সূরা ওয়ান নজম
হুজুর আকরম (ﷺ) এর মর্যাদা, আভিজাত্য ও তার নিদর্শন সম্পর্কে সূরা ওয়াননজমে এতাে অধিক বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে যা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তন্মধ্যে কয়েকটি দিক উল্লেখযােগ্য। যেমন, আল্লাহ তায়ালা হুজুর পাক (ﷺ) এর শানের গুরুত্ব প্রদানার্থে নজম' এর কসম করেছেন। 'নজম' শব্দের অর্থ তারকারাজির সঞ্চরণশীলতা অথবা সূরাইয়া নামক নক্ষত্র। অধিকাংশ মুফাসসিরগণ নজম' বলতে উদ্ভিদ বুঝিয়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ বলেন যে, এটা নাজমান নাজমান (অল্প অল্প করে নাযিল হওয়া) হিসাবে কুরআনে পাকেরই নাম। অথবা মােহাম্মদ মােস্তফা (ﷺ) মেরাজ রাত্রির আকাশ থেকে নির্গত অবতরণ করেছিলেন তার নাম নজম। অথবা মোহাম্মদ (ﷺ) এর পবিত্র কলব যা নূরের দ্বারা সম্প্রসারিত হয়েছিলাে এবং গায়রুল্লাহ থেকে তার কলব সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল, তার নাম নজম। যার ফলে তিনি কুদুসী (পবিত্র) আসমান থেকে উম্মা (আকর্ষণীয়) যমীনে অবতরণ করলেন এবং হেদায়েতের নীতিমালা বর্ণনা করলেন। যে কারণে আল্লাহতায়ালা তাকে প্রবৃত্তির অপ-আকাংখা থেকে পবিত্র করে দিলেন এবং হক ও সত্যবাদিতায় সুসজ্জিত করে দিলেন। এই আয়াতে কারীমা তার সাক্ষ্য বহন করছে। কলব থেকেই এরাদার উৎপত্তি। আর কলবই হচ্ছে সত্যবাদিতা ও হেদায়েতের মূল মহল। কাজেই কলবের কসম দেয়া হয়েছে। এটাই সবচেয়ে সমীচীন। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, মােহাম্মদ (ﷺ) নিজের প্রবৃত্তি প্রসূত কোনাে কথা বলেন না। তিনি তা-ই বলেন, যা তার কাছে ওহী করা হয়। এই ওহীর অর্থ হবে কুরআন। আর ওহী দ্বারা হাদীছ যাকে ওহীয়ে খফী বলা হয়, যদি তাকে বুঝানাে হয়, তাহলে তিনটি বিষয়কে উক্ত কালামের উদ্দেশ্য থেকে বাদ দিতে হবে।
(১) বদরের যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে রসূল (ﷺ)এর নির্দেশ।
(২) মারিয়ায়ে কিবতিয়া ও মধু পান ঘটনা।
(৩) খেজুর বৃক্ষের তাবীর করার ঘটনা।
এ তিনটি ঘটনা থেকে এই আয়াত বিচ্ছিন্নযােগ্য। কেননা, এ তিনটি ব্যাপার সম্পর্কে প্রকৃত করণীয় কি, সে সম্পর্কে আল্লাহপাকের ঘােষণা জানিয়ে দেয়া হয়েছিল রাসুল (ﷺ) কে। আবার এর অর্থ এ-ও হতে পারে, আল্লাহতায়ালা বলছেন, আমার বন্ধু যা বলেন এগুলি তার কথা নয়। এগুলি ওহী। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে বলা হয়েছে, আয়াতের মধ্যে যে সর্বনাম রয়েছে তা দ্বারা কুরআনকে বুঝনা চেয়ে কুরআন ও সুন্নাহ উদয় কে বুঝানাে অধিক যুক্তিযুক্ত। কেননা, কুরআন ও সুন্নাহ উভয়টিই ওহী। যেমন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, আমি আপনার উপর কিতাব ও হেকমত নাযিল করেছি। কিতাবের অর্থ কুরআন মজীদ আর হেকমতের অর্থ সুন্নতে রাসূল (ﷺ)। ইমাম আউযায়ী হজরত হাসসান ইবন আতিয়া (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে সুন্নাহ নিয়ে এমনভাবে আগমন করতেন যেমন আগমন করতেন কুরআন নিয়ে। এবং সুন্নাতসমূহ নিয়ে এসে তিনি হুজুর পাক (ﷺ) কে তার তালীম প্রদান করতেন। কাজেই এই বর্ণনা অনুসারে বুঝা যায় যে ইয়ানতিকু দ্বারা শুধু কুরআন বুঝায় না, হাদীছও বুঝায়। এবং হুজুর পাক (ﷺ) এর ইজতিহাদ ওহীর অন্তর্ভুক্ত।
