পীর মুরিদের হুকুম
✍ কৃতঃ আল্লামা আজিজুল হক আল কাদেরী (رحمة الله) ➡ মুনিয়াতুল মুছলেমীন [১ম খন্ড]
❏ মাসয়ালা: (২৮৬)
পীর মুরিদের কি হুকুম?
তা অত্যন্ত বরকতের কাজ এবং কোন বড় শায়খের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করা অনেক ভাল কাজ। যদি শায়খ বাহ্যিক জ্ঞান তথা কোরআন, হাদিস ফিকাহতে যোগ্যতা রাখে ও বিশুদ্ধ আকীদা পোষণ করে। এরকম মুর্শেদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করা অত্যন্ত মোবারক। প্রকৃত পক্ষে একজন মুসলমানের জন্য মুর্শেদ হল কোরআন ও হাদিস এবং মু’মিনদের প্রধান মুর্শেদ নবী (ﷺ)। যারা এগুণে গুণান্বিত হবেন তারা রূপকার্থে মুর্শেদ। নবী (ﷺ) এর উত্তরাধিকার ঐ ব্যক্তি হতে পারে যে ঐশী জ্ঞানের বাহক। ইসলাম ধর্মের অনুসরণ ব্যতীত কেউ মুর্শেদ হতে পারে না। তা একটি ধোকা ও প্রতারণা। আমি আপসোস করি বর্তমানের অবস্থার আলোকে বলতে হয়, কিছু লোক কোন মুর্শেদের নিকট যাওয়ার পূর্বে তাকে ভাল দেখায় সাদাসিধে মনে হয়; কিন্তু যখন কারো নিকট বাইয়াত গ্রহণ করে নিজকে সঠিক ঈমানদার মনে করেন তবে অপরকে ভেজাল মু’মিন মনে করেন। নিজের ভেতরে অহঙ্কার লোক দেখানো কর্ম বেড়ে যায়। তার অন্তরে প্রশস্ততা কমে আসে, অন্তর পরিস্কার হওয়ার বিপরীতে অহঙ্কারে ভর্তি হয়। জেনে রাখা উচিত, যে ব্যক্তি যত কোরআন হাদীছের সংস্পর্শে আসবে সে ততবেশী আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করবে এবং এর বিপরীতে যে ব্যক্তি যতবেশী দুনিয়ার মাল সম্পদ তালাশ করবে সে ততবেশী তাকে দুনিয়াবাজ মুর্শেদের নিকট যেতে দেখা যাবে। সে বিনয়ী হওয়ার পরিবর্তে অহঙ্কারী হবে। তার ইবাদতে লোক দেখানো ও রিয়ার সাথে যিকির আযকার পরিলক্ষিত হবে। নিখুঁত তাওহীদ চিন্তা ভাবনা দ্বারা অর্জিত হয়। নিজের পীরের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদেরকে সঠিক অন্যদেরক কূদৃষ্টি দিয়ে দেখবে।
সার কথা হল, সে বাইয়াত গ্রহণ করার পরিবর্তে তার অন্তরে পাপ-পঙ্কিলতা জন্মায়। তার মধ্যে গোপনীয়তার স্থানে প্রকাশিত হওয়া ও আল্লাহর দিকে রুজু হওয়ার পরিবর্তে বান্দাহর দিকে দৃষ্টি দান করে। সে মুরীদদের থেকে অনেক টাকা পয়সা অর্জনে লিপ্ত হয়ে যায়। সে নিজের পরে তার অযোগ্য সন্তানকে তার স্থলাভিষিত্ব করে মুর্শেদে কামেল হয়ে যায়। অথচ তা উত্তারাধিকারী বস্তু নয়; বরং তা বেলায়তি ও নবুয়তী কাজ। যাকে চায় বসানো যাবে না। জোরপূর্বক তা অর্জন করা যাবে না।
মাহবুবে ইলহী হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া বলেন, আল্লাহর অলীদের মর্যাদা তিন প্রকার।
১.কোন ব্যক্তি অলী হবে, কিন্তু সে নিজের বেলায়তের খবর রাখে না। মানুষেরাও তার বেলায়তের খবর রাখেনা।
২. মানুষেরা তাকে অলী হিসাবে চিনে তবে সে নিজে জানে না।
৩. সে সত্য অলী নিজেও জানে অপরেও জানে।
❏ মাসয়ালা: (২৮৭)
মুর্শেদে জাহেল যে জানে সে উত্তম ঐ আলেম মুর্শেদের চেয়ে যে জানে না। যেমন হযরত আদম (عليه السلام) শয়তান থেকে উত্তম।
➠এক সময় নবী (ﷺ) ইরশাদ করেন, তোমরা ঐ আলিম থেকে বাচ যে জানে না। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, সে ব্যক্তি কে? তিঁনি বলেন যার জিহ্বা আলিম হবে; কিন্তু অন্তর অজ্ঞ।
❏ মাসয়ালা: (২৮৮)
