কিতাবঃ ফতোয়ায়ে আজিজি (২য় খন্ড)
রচনায়ঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল্-কাদেরী
প্রকাশনায়ঃ আন্জুমানে কাদেরীয়া চিশ্তীয়া আজিজিয়া, বাংলাদেশ
গ্রন্থ স্বত্বঃ লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সার্বিক তত্ত্বাবধানেঃ
প্রফেসর ড. আবুল ফাতাহ মোহাম্মদ মহিউদ্দীন
অধ্যক্ষ আল্লামা আবুল ফরাহ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দীন
অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল ফছিহ মোহাম্মদ আলাউদ্দীন
অনুবাদঃ
মুহাম্মদ আবদুল অদুদ
উপাধ্যক্ষ- ছিপাতলী জামেয়া গাউছিয়া মূঈনীয়া আলিয়া মাদ্রাসা
আর্থিক সহযোগিতায়ঃ
হাজী মুহাম্মদ ইলিয়াস আলী
টেক্সট রেডীঃ
মুহাম্মদ সিরাজুম মুনির তানভীর ও মাসুম বিল্লাহ সানি
সূচীপত্রঃ প্রশ্ন
ঈমান ও আক্বীদার বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১ঃ ‘তাওহীদে উলূহিয়্যাত’ বা আল্লাহ'র একত্ববাদের ওপর ঈমান আনার মমার্থ ও উদ্দেশ্য কি?
❏ প্রশ্ন-২ঃ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর ওপর ঈমান আনার মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কি?
❏ প্রশ্ন-৩ঃ আল্লাহ্ তা‘আলার সত্তা ও গুণাবলীতে মুহাব্বত ও ভালবাসার মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কী?
❏ প্রশ্ন-৪ঃ ‘ইরাদা-ই ইলাহি’ বা ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ কাকে বলে? এর মর্মার্থ কী?
❏ প্রশ্ন-৫ঃ لَا اِلٰه اِلّا هُو‘’ বাক্যে هو‘ সর্বনামের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কী?
❏ প্রশ্ন-৬ঃ তাওহীদের ভিত্তি কিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ?
❏ প্রশ্ন-৭ঃ ‘আল্লাহ্’ (اللهُ) শব্দটি প্রকৃত মাবুদের সত্তাগত নাম, না গুণবাচক নাম?
❏ প্রশ্ন-৮ঃ তাওহীদ ও ‘তাওহীদে রাবুবিয়্যাত’-এর সংজ্ঞা কী?
❏ প্রশ্ন-৯ঃ ‘দ্বীন’ দ্বারা কী উদ্দেশ্য এবং দ্বীন ও মাযহাবের মধ্যে কী পার্থক্য?
ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ৭৩ দলে বিভক্ত হওয়ার বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১০ঃ ইসলামের ৭৩ দলগুলো কি কি?বর্ণনা করো।
মোস্তফা (ﷺ)-এর ফযিলত ও বৈশিষ্ট্যাবলীর বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১১ঃ মোস্তফা (ﷺ) এর ইচ্ছানুযায়ী তিন ওয়াক্ত নামায না পড়ার অনুমতি সাপেক্ষে ইসলাম কবুল করা কিভাবে হলো?
❏ প্রশ্ন-১২ঃ হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)-এর আসরের নামায ও সূর্য পুনরায় উদিত হওয়ার প্রমাণ সম্পর্কে মতামত কি?
❏ প্রশ্ন-১৩ঃ মি‘রাজ কতবার হয়েছে? কখন এবং কোন তারিখে সংঘটিত হয়েছে?
❏ প্রশ্ন-১৪ঃ মি‘রাজ শরীফ রাত্রে কেন হয়েছে?
❏ প্রশ্ন-১৫ঃ হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)’র জন্য রদ্দুস শামস বা সূর্য পুনরায় উদিত হওয়া সংক্রান্ত ঘটনাটি কি?
❏ প্রশ্ন-১৬ঃ যদি হুযূর(ﷺ)কে স্বপ্নযোগে শরীয়ত বিরোধী কোন হুকুম প্রদান করতে দেখলে এর হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-১৭ঃ عيد (ঈদ) অর্থ কী? ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা ছাড়া অন্য কোন ঈদ হতে পারে?
❏ প্রশ্ন-১৮ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ) এর পবিত্র জীবনী ও বংশধারা নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীর উদ্ধৃতিসহ দাও।
❏ প্রশ্ন-১৯ঃ হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ)-এর সম্মানিত মাতা-পিতার মধ্যকার বিশেষ বংশীয় সম্পর্ক কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-২০ঃ হুযূর তাঁর সম্মানিত পিতার ইন্তিকালের কতদিন পর এ ধরাধামে তাশরীফ আনেন?
❏ প্রশ্ন-২১ঃ হুযূর ইহ জগতে তাশরীফ আনয়নের মাস, দিন ও বছর কী ছিল?
❏ প্রশ্ন-২২ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ) -এর মুরদি‘আ বা দুধপানকারীনী মাতাগণের বরকতময় নাম কি কি?
❏ প্রশ্ন-২৩ঃ হুযূর (ﷺ) রেযায়ী বা দাইমাগণের তত্ত্বাবধানে কতো দিন ছিলেন?
❏ প্রশ্ন-২৪ঃ হুযূর (ﷺ)-এর শৈশবকাল কীভাবে অতিবাহিত হয়?
❏ প্রশ্ন-২৫ঃ হুযূর (ﷺ)-এর কফীল বা অভিভাবক কে কে ছিলেন এবং তাদের নিকট কতো দিন ছিলেন?
❏ প্রশ্ন-২৬ঃ হযরত সায়্যিদাতুনা খাদিজাতুল কুবরা (رضى الله تعالي عنها) সঙ্গে বিবাহ এবং তাঁর সিরিয়া সফর কখন হয়?
❏ প্রশ্ন-২৭ঃ ওহি নাযিল কখন থেকে আরম্ভ হয়?
❏ প্রশ্ন-২৮ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর মি‘রাজ কখন সংঘটিত হয়?
❏ প্রশ্ন-২৯ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর হিজরতের বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-৩০ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ) পবিত্র মক্কায় কতোদিন অবস্থান করেন এবং কখন মদিনায় হিজরত করেন?
❏ প্রশ্ন-৩১ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-৩২ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় যুদ্ধের সংখ্যা কত ছিল ?
❏ প্রশ্ন-৩৩ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর সম্মানিত বিবিগণের সংখ্যা এবং তাঁদের নাম মুবারক কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-৩৪ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর বাঁদী বা ক্রীতদাসী কতজন ছিলেন এবং তাঁদের নাম কি ছিল ?
❏ প্রশ্ন-৩৫ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর আওলাদ বা সন্তান-সন্ততি কতজন ছিলেন?
❏ প্রশ্ন-৩৬ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর ঘোড়াগুলোর নাম কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-৩৭ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর যুদ্ধাস্ত্রের নাম কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-৩৮ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর ধনুকের সংখ্যা কত ছিল?
❏ প্রশ্ন-৩৯ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর যুদ্ধের পোশাক সংখ্যা কত ছিল?
❏ প্রশ্ন-৪০ঃ হযরত যয়নব বিনতে জাহাশের নাম পরিবর্তন করার কারণ কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-৪১ঃ হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ) -এর শাহজাদীগণের মাঝে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ কে ছিলেন?
❏ প্রশ্ন-৪২ঃ দু’জাহানের সরদার হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর সম্মানিতা মাতা কখন এবং কোথায় ইন্তিকাল করেন?
❏ প্রশ্ন-৪৩ঃ ‘আহমদ’ এটা কার নাম ? বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-৪৪ঃ মাওলাদ বা জন্মস্থান ও জন্ম তারিখ দ্বারা উদ্দেশ্য কি বর্ণনা কর?
❏ প্রশ্ন-৪৫ঃ সিদরাতুল মুন্তাহা ও সিদরাতুন নবী কাকে বলে এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কি?
❏ প্রশ্ন-৪৬ঃ ‘বাহ্যিক দৃষ্টিতে আদম (عليه السلام) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আদম (عليه السلام)-এর পিতা।’ উক্ত বাণীর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মর্মার্থ কি?
❏ প্রশ্ন-৪৭ঃ সরকারে দু’আলম (ﷺ)-এর পবিত্র জানাযায় কোন নির্দিষ্ট ইমাম ছিলেন কি না?
❏ প্রশ্ন-৪৮ঃ হুযূর আক্বদাস (ﷺ)-এর পবিত্র জানাযায় ইমামতি না হওয়ার হিকমত কী ছিল?
❏ প্রশ্ন-৪৯ঃ হুজুর আক্বদাস (ﷺ) পবিত্র অন্তিম রোগ শয্যায় কোন কোন বিষয়ে অসিয়ত করেছিলেন?
ঈমান ও আক্বীদার বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১ঃ ‘তাওহীদে উলূহিয়্যাত’ বা আল্লাহ'র একত্ববাদের ওপর ঈমান আনার মমার্থ ও উদ্দেশ্য কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ আল্লাহ্ তা‘আলাকে প্রকৃত মাবুদ, একমাত্র উপাস্য হিসেবে মান্য করা, আল্লাহ্ পাককে এক ও অদ্বিতীয় জানা, যার কোন অংশীদার নেই, একথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা- প্রথম ফরয ও ঈমানের মূলভিত্তি। যেহেতু আল্লাহ্ এক, তাঁর কোন শরীক নেই। না সত্তায়, না গুণাবলীতে, এমনকি তাঁর নামে, কর্মে, আদেশে ও রাজত্বে,বাদশাহীতে সকল ক্ষেত্রে তিনি একক। এতে কারো অংশীদারিত্ব নেই। আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেক সৌন্দর্য ও উৎকর্ষতার পরিপূরক। তাঁর সকল গুণাবলী সম্পূরক। তিনি যে কোন ধরনের দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র। দোষ-ত্রুটি তাঁর মধ্যে পাওয়া অসম্ভব। বরং যেসব বিষয় সম্পূরক নয়, ত্রুটি মুক্তও নয়- সেটাও তাঁর সত্তায় অসম্ভব। কোন বিষয়ে কেউ তাঁর শরীক নেই। ঐ মহান সত্তা প্রত্যেক বস্তুর ওপর ক্ষমতাবান। তিনি প্রত্যেক সম্ভাব্যের ওপর ক্ষমতা রাখেন। কোন সম্ভাব্য বস্তু তাঁর ক্ষমতা বর্হিভূত নহে। তাঁরই ক্ষমতা প্রত্যেক অস্তিত্বশীল ও অস্তিত্বহীন সকল বস্তুর ওপর বিরাজমান। এমনকি কোন নশ্বর ও সম্ভাব্য বস্তুও তাঁর ক্ষমতার বর্হিভূত নহে। অর্থাৎ আল্লাহ'র পক্ষে সবই সম্ভব। সম্ভব নয় এমন কিছু থেকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু পবিত্র। আর অসম্ভব বলতে যা কখনো অস্তিত্বে আসে নাই।
❏ প্রশ্ন-২ঃ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর ওপর ঈমান আনার মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কি? বিস্তারিতভাবে বর্ণনা কর?
✍ উত্তরঃ
صَلَّى اللهُ عَلَيْكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ وَعَلٰى اٰلِكَ وَاَصْحَابِكَ اَجْمَعِيْنَ وَبَارَكَ وَسَلَّمَ
হযরত মুহাম্মদ কে সকল প্রকার পূর্ণাঙ্গ গুণাবলীতে সমগ্র বিশ্ব জগত থেকে একক, স্বতন্ত্র ও অতুলনীয় মনে করা- ফরয এবং নিশ্চিতরূপে ঈমানের অংশ। যা পরিপূর্ণ নাজাত ও আমলসমূহ কবুল হওয়ার মূলভিত্তি। পবিত্র কুরআনে মূলতঃ তাকেই বলা হয়েছে ঈমান। আর ঈমান একথা বলে যে, তিনিই আমার প্রাণ। রিসালতের শান ও মর্যাদা সম্পর্কে এটাই হচ্ছে সারকথা।
তাওহীদ দু’প্রকারঃ
প্রথমতঃ তাওহীদে ইলাহি, তা হচ্ছে- আল্লাহ্ তা‘আলা এক, অদ্বিতীয় তাঁর কোন শরীক নেই। না সত্তাগত ভাবে, না গুণাবলীতে এবং না হুকুমে, না আহকামে- তাঁর কোন শরীক নেই, অংশদারিত্বও নেই।
দ্বিতীয়তঃ তাওহীদে রাসূল, হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁর সকল পরিপূর্ণ গুণাবলীতে ও সুমহান মর্যাদায় উপমাবিহীন ও অতুলনীয় এবং তাঁর তুলনা করাও অসম্ভব। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে অতুলনীয় ও বে-নযীর রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। এমন প্রাণাধিক প্রিয় রাসূলকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন গুণাবলি, সুমহান সৌন্দর্য এবং অতুলনীয় ও প্রশংসনীয় চরিত্র দান করেছেন- যা অন্য কাউকে শরীক করেন নি এবং অন্য কাউকে এ মর্যাদাও দান করেন নি।
আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রত্যেক গুণাবলীর বিকাশস্থল এবং স্বীয় সত্তা ও সকল গুণাবলীর সুমহান আয়না ও প্রতিচ্ছবি হিসেবে পাঠিয়েছেন তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মদ (ﷺ)কে। তাঁর গুণাবলীতে অদ্বিতীয় ও একক হিসেবে বানিয়েছেন এবং সুমহান গুণাবলীতেও তুলনাবিহীন ও বে-মেছাল গুণের অধিকারী করে শরীকমুক্ত ও পবিত্র করেছেন। হযরত ইমাম শরফুদ্দীন বুসিরী (رحمه الله تعالي ) স্বীয় ‘কাসীদা-ই বুরদা শরীফে’ কতই না সুন্দর বলেছেন,
مُـنَزَّهٌ عَنْ شَرِيْكٍ فِىْ مُحَاسِـنِـهٖ
فَجَـوْهَرُ الْحُسْنِ فِـيْهِ غَيْرُ مُنْـقَسِمٖ .
‘হুযূর আক্বদাস (ﷺ) -এর স্বীয় গুণাবলী ও সৌন্দর্য অন্য কারো অংশীদারিত্ব থেকে পুতঃপবিত্র। মোস্তফা (ﷺ)-এর মাঝে যে অতুলনীয় সৌন্দর্য রয়েছে তা অবিভক্ত ও অবিচ্ছেদ্য।’
❏ প্রশ্ন-৩ঃ আল্লাহ্ তা‘আলার সত্তা ও গুণাবলীতে মুহাব্বত ও ভালবাসার মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কী?
✍ উত্তরঃ وبالله التوفيق অধিকাংশ যুক্তিবিদগণ বলেন, মুহাব্বত হচ্ছে ইরাদা বা ইচ্ছার একটি প্রকার। আর ইরাদা বা ইচ্ছার সম্পর্ক কেবল সম্ভাব্য বিষয়ের সাথে হয়। এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলার সত্তা ও গুণাবলীর সঙ্গে মুহাব্বতের সম্পর্ক অসম্ভব। তাই আমরা যখন একথা বলি, আমরা আল্লাহকে ভালবাসি; তখন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে- আমরা আল্লাহর আনুগত্য ও খিদমত অথবা আল্লাহ প্রদত্ত সওয়াব, প্রতিদান ও দয়াকে ভালবাসি।
"সুফিয়ায়ে কিরামগণ বলেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা শুধুমাত্র তাঁর সত্তার কারণে ভালবাসেন এবং তাঁর প্রদত্ত খিদমত, সওয়াব ও প্রতিদানকে মুহাব্বত করা মানে তাঁর দেওয়া ইহসান ও সওয়াবের স্বাদ গ্রহণ করা। এ স্বাদ ও দুঃখ-দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া তাঁর আনুগত্য ও খিদমতের ওপর নির্ভরশীল। এজন্যে আমরা আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্য করাকে ভালবাসি। আর এটাই হলো আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভালবাসার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও মর্মার্থ। যেমন- আমরা বলি যে, আমরা হযরত ইমাম আবু হানিফা এবং হযরত ইমাম শাফেঈ রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমাসহ অন্যান্য সকল ইমামকে ভালবাসি- এটা তাঁদের ইলম ও ফিক্হ শাস্ত্রে পান্ডিত্য ও গভীর জ্ঞানের কারণে। অনুরূপভাবে কেউ যদি বলেন- বেলায়তের অধিকারী অমুক ওলীকে মুহাব্বত করি- এটা তাঁর ইবাদত, রিয়াযত, তাকওয়া পরহেযগারীর কারণে। মানুষ হাতেম তাঈকে তাঁর দানশীলতা ও বদান্যতার কারণে ভালবাসে। পরম সুন্দর ও লাবণ্যময় ব্যক্তিকে তার সৌন্দর্যের কারণে মুহাব্বত করে। রাজা-বাদশা ও আমীর-ওমারাদেরকে ভালবাসে তাঁদের বীরত্ব, সাহসিকতা, নির্ভীকতা ও রাজনীতির কারণে। কিন্তু উপরিউক্ত সকল গুণাবলী পরিপূর্ণতার সাথে সত্তাগতভাবে একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার জন্যেই নিহিত; অন্যান্যদের গুণাবলী সত্তাগত নয়। তাই কাউকে যদি পরিপূর্ণ গুণাবলীর কারণে ভালবাসতে হয়, তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলাই এর পরিপূর্ণ ও অধিক হকদার। কারণ পরিপূর্ণ গুণাবলীর অধিকারী সত্তাগতভাবে একমাত্র আল্লাহই।"
1. তাফসীরে রাযী এবং যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা গোলাম রাসুল সাঈদি হানাফি চিশ্তি ছারেবী (رحمة الله)
❏ প্রশ্ন-৪ঃ ‘ইরাদা-ই ইলাহি’ বা ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ কাকে বলে? এর মর্মার্থ কী? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ قصد (কসদ) ও مرضى (মরযী) উভয়টি সমার্থক শব্দ। অর্থঃ ইচ্ছে করা, মর্জি বা আত্মার চাহিদা। আত্মা নিজ উদ্দেশ্য ও পছন্দনীয় দিক থেকে ফিরে গিয়ে আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুম পালনে লিপ্ত হওয়া।
আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছা নশ্বর নয়, অবিনশ্বর ও শাশ্বত। তাঁর ইচ্ছাশক্তি প্রত্যেক বিদ্যমান বস্তুর সাথে সম্পর্কিত- তা মূল সত্তাগত হোক কিংবা অস্থায়ী, গুণগত ভাল হোক কিংবা মন্দ; কুফরী হোক কিংবা ইসলামী, আনুগত্য হোক কিংবা অবাধ্য। যাই হোক আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোন বস্তু অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না। তাই তাঁর সৃষ্টি বা আবিষ্কার শক্তি প্রত্যেক সম্ভবপর বিষয় অনুপাতে সময়ের বিবর্তনের দরুন মতভিন্নতা ও আলাদা হয় না। ইরাদা বা ইচ্ছা বলা হয় প্রত্যেক অস্তিত্বশীল বস্তুর জন্য সুনির্দিষ্ট করে একটি নির্দিষ্ট সময়, নির্ধারিত সংখ্যা বা পরিমাণ এবং অবস্থা ইত্যাদির নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আল্লাহ'র ইচ্ছা অবশ্যই পূর্ণ হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ'র বাণী,
فَعَّالٌ لِمَا يُرِيْدُ
অর্থাৎ- ‘নিশ্চয়ই তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন’।
2. সূরা বুরূজ, আয়াতঃ ১৬
❏ প্রশ্ন-৫ঃ لَا اِلٰه اِلّا هُو‘’ বাক্যে هو‘ সর্বনামের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কী? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ هو‘ সর্বনামটি (একবচনে নাম পুরুষ, পুংলিঙ্গ) واحد مذكر غائب এর সীগাহ বা পদ। অর্থ- তিনি, বা সে। বর্ণিত আয়াতটি সূরা আলে-ইমরানের প্রথম নির্দেশনা। অর্থাৎ- তিনি ব্যতীত প্রকৃত কোন মাবুদ নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী।
সুফিয়ায়ে কিরামগণের মতে, هو সর্বনামটি মহান আল্লাহ তা‘আলার নির্দিষ্ট নাম, সর্বনাম নহে। তাই অধিকাংশ বুযূর্গানে দ্বীনের যিকর-আয্কারে ও অযিফাতে নামটি সম্বোধন করা হয়। কারো মতে, هو‘ সর্বনামটি মহান আল্লাহর (اسم اعظم) ইসমে আযম। অর্থাৎ- এই ضمير غائب বা সর্বনামের مرجع বা প্রত্যাবর্তনস্থল হলো ‘আল্লাহ’।
❏ প্রশ্ন-৬ঃ তাওহীদের ভিত্তি কিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ?
✍ উত্তরঃ রিসালতের বিশুদ্ধ ও সঠিক ভিত্তির ওপর তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং যার তাওহীদের ভিত্তি রিসালতের বিশুদ্ধ আক্বীদার ওপর প্রতিষ্ঠিত না হবে, তা প্রকৃত তাওহীদ নয়। তাই যার রিসালত সম্পর্কে চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা ভুল হবে, তার তাওহীদও প্রকৃত ইসলামী তাওহীদ নয়। বরং উহা ঐ সকল লোকের তাওহীদ হবে যারা রাসূলে কারীম (ﷺ) -এর আসল পরিচয় সম্পর্কে অবগত না হয়ে কেবল তাকে মাটির মানুষই মনে করে এবং যারা মুস্তফা (ﷺ) কে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল হিসেবে অস্বীকার করেছে, তারা অবশ্যই গোমরাহ, পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত ফেরকা, প্রকৃত তৌহিদপন্থি নহে।
তাই لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ হলো মহান আল্লাহ'র একত্ববাদের দাবী, আর مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ হলেন এ দাবীর প্রকাশ্য ও প্রকৃষ্ট দলিল। অতএব দলিল উপস্থাপনে যদি কোন রকম ভুল-ত্রুটি হয়, তার দাবি উপস্থাপন গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং একথা প্রমাণিত হলো যে, রিসালতের সঠিক ও বিশুদ্ধ আকীদার ভিত্তির ওপর প্রকৃত তাওহীদের ইমারত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যাঁকে আল্লাহ্ তা‘আলা তাওহীদের বাহক হিসেবে বিশ্ব জগতের জন্য রহমতরূপে পাঠিয়েছেন তাঁর জ্যোর্তিময় নূরানী অস্তিত্বকে যারা অস্বীকার করছে এবং পবিত্র কোরআন মাজীদের পরিপন্থী এ ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করছে যে, হুযূর মুস্তফা (ﷺ) মাটির তৈরী আমাদের মতো সাধারণ মানুষ। কিন্তু এসব ভ্রান্ত আক্বীদা সম্পর্কে গভীর দৃষ্টি নিবন্ধ করলে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ সকল মুসিবত, গোমরাহি ও পথভ্রষ্টতা এবং রাসূল কারীম (ﷺ) এর শারীরিক, দৈহিক ও আত্মার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অনবগত ও অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ।
এ সম্পর্কে চার অন্ধের হাতী সম্পর্কে একটি ঘটনা উদাহরণ স্বরূপ উপস্থাপন করা যায়। কথিত আছে যে, চার অন্ধের একজনের হাত হাতীর লম্বা দাঁতের ওপর পড়ল, দ্বিতীয় জনের হাত কানের ওপর, তৃতীয় জনের হাত পায়ের ওপর এবং চতুর্থ জনের হাত তার লেজের ওপর পড়ল। এ চারজনই ভাগ্যের নিমর্মতায় নিজ নিজ জ্ঞানানুসারে তাদের দাবীতে সত্য ছিল। কিন্তু অন্ধত্বের কারণে তারা হাতীর দেহের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারেনি। তাই তাদের প্রত্যেকের দাবী ভুল ও অবাস্তব প্রমাণিত হলো, যা তাদের মতভেদ ও মত পার্থক্যের মূল রহস্য ও কারণ ছিল। অন্ধ লোক সম্পর্কে হাতীর উদাহরণ তো সাধারণ লোকের মধ্যে প্রচলিত আছে।
বেশ কিছু দিন পূর্বে একটি আশ্চার্যজনক ঘটনার অবতারণা হয়েছে যে, লাউড স্পীকার আবিষ্কারের সূচনা থেকেই সাধারণ ওলামায়ে কিরাম ছাড়াও প্রখ্যাত শীর্ষ ও বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরামরাও এ ফতোয়া প্রদান করেন যে, লাউডস্পীকার শুধু বাদ্যযন্ত্র ও খেলা-ধুলার যন্ত্রের নাম। সুতরাং ওয়াজ-নসিহত ও দ্বীন-ধর্মের প্রচারের মতো ভালো কাজে এর ব্যবহার মাকরূহ ও নিষিদ্ধ। অথচ লাউডস্পীকার শুধু আওয়াজ বর্ধক যন্ত্র বৈ আর কিছুই নয়। এটাকে ভাল-মন্দ সব কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
অতএব, পরবর্তীতে আওয়াজ বর্ধক যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধকারী সকল শীর্ষ ওলামায়ে কিরামের ফতোয়া ভুল প্রমাণিত হলো। যার মূল কারণ এটাই ছিল যে, মাইক তৈরীর মূল উদ্দেশ্য ও বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি দেয়া ছাড়াই ফতোয়া দেয়া হয়েছিল। তাই একথা প্রমাণিত হলো যে, মূল উদ্দেশ্য ও বাস্তব বিষয় সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা ছাড়া গতানুগতিক রায় প্রদান করলে, তা যত বড় জ্ঞানী-গুণীর পক্ষ থেকে হোক বা সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে হোক- তা ভুলই প্রমাণিত হবে।
ঠিক একই অবস্থা তাদের যারা রাসূলে কারীম(ﷺ) -এর আসমানী জ্যোর্তিময় আত্মা এবং তাঁর মাটির দেহের বাস্তবিক অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞাত; তারা অনবগতি ও মূর্খতার দরুন বরাবরই অজ্ঞতায় শামিল। তারা সর্বসাধারণ হোক বা সাধারণ লোকের দৃষ্টিতে আলেম-ওলামা হোক। সুতরাং তাদের অজ্ঞতা ও মূর্খতার সুস্পষ্ট দলিল এটাই যথেষ্ট যে, উপরিউক্ত বিষয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। কারো মতে, রাসূল সম্পূর্ণরূপে মাটির মানুষ। আবার কারো মতে, তিনি তো আমাদের মতো সাধারণ মানব কিংবা আমাদের মতো মাটির তৈরী মানুষ। অনুরূপভাবে তারা তাঁর আসমানী নূরানী আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। যা আসমান থেকে নাযিল করা হয় এবং জমিনে মাটির দেহে মানবরূপে গোপন থেকে আল্লাহর ঐশি বাণী প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হয়। ওহীর প্রত্যাদেশ এবং মাটির দেহের সমন্বয়ে অলৌকিক ও অতীব আশ্চার্যজনক মু‘জিযা তাঁর থেকে প্রকাশিত হয়।
অতএব তাদের এ সকল মতামত ও প্রোপাগান্ডা শুধু কিয়াস ও আন্দায নির্ভর কথা-বার্তা। যা মূলতঃ বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। ফলে তারা গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট হয়েছে। কেননা যে সকল কথা কিয়াস ও আন্দায নির্ভর বলা হয়ে থাকে, তা সত্য ও হক্বের মোকাবিলায় অকার্যকর।
যেমন এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,
وَمَا يَتَّبِعُ أَكْثَرُهُمْ إِلَّا ظَنًّا إِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِيْ مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ بِمَا يَفْعَلُوْنَ .
‘ওদের অধিকাংশ অনুমানেরই ভিত্তিতে অনুসরণ করে। সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোন কাজে আসে না। ওরা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা সে বিষয়ে সবিশেষ অবগত।’
3. সূরা ইউনুস, আয়াতঃ ৩৬।
এখন দেখার বিষয় হলো, রাসূল এর হাকিকত এবং তাঁর জাত বা সত্তার আসল ও বাস্তবতা কী? হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ আল্লাহ'র রাসূল। তাঁর পবিত্র দেহ কখনো মানবীয় নয়, বরং আসমানী নূরানী পবিত্র সত্তা। এটাই মূলতঃ তাঁর রূহের বাস্তব রূপ এবং সত্তাগতভাবে নূরানী অস্তিত্ব। যা মানবীয় আসমানী নূরানী অস্তিত্বের চেয়ে অধিক পূতঃপবিত্র। অতএব রাসূলে পাক এর আসমানী নূরানী আত্মা দ্বারা তাঁর আসমানী নূরানী অস্তিত্ব উদ্দেশ্য; আর এটাই হলো রাসূল সত্তার মূল হাকিকত। কেননা মানবীয় মাটি-পানি পঞ্চইন্দ্রীয় দ্বারা সৃষ্ট দেহের হাকিকত মাটিই হয়ে থাকে। যেহেতু রাসূলে পাক এর রূহ মুবারক ঊর্ধ্বজগতের- মাটি ও পানি থেকে নয়; ফলে তা সৌন্দর্যের বিষয়ও হতে পারে না। তাঁর আত্মা হলো আসমানি যাকে মানবীয় আত্মাও বলা যায়। বাস্তবিক পক্ষে ওটাই মানবজাতির মূল হাকিকত। অনুরূপভাবে রাসূলে পাক-এর প্রকৃত সত্তা কখনো মানবীয় দেহ নয়।
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেন, وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُوْلٌ ‘মুহাম্মদ ইলাহ বা মাবুদ নন বরং মানব আকৃতিতে প্রেরিত আল্লাহর রাসূল। এভাবেও বলা যায় যে, মুহাম্মদ আল্লাহ'র বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ্ ও বান্দার মধ্যকার আড়াল বা আবরণের নাম রাসূল। যাকে برزخ كبرىٰ ‘বরযখে কুবরাও’ বলা যায়। আল্লাহ্ তা‘আলার পরিচিতি লাভ এবং তাঁর তাওহীদ বা একত্ববাদের কেন্দ্রবিন্দুর নাম রিসালত বা বরযখে কুবরা, বা তাঁর গোপন রহস্যের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এবং এটাকে قصر اضافىও বলা যায়।
قصر اضافى অর্থাৎ- قصر الموصوف على الصفة-এর ব্যাখ্যা হলো- তিনি মাবুদ, ইলাহ বা রাব্বুল আলামীন নন, বরং তিনি হলেন- রাহমাতুলিল আলামিন (বিশ্বজগতের জন্য রহমত), শফিউল মুয্নিবীন (পাপীদের সুপারিশকারী) এবং খাতামুন নাবীয়্যীন (সর্বশেষ নবী)।
❏ প্রশ্ন-৭ঃ ‘আল্লাহ্’ (اللهُ) শব্দটি প্রকৃত মাবুদের সত্তাগত নাম, না গুণবাচক নাম? যুক্তি ও বর্ণনা ভিত্তিক দলিল দ্বারা আলোচনা কর?
✍ উত্তরঃ هو المعين والمستعان আল্লাহ্ (اللهُ) অর্থ- খোদা, মাবুদ যা আল্লাহ্ তা‘আলার সত্তাগত নাম হিসেবে স্মরণ করা হয়। যদিও এতে গুণবাচক অর্থ বিদ্যমান আছে। সে নিরিখে এটাকে আল্লাহ'র গুণবাচক নাম হিসেবে গণ্য করা উচিত, কিন্তু সকল ওলামায়ে কিরাম এটা আল্লাহ'র সত্তাগত নাম হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উক্ত নাম সত্তাগতভাবে উল্লেখিত হয়েছে। বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরাম এর অর্থ এভাবে বর্ণনা করেছেন, هو ذات واجب الوجود المستجمع لجميع صفات الكمال ‘তিনি এমন সত্তা যার অস্তিত্ব অত্যাবশ্যকীয় এবং যার মধ্যে যাবতীয় সম্পূরক গুণাবলী সমষ্টিগত ও একীভূত ভাবে বিদ্যমান।’
الله‘‘ এই পবিত্র নামে এমন আশ্চর্যজনক ও বিস্ময়কর বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, যদি উক্ত নাম থেকে কোন একটি বর্ণ পৃথক করা হয়, তবুও আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র সত্তাগত নাম বিদ্যমান থাকে। যেমন- الله থেকে الف কে বাদ দিলে لله অবশিষ্ট থাকে এবং প্রথম لام কে বাদ দিলে لَـهُ অবশিষ্ট থাকে। আর দ্বিতীয় لام টি পৃথক করলে هُ ‘‘ শব্দটি বাকী থাকে- যেমন هو الحى القيوم । প্রত্যেক অবস্থায় আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র নামের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।
سبحانه ما اعظم شانه পবিত্র সে মহান সত্তার যাঁর শান ও মর্যাদা অতীব মহান। আল্লাহ্ শব্দের তাহ্কীক-এর জন্য আমার লিখিত التوضيح الجميل بشرح حديث جبرئيل এবং تنزيه الجليل عن الشبه والمثيل গ্রন্থদ্বয় পাঠের অনুরোধ রইল।
(اللهُ) আল্লাহ্ তা‘আলার অস্তিত্বের আক্বীদা পোষণ করা মানব জাতির আবশ্যকীয় বিষয়। কেননা যতদিন মানবজাতি চিন্তা-চেতনা, গবেষণা ও যুক্তিযুক্ত দলিল উপস্থাপনের মাধ্যমে উপকৃত হবে, ততোদিন উক্ত আক্বীদা পোষণ করতে তারা বাধ্য। কারণ মানুষ এর জন্য স্বীয় অস্তিত্ব ও মূল সত্তা এবং এ বিশাল জগত ও এর সৃষ্টি রহস্য উদঘাটন করার নিমিত্তে উক্ত আক্বীদা পোষণ করা আবশ্যক। কেননা চিন্তা-গবেষণা ছাড়া তা সম্ভব নয়। এ অভাবনীয় বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার প্রথম নীতিমালা হচ্ছে প্রত্যেক সৃজনশীল বস্তুর জন্যে অবশ্যই কোন না কোন প্রস্তুতকারক নির্মাতা রয়েছে। অনুরূপভাবে এই বিশ্বজগত দেখলে মানুষ সহজেই বুঝতে পারে যে, এর অবশ্যই একজন স্রষ্টা রয়েছেন। এ আক্বীদা মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই নিঃসন্দেহে চলে আসছে।
এতে কারো সন্দেহ নেই যে, হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর আগমনের ৬০০ বছর পূর্বে দর্শন শাস্ত্রের উদ্ভব হয়। তখন থেকে উক্ত আক্বীদা-বিশ্বাসে অনেক সন্দেহ-সংশয় ও মতবিরোধের সৃষ্টি হতে থাকে। যা আজো বিদ্যমান। হ্যাঁ! উক্ত আক্বীদায় কাল্পনিক সন্দেহ ব্যতীত অন্য কিছুর অবকাশ নেই। লোকেরা দর্শন শাস্ত্রের কাল্পনিক ও যুক্তি ভিত্তিক দলিল প্রমাণের মাধ্যমে আল্লাহর আকার-আকৃতি অনুমান করার চেষ্টা করেছে। পক্ষান্তরে আল্লাহ্ জওহর বা অণু, আরজ বা অস্থায়ী কিছুই নহেন। আর তিনি এমন বস্তুও নন যে, যা অন্তরে কল্পনা করা যায় এবং দৃষ্টিগোচর হয়। ফলে মানুষ তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহে নিপতিত। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, মানুষ তার সৃষ্টিকর্তাকে মানতিক শাস্ত্রের মুকাদ্দামা ও দর্শন বিদ্যার মূলভিত্তি لماذا، كيف، اين অর্থাৎ কোথায়, কিভাবে, কেন- এর মাধ্যমে জানার ও বুঝার চেষ্টা করছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তারা যুক্তি বিদ্যার নীতিমালার মাধ্যমে তাঁকে এজন্যে জানার চেষ্টা করছে যে, তারা যেন তাঁর ইবাদত করে।
নিঃসন্দেহে একথা বলা যায় যে, উক্ত দলিল প্রমাণাদির মাধ্যমে অবশ্যই দুটি বিষয়ের যে কোন একটি অর্জিত হবে। এক. হয়তো তারা যুক্তির নিরিখে কাল্পনিক আকৃতি নির্ধারণ করবে এবং তাকে খোদা মনে করে তাঁর উপাসনা করবে। এভাবে তারা আজীবন ধারণা ও কল্পনাপ্রসূত উপাসনা করতে থাকবে। দুই. অথবা সে নীতিমালার মাধ্যমে কিছুই মিলবে না, ফলে তারা আল্লাহকে অস্বীকার করে বসবে।
প্রথম শ্রেণির অনুসারী লোক অনেক। তারা তাদের কাল্পনিক খোদার উপাসনা করছে। তাদের মাঝে দ্বীন-ধর্মের প্রভাব মাত্রই প্রথাগত প্রচলন ও অভ্যাসগত নিদর্শন ছাড়া আর কিছুই নেই।
আর দ্বিতীয় শ্রেণির লোক- যখন তারা নিজেদের প্রাধান্য ও আধিক্য দেখতে পায়, তখন তারা অবাধ্য, সীমালংঘন ও নাফরমানী আরও বেশি করে এবং কুফরীতে লিপ্ত হয়ে যায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় যে, মানুষ যখন আল্লাহর ওপর আত্মবিশ্বাসের ইচ্ছে পোষণ করে, তখন গ্রীস দার্শনিক ও তাদের অনুসারীরা আরবীয় দার্শনিকদের নিকট জিজ্ঞেস করে এবং তর্কশাস্ত্রের জ্ঞান-বুদ্ধিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। বাহ! বাহ! এ কেমন জ্ঞানী-গুণীর কথা!
এ প্রচেষ্টা ও অনুসন্ধানের দ্বারা তাদের উপকার হবে যে, হয়তো তারা আল্লাহ'র কাল্পনিক আকৃতি নির্ধারণ করবে; না হয় মুলহিদ বা নাস্তিক হয়ে যাবে।
মানুষের একান্ত উচিত যে, নিজের অজ্ঞতা, অপারগতা, দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব স্বীকার করতঃ যে আক্বীদা বিশ্বাস হযরাতে আন্বিয়া-ই কিরাম বিশেষ করে হুযূর ইমামুল আন্বিয়া সৈয়্যদুল মুরসালীন মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে যে আক্বীদা-বিশ্বাস ও ঈমান রাখার আদেশ দিয়েছেন তা দৃঢ়ভাবে আকড়িয়ে ধরে এবং ভ্রান্ত আক্বীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ পরিহার করে একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি আন্তরিক ভাবে ফিরে আসা এবং এ বিশ্বাস স্থাপন করা যে,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ، لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ........ وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا .
অতএব মানুষ যখনই সত্যিকার অর্থে আন্তরিকভাবে কখন, কিভাবে, কোথায় মহান আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি ফিরে যাবে, তখন কোন ধরনের আকার-আকৃতি বিহীন তাঁর প্রকৃত পরিচিতি সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারবে, এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য অধম লিখকের লিখিত- تنزيه الجليل عن الشبه والمثيل গ্রন্থখানা অধ্যয়ন করার অনুরোধ রইল।
إِلَهٌ ‘ শব্দটি সাধারণত মাবুদ বা উপাস্যকে বুঝায়। তা সত্য হোক বা মিথ্যা হোক, হক্ব বা বাতিল- সকল উপাস্যকে বুঝায়। কেননা إِلَهٌ শব্দটি اسم جنس বা জাতি বাচক বিশেষ্য। যেমন- نجم বলতে যে কোন তারকাকে বুঝায়। কিন্তু পরবর্তীতে এর ব্যবহার ‘ছুরাইয়্যা’ তারকার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়।
الهى‘ঃ إِلَه শব্দটি আল্লাহ'র সত্তাগত নাম। ياء বর্ণটি متكلمএর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। إِلَهٌ অর্থ- আল্লাহ্। দর্শনশাস্ত্রের তিন প্রকারের এক প্রকারের নামও এটা। এটা একটি ঐতিহাসিক নামও। যা সম্রাট জালালুদ্দীন আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে শুরু হয়। যাকে ‘ইলাহি বছর’ বলা হয়।
❏ প্রশ্ন-৮ঃ তাওহীদ ও ‘তাওহীদে রাবুবিয়্যাত’-এর সংজ্ঞা কী? বিস্তারিতভাবে বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ هوالمستعانঃ তাওহীদের আভিধানিক অর্থ- কোন বস্তুকে একক জানা। পরিভাষায় আল্লাহ্ তা‘আলাকে পালনকর্তার গুণে একক, তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি এবং যে কোন ধরনের মন্দ থেকে পবিত্র মনে করা।
তাওহীদের মাসআলা অত্যন্ত কঠিন ও সূক্ষ্ম। এটাকে যদি ইসলামের যাবতীয় বিষয়ের মূল কেন্দ্র বা সূতিকাগার বলা হয়, তা হবে যথার্থ ও সত্য। তাওহীদ এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, হযরত আদম (عليه السلام) থেকে সৈয়্যদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলকে যা বর্ণনা করার জন্যে প্রেরণ করেছেন। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল ধর্মে এটি ঐকমত্য বিষয়। তা হৃদয়ঙ্গম ও অনুধাবন করার জন্য সর্বপ্রথম আল্লাহর অস্তিত্বকে প্রমাণ করা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে الحقوق والفرائض নামক কিতাবের উদ্ধৃতিই যথেষ্ট।
‘পৃথিবীর এই বিশাল কারখানার প্রত্যেক অণু-পরমাণুতে সমুদ্রের প্রতিটি বিন্দুতে, গাছের পাতায় পাতায় আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য বিদ্যমান। এ জন্যে কোন বস্তু বড় হোক বা ছোট, পৃথিবীতে হোক বা আকাশে, জলে হোক বা স্থলে, প্রাণী হোক বা জড়পদার্থ ইত্যাদিতে এমন বস্তু আছে যা নিজে নিজে অস্তিত্ব লাভ করেছে? অবশ্যই কোন না কোন নির্মাতা এগুলো তৈরী করেছেন। আমরা ঐ প্রস্তুতকারীকে পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত সকল স্থানে অনুসন্ধান ও বিচার-বিশেষণ করে কাউকে উহার উপযুক্ত পাইনি। যাকেই বিচার করি অনুপযুক্ত ও অপারগ পাওয়া যায়।
সুলতান মাহমুদ নিজের মর্যাদা ও যোগ্যতা সম্বন্ধে অবগত হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলে পরাজিত ও অক্ষমতা প্রকাশ করতে বাধ্য হন। অনন্যোপায় হয়ে আকাশের দিকে থাকালে হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর কাহিনী স্মরণ করে নিরব-নিস্তব্ধ হয়ে পড়েন। পরিশেষে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, যাকে তালাশ করছি তাঁকে তো দিব্যি চোখে বা কপালের চোখে দেখার বস্তু নয়। বনি ইসরাঈল অনিষ্টের চেষ্টা করলে فَأَخَذَتْهُمُ الصَّاعِقَةُ-এর শাস্তি পেল এবং আকাশ থেকে আওয়াজ এসে ধ্বংস করে দিল। হযরত মূসা (عليه السلام) অতি উৎসাহে এসে প্রভুকে দেখার সাহস করেন, অথচ তাজাল্লি দেখেই وَخَرَّ مُوْسٰى صَعِقًا ‘মূসা (عليه السلام) বেহুশ হয়ে লুটিয়ে পড়েন এবং লজ্জিত হন।’ আসল কথা হলো- আল্লাহ্ তা‘আলা হলেন আমাদের প্রকাশ্য অনুভূতির ঊর্ধ্বে এবং এটি আমাদের ইন্দ্রিয় ও বোধশক্তি দিয়ে জানা অক্ষম। যদি দুর্দান্ত ও নির্ভীক বাঘ চোখ দ্বারা পানির প্রস্রবণ দেখতে না পায় তাহলে সূর্যের কি দোষ?
হ্যাঁ! অন্তর—চক্ষু দ্বারা যদি দেখা যায়, তবে গোটা পৃথিবী আয়না ঘর বা দর্পনে পরিণত হবে। ঘরে-বাইরে যেদিকে তাকাই মহান আল্লাহ'র জ্যোতির্ময় নূর ঝলমল করতে দেখা যায়। অন্তরের আয়নাতে থাকে বন্ধুর প্রতিচ্ছবি।
دل كے آ ئينہ ميں ہے تصوير يار ٭ جب ذرا گردن جهكائى ديكھ لى
“অন্তরের আয়নাতে বন্ধুর রূপ নক্শা বিদ্যমান রয়েছে গ্রীবাদেশ একটু ঝুঁকিয়ে দেখে নিন।”
دوست نزديك شراز من عين است ٭ وايں عجب تركہ من اتردے مهجرام.
او دوست نزديك شراز من عين است ٭ وايں عجب تركہ من نزدوے بهجرم.
‘বন্ধু মন্দের নিকট আমার মতোই, এটি আশ্চর্যের বিষয় যে, আমি অপমানিত হলে তার নিকট পরিত্যক্ত হই।’
অথবা, ‘বন্ধু শত্রুর নিকট আমার মতোই, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, আমি অপমানিত হলে তার নিকট পরিত্যক্ত হই।’
আমাদের ধারণা যে, মানুষ শুরু থেকেই আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে ভুল সংঘটিত হয়েছে এবং বর্তমানেও অধিকাংশ আল্লাহ'র বান্দা সে-ই ভুলে লিপ্ত রয়েছে। যারা আল্লাহ্ তা‘আলাকে প্রকাশ্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করছে। তারা যখন উক্ত লক্ষ্য অর্জনে সফলকাম হয়নি, তখন মনগড়া ও বানোয়াট খোদাকে মেনে নিল। أتخذ الهه هواه স্বীয় কুপ্রবৃত্তিকে নিজের প্রভু বানিয়ে নেয় এবং নিজের ভ্রান্ত ধারণা অনুপাতে প্রভু মান্য করার স্বভাব গড়ে নিতে কোন ধরনের দ্বিধাবোধ করে না। তাই একেবারে নিকৃষ্ট ও তুচ্ছ বস্তুকেও খোদার স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করে না। তাদের স্বভাব হলো, কোন বস্তুকে পরিপূর্ণ মনে করে এবং খোদা বিশ্বাস করে তাদের ভ্রান্ত ধারণা মতে আল্লাহ'র ইখতিয়ার তাঁর থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অযোগ্য ও অনুপযুক্তদের দায়িত্বভার দিয়ে দেয়। এভাবেও বলা যায় যে, আল্লাহ্ তা‘আলার পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে অন্যকে স্থলাভিষিক্ত করে দিয়েছে। যেভাবে আল্লাহ'র বান্দারা তাঁর ব্যাপারে বেআদবী ও অবাধ্যতা মূলক আচরণ করেছে এবং করে আসছে। যা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনও কতিপয় বান্দা আছে যারা আল্লাহর পবিত্র সত্তার ওপরও আক্রমণ করছে, তারা দু’ খোদার প্রবক্তা এবং বলে যে, এক- জীবনদাতা, দুই- মৃত্যুদাতা। এক-ভাল ও কল্যাণের স্রষ্টা, দুই- মন্দ ও অকল্যাণের স্রষ্টা।
কারো মতে, তিন খোদা রয়েছে। মূলতঃ তিনি একজন। আবার কারো মতে, প্রত্যেক বস্তু স্বয়ং আল্লাহ'র স্থানে অভিষিক্ত। কারো ধারণা মতে, আল্লাহ্ এখন নিষ্ক্রীয় ও দায়িত্বমুক্ত ঘুমিয়ে আছেন এবং সকল উপকরণাদি সৃষ্টি করে রেখেছেন যার মাধ্যমে বিশ্বজগত পরিচালিত হচ্ছে। তাদের মতে, পৃথিবী এক ধরনের ঘড়ি এবং আল্লাহ্ হলেন এর কারিগর। যিনি এটি তৈরি করে সুসজ্জিত করেছেন এবং আওয়াজ ধ্বনি বড় করে দিয়েছেন। আর ঘড়ি অটোমেটিক চলতেছে। আল্লাহ'র জাত বা সত্তার ব্যাপারে তো এগুলো বলা হয়েছে। তাঁর সিফাত বা গুণাবলির ওপরও আক্রমণ চালানো হয়েছে। তারা এতো বেশি খোদা স্বীকার ও মান্য করে যে, প্রত্যেক খোদার ভাগে একজন করে বান্দা মিলানো বড় কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা এটা বুঝতেছে না যে, দুটি পাত্র এক স্থানে রাখলে পরস্পর সংঘর্ষ হয়ে আওয়াজ উঠে, তাই এক খোদা ভিন্ন দুই বা ততোধিক খোদা হলে দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্য অবশ্যই হবে। আর দ্বন্দ্ব ও মতভিন্নতা হলে পৃথিবী এক সেকেন্ডও স্থির থাকবে না।
মহান আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন,
لَوْ كَانَ فِيْهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللهُ لَفَسَدَتَا
অর্থাৎ ‘যদি আল্লাহ্ ব্যতীত (আসমান ও জমীন) এদুভয়ের মধ্যে বহু উপাস্য থাকত তবে উভয়ই ধ্বংস হত।’ 4. সূরা আন্বিয়া, আয়াতঃ ২২
দু’ বাদশাহ যদি পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত থাকে, তাহলে দেশ ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়ে যাবে। আর খোদা বা বহু স্রষ্টার যুদ্ধের পরিণামের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কোন ধরনের ব্যতিক্রম ছাড়া পৃথিবী একই নিয়মে পরিচালনা করা, এটা একথারই প্রমাণ যে, সমগ্র সৃষ্টি জগত এক আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে।
অন্যান্য জাতি আল্লাহর ব্যাপারে অনেক প্রকারের ধারণা পোষণ করছে, সেটা তাদের বিবেক-বিবেচনার ব্যাপার। আমাদের একান্ত চিন্তা হচ্ছে মুসলমানদের শৃঙ্খলা থাকার ব্যাপারে, যাদের মহান দাবী হচ্ছে তাওহীদ। কিন্তু মুশরিকদের এমন কোন চাল-চলন ও আচার-আচরণ নেই, যা তারা অবলম্বন করেনি।
আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে মুসলমানদের আক্বীদা এতো সহজ-সরল যে, যার চেয়ে সহজ ও পরিষ্কার কোন আক্বীদা হতে পারে না। ইসলাম সৃষ্টি জগতের মাধ্যমে আল্লাহ'র সত্তাগত ও গুণগত পরিচয় লাভ করে থাকে।
ذات শব্দটি ذو-এর مؤنث (স্ত্রীলিঙ্গ) অর্থ- কোন বস্তুর হাক্বিক্বত বা মূলতত্ত্ব। আল্লাহ্ তা‘আলার নাম দু’প্রকার। এক. اسم ذات বা সত্তাগত নাম,
দুই. اسم صفت বা গুণগত নাম।
اسم ذات বা সত্তাগত নাম বলা হয়- যা শুধু তাঁর সত্তার ওপর دلالت করে। অর্থাৎ- একমাত্র ‘আল্লাহ্’ ছাড়া অবশিষ্ট সকল নাম গুণবাচক। এখানে তাঁর গুণবাচক নামের কোন অধিকার নেই। اسماء صفت বা গুণবাচক নাম বলা হয়- সত্তাগত নাম ছাড়া যেখানে সিফতের অর্থ বিদ্যমান। অর্থাৎ- কোন বিশেষ গুণাবলীর অর্থ অনুপাতে আল্লাহ'র সত্তার ওপর এর প্রয়োগ হয় যেমন- রহমান, রহীম, আলীম, কাদীর ইত্যাদি।
আল্লাহ্ তা‘আলার জাত বা সত্তা ও গুণাবলীর পরিচয় লাভ করার নিয়মকে موصل الى المطلوب বলে। সৃষ্টি জগতের মাধ্যমে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, বিশ্ব জগতের স্রষ্টা অবশ্যই আছেন। তিনি ওই সকল বস্তুর পর্যায়ে নহেন যা আমরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানি। আমরা আল্লাহ'র সত্তার ব্যাপারে এর চেয়ে আর বেশি বলতে পারি না। কারণ মানুষের জ্ঞানের পরিধি এ পর্যন্ত (সীমিত)।
সিফাত বা আল্লাহ'র গুণাবলির ব্যাপারে বলা যায়, গোটা সৃষ্টি জগত তাঁর একক ব্যবস্থাপনা দ্বারা অত্যন্ত সুশৃংখল ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়াই তার গুণসম্পন্নতা প্রকাশ পাচ্ছে। অর্থাৎ- তার নিকট ঐ পরিপূর্ণ গুণাবলি বিদ্যমান থাকা সিফতের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।
আল্লাহ্ তা‘আলার নিরানব্বই নাম রয়েছে। যা نُودنہ নামে প্রসিদ্ধ। এগুলোর মধ্যে ‘আল্লাহ্’ اسم ذات বা সত্তাগত নাম হিসেবে পরিচিত। যদিও মাবুদ হওয়ার বিবেচনায় আল্লাহকেও সিফত বলা যায়। কিন্তু যাঁর এতগুলো গুণবাচক নাম আছে, অবশ্যই তাঁর সত্তাগত নাম থাকা আবশ্যক। আর তা হলো ‘আল্লাহ্’; বাকী রইলো আটানব্বই নাম- যা কোন না কোন গুণের অর্থ প্রদান করে।
সিফাতি নাম সম্পর্কে আমরা একথা বলতে পারি যে, এ নাম সমূহের বাস্তবতা ‘আল্লাহ্’-এর মধ্যে বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। সিফত সম্পর্কে আমরা এর বেশি কিছু বলতে পারি না। যেমন- আমরা বলি আল্লাহ্ سميع‘ সর্বশ্রোতা। এর অর্থ হলো- আল্লাহ্ শ্রবণ শক্তির গুণসম্পন্ন। যে জ্ঞান আমরা আদম সন্তানেরা শ্রবণ শক্তির মাধ্যমে অর্জন করি, ওই জ্ঞান আল্লাহ্ তা‘আলার জন্যও পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান এ নয় যে, আমাদের মতো তাঁর কান আছে। কিন্তু মানুষের কান থাকা প্রয়োজন যার মাধ্যমে শ্রবণ করা হয়। আল্লাহ্ তা‘আলার ক্ষেত্রে এমন নয়। আমাদের শ্রবণের প্রকৃতি হলো এই যে, কথা বর্ণনাকারী আওয়াজের মাধ্যমে বাতাসে ঢেউ সৃষ্টি করে, আর ওই ঢেউ শ্রবণ শক্তিসম্পন্ন কানের (রগের সাথে স্পর্শ হলে মানুষ) আবরণে (পর্দা) যখন আঘাত করে, তখন আমাদের আওয়াজ বা ধ্বনির জ্ঞান অর্জিত হয়। মহান আল্লাহ্ পাকেরও অনুরূপ পরিপূর্ণ জ্ঞান রয়েছে। কিন্তু তিনি কান, আওয়াজ বা ধ্বনি এবং কানের রগের মাধ্যমে শ্রবণ করা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও মুক্ত।
আল্লাহ্ পাকের অন্যান্য সিফাত ও গুণাবলিকেও এর ওপর কিয়াস করে নিন। এ সিফাতগুলো আমরা নিজেদের ওপর কিয়াস করে তার জন্য প্রমাণ করছি। অথচ আমাদের সিফাত অসম্পূর্ণ, নগণ্য ও ক্ষুদ্র এবং মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহর সিফাত পরিপূর্ণ। যেমন- অনু-কণার আলো এবং সূর্যের তীক্ষন্ড আলোকরশ্মির মধ্যেকার পার্থক্য।
তাওহীদ তিন প্রকারঃ-
১. আল্লাহ্ পাকের সত্তাগত নাম ও তাঁর সিফাতী নামসমূহ পরিপূর্ণভাবে জানা।
২. তাঁর প্রভুত্বের বৈশিষ্ট্য ও ইবাদতের উপযোগী জানা
এবং
৩. তাঁর সকল কার্যাবলি সম্পর্কে ভালভাবে জ্ঞান রাখা।
ইসলাম ধর্মের নাম তাওহীদ এ জন্যে রাখা হয়েছে যে, তার ভিত্তি তিনটি বিষয়ের পরিচিতির ওপর এর ভিত্তি স্থাপিত। এক. আল্লাহ্ পাক স্বীয় রাজত্ব ও কর্ম সম্পাদনে একক, তাঁর কোন শরীক নেই। দুই. স্বীয় সত্তায় তাঁর সমকক্ষ ও প্রতিপক্ষ কেউ নেই এবং তিন. স্বীয় প্রভুত্বে তিনি একক ও অদ্বিতীয়। সকল নবীগণের তাওহীদ এই তিন প্রকারের মধ্যে বিভক্ত। প্রত্যেক প্রকার পরস্পরকে আবশ্যক করে এবং পরস্পর পৃথক হতে পারে না। যে এই প্রকারত্রয় থেকে যে কোন একটিকে মানল, অন্যটিকে মানল না, সে তাওহীদের পরিপূর্ণ হক আদায় করেনি।
❏ প্রশ্ন-৯ঃ ‘দ্বীন’ দ্বারা কী উদ্দেশ্য এবং দ্বীন ও মাযহাবের মধ্যে কী পার্থক্য? আলোচনা কর।
✍ উত্তরঃ দ্বীন দ্বারা ‘মাযহাব’ উদ্দেশ্য। যে সকল বিষয় মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বোধশক্তির ঊর্ধ্বে যেমন- মৃত্যুর পর কি অবস্থা হবে, পৃথিবীর সূচনা কবে থেকে এবং এর স্থায়ীত্ব কতদিন থাকবে ইত্যাদি, এ জাতীয় বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট ধারণা পোষণ করার নাম ‘মাযহাব’। এ নিরিখে দ্বীন শব্দটি সকল হক ও বাতিল মাযহাবের ওপর ব্যবহৃত হয়। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজিদে ইরশাদ করেন- إِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম।’ অর্থাৎ- দ্বীন তো অনেক রয়েছে। তৎমধ্যে হক ও সত্য ধর্ম হলো একটিই। যার নাম ইসলাম। يوم الدين -বা বিচার দিবস অর্থ- পরকাল ও আখিরাত।
দ্বীন ও মাযহাবের মধ্যে পার্থক্য এই যে, দ্বীনের সম্পর্ক মুজ্তাহিদগণের প্রতি হয় না, পক্ষান্তরে দ্বীনের সম্পর্ক মাযহাবের প্রতি হয়। দ্বীনের সম্পর্ক বিশেষ করে আন্বিয়া-ই কিরামের প্রতি হয়।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ৭৩ দলে বিভক্ত হওয়ার বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-৯ঃ-ইসলামের ৭৩ দলগুলো কি কি?বর্ণনা করো।
✍ উত্তরঃ-
هو المستعان ইসলাম ধর্মে মোট ৭৩ দল রয়েছে। তম্মধ্যে একটি দল- আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। বাকী ৭২ দল মূলতঃ ছয় দলে বিভক্তঃ-
১. রাফেজী,
২. খারেজী,
৩. জবরিয়াহ,
৪. কদরিয়াহ,
৫. জাহমিয়াহ্
এবং
৬. মার্জিয়াহ্।
অতঃপর এদের প্রত্যেক দল ১২ দলে বিভক্ত হয়েছে।
রাফেজিয়া ফেরকার ১২ দল নিম্নরূপঃ
১.উলুবিয়্যাহঃ যারা হযরত আলীকে নবী বলে।
২.আজরিয়্যাহঃ যারা হযরত আলীকে নবুয়তের শরীক মনে করে।
৩.শিয়াঃ তাদের মতে, যারা হযরত আলীকে সকল সাহাবার চেয়ে উত্তম মনে না করে, তারা কাফির।
৪.ইসহাকিয়্যাহঃ যারা বলে নবুয়ত এখনো শেষ হয়নি।
৫.যাইদিয়্যাহঃ যারা বলে, নামাযের ইমামতির জন্য হযরত আলীর বংশধর ছাড়া অন্য কেউ যোগ্য নহে।
৬.আব্বাসিয়াহঃ যারা হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব ছাড়া অন্য কাউকে ইমাম মনে করে না।
৭.ইমামিয়্যাহঃ যারা ইহজগতকে অদৃশ্য ইমাম থেকে শূন্য মনে করে না এবং তারা নামায কেবল হাশেমী বংশের পেছনেই পড়ে।
৮.নাদেসিয়্যাহঃ যারা বলে, যে ব্যক্তি নিজেকে অন্যের চেয়ে উত্তম মনে করে সে কাফির।
৯.মুতনাসেহিয়্যাহঃ যারা বলে, প্রাণ যখন দেহ থেকে বের হয়ে যায়, তখন অন্যের দেহে চলে যাওয়া জায়েয।
১০.লানিয়্যাহঃ যারা হযরত তালহা (رضى الله تعالي عنه), হযরত যুবাইর (رضى الله تعالي عنه) এবং হযরত আয়েশা (رضى الله تعالي عنه) সহ সবাইকে অভিশাপ দেয়।
১১.রাজেইয়্যাহঃ যারা বলে, হযরত আলী পুনরায় পৃথিবীতে আসবেন।
১২.মুরতাযিয়্যাহঃ যারা বলে, মুসলিম বাদশাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েয।
খারেজিয়্যাহ ফেরকার ১২ দল নিম্নরূপঃ
১.আযরক্বিয়্যাহঃ যারা বলে, স্বপ্নযোগে কোন ব্যক্তি নেকী বা ভাল কিছু দেখতে পারবে না, ওহী বা ঐশিবাণী বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে।
২.রিয়াযিয়্যাহঃ যারা বলে, ভাল কথা, ভাল কাজ, সৎ নিয়্যত এবং সুন্নাতকেই ঈমান বলে।
৩.সা‘লাবিয়্যাহঃ যারা বলে, আমাদের কাজ-কর্ম আল্লাহ্ তা‘আলার কল্পনায় অর্জিত হয়েছে। তাঁর কুদরত কিংবা ইচ্ছা শক্তিতে নয়।
৪.খাযেমিয়্যাহঃ যারা বলে, ফরযিয়ত বা ফরয হওয়ার বিষয়গুলো জানা যায়নি।
৫.খল্ফিয়্যাহঃ যারা বলে, কাফিরদের মোকাবিলায় যে কেউ পলায়ন করা কুফরী।
৬.কুযিয়্যাহঃ যারা বলে, অধিক ঘষা-মাজা ও মালিশ ছাড়া শরীর পবিত্র হয় না।
৭. কন্যিয়্যাহঃ যারা বলে, যাকাত দেয়া ফরয নয়।
৮.মু‘তাযিলাহঃ যারা বলে- মন্দ কাজ আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত নয়। ফাসিক ইমামের পিছনে নামায জায়েয নয়। ঈমান মানুষের অর্জিত বিষয়। কোরআন মাখলুক বা সৃষ্ট বস্তু। সদ্কা ও দু‘আ দ্বারা মৃত ব্যক্তির নিকট কোন উপকার পৌঁছে না। মি‘রাজ বাইতুল মুকাদ্দাসের ঊর্ধ্বে প্রমাণিত নয়। কিয়ামত দিবসে হিসাব-নিকাশ, আমলনামা, মিযান, পাপ-পূণ্য ইত্যাদি কিছুই নেই। ফিরিশতারা মু’মিনদের চেয়ে উত্তম। কিয়ামত দিবসে আল্লাহর দিদার ও দর্শন লাভ হবে না। আউলিয়া-ই কিরামের কারামত বা অলৌকিকত্ব বলতে কিছুই নেই। জান্নাতবাসীদের জন্য ঘুম ও মৃত্যু আছে। হত্যাকৃত ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ে মারা যায় না। কিয়ামতের আলামত সমূহ যেমন- দাজ্জাল ইত্যাদি বলতে কিছুই নেই।
৯.মাইমুনিয়্যাহঃ যারা বলে, অদৃশ্যের ওপর ঈমান আনা বাতিল ও মিথ্যা।
১০. মুহকামিয়্যাহঃ যারা বলে, সৃষ্টির মাঝে আল্লাহ্ তা‘আলার কোন কর্তৃত্ব নেই।
১১.সিরাজিয়্যাহঃ যারা বলে, পূর্ববর্তী লোকদের অবস্থা আমাদের জন্য দলিল নয়, বরং তাদের অস্বীকার করা ওয়াজিব।
১২.আখ্তাসিয়্যাহঃ যারা বলে, বান্দা স্বীয় কর্ম ও আমলের কোন বিনিময় পাবে না। উপরে বর্ণিত বার প্রকার খারেজী অনুসারীদের প্রকারসমূহ।
জবরিয়্যাহ ফেরকার ১২ দল নিম্নরূপঃ
১.মুদ্ত্বারিবাহঃ যারা বলে, ভাল-মন্দ সব আল্লাহর পক্ষ থেকে। এতে বান্দার কোন ইখতিয়ার নেই।
২.আফ‘আলিয়্যাহঃ যারা বলে, বান্দা কাজ তো করে কিন্তু এতে তার কোন শক্তি ও ইখতিয়ার নেই।
৩.শা‘ঈয়্যাহঃ যারা বলে, বান্দার জন্য কর্ম ও শক্তি আছে। কিন্তু এ শক্তি ও সামর্থ আল্লাহ'র পক্ষ থেকে নয়।
৪.তারেকিয়্যাহঃ যারা বলে, ঈমানের পর আর অন্য কিছু ফরয নয়।
৫.বাহ্ছিয়্যাহঃ যারা বলে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের অংশ খেয়ে থাকে। সুতরাং কাউকে কিছু দেয়ার প্রয়োজন নেই।
৬.মুতমান্নিয়্যাহঃ যারা বলে, আত্মা প্রশান্তি লাভ করে এমন সব বিষয় ভাল ও পূণ্য।
৭.কুসতারনিয়্যাহঃ যারা বলে, পূণ্য ও শাস্তি আমলের হতে পারে না।
৮.হাবীবিয়্যাহঃ যারা বলে, বন্ধু আপন বন্ধুকে কখনো শাস্তি দিবে না।
৯.খাউফিয়্যাহঃ যারা বলে, বন্ধু কখনো ভয় প্রদর্শন করে না।
১০.ফিক্রিয়্যাহঃ যারা বলে, আল্লাহ'র মা‘রিফতে ধ্যানমগ্ন থাকা ইবাদতের চেয়ে উত্তম।
১১.হাস্বিয়্যাহঃ যারা বলে, ইহজগতে কোন ধরনের ভাগ্য বন্টন নেই।
১২.হুজ্জতিয়্যাহঃ যারা বলে, আল্লাহ'র নির্ধারণে যখন কাজ সম্পাদন হয়ে থাকে, তখন বান্দার ওপর কোন কৈফিয়ত তলব নেই, যার ফলে সে পাকড়াও হবে।
ক্বদরিয়া ফেরকার ১২ দল নিম্নরূপঃ
১.আহ্দিয়্যাহঃ যারা বলে, ফরয তো আমরা মানি কিন্তু সুন্নাতকে অস্বীকার করি।
২.ছনবিয়্যাহঃ যারা বলে, পূণ্য আল্লাহ'র পক্ষ হতে এবং পাপাচার শয়তানের পক্ষ থেকে হয়।
৩.কীসানাহঃ যারা বলে, আমাদের কর্মসমূহ মাখলুক বা সৃষ্ট।
৪.শয়তানিয়্যাহঃ যারা বলে, শয়তানের কোন অস্তিত্ব নেই।
৫.শরীকিয়্যাহঃ যারা বলে, ঈমান মাখলুক নয়। তা কখনো হয় আবার কখনো হয় না।
৬.ওহমিয়্যাহঃ যারা বলে, আমাদের কর্মের কোন বিনিময় পাওয়া যাবে না।
৭.রুয়াইদিয়্যাহঃ যারা বলে, পৃথিবী নশ্বর বা ধ্বংসশীল নয়।
৮.নাকিসিয়্যাহঃ যারা বলে, ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েয।
৯.মুতবর্রিয়্যাহঃ যারা বলে, গুনাহগারের তাওবা কখনো কবুল হবে না।
১০.কাসিতিয়্যাহঃ যারা বলে, ইলম, ধন-সম্পদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং রিয়াযত বা সাধনা করা ফরয।
১১.নিত্বামিয়্যাহঃ যারা বলে, আল্লাহ্ তা‘আলাকে বস্তু বলা জায়েয।
১২.মুতওয়াক্কিয়্যাহঃ যারা বলে, আমরা জানি না যে মন্দ নির্ধারিত বিষয় কি-না।
জাহমিয়্যাহ ফেরকার ১২ দল নিম্নরূপঃ
১.মু‘আত্তলিয়্যাহঃ যারা বলে, আল্লাহ্ তা‘আলার গুণাবলি মাখলুক বা সৃষ্ট।
২.মুতরা‘ঈয়্যাহঃ যারা বলে, ইলম, শক্তি ও ইচ্ছা মাখলুক কিন্তু সৃষ্টি মাখলুক নয়।
৩.মুতরাক্বিবিয়্যাহঃ যারা বলে, আল্লাহ্ তা‘আলা নির্দিষ্ট স্থানে সমাসীন।
৪.ওয়ারিদিয়্যাহঃ যারা বলে, যারা দোযখে যাবে, তারা আর সেখান থেকে বের হতে পারবে না। আর মু’মিন দোযখে যাবে না।
৫.হরক্বিয়্যাহঃ যারা বলে, দোযখীরা এমনভাবে জ্বলবে যে, তাদের কোন চিহ্নও সেখানে অবশিষ্ট থাকবে না।
৬.মাখলুক্বিয়্যাহঃ যারা বলে, কোরআন, তাওরাত, ইনজিল ও যাবুর আসমানি কিতাবসমূহ মাখলুক।
৭.ইবরিয়্যাহঃ যারা বলে, মুহাম্মদ একজন বিচক্ষণ জ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন কিন্তু রাসূল ছিলেন না।
৮.ফানিয়্যাহঃ যারা বলে, জান্নাত ও দোযখ উভয়টি ধক্ষংস হয়ে যাবে।
৯.যানদক্বিয়্যাহঃ যারা বলে, মি‘রাজ রূহানীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, শারীরিক ভাবে নয়। আল্লাহ্ তা‘আলাকে দুনিয়াতে দেখা সম্ভব। ইহজগত অবিনশ্বর। কিয়ামত বলতে কিছুই নেই।
১০.লফ্যিয়্যাহঃ যারা বলে, কোরআন পাঠকের কথা, আল্লাহ'র কালাম নয়।
১১.ক্ববরিয়্যাহঃ যারা বলে, কবরে কোন শাস্তি হবে না। তারা কবরের আযাবকে অস্বীকার করে।
১২.ওয়াক্বিফিয়্যাহঃ যারা বলে, কোরআন মাখলুক হওয়ার ব্যাপারে আমরা নিরব।
মারজিয়্যাহ ফেরকার ১২ দল নিম্নরূপঃ
১.তারেকিয়্যাহঃ যারা বলে, ঈমানের পর আর অন্য কোন বস্তু ফরয নয়।
২.শানিয়্যাহঃ যারা বলে, যে ব্যক্তি لا اله الّا الله বলল, সে যা ইচ্ছা তা করতে পারবে তার কোন শাস্তি হবে না।
৩.রাজিয়্যাহঃ যারা বলে, বান্দা আল্লাহ'র আনুগত্যের দ্বারা মাকবুল বা গ্রহণযোগ্য এবং অবাধ্যতার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে না।
৪.শাকিয়্যাহঃ যারা বলে, রূহ বা আত্মাই ঈমান এবং তারা নিজের ঈমান নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে।
৫.নাহমিয়্যাহঃ যারা বলে, জ্ঞানের নাম ঈমান। যে ব্যক্তি আদিষ্ট ও নিষিদ্ধ সকল বিষয়াদি সম্পর্কে অজ্ঞ সে কাফির।
৬.আমলিয়্যাহঃ যারা বলে, আমলের নাম ঈমান।
৭.মান্কুসিয়্যাহঃ যারা বলে, ঈমান কখনো কম হয় আবার কখনো বেশি হয়।
৮.মুস্তাছনিয়্যাহঃ যারা বলে, আমরা ইন্শাআল্লাহ্ মু’মিন।
৯.আশ্রাবাহঃ যারা বলে, কিয়াস বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য এবং দলিল হওয়ার গ্রহণযোগ্যতা রাখে না।
১০.বদঈয়্যাহঃ যারা বলে, বাদশাহর আনুগত্য পোষণ করা ওয়াজিব, যদিও সে গুনাহর নির্দেশ দেয়।
১১.মুশাব্বিহিয়্যাহঃ যারা বলে, আল্লাহ তা‘আলা হযরত আদম (عليه السلام)কে স্বীয় আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন।
১২.হস্বিয়্যাহঃ যারা বলে, ওয়াজিব, সুন্নাত এবং মুস্তাহাব সবারই হুকুম এক।
5. আল্-ফরকুল ইসলামিয়াহ্।
মোস্তফা (ﷺ) এর ফযিলত ও বৈশিষ্ট্যাবলীর বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১১ঃ মোস্তফা (ﷺ) এর ইচ্ছানুযায়ী তিন ওয়াক্ত নামায না পড়ার অনুমতি সাপেক্ষে ইসলাম কবুল করা কিভাবে হলো? আলোচনা কর।
✍ উত্তরঃ মুসনদে ইমাম আহমদে সকল বর্ণনাকারী সেক্বাহ ও গ্রহণযোগ্য এবং বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত আছে যে,
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ عَنْ قَتَادَةَ عَنْ نَصْرِ بْنِ عَاصِمٍ عَنْ رَجُلٍ مِنْهُمْ أَنَّهُ أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَسْلَمَ عَلَى أَنَّهُ لَا يُصَلِّي إِلَّا صَلَاتَيْنِ فَقَبِلَ ذَلِكَ مِنْهُ .