ওলামায়ে কেরাম বলেন, সূরা ওয়ানজম এ উক্ত আয়াতে কারীমার পর আল্লাহতায়ালা হুজুর পাক (ﷺ) এর মেরাজের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। সে বর্ণনায় পাওয়া যায়, হুজুর পাক (ﷺ) সিদরাতুল মুস্তাহা পর্যন্ত পৌছলেন। এই মাকামটি মাখলুকের জ্ঞানের শেষ সীমা। সে মাকাম অতিক্রম করে তিনি পরওয়াদিগারের দীদারে চলে গেলেন। আল্লাহ তায়ালা তার হাবীব (ﷺ) এর দৃষ্টিশক্তিকে এরকম সম্প্রসারিত ও শক্তিশালী করে দিলেন যে, তার নয়নযুগলে কোনােরপ বিচ্যুতি আসেনি এবং সীমা লঙ্ঘন করেনি। উক্ত সফরে হুজুর আকরম (ﷺ) যা কিছু দর্শন করলেন, জাবারুত ও লাহুত জগতের, মাকামসমূহ তার চোখের সামনে উন্মোচিত হলাে, আলমে মালাকুতের যে সমস্ত অভূতপূর্ব দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করলেন, সেগুলির বর্ণনা কোনাে শব্দের সীমানায় আনা সম্ভব নয়। জ্ঞান ও বুঝের এতটুকু শক্তি নেই যে, সে সম্পর্কে সামান্যতম বর্ণনাও শ্রবণ করে তা বরদাশত করতে পারে। কাজেই এহেন বিস্ময়কর ও সঙ্গীন পরিস্থিতির বর্ণনা আল্লাহ তায়ালা শুধু ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমেই প্রদান করেছেন, যা হুজুর পাক (ﷺ) এর মাহাত্ম ও সম্মানের ইঙ্গিত বহন করে। সুতরাং এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান, আল্লাহ তায়ালা তার রাসূল (ﷺ) এর কাছে ওহী প্রদান করলেন, যা প্রদান করার ছিলাে। আহলে এলেম হযরত গণ বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর হাবীব (ﷺ) এর সাথে তিন প্রকারের কালাম করেছেন। এক প্রকার কালাম আরবী ভাষায় প্রচলিত কুরআন ও হাদীছে বিবৃত রয়েছে। এর প্রকাশ্য অর্থ মাখলুকের বোধগম্যের অন্তর্গত। দ্বিতীয় প্রকার কালাম যা ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে বিবৃত হয়েছে। যেমন কুরআনে কারীমের হরফে মুকাত্তাআত। যাকে বুঝা ও তাহকীক বা বিশ্লেষণ করা কারও ক্ষমতা ও যােগ্যতার অন্তর্ভুত নয়। তৃতীয় প্রকার কালাম যা সম্পূর্ণ অস্পষ্ট। তার ভেদ বা রহস্য উদঘাটন করতে কোনােরকম ধারণা বা খেয়াল করাও সম্ভবপর নয়। সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতের মাধ্যমে ফাআউহা ইলা আবদিহি মা আউহা।
কালাম প্রসঙ্গের পর এখন বাকী রইল রুইয়াত বা দর্শন প্রসঙ্গ। রুইয়াতে বারীতায়ালার স্বীকৃতির কথা বর্ণিত হয়েছে এই আয়াতে, (নিশ্চয়ই তিনি তাকে দেখেছেন আর একবার)। এই আয়াতের তারাহু শব্দটিতে যে হু সর্বনাম রয়েছে এই 'হু' দ্বারা কাকে বুঝানাে হয়েছে এ নিয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। অর্থাৎ হুজুর (ﷺ) তাকে মানে জিব্রাইল (عليه السلام) কে দেখেছেন, নাকি তাকে মানে আল্লাহতায়ালাকে দেখেছেন। তার পরও মতানৈক্য রয়েছে—সে দর্শন অন্তরের ছিলাে? না চোখের। এ সমস্ত মতানৈক্যের পর সুসাব্যস্ত মত এই যে, হুজুর পাক (ﷺ) এর চর্মচোখেই দীদারে বারি তায়ালা সংঘটিত হয়েছিল—এতে সন্দেহ নেই। হযরত কাবে আহবার বর্ণনা করেন, আল্লাহ তায়ালা তার দিদার ও কালামকে হজরত সাইয়্যেদুল কাউনাইন (ﷺ) এবং হজরত মুসা (عليه السلام) এর মধ্যে বন্টন করেছিলেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতায়ালা হজরত মুসা (عليه السلام) এর সঙ্গে দুবার কালাম করেছিলেন এবং হুজুর আকরম (ﷺ) কে দুবার দীদার দান করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও অধিকাংশ সাহাবীগণ মত এটাই। তবে হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এ মাসআলাটির ব্যাপারে মতানৈক্য করেছেন। ওয়াল্লাহু আ'লাম।
মােটকথা, সূরা ওয়ানজম এর মধ্যে আল্লাহ তায়ালা তার হাবীব (ﷺ) এর মর্যাদা ও পূর্ণতা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। যা তিনি ব্যতীত অন্য কোনাে নবীর ভাগ্যে ঘটেনি। সূরা ইযাস শামসু কুব্বিরাত এর আয়াতের মাধ্যমে তার সীমাহীন মর্যাদাকে তুলে ধরা হয়েছে। কোনাে কোনাে মুফাসসিরগণ এই আয়াত দ্বারা যে হুজুর পাক (ﷺ) এর মুবারক সত্তাকে বুঝানাে হয়েছে বলে মত পোষণ করেন। কেননা, তার মধ্যে আয়াতে উল্লেখিত যাবতীয় গুণাবলী, সমস্ত মর্যাদা ও কামালাতের পূর্ণ সমন্বয় সাধিত হয়েছিলাে, যেমন বলা হয়েছে সূরা আল হাক্কাহ এর এই আয়াতে
انه لقول رسول کریم
এই আয়াত দ্বারাও হুজুর পাক ( ﷺ ) এর ব্যক্তি সত্তাকে বুঝানো হয়েছে।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]
© | সেনানী এপ্স |