আমলের দিক দিয়ে উম্মতে মোহাম্মদীর বিশেষত্ব


বিপদাপদের সময় ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন’ পড়ার আমলও উম্মতে মোহাম্মদীর একটি অন্যতম বিশেষত্ব। এই দোয়া পাঠ করা  আল্লাহ্তায়ালার তরফ থেকে কেবল রহমত ও হেদায়েতপ্রাপ্তির কারণ বটে। হজরত সাঈদ ইবনে জুবায়র (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ 

করেছেন, এই উম্মতের জন্য বিপদের সময় এমন এক নেয়ামত দেয়া হয়েছে, যা কোনো নবীকেও দেয়া হয়নি। সে নেয়ামতটি হচ্ছে বিপদের সময় উক্ত দোয়া পাঠ করা। 


এই নেয়ামত যদি কোনো নবীকে দান করা হতো, তবে তা অবশ্যই হজরত ইয়াকুব (عليه السلام) কে দান করা হতো। তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন ‘ওহে! আক্ষেপ ইউসুফের উপর!’ বান্দা মিসকীন (শায়েখ আবদুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী) বলেন, উক্ত হাদীছ দ্বারা দৃশ্যতঃ আম্বিয়া কেরামের উপর উম্মতে মোহাম্মদীর প্রাধান্য বুঝা যায়। কিন্তু আসল ব্যাপার সেরকম নয়। হজরত ইয়াকুব (عليه السلام)কে ইন্না লিল্লাহ অবশ্য দান করা হয়নি। কিন্তু তার সম অর্থবোধক বাণী তাঁকে দান করা হয়েছিলো। ‘ইয়া ইউসুফ’ বলে যখন তিনি দুঃখ প্রকাশ করতেন, তখন তাঁকে দান করা হয়েছিলো ‘এখন সুন্দর ধৈর্যই কাজ, আর আল্লাহ্তায়ালাই হচ্ছেন সাহায্যকারী।’ এক্ষেত্রে যদি এরূপ বলা হয় যে, “ইন্না লিল্লাহ” নামক যে নেয়ামত এ উম্মতকে দান করা হয়েছে, এরকম নেয়ামত আর কোনো উম্মতকেই দান করা হয়নি, তাহলে উত্তম হয়। এক্ষেত্রে একটি কথা স্পষ্টভাবে জানা থাকা উচিত যে, এই উম্মতের বিশেষত্ব পূর্ববর্তী উম্মতদের তুলনায়। নবীগণের তুলনায় নয়। 


উম্মতে মোহাম্মদীর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, আল্লাহ্তায়ালা মেহেরবানি করে এই উম্মতের উপর থেকে ইসর ও আগলাল নামক শাস্তিদ্বয় উঠিয়ে দিয়েছেন। ইসর এর আলিফে যদি যের দিয়ে পড়া হয়, তবে তার অর্থ দাঁড়ায় অঙ্গীকার, ভার, গোনাহ্। আর যদি আলিফে যবর দিয়ে পড়া হয়, তবে অর্থ হবে ভঙ্গ করা, বন্ধ করা, প্রতিহত করা। আর আগলাল এর অর্থ হিংসা রাখা, গনিমতের মধ্যে খেয়ানত করা। মোটকথা শাস্তি দু’টি উঠিয়ে দেয়ার ভাবার্থ হচ্ছে শাস্তিকে লঘু করা, কষ্ট দূর করা, যা অতীতের উম্মতের বেলায় ছিলো। যেমন 

স্বেচ্ছায় হত্যা বা ভুলক্রমে হত্যার মধ্যে কেসাস নির্ধারণ করা। অন্যায়কারীর অঙ্গ কেটে দেয়া। কোনো অঙ্গে নাপাকী লাগলে তা কেটে ফেলে দেয়া, তওবার ক্ষেত্রে আত্মাহুতি দেয়া। এজাতীয় কঠিন শাস্তি ছিলো পূর্ববর্তী উম্মতগণের জন্য। কিন্তু এই উম্মতের খাতিরে তা রহিত করে দেয়া হয়েছে। 