এক ব্যক্তি মোস্তফা (ﷺ) এর দরবারে এসে এই শর্তে ইসলাম কবুল করল যে, সে কেবল দুই ওয়াক্ত নামাযই পড়বে। হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ) তার এই আবেদন গ্রহণ করলেন। 6. মুসনদে ইমাম আহমদ।
অথচ উম্মতে মুহাম্মদী এর ফযিলত ও বিশেষত্ব সমূহের অন্যতম হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামায। পাঁচ ওয়াক্ত নামায এই উম্মতের জন্য নির্দিষ্ট, যা অন্য কোন উম্মতের জন্য ছিল না।
এই দুই ওয়াক্ত নামাযের অনুমতি প্রদান করা হুযূর মোস্তফা (ﷺ) এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব। হুযূর দুই ওয়াক্ত নামায পড়ার শর্তে ইসলাম গ্রহণ করার আবেদন মঞ্জুর করেন। এটা ছিল উক্ত ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ, অন্য কারো জন্য নয়। এমনি তো সামগ্রিকভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ের মাধ্যমে ইসলাম কবুল হয়।
❏ প্রশ্ন-১২ঃ হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)-এর আসরের নামায ও সূর্য পুনরায় উদিত হওয়ার প্রমাণ সম্পর্কে মতামত কি? অর্থাৎ- এক বর্ণনা মতে, ‘হুযূর হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) এর কোলে মাথা রেখে আরাম করছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)’র আসরের নামায সূর্যাস্ত যাওয়ার কারণে ছুটে যায়। হুযূর জাগ্রত হয়ে হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)কে নামায আদায় করেছে কিনা জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তরে না বলেন। একথা শুনে হুযূর দু‘আ করলেন, ফলে সূর্য পুনরায় আছর ওয়াক্তে ফিরে আসলে হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) আসরের নামায আদায় করেন।’, উক্ত রিওয়ায়েত শুদ্ধ কিনা?
✍ উত্তরঃ এই রেওয়ায়েতটি হযরত ইমাম তাবরানী (رحمه الله تعالي ) স্বীয় গ্রন্থ ‘আল-মু‘জমুল কবীর’ গ্রন্থে হযরত আসমা বিনতে উমাইস (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণনা করেন।
7. ইমাম তাবরানী রচিত, আল-মু‘জামুল কবীর, খন্ড-২৪, পৃষ্ঠা-১৪৫।
হযরত ইমাম আবু জাফর ত্বাহাবী ‘মুশকিলুল আছার’ গ্রন্থে এবং কাযী আয়াজসহ অন্যান্য মুহাদ্দিসীনগণ উক্ত হাদীস শরীফ বিশুদ্ধ বলেছেন। আর তাবরানী বর্ণিত হাদীসের রেওয়ায়েতকেও বিশুদ্ধ বর্ণনাসূত্রে গণ্য করেছেন।
সৈয়্যদ মাহমুদ আলুসি (رحمه الله تعالي ) فطفق يخصفان আয়াতের তাফসীরে উক্ত হাদীস শরীফ বিশুদ্ধ হওয়া সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
8. রুহুল মা‘আনি, খন্ড-২৩, পৃষ্ঠা-১৯৪।
কিন্তু ইবনে জওযী, ইবনে তাইমিয়া এবং আহমদ বিন হাম্বল (رحمه الله تعالي ) উক্ত হাদীসকে ‘মওজু‘আত’-এর মধ্যে গণ্য করেছেন। তবে উক্ত হাদীস দিরায়ত বা রেওয়ায়েতের দিক দিয়ে সুদৃঢ় ও বিশুদ্ধ মনে হয়। কেননা মুহাক্কিক ওলামাই কিরাম উক্ত হাদীস সম্পর্কে অভিমত পেশ করেছেন, যদিও রেওয়ায়েত সম্পর্কে কিছু কথা রয়েছে কিন্তু নবী-রাসূলগণের শানে রিসালতে, মু‘জিযা ও অলৌকিকত্বের এক মহান বাস্তব অধিকার রয়েছে। বিশেষ করে সৈয়্যদুল আম্বিয়া (ﷺ)-এর ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে মন্তব্য ও সমালোচনা করার কারো কোন অধিকার নেই।
❏ প্রশ্ন-১৩ঃ মি‘রাজ কতবার হয়েছে? কখন এবং কোন তারিখে সংঘটিত হয়েছে?
✍ উত্তরঃ মি‘রাজ সর্বমোট ৩৪ বার সংঘটিত হয়েছে। তন্মধ্যে কেবল একবার সশরীরে, বাকী সব রূহানীভাবে। যা নবুয়্যতের পূর্ব থেকে শুরু হয় এবং বিছাল শরীফের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। সশরীরে মি‘রাজ ২৭ রজব সোমবার রাত্রে সংঘটিত হয়- অধিকাংশ ওলামাই উম্মত একথার ওপর একমত। সোমবারের হাক্বিকত, ফযিলত, মহত্ত্ব, বুযূর্গী ও শরাফত মহান আল্লাহর নিকট উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। যার প্রমাণ হচ্ছে হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ)-এর মি‘রাজ হয়েছিল সোমবার রাত্রে, পবিত্র মক্কা মুয়ায্যমা থেকে হিজরত করেছিলেন সোমবার দিন, ওহীর ধারক ও বাহক হুযূর সোমবার মদিনায় প্রবেশ করেন, হুযূর-এর বেলাদত ও ওফাত শরীফ হয় সোমবার এবং পবিত্র রমযানে কোরআন শরীফ নাযিল হয় সোমবার ইত্যাদি। এখানে মোস্তফা (ﷺ) এর জন্য দ্বিতীয় স্থানে নির্দিষ্ট হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেহেতু সোমবারকে يوم الاثنين বলা হয়। الف (আলিফ) এবং يوم الاحد দ্বারা ذات বা সত্তা নির্দিষ্টকরণের মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আর باء (বা) يوم الاثنين দ্বারা صفت বা গুণাবলীর মর্যাদাকে মান্য করা হয়।
فافهم ولاتكن من الجاهلين
অর্থাৎ- ‘এ বিষয়ে তোমরা চিন্তা-গবেষণা কর, অজ্ঞদের অন্তভুর্ক্ত হয়ো না।’
❏ প্রশ্ন-১৪ঃ মি‘রাজ শরীফ রাত্রে কেন হয়েছে? রাতের পরিবর্তে যদি দিনে হতো, তাহলে কারো সমালোচনা করার সুযোগ থাকত না।
✍ উত্তরঃ রাত সৃষ্টি করা হয়েছে বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর মিলনের ও সাক্ষাতের নিমিত্তে। তাই রাত হলো মিলন ও একত্রিত হওয়ার উপযুক্ত সময়। আর দিন হলো বিচ্ছেদ ও দূরে থাকার। অথবা এভাবে বলা যায়, রাত হলো গোপন বিষয় সমূহের প্রকাশস্থল এবং দিন হলো প্রকাশ্য বিষয়সমূহের প্রকাশস্থল। সুতরাং মি‘রাজের জন্য রাতই উপযুক্ত সময়।
❏ প্রশ্ন-১৫ঃ হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)’র জন্য রদ্দুস শামস বা সূর্য পুনরায় উদিত হওয়া সংক্রান্ত ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي )-এর বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস শরীফের ইবনে তাইমিয়া কর্তৃক সমালোচনা করার মূল কারণ কী? রদ্দুস শামস-এর বাস্তব ঘটনা কী? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ রদ্দুস শামস বা সূর্য পুনরায় উদিত হওয়ার মূল ঘটনা সম্পর্কে মুহাদ্দিস আনওয়ার শাহ্ কাশ্মিরী বলেছেন, নবী করীম হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)কে কোন প্রয়োজনীয় কাজে আসরের পূর্বে পাঠিয়েছিলেন। তিনি প্রয়োজন সেরে আসতে আসতে আসরের নামায পড়ার আগে সূর্য ডুবে যায়। হুযূর কে এ খবর দেয়া হলে তিনি দু‘আ করেন। ফলে তাঁর দু‘আর বদৌলতে আল্লাহ্ তা‘আলা সূর্যকে পুনরায় উদিত করেন। হাদীসের বর্ণনা সূত্রের ভিন্নতার কারণে উক্ত ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায় যা মূল ঘটনার সাথে সংশিষ্ট নয়।
হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) আসরের নামায কেন আদায় করেন নি এ প্রসঙ্গে মুহাদ্দিস আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী বলেন, আমার মতে এর কারণ হচ্ছে এই যে, হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)-এর নিকট দু’টি হুকুম একই সময় একত্রিত হয়েছিল।
প্রথমতঃ সকলের জন্য সাধারণ হুকুম- সময় মতো নামায আদায় করা,
দ্বিতীয়তঃ বিশেষ হুকুম- নবী করীম (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে তাঁকে যে প্রয়োজনে পাঠানো হয়েছিল তা সূর্যাস্তের পূর্বে সম্পাদন করে ফিরে আসা।
যেমন- বুখারী শরীফে বনু কুরাইযার ঘটনা বর্ণিত আছে যে, রাসূলে করীম সাহাবা-ই কিরামকে বনু কুরাইযায় পৌঁছে আসরের নামায আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আসরের সময় পথিমধ্যে হয়ে যাওয়াতে কিছু সংখ্যক সাহাবা আল্লাহ তা‘আলার সাধারণ হুকুমের প্রতি লক্ষ্য করে পথিমধ্যে সময় মতো নামায আদায় করে নেন। আর কতিপয় সাহাবী বিশেষ হুকুমের প্রতি লক্ষ্য করে আদায় করেননি। তাঁরা হুযূর (ﷺ)-এর বিশেষ নির্দেশনাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। অতএব বুঝা গেল, স্পষ্টতঃ কারো থেকে আল্লাহর সাধারণ হুকুম আবার কারো থেকে বিশেষ হুকুম ছুটে গেল। এ ঘটনা হুযূর (ﷺ) জানার পর কোন দলকে কিছুই বলেন নি।
باب مرجع النبىﷺ من الاحزاب
অর্থাৎ- খন্দকের যুদ্ধ হতে হুযূর-এর ফিরে আসার সময় উক্ত ঘটনা সম্পর্কিত বর্ণনা বুখারী শরীফের ৫৯১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর শাহ সাহেব বলেন, এটা বড় কঠিন ইজতিহাদী মাসআলা, যার সমাধান সহজ নয়। কারণ বিশেষ হুকুমকে অগ্রবর্তী করা হলে সাধারণ হুকুম ছুটে যায়। আর সাধারণ হুকুমের ওপর আমল করলে বিশেষ হুকুম এড়িয়ে যেতে হয়।
তিনি আরো বলেন, রদ্দুস শামস বা সূর্য পুনরায় উদিত হওয়া এটা খাইবার যুদ্ধের ঘটনা। কতেক ওলামা ভুলবশতঃ এটাকে খন্দকের যুদ্ধ সম্পর্কে মনে করেছেন। অথচ খাইবরেই রদ্দুস শামস সম্পর্কিত ঘটনা ঘটে; আর খন্দকে গুরুবুশ শামস অর্থাৎ- সূর্য অস্ত যাওয়া সম্পর্কিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। সেখানে হুযূর ও হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আসরের নামায আদায় করেছিলেন। এ ঘটনাটি বুখারী শরীফের ১৮৪ ও ৫৯০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।
ইমাম ত্বাহাবী (رضى الله تعالي عنه)-এর বিশুদ্ধ হাদীস রদ্দুস শামস সম্পর্কে হাফিয ইবনে তাইমিয়ার সমালোচনার কারণঃ বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরামের নিকট একথা অস্পষ্ট নয় যে, এটা একটি সুপ্রসিদ্ধ ঘটনা। এ প্রসঙ্গে যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা কাউসারী রচিত গ্রন্থ ‘সীরাতে ত্বাহাবী’ এবং আল্লামা সৈয়দ আহমদ রেযা বজনূরী নকশবন্দী রচিত ‘আনওয়ারুল বারী’ গ্রন্থ থেকে কতিপয় উত্তর দেয়ার প্রয়াস পাব। হাফিয ইবনে তাইমিয়া ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي )’র রদ্দুস শামস সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কঠোর সমালোচনা করেছেন। এমন কি একথাও বলেছেন যে, ইমাম ত্বাহাবী বড় মাপের মুহাদ্দিস, ফকীহ ও আলিম হলেও অন্যান্য মুহাদ্দিস ও আলিমের ন্যায় ইসনাদে হাদীস সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল না।
মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي )-এর বিশুদ্ধতা ও নির্ভরযোগ্যতার ওপর বিশ্বাস করে বর্ণিত মূল ঘটনা চিহ্নিত করেন। তিনি এর চেয়ে বেশী আর কিছু বলেননি। হাফিয ইবনে তাইমিয়ার সমালোচনার কথাও উল্লেখ করেছেন। যার বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু কতেক ওলামা বলেন, এর বড় একটি কারণ এটাও হতে পারে যে, ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي )-এর প্রতি হাফিয ইবনে তাইমিয়ার উপরোক্ত সমালোচনা গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। কারণ হাফিয ইবনে তাইমিয়া অবশ্যই একজন বড় হাফিযে হাদীস এবং তাঁর অধিক জ্ঞান, মর্যাদা এবং জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে সকল ওলামা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ এবং তাঁকে সবাই সমর্থন করতেন। স্বয়ং মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরীও তাঁর প্রশংসাকারী ছিলেন। কিন্তু ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي )এর মতো উচ্চ পর্যায়ের মুহাদ্দিসের মোকাবিলায় ইবনে তাইমিয়ার সমালোচনা এমন পর্যায়ের যেরূপ আল্লামা শওকানী ইমাম বুখারী (رحمه الله تعالي ) এর সমালোচনা করেছিলেন।
মুহাদ্দিস আল্লামা কাউসারী (رحمه الله تعالي ) অবস্থার প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক ওলামায়ে কিরামের মধ্যে যাদের অনুভূতি শক্তি কম তাদের পথ নির্দেশনা ও আলোর পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে ইতিহাস ও রিজাল শাস্ত্র সম্পর্কিয় বিষয়ের ভুল-ভ্রান্তি দূরীকরণ সংশোধনকল্পে অপরিসীম পরিশ্রম করছেন।
جزاه الله خيرا عنا وعن المسلمين .
মুহাদ্দিস আল্লামা কাউসারী (رحمه الله تعالي ) তাঁর ‘সীরাতে ত্বাহাবী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي ) সম্পর্কে হাফিয ইবনে তাইমিয়ার এতো বড় গুজব ছড়িয়ে দেয়ার মূল কারণ হচ্ছে, তিনি রদ্দুস শামসের হাদীস শরীফটি বিশুদ্ধ প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) এর কৃতিত্ব, বুযূর্গী, শরাফত ও উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে ইবনে তাইমিয়ার গঠনকৃত থিউরির ওপর এক বিরাট প্রভাব পড়ছে, যা তিনি হযরত আলী মরতুযা (رضى الله تعالي عنه)কে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কেননা তার দৃষ্টিভঙ্গি খারেজী দলের চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিল। কারণ মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি ও দ্বিধা-বিভক্তি খারেজী ফেরকা থেকেই শুরু হয়েছিল। মুসলমানদেরকে কাফির, মুশরিক ও বিদ‘আতী হিসেবে তৈরী করার বিশাল কারখানা ও ইন্ডাষ্ট্রী উআইনা ও দরিনা নামক স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে নজদ হিসেবে প্রসিদ্ধ। উক্ত ফ্যাক্টরী থেকে শিরক ও বিদআত তৈরী হয়ে বের হয়, যা ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে বিস্তৃতি লাভ করছে।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে- كل اناء يترشح بما فيه ‘প্রত্যেক পাত্র কিংবা কারখানা ও ফ্যাক্টরী থেকে ওটাই বের হয়, যা এতে তৈরী হয়।’ পরবর্তীতে উক্ত ইন্ডাষ্ট্রীর ম্যানেজার ক্রমান্বয়ে ইবনে হাযম হয়ে ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাইয়ুম পর্যন্ত এবং পরিশেষে জেনারেল ম্যানেজার হন ইবনে আবদুল ওহাব নজদি। তাই তাদের অনুসারীদেরকে ওহাবী বলা হয়। যারা হিজায শরীফের নাম পরিবর্তন করে তাদের পূর্বপুরুষদের নামে নামকরণ করেন। এভাবে প্রত্যেক কিছুর পরিবর্তন করতে থাকে। অথচ প্রত্যেক ভাল কাজ সব সময় ভালই থাকবে আর মন্দ কাজ সব সময় মন্দই থাকবে। মন্দ মন্দই আর ভাল ভালই।
হাফিয ইবনে তাইমিয়া মূল আক্বীদা ও ফরঈ শাখা-প্রশাখাগত একক মাসআলাসমূহে মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি কোন ধরনের মুসলমান?
যখন যেখানে জাতির মধ্যে মৌলিক আক্বীদাগত মাসআলায় মতানৈক্য সৃষ্টি হয়, আল্লাহ্ তা‘আলার বিধান ও নিয়মানুসারে সেখানে নবী-রাসূল প্রেরণ করে থাকেন। যাতে ওই জাতিকে সরল ও সঠিক পথের দিক নির্দেশনা দিতে পারেন। হতে পারে এই দৃষ্টিকোণে হাফিয ইবনে তাইমিয়া গোপনে ও অপ্রকাশ্যভাবে নিজেকে নবী দাবী করেছেন। তাই শাস্তিও কম পেতে হয়নি তাকে। হিজায শরীফ যা জামাতার মিরাছ হিসেবে ওহাবীরা পেয়েছিল সে সুবাদে হারামাইন শরীফাইনেরও নাম পরিবর্তন করে সাউদিয়া নামে তারা নামকরণ করে দেয়।
সারকথা এই যে, ইবনে তাইমিয়া খারেজী সম্প্রদায়ের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হওয়ার প্রমাণ তার লিখিত ইবারত থেকেই বুঝা যায়। কেবল বিষয় অনুপাতে নয়।
রদ্দুস শামস-এর হাদীসকে কখনো বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত বলা যাবে না। যে বিষয়ের মাসআলা সে বিষয়ের উসূল বা নীতিমালার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে বাতিল প্রমাণ করা সম্ভব নয়। অবশ্য হাদীস শাস্ত্রের উসূল মতে বেশী জোর একথা বলা যাবে যে, উক্ত হাদীসের মান-মর্যাদা ও মরতবা অন্যান্য বিশুদ্ধ হাদীসে আহাদের সমপর্যায়ের।
হযরত ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي ) ইলালে হাদীস তথা হাদীস শুদ্ধ-অশুদ্ধ হওয়ার কারণসমূহ বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। অযথা রায় প্রদানের মতো ব্যক্তিত্ব তিনি ছিলেন না। সুতরাং তাঁর প্রদানকৃত বিশুদ্ধ রায় বাতিল প্রমাণ করা সহজ ব্যাপার নয়।
এমনকি অন্যান্য ওলামায়ে কিরাম এবং হাফিযে হাদীসগণের মতো মহান ব্যক্তিবর্গ প্রত্যেক যুগে উক্ত হাদীসের সনদ একত্রিত করেছেন। উক্ত হাদীসকে সহীহ বিশুদ্ধ ও তার ওপর আস্থা রেখেছেন এবং তা গ্রহণ করেছেন। যথা- হাফিযে হাদীস হুজ্জত হাকিম নিশাপুরী (رحمه الله تعالي ) এবং হাফিয সুয়ূতী (رحمه الله تعالي ) উক্ত বিষয়ের ওপর স্বতন্ত্র একটি রিসালা রচনা করেছেন। কাজী আয়ায শাফেঈ (رحمه الله تعالي )ও তাঁর শিফা শরীফে উক্ত হাদীস বিশুদ্ধ, সুদৃঢ় ও মজবুত বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। (বাতিলপন্থী লোকেরা বিপর্যয় ও ধ্বংস হোক।)
হাদীসসমূহের ওপর গভীর আলোচনা ও চিন্তা-গবেষণা করতে গিয়ে সৈয়্যদুনা ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي ) বিশেষ করে রিজালে হাদীস তথা হাদীসের বর্ণনা সূত্রের সমালোচনা ও বিশুদ্ধতার বর্ণনা করেছেন। তাঁর বহু কিতাবে রিজাল শাস্ত্রের সমালোচনার সুস্পষ্ট নিদর্শন ও প্রমাণ পাওয়া যায়। কারাবিসী লিখিত ‘কিতাবুল মুদালিস’ গ্রন্থের ভুল-ভ্রান্তি বিষয়ক আলোচনা ও সমালোচনা শুধু ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي ) ছাড়া আর কে করেছেন, বলুন তো? একমাত্র ইমাম ত্বাহাবীই (رحمه الله تعالي ) ‘কিতাবুল মুদালিসীন’ গ্রন্থের বর্ণনা সূত্রের বিশুদ্ধতার ওপর কঠোর সমালোচনা করেছেন। এত বড় হাদীস বিষয়ের খিদমত যিনি আঞ্জাম দিয়েছেন, তিনি রিজাল শাস্ত্রের ওপর অনভিজ্ঞ হলে কিভাবে কার্য সম্পাদন করতে পারেন? তা কখনো হয় না। এতদ্সত্ত্বেও ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي )কে রিজাল শাস্ত্র সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ছিলেন একথা বলা যাবে? কিংবা তাঁকে যার ধারাবাহিক ভুল-ভ্রান্তির ওপর হাফিয আবু বকর আস্-সামিত হান্বলীকে পুরো একটি কিতাব লিখতে হয়েছে।
9. আনওয়ারুল বারী, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-২১।
হাফিয ইবনে তাইমিয়ার দলিল পেশ করার ওপর একটি সমীক্ষা বা দৃষ্টিভঙ্গিঃ
এখানে একথাটিও উল্লেখ করার মতো যে, হাফিয ইবনে তাইমিয়া ও অন্যান্য উগ্র স্বভাবের লোকদের ন্যায়, যখন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন, তখন তার বিপরীতে অন্যান্যদেরকে সরাসরি না-হক্বের ওপর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতেন এবং তা নাকচ করতে প্রয়োজনাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করতেন। অর্থাৎ নিজের সামর্থ যোগ্যতা অভিজ্ঞতার পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করে তার বিপরীত অভিমত অশুদ্ধ প্রমাণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। যার পরিণাম এ দাঁড়ায় যে, পাঠকবৃন্দ চিন্তাবিদ ও গবেষকগণ প্রকৃত সঠিক তত্ত্ব ও তথ্য অনুসন্ধানে ব্যর্থ হয় এবং বাস্তব অনুধাবন করা থেকে অনেক দূরে চলে যায়। ফলে ভুল বুঝাবুঝি ও অশুদ্ধতার শিকার তো অবশ্যই হবে।
❏ প্রশ্ন-১৬ঃ যদি হুযূর(ﷺ)কে স্বপ্নযোগে শরীয়ত বিরোধী কোন হুকুম প্রদান করতে দেখলে এর হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ) কে স্বপ্নযোগে দেখা সত্য ও বরহক। সৈয়্যদুনা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, হুযূর মোস্তফা (ﷺ) ইরশাদ করেন,
مَنْ رَآنِي فِي الْمَنَامِ فَقَدْ رَآنِي فِي الْيَقَظَةِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ لَا يَتَمَثَّلُ عَلَى صُورَتِي.
যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখল, সে মূলতঃ আমাকে জাগ্রত অবস্থায়ই দেখল। কেননা শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না।
10.
১.ইবনে মাজাহ শরীফ।
২.সহীহ বোখারী শরীফ; হাদিস ৬৫৯২,
৩.মুসলিম ২২৬৬
অতএব, যে ব্যক্তি মোস্তফা (ﷺ) কে তাঁর পবিত্র দৈহিক গঠন (হুলিয়া শরীফ) ও আকৃতি মুবারক অনুযায়ী দেখেছে যা হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে তার স্বপ্ন হক্ব ও সত্য। নিঃসন্দেহে সে তাকেই দেখেছে, কেননা অভিশপ্ত শয়তানের এই শক্তি নেই যে, সে মোস্তফা (ﷺ)-এর আকৃতি ধারণ করবে।
স্মরণীয় যে, স্বপ্নে দেখা প্রত্যেক বিষয় জাগ্রত অবস্থায় দেখার মতো নয়। যেমন হুযূর(ﷺ)কে স্বপ্নে দেখলে কেউ সাহাবী হতে পারবে না। অনুরূপ স্বপ্নযোগে তাঁকে শরীয়ত বিরোধী কোন বিষয়ের হুকুম দিতে দেখলে তা শরীয়তের দলিল হবে না। শরীয়তের অনুসরণ বাধ্যতামূলকভাবে অবশ্যই করণীয়। যেমন- কোন ব্যক্তি হুযূর(ﷺ)কে দেখল তাকে মদ পান করার হুকুম করছেন। সে জাগ্রত হয়ে আশ্চযান্বিত হয়ে গেলেন। সে একজন আলিমে দ্বীনের নিকট গিয়ে তার স্বপ্নের বর্ণনা দিল। তিনি উত্তরে বলেন, এটা তোমার ভুল হচ্ছে, তিনি তোমাকে মদ পান করতে নিষেধ করেছেন কিংবা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, আগামীতে তোমার আক্বীদা বা আমলে শরীয়ত বিরোধী কোন কর্ম বা ফিৎনা-ফ্যাসাদ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সে ব্যাপারে হুশিয়ারী সংকেত দেয়া হয়েছে। এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে অনেক বড় দয়া ও মেহেরবানী যে, তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে। অনুরূপ ওলামায়ে কিরাম বিশদভাবে বর্ণনা দিয়েছেন যে, যদি কেউ হুযূর(ﷺ)কে অন্য কোন আকৃতি বা অবস্থায় দেখতে পায় যেমন- দাড়ি মুন্ডানোবস্থায়, মূলতঃ সে তাঁকে কে দেখেনি এবং তার এ স্বপ্ন ও ধারণা ভুল প্রমাণিত হবে।
মুহাদ্দিস সৈয়দ মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেছেন, হুযূর (ﷺ)কে যেকোন অবস্থায় দেখুক না কেন সে অবশ্যই তাঁকে দেখেছে। কেননা আকৃতি হচ্ছে উদাহরণ বা উপমা। কারণ তাঁর রূহে মুকাদ্দাসের আকৃতি ধারণ করার দুঃসাহস শয়তানের নেই যে, সে যে কোন আকৃতি ধারণ করে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ(ﷺ)বলে দাবী করবে। তবে এ ব্যাপারে ওলামায়ে ইসলাম একমত যে, স্বপ্নযোগে প্রকাশ্য শরীয়ত বিরোধী কোন হুকুম করতে দেখলে তা আমল করা জায়েয নেই। আর একথা বলতে হবে যে, উক্ত স্বপ্নে দর্শকের ভুল হয়েছে এবং সে প্রতারিত হয়েছে। শয়তান মানুষকে যখন জাগ্রত অবস্থায় এভাবে ধোকা দিচ্ছে, তাহলে স্বপ্নযোগে তাকে ধোকা দেয়া আরো সহজতর হবে।
11. মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান হায়দারাবাদী।
❏ প্রশ্ন-১৭ঃ عيد (ঈদ) অর্থ কী? ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা ছাড়া অন্য কোন ঈদ হতে পারে? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ عيد (ঈদ) অর্থঃ লোকজন একত্রিত হওয়ার দিন। মুসলমানদের উৎসবের দিন। বহুবচনে اعياد ।
عيد الشعانين অর্থাৎ- عيد الفضح، عيد القيامةঃ খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের ধারণা মতে হযরত ঈসা (عليه السلام)কে ক্রুশবিদ্ধ বা সুলিতে চড়ানোর দিন।
عيد الفطيرঃ ইহুদীদের একটি ধর্মীয় ঈদ।
عيد الميلادঃ খ্রীস্টানদের উৎসবের দিন (ঈযৎরংসধং উধু)। হযরত ঈসা (عليه السلام)এর জন্মদিন।
12. মিফতাহুল লুগাত, মাওলানা আবুল ফাতাহ সংকলিত। কোরআন মহল, মৌলভী মুসাফিরখানার বিপরীতে, করাচি।
عيدঃ খুশী, আনন্দ। খুশী, উৎসব ও ছুটির দিন। বহুবচেন اعياد ।
عيد الفىঃ হাজার বছর বর্ষপূর্তি।
عيد الفضحঃ খ্রীস্টানদের ধর্মীয় উৎসবের দিন।
عيد مِئوِىْঃ শত বর্ষপূর্তি।
عيد الميلادঃ জন্মোৎসব, জন্মবার্ষিকী, ইরৎঃয উধু ।
عيد وطنىঃ জাতীয় উৎসব দিবস।
13. অহিদুজ্জামান কিরানবী, শিক্ষক, দারুল উলুম দেওবন্দ। কুতুবখানা হোসাইনিয়া দেওবন্দ।
عيدঃ যা বারংবার আসে, মানুষের জমায়েত ও একত্রিত হওয়ার দিন, মুসলমানদের উৎসবের দিন। বহুবচনে اعياد ।
عيد ঃ اصله من عود المسرة ورجوعها . وياؤه منقلبة عن وج-
عه اعياد . وانما جمع بالياء واصله الواؤ للزومها فى الواحد، وقيل للفرق بينه وبين اعواد الخشب . والعيد اسم للموسم المعهود يحتفل به الناس سنويًا . قال الله تعالٰىঃ تَكُونُ لَنَا عِيْدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِنْكَ . (سورة مائدة)
عيد المائدة الّتى انزلها الله تعالٰى على عيسىٰ عليه السلام اكلها قومه منه ونحن المسلمون ولنا عيدان هماঃ عيد الفطر وعيد الاضحٰى.
عيد(ঈদ)ঃ আনন্দের দিন। খুশীর দিন। বহুবচনে اعياد । এটা عيد হতে উৎকলিত। যার অর্থ- ফিরে আসা। কথিত আছে যে, ঈদকে এজন্য ঈদ বলা হয়- যেহেতু ওটা প্রত্যেক বছর ফিরে আসে। ‘ইযহার’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, আরবে প্রত্যেক আনন্দের জন্য আয়োজিত সমাবেশকে ঈদ বলে থাকতো। কারণ উহা ফিরে আসাতে আনন্দও ফিরে আসে। এটাও বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা ঈদের দিন যেহেতু তাঁর প্রিয় বান্দাদের ওপর অসংখ্য রহমত ও বরকত নাযিল করেন, তাই এটাকে ঈদ নামকরণ করা হয়েছে।
অতএব হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) বলেন-
ليس العيد لمن لبس الجديد، انما العيد لمن أمن الوعيد .
‘ঈদ ওই ব্যক্তির জন্যে নয় যে নতুন কাপড় পরিধান করে, প্রকৃত ঈদ সে ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি, আযাব ও গজব থেকে পরিত্রাণ লাভ করেছে।’ প্রত্যেক জাতির মধ্যে ঈদ প্রথা বিদ্যমান আছে এবং তা নিজ নিজ সংস্কৃতি অনুযায়ী পালন করে থাকে। রাসূলুল্লাহ যখন মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ আনেন, তখন মদিনাবাসীরা ইরানীদের অনুসরণে নাইরোজ ও মেহেরজান নামে দু’টি ঈদ উদযাপন করতেন। রহমতে ‘আলম নূরে মুজাস্সাম মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা উক্ত দু’দিনের পরিবর্তে, এর চেয়ে আরো উত্তম দুটি দিন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।"
14. সুনানে আবু দাউদ শরীফ, হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত।
ইসলাম দুই ঈদের দিনকে পানাহার ও আনন্দের দিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একদিকে শারীরিক আনন্দ উপভোগের মাধ্যম বানিয়েছেন, অন্যদিকে উভয় দিনে নামায, সদকা, দান-খয়রাতকে ওয়াজিব করে আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের উসিলাও বানিয়ে দিয়েছেন। ইসলাম ধর্মে দু’ঈদের সূচনা দ্বিতীয় হিজরীতে হয়। পবিত্র কোরআনে কারীমে ‘ঈদ’ শব্দটি হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর দু‘আতে এসেছে। যা তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সহচর ও সাহায্যকারীদের জন্যে তাদের দাবীর প্রেক্ষিতে আসমান থেকে খাদ্য ভর্তি দস্তরখান অবতরণ করার জন্য দু‘আ করেছিলেন। অতএব তিনি বলেন,
اَللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا
অর্থাৎ- ‘হে আল্লাহ্! আমাদের জন্য খাদ্য ভর্তি দস্তরখান আসমান থেকে নাযিল করুন। যা আমাদের ও পরবর্তী প্রজন্মদের জন্য ঈদের (উৎসবের) দিন হিসেবে নির্ধারণ করতে পারি।’
অতএব তার দু‘আ মোতাবেক রবিবার আসমান থেকে খাদ্য নাযিল হতে শুরু করলো, খ্রীস্টানগণ সে দিনটিকে ঈদের দিন হিসাবে নির্ধারিত করেন। কতিপয় রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, চলিশ দিন যাবত সর্ব সাধারণের জন্য অনুমতি ছিল, ফলে তারা সকলেই উপকৃত হয়। চলিশ দিন পর আমীর-ওমরা ও ধনীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হলে তারা তা অমান্য করার দরুন তাদের ওপর আসমানী খাদ্য অবতরণ বন্ধ হয়ে যায় এবং তাদের ওপর আল্লাহর পক্ষ হতে শাস্তি অবতীর্ণ হয়।
অন্য বর্ণনা মতে, আল্লাহ্ তা‘আলা মায়িদা বা আসমানী খাদ্য এ শর্তে নাযিল করেন যে, এরপরও যদি কেউ কাফির হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের ওপর এমন শাস্তি নাযিল করবেন, যা অন্য কারো ওপর নাযিল করা হয়নি। এতে হাওয়ারীগণ ভীত হয়ে তাদের দাবী প্রত্যাহার করেন। ফলে মায়িদা অবতরণ বন্ধ হয়ে যায়।
15. কামুসুল কোরআন, কাজী জয়নুল আবেদীন রচিত।
ঈদ ওই নিয়ামত ও আনন্দকে বলা হয় যা প্রত্যেক বছর বারংবার ঘুরে ফিরে আসে। এমন বিষয়ের ওপর খুশি ও আনন্দ যা আল্লাহ তা‘আলার রহমত, করুণা ও অনুগ্রহ দ্বারা অর্জিত হয়। প্রত্যেক বছর রহমত, ফযিলত ও অনুগ্রহের দ্বারা যে আনন্দ হাসিল হয় তাকে ঈদ বলে এবং এটাকে প্রকৃত খুশী বলা হয়। এ কারণে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা খুশী উদযাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ্ বলেন-
قُلْ بِفَضْلِ اللهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا الخ .
এ সকল বিষয় প্রাপ্তির ওপর আনন্দ উৎসব পালন করাকে ‘কোরআনী ঈদ’ বলা হয়। যেমন সৈয়্যদুনা হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর দু‘আতে এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন- عِيْدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا. ইত্যাদি কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয়। আর এগুলো এক একটি নিয়ামত ও বরকতের বিনিময়ে হয়েছে বিধায় একে ঈদ বলা হয় এবং এটা প্রকৃত কোরআনী ঈদ বলা হয়েছে অথবা প্রচলিত পারিভাষিক বলা হয়।
দ্বিতীয়তঃ শরয়ী ঈদ। যা বাৎসরিক দু’ঈদ হিসেবে প্রসিদ্ধ। এটা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। আর প্রকৃত প্রচলিত ঈদ যা পূর্বে উল্লেখিত আল্লাহর নিয়ামত ও ফযল অর্জনের দরুন পালন করা হয়। এটা পবিত্র কোরআন দ্বারা প্রমাণিত। যেমন হযরত ঈসা (عليه السلام) আসমানী খাবার ‘মান্না ও সালওয়া’ অর্জন করার ওপর যে আনন্দ উৎসব হাসিল করেছিলেন, এটাকেই কোরআনী পরিভাষায় ঈদ বলা হয়েছে।
অন্ধকার যুগ থেকে হিদায়তের যুগের সূচনালগ্ন হুযূর (ﷺ)-এর দুনিয়াতে আগমন মুসলমানদের জন্য অনেক বড় ঈদ। এর চেয়ে উত্তম দুনিয়াতে আর কোন ঈদ হতে পারে না। এটি এমন এক অতুলনীয় ও অপরিসীম নিয়ামত যার কোন তুলনা ও নজীর নেই। এর চেয়ে বড় দয়া, মেহেরবানী ও পুরস্কার সৃষ্টি জগতের প্রতি অন্য কোন বস্তু নেই। এটা আল্লাহর একত্ববাদের পর অমূল্য ও অতুলনীয় নিয়ামত। অতএব এ নিয়ামত অর্জনের ওপর খুশী উদযাপন করা সুন্নাতে ইলাহি ও ইসলামী কানুন মোতাবেক পূণ্যের কাজ। শরয়ী উভয় ঈদের সঙ্গে এই ঈদের সম্পর্ক হচ্ছে نوعى তথা এক প্রকারের সম্পর্ক, كلى বা পূর্ণাঙ্গ নয়। একে বিদ‘আত বলা এক নতুন অজ্ঞতা বৈ কিছু নয়। শরয়ী ঈদ হচ্ছে সাময়িক আনন্দ, যা ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর হিসেবে কোরবানী ও রোযা দ্বারা পরিচিত স্পষ্টতঃ যা বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয়।
চিরস্থায়ী নিয়ামত, শাশ্বত দয়া অনুগ্রহকে ও কোরআনি পরিভাষায় ঈদ বলা হয়। সুতরাং একে বিদ‘আত বলা একটি নতুন আবিষ্কার, যা কোন জ্ঞানী ও বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তির জন্য সমীচীন নয়। আল্লাহ্ পাক সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুন।
বিদ‘আত হচ্ছে পূর্বের কোন প্রকারের নমুনা ও নিদর্শন ব্যতীত শরয়ী বিধান মনে করা। অতএব এটা শরয়ী বিদ‘আত কখনো হতে পারে না এবং এখানে تشبه বা তুলনামূলক কোন মাসআলা সংযুক্ত করা কোন ভাবেই উচিত নয়। কেননা এমন কোন বিষয় পাওয়া যাবে না যা কাজে-কর্মে কিংবা আকৃতি-প্রকৃতির দিক দিয়ে অন্যের সঙ্গে তুলনাবিহীন হবে। বিশেষতঃ এটাকেই বিদআতে শরয়ী আখ্যায়িত করা মানে আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ(ﷺ)এর ইহ জগতে তাশরীফ আনয়নে তাদের অসন্তুষ্টি ও বিরুদ্ধাচারিতার বহিঃপ্রকাশ। আর বিদআতের সাথে সম্বোধিত বস্তু, তা খুবই খারাপ ও মন্দ যা আল্লাহ্ তা‘আলার দয়া, ফযল ও অনুগ্রহের বিপরীত বিষয় বলে গণ্য। যে সকল বিষয় হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর প্রতি সম্বোধিত, সেগুলো শরয়ী বিদআত হতে পারে না। যেমন- মিলাদুন্ নবী ও উরশুন্ নবী । তবে পদ্ধতিগত ও বাস্তবতায় কোন অসংযত ও অশোভনীয় কিছু পরিলক্ষিত হলে তা অবশ্যই সংশোধন করা যেতে পারে। মূল বিষয়কে পরিবর্তন ও সংশোধন করার কোন মু’মিন মুত্তাকির অধিকার নেই। তাই এগুলোকে অযথা বিদআতে শরয়ী বলা মানে মুসলমানদের মাঝে দ্বিধাবিভক্তি ও ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা। এটা কোন ইসলামী খিদমত নয়, বরং ইসলামকে ধ্বংস করা বৈ আর কিছু নয়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِي مِنْ دُونِ اللهِ وَلَكِنْ كُونُوا رَبَّانِيِّينَ بِمَا كُنْتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنْتُمْ تَدْرُسُونَ .
‘কোন ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার কিতাব, হিকমত ও নবুওয়ত প্রাপ্তির পর একথা বলতে পারে না যে, ‘তোমরা আল্লাহকে পরিহার করে আমার বান্দা হয়ে যাও’ এটা সম্ভব নয়। বরং তারা বলবে যে, ‘তোমরা আল্লাহওয়ালা হয়ে যাও, যাতে তোমরা কিতাব শিখাতে পার এবং তোমরা নিজেরাও পড়তে পার।’
16. সূরা আলে ইমরান, আয়াতঃ ৭৯।
এই আয়াতের একান্ত জরুরী শব্দাবলীর অর্থ ও মর্ম নিম্নে প্রদত্ত হলো,
بشر (বশর) শব্দের অর্থঃআল্লামা মজদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব ফিরোজাবাদী (মৃত্যু- ৮১৭ হিজরী) বলেন, বশর মানুষকে বলা হয়। এটি একবচন হোক কিংবা বহুবচন হোক, বহুবচনে ابشار আসে। بشر অর্থ মানুষের বাহ্যিক চামড়া। আর চামড়ার সাথে চামড়া মিলানোকে মুবাশারাত বলে। বাশারত ও বাশরী শব্দের অর্থ- সুসংবাদ দেয়া।
17. ক্বামূসুল মুহীত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২৯৮।
বশর, ইনসান ও আদমী- এই শব্দগুলোর মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান আছে। প্রকাশ্য ও বাহ্যিক চামড়া এবং মুখমন্ডলের দিক বিবেচনাকে বশর বলা হয়, হাকীকত বা প্রকৃত মূলতত্ত্বকে ইন্সান বলে এবং জাতি ও বংশ পরিক্রমাকে আদমী বলা হয়।
আল্লামা হুসাইন বিন মুহাম্মদ রাগেব ইস্পাহানী (মৃত্যু-৫০২ হিজরী) লিখেছেন, চামড়ার বাইরের অংশকে بَشْرَةٌ (বশরাহ) এবং চামড়ার ভেতরের অংশকে أدَمَةٌ (আদামাহ্) বলা হয়। মানবজাতিকে তাদের বাহ্যিক চামড়ার দিক বিবেচনায় বশর বলে। কেননা জীব-জন্তুর চামড়া বড় পশম যুক্ত ও বিভিন্ন রং বিশিষ্ট হয়ে থাকে। কোরআন মজিদে যখন মানবজাতির দেহ ও বাহ্যিক অবস্থার বিবেচনা করা হয় তখন বশর শব্দ ব্যবহার করা হয়।
মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন- وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَرًا ‘তিনিই সে সত্তা যিনি পানি থেকে মানব আকৃতি সৃষ্টি করেছেন।’
18. সূরা ফোরকান, আয়াত-৫৪।
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন, إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ طِينٍ ‘নিশ্চয়ই আমি মাটি দ্বারা মানব সৃষ্টি করব।’
19. সূরা ছোয়াদ, আয়াতঃ ৭১।
কাফিররা যখন নবী-রাসূলগণের প্রতি হেয়পতিপন্ন করা উদ্দেশ্য হতো তখন তাঁদেরকে ‘বশর’ শব্দ বলে আখ্যায়িত করতো। যেমন,
إِنْ هَذَا إِلَّا سِحْرٌ يُؤْثَرُ . إِنْ هَذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ .
‘কাফির বললো, এ কোরআন তো আগের লোকদের থেকে প্রাপ্ত যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়। এ তো মানুষের কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।’
20. সূরা মুদ্দাস্সির, আয়াতঃ ২৪-২৫।
সূরা হুদে আছে,
مَا نَرَاكَ إِلَّا بَشَرًا مِثْلَنَا
‘আমরা তো আপনাকে আমাদের মতো একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’
21. সূরা হুদ, আয়াত-২৭
সূরা বনি ইসরাঈলে উল্লেখ আছে-
قَالُوا أَبَعَثَ اللهُ بَشَرًا رَسُولًا
‘কাফিররা বলতো, আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের মতো একজন মানুষকেই কি নবী করে পাঠালেন।’
22. সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত-৯৪
সূরা মারইয়ামে আছে, فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا
‘হযরত সৈয়্যদুনা জিবরাইল (عليه السلام) যখন হযরত মরিয়ম (عليه السلام)-এর নিকট মানবীয় আকৃতি ধারণ করে তাঁর সামনে আসলেন তখন বলেন।’
23. সূরা মরিয়ম, আয়াত-১৭
হযরত জিবরাইল (عليه السلام) বশরী আকৃতিতে আসলেন এখানে এটাই উদ্দেশ্য। আর মিসরের মহিলারা হঠাৎ যখন হযরত ইউসুফ (عليه السلام)কে আবরণ বিহীন দেখতে পেল, তৎক্ষাণাৎ বলে উঠল-
حَاشَ لِلهِ مَا هَذَا بَشَرًا
‘আল্লাহ'র শপথ! কখনোই নয়- এ ব্যক্তি মানব নয়’।
24. সূরা ইউসুফ, আয়াত-৩১
এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, মিসরের মহিলারা হযরত ইউসুফ (عليه السلام)কে অনেক উঁচু পর্যায়ের মনে করে তাঁর সত্তাগত বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃত অবস্থাকে মানবোর্ধ্ব ধারণা পোষণ করেছিলেন। বাশারত, মুবাশারাতও উক্ত শব্দ থেকে নির্গত।
মানুষ যখন কোন সুসংবাদ শুনতে পায় তখন তার চেহারায় খুশীর আলামত ও চিহ্ন প্রস্ফুটিত হয়, সে জন্য তাকে বাশারত বলা হয়। মুবাশারাত মানে নারী-পুরুষ নিজেদের দেহের চামড়াকে পরস্পর মিলানো এবং একে অপরের মধ্যে সংযুক্ত ও মিলিত হওয়া। কোরআন মজিদ ও হাদীস শরীফে এ দু’টি শব্দের ব্যবহার এসেছে।
25. আল-মুফরাদাত, পৃষ্ঠা-৪৭-৪৮, মাকতাবা-ই ইরান।
ইমাম মুসলিম (رحمه الله تعالي ) সৈয়্যদুনা হযরত আবু হুরায়রা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, আমাকে সকল নবী-রাসূলগণের ওপর ছয়টি বিষয়ে ফযিলত দেয়া হয়েছেঃ-
১.جوامع الكلم অর্থাৎ- স্বল্প কথায় ব্যাপক অর্থবোধক শব্দাবলী দান করা হয়েছে।
২.رعب অর্থাৎ-আমাকে ভীতি-আতঙ্ক ও প্রভাব-প্রতিপত্তি দ্বারা সম্মানিত করা হয়েছে।
৩. যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আমার জন্য হালাল করা হয়েছে।
৪.সমগ্র জমিনকে আমার জন্যে পবিত্রকারী, তায়াম্মুমের উপকরণ এবং মসজিদে পরিণত করে দিয়েছেন।
৫.আমাকে সমগ্র সৃষ্টির প্রতি রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন এবং
৬. আমার ওপর সমগ্র নবীগণের আগমন সমাপ্ত করেছেন।
হযরত জাবের (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, প্রত্যেক নবীকে বিশেষতঃ তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরণ করেছেন। কিন্তু আমাকে প্রত্যেক শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ তথা সমগ্র বিশ্বের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে।
26. মুসলিম শরীফ, খন্ড-১, হাদীস নং-৫২১, ৫২৩; জামে তিরমিযী, খন্ড-৩, হাদীস নং-১৫৫৯
কুরআনের আয়াত এবং হাদীস শরীফ একথার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا
‘আমি আপনাকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল লোকদের জন্য ভীতি প্রদর্শনকারী ও সুসংবাদ দানকারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।
27. সূরাঃ সাবা, আয়াত-২৮
উপরিউক্ত কুরআনের আয়াত ও হাদীস শরীফ দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, হুযূর মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) কে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। এর মর্মার্থ হচ্ছে, তাঁর শরীয়ত কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন,
إِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ
অর্থাৎ-‘ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।’
28. সূরাঃ আলে-ইমরান, আয়াত-১৯
নিশ্চয়ই একথা স্পষ্ট বুঝা গেল যে, পূর্ববর্তী সকল ধর্ম নিজ নিজ যুগে পরিপূর্ণ কার্যকর ছিল। কিন্তু যখন ইসলাম ধর্ম কিয়ামত পর্যন্ত পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে আল্লাহ্ তা‘আলা অনন্য বৈশিষ্ট্যের ঘোষণা দিলেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ الخ
‘আমি আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি।’(যা আমার একমাত্র মনোনীত ধর্ম- ইসলাম)।
29. সূরা মায়েদা, আয়াত-৩
ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জারীর তাবারী (ইন্তিকাল ৩১০ হিজরী) (رحمه الله تعالي ) বলেছেন, উক্ত আয়াত হুযূর-এর বিদায় হজ্বের বছর আরাফাত দিবসে জুমাবার অবতীর্ণ হয়। এরপর হালাল-হারাম সম্পর্কিত আহকামের আর কোন আয়াত নাযিল হয়নি। বরং উক্ত আয়াত নাযিলের পর মাত্র ৯১দিন পর্যন্ত তিনি ইহজগতে তাশরীফ ফরমা ছিলেন।
ইবনে জারীর (رحمه الله تعالي ) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। 30. জামেউল বয়ান, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-১০৬, বৈরুত।
ইমাম তিরমিযী (رحمه الله تعالي ) (ইন্তিকাল-২৭৯) হযরত আম্মার ইবনে আবি আম্মার (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণনা করেন যে, প্রখ্যাত সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) এক ইহুদীর সামনে,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ الخ
আয়াতটি তিলাওয়াত করলে ইহুদী লোকটি বলল, উক্ত আয়াত যদি আমাদের ওপর নাযিল হতো, আমরা ওই দিন ঈদ উদযাপন করতাম। ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) বলেন, এই আয়াত আমাদের দুই ঈদের দিন নাযিল হয়েছে, জুমার দিন ও আরাফাতের দিন।
31. জামে তিরমিযী, খন্ড-১, হাদীস নং-৩০৫৫।
উক্ত হাদীস দ্বারা বুঝা গেল যে, জুমার দিন মুসলমানদের জন্য ঈদ এবং আরাফাতের দিনও মুসলমানদের জন্য ঈদ। মিলাদুন্-নবী কে ঈদ মানতে যারা নারাজ তারা বলে, মুসলমানদের শুধু দু’টি ঈদ রয়েছে। তারা উক্ত বিশুদ্ধ হাদীসের প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত করেনি। হ্যাঁ! অবশ্য একথা বলা যেতে পারে যে, ঈদ বলতে প্রসিদ্ধ দু’টি, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাকে বুঝায়। যার সম্পর্কে শরীয়তের নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। যেমন- ঈদুল ফিতরের দিন সকালে মিষ্টিমুখ করা হয়, এরপর ঈদগাহে দুই রাকাত নামায আদায় করা এবং পরে খুৎবা পাঠ করা ইত্যাদি। অনুরূপ ঈদুল আযহায় প্রথমে নামায পড়া এবং এরপর খুৎবা পাঠ করা হয়। অতঃপর সাহেবে নেসাব কুরবানী করা ইত্যাদি।
জুমার দিন হচ্ছে মুসলমানদের জমায়েত ও একত্রিত হওয়ার দিন। এ সময় জোহরের পরিবর্তে দু’রাকাত জুমার নামায ফরয এবং খুতবা পাঠ করা আবশ্যক। আরাফাতের দিন হাজীগণ ছাড়া অন্য লোকদের রোযা পালন করাতে অসংখ্য ফযিলত রয়েছে এবং দু’বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণাও রয়েছে।
ইমাম রাগেব ইস্পাহানী (رحمه الله تعالي ) (ইন্তিকাল-৫০২) বলেছেন, যা বারবার ফিরে আসে ওই দিনকে ঈদের দিন বলা হয়। শরীয়তে ফিতরের দিন ও কোবরনাীর দিন ঈদের জন্য নির্ধারিত। শরীয়তে এই দিনে খুশী উদযাপনের কথা বলা হয়েছে। যেমন- শরীয়ত প্রবক্তা সরকারে দো’আলম সতর্ক করে বলেছেন, ঈদের দিন হচ্ছে, পানাহার এবং মিলন ও আনন্দের দিন। অতএব ঈদ শব্দটি ওই সকল দিনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, যেদিন কোন খুশী অর্জিত হয়। এর স্বপক্ষে কোরআনে কারীমের এই আয়াতটি দলিল
قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللهم رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا الخ .
‘হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (عليه السلام) আরয করলেন, হে আল্লাহ্! হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের প্রতি আসমান হতে খাঞ্চাভর্তি খাদ্য অবতরণ করুন। তা আমাদের পূর্বাপর সবার জন্যে আনন্দোৎসব হবে এবং আপনার পক্ষ থেকে হবে একটি নিদর্শন।’
32. সূরা মায়েদা, আয়াতঃ ১১৪
এমনও বলা যায় যে, শরয়ী ও পারিভাষিক ঈদ হচ্ছে কেবল দু’টি- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। আর জুমা এবং আরাফার দিন হচ্ছে প্রথাগত ঈদ। কেননা যেদিন কোন প্রকারের নিয়ামত এবং খুশি-আনন্দের সুসংবাদ আসে সেদিনকে প্রথাগত ঈদ বলে।
সকল নিয়ামতের মূল হচ্ছে- সৈয়্যদুনা মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) এর পবিত্র সত্তা। অতএব যেদিন এ মহান নিয়ামত অর্জিত হয়েছে (অর্থাৎ- যেদিন তিনি ইহজগতে তাশরীফ এনেছেন) সেদিন সকল ঈদের সেরা ঈদ এবং এটাও প্রথাগত ঈদ, শরয়ী ঈদ নয়। বরং উদ্দেশ্য ও অন্তর—নিহিত মর্মের দিক দিয়ে প্রকৃত ঈদ হচ্ছে হুযূর মোস্তফা (ﷺ) এর সত্তা। সুতরাং মু’মিনদের জন্য শরয়ী ঈদের সাথে, প্রথাগত ঈদেও অত্যন্ত খুশী ও আনন্দ এবং অসংখ্য নিয়ামত নিহিত রয়েছে। এ কারণে মুসলমানেরা সর্বদা আক্বা ও মাওলা পরম দয়ালু নবী রাসূলে করীম (ﷺ)-এর ১২ই রবিউল আউয়াল বেলাদতের দিন ঈদে মিলাদুন্ নবী দিবস অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে উদযাপন করে আসছে।
প্রশ্ন হলো ১২ই রবিউল আউয়াল রহমেত ‘আলম (ﷺ)-এর বেলাদত শরীফ পালন করা হয়, অথচ অন্য বর্ণনা মতে একই তারিখে তাঁর ওফাত শরীফও। অতএব তোমরা ওই দিন রাসূল (ﷺ)-এর জন্মোৎসব পালন করে থাক অথচ প্রথাগত নিয়ামনুযায়ী উক্ত তারিখে তোমরা শোক দিবস পালন কর না কেন?
উক্ত প্রশ্নের শরয়ী উত্তর হলো শরীয়ত আমাদেরকে নিয়ামত প্রাপ্তির ওপর আনন্দ প্রকাশের এবং তা বয়ান করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর কোন নিয়ামত চলে যাওয়াতে শোক প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন। প্রথাগত ও যুক্তিসংগত উত্তর হলো আমরা দুঃখ-বেদনা ও শোক কেন প্রকাশ করব?
হুযূর (ﷺ) ইরশাদ করেন, حياتى خيرلكم ومماتى خيرلكم অর্থাৎ- ‘আমার জীবদ্দশায় তোমাদের যেমন মঙ্গল নিহিত আছে আমার ইন্তিকালেও অনুরূপ তোমাদের মঙ্গল নিহিত রয়েছে।’ তিনি ইহকালে যেভাবে জীবিত ছিলেন তেমনি বর্তমানেও জীবিত আছেন। প্রথমে কষ্ট জগত পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন, এখন প্রতিদান জগত পরকালে ও জান্নাতে জীবিত আছেন। পৃথিবীর জীবনে হুযূর মোস্তফা (ﷺ) পথভ্রষ্ট লোকদের হিদায়ত ও সঠিক পথের নির্দেশ এবং শিক্ষা-দীক্ষা ও ধর্ম-কর্ম প্রচারণার দায়িত্ব পালন করেন; বর্তমানে গুনাহগার পাপী ও অবাধ্য লোকদের মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করছেন। তাঁর নিকট উম্মতের আমল পেশ করা হয়। তখন নেক ও পূণ্য আমলের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার প্রশংসা করেন এবং পাপ ও মন্দ আমলের কারণে তিনি উম্মতের জন্য মাগফিরাত কামনা করেন। তিনি যিয়ারতকারীদের সালামের জবাব প্রদান করেন, যেমনি পার্থিব জীবনে সালাম প্রদানকারীদের সালামের জবাব দিতেন। শাফাআত তথা সুপারিশ প্রার্থনাকারীদের জন্য সুপারিশ করেন। আল্লাহ্ তা‘আলার তাজালিয়াত বা জ্যোর্তিময় আলোকরশ্মির দর্শন ও পর্যবেক্ষণে সদা নিমগ্ন থাকেন। لايفارق حضرة الله تعالٰى ابدًا তাঁর উচ্চ মর্যাদা ও সুমহান সম্মান-প্রতিপত্তি প্রতি মুহূর্তে উন্নত হচ্ছে। এতে চিন্তিত ও শোক প্রকাশ করার কী কারণ থাকতে পারে?
