কিতাবঃ ঈমান ও ইসলাম
মূল: মওলানা খালেদ আল-বাগদাদী (رحمة الله)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
আরবী ও অনলাইন সেট-আপ: মুহাম্মদ রুবাইয়াৎ বিন মূসা।
অনুবাদকের আরয
ইরাকে বাগদাদ শরীফের মহান আলেম হযরত মওলানা জিয়াউদ্দীন খালেদ আল-বাগদাদী (رحمة الله)। প্রায় তিন শ বছর আগে তিনি এ বইটি “এ’তেকাদনামা” নাম দিয়ে রচনা করেন। তুরস্কভিত্তিক ‘ওয়াকফ এখলাস্’ (হাকীকত কিতাবেভী, ইস্তাম্বুল) সংস্থাটি তাঁর এ বইখানা “ঈমান ও ইসলাম” নাম দিয়ে আরবী ও ইংরেজি ভাষায় পুনঃপ্রকাশ করেছে। এ বইয়ে দ্বীন ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস ও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। অসংখ্য শুকরিয়া জানাই আমার পীর ও মুরশীদ (আলহাজ্জ্ব) সৈয়দ মওলানা এ,জেড,এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব কেবলার পাক দরবারে, যাঁর আধ্যাত্মিক সুদৃষ্টি ছাড়া আমি এ বইখানা অনুবাদ করতে সক্ষম হতাম না। মহান আল্লাহ্ পাক আমার পীর ও মুরশীদের অসীলায় এ বইটি কবুল করে নিলেই আমার শ্রম সার্থক হবে, আমীন!
ঈমান ও ইসলাম
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম,
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল করীম, আম্মা বা’দ
এ বইটিতে (এ’তেকাদনামা) ঈমান ও ইসলাম বর্ণনাকারী নবী করীম (ﷺ)-এর একখানা হাদীস শরীফ ব্যাখ্যা করা হবে। আমি আশা করি যে, এই হাদীসটির আশীর্বাদে মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাস পূর্ণতাপ্রাপ্ত হবে এবং তাঁরা নাজাত (পরিত্রাণ) ও সুখ-শান্তি অর্জন করতে সক্ষম হবেন। আমি আরও আশা করি যে, আমি খালেদ আল-বাগদাদী অতিশয় পাপী হওয়া সত্ত্বেও এর দ্বারা পরিত্রাণ পাবো। আল্লাহ্ তায়া'লা যিনি কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নন এবং যাঁর দয়া ও নেয়ামত অগণিত ও অফুরন্ত এবং যিনি নিজ বান্দাদের প্রতি পরম করুণাময়, তাঁর একজন নাদান, নাখাস্তা বান্দা – যার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত ও যার অন্তর অত্যন্ত কালো, ময়লা – তাকে তার অসঙ্গতিপূর্ণ কথাবার্তার জন্যে ক্ষমা করবেন এবং তার ত্রুটিপূর্ণ এবাদত-বন্দেগীও গ্রহণ করবেন। অতঃপর মিথ্যাবাদী, ধোকাবাজ শয়তানের ক্ষতি থেকেও তিনি আমাদেরকে রক্ষা করবেন এবং আমাদেরকে সুখ-শান্তি দান করবেন। নিশ্চয় তিনি দয়ালুদের সেরা এবং তিনি দাতাদেরও সেরা।
ইসলামী উলামাবৃন্দ (জ্ঞান বিশারদমণ্ডলী) বলেছেন যে প্রত্যেক বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর ও নারীর জন্যে সঠিকভাবে আল্লাহতায়া'লার ‘সিফাতুয্ যাতিয়্যা’ (সত্তাগত গুণাবলী) এবং ‘সিফাত আস্ সুবুতিয়্যা’ (প্রমাণিত গুণাবলী) সম্পর্কে জানা এবং বিশ্বাস করা অবশ্য কর্তব্য। এটাই প্রত্যেকের জন্যে প্রাথমিকভাবে ফরয (অবশ্য পালনীয়) কর্তব্য। এটা না জানাটা ওজর নয়, বরং একটি গুণাহ্। খালেদ আল-বাগদাদী (লেখক স্বয়ং) এ বইটি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও পাণ্ডিত্য অন্যদের সামনে প্রদর্শন করার জন্যে কিংবা সুনাম কুড়াবার জন্যে রচনা করিনি, বরং একটি উপহার, একটি খেদমত পেছনে রেখে যাবার জন্যেই করেছি। আল্লাহ্ পাক তাঁর ক্ষমতা দ্বারা এবং তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)-এর রহমতপ্রাপ্ত রূহ্ মোবারকের মাধ্যমে এই অধম খালেদকে সাহায্য করুন, আমীন!
আল্লাহতায়া'লা ভিন্ন অপরাপর সকল বস্তুকে “মা সিওয়া” বা “আলম” (সৃষ্টি, বিশ্বজগৎ) বলা হয়, যাকে মানুষেরা বর্তমানে “প্রকৃতি”ও বলে থাকে। সকল সৃষ্টি-ই অস্তিত্ববিহীন ছিল। একমাত্র আল্লাহতায়া'লাই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিসমূহ হলো “মুমকিন” (অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত) এবং “হাদীস” (শূন্য হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত)। অর্থাৎ, অস্তিত্ববিহীন অবস্থা হতে তারা হয়তো অস্তিত্ব পেতে পারে এবং অস্তিত্ববিহীন অবস্থায় তারা অস্তিত্ব পেয়েছে। –
وَكَاَنَ اللهُ وَلَم يَكُنْ مَعَهُ شَئٌ“
❏ আল্লাহতায়া'লা যখন ছিলেন, তখন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না”- হাদীসটি এটাকে সত্য প্রমাণ করে।
সমগ্র বিশ্বজগৎ এবং সকল সৃষ্টি যে হাদীস্ তা প্রতীয়মানকারী দ্বিতীয় প্রমাণটি হলো এই যে, সৃষ্টি জগৎ প্রতিটি মুহূর্তেই পরিবর্তিত ও বিকশিত হচ্ছে। অপর পক্ষে, যা কাদিম (আরম্ভবিহীন) তা কখনোই পরিবর্তিত হতে পারে না। আল্লাহতায়া'লার যাত মোবারক (পবিত্র সত্তা) এবং গুণাবলী হলো কাদিম ও অপরিবর্তনীয়। সৃষ্টিসমূহে সংঘটিত পরিবর্তন অনন্ত অতীত হতে আগমনকারী নয়; সেগুলোর একটি আরম্ভ আছে। সেগুলোর নিশ্চয় কোনো বস্তু বা পদার্থ দ্বারা আরম্ভ হয়েছে যা নিশ্চয়ই অনস্তিত্ব থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল।
সমগ্র বিশ্বজগৎ যে “মুমকিন” (অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত) তা প্রতীয়মানকারী আরেকটি প্রমাণ হলো এই যে, আমাদের দৃষ্ট সৃষ্টিসমূহ হলো হাদীস্ (শূন্য হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত)।
জগতে দুই প্রকারের সত্তা আছে: “মুমকিন” ও “ওয়াজিবুল ওজুদ” (অস্তিত্বসম্পন্ন সত্তা)। যদি শুধুমাত্র “মুমকিন” (অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত) বিরাজ করতো কিংবা যদি “ওয়াজিবুল ওজুদ” (অবশ্যই বিরাজমান) বিরাজ না করতেন, তাহলে কিছুই অস্তিত্বসম্পন্ন থাকতো না। এ কারণেই ’মুমকিন’ নিজ হতে অস্তিত্ব পেতে পারে না। যদি কোনো শক্তি এর ওপর প্রভাব বিস্তার না করতো, তাহলে এটা সবসময়ই অস্তিত্ববিহীন থাকতো এবং অস্তিত্বসম্পন্ন হতে পারতো না। যেহেতু একটি “মুমকিন” নিজেকেই সৃষ্টি করতে অক্ষম, সেহেতু এটা অবশ্যই অন্যান্য ‘মুমকিন’কে সৃষ্টি করতেও অক্ষম। ’মুমকিন’কে সৃষ্টি করেছেন যে সত্তা, তিনি অবশ্যঅবশ্যই ’ওয়াজিবুল অজুদ’ হবেন। “আলম” (বিশ্বজগৎ)-এর অস্তিত্ব-ই প্রতিভাত করে যে এর একজন স্রষ্টা, যিনি এটাকে অস্তিত্বহীনতা হতে সৃষ্টি করেছেন, তিনিও বিরাজমান। অতএব, সকল ’মুমকিনের’ তথা সৃষ্টিসমূহের একক স্রষ্টা হলেন ‘ওয়াজিবুল অজুদ’ যিনি নিজে হাদীস (শূন্য হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত) কিংবা মুমকিন নন, বরং সর্বদা অস্তিত্বসম্পন্ন। “ওয়াজিবুল অজুদ” অর্থ হলো এর অস্তিত্ব অন্য কোনো কিছু থেকে প্রাপ্ত নয়, বরং নিজ হতেই অস্তিত্বসম্পন্ন। অর্থাৎ, এটা সর্বদা স্ব-অস্তিত্বসম্পন্ন এবং কারো দ্বারা সৃষ্ট নয়। যদি এ রকম না হতো, তবে এটাকে অন্য কারো দ্বারা সৃষ্ট একটি সৃষ্টি (মুমকিন ও হাদীস্) হতে হতো। আর এ বিষয়টি উপরোল্লিখিত সিদ্ধান্তটির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। পারসিক “খোদা” শব্দটির মানেও হলো “সর্বদা স্ব-অস্তিত্বসম্পন্ন”।
আমরা সকল শ্রেণীর সত্তাকে একটি বিস্ময়কর নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ দেখতে পাই এবং বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত এই নিয়মের নিত্যনতুন আইন-কানুন আবিষ্কার করে থাকে। এই নিয়মের স্রষ্টা নিশ্চয় “হাই” (চিরঞ্জীব), “আলিম” (সর্বজ্ঞানী) “কাদির” (সর্ব শক্তিমান), “মুরিদ” (চূড়ান্ত ইচ্ছার মালিক), “সামিউন” (সর্ব-বিষয় শ্রবণকারী), “বাসির” (সর্ব-দ্রষ্টা), “মুতাকাল্লিম” (সর্ব বাক্ শক্তিসম্পন্ন)। কেননা, মৃত্যু, অজ্ঞতা, অক্ষমতা, শ্রবণ শক্তিহীনতা, দৃষ্টি শক্তিহীনতা, বাক্ শক্তিহীনতা ইত্যাদি হচ্ছে ত্রুটি-বিচ্যুতি, অপূর্ণতা। এই আলম (জগত) বা “কায়নাত” (সকল সত্তা) যিনি এ রকম নিয়মে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি সেগুলোকে ধ্বংস হতে রক্ষা করছেন, তাঁর পক্ষে ওই ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতির অধিকারী হওয়া একদম অসম্ভব। উপরন্তু, আমরা উপরোক্ত পূর্ণতার গুণাবলী সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও অবলোকন করে থাকি। তিনি ওই সকল গুণ তাঁর সৃষ্টির মধ্যেও সৃষ্টি করেছেন। যদি এ সব গুণ তাঁর মধ্যে বিরাজ না করতো, তাহলে কীভাবে তিনি এগুলো তাঁর সৃষ্টিসমূহের মধ্যে সৃষ্টি করতেন। তাঁর সৃষ্টিসমূহ কি তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতো না, যদি তিনি ওই সব গুণবিবর্জিত হতেন?
আমরা আরও যোগ করবো, যিনি এ সকল সত্তার জগৎসমূহ সৃষ্টি করেছেন, তাঁর মধ্যে পূর্ণতার সকল গুণ ও মাহাত্ম্য থাকা উচিৎ এবং কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি না থাকা-ই উচিৎ। কেননা, যে সত্তা ক্রটিপূর্ণ সে সৃষ্টিশীল হতে পারে না।
এ সব যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ ছাড়াও আয়াত ও হাদীসসমূহ সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে যে আল্লাহতায়া'লা পূর্ণতার অধিকারী। সুতরাং এতে সন্দেহ পোষণ করা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। সন্দেহ কুফর বা অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। তাঁর সত্তা, গুণাবলী কিংবা কর্মের মধ্যে কোনো ত্রুটি, অনিয়ম কিংবা পরিবর্তন নেই।
ইসলামের মূলনীতি
আল্লাহতায়া'লা যিনি সকল আলম (জগৎ)-কে অস্তিত্ব দিয়ে রেখেছেন এবং যিনি সকল করুণা ও দয়া প্রদর্শন করছেন এবং যিনি কখনো-ই নিদ্রাচ্ছন্ন নন, তাঁরই প্রদত্ত সাহায্য ও শক্তি দ্বারা এখন আমরা আমাদের নবী করীম (ﷺ)-এর পবিত্র মুখনিঃসৃত বাণী ব্যাখ্যা করতে শুরু করবো।
❏ আমাদের প্রিয় বুযর্গ হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه), যিনি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও মুসলিমদের সরদার ছিলেন, এবং যিনি নিজ সত্যবাদিতার জন্যে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনি বলেন:
بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ
– এটা এমন-ই এক দিন ছিল, যেদিন আমরা কতিপয় সাহাবী (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর উপস্থিতিতে এবং খেদমতে ছিলাম।
🔺[১] (ক) মুসলিম : আস সহীহ, বাবু মা‘রিফাতিল ঈমান ওয়াল ইসলাম, ১:৩৬ হাদীস নং ৮।
(খ) নাসায়ী : আস সুনান, বাবু না‘তিল ইসলাম, ৮:৯৭ হাদীস নং ৪৯৯০।
(গ) বায়হাকী : আস সুনানুল কুবরা, ৪:৫৩২ হাদীস নং ৮৬১০।
সেই দিন, সেই মুহূর্তটি এতো নেয়ামতপূর্ণ, এতো মূল্যবান ছিল যে তিনি এমন দিন আর দ্বিতীয়বার অতিক্রম করার হায়াত পাবেন কিনা সন্দেহ! সেই দিনটিতে হুজুর পূর নূর (ﷺ)-এর পবিত্র সাহচর্য ও তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলের দর্শন হযরত ওমর (رضي الله عنه)-এর ভাগ্যকে ধন্য করেছিল, যা রূহসমূহের খাদ্য ও প্রশান্তিও। দিনটির মূল্য ও মাহাত্ম্যকে সমর্থন দেয়ার জন্যে তিনি বলেন, “এটা এমন-ই এক দিন ছিল …..”। এ রকম একটি মুহূর্ত হতে কি আর অন্য কোনো সময় সম্মানজনক ও মূল্যবান হতে পারে, যখন তাঁরই ভাগ্যকে ধন্য করার জন্যে তিনি মনুষ্য বেশধারী হযরত জিবরীল (عليه السلام)-কে দেখতে ও তাঁর কণ্ঠস্বরকে শুনতে পেয়েছিলেন এবং মনুষ্যজাতির জন্যে প্রয়োজনীয় ও উপকারী জ্ঞান এতো সুন্দর এবং এতো স্পষ্টভাবে মহানবী (ﷺ)-এর পবিত্র মুখ হতে শ্রবণ করতে পেরেছিলেন?
إِذْ طَلَعَ عَلَيْنَا رَجُلٌ شَدِيدُ بَيَاضِ الثِّيَابِ، شَدِيدُ سَوَادِ الشَّعَرِ، لَا يُرَى عَلَيْهِ أَثَرُ السَّفَرِ، وَلَا يَعْرِفُهُ مِنَّا أَحَدٌ، حَتَّى جَلَسَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَسْنَدَ رُكْبَتَيْهِ إِلَى رُكْبَتَيْهِ،
– সেই মুহূর্তে চন্দ্রোদয়ের মতো এক ব্যক্তি আমাদের কাছে আসেন। তাঁর জামাকাপড় ছিল ধবধবে সাদা এবং তাঁর চুল ছিল ঘন কালো। তাঁর দেহে কোনো ভ্রমণের শ্রান্তি কিংবা ঘাম দৃশ্যমান ছিল না। হযরত নবী করীম (ﷺ)-এর সাহাবীদের মধ্যে আমরা কেউই তাঁকে চিনতাম না 🔺[অর্থাৎ, তিনি অপরিচিত আগন্তুক ছিলেন]। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সামনে উপবিষ্ট হলেন এমনভাবে যে, তাঁর হাঁটু বিশ্বনবী (ﷺ)-এর হাঁটুর সামনে স্থাপিত হলো।
وَوَضَعَ كَفَّيْهِ عَلَى فَخِذَيْهِ، وَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ أَخْبِرْنِي عَنِ الْإِسْلَامِ،
❏ – অতঃপর ওই মহান ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর পবিত্র হাঁটুর ওপর দুই হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাকে ইসলাম ও একজন মুসলিমের সংজ্ঞা প্রদান করুন।”
ইসলামের আক্ষরিক অর্থ “আত্মসমর্পণ”। রাসূলে আকরাম (ﷺ) ব্যাখ্যা করলেন যে “ইসলাম” অর্থ হলো শরীয়তের ৫টি মূল ভিত্তি, যা নিম্নরূপ:
১। فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْإِسْلَامُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، – ইসলামের পাঁচটি মূলনীতির প্রথমটি কলেমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করা। অর্থাৎ, “আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনো মা’বুদ/উপাস্য নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর প্রিয় বান্দা ও রাসূল) — বাক্যটি সবাইকে পড়তে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ব্যক্তিকে মৌখিকভাবে বলতে হবে, “আসমান ও জমিনে তিনি (আল্লাহতায়া'লা) ছাড়া আর কেউই অর্চনা পাওয়ার যোগ্য নয়। একমাত্র তাঁকেই অর্চনা করতে হবে। তিনি-ই ওয়াজিবুল অজুদ। তাঁর মধ্যে সকল প্রকারের শ্রেষ্ঠত্ব বিরাজমান। কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি তাঁর মধ্যে নেই। তাঁর নাম আল্লাহ্।” আর এ কথাগুলোকে সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করে নিতে হবে। অতঃপর আরও বলতে হবে – “হযরত মুহাম্মদ ইবনে আবদিল্লাহ্ (ﷺ) হলেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও প্রেরিত পয়গম্বর।” রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর মাতার নাম আমিনা বিনতে ওয়াহহাব। আরবের মক্কায় জন্মগ্রহণের কারণে তাঁকে একজন “আরব” বলা হয়। তাঁর গোত্রের নাম বনী হাশিম। তাঁর গায়ের রং ছিল গোলাপি এবং তাঁর চেহারা মোবারক ছিল উজ্জ্বল লালচে ফর্সা ও পছন্দনীয়; তাঁর ভ্রু ছিল কালো, চোখও কালো, প্রশস্ত কপাল এবং তাঁর আচার-ব্যবহার ছিল অত্যন্ত ভদ্র-নম্র। তাঁর কথা ছিল অত্যধিক মিষ্টি। তাঁর ছায়া কখনো মাটিতে পড়েনি। বি’সাত তথা নবুয়ত প্রকাশের সালে যখন তিনি চল্লিশ বছর বয়সে পদার্পণ করেন, তখন তাঁকে জ্ঞাত করানো হয় যে তিনি বিশ্বনবী (ﷺ)। অতঃপর তিনি মক্কা নগরীতে তেরো বছর মানুষদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন। আল্লাহর অনুমতিক্রমে এরপর তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরত করেন এবং সেখানে বসতি স্থাপন করেন। দশ বছর পর মদীনায় তিনি বেসাল (পরলোকে খোদার সাথে মিলন)-প্রাপ্ত হন।
২। وَتُقِيمَ الصَّلَاةَ – ইসলামের দ্বিতীয় মূলনীতি হলো (পাঁচ ওয়াক্ত) নামায কায়েম করা। নামায ওর ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাতসমূহের প্রতি মনোযোগ রেখে এবং আল্লাহর প্রতি অন্তরকে সমর্পণ করে সময় উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই পড়তে হবে। কুরআন মজীদে নামাযকে “সালাত” বলা হয়েছে। সালাতের অর্থ হলো কোনো ব্যক্তির প্রার্থনা, ফেরেশতাদের এসতেগফার ও খোদাতায়া'লার করুণা এবং দয়া। অবশ্য শরীয়তে এর অর্থ হলো ’এলমুল হাল্’ গ্রন্থাবলীতে প্রদর্শিত কিছু বিষয় পাঠ ও কিছু কর্ম সংঘটন। সালাত “আল্লাহু আকবর” শব্দগুলো যাকে “তাকবিরুল ইফতেতাহ্” বলা হয়ে থাকে, তা দ্বারা আরম্ভ হয় এবং কান পর্যন্ত হাত দুটো উত্তোলন করে নাভির নিচে বেঁধে তারপর পাঠ করতে হয় (পুরুষদের জন্যে)। এর পরিসমাপ্তি ঘটে কাঁধের ডান ও বাম দিকে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে যা শেষ বৈঠকে করতে হয়।
৩। وَتُؤْتِيَ الزَّكَاةَ– ইসলামের তৃতীয় মূলনীতি হলো কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি হতে যাকাত প্রদান করা। যাকাতের আক্ষরিক অর্থ পবিত্রতা। আরেক কথায়, প্রশংসা করা এবং ভালো ও সুন্দর হওয়া। শরীয়তের পরিভাষায় যাকাত মানে যাকাত প্রদানের সামর্থ্যবান ব্যক্তির সম্পত্তি হতে “নিসাব” নামক বিশেষ অংশ আলাদা করে তা আল-কুরআনে বর্ণিত মুসলমানদের কাছে তাঁদেরকে তিরস্কার না করেই প্রদান করা। যাকাত আট ধরনের লোককে দেয়া হয়ে থাকে। চার মাযহাবের সবগুলোতেই চার ধরনের যাকাত আছে; স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত, বাণিজ্যিক পণ্যের যাকাত, অর্ধ বছর হতে অধিক সময়কালব্যাপী চারণক্ষেত্রে লালিত গৃহপালিত পশু (যথা – ভেড়া, ছাগল, গরু ইত্যাদি)-এর যাকাত এবং সবশেষে জমিতে উৎপন্ন প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের যাকাত। এই চতুর্থ ধরনের যাকাত যাকে “উশর” বলা হয়, তা ফসল কেটে ঘরে তোলার অনতিবিলম্নেই প্রদান করতে হয়। বাকি তিন ধরনের যাকাত নিসাবের পরিমাণে পৌঁছার এক বছর পর প্রদান করা হয়।
৪।وَتَصُومَ رَمَضَانَ– ইসলামের চতুর্থ মূলনীতি হলো রমযান মাসের প্রতিটি দিন রোযা রাখা। রোযাকে বলা হয় “সওম”। সওমের অর্থ একটি বস্তুকে আরেকটি বস্তু হতে রক্ষা করা। শরীয়তে এর মানে নিজেকে রমযান মাসে তিনটি কাজ থেকে বিরত রাখা; যথা – আহার, পান ও স্ত্রী-সহবাস।
৫। وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إِنِ اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبِيلًا– ইসলামের পঞ্চম মূলনীতি হলো কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্যে জীবনে একবার হজ্জে গমন। হজ্জের যাতায়াত খরচ ও তার অনুপস্থিতিতে পরিবারের ভরণ-পোষণের খরচ বহনে সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্যে মক্কা শরীফ যেয়ে কাবা শরীফের তওয়াফ, আরাফাত ময়দানের ওয়াকফা ও আনুষাঙ্গিক রীতিসমূহ শারীরিক সুস্থতা ও জীবনের নিরাপত্তা বজায় রেখে জীবনে একবার পালন করা ফরয।
“রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর কাছ থেকে এ সকল জওয়াব শোনার পর ওই ব্যক্তি বললেন, قَالَ: صَدَقْتَ، قَالَ: فَعَجِبْنَا لَهُ يَسْأَلُهُ، وَيُصَدِّقُهُ ‘এয়া রাসূলাল্লাহ্ (ﷺ)! আপনি সত্য বলেছেন’! আমরা শ্রোতারা তাঁর এ মন্তব্যে বিস্মিত হয়ে গেলাম”- হযরত ওমর (رضي الله عنه) তাঁর এ বর্ণনা দ্বারা বোঝাতে চাইছেন যে, মজলিসে উপস্থিত সাহাবীবৃন্দ ওই ব্যক্তির আচরণে এ কারণে বিস্মিত হয়েছিলেন যে তিনি প্রশ্ন করে নিজেই আবার এর সত্যতা সমর্থন করেছিলেন। প্রশ্ন করা হয় সাধারণতঃ জানবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু যদি বলা হয় “আপনি সত্য বলেছেন,” তাহলে প্রতিভাত হয় যে প্রশ্নকারী আগেই উত্তরটি জানতেন।
উপরোল্লিখিত পাঁচটি মুলনীতির মুখ্য নীতি হলো কলেমায়ে শাহাদাত পাঠ করা এবং এর অর্থ বিশ্বাস করা। অতঃপর শ্রেষ্ঠ হলো সালাত। এরপর আসে সিয়াম (রোযা)। সিয়ামের পরের মূলনীতি হজ্জ। সবশেষে যাকাত। কলেমায়ে শাহাদাত যে সর্বশ্রেষ্ঠ, তা উলামায়ে কেরামের ঐকমত্য দ্বারা নিশ্চিত। অপর চারটির ব্যাপারে আমরা ওপরে যা লিখেছি, তা-ই অধিকাংশ উলামার অভিমত। কলেমায়ে শাহাদাত ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে ফরয হয়েছিল। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হয় বি’সাত বা নবুয়ত প্রচারের এক যুগের মাথায় – হিজরতের এক বছর কয়েক মাস আগে, মে’রাজ রজনীতে। রোযা দ্বিতীয় হিজরী সালের শা’বান মাসে ফরয করা হয়। যে বছর রোযা ফরয হয় সেই বছরের রমযান মাসে যাকাতও ফরয করা হয়। আর ষষ্ঠ হিজরী সালে হজ্জ ফরয করা হয়। ফলে মাহাত্ম্যের ক্ষেত্রে যাকাত সর্বশেষ, আর সর্বশেষ ফরয হওয়ার সময় হিসেবে হজ্জ-ই সর্বশেষ।
যদি কোনো ব্যক্তি ইসলামের এ পাঁচটি মূলনীতির যে কোনো একটিকে অস্বীকার করে, কিংবা অবিশ্বাস করে, কিংবা প্রত্যাখ্যান করে, অথবা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে, অথবা অশ্রদ্ধা করে, তবে সে কাফের (অবিশ্বাসী) হয়ে যাবে। আল্লাহ্ আমাদের রক্ষা করুন, আমীন!
অনুরূপভাবে, যে ব্যক্তি সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষিত হালাল কিংবা হারাম বস্তুসমূহকে সেভাবে গ্রহণ না করে, কিংবা হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল হিসেবে আখ্যা দেয়, সেও কাফেরে পরিণত হয়। যদি কোনো ব্যক্তি সর্বসাধারণের শ্রুত ও জ্ঞাত কোনো একটি ইসলামী বিশ্বাসকে অস্বীকার কিংবা ঘৃণা করে, অর্থাৎ, এমন শিক্ষা যা সাধারণ মুসলমানবৃন্দও শুনেছেন এবং জেনেছেন, তাহলে সেও কাফেরে রূপান্তরিত হবে। যদি কোনো সাধারণ ব্যক্তি সর্বসাধারণ্যে ততোটুকু জ্ঞাত কিংবা শ্রুত কিংবা প্রসারলাভকৃত শিক্ষাসমূহ সম্পর্কে জ্ঞাত না হয় যা তার জানা থাকা উচিৎ, তবে সে কাফের হবে না বটে, কিন্তু গুণাহগার (ফাসিক) হবে।
ঈমানের মূলনীতি
قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنِ الْإِيمَانِ، – ওই মহান ব্যক্তি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ্ (ﷺ)! এবার আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন।” ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করার এবং উত্তর পাওয়ার পর হযরত জিবরাইল আমীন (عليه السلام) রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর কাছে ঈমানের সারমর্ম ও প্রকৃতি জানতে চাইলেন। ঈমান অর্থ হলো কোনো সত্তাকে ত্রুটিবিহীন ও সত্যবাদী জানা এবং তাঁর প্রতি আস্থা রাখা। শরীয়তের পরিভাষায় অবশ্য এর মানে হলো এই বিষয়টিতে বিশ্বাস যে, রাসূলে আকরাম (ﷺ) আল্লাহতায়া'লার সর্বশেষ মনোনীত পয়গম্বর; আর এ কথাটি সর্বান্তকরণে মৌখিকভাবে উচ্চারণ করা এবং তিনি যা সংক্ষিপ্তভাবে এনেছেন তা সংক্ষিপ্তভাবে বিশ্বাস করা ও তিনি যা আল্লাহ্ পাকের কাছ থেকে বিস্তারিতভাবে এনেছেন তা বিস্তারিতভাবে বিশ্বাস করা; এ ছাড়া যতোবার সম্ভব ঘনঘন কলেমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করা। শক্তিশালী ঈমান সেটাই – যেভাবে আগুন দহন করে কিংবা সর্পের বিষ মৃত্যু ঘটায় ইত্যাদি চিরসত্যে আমরা বিশ্বাস করি এবং ওগুলো থেকে সতর্ক থাকি, ঠিক সেভাবে আমাদেরকে আল্লাহতায়া'লা ও তাঁর গুণাবলীকে মহান জানতে হবে এবং এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে, আর তাঁর প্রেম ও সৌন্দর্যের (জামাল) জন্যে প্রার্থী হতে হবে এবং তাঁর গযব (রুদ্ররোষ) ও জালাল (ভয়াল রূপ) হতে সতর্ক থাকতে হবে। মারবেলে খোদাইকৃত লেখার মতোই এই ঈমানকে আমাদের হৃদয়ের গভীরে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করতে হবে।
ঈমান ও ইসলাম হলো এক-ই। উভয়টিতেই কোনো ব্যক্তিকে কলেমায়ে শাহাদাত-এ বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। যদিও “উমুম” (সার্বিক দিকগুলো) ও “খুসুস” (বিশেষ দিকগুলো)-তে তাদের উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বিরাজমান এবং যদিও তাদের উভয়ের আক্ষরিক অর্থ পৃথক, তবু শরীয়তে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য-ই বিরাজমান নেই।
ঈমান কি একটি মৌল উপাদান? নাকি বহু যৌগ উপাদানে গঠিত? যদি এটা যৌগ উপাদানে গঠিত হয়ে থাকে, তাহলে এর কতোগুলো অংশ আছে? আমল কিংবা এবাদত ঈমানের অন্তর্ভুক্ত কি-না? যখন “আমি ঈমান রাখি” বলা হয়, তখন কি “ইনশা’আল্লাহ্” যোগ করা উচিৎ? ঈমানের মধ্যে কি স্বল্পতা কিংবা স্ফীতি আছে? ঈমান কি একটি প্রাণী? এটা কি কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তির আয়ত্ত্বাধীন? নাকি ঈমানদারেরা চাপের মুখেই বিশ্বাস করে নিয়েছেন? যদি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে শক্তি কিংবা চাপ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তাহলে কেন সবাইকে বিশ্বাস করতে আদেশ দেয়া হয়েছে? এ প্রশ্নগুলো একে একে ব্যাখ্যা করতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। অতএব, এখানে আমি এগুলো আলাদা আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করবো না। কিন্তু এটা ভালো করে জেনে রাখা দরকার যে, আশআরী ও মু’তাযেলা মতবাদ অনুযায়ী আমাদের সাধ্যাতীত কোনো কর্ম সংঘটন করার আদেশ দেয়াটা আল্লাহর পক্ষে জায়েয নয়। আর মু’তাযেলা সম্প্রদায়ের মতানুযায়ী তা সম্ভব, কিন্তু মানুষের ক্ষমতাবহির্ভূত কাজের আদেশ দেয়া আল্লাহর পক্ষে জায়েয নেই। আশআরীদের মতে এটা জায়েয, কিন্তু খোদাতায়া'লা তা আদেশ করেন নি। মানুষদেরকে আকাশে উড়তে বলা এ ধরনের একটি দৃষ্টান্ত। ঈমান কিংবা এবাদতের ক্ষেত্রে কোথাও আল্লাহ্ পাক তাঁর সৃষ্টিসমূহকে তাদের সাধ্যাতীত কোনো কাজ করতে আদেশ দেননি। এ কারণেই যে ব্যক্তি মুসলিম থাকা অবস্থায় পাগল কিংবা গাফেল (উদাসীন) কিংবা নিদ্রাচ্ছন্ন কিংবা মৃত হয়ে যায়, সে মুসলমান-ই থাকে; যদিও তার অবস্থা নিশ্চিত নয়।
এই হাদীসে ‘ঈমানের” আক্ষরিক অর্থ সম্পর্কে চিন্তা করা আমাদের উচিৎ নয়। কেননা, তদানীন্তন আরবে এমন কোনো সাধারণ মানুষও ছিলেন না, যিনি এর আক্ষরিক অর্থ জানতেন না। সত্য বটে, নবী করীম (ﷺ)-এর সাহাবীবৃন্দও তা জানতেন। কিন্তু হযরত জিবরীল (عليه السلام) শরীয়তে এর অর্থ কী তা জিজ্ঞেস করে সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه)-কে ঈমানের অর্থ শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। আর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন যে ঈমান হলো ছয়টি বিষয়ের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস:
১। প্রথমতঃ أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ – “আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস।” আল্লাহতায়া'লা-ই যে ’ওয়াজিব আল অজুদ’ এবং প্রকৃত মা’বুদ (উপাস্য) ও সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, তা ওই ছয়টি বিষয়ের প্রথমটি। এটা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে কেবলমাত্র আল্লাহতায়া'লাই এ জগৎ ও পরবর্তী জগতে শূন্য হতে কোনো বস্তু, সময় কিংবা সাযুজ্য ছাড়াই সকল জিনিস সৃষ্টি করে থাকেন। তিনি যেমন বিশ্বজগতের সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন, ঠিক তেমনি তিনি-ই সব কিছু ধ্বংস করে দেবেন (কেয়ামতের সময়)। সৃষ্টিসমূহের স্রষ্টা, মালিক, সর্বময় শাসনকারী হলেন একমাত্র আল্লাহ্ পাক-ই। এ কথাও বিশ্বাস ও জ্ঞাত করতে হবে যে তাঁর ওপর কোনো আধিপত্য বিস্তারকারী কিংবা হুকুমকারী অথবা তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সত্তা আর কেউই নেই। সব ধরনের শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য এবং পূর্ণতার গুণাবলী একমাত্র আল্লাহতায়া'লার জন্যেই বিহিত। তাঁর মধ্যে কোনো দোষত্রুটি কিংবা বিচ্যুতি বিরাজমান নেই। তিনি যা এরাদা (ইচ্ছা) করেন, তা-ই করতে সক্ষম হন। তিনি কাউকে খুশি করার জন্যে কিছু করেন না। পুরস্কারের জন্যেও তিনি কিছু করেন না। তবে তাঁর কৃত সকল কর্মের মধ্যেই হেকমত বা গোপন বিষয়াদি, উপকার ও বরকতসমূহ অন্তর্নিহিত রয়েছে।
আল্লাহর প্রতি আহলুস সুন্নাহর আকিদা
সৃষ্টিসমূহের কল্যাণ ও উপকার করতে আল্লাহ বাধ্য নন। আবার কিছু লোককে পুরস্কৃত করে কিছু লোককে শাস্তি দিতেও তিনি বাধ্য নন। যদি তিনি সকল পাপীকে জান্নাতে দাখিল করেন, তবে সেটা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও দয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আর তাঁর ন্যায়বিচারের সাথে এটাও সঙ্গতিপূর্ণ হবে যদি তিনি তাঁর অনুগত এবাদত-বন্দেগীকারীদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেন। তবু তিনি ঘোষণা ও ডিক্রি (বিধান জারি) করেছেন যে তাঁর উপাসনাকারী মুসলমানদেরকে তিনি জান্নাতে দাখিল করবেন এবং তাঁদের প্রতি তাঁর রহমত বর্ষণ করবেন, আর তিনি অবিশ্বাসী কাফেরদেরকে জাহান্নামে অনন্তকাল শাস্তি দেবেন। তিনি কখনোই তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। যদি সমস্ত সৃষ্টিজগত তাঁকে বিশ্বাস করতো এবং তাঁর অর্চনা করতো, তাতে তাঁর কোনো উপকার-ই হতো না। পক্ষান্তরে, যদি সমস্ত সৃষ্টিজগৎ অবিশ্বাসী কিংবা অবাধ্য হয়ে যেত, তাতেও তাঁর কোনো ক্ষতি হতো না। যখন মানুষ কোনো কিছু করতে চায়, তখন তাঁর ইচ্ছা হলে তিনি তা সৃষ্টি করে দেন। তাঁর সৃষ্ট মানুষের সকল ক্রিয়া এবং সকল বস্তু একমাত্র আল্লাহতায়া'লাই সৃষ্টি করে থাকেন। যদি তিনি সৃষ্টির এরাদা (ইচ্ছা) না করেন, তবে কোনো কিছুই সংঘটিত হতে পারে না। যদি তিনি ইচ্ছা না করেন, তাহলে কেউই অবিশ্বাসী কিংবা বিদ্রোহী হতে পারে না। কেউই তাঁর সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় কিংবা কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। তিনি কেন এমন করেছেন অথবা অমন করেছেন অথবা তিনি কীভাবে করবেন সে বিষয়ে মন্তব্য করার কোনো অধিকার কিংবা ক্ষমতা কারোরই নেই। শেরক কিংবা কুফর ছাড়া বাকি যে কোনো বড় অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি, যে নাকি তওবা ব্যতিরেকেই মৃত্যু বরণ করেছে, তাকে তিনি ইচ্ছা করলে মাফ করে দিতে পারেন। অপর পক্ষে, তিনি যদি ইচ্ছা করেন, তবে ছোট-খাটো পাপের জন্যেও তিনি তাকে শাস্তি দিতে পারেন। তিনি ঘোষণা করেছেন যে তিনি কখনোই অবিশ্বাসী ও ধর্মত্যাগী (মুরতাদ)-দেরকে ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে অনন্তকাল শাস্তি দেবেন। তিনি তাঁর এবাদতকারী সেই সব মুসলমানদেরকেও শাস্তি দেবেন, যাদের আকীদা-বিশ্বাস আহলে সুন্নাতের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং যারা তওবা না করে মৃত্যুবরণ করেছে।
আল্লাহকে দেখা সম্পর্কিত আকিদা
পৃথিবীতে চোখ দ্বারা আল্লাহতায়া'লাকে দেখা সম্ভব (জায়েয), কিন্তু কেউই কখনো দেখেননি। শেষ বিচার দিনে কাফের ও গুণাহগার মুসলমানরা তাঁকে তাঁর রূদ্র রূপে দেখতে পাবে। পক্ষান্তরে, পুণ্যবান মুসলমানবৃন্দ তাঁকে তাঁর জামাল (সুন্দর) ও দয়ালু রূপে দেখতে পাবেন। বিশ্বাসী মুসলমানবৃন্দ তাঁকে তাঁর “জামালী” গুণাবলীসহ বেহেশতে দেখবেন। ফেরেশতা ও মহিলারাও তাঁকে দেখতে পাবেন। কিন্তু অবিশ্বাসী কাফেররা এ থেকে বঞ্চিত হবে। একটি শক্তিশালী খবরে (বর্ণনায়) বিবৃত হয়েছে যে (অধিকাংশ) জ্বিনরাও এ থেকে বঞ্চিত হবে। অধিকাংশ উলামার মতানুযায়ী “আল্লাহতায়া'লার ভালোবাসাপ্রাপ্ত মুসলমানবৃন্দ প্রতি সকাল ও প্রতি বিকেলে আল্লাহতায়া'লার ’জামাল’ (সৌন্দর্য) দর্শনে ধন্য হবেন। কম মর্যাদাসম্পন্ন মুসলমানবৃন্দ প্রতি শুক্রবার তাঁর দর্শনে ধন্য হবেন; আর মহিলাবৃন্দ দুনিয়ার উৎসব পর্বের দিনগুলোর মত বছরে কয়েকবার তাঁকে দেখবেন।” এটা বিশ্বাস করতে হবে যে আল্লাহতায়া'লাকে দেখা যাবে। কিন্তু এটা কীভাবে হবে তা নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করা উচিৎ নয়। কেননা, আকল্ (বুদ্ধি) দ্বারা আল্লাহ্ পাকের কর্মকাণ্ড উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাঁর ক্রিয়াসমূহ দুনিয়াবী বিষয়াবলী নয়। সেগুলোকে পদার্থবিদ্যা কিংবা রসায়নবিদ্যার মাপকাঠিতে পরিমাপ করা যায় না। দিক কিংবা বিপরীত দিক কিংবা কাছের দিক দ্বারা আল্লাহর অবস্থান নির্ণীত হয় না। আল্লাহ্ পাক কোনো বস্তু নন। তিনি কোনো উপাদান কিংবা উপাদানের সংমিশ্রণ কিংবা যৌগ উপাদানও নন। তিনি অসীম। তিনি সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ নন, তাই তাঁকে মূল্যায়নও করা যায় না। তাঁর মধ্যে কোনো পরিবর্তন সাধিত হয় না। তিনি স্থান, কাল, পাত্র দ্বারা সীমাবদ্ধ নন। তার কোনো অতীত কিংবা ভবিষ্যত, সম্মুখভাগ কিংবা পশ্চাৎভাগ, উপরিভাগ কিংবা তলদেশ, দক্ষিণ কিংবা বাম দিক নেই। অতএব মানব যুক্তি কিংবা বুদ্ধি কিংবা জ্ঞান তাঁকে উপলব্ধি করতে একেবারেই অক্ষম। তাই তাঁকে কীভাবে দেখা যাবে তা মানুষ বুঝতে অপারগ। যদিও আল্লাহতায়া'লার জন্যে অপ্রযোজ্য ’হাত’, ’পা’, ’দিক’, ’স্থান’ ও অনুরূপ বিষয়াদির বর্ণনা কুরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহে বিরাজমান, তবুও বর্তমানকালে আমরা যেভাবে সেগুলোর ব্যবহার করি, সেভাবে সেগুলোর অর্থ ব্যবহৃত হয়নি। ওই ধরনের আয়াত ও হাদীসসমূহকে “মুতাশাবিহাত” বলা হয়ে থাকে। এগুলোতে আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু মুতাশাবিহাতকে বুঝতে অথবা ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করা আমাদের পক্ষে উচিৎ হবে না। অথবা সেগুলোকে তা’বিল (ভিন্নতর ব্যাখ্যা) করা যেতে পারে সংক্ষিপ্ত বা বিস্তারিত আকারে। অর্থাৎ, আল্লাহতায়া'লার জন্যে বিহিত অর্থসমূহ সেগুলোর প্রতি আরোপ করা যেতে পারে। যথা – ‘হাত’কে শক্তি কিংবা ক্ষমতারূপে ব্যাখ্যাকরণ।
মে’রাজ রজনীতে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) আল্লাহ পাকের দর্শন লাভ করেন (এ দর্শন চর্মচক্ষে হয়েছিল)। কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তি দাবি করে সে আল্লাহকে এ পৃথিবীতে দেখেছে, তবে সে একজন যিনদিক (অন্তর্ঘাতী শত্রু)। আউলিয়ায়ে কেরামের (رحمة الله) দর্শনক্ষমতা অবশ্য এ পৃথিবীর কিংবা পরকালের দৃষ্টিক্ষমতা নয়। আরেক কথায়, তাঁদের ওপর “রূ’য়্যা” (দৃষ্টি) নয়, বরং “শুহুদ” (দিব্যদৃষ্টি) প্রকাশ পায়। কিছু আউলিয়া বলেছেন যে তাঁরা দর্শন করেছেন। তবে, তাঁদের জযবার অবস্থায় (অর্থাৎ, ভাবের সাগরে তন্ময় অবস্থায়) তাঁরা শুহুদকে রূ’য়্যা হিসেবে ভুল বুঝেছিলেন। অথবা তাঁদের কথাকে তা’বিল করতে হবে।
🔴প্রশ্নঃ ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে আল্লাহকে এ পার্থিব চোখ দ্বারা দেখা জায়েয (সম্ভব)। তাহলে যে ব্যক্তি এটাকে সম্ভব বলে তাকে কীভাবে যিনদিক আখ্যা দেয়া যায়? যদি ওই কথা উচ্চারণকারী ব্যক্তি কাফের হয়ে যায়, তাহলে কি সেটাকে সম্ভব বলা যাবে?