বনী ইসরাইলদের বিধান ছিলো, রাতের অন্ধকারে কেউ গোনাহ্র কাজ করলে পরদিন সকালে তার ঘরের দরজায় লেখা থাকতো, সে এই গোনাহ্ করেছে এবং এর শাস্তি ছিলো দুই চোখ উপড়িয়ে ফেলা। তাই করা হতো। এই উম্মতের বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, আল্লাহ্তায়ালা অন্য উম্মতের তুলনায় এই উম্মতের দায়িত্বভার লঘু করে দিয়েছেন। এদের ধর্মে কঠোরতা রাখা হয়নি। দ্বীন পালনকে সহজসাধ্য করে দেয়া হয়েছে। যেমন দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে না পারলে বসে পড়লেও চলবে। সফরে রোজা ভঙ্গ করা এবং ফরজ নামাজে কসর করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তওবার দরজা রয়েছে তাদের জন্য। হককুল্লাহ্র ত্রুটির ক্ষেত্রে কাফফারা এবং হক্কুল এবাদের ত্রুটির ক্ষেত্রে দিয়ত ও যেমান আদায় করাকে বিধানসম্মত করা হয়েছে।

 

হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, বনী ইসরাইলের উপর যে সকল কঠোরতা ছিলো, এই উম্মতের উপর থেকে তা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। এই উম্মতের বৈশিষ্ট্যের আরেকটি দিক হচ্ছে, আল্লাহ্তায়ালা তাদের উপর থেকে ভুল করা, বিস্মৃত হওয়া এবং গোনাহ্তে লিপ্ত হতে বাধ্য হওয়া ইত্যাদি মাফ করে দিয়েছেন। কিন্তু বনী ইসরাইলের অবস্থা ছিলো, নির্দেশিত কাজ করতে ভুলে গেলে অথবা তা আদায় করার ক্ষেত্রে ভুল করলে অতি তাড়াতাড়ি তাদের উপর আযাব নাযিল হতো এবং তাদের গোনাহ্র প্রকৃতি ও পরিমাণ অনুসারে খাদ্যবস্তু থেকে কিছু অংশ তাদের জন্য হারাম করে দেয়া হতো। নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্তায়ালা আমার উম্মতের উপর থেকে খাতা, নিসইয়ান এবং মজবুরীর আমলের পাপ উঠিয়ে দিয়েছেন। খাতা ও নিসইয়ানের মধ্যে পার্থক্য এই যে, নিসইয়ান হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে কোনো জিনিস ভুলে যাওয়া। যেমন কোনো রোজাদার ভুলবশতঃ পানাহার করে ফেললো। আর খাতা হচ্ছে, রোজার কথা রোজাদারের স্মরণে আছে, কিন্তু কুলি করার সময় অসাবধানতাবশতঃ কণ্ঠনালীতে পানি প্রবেশ করলো। আর মজবুরীর আমল হচ্ছে, বলপ্রয়োগ করে কাউকে গোনাহ্র কাজে লিপ্ত করে দেয়া। 


যেমন, কোনো জালেম কাউকে বললো ‘কুফুরী কথা উচ্চারণ করো, নইলে হত্যা করবো।’ এমতাবস্থায় কুফুরী বাক্য উচ্চারণ করলে ক্ষতি হবে না। আল্লাহ্পাক এ ব্যাপারে তাকে পাকড়াও করবেন না।

 

এখন আলোচনায় আসা যাক, হাদীছে নফল (মনের কথা) অর্থাৎ মনের ভিতর যে সকল খেয়াল চিন্তা ও ওয়াসওয়াসার উদয় হয় সে সম্পর্কে। এর কয়েকটি অবস্থা আছে।

 

১. নিজের ইচ্ছা ও চেষ্টা ব্যতিরেকেই মনে যে সমস্ত চিন্তা খেয়াল হয় তাকে হাজেস বলা হয়।