হুযূর স্বয়ং একথা যখন বলেছেন, "আমার ইহকাল এবং পরকাল উভয়ই তোমাদের জন্য কল্যাণকর।"
33. আল-ওয়াফা বে-আহ্ওয়ালিল মুস্তফা , খন্ড-১০, পৃষ্ঠা-৮১০।
___________________________
[টিকা সংযোজনঃ মাসুম বিল্লাহ সানি, উক্ত হাদিস ভিন্ন সনদে বর্ণিত সূত্রসমূহঃ
১) আনাস বিন মালিক (রাঃ)
২) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রাঃ)
৩) আউস ইবনে আউস (রাঃ)
৪) বকর ইবনে আব্দুল্লাহ আল-মাজিনী (রহঃ)
তথ্যসূত্রঃ
► ইমাম ইবনে সা'দঃ তাবাকাত-আল-কুবরাতে (2ঃ 194)
► ইমাম ইবনে হিব্বান, কিতাব আল-মাজরুহিন, ২/160।
► ইমাম কাজী আয়াজঃ আশ-শিফা (1ঃ19)
► ইমাম বাজ্জারঃ আল-মুসনাদঃ1/397 ঃ ইবনে মাসউদের হাদীস থেকে সহীহ সনদে।
► ইমাম শাশীঃ আল মুসনাদঃ খন্ড 2, পৃষ্ঠাঃ 253, হাদীসঃ 826
► ইমাম জুহদামীঃ ফজল আস সালাহ আন নাবী (ﷺ)
ঃ 1, পৃষ্ঠাঃ 38-39, হাদীসঃ 25-26
► ইমাম সুবকীঃ আস শিফাউস-সিকাম ফী জিয়রতে খায়রুল আনম। [সর্বোত্তম সৃষ্টির জিয়ারতে রোগীদের রোগ নিরাময়], যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এটিঃ
১) বকর ইবনে আব্দুল্লাহ আল-মাজিনী এবং
২) ইবনে আল-জাওযী তা বকরের মাধ্যমে এবং
৩) আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) সূত্রেও বর্ণিত।
► ইমাম দায়লামিঃ মুসনাদ আল ফিরদাউসঃ 1, পৃষ্ঠাঃ 183, হাদীসঃ 686
► ইমাম ইবনে আল-জাওজীঃ আল-ওয়াফায়ঃ আউস ইবনে আউস (রাঃ) সূত্রে।
► ইমাম ইবনে কাসীরঃ তফসীরে ইবনে কাসীরঃ 3 ঃ পৃ 516
► ইমাম ইবনে হাজর আসকালানীঃ ফতহুল বারী শরহে বুখারীঃ 10ঃ 415,
► ইমাম মুনযিরীঃ আত তরগিব ওয়া আল-তরহিব 3ঃ 343,
► মুসনাদ আল-হারিস,
► ইমাম আবু হাতিমঃ আল-জারহ ওয়াত তা'আদিল, 26/64,
► ইমাম হাফিজ আল-হায়তামিঃ মাজমা আল-জাওয়ায়েদঃ2/884 (# 953)
► ইমাম ইবনুল ইরাকীঃ তারহুত-তাথরীব ফী শারহে-তাকরীব (3ঃ 297)
► ইমাম ইবনে হাজর আসকালানীঃ তাকরীব ওয়াহেদ তাহাদিব, 1/478
► ইমাম ইবনে হাজর আল-আসকালানী মাতালিব আল-আলিয়াঃ 4/22,
► ইমাম যাহাবীঃ আল মুগনি, 1/571 (# 3793) (নুরুদ্দীন এর ৩য় সংস্করণে)
► ইমাম যাহাবীঃ সিয়ার আল আলম আন নুবালাঃ 17, পৃষ্ঠাঃ 106
► ইমাম সুয়ূতীঃ খাসায়েসুল-কুবরা, 2/281
► ইমাম সুয়ূতীঃ মানাহিল আল-সাফা ফী তাখরিয় আহাদীদ আল-শিফাঃ পৃ .3 (# 8)
► ইমাম মিয্যিঃ তাহযীব আল কামালঃ 14, পৃষ্ঠাঃ 558
► ইমাম জুরকানিঃ শরহ্ আল মাওয়াহিবঃ 7
পৃষ্ঠাঃ 373
► ইমাম আল-মানাভি, ফয়জুল কাদির, 3/401
► ইমাম হিন্দিঃ কাঞ্জুল উম্মালঃ 31903-31904
► শাইখ শুয়ায়ব আল-আরনাউতঃ তাহরির আল-তাহরীবঃ 2/379 (# 4160) এ আবু দাউদ, আহমাদ ইবনে হাম্বল, ইবনে মাঈন, আন-নাসায়ী ও ইবনে সা'দের থেকে।
কিতাব আল-হজ (# 179)
► আল বুরকানীঃ তরিক আল-দাওরী, ২/370; পৃ .317;
► শায়খ আব্দুল্লাহ আল-তালিদীঃ তাহযিব আল খাসায়েসুল কুবরাঃ পৃঃ 458-459 (# 694)]
___________________________
মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফি দেওবন্দি (ইন্তিকাল-১৩৯৬ হিজরী) লিখেছেন, ‘খ্রীস্টানরা হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর জন্ম দিবসকে ঈদে মিলাদ পালন করে। তাদের দেখে কিছু মুসলমান রাসূলে করীম-এর জন্মদিনকে ঈদে মিলাদুন্নবী নামে আরেকটি ঈদ উদযাপন করছে। ওই দিন বাজারে মাঠে-ময়দানে জুলুস বের করে এবং এতে বিভিন্ন প্রকারের অযথা ও অপ্রত্যাশিত কর্মকান্ডকে ও রাতে আলোকসজ্জা করাকে ইবাদত মনে করছে। যার কোন মূলভিত্তি ও প্রমাণ সাহাবা-ই কিরাম, তাবেঈন এবং পরবর্তী বুযূর্গানে দ্বীনের আমলে ও কর্মকান্ডে পাওয়া যায়নি।’
34. মুআরেফুল কোরআন, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩৫, করাচি থেকে প্রকাশিত।
সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী (মৃত্যু ১৩৯৩ হিজরী) এক সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নোত্তরে বলেন, সবার আগে আপনাকে একথা জানতে চাওয়া উচিত ছিল যে, ইসলামে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে কিনা? ওই জশন যাকে ইসলামের হিদায়তকারী ’র প্রতি সম্বোধন করা হয়, বাস্তবিকপক্ষে ওটা ইসলামী উৎসবই নয়, এর কোন প্রমাণ ইসলামে পাওয়া যায়নি। এমনকি সাহাবা-ই কিরামগণও এটি পালন করেন নি।
আফসোস! পরিতাপের বিষয় উক্ত জশন ও উৎসবকে দেওয়ালী বা দীপমালা ও টোপর এর আকৃতি দেয়া হয়েছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় করা হয়। (দেওয়ালী-লাইটিং বা আলোকসজ্জা আর টোপর মুক্তাগাঁথা টুপি যা বর-কনের মাথায় পরানো হয়)।
35. হাপত্ রোযাহ্ কিন্দিল, ৩রা জুলাই-১৯৬৬ইং।
সাধারণত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের অনুসারী এবং দেওবন্দী ওলামারা একথা বলে প্রভাবিত করে যে, ১২ই রবিউল আউয়াল ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের তরিকা এবং তাদের নব আবিষ্কৃত ও উদ্ভাবিত প্রথা। যা তাদের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় এবং হচ্ছে। কিন্তু একথা আদৌ সত্য নয়। বরং বাস্তবতা হচ্ছে মুসলমানগণ সব সময় রবিউল আউয়াল মাসে রাসূল (ﷺ)-এর জন্মোৎসব উপলক্ষে খুশী ও ঈদ উদযাপন করে আসছে।
আল্লামা আহমদ কুস্তলানী (رحمه الله تعالي ) (ইন্তিকাল ৯১১ হিজরী) লিখেছেন, সর্বদা মুসলমানগণ রাসূল পাক (ﷺ)-এর মিলাদের মাসে মাহফিলসমূহ উদযাপন করে আসছেন এবং দাওয়াত দেন। তারা এ মাসের রাতগুলোতে বিভিন্ন প্রকারের দান-সদকা এবং আনন্দ উৎসব পালন করতেন। পূণ্যের কাজ অধিকহারে করতেন। রাসূল পাক (ﷺ)-এর মিলাদ সম্পর্কীয় আলোচনা করতেন, যার বরকতে তাদের ওপর আল্লাহ'র ফযল ও অনুগ্রহ অধিকহারে বর্ষিত হতো।
মিলাদ শরীফ উদযাপন করার ফলে এই অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে যে, এতে মানুষের সৎ উদ্দেশ্য পূরণ হয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা ওই ব্যক্তির ওপর স্বীয় রহমত নাযিল করেন, যিনি পবিত্র বরকতময় বেলাদত শরীফের রাতে ঈদ পালন করেন।
36. আল মাওয়াহিবুল লুদুনিয়া, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৭৮, দারুল কুতুব লাইব্রেরী, বৈরুত।
হযরত আল্লামা কুসতলানী (رحمه الله تعالي ) আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল-জয্রী (ইন্তিকাল ৮৩৩ হিজরী) (رحمه الله تعالي )-এর উদ্ধৃতি উল্লেখ পূর্বক বর্ণনা করেন যে, আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল বাকী যুরকানী মালিকী (ইন্তিকাল ১১৬৬ হিজরী) এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, এই কাজে কতিপয় দুনিয়া পিপাসু লোকজন অসৎকর্ম অন্তভুর্ক্ত করে দিয়েছে। আল্লামা ইবনুল্হাজ্ব মালিকী ‘মদখল’ গ্রন্থে এর খন্ডন করেছেন এবং স্পষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যা করে বলেন, এই মাসে পূণ্যের কাজ, সদকা-খায়রাত, ইসালে সওয়াব, খানা-মেজবানী ও যিয়াফত ইত্যাদি অধিকহারে করা উচিত। এটাই মিলাদ শরীফ পালনের উত্তম পন্থা।
আল্লামা ইবনে কাছীর (رحمه الله تعالي ) স্বীয় তারিখ গ্রন্থে লিখেছেন যে, ইরবিলের বাদশাহ কিং মুজাফ্ফর আবু সাঈদ (ইন্তিকাল ৬৩০ হিজরী) সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করেন। তিনি অত্যন্ত সাহসী, সৎ, গভীর জ্ঞানী ও পূণ্যবান বাদশাহ ছিলেন। তিনি তিনশত দিরহাম ব্যয় করে অত্যন্ত জাঁকজমক ও শানদার ভাবে মিলাদুন্নবী মাহফিল ও মেহমান নাওয়াযীর ব্যবস্থা করতেন।
37. শরহে আল-মাওয়াহিবুল লুদনিয়্যাহ, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৩৯, দারুল মা‘আরিফ লাইব্রেরী, বৈরুত।
আল্লামা সুয়ূতী (رحمه الله تعالي ) মিলাদুন্নবী কে বিদ‘আতে মুস্তাহিব্বাহ্ ও হাসনা বলেছেন। আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمه الله تعالي ) এবং হযরত আল্লামা গোলাম রাসূল সাঈদী হানাফী (رحمه الله تعالي ) মুসলিম শরীফ ৩য় খন্ড বিস্তারিতভাবে মিলাদুন্নবী পালনের বর্ণনা করেছেন। তিব্য়ানুল কোরআন ৩য় খন্ড ৬৮ পৃষ্ঠায় لايحب الله পারায় দলিল ও তথ্যসহ বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অন্যান্য হানাফী মাযহাবের ওলামায়ে কিরাম কোরআন ও সুন্নাহ থেকে মিলাদুন্নবী এর স্বপক্ষে যে দলীল উপস্থাপন করেছেন এবং বিরোধী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দলিল প্রমাণাদিসহ বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। কোনো কোনো শহরে মিলাদুন্নবীর জুলুসে গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র এবং শরীয়ত বিরোধী কর্মকান্ড করে থাকে। আমাদের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ওলামায়ে কিরাম সব সময় এগুলো থেকে নিষেধ করে আসছেন। অধিকাংশ শহরে সম্পূর্ণ পূত-পবিত্রতার সঙ্গে শরীয়তসম্মত জুলুস পালন করা হয়।
আল্লামা মুহাদ্দিস গোলাম রাসূল সাঈদী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন, আমি দু’বার লন্ডন গিয়েছিলাম এবং আমি সেখানে উক্ত মাসে বিভিন্ন মাহফিলে অংশগ্রহণ করি। এতে শুধু হামদ-না’ত শরীফ পাঠ ও যিকির-আযকার ব্যতীত অন্য কোন প্রকারের শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ করতে দেখিনি। জুলুসের আয়োজনকারী সকল সদস্য জামাআতের সাথে নামায আদায় করেন এবং অতঃপর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে নবী কারীম (ﷺ) রাউফুর রাহীম এর বিভিন্ন ফযিলত ও গুণগান এবং মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
প্রথমে দেওবন্দ ও জামায়াতে ইসলামীর আলিমরা ঈদে মিলাদুন্নবী এবং জুলুস উদযাপনের ঘোর বিরোধী ছিলেন কিন্তু আজ হতে ১৫,২০ বছর ধরে দেওবন্দ ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় ওলামারাও ঈদে মিলাদুন্নবী-এর জুলুস বের করেছেন এবং এতে শরীক হচ্ছেন।
সিপাহ-ই সাহাবা সংগঠনের শীর্ষ ওলামায়ে কিরাম হযরত আবু বকর (رضى الله تعالي عنه), হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) এবং হযরত ওসমান (رضى الله تعالي عنه)- এই খলিফাত্রয়ের জন্মদিবস পালন করে আসছে। উক্ত দিবসগুলোতে তারা জুলুস বের করে এবং সরকারের কাছে ওই দিবসগুলোতে সরকারী ছুটিরও দাবী করছেন।
মুফতি মুহাম্মদ শফি দেওবন্দি ঈদে মিলাদুন্নবী খন্ডন করতে গিয়ে লিখেছেন, কোথাও জাতির শীর্ষ ব্যক্তির জন্ম-মৃত্যু কিংবা সিংহাসন আরোহন দিবস পালন করা হয়। কোথাও কোন রাষ্ট্র বা শহরের স্বাধীনতা দিবস কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনা দিবস পালন করা হয়। যার সারগর্ভ কথা হচ্ছে, এতে ব্যক্তি বিশেষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বৈ আর কিছু নয়। ইসলাম ব্যক্তি পূজার পক্ষে নয়। ইসলাম অন্ধকার যুগের কুপ্রথাসমূহ এবং ব্যক্তি বিশেষের স্মরণ বাদ দিয়ে মৌলিক ও লক্ষ্যণীয় বিষয়াবলী স্মরণের মৌলিক নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
38. মুআরেফুল কোরআন, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩৪, করাচি থেকে মুদ্রিত।
কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, দেওবন্দি ওলামারা শুধু সাহাবা দিবস পালন করছেন না বরং তারা তাদের আকাবির শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কিরাম যেমন- শায়খ আশরাফ আলী থানভী, শায়খ শাব্বির আহমদ ওসমানী প্রমূখ আলিমদেরও জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করছেন এবং দেওবন্দ মাদ্রাসার শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন করা হয়েছে। এখানকার নামকরা হাটহাজারী খারেজী মাদ্রাসার শতবর্ষ পূর্তি পালন করা হয়েছে। যা এক নব আবিষ্কার তথা বিদ‘আত। আমরা প্রথমে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর জুলুসের ব্যাপারে দেওবন্দি শীর্ষ ওলামাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে উদ্ধৃতিসহ আলোচনা করব। অতঃপর ‘সাহাবা দিবস’ এবং ‘শীর্ষ ওলামায়ে দেওবন্দ দিবস’ তাদের ওলামায়ে কিরামদের পালন করা সম্পর্কে আলোচনা করব।
জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র ‘রোজনামা-ই জেসারত’ পত্রিকায় লিখা হয়েছে যে, পাকিস্তান কওমী ইত্তেহাদের মহাব্যবস্থাপক মাওলানা মুফতি মাহমুদ বলেছেন, দেশে ইসলামী আইনের পাশাপাশি কওমী ইত্তেহাদ যে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করেছে, তার জন্য তারা অবিরাম ও ধারাবাহিক সংগ্রাম করেছে। তারা আজ নীলা গম্বুজ মসজিদে জোহরের নামাযের পর কওমী ইত্তেহাদের নেতৃত্বে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর আজিমুশ্শান জুলুসে উপস্থিত অংশগ্রহণকারী সদস্যদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। সে সময় কওমী ইত্তেহাদের সহ-সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খাঁন, পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর মিয়া মুহাম্মদ তোফায়েল ওফাতী, অর্থমন্ত্রী ওসায়েল চৌধুরী, রহমত ইলাহী এবং মুসলিম লীগ ৬ গ্রুপের সেক্রেটারী মালিক মুহাম্মদ কাসিমও বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা শেষে মুফতি মাহমুদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ নীলা গম্বুজ মসজিদে নামায আদায় করেন। এরপর ওই সকল নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে এক বিশাল জুলুস বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে মসজিদে শোহাদায় গিয়ে শেষ হয়। সেখানে জুলুসে অংশগ্রহণকারী সবাই মুফতি মাহমুদের ইমামতিতে মাগরিবের নামায আদায় করেন।
39. রোজনামা জাসারত, ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৯ ইং
জামায়াতে ইসলামী ও দেওবন্দি সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘কওমী ইত্তেহাদ’-এর শাসনামলে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনকালে ‘রোজনামা জঙ্গ’ পত্রিকার একটি সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখুন,
‘আজ জশনে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) অত্যন্ত জাঁকঝমকপূর্ণভাবে পালিত হবে। অনুষ্ঠানের শুরুতে ২১ বার তোপ ধ্বনির মাধ্যমে গার্ড অব অনার বা রাজকীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হবে। গভর্নরের সভাপতিত্বে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। গোটা শহর জুড়ে জুলুস বের করা হবে। তশতর পার্ক, আরামবাগ এবং আরো অন্যান্য এলাকায় সমাবেশ হবে।
40. রোজনামা জঙ্গ, ৯ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৯ইং, করাচি।
‘রোজনামা হুর্রিয়্যাহ’ পত্রিকার আরো একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখুন, ইসলামী কানুনসমূহের ভাল-মন্দ নিরীক্ষা করার পর কওমী ইত্তিহাদের আন্দোলন প্রতিষ্ঠার মহান উদ্দেশ্য সফল হবে। মুফতি মাহমুদ বলেন, সমাজে পুরোপুরিভাবে ইসলামী কালচার ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হবে। মুফতি মাহমুদের নেতৃত্বে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন উপলক্ষে এক আজিমুশ্শান জুলুস বের হবে।
41. রোজনামা হুর্বিয়্যত, ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৯ইং
রোজনামা মশরিক-এর একটি সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখুন (লাহোর ৯ই ফেব্রুয়ারী পি পি আই) ‘কওমী ইত্তেহাদের সভাপতি মওলানা মুফতি মাহমুদ এবং সহ-সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান আগামীকাল ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর জুলুসে নেতৃত্ব দিবেন। উক্ত জুলুস নীলা গম্বুজ থেকে বের হয়ে শুহাদা মসজিদে গিয়ে শেষ হবে।’
42. রোজনামায়ে হুর্রিয়্যাত, ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৯ইং
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মওলানা মুহাম্মদ আজমল খান ‘খোলাফা-ই রাশেদীন দিবস’কে সরকারীভাবে উদযাপন করার দাবী জানান।
43. রোজনামা জঙ্গ, ২০ জুন, ১৯৯২ইং, লাহোর।
সিপাহ-ই সাহাবা-এর মহাপরিচালক জিয়াউর রহমান ফারূকী ঘোষণা করেন যে, মুহররম মাসের প্রথম তারিখ ফারূকে আযম হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه)-এর শাহাদত দিবস পালন করা হবে এবং জুলুস বের করা হবে।
44. নাওয়ায়ে ওয়াক্ত, ১৭ জুন, ১৯৯৪ ইং, লাহোর।
সিপাহ-ই সাহাবা পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ হাকিম আলী ১লা মুহররমুল হারামকে হযরত ফারূকে আযম ওমর (رضى الله تعالي عنه)-এর শাহাদত দিবস উপলক্ষে সরকারী ছুটি ঘোষণার দাবী জানিয়ে বলেন, আজ ঈদের দিন।
45. নওয়ায়ে ওয়াক্ত, ২৩ ফেব্রুয়ারী-১৯৯৫ ইং, লাহোর
সিপাহ-ই সাহাবা’র তত্ত্বাবধানে গত ২২শে ফেব্রুয়ারী গোপুর রাজ্যে মওলানা হক্ব নাওয়ায জিঙ্গয়ী শহীদ-এর শাহাদত দিবস অত্যন্ত ভাবগাম্ভির্য ও মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়। সিপাহ-ই সাহাবা জঙ্গ-এর তত্ত্বাবধানে হক্ব নাওয়ায শহীদ মহল্লার ইহ্তিরার পার্কে এক ঐতিহাসিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়।
কনফারেন্সে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সিপাহ-ই সাহাবার অন্যতম শীর্ষ তত্ত্বাবধায়ক মওলানা মুহাম্মদ আযম তারেক এম এন আই বলেন, ২২ ফেব্রুয়ারী হযরত জঙ্গুয়ী শহীদের শাহাদত দিবস এবং ২১ রমযানুল মুবারক শের-ই খোদা হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)-এর শাহাদত দিবস।
46. নওয়ায়ে ওয়াক্ত ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯২ইং, লাহোর
সিপাহ-ই সাহাবা’র প্রতিষ্ঠাতা মওলানা হক্ব নওয়ায জঙ্গুয়ীর দ্বিতীয় বার্ষিকীতে ২৩ ফেব্রুয়ারীকে পাকিস্তানসহ অন্যান্য রাষ্ট্রে মওলানা জঙ্গুয়ী স্মরণে সিপাহ-ই সাহাবা সভা, সেমিনারসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান পালন করবে এবং তাদের সকল কেন্দ্র ও অফিসগুলোতে সকাল ৯টায় ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোরআন খতম হবে। জঙ্গ-এ মওলানা জঙ্গুয়ীর মসজিদে খতমে কোরআনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান আরম্ভ হবে এবং পরে আজিমুশ্শান মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবেন।
47.[নওয়ায়ে ওয়াক্ত ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯২ইং, লাহোর]
হযরত ফারূকে আযম (رضى الله تعالي عنه)-এর শাহাদত দিবসে সরকারী বন্ধ ঘোষণা না করার বিরুদ্ধে সিপাহ-ই সাহাবা’র বিক্ষোভ প্রদর্শন।
করাচিতে মুহাম্মদ আহমদ মাদানী বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘খোলাফা-ই রাশেদীন-এর শাহাদত দিবস সরকারী ব্যবস্থাপনায় পালন না করার বিষয় বোধগম্য নয়’। সিপাহ-ই সাহাবা’র তত্ত্বাবধানে হযরত ফারূকে আযম (رضى الله تعالي عنه)-এর শাহাদত দিবস অত্যন্ত জাঁকজমক ও মর্যাদাপূর্ণভাবে পালিত হয়। এ ধারাবাহিকতায় জামিয়া সিদ্দীকে আকবর নাগন সুরঙ্গীতে সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে বিভাগীয় প্রধান আল্লামা মুহাম্মদ ওয়াইসী হযরত ওমর ফারূক (رضى الله تعالي عنه) এর সার্বিক অবদান ও কর্মকান্ড সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং ফারূকে আযম (رضى الله تعالي عنه)-এর শাহাদত দিবস উপলক্ষে সরকারী ছুটি ঘোষণা না করার বিরুদ্ধে সিপাহ-ই সাহাবার নেতৃত্বে যুক্তি ও প্রমাণ সাপেক্ষে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
বিক্ষোভকারী নেতৃবৃন্দ একথার ওপর অঙ্গীকার করেছিলেন যে, খোলাফা-ই রাশেদীন দিবস সরকারী তত্ত্বাবধানে পালন করা, ওই দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা এবং সাহাবাই- রাসূল-এর শানের বিরুদ্ধে অপমান সূচক বক্তব্যের প্রতিরোধ করা, নেতৃবৃন্দের নৈতিক চরিত্র এবং শ্রমিকদের দাবী-দাওয়া সম্বলিত বিশদ আলোচনা এর অন্তভুর্ক্ত ছিল। আঞ্চলিক পরিষদের সেক্রেটারী জেনারেল মওলানা মুহাম্মদ আহমদ মাদানী বিক্ষোভকারীদের সম্বোধন করে বলেন, দেশে জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতিবিদ ও নেতৃবৃন্দের দিবস পালন করা হয়। কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্রে খোলাফা-ই রাশেদীন দিবস পালন না করা এবং উক্ত দিন ছুটি ঘোষণা না করার কারণ বোধগম্য নয়।
এ সুবাদে একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে মওলানা আলী শের-ই হায়দারী, মওলানা আজম তারেক, হাফিয আহমদ বক্স, এডভোকেট মওলানা আবদুল গফুর নদীম এবং আরো অন্যান্যদের মুক্তির দাবী করা হয়। এমতাবস্থায় সিপাহ-ই সাহাবা স্টুডেন্ট করাচি বিভাগের জেনারেল সেক্রেটারী হাফিয সুফিয়ান আইয়্যাসি, সফিকুর রহমান, আবু আম্মার, জি.আই কাদের এবং এম.আই কাশ্মিরী প্রমুখ বিক্ষোভকারী ছাত্রদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও বিক্ষোভ করার জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন।
48.রোজনামা জঙ্গ, ১৫ মে- ১৯৯৭ইং, করাচি।
হাকীমুল উম্মতের আশরাফি দিবসঃ
হাকীমুল উম্মত মওলানা আশরাফ আলী থানভীর স্মরণীয় দশ কর্মদিবস তাঁর কর্ম দক্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হবে। ‘সুন্নী মজলিসে আমল পাকিস্তান’-এর নেতা মওলানা মুফতি মুহাম্মদ নঈম বলেছেন, মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর শিক্ষা বিষয়ক কিতাব রচনায় এবং সংস্কারমূলক কর্মকান্ড আমাদের জন্য পথনির্দেশক। যা কোন আশেকে রাসূল, পাকিস্তান প্রেমিক তথা আমাদের দেশ (বাংলাদেশ) প্রেমিক কখনো ভুলতে পারবে না। তিনি সমবেত জন সাধারণকে লক্ষ্য করে আরো বলেন, বুযূর্গানে দ্বীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক দ্বিপ্রহরের সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল। উক্ত সমাবেশে ‘সুন্নী মজলিসে আমল পাকিস্তান’-এর তত্ত্বাবধানে ‘হাকিমুল উম্মতের দশ কর্মদিবস’ পালনের ঘোষণা করতে গিয়ে মুফতি মুহাম্মদ নাঈম বলেন, করাচির প্রতিটি জেলায় মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর স্মরণে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
49. রোজনামা জঙ্গ করাচি, ৩০ জুন-১৯৯৭ইং।
‘সুন্নী মজলিসে আমল পাকিস্তান’ করাচির নেতা মুফতি মওলানা মুহাম্মদ নাঈম জামে মসজিদ সিদ্দীক আওরঙ্গী টাউনে হাকিমুল উম্মতের দশ কর্মদিবস উপলক্ষে আয়োজিত মাহফিলে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, আমাদের উচিৎ হাকিমুল উম্মত মওলানা আশরাফ আলী থানভী রচিত কিতাবসমূহ পাঠ করে নিজেদের জীবনের পরিবর্তন সাধিত করা। তিনি আরো বলেন, আমাদের মাযহাবে কারো ব্যাপারে যাচাই-বাছাই ও প্রকৃত প্রমাণ ছাড়া কোন কথা বলার অনুমতি দেয়নি। তাই মিথ্যা, বানোয়াট ধোঁকা ও গীবত থেকে বেঁচে থাকা একান্ত প্রয়োজন। সমাবেশে মওলানা গোলাম রাসূল, মওলানা আনছুর মাহমুদ ও মাওলানা মুহাম্মদ সিদ্দীকও বক্তব্য রাখেন।
50. রোজনামা জঙ্গ, ৪ জুলাই-১৯৯৭ ইং, করাচি।
তিবয়ানুল কোরআনের গ্রন্থকার মুহাদ্দিসে যমান মুহাক্কিকে দওরান আল্লামা গোলাম রাসূল সাঈদী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন যে- ‘যদি কেউ অধিক ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়ে কোন হারাম বস্তু ভক্ষণ করে। পক্ষান্তরে সে উক্ত খাবারের প্রতি আগ্রহী নয়। নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।’
51. সূরা মায়েদা, তিব্য়ানুল কোরআন, আল্লামা গোলাম রাসূল সাঈদী (رحمة الله), খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৭২।
উপরোক্ত আয়াতের অর্থ ও শানে নুযূলঃ উক্ত আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে, হে আল্লাহর মহান রাসূল! সাহাবা-ই কিরামরা আপনাকে প্রশ্ন করছে যে, তাদের জন্য কোন শ্রেণির প্রাণী হালাল ? তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে হাবীব! আপনি বলে দিন, সে সকল প্রাণী আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের জন্য হালাল করেছেন, তা তোমরা জবাই করে খেতে পারবে এবং তোমাদের শিকারী জন্তুগুলো শিকার করে, যে সকল জন্তু আহত অবস্থায় তোমাদের জন্য নিয়ে আসে, তাও তোমরা খেতে পারবে।
উক্ত আয়াতে এটাও ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের জন্য সকল প্রকারের পবিত্র খাদ্য হালাল করা হয়েছে। তাইয়্যেবাত বা পবিত্র বলতে বুঝায় যে, যাকে সুষ্ঠু স্বভাবসম্পন্ন ব্যক্তি ঘৃণা করে না এবং ঘৃণিত ও হিংস্র না হবে। এটা ইমাম বলখী (رحمه الله تعالي ) এর উক্তিও।
অন্য একটি বর্ণনা মতে, ওই সকল বস্তু যার সম্পর্কে হারামের কোন দলীল অবতীর্ণ হয়নি এবং ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমেও যা হারাম প্রমাণিত হয়নি। প্রথমোক্ত উক্তি বর্ণনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সুস্বাদু বস্তু এবং দ্বিতীয় উক্তির মর্মার্থ হচ্ছে, হালাল বস্তুসমূহ। এমনও বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা হালাল এবং সুস্বাদু বস্তু উদ্দেশ্য।
মওলুদ শরীফ তথা হুযূর (ﷺ) এর জন্মোৎসব কী বিদআত? কোরআন-হাদীসে এর কোন প্রমাণ আছে কী? মানবজাতির গৌরব বিশ্ব জগতের সরদার সরওয়ারে ‘আলম হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-এর বেলাদত শরীফের যিকির ইহকাল ও পরকালের মঙ্গল ও কল্যাণের অন্যতম উসিলা।
52. রেসালা হাফত্ মাসআলা, হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (رحمة الله)।
কেননা হুযূর আক্বদাস (ﷺ) হচ্ছেন, আল্লাহর নিয়ামত। কোরআনে কারীম(ﷺ) তাঁর নাম নিয়ামতুল্লাহ (نعمة الله) আখ্যায়িত করেছে। মহান আল্লাহর বাণী, اِنَّ الَّذِينَ بَدَّلُوا نِعْمَتَ اللهِ كُفْرًا আয়াতের তাফসীরে হযরত সৈয়্যদুনা আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) বলেন, নিয়ামাতুল্লাহ (نعمة الله) হলেন- মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) । সুতরাং তাঁর শুভাগমনের আলোচনা করা পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ পালন এবং তাঁর হুকুম মান্য করা। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ
‘আপনার পালনকর্তার নিয়ামতের খুব বেশি চর্চা করো।
53. সূরা আদ-দোহা, আয়াত-১১।
হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ) হচ্ছেন সকল নিয়ামতের মধ্যে সর্বোত্তম নিয়ামত। তাঁর শুভাগমনের বদৌলতে দুনিয়া, আখিরাত, কবর, হাশর, বরযখ, এমনকি প্রতিটি সময়, কাল ও মুহূর্ত প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নিয়ামত এবং আমাদের শরীরের সূক্ষ্ম পশম ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উপকৃত হচ্ছে এবং হবে।
আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে তাঁর নিয়ামতরাজির চর্চা ও আলোচনা মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর অনুষ্ঠানেই হয়ে থাকে। মিলাদ-মাহফিল মূলতঃ এমন একটি বিষয়, যেটি পালনের হুকুম স্বয়ং রাব্বুল আলামীন দিয়েছেন- وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ এবং হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে। অতএব প্রখ্যাত ইমাম, অত্যন্ত খ্যাতিসম্পন্ন ধর্মনিষ্ঠ ফকীহ মুহাদ্দিস আবুল লাইস নসর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম সমরকন্দি হানাফী (رحمه الله تعالي ) ‘তান্ভীহুল গাফিলীন’ গ্রন্থের ২৬৩ পৃষ্ঠায় বলেছেন, যখন সূরা নসর হুযূর আক্বদাস-এর বিছাল শরীফ তথা ইন্তিকালের রোগে আক্রান্তের সময় অবতীর্ণ হয়। হুযূর তাড়াতাড়ি বের হয়ে এসে মিম্বর শরীফে তাশরীফ রাখলেন। বার ছিল বৃহস্পতিবার। তিনি হযরত বেলাল (رضى الله تعالي عنه)কে হুকুম দিলেন যে, মদিনা মুনাওয়ারায় ঘোষণা করে দাও যে, লোকেরা! রাসূল (ﷺ)-এর শেষ অসিয়ত শুনার জন্য চলে এসো। উক্ত আওয়াজ ধ্বনি শুনা মাত্র ছোট-বড় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলই ঘরের দরজা এমনিতেই খোলা রেখে ছুটে আসলো। এমনকি কুমারী মহিলারাও বেরিয়ে আসলো। মসজিদে নববী শরীফ অধিক লোকের সমাগমে তিল পরার জায়গাও ছিল না। তাই হুযূর (ﷺ) একথা বলতে লাগলেন, তোমরা পেছনে আগতদের জন্য জায়গা উন্মুক্ত করে দাও, পেছনে আগতদের জন্য জায়গা উন্মুক্ত করে দাও। অতঃপর হুযূর (ﷺ) পবিত্র মিম্বর শরীফে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্ তা‘আলার হামদ ও ছানা আদায় করেন এবং হযরাত আম্বিয়া-ই কিরামের ওপর দরূদ শরীফ পাঠ করেন। অতঃপর ইরশাদ করেন, আমি মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম আরবী এবং মর্যাদাবান হেরম ও মক্কা শরীফের অভিভাবক হই। আমার পর আর কোন নবী আসবেন না।
এমন একদিন ছিল যে, মদিনা তাইয়্যেবায় হুযূর মোস্তফা (ﷺ) -এর শুভাগমনের আনন্দ-উৎসবের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে আসমান জমিন মুখরিত হয়ে উঠেছিল মদিনার ছোট ছোট শিশুরা পর্যন্ত আল্লাহ'র প্রিয় মাহবুবের সাক্ষাৎ ও দর্শন লাভের অধীর আগ্রহ নিয়ে গান করতে করতে বেরিয়ে এসেছিল যেমন কবির ভাষায়,
طلع البدر علينَا * من ثنيات الوداع
وجب الشكر علينَا * ما دعىٰ للهِ داع
‘সানইয়াতুল বিদা’ হতে আমাদের ওপর পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে থাকবে আমাদের ওপর ওয়াজিব তাঁর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করা।’
নাজ্জার গোত্রের কঁচি মেয়ে শিশুরা মদিনার অলি-গলি দিয়ে সুরেলা মধুর কন্ঠে গান পরিবেশন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
نحن جوار من بنى النجار * يا حبذا محمد من جار
‘আমরা বনু নাজ্জার গোত্রের প্রতিবেশীরা কতই না ভাগ্যবান, মুহাম্মদ হলেন আমাদের প্রতিবেশী।’
আজকের দিন মাহবুবে খোদা (ﷺ)এর বিদায়ের দিন এবং শেষ অসিয়তের মজলিস। আজকের জমায়েতেও ওই সব নারী-পুরুষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এবং পর্দার আড়ালের মহিলারা সকলই একত্রিত হয়ে ভীড় জমায়েছেন।
মুসলমানগণ! খোদা জানে মজলিসে মিলাদ কী? মূলতঃ এটা হচ্ছে সাধারণ দাওয়াত, পরিপূর্ণ জমায়েত এবং মিম্বর ও ক্বিয়াম। আর ওটাই সৈয়্যদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-এর মিলাদ মাহফিলের ফযিলত ও মর্যাদার বর্ণনা বৈ আর কিছু নয়। কিন্তু নজদি ওহাবীদের কাজ হচ্ছে মাহবুবে খোদার যিকির মিটিয়ে দেয়া।
54. ইফাদাতে ওলামা।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পবিত্র মিলাদ মাহফিলের হাক্বিক্বত হচ্ছে, সমস্ত মুসলমানদেরকে হুযূর আক্বদাস (ﷺ)-এর শুভাগমনের মর্যাদাপূর্ণ ফযিলত এবং সর্বোত্তম চরিত্রের আলোচনা করার নামই মিলাদ মাহফিল। মিলাদ শরীফ হচ্ছে, যিকিরে রিসালত । যা সলফে সালেহীনের যুগ থেকে এক সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এখনো পর্যন্ত প্রচলিত এবং এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিদর্শন। সারকথা হচ্ছে, আল্লাহর যিকির এবং হুযূর আকরাম মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ)কে স্মরণ করাই মিলাদ মাহফিল।
শিফা শরীফে হযরত ইবনে ‘আতা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে,
جعلتك ذكرًا من ذكرى فمن ذكرك ذكرنى .
‘সকল আন্বিয়া (عليه السلام) এবং আউলিয়া-ই কিরামের যিকির প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই যিকির।’ মুসলমানেরা! তোমাদের আর কিসের প্রয়োজন। فاستبقوا الخيرات ‘কল্যাণের প্রতি অগ্রসর হও এবং নিজের খালি থলে ভর্তি করে নাও।’ যেহেতু হুযূর পাক সাহেবে লাওলাক (ﷺ)-এর পবিত্র বেলাদত বা জন্ম হচ্ছে, সমস্ত নিয়ামতের উৎস। তাই এর বিশদ বর্ণনা এবং প্রকাশ করার অকাট্য দলীল কোরআন মজীদের মাধ্যমে আমাদেরকে হুকুম দেয়া হয়েছে। অতএব মিলাদ মাহফিল কোরআনে কারীম দ্বারা প্রমাণিত।
55. মুফতি আল্লামা মুহাম্মদ খললি (رحمة الله)-এর ‘ইফাদাত’ গ্রন্থ থেকে চয়িত।
প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত বস্তুকে বিদআতে সায়্যিয়াহ বা মন্দ বিদআত-এর অন্তভুর্ক্ত মনে করে ওটাকে গোমরা ও পথভ্রষ্টদের মধ্যে শামিল করা, এটা সাধারণ মুসলমানদের ওপর বিরাট যুলুম। কোন বস্তুকে বিদআতে সায়্যিয়াহ বলার জন্য, তাকে দু’টি বিষয়ের একটি দ্বারা প্রমাণ করা অপরিহার্য।
১. উক্ত বস্তু সত্তাগতভাবে খারাপ,
২. অথবা শরীয়ত একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
শরীয়ত যাকে নিষিদ্ধ করেনি এবং উক্ত বস্তু স্বয়ং মন্দও নয় বরং কোরআন মজিদের হুকুম এবং রাসূলে কারীম (ﷺ) -এর নির্দেশ মোতাবিক জায়েয ও বৈধ। ইমাম দারে কুতনী হযরত আবু ছা‘লাবা হাসানী (رضى الله تعالي عنه) হতে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেন,
انّ الله فرض فرائض فلا تضيعوها وحرم حرمات فلا تنهكوها وحدّ حدودًا فلاتعيدوها وسكت عن اشياء من غير نسيان فلا تبحثوا عنها
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা কতিপয় বিষয় ফরয করেছেন, এগুলো তোমরা কখনো ছাড়বে না। আর কতিপয় বিষয়কে হারাম করেছেন, তোমরা সেগুলোতে দুঃসাহস দেখাইও না। আর কিছু সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তোমরা উক্ত সীমা লংঘন করো না। আর কতিপয় বিষয় সম্পর্কে স্বেচ্ছায় কোন হুকুম উল্লেখ করেন নি, তোমরা সেগুলোর সন্ধান করো না। অর্থাৎ- এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। হতে পারে তোমাদের অনুসন্ধানের কারণে এগুলো হারাম করে দিতে পারে।
জামে তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ শরীফে হযরত সালমান ফার্সী (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা যে সব বিষয় সম্পর্কে স্বীয় কিতাবে হালাল ঘোষণা করেছেন, তা হালাল এবং যেগুলো সম্পর্কে হারাম ঘোষণা দিয়েছেন, সেগুলো হারাম। আর যেগুলো সম্পর্কে কিছুই বলেননি, তা মাফকৃত।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,
مَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
‘রাসূলে পাক (ﷺ) তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন তা গ্রহণ করো এবং যা কিছু সম্পর্কে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।’
এখানে انتهوا আমর বা নির্দেশ সূচক শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা (আমর) ওয়াজিবের জন্য আসে। অতএব প্রথম প্রকার হচ্ছে শরয়ী ওয়াজিবাত-যা অবশ্যই করণীয়। আর দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে নাহী শরয়ী নিষিদ্ধতা- যা দ্বারা বিরত থাকা আবশ্যক প্রমাণিত হয়।
অতএব বুঝা গেল, যে সকল বিষয় সম্পর্কে শরীয়তের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি এবং নিষেধও করা হয়নি, তা ওয়াজিবও নয় এবং গোনাহও নয়। অর্থাৎ এগুলো করা ওয়াজিব নয় এবং না করাতে গুনাহও হবে না। বর্তমানে কোরআনে কারীম(ﷺ)র প্রতিক্রিয়ায় দ্বীন পূর্ণতা লাভ করেছে, এখন নতুন কোন হুকুম আসার অবকাশ নেই। অতএব যে সকল বিষয়ে শরীয়ত কোন হুকুম করেনি এবং নিষেধও করেনি তা মাফ ও নাজাতপ্রাপ্ত হিসেবে প্রমাণিত হল। যাতে এখন পরিবর্তনের কোন অবকাশ নেই।
নজদি ওহাবীরা আল্লাহ্ তা‘আলার ক্ষমাকৃত বিষয়ে অভিযোগ করছে, যা গ্রহণযোগ্য নয় বিধায় তা অগ্রাহ্য ও প্রত্যাখ্যাত। এ পর্যন্ত জায়েয না-জায়েয সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বাকী রইলো মুস্তাহাব হওয়া সম্পর্কে আলোচনা।
মিলাদুন্নবী (ﷺ) এমন কাজ যা সত্তাগতভাবে ভাল এবং মু’মিন মুসলমানগণ যাকে পূণ্য ও প্রশংসনীয় মনে করে সম্পাদন করে আসছেন, তা রাসূলে পাক (ﷺ)-এর ইরশাদ মোতাবিক সুন্নাতের মধ্যে পরিগণিত হয়। যদিও উক্ত কাজ ইতিপূর্বে এভাবে কেউ না করে। সুবহানাল্লাহ্!
প্রত্যেক বিদআত, বিদআতে সাইয়্যিয়া নয়। প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত বস্তু খারাপ ও মন্দ নয়। অবশ্য যদি দ্বীনের পরিপন্থী নতুন কোন কাজ আবিষ্কার করা হয়, তা বিদআতে সাইয়্যিয়া হিসেবে গণ্য হবে। যেমন- নামাযের জামাতে ইকামত বলার সময় দাঁড়িয়ে থাকা এবং জামাতের পর ঠিক ওই জায়গায় যেখানে ফরয আদায় করেছে, স্থান পরিবর্তন না করে সেখানে সুন্নাত ইত্যাদি নামায আদায় করা। এসব নব আবিষ্কৃত যা সুন্নাত ও শরীয়তে অনুপ্রবেশ করেছে, তাই এটা বিদআতে সাইয়্যিয়াহ। যা পালন করা নিষিদ্ধ ও না-জায়েয।
হাদীসসমূহ পাঠ করলে একথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বিদআতে সাইয়্যিয়া হচ্ছে যা সুন্নাতের পরিপন্থী এবং যে প্রথা চালু করার দরুণ সুন্নাত বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সাইয়্যেদুনা আরিফ বিল্লাহ ইমাম আবদুল গণি নাবিলুসী হানাফী (رحمه الله تعالي ) ‘হাদিকাতুন নাদিয়্যাহ শরহে তরিকায়ে মুহাম্মদিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, যদিও বিদআত নতুন আবিষ্কৃত হয়, এর সম্পাদনকারীকে সুন্নীই বলা হবে, কখনো বিদ‘আতী বলা যাবে না। কেননা রাসূলে পাক ভাল কাজের আবিষ্কারককে ‘সুন্নাত উদ্ভাবনকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেহেতু তারা প্রত্যেক পূণ্যের কাজ যদিও নতুন আবিষ্কৃত হয় এবং প্রত্যেক ভাল ও উত্তম বিদ‘আতকে সুন্নাতের অন্তভুর্ক্ত করেছেন। এই পবিত্র বাণীতে কিয়ামত পর্যন্ত নতুন নতুন পূণ্যময় কাজ আবিষ্ককারের অনুমোদন প্রমাণিত হলো। অতএব, সে সকল লোক এ জাতীয় নতুন কাজ আবিষ্কার করবেন তারা সওয়াব পাবেন। আর কিয়ামত পর্যন্ত যত লোক এর ওপর আমল করবে, সকলের সওয়াবের একটি অংশ সে পাবে। প্রত্যেক ভাল বিদআত সুন্নাতই।
ইমাম নববী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন যে, যত লোক উক্ত আমল করবে, সবার সওয়াব সে পাবে। সে ব্যক্তি উক্ত কাজ আবিষ্কার করুক কিংবা তার দিকে সন্বোধন করা হোক। তা সওয়াবের কাজ হোক কিংবা অন্য কোন ভাল কাজ কিংবা অন্য কোন কিছু।
56. আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ খলিল কাদেরী’র ‘ইফাদাত’ গ্রন্থ থেকে।
❏ প্রশ্ন-১৮ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)
(فداه ابى وامى-যাঁর ওপর আমার পিতা-মাতা কোরবান হোক)-এর পবিত্র জীবনী সম্পর্কে প্রত্যেক মুসলমানের অবগত হওয়া অতীব জরুরী। তাই হুযূর মোস্তফা (ﷺ)
এর পবিত্র জীবনী ও বংশধারা নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীর উদ্ধৃতিসহ বিশুদ্ধরূপে বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ اقول وبالله التوفيق وهو المستعان তবকাতে কোবরা, সিক্বাতে ইবনে হিব্বান, উসদুল গাবাহ্ এবং তারিখে তাবারিসহ অন্যান্য গ্রহণযোগ্য কিতাবসমূহের বরাত পর্যালোচনা পূর্বক বর্ণনা করা হলোঃ-
তাঁর পবিত্র বংশধারাঃ
সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে কা’ব ইবনে লুওয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহার ইবনে মালিক ইবনে নাদর ইবনে কিনানাহ ইবনে খুযাইমাহ ইবনে মুদরিকাহ ইবনে ইলিয়াস ইবনে মুদার ইবনে নায্যার ইবনে মা‘আদ ইবনে আদনান ইবনে উদ্দ ইবনে উদাদ ইবনে মুকাওয়াম ইবনে নাহুর ইবনে ইয়ারজ ইবনে জর্ব ইবনে ইয়াসহব ইবনে সাবিত ইবনে ক্বাইযার ইবনে ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম ইবনে আযর ইবনে নাখুর ইবনে শারুখ ইবনে বাক্কু ইবনে ফাতিহ ইবনে ‘আইবর ইবনে শালুখ ইবনে আরকহস ইবনে সাম ইবনে নূহ ইবনে লামিক ইবনে মুতাওয়াশ্শিলাহ ইবনে আখনুখ ইবনে ইদ্রিস ইবনে ইয়ারদ ইবনে মাহলাঈল ইবনে ক্বাইনান ইবনে ইয়ালুশ ইবনে শীশ ইবনে আদম আলাইহিমুস সালাম।
উক্ত বংশধারা আদনান পর্যন্ত ঐকমত্যের ভিত্তিতে সন্দোহীত সূত্রে বর্ণিত আছে। এরপর ক্বীদার থেকে হযরত ইবরাহীম পর্যন্ত মতানৈক্য সূত্রে বর্ণিত। এরপর কিছু মতৈক্য সূত্রে আবার কিছু মতানৈক্য সূত্রে বর্ণিত আছে। হযরত নূহ (عليه السلام) থেকে হযরত সৈয়্যদুনা আদম (عليه السلام) পর্যন্ত ঐকমত্যের সূত্রে বর্ণিত আছে। হুযূর রহমতে ‘আলম (ﷺ) নিজেকে আদনান পর্যন্ত সম্বন্ধযুক্ত করতেন।
❏ প্রশ্ন-১৯ঃ হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ)-এর সম্মানিত মাতা-পিতার মধ্যকার বিশেষ বংশীয় সম্পর্ক কি ছিল? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ هوالمستعان হুযূর এর সম্মানিত মাতার নাম আমিনা বিনতে ওহাব বিন আবদু মুনাফা। যেমন তাঁর বংশানুক্রম তৃতীয় স্তর ও খান্দানে গিয়ে হুযূর (ﷺ)-এর বংশের সাথে মিলে যায়। তাঁর (رضى الله تعالي عنها) নানীর নাম মুবারক উম্মে হাবীবা বিনতে আসাদ।
❏ প্রশ্ন-২০ঃ হুযূর তাঁর সম্মানিত পিতার ইন্তিকালের কতদিন পর এ ধরাধামে তাশরীফ আনেন?
✍ উত্তরঃ হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ) তাঁর পিতার ইন্তিকালের কতো দিন বা কতো মাস পর ইহজগতে তাশরীফ এনেছেন, এ বিষয়ে ওলামায়ে কিরামের মাঝে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে।
কতিপয় ওলামা বলেন, হুযূর (ﷺ) তাঁর পিতা ইন্তিকালের সময় মাতৃগর্ভে মাত্র দু’মাস বয়সের ছিলেন। কিছু ওলামা আরো কম-বেশি বলে থাকেন। আবার কারো মতে, তখন তিনি দেড় বছর বয়সী ছিলেন। কেউ বলেন, তখন তিনি একুশ মাস বয়সের ছিলেন। কারো মতে, ছয় বছর বয়সী ছিলেন। কিন্তু বিশুদ্ধতম অভিমত হচ্ছে, তিনি পবিত্র মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ই তাঁর সম্মানিত পিতা ইন্তিকাল করেন।
❏ প্রশ্ন-২১ঃ হুযূর ইহ জগতে তাশরীফ আনয়নের মাস, দিন ও বছর কী ছিল? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ হুযূর ১২ রবিউল আউয়াল ৪২ কিসরওয়ায় এ পার্থিব জগতে তাশরীফ আনেন। হুযূর (ﷺ)-এর ইহজগতে শুভাগমন এবং হযরত আদম (عليه السلام) এর অবতরণের মাঝে ৬১১৩ বছরের ব্যবধান রয়েছে। যেদিন তাঁর পূণ্যময় বিলাদত শরীফ হয় সেদিন পৃথিবীতে আনন্দের শোর-গোল ও হৈ-হুলোর পড়ে যায়।
বর্ণিত আছে যে, ওইদিন পৃথিবীর সকল মূর্তি উপড়ে পড়ে গিয়েছিল এবং যত সব অগ্নিকুন্ড ছিল সব নিভে গিয়েছিল। পারস্য রাজ-প্রাসাদের ইট-পাথর-কংকর অবলিলায় এমনিতেই খসে পড়েছিল। হযরত শেখ সাদী (رحمه الله تعالي ) বলেন,
زلزله در ديوان كسرىٰ افتاد ‘
পারস্য সম্রাটের রাজ-প্রাসাদে কম্পন সৃষ্টি হয়।’
❏ প্রশ্ন-২২ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ) -এর মুরদি‘আ বা দুধপানকারীনী মাতাগণের বরকতময় নাম কি কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ হুযূর কে তাঁর সম্মানিত মাতাসহ আটজন সৌভাগ্যবান রমণী দুধপান করিয়েছেন
১. তাঁর মহিমান্বিত মাতা আমিনা বিনতে ওহাব (رضى الله تعالي عنها)।
২. আবু লাহাবের দাসী সুয়াইবা (رضى الله تعالي عنها)।
৩. খোয়াইলিদ বিনতুল মুন্যির।
৪. জনৈকা রমণী সা‘দিয়া হালিমা।
৫,৬,৭. তিনজন রমণী যাদের সবার নাম আতিকা।
৮. হালিমা সা‘দিয়া (رضى الله تعالي عنها)।
❏ প্রশ্ন-২৩ঃ হুযূর (ﷺ) রেযায়ী বা দাইমাগণের তত্ত্বাবধানে কতো দিন ছিলেন?
✍ উত্তরঃ হুযূর (ﷺ)-এর সম্মানিত মাতা সাত দিন এবং সুয়াইবা আট দিন দুধপান করিয়েছেন। আর মধ্যবর্তী রমণীদের অবস্থা জানা নেই। যখন হযরত হালিমা সা‘দীয়া হুযূর (ﷺ) কে নিয়ে যান, তখন তিনি প্রায় একমাস বয়সের শিশু ছিলেন। যখন তাঁর বয়স দু’বছর হয় তখন হযরত হালিমা তাকে নিয়ে মক্কা শরীফ আসেন। হযরত আমিনা (رضى الله تعالي عنها)কে বলেন, আপনি যদি তাঁকে আরো কিছু দিন আমার কাছে রাখেন, এতে তাঁর শক্তি ও তেজস্বীতা আরো মজবুত হবে। অন্যদিকে আজকাল মক্কায় পেগ ও মহামারির প্রাদুর্ভাবও দেখা যাচ্ছে। তাই আমার কাছে আরো কিছু দিন থাকলে মক্কার এই মহামারী থেকেও নিরাপদ থাকার আশা করা যায়।
এখানে থাকলে মহামারি রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। তাই মা আমিনা (رضى الله تعالي عنها) তার এই অনুরোধ মঞ্জুর করলেন।
হযরত হালিমা সা‘দিয়া তাঁকে পুনরায় নিয়ে গেলেন। তাঁর বয়স যখন চার বছর হয় ফিরিশতারা তাঁর বক্ষ মুবারক বিদীর্ণ করেন এবং এতে নূর ও রহমত দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেন। উক্ত ঘটনা হযরত হালিমার সন্তানেরা দেখে তাদের মায়ের নিকট গিয়ে বলেন, তা শুনে তিনি ভীত হয়ে পড়েন এবং তাঁকে তাঁর মায়ের নিকট পৌঁছে দেন। তিনি চার বছরের কিছু কম সময় হযরত হালিমার তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
❏ প্রশ্ন-২৪ঃ হুযূর (ﷺ)-এর শৈশবকাল কীভাবে অতিবাহিত হয়?
✍ উত্তরঃ হুযূর (ﷺ)-এর শৈশবকাল খুবই ব্যাপক ও বিস্তৃত। সংক্ষেপে হচ্ছে, তিনি শিশুকালে অত্যন্ত খোদাভীরু, দয়ালু, বীর-বাহাদুর, গম্ভীর, সত্যবাদী, লজ্জাশীল, বিশ্বস্ত, আমানতদার এবং সকল প্রশংসনীয় গুণের অধিকারী ছিলেন। সকল ধরনের অন্যায়, অবিচার, অপরাধ ও নিন্দনীয় কর্মকে ঘৃণা করতেন। তিনি কখনো বিবস্ত্র হননি। এক সময়ের ঘটনা কুরাইশ গোত্রের লোকেরা কা’বা শরীফ পুনঃনির্মাণ করছিল, এতে তিনিও পাথর কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যদ্দরুন তাঁর কাঁধ মুবারকে পাথরের ঘষা লেগে কাঁধের চামড়া উঠে যাচ্ছিল, তা দেখে তাঁর চাচা হযরত আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) কাঁধের ওপর পরনের লুঙ্গি রাখার জন্য বললে তিনি রাজি হননি।
57. মাহবুবে আলম রচিত ‘ইসলামী মা’লুমাত’ গ্রন্থ থেকে চয়নকৃত।
❏ প্রশ্ন-২৫ঃ হুযূর (ﷺ)-এর কফীল বা অভিভাবক কে কে ছিলেন এবং তাদের নিকট কতো দিন ছিলেন?
✍ উত্তরঃ হযরত হালিমা সা’দিয়া (رضى الله تعالي عنها)-এর নিকট চার বছর, তাঁর সম্মানিতা মাতা হযরত আমিনা (رضى الله تعالي عنها)-এর নিকট দু’বছর দু’মাস দশ দিন। অতঃপর হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)-এর সম্মানিত পিতা এবং হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ) এর চাচা খাজা আবু তালেবের তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
❏ প্রশ্ন-২৬ঃ হযরত সায়্যিদাতুনা খাদিজাতুল কুবরা (رضى الله تعالي عنها) সঙ্গে বিবাহ এবং তাঁর সিরিয়া সফর কখন হয়?
✍ উত্তরঃ হুযূর (ﷺ) তিনবার সিরিয়া সফর করেন। প্রথমবার তাঁর ১৩ বছর বয়সে চাচা আবু তালেব যখন সিরিয়া সফরের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিলেন, তখন দু’জাহানের বাদশাহ হুযূর তার উটের লিগাম ধরে বলতে লাগলেন যে, আমাকে একা রেখে কেন চলে যাচ্ছেন? এখানে আমার মা-বাবা তো কেউ নেই। আবু তালেব দয়া পরবশ হয়ে তাঁকে সফরে সঙ্গে নিয়ে যান। পথিমধ্যে বুহাইরা নামক একজন পাদ্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।
মোদ্দাকথা, হযরত খাদিজাতুল কুবরা (رضى الله تعالي عنها)-এর সাথে চার শত দিনার মোহর নির্ধারণ করে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়। তখন হুযূর-এর বয়স ২৫ বছর এবং খাদিজাতুল কুবরা (رضى الله تعالي عنها)-এর বয়স ৪০ বছর।
❏ প্রশ্ন-২৭ঃ ওহি নাযিল কখন থেকে আরম্ভ হয়?
✍ উত্তরঃ যখন হুযূর (ﷺ)-এর পবিত্র বয়স ৪০ বছরে উপনীত হয় এবং রিসালতকাল নিকটবর্তী হয়। তখন তিনি যে গাছ-পালা ও পাথরের পার্শ্ব দিয়ে যেতেন, সেগুলো তাঁকে সম্বোধন করে বলতো, اَلسَّلَامُ عَلَيْكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ (আস্-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ) হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনাকে সালাম। তারা তাঁকে সিজদা করতো এবং তিনি যা যা স্বপ্ন দেখতেন তা বাস্তবে সত্য প্রমাণিত হত।
পরিশেষে তাঁর বয়স যখন ৪০ বছর সাত মাস হয়, তখন তিনি হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত সৈয়্যদুনা জিবরাইল (عليه السلام) ওহী নিয়ে আসেন। সূরা ‘আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত,
اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ . خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ . اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ . الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ . عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ.
পর্যন্ত আয়াতগুলো পড়ান এবং সত্য রিসালত ও পরিপূর্ণ নবুওয়াত দ্বারা তাঁকে অনুকম্পা করা হয়। অধিকাংশ অস্বীকারকারী যখন তাঁকে দেখত তৎক্ষণাৎ নির্দ্বিধায় বলে উঠতো لَيْسَ هَذا وَجْهُ الْكَاذِبِيْنَ ‘এটা কোন মিথ্যাবাদীর চেহারা নয়।’ তাৎক্ষণিক মু‘জিযা তালাশ না করে তারা ঈমান নিয়ে আসতেন। পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضى الله تعالي عنه), মহিলাদের মধ্যে হযরত খাদিজাতুল কুবরা (رضى الله تعالي عنها) এবং বালকদের মধ্যে হযরত আলী শের-ই খোদা (رضى الله تعالي عنه) ঈমান গ্রহণ করেন।
তাঁদের পর হযরত ওসমান (رضى الله تعالي عنه), হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (رضى الله تعالي عنه), হযরত সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (رضى الله تعالي عنه), হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (رضى الله تعالي عنه), হযরত তালহা ইবনে ওবাইদুল্লাহ (رضى الله تعالي عنه) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضى الله تعالي عنه) ঈমান গ্রহণ করেন।
হুযূর সৈয়্যদুল আন্বিয়া (ﷺ) ইসলামের দাওয়াত অব্যাহত ভাবে অত্যন্ত গোপনে দিতে থাকেন। সুতরাং তিন বছরে ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা মাত্র ৩৯ জনে উপনীত হয়। অতঃপর হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) ইসলাম গ্রহণ করেন, ফলে ইসলাম ধর্ম অনেক শক্তিশালী হয় এবং মুসলমানের সংখ্যাও চলিশে উপনীত হয়। কিন্তু কাফিররা মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করতেই থাকে।
❏ প্রশ্ন-২৮ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ) -এর মি‘রাজ কখন সংঘটিত হয়?
✍ উত্তরঃ নবুওয়াতের একাদশ বৎসর ২৭শে রজব মি‘রাজ শরীফ সংঘটিত হয়। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) সর্বপ্রথম মি‘রাজ শরীফের ঘটনা সত্যায়ন করেন এবং ‘সিদ্দীক’ উপাধি লাভ করেন।
❏ প্রশ্ন-২৯ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ) -এর হিজরতের বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ যখন মক্কার কুরাইশ কাফিররা মুসলমানদের ওপর সীমাহীন ও অবর্ণনীয় নির্যাতন যুলুম করতে থাকে, তখন হুযূর আকরাম (ﷺ) সাহাবা-ই কিরামদেরকে হিজরত করার অনুমতি প্রদান করেন। অধিকাংশ মুসলমান আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। তাঁদের মধ্যে হুযূর (ﷺ)-এর চাচাতো ভাই হযরত সৈয়্যদুনা জাফর তাইয়্যার ইবনে আবি তালিব (رضى الله تعالي عنه), তাঁর জামাতা হযরত ওসমান ইবনে আফ্ফান (رضى الله تعالي عنه) এবং তাঁর শাহজাদী হযরত রুকাইয়া (رضى الله تعالي عنها)ও ছিলেন।
আর কাফিরদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও জোরজুলুম যখন সীমাহীন আরো বেড়ে গেল। তখন তিনি সাহাবা-ই কিরামদেরকে মদিনা মুনাওয়ারা হিজরত করার অনুমতি প্রদান করেন। একে একে সবাই হিজরত করে সেই ইবরাহীমী সুন্নাতকে আলোকিত করেন।
শুধুমাত্র স্বয়ং হুযূর মোস্তফা (ﷺ) রহমতে ‘আলম , হযরত সৈয়্যদুনা আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) ও তাঁর পরিবারবর্গ এবং হযরত সৈয়্যদুনা আলী মরতুজা (رضى الله تعالي عنه) মক্কায় থেকে যান। একদা অভিশপ্ত আবু জাহল হুযূর কে হত্যা করার পরামর্শ করল। (নাউযুবিল্লাহ) হুযূর (ﷺ) যখন এই সংবাদ পেলেন, তখন তাড়াতাড়ি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه)-এর নিকট গিয়ে তাকে বলেন, আবু জাহল আমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে আমি আজ রাতই হিজরত করার ইচ্ছে পোষণ করছি, তুমিও আমার সঙ্গে চলো। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) আরয করলেন, আমি এ উদ্দেশ্যে দু’টি উট আগে থেকেই ক্রয় করে রেখেছি। হুযূর (ﷺ) একটি উটের মূল্য সিদ্দীকে আকবরকে দিলেন, যদিও তিনি তা গ্রহণে অনেক ওযর-আপত্তি করেছেন। তিনদিন পর্যন্ত তারা ছাওর গুহার আত্মগোপনে অবস্থান করেন। অতঃপর সেখানে থেকে মদিনা শরীফের দিকে রওয়ানা হন।
❏ প্রশ্ন-৩০ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ) পবিত্র মক্কায় কতোদিন অবস্থান করেন এবং কখন মদিনায় হিজরত করেন?
✍ উত্তরঃ হুযূর (ﷺ) যখন হিজরত করেন সে সময় তাঁর পবিত্র বয়স ৫৩ বছর এবং তাঁর নবুওয়াত প্রকাশের ১৩তম বছর। তিনি রবিউল আউয়াল শরীফের ১২ কিংবা ১৩ তারিখ রবি অথবা সোমবার মদিনা শরীফে প্রবেশ করেন। অন্য একটি বর্ণনা মতে, তিনি ১৬ রবিউল আউয়াল শরীফ নবুওয়াতের ১৩তম বছর মোতাবেক ২ জুলাই ৬২২ খ্রীষ্টাব্দে হিজরত করেন।
❏ প্রশ্ন-৩১ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ হুযূর (ﷺ)-এর চরিত্র এত উঁচু পর্যায়ের ছিল যে, এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) বলেন, আমি দশ বছর হুযূর (ﷺ)-এর খিদমতে ছিলাম, ভুলবশতঃ আমার কোন কথা বা কাজে অসন্তুষ্ট হলেও তিনি কখনো আমাকে একথা বলেননি যে, তুমি এ কাজটি ভুল করেছ এবং কেন করেছ? আমরা যখন কোন ভাল কাজ করতাম, তিনি দু‘আ করতেন। আমাদের কোন কাজে যখন অসন্তুষ্ট হতেন, তখন বলতেন,
كَانَ اَمْرُ اللهِ قَدْرًا مَقْدُوْرًا
হুযূর (ﷺ) ঘরের কাজ সবার সাথে মিলেমিশে করতেন। মূর্খতাবশতঃ কেউ তাঁকে কোন কাজের জন্য বললে, তিনি নিষেধ করতেন না। সফরের সময় বাহন যেটা পেতেন সেটাতে সন্তুষ্ট থাকতেন। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنها)কে তাঁর স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে কেউ জিজ্ঞেস করলে তিনি (رضى الله تعالي عنها) উত্তরে বলেন, كَانَ خُلُقُهُ اَلْقُرْآن ‘তাঁর পুরো চরিত্রই ছিল কোরআনে কারীম(ﷺ) ’। অর্থাৎ- পবিত্র কোরআনে যে সকল প্রশংসনীয় স্বভাব-চরিত্রের কথা উল্লেখ আছে, সে সকল চরিত্রে তিনি ছিলেন চরিত্রবান ও প্রশংসিত। কোরআন মজিদই তাঁর প্রকৃত স্বভাব ও মহানূভবতার দলিল।
মদীনার দাস-দাসীরা তাদের অকৃত্রিম ই‘তিকাদ ও ভক্তি বিশ্বাস নিয়ে বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে হুযূর (ﷺ)-এর নিকট পানির পাত্র নিয়ে আবেদন করতেন যে, আপনি এতে আপনার হাত মুবারক ডুবিয়ে দিন। তিনি তীব্র শীতের মৌসুমেও তাদের প্রত্যাশা পূরণের জন্য পাত্রে হাত মুবারক ডুবিয়ে দিতেন।
❏ প্রশ্ন-৩২ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় যুদ্ধের সংখ্যা কত ছিল ?
✍ উত্তরঃ হুযূর (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় যুদ্ধের সংখ্যার ব্যাপারে ঐতিহাসিক এবং ওলামায়ে কিরামের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ বলেন, ১৯টি; কেউ বলেন, ২৬টি; কেউ বলেন, ২৭টি এবং কেউ বলেন, ৩৬টি। উক্ত যুদ্ধসমূহের মধ্যে মাত্র ৯টি যুদ্ধে হত্যাকান্ড ও সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছে, অন্যগুলোতে সংঘর্ষ হয়নি। যে সকল যুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর নাম নিম্নরূপঃ
১. বদর যুদ্ধ,
২. উহুদ যুদ্ধ,
৩. খন্দকের যুদ্ধ,
৪. বনু কুরাইযার যুদ্ধ,
৫. বনি মুসতলকের যুদ্ধ,
৬. খাইবরের যুদ্ধ,
৭. মক্কা বিজয়,
৮. হুনাইনের যুদ্ধ এবং
৯. তায়েফ যুদ্ধ।
কতিপয় ওলামায়ে কিরাম বলেন, ১২টি যুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ ও সংঘর্ষ হয়েছে, বাকীগুলোতে হয়নি।
হুযূর পাক (ﷺ)-এর সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণের বিভিন্ন উক্তি পাওয়া যায়। সরিয়্যাহ সংখ্যা মতান্তরে ৩৫টি কিংবা ৪৮টি। প্রত্যেক সারিয়্যাতে ৪০০ জন সৈন্য থাকে। এ হিসেবে হুযূর (ﷺ)-এর সৈন্য সংখ্যা ১৯,২০০ জন দাঁড়ায়।
হযরাত সাহাবা-ই কিরামের সংখ্যা সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, মক্কা বিজয়ের সময় হুযূর (ﷺ)-এর সঙ্গে ১০,০০০ (দশ হাজার) সৈন্যবাহিনী ছিলেন, হুনাইনের যুদ্ধে ছিলেন ১২,০০০ (বার হাজার) এবং তাবুক যুদ্ধে ছিলেন ৭০,০০০ হাজার। বিদায় হজ্বের দিন মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৮০,০০০ হাজার, তম্মধ্যে ৪০,০০০ হাজার তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সর্বশেষ হুযূর আক্বদাস-এর ইন্তিকালের সময় ১,২৪,০০০ (এক লক্ষ চব্বিশ হাজার) ছিলেন হযরাত সাহাবা-ই কিরাম (رضى الله تعالي عنه) এর সংখ্যা।
❏ প্রশ্ন-৩৩ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর সম্মানিত বিবিগণের সংখ্যা এবং তাঁদের নাম মুবারক কি ছিল? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর সম্মানিত স্ত্রীগণের সংখ্যা ছিল ১১ জন। সর্বপ্রথম হুযূর(ﷺ),
১. উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (رضى الله تعالي عنها)কে শাদী করেন। তখন তাঁর পবিত্র বয়স হয়েছিল ২৫ বছর এবং হযরত খাদিজার বয়স ৪০ বছর।
২. উম্মুল মু’মিনীন হযরত সাওদাহ বিনতে যাম‘আহ্ ইবনে কাইস ( رضى الله تعالي عنها )।
৩. উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা বিনতে আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنها)।
৪. উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা বিনতে ওমর ইবনুল খাত্তাব (رضى الله تعالي عنها)।
৫. উম্মুল মু’মিনীন হযরত যয়নব বিনতে খুযাইমা ইবনে হারিস (رضى الله تعالي عنها)।
৬. উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমা বিনতে আবি উমাইয়া মাখযুমী (رضى الله تعالي عنها)।
৭. উম্মুল মু’মিনীন হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (رضى الله تعالي عنها)।
৮. উম্মুল মু’মিনীন হযরত জুওয়াইরিয়্যাহ বিনতুল হারিস ইবনে আবি জারারাহ (رضى الله تعالي عنها)।
৯. উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে হাবীবা বিনতে আবি সুফিয়ান ইবনে হারব (رضى الله تعالي عنها)।
১০. উম্মুল মু’মিনীন হযরত সফিয়্যাহ বিনতে হুয়াই ইবনে আখতব (رضى الله تعالي عنها) এবং
১১. উম্মুল মু’মিনীন হযরত মাইমুনা বিনতুল হারিস আল হালালিয়াহ (رضى الله تعالي عنها)।
❏ প্রশ্ন-৩৪ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর বাঁদী বা ক্রীতদাসী কতজন ছিলেন এবং তাঁদের নাম কি ছিল ?