🖋উত্তরঃ আক্ষরিক অর্থে “জায়েয” শব্দটির মানে হলো সংঘটিত হওয়া সম্ভব কি-না। তবে ইমাম আশআরীর মতে, রূ’য়্যার সম্ভবনার অর্থ হলো আল্লাহতায়া'লা মানুষের মধ্যে এমন এক অন্য ধরনের দর্শনক্ষমতা সৃষ্টি করতে সক্ষম যা তাঁকে সামনাসামনি দেখার থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন এবং যা তাঁর সৃষ্ট দুনিয়ার প্রাকৃতিক নিয়ম হতেও ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি যেহেতু সক্ষম, সেহেতু এটা সম্ভব যে চীনের একজন অন্ধ লোককে তিনি আন্দালুসিয়ার একটি মশা প্রদর্শন করতে পারেন কিংবা চাঁদ অথবা নক্ষত্রের মধ্যে অবস্থিত কোনো বস্তু তিনি পৃথিবীতে অবস্থানকারী কোনো ব্যক্তিকে প্রদর্শন করতে পারেন। এ ক্ষমতাটি কেবলমাত্র আল্লাহতায়া'লার জন্যেই সুনির্দিষ্ট (খাস্)। উপরন্তু, আমরা বলি, “আমি এ পৃথিবীতে দেখেছি” বলাটা আয়াত ও উলামায়ে কেরামের মতৈক্যের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। অতএব, যে ব্যক্তি ও রকম কথা বলবে, সে যিনদিক কিংবা মুলহিদ (ধর্মচ্যুত) হয়ে যাবে। তৃতীয়তঃ আমরা বলি, “এ পৃথিবীতে আল্লাহকে দেখা জায়েয” মানে এই নয় যে “প্রাকৃতিক নিয়মকানুনের অধীন এ পৃথিবীতে আল্লাহকে দেখা জায়েয।” কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তি অন্যান্য বস্তুকে দেখার মতোই আল্লাহকে দেখার দাবি করে, তাহলে তার এ দাবি জায়েয (সম্ভব) নয়। যে ব্যক্তির কথাবার্তা অবিশ্বাস জন্ম দেয়, তাকে যিনদিক কিংবা মুলহিদ বলে। অতএব, সাবধান!
আল্লাহ অতুলনীয়, তিনি সৃষ্টির প্রতি মুখাপেক্ষী নন
আল্লাহতায়া'লার সাথে সময় কিংবা দিন-রাত্রির আবর্তন সম্পৃক্ত নয়। তাঁর মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন-ই সাধিত হয় না। এ কথাও বলা যায় না যে তিনি অতীতে এ ধরনের ছিলেন, কিংবা ভবিষ্যতে আরেক ধরনের হবেন। আল্লাহ্ পাক কোনো কিছুর মধ্যে প্রবিষ্ট হন না। কোনো জিনিসের সাথে তিনি একীভূতও হন না। আল্লাহতায়া'লার কোনো শরীক, সহকারী, পথপ্রদর্শক কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী সত্তা নেই। তাঁর কোনো পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা কিংবা স্ত্রীও নেই। তিনি সর্বদা সকলের কাছে হাযের-নাযের, সকল জিনিস ও বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত। প্রত্যেক ব্যক্তির গ্রীবাস্থ শিরাটির চাইতেও তিনি সন্নিকটে। তবে আমরা উপরোক্ত কথানুযায়ী তাঁর উপস্থিতি, নৈকট্য বলতে যা বুঝি, বাস্তবে কিন্তু তা নয়। তাঁর নৈকট্য উলামাবৃন্দের জ্ঞান, বিজ্ঞানীদের মস্তিষ্ক দ্বারা উপলব্ধি করা অসম্ভব। মানব-যুক্তি ও বিচার-বুদ্ধি কথাগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে সক্ষম নয়। আল্লাহ্ পাক তাঁর সত্তা ও গুণাবলীতে তুলনাবিহীন এবং অসাযুজ্যপূর্ণ। তাঁর সত্তাগত গুণাবলীর মধ্যেও কোনো পরিবর্তন অথবা পৃথকীকরণ সাধিত হয় না।
আল্লাহ্ পাকের নামগুলো তওকিফী। অর্থাৎ, তাঁর নামগুলো শরীয়ত-প্রদর্শিত পন্থায় ব্যবহার করা অনুমতিপ্রাপ্ত এবং অন্য শব্দ ব্যবহার করা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। আল্লাহতায়া'লার নামগুলোও অশেষ। এটা সুপ্রসিদ্ধ যে তাঁর এক হাজার একটি নাম আছে। অর্থাৎ, তিনি তাঁর বান্দাদের কাছে এক হাজার একটি নাম প্রকাশ করেছেন। তবে হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-এর শরীয়তে “আল্ আসমাউল হুসনা” নামক নিরানব্বইটি নাম-ই কেবল প্রকাশিত হয়েছে।
মাতুরিদিয়া মযহাবে “সিফাতুস্ সুবুতিয়া” আটটি। আশআরিয়া মযহাবে সাতটি। আল্লাহতায়া'লার সত্তা মোবারকের মতো তাঁর এ সব সিফাত (গুণ)-ও চিরন্তন, চিরস্থায়ী। এগুলো পুতঃপবিত্রও। সৃষ্টিসমূহের গুণাবলীর মতো এগুলো নয়। মানুষের ওপর তাঁর প্রতিটি গুণের উদাহরণ তিনি প্রতিফলিত করেছেন। এগুলো দেখে আল্লাহতায়া'লার গুণাবলী সম্পর্কে অল্প কিছুটুকু উপলব্ধি করা যায়। যেহেতু মানুষ আল্লাহকে পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করতে অক্ষম, সেহেতু তাঁকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করার কিংবা চিন্তাভাবনা করার কোনো অনুমতি-ই নেই। তাঁর আটটি গুণ তাঁর সত্তাকে গঠন করে না, আবার সেগুলো তাঁর সত্তা থেকে অসম্পৃক্ত কিছুও নয়। এ আটটি সিফাত হলো:
(১) হায়াত,
(২) এলম (সর্বজ্ঞান),
(৩) সাম’ (শ্রবণশক্তি),
(৪) বাসার (দৃষ্টিশক্তি),
(৫) কুদরত (সর্বশক্তি),
(৬) কালাম (বাকশক্তি),
(৭) এরাদা (চূড়ান্ত ইচ্ছা) এবং
(৮) তাকওয়ীন (সৃজনশীলতা)। আশ্আরী মযহাবে তাক্উয়ীন ও কুদরত মিলেই একটি গুণ। “মাশীয়্যা” ও এরাদা হলো সমার্থক শব্দ।
আল্লাহ্ তায়া'লার আটটি গুণের প্রত্যেকটি-ই অতুলনীয় এবং অপরিবর্তনীয় অবস্থায় বিরাজমান। সেগুলোর মধ্যে কোনো পরিবর্তন সাধিত হয় না। কিন্তু সৃষ্টিসমূহের সাথে সম্পৃক্ততার অনুপাতে সেগুলো সৃষ্টিসমূহে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে প্রকাশমান। আর সৃষ্টিসমূহের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সেগুলোর অতুলনীয়তাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। অনুরূপভাবে, যদিও আল্লাহ্ পাক-ই এতো রকম সৃষ্টি করেছেন এবং লয়প্রাপ্তি থেকে ওগুলোকে রক্ষা করছেন, তবুও তিনি একই সত্তা। তাঁর মধ্যে কোনো পরিবর্তন-ই সংঘটিত হয় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি মুহূর্তেই প্রত্যেক সৃষ্টির তাঁকেই প্রয়োজন। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই তাঁর কাউকে প্রয়োজন নেই।
২। ঈমানের ছয়টি মূলনীতির দ্বিতীয়টি হলো وَمَلَائِكَتِه – “খোদা তায়া’লার ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস।” ফেরেশতাবৃন্দ বস্তু নন, বরং লতিফ (বায়বীয়)। বস্তুর গ্যাসীয় স্তর হতেও অধিক বায়বীয় তাঁরা। তাঁরা নূরানী (জ্যোতির্ময়) এবং জীবিতও বটেন। তাঁদের আকল্ (বিচারবুদ্ধি) আছে। মানবের মধ্যে যে সব মন্দ আছে তা তাঁদের মধ্যে বিরাজ করে না। তাঁরা যে কোনো আকৃতি গ্রহণ করতে সক্ষম, গ্যাস যেমন তরল ও কঠিন আকৃতি গ্রহণ করতে পারে, ঠিক তেমনি ফেরেশতাবৃন্দও সুন্দর আকৃতিসমূহ গ্রহণ করতে পারেন। ফেরেশতামণ্ডলী মহান ব্যক্তিদের দেহত্যাগকারী রূহসমূহ নন। খ্রীষ্টানরা মনে করে থাকেন যে ফেরেশতাবৃন্দ বুঝি তা-ই। শক্তি ও ক্ষমতার সাথে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে তাঁরা অ-বস্তুগত নন। কিছু প্রাচীন দার্শনিক তাঁদেরকে তা-ই ধারণা করেছিলেন। তাঁদের সবাইকে “মালাইকা” বলা হয়ে থাকে। “মালাক” (ফেরেশতা) অর্থ “প্রতিনিধি,” “বার্তাবাহক” অথবা “শক্তি”। সকল জীবিত সৃষ্টির আগেই ফেরেশতাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। সুতরাং পবিত্র কেতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাসের আগে ফেরেশতাবৃন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্যে আমরা আদিষ্ট হয়েছি, যে কেতাবসমূহ নবী (عليه السلام)-বৃন্দের আগে এসেছে (ঈমানের বাক্য বা বর্ণনায়)। আর কুরআন মজীদে এ সব বিশ্বাসের নামগুলো এই ক্রমানুসারেই বিবৃত হয়েছে।
ফেরেশতা সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহর আকিদা
ফেরেশতাকুলের প্রতি বিশ্বাস নিম্নের বর্ণনা মোতাবেক হতে হবে: ফেরেশতামণ্ডলী খোদা তায়া'লার সৃষ্টি। তাঁরা তাঁর শরীক (অংশীদার) নন, পুত্র কিংবা কন্যাও নন – যেভাবে কাফের ও মুশরিকরা ধারণা করতো। আল্লাহতায়া'লা তাঁর সকল ফেরেশতাকেই ভালোবাসেন। তাঁরা আল্লাহতায়া'লার আদেশ মান্য করেন এবং কখনোই পাপ সংঘটন কিংবা আদেশ অমান্য করেন না। তাঁরা পুরুষ কিংবা নারী নন। তাঁরা বিয়েও করেন না। তাঁদের কোনো সন্তানও নেই। তাঁদের জীবন আছে; অর্থাৎ, তাঁরা জীবিত।
❏ তবে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত একটি রওয়ায়াত অনুসারে কতিপয় ফেরেশতার সন্তান ছিল, যাদের মধ্যে শয়তান ও জীনদেরকে ধরা হয়ে থাকে; এর তা’বিল (বিশদ ব্যাখ্যা) বিভিন্ন বই-পুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
❏ যখন আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করেন যে তিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করতে ইচ্ছুক, তখন ফেরেশতাবৃন্দ আরয করেন,
إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ –
"হে আল্লাহ পাক! আপনি কি ওদের সৃষ্টি করবেন যারা দুনিয়ার বুকে ফিতনা ও রক্তপাত ঘটাবে?”
🔺[২] আল কুরআন : আল বাকারা, ২:৩০।
“যাল্লা” নামক তাঁদের এ সকল প্রশ্ন ফেরেশতাদের ক্রটিহীনতার কোনো ক্ষতি সাধন করে না।
সকল সৃষ্টির মধ্যে ফেরেশতাবৃন্দ-ই হলেন অধিক সংখ্যক। আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউই তাঁদের সংখ্যা জানেন না। আসমানে এমন কোনো খালি জায়গা নেই যেখানে ফেরেশতামণ্ডলী এবাদত করেন না। আসমানের প্রত্যেক জায়গা-ই রুকূকারী কিংবা সেজদাকারী ফেরেশতাদের দ্বারা পরিপূর্ণ। আসমানে, পৃথিবীতে, ঘাসে, তারা-নক্ষত্রে, সকল জীবিত ও জড় সৃষ্টিতে, প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটায়, বৃক্ষলতায়, অণু-পরমাণুতে, প্রত্যেক প্রতিক্রিয়ায়, স্পন্দনে, এক কথায়, সকল বিষয়ে ফেরেশতাবৃন্দের কর্তব্য নিহিত। সর্বত্র তাঁরা আল্লাহতায়া'লার আদেশ পালন করে থাকেন। আল্লাহতায়া'লা ও সৃষ্টিজগতের মধ্যে তাঁরা হলেন মধ্যস্থতাকারী। তাঁদের কেউ কেউ আবার অন্যান্য ফেরেশতাদের সরদার (আমীর)। মানবের মধ্যে নবীবৃন্দের (عليه السلام) কাছে তাঁদের কেউ কেউ বার্তা বহন করে নিয়ে এসেছেন। মানব অন্তরে কতিপয় ফেরেশতা “এলহাম” (ঐশী প্রত্যাদেশ) নামক ভালো/সৎ চিন্তা বহন করে নিয়ে আসেন। অপর কয়েকজন ফেরেশতা আল্লাহতায়া'লার জামাল (সৌন্দর্য) অনুভব করে চেতনালুপ্ত হয়ে মানবকুল ও সৃষ্টিজগৎ সম্পর্কে অনবধান অবস্থায় আছেন। প্রত্যেক ফেরেশতা-ই নির্দিষ্ট একটি স্থানে অবস্থান করেন। তাঁরা তাঁদের স্থানত্যাগ করতে পারেন না। কারো কারো দুইটি পাখা আছে, কারো বা চারটি কিংবা ততোধিক। বেহেশতের ফেরেশতাবৃন্দ সেখানে অবস্থান করেন। তাঁদের নেতা হলেন “রিদ্ওয়ান”। জাহান্নামের ফেরেশতামণ্ডলী যাঁদের নাম “যাবানী”, তাঁরা জাহান্নামে যা করতে আদিষ্ট হন, তা তাঁরা পালন করেন। সমুদ্র যেমন মাছের জন্যে ক্ষতিকর নয়, তেমনি জাহান্নামের আগুনও তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে সক্ষম নয়। ’যাবানী’দেরকে ১৯জন নেতৃত্ব দেন। তাঁদের প্রধান হলেন “মালিক”।
ফেরেশতাদের নজরদারীতে মানবজীবন
প্রত্যেক মানুষের ভালো ও মন্দ কাজ নথিভুক্ত করেন চারজন ফেরেশতা। দুইজন রাতে এবং অপর দুইজন দিনে আসেন। তাঁদেরকে বলা হয় “কিরামান কাতেবীন” অথবা “হাফাযা” ফেরেশতা। এ কথাও বলা হয়েছিল যে হাফাযা ফেরেশতাবৃন্দ কিরামান কাতেবীন হতে ভিন্ন। ডান কাঁধের ফেরেশতাটি বাঁ কাঁধের ফেরেশতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তিনি সৎকাজসমূহ নথিভুক্ত করেন। বাঁ কাঁধের ফেরেশতা বদ কাজসমূহ নথিভুক্ত করেন। অবিশ্বাসী কাফেরদেরকে এবং অবাধ্য মুসলমানদেরকে তাদের কবরে শাস্তি দেবার জন্যে কতিপয় ফেরেশতা বিরাজমান; কবরে সওয়াল-জওয়াবের জন্যেও কতিপয় ফেরেশতা বিদ্যমান। প্রশ্নকারী ফেরেশতাবৃন্দ হলেন “মুনকার” ও “নকির”। মুসলমানদেরকে যাঁরা প্রশ্ন করবেন তাঁদেরকে “মুবাশশির” এবং “বাশীর”–ও বলা হয়।
ফেরেশতাদের মাকাম ও শ্রেষ্ঠত্ব
ফেরেশতাদের একে অপরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব আছে। শ্রেষ্ঠ ফেরেশতা হলেন চারজন। তাঁদের প্রথম জন হলেন হযরত “জীবরাইল আমীন” (عليه السلام)। তাঁর দায়িত্ব ছিল আম্বিয়া (عليه السلام)-দের কাছে ওহী পৌঁছানো এবং আদেশ নিষেধসমূহ অবহিত করানো। দ্বিতীয় জন হযরত “ইস্রাফিল” (عليه السلام), যিনি “সুর” নামক শিঙ্গায় শেষ ফুঁক দেবেন। তিনি দু বার ফুঁক দেবেন। প্রথম ফুঁকে আল্লাহ্ ছাড়া সকল প্রাণী-ই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন। দ্বিতীয় ফুঁকে সকলেই প্রাণ ফিরে পাবেন। তৃতীয় ফেরেশতা হলেন হযরত “মিকাইল” (عليه السلام)। তাঁর কাজ হলো আধিক্য কিংবা অভাব দান করা এবং প্রত্যেক বস্তুকে স্থানান্তর করা। চতুর্থ জনের নাম হযরত ”আযরাইল” (عليه السلام)। তিনি রূহ্ বা জান কবজ করেন। এই চারজনের পরে চারটি শ্রেণীর উচ্চ মকামের ফেরেশতামণ্ডলী বিরাজমান: “হামালাত আল আরশের” চারজন ফেরেশতা, যাঁরা পুনরুত্থানের সময় আটজন হবেন। “মুকাররাবুন” নামের ফেরেশতাবৃন্দ, যাঁরা খোদা তায়া'লার সান্নিধ্যে আছেন। এরপর শাস্তি প্রদানকারী ফেরেশতাদের নেতৃবৃন্দ, যাঁদের নাম “কারুবিয়ুন”, অতঃপর রহমতের ফেরেশতামণ্ডলী, যাঁদের নাম “রূহানীয়ুন”। এ সকল উচ্চ মকামের ফেরেশতা-ও নবী, ওলী ও পুণ্যবান মুসলমানবৃন্দ ছাড়া সকল মানব সন্তানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সাধারণ কিংবা নিম্ন মকামের ফেরেশতাদের চেয়ে মুসলমানবৃন্দ অধিক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। আর সাধারণ ফেরেশতাবৃন্দ হলেন সাধারণ তথা পাপী, অবাধ্য মুসলমানদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
অবশ্য অবিশ্বাসী কাফেররা সকল সৃষ্টির চেয়ে নিকৃষ্ট। “সুর”–এর প্রথম আওয়াজে ’হামালাত্ আল্ আরশ্’ ও চারজন প্রধান ফেরেশতা ছাড়া বাকি সকল ফেরেশতা-ই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। এরপর তাঁরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। দ্বিতীয় আওয়াজে সকল ফেরেশতা-ই জীবন ফিরে পাবেন। “সুর”–এর দ্বিতীয় আওয়াজটির অল্প আগেই ’হামালাত্ আল্ আরশ্’ ও চারজন প্রধান ফেরেশতা উত্থিত হবেন। এরপর সকল প্রাণীর বিলুপ্তি হলে এ সকল ফেরেশতাও নিশ্চিহৃ হয়ে যাবেন, যেহেতু তাঁদেরকে সবার আগে সৃষ্টি করা হয়েছিল।
৩। ঈমানের ৩য় মূলনীতি হলো وَكُتُبِهِ – “আল্লাহ্ তায়া'লা কর্তৃক প্রকাশিত কেতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন”। আল্লাহতায়া'লা এ সব কেতাব কিছু আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম-এর কাছে প্রেরণ করেছিলেন ফেরেশতার মাধ্যমে, যিনি এগুলো তাঁদেরকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। কয়েকজনের কাছে তিনি (পাথরের) ফলকের ওপর খোদাইকৃত কেতাব পাঠিয়েছিলেন, আর কয়েকজনের কাছে ফেরেশতার মধ্যস্থতা ছাড়াই (বাণী) শ্রবণ করিয়েছিলেন। এ কেতাবগুলোর সবগুলোই কালামুল্লাহ্ (আল্লাহর বাণী); এগুলো অতীত হতেই অনন্ত, চিরন্তন। এগুলো সৃষ্টি নয়, ফেরেশতাদের বানানো কথাও নয়, আবার আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম-মণ্ডলীর বাণীও নয়। আমরা যে ভাষায় লিখি, মস্তিষ্কে ধারণ করি এবং কথা বলি, তার সাথে খোদাতায়া'লার বাণী সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এটা লেখনী, বক্তৃতা কিংবা মস্তিষ্কে থাকার মতো নয়। এর কোনো আক্ষরিক শব্দ নেই। আল্লাহতায়া'লা ও তাঁর সিফাত (গুণাবলী)-সমূহ কেমন, তা মানুষ উপলব্ধি করতে অক্ষম। কিন্তু মানুষ সেই বাণীটি পাঠ করতে, মস্তিষ্কে ধারণ করতে এবং লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম। যখন সেটা আমাদের সাথে অবস্থান করে, তখন সেটা হাদীস তথা সৃষ্টিতে পরিণত হয়। অর্থাৎ, আল্লাহর কালামের দুইটি দিক আছে। যখন এটা মানুষের সাথে বিরাজ করে, তখন এটা হাদীস ও সৃষ্টি। আর যখন এটাকে আল্লাহর বাণী হিসেবে চিন্তা করা হয়, তখন এটা ’কাদিম’ (চিরন্তন)।
আল্লাহতায়া'লা কর্তৃক প্রেরিত সকল আসমানী কেতাব-ই সত্য, সঠিক ও ন্যায্য। সেগুলোর মধ্যে কোনো মিথ্যা অথবা ত্রুটি নেই। যদিও তিনি বলেছেন তিনি আযাব ও শাস্তি দেবেন, তবুও এ কথা বলা হয়েছে যে তাঁর দ্বারা ক্ষমা প্রদর্শন করাও সম্ভব (জায়েয)। এটা তাঁর এরাদা (ইচ্ছা) কিংবা মানুষের অজ্ঞাত শর্তাবলীর ওপর নির্ভরশীল। কিংবা এর মানে এই যে, মুসলমানবৃন্দ যে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, সেটা তিনি ক্ষমা করে দেবেন। যেহেতু “আযাব” ও ‘শাস্তি’ শব্দগুলো কোনো ঘটনাকে বিবৃত করে না, সেহেতু এটা মিথ্যা হবে না যদি তিনি ক্ষমা করে দেন। অথবা, যদিও তাঁর ওয়াদাকৃত পুরস্কারসমূহ প্রদান না করা তাঁর পক্ষে জায়েয নয়, তবুও শাস্তিসমূহ মাফ করে দেয়া তাঁর পক্ষে জায়েয। আয়াতসমূহ, যুক্তি ও মানব আচরিত রীতি-নীতি আমাদেরকে সঠিক প্রমাণ করে।
আয়াত ও হাদীসমূহকে ওগুলোর আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করা অবশ্যকর্তব্য, যদি না কোনো ঝুঁকি কিংবা অসুবিধা বিরাজ করে। ওগুলোর আক্ষরিক অর্থের অনুরূপ অন্য কোনো অর্থ প্রদান করার কোনো অনুমতি-ই এ ক্ষেত্রে নেই। ‘মুতাশাবিহাত’ নামক আয়াতগুলোর মধ্যে মানব জ্ঞানের ঊর্ধ্বে এবং গোপনীয় অর্থসমূহ নিহিত রয়েছে। শুধুমাত্র আল্লাহতায়া'লা এবং কিছু বিশিষ্ট বুযূর্গানে দ্বীন যাঁদেরকে “এলম-এ-লাদুন্নী” (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) মঞ্জুর করা হয়েছে, তাঁরা-ই কেবল এগুলোর অর্থ জানেন। আর কেউই এগুলো বুঝতে সক্ষম নয়। এ কারণেই আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে মুতাশাবিহাত আয়াতসমূহ খোদা তায়া'লারই পাক কালাম এবং এগুলোর অর্থ আমাদের অনুসন্ধান করা চলবে না। আশ্আরী মাযহাবের উলামাবৃন্দ বলেছেন যে এগুলোকে সংক্ষেপে কিংবা বিস্তারিতভাবে তা’বিল তথা ভিন্নতর ব্যাখ্যা দেয়া অনুমতিপ্রাপ্ত। তা’বিল অর্থ “একটি শব্দের কয়েকটি অর্থের মধ্য হতে অব্যবহৃত অসাধারণ অর্থটি পছন্দ করে নেয়া।” উদাহরণস্বরূপ,
❏ আল্লাহতায়া'লার বাণী
يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ–
“আল্লাহতায়া'লার হাত তাদের হাতের ওপরে”
🔺[৩] আল কুরআন : আল ফাতহ, ৪৮:১০।
আয়াতটির ক্ষেত্রে আমাদের বলা উচিৎ “আল্লাহ্ পাক এর দ্বারা যা বোঝাত চান, আমি তা বিশ্বাস করি।” এটা বলা সবচেয়ে ভালো, “আমি এর অর্থ উপলব্ধি করতে অক্ষম। আল্লাহতায়া'লার জ্ঞান আমাদের জ্ঞানের মতো নয়। তাঁর ইচ্ছাও আমাদের ইচ্ছার মতো নয়। অনুরূপভাবে, আল্লাহতায়া'লার হাতও তাঁর সৃষ্ট মানব জাতির হাতের মতো নয়।
আল্লাহতায়া'লা কর্তৃক নাযিলকৃত কেতাবসমূহের মধ্যে কিছু আয়াতের উচ্চারণ নয়তো অর্থ অথবা উভয়-ই আল্লাহতায়া'লা কর্তৃক পরিবর্তন করা হয়েছিল। আল-কুরআন সকল কেতাবের স্থলে অবতীর্ণ হয় এবং পূর্ববর্তীগুলোর আইন-কানুন রহিত করে দেয়। দুনিয়া লয়প্রাপ্ত হওয়ার সময় পর্যন্ত কুরআন মজীদে কোনো ভুল-ভ্রান্তি, বিস্মৃত বিষয়, সংযোজন অথবা বিয়োজন হবে না এবং এটা বিস্মৃতও হবে না। অতীত ও ভবিষ্যতের সকল জ্ঞান-ই কুরআন মজীদে বিরাজমান। এ কারণেই এটা অন্যান্য আসমানী কেতাব হতে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং মূল্যবান। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সর্বশ্রেষ্ঠ মো’জেযা হলো আল-কুরআন।
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا
❏ "যদি সমস্ত জ্বীন-ইনসান সমবেত হয়ে কুরআন পাকের সবচেয়ে ছোট সুরাটির অনুরূপ একটি কথাও বলতে চেষ্টা করতো, তাহলেও তারা তা পারতো না।
🔺[৪] আল কুরআন : আল ইসরা, ১৭:৮৮।
বস্তুতঃ আরবের বড় বড় কবি-সাহিত্যিক সমবেত হয়ে যথেষ্ট খাটাখাটুনি করেছিল, কিন্তু তারা তিনটি ছোট আয়াতের অনুরূপ কিছু-ই বানাতে পারেনি। তারা আশ্চর্যান্বিত হয়ে গিয়েছিল। আল-কুরআনের মোকাবেলায় ইসলামের শত্রুদেরকে মহান আল্লাহতায়া'লা অক্ষম ও পরাভূত করে থাকেন। কুরআনের সাবলীল ভাষা মানব ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। এটা যেভাবে বক্তব্য রাখে, মানুষ সেভাবে বক্তব্য রাখতে অক্ষম। কুরআন মজীদের আয়াতসমূহ মানুষের রচিত পদ্য, গদ্য কিংবা গীতের মতো নয়। অথচ এটা আরবেরই বড় বড় কবি সাহিত্যিকের ভাষার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে।
আমাদের কাছে এক’শ চারটি ঐশীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; এর মধ্যে সর্বজনজ্ঞাত দশটি সুহুফ (সহিফা বা ছোট কেতাবের বহুবচন) হযরত আদম (عليه السلام)-এর কাছে নাযিল হয়েছিল। অতঃপর পঞ্চাশটি সুহুফ হযরত শীষ (عليه السلام), ত্রিশটি সুহুফ হযরত ইদ্রিস (عليه السلام) এবং দশটি সুহুফ হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام)-এর কাছে নাযিল হয়। তাওরাত কেতাব অবতীর্ণ হয় হযরত মুসা (عليه السلام)-এর কাছে; যাবুর নাযিল হয় হযরত দাউদ (عليه السلام)-এর কাছে; ইনজিল প্রকাশিত হয় হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর কাছে; আর কুরআনুল করিম নাযিল হয় খাতেমুন্ নাবিয়্যিন, শাফিউল মুযনেবীন, রহমতুল্লিল্ আলামীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ) এর কাছে।
কোনো ব্যক্তি যখন একটি আদেশ, নিষেধ, অনুরোধ কিংবা কিছু খবর দিতে চান, তখন তিনি প্রথমে এটা চিন্তা করেন এবং তা মস্তিষ্কে প্রস্তুত করে রাখেন। মস্তিষ্কের মধ্যে এ সকল অর্থকে “কালাম নাফসী” বলে, যাকে আরবী, ফারসী কিংবা ইংরেজি বলা যায় না। বিভিন্ন ভাষায় এগুলোর অভিব্যক্তি এগুলোর অর্থকে পরিবর্তন করতে পারে না। এ অর্থগুলোর বহিঃপ্রকাশ যে বাক্য দ্বারা করা হয়, তাকে বলা হয় “কালাম লাফযী”। কালাম লাফযী বিভিন্ন ভাষায় ব্যক্ত করা যায়। অতএব, কোনো ব্যক্তির কালাম নাফসী হলো একটি খাঁটি, অপরিবর্তনযোগ্য, স্পষ্ট গুণ, যা ওর অধিকারী ব্যক্তির জ্ঞান, ইচ্ছা, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি গুণাবলীর মতোই ব্যক্তিটির মধ্যে বিরামান। আর কালাম লাফযী হলো একটি বাক্যমালা, যা কালাম নাফসীকে ব্যক্ত করে এবং যা ওগুলোর উচ্চারণকারী ব্যক্তির মুখ থেকে বেরিয়ে আসে এবং যা কানে শ্রুত হয়ে থাকে। সুতরাং আল্লাহতায়া'লার কালাম হলো চিরন্তন, অবিনশ্বর, সরব ও অসৃষ্ট বাক্য, যা তাঁর পবিত্র সত্তার সাথে বিরাজমান। এটা আল্লাহতায়া'লার সিফাত আয্ যাতিয়্যা ও সিফাতুস্ সুবুতিয়্যা হতে একটি সুস্পষ্ট গুণ, যেমন নাকি জ্ঞান ও এরাদা (চূড়ান্ত ইচ্ছা)।
কালাম (কথা, বাক্য) গুণটি কখনোই পরিবর্তন হয় না এবং এটা খাঁটি, নির্মল। এটা অক্ষর কিংবা শব্দ নয়, এটাকে আদেশ, নিষেধ, বর্ণনা কিংবা আরবী, ফারসী, হিব্রু, তুর্কী অথবা সিরীয়-র মতো পৃথক অথবা চিহ্নিত করা যাবে না। এটা ওরকম আকার গ্রহণ করে না। এটাকে লেখাও যায় না। বুদ্ধিমত্তা, কান অথবা জিহ্বার মতো মাধ্যম কিংবা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন এর নেই। তবু আমাদের জ্ঞাত সকল সত্তা হতে পৃথক একটি সত্তা হিসেবে আমরা ওগুলোর মাধ্যমে এটাকে উপলব্ধি করতে পারি। এটা ইচ্ছানুযায়ী যে কোনো ভাষায় ব্যক্ত করা যায়। অতএব, যখন এটাকে আরবীতে বলা হয়, তখন এর নাম হয় আল-কুরআন। যখন হিব্রুতে বলা হয়, তখন এটা তাওরাত। যদি এটা সিরীয়তে বলা হয়, তবে ইন্জিল।
❏ “শরহ আল-মাকাসিদ” পুস্তকটিতে লেখা আছে,
قِيْلَ بِالُّلغَةِ اَلْيَوْناَنِيْةِ فَهِيَ الْاِنْجِيْلُ وَاِنْ كَانَت بِالسُرْياَنِيْةِ فَهِيَ الزَبُوْرُ وَاِنْ
– যদি এটা গ্রীক-এ বলা হয়, তবে এটা ইন্জিল, আর যদি এটা সিরীয়তে বলা হয়, তবে এর নাম যাবুর।
🔺[৫] তাফতাযানী : শরহু আল মাকাসিদ।
আল-কালামুল্ ইলাহিয়্যা (ঐশী বাক্যাবলী) বিভিন্ন বিষয় ব্যক্ত করেছে: যদি এটা সংঘটিত অথবা ভবিষ্যতে সংঘটিতব্য কোনো ঘটনা ব্যক্ত করে থাকে, তবে একে বলা হয় “খবর” (বর্ণনা)। যদি তা না হয়, তবে বলা হয় “ইনশা’য়া”। যদি এটা আদেশসূচক হয়, তবে এটাকে বলা হয় “আমর” (আদেশ, আজ্ঞা)। যদি নিষেধসূচক হয়, তবে বলা হয় “নাহী” (নিষেধাজ্ঞা)। কিন্তু কালামুল্ ইলাহিয়্যা’র মধ্যে কোনো পরিবর্তন কিংবা বৃদ্ধি নেই। প্রকাশিত প্রতিটি বই কিংবা পাতা হলো আল্লাহতায়া'লার কালামের একটি পাতা; অর্থাৎ, সেগুলো তাঁরই কালামুন্ নাফসী। যখন তা আরবীতে হয়, তখন তার নাম হয় আল-কুরআন। যে ওহী পদ্যে প্রকাশিত এবং লিখিত ও কথিত এবং শ্রুত ও মস্তিষ্কে ধারণকৃত হতে পারে, তাকে “কালামুল লাফযী” অথবা “আল-কুরআন” বলা হয়। যেহেতু কালামুল লাফযী কালামুন্ নাফসীকে ইঙ্গিত করে, সেহেতু এটাকে আল-কালামুল্ ইলাহিয়্যা কিংবা ঐশী গুণ বলা অনুমতিপ্রাপ্ত। যদিও এ বাণীটি একই কিসিমের, তবু এটাকে ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে বিভক্ত ও খণ্ড খণ্ড করা সম্ভব। যেহেতু এর সবটুকুকেই কুরআন বলা হয়, সেহেতু এর অংশগুলোকেও কুরআন বলা যায়।
সঠিক পথের (আহলে সুন্নাতের) উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতভাবে বলেছেন যে কালামুন্ নাফসী কোনো সৃষ্টি নয়, বরং এটা কাদিম (চিরন্তন)। কালামুল্ লাফযী কি হাদীস (সৃষ্টি) না কাদিম, তা নিয়ে মতৈক্য হয়নি। যাঁরা কালামুল্ লাফযীকে হাদীস হিসেবে বিবেচনা করেছেন, তাঁরাও বলেছেন যে এটাকে হাদীস না বলা-ই উত্তম, কেননা এতে ভুল বোঝাবুঝি হবে এবং ফলস্বরূপ কালামুন্ নাফসীকেও হাদীস হিসেবে ধরে নেয়া হবে। এ সম্পর্কে এটা-ই সর্বোত্তম বক্তব্য। যখন মানব মস্তিষ্ক এমন কোনো জিনিস শুনে, যা অন্য কোনো বিষয়ের প্রতি ইশারা করে, তখন সেটা সেই ইশারাকৃত বিষয়াটিকেও একই সঙ্গে স্মরণ রাখে। যখন সঠিক পথের উলামাদের মধ্যে কাউকে বলতে শোনা যায় যে কুরআন মজীদ হলো হাদীস (শূন্য হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত), তখন আমাদেরকে বুঝতে হবে যে তিনি সেই সব শব্দ ও বাক্যকে বুঝিয়েছেন যেগুলো আমাদের মুখ দ্বারা আমরা পাঠ করে থাকি। সঠিক পথের উলামাবৃন্দ সর্বসম্মতভাবে বলেছেন যে কালামুন্ নাফসী ও কালামুল্ লাফযী উভয়-ই হলো আল্লাহতায়া'লার বাণী। যদিও কিছু “উলামা” এ বাণীটিকে (অর্থাৎ কালামুন্ নাফসীকে) রূপক হিসেবে বিবেচনা করেছেন, তবু তাঁরা একমত হয়েছেন যে এটা ঐশীবাণী। কালামুন্ নাফসীকে আল্লাহর বাণী বলার মানে হলো এই যে, এটা আল্লাহতায়া'লার-ই বচন গুণ; আর ‘কালামুল্ লাফযী খোদা তায়া'লার বাণী’ অর্থ হলো এটাকে খোদা তায়া'লা-ই সৃষ্টি করেছেন।
🔴প্রশ্নঃ
উপরোক্ত লেখনী থেকে এটা উপলব্ধি করা যায় যে আল্লাহতায়া'লার চিরন্তন বাণী শোনা যায় না। যে ব্যক্তি বলেন, “আমি আল্লাহতায়া'লার বাণী শ্রবণ করেছি,” তিনি বোঝান “আমি উচ্চারিত শব্দ ও বাক্য শ্রবণ করেছি”, অথবা “আমি চিরন্তন কালামুন্ নাফসী এই সকল বাক্য দ্বারা উপলব্ধি করেছি।” সকল নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম এমন কী প্রত্যেক ব্যক্তি-ই এ দুইটির মধ্যে যে কোনো একটি পদ্ধতিতে কালামুন্ নাফসী শ্রবণ করতে সক্ষম। তাহলে হযরত মূসা (عليه السلام)-কে কালিমুল্লাহ্ (আল্লাহর সাথে কথোপকথনকারী) হিসেবে চিহ্নিত করার কারণ কী?