২. উক্ত খেয়ালকে লালন করলে বা উৎসাহিত করলে তাকে বলা হয় খাতের।  


এরপর হচ্ছে কসদ ও এরাদার স্তর। করা না করার স্বাধীনতা। বান্দার অন্তরস্থিত ব্যাপার ক্ষমাযোগ্য। বরং এরাদা হওয়া সত্ত্বেও যদি উক্ত গোনাহ্টি না করে, তবে তার জন্য একটি নেকী লিখে দেয়া হয়। 


এরপর হচ্ছে আযম ও তাহিয়ার স্তর। অর্থাৎ গোনাহ্র খেয়াল, আগ্রহ ও ইচ্ছা কার্যকর করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলো, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতা প্রতিকূল হওয়ায় গোনাহ্র কাজটি করা যাচ্ছে না। এ অবস্থার জন্য আল্লাহ্তায়ালা তাকে পাকড়াও করবেন। কেনোনা এ অবস্থাটি অন্তরের স্থিরসিদ্ধান্ত। (উক্ত অবস্থায় অন্তর থেকে আল্লাহ্তায়ালাকে সরিয়ে দিয়ে গোনাহ্কে দৃঢ় স্থান দেয়া হয়েছে। তাই এর জন্য তাকে পাকড়াও হতে হবে)।অনুবাদক। 


আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের হৃদয়ে যা রয়েছে তা প্রকাশ করো আর গোপন রাখো আল্লাহ্তায়ালা এ ব্যাপারে তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন।’ তবে ব্যভিচারের স্থিরসংকল্প কিন্তু ব্যভিচারতুল্য নয়। ব্যভিচার করলে যে গোনাহ্ হয়, সংকল্প করলে সেরকম হবে না। হাঁ ব্যভিচারের সংকল্প এমন একটি গোপন গোনাহ্ যার জন্য অন্যান্য গোপন গোনাহ্র মতো পাকড়াও হওয়াও সম্ভব। উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য সবচেয়ে পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, খাইরুল উমাম (শ্রেষ্ঠ উম্মত) হওয়ার মর্যাদা লাভ করা। কেনোনা এই উম্মতের শরীয়ত পূর্ববর্তী সমস্ত শরীয়তের চেয়ে সর্বাধিক পরিপূর্ণ।


রসুলে আকরম (ﷺ) সকল উত্তম স্বভাব ও প্রশংসনীয় গুণাবলীর পূর্ণতা সাধনের জন্য আবির্ভূত হয়েছেন। তাই তাঁর আনীত শরীয়ত ও দ্বীন পূর্ববর্তী সকল দ্বীন ও শরীয়তের চেয়ে অধিকতর পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গতো হবেই। 


হজরত মুসা (عليه السلام) এর শরীয়ত কষ্টসাধ্য ও কঠিন ছিলো। যেমন, কতলে নফস বা তওবার উদ্দেশ্যে প্রাণ সংহার, হালাল বস্তু হারাম করে দেয়া, অপরাধের সাথে সাথে শাস্তি পাওয়া, অঙ্গীকার গ্রহণ, দুর্বিষহ দায়িত্বভার চাপিয়ে দেয়া এবং আল্লাহ্তায়ালার কহর ও পরাক্রমশীলতার বহিঃপ্রকাশ ইত্যাদি। ভীতিপ্রদ, ভয়াবহ ও রাগান্বিত হাল এবং শাস্তির জন্য সঙ্গে সঙ্গে পাকড়াও করার দিক দিয়ে হজরত মুসা সা. এর চেয়ে কঠিন কেউ ছিলেন না। মানুষ তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করতে পারতো না। বর্ণিত আছে, যেদিন হজরত মুসা (عليه السلام) কালামে এলাহী ও তাজাল্লী দ্বারা ধন্য হয়েছিলেন, সেদিন থেকে তিনি চাদরে মুখ ঢেকে রাস্তায় বের হতেন। স্থায়ী রোষোত্তপ্ততা থেকে মানুষ যেনো বিচলিত না হয়, এজন্য তিনি একাজটি করতেন। তাঁর উম্মতের লোকগুলোও ছিলো দূরন্ত এবং কর্কশ প্রকৃতির। সহজে সংশোধিত হওয়ার লোক তারা ছিলো না। সে দিকেই ইঙ্গিত করে আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘অতঃপর উহার পর তোমাদের হৃদয় পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেলো, এমনকি তার চেয়েও কঠিন।’ এদিকে হজরত ঈসা (عليه السلام) এর শরীয়ত ছিলো দয়া, মেহেরবানি, নম্রতা ও বিনয়ে ভরপুর। যুদ্ধ বিগ্রহের বিধান ছিলো না। নাসারাদের ধর্মে যুদ্ধ করা হারাম ছিলো। কেউ যুদ্ধ করলে সে হতো নাফরমান ও গোনাহ্গার। তাই হজরত ঈসা (عليه السلام) এর উম্মতের লোকেরা সাধারণতঃ মোলায়েম প্রকৃতির ও নরম স্বভাবের ছিলো। তাদের উপর কঠিন বিধান আরোপ করা হয়নি। বরং ইঞ্জীল কিতাবে তাদের প্রতি এরূপ নির্দেশ রয়েছে যে, ‘কেউ যদি তোমাদের ডান গালে একটি চপেটাঘাত করে, তাহলে বাম গালটিও তার সামনে এগিয়ে দাও। কেউ যদি কাপড়ের ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে ঝগড়া করে এবং তোমাদের পরিধেয় বস্ত্র খুলে নিতে চায় তাহলে পরিধেয় বস্ত্রের সাথে সাথে চাদর খানাও তাকে দিয়ে দাও। কেউ এক মাইল পথ নিতে চাইলে তার সাহায্যার্থে তুমি দুই মাইল যাও।” 


