সার্বজনীন রেসালত


হুজুর আকরম (ﷺ) এর চরিত্র যেহেতু মহানতম চরিত্র, তাই আল্লাহ তায়ালা তাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরণ করেছেন। তার রেসালত এর শুধু মানব জাতির জন্য সীমাবদ্ধ করেন নি, বরং নিখিল বিশ্বের সমগ্র জ্বীন-ইনসান তথা সমস্ত মাখলুকাতের জন্যই তার রেসালতকে সাধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালার রবুবিয়াত যেমন সমস্ত আলমকে বেষ্টন করেছে, তেমনি আখলাকে মোহাম্মদী (ﷺ)ও এই সমস্ত কিছুকে অধিকার করে নিয়েছে। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া এর গ্রন্থকার কোনাে কোনাে উলামায়ে কেরাম থেকে এরপ বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম (ﷺ)এর রেসালতের পরিধি ফেরেশতাকুল পর্যন্ত ব্যাপৃত। উলামায়ে কেরামের একটি দল এরূপ মত পোষণ করেন। তারা তাদের মতের স্বপক্ষে কুরআন কারীমের এই আয়াতখানাকে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করেন-রসূলে পাক (ﷺ) কে প্রেরণ করা হয়েছে সমস্ত জগতবাসীকে ভয় প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। আলামিন শব্দ দ্বারা আকলবিশিষ্ট সকলকেই শামিল করা হয়েছে। ফেরেশতা বৃন্দ যেহেতু একচলবিশিষ্ট সৃষ্টি তাই তাদের প্রতি রাসুলে পাক (ﷺ) এর রেসালত প্রযােজ্য। উক্ত মতের সপক্ষে হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত এই হাদীস খানা প্রণিধানযোগ্য। হুজুর আকরাম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমাকে সমস্ত মাখলুকের প্রতি রসূল হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ এরকম মতও পােষণ করে থাকেন যে, হুজুর পাক (ﷺ) এর রিসালাত কোন কোন ফেরেশতার উপর প্রযোজ্য। তাদের মতে সে সমস্ত ফেরেশতা, দুনিয়াতে যাদেরকে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত রাখা হয়েছে। তাদের কিছু সংখ্যক ফেরেশতাগণকে বিশিষ্ট করেছেন কেননা তার কারণ স্পষ্ট নয়। কেননা দলীল যা প্রদান করা হয়েছে তা সাধারণ নিয়মের ভিত্তিতে। এখানে বিশিষ্ট হিসাবে সীমাবদ্ধ। করার কোনাে অবকাশ নেই। আর আল্লাহ তায়ালা যে বলেছেন, আমি আপনাকে সমস্ত মানুষের জন্য রাসূল করেই প্রেরণ করেছি এটাও বিশেষদের জন্য দলীল নয়। এ আয়াতের হুকুম সম্পর্কে পছন্দনীয় মত হচ্ছে, এটা আম। এদ্বারা কাউকে খাছ করা হয়নি। যদি খাছই করা হয়, তবে তিনি যে জ্বীনদেরও নবী এটা রহিত হয়ে যায়। এরূপ হুকুম এজমার খেলাফ। তিনি কতিপয় মানুষের নবী এ বদ আকীদাটি খণ্ডন করার উদ্দেশ্যে এখানে 'সমগ্র মানুষের জন্য বলা হয়েছে। ইহুদীরা এ ধরনের বদ আকীদায় বিশ্বাসী ছিলাে। তারা মনে করতাে, হুজুর আকরম (ﷺ) কেবল আরববাসীদের জন্য নবী হিসেবে আগমন করেছেন। উক্ত বিশ্বাসকে আরও পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছেন, হে রাসূল (ﷺ) আপনি বলে দিন যে, হে মানব মন্ডলী! আমি আল্লাহর রাসূল। নিঃসন্দেহে আমি তোমাদের সকলের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহু আ'লাম।