🖋উত্তরঃ
হযরত মূসা (عليه السلام) চিরন্তন বাণী শ্রবণ করেছিলেন কোনো অক্ষর কিংবা শব্দ ছাড়াই, আল-আদত্ আল-ইলাহিয়্যা তথা ঐশী রীতি-নীতি বা কার্যকারণ আইন হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রক্রিয়ায়। তিনি এটা এমনভাবে শ্রবণ করেছিলেন যা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, যেমনিভাবে বেহেশতে আল্লাহতায়া'লার দর্শন লাভ হবে ব্যাখ্যা ও উপলব্ধির অতীত। এ পদ্ধতিতে কেউই শ্রবণ করেননি। অথবা, তিনি শুধুমাত্র আল্লাহতায়া'লার বাণী শব্দ আকারে তাঁর কান মোবারক দ্বারা-ই শ্রবণ করেননি, বরং তাঁর দেহ মোবারকের সকল অণুকণা দ্বারা সকল দিক হতেই শ্রবণ করেছিলেন। অথবা তিনি গাছটির দিক হতেই কেবলমাত্র শ্রবণ করেছিলেন, শব্দ কিংবা বায়ুর প্রকম্পন কিংবা অন্য কোনো মাধ্যম ছাড়াই তিনি তা শুনেছিলেন। যেহেতু তিনি এ তিনটি পন্থার একটি পন্থায় তা শ্রবণ করেছিলেন, সেহেতু তাঁকে “কালিমুল্লাহ্” খেতাবটি দ্বারা মহাসম্মানিত করা হয়েছে। মে’রাজ রজনীতে হযরত রাসূলে আকরাম (ﷺ)-ও একই পন্থায় খোদায়ী বাণী শ্রবণ করেছিলেন। ওহী গ্রহণের সময় হযরত জিবরাইল আমীনের (عليه السلام) শ্রুতিও একই পন্থায় হয়েছিল।
৪। ঈমানের ছয়টি মূলনীতির মধ্যে চতুর্থটি হলো وَرُسُلِهِ- “রাসূল আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দের প্রতি বিশ্বাস”– যাঁদের প্রেরণ করা হয়েছিল মানুষদেরকে আল্লাহ্ তায়া'লার পছন্দকৃত পথটি গ্রহণ করানোর উদ্দেশ্যে এবং তাদেরকে সঠিক পথের দিকে হেদায়াত দানের উদ্দেশ্যে। “রুসূল” (রাসূলের বহু বচন) হলেন “সে সকল পুণ্যাত্মা যাঁদেরকে ঐশী বাণীসহ প্রেরণ করা হয়েছিল।” শরীয়তের পরিভাষায় রাসূল হলেন “সেই মহান, সম্মানিত পুণ্যাত্মা যাঁর স্বভাবচরিত্র, জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা তাঁর সময়কার লোকদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং যাঁর চরিত্র বদ কিংবা অপছন্দীয় স্বভাব দ্বারা কলুষিত নয়।” রাসূলবৃন্দের একটি গুণ হলো ‘আসমত’। অর্থাৎ, রেসালাত অথবা নবুয়্যতপ্রাপ্তির আগে কিংবা পরে তাঁরা কোনো বড় অথবা ছোট গুনাহ সংঘটন করেন না। নবুয়্যত সম্পর্কে তাঁদেরকে জানানোর পরে এবং তাঁদের নবুয়্যত সর্বজনজ্ঞাত ও সর্বত্র প্রসারিত না হওয়া পর্যন্ত অন্ধত্ব, বধিরতা এবং অনুরূপ ত্রুটি তাঁদেরকে গ্রাস করেনি। এতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে প্রত্যেক রাসূল (عليه السلام)-ই সাতটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিলেন। এগুলো হচ্ছে “আমানা” (বিশ্বস্ততা), “সিদক্” (সত্যনিষ্ঠা), “তাবলীগ” (যোগাযোগ), “আদালা” (ন্যায়পরায়ণতা), “আসমত” (নিষ্পাপ), “ফাতানা” (ঐশী জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা) এবং “আমান আল-আযল্” (নবুয়্যত হতে পদচ্যুত হবার ভীতিমুক্ত)।
যে পয়গম্বর একটি নতুন শরীয়ত নিয়ে আসেন, তাঁকে “রাসূল” বলা হয়। যে পয়গম্বর কোনো নতুন শরীয়ত আনেন না, কিন্তু মানুষদেরকে পূর্ববর্তী শরীয়তের প্রতি আহবান করেন, তাঁকে বলা হয় “নবী”। আল্লাহতায়া'লার দ্বীনের প্রতি মানুষদেরকে আহবানের ক্ষেত্রে এবং তাঁর আজ্ঞাবলী তাবলীগ (প্রচার, পৌঁছানো) করার ক্ষেত্রে একজন নবী ও একজন রসূলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে সকল নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম ব্যতিক্রম ছাড়া-ই সত্যনিষ্ঠ ও নিবেদিত ছিলেন। যে ব্যক্তি তাঁদের কোনো একজনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে না, সে তাঁদের সকলেরই প্রতি অবিশ্বাসকারী হিসেবে বিবেচিত হবে।
অত্যধিক এবাদত-বন্দেগী, ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকা, কষ্ট ভোগ কিংবা কঠোর পরিশ্রম দ্বারা নবুয়্যত অর্জন করা যায় না। এটা কেবলমাত্র আল্লাহতায়া'লার অনুগ্রহ ও মনোনয়ন দ্বারা-ই অর্জন করা যায়। নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম-মণ্ডলীর মাধ্যমে শরীয়তসমূহ প্রেরিত হয়েছিল যাতে করে মানুষদের বিষয়াবলী এ পৃথিবীতে ও পরলোকে যথাযথ এবং উপকারী হয়; আর যাতে এলোমেলো, ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড হতে তাদেরকে বিরত রেখে হেদায়াত, পরিত্রাণ, সুখ-শান্তি অর্জনে তাদেরকে পরিচালনা করা যায়। যদিও রাসূল আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দের বহু শত্রু ছিল এবং তাঁরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছিলেন, তবু তাঁরা শত্রুদেরকে ভয় পাননি এবং বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়াবলী ও পালনীয় সৎকর্ম সংক্রান্ত খোদা তায়া'লার আজ্ঞাসমূহ মানুষদের কাছে প্রচার করার ক্ষেত্রে তাঁরা কাল বিলম্বও করেননি। আল্লাহতায়া'লা তাঁর রাসূল আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দকে সত্যনিষ্ঠ ও নিবেদিত প্রতীয়মান করার উদ্দেশ্যে তাঁদেরকে মু’জেযা দ্বারা শক্তিশালী করেছিলেন। তাঁদের মু’জেযার বিরুদ্ধে কেউই দাঁড়াতে পারেনি। কোনো পয়গম্বরের কওম বা জাতিকে তাঁর “উম্মত” বলা হয়। শেষ বিচারের দিনে নবী-রসূলবৃন্দকে (عليه السلام) তাঁদের উম্মতদের জন্যে শাফায়াত (সুপারিশ) করার অনুমতি দেয়া হবে, আর তাঁদের শাফায়াতকে গ্রহণও করা হবে। আল্লাহতায়া'লা তাঁদের উম্মতদের মধ্যে উলামা (জ্ঞান বিশারদমণ্ডলী), সুলাহা (সৎকর্মশীল পুণ্যাত্মাবৃন্দ) ও আউলিয়া (আল্লাহর বন্ধুবান্ধব)-কেও শাফায়াত করার অনুমতি মঞ্জুর করবেন। আর তাঁদের শাফায়াতও গৃহীত হবে। নবী-রসূলমণ্ডলী (عليه السلام) তাঁদের মোবারক রওযায় এমন এক হায়াতে জীবিত আছেন, যা আমরা জানি না; তাঁদের দেহ মোবারক মাটিতে পচে না। এ কারণেই -
❏ একটি হাদীস্ শরীফে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এরশাদ ফরমান,
– الأَنْبِيَاءُ أَحْيَاءٌ فِي قُبُورِهِمْ يُصَلُّونَ.
– নবী আলাইহিমুস সালামমণ্ডলী তাঁদের রওযা শরীফে নামায পড়েন।
🔺[৬]
(ক) বাযযার : আল মুসনাদ, মুসানাদু আবী হামযা আনাস ইবনে মালিক, ১৩:২৯৯ হাদীস নং ৬৮৮৮।
(খ) আবু ইয়ালা : আল মুসনাদ, ৬:১৪৭ হাদীস নং ৩৪২৫।
কোনো নবী (عليه السلام)-এর মোবারক চোখ নিদ্রাগত হলেও তাঁর অন্তরের চক্ষু কিন্তু নিদ্রাগত হয় না। নবুয়্যত-এর দায়িত্ব পালনকালে এবং নবুয়্যতের মাহাত্ম্য ও গুণাবলীর অধিকারী হিসেবে নবী আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দ সবাই সমান। উপরোক্ত সাতটি বৈশিষ্ট্য তাঁদের সবার মধ্যেই বিদ্যমান। নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দকে কখনোই তাঁদের নবুয়্যত হতে পদচ্যুত করা হয়নি। তবে আউলিয়াবৃন্দ হয়তো বেলায়াত হতে পদচ্যুত হতে পারেন। 🔺[এটাও কদাচিৎ হয়ে থাকে। উপরন্তু, পদচ্যুত ব্যক্তি আল্লাহর দৃষ্টিতে ওলী কখনোই ছিলেন না। কেননা, আল্লাহতায়া'লা তাঁর আউলিয়া বৃন্দেরও বেলায়াত কেড়ে নেন না (সুরা ইউনুস, ৬২ আয়াতে মোযারে’র সিগায় তথা ভবিষ্যৎকালে বলা হয়েছে ‘তাঁরা সন্তাপগ্রস্ত হবেন না’)- অনুবাদক] নবীবৃন্দ (عليه السلام) হলেন পুণ্যাত্মা, তাঁরা জ্বীন কিংবা ফেরেশতা নন – যে জ্বীন ও ফেরেশতা কখনোই নবী হতে পারবেন না; কেননা তাঁরা মানবাত্মা বনতে সক্ষম হবেন না এবং ফলস্বরূপ তাঁরা নবীর মর্যাদাও পাবেন না। নবী আলাইহিমুস সালাম-মণ্ডলী একে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। উদাহরণস্বরূপ, যেহেতু তাঁর উম্মাত ও প্রেরণের স্থান বৃহত্তম ছিল এবং যেহেতু তাঁর জ্ঞান ও মা’রেফত বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রসারিত হয়েছিল এবং যেহেতু তাঁর মো’জেযা অফুরন্ত ও নিয়মিত প্রবাহমান ছিল এবং যেহেতু তাঁর প্রতি খোদা তায়া'লার বিশেষ অনুগ্রহ ও বরকত বর্ষিত হয়েছিল, সেহেতু শেষ যমানার রাসূল হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ) অন্যান্য পয়গম্বর (عليه السلام) হতে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন। ‘উলুল আযম’ নামে খ্যাত পয়গম্বর (عليه السلام)-মণ্ডলীও অন্যান্য পয়গম্বর (عليه السلام) হতে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন। রসূল (عليه السلام)-মণ্ডলী নবী (عليه السلام)-বৃন্দের চেয়ে উচ্চ মকামের – যে নবীবৃন্দ (عليه السلام) রাসূল নন।
পয়গম্বরবৃন্দের (عليه السلام) সংখ্যা অজ্ঞাত। এটা সর্বজবিদিত যে তাঁদের সংখ্যা এক লক্ষ চব্বিশ হাজারের অধিক ছিল। তাঁদের মধ্যে ৩১৩ কিংবা ৩১৫ জন রাসূল আলাইহিমুস সালাম। রাসূল আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দের মধ্যে ছয় জন হলেন উচ্চ মকামের রাসূল, যাঁদেরকে উলুল আযম বলা হয়। তাঁরা হলেন: হযরত আদম (عليه السلام), হযরত নূহ (عليه السلام), হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام), হযরত মূসা (عليه السلام), হযরত ঈসা (عليه السلام) ও বিশ্বনবী হযরত রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)।
নিম্নোক্ত তেত্রিশ জন পয়গম্বর (عليه السلام) প্রখ্যাত: সর্ব-হযরত আদম (عليه السلام), ইদ্রীস (عليه السلام), শীষ (عليه السلام), নূহ্ (عليه السلام), হুদ (عليه السلام), সালেহ্ (عليه السلام), ইব্রাহীম (عليه السلام), লুত (عليه السلام), ইসমাইল (عليه السلام), ইসহাক (عليه السلام), ইয়াকুব (عليه السلام), ইউসুফ (عليه السلام), আইয়ুব (عليه السلام), শু’য়াইব (عليه السلام), মূসা (عليه السلام), হারুন (عليه السلام), খিযির (عليه السلام)
🔺[এ ব্যাপারে সুন্নী উলামাগণের মতপার্থক্য আছে। কেউ কেউ তাঁকে “ওলী” বলেন। — অনুবাদক],
ইউশা ইবনে নুন (عليه السلام), ইলিয়াস (عليه السلام), আল ইয়াসা (عليه السلام), যুলকিফল (عليه السلام), শামউন (عليه السلام), ইশমোইল (عليه السلام), ইউনুস ইবনে মাতা (عليه السلام), দাউদ (عليه السلام), সুলাইমান (عليه السلام), লোকমান (عليه السلام), যাকারিয়্যা (عليه السلام), ইয়াহইয়া (عليه السلام), উযাইর (عليه السلام), ঈসা ইবনে মরিয়ম (عليه السلام), যুলকারনাইন (عليه السلام) এবং হযরত রাসূলে কারীম (ﷺ)।
কুরআন মজীদে কেবলমাত্র আটাশ জন পয়গম্বরের (عليه السلام) নাম উল্লিখিত আছে। যুলকারনাইন (عليه السلام), লুকমান (عليه السلام), উযাইর (عليه السلام) ও খিযির (عليه السلام) নবী কিনা তা নিশ্চিত নয়। হযরত যুলকিফল (عليه السلام)-কে হারকিলও বলা হয়, যাঁকে সর্ব-হযরত ইলিয়াস (عليه السلام), ইদ্রিস (عليه السلام) কিংবা যাকারিয়্যা (عليه السلام)-ও ধারণা করা হয়ে থাকে।
হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) হলেন খলিলউল্লাহ, কারণ তাঁর অন্তরে আল্লাহ ছাড়া আর কারো প্রতি মুহব্বত তথা ভালোবাসা নেই। হযরত মূসা (عليه السلام) হলেন কালিম-উল্লাহ, কেননা وَكَلَّمَ اللَّهُ مُوسَى تَكْلِيمًا – তিনি আল্লাহ্ পাকের সাথে কথা বলেছিলেন।
🔺[৭] আল কুরআন : আন নিসা, ৪:১৬৪।
হযরত ঈসা (عليه السلام) হলেন কালেমাতুল্লাহ্, কারণ পিতা ছাড়াই তিনি শুধুমাত্র কালেমাত আল ইলাহিয়্যা (খোদায়ী বাক্য) “হও” (কুন্) দ্বারা-ই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। উপরন্তু, তিনি আল্লাহতায়া'লার বাণী প্রচার করেছিলেন, ঐশী জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন এবং ঐশীবাণী মানুষের কানে পৌঁছেও দিয়েছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) যিনি সৃষ্টিজগতের অস্তিত্বশীল হওয়ার কারণ ছিলেন এবং যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মকামের অধিকারী, মহাসম্মানিত ও সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনি হলেন হাবীবউল্লাহ (আল্লাহতায়া'লার বন্ধু)। তিনি-ই যে হাবীবউল্লাহ ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং মাহাত্ম্যের অধিকারী, তা প্রতীয়মানকারী বহু প্রামাণ্য দলিল বিদ্যমান। এ কারণেই “পরাভূত” কিংবা “পরাজিত হয়েছিলেন” বাক্যগুলো তাঁর শানে ব্যবহার করা উচিৎ নয়।
❏ পুনরুত্থানের সময় তিনি-ই সর্বাগ্রে তাঁর রওযা শরীফ হতে পুনরুত্থিত হবেন। তিনি-ই প্রথমে বিচারের স্থানে যাবেন। আবার,
وَأَنَا أَوَّلُ مَنْ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ–
তিনি-ই সর্বাগ্রে বেহেশতে প্রবেশ করবেন।
🔺[৮]
(ক) আহমদ : আল মুসনাদ, ৩:১৪৪ হাদীস নং ১২৪৯১।
(খ) দারেমী : আস সুনান, ১:১৯৮ হাদীস নং ৫৩।
(গ) বায়হাকী : শুয়াবুল ইমান, ৩:৭৪ হাদীস নং ১৪০৯।
যদিও তাঁর চরিত্রের সুন্দর গুণগুলো গোনে শেষ করা যাবে না এবং তা মানব শক্তি-সামর্থ্য দ্বারা সম্ভবও নয়, তবু আমরা সেগুলোর কয়েকটি এখানে লিখে আমাদের পুস্তককে অলঙ্কৃত করবো:
মে'রাজ রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর একটি অনন্য মো’জেযা
যখন তিনি মক্কা মোয়াযযমায় নিজ বিছানায় শায়িত ছিলেন, তখন তাঁকে জাগানো হয় এবং তাঁর পবিত্র স্বশরীরে তাঁকে জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারপর আসমানে এবং তারও পরে আল্লাহতায়া'লা যে সকল স্থান নির্ধারণ করেছিলেন, সাত আসমানের সেই সব স্থানে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মে’রাজ সম্পর্কে আমাদেরকে এভাবে বিশ্বাস করতে হবে। মে’রাজ কীভাবে হয়েছিল, তা বিস্তারিত লেখা হয়েছে বহু মহামূল্যবান গ্রন্থে, বিশেষ করে -
❏ শেফা শরীফ পুস্তকে,
।لَمَّا أُسْرِيَ بِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ انْتَهَى بِهِ إِلَى سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى، وَهِيَ فِي السَّمَاءِ السَّادِسَةِ
হযরত জিবরাইল আমীনের সাথে তিনি মক্কা হতে ষষ্ঠ ও সপ্তম আসমানে অবস্থিত সিদরাত আল-মুন্তাহা নামের একটি গাছের কাছে গিয়েছিলেন।
🔺[৯] ইবনে আবী শায়বা : আল মুসনাদ, ১:১৯৭ হাদীস নং ২৯১।
❏ কোন জ্ঞান, কোন ঊর্ধ্বগমন-ই ইতিপূর্বে এর বেশি যেতে পারেনি। সিদরাত আল-মুন্তাহা‘য় রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হযরত জিবরাইল আমীন (عليه السلام)-কে তাঁর ছয় শ পাখাসহ নিজস্ব (আসল) সুরতে দেখতে পান। হযরত জিবরাইল (عليه السلام) সিদরা-তে থেকে যান।
لَمَّا أُسْرِيَ بِالنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أُتِيَ بِدَابَّةٍ دُونَ الْبَغْلِ وَفَوْقَ الْحِمَارِ , يَضَعُ حَافِرَهُ عِنْدَ مُنْتَهَى طَرَفِهِ , يُقَالُ لَهُ: الْبُرَاقُ
মক্কা হতে জেরুজালেম কিংবা সাত আসমানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে “বোরাকে” বহন করে নেয়া হয়েছিল, যা বেহেশতের প্রাণী এবং যা একটি খচ্চরের চেয়ে ছোট কিন্তু একটি গাধার চেয়েও বড় আকৃতির।
🔺[১০] ইবনে আবী শায়বা : আল মুসনাদ, ৬:৩১২ হাদীস নং ৩১৬৯৯।
❏ চোখের পলকে এটা চোখের আড়ালে চলে যেতে সক্ষম। মসজিদে আকসায় এশা কিংবা ফজরের নামাযে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অন্যান্য নবী আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দের ইমাম হন। আম্বিয়া (عليه السلام)-মণ্ডলীর রূহ্ মোবারক তাঁদের জিসম্ (দেহ)-সহ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। জেরুসালেম হতে সপ্তম আসমান পর্যন্ত তাঁকে মে’রাজ নামক একটি অজ্ঞাত সিঁড়ি দ্বারা ঊর্ধ্ব-ভ্রমণ করানো হয়।سَلَّمَتْ عَلَيْهِ الْمَلَائِكَةُ
পথিমধ্যে ডান ও বাম ধারে ফেরেশতাকুল সারিবদ্ধ হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সালাত-সালাম ও সম্ভাষণ জানান এবং তাঁর প্রশংসা করেন।
🔺[১১] আব্দুর রাযযাক : আল মুসান্নাফ, ২:১৬২।
প্রতিটি আসমানেই হযরত জিবরাইল আমীন (عليه السلام) রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর শুভাগমণের শুভসংবাদ ঘোষণা করেন। প্রতিটি আসমানেই রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) একজন করে পয়গম্বরের (عليه السلام) সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং সালাম জানান। সিদরাতে তিনি বহু আশ্চর্যজনক জিনিস দেখতে পান, বেহেশতের নেয়ামত এবং দোযখের শাস্তিও দেখতে পান। তিনি আল্লাহতায়া'লার জামাল (সৌন্দর্য) দেখার আকাঙ্ক্ষা ও সুখানুভূতি ছাড়া বেহেশতের নেয়ামতসমূহ দেখেননি। সিদ্রাতুল মুন্তাহা পার হয়ে তিনি একাই এগিয়ে চললেন বহু নূরের (জ্যোতির) মধ্য দিয়ে। তিনি ফেরেশতাদের কলমসমূহের আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি সত্তর হাজার পর্দার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হলেন। এক পর্দা হতে অপর পর্দার দূরত্ব হলো পাঁচ শ বছরের যাত্রাপথ। অতঃপর “রফরফ্” নামক একটি ফরাশ (বাহন), যেটা সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল, সেটাতে চড়ে তিনি কুরসির মধ্য দিয়ে আরশে পৌঁছুলেন। তিনি আরশ্ থেকে বেরিয়ে গেলেন; স্থান- কাল-পাত্রের জগত হতেও বের হয়ে গেলেন। অতঃপর তিনি এমন এক মকামে পৌঁছুলেন যেখানে আল্লাহতায়া'লার কালাম শোনা যায়।
রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) আল্লাহতায়া'লাকে উপলব্ধি ও ব্যাখ্যার অতীত এমন এক পন্থায় দেখতে পান, যেভাবে স্থান-কালের ঊর্ধ্বে পরবর্তী জগতে আল্লাহতায়া'লার দর্শন পাওয়া যাবে। তিনি শব্দ ও অক্ষর ছাড়াই আল্লাহতায়া'লার সাথে কথা বলেন। তিনি খোদা তায়া'লার প্রশংসাস্তুতি করেন। তাঁকেও অসংখ্য উপহার ও সম্মান দেয়া হয়।
فُرِضَتْ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الصَّلَاةُ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِهِ الصَّلَاةُ خَمْسِينَ، ثُمَّ نُقِصَتْ حَتَّى جُعِلَتْ خَمْسًا
❏ তাঁর প্রতি এবং তাঁর উম্মতের প্রতি দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের এক কঠিন দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, যা হযরত মূসা (عليه السلام)-এর মধ্যস্থতায় পাঁচ ওয়াক্তে কমিয়ে আনা হয়।
🔺[১২] আব্দুর রাযযাক : আল মুসান্নাফ, ১:৪৫২ হাদীস নং ১৭৬৯।
ইতিপূর্বে কেবলমাত্র সকালে, বিকেলে কিংবা রাতেই নামায আদায় করা হতো। এতো বড় দীর্ঘ ভ্রমণশেষে এবং অনেক নেয়ামত ও উপহার লাভের পর এবং বহু বিস্ময়কর জিনিস দর্শন ও শ্রবণের পর তিনি তাঁর বিছানায় ফিরে আসেন, যা তখনো শীতল হয়ে যায়নি। আমরা এ পর্যন্ত যা লিখেছি তা আংশিকভাবে কুরআন মজীদ থেকে, আর আংশিকভাবে হাদীস শরীফ থেকে গৃহীত হয়েছে। এগুলোর সবই বিশ্বাস করা ওয়াজিব নয়। তবু যেহেতু আহলে সুন্তাতের উলামাবৃন্দ এগুলো বর্ণনা করেছেন, সেহেতু যারা এগুলো অস্বীকার করবে, তারা আহলে সুন্নাত হতে খারিজ (বিচ্যুত) হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো আয়াত কিংবা কোনো হাদীস্ বিশ্বাস করবে না, সে কাফের (অবিশ্বাসী) হয়ে যাবে।
হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে নবীকুল শ্রেষ্ঠ
হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে নবীকুল শ্রেষ্ঠ তা প্রতীয়মানকারী অসংখ্য দালিলিক প্রমাণের মধ্যে কিছু আমরা এখন উদ্ধৃত করবো:
শেষ বিচার দিবসে সকল আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম-ই রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর পতাকাতলে আশ্রয় নেবেন। মহান আল্লাহ্ পাক তাঁর নবী আলাইহিমুস সালাম-মণ্ডলীকে এই মর্মে আদেশ দিয়েছিলেন যে যদি তাঁরা তাঁর প্রিয়তম মাহবুব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সময় পর্যন্ত জীবিত থাকেন, তবে তাঁরা যেন তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁরই সাহায্যকারী হন। আর আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দও তাঁদের শেষ অনুরোধস্বরূপ নিজ নিজ উম্মতদেরকে তা করতে বলে গিয়েছিলেন।
❏ হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ) হলেন “খাতাম্ আল-আম্বিয়া” (শেষ নবী)। অর্থাৎ
,لَا نَبِيَّ بَعْدِي
তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না।
🔺[১৩]
(ক) আহমদ : আল মুসনাদ, ১:১৭৭ হাদীস নং ১৫৩২।
(খ) বুখারী : আস সহীহ, ৪:১৬৯ হাদীস নং ৩৪৫৫।
(গ) মুসলিম : আস সহীহ, ৩:১৪৭১ হাদীস নং ১৮৪২।
(ঘ) ইবনে মাজাহ : আস সুনান, ১:৪৫ হাদীস নং ১২১।
(ঙ) আবু দাউদ : আস সুনান, ৪:৯৭ হাদীস নং ৪২৫২।
(চ) তিরমিযী : আস সুনান, ৪:৬৯ হাদীস নং ২২১৯।
(ছ) নাসায়ী : আস সুনান, ৭:৩০৭ হাদীস নং ৮০৮২।
তাঁর পবিত্র রূহ্ মোবারককে সকল নবী আলাইহিমুস সালাম-এর পূর্বে সৃষ্টি করা হয়েছিল। নবুয়্যতের মর্যাদা তাঁকেই সর্বাগ্রে দেয়া হয়েছিল। আর নবুয়্যতের পূর্ণতাও দেয়া হয়েছে দুনিয়াতে তাঁর শুভাগমণ দ্বারা। দুনিয়ার অন্তিমলগ্নে ইমাম মাহ্দী (رضي الله عنه)-এর যমানায় হযরত ঈসা (عليه السلام) আসমান হতে দামেশকে অবতরণ করবেন এবং উম্মতে মোহাম্মদীর অন্তর্ভুক্ত হবেন, আর পৃথিবীতে হযরত রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর শরীয়ত প্রচার করবেন।
🔺[ক্বাদিয়ানী বা আহমদী নামে পরিচিত গোমরাহ লোকেরা যাদেরকে ভারতে ঔপনিবেশিক বৃটিশরা হিজরী ক্বামারী ১২৯৬ সালে সংগঠিত করেছিলো, তারাও পয়গম্বর ঈসা (আলাইহিস্ সালাম)) সম্পর্কে মিথ্যে কুৎসা রটনা করে। যদিও তারা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করে, তবুও অন্তর্ঘাত দ্বারা দ্বীন-ইসলামের ধ্বংস সাধনে তারা অপতৎপর। তারা যে মুসলমান নয়, এ মর্মে একটি ফতোয়া জারি করা হয়েছে।
জামা’আত-উত-তাবলীগিয়্যা
যিনদিক্বদের আরেকটি গোমরাহ দল যারা ভারতে আবির্ভূত হয়েছে, তাদের নাম হচ্ছে জামা’আত-উত-তাবলীগিয়্যা। তাদের দলটি প্রথমে গঠিত হয় ১৩৪৫ হিজরী মোতাবেক ১৯২৬ খৃষ্টাব্দ সালে, মৌলভী ইলিয়াস নামের জনৈক অজ্ঞ লোকের মাধ্যমে। সে ধরে নেয় যে মুসলমানবৃন্দ ‘ইসলামের সত্য পথ হতে বিচ্যুত হয়েছেন’; অধিকন্তু সে এক স্বপ্ন দেখে যার মধ্যে তাকে খোদায়ী নির্দেশ দেয়া হয় ‘তাঁদেরকে বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করতে হবে।’ সে তার শিক্ষকদের কাছ থেকে যা যা শিখেছিলো, তা-ই ব্যক্ত করে। এই শিক্ষকদের মধ্যে ছিলো নাযীর হুসাইন, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী ও খলীল আহমদ সাহারানপুরী, যারা নিজেরাও গোমরাহ। মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্যে যে ধোকাবাজির আশ্রয় তারা নিচ্ছে তা হলো এ কথাটি: ‘সর্বদা নামায ও জামাআতের কথা বলবে (মানে প্রচার করবে)।’ তবে বাস্তবতা হলো, গোমরাহ-পথভ্রষ্টদের পালিত কোনো নামায বা অন্য কোনো এবাদত-বন্দেগী (আল্লাহর দরবারে) গ্রহণযোগ্য নয়; কেননা তারা আহলে সুন্নাতে ওয়াল জামাআত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব লোকের প্রথমে যা করা দরকার তা হলো উলামাবৃন্দের বইপত্র পাঠ করা, গোমরাহ ধ্যানধারণা ত্যাগ করা এবং প্রকৃত মুসলমান হওয়া। যেসব লোক আল-ক্বুরআনের অন্তর্নিহিত অর্থসম্বলিত আয়াতগুলোর অপব্যাখ্যা করে, তাদেরকে বলা হয় বেদআতী বা গোমরাহ। আর যেসব দ্বীনের শত্রু নিজেদের ষড়যন্ত্রমূলক ও গোমরাহীপূর্ণ চিন্তাধারা অনুযায়ী আয়াতে করীমার অর্থারোপ করে, তাদের বলা হয় যিনদিক্ব। এভাবে তারা ক্বুরআন মজীদ ও ইসলাম ধর্ম পরিবর্তন করতে অপপ্রয়াস পাচ্ছে। এই সমস্ত গোমরাহী যারা তৈরি ও প্রচার-প্রসার করছে, তারা হচ্ছে সবচেয়ে বড় শত্রু বৃটিশ রাজ; আর তারাই এই হীন উদ্দেশ্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। ‘তাবলীগী জামা’আতে‘র লোকেরা যারা নিরেট মূর্খ ও বৃটিশের পাতা ফাঁদে পড়ে জঘন্য ক্রীড়নকে পরিণত, তারা দৈনিক (পাঁচ নামায ওয়াক্ত) নামায ও মিথ্যের বেসাতি দ্বারা নিজেদেরকে সুন্নী দাবি করে মুসলমানদেরকে ধোকা দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ ধরনের লোক হচ্ছে (মসজিদের) মিনারার চূড়ায় বকের বাসার মতোই; আর তারা জাহান্নামে সর্বনিম্ন স্তরে শাস্তি পাবে। দীর্ঘ পাগড়ি, লম্বা দাড়ি ও বিশাল জুব্বা নিয়ে এবং ক্বুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে ওর অপব্যাখ্যা করাটা হলো মুসলমানদেরকে ধোকা দেয়ার ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে এসব লোকের অহরহ ব্যবহৃত চালগুলোর একটি। তবে একটি হাদীস শরীফে বিবৃত হয়েছে:
إِنَّ اللَّهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى أَجْسَادِكُمْ وَلَا إِلَى صُوَرِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ
“ইন্নাল্লা’হা লা’ এয়ানযুরু ইলা’ সুওয়ারিকুম ওয়া সিয়্যা’বিকুম ওয়া লা’কিন এয়ানযুরু ইলা’ ক্বুলূবিকুম ওয়া নিয়্যা’তিকুম।” অর্থাৎ, আল্লাহতায়া'লা তোমাদের আকার-আকৃতি ও জামাকাপড় দেখেন না, কিন্তু তোমাদের অন্তর ও উদ্দেশ্য দেখেন।
এখলাস ওয়াক্বফ (তুরস্ক) সংস্থার বইপত্র যেগুলো প্রমাণ করে যে ওই সব লোকের কথাবার্তা মিথ্যে, সেগুলোর কোনো জবাব যেহেতু তারা দিতে পারেনি সেহেতু তারা বলে, “এখলাস ওয়াক্বফ’র প্রকাশিত বইপত্র ভ্রান্ত ও গোমরাহীপূর্ণ। ওই সব বই পড়বেন না।” ইসলামের শত্রু এই গোমরাহ ও যিনদিক্বের দলগুলোকে চেনার সবচেয়ে স্পষ্ট চিহ্ন হচ্ছে তাদের দ্বারা সুন্নী উলামাবৃন্দের প্রতি গোমরাহীর অপবাদ আরোপের মাধ্যমে তাঁদেরই শিক্ষাসমূহ প্রচারকারী বইপত্র পড়া হতে মানুষকে নিবৃত্ত করা। আমাদের তুর্কী ভাষায় রচিত ‘ফা‘য়দালি বিলগিলার’ (উপকারী তথ্য) শীর্ষক বইটি এসব লোকের দ্বারা ইসলামের ক্ষতি সাধনের বিশদ বিবরণ পেশ করে এবং আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদদের দ্বারা তাদের প্রতি প্রদত্ত উত্তর-ও বিধৃত করে (আমাদের ‘সুন্নী পথ’, ’অনন্ত আশীর্বাদ’ ৫ খণ্ড, ‘ঈমান ও ইসলাম’ এবং ‘অকাট্য প্রামাণ্য দলিল’ পুস্তকগুলো দেখুন)।]
শানে মুস্তফা (ﷺ)
❏ হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ) হলেন নবীকুল শ্রেষ্ঠ এবং সৃষ্টিজগতের জন্যে আল্লাহতায়া'লার সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত (করুণা)।
🔺[১৪] আল কুরআন : আল আম্বিয়া, ২১:১০৬।
আঠারো হাজার আলম (জগত) তাঁর রহমতের সাগর থেকে উপকার পেয়েছে। (উলামায়ে কেরামের) সর্বসম্মতিতে ব্যক্ত অভিমত হলো এই যে, তিনি জ্বীন ও ইনসান সকলেরই রাসূল (ﷺ)। বহু উলামা বলেছেন যে তিনি ফেরেশতা, গাছ-গাছালি, প্রাণী ও প্রতিটি বস্তুর জন্যে রাসূল (ﷺ)। অন্যান্য আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দকে যেখানে বিশেষ বিশেষ দেশের বিশেষ বিশেষ গোত্রের জন্যে প্রেরণ করা হয়েছিল, সেখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সকল জগত ও সকল জীব এবং জড় সৃষ্টির জন্যে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। আল্লাহতায়া'লা অন্যান্য নবী আলাইহিমুস সালাম-মণ্ডলীকে নাম সহকারে সম্বোধন করেছেন। কিন্তু হযরত রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর ক্ষেত্রে তিনি কৃপাভরে সম্বোধন করেছেন –
❏ “হে আমার রাসূল (ﷺ)!” প্রত্যেক পয়গম্বর (عليه السلام)-কে উপহৃত প্রতিটি মো’জেযার অনুরূপ মো’জেযা তাঁকে উপহার দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়া'লা অন্যান্য পয়গম্বর আলাইহিমুস সালাম-কে যা মো’জেযা ও নেয়ামত দান করেছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি তিনি রাসূলে কারীম (ﷺ)-কে দান করেছেন। তাঁকে অগণিত নেয়ামত, মাহাত্ম্য ও সম্মান দানের মাধ্যমে অন্যান্য পয়গম্বর (عليه السلام) হতে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি যখন পবিত্র আঙ্গুলের ইশারা করেছেন, তখনই চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে।
🔺[১৫] আল কুরআন : আল কামার, ৫৪:১।
❏ তাঁর হস্তস্থিত পাথর কলেমা পাঠ করেছে। গাছ “ইয়া রাসূলাল্লাহ্” (ﷺ) সম্ভাষণ জানিয়েছে।
🔺[১৬] আবু দাউদ তায়ালুসী : আল মুসনাদ, ৩:১৬।
হান্নানা নামক শুকনো কাঠটিও রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) যখন সেটাকে ত্যাগ করেছিলেন, তখন ক্রন্দন করেছিল। তাঁর মোবারক আঙ্গুল হতে পানির নহর বয়েছিল। পরবর্তী জগতে মাকামুল মাহমূদ, শাফায়াতে কুবরা, হাউযুল কাওসার, আল-ওসীলা ও আল-ফযিলা নামক উচ্চমর্যাদা তাঁকে মঞ্জুর করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। বেহেশতে প্রবেশের পূর্বেই তিনি আল্লাহ্ পাকের জামাল দর্শন করার মহাসম্মান লাভ করেছেন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নৈতিক গুণের অধিকারী রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) একাধারে পূর্ণাঙ্গ ঈমান, জ্ঞান, ভদ্রতা ও পুতঃপবিত্রতা, ন্যায়পরায়ণতা, সাহসিকতা, লজ্জাশীলতা, বিনয়, সুন্দর স্বভাব, দয়া, অন্যদের সাহায্য ও রক্ষাকারী ইত্যাদি গুণাবলীরও অধিকারী ছিলেন। তাঁকে প্রদত্ত মো’জেযার সংখ্যা আল্লাহতায়া'লা ছাড়া আর কেউই জানেন না। তাঁর আনীত শরীয়ত সকল ধর্মকে রহিত করে দিয়েছে। সকল শরীয়তের চেয়ে তাঁর শরীয়ত-ই শ্রেষ্ঠ। তাঁর উম্মাতও অন্যান্য উম্মত হতে শ্রেষ্ঠ। আর তাঁর উম্মতদের মধ্যে আউলিয়াবৃন্দ অন্যান্য উম্মতের আউলিয়া অপেক্ষা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন।
উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবায়ে কেরামের শান
হযরত রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর উম্মতের আউলিয়ামণ্ডলীর (رحمة الله) মধ্যে তাঁর খলীফা হওয়ার যোগ্য ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) যাঁকে আউলিয়ায়ে কেরাম ও ইমামবৃন্দ অধিক ভালোবাসতেন এবং যিনি অন্যান্যদের চেয়ে খেলাফতের জন্যে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন।
أُحَدِّثُكَ بِأَفْضَلِ النَّاسِ كَانَ بَعْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ قُلْتُ بَلَى فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ
❏ পয়গম্বর আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দের পরে তিনি-ই আগত ও ভবিষ্যতে আগমনকারী ইনসানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সৌভাগ্যবান।
🔺[১৭] আহমদ : আল মুসনাদ, ২:৪৯২ হাদীস নং ১০৫৪।
খলীফা হওয়ার মর্যাদা ও সম্মান তিনি-ই সর্বপ্রথম অর্জন করেন। আল্লাহতায়া'লার দয়া ও রহমতে ইসলামের সূচনার পূর্বেও তিনি মূর্তি পূজা করেন নি। কুফর (অবিশ্বাস) ও গোমরাহী (পথভ্রষ্টতা)-এর ত্রুটি হতে তাঁকে হেফাযত করা হয়েছিল।
فَلَا أُخْبِرُكَ بِخَيْرِ النَّاسِ كَانَ بَعْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبِي بَكْرٍ قُلْتُ بَلَى قَالَ عُمَرُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ-
❏ হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه)-এর পরে ইনসানকুল শ্রেষ্ঠ হলেন দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه) যাঁকে আল্লাহতায়া'লা তাঁর মাহবুব হযরত রাসূলে করীম (ﷺ)-এর বন্ধু হিসেবে পছন্দ করেছিলেন।
হযরত উমর (رضي الله عنه)-এর পরে শ্রেষ্ঠ হলেন তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফফান যিন্নূরাইন (رضي الله عنه) যিনি নেয়ামত ও দয়ার খনি এবং বিনয়, বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উৎস ছিলেন।
হযরত উসমান (رضي الله عنه)-এর পরে শ্রেষ্ঠ হলেন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর চতুর্থ খলিফা হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (رضي الله عنه) যিনি বিস্ময়কর গুণাবলীর অধিকারী এবং আল্লাহতায়া'লার আসাদ (সিংহ) ছিলেন।
❏ হযরত হাসান ইবনে আলী (رضي الله عنه) তাঁর পরে খলিফা হন। হাদীসে উল্লিখিত الْخِلَافَةُ بَعْدِي ثَلَاثُونَ سَنَةً – 🔺[১৮]
(ক) বাযযার : আল মুসনাদ, ৯:২৮০।
(খ) ইবনে হিব্বান : আস সহীহ, ১৫:৩৯২ হাদীস নং ৬৯৪৩।
খেলাফতের ত্রিশ বছর তাঁর শাসনামল দ্বারা পূর্ণ হয়। তাঁর পরে শ্রেষ্ঠ হলেন হযরত হুসাইন ইবনে আলী (رضي الله عنه) যিনি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর দুই চোখের মণি ছিলেন।
এই সকল শ্রেষ্ঠ গুণাবলী উপরোক্ত পুণ্যাত্মাগণের মধ্যে বিরাজ করার ভিত্তি হলো তাঁদের অধিক সওয়াব অর্জন, ইসলামের ওয়াস্তে স্বদেশ ও স্বজন ত্যাগ, অন্যান্যদের পূর্বে মুসলমান হওয়া, সর্বোচ্চ মাত্রায় রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর তাবেদারী ও তাঁর সুন্নাতের কাছে আত্মসমর্পণ, নবী করীম (ﷺ)-এর শরীয়তকে প্রচার-প্রসার করার মহৎ উদ্দেশ্যে সংগ্রাম এবং অবিশ্বাস, ফিতনা (গণ্ডগোল, হট্টগোল) ও দুর্নীতির মূলোৎপাটন।
হযরত আলী (رضي الله عنه) করীম ইসলাম গ্রহণ করেন সবার আগে, একমাত্র হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)-এর ক্ষেত্র ছাড়া। তিনি তখন একজন বালক ছিলেন এবং তাঁর কোনো সম্পত্তিও ছিল না; তিনি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর ঘরে বসবাস করতেন এবং তাঁর খেদমত করতেন। যেহেতু হযরত আলী (رضي الله عنه) ও তাঁর পুত্রবৃন্দ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকটাত্মীয় ছিলেন এবং হুজুর পূর নূর (ﷺ)-এরই মোবারক রক্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন, সেহেতু তাঁদেরকে হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) ও হযরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) হতে শ্রেষ্ঠ হয়তো বলা যেতে পারে; কিন্তু এ শ্রেষ্ঠত্ব বা মাহাত্ম্য সকল ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব নয় এবং সকল ক্ষেত্রেই তাঁদেরকে এটা ওই সকল মহান ব্যক্তিত্ব হতে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়নি। এর দৃষ্টান্ত হলো হযরত খিযির (عليه السلام) ও হযরত মূসা (عليه السلام)-এর ঘটনাটির মতো, যে ঘটনায় খিযির (عليه السلام) হযরত মূসা (عليه السلام)-কে কিছু বিষয় শিক্ষা দিয়েছিলেন।
হযরত মা খাদেজা (رضي الله عنه) ও হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে হযরত মা ফাতেমা (رضي الله عنه) উচ্চমর্যদাসম্পন্ন ছিলেন। কেননা, তিনি নূর নবী (ﷺ)-এর রক্ত-সম্পর্কের। কিন্তু এক কিসিমের শ্রেষ্ঠত্ব সকল ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিফলন করে না। এঁদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা নিরূপণ করতে গিয়ে উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। হাদীস শরীফ হতে উপলব্ধি করা যায় যে এই তিন জন ও হযরত মরিয়ম এবং ফেরাউনের স্ত্রী হযরত আসিয়া দুনিয়ার নারীকুল শ্রেষ্ঠ।
فَاطِمَةَ سَيِّدَةُ نِسَاءِ أَهْلِ الجَنَّةِ وَأَنَّ الحَسَنَ وَالحُسَيْنَ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الجَنَّةِ.
❏ – “বেহেশতের নারীকুল শ্রেষ্ঠ হলো ফাতেমা (رضي الله عنه)
🔺[১৯]
(ক) বুখারী : আস সহীহ, মানাকিবু ফাতিমাতুয যাহরা, ২০:৫।
(খ) তিরমিযী : আস সুনান, ৬:১২৭ হাদীস নং ৩৭৮১।
❏ এবং বেহেশতের যুবককুল শ্রেষ্ঠ হলো হাসান (رضي الله عنه) ও হুসাইন (رضي الله عنه)” — হাদীসটি একটি ক্ষেত্রের শ্রেষ্ঠত্বকেই ইশারা করেছে।
রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সাহাবীদের মধ্যে পরবর্তী শ্রেষ্ঠ হলেন ”আশারাত্ আল্ মুবাশ্শারা”– দশজন পুণ্যাত্মা, যাঁদেরকে বেহেশতী হওয়ার শুভসংবাদ দ্বারা ধন্য করা হয়েছে। তাঁদের পরে বদরের জেহাদে অংশগ্রহণকারী তিন শ তের জন মুসলমান-ই হলেন শ্রেষ্ঠ। অতঃপর শ্রেষ্ঠ হলেন উহুদ জেহাদে অংশগ্রহণকারী সাত শ জন বীর মুসলমান। তাঁদের পরে শ্রেষ্ঠ হলেন “বি’য়াত আর-রিদ্ওয়ান” নামক চৌদ্দ শ মুসলমান যাঁরা নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে গাছের নিচে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছিলেন।
সাহাবায়ে কেরামগণকে তাজিম ও ভালবাসার ফজিলত
রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর ওয়াস্তে তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه) নিজেদের জীবন ও মালামাল উৎসর্গ করেন এবং তাঁকে সাহায্য করেন। তাঁদের যে কারো নাম উল্লেখ করার সময় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাসহ তা করা আমাদের জন্যে অবশ্যকর্তব্য (ওয়াজিব)। তাঁদের মাহাত্ম্যের পরিপন্থী কোনো অশোভনীয় উক্তি করা আমাদের জন্যে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। অশ্রদ্ধাসহ তাঁদের নাম উল্লেখ করা গোমরাহী (পথভ্রষ্টতা) ও বিচ্যুতি।
যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে ভালোবাসেন, তাঁর জন্যে সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه)-কে ভালোবাসাও কর্তব্য।
❏ একটি হাদীসে নূরনবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান —
فَمَنْ أَحَبَّهُمْ فَبِحُبِّي أَحَبَّهُمْ ، وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِي أَبْغَضَهُمْ ، وَمَنْ آذَاهُمْ فَقَدْ آذَانِي ، وَمَنْ آذَانِي فَقَدْ آذَى اللَّهَ ، وَمَنْ آذَى اللَّهَ أَوْشَكَ أَنْ يَأْخُذَهُ.
– যে ব্যক্তি আমার সাহাবীদেরকে ভালোবাসে, সে আমাকে ভালোবাসার কারণেই ভালোবাসে। যে ব্যক্তি তাদেরকে ভালোবাসে না, সে আমাকেও ভালোবাসে না। যে ব্যক্তি তাদেরকে আঘাত দেয়, সে প্রকৃতপক্ষে আমাকেই আঘাত দেয়। আর যে ব্যক্তি আমাকে আঘাত দেয়, সে আল্লাহ তায়া'লাকেই আঘাত দেয়। আল্লাহ তায়া'লাকে যে ব্যক্তি আঘাত দেয়, সে অবশ্যই শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।”
🔺[২০]
(ক) আহমদ : আল মুসনাদ, ৪:৮৭ হাদীস নং ১৬৮৪৯।
(খ) তিরমিযী : আস সুনান, ৬:১৭৯ হাদীস নং ৩৮৬২।
(গ) বাগাবী : শরহুস সুন্নাহ, ১৪:৭০ হাদীস নং ৩৮৬০।
(ঘ) বায়হাকী : শুয়াবুল ইমান, ২:১৯১ হাদীস নং ৬৪৯।
❏ অপর এক হাদীস শরীফে তিনি এরশাদ ফরমান —
اذَا اَرَادَ اللهُ بِرجُلٍ مِنْ أُمَتِيْ خَيْراً اُلْقَيَ حُب اَصْحَابِيْ فِيْ قَلْبِهِ
– যখন আল্লাহতায়া'লা আমার উম্মতের মধ্যে কাউকে কৃপা করতে চান, তখন তিনি তার অন্তরে আমার সাহাবীদের প্রতি ভালোবাসা প্রোথিত করেন। আর ফলস্বরূপ সেই ব্যক্তিও তাদেরকে অত্যন্ত ভালোবাসে”।
এ কারণেই এটা ধারণা করা উচিৎ নয় যে নবী করীম (ﷺ)-এর সাহাবী (رضي الله عنه)-বৃন্দ খলিফা হওয়ার জন্যে কিংবা নিজেদের বদ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে অথবা নিজেদের ইন্দ্রিয় কামনাকে পূর্ণ করার জন্যে পরস্পর পরস্পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এ ধরনের ধারণার বশবর্তী হয়ে তাঁদের সমালোচনা করা চরম মোনাফেকী (কপটতা) যা কোনো ব্যক্তিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। কেননা, রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর সাহচর্য ও তাঁর পুণ্যময় ভাষণসমূহ শ্রবণ দ্বারা সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه)-এর অন্তর থেকে দুনিয়ার প্রেম এবং হিংসা-বিদ্বেষ তিরোহিত হয়েছিল। তাঁদেরকে পরিশুদ্ধ করা হয়েছিল এবং তাঁরা লোভ, উচ্চাভিলাষ, বিদ্বেষ ও বদ স্বভাব হতে মুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা সর্বাংশে পবিত্র হয়ে গিয়েছিলেন। যেখানে এই মহাসম্মানিত রাসূল (ﷺ)-এর উম্মতের আউলিয়াগণের কোনো একজনের মাত্র কয়েক দিনের সান্নিধ্য লাভকারী ব্যক্তি সেই ওলীর সুন্দর নৈতিকতা ও মাহাত্ম্য হতে উপকার পায় এবং দুনিয়াবী খায়েশ হতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়, সেখানে এ কথা কীভাবে ধারণা করা যায় যে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সাহাবীবৃন্দ, অর্থাৎ, আমাদের মনিববৃন্দ যাঁরা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন ও নিজেদের জান-মাল তাঁর জন্যে উৎসর্গ করেছিলেন এবং নিজেদের রাজ্য তাঁর ওয়াস্তেই ত্যাগ করেছিলেন, আর তাঁরই সাহচর্যে থাকতে পছন্দ করতেন যা আত্মাসমূহের খাদ্য ছিল, তাঁরাই আবার বদ নৈতিকতা হতে মুক্ত ছিলেন না এবং তাঁদের নফসগুলোও পরিষ্কার ছিল না এবং তাঁরা এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর পচা জিনিসের জন্যে যুদ্ধ করেছিলেন? ওই সকল মহান ব্যক্তি নিশ্চয়ই অন্যান্যদের চেয়ে নির্মল ছিলেন। তাঁদের মধ্যকার মতপার্থক্য ও যুদ্ধকে আমাদের মতো বদ উদ্দেশ্যসম্পন্ন লোকদের মধ্যকার মতপার্থক্য ও যুদ্ধ-বিগ্রহের সাথে তুলনা করা কিংবা তাঁরা তাঁদের দুনিয়ারী স্বার্থে ও অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে যুদ্ধ করেছিলেন বলাটা অনভিপ্রেত। প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সাহাবী (رضي الله عنه)-দের প্রতি এ ধরনের বাজে ধারণা পোষণ করা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। যে ব্যক্তি তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে চায়, তার ভালো করে জানা উচিৎ যে সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه)-এর বিরুদ্ধাচরণ করা নবী করীম (ﷺ)-এরই বিরুদ্ধাচরণ, আর তাঁদের সমালোচনা করা নবী (ﷺ)-এরই সমালোচনা, যিনি তাঁদেরকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এ কারণেই ইসলামের মহান উলামামণ্ডলী বলেছেন যে নবী করীম (ﷺ)-এর সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه)-এর প্রতি যে ব্যক্তি শ্রদ্ধা ও উচ্চ ধারণা পোষণ করে না, সে প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এরই প্রতি অবিশ্বাস রাখে। সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه)-এর কুৎসা রটনা করার জন্যে “জামাল” (উট) ও “সিফফিনের” যুদ্ধকে অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। কিছু ধর্মীয় কারণে এ সকল যুদ্ধে যাঁরা হযরত আলী (رضي الله عنه)-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন তাঁরা পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্য ছিলেন।
❏ একটি হাদীস শরীফে রাসূলে কারীম (ﷺ) এরশাদ ফরমান – إِنْ أَصَبْتَ فَلَكَ عَشْرُ أُجُورٍ وَإِنِ اجْتَهَدْتَ فَأَخْطَأْتَ فَلَكَ أَجْرٌ.
“ইজতেহাদ প্রয়োগকারী মুজতাহিদ যিনি ভুল করেন, তাঁর জন্যে রয়েছে একটি সওয়াব (পুরস্কার)। আর যে মুজতাহিদ সঠিক পথপ্রাপ্ত হন, তাঁর জন্যে রয়েছে দুইটি (বর্ণনান্তরে দশটি) পুরস্কার। একটি পুরস্কার হলো ইজতেহাদ (গবেষণা) প্রয়োগের জন্যে; অপরটি সত্যপ্রাপ্তির জন্যে” ।
🔺[২১] হাকিম : আল মুস্তাদরাক, কিতাবুল আহকাম, ৪:৮৮ হাদীস নং ৭০০২।
ওই সকল মহান ইসলামী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ হিংসা-বিদ্বেষ হতে সৃষ্ট ছিল না, বরং তা ছিল তাঁদের ইজতেহাদী পার্থক্য হতে সৃষ্ট এবং শরীয়তের আদেশ-নিষেধ পালনে তাঁদের ইচ্ছা হতে নিঃসৃত। নবী পাক (ﷺ)-এর প্রত্যেক সাহাবী (رضي الله عنه)-ই একেকজন মুজতাহিদ ছিলেন।
মুজতাহিদের জন্যে নিজ ইজতেহাদ
কোনো মুজতাহিদের জন্যে নিজ ইজতেহাদ দ্বারা বের করা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমল করা ফরয, যদিও তা তাঁর চেয়েও উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন মুজতাহিদের ইজতেহাদের পরিপন্থী হয়। অন্য কারো ইজতেহাদ অনুসরণ করা তাঁর জন্যে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। ইমামুল আযম হযরত আবু হানিফা (رحمة الله)-এর শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ (رحمة الله) ও ইমাম মুহাম্মদ শায়বানি (رضي الله عنه) এবং ইমাম মুহাম্মদ শাফেয়ী (رحمة الله)-এর শিষ্য ইমাম আবু সাওর (رحمة الله) ও ইমাম ইসমাইল মুযানী (رحمة الله) বহু ক্ষেত্রে নিজেদের ওস্তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন; কয়েকটি বিষয়ে তাঁদের ওস্তাদবৃন্দ যেখানে বলেছিলেন “হারাম” (নিষিদ্ধ), সেখানে তাঁরা বলেছেন “হালাল” (অনুমতিপ্রাপ্ত, বৈধ); আর যেখানে তাঁদের ওস্তাদবৃন্দ বলেছিলেন “হালাল”, সেখানে তাঁরা “হারাম” বলেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদেরকে পাপিষ্ঠ কিংবা বদ আখ্যা দেয়া চলে না। কেউই তা বলেননি, কেননা তাঁরাও তাঁদের ওস্তাদদের মতোই মুজতাহিদ ছিলেন।
এটা সত্য যে হযরত মু’য়াবিয়া (رضي الله عنه) ও হযরত আমর ইবনে আস্ (رضي الله عنه) হতে হযরত আলী (رضي الله عنه) অনেক উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ও শিক্ষিত ছিলেন। তাঁর বহু মাহাত্ম্য ছিল যা তাঁকে ওই দু জন হতে পৃথক করেছিল, আর তাঁর ইজতেহাদও তাঁদের চেয়ে শক্তিশালী ও তীক্ষ্ণ ছিল। তবে যেহেতু প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সকল সাহাবী-ই মুজতাহিদ ছিলেন, সেহেতু ওই দু জন সাহাবী (رضي الله عنه)-এর পক্ষে হযরত আলী (رضي الله عنه)-এর মতো এতো বড় একজন ধর্মীয় ইমামের ইজতেহাদ অনুসরণ করা অনুমতিপ্রাপ্ত ছিল না। তাঁদের নিজেদের ইজতেহাদকে অনুসরণ করাই তাঁদের জন্যে জরুরি ছিল।
“জামাল” ও ”সিফফিন”-এর যুদ্ধ বিতর্কের সমাধান
🔴প্রশ্নঃ “জামাল” ও ”সিফফিন”-এর যুদ্ধে রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর সাহাবীদের মধ্যে বহু মুহাজিরিন ও আনসার সাহাবী (رضي الله عنه) হযরত আলী (رضي الله عنه)-এর পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন এবং তাঁকে অনুসরণ ও মান্য করেছিলেন। যদিও তাঁরা সকলেই মুজতাহিদ ছিলেন, তবুও তাঁরা হযরত আলী (رضي الله عنه)-কে অনুসরণ করা ওয়াজিব বিবেচনা করেছিলেন। এটা পরিস্ফুট করে যে হযরত আলী (رضي الله عنه)-কে অনুসরণ করা মুজতাহিদদের জন্যেও ওয়াজেব। যদিও তাঁদের ইজতেহাদ তাঁর ইজতেহাদের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতো, তবুও তাঁদের জন্যে তাঁর-ই অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক ছিল, তাই নয় কি?
জবাব: হযরত আলী (رضي الله عنه)-কে যাঁরা অনুসরণ করেছিলেন এবং তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁরা তা করেছিলেন তাঁর ইজতেহাদকে অনুসরণ করার অভিপ্রায়ে নয়, বরং এ কারণেই যে তাঁদের ইজতেহাদ তাঁর ইজতেহাদের সাথে মিলে গিয়েছিল; তাঁরা এটা করে পরিস্ফুট করলেন যে হযরত ইমাম আলী (رضي الله عنه)-কে অনুসরণ করা ওয়াজেব ছিল। অনুরূপভাবে, নবী করীম (ﷺ)-এর বহু বিখ্যাত সাহাবীর ইজতেহাদসমূহও হযরত আলী (رضي الله عنه) করীম-এর ইজতেহাদের সাথে মিলে নি; ফলে তাঁর বিরোধিতা করা তাঁদের জন্যে ওয়াজেব হয়েছিল। অতএব, নূরনবী (ﷺ)-এর সাহাবীবৃন্দের ইজতেহাদসমূহ তিনটি পৃথক ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল: তাঁদের কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিলেন যে হযরত আলী (رضي الله عنه)-ই সঠিক; তাই তাঁকে অনুসরণ করা তাঁদের জন্যে অত্যাবশ্যক ছিল। অপর পক্ষটি হযরত আলী (رضي الله عنه)-এর বিরোধিতাকারীদের ইজতেহাদকে সঠিক মনে করেছিলেন; তাই তাঁদের পক্ষে সেটাকে অনুসরণ করা অবশ্য করণীয় ছিল। তৃতীয় পক্ষটি বলেছিলেন যে উভয় পক্ষকে অনুসরণ করা এবং দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া অপরিহার্য ছিল না; তাই তাঁদের ইজতেহাদ অনুযায়ী দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। এ তিনটি পক্ষের সকলেই সঠিক ছিলেন এবং তাঁরা পরকালে পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্য।
সাহাবীগণের মধ্যকার ইজতিহাদী দ্বন্দ্ব
🔴প্রশ্নঃ
উপরোক্ত লেখনী প্রতিভাত করে যে যাঁরা হযরত আলী (رضي الله عنه)-এর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলেন, তাঁরাও সঠিক ছিলেন। অথচ আহলে সুন্নাতের উলামায়ে কেরাম বলেছেন যে হযরত আলী (رضي الله عنه)-ই সঠিক ছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধবাদীবৃন্দ ভুল করেছিলেন; কিন্তু তাঁদেরকে তাঁদের ওযরের কারণে ক্ষমা করা গিয়েছিল এবং এমন কী তাঁরা এর জন্যে সওয়াবও হাসিল করেছিলেন। এ ব্যাপারে ফয়সালা কী?