ধর্মে তারা রুহবানিয়াত বা বৈরাগ্যবাদের আবির্ভাব ঘটিয়েছে। এটা বেদাত। এটা তাদের স্বসৃষ্ট মতবাদ বৈ কিছুই নয়। আল্লাহ্তায়ালা তাদের জন্য ইঞ্জীল  কিতাবে যা লিখেছেন এবং ওয়াজিব করেছেন, ‘তাদের বৈরাগ্যবাদ তারা নিজেরাই আবিষ্কার করেছে, আমি তাদের উপর এসব ফরজ করিনি।’ হজরত ঈসা (عليه السلام) এর মধ্যে ছিলো খালেস জামালের হাল। লূতফ এবং এহসানের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো তার মধ্যে।


হজরত মুসা (عليه السلام) ছিলেন বিপরীত স্বভাবের। তাঁর মধ্যে জালাল, পরাক্রান্তি ও ভয়াবহতা ছিলো। কিন্তু আমাদের নবী করীম (ﷺ) এর মধ্যে ছিলো কামাল, জামাল এবং জালাল, এই ত্রিবিধ গুণের সমন্বয়। 


শক্তি, ন্যায়পরায়ণতা, কঠোরতা, নম্রতা, দয়া ও মেহেরবাণী এ ধরনের যাবতীয় গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন তিনি (ﷺ)। তাঁর শরীয়ত অন্যান্য সমস্ত শরীয়তের তুলনায় আকমাল। তাঁর উম্মত অন্যান্য উম্মতের চেয়ে আকমাল। তাঁর হাল এবং মাকামও তদ্রুপ আকমাল বা অধিকতর পূর্ণ। কাজেই তাঁর শরীয়ত হচ্ছে মধ্যবর্তীতাম-িত, ভারসাম্যময় এবং পূর্ণাঙ্গ। 