✍ উত্তরঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর চারজন ক্রীতদাসী ছিলেন। যথাঃ
১. মারিয়াহ কিব্তিয়াহ (رضى الله تعالي عنه)। তাঁর গর্ভে হযরত ইবরাহীম (رضى الله تعالي عنه) জন্মগ্রহণ করেন।
২. রাইহানা (رضى الله تعالي عنه)।
৩. জামিলা (رضى الله تعالي عنه) এবং
৪. চতুর্থ জনের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
বর্ণিত আছে যে, তবে উক্ত ক্রীতদাসীকে হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (رضى الله تعالي عنها) হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ)কে হাদিয়া দিয়েছিলেন।
❏ প্রশ্ন-৩৫ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর আওলাদ বা সন্তান-সন্ততি কতজন ছিলেন?
✍ উত্তরঃ হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পাঁচজন শাহজাদা (ছেলে) এবং চারজন শাহজাদী (মেয়ে) ছিলেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র হযরত ইবরাহীম (رضى الله تعالي عنه) হযরত মারিয়াহ কিব্তিয়াহ (رضى الله تعالي عنها)-এর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। বাকী সকল সন্তান-সন্ততি হযরত খাদিজাতুল কুবরা (رضى الله تعالي عنها) এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পবিত্র নামসমূহ নিম্নরূপঃ
১. হযরত ইবরাহীম (رضى الله تعالي عنه),
২. হযরত কাসেম (رضى الله تعالي عنه),
৩. হযরত তৈয়ব (رضى الله تعالي عنه),
৪. হযরত তাহির (رضى الله تعالي عنه),
৫. হযরত আবদুল্লাহ (رضى الله تعالي عنه),
৬. হযরত যয়নব (رضى الله تعالي عنها),
৭. হযরত রুকাইয়াহ (رضى الله تعالي عنها),
৮. হযরত উম্মে কুলসুম (رضى الله تعالي عنها) এবং
৯. হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা (رضى الله تعالي عنها)।
তাঁর সকল ছেলে সন্তান শৈশবেই ইন্তিকাল করেন কিন্তু মেয়ে সন্তানেরা বড় হয়েছিলেন এবং বিবাহ-শাদীও দেয়া হয়েছিল।
❏ প্রশ্ন-৩৬ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর ঘোড়াগুলোর নাম কি ছিল?
✍ উত্তরঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ) মদিনা মুনাওয়ারায় ফুযারা গোত্রের এক বেদঈন থেকে ‘সাকাব’ নামী একটি ঘোড়া দশ আউকিয়া মূল্যে ক্রয় করেছিলেন এবং উহুদ যুদ্ধে তিনি উক্ত ঘোড়ায় আরোহন করেছিলেন। হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর ‘মালাদাহ’ নামক আরো একটি প্রসিদ্ধ ঘোড়া ছিল, যা প্রথমে আবু বুরদাহ ইবনে আবি নিয়ারের নিকট ছিল। হুযূর (ﷺ)-এর ‘আল-মুর্তাজিয্’ নামক আরো একটি ঘোড়া ছিল যা বনি মুর্রাহ গোত্রের এক বেদুঈন ক্রয় করেছিলেন। তাঁর আরো তিনটি ঘোড়া ছিল। এগুলোর একটির নাম ছিল লায্যায্, দ্বিতীয়টির নাম ত্বারব এবং তৃতীয়টির নাম ছিল লুখাইফ।
❏ প্রশ্ন-৩৭ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর যুদ্ধাস্ত্রের নাম কি ছিল?
✍ উত্তরঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর একটি তরবারির নাম ছিল ‘যুল-ফিক্বার’। যা বদর যুদ্ধে পেয়েছিলেন। কাইনুকার যুদ্ধে তিনটি তরবারি পেয়েছিলেন। সেগুলো হচ্ছে ক্বিলাঈ, বতার ও হতফ। তাঁর নিকট আরো দু’টি তরবারি ছিল। একটি হচ্ছে মিহযাম, অপরটি রাসূব।
❏ প্রশ্ন-৩৮ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর ধনুকের সংখ্যা কত ছিল?
✍ উত্তরঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর তিনটি ধনুক ছিল। প্রথমটির নাম রাউহা, দ্বিতীয়টি বায়দা এবং তৃতীয়টির নাম সাফারা ছিল।
❏ প্রশ্ন-৩৯ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর যুদ্ধের পোশাক সংখ্যা কত ছিল?
✍ উত্তরঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর তিনটি যুদ্ধের পোশাক ছিল। তন্মধ্যে প্রথমটির নাম সা‘দিয়াহ, দ্বিতীয়টির নাম ফচ্ছাহ এবং তৃতীটির নাম যাতুল ফুযূল।
তাঁর নিকট ঢালও ছিল (তলোয়ারের ফলা)। যার ওপর ছাগল এবং মূর্তি অংকিত ছবি ছিল। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত তাঁর নিকট ছিল না।
❏ প্রশ্ন-৪০ঃ হযরত যয়নব বিনতে জাহাশের নাম পরিবর্তন করার কারণ কি ছিল?
✍ উত্তরঃ যয়নব বিনতে জাহাশ (رضى الله تعالي عنها) ছিলেন হুযূর (ﷺ)-এর আপন ফুফু হযরত উমাইয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিবের কন্যা। তাঁর নাম প্রথমে ছিল বুর্রাহ। হুযূর (ﷺ) উক্ত নাম পরিবর্তন করে যয়নব রাখেন। কারণ ‘বুররাহ শব্দের অর্থ অতীব পবিত্র ও পূণ্যবতী মহিলা। যেহেতু উক্ত অর্থে অহংকার ও আত্মগরিমার গন্ধ পাওয়া যায়, তাই শরীয়তের দৃষ্টিতে তা নিষিদ্ধ।
58. আহকামে শরীয়ত।
এমনকি উক্ত শব্দ ব্যবহারেও অনেক ক্ষেত্রে খারাপ অর্থের সৃষ্টি হয়। যেমন, যদি কেউ বলে ‘বুর্রাহ ঘরে নেই’। তখন বাহ্যিকভাবে এর অর্থ দাড়াবে, কোন পূণ্যবতী মহিলা ঘরে নেই। তাই হুযূর (ﷺ) তাঁর নাম পরিবর্তন করে দিয়েছেন। এ জাতীয় অন্যান্য নাম যেমন রহমত বরকত ইত্যাদি রাখাও সমীচীন নয়।
فلا تزكوا انفسكم الخ ‘তোমরা নিজেদেরকে পবিত্র মনে করো না’ আয়াত দ্বারা দলিল উপস্থাপন করেন।
❏ প্রশ্ন-৪১ঃ হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ) -এর শাহজাদীগণের মাঝে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ কে ছিলেন?
✍ উত্তরঃ শাহজাদীগণের মাঝে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন হযরত যয়নব বিনতে মুহাম্মদ ।ইবনে ইসহাক মতে, তাঁর জন্ম হুযূর পাক(ﷺ)-এর বিলাদত শরীফের ত্রিশতম বৎসরে হয়েছিল। যুবতী হওয়ার পর লক্বীত আবুল আস ইবনুর্ রবী’র সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। পরবর্তীতে হযরত হযরত যয়নব (رضى الله تعالي عنها) মদিনা শরীফে হিজরত করেন। আবুল আস্ কাফির থাকার কারণে তারা পৃথক হয়ে যান। কয়েক বছর পর আবুল আস মদিনা মুনাওয়ারায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাই মোস্তফা (ﷺ) তাঁদের পূর্বের বিবাহ বহাল রেখে কিংবা নতুন করে নিকাহ দ্বারা হযরত আবুল আস (رضى الله تعالي عنه)-এর নিকট সোপর্দ করেন। অতঃপর তাঁদের সংসারে আলী নামক এক পুত্র এবং উমামাহ নামী এক কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। আলী ইবনে যয়নব বাল্যকালে ইন্তিকাল করেন এবং উমামাহ জীবিত ছিলেন। খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা যাহরা (رضى الله تعالي عنها)-এর ইন্তিকালের পর তাঁর অসিয়ত মোতাবেক হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) তাঁকে বিবাহ করেন এবং তাঁর গর্ভে মুহাম্মদ আওসত নামে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করেন কিন্তু জীবিত ছিলেন না। হযরত যয়নব (رضى الله تعالي عنها) ৮ম হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। হযরত সওদা বিনতে যাম‘আহ (رضى الله تعالي عنها), উম্মে সালামা (رضى الله تعالي عنها), উম্মে আইমন (رضى الله تعالي عنها) এবং উম্মে আতিয়াহ আনসারী (رضى الله تعالي عنها) প্রমূখ তাঁকে গোসল দেন। পবিত্র হাদীস দ্বারা একথা স্পষ্ট যে, হুযূর ধৌতকারী মহিলাদেরকে সন্বোধন করে বলেন, তাঁকে তিনবার কিংবা পাঁচবার ধৌত কর। হাদীস বর্ণনাকারী উম্মে আতিয়া বলেন, গোসল শেষে আমি খবর দিলাম যে, গোসল সম্পন্ন হয়েছে। তখন হুযূর (ﷺ) নিজের লুঙ্গী মুবারক দিয়ে বললেন যে, এটা কাফনের সঙ্গে বরকতের উদ্দেশ্যে দিয়ে দাও। অতঃপর তাঁকে কাফনের ব্যবস্থা এবং জানাযার নামাযের পর দাফন করা হয়। হুযূর মোস্তফা (ﷺ) স্বয়ং নিজেই তাঁকে কবরে রাখেন। তখন যয়নব-এর বয়স বিশ কিংবা একুশ বছরের কাছাকাছি হয়েছিল।
❏ প্রশ্ন-৪২ঃ দু’জাহানের সরদার হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর সম্মানিতা মাতা কখন এবং কোথায় ইন্তিকাল করেন?
✍ উত্তরঃ হুযূর রহমতে ‘আলম(ﷺ)-এর সম্মানিতা মাতা হযরত আমিনা বিনতে ওহাব (رضى الله تعالي عنه) এবং হুযূর-এর সম্মানিত পিতা হযরত আবদুল্লাহ (رضى الله تعالي عنه) উভয়ের মাঝে বংশীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। যা নিম্নোক্ত শজরা থেকে প্রকাশ পায়।
হুযূর(ﷺ)-এর সম্মানিত পিতা হযরত খাজা আবদুল্লাহ তাঁর জন্মের কিছুদিন পূর্বে ইন্তিকাল করেন। কিন্তু হযরত আমিনা অত্যন্ত সাহসিকতা ও দৃঢ়মনোবল নিয়ে আল্লাহর প্রিয় মাহবুবকে লালন-পালন শুরু করেন। আরবের প্রথানুযায়ী হালিমা সা‘দিয়া নামক এক গ্রাম্য দাইমার নিকট তাঁকে লালন-পালন ও দুধপান করানোর দায়িত্ব অর্পন করেন। দু’বছর পর দুধপান শেষ হলে তাঁকে তাঁর মাতা আমিনার নিকট নিয়ে আসেন। বিচক্ষণ গুণবতী ও জ্ঞানী মাতা সন্তানের সু-স্বাস্থ্য দেখে চিন্তা করলেন যে, হয়তো মক্কার আবহাওয়া তাঁর অনুকূলে নাও হতে পারে, তাই হালিমা সা‘দিয়ার সঙ্গে তাঁকে পুনরায় পাঠিয়ে দিলেন। অতএব একথা প্রতীয়মান হয় যে, অধিকাংশ সম্মানিত ও শরীফ খান্দান ভদ্রলোকদের মাতা শিক্ষিত, মার্জিত ও বিচক্ষণ হয়ে থাকেন, রহমতে ‘আলম (ﷺ)-এর মাতাও সেই প্রশংসনীয় গুণসম্পন্না বিদূষী মহিলা এবং দূরদর্শী জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। আমাদের দেশের অনেক মহিলারা নিজ সন্তানের সুস্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখেন না।
হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ(ﷺ)এর বয়স যখন ছয় বছরে উপনীত হয়, তখন হযরত আমিনা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মদিনা শরীফের বনু নাজ্জার গোত্রে খাজা আবদুল মুত্তালিবের মাতুলালয়ে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে মর্বুয়া কিংবা আব্ওয়া নামক স্থানে বিশ কিংবা একুশ বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন।
কতিপয় ওলামার মতে, তিনি মক্কা শরীফে ইন্তিকাল করেন। তাঁর পবিত্র ঔরসে শুধুমাত্র আল্লাহর প্রিয় হাবীব মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্মলাভ করেন। তিনি একজন প্রখ্যাত কবিও ছিলেন।
❏ প্রশ্ন-৪৩ঃ ‘আহমদ’ এটা কার নাম ? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ ‘আহমদ’ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর অন্যতম দ্বিতীয় নাম। যার অর্থ হচ্ছে, নির্বাচিত, মনোনীত ও প্রশংসনীয় গুণাবলী। হুযূর-এর পূর্ববর্তী নবীগণের ওপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাবসমূহে হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর নবুওয়াতে সুসংবাদ লিপিবদ্ধ ছিল এবং সেখানে তাঁর ‘আহমদ’ নামই এসেছিল। পার্থক্য শুধুমাত্র ভাষার। হুযূর মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) ছিলেন আরবী এবং তাঁর ভাষাও আরবী। তাই তাঁর নামও আরবী হওয়া উচিৎ। অন্যদিকে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ ছিল অনারবী ভাষায়। তাই উক্ত কিতাবসমূহে ‘আহমদ’-এর স্থলে قارقليط (কারে-কলীত্ব) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যা অর্থের দিক দিয়ে আহমদ শব্দের সমার্থক এবং একই ওযনের। কোরআন মজিদে উক্ত সুসংবাদের বর্ণনা এভাবে এসেছে।
وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ .
‘হে হাবীব আপনি স্মরণ করুন, যখন মরিয়ম পুত্র ঈসা (عليه السلام) বললেন, হে বনি ইসরাইল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে তাশরীফ আনবেন। তাঁর নাম আহমদ।’
❏ প্রশ্ন-৪৪ঃ মাওলাদ বা জন্মস্থান ও জন্ম তারিখ দ্বারা উদ্দেশ্য কি বর্ণনা কর?
✍ উত্তরঃ কোন নবী-রাসূল কিংবা বুযূর্গের জন্মদিবস। সাধারণত এর দ্বারা রবিউল আউয়াল শরীফের ১২ তারিখ উদ্দেশ্য, যা হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর বেলাদত শরীফের দিন। এটাকেই মাওলুদুন্ নবী (ﷺ) বলা হয়। হিন্দুস্তান ও মিশরে এর অধিক প্রচলন বিদ্যমান আছে কিন্তু মধ্য এশিয়াতে এর প্রসিদ্ধি কম। উক্ত দিবসে হিন্দুস্তানে হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে আলোচনার বিশেষ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। হুযূর (ﷺ)-এর প্রশংসা ও মর্যাদা সম্বলিত না’তে রাসূল পাঠ করা হয় এবং দরূদ শরীফের খতম ও যিকিরের ব্যবস্থা করা হয়।
কিন্তু ওহাবী সম্প্রদায় যারা আহলে হাদীস হিসেবে প্রসিদ্ধ তারা এ জাতীয় মাহফিলকে বিদ‘আত ও সুন্নাত পরিপন্থী বলে বিশ্বাস করে।
বেলাদত বলতে ১২ রবিউল আউয়াল শরীফ উদ্দেশ্য। ১২ রবিউল আউয়াল সমগ্র মুসলিম বিশ্বে অতীব সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ দিবস হিসেবে প্রসিদ্ধ এবং ওই দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়। মসজিদ সমূহে এবং বিভিন্ন ঘরে মিলাদ শরীফের মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে হুযূর (ﷺ)-এর মর্যাদাপূর্ণ জীবনী আলোচনা করে লোকজনকে নবী প্রেমে উজ্জীবিত করা হয় এবং মর্মস্পর্শী ও হৃদয়গ্রাহী না‘ত শরীফ পাঠ করার মাধ্যমে এ মুহাব্বতে আবেগের সৃষ্টি হয়।
কিন্তু ওহাবী তথা আহলে হাদীসরা এ জাতীয় কর্ম সম্পাদনকে বিদ‘আত ও সুন্নাত পরিপন্থী কাজ বলে আক্বীদা পোষণ করে। হুযূর (ﷺ)-এর বেলাদত শরীফের তারিখ ১২ রবিউল আউয়াল শরীফ এবং ওফাত শরীফের তারিখও মতান্তরে ১২ রবিউল আউয়াল শরীফ। অতএব মুসলমানদের জন্য ১২ রবিউল আউয়াল শরীফ অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত ও মর্যাদাপূর্ণ দিন, যাতে তাঁর বিলাদত ও ওফাত উভয়ের স্মরণ করা হয়।
১৩২৭ হিজরীতে সিরিয়া ও আরব দেশে এ আন্দোলন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয় যে, ওই দিনকে সকল ইসলামী মহান ও স্মরণীয় দিনগুলোর চেয়ে অধিক শানদার মর্যাদাপূর্ণ ও বরকতময় দিন হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। উক্ত আন্দোলনের প্রতিধ্বনি হিন্দুস্তানসহ বিভিন্ন ইসলামী দেশগুলোতেও পৌঁছে যায়। ফলে ১৩২৮ হিজরীতে হিন্দুস্তানের মুসলমানেরা বিভিন্ন শহরে উক্ত দিন ঈদে মিলাদুন্ নবী উদযাপন করেন। হুযূর (ﷺ)-এর ওফাত শরীফের বিশুদ্ধ তারিখ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। সাধারণত প্রসিদ্ধ যে, ১২ তারিখ তাঁর মাওলুদ শরীফ। শিক্ষিত গুণিজন এবং প্রখ্যাত ওলামা ও বুযূর্গানে দ্বীন সম্মিলিতভাবে মাহফিল করেছেন এবং হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্রতা ও মহত্ব সম্পর্কে জোরালো বক্তব্য পেশ করেন। উক্ত সমাবেশের নাম ‘১২ই ওফাত দিবস’-এর পরিবর্তে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী ’ নামে স্বীকৃতি লাভ করে। বিভিন্ন পত্রিকা ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর খুশিতে রঙ্গীণ ক্রোড়পত্র এবং বিলাদতে মোস্তফা (ﷺ)-এর ওপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী প্রকাশ করে। প্রত্যেক বছর এবং প্রতিটা মুহূর্তে একবার স্বীয় প্রিয় মাওলা নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্মরণে মাহফিল করা এবং তাঁর নবুওয়াতের বিশুদ্ধ ঘটনাবলীকে গদ্য ও পদ্যের বিভিন্ন পদ্ধতিতে বর্ণনা করা, এমন এক মুস্তাহসন বা পূণ্যময় প্রশংসনীয় বিষয় যে, যা বর্ণনা ও যুক্তির নিরিখে অস্বীকার করা যাবে না।
من احب شيئًا اكثر ذكرهُ এটি স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনস্বীকৃত নীতিমালা। অর্থাৎ- যে যাকে ভালবাসে সে তার স্মরণ অধিকহারে করে থাকে। কোন ব্যক্তি মুসলমান হতে পারবে না যতক্ষণ তার মাঝে স্বীয় আক্বা মাওলা মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুহব্বত নিজ প্রাণ ও সন্তান-সন্ততি থেকে অধিক প্রিয় না হবে। মুহব্বতের চাহিদা হচ্ছে, বন্ধুর স্মরণে সর্বদা ব্যাপৃত থাকা। বর্তমানে প্রত্যেক জাতি তাদের দলীয় নেতৃবৃন্দ ও পথপ্রদর্শকদের জন্মবার্ষিকী ও শাহাদত বার্ষিকী অত্যন্ত জাঁকজমক ও ধুম-ধামের সাথে পালন করছে। অতএব মুসলমানগণ তাদের সত্য নবী ও প্রিয় রাসূল (ﷺ)-এর বছরের এই মুবারক দিনে যে নূর ইহজগতে প্রকাশিত হয়েছেন এবং ওই দিন আল্লাহ তা‘আলার মাহবুব তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, সে পূণ্যময় দিনে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) করে উক্ত অনুপম পূণ্যময় দিনকে স্মরণীয় করে রাখবে না কেন?
59. সূরা আছ্-ছফ্, আয়াতঃ ৬
❏ প্রশ্ন-৪৫ঃ সিদরাতুল মুন্তাহা ও সিদরাতুন নবী কাকে বলে এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কি?
✍ উত্তরঃ সিদরাতুল মুন্তাহা মি‘রাজ শরীফের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ‘সিদরা’ অর্থ- বরই গাছ বা কুল বৃক্ষ। সিদ্রাতুল মুন্তাহা ওই কুল বৃক্ষকে বলা হয়, যা সপ্ত আসমানের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। ফেরেশতাকুল সরদার সৈয়্যদুনা জিবরাঈল (عليه السلام)-এর উর্ধ্বকাশের শেষ গমনস্থল, এর সামনে এক চুল পরিমাণও তিনি যেতে সক্ষম নন। পৃথিবী থেকে যা কিছু আকাশের দিকে উঠানো হয় এবং আসমান থেকে যা কিছু পৃথিবীতে অবতরণ করা হয় সব কিছু ‘সিদরাতুল মুন্তকাহা’য় গিয়ে থেমে যায়। অতঃপর সেখান থেকে ফেরেশতারা উপরে নিয়ে যায় এবং নীচে নিয়ে আসে।
60. মিশকাত শরীফ।
কোরআন মজিদের ‘সূরা আন-নাজমে’ এভাবে বর্ণিত হয়
أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى . وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى . عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى . عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى . إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى .
‘তোমরা কি বিষয়ে তাঁর সঙ্গে যুক্তিতর্কে লিপ্ত হয়েছ? অথচ এটা তর্কের বিষয় নয়। কেননা তিনি তো মি‘রাজ রজনীতে সিদরাতুল মুন্তাহায় যা পূণ্যবানদের অবস্থান করার অনেক স্থান রয়েছে। সৈয়্যদুনা জিবরাইল (عليه السلام) তাঁর প্রকৃত আকৃতিতে আরো একবার তাঁর নিকট আসা অবস্থায় দেখেছিলেন। যখন ওই সিদ্রার ওপর নূরের ছায়া ছিল সিদ্রাতুল মুন্তাহার নিকটে। যার নিকট রয়েছে ‘জান্নাতুল মাওয়া’। যখন বৃক্ষটি আচ্ছন্ন করেছিল, যা আচ্ছন্ন করার ছিল।’
61. সূরা আন-নজম, আয়াতঃ ১২-১৬।
প্রশ্নোলিখিত ‘সিদরাতুল মুন্তাহা, যা কোরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং ‘সিদরাতুন নবী’ যা সম্পর্কে হাদীস ও ইতিহাসে বর্ণনা আছে। ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’ আসমানে এবং ‘সিদরাতুন্ নবী’ পৃথিবীতে অবস্থিত। ঘটনাটি এভাবে বর্ণিত আছে যে, একটি কুল বৃক্ষ হুযূর (ﷺ) -এর মু’জিযা স্বরূপ দ্বিখন্ডিত হয়ে গিয়েছিল। একদা হুযূর মোস্তফা (ﷺ) উটের ওপর আরোহন করে অন্ধকার রাত্রে সফর করছিলেন এবং তাঁর চোখে তন্দ্রারভাব এসেছিল। এমতাবস্থায় তিনি নিদ্রার জন্য ঘুমাতে গেলে সামনে একটি কুল বৃক্ষ এসে দ্বিখন্ডিত হয়ে তাঁর দু’পাশের্ব দু’ভাগ হয়ে তাকে পরিবেষ্টন করে নিল। তিনি কোন অসুবিধা ছাড়া অত্যন্ত নিরাপদে মাঝখানে ঢুকে ঘুমাচ্ছিলেন এবং সে অবস্থা ঘুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছিল। তাই উক্ত গাছটি 'সিদরাতুন নবী’ নামে প্রসিদ্ধ হয়।
62. ইসলামী মা‘লুমাত কা মাখযন, পৃষ্ঠা-৪০২।
❏ প্রশ্ন-৪৬ঃ ‘বাহ্যিক দৃষ্টিতে হযরত আদম (عليه السلام) সৈয়্যদুনা মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সম্মানিত পিতা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ হযরত আদম (عليه السلام)-এর পিতা।’ উক্ত বাণীর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মর্মার্থ কি? দলিলসহ বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ ‘সীরাতে মোস্তফা (ﷺ) ’-এর দ্বিতীয় খন্ডের ২৬৫ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, হুযূর (ﷺ) হজ্বের সময় ঐতিহাসিক মহান খুৎবা প্রদানকালে ইরশাদ করেন, যার একাংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে যেমন, ইমাম বায়হাকী (رحمه الله تعالي ) হযরত জাবের (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণনা করেন যে, হুযূর (ﷺ) হজ্বের ১২ জ্বিলহজ্বের খুৎবায় ইরশাদ করেন,
يَا ايها النّاسُ ان ربكم واحدٌ وَان اباكم واحد .
হে লোকসকল! তোমাদের প্রভু এক এবং তোমাদের পিতা এক অর্থাৎ হযরত আদম (عليه السلام)। উক্ত সময় তিনি তাঁকে নিজের পিতা সম্বোধন করেন নি। অথচ প্রকাশ্য জগতে নিশ্চয়ই তিনি হুযূর (ﷺ) এর পিতা। যদিও আত্মিক জগতে হুযূর আক্বদাস (ﷺ) হযরত আদম (عليه السلام) ও সমগ্র সৃষ্টিকুলের পিতা।
ইমাম ইবনুলহাজ্ব মক্কী (رحمه الله تعالي ) রচিত ‘মাদখাল’ কিতাবে বর্ণিত আছে যে, সৈয়্যদুনা আদম (عليه السلام) যখন হুজুর আক্বদাস (ﷺ)কে স্মরণ করতেন তখন এভাবে বলতেন, يا ابنى صورةً وابي معنًى ‘বাহ্যিক দৃষ্টিতে হে আমার সন্তান এবং আত্মিক দিক দিয়ে হে আমার পিতা’।
63. ফতওয়া আফ্রিকা, পৃষ্ঠা-২১ঃ২৩।
অনুরূপ আরেকটি খুৎবায় বর্ণিত আছে, যা হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযূর (ﷺ) আইয়ামে তাশরীকের মধ্যে বিদায় হজ্বে খুৎবা দিতে গিয়ে বলেন,
يَا ايها الناس ان ربكم واحدٌ واِنّ اباكم واحد، لافضل لعربى على عجمى ولا لعجمى على عربى، ولا لاحمر على الاسود ولا لاسود على الاحمر الا بالتقوىٰ، ان اكرمكم عند الله اتقاكم، الآهل بلغت قالوٰ بلى يا رسول اللهِ! قال فليبلغ الشاهد الغائب .
‘হে লোকসকল! নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক এক এবং তোমাদের পিতা এক। একথা ভালভাবে শুনে রাখো যে, অনারবীদের ওপর আরববাসীদের কোন ফযিলত নেই এবং আরববাসীদের ওপর অনারবীদের কোন ফযিলত ও শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালো বর্ণের ওপর লাল বর্ণের এবং লাল বর্ণের ওপর কালো বর্ণের কোন ফযিলত ও বুযূর্গী নেই, কিন্তু তাকওয়া বা খোদাভীতির ওপর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট তোমাদের মাঝে সবচেয়ে মর্যাদাবান ওই ব্যক্তি, যিনি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী খোদাভীরু। তোমরা কী শুনতেছ? আমি কী আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ তোমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছি? সাহাবা-ই কিরাম আরয করলেন, হ্যাঁ! আপনি অবশ্যই পৌঁছে দিয়েছেন হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)। অতঃপর ইরশাদ করেন, ‘যারা উপস্থিত আছ তারা অুনপস্থিতদের নিকট পৌঁছে দিবে’। তারপর মানুষের রক্ত, জান-মাল, ইজ্জত-সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাণী পেশ করেন।
64. সীরাতুল মোস্তফা (ﷺ), খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২৬৬।
❏ প্রশ্ন-৪৭ঃ সরকারে দু’আলম (ﷺ)-এর পবিত্র জানাযায় কোন নির্দিষ্ট ইমাম ছিলেন কি না? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ هو المستعان সরকারে দু’আলম (ﷺ)-এর পবিত্র জানাযায় কোন নির্দিষ্ট ইমাম ছিলেন না। তাবকাতে ইবনে সা’দ গ্রন্থে হযরত আমিরুল মু’মিনীন মাওলা আলী শের-ই খোদা (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে,
قال لما وضع رسول الله صلى الله عليه وسلم على السرير قال لايقوم عليه احد هوامامكم حيا وميتًا، فكان يدخل الناس رسلا رسلًا، فيصلون عليه صفًا صفًا ليس لهم امام الخ .
‘হুযূর মোস্তফা (ﷺ) কে গোসল শরীফ দেয়ার পর খাটের ওপর শোয়াইয়ে রাখা হলো। হযরত মাওলা আলী (رضى الله تعالي عنه) বলেন, জানাযায়ে আক্বদাসের কোন ইমাম ছিলেন না।
65. সীরাতুল মোস্তফা (ﷺ), খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৩১০।
সৈয়্যদুনা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) ও হযরত ওমর ফারূক (رضى الله تعالي عنه) সালাম আরয করেছেন। এটাই মূলতঃ স্পষ্ট, যা ইবনে সা’দ (رضى الله تعالي عنه)-এর হাদীস এবং ইমাম বায়হাকী (رحمه الله تعالي ) হযরত মুহাম্মদ ইবরাহীম তাইমী মাদানী (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন,
لمّا كفن رسول الله صلى الله عليه وسلم وضع على سريره دخل ابوبكر وعمر، فقال السلام عليك ايها النبى ورحمة الله وبركاته ومعهما نفر من المهاجرين والانصار .
‘যখন হুজুর আক্বদাস (ﷺ)কে গোসল ও কাফন মুবারক পরিয়ে পবিত্র খাটে রাখলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) ও হযরত ওমর ফারূক (رضى الله تعالي عنه) হাযির হয়ে সালাম পেশ করে বলেন, হে আল্লাহ'র নবী (ﷺ)! আপনার ওপর শান্তি এবং আল্লাহ'র দয়া মেহেরবানী বর্ষিত হোক। তাঁদের সঙ্গে মুহাজির ও আনসারগণের একটি দলও ছিলেন। হযরত জিবরাইল (عليه السلام) ও মিকাইল (عليه السلام) সালাত ও সালাম পেশ করেছেন।
বায্যার, হাকেম, ইবনে সা’দ, বায়হাকী এবং তাবরানীসহ অন্যান্য মুহাদ্দিসীনে কিরাম হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, হুযূর (ﷺ) ইরশাদ করেছেন,
فان اوّل من يصلى علّى جبرائيل ثم ميكائيل ثم اسرافيل ثم ملك الموت مع جنوده .
‘সর্বপ্রথম আমার ওপর সালাত ও সালাম পেশ করবেন হযরত জিবরাইল (عليه السلام), অতঃপর মিকাইল (عليه السلام), অতঃপর ইসরাফিল (عليه السلام), অতঃপর মালাকুল মাউত (عليه السلام) তাঁদের সকল সৈন্যবাহিনী সঙ্গে নিয়ে।
ثم دخلوا علّى فوجًا بعد فوجٍ فصلوا علّى وسلموا تسليمًا .
অতঃপর দলে দলে অন্যান্যরা প্রবেশ করবেন এবং সালাত ও সালাম পেশ করবেন।
উক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, হুযূর স্বয়ং নিজের পবিত্র জানাযার নামায সম্পর্কে এ রকম শিক্ষা দিয়েছেন যে, লোকজন দলে দলে উপস্থিত হয়ে সালাত ও সালাম পেশ করবেন।
হুযূর (ﷺ)-এর ওপর সালাত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, একেক জামাত গিয়ে সালাত ও সালাম পেশ করতেছিলেন। হুযূর(ﷺ)-এর জানাযা প্রচলিত নিয়মে না পড়াও তাঁর অন্যতম বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য। হ্যাঁ! লোকজন এসে শুধুমাত্র দু‘আ (সালাতু সালাম পাঠ) করে করে চলে যাচ্ছিলেন।
66. ফতাওয়া রেজভীয়া, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৪০ঃ৪১; সীরাতুল মোস্তফা (ﷺ), খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৩১৩।
❏ প্রশ্ন-৪৮ঃ হুযূর আক্বদাস (ﷺ)-এর পবিত্র জানাযায় ইমামতি না হওয়ার হিকমত কী ছিল? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ هو المستعان ইমাম আহমদ রেযা (رحمه الله تعالي ) বলেন, লাশ মুবারক রওজা শরীফের দিকে নিয়ে না যাওয়া, যেখানে রূহে আক্বদাস পরম বন্ধুর দিকে ঊর্ধ্বগমন করেছে, বিশেষ নির্দিষ্ট স্থানে দাফন হওয়া, গোসল দেয়ার সময় পবিত্র জামা শরীর মুবারক থেকে আলাদা না করা, সকল সাহাবা-ই কিরাম সাক্ষাৎ লাভের সুবিধার্থে জানাযা মুবারক পৌনে দু’দিন বিলম্ব করা এবং পবিত্র জানাযায় কাহারো ইমামতি প্রযোজ্য না হওয়া, হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব। বিশেষতঃ হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, এ সকল কার্যক্রম হুযূর (ﷺ)-এর অসিয়ত মোতাবেক সংঘটিত হয়েছে।
জানাযার নামায এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের হক্ব। রাসূলে কারীম(ﷺ) ইরশাদ করেন,
حق المسلم على المسلم خمس ঃ ردُّ السلام وعيادة المريض واتباع الجنازة واجابة الدعوة وتشميت العاطس .
এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের পাঁচটি হক্ব রয়েছে।
১. সালামের জবাব দেয়া,
২. রোগীর সেবা করা,
৩. জানাযার অনুসরণ করা,
৪. দাওয়াত কবুল করা এবং
৫. হাঁচির জবাব দেয়া।
অত্র হাদীসখানা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরায়রা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে।
সাধারণ মু’মিন মুসলমানের হক্ব এমন হওয়া সমীচীন যে, উপস্থিত লোকদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক আদায় করলে তা আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু মহান আল্লাহ তা‘আলার হক্বের পর সবচেয়ে বেশী হক্বের অধিকারী হচ্ছেন আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ নিয়ামত দু’জাহানের বাদশাহ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর হক্ব বা অধিকার। যদি উপস্থিত সকলের ওপর আবশ্যিক হয় তা হলে মহান উদ্দেশ্য দ্বারা উপস্থিত প্রত্যেক মুসলমানের সত্তাগতভাবে এ মহান সত্তার সাক্ষাৎ লাভ করা দূরের কথা নয়।
সীরাতে মোস্তফা (ﷺ) দ্বিতীয় খন্ডর ৩১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, রাসূল কারীম (ﷺ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যবান বান্দা ইন্তিকালের পর তাঁর প্রথম পুরস্কার যা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে মিলে, তা হচ্ছে, যে সকল লোক তাঁর জানাযার নামায পড়ে, পরম করুণাময় আল্লাহ তা‘আলা সকলের গুনাহ ক্ষমা ও মাফ করে দেন। তা কোন নবীর কিংবা কোন রাসূলের কিংবা সৈয়্যদুল আন্বিয়া ওয়াল মুরসালীন-এর জানাযা হোক। তাঁর দয়ার পরিমাণ কে বা আছেন তা পরিমাপ করতে পারবেন? এখানে কোন্ ধরনের কিয়াস? এখানে রহমতে ‘আলম (ﷺ)-এর জোর তাগিদ এটাই ছিল যে, এখানে সাধারণ অনুমতি দেয়া হয়েছে।
হুজরা শরীফের জায়গাই বা কতো? আর উপস্থিত লোকের সংখ্যা ৩০,০০০ হাজার। যেমন হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, এখন যদি এমন হুকুম হতো যে, প্রথমবার যারা পড়ার তারা পড়ে নিন। তাহলে হাজার হাজার সাহাবার বঞ্চিত হওয়া এতে অন্যান্য সাহাবাগণ নিশ্চিতরূপে কঠিন বিবাদে লিপ্ত হতেন। যখন একথা জানা হতো যে, অন্যান্য জানাযার ন্যায় এখানেও একবারই অনুমতি মিলবে, তাহলে প্রত্যেকেই এটা কামনা করতো যে, আমিই পড়ব।
অতএব হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর মহাজ্ঞানের জোর তাগাদা হচ্ছে, স্বয়ং নিজের ক্ষেত্রে দলে দলে এসে হাযিরী দেয়ার অসিয়ত করেন। صلى الله عليه دائمًا ابدًا । এ মহান গোপন কথা ও অন্তঃরহস্য পবিত্র জানাযায় ইমামতি না হওয়ারও এক স্বচ্ছ হিকমত রয়েছে, যাতে উপস্থিত সবাই সত্তাগতভাবে কোন মাধ্যম ছাড়াই হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর থেকে ফয়েয ও বরকত দ্বারা সম্মানিত এবং উপকৃত ও মর্যাদাবান হয়।
প্রখ্যাত ইমাম সুহাইলী (رحمه الله تعالي ) এখানে ইমামতি না হওয়ার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
اخبرالله تعالٰى انه وملائكتهُ يصلّون عليه صلّى اللهُ عليهِ وسلّم وامر كل واحدٍ من المؤمنين ان يصلّى عليه فوجب على كل واحد ان يباشر الصلواة عليه فى حياته والصلواة عليه صلّى اللهُ عليه وسلّم بعد موته من هذا القبيل .
‘মহান আল্লাহ সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি এবং তাঁর সকল ফিরিশতা মাহবুবে খোদা (ﷺ)-এর ওপর দরূদ প্রেরণ করেন এবং প্রত্যেক মুসলমানের ওপর হুকুম করেছেন যে, তাঁর (ﷺ) ওপর দরূদ প্রেরণ করার। তাই প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ওয়াজিব যে, মাহবুবে খোদা (ﷺ)-এর ওপর এমনভাবে দরূদ প্রেরণ করবে যে, অন্যের মাধ্যম ছাড়া স্বয়ং নিজের পক্ষ থেকে মাহবুবে খোদা (ﷺ)-এর দরবারে দরূদ প্রেরণ করবে।
صلّى اللهُ عليك يا رسول الله وسلّم عليك يا حبيب الله وعلى اٰلك واصحابك يا نبى الله .
মাহবুবুল্লাহ, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) , নবীয়ুল্লাহ (ﷺ)-এর ওপর বেছাল শরীফের পর সালাত ও সালামও সরাসরি কোন মাধ্যম ছাড়াই একাকী হওয়াই উচিত।
ইমাম শাহ্ আহমদ রেযা (رحمه الله تعالي ) জানাযায়ে আক্বদাসে ইমামতি না হওয়ার আরো একটি কারণের দিকে ইঙ্গিত করতে গিয়ে লিখেছেন যে, ইমাম শামসুল আইম্মা সারখ্সী (رحمه الله تعالي ) তাঁর ‘মাব্সুত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে,
ان ابابكر رضى الله عنه كان مشغولًا بتسوية الامور وتسكين الفتنة فكانوا يصلون عليه قبل حضوره . وكان الحق له لانه هو الخليفة فلمَّا فرغ صلّى عليه ثم لم يصلِّ عليه بعدهُ عليه .
সারকথা হচ্ছে এই যে, সৈয়্যদুনা আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) ফিৎনা-ফ্যাসাদ থেকে শান্তি এবং উম্মতের কর্মকান্ড সমূহ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর পবিত্র হাতে বাইআত গ্রহণ করেনি। মানুষ দলে দলে আসলেন এবং তাঁর পবিত্র জানাযার ওপর নামায পড়লেন। যখন পরিপূর্ণ বা’ইআত হলো, তখন ওলীয়ে শরয়ী বা হযরত সৈয়্যদুনা আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) শরীয়তসম্মত ওলী বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন। তিনি জানাযা-ই মুকাদ্দাসার ওপর জানাযার নামায পড়েন এবং এরপর আর কেউ জানাযা পড়েননি।
ثم لم يصل عليه بعدهُ عليه
ওলী বা অভিভাবকের জানাযার নামায আদায় করার পর, জানাযার নাম পুনরায় পড়ার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাই ইমাম আহমদ রেযা বেরেলভী (رحمه الله تعالي ) জানাযার নামায পুনরুক্তি শরীয়ত সম্মত না হওয়ার সুস্পষ্ট বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
নূরুল ইযাহ গ্রন্থের পাদটীকায় সিরাজ, গুনিয়্যাহ ও ইমদাদ গ্রন্থের হুবহু শব্দ উল্লেখ করে বলেন,
ولايصلِّ على قبره الشريف الى يوم القيمة لبقائه صلّى اللهُ عليه وسلّم كما دفن طريًا بل هو حىّ يرزق ويتنعم سائراللذات والعبادات وكذا سائر الانبياء عليهم الصلواة والسلام ، وقد اجتمعت الامة على تركها .
‘এই জানাযার নামায যদি তাক্রার বা বারবার হতো, তাহলে পবিত্র মাযার শরীফে কিয়ামত পর্যন্ত নামায পড়া হতো। কেননা হুযূর আক্বদাস (ﷺ) সব সময় এভাবেই তরুতাজা ও প্রাণবন্ত আছেন যেমন দাফন মুবারকের সময় ছিলেন বরং তিনি স্বশরীরে জীবিত এবং তাঁকে রিযিক দেয়া হয়। সব ধরনের স্বাদ এবং সকল ইবাদতের মনোমুগ্ধকর নি‘য়ামতসমূহ বিদ্যমান এবং অনুরূপ অন্যান্য নবীগণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অথচ মুসলিম উম্মাহর সকলেই এ নামায না পড়ার ওপর ঐকমত্য পোষণ করেন।
67. সীরাতে মোস্তফা (ﷺ), খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৩১৭; ফতওয়া রেযভীয়া, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৬৬।
❏ প্রশ্ন-৪৯ঃ হুজুর আক্বদাস (ﷺ) পবিত্র অন্তিম রোগ শয্যায় কোন কোন বিষয়ে অসিয়ত করেছিলেন? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ وبالله التوفيق প্রখ্যাত ইমাম ফকীহ মুহাদ্দিস সৈয়্যদুনা ইমাম আবুল লাইছ নসর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম সমরকন্দি হানাফী (رحمه الله تعالي ) ‘তানবীহুল গাফিলীন’ গ্রন্থে বলেছেন যে, যখন সূরা নসর হুযূর সৈয়্যদুল মুরসালীন (ﷺ)-এর বেছাল শরীফের রোগাক্রান্ত অবস্থায় বৃহস্পতিবার অবতীর্ণ হয়, তখন হুযূর (ﷺ) কালবিলম্ব না করে মসজিদে নববীর মিম্বর শরীফে তাশরীফ রাখলেন এবং হযরত বেলাল (رضى الله تعالي عنه)কে নির্দেশ দিলেন যে, মদিনা শরীফে ঘোষণা করে দাও যে, হে মদিনাবাসীগণ! হাবীবে খোদা (ﷺ)-এর শেষ অসিয়ত শুনার জন্য এসো। উক্ত আহ্বান শুনামাত্র ছোট-বড় নারী-পুরুষ সবাই ঘরের দরজা এমনিতেই খোলা রেখে এসে পড়েন এবং কুমারী পর্দানশীন মহিলারাও বেরিয়ে আসেন। এমন কি অধিক সমাগমের কারণে মসজিদে জায়গা সংকুলান না হলে হুযূর (ﷺ) বলতে লাগলেন, তোমরা পিছনে আগতদের জন্য জায়গা উন্মুক্ত করে দাও। তোমরা পিছনে আগতদের জন্য জায়গা বিস্তৃত করে দাও।
والنبى يقول وسعوا وسعوا لمن وراءكم . ثم قال النبى صلى الله عليه وسلّم فحمدالله واثنى عليه .
অতঃপর হুযূর মিম্বর শরীফের ওপর দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহ্ তা‘আলার মুহাব্বতে কাঁদেন এবং আল্লাহ্ সমীপে প্রত্যাবর্তিত হওয়ার কথা স্মরণ করে মহান আল্লাহ্ তা‘আলার হামদ-ছানা আদায় করেন এবং পূর্ববর্তী সকল আন্বিয়া আলাইহিমুস সালামের ওপর সালাত ও সালাম প্রেরণ করেন।
অতঃপর ইরশাদ করেন,
انّا محمد بن عبدالله بن عبد المطلب بن هاشم العربى الحرمى المكى لانبىّ بعدى .
‘আমি মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মত্তালিব ইবনে হাশিম আরবী মক্কা মুয়ায্যামার সম্মানিত হেরেমের মোতাওয়াল্লি, আমার পরে আর কোন নবী আসবেন না।’
দেখুন! মহান মর্যাদাশীল ও চিরস্থায়ী ক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহ'র শান ও মর্যাদা। এমন একদিন ছিল যে, মদিনা মুনাওয়ারায় হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর শুভাগমনের খুশি ও আনন্দের ধূমধাম উৎসবের ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে আকাশ ও পৃথিবী গর্জে উঠেছিল। তাঁদের চেহারা আনন্দ উৎফুলতায় আনারের দানার ন্যায় ঝলমল করছিল। আরশ থেকে পরশ পর্যন্ত নূরের পূণ্য ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। পর্দানশীন কুমারী মহিলারা আল্লাহর মাহবুব (ﷺ)-এর দর্শন লাভের অধির আগ্রহ ও উৎসাহ-উদ্দীপনার গান গাইতে গাইতে রাস্তায় বের হয়ে এসেছিল।
طلع البدر علينَا ٭ من ثنيات الوداع
وجب الشكر علينَا ٭ ما دعىٰ للهِ داع
‘সানইয়াতুল বিদা’ হতে আমাদের ওপর পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে থাকবে আমাদের ওপর ওয়াজিব তাঁর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করা।’ (অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত)
বনু নাজ্জার গোত্রের ছোট ছোট মেয়েরা মদিনার অলি-গলিতে আনন্দ সংগীত পরিবেশনে নিমগ্ন ছিলেন।
نحن جوار من بنى النجار ٭ يا حبذًا محمد من جار
‘আমরা বনু নাজ্জার গোত্রের প্রতিবেশীরা কতই না ভাগ্যবান, মুহাম্মদ হলেন আমাদের প্রতিবেশী।’
শাফায়াতের বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-৫০ঃ শাফা‘আত ও শাফা‘আতে কুবরা কী? তা কখন এবং কিভাবে হবে?
❏ প্রশ্ন-৫১ঃ কিয়ামত দিবসে নবী করীম (ﷺ)’র সুপারিশ কত প্রকারের হবে?
❏ প্রশ্ন-৫২ঃ পবিত্র কুরআনের যে কয়টি আয়াতে শাফা‘আত বা সুপারিশের কথা উল্লেখ রয়েছে। সে আয়াতগুলো কি কি?
কা’বা নির্মাণের বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-৫৩ঃ কা’বা ঘর কখন স্থাপিত হয়? এটির নির্মাণ কবে থেকে শুরু হয়েছে?
❏ প্রশ্ন-৫৪ঃ কখন কোন সময় থেকে কা’বায় গিলাফ লাগানো শুরু হয়? এই রীতিটি কে চালু করেন?
❏ প্রশ্ন-৫৫ঃ কা’বা শরীফের ভিত্তি যা ইবরাহীম (عليه السلام) করেছিলেন এবং বর্তমান ভিত্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কিনা?
গোসল,অযু ও তায়াম্মুমের বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-৫৬ঃ অযু কি দাঁড়িয়ে করা উচিত, না বসে করা? এ-দু’টির কোনটি উত্তম?
❏ প্রশ্ন-৫৭ঃ শীতকালে অযু করলেও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো শুকিয়ে যায় এই পরিস্থিতে কী করণীয়?
❏ প্রশ্ন-৫৮ঃ গরম পানি দ্বারা অযু করা কি জায়েয? এ-বিষয়ে শরয়ী হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-৫৯ঃ বিড়ি, সিগারেট ও হুক্কা পানে কি অযু নষ্ট হয়ে যায়?
❏ প্রশ্ন-৬০ঃ লবনের ওপর তায়াম্মুমের শরয়ী বিধান কি?
❏ প্রশ্ন-৬১ঃ ইসলামী শরীয়তে গোসল কত প্রকার ও কী কী?
❏ প্রশ্ন-৬২ঃ তায়াম্মুমের সময় দাড়ি খিলাল করার বিধান কী?
❏ প্রশ্ন-৬৩ঃ অযুতে ব্যবহৃত কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জখমপ্রাপ্ত হলে, সে ব্যক্তি যদি অযুর সময় ক্ষত স্থানের ব্যান্ডেজের মাসেহ করে, তাহলে এমন ব্যক্তির ইকতেদা করে জামাত পড়া কি জায়েয হবে?
নামাযের বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-৬৪ঃ ফরয নামাযে একই সূরা তাক্রার বা পুনরুক্তি করা যেমন- ফজরের ফরয নামাযের উভয় রাকাআতে সূরা ইখলাস পাঠ করা জায়েয আছে কি না ?
❏ প্রশ্ন-৬৫ঃ পায়খানা ও প্রস্রাবের বেগ অধিক হওয়া সত্ত্বেও তা চেপে রেখে নামায আদায় করার হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-৬৬ঃ চোখ বন্ধ করে নামায পড়া কী? কিছু লোক চোখ বন্ধ করে নামায আদায় করে, এটা জায়েয কি না?
❏ প্রশ্ন-৬৭ঃ শীতকালে লোকজন চাদর কিংবা রুমাল দ্বারা মুখ ঢেকে রাখা অবস্থায় নামায আদায় করে থাকে- এর হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-৬৮ঃ সিজদায় যাওয়ার সময় পায়জামা উপরের দিকে উঠানোর হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-৬৯ঃ ইমামের পূর্বে সালাম বলার হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-৭০ঃ একই রাকাআতে একাধিক সূরা পাঠ করা জায়েয কি না?
❏ প্রশ্ন-৭১ঃ ইমাম সাহেব নামায কখন আরম্ভ করবেন?
❏ প্রশ্ন-৭২ঃ নামাযী বা মুসল্লিকে সালাম ফিরানোর সময় কী করা উচিত?
❏ প্রশ্ন-৭৩ঃ নামাযে ছানার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া হয় না কেন? এটা রাসূল (ﷺ)-এর হাদীস
كل امر ذى بال لم يبداء ببسم الله الخ- এর বিপরীত আমল নয় কি?
❏ প্রশ্ন-৭৪ঃ এশার নামায বিলম্বে আদায় করার হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-৭৫ঃ মহিলাদের স্বতন্ত্র ও এককভাবে জামাতে নামায পড়ার হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-৭৬ঃ নামাযীর সামনে দিয়ে মহিলা চলে গেলে নামায ফাসেদ বা ভঙ্গ হবে কি না?
❏ প্রশ্ন-৭৭ঃ ইমাম নামাজ আদায়ের জন্য নির্ধারিত স্থানে দাঁড়ালে মুক্তাদিগণ যদি তাঁর কর্মকান্ড ও অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজানা থাকে তবে এর হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-৭৮ঃ নামাযে নবীকুল সরদার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কল্পনা ও ধ্যান আসলে কি নামায ভঙ্গ কিংবা এর কোন ক্ষতি হবে?
❏ প্রশ্ন-৭৯ঃ পাগড়িবিহীন ইমামের পেছনে নামায পড়া জায়েয কি না?
❏ প্রশ্ন-৮০ঃ নামাযে হাই আসলে কি করা উচিৎ?
❏ প্রশ্ন-৮১ঃ ফরয নামায শেষে ইমাম সাহেব তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাবেন, না কিছুক্ষণ পর দাঁড়াবেন?
❏ প্রশ্ন-৮২ঃ ফরয নামায শেষে ডান হাত মাথার ওপর রেখে কোনো বিশেষ দু‘আ ইত্যাদি পাঠ করার শরয়ী হুকুম কি?
❏ প্রশ্ন-৮৩ঃ রমযান মুবারক ছাড়া বিতির নামায জামাতে পড়ার হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-৮৪ঃ পাগড়ি ছাড়া ইমাম শুধু টুপি পরে নামায পড়া এবং পড়ানো কি জায়েয? এতে নামাযের সওয়াবে তারতম্য বা কম-বেশি হবে কিনা?
❏ প্রশ্ন-৮৫ঃ হুযূর মোস্তফা (ﷺ) অসুস্থাবস্থায় হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه)-এর পিছনে নামায আদায় করেছিলেন। তখন তাঁর মাথায় পবিত্র পাগড়ি ছিল না কি টুপি?
❏ প্রশ্ন-৮৬ঃ মু’মিনের জন্য নামায মি‘রাজ হওয়া কি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত?
❏ প্রশ্ন-৮৭ঃ এশার নামাযের সঠিক সময় দলিলসহ বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-৮৮ঃ মাগরিবের নামায তাড়াতাড়ি পড়ার ফযিলত দেখে কিছু সংখ্যক লোক প্রবঞ্চনার স্বীকার হয় যে, মাগরিবের নামাযের সময় অতীব সংক্ষিপ্ত! সাধারণত মাগরিবের নামাজের সময়সীমা কতটুকু হওয়া উচিত?
❏ প্রশ্ন-৮৯ঃ ইস্তিসকার নামায ছাড়া অন্য কোন শরয়ী পদ্ধতি অনুমোদন আছে কিনা?
❏ প্রশ্ন-৯০ঃ মাগরিবের নামাযে দীর্ঘ সূরা পাঠ করার বিধান কী?
❏ প্রশ্ন-৯১ঃ কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ব্যভিচারের অপবাদ দিলে অভিযুক্ত ব্যক্তির পিছনে ইকতিদা করা জায়েয হবে কি না?
❏ প্রশ্ন-৯২ঃ নামাযে আরবী ছাড়া অন্যান্য ভাষায় দু‘আ করার বিধান কী?
❏ প্রশ্ন-৯৩ঃ জামার আস্তিন বা হাতা কনুইর উপরে উঠিয়ে নামায পড়ার হুকুম কী? এতে নামায মাকরূহ হবে কি না?
❏ প্রশ্ন-৯৪ঃ হজ্ব মৌসুমে আরাফাতের ময়দানে হানাফী মাযহাবের অনুসারী হাজীদের, মুকীম বা স্থায়ী বাসিন্দা ইমামের পিছনে নামায পড়া জায়েয হবে কি না?
❏ প্রশ্ন-৯৫ঃ ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে সাউদি আরবে পনের দিনের ভিসা নিয়ে যারা পবিত্র মক্কা ও মদিনা মুনাওয়ারা গমন করেন, তারা নামায পুরো পড়বেন না কসর পড়বেন?
❏ প্রশ্ন-৯৬ঃ মুসাফির ভুলক্রমে দু’রাকাতের পরিবর্তে চার রাকাতের নিয়ত করলে, এ ক্ষেত্রে তার করণীয় কি? সে নিয়ত অনুযায়ী চার রাকাত আদায় করবে, না দু’রাকাত?
❏ প্রশ্ন-৯৭ঃ মুসাফির ইচ্ছাকৃতভাবে পুরা চার রাকাত পড়লে তার নামাযের হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-৯৮ঃ দু’জন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি দুই শহরে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বাস করে, একজন অপরজনের নিকট গেলে তারা উভয়ই কী নামায কসর পড়বে?
তারাবীহ নামাযের বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-৯৯ঃ হুযূর সৈয়্যদুল মুরসালীন (ﷺ) তারাবীহ কত রাকাত পড়েছেন?
জানাযার বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১০০ঃ কবরের নিকট দু‘আ করার সময় কবরকে সামনে নিয়ে দু‘আ করা উত্তম, না কিবলামুখী হয়ে?
❏ প্রশ্ন-১০১ঃ মাইয়্যেত বা মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর দাঁড়িয়ে দু‘আ করা উচিত কি না?
❏ প্রশ্ন-১০২ঃ মসজিদে ইতিকাফকারী জানাযার জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবে কিনা?
❏ প্রশ্ন-১০৩ঃ দ্বিতীয়বার জানাযার নামায পড়ার বিধান কি?
❏ প্রশ্ন-১০৪ঃ দাঁড়ানোর সময় নিয়ত করতে ভুলে গেলে, এরকম জানাযার নামায পড়ার হুকুম কি?
❏ প্রশ্ন-১০৫ঃ সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত এবং দ্বিপ্রহরের সময় জানাযার নামায ও তিলাওয়াতে সিজদা করা জায়েয আছে কিনা?
❏ প্রশ্ন-১০৬ঃ জারজ সন্তান বা অবৈধ পন্থায় জন্মগ্রহণ করেছে এমন সন্তান মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযার হুকুম কি?
❏ প্রশ্ন-১০৭ঃ জানাযার নামায পড়ানোর সবচেয়ে অধিক হকদার কে?
❏ প্রশ্ন-১০৮ঃ নিয়তবিহীন জানাযা নামাযের কোন গ্রহণযোগ্যতা আছে কি-না?
কাফন ও দাফনের বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১০৯ঃ কোরআন শরীফের আয়াত সম্বলিত কা’বা শরীফের গিলাফের টুকরো কিংবা কালিমা খচিত কাপড় অথবা অন্য কোন বরকতময় কাপড় কাফনের সাথে তাবার্রুক হিসেবে দেয়া যাবে কি না?
❏ প্রশ্ন-১১০ঃ মাইয়্যেতের ওপর সওয়াবের উদ্দেশ্যে যদি অতিরিক্ত কাপড় দেয়া হয়, এতে কি সওয়াব পাওয়া যাবে?
❏ প্রশ্ন-১১১ঃ কাফনের ওপর কালিমা-ই তাইয়্যেবা কিংবা কোরআন শরীফের আয়াত কালির কলম দ্বারা লিখে দেয়া জায়েয আছে কি না?
❏ প্রশ্ন-১১২ঃ মানুষ মারা গেলে কি মাটি ও পাথর হয়ে যায়?
পাগড়ির বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১১৩ঃ শরীয়তে পাগড়ির হুকুম কি?
❏ প্রশ্ন-১১৪ঃ শুধু পাগড়ির ওপর মাসেহ করা জায়েয কি না?
শাফায়াতের বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-৫০ঃ শাফা‘আত ও শাফা‘আতে কুবরা কী? তা কখন এবং কিভাবে হবে?
✍ উত্তরঃ সহীহ বুখারীসহ অন্যান্য হাদিসগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত আছে, কিয়ামত দিবসে যখন সময় খুবই দীর্ঘ হবে এবং তাপ প্রচন্ড গরম হবে এবং ইত্যাদি বিভিন্ন মুসিবত ও কষ্ট-যন্ত্রণায় মানুষ অতিষ্ট হবে, ভীতসন্ত্রস্ত হবে; ঠিক তখনই তারা পরস্পর পরামর্শ করবে। পরামর্শের বিষয় হলো, এমন কাকে সুপারিশপ্রদানকারী রূপে মহান আল্লাহর দরবারে পাঠানো যেতে পারে, যিনি সবার নাজাতের জন্য সুপারিশ করবেন, যেমন- হাদীস সমূহ দ্বারা প্রমাণিত।
অতএব, মানব সকল হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (عليه السلام) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলগণের নিকট যাবে। তারা প্রত্যেক নবীকে (ﷺ) সুপারিশের জন্য নিবেদন করবে। কিন্তু সকলই এই উত্তর দিবেনঃ ‘এটি আমার পদমর্যাদা নয়’। শেষতক হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর ইঙ্গিতে তারা আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)’র নিকট আসবে। এরপর তাঁকে সুপারিশের জন্য আবেদন করবে। নবীজি (ﷺ) উত্তর দিবেন, আমিই তো এ-কাজের জন্য উপযুক্ত। সে-সময় নবী করীম (ﷺ) আল্লাহর দরবারে সিজদাবনত হয়ে মহান রবের অভিনব ও সুউচ্চ প্রশংসা করবেন। পরক্ষণে আল্লাহ পাকের হুকুম হবে,
يَا مُحَمَّدُ إرْفَعْ رَأسَكَ سَلْ تُعْط وَاِشْفَعْ تُشْفَعْ
হে মুহাম্মদ! উঠুন! যা ইচ্ছে আপনি চান, সবই দেয়া হবে। সুপারিশ করুন, আপনার সকল সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। এরপর নবী করীম (ﷺ) সিজদা থেকে উঠে বলবেন, হে রব! আমার উম্মতের ওপর রহম করুন।এ শাফা‘আতের নাম হলো শাফা‘আতে কুবরা বা সর্বোত্তম সুপারিশ।
❏ প্রশ্ন-৫১ঃ কিয়ামত দিবসে নবী করীম (ﷺ)’র সুপারিশ কত প্রকারের হবে?
✍ উত্তরঃ আল্লাহর সাহায্য ও তাঁর তাওফীকের ওপর ভরসা করে উত্তর প্রদান করছি। মোস্তফা(ﷺ) র সুপারিশ ১২ প্রকারের হবেঃ-
১.শাফা‘আতে কুবরাঃ ইতিপূর্বে এর আলোচনা করা হয়েছে।
২.شفاعة ادخال فى الجنة بلاحساب‘হিসেব-নিকেশ ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করানোর জন্য সুপারিশ।’ এটিও নবী করীম -এর বৈশিষ্ট্য।
৩.হিসেব-নিকেশের পর জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের জন্য সুপারিশ।
৪.পদমর্যাদা উন্নতির ক্ষেত্রে জান্নাতবাসীদের জন্য সুপারিশ।
৫.কিছু সংখ্যক কাফির ও অমুসলিমদের আযাব হ্রাস করার জন্য সুপারিশ। অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও যারা নবীজিকে সহযোগিতা করতো এবং তাঁকে ভালোবাসতো তাদের জন্য এই সুপারিশ যেমন, আবু তালেব প্রমুখ।
৬.আমলসমূহ পরিমাপের সময় উম্মতের জন্য সুপারিশ।
৭.হিসেব গ্রহণে শিথিলতা প্রদর্শনের জন্য একটি দলের পক্ষে সুপারিশ।
৮.স্খলন ও ইবাদত-অনুগত্যে দুর্বলতা ও ত্রুটি ক্ষমা করার জন্য সুপারিশ।
৯.আ’রাফবাসীদের জন্য সুপারিশ।
১০.মুশরিক ও অমুসলিমদের শিশুদের জন্য সুপারিশ।
১১.আহলে বায়ত বা নবী-পরিবারের জন্য সুপারিশ।
১২.মক্কা, মদিনা এবং তায়েফবাসীদের জন্য সুপারিশ।
উল্লেখ্য, ইমাম ইবনে হাজর আস্কালানী (رحمه الله تعالي ) রওযা পাক যিয়ারতকারী, আযানের উত্তরদাতা এবং নবী -এর জন্য ওয়াসিলা ও সবোর্চ্চ মর্যাদার দো‘আ পাঠকারীর জন্য সুপারিশকে পঞ্চম ভাগে অন্তরÍভূক্ত করেছেন।
আরেকটি শাফাআত বা সুপারিশ হলো তুফাইলী শাফা‘আত বা মাধ্যম দ্বারা সুপারিশ। এটি আবার কয়েক রকমের হয়ে থাকে। এই ধরনের সুপারিশে অনেকেই নবী, ওলি, আলিম-ওলামা এবং পূণ্যাত্মা মনীষীদেরও শামিল করেছেন। এসব তুফাইলী শাফা‘আত মোস্তফা (ﷺ) -এর মাধ্যমে হবে।
হযরত শাহ আবদুল আযিয দেহলভী (رحمه الله تعالي ) স্বীয় তাফসীরগ্রন্থে বলেন, তিয়াত্তোর দল তাদের গুনাহের মাত্রা অনুসারে আযাব পাবে। এমনকি নবীগণ, ওলিগণ, আলিম-ওলামা, শহীদগণ ও ফেরেশতাদের সুপারিশে আযাব থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে। এসব হচ্ছে তুফাইলি শাফা‘আত বা মাধ্যম দ্বারা সুপারিশ। হাশরের মাঠে হিসেব দ্রুত সম্পন্ন করতে সুপারিশ করা হবে।
হাদিস শরীফে এসেছে, কেয়ামতের দিন সুরা বাকারা ও আলে-ইমরান সূরা দু’টি মেঘ বা কালো ছায়ার আকৃতিতে আসবে। তাতে একটি আলো চমকাতে থাকবে, তা উজ্জ্বল ও আলোকিত হবে অথবা সূরা দু’টি পাখির মত দল বেঁধে সারিবদ্ধ হয়ে আসবে। এরপর এই দুই সূরা পাঠকারীর পক্ষে সুপারিশ করবে। এভাবে তাদের বেহেশত পর্যন্ত পৌঁছানোর পরই সূরা দু’টি ক্ষান্ত হবে।
ইবনে মরদুওয়াইয়াহ, ইস্পাহানী এবং দায়লামীর বরাতে হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন, ফেরেশতারা কা’বা ঘরকে নব-বধুর মত সজ্জিত করে হাশর-মাঠে আনবে। পথে তারা যখন আমার রওযা অতিক্রম করবে, তখন কা’বা ঘর স্পষ্ট ভাষায় বলবে, اَلسَّلَامُ عَلَيْكَ يَا مُحَمَّد صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ হে মুহাম্মদ ! সালাম নিন। আমি উত্তরে বলব, وَعَلَيْكَ السَّلَام
يَا بَيْتُ اللهِ হে বায়তুল্লাহ! তোমার ওপরও শান্তি বর্ষিত হোক। বলো তো আমার উম্মত তোমার সাথে কেমন আচরণ করেছে? আর তুমি আল্লাহর সামনে তাদের নিয়ে কী আচরণ করবে? কা’বা ঘর উত্তর দিবে, হে নবীকুল শিরোমণি! আপনার উম্মতের মধ্যে যেই আমার যেয়ারত করতে এসেছে, আমি তার জন্য যথেষ্ট সুপারিশ করব। আপনি তাদের ব্যাপারে আমার পক্ষ থেকে নিশ্চিন্ত থাকুন। এ-ব্যাপারে আমার ওপর আস্থা রাখুন। আর যারা আমার কাছে আসেনি, তাদের জন্য আপনিই সুপারিশ করবেন।
❏ প্রশ্ন-৫২ঃ পবিত্র কুরআনের যে কয়টি আয়াতে শাফা‘আত বা সুপারিশের কথা উল্লেখ রয়েছে। সে আয়াতগুলো কি কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ
১- لَا يَمْلِكُونَ الشَّفَاعَةَ إِلَّا مَنِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمٰنِ عَهْدًا .