জবাব:
❏ ইসলামের দু জন মহান ব্যক্তিত্ব ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) ও খলিফা উমর ইবনে আবদিল আযীয (رحمة الله) বলেছেন যে, لاَ يَجُوْزُ اَنْ يَقَالَ لاَيِ صَحَابِيِ أنَهُ قَدْ أَخْطَا রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সাহাবায়ে কেরামের কাউকেই “ভ্রান্ত” আখ্যা দেয়া অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। এ কারণেই এটা বলা হয়েছিল ”গুরুজনদের প্রতি ‘ভ্রান্ত’ শব্দটি আরোপ করা চরম ভ্রান্তি।” ছোটদের জন্যে গুরুজনকে “তিনি সঠিক ছিলেন”, তিনি ভ্রান্ত ছিলেন”, “আমরা স্বীকৃতি জানাই”, কিংবা “আমরা অনুমোদন করি না” বলা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। আল্লাহতায়া'লা যেমন ওই সকল মহান ব্যক্তির রক্ত দ্বারা আমাদের হাতকে রঞ্জিত করেন নি, ঠিক তেমনি আমাদেরকেও তাঁদের প্রতি “সঠিক” ও “ভ্রান্ত” শব্দগুলো ব্যবহার করা হতে আমাদের জিহ্বাকে হেফাযত করতে হবে। যে সকল গভীর জ্ঞানী আলেম তখনকার ঘটনাবলী ও প্রামাণ্য দলিলাদি বিচার-বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন যে হযরত আলী (رضي الله عنه)-ই সঠিক ছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধাচারীবৃন্দ ভুল করেছিলেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে বুঝিয়েছিলেন যে যদি হযরত আলী (رضي الله عنه) তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের সাথে কথা বলার সুযোগ পেতেন, তাহলে তিনি তাঁদেরকে নিজ ইজতেহাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ইজতেহাদ প্রয়োগ করায় পরিচালিত করতে সক্ষম হতেন। বস্তুতঃ “জামাল”-এর যুদ্ধে হযরত যুবাইর ইবনে আউয়াম (رضي الله عنه) হযরত আলী (رضي الله عنه)-এর বিরুদ্ধে ছিলেন, কিন্তু তথ্যসমূহকে আরো গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করার পর তিনি নিজ ইজতেহাদ পরিবর্তন করেন এবং যুদ্ধ বন্ধ করেন। যে সকল আহলে সুন্নাতের আলেম ভুলকে অনুমতিপ্রাপ্ত বিবেচনা করেন, তাঁদের কথাকে ওভাবে গ্রহণ করতে হবে। আর এ কথা বলা অনুমতিপ্রাপ্ত নয় যে হযরত আলী (رضي الله عنه) ও তাঁর অনুসারীগণ সঠিক ছিলেন এবং মা আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنه)-এর পক্ষাবলম্বনকারী নবী করীম (ﷺ)-এর অন্যান্য সাহাবী (رضي الله عنه)-বৃন্দ পথভ্রষ্ট ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সাহাবীমণ্ডলীর মধ্যকার এ সকল দ্বন্দ্ব শরীয়তের আইন-কানুনের সহায়তাকারী শাখা-প্রশাখায় প্রয়োগকৃত ইজতেহাদী মতপার্থক্য হতেই নিঃসৃত হয়েছিল। তাঁরা শরীয়তের মৌলিক বিষয়গুলোতে মতভেদ করেন নি।
❏ আজকাল হযরত মোয়াবিয়া (رضي الله عنه) ও হযরত আমর ইবনে আস্ (رضي الله عنه)-এর মতো মহান ইসলামী ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে কিছু লোক বেয়াদবিপূর্ণ কুৎসা রটনা করছে
🔺[উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের আবুল আলা মওদুদী তার “খেলাফত ও রাজন্ত্র” নামক পুস্তকের ১২৭ পৃষ্ঠায় সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه)-কে নির্ভুল জানা “যুলুম” ও “অন্যায়” বলেছে (বাংলা সংস্করণ ১৯৮৯ ইং) – অনুবাদক]।
হযরত মোয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর সমালোচনার
তারা উপলব্ধি করতে অক্ষম যে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه)-কে গালমন্দ করে তারা বাস্তবে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কেই হেয় ও অপমান করার অপচেষ্টায় লিপ্ত।
❏ “শিফা” গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে যে,ইমাম মালেক ইবনে আনাস্ (رحمة الله) বলেছেন,
مَنْ شَتَمَ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى الله عليه وسلم أبا بكرأَوْ عُمَرَ ، أَوْ عُثْمَانَ ، أَوْ مُعَاوِيَةَ ، أَوْ عَمْرَو بْنَ الْعَاصِ فَإِنْ قَالَ: كَانُوا عَلَى ضَلَالٍ وَكُفْرٍ قُتِلَ، وَإِنْ شَتَمَهُمْ بِغَيْرِ هَذَا مِنْ مُشَاتَمَةِ النَّاسِ نُكِّلَ نَكَالًا شَدِيدًا.
– যে ব্যক্তি হযরত মোয়াবিয়া (رضي الله عنه) (বেসাল: ৬০ হিজরী/৬৮০ খৃষ্টাব্দ, দামেশক) ও হযরত আমর ইবনে আস্ (رضي الله عنه) (বেসাল: ৪৩ হিজরী/৬৬৩ খৃষ্টাব্দ, মিসর)-এর কুৎসা রটনা করে এবং তাঁদেরকে গালমন্দ করে, তার প্রাপ্য হলো সেই সব বাক্যমালা যা সে তাঁদের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছে। যারা তাঁদের বিরুদ্ধে বলে ও লিখে এবং তাঁদেরকে সম্মান করে না, তাদেরকে কঠোরভাবে শাস্তি দেয়া আবশ্যক।
🔺[২২] কাযী আয়ায : আশ শিফা, ২:২৫৩।
আল্লাহ্ পাক আমাদের অন্তরগুলোকে তাঁর হাবীব (ﷺ)-এর সাহাবীবৃন্দ (رضي الله عنه)-এর প্রতি ভালোবাসা দ্বারা পরিপূর্ণ করুন, আমীন। মোনাফেক ও পাপিষ্ঠ লোকেরা নয়, বরং খোদা-ভীরু, নেককার মুসলমানবৃন্দ-ই ওই সকল গুরুজনকে ভালোবাসেন।
🔺[হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র আসহাব-এ-কেরাম তথা সাথীবৃন্দের (رضي الله عنه) মূল্য ও শ্রেষ্ঠত্ব যে সকল মুসলমান উপলব্ধি করেন এবং তাঁদেরকে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন ও অনুসরণ করেন, তাঁরা আহলে সুন্নাত নামে অভিহিত। যারা সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর মধ্যে কয়েকজনকে ভালোবাসার দাবি করে এবং অন্যান্যদের প্রতি মহব্বত রাখে না, আর এরই ফলশ্রুতিতে তাঁদের অধিকাংশেরই কুৎসা রটনা করে এবং অনুসরণও করে না, তাদেরকে বলা হয় শিয়া। ইরান, ভারত ও ইরাক্বে অনেক শিয়া রয়েছে, কিন্তু তুরস্কে নেই। এদের মধ্যে কিছু কিছু শিয়াপন্থী তুরস্কের প্রকৃত ‘আলাউয়ী’ মুসলমানদেরকে ধোকা দেয়ার জন্যে নিজেদেরকে ‘আলাউয়ী’ নামে ডাকে, যার অর্থ ’হযরত ইমামে আলী (رضي الله عنه)’র প্রতি মহব্বতকারী মুসলমান।’ কাউকে ভালোবাসার জন্যে প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ এবং তিনি যাঁদের ভালোবাসেন, তাঁদেরকেও ভালোবাসা; যদি শিয়ারা হযরত আলী (رضي الله عنه)’কে ভালোবাসতো, তাহলে তারা তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করতো। তিনি তো রাসূলে খোদা (ﷺ)’র সকল সাহাবা (رضي الله عنه)-কেই ভালোবাসতেন; খলীফা উমর (رضي الله عنه)-এর উপদেষ্টা ছিলেন; খলীফা তাঁকে নিজের দুঃখকষ্টের কথা জানাতেন। তিনি তাঁর এবং মা ফাতেমা (رضي الله عنه)’র কন্যা উম্মে গুলসুমকে হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর সাথে বিয়ে দেন।
❏ একটি খুতবায় তিনি আমীরে মু’আবিয়া (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলেন:
إخْوَانُنَا بَغَوْا عَلَيْنَا لَيْسُوا بِكُفَّارٍ وَلاَ فِساَقٍ فانَ لَهُمْ تَاوِيْلاً يَمْنَعُ عَنْهُمْ الْكُفْرُ وَالْفِسْق
“আমাদের ভাইয়েরা আমাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। কিন্তু তাঁরা কাফের বা পাপী নন। তাঁদের এজতেহাদ ওই পন্থায় হয়েছে”
🔺(ক/ মুসলিম: আস সহীহ, ১২:৪২৬ হাদীস নং ৪৬৫০; খ/ ইবনে মাজাহ: আস সুনান, ১২:১৭৩ হাদীস নং ৪১৩৩; গ/ আল খতিব: মিশকাতুল মাসাবীহ, ৩:১৫২, হাদীস নং ৫৩১৪; ঘ/ আহমদ: আল মুসনাদ, ১৬:৩৪, হাদীস নং ৭৪৯৩; ঙ/ বায়হাকী: শুয়াবুল ইমান, ২১:৪০৯, হাদীস নং ১০০৮৮; চ/ ইবনে হিব্বান : আস সহীহ, ২:২৭৮, হাদীস নং ৩৯৫)।
❏ হযরত তালহা (رضي الله عنه) যখন তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় শহীদ হন, তখন তিনি নিজেই হযরত তালহা (رحمة الله)’র মুখ হতে ধুলো পরিষ্কার করে দেন এবং তাঁর জানাযার নামাযে ইমামতি করেন।
❏ আল্লাহতায়া'লা ঘোষণা করেন:
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
“ঈমানদাররা পরস্পরের ভাই” (আল কুরআন: আল-হুজুরাত, ৪৯:১০)।
❏ সূরা ফাত’হ-এর শেষ আয়াতে তিনি এরশাদ ফরমান –
رُحَمَآءُ بَيْنَهُمْ
অর্থ: সাহাবা-মণ্ডলী পরস্পরের প্রতি করুণা/মহব্বতশীল (আল কুরআন: আল-ফাতহ, ৪৮:২৯)।
মহানবী (ﷺ)’র এমন কী একজন সাহাবী (رضي الله عنه)’কেও ভালো না বাসা, কিংবা আরো মন্দকর্ম হিসেবে হুযূরের (ﷺ) প্রতি বৈরীভাবাপন্ন হওয়ার মানে হলো ক্বুরআনুল করীমেরই প্রতি অবিশ্বাস স্থাপন। সুন্নী উলামাবৃন্দ সঠিকভাবে সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং (সেই মোতাবেক) মুসলমানদের প্রতি তাঁদেরকে ভালোবাসার জন্যে নির্দেশ দিয়েছিলেন; আর ফলশ্রুতিতে তাঁরা সকল মুসলমানকে বিপদ হতে রক্ষা করেন।
বাতিল ফির্কার পরিচয়
আহলে সুন্নাতের নয়নমণি আমাদেরই গুরুজন হযরত ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম) ও তাঁর পুত্রবৃন্দ এবং বংশধরদের প্রতি যারা ঘৃণা ও বৈরীভাব পোষণ করতো, তাদের বলা হতো খারেজী (খাওয়া’রিজ)। বর্তমানে তাদেরকে এয়াযীদী নামে ডাকা হয়। তাদের আক্বীদা-বিশ্বাস এতোই ভ্রান্ত যে দ্বীন-ইসলামের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
ওহাবী সম্প্রদায় হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর প্রতি মহব্বতের দাবিদার হলেও তারা তাঁদের পথ ও মতকে অনুসরণ করে না, বরঞ্চ অনুসরণ করে নিজেদের গোমরাহীর, যেটাকে তারা সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দের প্রতি আরোপ করে থাকে। তারা পছন্দ করে না আহলে সুন্নাতের হক্কানী উলামামণ্ডলীকে, সূফীবৃন্দকে এবং ‘আলাউয়ী’দেরকেও; আর তারা এঁদের সবারই কুৎসা রটনা করে থাকে। তারা ধারণা করে যে একমাত্র তারাই হলো মুসলমান। তাদের মতো নয় এমন মুসলমানদেরকে তারা ‘মুশরিক/মূর্তি পূজারী’ বিবেচনা করে এবং তাঁদের জান ও মাল হরণ করতে সম্মত হয়। ফলে তারা ‘এবা’হাতী’ গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। ক্বুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ হতে তারা ভুল অর্থ বের করে এবং মনে করে যে ইসলাম ধর্ম বুঝি ওইসব অর্থ নিয়েই গঠিত। তারা আদিল্লাত আশ-শরীয়ত (শরঈ দলিলাদি) এবং বেশির ভাগ হাদীস-ই অস্বীকার করে। চার মাযহাবের বিশিষ্ট আলেম-উলামা বহু বইপত্র লিখে দলিলাদিসহ প্রমাণ করেছেন যে আহলে সুন্নাত হতে যারা বিচ্যুত হয়, তারা গোমরাহ/পথভ্রষ্ট এবং ইসলামের জন্যে ক্ষতিকর। 🔺[বি:দ্র: বিস্তারিত তথ্যের জন্যে পড়ুন ‘ওহাবীদের প্রতি নসীহত’, ‘অনন্ত আশীর্বাদ’, ‘ওহাবী মতবাদ খণ্ডনে ঐশী অবদান’, (আরবীতে) ‘আত-তাওয়াসসুলু বিন্ নবী ওয়া জাহালাত আল-ওয়াহহা’বিয়্যীন’ ও ‘সাবি’ল আন্ নাজাত’ এবং (ফার্সীতে) ‘সাইফ আল-আবরার’ বইগুলো। এসব বই এবং আহলে বেদআত গোষ্ঠীর খণ্ডনে মূল্যবান গ্রন্থাবলী ইস্তাম্বুলে অবস্থিত হাক্বীক্বাত কিতাবাভী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। (ইমাম মুহাম্মদ আমিন ইবনে আবেদীন যিনি দামেশকে ১২৫২ হিজরী/১৮৩৬ খৃষ্টাব্দ সালে বেসালপ্রাপ্ত হন, তাঁর রচিত) আরবী ‘রাদ্দুল মোহতার’ (৩য় খণ্ড, ‘বাগী’ অধ্যায়) ও তুর্কী ’নি’মাত-এ-ইসলাম’ (’নিকাহ’ অধ্যায়) শীর্ষক দুটো পুস্তকেই স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে যে ওহাবীরা হচ্ছে ‘এবা’হতী। আইয়ূব সাবরী পাশা (ইন্তেক্বাল: ১৩০৮ হিজরী/১৮৯০ খৃষ্টাব্দ) যিনি সুলতান আবদুল হামীদ খাঁন ২য়’র শাসনামলে নৌবাহিনীর রিয়ার-এডমিরাল পদে কর্মরত ছিলেন, তিনি তাঁর লিখিত ‘মিরআত আল-হারামাইন’ ও ‘তা’রীখে ওয়াহহা’বিয়্যীন’ শীর্ষক দুটি গ্রন্থে এবং আহমদ জওদাত পাশা নিজের ‘উসমানীয়া তুর্কী ইতিহাস’ শীর্ষক পুস্তকের ৭ম খণ্ডে ওহাবীদের সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করেন। ইমাম ইঊসুফ নাবহানী (رحمة الله)-ও তাঁর আরবী ‘শওয়াহিদুল হক্ব’ (৩য় সংস্করণ, কায়রো, ১৩৮৫ হিজরী/১৯৬৫ খৃষ্টাব্দ) শীর্ষক কিতাবে ওহাবী গোষ্ঠী ও ইবনে তাইমিয়ার সামগ্রিক খণ্ডন করেন। তাঁর বইয়ের পঞ্চাশটি পৃষ্ঠা আরবী ‘উলামা’ আল-মুসলিমীন ওয়া ওয়াহহা’বিয়্যূন’ শিরোনামের পুস্তকে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে (ইস্তাম্বুল, ১৯৭২)।]
আইয়ূব সাবরী পাশা (রাহিমাহ-আল্লাহু তাআলা) বলেন, “আরব উপদ্বীপে ১২০৫ হিজরী/১৭৯১ খৃষ্টাব্দ সালে ওহাবী মতবাদের আবির্ভাব ঘটে এক রক্তাক্ত ও নির্যাতনমূলক বিদ্রোহের মাধ্যমে।” মিসরের আবদুহু ছিলো সেসব লোকের একজন, যে তার বইপত্র দ্বারা গোটা বিশ্বে লা-মাযহাবী/সালাফী মতবাদের প্রচার-প্রসার করার অপপ্রয়াস পায়। (তুরস্কে) ইউনিয়ন ও প্রগ্রেস পার্টির শাসনামলে আবদুহু’র পুস্তকগুলো তুর্কী ভাষায় অনূদিত হয় এবং সেগুলো তরুণ প্রজন্মের সামনে “ইসলামের মহান আলেম, (উদ্ভাবনী) চিন্তাধারায় আলোকিত ব্যক্তিত্ব, বিখ্যাত সংস্কারক আবদুহুর কীর্তি” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অথচ আবদুহু প্রকাশ্যে লিখেছিলো সে জামালউদ্দীন আফগানী (১৩১৪ হিজরী/১৮৯৭ খৃষ্টাব্দ)’কে শ্রদ্ধা করতো; আর এই জামালউদ্দীন আফগানী ছিলো একজন ফ্রীমাসন (Freem❏ son/যিনদিক্ব) ও কায়রোর মাসনিয়্যা গোষ্ঠীর প্রধান। ইসলামের শত্রুরা যারা আহলে সুন্নাতকে অতর্কিত হামলায় বিনাশ সাধন করতে এবং দ্বীন-ইসলামকে চাটুকারিতাপূর্ণ মিথ্যে কথা দ্বারা নির্মূল করতে অপতৎপর ছিলো, তারা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব সেজে এই ফিতনাকে ভেতর থেকে উস্কানি দেয়। আবদুহুর গুণকীর্তন করে তাকে আকাশে তোলা হয়। আহলে সুন্নাতের মহান উলামাদেরকে এবং আ’ইম্মায়ে মাযা’হিব (চার মাযহাবের চারজন ইমাম)’কে মূর্খ বলে ঘোষণা করা হয়। তাঁদের নামের উল্লেখ বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের পূর্বসূরীমণ্ডলীর খাঁটি ও মহৎ উত্তরসূরীবৃন্দ যাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও দ্বীন-ইসলামের খাতিরে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, যাঁরা ছিলেন সম্মানিত শহীদানের আওলাদ, তাঁরা এসব কোটি কোটি পাউন্ড-স্টার্লিং ব্যয়িত অপপ্রচারের মুখে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। ওই সকল ভুয়া ‘ইসলামী নায়ক’দের কথা শুনতে বা তাদেরকে স্বীকার করতে তাঁরা রাজি ছিলেন না। শহীদানের সন্তানদেরকে এই জঘন্য আক্রমণ হতে আল্লাহতায়া'লা রক্ষা করেছেন। আজকে মওদূদী (*ভারত উপমহাদেশে জামাআতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা; ১৩৯৯ হিজরী/১৯৭৯ খৃষ্টাব্দ সালে সে মারা যায়), সাইয়্যেদ ক্বুতুব (*মিসরে ১৩৮৬ হিজরী/১৯৬৬ খৃষ্টাব্দ সালে তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়) ও হামিদউল্লাহ’র মতো লা-মাযহাবী/সালাফীপন্থী লোকদের বইপত্র ভাষান্তর করে তরুণ প্রজন্মের সামনে পেশ করা হচ্ছে। এগুলোতে নিহিত রয়েছে গোমরাহীপূর্ণ ধ্যানধারণা যা আহলে সুন্নাতের উলামাবৃন্দের ব্যক্ত মতাদর্শের খেলাফ; আর এগুলো অত্যধিক স্তুতির মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করা হচ্ছে। তাই আমাদেরকে সর্বদা সতর্ক হতে হবে। আল্লাহতায়া'লা তাঁর প্রিয়তম হাবীব (ﷺ)’র অসীলায় মুসলমানদেরকে অনবধানতা থেকে জাগ্রত করুন! দুশমনদের মিথ্যে ও কুৎসার ধোকায় পড়া হতে তিনি তাদেরকে রক্ষা করুন, আমীন! স্রেফ এবাদত-বন্দেগী পালনের মাধ্যমে আমরা যেনো নিজেদের প্রতারিত না করি! আল্লাহতায়া'লার ‘আল-আদত আল-ইলাহিয়্যা’তথা ঐশী বিধানকে আঁকড়ে না ধরে, অর্থাৎ কোনো মাধ্যম/অসীলা গ্রহণ না করে প্রার্থনা করার মানে হলো মহান প্রভুর কাছ থেকে অলৌকিকত্ব আশা করা। একজন মুসলমানের উচিত কাজ ও প্রার্থনা দুটোই এক সাথে চালিয়ে যাওয়া। প্রথমে মাধ্যমকে আমাদের ধরতে হবে, তারপর প্রার্থনা করতে হবে। অবিশ্বাস/কুফর হতে রক্ষা পেতে হলে প্রথম মাধ্যমটি হলো ইসলাম শিক্ষা করা এবং তা শিক্ষা দেয়া। বস্তুতঃ আহলে সুন্নাতের আক্বীদা-বিশ্বাস, আদেশ ও নিষেধ সম্পর্কে জানা প্রত্যেক নর ও নারী তথা সবার জন্যে ফরয/বাধ্যতামূলক এবং প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
দ্বীন ও আকাঈদ শিক্ষাদানের গুরুত্ব
আহলে সুন্নাতের আক্বীদা-বিশ্বাস ও শিক্ষাসমূহ (’এলম-এ-হা’ল) যারা শেখে না কিংবা তাদের সন্তানদেরকে শেখায় না, ইসলাম ধর্ম হতে বিচ্যুত হয়ে অবিশ্বাসের অতল গহ্বরে পতিত হবার বিপদ তাদের মাথার ওপরে ঝুলছে। এ ধরনের লোকের এবাদত-বন্দেগী গ্রহণযোগ্য নয়। এমতাবস্থায় তারা কীভাবে নিজেদেরকে অবিশ্বাস/কুফর হতে রক্ষা করতে পারবে?
❏ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান:
أيْنَماَ يَوْجِدُ فِيْهِ الاِسْلاَم وَلا يوجدُ الاسلاَم فِيْ مَكَانِ لايوْجِدُ فِيْهِ العِلْمُ
“ইসলাম ধর্ম সেখানেই বিরাজমান, যেখানে জ্ঞান বিদ্যমান। যেখানে জ্ঞানের অস্তিত্ব নেই, সেখানে ইসলামও নেই।” অভুক্ত অবস্থায় মৃত্যুকে এড়াতে যেমন পানাহার করা জরুরি, ঠিক তেমনি কুফফার (অবিশ্বাসী)’দের দ্বারা ধোকা এড়াতে এবং অমুসলিমে পরিণত হওয়া থেকে বাঁচতে আমাদের ধর্ম শিক্ষা করা অতীব প্রয়োজনীয়। আমাদের পূর্বসূরীবৃন্দ ঘনঘন সমবেত হতেন এবং ‘এলম-এ-হাল’ পুস্তকাদি পাঠ করতেন, আর এরই ফলশ্রুতিতে তাঁরা মুসলমানিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হন এবং দ্বীন-ইসলামের স্বাদ আস্বাদন করেন। তাঁরা এই আশীর্বাদময় নূর/জ্যোতি যথাযথভাবে আমাদের কাছে পৌঁছে দেন। অতএব, মুসলমানিত্ব বহাল রাখার জন্যে এবং আমাদের সন্তানদেরকে প্রকাশ্য বা অন্তর্ঘাতী শত্রুদের দ্বারা ধরাশায়ী হওয়া থেকে রক্ষার খাতিরে প্রাথমিক ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হলো আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদদের রচিত ‘এলম-এ-হা’ল’ গ্রন্থাবলী পাঠ করা এবং তা অাত্মস্থ করা। কোনো শিশুর পিতামাতা যদি তাকে মুসলমান হিসেবে তৈরি করতে চান, তাহলে তাঁরা তাকে কোনো শিক্ষকের কাছে দরস/পাঠগ্রহণ করতে পাঠাবেন এবং নিশ্চিত করবেন যেনো শিশুটি ভালোভাবে ক্বুরআন মজীদ তেলাওয়াত করতে পারে। চলুন, আমরা সময়-সুযোগ থাকতে থাকতে অধ্যয়ন ও শিক্ষা করি এবং আমাদের শিশুদের ও দায়িত্বাধীন পোষ্যদেরকেও শিক্ষা দেই। তারা বিদ্যালয়ে যাওয়া আরম্ভ করলে এটা করা তাদের জন্যে কঠিন হবে, এমন কী অসম্ভবও হবে। একবার অধঃপতন হলে বিলাপ করেও তখন লাভ হবে না। আমাদের উচিত নয় ইসলামের শত্রুদেরকে এবং তাদের ধোকাপূর্ণ বইপত্র, খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, টেলিভিশন, রেডিও প্রোগ্রাম ও ছায়াছবিকে বিশ্বাস করা।
❏ ইমাম ইবনে আবেদীন শা’মী (রাহিমাহ-আল্লাহু তাআলা) নিজ ‘রাদ্দুল মোহতার’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে লেখেন:
الزِّنْدِيْقُ هُوَ مَنْ لَمْ يَتَدِّيْنَ بِأَيِّ دِيْنٍ وَيَحَاوَلُ انْ يَصُدَّ المُسْلِمِيْنَ مِنْ الدِّيْنِ الاِسْلاَمِيْ بَالتَظَهُرِ كَمُسْلِمٍ وَ بِشَرْحِ الأَشْيَاءِ المُسَبَبَةِ اِلَيْ الكُفْرِ كَانَّهاَ اشْيَاءِ اسْلاَمية
অন্তর্ঘাতী অবিশ্বাসীরা কোনো ধর্মে বিশ্বাস না করলেও মুসলমান হওয়ার ভান করে এবং এমন সব বিষয় শিক্ষা দেয় যেনো তা ইসলামী, অথচ তা ঈমান-বিনাশী; আর তারা মুসলমানদেরকে ইসলাম হতে খারিজ তথা বিচ্যুত করতে অপতৎপর। এ জাতীয় শত্রুদের বলা হয় ‘যিনদিক্ব।’
মাযহাবের তাক্বলিদ ও বিরোদ্ধবাদীদের খন্ডন
🔴প্রশ্নঃ “গোমরাহ-পথভ্রষ্টদের বইপত্রের অনুবাদ যে ব্যক্তি পড়েছে, সে বলে: ‘আমাদের উচিত ক্বুরআন মজীদের ব্যাখ্যা (তাফসীর) পাঠ করা। আমাদের দ্বীন ও আল-ক্বুরআনকে বোঝার কাজ আলেম-উলামার ওপর ন্যস্ত করা একটি বিপজ্জনক ও ভয়ানক চিন্তা। ক্বুরআনুল করীম এ কথা বলে সম্বোধন করে না – ওহে ধর্মীয় আলেমবর্গ, বরং সম্বোধন করে এই বলে – ওহে মুসলমান সম্প্রদায়, ওহে মানবজাতি। এই কারণে প্রত্যেক মুসলমানের উচিত নিজে নিজে ক্বুরআন উপলব্ধি করা এবং অন্যের ওপর ভরসা না করা।’
“সে সবাইকে তাফসীর ও হাদীস গ্রন্থাবলী পড়তে দেখতে চায়। পক্ষান্তরে, সে ইসলামী বিদ্বান ও আহলে সুন্নাতের মহান জ্ঞান বিশারদদের লেখা কালামশাস্ত্র, ফেক্বাহশাস্ত্র ও ‘এলম-এ-হাল’ পুস্তকাদি পাঠ করতে মানা করে। উপরন্তু, তুর্কী সরকারের ধর্মবিষয়ক কেন্দ্রীয় দপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত (প্রকাশনা নং ১৫৭; ১৩৯৪ হিজরী/১৯৭৪) রশীদ রেযা’র ‘ইসলামদা বিরলিক ভা ফিকহ মাযহাবলারি’ শিরোনামের তুর্কী বইটি পাঠক সমাজে আরো বেশি বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।
বইটির অনেক পৃষ্ঠায়, বিশেষ করে ‘ষষ্ঠ সংলাপে’ লেখা হয়েছে:
رُفِعُوا قَدْرُ الْمُجْتَهِدِيْنَ اِلَيْ مَرْتَبَةِ ألأَنْبِيَاءِ
‘মুক্বাল্লিদবর্গ (চার মাযহাবের কোনোটির অনুসারীবৃন্দ) তাদের মুজতাহিদ ইমামদের এমন প্রশংসা করেছে যে নবুয়্যতের পর্যায়ে তুলেছে। তারা এমন কী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর হাদীসের সাথে ভিন্নমত পোষণকারী কোনো মুজতাহিদের কথাকে ওই হাদীসের ওপরে প্রাধান্য দিয়েছে। তারা বলেছে হাদীসটি হয়তো নাসখ (রহিত), নতুবা তাদের ইমামের দৃষ্টিতে হয়তো অন্য আরেকটি হাদীস রয়েছে। ভুল করতে পারেন এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে নাও জানতে পারেন এমন সব (মুজতাহিদ) ব্যক্তির কথার ওপর আমল/অনুশীলন করে, অধিকন্তু অভ্রান্ত রাসূলে পাক (ﷺ)’এর হাদীস ছেড়ে দিয়ে এসব মুক্বাল্লিদ তাদের মুজতাহিদদের সাথেও ভিন্নমত পোষণ করেছে। তারা এ রকম করে এমন কী আল-ক্বুরআনের সাথেও মতভেদ করেছে। তারা দাবি করে মুজতাহিদ ছাড়া অন্য কেউই আল-ক্বুরঅান বুঝতে সক্ষম নয়। ফক্বীহ ও অন্যান্য মুক্বাল্লিদদের এ ধরনের কথা প্রতীয়মান করে যে তারা এগুলো ইহুদী ও খৃষ্টানদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছে। অপর দিকে, ফেক্বাহবিদদের লেখা বইপত্র উপলব্ধির চেয়ে ক্বুরআন-হাদীস আরো সহজে বোধগদম্য। যারা আরবী শব্দ ও ব্যাকরণ রপ্ত করেছেন, তারা ক্বুরআন-হাদীস বুঝতে মোটেও অসুবিধা বোধ করবেন না। দুনিয়াতে কে অস্বীকার করতে পারে এই বাস্তবতাকে যে আল্লাহতায়া'লা তাঁর ধর্মের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম? আর এই বাস্তবতার প্রতিও বা কে আপত্তি উত্থাপন করতে পারে যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আল্লাহ যা বুঝিয়েছেন তা সবার চেয়ে ভালো বুঝতে সক্ষম ছিলেন এবং অন্যান্যদের চেয়ে ভালোভাবে তা ব্যাখ্যা করতেও সক্ষম ছিলেন? মহানবী (দ;)’র ব্যাখ্যাগুলো মুসলমানদের জন্যে অপর্যাপ্ত বলাটা তিনি যথাযথভাবে তাবলীগ (ধর্ম প্রচার)’এর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন মর্মে দাবি করারই সামিল। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ক্বুরআন-সুন্নাহ উপলব্ধি করতে অক্ষম হতেন, তাহলে আল্লাহতায়া'লা সবাইকে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহ’র বিধান মান্য করার দায়ভার অর্পণ করতেন না। প্রত্যেকের জানা উচিত যে তিনি প্রামাণ্য দলিলাদিসহ বিশ্বাস (ঈমান) স্থাপন করে থাকেন। আল্লাহ পাক তাক্বলীদ (মাযহাবের অনুসরণ)’কে অনুমোদন করেন না এবং তিনি (পাক কালামে) বলেন যে মুকাল্লিদদের দ্বারা তাদের বাপ-দাদাদের অনুসরণের ওজর গ্রাহ্য হবে না। আয়াতসমূহ পরিদৃষ্ট করে যে আল্লাহ পাক কখনোই তাক্বলীদকে অনুমোদন করেন না। ধর্মের ফুরূ (শাখা) অংশকে তার দলিলাদি দ্বারা বোঝাটা ঈমান/উসূল-সংক্রান্ত অংশটি অনুধাবন করা হতেও সহজতর। আল্লাহ কষ্টসাধ্য অংশটির ব্যাপারে দায়িত্ব দেয়ার কালে সহজসাধ্যটির ব্যাপারেও কি দায়িত্ব দেবেন না? কতিপয় বিরল বিষয়ে শরঈ আইনকানুন বের করাটা কঠিন হবে সত্য, তবে সে সময় সেগুলো সম্পর্কে না জানা বা সেগুলোর অনুশীলন না করার পক্ষে তা ওজর হিসেবে বিবেচিত হবে। ফিক্বাহবিদরা নিজেরাই কিছু মাস’আলা বা বিষয় উদ্ভাবন করে নিয়েছেন। তারা সেগুলোর নিয়মও প্রণয়ন করেছেন। এ ধরনের বিষয়াদিকে তারা ‘রায়’, ‘ক্বেয়াসে জলী’ ও ‘ক্বেয়াসে খফী’ নাম দিয়ে নিজেদের জন্যে দলিল হিসেবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন। এগুলোকে এবাদতের অংশের ভেতরে উপচে পড়তে দেয়া হয়েছে, যেখানে যুক্তি-বিবেচনার মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ করা অসম্ভব ব্যাপার। এর ফলে ফেক্বাহবিদরা ধর্মকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অনেক গুণ বড় করেন। তারা মুসলমানদেরকে মসীবতে ফেলেন। আমি ক্বেয়াস’কে অস্বীকার করি না; কিন্তু আমি বলি, এবাদতের ক্ষেত্রে কোনো ক্বেয়াস নেই। ঈমান ও এবাদত মহানবী (ﷺ)’র যুগেই পূর্ণতা পেয়েছে। তাতে আর কেউই নতুন কিছু যোগ করতে পারবেন না। মুজতাহিদ ইমামবর্গ সর্বসাধারণকে তাক্বলীদ (অনুসরণ/অনুকরণ) মানতে নিষেধ করেছেন এবং এর (মানে তাক্বলীদের) ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।’
“ওপরের এই উদ্ধৃতিটি, যা (তুরস্কের) ধর্মবিষয়ক কেন্দ্রীয় দপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত বই হতে নেয়া হয়েছে, তা অন্যান্য সকল লা-মাযহাবী বইয়ের মতোই চার মাযহাবের ইমামমণ্ডলীর অনুসরণকে নিষেধ করে। এটা এ মর্মে আদেশ দেয় যে সবারই ক্বুরআনের তাফসীর ও হাদীস শিক্ষা করা উচিত। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?”