তাঁর শরীয়তের বিধানগুলো এতো আকর্ষণীয় যে, কোনো বিষয় ফরজ, কোনো বিষয় ওয়াজিব, কোনোটি মনছুব বা জায়েয, আবার কোনোটি মোস্তাহাব। কঠোরতার স্থলে কঠোর বিধান, নম্রতার স্থলে বিনম্রতা। কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় তরবারী চালনার বিধান, আবার কোনো ক্ষেত্রে দানশীলতার অনুপম দৃশ্য। কোনোস্থানে দেখা যায় আদল ইনসাফের বহিঃপ্রকাশ। কোথাও আবার পরিলক্ষিত হয় ফজল ও মেহেরবানির বারিবর্ষণ। একসময় একটি অন্যায়ের বিনিময়ে সমপরিমাণ শাস্তির বিধান দেয়া হয়ে থাকে। আদল ও ইনসাফের মাধ্যমে কাজ করা হয়। আবার আরেক সময় মাফ করে দিলে এবং সংশোধন করে দিলে তার পুরস্কার রয়েছে আল্লাহ্তায়ালার কাছে। এর মাধ্যমে ক্ষমার দিকে উৎসাহিত করা হয়। শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে জুলুমের আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য হুঁশিয়ার করে বলা হয়, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্তায়ালা যুলুমকারীদেরকে ভালোবাসেন না।’

 

এ জাতীয় বাণীর মাধ্যমে যুলুমকে হারাম করে দেয়া হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে ‘কেউ তোমাদেরকে শাস্তি দিলে তাদের দেয়া শাস্তির পরিমাণে তাদেরকে শাস্তি দাও।’ এজাতীয় বাণীর মাধ্যমে আদল ও ইনসাফকে ওয়াজিব করা হয়েছে, আবার যুলুমকেও হারাম করা হয়েছে। ‘তোমরা যদি ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যধারীদের জন্য তা অবশ্যই কল্যাণকর।’ এই বাণীর মাধ্যমে দয়া ও অনুগ্রহের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। এই উম্মতের জন্য যাবতীয় ক্ষতিকর ও মন্দ জিনিসকে হারাম করে দেয়া হয়েছে। যাবতীয় পছন্দনীয় ও উপকারী কাজকে মোবাহ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এই হারাম করে দেয়া উম্মতের জন্য বিশেষ রহমতস্বরূপ। কেনোনা অতীতে এ জাতীয় কাজের জন্যই আল্লাহ্তায়ালার আযাব নেমে এসেছিলো। 


এ মর্মে আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহ্তায়ালা তোমাদিগকে বেছে নিয়েছেন, রক্ষা করেছেন এবং ধর্মের মধ্যে তোমাদের উপর কোনো সংকীর্ণতা রাখেননি।’ উম্মতে মোহাম্মদী (ﷺ) কে আল্লাহ্তায়ালা সমস্ত উম্মতের উপর সাক্ষী বানিয়েছেন এবং নবীগণের স্থলাভিষিক্ত করে দিয়েছেন। কেনোনা নবীগণ সকলেই আপন আপন উম্মতের ব্যাপারে সাক্ষী প্রদান করবেন। এ উম্মতকে ‘উত্তম উম্মত যাকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে’ বলে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সম্মান ও পদমর্যাদার মাধ্যমে তাদেরকে বিশেষিত করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ্তায়ালা যাকে ইচ্ছা তাঁর রহমত দিয়ে বিশেষিত করেন। তিনিতো মহান অনুগ্রহশীল।’ 


উম্মতে মোহাম্মদীর আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, কোনো গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার উপর তারা একতাবদ্ধ হবে না। এই হাদীছখানা বহু সনদের মাধ্যমে মশহুর। হাদীছ শরীফে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন, আল্লাহ্তায়ালার কাছে আমি প্রার্থনা করলাম, হে আমার রব! আমার উম্মতের সকল লোক যেনো কোনো গোমরাহীর উপর একতাবদ্ধ না হয়। আল্লাহ্তায়ালা আমার প্রার্থনা কবুল করেছেন। অধিকন্তু এ উম্মতের জন্য আল্লাহ্তায়ালার আরেকটি বিশেষ মেহেরবানি, তাদের এজমা (ঐকমত্য) শরীয়তের একটি দলীল হিসেবে মঞ্জুরী পেয়েছে। কিন্তু পূর্ববর্তী উম্মতগণের এজমা শরীয়তের দলীল হিসেবে স্বীকৃত ছিলো না। এ উম্মতের মধ্যে এখতেলাফ একটি রহমত স্বরূপ, যা অতীত উম্মতের জন্য আযাব ছিলো। হাদীছ শরীফে উক্ত হয়েছে, আমার সাহাবীগণের পারস্পরিক মতানৈক্য তোমাদের জন্য রহমত। আমার উম্মতের পারস্পরিক মতানৈক্য রহমত এই হাদীছখানাও সর্বজনবিদিত। মুফতী ও আলেম মুজতাহিদগণের বিভিন্ন বিষয়ে ধর্মীয় মতানৈক্য সুবিদিত ব্যাপার। 