‘যে দয়াময় আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে, সে ব্যতীত আর কেউ সুপারিশ করার অধিকারী হবে না।’
68. সূরা মরয়ম, আল কোরআন, আয়াতঃ ৮৭।
২- يَوْمَئِذٍ لَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمٰنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلًا.
‘দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন সে ছাড়া কারও সুপারিশ সেদিন কোন উপকারে আসবে না।’
69. আল কোরআন, সূরা ত্বা-হা, আয়াতঃ ১০৯।
-وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ حَتَّى إِذَا فُزِّعَ عَنْ قُلُوبِهِمْ-৩ قَالُوا مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ قَالُوا الْحَقَّ .
‘যার জন্যে অনুমতি দেয়া হয়, তার জন্যে ব্যতীত আল্লাহর কাছে কারও সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না। যখন তাদের মন থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাবে, তখন তারা পরস্পরে বলবে, তোমাদের পালনকর্তা কি বললেন? তারা বলবে, তিনি সত্য বলেছেন এবং তিনিই সবার উপরে মহান।’
70. আল কোরআন, সূরা সাবা, আয়াতঃ ২৩।
قُلْ لِلهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيْعًا لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ-৪
‘তাদেরকে বলুন, সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই ক্ষমতাধীন, আসমান ও যমীনে তাঁরই সাম্রাজ্য। অতঃপর তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’
71. আল কোরআন, সূরা যুমার, আয়াতঃ ৪৪।
يَوْمَ يَقُوْمُ الرُّوْحُ وَالْمَلَائِكَةُ صَفًّا لَا يَتَكَلَّمُوْنَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمٰنُ৫ وَقَالَ صَوَابًا .
‘যেদিন রূহ (জিবরাঈল) ও ফেরেশতাগণ তাঁর সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন, সে ব্যতীত কেউ কথা বলতে পারবে না এবং সে সত্যকথা বলবে।’
72. আল কোরআন, সূরা নাবা, আয়াতঃ ৩৮।
আরবের মুশরিকদের বিশ্বাস ছিল, ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা-সন্তান (নাউযুবিল্লাহ)। কিয়ামত দিবসে তারা সুপারিশ করবে। এখানে তাদের সে-বক্তব্যটি খন্ডন করা হয়েছে। প্রথমত আল্লাহর অনুমতি বিনে মুখ খোলারও সাহস করবে না কেউ। দ্বিতীয়ত অনুমতি পেলেও সুপারিশ যুক্তিসঙ্গত হতে হবে। অর্থাৎ- শুধু একত্ববাদে বিশ্বাসী এবং প্রকৃত সুপারিশের হকদারদের জন্য সুপারিশ করতে পারবে। হযরত আবু হুরায়রা (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ ফরমান, কিয়ামত দিবসে আমার সুপারিশ পাওয়ার জন্য সবার্পেক্ষা উপযুক্ত ব্যক্তি হলো যে একনিষ্ঠভাবে অন্তর থেকে বলেছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।
73. সহীহ বুখারী।
হযরত ইমরান বিন হুসাইন (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত অপর এক রেওয়াতে আছে, মুখতারে কুল নবী করীম (ﷺ) এর সুপারিশের সুবাদে একটি দলকে জাহান্নাম থেকে নিস্তার দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। তাদেরকে জাহান্নামী বলা হবে।
74. সহীহ বুখারী শরীফ।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে এমন লোকও থাকবে যে একটি বিশাল দলের পক্ষে সুপারিশ করবে। এদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও হবে যে শুধু একজন ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর জন্য সুপারিশ করবে, ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
75. জামে‘ তিরমিযী শরীফ।
হযরত উসমান বিন আফ্ফান (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হাবীবে কিবরিয়া নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন, কিয়ামত দিবসে তিন প্রকারের মানুষ সুপারিশ করবেঃ
এক. নবীগণ,
দুই. আলেমগণ এবং
তিন. শহীদান।
76. মিশকাত শরীফ।
কবিরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির পক্ষে নবীগণ এবং পূণ্যবান ব্যক্তিদের সুপারিশের কথা কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। অবশ্য মু’তাজিলা নামক দলটি এর বিরোধিতা করে। তাদের ভাষ্য হলো, সুপারিশে কোন লাভ হবে না। মতানৈক্যের মূল ভিত্তি হলো অপর একটি বিষয়ের ওপর, তা হলো- আমাদের মতে সুপারিশ ব্যতীত ক্ষমা সম্ভব। সুতরাং, সুপারিশ থাকলে তো আরও ভালো।
পক্ষান্তরে মু’তাজিলা দলের মতে কবিরা গোনাহ ক্ষমাযোগ্য নয়। সুতরাং, সুপারিশেও কোন কাজ হবে না। এ-প্রসঙ্গে আমাদের প্রমাণ কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি প্রণিধানযোগ্য।
এরশাদ হচ্ছে,
وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَا
হে মুহাম্মদ ! আপনি ক্ষমাপ্রার্থনা করুন নিজের ত্রুটির জন্যে এবং মু’মিন পুরুষ ও নারীদের জন্যে।
77. আল কোরআন, সূরা মুহাম্মদ, আয়াতঃ ১৯।
এ-থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের পক্ষে নবীজির ক্ষমাপ্রার্থনা লাভজনক ও ফলপ্রসু।
অন্য আয়াতে এরশাদ হচ্ছে,
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِيْنَ.
‘সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন উপকারে আসবে না।’
78. আল কোরআন, সূরা মুদ্দাসির, আয়াতঃ ৪৮।
এই আয়াতে কাফিরদের দুর্দশা ও দুর্ভাগ্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না। বাক্য ভঙ্গি থেকে সাধারণত সুপারিশ যে কাজে আসবে তা প্রমাণিত হচ্ছে। অর্থাৎ- সুপারিশ অনেকের কাজে আসবে। অবশ্যই এ-দ্বারা কাফিরদের কোন লাভ হবে না। যদি তা না হত, তাহলে কাফিরদের সুপারিশ কাজে না আসার বিষয়টির উল্লেখ দ্বারা বিশেষ কোন ফায়দা হতো না। কারণ এখানে তাদের বিশেষ একটি ব্যর্থতার বর্ণনাই উদ্দেশ্য। সবাই যে ব্যর্থতায় শরীক তা বর্ণনা উদ্দেশ্য নয়।
পবিত্র হাদিসে একথাও এসেছে,
شَفَاعَتِىْ لِاَهْلِ الْكَبَائِرِ مِن اُمَّتِىْ
নবী করীম (ﷺ) বলেন, ‘আমার উম্মতের কবীরা গোনাহকারীদের জন্যে আমার সুপারিশ আম থাকবে’।
যেহেতু মূল শাফা‘আত ও ক্ষমার কথা কোরআন-হাদিস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত, তা অস্বীকার করা অসম্ভব। এ কারণে মু’তাজিলা দলও মূল ক্ষমার কথা স্বীকার করে। তাদের ভাষ্য হলো ছোট গুনাহের ক্ষমা হবে শুধু। অবশ্য ঐ-সব বড় গোনাহও ক্ষমা করা হবে যার জন্য তাওবা করা হয়েছে। সুপারিশের মাধ্যমে কেবল পূণ্য বৃদ্ধি হতে পারে, গোনাহ ক্ষমা হয় না।
সূফীয়া-ই কিরামের আক্বীদা হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীগণ, অলিগণ ও নেককার ব্যক্তিগণকে যে-কোন সময় কোন নির্দিষ্ট দল কিংবা ব্যক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করার অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওয়াহাবী-আহলে হাদিসের মত হলো, কিয়ামতের পূর্বে সুপারিশ হতেই পারে না। আর কিয়ামত দিবসেও আল্লাহর অনুমতি বিনে কোন সুপারিশ হবে না।
হাদিস শরীফে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) বলেন,
انا سيد ولد آدم ولافخرو اول من تنشق الارض عنه يوم القيامة ولا فخر وانا اوّل شافع واول مشفع ولا فخر ولواء الحمد بيدى-.
‘আমি আদম-সন্তানদের সরদার, এটা অহংকার নয়। কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম আমিই ভূ-গর্ভ (কবর) থেকে উঠব, এটা অহংকার নয়। সর্বপ্রথম আমিই সুপারিশ করব এবং আমার সুপারিশই সর্বপ্রথম গ্রহণ করা হবে, এটা অহংকার নয়। আমার হাতে লিওয়াউল হামদ বা আল্লাহ'র প্রশংসা মুখর পতাকা থাকবে।’
এটাও হাদীস শরীফে আছে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আমাকে অর্ধেক উম্মতের গোনাহ ক্ষমা করিয়ে নিতে কিংবা সুপারিশের ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে। আমি সুপারিশ করার বিষয়টি গ্রহণ করেছি।
কোরআন মজিদে যে ‘মাকামে মাহমুদ’ বা প্রশংসিত স্থানের অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, মুফাস্সিরদের সর্বসম্মতিক্রমে তা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সুপারিশের স্থান। নবী করীম (ﷺ) নিজ উম্মতের জন্য সুপারিশ করবেন- এ-বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অণু পরিমাণ ঈমান যার অন্তরে থাকবে, তিনি তাকেও ক্ষমা করিয়ে নিবেন।
79. ইসলামী মালুমাত কা মাখযান, খন্ড-১, পৃষ্ঠা- ৪২২।
اللهم ارزقنا شفاعَة حبيبكَ المصطفىٰ صَلّى اللهُ عَليهِ وسلَّم بِمَنِّكَ وَكَرَمِكَ وَفَضْلِكَ وَجُوْدِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ .
আল্লাহ সর্বজ্ঞানী। হে দয়াময় আল্লাহ! আমাদেরকে আপনি দয়া, অনুগ্রহ ও দানের মাধ্যমে আপনার প্রিয়তম রাসূল (ﷺ)-এর সুপারিশ ।
কা’বা নির্মাণের বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-৫৩ঃ কা’বা ঘর কখন স্থাপিত হয়? এটির নির্মাণ কবে থেকে শুরু হয়েছে?
✍ উত্তরঃ হজ্ব ও ওমরায় যে ঘরটির চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করা হয় সেটিই কা’বা ঘর। এটি সেই পবিত্র গৃহ, মুসলমানরা প্রতি বছর, প্রতি মাস, প্রতিক্ষণে যার প্রদক্ষিণ করে। ফেরেশতারাও অবতীর্ণ হয়ে যার তাওয়াফ করে থাকে।
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে এ-পর্যন্ত দশবারের মত কা’বা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
১. সর্বপ্রথম আল্লাহর আদেশে ফেরেশতারা কা‘বা ঘর নির্মাণ করেছিল।
২. এরপর নিমার্ণ করেন হযরত আদম আলাইহিস সালাম পাঁচটি পাহাড়ের পাথরের সাহায্যে। পাহাড় পাঁচটি হলো, লেবানন পাহাড়, সীনার তুর পাহাড়, যাইতার তুর পাহাড়, জুদি পাহাড় এবং খোরাসান পাহাড়। পাঁচ পর্বতসমূহের পাথর দ্বারা নির্মাণ করা হয়। কিন্তু হেরা পর্বতের পাথর দ্বারা এর ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল।
80. মক্কার ইতিহাস, আল্লামা ফাসী, বর্ণনাকারী আল্লামা কুতুবুদ্দিন (رحمة الله)।
৩. হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর তিরোধানের পর তাঁর পুত্র হযরত শীস আলাইহিস সালাম নিমার্ণ করেন।
৪. এরপর নিমার্ণ কাজ সম্পাদন করেন হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)। তিনি প্রথম ভিত্তির ওপর এটি নিমার্ণ করেন। এই নিমার্ণের বর্ণনা হলো, কা’বা-মুখ তথা হাজরে আসওয়াদ থেকে রুকনে ইরাকী পর্যন্ত বিস্তৃত, এই স্থানটির দৈঘর্য ৩২ গজ, যাকে কা’বার মুখমন্ডল বলা হয়। রুকনে ইয়ামানী থেকে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত স্থানের প্রস্থ ২০ গজ। অন্যদিকে কা’বার পশ্চাদ ভাগ তথা রুকনে শামী থেকে রুকনে ইয়ামানী পর্যন্ত স্থানের দৈঘর্য ৩১ গজ। রুকনে ইরাকী থেকে রুকনে শামী পর্যন্ত যেখানে হাতীমও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে এই স্থানের প্রস্থ ২২ গজ। অন্যান্য প্রতিটি রুকনের উচ্চতা ৯ গজ।
এছাড়া হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কা’বা ঘরের দু’টি দরজা নিমার্ণ করেছিলেন। একটি পূর্বে, অপরটি পশ্চিমে। কিন্তু হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার ছাদ বানাননি। ইতিহাসগ্রন্থগুলো থেকে জানা যায়, সে-যুগে শুধু দেওয়ালই নির্মিত হত, ছাদ থাকত না। আর দরজা ভূমির সাথে মিলিত থাকত। অবশ্য দরজার পার্ট লাগানো থাকত না, খিলও থাকত না। সে যুগের অবস্থা এমন ছিল যে, এর চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব ছিল না, যদিও তা আল্লাহর ঘর ছিল।
এই ঘরের এক পাশে বাইরের দিকে তাওয়াফ গণনার সুবিধার জন্য একটি লম্বা পাথর লাগানো হয়েছে, এটি ‘হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর’ নামে প্রসিদ্ধ। চিন্তা-ভাবনা করলে ধারণা করা যায় যে, এটি সেই ধরনের পাথর যা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর ইবাদতের জন্য দাঁড় করেছিলেন। যেটিকে আবার ‘মাযবাহ বা কুরবানির স্থান’ অথবা আয়েরও বলা হয়।
এই দেয়ালের ভেতর একটি খননকৃত গর্ত ছিল। একে বলা হত কা’বার খনি। কা’বার জন্য যা হাদিয়া-তুহফা আসত তা চুরি থেকে রক্ষার জন্য এখানে রাখা হত।
নোটঃ এই রীতি সেই প্রাচীন যুগ থেকেই চলে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজও মানুষেরা মসজিদ, খানকা, মাযার ও পবিত্র স্থানগুলোতে হাদিয়া-তোহফা দিয়ে থাকে। সেগুলোও একটি নিরাপদ স্থানে রাখা দরকার। প্রয়োজনের সময় তা থেকে হতদরিদ্র, ফকির, মিসকিনদের প্রয়োজনসহ অন্যান্য যেকোন ধর্মীয় কল্যাণমূলক কর্মে খরচ করা যেতে পারে। সদস্যদের প্রস্তাবিত কর্মেও তা খরচ করা যেতে পারে।
৫. এরপর কা’বা ঘর নির্মাণ করে ‘আমালেকা গোত্র। এরা হলো ‘আমলীক বিন লিওয়ায বিন ইরাম বিন সাম বিন নূহ আলাইহিস সালাম এর বংশধর। এরাই মক্কার সর্বপ্রথম বাসিন্দা।
৬. জুরহুম এর পুত্ররা ষষ্ঠবারের নিমার্ণে শরীক হন। জুরহুম হলো কাহতান বিন আ’বির বিন শামিখ আরক্বাহশাদ বিন সাম বিন নূহ আলাইহিস সালাম এর পুত্র। অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে, প্রথমে বনি জুরহুম এবং পরে আ’মালেকা নিমার্ণ করেছিল।
৭. কুসাই বিন কেলাব নিমার্ণ করেন। এর প্রেক্ষাপট ছিল, একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর কা’বার স্থাপনায় কিছুটা জীর্ণতা দৃশ্যমান হয়। এটি বন্যার কারণে সংঘটিত হয়েছিল। এখনও অনেক সময় এ-ধরনের বন্যা হয়ে থাকে। এ-ছাড়া অন্য কোন কারণ খোঁজে পাওয়া যায় নি। সে-সময় কুসাই বিন কেলাব খেজুরের ঢাল-পালা ও গোগল কাঠ দিয়ে কা’বার ছাদ নিমার্ণ করেছিলেন। এই পুনঃনির্মাণ হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর ভিত্তি মুতাবেক হয়েছিল। যদিও নিমার্ণের নির্দিষ্ট সময় জানা নেই, কিন্তু এতে সন্দেহ নেই যে, কুসাই বিন কেলাব নবী কারীম (ﷺ) -এর ছয় প্রজন্ম পূর্ব পুরুষ ছিলেন। তাই অনুমানের ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, এই নিমার্ণকর্মটি নবীজি (ﷺ)-এর জন্মের দুইশ’ বছর আগে হয়েছিল।
৮. কুরাইশরা নিমার্ণ করেছিল। এ সময় নবী কারীম (ﷺ) -এর বয়স মুবারক মাত্র ৩৫ বছর। সে-সময় ইবরাহীম (عليه السلام)-এর নিমার্ণে কিছুটা বেশ-কম করা হয়। কা’বা উচ্চতা যা পূর্বে ৯ গজ ছিল তা বৃদ্ধি করা হয়। দৈর্ঘ্য ৭ গজের কম করে ফেলা হয়। হাতিমের দিকে কিছু জায়গা রেখে দেয়া হয়। পশ্চিমের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং পূর্বের দরজা ভূমি থেকে ৪ গজ এক বিঘত উঁচু করে দেয়া হয়। হাতিম ছাড়া অন্যান্য দিকে একেক হাত করে ছেড়ে দেয়া হয়।
কা’বা ঘর নিমার্ণকালে যখন হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের বিষয়টি আসে, ঠিক তখনই লেগে যায় ঝগড়া-বিবাদ ও দ্বন্দ্ব। প্রত্যেক গোত্রই হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করতে চাচ্ছিল। এমন সংকটময় মুহূর্তে আবু উমাইয়া বিন মুগিরার পরামর্শে সবাই একমত হয়। তার পরামর্শ ছিল- আগামীকাল সর্বপ্রথম যেই এই রাস্তা দিয়ে আসবে, তাকেই আমাদের বিষয়ে বিচারক বানানো হবে। তাদের সবার সৌভাগ্য যে, নবী কারীম (ﷺ) সর্বপ্রথম সেই নির্ধারিত পথে প্রথমে এসেছিলেন, যদিও সে-সময় নবী কারীম (ﷺ)-এর বয়স কম ছিল। কিন্তু সবাই ‘আল-আমীন’ বলে খুশিতে চিৎকার করে উঠে। আমরা সবাই তাঁর ফয়সালার ওপর রাজি, একথা বলে সবাই দাঁড়িয়ে উঠে।
পরে নবী কারীম (ﷺ) তাঁর চাদর মুবারক বিছিয়ে আল্লাহর আদেশ মতে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে দেন। সকল গোত্রপতিদের উদ্দেশ্য বলা হলো, সবাই যেন চাদর ধরে হাজরে আসওয়াদ যেখানে স্থাপন করা হবে সে-পর্যন্ত নিয়ে যায়। সকলই তা করল। চাদর ধরে নিধার্রিত স্থানে চলে যায়। এরপর হাজরে আসওয়াদটি নবী কারীম(ﷺ) নিজ হাতে নিয়ে স্ব-স্থানে স্থাপন করে দেন। এতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা আর হয়নি।
৯. হযরত আবদুল্লাহ বিন যুবাইর রাদিআল্লাহু আনহু নির্মাণ করেন। এর ঘটনা ছিল, হযরত আবদুল্লাহ বিন যুবাইর (رضى الله تعالي عنه) হেজাজের গভর্ণর হলে পুরো হেজাজ তাঁর অধীনে চলে আসে। ইয়াজিদের পক্ষ থেকে তাঁকে হত্যা করার জন্য মসজিদে হেরমের দিকে লক্ষ্য করে হোছাইন বিন নুমাইর প্রাচীন কামান দ্বারা আগুন নিক্ষেপ করে। এই আঘাতে কা’বা ঘরের দেয়ালের কিছু অংশ পুড়ে যায় এবং ছাদের কিছু কাঠও জ্বলে যায়। এমন সময় ইয়াজিদ মারা যায়। ফলে তাঁর সৈন্যরা ফিরে যায়। সে-সময় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (رضى الله تعالي عنه) ইচ্ছা করলেন, অবশিষ্ট দেয়ালগুলো ভেঙ্গে পুনরায় নতুনভাবে মজবুত করে দেয়াল নিমার্ণ করতে। অতপর সকল দেয়াল ভাঙ্গার পর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর ভিত্তি প্রকাশ পায়। ফলে তার ওপরই কা’বা ঘর পুনঃনির্মাণ করা হয়। যে ভূমি বাইরে রয়ে গিয়েছিল তা আবার কা’বা ঘরের অন্তভর্ূক্ত করা হয়। পূর্বের মত দরজা ভূমির সাথে সমতল করা হয়। দ্বিতীয় দরজাও আগের মত পুনঃনিমার্ণ করা হয়। উচ্চতায় এর আগের তুলনায় ৯ গজ উঁচু করা হয়। এই নিমার্ণ কাজ ১৫ জুমাদাস সানী হিজরী ৬৪ সনে শুরু হয়ে ২৭ রজব ৬৪ হিজরীতে শেষ হয়।
১০. আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের আদেশে ৭২ হিজরী সনে হাজ্জাজ বিন ইউসূফ নির্মাণ করেন। মৌলিকভাবে এইবার হযরত আবদুল্লাহ বিন যুবাইর রাদিআল্লাহু আনহু এর নিমার্ণ ঠিক রাখা হয়। কিন্তু হাতিমের দিকে ৬ গজ এক বিঘত ভূমি বের করে দিয়ে কুরাইশের ভিত্তি মোতাবেক দেয়াল নিমার্ণ করে দেয়া হয়। পশ্চিমের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। পূর্বের দরজা ৪ গজ এক বিঘত উঁচু করা হয়। যা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে হাজ্জাজের নিমার্ণের ওপর। কা’বা ঘরের ভেতরে প্রথম দুই সারিতে ৬টি স্তম্ভ ছিল। হযরত আবদুল্লাহ বিন যুবাইর (رضى الله تعالي عنه) তাঁর সময়ে ৩টি স্তম্ভ কমিয়ে দিয়েছিলেন এবং একই সারিতে ৩টি স্তম্ভ নির্মাণ করেন। সুতরাং এখনো ৩টি স্তম্ভ বিদ্যমান আছে। যার এক কোণে হাজরে আসওয়াদ রাখা হয়।
কা’বার মূল নাম হলো বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর। হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর যুগ থেকে একটি নিয়ম প্রচলিত ছিল আল্লাহর ইবাদতের জন্য যেখানেই কোন চিহ্ন স্থাপন করা হত তাকে ‘বায়তে ইল’ বা আল্লাহর ঘর বলা হত। কিন্তু যেহেতু এই ঘরটি হযরত ইসমাইল (عليه السلام) মুকা’আব বা ঘন ক্ষেত্রফলের আকৃতিতে নির্মাণ করেছিলেন, তাই এটি ‘কা’বা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। কা’বার নাম বায়তুল আতীক, মক্কা, বক্কা এবং উম্মুল ক্বোরাও এসেছে। বিভিন্ন কিতাবে কা’বার আরও অনেক নাম লেখা রয়েছে। প্রায় ১৮টি নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। সব নামের মধ্যে মক্কা ও কা’বা নামে বেশি প্রসিদ্ধ। কা’বা ঘরে অসংখ্য মূর্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) মক্কা বিজয়ের দিন মূর্তিগুলো ভেঙ্গে আল্লাহর ঘর খানায়ে কা’বাকে একমাত্র আল্লাহ'র উপাসনালয়ে পরিণত করেছিলেন। হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর যুগ ও তাঁর পরবর্তী যুগগুলোতে দেয়াল পূর্বের মতই ছিল। কয়েকবার আগুন ধরে কা’বা জ্বলে গিয়েছিল।
অনুমান করা হচ্ছে আবদুল্লাহ বিন যুবাইর রাদিআল্লাহু আনহু এর যুগ পর্যন্ত পুরাতন গিলাফের ওপর নতুন গিলাফ পরিয়ে দেয়ার প্রচলন ছিল। এ-কারণেই তাঁর যুগে কা’বা ঘরে আগুন লেগেছিল। এর পরেও এই রীতি চালু ছিল। ইসলামী যুগেও কা’বার ওপর চাদর পরানোর রীতি ছিল এবং অদ্যবধিও প্রতি বছর হজ্বের দিন নতুন গিলাফ পরানোর প্রথা চালু রয়েছে। এতে কোন সন্দেহ নেই।
❏ প্রশ্ন-৫৪ঃ কখন কোন সময় থেকে কা’বায় গিলাফ লাগানো শুরু হয়? এই রীতিটি কে চালু করেন?
✍ উত্তরঃ হিজরতের ২২০ বছর পূর্বে কা’বার ওপর গিলাফ পরানোর রীতি চালু হয়। সর্বপ্রথম তুব্বা আবু কুরব আস‘আদ শাহ হুমাইর কা’বা ঘরকে স্বর্ণাবৃত চাদরের গিলাফ পরান। কা’বার জন্য একটি দরজা ও তালা-চাবিও বানিয়েছিলেন। এই রীতি তার অনুসারীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তারা চামড়া এবং মিসরীয় কাপড়ের গিলাফ পরাত। এরপর অন্যান্য ভক্তরাও গিলাফের জন্য কাপড় পাঠাত।
কুসাই গিলাফ বাবদ গোত্রসমূহকে বাৎসরিক সহযোগিতা করতে একটি নির্ধারিত অংকের অনুদান ধার্য করে দেন।
ইসলামের পূর্বে এই রীতি ছিল যে, আবু রবিআ‘ বিন মুগিরা এক বছর গিলাফের ব্যবস্থা করতো আর অপর বছর কুরাইশের বিভিন্ন গোত্ররা করতো।
অন্ধকার যুগ ও ইসলাম-পূর্ব যুগের কা’বার সম্মান ও সৌন্দর্য্য-বর্ধনের এই রীতি-নীতি ইসলাম প্রণেতা নবী মুহাম্মদ (ﷺ) ও ঠিক রেখে নিজেই ইয়ামেনী কাপড়ের গিলাফ দ্বারা কা’বা ঘরকে সজ্জিত করেন। তাঁর পরে হযরত আবু বকর, হযরত উমর, হযরত উসমান রাদিআল্লাহু আনহুমও সৌন্দর্য বর্ধনের রীতি বহাল রাখেন। এরপর আবদুল্লাহ বিন যুবাইর (رضى الله تعالي عنه) মিসরীয় কবাতি কাপড় এবং স্বর্ণাবৃত কাপড় দ্বারা গিলাফ টানেন। এ-ভাবে উমাইয়া ও আব্বাসীসহ অন্যান্য খেলাফত যুগে খুব গুরুত্বের সাথে কা’বায় চাঁদর পরানো হত। কেউ এ-কথা বলেননি যে, এই সম্মান ও সৌন্দর্য বর্ধন রীতি অন্ধকার যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সুতরাং তা জায়েয হবে না। বুঝা গেল, ভালো সর্বদাই ভালো থাকে, আর মন্দ সর্বদা মন্দই হয়। অবশ্য স্পষ্টভাবে শরীয়তের কোন বিধান আসলে ভিন্ন কথা।
রোম বাদশার পক্ষ থেকে খুব শানদার ও ধুমধামের সাথে এই পবিত্র কাজটি করা হত। কুরাইশরা হাতিম ব্যতীত অন্য তিন পাশে একেক গজ করে যে অংশটা ছেড়ে দিয়েছিল মুহিব্বুদ্দিন তবরী শাফেয়ী এর যুগে সে-স্থানে প্রাচীরের নিম্নভাগে ১৬ আঙ্গুল পরিমাণ উঁচু করে টিলা তৈরি করে দেয়া হয়। যাতে সেদিক দিয়ে কেউ যাতায়াত করতে না পারে। দর্শকরা যাতে মনে করে, এটি দেয়ালের ভিত্তি মজবুত থাকার জন্য দেয়া হয়েছে। (মসজিদে হেরেমের ইতিহাস)
আবদুল মালিক বিন মারওয়ান নবী কারীম(ﷺ) -এর অনুসরণ করেন। আব্বাসীয় খলিফা মাহদী ১৬০ হিজরীতে হজ্ব করার সময় প্রত্যক্ষ করেন যে, কা’বা ঘরের ওপর অসংখ্য চাঁদর ঝুলে আছে। খাদেম-সেবকদের কাছে এই বলে অভিযোগ করলেন, যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে এগুলোর ভারে তো ছাদের ক্ষতি হবে। তাঁরই আদেশে কা’বার ওপর শুধুমাত্র একটি চাঁদর রাখা হয়। এই নিয়ম এখনও চালু রয়েছে। প্রতি বছর হজ্বের দিন সকালে নতুন চাঁদর পরানোর সময় পুরাতন চাঁদরটি খুলে ফেলা হয়। পুরাতন চাঁদর যদি ফেঁটে-ছিড়ে যায়, সাধারণত তা মক্কার গভর্নর শরীফ হুসাইনের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হতো।
যদি হজ্ব জুমার দিন হয়, তাহলে তা বাদশার কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া হতো। অবশিষ্ট অস্বর্ণ খচিত কাপড় কা’বার তত্ত্বাবধায়ক শায়খ সিবী নিয়ে নিতেন এবং যে-কোনভাবে তা হাজীগণের হাতে পৌঁছে দিতেন। সুতরাং বাবুস্ সালামের কাছেই এর জন্য নির্দিষ্ট দোকান রয়েছে। গজ প্রতি সাত থেকে পনের রিয়ালে এটি কিনাতে পাওয়া যেত।
❏ প্রশ্ন-৫৫ঃ কা’বা শরীফের ভিত্তি যা ইবরাহীম (عليه السلام) করেছিলেন এবং বর্তমান ভিত্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কিনা?
✍ উত্তরঃ হ্যাঁ! অবশ্যই আছে। নিম্নোক্ত পরিমাপের ভিত্তিতে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যাবে।
১. রুকনে হাজরে আসওয়াদ থেকে রুকনে ইরাকী পর্যন্ত ৩২ গজ হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) এর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর বর্তমান ভিত্তি হচ্ছে- ২৫ গজ।
২. রুকনে ইরাকী থেকে রুকনে শামী পর্যন্ত ২২ গজ। আর বর্তমান ভিত্তি হচ্ছে-২৪ গজ।
৩. রুকনে শামী থেকে রুকনে ইয়েমেনী পর্যন্ত ৩১ গজ। আর বর্তমান ভিত্তি হচ্ছে- ২২ গজ।
৪. রুকনে ইয়েমেনী থেকে রুকনে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত ২০ গজ। আর বর্তমান ভিত্তি হচ্ছে- ২১ গজ।
গোসল,অযু ও তায়াম্মুমের বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-৫৬ঃ অযু কি দাঁড়িয়ে করা উচিত, না বসে করা? এ-দু’টির কোনটি উত্তম?
✍ উত্তরঃ বসে অযু করা অযুর অন্যতম আদব। কারণ অযুর একটি আদব হলো, উঁচু স্থানে বসে অযু করা। যাতে ব্যবহৃত পানির ছিঁটা-ফোঁটা শরীরে ও পোশাকে না পড়ে।
ومن الآداب أن يكون جلوسه على مكان مرتفع.
উঁচু স্থানে বসে অযু করা অযুর অন্যতম আদব।
81. হালবী কাবীর, পৃষ্ঠা- ৩১, অযু অধ্যায়, খন্ড-১।
ومن الآداب أن يجلس المتوضي مستقبل القبلة عند غسل سائر الأعضاء.
‘অযুর আদব হচ্ছে, অযুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ধৌত করার সময় কেবলামুখী হয়ে বসা।’
82. দুররে মুখতার, অযুর আদবসমূহ, পৃষ্ঠা- ১২৭, খন্ড-১।
الجلوس في مكان مرتفع تحرزا عن الماء المستعمل وعبارة الكمال وحفظ ثيابه من التقاطر وهي أشمل.
উঁচু স্থানে বসে অযু করলে ব্যবহৃত পানি শরীরে বা কাপড়ে লাগা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মূলকথা হচ্ছে ব্যবহৃত পানির ফেঁাটা কাপড়ে লাগা থেকে হেফাযত হবে এবং এটাই যুক্তিযুক্ত।
83. সেআ’য়া, অযুর আদবসমূহ, পৃষ্ঠা- ১৮।
❏ প্রশ্ন-৫৭ঃ শীতকালে অযুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো এমনভাবে শুকিয়ে যায় যে, তাতে পানি প্রবাহিত করলেও শরীর শুকনো থেকে যায়। অথবা পাথর-ভূমিতে বেশি চলা-ফেরার কারণেও অনেক সময় শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ শুকনো হয়ে যায়। এই পরিস্থিতে কী করণীয়?
✍ উত্তরঃ শীতকালে পা অধিকাংশই শুকনো থাকে এবং পানিতে শরীরের অঙ্গগুলো ভালভাবে ধৌত করতে পারে না। এই কারণেই ফোকাহা-ই কেরাম বলেন, ধোয়ার পূর্বে অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো ভিজিয়ে নিবে। ফলে অযুর পানি যখন প্রবাহিত হবে তখন পানি অঙ্গগুলো ভালোভাবে ভেজাতে পারবে এবং অযুর অঙ্গগুলো ভালোভাবে ধৌত করা সম্ভব হবে।
বাদায়েউস্ সানায়ে‘ (পবিত্রতা অধ্যায়) খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩, এ আছে,
عن خلف بن أيوب أنه قالঃ ينبغي للمتوضئ في الشتاء أن يبل أعضاءه شبه الدهن، ثم يسيل الماء عليها؛ لأن الماء يتجافى عن الأعضاء في الشتاء.
হজরত খলফ বিন আইয়ুব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, শীতকালে অযুকারীর জন্য উচিত হলো (প্রথমে) শরীর তৈল মালিশের মত অযুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পানিতে ভিজিয়ে দেয়া অতঃপর পানি প্রবাহিত করা। নচেৎ শীতকালে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পানি যথাযথ ভাবে পৌঁছবেনা।
ফতোয়ায়ে হিন্দিয়াতে আছে,
في الشتاء أن يبل أعضاءه بالماء شبه الدهن.
অর্থাৎ- শীতকালে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অযুর পানি দ্বারা এমনভাবে সিক্ত করবে, যেমনি ভাবে শরীরে তেল মালিশ করা হয়।
এ-কারণেই ইমাম কাসানী(رحمه الله تعالي ) ‘شبه الده)’ ‘তৈল মালিশের ন্যায়’ বলেছেন। ثم يسيل الماء عليها অর্থঃ অতঃপর তার ওপর পানি প্রবাহিত করবে।
لأن الماء يتجافى عن الأعضاء في الشتاء -
দ্বারা বুঝা যায় এটি মুস্তাহাব।
84. ফতোয়া হিন্দিয়া, তৃতীয় অধ্যায়- মুস্তাহাবসমূহের বর্ণনা, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৯।
❏ প্রশ্ন-৫৮ঃ গরম পানি দ্বারা অযু করা কি জায়েয? এ-বিষয়ে শরয়ী হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ যে কোন পাক-পবিত্র পানি দ্বারা অযু করা বৈধ। হোক তা গরম কিংবা ঠান্ডা পানি। প্রত্যেক প্রকারের পানি দ্বারা অযু করা জায়েয। হ্যাঁ! অবশ্য সূর্যের তাপে উত্তপ্ত পানি দিয়ে অযু করা চিকিৎসা শাস্ত্রের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয়। সুতরাং এটি তবয়ী মাকরূহ বা প্রাকৃতিক অপছন্দনীয় বিষয়। শরয়ী মাকরূহ নয়।
أن عمر بن الخطابؓ كان يسخن له ماء في قمقمة ويغتسل به.
বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর বিন খাত্তাব (رضى الله تعالي عنه)-এর জন্য তামার পাত্র বা ডেক্সীতে পানি গরম করা হতো। তিনি ঐ পানি দিয়ে অযু বা গোসল করতেন।
আরও একটি বর্ণনা,
أن عمر بن الخطابؓ قالঃ لا تغتسلوا بالماء المشمس ، فإنه يورث البرص.
অন্য বর্ণনায় আছে, হযরত ওমর ফারুক (رضى الله تعالي عنه) বর্ণনা করেন, তোমরা রৌদ্রের গরম পানি দ্বারা গোসল করোনা। কারণ এতে শ্বেত রোগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
85. দারে-কুতনী, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৭৩, উত্তম পানি অধ্যায়।
عن عائشة رضى الله عنها قالتঃ نهى رسول الله صلّى الله عليه وسلّم أن يتوضأ بالماء المشمَّس.
হযরত আয়েশা (رضى الله تعالي عنها) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযূর (ﷺ) রৌদ্রের উত্তপ্ত পানি দিয়ে অযু করতে নিষেধ করেছেন।
86. নসবুর রায়া, পৃষ্ঠা-১০২-১০৩, অধ্যায়ঃ যে পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন জায়েয। সেআ’য়ার পৃষ্ঠা-৩৩৭, খন্ড- ১, অধ্যায়ঃ সূর্যের তাপে উত্তপ্ত পানি মাকরূহ। ফতোয়া হক্কানিয়া, পৃষ্ঠা-৫১৫, খন্ড-২।
❏ প্রশ্ন-৫৯ঃ বিড়ি, সিগারেট ও হুক্কা পানে কি অযু নষ্ট হয়ে যায়?
✍ উত্তরঃ অযু বিনষ্টকারী প্রসিদ্ধ কারণসমূহ ছাড়াও প্রত্যেক নেশা-উদ্দীপক বস্তু ব্যবহারে অযু ভঙ্গ হয়ে যায়। আর যেহেতু ফোকাহা-ই কেরাম যে নেশার কথা বলেছেন তা বিড়ি-সিগারেট এবং হুক্কাতে পাওয়া যায় না, তাই এগুলো ব্যবহারে অযু ভঙ্গ হবে না। কিন্তু দুর্গন্ধ দূর করতে ভালোভাবে মুখ ধোয়ে নেয়া এবং ভালোভাবে কুলি করা উচিত। ফতোয়া শামীতে রয়েছে,
فإنه لم يثبت إسكاره ولا تغيره ولا إضراره، بل ثبت له منافع .
অর্থঃ ‘যখন এর দ্বারা নিশা, কোন ধরনের পরিবর্তন এবং ক্ষতি প্রমাণিত হয়নি, বরং এর দ্বারা উপকারিতাই সাব্যস্ত হবে।
87. ফতোয়া শামী, পানীয় অধ্যায়, পৃষ্ঠা-৪৫৯, খন্ড-৬
কেফায়াতুল মুফতি গ্রন্থে আছে, তামাক পানে কিংবা ধুমপানে অযু নষ্ট হয় না।
88. মুফতি কেফায়াতুল্লাহ, কেফায়াতুল মুফতি, পবিত্রতা অধ্যায়, চতুর্থ অনুচ্ছেদ, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২৭২
আল্লামা শামীর মতে,
فان لم يثبت اسكاره، بل ثبت له منافع .
এতে নেশা নয়, বরং কিছুটা উপকারিতা দেখা যায়। বিষয়টি ভালোভাবে চিন্তা করুন।
❏ প্রশ্ন-৬০ঃ লবনের ওপর তায়াম্মুমের শরয়ী বিধান কি? একজন ব্যক্তি লবনের দোকানে কাজ করে এবং সেখানে যদি তার তায়াম্মুমের প্রয়োজন হয় এবং আশ-পাশে কোন মাটিও না থাকে, তাহলে এই মুহূর্তে উক্ত ব্যক্তি কি লবণের ওপর তায়াম্মুম করলে তা বৈধ হবে?
✍ উত্তরঃ হযরত আল্লামা ইবরাহীম হালবী হানাফী (رحمه الله تعالي ) কবীরী গ্রন্থের তায়াম্মুম অধ্যায়ে বলেন,
ولو تيمم بالملح نظر إن كان مائيا أي كان ماء فجمد ، لا يجوز لأنه ليس من أجزاء الأرض وإن كان جبليا أى معدنيا وهو ما استحال ملحا من أجزاء الأرض يجوز به التيمم لأنه جنس الأرض
‘আর যদি লবনের ওপর তায়াম্মুম করতে হয়- তাহলে তৎপূর্বে দেখতে হবে যে, লবন কি লোনা পানি থেকে উৎপন্ন (অর্থাৎ সমুদ্রের লবন) তাহলে এতে তায়াম্মুম জায়েয নেই। যেহেতু এটা মাটির অংশ নহে। আর যদি খনিজ লবন হয় তাহলে এতে তায়াম্মুম জায়েয। যেহেতু এটা মাটির অংশ, পানি জাতীয় নয়।
ফতোয়া কাজীখান-এ উল্লেখ আছে,
اختلفوا في الجبلى والصحيح هو الجواز .
‘ওলামাদের মধ্যে খনিজ লবনের ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। তবে বিশুদ্ধ মতে, জায়েয।’
89. বাহরুর রায়েক, তায়াম্মুম অধ্যায়; কাজীখান, অনুচ্ছেদঃ যা দ্বারা তায়াম্মুম জায়েয।
বিশুদ্ধ মত হলো, পাহাড়ী লবন যেহেতু মাটির অংশবিশেষ, তাই তা দ্বারা তায়াম্মুম করা শরয়ীভাবে বৈধ। আর আমাদের দেশে যে লবনগুলো সমুদ্র-পানি থেকে তৈরি হয়, তা দ্বারা তায়াম্মুম জায়েয নয়।
هذا ما ظهرلى والعلم عندالله تعالىٰ ورسوله الكريم .
‘এটাই আমার বুঝে এসেছে। বাকি প্রকৃত জ্ঞান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট।’
❏ প্রশ্ন-৬১ঃ ইসলামী শরীয়তে গোসল কত প্রকার ও কী কী?
✍ উত্তরঃ ইসলামী শরীয়তে গোসল মোট (৯) নয় প্রকার। তা হলোঃ
১. মহিলার ঋতুস্রাব বা সন্তান প্রসবের পরে রক্ত বন্ধ হলে গোসল করতে হয়। এটি ফরয।
২. নারী-পুরুষের সহবাস বা স্বপ্নদোষ হলে গোসল করতে হয়। এই দু’প্রকারের গোসলও ফরয।
৩. জুমার দিন জুমার নামাযের জন্য গোসল করা। এটি সুন্নাতে মুআক্কাদা।
৪. অমুসলিম মুসলমান হবার পর গোসল করতে হয়। এটিও সুন্নাতে মুআক্কাদা।
৫. উভয় ঈদের দিন ঈদগাহে যাবার পূর্বে গোসল করা।
৬. হজ্বের ইহরাম বাঁধার পূর্বে।
৭. বায়তুল্লায় প্রবেশের পূর্বে। অনুরূপভাবে যিয়ারেতে মোস্তফা(ﷺ) উদ্দেশ্যে মদিনায় প্রবেশের পূর্বে।
৮. সিঙ্গা লাগানোর সময়।
৯. মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেবার পর। এটি মুস্তাহাব।
শেষ দু’টি গোসল সতর্কতামূলক। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য এটাও মুস্তাহাব যে, কমপক্ষে সপ্তাহে একবার মাথা এবং পুরো শরীর ধৌত করা।
❏ প্রশ্ন-৬২ঃ তায়াম্মুমের সময় দাড়ি খিলাল করার বিধান কী?
✍ উত্তরঃ অযুতে দাঁড়ি খিলাল তো হয়ে থাকে। তায়াম্মুমেও দাঁড়ি খিলাল করা সুন্নাত। এর জন্য স্বতন্ত্রভাবে মাটিতে হাত মারার প্রয়োজন নেই।
فبقي تخليل اللحية من السنن.
‘তায়াম্মুমের সময়ও দাঁড়ি খিলাল করা সুন্নাত।’
90. রাদ্দুল মুখতার, শামী, তায়াম্মুম অধ্যায়, পৃষ্ঠা-২৩২,
ফতোয়া হক্কানী, পৃষ্ঠা-৫৫০, খন্ড-২।
❏ প্রশ্ন-৬৩ঃ যদি কারও হাত, পা কিংবা অযুর অন্য যে কোন অঙ্গ জখমপ্রাপ্ত হয়, সে ব্যক্তি ক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ বাঁধে এবং অযু করার সময় সে উক্ত স্থানে মাসেহ করে, তাহলে এমন ব্যক্তির ইকতেদা করে জামাত পড়া কি জায়েয হবে?
✍ উত্তরঃ উল্লেখ থাকে যে, শরীয়তে অপারগতা গ্রহণযোগ্য। যদি উক্ত ব্যক্তিটি শরীয়ী অপারগতার ভিত্তিতে ব্যান্ডেজে মাসেহ করে নামাযে ইমামতি করে এবং উক্ত ক্ষতস্থান থেকে আপনা-আপনি পুঁজ-রক্ত প্রবাহিতও না হয়, তাহলে এমন ব্যক্তির ইমামতিকে ফোকাহা-ই কেরাম বিশুদ্ধ বলেছেন। এ কারণে নামাযে কোন প্রভাব পড়বে না।
মারাকিউল ফালাহ মা‘ত তাহ্তাবী, ইমামত অধ্যায়, পৃষ্ঠা-১৬১ তে রয়েছে,
وصح اقتداء غاسل بماسح على الخف والجبيرة أو فرصت لا يسيل منها شيء.
‘শরাহ মোতাবেক মৌজা, ব্যান্ডিজ বা এমন ক্ষত যা থেকে পূজ-রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে না, এমন স্থানে মুসেহকারী ইমামের পিছনে পানি দ্বারা অযুকারীর ইকতেদা সহীহ হবে।’
নামাযের বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-৬৪ঃ ফরয নামাযে একই সূরা তাক্রার বা পুনরুক্তি করা যেমন- ফজরের ফরয নামাযের উভয় রাকাআতে সূরা ইখলাস পাঠ করা জায়েয আছে কি না ? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ নফল নামাযে একই সূরা তাক্রার বা পুনরাবৃত্তি করা জায়েয কিন্তু উত্তমের বিপরীত। অবশ্য ফরযসমূহে সূরা তাক্রার করা মাকরূহে তানযিহী। এতে নামাযের কোন ক্ষতি সাধন হবে না।
لا بأس ان يقرأ سورة ويعيدها فى الثانية . قال ابن عابدين افاد أنه يكرهُ تنزيها وعليه يحمل جزم القنية بالكراهة .
‘উভয় রাকাআতে একই সূরা তাকরার বা পুনরুক্তিতে কোন ক্ষতি নেই। আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (رحمه الله تعالي ) বলেন, এটা মাকরূহে তানযিহী আর কেনিয়া প্রণেতা এতে মাকরূহ হওয়ার ব্যাপারে জোর রায় দিয়েছেন।
91. ফতওয়ায়ে শামী, কিরাত অধ্যায়, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৫৪৬।
❏ প্রশ্ন-৬৫ঃ পায়খানা ও প্রস্রাবের বেগ অধিক হওয়া সত্ত্বেও তা চেপে রেখে নামায আদায় করার হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ ফিকহশাস্ত্রবিদগণ বলেছেন, পায়খানা ও প্রস্রাবের হাজত বা বেগ অধিক হওয়া অবস্থায় নামায আদায় করা মাকরূহে তাহ্রিমী। উত্তম হলো, প্রয়োজন সেরে নামায আদায় করা। হ্যাঁ! যদি নামায কাযা বা ওয়াক্ত চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে এমতাবস্থায় মাকরূহ বিহীন নামায আদায় করা জায়েয। ফতোয়ায়ে শামীতে আছে,
وصلاته مع مدافعة الاخبثين، قال حسن شرنبلالى ومدافعًا لاحد الاخبثين البول والغائط او الريح... الا اذ خاف فوتُ الوقتِ او فوتُ الجماعة فحينئذٍ يصلى بتلك الحال لان اخراج الصلواة عن وقتها حرام، والجماعة مؤكدة واجبة . قال السيد احمد الطحطاوى تحت الا اذا حاضر.... ظاهره انها تختفى الكراهة عند ذالك.
‘পায়খানা-প্রস্রাবের বেগ অধিক হওয়া অবস্থায় নামায পড়া সম্পর্কে আল্লামা হাসান শরম্বেলালী (رحمه الله تعالي ) বলেন, পায়খানা-প্রস্রাব অথবা পশ্চাৎপদ থেকে বায়ুর বেগ অধিক হওয়া অবস্থায় তা চেপে রেখে নামায পড়া মাকরূহে তাহ্রিমী। কিন্তু নামাযের ওয়াক্ত কিংবা জামাত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা হলে তখন সে অবস্থায় নামায আদায় করে নিবে। কেননা নামাযের ওয়াক্ত চলে যাওয়া হারাম এবং জামাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিংবা ওয়াজিব।’
সৈয়দ আহমদ তাহ্ত্বাবী বলেন, এমতাবস্থায় নামায আদায় করা মাকরূহ হবে না।
92. মারাকিউল ফালাহ فصل ما يكره فى الصلواة, পৃষ্ঠা-২৯২; রদ্দুল মুখতার, باب مكروهات الصلواة, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২৪১।
❏ প্রশ্ন-৬৬ঃ চোখ বন্ধ করে নামায পড়া কী? কিছু লোক চোখ বন্ধ করে নামায আদায় করে, এটা জায়েয কি না?
✍ উত্তরঃ নামাযে চোখ বন্ধ করা মাকরূহে তান্যিহী বা উত্তমের বিপরীত। তাই চোখ বন্ধ করে নামায না পড়া উচিত। হ্যাঁ! যদি খোদাভীতি, বিনয়-নম্রতা ও একাগ্রতার ভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে চোখ বন্ধ করা হয়, তবে বিনা মাকরূহে জায়েয। কিছু সংখ্যক ওলামা এটাকে উত্তমও বলেছেন।
وكره ..... تغميض عينه للنهى الا لكمال الخشوع . قال ابن عابدين تحت قوله للنهى ثم الظاهر ان الكراهة للتنزيه .
‘এবং চোখবুঝে নামায পড়া মাকরূহ, কিন্তু গভীর মনযোগ বা খোদাভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্য হলে মাকরূহ হবে না। এই মর্মে শামী প্রণেতা ইবনু আবেদীন বলেন, বাহ্যতঃ এটা (চোখবুঝে) মাকরূহে তানযিহী।’
93. রদ্দুল মুখতার, باب ما يفسد وما يكره فيها , খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৪৫।
❏ প্রশ্ন-৬৭ঃ শীতকালে লোকজন চাদর কিংবা রুমাল দ্বারা মুখ ঢেকে রাখা অবস্থায় নামায আদায় করে থাকে- এর হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ নামাযে নাক ও মুখ ঢেকে রাখা মাকরূহ। তাই শীত ও গ্রীষ্মকালীন সময় নামাযে এরকম না করা উচিত। কারণ এর দ্বারা নামায মাকরূহ হবে। ফতোয়া হিন্দীয়াতে আছে,
ويكره التلثم وهو تغطية الانف والفم فى الصلواة والتثائب الخ . انه صلى الله عليه وسلّم نهى عن ان يغطىٰ الرجل فاه .
‘নামাযে নাক-মুখ ঢাকা মাকরূহ অনুরূপ হাই তোলাও। যেহেতু হুযূর নামাযে মুখ ঢাকতে নিষেধ করেছেন।’
94. শরহে তাহ্তাবী আলা মারাকিউল ফালাহ, পৃষ্ঠা- ২৮৯।
❏ প্রশ্ন-৬৮ঃ সিজদায় যাওয়ার সময় পায়জামা উপরের দিকে উঠানোর হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ নামাযরত অবস্থায় প্রয়োজন ছাড়া এমন করা মাকরূহ। তবে প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে রুকু-সিজদা করার সহজার্থে এরূপ করা মাকরূহ হবে না।
95. রদ্দুল মুখতার, باب مايفسد الصلواة وما يكره فيها, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৪০।
❏ প্রশ্ন-৬৯ঃ ইমামের পূর্বে সালাম বলার হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ ফিকহ শাস্ত্রের কিতাবসমূহে এর সুনির্দিষ্ট হুকুম বা বিধান আমার নযরে পড়েনি। অবশ্য সহীহ মুসলিম শরীফের বরাত দিয়ে মিশকাত শরীফের বর্ণনা মতে মাকরূহ বুঝা যায়।
عن انس قال صلى النبى صلّى الله عليه وسلّم ذات يوم فلمّا قضى الصلواة اقبل علينا بوجهه فقال ايها الناس انى امامكم فلا تسبقونى بالركوع ولا بالسجود ولا بالقيام ولا بالانصراف فانى أراكم امامى ومن خلفى.
‘হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে নামায পড়ালেন এবং নামায শেষে তাঁর চেহারা মুবারক আমাদের দিকে ফিরিয়ে বললেন, হে লোকেরা! আমি তোমাদের ইমাম; তাই তোমরা রুকু, সিজদা, কিয়াম এবং নামায শেষ করার ক্ষেত্রে আমার অগ্রগামী হয়ো না। নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে আমার সামনে যেমন দেখি, পেছনেও তেমনি সমানভাবে দেখতে পাই।’ অর্থাৎ মুকতাদীদের ওপর ইমামের অনুসরণ অনুকরণ করা অবশ্যই ওয়াজিব।
96. সহীহ মুসলিম, باب ما على الماموم من المتابعة,
❏ প্রশ্ন-৭০ঃ একই রাকাআতে একাধিক সূরা পাঠ করা জায়েয কি না?
✍ উত্তরঃ এক রাকাআতে একটি সূরা পড়াই উত্তম। যদি একাধিক সূরা পাঠ করা হয়, এতে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। যদিও তা (অবশ্যই) অনুত্তম।
97. মারাকিউল ফালাহ, باب ما يكره فى الصلواة
❏ প্রশ্ন-৭১ঃ ইমাম সাহেব নামায কখন আরম্ভ করবেন?
✍ উত্তরঃ قَدْ قَامَتِ الصَّلٰواةُ বলার সময় ইমামের নামায আরম্ভ করা মুস্তাহাব। যদিও ইমাম আবু ইউসুফ (رحمه الله تعالي ) ইকামত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছেন। মূলতঃ এ মতানৈক্য শুধু মুস্তাহাব সম্পর্কে। উভয় অবস্থায় কোন অসুবিধা ও ক্ষতি নেই।
ولو اخّر حتى اتمها لابأس به اجماعًا .
‘যদি ইকামত শেষ হওয়া পর্যন্ত নামায আরম্ভে বিলম্ব করে তাতে সর্বসম্মতিক্রমে কোন ক্ষতি নেই।’
98. তাহতাবী শরহে মারাকিউল ফালাহ, باب اداب الصلواة, পৃষ্ঠা-২২৫; ফতওয়া শামী, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৪৭৯।
❏ প্রশ্ন-৭২ঃ নামাযী বা মুসল্লিকে সালাম ফিরানোর সময় কী করা উচিত?
✍ উত্তরঃ মুসল্লি সালাম ফিরানোর সময় ইমাম ও ফিরিশতার নিয়ত করা উচিত।
জেনে রাখা আবশ্যক, নামাযী তিন প্রকারঃ
১. ইমাম
২. মুক্তাদী এবং
৩. মুনফারিদ বা একাকী নামায আদায়কারী।
নামাযী যদি মুক্তাদি হয় এবং ইমামের ডান পাশে থাকে তাহলে ডানদিকে সালাম ফিরানোর সময় ফিরিশতা, ডান দিকের মুক্তাদি এবং ইমামকে উদ্দেশ্য করে সালাম দেয়া উচিত। আর ইমাম যদি বাম পাশে হয়, তাহলে বাম পাশের মুক্তাদি, ফিরিশতা ছাড়াও ইমামেরও নিয়ত করতে হবে। আর যদি মুক্তাদি কাতারের ঠিক মাঝখানে ইমামের সোজা পেছনে দাঁড়ায়, তাহলে উভয় দিকে সালাম দেয়ার সময় ইমামের নিয়ত করবে। আর নামাযী যদি ইমাম হয়, তাহলে ইমামের উভয় পাশের মুক্তাদির নিয়ত করবে। আর নামাযী একাকী হলে সালামের সময় উভয় পাশের ফিরিশতাগণের নিয়ত করবে। ফতোয়া হিন্দীয়াতে আছে,
و ينوى من عنده من الحفظة والمسلمين فى جانبيه والمقتدى يحتاج الى نية الامام مع نية من ذكرنا .
‘ইমাম সাহেব সালাম ফিরানোর সময় ফিরিশতা ও উভয়দিকের মুসল্লিদের নিয়ত করবে এবং মুকতাদী ইমামেরও ‘নিয়ত করবে’ উল্লেখিতদের সাথে।’
99. ফতেওয়া হিন্দীয়া, الفصل الثالث من سنن الصلواة وآدابها খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৭৭।
❏ প্রশ্ন-৭৩ঃ নামাযে ছানার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া হয় না কেন? এটা রাসূল (ﷺ)-এর হাদীস
كل امر ذى بال لم يبداء ببسم الله الخ- এর বিপরীত আমল নয় কি? দলীলসহ বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ নামাযে ছানা سُبْحَانَكَ اَللهم وَبِحَمْدِكَ الخ এর পূর্বে বিসমিল্লাহ শরীফ পড়ার কোন প্রমাণ নেই। বরং তাকবীরে তাহরীমার পর হাত বেঁধে ছানা পাঠ করার পর বিসমিল্লাহ শরীফ পাঠ করা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং ফিকহ্ শাস্ত্রের সকল কিতাবে সংরক্ষিত রয়েছে। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنها) হতে বর্ণিত আছে,
-
َالَتْ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلَاةَ قَالَ سُبْحَانَكَ اللهم وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالٰى جَدُّكَ وَلَا إِلٰهَ غَيْرُكَ-
হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنها) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযুর (ﷺ) যখন নামায শুরু করতেন অর্থাৎ تكبير تحريمه বাঁধার পর ছানা পড়তেন এবং বলতেন, سُبْحَانَكَ اَللهم হে আল্লাহ্! তোমারই তাসবীহ পাঠ করি, তোমারই প্রশংসায় বিভোর, তোমার নাম বরকতপূর্ণ, তোমার মহিমা সুউচ্চ ও সমুন্নত, তুমি ছাড়া কোন উপাস্য নেই।’
100. জামে তিরমিযী, ابواب الصلواة، باب ما يقول عنه افتتاح الصلواة , খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৫৭।
আল্লামা ইবনে নজীম হানাফী মিসরী (رحمه الله تعالي ) বলেন-
اى يضع قائلا سبحانك اللهم وبحمدك الخ، وقد تقدم انه سنة لرواية الجماعة انه كان صلى الله عليه وسلّم يقول اذا افتتح الصلواة .
‘তাকবিরে তাহরীমা বলে উভয় হাত নামিয়ে ছানা পড়বে। এর পূর্বেও ছানা পড়া সুন্নাত বলে বর্ণনা রয়েছে যে, হুযুর এরশাদ করেছেন- যখন নামায শুরু করবে তখনি ছানা পড়বে।’
101. বাহরুর রায়েক, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩০৯।
❏ প্রশ্ন-৭৪ঃ এশার নামায বিলম্বে আদায় করার হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ এশার নামায বিলম্বে আদায় করা উম্মতে মুহাম্মদীর বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব। এশার নামায যেমন আমাদের জন্য খাস তেমনি পুরো পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও আমাদের পূর্ববর্তী কোন উম্মত পায়নি। এ মহান নিয়ামত আমাদের প্রিয়নবী সৈয়্যদুল মুরসালীন (ﷺ) ব্যতীত পূর্ববর্তী কোন নবী-রাসূলের ক্ষেত্রে পাঁচ ওয়াক্ত নামায একত্রিতভাবে ছিল না। ইমাম সুয়ূতী (رحمه الله تعالي ) ‘খসায়েস শরীফে’ একটি অধ্যায় লিখেছেন,
ختصاصه صلى الله عليه وسلّم بمجموع الصلواة الخمس ولم تجمع لاحد .
‘হুযূর এর বিশেষত্বের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায একত্রিত হওয়াকে গণ্য করা হয়েছে। এ সৌভাগ্য অন্য কেউ পাননি।’ যা জনাবে মোস্তফা (ﷺ) এবং মোস্তফা (ﷺ)-এর উম্মতকে বিশেষভাবে দান করা হয়েছে। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আমিরুলহাজ্ব ‘হুলিয়া শরীফে’ বর্ণনা করেছেন-
هذه الصلواة تفرقت فى الانبياء وجمعت فى هذه الامة .
‘পূর্ববর্তী নবীগণের (عليه السلام) মাঝে উক্ত নামাযসমূহ পৃথক পৃথক ছিল। আর উম্মতে মুহাম্মদী কে সবগুলো নামায একত্রিতভাবে দেয়া হয়েছে।’
ইমাম যুরকানী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন-
لم يجمع لاحد غيرهم من الانبياء والامم .
‘হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) এর উম্মত ছাড়া পূর্ববর্তী কোন নবী এবং উম্মতের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায একত্রিত হয়নি।’
‘হুলিয়া শরীফে’ উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ নামাযসমূহ আম্বিয়া কিরামের (عليه السلام) মাঝে পৃথক পৃথকভাবে ছিল। শুধু মোস্তফা(ﷺ) -এর উম্মতকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায একত্রিতভাবে দেয়া হয়েছে। অতঃপর বলেন-
فذكر الفجر لادم والظهر لابراهيم والعصر لسليمان والمغرب لعيسى عليهم الصلواة والسلام، ثم قال واما العشاء فخصصت بها هذه الامة .
‘ফজর- হযরত আদম (عليه السلام)-এর জন্য, যোহর- হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর জন্য, আসর- হযরত সোলাইমান (عليه السلام)-এর জন্য এবং মাগরিব- হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর জন্য ফরয ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন, এশার নামায এই উম্মতের জন্য নির্দিষ্ট।’
বর্ণিত প্রশ্নের উত্তর হলো, এশার নামায উম্মতে মুহাম্মদীর অনন্য বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব। হযরত মু‘আয (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ আছে,
انكم فضلتم بها على سائر الامم-
‘তোমরা সকল উম্মতের ওপর এশার নামাযের কারণে সম্মানিত ও মর্যাদাশীল হয়েছ।’
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এশার নামায বিলম্ব করেন। অতঃপর যখন মসজিদে তাশরীফ আনেন তখন মানুষ নামাযের জন্য অপেক্ষমান ছিল। তিনি বলেন,
اما انه ليس من اهل هذه الاديان احد يذكرالله تعالى هذه الساعة غيركم-
‘জেনে রাখো, তোমরা এমন এক শুভ সময়ে অবস্থান করছো, যে সময় তোমরা ছাড়া অন্য কোন ধর্মাবলম্বী মহান আল্লাহ তা‘আলার যিকির করছে না।’
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, لَيْسَ اَحَدٌ مِنْ اَهْلِ الْاَرْضِ অর্থ-‘সমগ্র ভূ-মন্ডলে তোমরা ছাড়া অন্য কেউ নামাযের জন্য অপেক্ষমান নেই।’ অর্থাৎ এ সময় পৃথিবীতে তোমরা ছাড়া অন্য কেউ নামাযের জন্য অপেক্ষা করছে না।
অন্য একটি হাদীস হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে, তিনি বলেন, হুযূর এক রাত্রে এশার নামায অর্ধরাত পর্যন্ত বিলম্ব করেন। অতঃপর তাশরীফ আনেন এবং নামায আদায় করেন। নামায শেষে ইরশাদ করেন, যারা উপস্থিত আছ তারা অন্যদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও যে,
لمن حضره ابشروا ان من نعمة الله عليكم انه ليس احد من الناس يصلى هذه الساعة غيركم-
‘আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে তোমাদের ওপর এ মহান নিয়ামত যে, এ সময় তোমরা ছাড়া অন্য কেউ নামায পড়ছে না।’
أو قال ما صلى هذه الساعة احد غيركم .
‘অথবা এ রকম বলেছেন, এ সময় তোমরা ছাড়া অন্য কেউ নামায পড়ছে না।’
102. সীরাতে মোস্তফা, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৮৬৫।
❏ প্রশ্ন-৭৫ঃ মহিলাদের স্বতন্ত্র ও এককভাবে জামাতে নামায পড়ার হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ শুধুমাত্র মহিলাদের স্বতন্ত্র ও একক জামাত মাকরূহে তাহরীমী। ‘দুর্রুল মুখতার’-এর ৫৬৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
ويكره تحريما جماعة النساء .
অর্থাৎ- ‘মহিলাদের স্বতন্ত্র একক জামাত মাকরূহে তাহরিমী।’ ‘হিন্দিয়া’য় উল্লেখ আছে যে,
ويكره امامة المرأة للنساء فى الصلواة كلها من الفرائض والنوافل الا فى صلواة الجنازة، هكذا فى النهاية-
‘ফরয ও নফল সকল নামাযে মহিলাদের জন্য ইমামতি করা মাকরূহ। কিন্তু জানাযার নামায ছাড়া। হিন্দীয়া গ্রন্থেও অনুরূপ উল্লেখ আছে।’
এতদ্সত্ত্বেও যদি মহিলারা জামাতে নামায পড়তে চায়, তাহলে মহিলা ইমাম কাতারের মাঝখানে দাঁড়াবে। পুরুষদের ন্যায় কাতারের সামনে একাকী দাঁড়াবে না। আর মহিলা ইমাম পুরুষ ইমামের ন্যায় কাতারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে গোনাহগার হবে।
হ্যাঁ! আল্লামা ‘আইনি, ইমাম ইবনে হুমাম এবং মওলানা আবদুল হাই লক্ষ্মৌভি (رحمه الله تعالي )-এর গবেষণা মতে মহিলাদের জামাত অনুত্তম। মহিলারা পুরুষদের জামাতে পর্দা ও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পেছনে এক পাশের্ব দাঁড়িয়ে যদি ইচ্ছে করে নামায পড়তে পারবে। আর জামাত ছাড়া তারা যদি একাকী নামায পড়ে, তা হবে তাদের জন্য উত্তম ও উৎকৃষ্ট।
فان فعلن وقعت الامام وسطهن و بقيامها وسطهن لا تزول الكراهة . وان تقدمت عليهن امامهن لم تفسد صلاتهن . هكذا فى الجوهرة النيرة . وصلاتهن فرادى افضل، هكذا فى الخلاصة .