🖋উত্তরঃ লা-মাযহাবী/সালাফী ব্যক্তিটির (রশীদ রেযা’র) ওপরের উদ্ধৃতিটুকু মনোযোগসহ পড়লে যে কেউ দেখতে পাবেন যে গোমরাহ-পথভ্রষ্ট এই চক্র নিজেদের ভ্রান্ত চিন্তা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে নড়বড়ে যুক্তি ও মিথ্যে বক্তব্য দ্বারা সাজিয়ে মুসলমান সমাজকে ধোকা দিতে অপতৎপর। গণ্ডমূর্খ লোকেরা হয়তো এসব লেখনীকে জ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক ধারণা করে এগুলোর ধোকায় পড়ে যেতে পারে, কিন্তু জ্ঞানী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ লা-মাযহাবীদের এই ফাঁদে কখনো পা দেবেন না।
লা-মাযহাবী/সালাফী তথা সুন্নী-বিরোধীচক্রের বিপদ, যেটা মুসলমানদেরকে পরকালীন শাস্তির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সেটা সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে ইসলামী উলামাবৃন্দ গত চৌদ্দ শ বছর যাবৎ সহস্র সহস্র মূল্যবান বই লিখেছেন। ওপরের প্রশ্নের উত্তরে নিচে
❏ ইমাম ইঊসুফ নাবহানী (رحمة الله) প্রণীত ‘হুজ্জাত -আল্লাহি ‘আলাল-’আলামীন’ শীর্ষক পুস্তক হতে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা হলো:
واَلْحَاصِلُ اَنَّ أَئِمَّةَ الاُمَةُ لَماَ كَانُوْ لاَ قُدْرَةَ لَهُمْ عَلَيْ اسْتِنْبَاطِ جَمِيْعِ الْاَحْكَامِ مِنَ كِتَابِ اللهِ تَعَالَيْ شَرَّحَهُ رَسُوْلُ اللهُ صَلّيَ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَفِيِ الحَقِيْقَةِ هِيَ مِنَ اللهِ الغ
“ক্বুরআনুল করীম হতে সবাই আহকাম (আইনকানুন, সিদ্ধান্ত) বের করার যোগ্যতাসম্পন্ন নয়। যেহেতু এমন কী মুজতাহিদ ইমাম-মণ্ডলীও ক্বুরআনুল করীমে বিরাজমান সমস্ত বিধান হতে আইনকানুন বের করতে সক্ষম হবেন না, সেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর হাদীসগুলোতে আল-কুরআনে বিদ্যমান বিধানগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। যেহেতু ক্বুরআন মজীদ শুধুমাত্র তিনি-ই ব্যাখ্যা করেছেন, সেহেতু ওই হাদীসগুলো স্রেফ সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) ও মুজতাহিদ ইমামবৃন্দ (رحمة الله)-ই বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম ছিলেন। ইমামবৃন্দ (رحمة الله) যাতে এগুলো বুঝতে সক্ষম হন, সে জন্যে আল্লাহতায়া'লা তাঁদেরকে পার্থিব ও ধর্মীয় জ্ঞান, তীক্ষ্ণ উপলব্ধি ও দৃষ্টিশক্তি, অসাধারণ ধীশক্তি এবং আরো অনেক উন্নত বৈশিষ্ট্য দান করেন। এসব গুণের সর্বাগ্রে ছিলো তাক্বওয়া (খোদাভীরুতা/পরহেযগারী)। এরপর ছিলো তাঁদের অন্তরে অবস্থিত খোদায়ী নূর/ঐশী জ্যোতি। এসব অনন্য বৈশিষ্ট্যের সহায়তায় আমাদের মুজতাহিদ ইমাম-মণ্ডলী (رحمة الله) বুঝতে পারেন আল্লাহতায়া'লা ও তাঁর রাসূল (ﷺ) তাঁদের বাণীতে কী বোঝাতে চেয়েছেন; আর যেগুলো তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেননি, সেগুলোর (সমাধান) ক্বেয়াস দ্বারা প্রদর্শন করেছেন। চারজন আয়েম্মাত আল-মুজতাহিদের (অর্থাৎ, মুজতাহিদ ইমাম-মণ্ডলীর) প্রত্যেকেই জানিয়েছেন যে তাঁরা তাঁদের নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি; আর তাঁরা তাঁদের শিষ্যদের বলেছিলেন, ‘তোমরা যদি কোনো সহীহ হাদীস পাও, তাহলে আমার সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর হাদীসের অনুসরণ কোরো!’ চার মাযহাবের ইমামবৃন্দ (رحمة الله) যাঁদের প্রতি এ নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁরাও তাঁদেরই মতো গভীর জ্ঞানী মুজতাহিদ আলেম ছিলেন। এই সমস্ত আলেম ছিলেন মুজতাহিদ তারজীহ (পার্থক্য করার যোগ্যতাসম্পন্ন মুজতাহিদ), যাঁরা চার মাযহাবের দলিলাদি সম্পর্কে জানতেন। তাঁরা দলিলগুলো এবং সেসব হাদীসের বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে অধ্যয়ন করতেন, যে হাদীসের ওপর ভিত্তি করে মাযহাবের ইমাম সাহেব (رحمة الله) তাঁর এজতেহাদ প্রয়োগ করেছেন; আর (এর বিপরীতে) নতুন মোকাবেলাকৃত সহীহ হাদীসও তাঁরা দেখতেন এবং পরীক্ষা করতেন কোনটি পরবর্তীকালে বর্ণিত হয়েছে; এছাড়াও তাঁরা অন্যান্য অনেক শর্ত পরীক্ষা করতেন, যার ফলশ্রুতিতে তাঁরা বুঝতে পারতেন কোনটি বেছে নিতে হবে (তারজীহ)। অথবা, মুজতাহিদ ইমাম (আল-মাযহাব) কোনো মাস’আলা তথা বিষয়ের সমাধান দিতেন ক্বেয়াসের (মানে গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তের) মাধ্যমে, কেননা তিনি এর প্রামাণ্য হাদীসটি সম্পর্কে জানতেন না; তবে তাঁর শিষ্যবৃন্দ ওই হাদীসটি খুঁজে পেয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু এ ধরনের এজতেহাদ প্রয়োগের সময় শিষ্য (কখনোই) মাযহাবের ইমামের (رحمة الله) উসূল/নিয়মকানুনের আওতাধীন সীমারেখার বাইরে যেতেন না। যেসব মুজতাহিদ মুফতী তাঁদের উত্তরসূরী ছিলেন, তাঁরাও এ পদ্ধতিতে ফতোয়া দেন। এখানে যা লেখা হয়েছে তা হতে বোঝা যায়, চারজন আয়েম্মাত আল-মাযাহিব ও তাঁদের মাযহাবগুলোতে প্রশিক্ষিত মুজতাহিদ-মণ্ডলীকে যে মুসলমানবৃন্দ অনুসরণ করেছেন, তাঁরা প্রকৃতপ্রস্তাবে আল্লাহতা’আলা ও তাঁর রাসূল (ﷺ)’এর বিধিবিধানকেই মান্য করেছেন। এই মুজতাহিদবৃন্দ আল-ক্বুরআন ও হাদীস শরীফে বিদ্যমান বিধানগুলো অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, যা অন্য কেউই বুঝতে পারেনি; আর তাঁরা এ থেকে যা উপলব্ধি করেছিলেন, তা (আমাদের কাছে) ব্যক্ত করেছিলেন। মুজতাহিদবৃন্দ (رحمة الله) নস্ তথা শরঈ দলিল (ক্বুরআন মজীদ ও সুন্নাহ) হতে যা বুঝেছেন ও জ্ঞাত করেছেন, মুসলমানবৃন্দ সে অনুযায়ী আমল/অনুশীলন করেছেন। কেননা আল্লাহতায়া'লা সূরা নাহল ৪৩ আয়াতে ঘোষণা করেন: فاسألوا اهل الذكر إن كنتم لا تعلمون “তোমরা না জানলে জ্ঞানীদের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে শেখো।” {আল্লামা হুসাইন হিলমী (رحمة الله)’র নোট: এই আয়াতটি পরিস্ফুট করে যে সবাই ক্বুরআন ও সুন্নাহ’কে নির্ভুলভাবে বুঝতে সক্ষম নয়। উপলব্ধি করতে অক্ষম ব্যক্তিদের প্রতি আয়াতটি আদেশ করে যেনো তারা ব্যক্তিগতভাবে ক্বুরঅান-হাদীস উপলব্ধি করতে চেষ্টা না করে, বরঞ্চ যাঁরা তা বুঝেছেন তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করে শিক্ষা করে। যদি সবাই ক্বুরঅান-হাদীসের অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হতো, তাহলে বাহাত্তরটি ভ্রান্ত ফেরকাহ/দলের আবির্ভাব ঘটতো না। এসব দলের প্রবর্তন যারা করেছিলো তারা বেশ শিক্ষিত ছিলো, কিন্তু তাদের কেউই ক্বুরআন-হাদীস সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিলো না। এগুলোকে ভুলভাবে বুঝে তারা সঠিক পথ হতে বিচ্যুত হয়েছিলো; আর অনেক মুসলমানকেও তারা গোমরাহীর দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো। এদের মধ্যে কেউ কেউ ক্বুরআন-হাদীসের এমন ভুল অর্থারোপ করেছে যে তারা সীমা লঙ্ঘন করে সঠিক পথের অনুসারী মুসলমানদেরকে ‘কাফের’/অবিশ্বাসী ও ‘মুশরিক’/মূর্তিপূজারী আখ্যা দেয়ার মতো গোমরাহীতে পতিত হয়েছে। তুর্কী ভাষায় অনূদিত ‘কাশফুশ শুবহাত’ পুস্তিকা যেটা গোপনে তুরস্কে প্রবেশ করেছে, সেটাতে বিবৃত হয়েছে যে আহলে সুন্নাতের আক্বীদা-বিশ্বাস ধারণকারী মুসলমানদের জান ও মালামাল হরণ করা মোবাহ/বৈধ। বঙ্গানুবাদকের নোট: ’কাশফুশ শুবহাত’ পুস্তিকাটির এতদসংক্রান্ত ভ্রান্ত আক্বীদার খণ্ডন বিধৃত হয়েছে আমার রচিত ‘ওহাবীদের সংশয় নিরসন’ পুস্তিকায় যা প্রকাশিতব্য}
তাক্বলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
“আল্লাহতায়া'লা তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)’র উম্মতের মাঝেই কেবল এই নেআমত তথা আশীর্বাদপূর্ণ সৌভাগ্য নসীব করেছেন যে আ’ইম্মায়ে মাযা’হিব (চারজন মাযহাবের ইমাম) এজতেহাদ প্রয়োগ করতে পেরেছেন এবং নিজেদের মাযহাবও প্রতিষ্ঠা করেছেন, আর সমগ্র মুসলমান সম্প্রদায় এসব মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। আল্লাহ পাক এক দিকে এ’তেক্বাদ-বিষয়ক শাস্ত্রের ইমামবৃন্দকে সৃষ্টি করেছেন এবং গোমরাহ/পথভ্রষ্ট, যিনদিক্ব, মুলহিদ ও শয়তান প্রকৃতির লোকদের দ্বারা এ’তেক্বাদ (আক্বীদা-বিশ্বাস)’কে কলুষিত হওয়া থেকে হেফাযত করেছেন, অপর দিকে তাঁর ধর্মের কলুষিত হওয়া রোধ করতে (চার) মাযহাবের ইমামবৃন্দকে (رحمة الله) তিনি সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু এই আশীর্বাদ খৃষ্ট ও ইহুদী ধর্মগুলোতে অস্তিত্বশীল ছিলো না, সেহেতু তাদের ধর্মগুলো বিকৃত হয় এবং খেলার বস্তুতে পরিণত হয়।
“ইসলামী উলামাবৃন্দের সর্বসম্মতি অনুসারে, রাসূলে খোদা (ﷺ)’র বেসাল শরীফ তথা পরলোকে খোদার সাথে মিলনপ্রাপ্তির চার শ বছর পর এজতেহাদ প্রয়োগ করার মতো সামর্থ্যবান আর কোনো গভীর জ্ঞানী আলেম পয়দা হননি।
ইজতিহাদ এর যোগ্য কারা?
যে ব্যক্তি দাবি করে এখনো এজতেহাদ প্রয়োগ করা জরুরি, সে নিশ্চয় পাগল, অথবা ধর্মের ব্যাপারে অজ্ঞ।
▶মহান ইমাম জালা’লউদ্দীন সৈয়ূতী (বেসাল: ৯১১ হিজরী/১৫০৫ খৃষ্টাব্দ, মিসর) যখন দাবি করেন তিনি এজতেহাদের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন, তখন অন্যান্য সমসাময়িক আলেম-উলামা তাঁকে এমন একটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেন যেটার বেলায় দুইটি পৃথক উত্তর (ইতিপূর্বে) দেয়া হয়েছিলো, আর তাঁরা ইমাম সৈয়ূতী (رحمة الله)’র কাছে জানতে চান কোন্ উত্তরটি অধিকতর নির্ভরযোগ্য। তিনি তাঁদের সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন এর উত্তর দেয়ার মতো সময় তাঁর হাতে নেই, কেননা তিনি ভীষণ ব্যস্ত। অথচ তাঁকে বলা হয়েছিলো একটি ফতোয়ার ক্ষেত্রে এজতেহাদ প্রয়োগ করতে, যে কাজটা এজতেহাদের সর্বনিম্ন পর্যায়ের। ইমাম সৈয়ূতী (رحمة الله)’র মতো গভীর জ্ঞানী আলেমকে ফতোয়ার ক্ষেত্রে এজতেহাদ প্রয়োগ এড়িয়ে যেতে দেখে আমরা ওই সব লোককে কী বলে ডাকবো – যদি না তাদেরকে আমরা উন্মাদ বা আত্মিকভাবে মূর্খ বলে ডাকি – যারা মুতলাক্ব (স্বয়ংসম্পূর্ণ) এজতেহাদ প্রয়োগ করতে মানুষের ওপর চাপ প্রয়োগ করে থাকে?
▶ ইমাম গাযযালী (বেসাল: ৫০৫ হিজরী/১১১১ খৃষ্টাব্দ, তুস নগরী) তাঁর ‘এহইয়া’-এ-উলূম আল-দ্বীন’ পুস্তকে বর্ণনা করেন যে,
امَا مَنْ لَيْسَ لَهُ رُتْبَةُ الاِجْتِهَادِ
তাঁর সময়ে কোনো (মুতলাক্ব) মুজতাহিদ ছিলেন না।
“কোনো অ-মুজতাহিদ মুসলমান যদি একটি সহীহ হাদীস সম্পর্কে জানতে পারেন এবং যদি (কোনো মাসআলায়) হাদীসটির সাথে মতভেদকারী তাঁর নিজ মাযহাবের ইমাম সাহেবের প্রয়োগকৃত এজতেহাদ অনুযায়ী অনুশীলন করা তাঁর জন্যে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তিনি চার মাযহাবের কোনোটির অন্তর্ভুক্ত এমন আরেকজন মুজতাহিদকে খুঁজে বের করতে পারেন যাঁর এজতেহাদ ওই হাদীসটির ওপর ভিত্তিশীল, আর তখন ওই বিষয়টি তিনি সেই মুজতাহিদের মাযহাব অনুযায়ী পালন করতে পারেন।
▶মহান ইমাম নববী (বেসাল: ৬৭৬ হিজরী/১২৭৭ খৃষ্টাব্দ, দামেশক) তাঁর প্রণীত ‘রওদাত আত্ তালেবীন’ গ্রন্থে এই বিষয়টি বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। কেননা যারা এজতেহাদের পর্যায়ে উন্নীত হয়নি, তাদের জন্যে নস তথা ক্বুরআন-সুন্নাহ হতে (শরঈ) বিধিবিধান বের করার কোনো অনুমতি-ই নেই।
বর্তমানে কিছু গণ্ডমূর্খ লোক দাবি করে তারা মুতলাক্ব এজতেহাদের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে; আর তারা নস হতে আইনকানুন বের করতেও সক্ষম; অধিকন্তু চার মাযহাবের কোনোটির অনুসরণ তাদের আর এখন প্রয়োজন নেই। অতঃপর তারা বহু বছর ধরে তাদেরই অনুসৃত মাযহাবের অনুসরণকে পরিহার করে। তাদের অনির্ভরযোগ্য চিন্তাধারার সাহায্যে তারা মাযহাবগুলোকে খণ্ডন করার অপচেষ্টাও চালায়। তারা এই আহাম্মকীপূর্ণ দাবি উত্থাপন করে, ‘আমরা এমন আলেমের মতামত অনুসরণ করবো না যিনি ছিলেন আমাদের মতোই অজ্ঞ।’ শয়তানের দ্বারা ধোকাপ্রাপ্ত হয়ে এবং নফসের উস্কানি পেযে তারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ দাবি করে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না এ কথা দাবি করে তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে না, বরং নিজেদের বেয়াকুফি ও অপকীর্তি-ই প্রকাশ করে। এদের মধ্যে আমরা সেসব গোমরাহ মূর্খ লোককেও দেখতে পাই যারা বলে ও লিখে যে প্রত্যেকের উচিত তাফসীর বইপত্র ও সহীহ বুখারী হাদীসগ্রন্থ হতে আইনকানুন বের করা। হে আমার মুসলিম ভাইয়েরা, এ ধরনের আহাম্মকদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন সম্পূর্ণভাবে পরিহার করুন, আর তাদেরকে আলেম-এ-দ্বীন মনে করাও বাদ দিন! বরঞ্চ আপনাদের ইমামের মাযহাবকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরুন! চার মাযহাবের যে কোনোটি বেছে নেয়ার ব্যাপারে আপনারা স্বাধীন। কিন্তু মাযহাবগুলোর রুখসাত তথা সহজ পদ্ধতিগুলো জড়ো করে তালফীক্ব বা মাযহাবগুলোর একীভবন/একত্রে মিশ্রণ জায়েয নেই। {নোট: তালফীক্ব অর্থ ’কোনো আমল পালনের সময় মাযহাবগুলোর সহজ পদ্ধতিগুলো এমনভাবে একত্রে মিশ্রণ করা যা চার মাযহাবের কোনোটির সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’ চার মাযহাবের কোনো একটির পদ্ধতি অনুসারে কোনো আমল/অনুশীলনী কেউ পালন করার পর, অর্থাৎ, সেই মাযহাবে তাঁর পালিত আমল সহীহ (সঠিক, বৈধ) হওয়ার পর এতদসংক্রান্ত আমলের সহীহ হবার জন্যে অন্য তিন মাযহাবে আরোপিত শর্তাবলী যথাসম্ভব অতিরিক্ত হিসেবে পালন করার মানসে তিনি তা অনুশীলন করলে এটাকে বলা হয় ‘তাক্বওয়া’ (পরহেযগারী); এটা পুরস্কারের যোগ্য।}
“যে মুসলমান ব্যক্তি হাদীসশাস্ত্র পাঠ করে তা ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম, তাঁর উচিত নিজের অনুসৃত মাযহাবের দলিলস্বরূপ বিদ্যমান হাদীসগুলো শিক্ষা করা; অতঃপর তাঁর উচিত ওই আহাদীসে প্রশংসিত (পুণ্যদায়ক) কাজগুলো পালন করা ও নিষিদ্ধ কাজগুলো পরিহার করা; এরপর জ্ঞানার্জন করা দ্বীন-ইসলামের মাহাত্ম্য ও মূল্য সম্পর্কে; আল্লাহতায়া'লা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নামসমূহ ও গুণাবলীর পূর্ণতা/শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে; মহানবী (ﷺ)’র জীবন, তাঁর (সত্তাগত) উন্নত বৈশিষ্ট্যাবলী ও মো’জেযা/অলৌকিকত্ব সম্পর্কে; ইহ-জগৎ ও পরলোকের বিষয়াদি ও সুবিন্যস্ততা সম্পর্কে; আর পুনরুত্থান, (শেষ) বিচার, বেহেস্ত ও দোযখ, ফেরেশতা ও জ্বিন, পূর্ববর্তী (আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামের) উম্মতবর্গ, পয়গম্বরবৃন্দ (عليه السلام) ও তাঁদের আসমানী কেতাবসমূহ, রাসূলে পাক (ﷺ) ও ক্বুরআন মজীদের সুনির্দিষ্ট (খাস) শ্রেষ্ঠত্বসমূহ, আহলে বায়তে নববী (رضي الله عنه) ও আসহাবে কেরাম (رضي الله عنه)’এর জীবন, প্রলয় দিবসের আলামতগুলো এবং এই জগৎ ও পরবর্তী জগতের অন্যান্য তথ্যাদি সম্পর্কেও। এই দুনিয়া ও আখেরাত সম্পর্কে সমস্ত তথ্য সংকলিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর আহাদীস পাকে।
“আমরা এখানে যা লিপিবদ্ধ করেছি তা বোধগম্য হলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় ওইসব লোক কতোখানি মূর্খ, যারা বলে হাদীস শরীফ হতে বের করা নয় এমন ইসলামী বিধিবিধান অর্থহীন বা অকার্যকর। হাদীসগুলোতে প্রদত্ত অসংখ্য তথ্যের মধ্যে এবাদত-বন্দেগী ও মু’আমালা’ত শিক্ষাদানকারী হাদীসের সংখ্যা খুবই অল্প/নগণ্য। কতিপয় আলেমের মতানুসারে, এগুলো (মাত্র) পাঁচ শ (পুনরাবৃত্তি হয়েছে এমন হাদীস পরিগণিত হলে এই সংখ্যা তিন সহস্রের বেশি নয়)। এতো কম সংখ্যক হাদীসের মধ্যে চার মাযহাবের ইমামবৃন্দের কেউ একজন একটি সহীহ হাদীস হয়তো শোনেননি, এমনটি মোটেও ধারণাযোগ্য নয়। প্রতিটি সহীহ হাদীসকেই চার আ’ইম্মায়ে মাযা’হিবের অন্ততঃ একজন হলেও দলিল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যে মুসলমান ব্যক্তি নিজের অনুসৃত মাযহাবের কিছু বিষয়কে কোনো সহীহ হাদীসের সাথে অসুবিধাজনক হিসেবে দেখতে পান, তাঁর উচিত ওই বিষয়টি এমন আরেকটি মাযহাবকে অনুসরণ করে সমাধা করা, যেটার এজতেহাদ (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত/রায়) ওই হাদীসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। হয়তো তাঁর মাযহাবের ইমাম সাহেবও হাদীসটি শুনেছেন, তবে অন্য কোনো হাদীস যেটাকে তিনি আরো সহীহ হিসেবে পেয়েছেন বা জেনেছেন, অথবা সেটা (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কর্তৃক বিবৃত) পরবর্তীকালের হাদীস যেটা পূর্ববর্তী হাদীসকে রহিত করেছে (বলে তাঁর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে), কিংবা মুজতাহিদবৃন্দের জ্ঞাত অন্যান্য কারণে তিনি পূর্ববর্তী ওই হাদীসটিকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেননি। পূর্ববর্তী হাদীসটি যে সহীহ, তা উপলব্ধিকারী মুসলমানের জন্যে হাদীসটির সাথে অসুবিধাজনক নিজের মাযহাবের এজতেহাদকে ত্যাগ করে ওই হাদীসটি অনুসরণ করা উত্তম, তবে এক্ষেত্রে তাঁকে অন্য আরেকটি মাযহাবের এজতেহাদের অনুসরণ করতে হবে যেটা ওই হাদীসের ওপর ভিত্তিশীল। কেননা ওই দ্বিতীয় মাযহাবটির ইমাম সাহেব অাহকাম তথা বিধিবিধানের দলিলগুলো, যা সম্পর্কে মুসলমান ব্যক্তিটির জানা নেই, তা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকেফহাল হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে ওই হাদীসের ওপর ভিত্তি করে আমল করার বেলায় কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা নেই। তথাপি ওই মুসলমানের জন্যে নিজের মাযহাবের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিষয়টি সমাধা করারও অনুমতি রয়েছে; কেননা তাঁর নিজের মাযহাবের ইমাম সাহেবও তাঁর এজতেহাদ প্রয়োগের সময় মজবুত দলিলের ওপর নির্ভর করেছেন। কোনো মুক্বাল্লিদের জন্যে ওই দলিল না জানার ওজরকে ইসলাম ধর্ম অনুমতি দেয়। এটা এ কারণে যে চার মাযহাবের কোনো ইমামই এজতেহাদের ক্ষেত্রে ক্বুরআন-সুন্নাহকে ছাড়িয়ে যাননি। তাঁদের মাযহাবগুলো হলো আল-ক্বুরআন ও সুন্নাহরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। তাঁরা ক্বুরআন-সুন্নাহতে অন্তর্নিহিত অর্থ ও বিধিবিধান মুসলমান সমাজের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন এমনভাবে যাতে মুসলমানবৃন্দ তা সহজে বুঝতে পারেন; আর এই লক্ষ্যে তাঁরা সেগুলো বইপত্রে লিপিবদ্ধ করেছেন। আ’ইম্মায়ে মাযা’হিব (রহমতুল্লাহে আলাইহিম)’এর এই অবদানটি ইসলামের এতো বড় খেদমত ছিলো যে আল্লাহর সাহায্য ছাড়া মানবের সামর্থ্যে এটা কোনোক্রমেই কুলোতো না। এসব মাযহাবের অস্তিত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে এ বাস্তবতাকেই প্রমাণ করে যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হচ্ছেন (আল্লাহর) প্রকৃত পয়গম্বর এবং দ্বীন-ইসলাম তাঁরই সত্য ধর্ম।
“আমাদের আ’ইম্মাত আল-মাযা’হিবের (চার মাযহাবের চারজন ইমামের) এজতেহাদী মতপার্থক্য ছিলো কেবল ফুরূ’ আদ-দ্বীন (ধর্মের আনুষঙ্গিক) বিষয়াদির ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, তা ছিলো ফেক্বাহ-সংক্রান্ত মতােনৈক্য। কিন্তু উসূলে দ্বীন তথা ঈমান-আক্বীদা সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে কোনো মতভেদ ছিলো না। অধিকন্তু, তাঁদের মধ্যে মতান্তর ছিলো না সেসব ফুরূ’-বিষয়ক শিক্ষার বেলায়ও, যেগুলো ছিলো ধর্মের আবশ্যকীয় অংশ এবং যেগুলো তাওয়াতুর/সর্বজনজ্ঞাত প্রামাণিক আহাদীস দ্বারা ছিলো সমর্থিত। ফুরূ’ আদ-দ্বীন সংক্রান্ত কিছু কিছু জ্ঞানের শাখা নিয়েই শুধু তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিলো। এসব বিষয়ে দালিলিক প্রমাণাদির নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে তাঁদের উপলব্ধির পার্থক্য হতেই এর সূত্রপাত হয়েছিলো। আর তাঁদের মধ্যে এই সামান্য মতপার্থক্য হচ্ছে উম্মতের প্রতি (আল্লাহতায়া'লার) রহমত-বিশেষ; মুসলমানবৃন্দ যে মাযহাব পছন্দ করেন এবং তাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তা-ই অনুসরণ করার অনুমতি (জায়েয) তাঁদের রয়েছে। রাসূলে খোদা (ﷺ) এই মতপার্থক্যের খোশ-খবরী দিয়েছিলেন, আর তিনি যেভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ঠিক সেভাবেই ঘটেছে।
“এ’তেক্বাদ-সংক্রান্ত জ্ঞান তথা যেসব বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, সেগুলোর ব্যাপারে এজতেহাদ প্রয়োগের কোনো অনুমতি নেই। এ রকম করা হলে বিচ্যুতি ও গোমরাহী দেখা দেবে, যা মহাপাপ। এ’তেক্বাদের ক্ষেত্রে শুধু একটাই সঠিক পথ বিদ্যমান আর তা হলো ‘আহল আস্ সুন্নাত ওয়াল-জামাআত।’ (আল্লাহতায়া'লার) রহমত হিসেবে যে মতপার্থক্যকে হাদীস শরীফে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা ফুরূ’ বা আহকাম-সংক্রান্ত পার্থক্য।
“চার মাযহাবের সিদ্ধান্তসমূহ কোনো বিষয়ে বিভিন্ন হলে স্রেফ একটি রায়-ই সঠিক
“চার মাযহাবের সিদ্ধান্তসমূহ কোনো বিষয়ে বিভিন্ন হলে স্রেফ একটি রায়-ই সঠিক। যাঁরা সঠিক পদ্ধতিতে সেই আমল/অনুশীলনী পালন করবেন, তাঁরা পাবেন দুটি সওয়াব/পুরস্কার; আর যাঁরা ভুল সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমল করবেন, তাঁদেরকে দেয়া হবে একটি সওয়াব। মাযহাবগুলো যে রহমত-স্বরূপ তা পরিদৃষ্ট হয় এই বাস্তবতা দ্বারা যে এক মাযহাব ছেড়ে আরেকটি মাযহাবের অনুসরণ জায়েয/অনুমতিপ্রাপ্ত সাব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত এই চার মাযহাব ছাড়া অন্য মাযহাব অনুসরণের কোনো অনুমতি-ই নেই; এমন কী সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)’এর মাযহাবও নয়, যেহেতু তাঁদের মাযহাবগুলো লিপিবদ্ধ আকারে আসেনি এবং এরই ফলশ্রুতিতে বিস্মৃত হয়েছে। জ্ঞাত এই চার মাযহাব ছাড়া অন্য কোনো মাযহাব অনুসরণের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
❏ ইমাম আবূ বকর আহমদ রা’যী (বেসাল: ৩৭০ হিজরী/৯৮০ খৃষ্টাব্দ)-ও বর্ণনা করেছেন যে,
اِجْماَعُ الْمُحَقِّيْقِّنَ عَلَيْ مَنْعِ الْعَوَامِ مِنْ تَقْلِيْدِ اَعْيَانِ الصَحَابَةِ وَاكَابِرُهُمْ نَعَمْ يَجُوْزُ عَامِيِ مِنَ الفُقَهَاءِ تَقْلِيدُ غَيْرَ الاَرْبَعَةِ فِيْ العَمَلِ لِنَفْسِهِ
ইসলামী উলামা-মণ্ডলী সর্বসম্মতভাবে জানিয়েছেন (সরাসরি) সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)’কে অনুসরণ (করার চেষ্টা করা) জায়েয নেই। মাযহাবগুলোর ও মুজতাহিদবৃন্দের শ্রেষ্ঠত্ব, বিশেষ করে মাযহাবগুলোর ক্বুরআন-সুন্নাহকে ছাড়িয়ে না যাওয়ার এবং এজমা’ ও ক্বেয়াসের মাধ্যমে বের করা বিধিবিধানগুলো নিজেদের মনগড়া না হয়ে ক্বুরআন-সুন্নাহ হতে নিঃসৃত সিদ্ধান্ত হওয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে যাঁরা বুঝতে চান, তাঁদের প্রতি আমি পরামর্শ দেই ইমাম আবদুল ওয়াহহাব শারানী (رحمة الله)’র প্রণীত ‘আল-মীযা’ন আল-কুবরা’য়া’ ও ‘আল-মীযা’ন আল-খিদরিয়্যা’ গ্রন্থ দুটো পড়তে। {ইঊসুফ নাবহানী কৃত ‘হুজ্জাত-আল্লাহি ‘আলাল-’আলামীন’, ৭৭১ পৃষ্ঠা; মূল আরবী বই হতে অনূদিত ওপরের উদ্ধৃতিটিতে অনুবাদকের কোনো কথা যুক্ত হয়নি; আমাদের অন্যান্য বইযের মতো অনুবাদকের সংযোজনীগুলো এখানেও ব্র্যাকেটের মধ্যে রাখা হয়েছে, যাতে অনূদিত অংশের ব্যাপারে বিভ্রান্তি দেখা না দেয়। মূল আরবী ‘হুজ্জাত-আল্লাহি আলাল-আলামীন’ বইটি ইস্তাম্বুল হতে অফসেটে পুনর্মুদ্রিত হয় ১৩৯৪ হিজরী/১৯৭৪ সালে}
এ কথা বলা সঠিক নয় – ‘উলামায়ে দ্বীনের ব্যাপারে ক্বুরআনুল করীমে (সম্বোধনসূচক) কোনো উল্লেখ নেই।’ বহু আয়াতে পাকে ইসলামী উলামা ও এলম/জ্ঞানের প্রশংসা করা হয়েছে। ইমাম আবদুল গনী নাবলুসী (বেসাল: ১১৪৩ হিজরী/১৭৩১ খৃষ্টাব্দ) তাঁর ‘আল-হাদীক্বা’ পুস্তকে লেখেন:
❏ “সূরা আম্বিয়া’র ৭ম আয়াতে এরশাদ হয়েছে –
فَاسْئَلُوۤاْ أَهْلَ ٱلذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ
‘তোমরা না জানলে জ্ঞানীদের কাছে জিজ্ঞেস করে শেখো।’ এ আয়াতোক্ত ‘যিকর’ অর্থ ’জ্ঞান।’ যারা স্বল্প জ্ঞানী তাদেরকে আয়াতটি উলামাদের শরণাপন্ন হয়ে তাঁদের কাছ থেকে বিদ্যা শিক্ষা করার আদেশ দেয়।’
❏ সূরা আলে ইমরানের সপ্তম আয়াতে ঘোষিত হয়েছে –
هُوَ ٱلَّذِيۤ أَنزَلَ عَلَيْكَ ٱلْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ ٱلْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ في قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ٱبْتِغَاءَ ٱلْفِتْنَةِ وَٱبْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلاَّ ٱللَّهُ وَٱلرَّاسِخُونَ فِي ٱلْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلاَّ أُوْلُواْ ٱلأَلْبَابِ
অর্থাৎ, ‘দ্ব্যর্থবোধক আয়াতগুলো কেবল জ্ঞানী (ঈমানদার) ব্যক্তিবর্গ-ই জানে।’
❏ একই সূরার ১৮ আয়াতে এরশাদ হয়েছে –
شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُ لاَ إِلَـٰهَ إِلاَّ هُوَ وَٱلْمَلاَئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلْعِلْمِ قَآئِمَاً بِٱلْقِسْطِ لاَ إِلَـٰهَ إِلاَّ هُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ
অর্থাৎ, ‘আল্লাহ সাক্ষ্য প্রদান করেছেন যে তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই আর ফেরেশতাবর্গ ও জ্ঞানীবৃন্দ-ও ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া অন্য কারো এবাদত নেই, (তিনি) মহা মর্যাদাবান, প্রজ্ঞাময়।’
❏ সূরা ক্বাসাসের ৮১ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে –
وَقَالَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ ٱللَّهِ خَيْرٌ لِّمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحاً وَلاَ يُلَقَّاهَآ إِلاَّ ٱلصَّابِرُونَ
অর্থাৎ, ‘এবং বল্লো ওইসব লোক, যাদেরকে জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে: তোমাদের ধ্বংস সাধন হোক! আল্লাহর পুরস্কার উত্তম ওই ব্যক্তির জন্যে, যে ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করে; আর এটা তারাই পায় যারা ধৈর্যশীল।’
❏ সূরা রূমের ৫৬ আয়াতে এরশাদ হয়েছে –
وَقَالَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ وَٱلإِيمَانَ لَقَدْ لَبِثْتُمْ فِي كِتَابِ ٱللَّهِ إِلَىٰ يَوْمِ ٱلْبَعْثِ فَهَـٰذَا يَوْمُ ٱلْبَعْثِ وَلَـٰكِنَّكُمْ كُنتمْ لاَ تَعْلَمُونَ
অর্থ: ‘এবং বল্লো তারাই, যাদেরকে জ্ঞান ও ঈমান প্রদান করা হয়েছে: নিশ্চয় তোমরা অবস্থান করেছিলে আল্লাহর লিপির মধ্যে পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত। সুতরাং এটাই হচ্ছে ওই দিন পুনরুত্থানের; কিন্তু তোমরা জানতে না।’
❏ সূরা ইসরা’র ১০৭/৮ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে –
قُلْ آمِنُواْ بِهِ أَوْ لاَ تُؤْمِنُوۤاْ إِنَّ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ مِن قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلأَذْقَانِ سُجَّداً وَيَقُولُونَ سُبْحَانَ رَبِّنَآ إِن كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُولاً
অর্থাৎ, ‘(হে রাসূল) আপনি বলুন: তোমরা এর ওপর ঈমান আনো অথবা না আনো! নিশ্চয় ওই সব লোক যারা এটা (ক্বুরআন) অবতীর্ণ হবার আগে জ্ঞান লাভ করেছে, যখনই তা তাদের প্রতি পাঠ করা হয় তারা থুতনির ওপর ভর করে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে; আর বলে, পবিত্রতা আমাদের রব্বের জন্যে; নিঃসন্দেহে আমাদের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবারই ছিলো।’
❏ সূরা হজ্জ্ব ৫৪ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে –
وَلِيَعْلَمَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ أَنَّهُ ٱلْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَيُؤْمِنُواْ بِهِ
অর্থাৎ, ‘এবং এ জন্যে যে জানতে পারে ওই সব লোকও, যারা জ্ঞান লাভ করেছে যে তা (মানে ক্বুরআন) আপনার রব্বের কাছ থেকে সত্য; অতঃপর তারা যেনো সেটার প্রতি ঈমান আনে।’
❏ সূরা আনকাবূতের ৪৯ আয়াতে এরশাদ হয়েছে –
بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ
অর্থ: ‘বরং ওটা (মানে ক্বুরআন) সুস্পষ্ট নিদর্শন তাদের অন্তরের মধ্যে, যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে।’
❏ সূরা সাবা’র ৫৯ আয়াতে বলা হয়েছে –
وَيَرَى ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ ٱلَّذِيۤ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ هُوَ ٱلْحَقَّ وَيَهْدِيۤ إِلَىٰ صِرَاطِ ٱلْعَزِيزِ ٱلْحَمِيدِ
অর্থাৎ, ‘এবং যারা জ্ঞান লাভ করেছে তারা জানে যে, যা কিছু আপনার প্রতি আপনার রব্বের কাছ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে (ক্বুরআন), তা-ই সত্য এবং সম্মানের অধিকারী, সমস্ত প্রশংসায় প্রশংসিতের পথনির্দেশ করে।’
❏ সূরা মুজাদা’লার ১১ আয়াতে এরশাদ হয়েছে –
وَٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ دَرَجَاتٍ
অর্থ: ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদেরকে জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা (আখেরাতে) সমুন্নত করবেন।’
❏ সূরা ফাতিরের ২৮ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে –
إِنَّمَا يَخْشَى ٱللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ ٱلْعُلَمَاءُ
অর্থাৎ, ‘আল্লাহকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে তারাই ভয় পায়, যারা জ্ঞানসম্পন্ন।’
❏ সূরা হুজুরাতের ১৪ আয়াতে বলা হয়েছে –
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عَندَ ٱللَّهِ أَتْقَاكُمْ
অর্থ: ‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে অধিক সম্মানিত সে-ই, যে তোমাদের মধ্যে অধিক খোদাভীরু।’
❏ একই গ্রন্থের (আল-হাদীক্বা) ৩৬৫ পষ্ঠায় উদ্ধৃত হাদীসগুলোতে এরশাদ হয়েছে:
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرَضِينَ حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ
‘আল্লাহতায়া'লা, ফেরেশতাকুল ও সকল সৃষ্টি সেই ব্যক্তির ভালাই কামনা করেন, যে মানুষকে উত্তম বিষয়াদি শিক্ষা দেয়’
🔺(ক/ তিরমিযী: আস্ সুনান, ৯:২৯৯, হাদীস নং ২৬০৯; খ/ আল-খতীব: মিশকাতুল মাসাবীহ, ১:৪৬, হাদীস নং ২১৩; গ/ আব্দুর রাযযাক: আল-মুসান্নাফ, ১১:৪৬৯; ঘ/ তাবারানী: আল-মু‘জামুল কাবীর, ৭:২৬৭);
يَشْفَعُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثَلَاثَةٌ الْأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الْعُلَمَاءُ ثُمَّ الشُّهَدَاءُ
❏ ‘শেষ বিচার দিবসে প্রথমে আম্বিয়া (عليه السلام), তারপর উলামা (-এ-হক্কানী/রব্বানী) এবং তারপর শহীদান সুপারিশ করবেন’
🔺(ক/ ইবনে মাজাহ: আস সুনান, ১২:৩৭২, হাদীস নং ৪৩০৪; খ/ আল-খতীব: মিশকাতুল মাসাবীহ, ৩:২১৯; গ/ বায়হাকী: শু‘য়াবুল ইমান, ৪:২৩১, হাদীস নং ১৬৬৮);
يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّمَا الْعِلْمُ بِالتَّعَلُّمِ
❏ ‘ওহে মানব সকল! জেনে রেখো, জ্ঞান (একমাত্র উলামাবৃন্দের) তা’লিম/পাঠদান বা প্রশিক্ষণ দ্বারা শেখা যায়।’ 🔺(তাবারানী: আল-মু‘জামুল কাবীর, ১৪:৩২৪);
تَعَلِّموُا العِلْمَ فَاِنَّ تَعَلَّمَهُ لِلهِ خَشِيَةٌ وطلبه عِبَادَةٌ وَمُذَاكَرَاتَهُ تَسْبِيْحٌ وَالْبَحْثُ عَنْهُ جِهَادٌ وَتَعْلِيْمُهُ لِمَنْ لاِ يَعْلِمُهُ صَدْقَةٌ وَبْذْلُهُ لِاَهْلِهِ قُربَةٌ
❏ ‘জ্ঞান শিক্ষা করো! (কেননা) তা একটি এবাদত। (দ্বীনী জ্ঞান) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে জ্বেহাদ করার সওয়াব/পুরস্কার দেয়া হবে। জ্ঞান শিক্ষাদান দান-সদকাহ’র মতোই। আলেমের কাছ থেকে জ্ঞান শিক্ষা করা মধ্য রাতের নামায আদায়ের মতো সওয়াবদায়ক।’
তা‘হির নাজা’রী (ইন্তেক্বাল: ৫৪২ হিজরী/১১৪৭ খৃষ্টাব্দ) যিনি ‘খুলা’সা’ নামের ফতোয়াগ্রন্থের প্রণেতা, তিনি বিবৃত করেন: ‘ফেক্বাহর বইপত্র পাঠ করা রাতে নামায আদায়ের চেয়েও সওয়াবদায়ক। কেননা ফরয/বাধ্যতামূলক আমল ও হারাম/নিষিদ্ধকর্মগুলো সম্পর্কে উলামাবৃন্দ (বা তাঁদের বইপত্র) হতে জানাটা ফরয। জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ তথা অনুশীলনের জন্যে বা তা শিক্ষা দেয়ার খাতিরে ফেক্বাহ’র বইপুস্তক পাঠ করা সালাতু্স্ তাসবীহ (নামায) আদায়ের চেয়েও শ্রেয়তর। একটি হাদীস শরীফে এসেছে – ‘জ্ঞানার্জন করা নফল এবাদত-বন্দেগীর চেয়েও বেশি সওয়াবদায়ক; কেননা তা যেমন কারো জন্যে উপকারী, তেমনি অন্য যাদেরকে সে তা শিক্ষা দেয়, তাদের জন্যেও তা উপকারী’;
مَنْ تَعَلَّمَ بَابَا مِنَ الْعِلمِ لِيَعْلَمَ النَّاسَ أُعْطِيَ ثَوَابُ سَبعِيْنَ صِدِّيقًا
❏ ‘যে ব্যক্তি অন্যদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে জ্ঞানার্জন করে, তাকে সিদ্দীক্ব তথা সত্যনিষ্ঠ বুযূর্গদের মতো সওয়াব দেয়া হবে (আল-হাদীস)।’
ইসলামী বিদ্যা শিক্ষা স্রেফ কোনো শিক্ষক/মুর্শীদ ও বইপত্র থেকে আহরণ করা যায়। যারা দাবি করে যে ইসলামী (মৌলিক) কিতাব-পত্র ও মুর্শীদের কোনো প্রয়োজন নেই, তারা প্রকৃতপ্রস্তাবে মিথ্যুক নতুবা যিনদিক্ব। তারা মুসলমানদেরকে ধোকা দেয় এবং ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ধর্মীয় বইপত্রের জ্ঞান বের করা হয় ক্বুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ হতে।’ {ইমাম আবদুল গনী নাবলুসী কৃত ‘হাদীক্বা’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি এখানে শেষ হলো। তিনি ১১৪৩ হিজরী মোতাবেক ১৭৩১ খৃষ্টাব্দে বেসালপ্রাপ্ত হন।}
আল্লাহতায়া'লা তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)’কে প্রেরণ করেন যাতে তিনি (হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ক্বুরআন মজীদের বাণী পৌঁছে দিতে পারেন এবং তা শিক্ষাও দিতে পারেন। মহানবী (ﷺ)’র কাছ থেকে (সরাসরি) আসহাবে কেরাম (رضي الله عنه) ক্বুরআনুল করীমের জ্ঞান শিক্ষা করেন। উলামায়ে ইসলাম তা শিক্ষা করেন সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) হতে; আর মুসলমানবৃন্দ তা শেখেন ইসলামী উলামা-মণ্ডলী ও তাঁদের বইপত্র হতে।
একটি হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে:
الْعِلْمُ خَزَائِنُ وَتَفْتَحُهَا الْمَسْأَلَةُ
❏ “জ্ঞান হলো এক ধনাগার, এর চাবিকাঠি জিজ্ঞেস করে শেখা” (দারেমী: আস্ সুনান, ২:১০৩, হাদীস নং ৫৫৮);
تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ وَعَلِّمُوهُ النَّاسَ
❏ “জ্ঞান শিক্ষা করো এবং শিক্ষা দাও!”