উপর্যুক্ত হাদীছের ইঙ্গিত এদিকেই। তাই দেখা যায়, কেউ কোনো বিষয়ে হালাল হওয়ার ফতওয়া দিয়েছেন। আবার অন্যে এটাকে হারাম বলেছেন। অথচ একে অপরের প্রতি দোষারোপ করেননি। কোনো কোনো আলেম আবার উক্ত হাদীছের মর্ম এভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, উম্মতের কাজ ও পেশার বিভিন্নতার মধ্যে রহমত রয়েছে। উম্মত বিভিন্ন ধরনের কাজ ও পেশা গ্রহণ করে শিল্প বা সৃজনশীলতার মধ্যে শৃংখলা ও সহজসাধ্যতার উদ্ভব ঘটাবে। তেমনি ফেকাহ শাস্ত্রের মাসআলায় আলেমগণের এখতেলাফের মাধ্যমে রূখসত বা সহজসাধ্য আমল করা এবং আমলের ক্ষেত্রে সংকীর্ণতা পরিহার করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। উম্মতে মোহাম্মদীর আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে, তাউন বা প্লেগ রোগ তাদেরকে শহীদের মর্যাদা দান করে এবং বিশেষ রহমতের কারণ হয়। অথচ এ রোগটি অন্যান্য উম্মতের জন্য ছিলো আযাব। যেমন হাদীছ শরীফে উক্ত হয়েছে, প্লেগ একটি আযাব যা বনী ইসরাইলের উপর নাযিল হয়েছিলো। অন্য এক বর্ণনায় আছে, প্লেগ তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর নাযিল হয়েছিলো আযাবরূপে। 


সহীহ্ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, মুসলমানের শহীদী মর্যাদা রয়েছে প্লেগে। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, প্লেগ আমার উম্মতের জন্য শহীদী দরোজা এবং এটি তাদের জন্য রহমত। আর কাফেরদের জন্য আযাব।


যেহেতু এ রোগটি মুসলমানদের জন্য রহমত এবং শাহাদত, কাজেই এ থেকে পলায়ন করা মুসলমানদের জন্য ধর্মযুদ্ধ থেকে পলায়ন করা সদৃশ। 


হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এবং হজরত জাবের (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে আছে, প্লেগ থেকে পলায়ন করা কবীরা গোনাহ্। এই উম্মতের বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, যখন এ উম্মতের কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে দু’জন লোক সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, লোকটি ভালো ছিলো তখন সে লোকটির জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। পূর্ববর্তী উম্মতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি এরকম ছিলো যে, একশ’ লোক ভালো বললে জান্নাত ওয়াজিব হতো। 


এ সম্পর্কে হাদীছ শরীফে এসেছে, তোমরা যার সম্পর্কে ভালো বলবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। আর যার সম্পর্কে মন্দ বলবে তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যাবে। এ উম্মতের আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, অতীত উম্মতসমূহের তুলনায় এদের আয়ু কম। তাই আমলও কম। ছওয়াব ও পুরস্কার কিন্তু কম নয়। তারা ছওয়াব পায় অত্যধিক। 


যেমন সহীহ্ হাদীছ শরীফে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, তোমাদের কাজের বর্ণনা আর তোমাদের পূর্বের ইহুদী নাসারাদের কাজের বর্ণনার উপমা হচ্ছে, যেমন কোনো লোক সারা দিনের জন্য তিনজন শ্রমিক নিয়োগ করলো। একজনকে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত, আরেকজনকে দুপুর থেকে আসর পর্যন্ত এবং শেষের জনকে আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত কাজের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হলো এবং প্রত্যেকের জন্য পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হলো এক দেরহাম করে। কাজ শেষে যখন পারিশ্রমিক প্রদানের পালা, তখন শ্রমিক তিনজন বলতে লাগলো, আমাদের কাজের পরিমাণের মধ্যে তারতম্য রয়েছে, অথচ সকলের পারিশ্রমিক সমান, এটা কেমন কথা। তখন লোকটি বললো, কাজের শর্ত মোতাবেক আমি সকলকেই দিয়েছি। বাকীটা আমার অনুগ্রহ। এটা যাকে ইচ্ছা তাকেই প্রদান করবো। 


