকতে মানুষের জন্য আল্লাহ্তায়ালা বৃষ্টিবর্ষণ করেন। তাঁদের কেউ ইনতেকাল করলে আল্লাহ্তায়ালা তাঁর স্থলে অন্য আবদাল নিয়োজিত করেন। বদল শব্দের বহুবচন আবদাল। একজনের বদলে আরেক জনকে যেহেতু আল্লাহ্তায়ালা মনোনীত করেন, সেজন্য তাঁদেরকেআবদাল বলা হয়।
আবার কেউ কেউ এই বদল নামকরণ সম্পর্কে বলেন, তাঁরা মানুষের মন্দ স্বভাবসমূহকে প্রশংসনীয় গুণাবলীতে রূপান্তরিত করে দিতে পারেন। তাই তাদেরকে আবদাল আখ্যায়িত করা হয়। তাঁরা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের বাইরে চলে আসেন।
‘আবদালগণ হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام) এর বেলায়েতের ন্যায় বেলায়েতধারী হন’ এ কথার অর্থ, হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام) যে সকল বিশেষ কামালিয়াত ও গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন, সে সমস্ত থেকে যেকোনো একটি বিশেষ কামালিয়াত ও গুণের অধিকারী তাঁরা হয়ে যান। উক্ত বিশেষ গুণটির ক্ষেত্রে তাঁরা ইব্রাহীম (عليه السلام) এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। “প্রত্যেক ওলী নবীর পদতলে” মাশায়েখগণের এই উক্তির তাৎপর্য এটাই। নবীর সমস্ত গুণাবলী কোনো ওলীর মধ্যে বিদ্যমান থাকা উদ্দেশ্য নয়। হজরত ইবনে আবী আদ্দী (رحمة الله) ‘কামেল’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, চল্লিশজন আবদালের মধ্যে বাইশজন থাকবেন শাম দেশে। আর বাকী আঠারো জন থাকবেন ইরাকে। আল্লাহ্তায়ালার হুকুম যখন হবে, তখন তাঁরা সকলেই ইনতেকাল করবেন এবং তখনই কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। মসনদে আহমদ কিতাবেও এরকম বর্ণিত আছে। হজরত আবু নাঈম ‘হুলিয়া’ কিতাবে হজরত ইবনে ওমর থেকে মারফু সনদের ভিত্তিতে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, খয়রি উম্মত বা শ্রেষ্ঠ উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সংখ্যা পাঁচশত। আর আবদালের সংখ্যা চল্লিশ। পাঁচশ’ নয়। এই চল্লিশ সংখ্যা কখনও কম হয় না। আবার অধিকও হয় না। এই চল্লিশজনের মধ্য থেকে কারও মৃত্যু হলে তাঁর স্থলে অন্য আরেকজনকে নিযুক্ত করা হয়। তাঁরা সবাই পৃথিবীতেই থাকেন। ‘হুলিয়া’ কিতাবে আরও বর্ণিত হয়েছে, হজরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে চল্লিশ জন লোক এমন হয়ে থাকে যাদের অন্তর থাকে ইব্রাহীম (عليه السلام) এর অন্তরের সঙ্গে সংযুক্ত। আল্লাহ্তায়ালা তাদের বরকতে সৃষ্টজীবকে বালা মুসিবত থেকে রক্ষা করেন। তাদেরকে আবদাল বলা হয়। এই আবদালগণ রোজা, নামাজ ও দান সদকা দ্বারা এহেন মর্যাদা লাভ করেন না। হজরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে তাঁরা এ মর্যাদা কোন আমলের কারণে পেয়ে থাকেন? রসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, মুসলানদের জন্য শুভ কামনা এবং দানশীলতার কারণে তাঁরা এহেন মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকেন। হাদীছের তাৎপর্য এই যে, রোজা, নামাজ, দান খয়রাতের দিক দিয়ে তো তাঁরা অন্যান্য মুসলমানের মতই। তবুও তাঁরা উপরোক্ত দু’টি বিশেষ গুণের অধিকারী। হজরত মারুফ কারখী (رحمة الله) থেকে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি দৈনিক এই দোয়া পড়বে ‘হে আল্লাহ্ উম্মতে মোহাম্মদীকে দয়া করো’, আল্লাহ্তায়ালা তাকে আবদালগণের তালিকাভুক্ত করে নিবেন। হুলিয়া কিতাবে এই প্রসঙ্গে এই দোয়ার উল্লেখ রয়েছে, ‘হে আল্লাহ্ উম্মতে মোহাম্মদীকে সংশোধন করে দিন, হে আল্লাহ্ উম্মতে মোহাম্মদীকে প্রশস্ত করে দিন। হে আল্লাহ্! উম্মতে মোহাম্মদীর উপর রহম করুন।’ কথিত আছে, আবদালগণের আলামত হচ্ছে, তাঁদের সন্তান-সন্তুতি থাকবে না। তাঁরা কখনো কারো উপর লানত করবেন না। যায়েদ ইবনে হারুন থেকে বর্ণিত হয়েছে, আবদাল আহলে এলেম থেকে হয়ে থাকেন। ইমাম আহমদ (رحمة الله) বলেন, আবদাল মোহাদ্দিছগণের মধ্য থেকে না হলে আর কার মধ্য থেকে হবেন।
আল্লামা খতীব (رحمة الله) তারিখে বাগদাদে উল্লেখ করেছেন, পৃথিবীতে নুকাবা থাকবেন তিনশ’, নুজাবা সত্তর, আবদাল চল্লিশ, আখইয়ার সাত, আমাদ বা আওতাদ চার, গাউছ একজন। নুকাবা থাকেন পশ্চিমাঞ্চলীয় দেশে, নুজাবার বাসস্থান সাধারণতঃ মিশরে, আবদালের বাসস্থান শামদেশে আর আখইয়ার থাকেন ভ্রাম্যমান। আমাদ বা আওতাদ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকবেন আর গাউছ এর বাসস্থান হয় মুকাররমায়। বিশৃংখলা ব্যাপক হলে তা দূর করার জন্য প্রথম দোয়া করেন নুকাবা। আর প্রয়োজন পূরণের জন্য তিনি অত্যন্ত আজেযী এনকেছারী ও বিনয়ের সাথে দোয়া করতে থাকেন। অতঃপর সে বিষয়ে দোয়া করেন নুজাবা, এরপর আবদাল, এরপর আখইয়ার, এরপর আমাদ বা আওতাদ। তাঁদের দোয়া যদি কুবল হয়ে যায়, তাহলে তো ভালোই, অন্যথায় এ ব্যাপারে দোয়ার জন্য হাত তোলেন গাউছ। তিনি অত্যন্ত আজেযী এনকেছারী ও বিনয়ের সাথে দোয়া করতে শুরু করেন। তিনি এতো বিনয়ের সাথে হাত তোলেন যে, তাঁর প্রার্থনা শেষ হওয়ার পূর্বেই কবুল হয়ে যায়।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]
© | সেনানী এপ্স |