(ক/ দারেমী: আস্ সুনান, ১:২৫০, হাদীস নং ২২৭; খ/ আল-খতীব: মিশকাতুল মাসাবীহ, ১:৫৯, হাদীস নং ২৫৯; গ/ বায়হাকী: শু‘য়াবুল ইমান, ৪:২৬৫, হাদীস নং ১৭০১; ঘ/ দারে কুতনী: আস্ সুনান, ৯:৩৭৯, হাদীস নং ৪১৪৯)
لِكُلِّ شَيْءٍ مَعْدِنٌ , وَمَعْدِنُ التَّقْوَى قُلُوبُ الْعَارِفِينَ
❏ “প্রতিটি বস্তুরই রয়েছে উৎস; তাক্বওয়া (মানে খোদাভীরুতা)’র উৎস হলো ‘আরেফ/খোদা-জ্ঞানীদের অন্তরসমূহ”
(তাবারানী: আল-মু‘জামুল কাবীর, ১০:৪৪৩);
تَعْلِيْمُ العِلْمِ كَفَّارةْ لِلْكَبَائِرْ
❏ “জ্ঞান শিক্ষাদানে পাপ মোচন হয়।”
❏ ইমামে রব্বানী শায়খ আহমদ ফারূক্বী সেরহিন্দী (رحمة الله) তাঁর রচিত ‘মকতুবাত শরীফ’ পুস্তকের প্রথম খণ্ডের ১৯৩তম পত্রে লেখেন:
“কোনো দায়িত্বশীল (বালেগ/সাবালক) ব্যক্তিকে প্রথমে তাঁর ঈমান তথা আক্বীদা-বিশ্বাস পরিশুদ্ধ করা বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের জ্ঞান বিশারদবৃন্দের শেখানো আক্বীদা-বিশ্বাস জেনে তা অন্তরে ধারণ করা উচিত। আল্লাহতায়া'লা ওই মহান ব্যক্তিত্বদের সাধনার জন্যে তাঁদেরকে প্রচুর সওয়াব দিন, আমীন। এ সকল মহৎ ব্যক্তি সঠিকভাবে যে (ধর্মীয়) জ্ঞান (গবেষণা করে) বের করেছেন, স্রেফ তা শিক্ষা করা এবং তাতে বিশ্বাস করার ওপরই পরকালীন শাস্তি হতে মুক্তি লাভ নির্ভরশীল {তাঁদের পথের অনুসারীদের বলা হয় সুন্নী}। একটি হাদীস শরীফে ঘোষিত হয়েছে যে জাহান্নামের আগুন থেকে একটি দল নাজাত/পরিত্রাণ পাবে; আর এটা সেই মুসলমানদের দল যাঁরা (ওপরোক্ত) উলামাবৃন্দের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। রাসূলে খোদা (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীবৃন্দ (رضي الله عنه)’কে অনুসরণকারী প্রকৃত মুসলমান হচ্ছেন কেবল এসব মুসলমান-ই। ক্বুরঅান মজীদ ও হাদীস শরীফ হতে বের করা (বিধিবিধান-সংক্রান্ত) সঠিক ও মূল্যবান জ্ঞান সেগুলোই, যা আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদমণ্ডলী ক্বুরআন-হাদীস থেকে (গবেষণা করে) বের করেছেন। কেননা ধর্মক্ষেত্রে মুসলমান নামধারী প্রতিটি পথভ্রষ্ট লোকই দাবি করে থাকে যে তার গোমরাহ ধ্যান-ধারণা ক্বুরআন-হাদীস থেকে গৃহীত হয়েছে। ভ্রান্ত চিন্তা ও বিচ্যুত আক্বীদা-বিশ্বাসের ধারক প্রত্যেকেই বলে সে ক্বুরআন-সুন্নাহ’র অনুসারী। তবে এটা পরিদৃষ্ট হয়েছে যে, ক্বুরআন-হাদীস থেকে উপলুব্ধ (জ্ঞান) ও বের করা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সবাই কিন্তু সঠিক নয়।
{আল্লামা হুসাইন হিলমীর নোট: আহলে সুন্নাতের সঠিক আক্বীদা-বিশ্বাস শিক্ষা করার বেলায় হানাফী মাযহাবের মহান ইসলামী বিদ্বান হযরত ফযলুল্লাহ বিন হাসান তুর পুশতী (বেসাল:৬৬১ হিজরী/১২৬৩ খৃষ্টাব্দ) বিরচিত ‘আল-মো’তামাদ’ শীর্ষক বইটি অগ্রগণ্য; এটা আহলে সুন্নাতের উলামাদের প্রচারিত প্রকৃত আক্বীদা-বিশ্বাস বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে। এর অর্থ স্পষ্ট ও সহজে বোধগম্য। হাক্বীক্বত কিতাবাভী ১৪১০ হিজরী/১৯৮৯ খৃষ্টাব্দ সালে বইটি প্রকাশ করেছে।}
“আক্বায়েদ সঠিকভাবে শেখার পর আমাদেরকে ‘হালা’ল’, ’হারা’ম’, ‘ফরয’, ‘ওয়াজিব’, ‘সুন্নাত’, ‘মানদুব’ ও ‘মকরূহ’-গুলো সম্পর্কে আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদদের লেখা ফেক্বাহ’র বইপত্র হতে শিক্ষা ও তা মান্য করা উচিত। এ সকল মহান উলামাকে বুঝতে অক্ষম গণ্ডমূর্খ লোকদের প্রকাশিত গোমরাহ-পথভ্রষ্ট বইপত্র আমাদের পাঠ করা উচিত নয়। আক্বায়েদে আহলে সুন্নাতের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ আক্বীদা-বিশ্বাসধারী মুসলমানবর্গ পরলোকে জাহান্নাম হতে বাঁচতে পারবে না – আল্লাহতায়া'লা আমাদের রক্ষা করুন! সঠিক আক্বীদা-বিশ্বাস পোষণকারী মুসলমান যদি এবাদত-বন্দেগীতে তথা ধর্মানুশীলনে শিথিল হন, তাঁকে হয়তো মাফ করা হতে পারে, যদি তিনি তওবা না-ও করে যেতে পারেন। আর মাফ না করা হলে জাহান্নামে শাস্তি লাভের পরে তিনি মুক্তি পাবেন। মূল বিষয় হলো আক্বীদা-বিশ্বাস পরিশুদ্ধ করা। হযরত খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার (বেসাল: ৮৯৫ হিজরী/১৪৯০ খৃষ্টাব্দ, সমরক্বন্দ) বলেন, ‘আমাকে যদি সমস্ত কাশফ ও কারামত দেয়া হতো কিন্তু আহলে সুন্নাতের আক্বীদা-বিশ্বাস হতে বঞ্চিত করা হতো, তাহলে আমি নিজেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিবেচনা করতাম। (পক্ষান্তরে) আমার যদি কোনো কাশফ-কারামত না থাকতো অথচ থাকতো অনেক দোষত্রুটি, আর যদি আমাকে আহলে সুন্নাতের আক্বীদা-বিশ্বাস দ্বারা আশীর্বাদধন্য করা হতো, তাহলেও আমি অনুতপ্ত হতাম না।’
“আজকে ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের অধঃপতিত অবস্থা। ইসলামের শত্রুরা চারদিক থেকে তাদেরকে আক্রমণ করছে। বর্তমানে দ্বীনের সেবায় একটি মুদ্রা দান করা অন্য যে কোনো সময়ের সহস্র সহস্র মুদ্রা দানের চেয়েও বেশি সওয়াবদায়ক। ইসলাম ধর্মের জন্যে সবচেয়ে বড় খেদমত হবে আহলে সুন্নাতের বইপত্র, যা ঈমান ও ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়, তা সংগ্রহ করা এবং গ্রামবাসী ও তরুণ প্রজন্মের মাঝে বিতরণ করা। যে ব্যক্তির ভাগ্যে এই পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য নসীব হয়েছে, তিনি অবশ্যই খুশি অনুভব করবেন; তিনি আল্লাহতায়া'লার প্রতি অগণিত কৃতজ্ঞতা জানাবেন; তিনি যে কী সৌভাগ্যবান, কতোখানি উত্তম তাকদীরের অধিকারী! ইসলাম ধর্মের খেদমত আঞ্জাম দেয়া সব সময়-ই ভালো। কিন্তু এ রকম ক্রান্তিকালে যখন দ্বীন-ইসলামের পরিস্থিতি নাজুক ও দুর্বল, যখন মিথ্যের বেসাতি ও কুৎসা রটনার মাধ্যমে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার অনেক অপচেষ্টা চলছে, তখন আহলে সুন্নাতের আক্বীদা-বিশ্বাস প্রচার করাটা অনেক উত্তম একটা কাজ।
❏ রাসূলে পাক (ﷺ) তাঁর সাহাবা-মণ্ডলী (رضي الله عنه)’কে বলেন:
إِنَّكُمْ فِي زَمَانٍ مَنْ تَرَكَ مِنْكُمْ عُشْرَ مَا أُمِرَ بِهِ هَلَكَ ثُمَّ يَأْتِي زَمَانٌ مَنْ عَمِلَ مِنْكُمْ بِعُشْرِ مَا أُمِرَ بِهِ نَجَا
‘তোমরা এমন এক সময়ে জীবন যাপন করছো যখন অাল্লাহতায়া'লার আদেশ-নিষেধের নয়-দশমাংশ তোমরা মান্য করা সত্ত্বেও যদি এক-দশমাংশ অমান্য করো, তাহলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তোমাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে! আর তোমাদের পরে এমন এক সময় আসবে যখন স্রেফ (শরীয়তের আদেশ-নিষেধের) এক-দশমাংশ যারা মান্য করবে তারাই নাজাত পাবে’
🔺{নোট: এ হাদীস লিপিবদ্ধ আছে মিশকা’তুল মাসা’বিহ ১ম খণ্ড, ১৭৯ অনুচ্ছেদে; তিরমিযী, কিতাবুল ফিতান, ৭৯ অনুচ্ছেদে; তিরমিযী: আস্ সুনান, ৮:২২২, হাদীস নং ২১৯৩; এবং আল-খতীব: মিশকাতুল মাসাবিহ, ১:৩৯, হাদীস নং ১৭৯}।
হাদীস শরীফে যে সময়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা হলো বর্তমান সময়কাল। অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ইসলামের আক্রমণকারীদের চেনা এবং তাদেরকে অপছন্দ করা একান্ত জরুরি {নোট: জ্বেহাদ ক্বাতলী তথা শক্তি দ্বারা জ্বেহাদ পরিচালনা করে থাকে রাষ্ট্রপক্ষ ও তার সেনাবাহিনী। মুসলমানবৃন্দ তাতে শরীক হন সৈন্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে, যা রাষ্ট্রপক্ষ তাঁদের প্রতি অর্পণ করে। জ্বেহাদ ক্বওলী তথা কথা ও লেখনীর মাধ্যমে জ্বেহাদ যে জ্বেহাদ ক্বাতলী হতে শ্রেয়তর, তা লিপিবদ্ধ আছে ইমামে রব্বানী (رحمة الله)’র মকতুবাত পুস্তকের ৬৫ নং পত্রে}। আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদদের বইপত্র ও বাণী প্রচার করার জন্যে কাউকে কারামত/অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বা আলেম হতে হবে না। প্রত্যেক মুসলমান ব্যক্তিরই এই লক্ষ্যে সংগ্রাম-সাধনা করা উচিত। এই সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয়। শেষ বিচার দিবসে প্রত্যেক মুসলমানকেই এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে এবং প্রশ্ন করা হবে কেন তারা ইসলামের খেদমত করেনি। যারা ইসলামী শিক্ষামূলক বইপত্র বিতরণে সাধনা করে না এবং যারা ইসলামী জ্ঞান প্রচারকারী মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য-সহায়তা করে না, তাদেরকে ভীষণ শাস্তি দেয়া হবে। কোনো রকম ওজর-আপত্তি গ্রাহ্য করা হবে না। আম্বিয়া (عليه السلام) যদিও সবচেয়ে সম্মানিত ও সৃষ্টিকুলসেরা, তথাপিও তাঁরা কখনো নিজেদের আরাম-আয়েশের দিকে নজর দেননি। অনন্ত নেআমত/আশীর্বাদপ্রাপ্তির পথ আল্লাহতায়া'লার ধর্মকে প্রচার করার উদ্দেশ্যে তাঁরা দিন-রাত সাধনা করেছেন। যারা তাঁদের কাছে অলৌকিক ক্রিয়া দেখতে চেয়েছিলো, তাদের প্রতি তাঁরা উত্তর দিয়েছিলেন যে ‘আল্লাহতায়া'লা মো’জেযা/অলৌাকক ক্রিয়া সৃষ্টি করেছেন, আর তাঁদের দায়িত্ব হলো আল্লাহর ধর্মকে (মানুষের কাছে) পৌঁছে দেয়া।’ যেহেতু তাঁরা এই উদ্দেশ্যে কাজ করেছিলেন, সেহেতু আল্লাহতায়া'লা তাঁদেরকে সাহায্য করেন এবং মো’জেযা সৃষ্টি করে দেন। আমাদেরও উচিত আহলে সুন্নাতের বিদ্বানমণ্ডলীর বইপত্র ও বাণী প্রচার করা এবং তরুণ প্রজন্ম ও আমাদের বন্ধুদেরকে অবিশ্বাসী শত্রুদের হীনতা এবং মুসলমানদের প্রতি আরোপিত তাদের মিথ্যে ও কুৎসা এবং হয়রানি সম্পর্কে জানানো
❏ {নোট: মুসলমানদেরকে তা জানানো গুজব নয়, বরং
الَأْمْرُ بِالْمَعْرُفِ وَالنَهْيُ عَنْ الْمُنْكَرُ
আল-আমরু বিল-মা’রূফ ওয়ান্ নাহী আনিল মুনকার তথা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ।}
প্রত্যেক মুসলমানেরই উচিত আহলে সুন্নাতের আক্বীদা-বিশ্বাস শিক্ষা করা এবং যেসব মানুষের ওপর তাঁর প্রভাব বিদ্যমান তাদেরকেও শেখানো। সুন্নী উলামাবৃন্দের বাণীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসম্বলিত বইপত্র, ম্যাগাজিন ও প্রচারপত্র কেনা উচিত এবং তরুণ দ্বীনী ভাইবোন ও পরিচিতজনের মাঝে বিলিবণ্টন করা উচিত। তাঁরা যাতে সেগুলো পাঠ করেন, তা নিশ্চিত করতে আমাদের কঠিন পরিশ্রম করা উচিত। এছাড়া ইসলামের শত্রুদের প্রকৃত উদ্দেশ্য বর্ণনাকারী বইপত্রও বিতরণ করা উচিত}। যারা এই লক্ষ্যে ধনসম্পদ ব্যয় ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে না বা পেশাগত শ্রম দেয় না, তারা শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না। এই উদ্দেশ্যে কাজ করার সময় দুঃখকষ্ট ভোগ ও হয়রানির শিকার হওয়াকে এক মহা সুখের বিষয় ও বড় ফায়দা হিসেবে গণ্য করতে হবে। পয়গম্বর (عليه السلام)’বৃন্দ মানুষের কাছে আল্লাহতায়া'লার বিধান পৌঁছে দেয়ার সময় মূর্খ ও হীন লোকদের আক্রমণের শিকার হন। তাঁরা প্রচুর কষ্টভোগ করেন। আল্লাহতায়া'লার প্রিয়নবী (ﷺ) যাঁকে নবীকুলশ্রেষ্ঠ হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিলো, তিনি এরশাদ করেন – ‘কোনো পয়গম্বর-ই আমার মতো রূঢ় ব্যবহার দ্বারা কষ্টভোগ করেননি।’ {ইমাম রব্বানী (رحمة الله)’র মকতুবাত পুস্তকের উদ্ধৃতি এখানে সমাপ্ত হলো}]
হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ) এর শরীয়ত শিক্ষা করার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শন ও পৃথিবীর বুকে সকল মুসলমানকে সঠিক পথপ্রাপ্তির দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন চারজন মহান ব্যক্তিত্ব। তাঁদের একজন হলেন ইমামুল আযম আবু হানিফা নু’মান ইবনে সাবিত (رحمة الله)। তিনি ইসলামী উলামামণ্ডলীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। আহলে সুন্নাতের তিনি-ই একজন ইমাম। তাঁর জন্ম কুফা নগরীতে ৮০ হিজরী সালে (৬৯৯ খ্রী:)। তিনি ১৫০ হিজরী সালে (৭৬৭ খ্রী:) বাগদাদে বেসালপ্রাপ্ত হন।
উলামাবৃন্দের মধ্যে দ্বিতীয় জন হলেন ইমাম মালেক ইবনে আনাস্ (رحمة الله)। তিনি ৯৫ হিজরী সালে (৯১৩ খ্রী:) মদিনা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই ১৭৯ হিজরী (৭৯৫ খ্রী:) সালে বেসালপ্রাপ্ত হন।
তৃতীয় জন হলেন ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস্ শাফেয়ী (رحمة الله), যিনি ইসলামী জ্ঞান বিশারদগণের নয়নমণি। তিনি প্যালেস্টাইনের গাযায় ১৫০ হিজরী (৭৬৭ খ্রী:) সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং মিসরে ২০৪ হিজরী (৮১৯ খ্রী:) সালে বেসালপ্রাপ্ত হন।
চতুর্থ জন হলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) যিনি বাগদাদ নগরীতে ১৬৪ হিজরী (৭৮০ খ্রী:) সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই ২৪১ হিজরী (৮৫৫ খ্রী:) সালে বেসালপ্রাপ্ত হন। তিনি-ই ইসলামী জ্ঞানের বিশাল ইমারতের ভিত্তিপ্রস্তর।
আজকাল যারা এই চারজন ইমামের কোনো একজনকে অনুসরণ করে না, তারা মহাবিপদে পতিত। বস্তুতঃ তারা গোমরাহীতে নিমজ্জিত। এই চারজন ইমাম ছাড়াও আরও অনেক সত্যপন্থী মযহাবের ইমাম ছিলেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমণে তাঁদের মযহাব বিস্মৃত হয়েছে এবং বইপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, মদীনা শরীফের সাতজন উলামা যাঁদের “আল্ ফুকাহা আস্ সাব’আ” বলা হতো, তাঁরা এবং হযরত উমর ইবনে আবদিল আযীয (رحمة الله), হযরত সুফিয়ান ইবনে উবায়না (رحمة الله), হযরত ইসহাক ইবন রাহাউয়ীয়্যা (رحمة الله), হযরত দাউদ আত-তায়ী (رحمة الله), হযরত আমীর ইবনে শারাহিল আশ্ শা’বী (رحمة الله), হযরত লাইস্ ইবনে সা’দ (رحمة الله), হযরত আ’মাশ (رحمة الله), হযরত মুহাম্মদ ইবনে জারির তাবারী (رحمة الله), হযরত সুফিয়ান সাওরী (رحمة الله) ও হযরত আবদুর রহমান আওযাই (رحمة الله) প্রমুখ উলামায়ে কেরাম ওরকম মযহাবের স্রষ্টা ছিলেন।
প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সকল সাহাবী-ই বাস্তবিক অর্থে হেদায়াত (পথপ্রাপ্তি)-এর “উজ্জ্বল নক্ষত্র”। সারা পৃথিবীকে সঠিক পথপ্রদর্শনের জন্যে তাঁদের যে কোনো একজন-ই যথেষ্ট। তাঁরা ছিলেন মুজতাহিদ, যাঁদের নিজ নিজ স্বতন্ত্র মযহাব ছিল। তাঁদের অধিকাংশ মযহাব-ই অনুরূপ ছিল। তবু যেহেতু তাঁদের মযহাবগুলো বইপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হয়নি, সেহেতু আমাদের পক্ষে সেগুলো অনুসরণ করা সম্ভব নয়। চারজন ইমামের মযহাবগুলো, অর্থাৎ, বিশ্বাস সংক্রান্ত ও কর্ম (আমল) সংক্রান্ত তাঁদের বর্ণিত বিষয়াবলী তাঁদের শিষ্যবৃন্দ কর্তৃক সংগৃহীত এবং ব্যাখ্যাকৃত হয়েছে। সেগুলো বইপত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রত্যেক মুসলমানকে উপরোক্ত চারজন ইমামের যে কোনো একজনের মযহাব অনুসরণ করতে হয় এবং সেই মযহাব অনুযায়ী জীবনযাপন ও এবাদত-বন্দেগী পালন করতে হয়।
ঈমানের জ্ঞানে এই চারজন ইমামের দু জন শিষ্য অত্যন্ত উচ্চস্তরে উন্নীত হয়েছিলেন। ফলে ঈমান তথা এ’তেকাদের ক্ষেত্রে দুইটি মযহাব জন্মলাভ করে। কুরআন ও হাদীসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সঠিক ঈমান হলো সেটাই, যেটা ওই দু জন ইমাম প্রদর্শন করেছেন। বস্তুতঃ পরিত্রাণপ্রাপ্ত সম্প্রদায় আহলুস্ সুন্নাতের আকীদা-বিশ্বাস ওই দু জন ইমাম-ই সারা পৃথিবীতে প্রচার-প্রসার করেন। তাঁদের একজন হলেন ইমাম আবুল হাসান আলী আল্ আশআরী (رحمة الله) যিনি ২২৬ হিজরী (৪৭৯ খ্রী:) সালে বসরায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩৩০ হিজরী (৯৪১ খ্রী:) সালে বাগোদে বেসালপ্রাপ্ত হন। অপর জনের নাম ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি (رحمة الله) যিনি ৩৩৩ হিজরী (৯৪৪ খ্রী:) সালে সমরকন্দ অঞ্চলে বেসালপ্রাপ্ত হন। ঈমানের ক্ষেত্রে প্রত্যেক মুসলমানকেই এই দু জন ইমামের কোনো একজনকে অনুসরণ করতে হয়।
আউলিয়ায়ে কেরামের তুরুক (তরীকা বা রাস্তার বহুবচন) সত্য, সঠিক। তাঁরা শরীয়ত হতে এক বিন্দুও বিচ্যুত হননি। আউলিয়াবৃন্দ কারামত (অলৌকিক ক্রিয়া)-এর অধিকারী। তাঁদের সকল কারামত-ই সত্য এবং সঠিক।
❏ মহান আলেম ইমাম ইয়াফি’ই (رحمة الله) বলেছেন, وَانْتَشَرَتِ كَرَامَاتَ غَوْثِ الثَفَلَيْنِ عَبْدِ القَادِرِ الْجِيْلاَنِيْ اِلَيْ كُلِّ الاَنْحَاءِ وَكَانَتْ تَنْتَقِلُ مِنَ الفَمِّ اِليْ الفَمِ بِشِكْلِ لاَ يَمْكِنُ اَنْكَارَهَا وَالْشُّبهَةَ فِيْهَا لأَنَّ التَّوَاتُرَ فِيْهَا يَعْنِيْ الأِنْتِشَارُ فِيْ كُلِّ مَكَانٍ يَعْتَبِرُ سَنْدَا قَوِيًا لَهَا. –
“গাউস্ আস্ সাকলাইন হযরত মওলানা আবদুল কাদির আল জিলানী (رحمة الله)-এর কারামতসমূহ এতো সর্বজনবিদিত ও সর্বত্র প্রসার লাভকৃত যে, কেউ এতে সন্দেহ কিংবা অবিশ্বাস পোষণ করতে পারে না। কেননা, ’তাওয়াতুর’ (সর্বত্র প্রসার লাভকৃত অবস্থা) হলো সত্যতার একটি সনদ (প্রামাণ্য দলিল)।”
নামায আদায়কারী কোনো ব্যক্তিকে “কাফের” (অবিশ্বাসী) আখ্যা দেয়া আমাদের জন্যে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়, যদি না আমরা তাকে কুফর বা অবিশ্বাস সৃষ্টিকারী কোনো কথা বলতে শুনি অথবা কাজ করতে দেখি। সেই ব্যক্তির কাফের হয়ে মৃত্যুবরণ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে না জেনে আমরা লা’নত (অভিসম্পাত) দিতে পারি না। এমন কি একজন কাফের (ভিন্ন ধর্মাবলম্বী)-কেও লা’নত দেয়া অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। এ কারণে ইয়াযিদকে লা’নত না দেয়া-ই উত্তম।
৫। ঈমানের পঞ্চম মূলনীতি হলো وَالْيَوْمِ الْآخِرِ– “শেষ বিচার দিবস (আল-ইয়াওমুল আখির)-এর প্রতি বিশ্বাস”। এটা আরম্ভ হয় কোনো মানুষের মৃত্যু বিদস থেকে এবং এটা কেয়ামত দিবস পর্যন্ত চলতে থাকে। এটাকে শেষ দিবস বলা হয় এ কারণে যে, এর পরে আর কোনো রাত আসবে না; অথবা এ কারণে যে, এটা পৃথিবীর পরে আগমনকারী। এই হাদীসে উল্লিখিত “দিবস”-টি কিন্তু আমাদের জ্ঞাত দিবারাত্রির মতো নয়। এটা কিছু সময়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। কেয়ামত কবে হবে তা জ্ঞাত করানো নয়। তথাপি আমাদের প্রিয়নবী (ﷺ) কেয়ামতের বহু আলামত (লক্ষণ) বর্ণনা করেছেন: হযরত ইমাম আল্ মাহ্দী আগমন করবেন; হযরত ঈসা (عليه السلام) আসমান হতে দামেশকে অবতরণ করবেন, দাজ্জাল আবির্ভূত হবে; ইয়াজুজ ও মা’জুজ সম্প্রদায় সমস্ত পৃথিবীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করবে। সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হবে, প্রাণ-সংহারী ভূমিকম্পসমূহ সংঘটিত হবে; ধর্মীয় জ্ঞান বিস্মৃত হবে; দুর্নীতি ও বদমায়েশী বৃদ্ধি পাবে; অধার্মিক, দুর্নীতিপরায়ণ, দুশ্চরিত্র লোকেরা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে; আল্লাহতায়া'লার আজ্ঞাসমূহ বিস্মৃত হবে; সর্বত্র হারাম কাজ সংঘটিত হবে; ইয়ামেন রাজ্যে আগুন দেখা দেবে; সাগর ও পর্বতমালা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে; সূর্য ও চাঁদ অন্ধকার হয়ে যাবে; মহাসাগরগুলো একে অপরের সাথে মিশ্রিত হয়ে ফুটন্ত পানি হবে এবং শুকিয়েও যাবে।
যে মুসলমান ব্যক্তি পাপ সংঘটন করে, তাকে “ফাসিক” (পাপিষ্ঠ) বলা হয়। ফাসিক এবং সকল অবিশ্বাসী মানুষকে তাদের কবরে মর্মন্তুদ আযাব (শাস্তি) প্রদান করা হবে। এগুলোতে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে হবে। দাফন করার পর মৃতজন একটি অজ্ঞাত জীবনে প্রত্যাবর্তন করবেন এবং শান্তি নয়তো শাস্তি পেতে থাকবেন। একটি হাদীস শরীফে ঘোষিত হয়েছে যে “মুনকার” ও “নকির” নামের দু জন ফেরেশতা দুইটি অজ্ঞাত, ভয়ঙ্কর মানুষের ছদ্মবেশে মৃতজনের কবরে এসে তাঁকে প্রশ্ন করবেন। কতিপয় উলামার মতানুযায়ী কবরে প্রশ্নগুলো ঈমানের কিছু মূলনীতি সম্পর্কেই করা হবে; আর কতিপয় উলামার মতানুযায়ী সমগ্র ঈমান সম্পর্কেই প্রশ্ন করা হবে। এ কারণেই আমাদের সন্তানদেরকে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলোর জবাব শিক্ষা দেয়া উচিৎ: তোমার রব্ব (আল্লাহ্) কে? তোমার দ্বীন (ধর্ম) কী? তুমি কোন্ নবী (عليه السلام)-এর উম্মত? তোমার পবিত্র ধর্মগ্রন্থের নাম কী? তোমার কিবলা কী? ঈমান ও এবাদতের (অর্থাৎ, আমলের) ক্ষেত্রে তোমার মযহাবগুলো কী কী? ’তাযকেরাতুল কুরতুবী’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে যে, مَنْ يَّكُنُ خَارِجًا مِنْ اَهْلِ السُّنَّةِ فَلَمْ يَستَطِعِ رَدَّ الأَسْئِلَةِ رَدَّا صَحِيْحًا– যারা আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত নয়, তারা সঠিকভাবে জবাব দিতে সক্ষম হবে না।
🔺[২৩] কুরতুবী : আত তাযকিরা।
যাঁরা সঠিক উত্তর দেবেন, তাঁদের কবরগুলো প্রশস্ত হয়ে যাবে এবং বেহেশতের একটি বাতায়ন কবরে খুলে দেয়া হবে। প্রতি সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁরা বেহেশতে নিজেদের স্থান দর্শন করবেন, আর ফেরেশতামণ্ডলী তাঁদের সেবা করবেন এবং তাঁদেরকে শুভসংবাদ দেবেন। যারা সঠিক জবাব দিতে ব্যর্থ হবে, তাদেরকে এমন কঠোরভাবে লাঠি দ্বারা প্রহার করা হবে যে মানব ও জ্বীন জাতি ছাড়া বাকি সকল সৃষ্টি-ই তাদের আর্তনাদ শুনতে পাবে। তাদের কবরগুলো এতো সংকীর্ণ হয়ে যাবে যে তারা তাদের হাড়গুলোকে এলোমেলোভাবে জড়ানো মনে করবে। দোযখ অভিমুখে একটি ছিদ্র করা হবে। প্রত্যেক সকাল ও সন্ধ্যায় তারা দোযখে তাদের স্থান দেখতে পাবে। পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত তাদেরকে তাদের কবরে চরম শাস্তি প্রদান করা হবে।
ইন্তেকালের পরের (আরেকটি) জীবনে বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরি। মাটিতে দাফন হবার পর আবারও দেহে আত্মা প্রবেশ করবে এবং শরীর সমেত তা কবর থেকে পুনরুথ্বিত হবে। অতএব, এই সময়টিকেই কেয়ামতের দিন (পুনরুথ্বান দিবস) বলা হয়েছে।
সকল জীবিত সৃষ্টি মাহশর স্থানে সমবেত হবে। আমলনামাগুলো তাদের নিজ নিজ সংঘটনকারীদের কাছে উড়ে যাবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়া'লা যিনি আসমান-জমীন, সূর্য-নক্ষত্র ও সকল অণু-কণার স্রষ্টা, তিনি-ই এগুলো সংঘটিত করবেন। আল্লাহতায়া'লার রাসূল (ﷺ) বর্ণনা করেছেন যে এগুলো ঘটবে। তিনি যা বলেছেন তা অবশ্যই সত্য। নিশ্চয়ই এগুলোর সব-ই ঘটবে।
সালেহ্ (পুণ্যবান) মানুষদের আমলনামা তাঁদের ডান দিক থেকে প্রদান করা হবে। আর ফাসিক (গুণাহ্গার) লোকদের আলমনামা তাদের বাম দিক থেকে প্রদান করা হবে; পেছন দিক থেকেও দেয়া হবে। ভালো হোক বা মন্দ, বড় বা ছোট, প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য, সব-ই ওই আমলনামায় লিপিবদ্ধ থাকবে। কেরামান কাতেবীন ফেরেশতাবৃন্দের অজ্ঞাত আমলগুলোও সেই দিন আল্লাহতায়া'লা কর্তৃক এবং দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা প্রকাশ হয়ে পড়বে। সেই দিন এ সব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং সবার কাছ থেকেই হিসেব নেয়া হবে। যদি আল্লাহতায়া'লার ইচ্ছা হয়, তবে প্রতিটি গোপন কর্মই শেষ বিচার দিবসে প্রকাশিত হবে। আসমান ও জমিনে ফেরেশতামণ্ডলী কী কাজ করেছেন তার হিসেবও নেয়া হবে। নবী আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দ মানুষদের কাছে কীভাবে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও ধর্ম প্রচার করেছেন, তারও হিসেব নেয়া হবে। আর মানুষেরা কীভাবে এসব আদেশ-নিষেধ কবুল করে তদানুযায়ী আমল করেছে, তারও হিসেব নেয়া হবে। শেষ বিচার দিবসে ঈমানদার যাঁদের কর্ম ও নৈতিকতা সুন্দর হবে, তাঁদেরকে উত্তম পুরস্কার দেয়া হবে। পক্ষান্তরে, যাদের মেজাজ উগ্র ও কর্ম মন্দ হবে, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি প্রদান করা হবে।