প্রথম শ্রমিক দ্বারা ইহুদী, দ্বিতীয় শ্রমিক দ্বারা নাসারা আর তৃতীয় শ্রমিক দ্বারা উম্মতে মোহাম্মদীকে বুঝানো হয়েছে। 


এই উম্মতের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে, হাদীছ শরীফের সনদের মধ্যে সংশ্লিষ্ট হওয়ার মর্যাদা লাভ করা। কেনোনা নবী করীম (ﷺ) এর হাদীছের ক্রমধারা বিদ্যমান এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। এটা তাদের জন্য বিশেষ বৈশিষ্ট্য, আল্লাহ্তায়ালাই এ উম্মতের জন্য এ মর্যাদা ও ফযীলত দান করেছেন। 


অতীতের কোনো উম্মত এরকম মর্যাদা পায়নি। পূর্বের সহীফাসমূহ যদিও তাদের মাধ্যমেই মানুষের কাছে পৌঁছেছে, কিন্তু তারা ওই সহীফার খবরসমূহকে আত্মচিন্তার সঙ্গে সংমিশ্রিত করে ফেলেছে এবং পরবর্তী লোকেরা সেগুলো অনির্ভরযোগ্য লোকদের কাছে থেকে পেয়েছে। 


দুষ্ট লোকেরা তাওরাত ও ইঞ্জিল কিতাবে এরূপ সুকৌশলে তাদের ভ্রান্তমতবাদকে সংমিশ্রিত করে দিয়েছে যে, আসল ও নকলের মধ্যে প্রভেদ নিরূপণ করা দুষ্কর। আর এই উম্মতের লোকেরা নবী করীম (ﷺ) এর হাদীছ শরীফ এমন নির্ভরযোগ্য লোকদের মাধ্যমে পেয়েছেন, যাঁরা সর্বকালেই সত্যবাদী ও আমানতদার হিসেবে মশহুর ছিলেন। আর তাঁরাও এভাবেই হাদীছ সংগ্রহ করেছেন অন্যের নিকট থেকে। এভাবে রসুলেপাক (ﷺ) পর্যন্ত এর ক্রমধারা চলে গিয়েছে। সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাঁরা সীমাহীন যাচাই, বাছাই, পর্যালোচনা ও সত্যান্বেষণে ব্যাপৃত রয়েছেন, যাতে করে মর্যাদার দিক দিয়ে অধিকতর মযবুত ও সুরক্ষিত হাদীছ চিনে নিতে পারেন এবং জাল হাদীছকে বিশুদ্ধ হাদীছ থেকে পৃথক করে নিতে পারেন। বর্ণনাকারীগণের মধ্যে যাঁদের আপন শায়েখের সঙ্গে ওঠা বসা ও সোহবত বেশী ছিলো তাঁদের হাদীছকে ওই বর্ণনাকারীর হাদীছের তুলনায় বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন, যাঁদের আপন শায়খের সঙ্গে উঠাবসা ও সোহবত ছিলো কম। তাছাড়া বিভিন্ন ধারায় যাঁরা হাদীছ পেয়েছেন, তাঁদের হাদীছকেও বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন। 