‘যদি তারা জামাতে নামায পড়তে চায়, তাহলে ইমাম দাঁড়াবে কাতারের মাঝখানে এবং কাতারে দাঁড়ালেও মাকরূহ মুক্ত হবে না। আর ইমাম কাতারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও নামায ফাসেদ হবে না, ‘জওহারাতুন্ নাইয়্যেবা’ গ্রন্থে এভাবে উল্লেখ আছে। আর মহিলাদের নামায একাকী আদায় করা উত্তম, যা ‘খোলাসা’ গ্রন্থে লিখা আছে।’
103. খোলাসাহ, باب الامامة, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৮৫।
❏ প্রশ্ন-৭৬ঃ নামাযীর সামনে দিয়ে মহিলা চলে গেলে নামায ফাসেদ বা ভঙ্গ হবে কি না?
✍ উত্তরঃ নামাযীর সামনে দিয়ে মহিলা চলে গেলে নামায ফাসেদ হবে না যেমন, ফতোয়া শামীতে উল্লেখ আছে,
قال ابن عابدين قوله ولوامرأة او كلب . هذا بيان للاطلاق واشاربه الى الرد على الظاهرة بقولهم يقطع الصلواة مرورالمرأة والكلب والحمار وعلى احمد فى الكلب الاسود.
او مرّ مارّ فى موضع سجوده لاتفسد سواء المرأة والكلب والحمار لقوله صلى الله عليه وسلّم لا يقطع الصلواة شئى وادرؤا ما استطعتم فانما هو شيطان وان اثم المار.
‘ইবনে আবেদীন শামী (رحمه الله تعالي ) বলেন-
قوله ولو امرأة اوكلب অর্থাৎ- যদিও পথচারী কোন মহিলা কিংবা কুকুর হয়’, এ উক্তিটি জাহিরিয়াদের উক্তি। ‘মহিলা, কুকুর কিংবা গাধা নামাযীর সামনে দিয়ে চলে গেলে নামায ফাসেদ হয়ে যাবে’ উক্তিকে খন্ডন করার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইমাম আহমদ (رحمه الله تعالي ) এর মতে, কালো কুকুর সামনে দিয়ে চলে গেলে নামায ফাসেদ হবে’।
104. রদ্দুল মুখতার, যে-সব কারণে নামায ভঙ্গ হবে অধ্যায়, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৪৩৬, মিসরী ছাপা।
‘কোন মহিলা, কুকুর কিংবা গাধা নামাযীর সামনে দিয়ে চলে গেলে নামায ফাসেদ হবে না। কেননা হুযূর ইরশাদ করেন, কোন বস্তু বা বিষয় নামায ভঙ্গ করে না। যতদূর সম্ভব তোমরা পথচারীকে বাঁধা দিবে। কারণ উক্ত পথচারী শয়তান এবং এতে পথচারীই গোনাহগার হবে’।
105. মারাকিউল ফালাহ, পৃষ্ঠা-২০৫, ফতওয়া হক্কানিয়া, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-২২৮।
❏ প্রশ্ন-৭৭ঃ ইমাম নামায আদায়ের নিমিত্তে সম্পূর্ণরূপে মিহরাবের ভিতর দাঁড়ানোর ফলে তাঁর উঠা-বসা, রুকু-সিজদা এবং তাঁর প্রত্যেক কর্মকান্ড ও অবস্থা সম্পর্কে মুক্তাদিরা অজ্ঞাত থাকলে অথবা ইমাম নির্ধারিত স্থানে দাঁড়ালে মুক্তাদিগণ তাঁর কর্মকান্ড ও অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজানা থাকলে- এমতাবস্থায় নামাযের হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ ইমাম মিহরাবে এভাবে দাঁড়ানো যাতে মুকতাদিরা তার অবস্থার পরিবর্তন ও কর্মকান্ড সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে- এমতাবস্থায় নামায মাকরূহ হবে। হ্যাঁ! অবশ্য ইমাম যদি এমন স্থানে দাঁড়ায় যাতে তার সকল কার্যক্রম ও অবস্থা সম্পর্কে মুক্তাদিরা অবগত থাকে, তবে মাকরূহ হবে না। যেহেতু ইমামের কার্যক্রম মুক্তাদিগণের নিকট অস্পষ্ট নয়, তাই মাকরূহ হবে না।
অনুরূপ ইমাম নির্দিষ্ট স্থানে এবং মুক্তাদিরা আঙ্গিনায় দাঁড়ালে, তখন ইমামের সকল কার্যক্রম ও অবস্থা তাদের নিকট স্পষ্ট হলে নামায বিনা মাকরূহে জায়েয। আর যদি অজানা থেকে যায়, তাহলে মাকরূহ হবে।
106. দুররুল মুখতার শরহে রদ্দুল মোহতার, অধ্যায়ঃ নামাযের পরের বর্ণনা, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৪৫।
قيام الامام فى المحراب لاسجوده فيه وقدماه خارجه لان العبرة للقدم مطلقًا وان لم يتشبه حال الامام ان علل بالتشبه وان بالاشتباه ولا اشتباه فلا اشتباه فى الكراهة، قال الشيخ السيد احمد الطحطاوى لايكره قيام الامام بجملة فى المحراب لاقيامه خارجه وسجوده فيه مسمّى محرابًا لانه يحارب النفس والشيطان بالقيام اليه والكراهة لاشتباه الحال على القوم واذا ضاق المكان فلا كراهة .
‘সম্পূর্ণভাবে মিহরাবে দাঁড়ানো মাকরূহ। হ্যাঁ! যদি মিহরাবে সিজদা পড়ে আর উভয় পা মিহরাবের বাইরে থাকে তাহলে মাকরূহ হবে না। যেহেতু নামাযে কদমের অবস্থান প্রযোজ্য। এতে যদিও ইমামের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে না হয়।
ইমাম তাহ্তাবী বলেন, ইমাম সম্পূর্ণরূপে মিহরাবের ভিতর দাঁড়ালে নামায মাকরূহ হবে না। আর যদি মিহরাবের বাইরে দাঁড়ায় এবং মিহরাবে সেজদা করে তবে ভিন্ন কথা।
মিহরাব নামকরণের কারণ হচ্ছে যেহেতু এখানে স্বীয় রিপু ও শয়তানের সাথে যুদ্ধ করা হয়, তাই মিহরাব নামকরণ করা হয়েছে। এখানে দাঁড়ানো মুক্তাদির সাপেক্ষে মাকরূহ বলা হয়েছে। তথাপি জায়গার সঙ্কীর্ণতা হলে মাকরূহ হবে না।’
107. তাহতাবী আলা দুর্রিল মুখতার, মাকরূহ পরিচ্ছেদ, পৃষ্ঠা-২৯৪।
সারকথাঃ ইমাম মিহরাব কিংবা নির্ধারিত এমন স্থানে দাঁড়ালে মুক্তাদিরা তার অবস্থার পরিবর্তন বা কর্মকান্ড সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকলে নামায মাকরূহ হবে। অন্যথায় মাকরূহ হবে না।
❏ প্রশ্ন-৭৮ঃ নামাযে নবীকুল সরদার বুরহানুত্ তাওহীদ হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কল্পনা ও ধ্যান আসলে নামায ভঙ্গ কিংবা নামাযের কোন ক্ষতি হবে কিনা? কিছু অনুপযুক্ত লোকের ধারণা যে, এতে নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে- বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ নামাযে তাওহীদের সাক্ষ্য হযরত মুহাম্মদ -এর ধ্যান ও চিন্তা-ভাবনা আসা মানে ঈমানী ও রূহানী খোরাক দ্বারা সৌভাগ্যবান হওয়া। এখানে নামায ফাসেদ হওয়া তো দূরের কথা বরং নামাযে হুযূর (ﷺ)-এর পবিত্র খেয়াল ও কল্পনা আসা নামায গ্রহণীয় ও পরিপূর্ণতার স্থানে পৌঁছার অন্যতম মাধ্যম। কেননা আত্-তাহিয়্যাতু এবং দরূদ শরীফ পাঠ করলে মু’মিনের অন্তরে রাহমাতুলিল আলামীন (ﷺ)-এর খেয়াল ও ধ্যান স্বাভাবিকভাবে এসে যায়, যা ঈমানের দাবী। على سبيل التعظيم لا على العبادة ‘যা হুযূর (ﷺ) এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে, ইবাদতের উদ্দেশ্যে নয়।’ আর কেবল খেয়াল ও ভাবনার দ্বারা নামায ফাসেদ হবে না।
❏ প্রশ্ন-৭৯ঃ পাগড়িবিহীন ইমামের পেছনে নামায পড়া জায়েয কি না? কতিপয় লোক পাগড়ির ব্যাপারে এমন কঠোরতা অবলম্বন করে যে, তারা পাগড়ি ছাড়া নামায না-জায়েয মনে করে। শরয়ী বিধান মতে তাদের উক্ত ধারণা সঠিক কি না?
✍ উত্তরঃ নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পাগড়ি পরিধান করা হুযূর (ﷺ) এর একটি উত্তম সুন্নাত ও সম্মানী পোশাক। কিন্তু এটা হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ)-এর স্বভাবগত সুন্নাত, সুন্নাতে হুদা বা নির্দেশিত সুন্নাত নয়।
كالسواك والافعال المعهودة فى الصلواة وفى خارجها وتاركها غير معاقب .
‘যেমন মিসওয়াক এবং নামাযের ভেতরে-বাইরে অনুসরণীয় কাজ যেগুলো বর্জনকারী শাস্তির উপযোগী নয়।’
সুন্নাত দু’প্রকারঃ
এক. হুযূর -এর মুবারক স্বভাবগত সুন্নাত।
দুই. শরীয়তের স্বীকৃত সুন্নাত।
مشتركٌ بين ما صدر عن النبى صلى الله عليه وسلّم عليه بلا وجوب من قول اوفعل او تقرير .
নবী কারীম(ﷺ) থেকে ওয়াজিব ব্যতীত কথা, কর্ম ও সম্মতি যা প্রকাশ পেয়েছে, তা দু’ভাগে বিভক্ত।
১. সুন্নাতে হুদা যেমন- আযান, ইকামত ও জামাত ইত্যাদি।
২. সুন্নাতে রাতেবা যেমন- কুলি করা, নাকে পানি দেয়া বা নাক পরিষ্কার করা।
সুন্নাতে হুদা পরিত্যাগকারীর জন্য শরীয়তের পক্ষ থেকে শাস্তির বিধান রয়েছে।
অপরদিকে সুন্নাতে রাতেবা বর্জনকারীর কোন শাস্তি নেই। সুতরাং পাগড়ী সে উত্তম পরিধান যা মোস্তফা(ﷺ) ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন।
قال صدر الشهيد رحمة الله عليه فسنن الهدىٰ وان كانت على سبيل العادة فسنن الزوائد كلبس الثياب والاكل باليمين وتقديم الرجل اليمنى فى الدخول ونحوذالك كل منا فى الاوّل الى اخره .
বেকায়া প্রণেতা বলেন, ডান দিক দিয়ে কাপড় পরিধান, ডান হাতে খাওয়া, মসজিদে প্রবেশে প্রথমে ডান পা দেয়া ইত্যাদি যদিও অভ্যাসগত সুন্নাত, কিন্তু এটা সুন্নাতে হুদাও।
108. শরহে বেক্বায়াহ, কিতাবুত্ ত্বাহারাত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা ৬৯।
যেমন ধুতি ও সাদা কাপড় পরিধানের ফযিলত নামাযের সাথে নির্দিষ্ট নয়, তেমনি পাগড়ি পরিধান করাও নামাযের সাথে নির্দিষ্ট নয়। কারণ রাসূলে পাক (ﷺ) এর পছন্দনীয় পোশাক পরিধান অবশ্যই সম্মানীয় পোশাক মনে করা হয়। তাই আল্লাহ্ পাকের মহান দরবারে যাওয়ার প্রাক্কালে সম্মানী পোশাক পরিধান করা অতীব উত্তম ও উৎকৃষ্ট আমল। তাই ফকীহগণ (رحمه الله تعالي ) পাগড়ি পরে নামায আদায় করার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন।
কারো যদি পাগড়ি পরার সুযোগ না হয়, সে ব্যক্তি পাগড়ি ছাড়া নামায পড়াতে কোন অসুবিধা নেই। হযরত তাহের ইবনে আবদুর রশীদ বলেছেন, মূলতঃ এক কাপড় পরে নামায পড়াতে কোন ক্ষতি নেই।
وفى الاصل لابأس بان يصلّى الرجل فى ثوبٍ واحدٍ متوشحًا به ويؤم كذالك والمستحب ان يصلى الرجل فى ثلاثة اثواب، قميص وازار وعمامة. اما لو صلى فى ثوب واحد متوشحابه جميع بدنه كازار الميت يجوز صلاته من غير كراهة .
قال ابن نجيم والمستحب ان يصلى فى ثلاثة اثوابঃ قميص وازاروعمامة .
মূলতঃ এক কাপড়ে নামায পড়লে ক্ষতি নাই, ইমামতিও করা যায়। মুস্তাহাব হচ্ছে তিন কাপড়ে (জামা, পায়জামা, লুঙ্গি ও পাগড়ী) নামায পড়া। আর যদি এমন এক কাপড়ে নামায পড়া যায় যা পুরো শরীর আবৃত হয় যেমন- বড় লুঙ্গি, তাহলে এতে নামায মাকরূহ হবে না।
109. খুলাছাতুল ফতাওয়া, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদঃ সতর আবৃত করা প্রসঙ্গে, খন্ড-১, পৃ ৭৩।
আল্লামা ইবনু নজিম বলেন- মুস্তাহাব হচ্ছে তিন কাপড়ে- জামা, লুঙ্গি, পাগড়ি পরে নামায পড়া।
110. বাহরুর রায়েক, নামাযের শর্ত অধ্যায়, পৃ ২৬৯।
কিন্তু পাগড়ির হুকুম ইমামের জন্য নির্দিষ্ট নয় বরং তা সকল নামাযীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পাগড়ি সম্পর্কিত আলোচনা দ্বারা একথা প্রতীয়মান হয় যে, পাগড়ি শুধুমাত্র ইমামের জন্য নির্দিষ্ট করা শরয়ী বিধান অতিরঞ্জিত করার নামান্তর। উহা পরিধান না করাকে নামায অনিষ্টের কারণ মনে করা মূলতঃ ফোকাহা-ই কিরামের কানুন ও মূলনীতিমালা সম্পর্কে অবগত না হওয়ার প্রমাণ।
যদি কোন ব্যক্তি পাগড়িকে সম্মানীয় পোশাক মনে করে কোন বড় মাহফিল ও সভা-সমাবেশে যাওয়ার সময় তা পরিধান করে কিন্তু নামায পড়ার সময় এর অধিক গুরুত্ব দেয় না, সে ক্ষেত্রে (بذل الثوب) কাপড় অপচয়ের হুকুমে নামাযীর জন্য এটা মাকরূহ হবে। আর যে ব্যক্তি পাগড়ি পড়ায় অভ্যস্ত নয় এবং এতো গুরুত্ব দিয়ে সর্বদা পড়েন না; এমতাবস্থায় পাগড়িবিহীন ইমামের পেছনে ইক্তিদা করলে কোন ক্ষতি নেই।
হ্যাঁ! অবশ্য যেখানে পাগড়ি বর্জন করলে ঝগড়া-বিবাদ ও ফিৎনা-ফাসাদের আশঙ্কা থাকে, এসব স্থানে পাগড়ি ছাড়া নামায পড়ানো উচিৎ না। কেননা পাগড়ি সম্পর্কে হাদীস শরীফে বিভিন্ন রেওয়ায়েত এসেছে এবং ঝগড়া-বিবাদ থেকে বেঁচে থাকাও জরুরী।
❏ প্রশ্ন-৮০ঃ নামাযে হাই আসলে কি করা উচিৎ? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ ফতোয়ায়ে দুর্রুল মুখতারে আছে,
وامساك فمه عند التثائب فائدة لدفع التثائب مجربة ولو بأخذ شفتيه بمسته فان لم يقدر غطائه بظهر يده اليسرىٰ وقيل باليمنى لوقائما والافيسراهُ .
‘নামাযরত অবস্থায় যদি কারো হাই আসে, তার জন্য মুস্তাহাব যে, সাধ্যানুযায়ী তা বারণ বা দমন করা; আর যদি দমন করা সম্ভব না হয়, তবে ডান হাতের পৃষ্ঠ দ্বারা মুখ আবৃত করে রাখবে এবং সম্পূর্ণরূপে মুখ খুলে রাখবে না।’
111. দুররে মুখতার, সিফাতুস্ সালাত অধ্যায়; মারাকিউল ফালাহ, আদাবুস্ সালাত অধ্যায়।
জেনে রাখা আবশ্যক যে, দাঁড়ানো অবস্থায় ডান হাত ব্যবহার করবে, আর অন্যান্য রুকনগুলোতে বাম হাত ব্যবহার করবে।
❏ প্রশ্ন-৮১ঃ ফরয নামায শেষে ইমাম সাহেব তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাবেন, না কিছুক্ষণ পর দাঁড়াবেন?
✍ উত্তরঃ পাঁচ ওয়াক্ত নামায সমূহের মধ্যে ফরযের পর যে সকল নামাযে সুন্নাত ইত্যাদি আছে, সে সকল ফরয নামায শেষে ইমামের জন্য উচিত যে, তিনি তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে একটু সামনে-পিছনে কিংবা ডানে-বামে সরে সুন্নাত আদায় করা। লম্বা মুনাজাত বা দীর্ঘ দু‘আ-আদিয়্যাহ্ পাঠ করা অনুচিত ও সুন্নাতের খেলাফ।
اذا فرغ من الظهر والمغرب والعشاء يشرع فى السنة ولايشتغل بادعية طويلة. وفى الهندية اذا فرغ من الظهر والمغرب والعشاء يشرع فى السنة ولايشتغل بادعية طويلة .
‘জোহর, মাগরিব ও এশার ফরয নামাযের পর সুন্নাত পড়া আরম্ভ করবে। দীর্ঘ দু‘আ বা মুনাজাত করবে না। ফতোয়ায়ে হিন্দিয়াতে আছে, যে সব নামাযের পর সুন্নাত রয়েছে যেমন- জোহর, মাগরিব, এশা ওই সকল ফরয নামাযের পর লম্বা দোয়া বা মুনাজাত না করে সুন্নাত নামায আদায় করবে।’
112. ফতওয়া তাতারখানিয়া, খন্ড-১ম, তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ নামাযের সুন্নাত সমূহের বর্ণনা।
❏ প্রশ্ন-৮২ঃ ফরয নামায শেষে ডান হাত মাথার ওপর রেখে কোনো বিশেষ দু‘আ ইত্যাদি পাঠ করার শরয়ী হুকুম কি?
✍ উত্তরঃ হ্যাঁ! হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ফরয নামায শেষে তাঁর মাথার ওপর ডান হাত মুবারক রেখে এ দু‘আটি পাঠ করতেন,
بسم الله الذى لا الٰه الّا هو الرحمٰن الرحيم . اللهم ادفع عنى الهمّ والحزن برحمتك يا ارحم الراحمين .
অতএব এটা হুযূর মোস্তফা(ﷺ) এর সুন্নাত যে, ফরয হোক কিংবা সুন্নাত যে কোন নামাযের পর নিজের ডান হাত মাথার ওপর রেখে উপরিউক্ত পবিত্র দু‘আ পাঠ করা উচিত। হিস্নে হাসীন গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, হুযুর (ﷺ) যখন নামায শেষ করতেন তখন ডান হাত মাথার ওপর বুলায়ে এই দু‘আ পড়তেন।
كان رسول الله صلى الله عليه وسلّم اذا صلّى وفرغ عن صلواته ويمسح بيمينه على راسه قالঃ بسم اللهِ الذى لا اله الّا هو الرحمٰن الرحيم اللهم اذهب عنى الهمّ والحزن-
❏ প্রশ্ন-৮৩ঃ রমযান মুবারক ছাড়া বিতির নামায জামাতে পড়ার হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ শরহে ইলিয়াস ১ম খন্ডর ২৪২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
ان الاقتداء فى الوتربالامام خارج رمضان جائز-
‘পবিত্র রমযান ছাড়া বিতির নামায ইমামের পিছনে জামাত সহকারে আদায় করা জায়েয।’
قال ابن عابدين ويمكن ان يقال الظاهر ان الجماعة فيه اى الوتر غير مستحبة ثم ان كان ذٰلك احياناكما فعل عمر رضى الله عنه كان مباحًا غير مكروه وان كان على سبيل المواظبة كان بدعة مكروهة لانه خلاف المتوارث .
ولو صلوٰ الوتر بجماعة فى غير رمضان فهو صحيح مكروه كالتطوع فى غير رمضان بجماعة، وقيّده فى الكافى بان يكون على سبيل التداعى .
অবশ্য রমযান শরীফে বিতির নামায জামাত সহকারে আদায় করা সকল ইমামের ঐকমত্যে সুন্নাত। রমযান মুবারক ব্যতীত বিতির জামাতে আদায় করা মাকরূহ সমেত শুদ্ধ। যেরূপ রমযান এর বাইরে নফল নামায জামাতে পড়া মাকরূহ। অবশ্য যদি ডাকাডাকি ছাড়া হঠাৎ পড়ানো হয় যেমন আমিরুল মু’মিনীন হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) পড়িয়েছিলেন, তাহলে মাকরূহ ছাড়া মুবাহ হবে।
113. ফতওয়া শামী, নফল নামাযে ইকতিদা করা মাকরূহ অধ্যায়, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৮।
হ্যাঁ! কাফি প্রণেতা উল্লেখ করেন যে, নফল নামায যদি এমন হয় যে, কোনো ডাকা-ডাকি ছাড়াই সমবেত হয় (যেমন- শবে বরাত), তবে এমতাবস্থায় জামাতে পড়া জায়েয। ‘শরহে ইলিয়াস’-এর ইবারত দ্বারা জায়েয প্রমাণিত হয় এবং অধিকাংশ ফোকাহা-ই কিরামও মূল নামায জায়েয হওয়ার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। হ্যাঁ! যদি পরস্পর ডাকাডাকি করে সব সময় জামাতে আদায় করে, তাহলে মাকরূহ হবে।
114. বাহরুল রায়েক, নফল অধ্যায়, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৭০;
আল জওহিরাতুন নায়্যিরা, কিয়ামে রমযান অধ্যায়, খন্ড-১, পৃষ্ঠা ১২০।
❏ প্রশ্ন-৮৪ঃ পাগড়ি ছাড়া ইমাম শুধু টুপি পরে নামায পড়া এবং পড়ানো কি জায়েয? এতে নামাযের সওয়াবে তারতম্য বা কম-বেশি হবে কিনা?
✍ উত্তরঃ পাগড়ি ছাড়া শুধু টুপি পরিধান করে নামায পড়া এবং পড়ানো জায়েয। এতে কোন ধরনের মাকরূহ হবে না।
قال فى شرح التنوير فى مكروهات الصلواة ، وصلاته حاسرًا اى كاشفًا راسه للتكاسل ولابأس به للتذلل واما للاهانة بها فكفر ولو سقطت قلنسوته فاعادتها أفضل .
‘উক্ত ইবারত দ্বারা বুঝা গেল যে, অবমাননাকর অবস্থায় না হলে খালি মাথায় নামায পড়লে মাকরূহ হবে না। তাই টুপি পরে নামায পড়াতে মাকরূহ হওয়ার কোন অবকাশ নেই। আর অবমাননার মানসে খালী মাথায় নামায পড়লে কুফরী হবে। তাই টুপি পড়ে গেলে তা উঠিয়ে নেয়া উত্তম।’
এমনকি ولو سقطت قلنسوته ,এর ব্যাপারে ব্যাখ্যাকার (رحمه الله تعالي ) টুপি ছাড়া নামায মাকরূহ হওয়ার হুকুম আরোপ করেননি, যা মাকরূহ না হওয়ারই দলিল। অবশ্য যে ব্যক্তি পাগড়ি ছাড়া মজলিশে আসতে লজ্জাবোধ করে, এমন ব্যক্তির জন্য শুধু টুপি পরে নামায পড়া মাকরূহ হবে।
বিভিন্ন রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত যে, হযরাত সাহাবা-ই কিরাম (رضى الله تعالي عنه) এবং পূর্ববর্তী ইমামগণ হতে টুপি পরে নামায পড়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন বুখারী শরীফে উল্লেখ আছে,
وضع ابو اسحاق قلنسوته فى الصلواة ورفعها .
‘আবু ইসহাক নামাযে তাঁর টুপি মাথায় উঠায়ে নিলেন।’
115. সহীহ্ বুখারী, খন্ড-১ম, পৃষ্ঠা-১৫৯।
যদিও এখানে ইমাম বুখারী (رحمه الله تعالي )-এর উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। কিন্তু এতে এ বিষয়টিও প্রমাণিত হয়ে যায়। বুখারী শরীফের অন্যত্র উল্লেখ আছে,
قال الحسن كان القوم يسجدون على العمامة والقلنسوة .
‘ইমাম হাসান (رضى الله تعالي عنه) বলেন, লোকেরা পাগড়ি ও টুপি পরিধান করে নামায আদায় করতেন।’
116. সহীহ্ বুখারী, খন্ড-১ম, পৃষ্ঠা-৫২।
শরহে বেকায়ার ব্যাখ্যাগ্রন্থ ওমদাতুর রি‘আয়া গ্রন্থে আছে,
وكلا ذكروا ان المستحب ان يصلى فى قميص وازار وعمامة لايكره والاكتفاء بالقلنسوة ولاعبرة لما اشتهر بين العوام من كراهة ذلك وكذا ما اشتهر ان المؤتم لوكان معتما بعمامة والامام مكتفيا على قلنسوة لايكره .
যদিও সুন্নাত ও মুস্তাহাব হওয়ার দরুন পাগড়ি পরিধান করে নামায পড়া উত্তম- চাই ইমাম হোক বা মুক্তাদি, নামাযে হোক বা নামাযের বাইরে সব সময় পাগড়ি ব্যবহার করা সুন্নাত, এতদ্সত্ত্বেও পাগড়ি বিহীন শুধু টুপি পরে নামায পড়া এবং ইমামতি করা মাকরূহ ছাড়াই শুদ্ধ।
আর যদি মুকতাদিরা পাগড়ি বাঁধে এবং ইমাম শুধু টুপি পরিধান করে নামায পড়ায়, তাতেও মাকরূহ হবে না।
117. শরহে বেকায়ার ব্যাখ্যাগ্রন্থ উমদাতুর রেয়ায়াহ, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৯৮।
যেমন ‘ওমদাতুর রি‘আয়া’ শরহে বেকায়া কিতাবের আনুষাঙ্গিক আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়।
❏ প্রশ্ন-৮৫ঃ হুযূর মোস্তফা(ﷺ) অসুস্থাবস্থায় হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه)-এর পিছনে নামায আদায় করেছিলেন। তখন তাঁর মাথায় পবিত্র পাগড়ি ছিল না কি টুপি?
✍ উত্তরঃ সীরাতে মুহাম্মদীয়াতে উল্লেখ আছে যে, তখন হুযূর মোস্তফা(ﷺ) এর পবিত্র মাথায় পাট্টী বা ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল।
وروىٰ الطبرانى والبيهقى عن الفضل بن عباس رضى الله عنهما قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلّم شدوا راسى لعلى اخرج الى المسجد فشدوا راسهُ بعصابة ثم خرج .
‘তাবরানী ও বায়হাকী শরীফে হযরত ফযল বিন আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযূর (ﷺ) এরশাদ করেন, তোমরা আমার মাথা ব্যান্ডেজ করে দাও যাতে আমি মসজিদে যেতে পারি। তাঁর মাথা শক্তভাবে বেঁধে দেয়া হলো অতঃপর তিনি মসজিদের দিকে বের হলেন।’
118. খাইরুল ফতওয়া, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২৫০।
❏ প্রশ্ন-৮৬ঃ মু’মিনের জন্য নামায মি‘রাজ হওয়া কি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত? দলিলসহ বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ নামায মু’মিনের জন্য মি‘রাজ হওয়া হুযূর মোস্তফা(ﷺ) -এর স্পষ্ট বাণী দ্বারা প্রমাণিত- একথা আমি (লেখক) অধম নগন্যের নযরে পড়েনি। হ্যাঁ! অবশ্য কতিপয় বিশুদ্ধ রেওয়ায়েত এবং কিছু সুফিয়া-ই কিরামের বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ্ তা‘আলার নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের নাম মি‘রাজ।
এক হাদীসে হুযূর (ﷺ) ইরশাদ করেন, বান্দার সবচেয়ে অধিক আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয় সিজদারত অবস্থায়। কতেক সুফিয়া-ই কিরাম বলেন, الصلواة معراج المؤمنين অর্থাৎ- ‘নামায মু’মিনের মি‘রাজ’।
❏ প্রশ্ন-৮৭ঃ এশার নামাযের সঠিক সময় দলিলসহ বর্ণনা কর।
অর্থাৎ-এশার নামায শফক বা লালিমা অস্ত যাওয়া হতে ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে এশার নামায পড়া জায়েয। কিন্তু ‘মজমুয়ায়ে ফতোয়া’ (উদুর্, ২য় খন্ড এইচ এম সাঈদ করাচি থেকে প্রকাশিত) গ্রন্থে উল্লেখ আছে, এশার নামায অর্ধ রাতের পর পড়া মাকরূহে তাহ্রিমী এবং সকালে তা পুনরায় পড়ে নেয়া ওয়াজিব। মূলতঃ অর্ধ রাতের পর নামাযই হবে না, অথচ এটা নামাযেরই ওয়াক্ত দলিলসহ বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ এশার নামায অর্ধরাত পর্যন্ত বিলম্ব করে পড়ার ব্যাপারে ওলামাগণের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে।
কারো মতে, অর্ধরাত পর্যন্ত বিলম্ব করা মাকরূহে তাহরীমী। যে কোন নামায মাকরূহে তাহরীমীর সাথে আদায় করলে, তা পুনরাবৃত্তি করা ওয়াজিব। আবার কারো মতে, মাকরূহে তানযীহি। যার কারণ জামাতে লোকসংখ্যা কমে যায়। মাকরূহে তানযীহির পরিণতি হলো খেলাফে আওলা বা অনুত্তম। এ অভিমতটি গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত।
অতএব অর্ধরাতের পরও এশার নামায আদায় করা জায়েয এবং পুনরায় পড়ে নেয়াও ওয়াজিব নয়, বরং উত্তমের বিপরীত।
ان الكراهة فى تاخير العشاء تنـزيهية وهو الاظهر .
‘ফতাওয়ায়ে শামীতে উল্লেখ আছে- এশার নামায বেশী বিলম্ব করা অনুত্তম আর এটাই স্বতঃসিদ্ধ।’
119. রদ্দুল মুহতার, সালাত পর্ব, নামাযের আওকাত অধ্যায়, খন্ড-১ম, পৃষ্ঠা-২৬৯।
وفى الغياثية بعده الى نصف الليل مباح غير مكروه، قال الطحطاوى بعد نصف الليل الى طلوع الفجر مكروه ، اذا كان التاخير بغير عذر-
‘পক্ষান্তরে গিয়াছিয়া গ্রন্থে উল্লেখ আছে-এশার নামায অর্ধ রাত্রি পর্যন্ত বিলম্ব করা অনায়াসে জায়েয। ইমাম তাহ্তাবী বলেন, কোন শরয়ী ওজর ছাড়া অর্ধ রাত্রের পর ফজর পর্যন্ত বিলম্ব করা মাকরূহ।’
120. ফতওয়া তাতারখানিয়া, সালাত অধ্যায়, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৪০৬।
❏ প্রশ্ন-৮৮ঃ মাগরিবের নামায তাড়াতাড়ি পড়ার ফযিলত দেখে কিছু সংখ্যক লোক প্রবঞ্চনার স্বীকার হয় যে, মাগরিবের নামাযের সময় অতীব সংক্ষিপ্ত! সাধারণত মাগরিবের নামাজের সময়সীমা কতটুকু হওয়া উচিত? দলিলসহ বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ মাগরিবের নামাযের সময় ফিকহে হানফি মতে, সূর্যাস্ত হতে শুরু হয়ে পশ্চিম আকাশে লাল রেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকে। ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي )-এর মতে, সাদা রেখা অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে। মাগরিবের সময় মৌসুম ও বিভিন্ন এলাকার তারতম্যে দূরে-কাছের আনুপাতিক তারতম্যে কার্যকর হয়ে থাকে। এমনকি কোনো এলাকায় এক ঘন্টা তিন মিনিট, কোনো জায়গায় এক ঘন্টা পনের মিনিট এবং আবার কোথাও এক ঘন্টা বিশ মিনিট মাগরিবের সময় হয়। সাধারণত মাগরিব ও এশার মাঝখানে দেড় ঘন্টা সময়ের ব্যবধান হয়ে থাকে।
তবে মাগরিবের নামায পশ্চিমাকাশের লালিমা ডুবে যাওয়ার পূর্বে পড়ে নেয়া উচিৎ। যাতে ইমামগণের মতবিরোধ থেকে বাঁচা যায়। অবশ্য মুসাফির অথবা ওজর-আপত্তি ও অসুস্থ লোকের জন্য সাদা রেখার মধ্যে পড়ার অনুমতি আছে।
121. ফতওয়ায়ে শামী, কিতাবুস সালাত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৬১।
শরহে বেকায়ায় আছে,
وعند ابى حنيفة الشفق هو البياض الذى يلى الحمرة، هكذا فى القدورى .
‘ইমাম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي )’র মতে শফক অর্থ হচ্ছে, লালিমা অস্তমিত হওয়ার পর সাদা লালিমা ডুবা পর্যন্ত থাকে।’
মাসআলাঃ সূরা ফাতিহা থেকে যদি একটি অংশও ভুলক্রমে বাদ পড়ে, তবে সিজদা সাহু ওয়াজিব হবে। যেমন- নামাযের প্রথম রাকাতে যদি সূরা ফাতিহা থেকে اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ ভুলক্রমে বাদ পড়ে, এতে সিজদা সাহু ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ ফরযসমূহের প্রথম দুই রাকাত, সুন্নাত, বিতির এবং নফল নামাযের সকল রাকাতে সূরা ফাতিহা থেকে একটি অক্ষরও যদি বাদ পড়ে, তবে সিজদা সাহু ওয়াজিব হবে। যদি সিজদা সাহু আদায় না করে, তাহলে নামায পূনরায় পড়া ওয়াজিব হবে।
122. দুর্রুল মুহতার শামী, باب كل صلواة اديت مع كراهة , খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৪৫।
❏ প্রশ্ন-৮৯ঃ ইস্তিসকার নামায ছাড়া অন্য কোন শরয়ী পদ্ধতি অনুমোদন আছে কিনা? অর্থাৎ- কোনো কোনো এলাকায় ইস্তেসকার নামাযের পরিবর্তে এ নিয়ম প্রচলিত আছে, এশার নামাযের পর এক ব্যক্তি সূরা ইয়াসীন শরীফ শুরু থেকে প্রথম মুবীন পর্যন্ত তিলাওয়াত করে। অতঃপর এক ব্যক্তি উচ্চকন্ঠে নামাযের সুন্নাত আযানের মত আযান দেয়া শুরু করে এবং আরো অনেক কিছু করে। পরিশেষে এক লম্বা দু‘আর মাধ্যমে এর যবনিকাপাত করে। বৃষ্টির জন্য এ ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ করা কী জায়েয?
✍ উত্তরঃ ইস্তিসকার নামাযের পরিবর্তে এমন নিয়ম সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়। হ্যাঁ! যদি কোন আল্লাহর সাহেবে বেলায়ত ওলি ও দরবেশ-বুযূর্গ কোনো বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেন, তাহলে সেটা হবে তাঁর জন্য খাস। সর্বসাধারণের জন্য নয়। সার্বজনীন নিয়ম যা প্রচলিত আছে তা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। বৃষ্টিবর্ষণ মহান আল্লাহ তা‘আলার দয়া, মেহেরবানী ও অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল এবং এটা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি যা চান তাই করেন- فَعَّالٌ لِمَا يُرِيْدُ আল্লাহ'র নিকট দু‘আ প্রার্থনা করা, বৃষ্টি চাওয়া- এটা প্রত্যেক সময়, প্রত্যেক অবস্থায় এবং যে কোনো পদ্ধতিতে জায়েয, বৈধ, মুসতাহসান ও মনদুব।
❏ প্রশ্ন-৯০ঃ মাগরিবের নামাযে দীর্ঘ সূরা পাঠ করার বিধান কী? অথচ প্রায় সকল কিতাবে মাগরিবের নামাযে ছোট সূরা পড়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। লম্বা ক্বিরাত পড়লে নামাযের কোন ক্ষতি হবে কি না?
✍ উত্তরঃ هوالمستعان ইমাম সাহেব মুক্তাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে ক্বিরাত পড়া উত্তম। কারণ মুকতাদিদের মধ্যে কোনো অসুস্থ ও দুর্বল লোক থাকতে পারে। তাই ফোকাহা-ই কিরাম রাহিমাহুমুল্লাহ নামাযে লম্বা ক্বিরাতকে মাকরূহ বলেছেন। অবশ্য দীর্ঘ ক্বিরাতে নামাযের ওপর কোন প্রভাব পড়বে না। স্বয়ং নবী করীম মাগরিবের নামাযে বেশ কয়েকবার সূরায়ে তুর এবং সূরায়ে মুরসালাত পড়েছেন।
হযরত ইমাম হাম্মাদ ইবনুল হাসান আশ-শরন্বলালী (رحمه الله تعالي ) বলেন,
وكره للامام تطويل الصلواة لما فيه من تنفير الجماعة لقوله عليه السلام من ام فليخفف . قال العلامة احمد الطحطاوى تحت قول تطويل الصلاة بقرأة او تسبيح او غيرهما.
‘শরন্বলালী গ্রন্থে ইমাম হাম্মাদ বলেন, ইমামের জন্য লম্বা কেরাত পড়া ঠিক নহে। কেননা এতে জমাতে মুসল্লিদের বিরক্তি আসে। হাদিস শরীফেও হুযূর এরশাদ করেন, যিনি ইমামতি করবেন তিনি যেন কিরাত, রুকু, তাসবীহ্ সর্বত্রই সংক্ষেপ করেন। ইমাম তাহ্তাবী বলেন, শুধু কিরাত নয়।’
123. তাহত্বাবী, বাবুল ইমামত, পৃষ্ঠা-২৪৬।
ফতোয়ায়ে শামীতে আছে,
ويكره تحريما تطويل الصلواة على القوم زائدًا على قدر السنة فى قرأة واذكار رضٰى القوم الخ .
‘ফাত্ওয়ায়ে শামীতে উল্লেখ আছে, জামাতে ইমামতি করাতে যেন কেরাত লম্বা না করে অবশ্যই তা সুন্নাত মোতাবেক এবং কেরাত, রুকু, সিজদাহ্ ও তাসবীহ পড়াতে মুসল্লিদের অবস্থাভেদে করা হয়, নচেৎ মাকরূহ হবে।’
124. রদ্দুল মুখতার, বাবুল ইমামত, খন্ড-১ম, পৃষ্ঠা-৫৬৪।
عن جبير بن مطعم عن ابيه قال سمعتُ رسول الله صلى الله عليه وسلّم يقرأ فى المغرب بالطور، عن ام الفضل بنت الحارث قالت سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلّم يقرأ بالمغرب بالمرسلات-
হযরত যোবায়ের বিন মুতয়িম (رضى الله تعالي عنه) স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি হুযূর কে মাগরিবের নামাযে সূরায়ে তূর পড়তে শুনেছি। হযরত উম্মুল ফযল বিনতুল হারিস (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হুযূর কে মাগরিবের নামাযে সূরাতুল মুরসিলাত পড়তে শুনেছি।
125. সহীহ মুসলিম, খন্ড-১ম, মাগরিবের নামাযে কিরাত অধ্যায়, পৃষ্ঠা-১৮৭; সহীহ বুখারী শরীফ (উভয় হাদীস বর্ণিত), খন্ড-১ম, মাগরিবের নামাযে কিরাত বড় করে পড়ার অধ্যায়, পৃষ্ঠা-১০০; অনুরূপ আল-জওয়াহারাতুন্ নায়্যিরাহ্, খন্ড-১ম, পৃষ্ঠা-৭৫; অনুরূপ মেশকাত শরীফে, খন্ড-১ম, পৃষ্ঠা-৭৯।
❏ প্রশ্ন-৯১ঃ এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে অপবাদ দিল যে, তুমি (নিজ ভাইয়ের স্ত্রীর) ভাবির সাথে অপকর্ম বা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে। অথচ উক্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। এখন শরয়ী বিধান মতে অভিযুক্ত ব্যক্তির পিছনে ইকতিদা করা জায়েয হবে কি না?
✍ উত্তরঃ বাস্তবিক পক্ষে যদি প্রশ্ন সঠিক হয় এবং এটা পক্ষান্তরে ভিত্তিহীন অভিযোগ। অভিযোগকারী ব্যক্তি যদি তাওবা না করে, তাহলে অপবাদ দেয়ার কারণে উক্ত ব্যক্তি ফাসেক হিসেবে গণ্য হবে। অতএব দ্বীনদার মুত্তাকী ও পরহেজগার লোক তার পেছনে ইক্তিদা করা মাকরূহে তাহরীমী। হ্যাঁ! একথা স্মরণ রাখবে যে, একাকী নামায পড়ার চেয়ে ফাসেকের ইকতিদায় জামাতে নামায পড়া উত্তম।
ولو صلى خلف مبتدع او فاسق فهو محرز ثواب الجماعة لكن لا ينال مثل ما ينال خلف تقى.
‘কেউ যদি ফাসেক বা বিদআতীর পেছনে নামায পড়ে সে জামাতের সাওয়াব পাবে। কিন্তু মুত্তাকি ইমামের ইকতিদার সমতুল্য সাওয়াব পাবে না।’
126. খোলাসাতুল ফাতওয়া, পঞ্চদশ পরিচ্ছেদঃ ইমামের ইকতিদা প্রসঙ্গে, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৫০।
❏ প্রশ্ন-৯২ঃ নামাযে আরবী ছাড়া অন্যান্য ভাষায় দু‘আ করার বিধান কী? যদি কোন ব্যক্তি নামাযে আরবী ছাড়া বাংলা, উদুর্ ইত্যাদি ভাষায় আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করা আরম্ভ করে, এতে নামাযের ওপর কোন প্রভাব পড়বে কি না?
✍ উত্তরঃ সুন্নাত তরিকা এই যে, নামাযে শুধু আরবী ভাষায় দু‘আ করা উচিত। যদি ভিন্ন কোন ভাষায় দু‘আ করা হয়, তাহলে নামায মাকরূহ তানযিহী সাথে জায়েয হবে। جائز مع الكراهة অর্থাৎ-খেলাফে আওলার সাথে নামায জায়েয হবে।
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (رحمه الله تعالي ) বলেন,
وظاهر التعليل ان الدعاء بغير العربية خلاف اولٰى وان الكراهة تنزيهية .
‘মূল কারণ হচ্ছে, আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় দু‘আ করা অনুত্তম বা খেলাফে আওলা। মাকরূহ বলতে মাকরূতে তানযিহী উদ্দেশ্য।’
127. রদ্দুল মুহ্তার, খন্ড-১ম, পৃষ্ঠা- ৫৬১; আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় দু‘আ প্রসঙ্গে, বাবে সিফাতুল সালাত; আস্-সে‘আয়া; খন্ড-২য়, পৃষ্ঠা- ২৪৫, বাবে সিফাতুল সালাত।
আল্লামা আবদুল হাই লৌক্ষ্মভী (رحمه الله تعالي ) বলেন,
ومنها ان يدعوا بالعربية ليكون اقرب الى الاجابة، فان اللسان العربى من الفضل ماليس لغيره .
‘আরবী ভাষায় দু‘আ করলে কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। আরবী ভাষায় যে ফযিলত ও মাহাত্ম্য রয়েছে তা অন্য ভাষায় নেই।’
128. ফাতওয়ায়ে আবদুল হাই, খন্ড-২য়, পৃষ্ঠা- ২৪৫; ফাতওয়ায়ে হাক্কানিয়্যাহ্, খন্ড-৩য়, পৃষ্ঠা-২০৯।
❏ প্রশ্ন-৯৩ঃ জামার আস্তিন বা হাতা কনুইর উপরে উঠিয়ে নামায পড়ার হুকুম কী? এতে নামায মাকরূহ হবে কি না?
✍ উত্তরঃ وبالله التوفيق উভয় হাতের কনুইয়ের উপরে আস্তিন উত্তোলন করে নামায পড়া মাকরূহ। যেমন,
ولو صلّى رافعًا كميه الى المرافقين كره-
‘কেউ হাতের কনুইয়ের উপরে আস্তিন তুলে নামায পড়লে মাকরূহ হবে।’
129. ফতওয়ায়ে কাজী খান, আল-হিন্দীয়া, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ- নামাযে যেসব কাজ মাকরূহ, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২৬; আল-বাহরুর রায়েক্ব, অধ্যায়- যে সব কাজসমূহ করলে নামায ভঙ্গ ও মাকরূহ হয়, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২৪; রদ্দুল মুহতার, অধ্যায়- নামাযের মাকরূহসমূহ, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২৪।
❏ প্রশ্ন-৯৪ঃ হজ্ব মৌসুমে আরাফাতের ময়দানে হানাফী মাযহাবের অনুসারী হাজীদের, মুকীম বা স্থায়ী বাসিন্দা ইমামের পিছনে নামায পড়া জায়েয হবে কি না?
✍ উত্তরঃ وبه نستعين হানাফী মাযহাব মতে, মুসাফিরের জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বের কম হলে নামায কসর পড়া জায়েয নেই। অতএব যে ইমাম মুকীম হওয়া সত্ত্বেও কসর নামায পড়াবে, হানাফি মাযহাব অনুসারী মুকতাদির নামায উক্ত ইমামের পিছনে জায়েয হবে না।
যেমন, আল্লামা শামী (رحمه الله تعالي ) বলেন,
لو كان مقيمًا كامام مكة صلى بهم صلواة المقيمين لايجوزله القصرو لا للحجاج الاقتداء به .
আল্লামা শামী বলেন, হজ্ব মৌসুমে মক্কা শরীফের ইমামের মত ইমাম যদি মুকীম হয় তিনি মুক্তাদীদের নিয়ে মুকীমের নামাযই পড়বেন। কছর করা জায়েয হবে না। হাজীদেরও উক্ত ইমামের পিছনে একতেদা সহীহ নহে।’
130. রদ্দুল মুহতার, কিতাবুল হজ্ব, খন্ড-২, পৃষ্ঠা- ৫০৫; আল-কবীর, অধ্যায়- মুসাফিরের নামায, পৃষ্ঠা-৫৯১।
ফাত্ওয়ায়ে রহিমিয়ায় আবদুর রহীম লাজপুরী (رحمه الله تعالي ) বলেন, আরাফাত ময়দানে হানাফি ইমাম মুকীম হওয়া সত্ত্বেও যদি নামায কসর পড়ে, তাহলে হানাফি মুকতাদির নামায উক্ত ইমামের পিছনে জায়েয হবে না; মুকতাদি মুসাফির হোক বা মুকীম।
131. ফতওয়া রহিমীয়া, খন্ড-১, অধ্যায়- মুসাফিরের নামায, পৃষ্ঠা- ১৫৯।
❏ প্রশ্ন-৯৫ঃ ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে সাউদি আরবে পনের দিনের ভিসা নিয়ে যারা পবিত্র মক্কা ও মদিনা মুনাওয়ারা গমন করেন, তারা নামায পুরো পড়বেন না কসর পড়বেন?
✍ উত্তরঃ ইকামতের নিয়তের জন্য একই স্থানে পনের দিনের নিয়ত করা জরুরি। প্রশ্নোলিখিত বিবরণ মোতাবেক তারা বিভিন্ন স্থানে পনের দিন অবস্থান করবেন, তাই তাদের ইকামতের নিয়ত গ্রহণযোগ্য ও শুদ্ধ হবে না। বরং তারা কসর নামাযই আদায় করবে।
দুররুল মুহতারে উল্লেখ আছে,
لودخل الحاج مكة لايام العشر لم تصح نيته لانه يخرج الى منٰى وعرفة فصار كنية الاقامة فى غير موضعها .
‘যিলহজ্ব মাসের ১ম দশ দিনে কোন হাজী মক্কায় প্রবেশ করলে মুকিমের নিয়ত করা সহীহ হবে না। কেননা সে তো ওইদিনগুলোতেই মিনা আরাফাতে যাবে। সুতরাং সে মুসাফির থাকবে।
132. ফতওয়ায়ে শামী, কিতাবুল মুসাফির, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১২৬।
হিদায়া গ্রন্থে উল্লেখ আছে,
واذا نوى المسافر ان يقيم بمكة ومنىٰ خمسة عشر يومًا، لم يتم الصلواة لان اعتبار النية فى موضعين يقتضىٰ اعتبارها فى مواضع وهو متمنع ، ومثله فى الهندىة .
‘কোন মুসাফির যদি মক্কা ও মিনায় পনের দিন অবস্থান করার নিয়ত করে, সে নামায পুরা পড়বে না। কেননা দুই জায়গায় নিয়ত করা মানে বিভিন্ন জায়গার নিয়ত করা যা মুকিম হওয়াকে বাধা সৃষ্টি করে। অর্থাৎ মুকীম হবে না। অনুরূপ ফাতওয়া হিন্দিয়াতে রয়েছে।’
133. হিদায়া, কিতাবুল মুসাফির, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৪৭।
❏ প্রশ্ন-৯৬ঃ মুসাফির ভুলক্রমে দু’রাকাতের পরিবর্তে চার রাকাতের নিয়ত করলে, এ ক্ষেত্রে তার করণীয় কি? সে নিয়ত অনুযায়ী চার রাকাত আদায় করবে, না দু’রাকাত?
✍ উত্তরঃ একথা স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, নামাযের নিয়ত করার সময় নামায এবং ওয়াক্ত নির্ধারণ করা আবশ্যক। রাকাতের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা জরুরী নয়। এটা প্রসঙ্গত এমনিতেই এসে যাবে।
যেহেতু মুসাফিরের ওপর মাত্র দু’রাকাত ফরয, তাই নামাযের নিয়তও মুসাফির হিসেবে হবে। যদিও ভুলবশতঃ মুখে রাকাতের সংখ্যা বেশি উচ্চারিত হয়, তা গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং ঐ ব্যক্তি কসর নামায আদায় করবে। ফতোয়া শামীতে আছে,
لابد من التعين عند النية دون التعين عدد ركعاته لحصولها ضمنا فلا يضر الخطأ فى عددها-
‘মুসাফির ভুলক্রমে দুই রাকআতের স্থলে চার রাকআত এর নিয়ত করলেও দুই রাকআতই পড়বে। এখানে সংখ্যার কোন গুরুত্ব হবে না।’
134. দুররুল মুখতার সহ রদ্দুল মুহতার, বাবু শুরুতত্ সালাত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা- ৪১৮-৪২০; ফাতওয়া হিন্দিয়া, চতুর্থ অধ্যায়- নিয়ত প্রসঙ্গে, খন্ড-১, পৃষ্ঠা- ১৬৬।
❏ প্রশ্ন-৯৭ঃ মুসাফির ইচ্ছাকৃতভাবে পুরা চার রাকাত পড়লে তার নামাযের হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ هو المتسعان সফরে নামায কসর করা আইনসিদ্ধ এবং আল্লাহর পক্ষ হতে পুরস্কার ও অশেষ রহমত। এতে নিজের পক্ষ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত কিছু করা, আল্লাহ্ তা‘আলার ইহসান ও দয়া অগ্রাহ্য করার শামিল। সুতরাং এটা গোনাহ ও না-ফরমানী। অতএব যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে সফরে পুরা নামায আদায় করবে সে গোনাহগার হবে এবং তার ওপর তাওবা ওয়াজিব হবে।
135. হেদায়া, কিতাবুল মুসাফির, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৪৬।
ان صلى اربعًا و قعد فى الثانية قدر التشهد اجزئه الاوليان عن الفرض والآخريان له نافلة اعتبارًا بالفجر، ويصير مسيئا لتاخير السلام .
‘মুসাফির যদি চার রাকআত পড়ে ফেলে এবং দ্বিতীয় রাকআতে তাশাহুদ পরিমাণ বসে, তাহলে ঐ প্রথম দু’রাকআত ফরয হিসেবে আদায় হয়ে যাবে। আর পরবর্তী দু’রাকআত নফল হবে ফজরের নামাযের মত। দুই রাকআতের স্থলে চার রাকআত পড়তে গিয়ে সালামে বিলম্ব হওয়ায় গোনাহগার হবে।’
136. দুর্রুল মুখতার, কিতাবুল মুসাফির, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১২৮।
❏ প্রশ্ন-৯৮ঃ দু’জন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি দুই শহরে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বাস করে, একজন অপরজনের নিকট গেলে তারা উভয়ই কী নামায কসর পড়বে?
✍ উত্তরঃ শরীয়তের বিধান মতে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আলাদা আলাদা বাসস্থান গ্রহণযোগ্য হবে। যখন তাদের উভয়ের মূল বাসস্থান পৃথক পৃথক, তাই উভয়ই একজন অন্যজনের নিকট গেলে মুকীম হবে না, বরং মুসাফির হিসেবে কসর আদায় করবে।
137. দুর্রুল মুখতার, বাবু সালাতিল মুসাফির, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১৩২।
তারাবীহ নামাযের বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-৯৯ঃ হুযূর সৈয়্যদুল মুরসালীন (ﷺ) তারাবীহ কত রাকাত পড়েছেন? বিশ রাকাত তারাবীর পক্ষে বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ حامدًا ومصليًا মুসান্নিফে ইবনে আবি শাইবা, তাবরানী এবং বায়হাকী শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে,
روىٰ ابن ابى شيبة فى مصنّفه والطبرانى فى معجمه والبيهقى من حديث ابراهيم بن عثمان عن ابن ابى شيبة عن الحكم عن مقسم عن ابن عباس رضى الله تعالىٰ عنهما ان النبى صلى الله عليه وسلّم كان يصلى رمضان عشرين ركعة سوىٰ الوتر-
‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ রমযান শরীফে বিতির ছাড়া তারাবীহ নামায বিশ রাকাত পড়তেন।’
138. النهى نصب الراية , খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১৫৩।
হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه)-এর যামানায় তারাবীহ বিশ রাকাত পড়া হতো। অতএব ‘মুআত্তা ইমাম মালিক’-এ আছে যে,
كان الناس يقومون فى زمن عمر بن الخطاب رمضان بثلاث وعشرين ركعة-
‘হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (رضى الله تعالي عنه) এর আমলে লোকেরা (বিতিরসহ) তেইশ রাকাত নামায আদায় করতেন।’ এটা হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه)-এর হুকুমে আদায় করা হতো।"
139. মুআত্তা ইমাম মালেক, পৃষ্ঠা-৪০।
জানাযার বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১০০ঃ কবরের নিকট দু‘আ করার সময় কবরকে সামনে নিয়ে দু‘আ করা উত্তম, না কিবলামুখী হয়ে?
✍ উত্তরঃ শরহে শর‘আতুল ইসলামে উল্লেখ আছে,
قال فى الاحياء والمستحب فى زيارة القبور ان يقف مستدبر القبلة مستقبلًا بوجه الميت .
‘কবর যিয়ারতের সময় কিবলাকে পিছ দিয়ে কবরকে সামনে নিয়ে যিয়ারত করা মুস্তাহাব।’
140. খাইরুল ফতওয়া, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা ১৫২; ফতওয়া দারুল উলূম, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা ৪৩৪।
বর্ণিত ইবারত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, দু‘আ করার সময় কবরকে সামনে রেখে, কিবলার দিকে পীঠ করে দাঁড়িয়ে যিয়ারতের দু‘আ করা উত্তম।
❏ প্রশ্ন-১০১ঃ মাইয়্যেত বা মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর দাঁড়িয়ে দু‘আ করা উচিত কি না?
✍ উত্তরঃ মারাক্বিউল ফালাহ গ্রন্থের ৩৪১ পৃষ্ঠায় আছে,
والسنة زيارتها قائمًا والدعاء عندها قائمًا كما كان يفعل رسول الله صلّى الله عليه وسلّم فى الخروج الى البقيع .
‘দাঁড়িয়ে যিয়ারত করা এবং কবরের সামনে দাঁড়িয়ে দু‘আ করা সুন্নাত। যেমন রাসূলে কারীম(ﷺ) জান্নাতুল বাকীর দিকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে দু‘আ করতেন।’
এটা শুধু দু‘আর জন্য। যদি সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করা উদ্দেশ্য হয়, তখন বসেও দু‘আ করতে পারবে। যেমন- হাদীস শরীফ দ্বারা এটি মুস্তাহাব হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।
كما فى الدرالمختار وجلوس ساعة بعد دفنه لدعاء قرأة الخ. وفى سنن ابى داؤد كان النبى صلّى الله عليه وسلّم اذا فرغ من دفن الميت وقف على قبره الخ .
তাহ্তাবী ও ফতোয়ায়ে শামীতে আছে, যদি কবর সামনে হয়, তখন কবরের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো উত্তম ও মুস্তাহাব।
❏ প্রশ্ন-১০২ঃ মসজিদে ইতিকাফকারী জানাযার জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবে কিনা? যদি কোন ইমাম রমযান শরীফে ইতিকাফ থাকেন, জানাযার জন্য তিনি বের হতে পারবেন কিনা? যদি বের হতে না পারেন তবে কি মসজিদে জানাযা পড়াতে পারবেন?
✍ উত্তরঃ ই‘তিকাফের পূর্বে যদি এ রকম শর্ত করে থাকে যে, জানাযার নামাযের জন্য বের হবে, তখন জানাযার জন্য বাইরে যাওয়া জায়েয হবে। (কারো সাথে কথা-বার্তা বলতে পারবে না এবং ঠিক সময়ে গিয়ে জানাযা শেষে ফিরে আসতে হবে) মসজিদে জানাযার নামায পড়া মাকরূহ।
141. খাইরুল ফতওয়া, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা- ৩১৫।
❏ প্রশ্ন-১০৩ঃ দ্বিতীয়বার জানাযার নামায পড়ার বিধান কি?
✍ উত্তরঃ মৃত ব্যক্তির জানাযার নামায একবার পড়া ফরযে কিফায়াহ। অতএব যদি মৃত ব্যক্তির ওলি কিংবা কাজী নিজেই বা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে জানাযার নামায একবার আদায় করে, তা হলে দ্বিতীয়বার কিংবা কয়েকবার জানাযার নামায আদায় শরীয়ত স্বীকৃত নয়। অবশ্য যদি কোন অপরিচিত ব্যক্তি ওলীর অনুমতি ছাড়া জানাযা পড়ায় ফেলে, তখন ওলী কিংবা কাজীর অধিকার থাকবে পুনরায় জানাযা পড়ার।
ফতোয়ায়ে আলমগীরিতে আছে,
وان كان غير هولاء له ان يعيد .
‘ওলী ছাড়া অন্য কেউ জানাযা পড়ালে তখন ওলী পুনরায় পড়ার অধিকার রাখে।’
142. ফতওয়া হিন্দিয়া, পঞ্চম পরিচ্ছেদ, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৬৩।
❏ প্রশ্ন-১০৪ঃ নিয়তবিহীন জানাযার নামাযের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। যেমন- দাঁড়ানোর সময় নিয়ত করতে ভুলে গেলে, এরকম জানাযার নামায পড়ার হুকুম কি?
✍ উত্তরঃ অন্যান্য সকল নামাযের ন্যায় জানাযার নামাযেও নিয়ত আবশ্যক। সুতরাং নিয়তবিহীন পঠিত জানাযার নামাযের কোন গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা নেই।
والنية يعتبر شرطًا لصحتها.
‘নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য নিয়ত শর্ত।’
143. বাদায়েউস সানা‘য়ে, খন্ড-১, পৃষ্ঠা- ৩১৫।
❏ প্রশ্ন-১০৫ঃ সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত এবং দ্বিপ্রহরের সময় জানাযার নামায ও তিলাওয়াতে সিজদা করা জায়েয আছে কিনা?
✍ উত্তরঃ প্রশ্নোলিখিত মাকরূহ সময়ে যদি জানাযা তৈরী হয়ে যায় কিংবা তিলাওয়াতে সিজদা ওয়াজিব হয়, তাহলে এ সময় জানাযার নামায পড়া এবং তিলাওয়াতে সিজদা আদায় করা মাকরূহবিহীন জায়েয। হ্যাঁ! যদি জানাযা পূর্ব থেকে প্রস্তুত হয় কিংবা তিলাওয়াতে সিজদা উক্ত সময়ের পূর্বে ওয়াজিব হয়ে থাকে, তাহলে উক্ত সময়ে জানাযার নামায এবং তিলাওয়াতে সিজদা আদায় করা মাকরূহে তাহরিমী।
144. ফতওয়া-ই শামী।
❏ প্রশ্ন-১০৬ঃ জারজ সন্তান বা অবৈধ পন্থায় জন্মগ্রহণ করেছে এমন সন্তান মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযার হুকুম কি?
✍ উত্তরঃ যেনা বা ব্যভিচারের দোষ ও অপরাধ ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিনীর প্রতি সম্বোধিত হবে। সন্তান এ ধরনের অপরাধ থেকে দায়মুক্ত থাকবে। অতএব তার নিষ্পাপের প্রতি লক্ষ্য রেখে মুসলমানদের ওপর আবশ্যক যে, এ ধরনের সন্তান মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযার নামায পড়া। কারণ গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, এ ধরনের শরীয়ত বিরোধী গর্হিত কাজে লিপ্ত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিনীর যদি জানাযার নামায পড়া যায়, সে ক্ষেত্রে নিষ্পাপ সন্তানের জানাযা পড়া উত্তম পন্থায় জায়েয হবে।
ويصلّى على مسلم مات بعد الولادة صغيرًا كان او كبيرًا، ذكرًا كان او انثىٰ . ومثلهُ فى الشامى .
‘মুসলমান সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর মারা গেলে তার ওপর জানাযার নামায পড়া ওয়াজিব- মৃত ব্যক্তি ছোট হোক কিংবা বড়, ছেলে হোক বা মেয়ে।’
145. কনযুল উম্মাল, খন্ড-৬, হাদীস নং- ১৪১১৫; ফাতওয়ায়ে শামী, জানায়েয অধ্যায়, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২১।
❏ প্রশ্ন-১০৭ঃ জানাযার নামায পড়ানোর সবচেয়ে অধিক হকদার কে? পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের ন্যায় জানাযার নামায পড়ানোর ক্ষেত্রেও উপযুক্ততা বিবেচনা করা হবে? না এর জন্য কোন আলাদা হুকুম রয়েছে?
✍ উত্তরঃ وبـالله الـتـوفـيـق
জানাযার নামায পড়ানোর জন্য সবচেয়ে অধিক হকদার হলেন রাষ্ট্রপ্রধান বা বাদশাহ। তবে ইমামতির যোগ্যতার শর্ত সাপেক্ষে। রাষ্ট্রপ্রধানের অবর্তমানে এলাকার কাজী কিংবা মুফতি পড়াবেন। অন্যথায় মহল্লা মসজিদের ইমাম জানাযার নামায পড়াবেন। তা-ও নাহলে আত্মীয়-স্বজনের মধ্য থেকে কোন নিকটাত্মীয় জানাযার নামায পড়ানোর হকদার।
ফতোয়া হিন্দীয়াতে আছে,
اوّل الناس بالصلوٰة عليه السلطان ان حضر فان لم يحضر فالقاضى ثم امام الحى ثم الولى .
‘জানাযা নামাযের ইমামতির জন্য উত্তম ব্যক্তি হচ্ছেন রাষ্ট্রপ্রধান, যদি তিনি উপস্থিত থাকেন (ইমামতির যোগ্যতা সাপেক্ষে), তাঁর অবর্তমানে স্থানীয় কাজী তথা মুফতি পড়াবেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে মহল্লা মসজিদের ইমাম পড়াবেন, অন্যথায় মৃতের ওলি পড়াবেন।’
146. ফতওয়া হিন্দীয়া, খন্ড-১, পরিচ্ছেদ-৫, মৃতব্যক্তির উপর জানাযার নামায পড়ার বর্ণনা, পৃষ্ঠা-১৬৩।
বাদায়েউস্ সানায়ে গ্রন্থে উল্লেখ আছে,
قال علاء الدين الكاسانى وروى الحسن عن ابى حنيفة ان الامام الاعظم قالঃ السلطان احق بالصلوٰة عليه ان حضر فان لم يحضر فامير المصر، وان لم يحضر فامام الحى، فان لم يحضر فالاقرب من ذوى قرابته . وهذا هو حاصل المذهب عندنا، ومثله فى كبيرى.
‘আল্লামা আলাউদ্দিন কাসানী বলেন, ইমাম হাসান, ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) থেকে বর্ণনা করেন যে, জানাযার নামাযে রাষ্ট্রপ্রধান উপস্থিত থাকলে তিনিই ইমামতি করবেন। তাঁর অবর্তমানে ঐ শহরের আমীর পড়াবেন। তিনি না থাকলে স্থানীয় মসজিদের ইমাম পড়াবেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে মৃতের নিকটত্মীয় যোগ্য ব্যক্তি পড়াবেন। এটাই আমাদের মাযহাবের মূল রায়।’
147. বাদায়েউস্ সানায়ে, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩১৭; আল-কবিরী, জানাযা অধ্যায়, পৃষ্ঠা-৫৮৪।
❏ প্রশ্ন-১০৮ঃ নিয়তবিহীন জানাযা নামাযের কোন গ্রহণযোগ্যতা আছে কি-না?
✍ উত্তরঃ حامدًا ومصليًا নামাযের মধ্যে নিয়্যত এবং সময় নির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক। অনুরূপভাবে জানাযার নামাযেও নিয়্যত আবশ্যক। যদি ভুলে নিয়্যত করা না হয়, তবে ঐ জানাযার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। কেননা নিয়্যত ছাড়া জানাযার নামায শুদ্ধ হবে না। বাদায়েউস সানায়ে গ্রন্থে উল্লেখ আছে, والنية يعتبر شرطًا لصحتها. অর্থাৎ- ‘জানাযার নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য নিয়্যত শর্ত।’
কাফন ও দাফনের বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১০৯ঃ কোরআন শরীফের আয়াত সম্বলিত কা’বা শরীফের গিলাফের টুকরো কিংবা কালিমা খচিত কাপড় অথবা অন্য কোন বরকতময় কাপড় কাফনের সাথে তাবার্রুক হিসেবে দেয়া যাবে কি না?
✍ উত্তরঃ তাবার্রুক বা বরকত লাভের উদ্দেশ্যে দেয়া যাবে। আশা করা যায়, উপকার হবে।
وفى هذا ندب ان يجعل الثوب المتبرك فى الكفن زائدًا عليه .