যে আলেমে ফাযেলকে মুর্শেদ শিক্ষা দেবে তার উচিত প্রথমে তাকে মজলিসে মুহাম্মদীতে পৌঁছিয়ে দেওয়া এবং নিজে রাসূলের উক্তি দ্বারা কথা বলে হে মাওলানা আল্লাহ তালাশকারীর এটিই গুণ নতুবা সে অজ্ঞ। স্বাদ ঐ সময় পাওয়া যায়, যখন মুর্শেদ তাওফীকের মালিক হয় এবং মুরিদ আলেম ও ফাযেল হয় এবং তাহকীককারী হয়। অজ্ঞ কখনো আল্লাহর আরেফ হতে পারে না; বরং সে বেদ্বীন হয়ে যায়। ফকিরী ও মারেফাত অর্জন হওয়ার জন্য দুটি পদ্ধতি রয়েছে একটি জ্ঞানের রাস্তা। যা জ্ঞান দ্বারা অর্জিত হয়েছে। যাকে মুফাসসির মুহাদ্দিস বলা হয়। দ্বিতীয় ইলমে বাতেন যা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়।
❏ মাসয়ালা: (২৮৯)
তাই যে মুর্শেদের এ দু’টির থেকে কোনো একটি অর্জন হবে না সে অজ্ঞ। আল্লাহর মারেফাত অর্জন করতে পারবে না। যা কিছু সে অলৌকিকতা দেখায় তা ইসদারাজের অন্তর্ভূক্ত।
উলেখ থাকে যে, আলিমগণ নবীর উত্তরাধিকার তারা প্রত্যেক প্রকার মাসয়ালার সমাধান দেন। কিন্তু ফকীরগণ ফানা ফিল্লাহ আরেফ বিল্লাহ ও মারেফাত অর্জন করে। তাই বলাতে ও দেখানোতে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। যার শরীরে আল্লাহর নামের প্রভাব পড়ে তার আমলে তাওফীক হয়। তার বাইরে ও ভেতরে এক প্রকার ভান্ডারে পরিণত হয়।
❏ মাসয়ালা: (২৯০)
তালেবে ইলম তথা আলিমগণ ও তালেবে মাওলা তথা ফকীর গণের মধ্যে পার্থক্য: আলিমগণ তাওহীদের রাস্তা বলে দেন। কিন্তু ফকীরগণ সে জ্ঞান দ্বারা বাস্তব রাস্তা দেখান।
ইন্তেকালের পরে ইলম কিতাবে ও আমলদার আলিমগণ কবরে কিন্তু মুর্শেদে কামেল যাহের ও বাতেনে উপস্থিত থাকেন। তাদের নিকট আল্লাহর ভান্ডারের চাবি থাকে। বেলায়াতের অধিকারী ব্যক্তি কখনো মানুষের খেদমত থেকে বিমুখ হয় না। তিনি সূর্যের মত সকলকে তার ফয়েয দিতে থাকেন। প্রত্যেককে রাস্তা দেখান। মুরীদের স্তর উপস্থিতির মাধ্যমে অর্জিত হয়।
➥ [আকলে বেদার:২৪]
সায়্যিদুনা পীরানে পীর মুহিউদ্দীন আব্দুল কাদের জীলানী (رحمة الله) তালেব ও মুরীদদের জন্য এমন যেমন প্রাণ শরীরের জন্য। তার মুরীদ বা তালেব ভাল হোক খারাপ হোক কোন অবস্থা, কাজে, কথায় কিয়ামত পর্যন্ত তার থেকে পৃথক হয় না; বরং সময়ে তাকে সাহায্য করে।
মহান আল্লাহ নবীর মারফতে গাউছে পাককে সুসংবাদ দেন যে, আব্দুল কাদের তোমার কোন মুরীদ জাহান্নামে যাবে না। কিছু ইর্ষাপরায়ণ ও মুনাফিকরা বলে, গাউছ পাকের মুরীদদের থেকেও কেউ কেউ আমল না থাকার কারণে জাহান্নামে যাবে। মনে রাখা উচিত, ঐ ব্যক্তি জাহান্নামের উপযুক্ত যে নিজে গাউছে পাকের মুরীদ হয়ে নিজেকে গাউছে পাক থেকে পৃথক বুঝে এবং যে মুরীদ নিজেকে গাউছে পাক থেকে পৃথক বুঝবে এরকম লোককে তার মুরীদ দাবী করাও বৈধ নয়।
যখন কোন ব্যক্তি গাউছে পাককে ইখলাছ বিশ্বাস ও ইয়াকীনের সাথে মুশকিলের সময় সাহায্যের জন্য আবেদন করে তখন গাউছে পাক আধ্যাত্মিকভাবে তার নিকট তাশরীফ এনে সাহায্য করে। অনেক সময় পরিষ্কার অন্তরের অধিকারী তো তাকে স্বচক্ষে দেখতে পান।
➥ [আকলে বেদার:১৯]
❏ মাসয়ালা: (২৯১)
কাদেরী ও গাইরে কাদেরীর মাঝে পার্থক্য:
কাদেরী কষ্ট ও অনুসরণ বিহীন একত্ববাদী হয়। অন্যরা অনুসরণের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়।
❏ মাসয়ালা: (২৯২)
যে ব্যক্তি নবী (ﷺ) এর সাথে সাক্ষাত লাভ করে সে ব্যক্তিকে সূফী, ফকীর মিসকিন ও গরীব বলা হয়।
তাসাউফের পরিভাষায় মিসকিন বলা হয় যার কাছে একদিনেরও খোরাক নেই। কিন্তু সে তাসাউফের ভান্ডার রাখে। গরীব বলা হয়, ঐ ব্যক্তিকে যার শরীরে রাগ ও কঠোরতা নেই। ফকীর বলা হয়, যে সব সময় রাসূলের দিকে দৃষ্টিদান ও তার মুহাব্বাতে মগ্ন থাকে।
➠মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا .
অর্থ: আপনি আপনার আত্মাকে ঐ সকল লোকদের সাথে রাখেন যারা সকল-বিকাল আল্লাহকে ডাকে তারা তার রেযামন্দী তালাশ করে এবং তাদের থেকে আপনি মুখ ফিরাবেন না দুনিয়ার মোহে পড়ে।
➥ [কাহফ:২৮।)
❏ মাসয়ালা: (২৯৩)
যে আলেমের রাসূলের সান্নিধ্য অর্জন নেই তার জ্ঞান তাকে ফায়দা দেবে না সে গাধার মত অজ্ঞ। সে মানুষের দৃষ্টিতে তুচ্ছমানের এবং যে ব্যক্তি রাসুলের নামের অস্বীকার করে সে আবু জেহেল সানী।
➥ [আকলে বেদার:১৫]
❏ মাসয়ালা: (২৯৪)
মৃত অন্তরের জন্য তাসাউফ কঠিন। যেমন কাফিরের কালেমা পাঠ করা। কেননা; তাসাউফ দ্বারা আত্মা লজ্জিত হয়। অন্তর জীবিত হয়, আত্মা দর্শনকারী হয় এবং তাসাউফ দ্বারা মানুষ আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং নফসানী স্বাদ থেকে বিরক্ত হয়।
❏ মাসয়ালা: (২৯৫)
আলেম ও ফকীরের মাঝে পার্থক্য হল, আলিম ইলমের কারণে ব্যক্তিত্ব লাভ করে। আর ফকীর তামান্নার কারণে ব্যক্তিত্ব লাভ করে এবং তামান্নায় বিভোর হয়। সে আল্লাহর নৈকট্য মুহাব্বাত লাভ করে, তার প্রত্যেক বস্তুতে নৈকট্য অর্জিত হয়।
❏ মাসয়ালা: (২৯৬)
ইয়াকীন কয়েক প্রকার:
১. একটি হল ‘করারী’ যা মুর্তিপূজক কাফির ও জ্বিনদের অর্জিত।
২. ইকরারী যা মুসলমাদের অর্জিত।
৩. ইয়াকীন ই’তেবারী যা সত্য লোকের শিক্ষা দ্বারা অর্জিত হয়, এ ধরণের বিশ্বাস পাহাড় সমতুল্য।
৪. ইয়াকীন ফকীরের সিফাত। যা দ্বারা অক্ষমদের সহযোগতিা করা হয়। তাই যার ভেতরে ইয়াকীন স্থান পাবে তার থেকে নাস্তিকতা দূরে চলে যাবে।
➥ [আকলে বেদার:১২]
❏ মাসয়ালা: (২৯৭)
গাইব জানা আল্লাহর গুণ। মহান আল্লাহ নিজ বিশেষ বান্দাহদের নিজ স্পেশাল জ্ঞান দান করেন। যেমন ইলমে লুদুনী। কারো কারো আল্লাহর নৈকট্য দ্বারা ইলহাম অর্জিত হয়। এই রাস্তা রাসূল (ﷺ) এর প্রদর্শিত। যে তা অস্বীকার করবে সে বাতিল। তার অন্তর মৃত।
➥ [আকলে বেদার:১১]
❏ মাসয়ালা: (২৯৮)
কামেল মুর্শেদের নিদর্শন হল সে কারো নিকট মুখাপেক্ষী হবে না এবং নিজে কাশফ কারামাতের কারণে অহঙ্কারী হবে না।
➥ [আকলে বেদার:১০]