এভাবে তাঁরা হাদীছকে ভুলভ্রান্তির অনুপ্রবেশ থেকে সংরক্ষণ করেছেন। তাঁরা শব্দ ও হরফ পর্যন্ত সংরক্ষণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন। বিশেষ করে সিহাহ্ সেত্তা কিতাবসমূহ। এর মধ্যে বোখারী ও মুসলিম শ্রেষ্ঠত্বের আসন পেয়েছে। এই দুখানি কিতাব আসমানের চন্দ্র সূর্য তুল্য। আল্লাহ্তায়ালা মুসলমানগণের তরফ থেকে তাঁদেরকে কল্যাণের পুরস্কার প্রদান করুন। এ সকল কিতাব এই উম্মতের জন্য আল্লাহ্তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ। আবু হাতেম রাযী বলেন, পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যে এমন কোনো উলামা ছিলেন না, যাঁরা আপন নবীগণের বাণীসমূহকে সংরক্ষণ করেছেন। এ কাজটি করেছে কেবল আমাদের নবীর উম্মতেরা। ইতিহাস ও বংশধারা পরিচিতির দিক দিয়েও এই উম্মতের বিশেষত্ব রয়েছে। উলামা কেরাম বলেন, সাহাবা কেরামের মধ্যে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) নসব (বংশধারা) সম্পর্কিত এলেমে সর্বাধিক অগ্রণী ছিলেন। বর্ণিত আছে, হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) সপ্তাহে একদিন কবিতা, ইতিহাস, বংশ ইতিবৃত্ত পর্যালোচনা এবং আরবের বিভিন্ন কালের আলোচনায় ব্যয় করতেন। 


সাইয়েদুনা হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি আরব কবিগণের দেওয়ান (কাব্যগ্রন্থ) এবং আরবদের ভাষা রপ্ত করার জন্য ওসিয়ত করতেন, যাতে করে কোরআনুল করীমের তাফসীর ও যথাযথ বিবরণ সহজে বোধগম্য হয়। এই উম্মতের আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, তারা দ্বীনী কিতাবাদি রচনা করার ক্ষেত্রে আল্লাহ্তায়ালার বিশেষ সাহায্যলাভ করে থাকে। হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে, এই উম্মতের মধ্য থেকে একদল লোক কিয়ামত পর্যন্তসর্বদাই সত্যকে শক্তিশালী ও বিজয়ী করতে থাকবেন। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে থাকবেন। আর তার মাধ্যমে রসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সুন্নতকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবেন। করনে আউয়াল (সাহাবীগণের যুগ) এবং করনে ছানী (তাবেয়ীগণের যুগ) এর প্রারম্ভে ধর্মগ্রন্থ প্রণয়ন ও রচনার কার্যক্রম শুরু হয়নি। যদিও সে সময় এলমের বিষয় লিপিবদ্ধ করা এবং হাদীছ সংগ্রহ ও একত্রিত করার কাজ জারী ছিলো, তথাপিও এসব বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করা এবং বিধিবদ্ধভাবে তা তৈরী করার কাজ ছিলো না। ঠিক তদ্রুপ কোনো বিষয়ের আলোচনায় অধ্যায়, অনুচ্ছেদ, ব্যবহারিক ও পরিভাষাগত শব্দের ব্যবহার, বিভিন্ন এলেমের প্রকরণ বিন্যাস, বিষয়বস্তু নির্ধারণ এবং সুলুকের মাসআলার কোনো নিয়ম ছিলো না। পরবর্তী যুগে এ সকল বিষয়ে এতো অধিক চর্চা হয় ও গ্রন্থ রচনার কাজ চালু হয়, যা গণনা করে শেষ করা মুশকিল। এ বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান কেবল আল্লামুল গুয়ুবের কাছেই রয়েছে। করন বা যুগের সময়সীমা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কারও মতে তিরিশ বৎসরের সময় সীমাকে করন বলা হয়। কারও মতে বিশ বৎসর, কারও মতে আশি বৎসর, আবার কারও মতে এক শতাব্দীকে করন বলা হয়। তবে এক্ষেত্রে শেষোক্ত কথাটি অধিকতর বিশুদ্ধ, এর দলীল হচ্ছে, রসুলেপাক (ﷺ) এক শিশুকে এই বলে দোয়া করেছিলেন, তুমি এক করন বেঁচে থেকো। শিশুটি বেঁচে ছিলো একশত বৎসর। 


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 




© | সেনানী এপ্স |

Top