‘এতে (কাফনের সাথে) বরকতময় কাপড়ের টুকরো তাবার্রুক হিসেবে দেয়া উত্তম।’
148. রাসাইলুল আরকান, মুহাম্মদ আবদুল আলী বাহরুল উলূম, পৃষ্ঠা- ১৫৩।
❏ প্রশ্ন-১১০ঃ মাইয়্যেতের ওপর সওয়াবের উদ্দেশ্যে যদি অতিরিক্ত কাপড় দেয়া হয়, এতে কি সওয়াব পাওয়া যাবে?
✍ উত্তরঃ মাইয়্যেতের ওপর নিয়মাতিরিক্ত কাপড় দেয়া শরয়ী বিধান মতে জায়েয নেই। বরং অতিরিক্ত কাপড় নিয়ে ফেলার প্রতি শরয়ী নির্দেশ রয়েছে। মারাক্বিউল ফালাহ গ্রন্থে আছে,
وينقص ان زاد العدد فى ثيابه على كفن السنة .
‘সুন্নাত মোতাবেক কাফনের কাপড় রেখে অতিরিক্ত কাপড় ফেলে দিতে হবে।’
❏ প্রশ্ন-১১১ঃ কাফনের ওপর কালিমা-ই তাইয়্যেবা কিংবা কোরআন শরীফের আয়াত কালির কলম দ্বারা লিখে দেয়া জায়েয আছে কি না?
✍ উত্তরঃ কালির কলম দ্বারা লিখা জায়েয নেই। ফতোয়া শামীতে আছে,
وقد افتىٰ ابن الصلاح بانه لايجوز ان يكتب على الاكفان خوفًا من صديد الميت .
‘ইবনুস্ সেলাহ ফাত্ওয়া দিয়েছেন যে, কাফনের কাপড়ে কালির কলম দ্বারা কিছু লিখা জায়েয নেই, কেননা তাতে মৃতের গলিজের দ্বারা নাপাক হতে পারে।’
149. ফতওয়া শামী, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৮৪৭।
❏ প্রশ্ন-১১২ঃ মানুষ মারা গেলে কি মাটি ও পাথর হয়ে যায়? যেমন আল্লাহ বলেন,
لَايَسْمَعُ وَلَا يُبْصِرُ وَلَا يُغْنِي عَنْكَ شَيْئًا .
‘তারা কিছুই দেখে না, শুনে না এবং কারো কোন কিছুর মুখাপেক্ষী হয় না- যেমন জীবিত অবস্থায় ছিল।’ অতএব বুঝা গেল, মানুষ মারা গেলে মাটি ও পাথর হয়ে যায়। সাধারণ মুসলমানের কবর তো আছেই বরং আউলিয়া-ই কিরামের মাযারসমূহেরও কোন মর্যাদা নেই। তাই যথাসম্ভব এগুলো অবজ্ঞা ও অপমান করা কী উচিত? এমন আক্বীদা পোষণ করা কী শুদ্ধ?
✍ উত্তরঃ وبالله التوفيق পবিত্র শরীয়তে আউলিয়া-ই কিরামের মাযার তো দূরের কথা, সাধারণ মুসলমানের কবরকেও সম্মান করা ওয়াজিব; অবজ্ঞা ও অপমান করা যাবে না। কেননা ওলামায়ে কিরাম এমনও বলেছেন, কবরের ওপর পা রাখা গুনাহ এবং কবরের উপরিভাগও মাইয়্যেতের হক্ব। ফতোয়া কেনিয়া’য় ইমাম ‘আলাই (رحمه الله تعالي ) এর ভাষ্য বর্ণিত আছে যে,
يأثم بوطى القبور لان سقف القبر حق الميت
ইবনে মাজাহ শরীফে হযরত উকবা ইবনে আমের (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন,
احبُّ الّى من أن امشى على قبر مسلم
‘আগুন কিংবা তরবারীর ওপর দিয়ে চলা অথবা আগুনের জুতা পরিধান করা, আমার নিকট মুসলমানের কবরের ওপর দিয়ে চলার চেয়ে অধিক পছন্দনীয়।’
150. ইবনে মাজাহ, অধ্যায়ঃ কবরের উপর হাটা নিষেধ, পৃষ্ঠা-৪৭২।
উল্লেখ্য যে, বর্তমান যুগে কবর এবং বাজারের মাঝখান দিয়ে পায়খানা-প্রশ্রাবের হাজত পূরণ করতে যাওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে বলে আমার মনে হয় না।
ওলামায়ে কিরামের ঐকমত্য ফতোয়া আছে যে, মুসলমানের সম্মান ও মর্যাদা মৃত ও জীবিত উভয় অবস্থায় সমান। ফতহুল কাদির ও আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলে কারীম (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, মৃতের হাড় ভাঙ্গা এবং একে কষ্ট দেয়া মানে জীবিতের হাড় ভাঙ্গার মতো।
151. সুনানে আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضى الله تعالي عنه) বলেন, মুসলমান মৃত দেহকে কষ্ট দেয়া মানে জীবিতকে কষ্ট দেয়া।
152. মুসান্নাফে আবু বকর ইবনে আবি শাইবা।
ওলামায়ে কিরামগণ বলেছেন, যে সব কথা ও কারণে জীবিতদের কষ্ট পৌঁছে, মৃতরাও সে সব কারণে কষ্ট অনুভব করেন। এমনকি আমাদের ওলামায়ে কিরামগণ এ ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন যে, কবরস্থানের ওপর দিয়ে যে নতুন রাস্তা তৈরী করা হয়েছে, উক্ত রাস্তা দিয়ে মানুষের চলাচল করা হারাম।
153. রদ্দুল মুহতার, ফতওয়ায়ে শামী ইত্যাদি।
কবরস্থানের তাজা সবুজ ঘাস কেটে ফেলা মাকরূহ। কারণ এগুলো যতদিন তরুতাজা থাকবে, আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করতে থাকবে। এ বিষয়ে আরো অনেক মাসআলা রয়েছে, যদি কারো জানতে বেশী আগ্রহ থাকে, তাহলে মুফতি খলিল খান বিরচিত ‘তাওযীহাত বর হাফত মাসআলা’ গ্রন্থখানা দেখার অনুরোধ রইল।
154. তাওযীহাত বর হাফত মাসআলা, পৃষ্ঠা-২২৪।
পাগড়ির বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১১৩ঃ শরীয়তে পাগড়ির হুকুম কি? অর্থাৎ হুযূর রহমতে ‘আলম মুহাম্মদ মোস্তফা(ﷺ) নামাযের জন্য কী আলাদা পাগড়ি রাখতেন। কারো মতে, হুযূর (ﷺ) মাত্র দু’টি কাপড় পরে নামায আদায় করতেন। টুপি ছাড়া খালি মাথায় নামায পড়লেও নামায পরিপূর্ণ হবে, দলিল হিসেবে তারা হযরত জাবের (رضى الله تعالي عنه)-এর কর্মকে পেশ করে থাকেন। হুযূর রহমতে ‘আলম খুৎবা দানকালে পাগড়ি পরিধানের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু নামায পড়তেন শুধু দুটি কাপড় পরে, এটা কিভাবে হতে পারে?
✍ উত্তরঃ আল্লাহর প্রিয় হাবীব (ﷺ) সর্বদা দু’টি কাপড় পরিধান করে নামায পড়তেন এবং মাথায় পাগড়ি মুবারক থাকত না, এটা সম্পূর্ণ ভুল। বরং হুযূর (ﷺ) নামাযের জন্য একটি আলাদা পাগড়ি ব্যবহার করতেন। মুহাদ্দিসীনগণ এ ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। আরো বিস্তারিত জানার জন্য জামে‘ তিরমিযীর শরাহ ‘আরফুশ সজি’ দেখুন।
155. আরফুশ সজি, পৃষ্ঠা-৪৪২।
প্রশ্নকারী লিখেছেন যে, খুৎবা প্রদানকালে হুযূর (ﷺ) পাগড়ি মুবারক পড়তেন। তবে কী নামাযের সময় খুলে ফেলতেন? এটা একটি হাস্যকর ও উপহাসমূলক কথা। মূলতঃ নামাযের সময় পাগড়ি পরিধান করা রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত এবং হযরাত সাহাবা-ই কিরামের সুন্নাত। সকল সাহাবা-ই কিরাম এর ওপর আমল করতেন। দুই কাপড় দ্বারা নামায আদায় করা তা পরিপূর্ণ হওয়ার কথা, এটা কোন দালিলিক কথা নয়। বরং এটা নিজের পক্ষ হতে মনগড়া কথা। আল্লাহ্ তা‘আলা হিদায়ত নসীব করুন।
❏ প্রশ্ন-১১৪ঃ শুধু পাগড়ির ওপর মাসেহ করা জায়েয কি না? কতিপয় ওলামায়ে কিরাম ‘বুলুগুল মুরাম’ গ্রন্থের নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি
مسح بناصية وعلى العمامة وعلى الخفين .
দ্বারা পাগড়ির ওপর মাসেহ জায়েয হওয়ার পক্ষে দলিল পেশ করে থাকেন। অতএব পাগড়ির ওপর মাসেহ জায়েয বুঝা যায়?
✍ উত্তরঃ পাগড়ির ওপর মাসেহ জায়েয না হওয়ার দলিল কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ বলেন, وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, পাগড়ির ওপর মাসেহ করা মানে মাথার ওপর মাসেহ করা নয়। অতএব কুরআনের দলিল দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, পাগড়ির ওপর মাসেহ করা জায়েয নেই। হ্যাঁ! অবশ্য হাদীস শরীফে পাগড়ীর ওপর মাসেহ করার ব্যাপারে বিভিন্ন রেওয়ায়েত বর্ণিত আছে। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত মুগীরা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে,
ومسح بناصية وعلى العمامة
আর কোন বর্ণনায় শুধু পাগড়ির কথা উল্লেখ আছে।
সুতরাং পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা মাথা মাসেহ করা ওয়াজিব প্রমাণিত। একথা সামনে রেখে যে সকল হাদীস দ্বারা পাগড়ির ওপর মাসেহ জায়েয সেগুলোর বিশুদ্ধ আমল নির্দিষ্ট করা হবে। আর তা হলো এই যে, হুযূর (ﷺ) মাথা মুবারকের এক চতুর্থাংশ মাসেহ করেছেন। যা কপালের প্রায় সমপরিমাণ। কিন্তু সে সময় পাগড়ি মাথা থেকে একেবারে খুলে ফেলেননি বা নামিয়ে রাখেননি। বাকী মাথার ওপর পাগড়ির ওপর দিয়ে হাত বুলিয়ে মাসেহ করেছেন। যা রাবী কখনো পরিপূর্ণ বর্ণনা দিতে গিয়ে কপালের পরিমাণ মাসেহ এবং পাগড়ির ওপর উল্লেখ করেছেন। আবার কখনো শুধু পাগড়ির কথা উল্লেখ করেছেন।
সারকথা হচ্ছে এই যে, মাথার এক চতুর্থাংশ মাসেহ করা হয়েছিল, যা ফরয। পাগড়ির ওপর মাসেহ করা ফরযের কারণে ছিল না। হযরত মুহাক্কিক আল্লামা আবদুল বার (رحمه الله تعالي ) পাগড়ির ওপর মাসেহ সম্পর্কীয় বর্ণিত সকল রেওয়ায়েতগুলোকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন।
156. খায়রুল ফতওয়া, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২১।
তা‘যিমী সিজদার বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১১৫ঃ সিজদায়ে তা‘যিমী বা কবর সিজদা করার প্রকার কতটি এবং তা বিস্তারিত আলোচনা কর।
❏ প্রশ্ন-১১৬ঃ কোন ওলি, সুফি বা আলিমের সামনে সিজদা করার হুকুম কী?
বিবাহের বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১১৭ঃ দ্বিতীয় বিবাহ কাকে বলে? বিস্তারিত আলোচনা কর?
❏ প্রশ্ন-১১৮ঃ গোপন বিবাহ কাকে বলে?
❏ প্রশ্ন-১১৯ঃ নিকাহ অর্থ কি? নিকাহ কাকে বলে?
ওয়ালিমা এবং যিয়াফতের বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১২০ঃ ওয়ালিমা কাকে বলে? ওয়ালিমা অর্থ কী?
❏ প্রশ্ন-১২১ঃ যিয়াফত বা ভোজ্যানুষ্ঠান কী? এবং কখন হতে এর প্রচলন শুরু হয়?
ওলির বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১২২ঃ ‘ওলি’ অর্থ কী? ওলি কাকে বলে? এবং ওলির সংজ্ঞা কী?
মাযার সমূহের ওপর ঘর নির্মাণ করার বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১২৩ঃ আউলিয়া-ই কিরামের মাযারসমূহের ওপর ভবন বা ঘর নির্মাণ করা কেমন?
❏ প্রশ্ন-১২৪ঃ মাযারসমূহ গোসল দেয়া জায়েযের সপক্ষে কী কোন দলিল আছে?
তাজিমার্থে দাঁড়ানো ও না‘রা দেয়া
❏ প্রশ্ন-১২৫ঃ কোন সম্মানিত ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির আগমনে না‘রা বা তাকবীর দেয়ার বিধান কী?
❏ প্রশ্ন-১২৬ঃ কোন মজলিসে সম্মানিত ব্যক্তির আগমনে সমাবেশে উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে হযরাত ওলামায়ে কিরামের মতামত কী?
সেমা’র বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১২৭ঃ সেমা তথা ধর্ম-সঙ্গীত সম্পর্কে ওলামায়ে কিরামের অভিমত কি এবং এর ফয়সালার পদ্ধতি কি?
ওহাবী ফেরকার বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১২৮ঃ সংক্ষিপ্তাকারে ওহাবী সম্প্রদায়ের পরিপূর্ণ অবস্থা এবং তারা কতভাগে বিভক্ত হয়েছে তা যথাযথভাবে বর্ণনা কর।
বিভিন্ন প্রকারের মাসায়েল এর বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১২৯ঃ অভিশপ্ত ইবলিশ কি সিজদার আদেশের মুকাল্লাফ (আজ্ঞাবহ) ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৩০ঃ জনৈক ব্যক্তির বিবাহের জন্য সঞ্চিত অর্থ যদি বছর ঘুরে আসে তবে সেই অর্থের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে নাকি হবে না?
❏ প্রশ্ন-১৩১ঃ সূরা ইয়াসিন এর তেলাওয়াত কখন ও কিভাবে করতে হয় এবং এর উপকার কী- দলিলসহ বর্ণনা কর ?
❏ প্রশ্ন-১৩২ঃ উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের হাকীকত কী?
❏ প্রশ্ন-১৩৩ঃ বর্ণনাকারী এবং বৈশিষ্ট্য বা গুণ বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য হাদিস কত প্রকার?
❏ প্রশ্ন-১৩৪ঃ সূরা ইনশিরাহ এর আয়াত وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ ‘আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি’ এর ব্যবহার বা প্রয়োগ ব্যাপকার্থে সবার জন্য করা কেমন?
❏ প্রশ্ন-১৩৫ঃ ইসলামে শিরকের অবস্থান কী? উম্মতে মুহাম্মদীয়া হতে শির্ক প্রতীয়মান হতে পারে কি?
❏ প্রশ্ন-১৩৬ঃ ‘এটি (সূর্য) এভাবে চলতে চলতে আরশের নিচে সিজদাবনত হয়’ অত্র হাদিসটির মর্মার্থ ও ব্যাখ্যা কী হবে?
❏ প্রশ্ন-১৩৭ঃ ফিতনার সময় ঈমান, আক্বীদা ও আধ্যাত্মিক বা আত্মিক আমলসমূহ হিফাযতের জন্য ফিত্না-ফাসাদ হতে দূরে পালানোর ধরনটা কি রকম?
❏ প্রশ্ন-১৩৮ঃ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা হেঁটে হেঁটে কোন কিছু খাওয়ার হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-১৩৯ঃ বলা হয়ে থাকে যে, প্রাচ্য অঞ্চলের লোকেরা শেষ যামানায় হযরত সাইয়েদুনা ইমাম মাহদীর (عليه السلام) সাম্রাজ্যকে সুসংহত ও সুদৃঢ় করবে। একথা কি কোনো দলিল দ্বারা প্রমাণিত নাকি কেবল জনশ্রুতি?
❏ প্রশ্ন-১৪০ঃ ইবলিশ শয়তান কি বিতাড়িত হওয়ার পূর্বে ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলো?
❏ প্রশ্ন-১৪১ঃ হযরত ইবরাহিম (عليه السلام), ইসমাইল (عليه السلام) এর স্থলে যে দুম্বাটি জবাই করেছিলেন ওই দুম্বাটির গোশত কারা ভক্ষণ করেছিলো?
❏ প্রশ্ন-১৪২ঃ কে শাসন ক্ষমতার জন্য অধিক যোগ্য হবেন? অনভিজ্ঞ মুত্তাকী ও আলেমে দ্বীন নাকি অভিজ্ঞতা আলেম নন এমন মানুষ?
❏ প্রশ্ন-১৪৩ঃ الاستمناء باليد তথা হাত দ্বারা বীর্যপাত করা অর্থাৎ হাত দ্বারা বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করা, শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এর বিধান কী?
❏ প্রশ্ন-১৪৪ঃ মুরতাদদেরকে মুসলমান মনে করে তাদের সঙ্গ দেওয়া, তাদের নিকট হতে উন্নতি ও উপকারের আশা করা, শরীয়তে এগুলোর বিধান কী?
❏ প্রশ্ন-১৪৫ঃ নকশবন্দিয়া খান্দানে খতমে খাজেগান সর্বদা দৈনিক পড়া হয়। কোন কোন সময় সহিংসতা, অস্থিরতা ও যুদ্ধ-বিগ্রহকালে ফজরের নামাযে ইমাম সাহেব মসজিদে কুনুতে নাযেলাও পড়েন
❏ প্রশ্ন-১৪৬ঃ কোন নামাযের পর খতমে খাজেগানের পাঠকে নিয়মিত অযিফা বানিয়ে নেওয়া কেমন?
❏ প্রশ্ন-১৪৭ঃ বিয়েতে প্রস্তাবের উত্তরে ‘কবুল’ শব্দের পরিবর্তে আলহামদুলিল্লাহ বলা কেমন?
❏ প্রশ্ন-১৪৮ঃ হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله عنها ) কর্তৃক তাঁকে (ﷺ) রওজায়ে আকদাসে দাফন করার ব্যাপারে নিষেধ করার কারণ কী ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৪৯ঃ কোরআন মজিদ খোলার পূর্বে কিছু লোক তাতে চুমো খায়। এই কাজটি জায়েয বা সঠিক কিনা?
❏ প্রশ্ন-১৫০ঃ مُحَدَّثْ মুহাদ্দাস (দাল বর্ণের ওপর তাশদীদ ও যবর সহকারে) শব্দের অর্থ কী?
❏ প্রশ্ন-১৫১ঃ বারো মাসের গণনা প্রথা কখন হতে শুরু হয়?
❏ প্রশ্ন-১৫২ঃ আরববাসীগণ নিজেদের চান্দ্র মাসের কী কী নাম রেখেছিলেন?
❏ প্রশ্ন-১৫৩ঃ شاه ‘শাহ’ শব্দটি কোন ভাষার শব্দ এবং তা কোথায় ব্যবহার করা হয়?
❏ প্রশ্ন-১৫৪ঃ শাহাদাত কাকে বলে, এর সংজ্ঞা কী এবং শাহাদাতের সংখ্যা কত?
❏ প্রশ্ন-১৫৫ঃ হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) এর পিতার নাম কি ছিল? তারুখ তাঁর পিতার নাম এবং আযর তাঁর চাচা,একথা বলা সঠিক কিনা?
❏ প্রশ্ন-১৫৬ঃ হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) কর্তৃক বর্ণিত পুরো দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ চারজন নারী কারা কারা ছিলেন? আছিয়া কে ছিলেন?
❏ প্রশ্ন-১৫৭ঃ আসফ বিন বরখিয়া কে ছিলেন, তার অবস্থা ও কাহিনী বর্ণনা কর?
❏ প্রশ্ন-১৫৮ঃ হযরত মুসা (عليه السلام) এর মাতার নাম কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৫৯ঃ হযরত শুয়াইব (عليه السلام)কে কোন্ জাতির নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছিল?
❏ প্রশ্ন-১৬০ঃ আসহাবে আইকা বলা হয় কাদেরকে, আইকা শব্দের অর্থ কী?
❏ প্রশ্ন-১৬১ঃ وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ ...... فَأَصْبَحَ مِنَ الْخَاسِرِينَ (সূরা মায়েদা, পারা নং-৬) আয়াতটির তাফসীর কী?
❏ প্রশ্ন-১৬২ঃ شهنشاه ‘শাহিনশাহ’ শব্দটির অর্থ কী, তার ব্যবহার জায়েয নাকি না-জায়েয?
❏ প্রশ্ন-১৬৩ঃ শীশ শব্দটি কোন ভাষার শব্দ এবং অর্থ কী?
❏ প্রশ্ন-১৬৪ঃ ‘শায়খ’ শব্দের ব্যাখ্যা কী এবং ‘শায়খ’ কাকে বলা হয়?
❏ প্রশ্ন-১৬৫ঃ দস্তারবন্দি মাহফিল আয়োজন করার বিধান কী?
❏ প্রশ্ন-১৬৬ঃ اُم الولد ‘উম্মুল ওয়ালাদ’ কাকে বলা হয় এবং এর সংজ্ঞা ও বিধান কী?
❏ প্রশ্ন-১৬৭ঃ امّ هانىউম্মে হানীর মূল বা প্রকৃত নাম কি? হুযূর তাঁর ঘর হতে কিভাবে মি‘রাজে গেলেন?
❏ প্রশ্ন-১৬৮ঃ হযরত উম্মে সালমা কে ছিলেন? তার ব্যাপারে কিছু আলোচনা কর।
❏ প্রশ্ন-১৬৯ঃ ‘জাম্উল জামা’ কাকে বলা হয়?
তা‘যিমী সিজদার বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১১৫ঃ সিজদায়ে তা‘যিমী বা কবর সিজদা করার প্রকার কতটি এবং তা বিস্তারিত আলোচনা কর।
✍ উত্তরঃ কবরকে সামনে রেখে সিজদা তিন প্রকারঃ-
এক. কবরকে সামনে রেখে সিজদা করা- যদি কবর এবং সিজদাকারীর মাঝখানে কোন আড়াল বা পর্দা না থাকে তাহলে মাকরূহে তাহরিমী। এতে সিজদাকারী গুনাহগার হবে।
দুই. কবরকে সিজদায়ে তা‘যিমী করা হারাম। এতে সিজদাকারীর তাওবা করা আবশ্যক।
তিন. ইবাদতের উদ্দেশ্যে সিজদা করা শির্ক। এতে সিজদাকারীকে নতুনভাবে ঈমান আনতে হবে। কেউ কেউ সিজদায়ে তা‘যিমীকেও শির্ক বলেছেন।
অতএব, যে কোন কবরকে সিজদা করা থেকে বিরত থাকা উচিত এবং যারা সিজদা করে তাদেরকে বাধা দিতে হবে। এর জন্য তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার উপদেশ দেয়া উচিত। ফতোয়া হিন্দীয়াতে আছে,
من سجد للسلطان علٰى وجه التحية او قبل الارض بين يديه لايكفر ولكن يأثم لارتكا به الكبيرة وهو المختار . وقال ابو جعفر رحمة الله وان سجد للسلطان بنية العبادة او لم يحقر النية فقد كفر، كذا فى جوهر الاخلاطى .
وفى الخلاصة ومن سجد لهم اراد به التعظيم كتعظيم الله سبحانه وتعالٰى كفر. وان اراد به التحية اختار العلماء انه لايكفر . اقول هذا هو الاظهر .
‘কেহ বাদশাহ এর সম্মানার্থে মাথানত বা সিজদা করলে কিংবা তাঁর সামনে জমিন চুম্বন করলে কাফির হবে না, তবে কবিরা গোনাহ হবে। এটাই উত্তম অভিমত। ইমাম আবু জাফর তাহাবী বলেন, ইবাদতের নিয়তে বাদশাহকে সিজদা করলে অথবা নিয়তে পোক্ত থাকলে কাফির হয়ে যাবে।"
157. ফাত্ওয়া হিন্দিয়া, খন্ড-৫, বাদশাহর সঙ্গে মোলাকাত অধ্যায়। অনুরূপ জাওহারুল আখলাতীতে রয়েছে।
খোলাছা গ্রন্থে আছে, যারা আল্লাহর মত সম্মান প্রদর্শন করে সিজদা করে তারা কাফির হবে। আর স্বাভাবিক সম্মান প্রদর্শন করলে কাফির হবে না, এটাই উত্তম মত।’
158. শরহে ফিকহে আকবর, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কুফরী পরিচ্ছেদ; রদ্দুল মুহতার, কিতাবুল কারাহিয়া, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৮৩
❏ প্রশ্ন-১১৬ঃ কোন ওলি, সুফি বা আলিমের সামনে সিজদা করার হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ ইসলামী সকল কিতাবসমূহে লিখা আছে যে, আল্লাহ্ ব্যতীত যে কোন ওলি, পীর-মুর্শিদ ও সুফির সামনে সিজদা করা হারাম। ফুকাহা-ই কিরাম একথাও বলেছেন যে, মহান আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো সামনে ইবাদতের নিয়্যতে সিজদা করলে, সিজদাকারী কাফির হয়ে যাবে। যদি তা‘যিম বা সম্মানের উদ্দেশ্যে সিজদা করে থাকে, তাতেও ফাসিক হবে।
মানুষ মানুষকে সিজদা করার সর্বপ্রথম কুপ্রথা চালু করেন ফেরআউনের উজির হামান। তিনিই সর্বপ্রথম মিশরের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ফেরাউনকে সিজদা করেছিলেন এবং ফেরাউনের জন্য সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন।
আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত আছে যে, হযরত সা‘দ (رضى الله تعالي عنه)-এর ছেলে কুফার নিকটবর্তী একটি শহর ‘হিরা’য় গিয়েছিলেন, সেখানে দেখতে পেলেন, লোকেরা তাদের সরদার বা দলপতিকে সিজদা করছে। সা‘দ বলেন, তখন আমি মনস্থ করলাম যে, রাসূল (ﷺ)ই সিজদার অধিক হকদার। সুতরাং আমি রাসূল (ﷺ)-এর নিকট এসে আরয করলাম যে, আমি হিরা শহরে গিয়ে দেখতে পেলাম যে, লোকেরা তাদের সরদারকে সিজদা করছে। অথচ আপনিই সিজদার অধিকতর হকদার। তাই আমরা আপনাকে সিজদা করতে চাই। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, ভাল! তোমরা আমার কবরের পার্শ্বদিয়ে যাওয়ার সময় কী উহাকে সিজদা করবে? আমি আরয করলাম, না। তখন আল্লাহ'র প্রিয় হাবীব (ﷺ) বলেন, এমন করো না। আমি যদি কাউকে সিজদা করার হুকুম দিতাম, তাহলে স্ত্রীদেরকে স্ব-স্ব স্বামীকে সিজদা করার হুকুম দিতাম। কেননা আল্লাহ তা‘আলা স্বামীর হক স্ত্রীর ওপর রেখেছেন।
কোরআন মজীদের ৪১তম সূরার নামও সিজদা। যা এভাবেই আরম্ভ হয়েছে حـٰـمٓ । এ হুকুম রাহমানুর রহীম মহান আল্লাহ'র পক্ষ হতে ঘোষণা করা হয়েছে।
একথা প্রতীয়মান হয় যে, ফিরিশতারা হযরত আদম (عليه السلام)কে যে সিজদা করেছিলেন, তা হযরত আদম (عليه السلام)-এর জন্য ছিল না বরং তা ছিল মূলতঃ আল্লাহর হুকুম পালনার্থে। যা আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় কুদরতের একটি নতুন পদ্ধতি ও নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ হযরত আদম (عليه السلام)কে পৃথিবীতে খলিফা হিসেবে সৃষ্টি করার প্রেক্ষাপটে তাদেরকে হুকুম দিয়েছিলেন।
অনুরূপভাবে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)কে তাঁর ভাইয়েরা যে সিজদা করেছিলেন, তা মূলতঃ হযরত ইউসুফ (عليه السلام) যে তাদের ভুল ও অপরাধকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, তার শুকরিয়া হিসেবে মহান আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে সিজদা করেছিলেন। সারকথা হচ্ছে, যে কোন ব্যক্তির কোন প্রকারের সিজদা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে করা জায়েয নেই।
হ্যাঁ! কোন আলিম বুযূর্গ ও আল্লাহর ওলির হাত-পা চুম্বন করা এবং মা-বাবা কিংবা তাদের কবরকে চুম্বন করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয। যা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত।
বিবাহের বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১১৭ঃ দ্বিতীয় বিবাহ কাকে বলে? বিস্তারিত আলোচনা কর?
✍ উত্তরঃ যদি স্ত্রীকে এক তালাক বা দুই তালাক দেয়ার পর ইদ্দত অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর নিজ স্বামীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার আক্বদ নিকাহ করার নাম- দ্বিতীয় নিকাহ বা বিবাহ। আর এটা জায়েযও আছে। যদি তিন তালাক দেয়া হয়, তবে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করে তার সঙ্গে সহবাস করার পর যদি সে তালাক দিয়ে দেয় এবং ইদ্দত শেষ হয়ে যায়, তবে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ জায়েয হবে। অন্যথায় প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ শুদ্ধ হবে না।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يَتَرَاجَعَا إِنْ ظَنَّا أَنْ يُقِيْمَا حُدُودَ للهِ.
‘যদি স্বামী স্ত্রীকে তিন তালাক প্রদান করে, অতঃপর স্ত্রী যতক্ষণ দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রথম স্বামী তার জন্য হালাল বা বৈধ হবে না। হ্যাঁ! যদি দ্বিতীয় স্বামী সহবাসের পর তাকে তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য কোন গোনাহ হবে না। অতঃপর দ্বিতীয় বিবাহের মাধ্যমে একে অপরের প্রতি ফিরে যাবে। তবে শর্ত হচ্ছে, তারা উভয়ই আল্লাহ্ তা‘আলার নির্ধারিত বিধি-বিধানের ওপর অটল থাকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে।"
159. সূরা বাক্বারা, আয়াতঃ ২৩০।
হিন্দুদের মধ্যে এ প্রথা প্রচলিত ছিল এবং বর্তমানেও আছে যে, বিধবা মহিলাদের দ্বিতীয় বিবাহ-শাদীর সুযোগ দেয়া হয় না। এ হতভাগা মহিলারা এমনিতেই ঘরের আন্দর মহলে একাকিত্ব জীবন কাটাতে হয় এবং জীবনের মূল্যবান সময় ও আশা-ভরসা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়ে যায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যেও এমন কিছু সম্প্রদায় রয়েছে যারা নিজেদেরকে উচ্চ পর্যায়ের ভদ্র, সভ্য ও কৃষ্টিমনা মনে করে থাকে। তারা হিন্দুদের এই কুপ্রথাকে পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণ করে। একথা তারা কখনো চিন্তাও করেনি যে, ইসলামে বিধবাদের সম্পর্কে কী বিধান রয়েছে। অথচ পবিত্র হাদীস শরীফে এসেছে যে, তোমরা বিধবাদের খুব তাড়াতাড়ি বিবাহের ব্যবস্থা করো।
❏ প্রশ্ন-১১৮ঃ গোপন বিবাহ কাকে বলে?
✍ উত্তরঃ গোপনীয়ভাবে বিবাহ হওয়াকে نكاح السّر বা গোপন বিবাহ বলে। আর গোপন বিবাহ হচ্ছে যা লোকসমাজে প্রকাশ্যভাবে ও জানাজানি করে করা হয়না।
❏ প্রশ্ন-১১৯ঃ নিকাহ অর্থ কি? নিকাহ কাকে বলে?
✍ উত্তরঃ নিকাহ অর্থ- মিলানো, একত্রিত করা। শরীয়তের পরিভাষায় একজন পুরুষ অপর মহিলার সঙ্গে যৌন মিলনের উপকারিতা উপভোগ করার লক্ষ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে নিকাহ বলা হয়। অথবা একজন পুরুষ ও একজন মহিলা পরস্পর সুখে-শান্তিতে ও মনোতুষ্টি নিয়ে বসবাস করা এবং সন্তানদের মা-বাবা হওয়া এবং জীবনের প্রয়োজনে পরস্পর সহযোগিতা প্রসারিত করার নিমিত্তে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে নিকাহ বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় বিবাহ করা সুন্নাত এবং কামভাব প্রবল ও নিয়ন্ত্রণ বর্হিভূত হলে বিবাহ করা ওয়াজিব।
160. কান্যুদ্ দাক্বাইক্ব।
ওয়ালিমা এবং যিয়াফতের বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১২০ঃ ওয়ালিমা কাকে বলে? ওয়ালিমা অর্থ কী?
✍ উত্তরঃ ওয়ালিমা শব্দটি ايتلام থেকে নির্গত। ايتلام অর্থ- একত্রিত হওয়া। কেননা এটা স্বামী-স্ত্রী একত্রিত হওয়ার সময় খাওয়ানো হয়, তাই এটাকে ওয়ালিমা বা বৌ-ভাত বলা হয়। অতএব, ওয়ালিমা সে ভোজ্যানুষ্ঠানকে বলা হয়, যা বিবাহ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়। অধিকাংশ ওলামার মতে, ওয়ালিমা সুন্নাত। কারো মতে, মুস্তাহাব। আর কেউ কেউ ওয়াজিব বলেছেন।
ওয়ালিমা সম্পর্কে ওলামাদের বিভিন্ন উক্তি পাওয়া যায়। কারো মতে, স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষাতের পরের খাবারই ওয়ালিমা। কেউ বলেন, আক্দের সময় খাবারকে ওয়ালিমা বলে। আবার কারো মতে, আক্দের সময় এবং স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষাতের পর- উভয় খাবারের নাম ওয়ালিমা। তবে গ্রহণযোগ্য অভিমত হলো- বিবাহোত্তর স্বামীর সামর্থানুযায়ী বৌ-ভাত খাওয়ানোকে ওয়ালিমা বলে।
❏ প্রশ্ন-১২১ঃ যিয়াফত বা ভোজ্যানুষ্ঠান কী? এবং কখন হতে এর প্রচলন শুরু হয়?
✍ উত্তরঃ هوالمستعان ‘মজমাউল বাহার’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, যিয়াফত হচ্ছে সে খাবার যা কোন কারণ ছাড়া কেবল যিয়াফত ও আতিথিয়েতার উদ্দেশ্যে তৈরী করা হয় এবং এটা মুস্তাহাব।
যিয়াফত আট প্রকারঃ
১.ওয়ালিমাঃ যা বিবাহ উপলক্ষে করা হয়।
২.খুর্সঃ যা নবজাত শিশুর জন্মের খুশিতে করা হয়।
৩.ই‘যার (اعذار)ঃ খৎনা বা মুসলমানী উপলক্ষে যে খাবার প্রস্তুত করা হয়।
৪.নতুন ঘর নির্মাণ উপলক্ষে তৈরীকৃত খাবার।
৫.নকী‘য়াহ (نقيعه)ঃ মুসাফির সফর থেকে ফিরে আসার পর তৈরীকৃত খাবার। যা মুসাফির নিজে তৈরী করুক বা অন্য কেউ তার আগমনে তৈরী করুক।
৬.ওযীমাহ (وضيمه)ঃ বিপদের সময় তৈরীকৃত কাঙ্গালীভোজ।
৭.আক্বীক্বা (عقيقة)ঃ নবজাত শিশুর নামকরণের সময় তৈরীকৃত খাবার।
৮.মা’দাবাহ (مأدبه)ঃ যা কোন উপলক্ষ ছাড়া শুধু মেহমানদারী আতিথিয়েতার জন্য তৈরীকৃত খাবার।
উপরোক্ত সকল প্রকারের খাবারের ব্যবস্থা করা সুন্নাত। কারো মতে, ওয়ালিমা খাওয়ানো ওয়াজিব। তবে বিশুদ্ধ মতে ওয়ালিমা সুন্নাত। হুযূর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এবং সকল সাহাবা-ই কিরাম তা করতেন।
কতেক ওলামার মতে, ওয়ালিমাতে যাওয়া ওয়াজিব। না গেলে গুণাহগার হবে। আবার কারো মতে, মুস্তাহাব। খাবার খাওয়া আবশ্যক নয়, অপারগ হলে না খেলেও অসুবিধা নেই।
161. ইসলামী মা‘লুমাত, খন্ড-২, পৃষ্ঠা- ৭৯৮।
ওলির বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১২২ঃ ‘ওলি’ অর্থ কী? ওলি কাকে বলে? এবং ওলির সংজ্ঞা কী?
✍ উত্তরঃ ওলি (ولى) অর্থ- বন্ধু, সহচর, ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ। ওলি (ولى) এটা فعيل ,এর ওযনে فاعل তথা কতৃকারক অর্থে ব্যবহৃত। শাব্দিক অর্থ- বন্ধু ও সহচর। পরিভাষায় ওলি বলা হয়, যার মধ্যে ধারাবাহিক ভাবে আনুগত্য পাওয়া যাবে এবং মাঝখানে কোন ধরনের গুণাহ পাওয়া যাবে না। অথবা এটা مفعول তথা কর্মকারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর দ্বারা ওই ব্যক্তি উদ্দেশ্য- যার ওপর নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহ'র অনুগ্রহ বর্ষিত হয়েছে।
ওই ব্যক্তিকেও ওলি বলা হয়, যিনি আল্লাহ্ তা‘আলার সত্তা ও গুণাবলি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান রাখেন, ইবাদতে সর্বদা নিমগ্ন থাকেন, সর্বদা পাপাচার ও গুণাহ থেকে বেঁচে থাকেন এবং জৈবিক চাহিদা, কামভাব ও কুপ্রবৃত্তি পরিহার করেন।
ولى একবচন, বহুবচনে اولياء আসে। কোরআন মজিদে শব্দটি এভাবে এসেছে,
أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ .
‘আল্লাহ্ তা‘আলার অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী খাস বান্দা সম্পর্কে সাবধান যে, কিয়ামত দিবসে তাঁরা এমন নিরাপদে থাকবেন যে, তাদের না কোন ভয়-ভীতি থাকবে আর না তারা চিন্তিত ও ব্যথিত হবেন।’
162. সূরা ইউনুস, আয়াতঃ ৬২।
الولى ‘আল-ওলিয়্যু’ আল্লাহ্ তা‘আলার একটি গুণাহবাচক নামও। কেননা আল্লাহ্ ঈমানদার, পরহেজগার ও খোদাভীরুদের বন্ধু এবং তিনি তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেন, একারণে তাদেরকে ওলি বলা হয়।
ولى শব্দটি متولى অর্থেও আসে। যার অর্থ অভিভাবক ও ব্যবস্থাপক। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলা পূণ্যবান ও নেককার ব্যক্তিদের কার্যাদির متولى বা ব্যবস্থাপক। ولى শব্দটি নিকটবর্তী অর্থেও ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত পূণ্যবানদের নিকটতম হয়ে থাকে।
মাযার সমূহের ওপর ঘর নির্মাণ করার বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১২৩ঃ আউলিয়া-ই কিরামের মাযারসমূহের ওপর ভবন বা ঘর নির্মাণ করা কেমন? অথচ স্পষ্ট বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা এর নিষেধ করা হয়েছে। মসজিদসমূহ অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে বিশাল আকারের এবং এতে গম্বুজ ও বিভিন্ন প্রকারের আকর্ষণীয় স্থাপত্যশৈলী ও কারুকার্য দ্বারা সুসজ্জিত করে নির্মাণ করা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ কি-না? অথচ হাদীস শরীফে এরকম কারুকার্য মাকরূহ বলা হয়েছে। কারণ যাতে মুসলিদের ধ্যান কারুকার্যের সৌন্দর্য্যের দিকে ধাবিত না হয় অথবা অযথা অর্থের অপচয় না হয়। অনুরূপভাবে মসজিদের ওপর গম্বুজ নির্মাণ করার বিধান কী?
✍ উত্তরঃ আউলিয়া-ই কিরামের মাযার এবং মসজিদ সমূহের সুউচ্চ ইমারত বর্তমানে সেগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং দূর-দূরান্ত থেকে এই ইসলামি নিদর্শনসমূহের ওপর অবহিত হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে এটাই অন্যতম কারণ। তাছাড়া তা ইসলামের প্রাথমিক যুগে ছিল না। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে মানুষের মাঝে যে নিত্য নতুন অবস্থার সৃষ্টি হতে চলেছে, অনুরূপভাবে তাদের জন্য ফতোয়াও নতুন নতুন হচ্ছে। বর্তমানে মুসলিম এবং কাফিরসহ সকল জাতি নিজ নিজ বাড়ী-ঘর সুউচ্চ ইমারত ও অট্টালিকা তৈরীর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। আর আমরা মুসলমানরা যদি আকর্ষণীয় উচ্চ ইমারতের মাঝে কাঁচা ইটের নিচু দেয়ালের মসজিদ নির্মাণ করি অথবা তালিজোড়া দিয়ে ঝোপড়ির ন্যায় তৈরী করা হয় এবং আকর্ষণীয় গম্বুজ এবং সুউচ্চ মিনার নির্মাণ করা না হয়। এতে বিশেষ করে অমুসলিমদের দৃষ্টিতে তা হেয়প্রতিপন্ন হবে। আর মসজিদের অবমূল্যায়ন করা মানে পক্ষান্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের অবমাননা ও অবমূল্যায়নের শামিল। যা পবিত্র শরীয়তের দৃষ্টিতে কখনো পছন্দনীয় নয়।
এই পবিত্র দলিল ও মর্যাদাপূর্ণ নিদর্শনের কারণে মুসলিম জাতিসত্তার সম্মান রক্ষার্থে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল ইমাম ও ওলামায়ে কিরাম এগুলোকে জায়েয বলেছেন। যা বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে নিদ্বির্ধায় প্রচলিত নিয়ম-নীতিতে পরিণত হয়েছে।
ماراه المسلمون حسنا فهو عند الله حسن -এর অন্তভুর্ক্ত হয়েছে।
‘জওয়াহিরে ইখলাতি’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে,
وان كان احداثا فهو بدعة حسنة وكم من شئ كان احداثا وهو بدعة حسنة وكم من شئ يختلف باختلاف الزمان والمكان .
যদিও এটা নতুন আবিষ্কার। তবুও بدعة حسنة বা ভাল আবিষ্কার। এমন অনেক বস্তু রয়েছে যা নতুন আবিষ্কার, অথচ উহা উত্তম বিদআত বৈ আর কিছু নয়। অনেক বিধান এমনও আছে যা স্থান-কাল পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত হয়, এমতাবস্থায় পূর্বযুগের বিধানাবলী থেকে দলিল পেশ করা বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। যুগের চাহিদা অনুপাতে হুকুম প্রদান করা উচিৎ। যেমন- উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنها) বলেছেন যে, যদি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বর্তমানে মহিলারা যেসব কর্মকান্ড বের করেছেন তা উপলব্ধি করতেন, তা হলে তাদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করতেন। যেমনিভাবে বনি ইসরাঈলের মহিলাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল। পরিশেষে আইম্মায়ে কিরাম ও মুহাক্কিক আলিমগণ মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। অথচ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার বন্দিনীদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করিও না।"
163. সহীহ মুসলিম।
আইম্মা-ই কিরাম এবং ওলামায়ে মুহাক্কিকীনরা যুগের চাহিদা মোতাবেক অবস্থার প্রেক্ষাপটে যে হুকুম প্রদান করেছেন, তবে এটাকে কী হাদীসের বিপরীত বলা যাবে? এটা কখনো হতে পারে না? আল্লাহ্ না করুক, এমন কথা নির্বোধ ও বোকা ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। এ জন্যে আউলিয়া-ই কিরামের মাযার সম্পর্কে ওলামায়ে কিরামগণ যে ফতোয়া দিয়েছেন তা যুগের মুহাক্কিক হযরত আল্লামা ইউসুফ নাব্হানি (رحمه الله تعالي ) ‘মাজমাউ বিহারুল আনওয়ার’ গ্রন্থের তৃতীয় খন্ড বলেছেন,
قد اباح السلف البناء علي قبور الفضلاء الاولياء والعلماء ليزورهم الناس ويستريحون فيه .
‘নিশ্চয়ই পূর্ববর্তী ইমামগণ সম্মানিত আউলিয়া ও ওলামায়ে কিরামের যিয়ারতের স্থানে মাযার ও অবকাঠামো নির্মাণ করা বৈধ বলে ফতোয়া প্রদান করেছেন। যাতে লোকজন তাঁদের কবর যিয়ারত করতে পারে এবং তাতে প্রশান্তি লাভ করে। সলফে সালেহীন তথা পূর্ববর্তী বুযূর্গানে দ্বীনের পবিত্র আত্মাসমূহ শা‘আয়িরুল্লাহ বা আল্লাহ'র নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান পূর্ণমাত্রায় ছিল। বাহ্যিক শান-শওকত, সম্মান-প্রতিপত্তি ও ঐশ্বর্যতার মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তাদের সময় এগুলো ছিল অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয়। প্রত্যেক অপ্রয়োজনীয় বিষয় মাকরূহ এবং এতে অর্থ ব্যয় করা নিষিদ্ধ।
বর্তমান যুগে বাহ্যিক শান-শওকত, জাকজঁমক ও আড়ম্বরতা ব্যতীত সাধারণ মানুষের অন্তরে মর্যাদার স্থান পাওয়া যায় না বিধায় উক্ত বিষয়াদির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। যেমন- কোরআন শরীফের ওপর অক্ষর স্বর্ণখচিত করার অনুমতি হয়েছে, মসজিদ সমূহে সোনালী গম্বুজ এবং স্বর্ণ-রৌপ্য দ্বারা কারুকার্য করার অনুমতি হয়েছে এবং আউলিয়া-ই কিরামের মাযারে চাদর, গিলাফ পরিধান করা এবং আলোক সজ্জা করার অনুমতি হয়েছে। সে ভিত্তিতে তাঁদের মাযারে গম্বুজ নির্মাণের বৈধতার হুকুম দেয়া হয়েছে। উপরোক্ত সকল বিষয়ের ক্ষেত্রেও বর্ণিত হাদীস এবং প্রাথমিক যুগের বিধানাবলী পেশ করা মূর্খতা ও নিবুর্দ্ধিতা ছাড়া আর কি হতে পারে? উক্ত ইমারত নির্মাণের ফলে মাটি ও ইট-পাথরের প্রতি কখনো সম্মান প্রদর্শন হতে পারে না, বরং আল্লাহ্ পাকের নৈকট্য লাভে ধন্য এবং তাঁর প্রিয় বান্দার পবিত্র আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শন উদ্দেশ্য। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ। আর আমলের ভিত্তি নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। তাই ইমাম আবদুল গণি নাবুলুসী (رحمه الله تعالي ) তাঁর অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্ববিখ্যাত ‘হাদিকাতুন নাদিয়্যাহ’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,
تعظيما لروحه المشرفة على نواب جسده الخ .
অর্থাৎ- আউলিয়া-ই কিরামের মাযার শরীফে আলোক সজ্জা করা, তাঁর পবিত্র আত্মার প্রতি সম্মান জ্ঞাপনার্থে। যা স্বীয় শরীর মোবারকের সাথে মিলিত মাটিতে আকাশের সূর্যের ন্যায় আলোকরশ্মি দান করছেন। যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে, এখানে কোন ওলি-আল্লাহ'র মাযার আছে। ফলে এখান থেকে বরকত হাসিল করতে পারবে এবং সেখানে গিয়ে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলে, তার দু‘আ কবুল হবে। যেমন, ইমাম শাফেঈ (رحمه الله تعالي ) হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) এর মাযার শরীফে গিয়ে তাঁর পবিত্র কবর সামনে রেখে দু‘আ করতেন, যা তিরয়াক্ব পাথরের ন্যায় অতি দ্রুত কবুল হতো। হযরত আবদুল গণি নাবুলুসি (رحمه الله تعالي ) সকল প্রশ্নের উত্তর ওই দু’টি শব্দের দ্বারা দিয়ে দিয়েছেন যে, تعظيما لروحه উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহ'র প্রিয় মাহবুব বান্দাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন; মাটি, ইট ও পাথরের নয়। তাই উক্ত সম্মান প্রদর্শনকে ইবাদত আখ্যা দেয়া এবং নৈকট্যকে ইবাদত বন্দেগী মনে করা মানে হাজার হাজার আল্লাহর ওলি ও বুযূর্গানে দ্বীনকে শিরক ও কুফরীর সাথে লিপ্ত করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের কুধারণা থেকে রক্ষা করুন। যেমন- তাবুতে সকিনার কাহিনী আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজিদে উল্লেখ করেছেন। ফলে স্পষ্টতঃ একথা প্রতীয়মান হয় যে, বুযূর্গানে দ্বীনের তাবার্রুকাতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আবশ্যক। তাঁদের বরকতে মানুষের দু‘আ কবুল এবং হাজত পূর্ণ হয়। আর তাবাররুকাতের অবমাননা করা পথভ্রষ্টতারই কাজ এবং যা ধ্বংস হওয়াকে আবশ্যক করে।
164. তাওযীহাত-ই হাফত মাসআলা, পৃষ্ঠা-২২২।
আউলিয়া-ই কিরামের মাযারের ওপর গম্বুজ নির্মাণ সম্পর্কে আল্লামা গোলাম দস্তগীর কুরাইশী হাশেমী (رحمه الله تعالي ) ‘তারীখে মক্কা মুয়ায্যমা’ গ্রন্থের ৩০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, আমার তত্ত্বাবধানে ‘তোহাফায়ে ওহাবী’ নামক একটি কিতাব প্রকাশিত হয়েছে।
النَّاسُ عَلٰى دِيْنِ مُلُوْكِهِمْ . বাক্যের সত্যতা দেখুন যে, হিন্দুস্তান ও বাংলার ওহাবীরা প্রাথমিক যুগে বা প্রথম প্রথম তাদেরকে ওহাবী বললে খুব রেগে যেত এবং ক্ষোভ প্রকাশ করতো। কিন্তু বর্তমানে তারা অত্যন্ত গর্বের সাথে কিতাবের নাম ‘তোহফাতুল ওহাবীয়্যাহ’ রাখছেন। নজদীরা হিজাযে এসে হিন্দী আহলে হাদীসের জন্যে ওহাবী শব্দটির উপাধি ও সম্বোধন অত্যন্ত সম্মানের ফাঁদে ও তোড়ায় পরিণত হয়েছে। অথচ ইতিপূর্বে ওহাবী শব্দটি তাদের জন্য গালিগালাজ ও বদনাম ছিল।
‘তোহফাতুল ওহাবীয়্যাহ’ গ্রন্থের ৫৯ পৃষ্ঠায় লিখা আছে যে, সালেহীন ও বুযূর্গানে দ্বীনের কবরের ওপর যে গম্বুজ ও মীনার নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোও এক প্রকারের মূর্তি। অথচ কোরআন মজিদে মূর্তি ও প্রতিমাগুলোকে নাপাক ও অপবিত্র বলা হয়েছে। লোকেরা এগুলো হতে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দু‘আ করে থাকে। তাই এগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। নজদিরা বুযূর্গানে দ্বীনের মাযারসমূহ যা যিয়ারত করা ওয়াজিব, এগুলোকে মূর্তির সাথে তুলনা করে এবং নাপাক ও অপবিত্র বলে জঘন্যতম অপরাধ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও বেআদবী করেছে। আমরা কাউকে কখনো কবর থেকে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য প্রার্থনা করতে দেখিনি এবং শুনিনি বরং সাহেবে মাযার আউলিয়া-ই কিরামকে উসিলা বানিয়ে মুনাজাত করে থাকে। কবরসমূহকে ইমারত দ্বারা হিফাযত ও সংরক্ষণ করার বিষয়টি নবুয়তের যুগ এবং সাহাবা-ই কিরামের যুগ থেকে প্রমাণিত আছে
১. হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম(ﷺ)ইন্তিকালের স্থান উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنها)-এর হুজরায়, সেখানেই তাঁর রওজা শরীফ।
২. হযরাত আম্বিয়া-ই কিরামের পর সর্বোত্তম মানব হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضى الله تعالي عنه)-এর মাযার শরীফও হুযূর(ﷺ)-এর একই ছাদযুক্ত স্থানে হয়েছে।
৩. হযরত ফারুকে আযম ওমর (رضى الله تعالي عنه)-এর ইন্তিকাল নিকটবর্তী হলে তিনি অসিয়ত করেন যে, আমাকেও হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম ও সিদ্দীকে আকবর (رضى الله تعالي عنه)-এর পাশেই পবিত্র হুজরা শরীফে যেন দাফন করা হয়।
৪. উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনা (رضى الله تعالي عنها)কে ৩৮ হিজরীতে মক্কা মকার্রমা থেকে দশ মাইল দূরে অবস্থিত শরফ নামক স্থানের ওই ঘরে দাফন করা হয়, যেখানে তিনি হুযূর(ﷺ)-এর সাথে বাসর ঘরে আরাম করেছিলেন।
165. তিরমিযী শরীফ, باب ترويج المحرام , খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১১০।
যে ঘটনাটি হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)-এর খিলাফতকালে সংঘটিত হয়। যার সম্পর্কে নজদীরা প্রচার করে যে, তাঁকে উঁচু কবরসমূহ বিলীন করে দেয়ার হুকুম দেয়া হয়েছিল। পক্ষান্তরে এ হুকুমটি ছিল মুশরিকদের কবর সম্পর্কে। একথার ওপর কোন সাক্ষ্য প্রমাণ নেই যে, তিনি কোন মুসলমানের কবর বিলীন করে দিয়েছিলেন।
166. জওহরুন নক্বী, পৃষ্ঠা-২৬৫।
বুখারী শরীফে বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, হুযূর হযরত ওসমান বিন মাযউন (رضى الله تعالي عنه)-এর কবরের ওপর অনেক বড় পাথর দিয়ে উঁচু করে দিয়েছিলেন। যাতে হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম(ﷺ)-এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য সাহাবা-ই কিরামের কবর তাঁর পাশে দেয়া যেতে পারে।
আফসোস! পরিতাপের বিষয়!! নজদিরা সে সকল কবরসমূহ যা মদিনা মুনাওয়ারার জান্নাতুল বাক্বীতে ছিল, সব কবরই বিদীর্ণ ও চুরমার করে বিলীন করে দিয়েছে। প্রথম দিকে কবরসমূহের ইমারতের চারিপার্শ্ব সাধারণ কাঁচা ইট দ্বারা নির্মিত ছিল। ক্রমান্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদেরকে ধন-দৌলত দান করেন। ফলে তারা মসজিদ সমূহকে পাকা ও কারুকার্য দ্বারা শোভাবর্ধন করেন। আর বুযূর্গানে দ্বীনের বিশ্রামস্থল ও মাযারকেও তাঁদের শান ও মর্যাদা অনুপাতে বিশাল ও জাঁক-জমকপূর্ণ করে তৈরী করেন। এ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কোন আলেমদ্বীন অভিযোগ উত্থাপন করেননি। এখানকার ভারত-বাংলার যে সকল ওহাবী মোল্লারা হজ্ব করতে যেতো তারাও ফিরে এসে কখনো উক্ত ইমারত ও নির্মাণকে নাজায়েয বলে ভেঙ্গে ফেলার ফতোয়া প্রদান করেননি। কিন্তু যখনই নজদিরা মক্কা মুয়ায্যমার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করল, তখন থেকেই তারা ওই সকল বুযূর্গানে দ্বীনের শান-মান হ্রাস ও খর্ব করার নিমিত্তে তাঁদের পবিত্র মাযার ও নিদর্শনাবলিকে ভেঙ্গে বিলীন করে দিল।
কিন্তু হিন্দুস্থানের আহলে হাদীসরা অত্যন্ত কঠিন ভাষায় তাদের চরম বিরোধিতা করেছিলেন যে, এমন কখনো হতে পারে না। এতদ্সত্ত্বেও নজদি শায়খের বংশধরেরা তাদের হিংসাত্মক কার্যক্রম খুব দ্রুত বেগে প্রকাশ করল। তখন মসজিদ ও মাযার সমূহের বিভিন্ন নিদর্শনাবলী চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ভেঙ্গে দেয়ার পক্ষে জায়েয ফতোয়া প্রদানে তাদের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের সিলসিলা শুরু হয়। তখন তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের আলিম-ওলামারা ফতোয়া প্রদান করতে থাকেন যেমন, সৈয়্যদুনা মাযহার হুসাইন লাহোরীসহ শীর্ষ আলিমরা, তখন তাদের পক্ষ থেকে কোন প্রতি উত্তর আসেনি। বরং তাদের থিওরী ছিল যে, কারো কোন কথা শুনবে না এবং নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে এবং শায়খে নজদির মিশনকে সহযোগিতা ও বাস্তবায়ন করে যাবে।
❏ প্রশ্ন-১২৪ঃ মাযারসমূহ গোসল দেয়া জায়েযের সপক্ষে কী কোন দলিল আছে?
✍ উত্তরঃ وبه نستعين মাযারসমূহ গোসল দেয়া জায়েযের সপক্ষে এতটুকু দলিলই যথেষ্ট যে, যারা এটাকে নাজায়েয বলেছে তাদের হাতেই বর্তমানেও পবিত্র কা’বা শরীফকে গোসল দেয়া ও গিলাফ লাগানো হচ্ছে। সুতরাং شعائرالله কে সম্মান প্রদর্শন বিশেষ করে আউলিয়ায়ে কিরামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন মূলতঃ বিশ্ব প্রতিপালকের প্রিয় বান্দাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনরই অন্তভুর্ক্ত।
কোন সম্মানী ব্যক্তির আগমনে দাঁড়ানো এবং
না‘রা বা তাকবীর ধ্বনি দেয়ার বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১২৫ঃ কোন সম্মানিত ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির আগমনে না‘রা বা তাকবীর দেয়ার বিধান কী?
✍ উত্তরঃ এটা সুন্নাত ও সওয়াবের কাজ। আর উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উত্তম আদর্শ ও ভদ্রতার পরিচায়ক। পবিত্র কা’বা ঘর পুনঃনির্মাণকালে সৃষ্ট জটিলতা হুযূর কর্তৃক নিরসন ও সমাধানের পর আনন্দিত হয়ে উপস্থিত সবাই না‘রা দেয়। যখন হুযূর এর বয়স ৩২ বছর তখন কুরাইশগণ কা’বা শরীফকে নতুন করে নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যেহেতু পূর্বের নির্মাণ এত সুদৃঢ় ও মজবুত ছিল না যে, বন্যার প্লাবন মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। আর পবিত্র কা’বাও ছিল তখন সকল গোত্রের উপসনালয়। সে কারণে সকলেই আগ্রহী ছিল যে, উক্ত পূণ্যময় নির্মাণ কাজের সৌভাগ্য অর্জন করবে। তাই প্রত্যেক গোত্রের লোকেরা ভাগাভাগি করে কা’বা শরীফের দেয়াল নির্মাণ করেন। কিন্তু ‘হাজরে আসওয়াদ’ নির্ধারিত স্থানে রাখার প্রাক্কালে চরম জটিলতা দেখা দেয় এবং বিরোধ ও ঝগড়া চরম পর্যায়ে চলে যাওয়ার কারণে যুদ্ধ বেধে যাওয়া উপক্রম হয়ে যায়। পরিশেষে কুরাইশ গোত্রের সবচেয়ে বয়োজেষ্ঠ্য ব্যক্তি আবু ইলাহিয়া ইবনে মুগীরা সিদ্ধান্ত দেন যে, আগামীকাল সকালে যে ব্যক্তি সবার আগে হেরম শরীফে প্রবেশ করবেন তিনিই উক্ত সমস্যার ফয়সালা করবেন এবং তিনিই উক্ত কাজের উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হবেন। মহান আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছেও ছিল যে, কা’বা শরীফের নির্মাণ কাজ তাঁর প্রিয় হাবীব এর মাধ্যমে সমাপ্ত ও পূর্ণতা দান করবেন।
সুতরাং আগামীকাল সকালে সর্বপ্রথম যিনি হেরেম শরীফে তাশরীফ নিলেন, তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রিয় হাবীব মোস্তফা(ﷺ) । তাঁর আগমণে সকলেই খুশী হয়ে উচ্চস্বরে ‘নারায়ে তাকবীর’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন এবং বলতে থাকেন- এসেছেন আল-আমীন অর্থাৎ শান্তি ও নিরাপত্তাদানকারী এসেছেন। তিনি যা সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা সকলেই তা মেনে নেব। আর হুযূর (ﷺ) এমনভাবে সিদ্ধান্ত দিলেন যে, তা সকলেই সানন্দে গ্রহণ করেন এবং মেনে নেন।
❏ প্রশ্ন-১২৬ঃ কোন মজলিসে সম্মানিত ব্যক্তির আগমনে সমাবেশে উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে হযরাত ওলামায়ে কিরামের মতামত কী? যা বর্তমানে প্রচলিত আছে। শরীয়তের বিধান মতে তা জায়েয কিনা? এটির ওপর কিয়াস করে মিলাদুন্নবী -এর মাহফিলে দাঁড়িয়ে কিয়াম করার হুকুম কি?
প্রথমতঃ মিলাদুন্নবী -এর যিকির করার পর দাঁড়ানো। আর
দ্বিতীয়তঃ সম্মানিত ব্যক্তির আগমনে দাঁড়ানো।
উভয়টি কিন্তু এক নয়। কোন প্রকারের পার্থক্য ছাড়া একই হুকুম আরোপ করা কী? বিস্তারিত বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ عليه التكلان وهو المستعان কিয়াম শব্দের অর্থ দাঁড়ানো। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য সে কিয়াম যা কোন সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যক্তির আগমনে করা হয়। যা বর্তমানে সুপরিচিত ও প্রচলিত আছে যে, কোন সম্মানিত ব্যক্তি মজলিসে প্রবেশ করলে সমাবেশে উপস্থিত সকলেই তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যায়।
এ সম্পর্কে ‘আশি‘আতুল লুম‘আত’ ৪র্থ খন্ডর ৮ম পৃষ্ঠায় শায়খ মুহাক্কিক হযরত মুহাদ্দিস আবদুল হক দেহলভী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন যে, উক্ত মাসআলার ব্যাপারে ওলামায়ে কিরামের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কারো মতে, মাহফিলে প্রবেশকারীর সম্মানার্থে দাঁড়ানো সুন্নাত। তারা দলিল হিসেবে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضى الله تعالي عنه) বর্ণিত হাদীসটি উপস্থাপন করেন। হুযূর মোস্তফা(ﷺ) হযরত সা‘দ বিন মু‘আজ (رضى الله تعالي عنه)-এর আগমনে সাহাবা-ই কিরামদেরকে হুকুম দিয়েছিলেন-
قوموا الى سيدكم الخ
অর্থাৎ-‘তোমরা তোমাদের সরদার সা‘দের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাও।’
কতেক আলেম বলেন, এটা মাকরূহ, বিদ‘আত ও নিষিদ্ধ। তারা দলিল হিসেবে হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) বর্ণিত হাদীস পেশ করেন যে, হুযূর সৈয়্যদুল কাউনাইন (ﷺ) সাহাবা-ই কিরামদেরকে দন্ডায়মান হতে নিষেধ করেছেন এবং একথাও বলেছেন যে, তোমরা অনারব লোকদের মতো অন্যের সম্মানার্থে দাঁড়াইও না।
অবশ্য অত্র অধ্যায়ে উভয় প্রকারের হাদীস বিদ্যমান আছে। বর্ণিত আছে যে, কখনো হুযূর মোস্তফা(ﷺ) হুকুম করেছেন এবং কখনো অবস্থার প্রেক্ষাপটে নিষেধও করেছেন। সুমহান উত্তম চরিত্রের অধিকারী হুযূর মোস্তফা(ﷺ) -এর সাহাবা-ই কিরামগণও কখনো কারো সম্মানার্থে দাঁড়িয়েছেন আবার কখনো দাঁড়ান নি।
মুহাদ্দিসীনে কিরাম উভয় হাদীসের মধ্যে বৈপরীত্ব ও দ্বন্দ্ব এভাবে নিরসন করেছেন। কোন কোন ওলামা বলেছেন, এ সমাধান সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। আসল কথা হলো, উভয় হাদীসের সমন্বয় এভাবে করা যায় যে, রাসূলে পাক উম্মতকে উত্তম চরিত্র শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছেন। হাদীস শরীফে এসেছে- بعثت لاتمم مكارم الاخلاق ‘আমি উত্তম চরিত্র পূর্ণতাদানের নিমিত্তে প্রেরিত হয়েছি।’ মানুষের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকৃতির লোক। কেউ রয়েছেন উত্তম ও উৎকৃষ্ট। আল্লাহ্ তা‘আলা সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর অন্যরা তাদের মোকাবিলায় নিকৃষ্ট ও অধম। যাদেরকে এ সম্মান দেয়া হয়নি। স্বাভাবিকতঃ একথা স্পষ্ট যে, এ জাতীয় অবস্থার তারতম্যের কারণে স্বভাব-চরিত্রেও তারতম্য ও তফাত হওয়া আবশ্যক। যেমন- মুকীম বা স্থায়ী বসবাসকারীর হুকুম মুসাফিরের জন্য সমীচীন নয়। অনুরূপভাবে ধনাঢ্য ব্যক্তি ও ফকির আর স্বাস্থ্যবান ও রোগীর জন্য একই বিধান কখনো প্রযোজ্য নয়। অনুরূপভাবে সম্মানিত ও উৎকৃষ্ট ব্যক্তি; তাদের উৎকৃষ্টতা তাদেরকে নিম্নস্তরের লোকদের থেকে সম্মান প্রদর্শন কামনা করে। এমনকি তাদেরকে অহংকারী, দাম্ভিক ও আত্ম-পূজারী করে তোলে। তাই উৎকৃষ্টদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, অন্যদের থেকে সম্মান তালাশ করো না এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের ওপর অহংকার করো না। আর অন্যদেরকে শিক্ষা দিলেন যে, এ প্রকৃতির লোকদের তোমরা সম্মান করো না। যাতে মুসলমানদের মাঝে অধঃস্তনদের পক্ষ হতে সম্মান পাওয়ার মতো মহামারি ব্যাধি বিস্তার লাভ করতে না পারে। তাই হুযূর মোস্তফা (ﷺ) প্রভূর পক্ষ হতে শিক্ষার ওপর ক্ষান্ত না হয়ে স্বয়ং নিজেই বাস্তব নমুনা প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহর মহান রাসূল (ﷺ) হওয়া সত্ত্বেও স্বীয় তা‘যিমের জন্য মানুষজন দন্ডায়মান হওয়াকে জায়েয রাখেন নি। এটা ছিল আল্লাহর প্রিয় হাবীব (ﷺ)-এর শ্রেষ্ঠতম পর্যায়ের বিনয়-নম্রতা ও মিনতির সুস্পষ্ট প্রমাণ
الله اكبر وصلّى الله على سيدنا محمد وعلى اٰله واصحابه اجمعين-اللهم صل على سيدنا محمد صلّى الله عليه وسلّم ابدًا ابدًا.