হযরত শায়খ শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله) বলেন, অন্ত দৃষ্টি সম্পন্ন কোনাে কোনাে মুহাক্কিক আলেম এরকম বলেন যে, মুহাম্মদ মােস্তফা (ﷺ) এর আবির্ভাব জগতের সমস্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশের সাথেও সংশ্লিষ্ট। যাদের মধ্যে প্রাণীকুল, উদ্ভিদরাজি ও জড় পদার্থ শামিল। তবে জ্ঞান বিশিষ্ট যারা তাদের প্রতি তার রেসালতের বিধান প্রয়োগ করা হয়েছে —তাদের শিক্ষা দেওয়া, দায়িত্বশীল করা, শুভ সংবাদ প্রদান ও গযবে এলাহীর ভয় প্রদর্শনের নিমিত্তে। আর প্রাণী ও জড় পদার্থ এ সমস্তের প্রতি তিনি প্রেরিত হয়েছেন পূর্ণতার ফয়েয পৌছানাের উদ্দেশ্যে। যেমন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, আমি আপনাকে সমস্ত আলমের রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি। জড়পদার্থ হুজুর পাক (ﷺ) কে সালাম প্রদান করেছে। আসসালামু আলাইকুম ইয়া রসূলুল্লাহ বলেছে। এটা তাদের পক্ষ থেকে তার রেসালতের স্বীকারোক্তি। যদি কেউ এরকম প্রশ্নের অবতারণা করে যে, আদেশ, নিষেধ, দাওয়াত, সুসংবাদ প্রদান ও ভয় প্রদর্শন-এগুলিই তাে হচ্ছে রেসালতের কাজ। ফেরেশতা বৃন্দের বেলায় এগুলো কখন সংঘটিত হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর ‘মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া' কিতাব কিভাবে প্রদান করা হয়েছে যে, হয়তাে এ দাওয়াত মেরাজের রজনীতে সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু একাজকে মেরাজ রজনীর জন্য নির্দিষ্ট করার কোনো কারণ নেই। বরং সব সময় তা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলাে। কেননা হুজুর আকরম (ﷺ) এর দরবারে অধিকাংশ সময় ফেরেশতা বৃন্দের আগমন ঘটে। যেমন হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে জ্বীন জাতি আগমন করতাে। তিনি তাদেরকে দ্বীনের দাওয়াত প্রদান করতেন। জ্বীনদেরকে দাওয়াত দেয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ফেরেশতাদের ব্যাপারে তার উল্লেখ নেই। তার কারণ জীবনের ক্ষেত্রে অবাধ্যতা ও ফাসাদের তৎপরতা ছিলাে। অপরপক্ষে ফেরেশতাদের বেলায় এরকম সম্ভাবনা নেই। তাই তাদেরকে নিষেধ করা বা ভয় প্রদর্শন করার কোন প্রয়োজন পড়ে না ।যেহেতু গুনাহ করার ক্ষমতা তাদের নেই। যেমন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, তারা আল্লাহ তায়ালার কোনাে কথা অতিক্রম করে যেতে পারে না।


আলমে মালাকুতকে আলমে আমর (আদেশ জগত বা সূক্ষ্ম জগত) বলা হয়। সেখানে নিষেধ বা নিষিদ্ধতার কোনরূপ অবকাশ নেই। হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) ছাড়াও অন্যান্য ফেরেশতা যে হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে আগমন করতেন—এ সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীছ গ্রন্থে আওকাতুন্নবী অনুচ্ছেদে বর্ণনা আছে। যেমন বর্ণিত আছে, হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) এসেছেন। তার সাথে ছিলেন ইসমাইল নামে একজন ফেরেশতা। ইসমাইল ফেরেশতা এক লক্ষ ফেরেশতার সরদার ছিলেন। সে এক লক্ষ ফেরেশতা প্রত্যেকেই আবার এক লক্ষ ফেরেশতার নেতা ছিলেন। ফাযায়েলে কুরআনের অনুচ্ছেদে সূরা ফাতিহার ফযীলত এবং সূরা বাকারার শেষ আয়াত সমূহের ফযীলত সম্পর্কে এরূপ বর্ণিত আছে যে, একজন ফেরেশতা হাজির হয়েছেন তার সম্পর্কে হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) বলেছেন, এ এমন এক ফেরেস্তা যে আজকের এদিন ছাড়া পৃথিবীতে আর আগমন করেনি। সুবহানাল্লাহ। আরও অন্যান্য হাদীসে বর্ণিত আছে, হুজুর আকরম (ﷺ) এর রওজা আতাহারের সম্মানার্থে সকাল সন্ধ্যায় সত্তর হাজার ফেরেশতা আগমন করে থাকেন। যেসমস্ত ফেরেশতা হুজুর পাক (ﷺ) এর ওফাতের পর রওযা শরীফে আগমন করে থাকেন তারা তার জীবদ্দশায় যে আসতেন না এটা কেমন করে কল্পনা করা যায়?


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী] 


© | সেনানী এপ্স |

Top