আল্লাহতায়া'লা তাঁর ন্যায়বিচারের খাতিরে কিছু মুসলমানকে তাদের ছোটখাটো গুণাহর জন্যে শাস্তি দেবেন; পক্ষান্তরে, তাঁর দয়ার খাতিরে তিনি যাদের ইচ্ছা করেন, সেই সব কবীরা ও সগীরা গুণাহ্কারী মুসলমানকে ক্ষমা করে দেবেন। কুফর ও শেরক বাদ দিয়ে বাকি সব গুণাহ্ তিনি মাফ করে দিতে পারেন। তাঁর ইচ্ছা হলে ছোটখাটো গুণাহর জন্যেও তিনি শাস্তি দেবেন।
❏ তিনি ঘোষণা করেছেন,
إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ
যে তিনি কখনোই কুফর (অবিশ্বাস) ও শেরক (মূর্তি পূজা)-কে ক্ষমা করবেন না।
🔺[২৪] আল কুরআন : আন নিসা, ৪:৪৮।
কেতাব (ঐশীগ্রন্থ)-সম্পন্ন কিংবা কেতাববিহীন কাফেররা, অর্থাৎ, যারা সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর পয়গম্বর হওয়াকে অথবা তাঁর আনীত কোনো একটি বিধানকে বিশ্বাস করে না, তারা জাহান্নামে চিরকাল শাস্তি পাবে।
শেষ বিচার দিবসে আমল পরিমাপ করার জন্যে একটি মিযান (পাল্লা) থাকবে, যা আমাদের জ্ঞাত পাল্লা হতে ভিন্ন। এটা এতো বড় হবে যে সমস্ত আসমান ও জমীন এর এক পাল্লাতেই এঁটে যাবে। সৎ-কর্ম বা নেক আমলের পাল্লা উজ্জ্বল হবে এবং তা আরশের ডান দিকে হবে — যেখানে বেহেস্ত অবস্থিত; আর গুণাহ-খাতার পাল্লা হবে অন্ধকার এবং তা আরশের বাম দিকে হবে — যেখানে দোযখ অবস্থিত। কর্ম, কথাবার্তা, চিন্তাধারা ও চাহনি, যা পৃথিবীতে সংঘটন করা হয়েছে, তা আকার-আকৃতি গ্রহণ করবে; উজ্জ্বল আকৃতির নেক আমল ও কুৎসিত, অন্ধকারাচ্ছন্ন আকৃতির বদ আমলসমূহ ওই মিযানে (পাল্লায়) পরিমাপ করা হবে। এ কথা বর্ণিত হয়েছে যে ভারি পাল্লাটি ওপর দিকে চড়বে এবং হাল্কা পাল্লাটি নিচে নেমে যাবে। কতিপয় উলামার মতে, বহু মিযান থাকবে।
❏ আর বহু উলামা বলেছেন, “দ্বীন ইসলামে পরিস্ফুট করা হয় নি যে কতোগুলো মিযানের অস্তিত্ব রয়েছে, তাই এ ব্যাপারে চিন্তা না করা-ই উচিৎ।”
আল্লাহতায়া'লার আদেশক্রমে দোযখের ওপরে একটি সেতু নির্মাণ করা হবে যার নাম হবে “সিরাত”। সকলকে ওই সেতু পার হওয়ার জন্যে আদেশ করা হবে। সেই দিন অন্যান্য নবী আলাইহিমুস সালাম-মণ্ডলীও প্রার্থনা করবেন,
وَنَبِيُّهُمْ قَائِمٌ عَلَى الصِّرَاطِ، يَقُولُ: يَا رَبِّ، سَلِّمْ سَلِّمْ
❏ — “হে আল্লাহ্! নিরাপত্তা দান করুন”।
🔺[২৫] বাগাবী : শরহুস সুন্নাহ, ১৫:১৮০।
যাঁরা বেহেস্তী হবেন, তাঁরা সহজেই সেতু পার হয়ে বেহেস্তে পৌঁছে যাবেন। তাঁদের কেউ কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, আর কেউ কেউ বাতাসের গতিতে এবং অপর কেউ কেউ দ্রুত ধাবমান ঘোড়ার গতিতে সেতুটি পার হয়ে বেহেস্তে পৌঁছুবেন। সিরাত সেতুটি একটি চুলের চেয়েও পাতলা এবং একটি তলোয়ারের চেয়েও ধারালো। এ পৃথিবীতে দ্বীন ইসলামের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়াও তদ্রূপ বিষয়। ইসলামের সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া সিরাত পার হওয়ার মতোই ব্যাপার। যাঁরা এখানে নিজেদের নফস (কুপ্রবৃত্তি)-এর সাথে সংগ্রামের কষ্ট সহ্য করতে পারেন, তাঁরা সিরাত সহজেই পার হয়ে যাবেন। যারা নফসের কারণে দ্বীনদারী অবলম্বন করতে পারে না, তারা বহু কষ্টে সিরাত পার হবে। এ কারণেই আল্লাহতায়া'লা দ্বীন ইসলামের সঠিক পথটিকে “সিরাত আল্ মুস্তাকীম” আখ্যা দিয়েছেন। নাম দুটোর সাযুজ্য প্রতিভাত করে যে দ্বীন ইসলামের পথের ওপর কায়েম থাকা সিরাত পার হওয়ার মতোই ব্যাপার। যারা জাহান্নামী হওয়ার যোগ্য, তারা সিরাত হতে জাহান্নামে পড়ে যাবে।
আমাদের আকা ও মওলা হযরত রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর জন্যে সংরক্ষিত একটি জলাধারের নাম হবে “হাউয আল কাউসার”। এটা এতো বিশাল যে এর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ঘুরে আসতে সময় লাগবে এক মাস। এর পানি দুধের থেকেও সাদা হবে এবং এর সুগন্ধ মেশকের চেয়েও বেশি হবে। এর চার পার্শ্বে পানি পানের পাত্রগুলো আকাশে নক্ষত্র সংখ্যার চেয়েও অধিক। যে ব্যক্তি এর পানি একবার পান করবে সে যদি জাহান্নামেও যায়, তথাপিও তার আর কখনো তৃষ্ণা পাবে না।
এটা বিশ্বাস করতে হবে যে “শাফায়াত” হবে। আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম, আউলিয়া, সুলাহা (পুণ্যাত্মা মুসলমানবৃন্দ), ফেরেশতামণ্ডলী এবং যাঁদেরকে আল্লাহতায়া'লা অনুমতি দেবেন, তাঁরা তওবা ব্যতিরেকে ইন্তেকালকারী মুসলমানদের ছোট অথবা বড় গুণাহ্ মাফ করানোর উদ্দেশ্যে শাফায়াত করবেন এবং তাঁদের শাফায়াত কবুলও করা হবে।
❏ আমাদের রাসূলে পাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন,
شَفَاعَتِي لأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنَ أُمَّتِي –
আমার উম্মতের মধ্যে বড় বড় গুণাহ্গারদের জন্যে হবে আমার শাফায়াত।
🔺[ ২৬]
(ক) আহমদ : আল মুসনাদ, মুসনাদু আনাস বিন মালিক, ৩:২১৩ হাদীস নং ১৩২৪৫।
(খ) আবু দাউদ : আস সুনান, বাবু ফিশ শাফাআত, ৪:২৩৬ হাদীস নং ৪৭৩৯।
(গ) তিরমিযী : আস সুনান, ৪:২১৩ হাদীস নং ২৪৩৫।
(ঘ) বাযযার : আল মুসনাদ, ১২:১৮৬ হাদীস নং ৫৮৪০।
(ঙ) আবু ইয়ালা : আল মুসনাদ, ৬:৪০ হাদীস নং ৩২৮৪।
(চ) ইবনে হিব্বান : আস সহীহ, ১৪:৩৮৬ হাদীস নং ৬৪৬৭।
(ছ) তাবারানী : আল মু‘জামুল সগীর, ১:২৭২ হাদীস নং ৪৪৮।
(জ) বায়হাকী : শু‘য়াবুল ইমান, ১:৪৮৯ হাদীস নং ৩০৫।
– অনুবাদক]
পরবর্তী জগতে পাঁচ কিসিমের শাফায়াত বা সুপারিশ হবে:
প্রথমতঃ পাপীরা ভিড়ের চাপে এবং দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার কারণে কান্নাকাটি আরম্ভ করবে এবং বিচার তাড়াতাড়ি শুরু করার জন্যে ফরিয়াদ করতে থাকবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শাফায়াত করা হবে।
দ্বিতীয়তঃ জিজ্ঞাসাবাদ যাতে দ্রুত ও সহজেই সম্পন্ন করা যায়, তার জন্যে শাফায়াত হবে।
তৃতীয়তঃ পাপী মুসলমানবর্গ যাতে সিরাত থেকে দোযখে পড়ে না যায় এবং দোযখের আগুনে কষ্ট না পায়, তার জন্যেও শাফায়াত করা হবে।
চতুর্থতঃ মহাপাপী মুসলমানদেরকে দোযখ থেকে বের করে নেয়ার জন্যেও শাফায়ত করা হবে।
পঞ্চমতঃ বেহেস্তে উচ্চ মকামে উন্নীত হওয়ার জন্যে শাফায়াত করা হবে। অসংখ্য নেয়ামত ও চিরস্থায়ী সুখের আবাস বেহেস্ত আটটি স্তরের হবে, যেখানে প্রত্যেকটি মানুষের স্থান তাঁর ঈমান ও আমলের অনুপাতে বিরাজমান।
বেহেস্ত ও দোযখ বর্তমানে বিরাজ করছে। বেহেস্ত সাত আসমানের ওপরে অবস্থিত। দোযখ সব কিছুর নিচে অবস্থিত। বেহেস্তের সংখ্যা আটটি এবং দোযখের সংখ্যা সাতটি। পৃথিবী, সূর্য ও আসমানসমূহ থেকে বেহেস্ত আকৃতিতে বড়। দোযখ সূর্যের থেকে আকৃতিতে বড়।
৬। ঈমানের ছয়টি মূলনীতির শেষটি হলো وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ – কদর তথা তাকদীরে বিশ্বাস স্থাপন”। অর্থাৎ, এ কথায় বিশ্বাস করা যে, খায়র (ভালো) ও শার্র (মন্দ) সব-ই আল্লাহতায়া'লার ইচ্ছা ও নিয়ন্ত্রণাধীন। আরেক কথায়, সকল মানবের কাছে আগমনকারী ভালো-মন্দ, লাভ-ক্ষতি, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি আল্লাহতায়া'লার চূড়ান্ত ইচ্ছার অধীন। “কদর” অর্থ একটি পরিমাণের পরিমাপ; সিদ্ধান্ত, আদেশ; আধিক্য ও বিশালতা। কোনো বস্তুর অস্তিত্বের জন্যে খোদা তায়া'লার চিরন্তন ইচ্ছাকে “কদর” (নিয়তি) বলে। কদর সংঘটিত হওয়ার দৃষ্টান্ত, অর্থাৎ, যে বিষয়টি এরাদা করা হয় তাকে ’কাযা’ বলে। কাযা এবং কদর পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়। কাযা-র অর্থ হলো অনন্ত অতীত হতে অনন্ত ভবিষ্যত পর্যন্ত আল্লাহতায়া'লার সৃষ্টি করার এরাদা/ইচ্ছা; আর কদর মানে হলো কাযা’র সাথে সঙ্গতি রেখে কোনো কিছু সৃষ্টি করার নজির, যা কম নয়, আবার বেশিও নয়। অনন্ত অতীতে আল্লাহতায়া'লা জানতেন যা যা সংঘটিত হবে। তাঁর এ জ্ঞানটিকেই “কাযা” ও “কদর” বলে। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা এর নামকরণ করেছিলেন “আল্ এনায়াত আল্ আযলীয়্যা।” কাযা হতেই সকল সৃষ্টির উৎপত্তি হয়েছে। অনন্ত অতীতে আল্লাহতায়া'লার জ্ঞানানুসারে বস্তুসমূহের সৃষ্টিকেও কাযা এবং কদর বলে। কদর-এ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আমাদেরকে সুনিশ্চিতভাবে জানতে হবে যে, যদি অনন্তকালে আল্লাহতায়া'লা কোনো বস্তু সৃষ্টির এরাদা করে থাকেন, তবে তা তাঁর এরাদা অনুযায়ী অস্তিত্বসম্পন্ন হতে বাধ্য — একটুও কম বেশি তাতে হবে না। তিনি যা সৃষ্টি করতে এরাদা করেছিলেন তার অনস্তিত্ব কিংবা তিনি যা সৃষ্টি করতে এরাদা করেন নি তার অস্তিত্ব একেবারেই অসম্ভব।
অনন্তকালে আল্লাহতায়া'লার জ্ঞানে সকল বস্তু, প্রাণী, গাছ-পালা, প্রাণহীন সৃষ্টি, প্রত্যেক জিনিসের অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব, প্রতিটি মানুষের ভালো ও মন্দ কর্ম এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের শাস্তি বিরাজমান ছিল। তিনি সব কিছুই জানতেন অনন্তকালে। অনন্ত অতীত হতে চিরস্থায়ী ভবিষ্যত পর্যন্ত যা যা ঘটবে, তার গুণাবলী, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও প্রতিটি ইতিবৃত্ত অনন্ত অতীতে তাঁর জ্ঞানের সাথে সঙ্গতি রেখে তিনি-ই সৃষ্টি করেছেন। মানুষের সকল সৎ ও বদ কর্ম, দ্বীন ইসলামে তাদের বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস, তাদের সকল ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত কাজ একমাত্র আল্লাহতায়া'লাই সৃষ্টি করেন। তিনি একাই সৃষ্টি করেন এবং কোনো একটি সাবাব (কারণ)-এর মাধ্যমে তা সংঘটন করেন। তিনি প্রত্যেক জিনিস-ই কার্যকারণের মাধ্যমে সৃষ্টি করেন।
উদাহারণস্বরূপ, আগুন দহন করে। বাস্তবে আল্লাহ্ পাক একাই দহন সৃষ্টি করেন। দহনের ব্যাপারে আগুনের স্বতন্ত্র কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু আল্লাহতায়া'লার আদত (স্বাভাবিক রীতি/প্রথা) এমনই যে, আগুন কোনো কিছু স্পর্শ না করলে তিনি দহন সৃষ্টি করেন না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতায়া'লা একাই দহন করে থাকেন। তিনি আগুন ছাড়াও দহন সৃষ্টি করতে সক্ষম, কিন্তু এটা তাঁর স্বাভাবিক রীতি যে তিনি আগুন দ্বারা-ই দহন করে থাকেন। যদি তিনি দহন না করার এরাদা করেন, তবে আগুনেও দহন অসম্ভব। তিনি হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام)-কে আগুনে দহন করেননি। যেহেতু তিনি তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, সেহেতু তিনি তাঁর স্বাভাবিক রীতিকে নাকচ করেছিলেন।
যদি আল্লাহতায়া'লা এরাদা করতেন, তাহলে তিনি কোনো কার্যকারণ ছাড়াই সকল বস্তু সৃষ্টি করতে পারতেন; দহন ব্যতিরেকে আগুন, খাদ্য ছাড়া ভরণপোষণ সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি মানুষদেরকে কোনো না কোনো মাধ্যম দ্বারা সৃষ্টি করার নেয়ামত দান করেছেন। তিনি কোনো বিশেষ বস্তুকে কোনো বিশেষ মাধ্যম দ্বারা সৃষ্টির এরাদা করেছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে মধ্যস্থতাকারী বস্তুর অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছেন। যে ব্যক্তি তাঁর কাছ থেকে কোনো কিছু সৃষ্টির আশা করেন, তিনি মাধ্যমের শরণাপন্ন হন এবং তা হাসিল করেন।
যদি আল্লাহতায়া'লা মধ্যস্থতা দ্বারা তাঁর কর্ম সৃষ্টি না করতেন, তবে কাউকেই কারো প্রয়োজন হতো না; সকলেই আল্লাহর কাছ থেকে সরাসরি প্রার্থনা করতো এবং কোনো কিছুর শরণাপন্ন হতো না। মানুষের মাঝে সামাজিক সম্পর্ক আর থাকতো না, যথা – মুরব্বি ও শিষ্য, শ্রমিক ও তত্ত্বাবধায়ক, ছাত্র ও শিক্ষক ইত্যাদি। ফলে এই পৃথিবী ও পরবর্তী জগত বিশৃংখল হয়ে যেতো এবং সুন্দর ও কুৎসিত, ভালো ও মন্দ, বাধ্য ও অবাধ্যের মধ্যে কোনো পার্থক্যই থাকতো না।
যদি আল্লাহতায়া'লা এরাদা করতেন, তবে তিনি তাঁর আদত অন্য কোনো পন্থায় সৃষ্টি করতেন এবং প্রতিটি বস্তুকে এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে সৃষ্টি করতেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি তিনি এরাদা করতেন, তাহলে তিনি এই দুনিয়ার মোহাচ্ছন্ন, মানুষের প্রতি অত্যাচারী, বে-ঈমান কাফেরদেরকে বেহেস্তে প্রবেশাধিকার দিতে পারতেন এবং ঈমানদার, সৎকর্মশীল ও দানশীলদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কতে পারতেন। কিন্তু আয়াত ও হাদীসসমূহ প্রতিভাত করে যে তিনি এ রকম এরাদা করেন নি।
মানুষের সকল ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত কর্ম ও তৎপরতার স্রষ্টা হলেন আল্লাহতায়া'লা। তিনি মানবের মধ্যে তার ইচ্ছাকৃত কর্মকাণ্ড সৃষ্টির লক্ষ্যে এরাদা (আংশিক স্বাধীন ইচ্ছা) সৃষ্টি করে দিয়েছেন, যাতে করে এর মাধ্যমে মানুষ তার কর্ম সংঘটন করতে সক্ষম হয়। যখন মানুষ কোনো কিছু করতে চায়, তখন আল্লাহতায়া'লা ইচ্ছা করলে তা সৃষ্টি করে দেন। যদি মানুষ না চায় এবং আল্লাহ পাকও এরাদা না করেন, তবে তিনি সৃষ্টি করেন না। আল্লাহতায়া'লা শুধু মানুষের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতেই সৃষ্টি করেন না, বরং তাঁর ইচ্ছানুযায়ীও সৃষ্টি করেন। আল্লাহতায়া'লার সৃষ্ট মানুষের ইচ্ছাকৃত কর্মগুলোর উপমা হলো আগুনের মতোই, যা কোনো বস্তু স্পর্শ করলে তিনি দহন সৃষ্টি করে দেন; আর আগুন স্পর্শ না করলে তিনি দহন সৃষ্টি করেন না। একইভাবে যখন ছুরি কোনো বস্তু স্পর্শ করে, তখন তিনি কর্তন সৃষ্টি করে দেন। ছুরিটি নয়, বরং তিনি-ই কর্তন করেন। কর্তনের জন্যে ছুরিটিকে তিনি একটি মাধ্যম বানিয়েছেন। আরেক কথায়, তিনি মানুষের ইচ্ছাকৃত কর্মগুলো তাদের ইচ্ছার কারণে (সাবাব) সৃষ্টি করে দেন। তবে প্রকৃতির কর্মকাণ্ড মানুষের ইচ্ছাধীন নয়, বরং আল্লাহতায়া'লা যখন ইচ্ছা করেন তখন-ই অন্যান্য কার্যকারণ দ্বারা তা সৃজিত হয়। আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনো স্রষ্টা নেই। তিনি-ই সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, অণুকণা, জীবকোষ, জীবাণু ও তাদের উপাদান সৃষ্টি করেছেন। তথাপি মানুষ ও প্রাণীদের ইচ্ছাধীন কর্মের সাথে প্রাণহীন বস্তুসমূহের কর্মকাণ্ডের পার্থক্য বিরাজ করছে; যখন কোনো মানুষ কিংবা কোনো প্রাণী কোনো কাজ করতে ইচ্ছা পোষণ করে, তখন খোদা তায়া'লা ইচ্ছা করলে সেই মানুষ কিংবা সেই প্রাণীকে কর্ম সংঘটনের ক্ষমতা মঞ্জুর করেন এবং তিনি তা সৃষ্টি করে দেন। মানুষের ক্রিয়া তার ক্ষমতাধীন নয়। প্রাণহীন (জড়) বস্তুসমূহের ক্ষেত্রে কোনো ইচ্ছা বা পছন্দ সেগুলোর নেই। আল্লাহতায়া'লা আগুনের স্পর্শের মাধ্যমে দহন সৃষ্টি করেন, কিন্তু এতে আগুনের কোনো ইচ্ছা বা পছন্দ নেই।
দুটি কারণে মানুষের ইচ্ছাধীন কর্ম সংঘটিত হয়। প্রথমতঃ মানুষের ইচ্ছা ও ক্ষমতা এর সাথে জড়িত। এ কারণে মানুষের কর্মকাণ্ডকে ’কাসব’ (অর্জন) বলে, যা মানুষের একটি গুণবিশেষ। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহতায়া'লার সৃষ্টি প্রক্রিয়া জারি হয়। মানুষকে ’কাসব’ মঞ্জুর করার জন্যেই আল্লাহতায়া'লার আদেশ-নিষেধ, পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
❏ সুরা সফফাত ৯৬ নং আয়াতে আল্লাহ্ পাক এরশাদ ফরমান, وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ
— আল্লাহতায়া'লা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তোমাদের ক্রিয়াও সৃষ্টি করেছেন” ।
🔺[২৭] আল কুরআন : আস সফফাত, ৩৭:৯৬।
এ আয়াতটি মানুষের মধ্যে কাসব বা ’এরাদাত-এ-জুযিয়্যার’ (আংশিক স্বাধীন ইচ্ছার) অস্তিত্ব এবং চাপ প্রয়োগের অনস্তিত্ব-ই কেবল প্রতিভাত করে না — যার দরুন ক্রিয়াসমূহ মানুষের প্রতি আরোপিত হয় ও বলা হয় যে “মানুষের কর্ম সংঘটন” — বরং আয়াতটি আরো প্রতিভাত করে যে সকল জিনিস কাযা ও কদরসহ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে।
মানুষের দ্বারা ক্রিয়া সৃষ্টির জন্যে প্রথমে তার ইচ্ছার প্রয়োজন হয়। এ ইচ্ছাকে কাসব (অর্জন) বলে। মরহুম আমিদী বলেছেন যে, ক্রিয়া সৃষ্টির ক্ষেত্রে কাসব প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু এ কথা বলা ভুল নয় যে একটি ইচ্ছাকৃত ক্রিয়া সৃষ্টির ক্ষেত্রে কাসব কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না – যেহেতু মানুষের ইচ্ছাকৃত ক্রিয়াটি এবং সৃষ্ট ক্রিয়াটি একে অপর থেকে ভিন্ন নয়। অতএব, মানুষ যা কিছু চায়, তার সব-ই সে করতে পারে না। সে যা কামনা করে না তাও সংঘটিত হতে পারে। যদি মানুষ যা চাইতো, তাই করতে সক্ষম হতো এবং যদি সে যা চাইতো না তা সংঘটিত না হতো, তবে সে আর মানুষ থাকতো না, বরং খোদা দাবিদার হতো। আল্লাহতায়া'লা তাঁর সৃষ্ট মনুষ্য জাতিকে দয়া করে তাঁর আদেশ-নিষেধ মান্য করার মতো শক্তি-সামর্থ্য প্রদান করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্যবান ও ধনাঢ্য ব্যক্তি জীবনে একবার হজ্জ করতে সক্ষম; আকাশে রোজার চাঁদ দেখার পর তিনি বছরে এক মাস রোযা রাখতে সক্ষম; তিনি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরযকৃত নামায আদায় করতে পারঙ্গম; নিসাবের পরিমাণ সম্পদ অথবা সম্পত্তি থেকে শতকরা আড়াই ভাগ তিনি গরিব মুসলমানদের মাঝে যাকাত দান করতে সমর্থ। অতএব, মানুষ ইচ্ছা করলেই ইচ্ছাধীন ক্রিয়া সংঘটন করে, আর ইচ্ছা না করলে তা করে না। আল্লাহ্ পাকের মাহাত্ম্য এখানেও উপলব্ধি করা যায়। যেহেতু অজ্ঞ ও আহাম্মকেরা কাযা ও কদরের জ্ঞান উপলব্ধি করতে অক্ষম, সেহেতু তারা আহলে সুন্নাতের উলামামণ্ডলী যা বলেছেন তা বিশ্বাস করে না এবং মানুষের ক্ষমতা ও (আংশিক) স্বাধীন ইচ্ছাকে সন্দেহ করে। তারা মনে করে যে মানুষ তার ইচ্ছাধীন ক্রিয়া সংঘটনের ক্ষেত্রে অপারগ বা প্রভাবিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষকে স্বাধীনভাবে কর্ম সংঘটন করতে অক্ষম দেখে তারা আহলে সুন্নাতকে গালমন্দ করে থাকে। তাদের এই ভ্রান্ত আচরণ প্রতিভাত করে যে তাদেরও স্বাধীন ইচ্ছা ও পছন্দ-অপছন্দ আছে।
একটি ক্রিয়া সংঘটন করা বা না করার ক্ষমতা হলো কুদরত-এর বিষয়। একটি ক্রিয়া সংঘটন করা বা না করার ইচ্ছাকে এরাদা বলা হয়। কোনো কিছুকে গ্রহণ করা বা অস্বীকৃতি না জানানোকে বলা হয় রেযা (সম্মতি)। যখন কোনো কিছুতে ইচ্ছার প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার শর্তে ক্ষমতা ও ইচ্ছা মিলিত হয়, তখন খালক্ (সৃষ্টি) সংঘটিত হয়। যদি প্রভাব বিস্তার ছাড়াই তারা উভয়ে মিলিত হয়, তবে এটাকে বলা হয় কাসব। যদি প্রভাব বিস্তার করা কিংবা না করা কোনো শর্ত না হয়, তবে এটাকে বলা হয় এখতেয়ার। ইচ্ছা পোষণকারী যে কেউই স্রষ্টা নয়। অনুরূপভাবে, ইচ্ছাকৃত সকল বিষয়ে সম্মতি দেয়াও অত্যাবশ্যক নয়। এখতেয়ার ও কাসব (অর্জন) এক সাথে থাকতে পারে। আবার এখতেয়ার ও সৃষ্টিও এক সাথে থাকতে পারে। এ কারণেই আল্লাহতায়া'লাকে খালেক (স্রষ্টা) ও মোখতার (এখতেয়ারসম্পন্ন) বলা হয়; আর মানুষকে বলা হয় কাসেব (অর্জনকারী) ও মোখতার (এখতেয়ার সম্পন্ন)।
আল্লাহতায়া'লা তাঁর বান্দাদের এবাদত ও গুণাহসমূহ এরাদা ও সৃষ্টি করেন। তথাপি তিনি এবাদত-বন্দেগী পছন্দ করেন এবং গুণাহ-খাতা অপছন্দ করেন। তাঁর চূড়ান্ত ইচ্ছা (এরাদা) ও সৃষ্টির দ্বারা-ই সকল বস্তু অস্তিত্ব পায়।
❏ সুরা আন’আমের ১০২ নং আয়াতে তিনি এরশাদ ফরমান, لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ–
“নেই কোনো উপাস্য তিনি ব্যতিরেকে; একমাত্র তিনি-ই সব কিছুর স্রষ্টা” ।
🔺[২৮] আল কুরআন : আল আন’আম, ৬:১০২।
মো’তাযেলা সম্প্রদায় এরাদা (ইচ্ছা) ও রেযা (সম্মতি)-র মধ্যে পার্থক্য বুঝতে অপারগ হয়ে বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকা পড়ে গিয়েছিল এবং বলেছিল, “মানুষ নিজেই তার ইচ্ছানুযায়ী ক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে।” ফলে তারা কাযা এবং কদরকে অস্বীকার করে বসে। জবরীয়্যা সম্প্রদায় ছিল পুরোপরিভাবে বিভ্রান্ত। তারা বুঝতে পারে নি যে সৃষ্টি ছাড়াও এখতেয়ার বিরাজ করতে পারে। মানুষের মধ্যে কোনো এখতেয়ার নেই ধারণা করে তারা মানুষকে কাঠ ও পাথরের সাথে তুলনা করেছিল। তারা বলেছিল, “মানুষ পাপী নয়; আল্লাহতায়া'লাই সকল পাপ সংঘটন করেন” (আল্লাহ্ মাফ করুন!)। যদি মানুষের মধ্যে কোনো ইচ্ছা ও এখতেয়ার না থাকতো এবং যদি জবরীয়্যা সম্প্রদায়ের কথা মতো আল্লাহতায়া'লাই ক্ষমতাবলে বদকর্ম ও পাপ সংঘটন করতেন, তাহলে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাহাড় থেকে ফেলে দেয়া মানুষটি এবং চারদিক লক্ষ্য করে হেঁটে নেমে যাওয়া মানুষটির মধ্যে কোনো পার্থক্যই থাকতো না। অথচ প্রথমজন ক্ষমতার জোরে গড়িয়ে নামছে, আর দ্বিতীয়জন তার ইচ্ছা ও এখতেয়ারসহ নামছে। যারা এদের মধ্যকার পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারে না, তারা অদূরদর্শী এবং কুরআনের আয়াতসমূহে অবিশ্বাসকারীও। তারা আল্লাহ্ পাকের আদেশ-নিষেধকে অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক মনে করে। মো’তাযেলা ও কাদারীয়্যা সম্প্রদায়ের ধারণানুযায়ী যদি মনে করা হয় যে মানুষ নিজেই তার ইচ্ছা হতে সৃষ্টি করে, তাহলে নিম্নোক্ত আয়াতটি অবিশ্বাস করা হয়, যা ঘোষণা করে,
هُوَ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ –
❏ “আল্লাহ্ একাই সকল বস্তুর স্রষ্টা”।
🔺[২৯] আল কুরআন : আল আন’আম, ৬:১০২।
পাশাপাশি এর দরুন মানুষকেও আল্লাহর শরীকদার বানানো হয়।
মো’তাযেলার মতো শিয়া সম্প্রদায়ও বলে যে মানুষ যা চায়, তা-ই সে সৃষ্টি করতে সক্ষম। এর সমর্থনে তারা বলে যে গাধা যতোই মার খাক না কেন, কখনোই খাল পার হয় না। অথচ তারা একবারও ভেবে দেখে না যে মানুষ যদি কিছু করার ইচ্ছা করে এবং তাতে যদি আল্লাহর ইচ্ছা না থাকে, তাহলে এ দুটো ইচ্ছা এক সাথে হতে পারে না। যদি আল্লাহতায়া'লার এরাদা সংঘটিত হয়, তবে শিয়ারা যা বলছে তা ভ্রান্ত। অর্থাৎ, মানুষ যা চায়, তার সবই সৃষ্টি করতে বা সংঘটন করতে সে পারে না। যদি মানুষের ইচ্ছানুযায়ী সব কিছু ঘটতো যা শিয়ারা দাবি করছে, তাহলে আল্লাহতায়া'লা অক্ষম ও ব্যর্থ হতেন (আল্লাহ্ মাফ করুন!)। কিন্তু তিনি তো অক্ষম নন। শুধু তিনি যা এরাদা করেন, তা-ই সংঘটিত হয়। একমাত্র তিনি-ই সকল জিনিসের স্রষ্টা। আর এটাই আল্লাহতায়া'লার সত্তা মোবারক। “মানুষ এটা সৃষ্টি করেছে” কিংবা “আমরা এটা সৃষ্টি করেছি” কিংবা “তারা এটা সৃষ্টি করেছে” ইত্যাদি কথার মতো কথা বলা অথবা লিখা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। আল্লাহতায়া'লার প্রতি এটা দুর্ব্যবহার (হাকিকী অর্থে সৃষ্টি ক্ষমতা যেহেতু তাঁরই)। বস্তুতঃ এটা কুফর বা অবিশ্বাসের জন্ম দেয়।
= সমাপ্ত =