হযরাত সাহাবা-ই কিরামগণ (رضى الله تعالي عنه) সৈয়্যদুল মুরসালীন মোস্তফা(ﷺ) -এর তা‘যিম ও সম্মানার্থে এ কারণে দাঁড়াতেন না যে, হুযূর তা পছন্দ করতেন না। অথচ তাঁদের চেয়ে অধিক সম্মান হুযূর -এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার মতো আর কে আছে? কারণ তাঁরা ভয় ও আদব রক্ষার্থে হুযূর (ﷺ)-এর সামনে উচ্চস্বরে কথাও বলতেন না।
অবশ্য আমাদের একথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কিয়ামের অনুমতি এবং তা নিষিদ্ধকরণের হুকুম দুই শ্রেণীর লোককে সম্বোধন করে দেয়া হয়েছে। আর কিয়াম হচ্ছে সম্মান প্রদর্শনের একটি নিয়ম ও রীতি মাত্র। কিয়াম ছাড়াও আরো অনেক নিয়ম ও মাধ্যম রয়েছে যা অবলম্বনে শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা যায়। ভদ্র, উৎকৃষ্ট ও মর্যাদাবান লোকদের ক্ষেত্রে এটি অবলম্বন করা আমলযোগ্য ও অপরিহার্য বিষয়।
কিয়ামে তা‘যিমী তথা সম্মানার্থে দাঁড়ানোর সাথে সাথে আমাদের কিয়ামের কথাও স্মরণে এসেছে যে, যা মওলুদ শরীফের মাহফিলে রাসূলে পাক (ﷺ)-এর বিলাদত শরীফের যিকিরের পর করা হয়। উক্ত কিয়ামের ব্যাপারে ওলামায়ে কিরামের মাঝে মতানৈক্য ও মতভেদ বৃদ্ধি পেয়ে রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষে উপনীত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে কম-বেশি, হ্রাস-বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত ও অতিরঞ্জিত প্রত্যেক পক্ষেই আছে।
নিষ্পত্তি ও সমাধানমূলক কথা এই যে, হুযূর পাক (ﷺ) -এর বিলাদত শরীফের আলোচনা এটা যিকিরে মাহফিলের অন্তভুর্ক্ত। তবে শর্ত হলো জাল হাদীস এবং বানোয়াট ঘটনা যেন না হয়। যাতে বিশুদ্ধ হাদীসের রেওয়ায়েত ও সঠিক ঘটনার পর্যালোচনার মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদ প্রমাণিত হয় এবং হুযূর পাক -এর বরকতময় জীবনের ঐ সকল দিকসমূহ বর্ণনা করা হয়, যার প্রেক্ষিতে মুসলমানদের স্বীয় জীবনের বিভ্রান্ত দিকগুলো সংশোধনের দিকে উৎসাহিত ও দৃষ্টি দিতে পারে। মহান আল্লাহর বাণী,
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ .
আয়াতের বাস্তবতা প্রকাশ
167. সূরা তাওবা, আয়াতঃ ১২৮।
সেমা’র বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১২৭ঃ সেমা তথা ধর্ম-সঙ্গীত সম্পর্কে ওলামায়ে কিরামের অভিমত কি এবং এর ফয়সালার পদ্ধতি কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ هوالمستعان সুর সংযোজন করে সেমা বা ধর্ম-সঙ্গীত পরিবেশন করার মাসআলা প্রসঙ্গে কুরআনের আয়াত ও পবিত্র হাদীস শরীফ পরস্পর বিরোধী ও বৈপরীত্য অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ .
‘এক শ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’
168. সূরা লোকমান, আয়াতঃ ৬।
এই পবিত্র আয়াত সেমা বা ধর্ম-সঙ্গীত নিষিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে।
হযরত আবু উমামা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেন, যখন কোন ব্যক্তি সুর ধ্বনি দিয়ে আওয়াজ উঁচু করে, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তার কাঁধের ওপর দু’জন শয়তান পাঠিয়ে দেন যারা তার বক্ষের ওপর গোড়ালী দ্বারা আঘাত করে, যাতে সে সুর সঙ্গীত থেকে ফিরে আসে।
169. তাবরানী রচিত আল-কবীর।
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা গায়িকা রমণী, তার ক্রয়ক্রিয়া, উপার্জন এবং শিক্ষা বিষয়কে হারাম করে দিয়েছেন।
170. তাবরানী রচিত আওসত।
হযরত জাবের (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেন, গান বা সুর সঙ্গীত মানুষের অন্তরে পাপের জন্ম দেয়, যেমনিভাবে পানি ক্ষেত উৎপাদন করে।
171. শু‘আবুল ঈমান।
গান ও বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার ব্যাপারে আরো অনেক দলিল রয়েছে।
এখন সেমা বা সুর-সঙ্গীত মুবাহ হওয়ার দলিলসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
উপরোক্ত কুরআনের আয়াত ও হাদীস শরীফ সেমা, গান, সুর-সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার প্রমাণ বহন করে। কিন্তু এমনও কতিপয় হাদীস শরীফ রয়েছে যা এটি জায়েয ও মুবাহ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার ঘরে তাশরিফ আনলেন, সে সময় দু’জন বালিকা আমার নিকট গান গাইতেছিল। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে।)
অন্যত্র বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) তাঁর নিকট আসলেন। এমন সময় দু’জন বালিকা আমার নিকট দফ্ বা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করছিল। আর রাসূলুল্লাহ তাঁর কাপড় দ্বারা মুখমন্ডল মুবারক ঢেকে রাখেন। তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) গায়িকা বালিকাদেরকে নিষেধ করেন। তা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চেহারা মুবারক হতে কাপড় সরিয়ে বললেন, আবু বকর তাদেরকে ছেড়ে দাও। যেহেতু আজ খুশির দিন।
‘সবিলুর রাশাদ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, যখন রাসূলে পাক মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ নিয়ে বনু নাজ্জার গোত্রে আরাম করছিলেন। তখন উক্ত গোত্রের মেয়েরা গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করেছিলেন
نحن جوار من بنى نجّار ۞ وحبذا محمد من جار .
‘আমরা হলাম বনি নাজ্জার গোত্রের রমণি। কি যে মুবারক ও সৌভাগ্যের কথা যে, আল্লাহ'র নবী মুহাম্মদ (ﷺ) হয়েছেন আমাদের প্রতিবেশী।’
ইমাম বায়হাকী (رحمه الله تعالي ) ‘দলাইলুন্ নবুয়ত’ গ্রন্থে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنه) হতে হাদীস বর্ণনা করেন। যা হুযূর(ﷺ)তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময় নাজ্জার গোত্রের রমণীরা নিম্নোক্ত কবিতা ছন্দাকারে পাঠ করার বর্ণনা রয়েছে।
طلع البدر علينا ۞ من ثنيات الوداع
وجب الشكر علينا ۞ ما دعى لله داع .
‘সনইয়াতুল বিদা’ হতে আমাদের ওপর পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে থাকবে আমাদের ওপর ওয়াজিব তাঁর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করা।’
ইমাম গাজ্জালী (رحمه الله تعالي ) তাঁর কবিতা চর্চা, দফ বাজানো এবং সুরেলা কন্ঠ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন।
মুহাম্মদ বিন হাতেব (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, হালাল ও হারামের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, বিবাহে সবাই দফ্ বাজাবে এবং গান-বাজনা করবে।
172. জামে‘ তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ শরীফ।
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنها) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলে পাক(ﷺ)ইরশাদ করেছেন, উক্ত বিবাহের প্রচার কর। আরো বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব ফারূকে আযম (رضى الله تعالي عنه) একদা এক নতুন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ঢোলের আওয়াজ শুনে জিজ্ঞেস করলেন যে, এখানে কি হচ্ছে কিসের শব্দ? উত্তরে বলা হলো, খৎনার উৎসব। তখন তিনি নিরবতা অবলম্বন করেন এবং নিষেধও করেন নি।
ফয়সালাঃ এখন যেহেতু সেমা বা সুর-সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে হালাল-হারাম নিয়ে বিপরীতমুখী দলিল এসেছে। তাই সৈয়্যদুনা ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) সতর্কতামূলক এটাকে হারাম বলেছেন। যেমন, উসূলে ফিকহের কায়েদা বা মূলনীতি হচ্ছে, দলিল পরস্পর বিপরীতমুখী হলে, তখন হারামকে হালালের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়। এমনকি তিনি ওয়ালিমাতেও গান জায়েয রাখেন নি।
173. হেদায়া-মাকরূহ অধ্যায়।
যে ব্যক্তি ওয়ালিমা কিংবা অন্য কোন যিয়াফতে আমন্ত্রিত হয়ে দাওয়াতে গিয়ে সেখানে গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র ও খেলাধূলা দেখতে পান। তখন সেখানে বসে তার খাবার গ্রহণ করাতে কোন অসুবিধা নেই।
ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) বলেন, আমি নিজেই এরকম অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম, তবে আমি ধৈর্যধারণ করেছিলাম। হিদায়া গ্রন্থকার বলেন, উক্ত মাসআলা একথা প্রমাণ করে যে, খেলাধূলার সকল সামগ্রী হারাম। এমনকি বাঁশি বাজিয়ে গান করাও হারাম। এজন্য ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) ‘নিজে লিপ্ত হয়েছি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। কেননা ‘লিপ্ত হওয়া’ শব্দটি হারাম বিষয়ে ব্যবহার করা হয়।
হযরত ইমাম শাফেয়ী (رحمه الله تعالي ) সুর দিয়ে গান করার ওই সকল হাদীসকে নিষিদ্ধ বলেছেন, যা শুধু গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র ও খেলাধূলার আনন্দ উপভোগ করার নিমিত্তে করা হয় অথবা যেখানে বিভিন্ন ধরনের ফিৎনা-ফাসাদের আশঙ্কা থাকে। আর যে সকল গান-বাজনা সৎ উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়। যেমন, বিবাহের প্রচার করা কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন বিষয়ের ওপর করা হয়, তাঁর মতে এটা মুবাহ। হানাফী মাযহাবের কিতাবসমূহেও এমন বর্ণনা বিদ্যমান আছে। অতএব হিদায়া গ্রন্থের ‘কিতাবুল গজব’ অধ্যায়ে লিখা আছে যে, গাজীদের লুন্ঠিত মাল এবং বিবাহ অনুষ্ঠানে দফ বা সুরেলা কন্ঠে গান-বাজনা করা মুবাহ। এগুলো নষ্ট করাতে দায়িত্বশীলতাকে আবশ্যক করে।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (رحمه الله تعالي ) ‘ইহইয়াউল উলূম’ শরীফে বলেছেন যে, গান ও বাদ্যযন্ত্র হারাম সম্পর্কে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তা ওই সকল গান-বাজনার ওপর প্রযোজ্য হবে, যা কেবল কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থের নিমিত্তে এবং রূপক ইশ্ক প্রেম দ্বারা শয়তানী চাহিদা ও উদ্দেশ্য পূরণে করা হয়। কিন্তু যে গান ও বাদ্যযন্ত্র আল্লাহর মুহাব্বত সৃষ্টি করে, তা সত্তাগতভাবে বৈধ ও মুবাহ। যখন বিবাহ অনুষ্ঠানে গান-বাজনা দ্বারা আনন্দ উৎসব বৃদ্ধি পায়; এ রকম আনন্দ উপভোগ করা যদি মুবাহ ও বৈধ হয়, তাহলে গান-বাজনা করাও মুবাহ ও বৈধ।
সুতরাং ঈদের দিন, বিবাহের দিন, প্রিয়জনের আগমনের দিন, ওয়ালিমার দাওয়াতে, সন্তান জন্ম লাভের উৎসবে, আকীকাহ, সুন্নাতে খাৎনা এবং কোরআন মজিদ হিফজ সমাপ্ত হওয়ার দিন ইত্যাদি খুশির দিনে গান-বাজনা ও খেলাধূলা করা বৈধ ও মুবাহ।
‘খযানাহ্’ ও ‘কাফি’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি নিষিদ্ধের ভিত্তি শুধুমাত্র খেলাধূলার সাথে সীমাবদ্ধ। আর গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র যদি অন্য কোন উদ্দেশ্যে করা হয় যেমন, বিবাহের সময়, ওয়ালিমায়, মুজাহিদদের বিজয়ে, সৈন্যবাহিনীর আগমনে এবং আল্লাহ্ তা‘আলার বান্দা সুফি দর্শনে অনুসারীদের আত্মার কোমলতা সৃষ্টির লক্ষে যেভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় সব ধরনের নিয়ম-পদ্ধতি অবলম্বন করা হানাফি মাযহাব মতে হারাম নয়।
ইম্সা‘ কিতাবে উল্লেখ আছে, গান ও ধর্ম-সঙ্গীত শুনাতে অন্তরের কোমলতা, আল্লাহভীতি এবং আল্লাহর দিদার লাভের আগ্রহ ও উৎসাহ-উদ্দীপনার উদ্ভব হয় এবং আল্লাহ'র গজব ও আযাবের ভীতি সৃষ্টি হয়। অতএব যে কাজের ফলাফল ইবাদতই হয়। যদি গান-বাজনা শুনাতে অবস্থা যদি এরকমই হয়, তাহলে সেখানে খেলাধূলা ও অনর্থক কাজের স্থানই বা কোথায়?
আলিমকুল শিরোমণি অলিকুল সরদার হযরত সৈয়দ শায়খ সিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (رحمه الله تعالي ) ‘আওয়ারিফুল মু‘আরিফ’ শরীফে বলেছেন,
السماع يستحب الرحمة من الله الكريم
‘সেমা আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত নিয়ে আসে।’
হযরত খাজায়ে খাজেগান খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (رحمه الله تعالي ) সেমা সম্পর্কে বলেন যে,
ونہ انكار ميكنم ونہ ايں كار ميكنم
অর্থাৎ ‘আমি এটাকে অস্বীকারও করিনা এবং আমি এটা নিজেও করি না।’
যেহেতু তার তরিকার ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে সুন্নাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, বিধায় তিনি তা করতেন না। নিঃসন্দেহে গান শ্রবণ করা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)এবং সাহাবা-ই কিরামের নিয়ম ও রীতি ছিল না। তাই তিনি নিষেধ করতে গিয়ে বলেন, نہ ايں كار ميكنم অর্থাৎ- ‘আমি এ কাজ বা আমল করি না’। আর যেহেতু তাঁর নিকট সেমা হারাম হওয়ার প্রমাণ ছিল না, তাই বলেছেন, نہ انكار ميكنم অর্থাৎ- ‘আমি অস্বীকারও করি না’। যদি তিনি হারাম মনে করতেন তাহলে অবশ্যই অস্বীকার করতেন। অতএব বলা যায় বিবাহ প্রচারকল্পে যদি দফ্ বাজানো হালাল বা মুস্তাহাব হয়ে থাকে, তাহলে ঢোল, সঁাতারা ও বাঁশী ইত্যাদি বাজানো দফের স্থলে তা হলে পার্থক্যটা কি? খেলাধূলা ও অনর্থক পাপাচারের ক্ষেত্রে সব কিছুই হারাম। আর সৎ উদ্দেশ্য ও পূণ্য কাজের জন্য সবই জায়েয।
বিবাহ-শাদীর প্রচার সকল কিছু দ্বারা করা যায়। দফ্ ইত্যাদির মাঝে পার্থক্য করা এটা অযৌক্তিক কথা। বাদ্য-বাজনা ও গীত-বাঁশী বাজানো নিষিদ্ধ মেনে নিলেও তা অকাট্য দলিল দ্বারা হারাম নয়। কেননা কেবল অকাট্য দলিল কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াত, মুতাওয়াতির হাদীস এবং ইজমা-ই উম্মত দ্বারা প্রমাণিত হয়।
যদি বলা হয় যে, সেমা বা বাদ্যযন্ত্র সহকারে ধর্ম-সঙ্গীত পরিবেশন করা মুবাহ বা বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে এটির আহ্ল বা উপযুক্ত হওয়া শর্ত। তবে এটা সত্য। কিন্তু বর্তমান যুগের অধিকাংশ দরবেশ লোক এটির আহ্ল বা উপযুক্ত নয়, বরং তারা বানোয়াট ও নামে মাত্র লোক দেখানো ওয়াজদ্ বা উম্মত্ততা প্রকাশ করে।
তার জবাব হচ্ছে, এমন কথা বলা উচিত হবে না যে, বর্তমান যুগে এমন লোক কেউ নেই, যারা এর উপযুক্ত। কেননা রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
لا يزال من أمتي قائمة
আমার উম্মতের মধ্যে বরাবরই এমন একটি দল প্রত্যেক যুগে বিদ্যমান থাকবেন যারা আল্লাহ'র হুকুমের ওপর অটল ও অবিচল থাকবে। তাদেরকে পরিত্যাগকারী কিংবা বিরোধীতাকারী ব্যক্তি তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। তিনি আরো বলেন,
مثل امتى كمثل المطر لايدرى اوّلها او اخرها .
‘আমার উম্মতের উদাহরণ ওই বৃষ্টি বারিধারা ন্যায়, যা সম্পর্কে ধারণা করা যায় না যে, এটির প্রথম উত্তম, না শেষাংশ উত্তম।’
জেনে রাখা আবশ্যক যে, আহলে ওয়াজদ বা খোদা প্রেমে আসক্তি তিন প্রকারঃ
প্রথমতঃ আহলে কামাল বা পূর্ণ উৎকর্ষতার অধিকারী দল। যাদের অন্তরাত্মায় আল্লাহ্ প্রেমের অযীফা ও যিকিরের সৃষ্টি হয় এবং যা তাদেরকে ইচ্ছাশক্তি বহির্ভূত ও ক্ষমতাহীন করে দেয়। এঁরা হচ্ছেন আল্লাহর দল। এঁদের অস্বীকার করা অবশ্যই দ্বীনের ক্ষতি সাধনকে আবশ্যক করে।
দ্বিতীয়তঃ ওই সকল লোক যারা উত্তম অবস্থা সৃষ্টির লক্ষে গান-বাজনা ও ধর্ম-সঙ্গীত শুনেন এবং চেষ্টা করেন যে, উক্ত কর্মপন্থা অবলম্বন করে খোদা প্রেমের উত্তম অবস্থা অর্জন করা যায়। এটাও প্রশংসিত দল।
তৃতীয়তঃ ওই সকল লোক যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আবেগাপ্লুত ও ভাবোদ্দীপনার ভাব দেখায়, যাতে লোকেরা তাকে আহলে কামাল বা পূর্ণ উৎকর্ষতা অর্জনকারী লোক মনে করে। এরা হলেন ফাসিক, বদকার ও বিদ‘আতী।
ইমাম গাজ্জালী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন, বানোয়াট ও লোক দেখানো ওয়াজদ্ বা ভাবোদ্দীপনা ভাব দেখানো এক প্রকার মন্দ ও নিন্দনীয়। আর তা হচ্ছে, বানোয়াটির মাধ্যমে লোক দেখানো অতীব ভদ্র ও প্রশংসিত অবস্থা বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করা। আর এটা একদিক দিয়ে প্রশংসিত- যারা উক্ত অবস্থা অর্জন করার আশা-আকাঙ্খা ও প্রত্যয় নিয়ে এ পন্থা অবলম্বন করেন। তাদের উক্ত অবস্থা এ ধরনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া এবং আধ্যাত্মিকতা অর্জন করা। কেননা অব্যাহত প্রচেষ্টা ও অর্জনের মাধ্যমে অবস্থার সৃষ্টি করার সফলতা আসে। তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সে সকল কোরআন তিলাওয়াতকারীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, কোরআন তিলাওয়াতের সময় যাদের কান্না না আসে, তারা যেন ইচ্ছে করে অন্তরে কোমলতা সৃষ্টির লক্ষে কান্নার ভান করে এবং চিন্তিত, বিষণ্ন চেহরা ও অনুতপ্ত হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি করে। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় যদিও ছলনা ও কৃত্রিমতার মাধ্যমে করা হলেও পরিশেষে বাস্তবিকপক্ষে সত্যি সত্যিই ওই প্রকৃত অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়।
স্মতর্ব্য যে, সেমার সময় যাদের ওয়াজদ্ বা ভাবাবেগ সৃষ্টি হতে দেখা যায়, তাদের অস্বীকার করা উচিত নয়।
174. কাজী ছানা উল্লাহ পানিপথি রহ রচিত ‘আস-সেমা’ গ্রন্থ হতে সংকলিত।
মাহবুবে ইলাহী হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (رحمه الله تعالي ) ‘ফাওয়াইদুল ফুয়াদ’ গ্রন্থে বলেছেন, বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে গান বাজনা ও ধর্ম-সঙ্গীত নিম্নোক্ত শর্ত সাপেক্ষে জায়েয।
১. সঙ্গীত গায়ক নারী ও বালক না হওয়া।
2.অশ্লীল ও অনর্থক কথা গানের মধ্যে না থাকা।
৩. সঙ্গীত শ্রবণকারী সকলই আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকা এবং এতে কুপ্রবৃত্তির চাহিদা পূরণকারী না থাকা।
৪. পেশাদার বাদ্যযন্ত্রকার ও গায়ক দ্বারা বাদ্য বাজনা না করা।
অতএব, উপরোক্ত শর্তাবলীর কোন একটি না থাকলে সেমা বা ধর্ম-সঙ্গীত শ্রবণ করা হারাম।
ওহাবী ফেরকার বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১২৮ঃ সংক্ষিপ্তাকারে ওহাবী সম্প্রদায়ের পরিপূর্ণ অবস্থা এবং তারা কতভাগে বিভক্ত হয়েছে তা যথাযথভাবে বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ عليه التكلان وهو المستعان ওহাবী একটি দল বা সম্প্রদায়ের নাম। যার প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব। যিনি নজদের উআইনিয়া এলাকায় ১৬৯১ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা অনেক কষ্ট করে তাকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। তারপর তিনি মক্কা মুয়ায্যমা ও বসরা শহরে গিয়ে দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করেন। সিহাহ সিত্তাসহ বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। অতঃপর তাঁর পিতার সঙ্গে মক্কা শরীফে হজ্বব্রত পালন করেন এবং মদীনা তাইয়্যেবা যিয়ারত শেষে শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে ইবরাহীমের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং এক বছর পর্যন্ত তার থেকে ফিক্বহ্ শাস্ত্র শিক্ষা করেন। অতঃপর নিজ দেশে ফিরে যান এবং সেখানকার মুজতাহিদ হন। তিনি প্রকাশ্যভাবে ইসলামী শরীয়তের অনুসরণ এবং এর মূলনীতিতে কোন ধরনের প্রার্থক্য করেন নি। কিন্তু যে সকল লোক ফাল (গণনা করে ভবিষ্যতের কথা বলা) দেখতেন, শগুন (শুভাশুভের নিদর্শন) মানতেন, মাযারসমূহকে সুসজ্জিত ও সম্মান করতেন, তামাক ব্যবহার করতেন এবং রেশমি কাপড় পরিধান করতেন তাদেরকে খারাপ বলতেন। কেননা এগুলো রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর শরীয়তের পরিপন্থী। কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ পাঠ করে তিনি ধারণা করেন যে, শরীয়তের মূলনীতিতে বিভিন্ন অবস্থার সংমিশ্রণের কারণে বিশাল পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। তখন তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন যে, মানুষদেরকে বিশেষ নিয়ম এবং ইসলামী শরীয়তের বিধান ও নীতিমালা এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যে, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শিক্ষা দিয়েছেন এবং আমল করেছেন। তার মতে, দুনিয়ার সকল মুসলমান পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। যে সকল পীর আউলিয়া-ই কিরামের কথা ও কাজের অনুসরণ করছে, তারা এ প্রথা নিজেদের ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যেই প্রচলন করতেছে।
তিনি ইমাম চতুষ্টয়ের আনীত নিয়ম-নীতি অনুসরণ করতে অস্বীকার করেছেন। কেবল পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফকে নিজের রাহনুমা বা পথপ্রদর্শক হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। লোকেরা তার কথা মেনে তার অনুসৃত নীতি অনুসরণ করতে লাগলো। যখন তার সঙ্গে আরো অন্যান্য দল একত্রিত হলো, তখনকার গভর্ণরের সঙ্গে মতবিরোধ হয়। অবস্থা জটিল ও বেগতিক দেখে তিনি তখনকার দরিনার প্রভাবশালী নেতা মুহাম্মদ বিন সউদ-এর নিকট গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইবনে সউদের সহযোগিতায় ওহাবী মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। দরিনার শাসক নতুন মাযহাবের উদ্ভাবকের সঙ্গে বংশীয় আত্মীয়তার বন্ধন স্থাপন করে তাকে আরো শক্তিশালী করে তোলেন। দরিনার এই নেতার পুত্র আবদুল আজিজ একজন প্রসিদ্ধ ওহাবী হন। ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে যখন ইবনে আবদুল ওহাব ও দরিনার নেতার ইন্তিকাল হয়, তখন আবদুল আজিজ তাদের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ওহাবী জামাআতকে আরো শক্তিশালী ও অগ্রগামী করলেন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ জয় করেন। আবদুল আজীজ বীর সাহসী যোদ্ধা ছিলেন না। ১৮০৩ খ্রীস্টাব্দে এক ইরানী তাকে হত্যা করেন। তারপর আবদুল আজীজের বড় সন্তান সউদ তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং তুমুল যুদ্ধ করে বিজয়ী হন। তিনি সমস্ত তুর্কী সম্রাজ্য জয় করার সংকল্প করেন এবং যুদ্ধ কৌশল অবলম্বনে কোন আপোষ করতেন না। তিনি বাল্যকাল থেকেই তরবারী হাতে নেন। সে বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ‘কারবালায়ে মুআল্লা’তে আক্রমণ করেন এবং সেখানকার কাফির ও মুশরিকদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। ইমামে হুম্মাম সৈয়্যদুশ শুহাদা আমীর হামযা আলাইহিস সালামের পবিত্র রওজা মুবারকের প্রতিও কোন ধরনের আদব ও সম্মান প্রদর্শন করেনি। নগদ টাকা, মণি-মুক্তা ও খনিজ সম্পদ সহ যা কিছু রওজা শরীফে সংরক্ষিত ছিল সব ওহাবীরা নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী বৎসর মক্কা অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং ওহাবী মতবাদ ও রীতি-নীতি চালু করে দেয়। হুক্কা, তাসবিহ, তাবিজ এবং রেশমী কাপড়ের টুকরোগুলো জোরপূর্বক সকল থেকে কেড়ে নিতেন এবং সকলের সামনে এগুলো জ্বালিয়ে দিতেন। নামাযের সময় হলে শরয়ী লোকেরা চাবুক ও বেত নিয়ে বের হতেন, ফলে লোকজন মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতেন।
মক্কা মুয়াযযামায় যখন তার মিশন পূর্ণতা লাভ করল এবং একচ্ছত্র আধিপত্য অর্জিত হল, তখন রোম সম্রাটের নিকট তার বিজয়ী সংবাদের চিঠি এভাবেই লিখে পাঠান যে,
‘সউদের পক্ষ হতে কন্স্টানটিনোপল সরকারের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমি ৪ঠা মুহাররম ১২১৮ হিজরী মোতাবেক পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করি এবং সেখানকার অধিবাসীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। আমি এই বরকতময় স্থান হতে ঐ সকল বস্তু অপসারণ করেছি যেগুলোকে মানুষ মূর্তির ন্যায় পূজা করতো। আমি যাবতীয় শুল্ক ও টেক্স মাফ করে দিয়েছি। আমি নবী করীম কর্তৃক প্রবর্তিত সকল নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করেছি, যা আপনি করেছিলেন। আমার ঐকান্তিক ইচ্ছে যে, আপনি সিরিয়া ও মিশরের গভর্ণরদের নির্দেশ দিবেন যে, সেখানকার লোকেরা যেন ঢোল-তবলা ও বাদ্য-যন্ত্র নিয়ে এখানে না আসে।’
দ্বিতীয় বছর মদিনা মুনাওয়ারায় বিজয়ী লাভ করে। তার মিশন এমন ভাবে পরিপূর্ণতার সাথে পরিচালনা করে যে, এমন কোন সেক্টর বা বিষয় ছিল না- যেখানে তার শাসন ক্ষমতা একচ্ছত্র আধিপত্য লাভ করেনি। এমন কি রাসূলে পাক -এর রওজা মুবারক ও বিশ্রাম স্থল থেকে চাঁদর মুবারক ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বপ্নযোগে সুসংবাদ পেল যে, হুযূর রহমতে ‘আলম বলেছেন, সাবধান! এ ধরনের অপকর্ম থেকে বিরত থাক। তাই সে উক্ত মত পরিবর্তন করেন। এখানে দীর্ঘ নয় বছর ইবনে সাউদ শাসন পরিচালনা করেন। ওহাবী দল সংখ্যায় এতো বেশী পৌঁছে গিয়েছিল যে, তুরস্ক সরকারের স্বীয় রাজত্ব হারানোর ভয় হয়। তাই সরকার আলী পাশাকে নির্দেশ দিলেন যে, বাতিল ওহাবী সম্প্রদায়কে পবিত্র স্থান থেকে জোরপূর্বক সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে আক্রমণ করা হোক। আলী পাশা হুকুম মোতাবেক সৈন্য বাহিনী জমায়েত করে তাদের হারামাইন শরীফাইন থেকে বের করে দিলেন। ১৮১৪ খ্রীস্টাব্দে ইবনে সাউদ মারা গেলে ছেলে আবদুল্লাহ তার স্থলাভিষিক্ত হন। যদিও সে কুচক্রী ও অসৎ প্রকৃতির ছিলেন কিন্তু যুদ্ধ কৌশলে পারদর্শী ছিলেন না। সব কিছুতেই সন্দেহ পোষণ করতেন। পরিশেষে ইবরাহীম পাশা তাকে গ্রেফতার করে কনস্টানটিনোপলে পাঠিয়ে দেন এবং সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। অতঃপর তার পুত্র ফয়সল তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে ১৮৬৬ খ্রীস্টাব্দে মারা যান। তারপর পুত্র আবদুল্লাহ তার স্থলাভিষিক্ত হয়। অতঃপর ওহাবী দলের সামরিক শক্তি একেবারে হারিয়ে যায়। পরিশেষে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব মনগড়া যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল, তা কিছু সংখ্যক মাযহাবের নেতা অনুসরণ করেছিল।
ওহাবীরা নিজেদেরকে- আহলে হাদীস, আহলে সুন্নাত, মুহাদ্দিস, হাদীস চর্চাকারী ও গবেষক এবং মওয়াহ্হিদ বা একত্ববাদী বলে থাকে এবং তাদের পরিপন্থী ও বিরোধীতাকারীদেরকে বিদ‘আতী বলে। আর আজকাল ওহাবী গাইরে মুকালিদরা, হানাফী মুকালিদ নামে প্রসিদ্ধ।
বর্তমানে এই দলটি বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত। এদের মধ্যে কেউ কেউ স্বঘোষিত নবী দাবীদার মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসারী। কেউ কেউ গোলাম নবী ছকরালভীর মাযহাবের অনুসারী, যারা নিজেদেরকে আহলে কোরআন বলে। তাদের নিকট হাদীস শরীফের কোন মূল্য নেই। তারা প্রত্যেক মাসআলা কোরআন মজিদ থেকে দলিল পেশ করতে চায়। এ সকল অপকর্ম ও ভ্রষ্টতার কারণে তারা তাকলীদ বা মাযহাব ছেড়ে দিয়েছে। ওহাবী ফেরকা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে আমার লিখিত ‘সংক্ষিপ্ত নজদি ওহাবীদের ইতিহাস’ গ্রন্থখানা অধ্যয়ন করার অনুরোধ করছি।
বিভিন্ন প্রকারের মাসায়েল এর বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১২৯ঃ অভিশপ্ত ইবলিশ কি সিজদার আদেশের মুকাল্লাফ (আজ্ঞাবহ) ছিল? কোরআন কারিমের পূর্বাপর বর্ণনা হতে বুঝা যাচ্ছে যে, وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا الخ. ‘যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা করো’ আয়াতাংশে প্রদত্ত আদেশটি কেবল ফেরেশতাদের ওপর প্রযোজ্য ছিল। অথচ ইবলিশ ফেরেশতাদের স্বজাতিভূক্ত ছিল না। তাই সিজদা না করার কারণে তাকে কেন অভিশপ্ত করা হল?
✍ উত্তরঃ দৃশ্যতঃ আয়াতে যদিও কেবল ফেরেশতাদের কথা উল্লেখ রয়েছে, তবে এটা শাব্দিক আধিক্য, নচেৎ আদেশ ইবলিশের ওপরও করা হয়েছিল। আল্লাহ্ তা‘আলার নিন্দা ও ক্রোধ এবং প্রশ্নোত্তর একথার প্রমাণ বহন করে বা নজির স্থাপন করে। অনেক সময় নজির স্থাপনের মাধ্যমে কোন ব্যক্তির ওপর আদেশদাতার পক্ষ হতে আদেশ প্রমাণিত হয়। এই পদ্ধতিতে সেও ওই আদেশের আজ্ঞাবহ ছিল। যে বিষয়ে নজির স্থাপিত হয়, সে বিষয়টি বিশদভাবে বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। আর এখানে কাহিনীর মধ্যে নজির বিদ্যমান রয়েছে। আর তা হচ্ছে যখন তার ওপর ক্রোধ ও নিন্দার কাহিনীটি বর্ণনা করা হলো, তখন এতে বুঝা গেলো যে, সেও ওই হুকুমের আজ্ঞাবহ ছিলো।
আবার সূরা আ‘রাফের এই আয়াতটিতে রয়েছে যে,
مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ.
‘যখন আমি আদেশ করলাম তখন তোমাকে সিজদা করতে কিসে বারণ করল’, এতে আদেশ দেওয়ার বিষয়টি অতি সুস্পষ্ট। প্রথম দলিলটি হচ্ছে আকলি বা বুদ্ধিভিত্তিক এবং দ্বিতীয় দলিলটি হচ্ছে দালিলিক বা তাত্ত্বিক।
175. ইমদাদুল ফতওয়া, খন্ড নং-৫, পৃষ্ঠা নং-১২; ফাতওয়ায়ে হক্কানীয়া, খন্ড নং-২, পৃষ্ঠা নং- ১৬৭, ।
❏ প্রশ্ন-১৩০ঃ জনৈক ব্যক্তি বিবাহের জন্য কিছু অর্থ সঞ্চয় করলো এবং তা নিসাবের সীমা অতিক্রম করলো। আর এই অর্থ কয়েক বছর যাবত তার নিকট গচ্ছিত রইলো। তবে পুরো বছর বিয়ে করার সুযোগ না হওয়ায় সে এখনো বিয়ে করেনি। তার এই সঞ্চিত অর্থ বিয়ের প্রয়োজন নির্বাহের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখন এই অর্থের ওপর একটি বছর অতিক্রান্ত হলে যাকাত ওয়াজিব হবে নাকি হবে না?
✍ উত্তরঃ যতক্ষণ পর্যন্ত এই অর্থ ব্যয় করা হবেনা ততক্ষণ বিয়ের প্রয়োজনাদি যাকাত ওয়াজিব হওয়ার ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না। বরং ওই ব্যক্তির ওপর যথারীতি যাকাত ওয়াজিব হবে। অনুরূপ পিতা তার সন্তান অর্থাৎ পুত্র-কন্যার বিয়ের জন্য অর্থ সঞ্চয় করলে এবং তা যাকাতের নিসাব পরিমাণ পৌঁছালে একটি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে।
وسبب لزوم ادائها توجه الخطاب
যাকাত প্রদান ওয়াজিব হওয়ার কারণ হচ্ছে আল্লাহ'র সম্বোধন অর্থাৎ আল্লাহ'র বাণী,
واٰتو الزكوٰة . وشرطه اى شرط افتراض ادائها حولان حول وهو فى ملكه وثمنية المال كالدراهم والدنانير الخ .
‘তোমরা যাকাত প্রদান করো’ এবং আদায় করা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত হচ্ছে সম্পদ ও সম্পদের মূল্য যেমন- দিরহাম ও দিনারের ওপর পূর্ণ একটি বছর অতিক্রান্ত হওয়া।
176. হাশিয়া আত্-তাহ্তাভী, খন্ড নং-১, পৃষ্ঠা নং ২৬৭ ও হিন্দিয়া ইত্যাদি।
❏ প্রশ্ন-১৩১ঃ সূরা ইয়াসিন এর তেলাওয়াত কখন ও কিভাবে করতে হয় এবং এর উপকার কী- দলিলসহ বর্ণনা কর ?
✍ উত্তরঃ শায়খ ইবনে হাইয়ান (رحمه الله تعالي ) ‘কিতাবুস্ সাওয়াব’-এ স্বীয় সনদে একটি রেওয়ায়ত এনেছেন,
حدثنا ابن ابى عاصم قال حدثنا عمر بن حفص الوصائى قال حدثنا سعيد بن موسى قال حدثنا رباح بن زيد عن معمر عن الزهرى عن انس رضى الله تعالٰى عنه قال قال رسول الله صلّى الله عليه وسلّم انى فرضت على امّتى قرأة يٰس كل ليلة فمن دوام على قرأتها كل ليلة ثم مات، مات شهيدًا .
অর্থাৎ উপরোক্ত সনদে বর্ণনা করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমি প্রতি রাতে সূরা ইয়াসিন এর পাঠ স্বীয় উম্মত এর ওপর ফরয করেছি। যে ব্যক্তি সর্বদা প্রতি রাতে নিয়মিত এই সূরাটি পাঠ করবে, অতঃপর সে মৃত্যুবরণ করলে শহীদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করবে অর্থাৎ তার শহীদী মৃত্যু নসীব হবে।’
যে সব বিষয় ও জিনিসের মধ্যে উম্মতে মুহাম্মদীর কপালে কল্যাণ রয়েছে তা ফরয করে দেওয়ার অধিকার রাসূলুল্লাহ'র (ﷺ) নিকট রয়েছে। এই রেওয়ায়তটিতে, انى فرضتُ على امّتى “আমি স্বীয় উম্মতের ওপর ফরয করেছি” বাক্যটি দ্বারা এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এটি আল্লাহ'র হুকুম এবং একই সঙ্গে নফলের ওপর নিয়মানুবর্তিতার বিষয়টিও প্রমাণিত হয়ে গেলো। فمن دوام على قرأتها “যে ব্যক্তি নিয়মিত এই সূরাটি পাঠ করবে” হাদিসের অংশটি হতে শায়খুল মাশায়েখ ইবনে হিব্বান এই হাদিসটি হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) হতে স্বীয় সনদে রেওয়ায়ত করেন।
177. সীরাতে মুস্তাফা, জানে রহমত, ইখতিয়ারাতে মুস্তাফা, খন্ড নং-৪, পৃষ্ঠা নং-২০৯, ।
নোটঃ ফরয দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমলী (কর্মগত) ফরয, বিশ্বাসগত ফরয নয়। কারণ তা পরিত্যাগকারীর ব্যাপারে শাস্তির কোন প্রসঙ্গ আসেনি।
❏ প্রশ্ন-১৩২ঃ উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের হাকীকত কী?
✍ উত্তরঃ এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার ওই মহান নেয়ামত যা তিনি আপন করুণা-অনুগ্রহে বিশেষভাবে আমাদেরকে দান করেছেন। আমাদের পূর্ববর্তী কোন উম্মত তা পায়নি।
যেমন-আসমানী গ্রন্থসমূহের মধ্যে আমাদেরকে দান করেছেন উম্মুল কিতাব (মূলগ্রন্থ) আল-কোরআন এবং রাসূলদের মধ্যে দান করেছেন তাঁকে যিনি নবী-রাসূলগণের সরদার। আর মাখলুকের মধ্যে দান করেছেন সর্বপ্রথম সৃষ্টি নবীগণের শ্রেষ্ঠ নবীকে। বাণী সমূহের মধ্যে দান করেছেন সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী। আর আমাদেরকে দান করেছেন সর্বপ্রথম ঘরটি। সূরা সমূহের মধ্যে দান করেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা সূরায়ে ফাতিহা। কালেমা সমূহের মধ্যে দান করেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম কালিমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’।
এভাবে যাবতীয় উত্তম ও শ্রেষ্ঠ নেয়ামতসমূহ আমাদেরকে দান করেছেন। অনুরূপ যে সব ইবাদত আল্লাহ'র দরবারে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ সে সব আমরা পেয়েছি। অসংখ্য কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্য যিনি শাশ্বত ও চিরন্তন الحمدُ للهِ حمدًا كثيرًا كثيرًا। নচেৎ বনি ইসরাঈলের ওপর দুই ওয়াক্ত নামায ফরয ছিল, তাও কেবল চার রাকাত; দু’রাকাত সকালে এবং দু’রাকাত বিকেলে। কিন্তু তাও তারা আদায় করেনি।
নাসায়ী শরীফে হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে,রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হাদিসে মি’রাজে বলেন,
فانّه فرض على بنى اسرائيل صلاتين فما قاموا بهما .
‘বনি ইসরাঈলের ওপর দুই ওয়াক্ত নামায ফরয ছিল। কিন্তু তাও তারা আদায় করেনি।’
যখন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের আদেশ করা হল, তখন হযরত মুসা (عليه السلام) হুযূরকে (ﷺ) বললেন, আপনি আবার যান এবং স্বীয় রবের নিকট এতে হ্রাসের প্রার্থনা করুন। কারণ তিনি বনি ইসরাঈলের ওপর দুই ওয়াক্ত নামায ফরয করেছিলেন। কিন্তু তারা তাও আদায় করেনি।
মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন, বনি ইসরাঈলের ওপর চার রাকাত নামায ফরয করা হয়েছিল; দুই রাকাত সকালে এবং দুই রাকাত বিকেলে। আর কথিত আছে, দুই রাকাত অপরাহ্নে। ‘খাসায়েসে উম্মতে মরহুমা’ গ্রন্থে রয়েছে যে,
ومنها مجموع الصلوات الخمس ولم تجمع لاحد غيرهم .
‘অনুগ্রহপ্রাপ্ত উম্মতের অন্যতম মাহাত্ম্য হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামায। এই উম্মত ছাড়া অন্য কারো জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায একত্রিত করা হয়নি।’
ইমাম যারকানী (رحمه الله تعالي ) নাসায়ীর হাদিসটির সূত্রে বলেন,
هذا هو الصواب وما وقع فى البيضاوى انه فرض عليهم خمسون صلاة فى اليوم والليلة، قال السيوطى هذا غلط ولم يفرض على بنى اسرائيل خمسون صلاة قط بل ولاخمس صلاة ولم تجمع الخمس الا لهذا الامة وانما فرض على بنى اسرائيل صلاتان فقط كما فى الحديث .
‘এটাই সঠিক। আর যে কথাটি বায়যাভীতে রয়েছে যে, বনি ইসরাঈলের ওপর দিবা-রাত্রি পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরয করা হয়েছিল- সে ব্যাপারে ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী বলেন, একথাটি অশুদ্ধ। বনি ইসরাঈলের ওপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায কখনো ফরয করা হয়নি। বরং পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও ফরয করা হয়নি। পাঁচ ওয়াক্ত নামায কেবল এই অনুগ্রহপ্রাপ্ত উম্মতের জন্য একত্রিত করা হয়েছে। হ্যাঁ! বনি ইসরাঈলের ওপর কেবল দুই ওয়াক্ত নামায ফরয ছিল যেমন হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে।’
শায়খ মুহাক্কিকসহ অন্যান্য বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ বলেন,
مجموع هذه الخمس من خصوصياتنا .
‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের একত্রীকরণ হচ্ছে, আমাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।’ ‘আশআতুল লুম‘আত’ নামক গ্রন্থে রয়েছে যে,
مجموع خمس اوقات مخصوص ايں امت است .
‘ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের একত্রীকরণ হচ্ছে এই উম্মতের বৈশিষ্ট্য।’
আবু দাউদ শরীফ, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ইত্যাদি হাদিসের কিতাবে হাসান সনদ সহকারে হযরত মুয়ায বিন জাবাল (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, হুযূর (ﷺ) ইশার নামাযের ব্যাপারে বলেনঃ
اعتموا بهذه الصلاة فانكم فضلتم بها على سائر الامم ولم تصلها امة قبلكم.
‘তোমরা ইশার নামায দেরী করে পড়ো। কারণ এর বদৌলতে তোমাদেরকে অন্যান্য সকল উম্মতের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। তোমাদের পূর্ববর্তী কোন উম্মত এই নামায পড়েনি।’
❏ প্রশ্ন-১৩৩ঃ বর্ণনাকারী এবং বৈশিষ্ট্য বা গুণ বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য হাদিস কত প্রকার?
✍ উত্তরঃ বর্ণনাকারী বিবেচনায় হাদিস চার প্রকার। যথাঃ মুতাওয়াতির, মাশহুর, আজিজ ও গরীব। বৈশিষ্ট্য বা গুণ বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য হাদিস চার প্রকার। যথাঃ সহীহ লি-যাতিহী, সহীহ লি-গায়রিহী, হাসান লি-যাতিহী ও হাসান লি-গায়রিহী।
❏ প্রশ্ন-১৩৪ঃ সূরা ইনশিরাহ এর আয়াত وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ ‘আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি’ এর ব্যবহার বা প্রয়োগ ব্যাপকার্থে করা। আয়াতটি দ্বারা একথা বলা যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য কেবল হুযূর নন, বরং যে সব ব্যক্তি জীবনের এই কাঠামোবদ্ধ সময়কালে চেষ্টা-সাধনা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে কর্ম করে উঁচু মর্যাদা অর্জন করেছেন, তারাও এই উচ্চতা-সমুচ্চতায় অন্তভুর্ক্ত। এই আয়াতটির এরূপ অর্থ-মর্মার্থ গ্রহণ করা কি সঠিক নয়? যেমন, বর্তমান যুগে কতিপয় নাস্তিক্যবাদী বিশ্বাস পোষণকারী এবং রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এর সাথে সমতুল্য হওয়ার দাবীদার লোকেরা এরূপ মনে করে এবং এই আয়াতটি হতে এরূপ অর্থ-মর্মার্থ গ্রহণ করে, এটা সঠিক কি না?
✍ উত্তরঃ এই আয়াতটি বিশেষতঃ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর সুউচ্চ মর্যাদার ব্যাপারে প্রশংসার স্থলে অবতীর্ণ হয়, সেখানে অন্য কারো জন্য কোনরূপ অর্থের অবকাশ নেই।
যেহেতু وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ এর ك ‘ক্বাফ’ বর্ণটি মধ্যম পুরুষবাচক একবচনের সর্বনাম যা দ্বারা কাউকে সম্বোধন করা হয় এবং এই আয়াতে সম্বোধিত ব্যক্তি হচ্ছেন বিশেষ ও এককভাবে হুযূর (ﷺ)। তাই এই আয়াতটিকে ব্যাপক বা সার্বজনীন অর্থে ব্যবহার করা এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে এতে অন্তভুর্ক্ত করা একধরনের বিকৃতি। সুতরাং তা সঠিক নয়। অত্র আয়াতে সমুচ্চ আলোচনা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, হুযূর এর বরকতময় নামটি আযান, কালেমা ও তাশাহ্হুদ ইত্যাদিতে আল্লাহর নামের সাথে উচ্চারণ বা স্মরণ করা উদ্দেশ্য, যা অন্য কেউ লাভ করতে পারেনা।
178. আহকামুল কোরআন, কুরতুবী, সূরা ইনশিরাহ, খন্ড নং-২, পৃষ্ঠা নং-১০৬।
এই আয়াতটি সূত্রে ইমাম মুহাম্মদ বিন আহমদ হযরত ইমাম দাহহাক হতে রেওয়ায়ত করেন যে, হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছেঃ
قال يقول له لاذكرتُ الاذكرتَ معى فى الاذان والاقامة والتشهد ويوم الجمعة على المنابر.
‘আল্লাহর নামের সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র নাম অবশ্যই আযান, ইকামত, তাশাহ্হুদ ও জুমার দিন মিম্বরে উচ্চারণ বা স্মরণ করা হয়।’
179. ফাতাওয়া হক্কানীয়া, খন্ড নং-২, পৃষ্ঠা নং- ১৫৮।
❏ প্রশ্ন-১৩৫ঃ ইসলামে শিরকের অবস্থান কী? উম্মতে মুহাম্মদীয়া হতে শির্ক প্রতীয়মান হতে পারে কি?
✍ উত্তরঃ শিরক আল্লাহর পবিত্র সত্তার সাথে একটি মহা অন্যায় ও অপরাধ কর্ম। إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ আল্লাহ্ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর মাধ্যমে শিরক নির্মুল করেছেন। ماحى الشرك والكفر তাই রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِنَّهُ خَرَجَ يَوْمًا فَصَلَّى عَلَى أَهْلِ أُحُدٍ صَلَاتَهُ عَلَى الْمَيِّتِ ثُمَّ انْصَرَفَ إِلَى الْمِنْبَرِ فَقَالَ إِنِّي فَرَطُكُمْ وَأَنَا شَهِيدٌ عَلَيْكُمْ إِنِّي وَاللهِ لَأَنْظُرُ إِلَى حَوْضِي الْآنَ وَإِنِّي قَدْ أُعْطِيتُ خَزَائِنَ مَفَاتِيحِ الْأَرْضِ وَإِنِّي وَاللهِ مَا أَخَافُ بَعْدِي أَنْ تُشْرِكُوا وَلَكِنْ أَخَافُ أَنْ تَنَافَسُوا .
‘হযরত উকবা বিন আমের (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বাইরে গেলেন এবং উহুদের (যুদ্ধের) শহীদগণের জন্য এভাবে নামায পড়লেন যেভাবে জানাযার নামায পড়া হয়। এরপর মিম্বরে সমাসীন হয়ে বললেন, আমি তোমাদের অগ্রপথিক অর্থাৎ আগে গিয়ে ব্যবস্থাপনাকারী এবং আমি তোমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্যদাতা। নিশ্চয় আমি এখন হাউযে কাওসার দেখতে পাচ্ছি এবং আমাকে দুনিয়ার (সম্পদরাজির) ভান্ডারসমূহের চাবি দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ'র কসম! আমার নিকট এরূপ কোন ভয় নেই যে, তোমরা শিরক করবে। তবে আমার ভয় হচ্ছে তোমরা দুনিয়াকে ভালবাসতে থাকবে।’ দুনিয়ার মোহে বিমোহিত হবে।
180. বুখারী শরীফ, কিতাবু বদ’উল খলক, কিতাবুল মানকিব, খন্ড-১, হাদীস নং-৩৩৬৭।
❏ প্রশ্ন-১৩৬ঃ নিম্নোক্ত হাদিসের অংশ,
فَإِنَّهَا تَذْهَبُ حَتَّى تَسْجُدَ تَحْتَ الْعَرْشِ ‘এটি (সূর্য) এভাবে চলতে চলতে আরশের নিচে সিজদাবনত হয়’ (বুখারী শরীফ)। হযরত আবু যর (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি বলেনঃ
قَالَ كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمَسْجِدِ عِنْدَ غُرُوبِ الشَّمْسِ فَقَالَ يَا أَبَا ذَرٍّ أَتَدْرِي أَيْنَ تَغْرُبُ الشَّمْسُ قُلْتُ اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ فَإِنَّهَا تَذْهَبُ حَتَّى تَسْجُدَ تَحْتَ الْعَرْشِ فَذَلِكَ قَوْلُهُ تَعَالَى وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ.
সূর্যাস্তের সময় আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এর সাথে মসজিদে ছিলাম। তখন তিনি বললেন, হে আবু যর! তুমি কি জানো সূর্য কোথায় অস্ত যায়। আমি বললাম, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই সমধিক জ্ঞাত। তখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেন, সূর্য চলতে চলতে আরশের নিচে সিজদাবনত হয়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, সূর্য তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তন করে। এটা মহাপরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্বের সকল দেশের সময় তো আলাদা আলাদা বা ভিন্ন ভিন্ন যেমন- আমাদের এখানে বাংলাদেশে রাত হলে তো অন্য কোন দেশে দিন হয়। এখন যদি আমরা এখান থেকে রাত ১২টা কিংবা ১টার সময় এই খবর প্রচার করি যে, সূর্য আরশের নিচে সিজদাবনত অবস্থায় আছে, তখন হয়ত অন্য কোন দেশে সকাল ৮টা বা ৯টা বাজবে এবং ওই দেশের লোকেরা বলবে যে, এখানে তো সূর্যকে উদিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং একথা সঠিক নয় যে, সূর্য আরশের নিচে সিজদাবনত অবস্থায় আছে। এখন অত্র হাদিসটির মর্মার্থ ও ব্যাখ্যা কী হবে?
✍ উত্তরঃ এই প্রশ্নটি নিরসনের জন্য ওলামায়ে কেরাম এই হাদিসটির নানা ধরনের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন যেমন, সাইয়েদ মাহমুদ আলুসী বাগদাদী (رحمه الله تعالي ) বলেন, সূর্যের আত্মা ঊর্ধ্ব জগতে গিয়ে সিজদা করে যা সূর্যের আবর্তনের সাথে সাংঘর্ষিক বা বিপরীত নয় বিশেষতঃ যখন এই অস্ত যাওয়ার বিষয়টি দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান কাজে আদিষ্ট হওয়া। এটি ‘বিকল্প প্রতিস্থাপন’ নীতিতে আল্লাহর কুদরতী শক্তির বদৌলতে সংঘটিত হয়। তাতে দৃষ্টিশক্তির কোন ভূমিকা নেই। কোন কোন আলেম এই ব্যাখ্যাটি প্রদান করেছেন যে, যেহেতু আরশের অবস্থান হচ্ছে গোটা বিশ্ব জগত ও সৃষ্টি জগতের ওপর, তাই সূর্য স্বীয় আবর্তনের সময় অবশ্যই আল্লাহ'র আরশের নিচ দিয়ে অতিক্রম করবে। এজন্য এতে কোন কথা বিবেক ও বুদ্ধি পরিপন্থী নয়, অবশ্যই বিবেক-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে। যেহেতু এই সংবাদটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দিয়েছেন যার সম্পর্ক আল্লাহর ওহীর সাথে, তাই তা উপলব্ধি করার ও প্রত্যক্ষ করার অবকাশ নেই। বরং এর ওপর ঈমান আনা আমাদের জন্য আবশ্যক।
আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (رحمه الله تعالي ) ‘উমদাতুল কারী’ পৃষ্ঠা নং ১১৯, খন্ড নং-৫, চন্দ্র-সূর্যের গণনাবাচক গুণ বিষয়ক অধ্যায়, সৃষ্টির সূচনা বিষয়ক কিতাব এবং অন্যান্য বর্ণনায় বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই সমধিক জ্ঞাত।
❏ প্রশ্ন-১৩৭ঃ ফিতনার সময় ঈমান, আক্বীদা ও আধ্যাত্মিক বা আত্মিক আমলসমূহ হিফাযতের জন্য ফিত্না-ফাসাদ হতে দূরে পালানোর ধরনটা কি রকম?
✍ উত্তরঃ ফিতনা হতে দূরে পালানোও দ্বীনের অন্তভুর্ক্ত বিষয় এবং এটা নবীগণের (عليه السلام) সুন্নত, যদিও তা এক বিঘত পরিমাণ হয়। ঈমান, আক্বীদা ও বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতার পরিবেশ যেখানে বিরাজমান হিজরত করে ওই ভাল পরিবেশে যাওয়া রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র সুন্নত। যেখানে অনুকূল পরিবেশ, কোরআন-সুন্নাহ ও বুযূর্গানে দ্বীনের রীতি-নীতির পরিবেশ এবং বিশেষতঃ বিশুদ্ধ ও সঠিক ঈমান ও আক্বীদার অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান, সেখানে হিজরত করতে হবে। নষ্ট ও বাতিল আক্বীদা হতে দূরে পালিয়ে থাকা জরুরী ও ওয়াজিব। আল্লাহ্ পাক সকলকে হেফাজত করুক। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেনঃ
يُوشِكُ أَنْ يَكُونَ خَيْرَ مَالِ الْمُسْلِمِ غَنَمٌ يَتْبَعُ بِهَا شَعَفَ الْجِبَالِ وَمَوَاقِعَ الْقَطْرِ يَفِرُّ بِدِينِهِ مِنْ الْفِتَنِ.
‘অতি শীঘ্রই মুসলমানদের সর্বোত্তম সম্পদ হবে ওই বকরীগুলো যেগুলো নিয়ে তারা পাহাড়ের চূড়ায় বা উপত্যকায় জীবন কাটাবে, যাতে তারা স্বীয় বিশুদ্ধ দ্বীনকে ওই যামানার ফিতনাসমূহ হতে সংরক্ষিত রাখতে পারে।’
181. বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড।
দ্বীনের সার্বিক ও সামগ্রিক উপকার ও সুবিধার প্রেক্ষাপটে সমাজবদ্ধ জীবন ইসলামে অধিক প্রিয় এবং নবীগণের (عليه السلام) কর্মপদ্ধতিও এটা যে, সমাজে অবস্থান করে নিজের ও সমাজের পরিশুদ্ধি ও সংশোধনের প্রতি মনোযোগ দেওয়া।
❏ প্রশ্ন-১৩৮ঃ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা হেঁটে হেঁটে কোন কিছু খাওয়ার হুকুম কী?
✍ উত্তরঃ যমযম এর পানি ছাড়া অন্য সব পানাহার দাড়িয়ে বা হেঁটে খাওয়া মাকরূহ। যমযমের পানি দাঁড়িয়ে পান করা মুস্তাহাব। অন্য সব পানাহার বসে খাওয়া উত্তম।
عَنْ ابْنِ عُمَرَ قَالَ كُنَّا عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَأْكُلُ وَنَحْنُ نَمْشِي وَنَشْرَبُ وَنَحْنُ قِيَامٌ .
‘হাদীস শরীফে হযরত ইবনে ওমর (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র যামানায় হেঁটে হেঁটে আহার করতাম এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করতাম।’
183. ইবনে মাজাহ।
বুঝা গেল যে, দাঁড়ানো অবস্থায় বা হাঁটা-চলা অবস্থায় পানাহার করা জায়েয। তবে ফকীহগণ যমযমের পানি ছাড়া অন্য কিছু পানাহার করাকে মাকরূহ বলেছেন। যমযমের পানি দাঁড়িয়ে পান না করা মাকরূহ। অন্যান্য সব পানি বসে পান করা উত্তম। দাঁড়ানো অবস্থায় বা হেঁটে হেঁটে আহার করা অনুত্তম এবং শিষ্টাচার পরিপন্থী। আর এতে ‘আদালত বা ন্যায়পরায়ণতা রহিত হয়ে যাবার আশংকা থাকে।
বুযূর্গদের তাবারুক এবং ওযুর উচ্ছিষ্ট পানিও দাঁড়িয়ে পান করা মুস্তাহাব। অবশিষ্ট যাবতীয় পানি বসে পান করা উচিত। হযরত শা‘বী (رحمه الله تعالي ) ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) হতে রেওয়ায়ত করেন যে, আমি হুযূরকে যমযম এর পানি পান করালাম, তিনি তা দাঁড়িয়ে পান করলেন।
শা‘বী বলেন, আমি এই হাদিসটি ইকরামা হতে বর্ণনা করছি যে, তিনি আল্লাহর নামে শপথ করে বললেন যে, রাসূলুল্লাহ এরূপ করেননি। হযরত ইকরামা নিজের ধারণা ও খেয়াল অনুযায়ী শপথ করেছেন, নতুবা প্রসিদ্ধ রেওয়ায়ত সমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তিনি যমযমের পানি দাঁড়িয়ে পান করেছেন। ওলামায়ে কেরাম বলেন, যমযমের পানি ও ওজুর উচ্ছিষ্ট পানি দাঁড়িয়ে পান করা মুস্তাহাব। অনুরূপ বুযূর্গদের তাবারুকও দাঁড়িয়ে পান বা আহার করা মুস্তাহাব। আর অবশিষ্ট সব কিছু বসে পান বা আহার করা উচিত।
হযরত ইকরামার পক্ষ হতে ইবনে ওমর (رضى الله تعالي عنه) বর্ণিত হাদিসটির জবাবে বলা হয় যে, এতে এই সম্ভাবনাটি রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) দাঁড়িয়ে যে যমযমের পানিটুকু পান করেছিলেন, তা হয়তো কোন অসুবিধার কারণে করেছিলেন। সেখানে হয় তো বসার জায়গা ছিলনা কিংবা ভীড়ের কারণে দাঁড়িয়ে পান করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন, দাঁড়িয়ে পানি পান করা প্রথমে নিষেধ ছিল। পরে এই নিষেধাজ্ঞা রহিত হয়ে গেলো। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রথমে জায়েয ছিলো, পরে নিষিদ্ধ হলো। হযরত জাবের (رضى الله تعالي عنه) হতে এধরনের কথা বর্ণিত রয়েছে। মোদ্দাকথা বসে পান করা উত্তম। তবে প্রয়োজনের সময় দাঁড়িয়ে পান করা যাবে। এই হুকুমটি উপরোক্ত পানি ব্যতীত সাধারণ পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
❏ প্রশ্ন-১৩৯ঃ বলা হয়ে থাকে যে, প্রাচ্য অঞ্চলের লোকেরা শেষ যামানায় হযরত সাইয়েদুনা ইমাম মাহদীর (عليه السلام) সাম্রাজ্যকে সুসংহত ও সুদৃঢ় করবে। একথা কি কোনো দলিল দ্বারা প্রমাণিত নাকি কেবল জনশ্রুতি?
✍ উত্তরঃ হ্যাঁ, ইবনে মাজাহ শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ বিন হারেস বিন জুমআ হতে বর্ণিত রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ বলেনঃ
يَخْرُجُ نَاسٌ مِنْ الْمَشْرِقِ فَيُوَطِّئُونَ لِلْمَهْدِيِّ .
‘প্রাচ্য দেশ হতে কিছু লোক বের হবে এবং তারা (ইমাম) মাহদীর (عليه السلام) সাম্রাজ্যকে সুসংহত ও সুদৃঢ় করবে অর্থাৎ তাকে সাহায্য করবে।’
বুঝা গেলো যে, ইমাম মাহদী (عليه السلام)’র বড় সাহায্যকারী হবে প্রাচ্য অঞ্চলের লোকেরা। মদীনা মুনাওয়ারা হতে এসব দেশ পূর্ব দিকে অবস্থিত যেমন- ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ইত্যাদি। সম্ভবতঃ ওই সব দেশের সঠিক আক্বীদা-বিশ্বাসের মুসলমানগণ তার সাথে যোগ দিবে। হযরত ইমাম মাহদীর (عليه السلام) আহবানে তার সাথে যোগ দেওয়া এবং তার সাহায্যকারী হওয়া বড়ই ভাগ্যের ব্যাপার। প্রাচ্যের এই ফরমানটি ব্যাপক এবং এতে কোন অঞ্চল বা এলাকা নির্দিষ্ট নয়। হযরতের সাহায্যকারী হওয়া কোন নগন্য ব্যাপার নয়।
কতিপয় মুহাদ্দেসীনে কেরাম বলেন, খৃস্টানদের শৌর্য-বীর্য ও সাম্রাজ্য কিয়ামতাবধি অটুট থাকবে অর্থাৎ ইমাম মাহদীর (عليه السلام) সময়কাল পর্যন্ত। একটি হাদিসে একথা পাওয়া যায় যে, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ খৃস্টান না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না।
বুঝা গেলো যে, ইমাম মাহদীর (عليه السلام) আগমনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত খৃস্টানদের শৌর্য-বীর্য ও সাম্রাজ্য অটুট থাকবে। অধিকাংশ লোক খৃস্টানদের সাথে মেলবন্ধন বজায় রাখবে। খৃস্টানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অধিক হবে। তাদের একটি পক্ষ ইহুদীদের সাহায্য করবে এবং অন্য পক্ষ মুসলমানদের সাথে নাম সর্বস্ব মৈত্রী স্থাপন করবে। এ কারণে হযরত ইমাম মাহদীর (عليه السلام) আগমনকালীন সময় পর্যন্ত তাদের শৌর্য-বীর্য বাড়তে থাকবে। মদীনা শরীফ হতে পূর্ব দিকে অবস্থিত অঞ্চলের লোকেরা তার সাহায্যকারী হবে। ইমাম মাহদীর (عليه السلام) আর্বিভাবের পর তাদের (খৃস্টানদের) শৌর্য-বীর্য খতম হয়ে যাবে। যদিও হাদিসটি দূর্বল, তবে বর্তমান পরিস্থিতির কারণে কিছুটা শক্তিশালী বলে মনে হয়।
কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সমধিক জ্ঞাত।
❏ প্রশ্ন-১৪০ঃ ইবলিশ শয়তান কি বিতাড়িত হওয়ার পূর্বে ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলো?
✍ উত্তরঃ তাফসীরে ইবনে কাসিরে নানা ধরনের বক্তব্য উল্লেখ রয়েছে যা দ্বারা একথাটি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে,
شيطان قبل المسخ من اشراف الملائكة وخازن الجنةو سلطان السماء الدنيا والارض.
‘শয়তান বিতাড়িত হওয়ার পূর্বে ছিলো ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, জান্নাতের কোষাধ্যক্ষ এবং পৃথিবীর সন্নিকটস্থ আকাশ ও পৃথিবীর সম্রাট। আর ইলমে ইজতিহাদে সে ছিলো ফেরেশতাদের চেয়ে এগিয়ে।’
ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) বলেন,
قال ابن عباس رضى الله عنه كان ابليس من اشرف الملائكة واكرمهم قبيلة، وكان خازنا على الجنان وكان له سلطان السماء الدنيا وكان له سلطان الارض.
‘ইবলিশ ছিলো ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, গোত্রীয় দিক দিয়ে তাদের চেয়ে সম্মানিত, জান্নাতসমূহের কোষাধ্যক্ষ। তার অধীনে ছিলো পৃথিবী ও আকাশের রাজত্ব।’
184. আহকামুল মারজান, পৃষ্ঠা নং-১৫৫, হায়াতুল হাইওয়ান দামিরী, খন্ড নং-১, পৃষ্ঠা নং-২৯৮; তাফসীরে ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা নং-৭৫, ফেরেশতাগণ কর্তৃক আদমকে সিজদা সম্পর্কীত অধ্যায়।
كان من اشدهم اى اشد الملائكة اجتهادًا واكثرهم علما، كان اشرف الملائكة من ذوالاجنحة الاربعة كان من اشراف الملائكة واكرمهم قبيلة وكان خازنا على الجنان . كان له سلطان السماء الدنيا وكان له سلطان الارض . وكان يسوس ما بين السماء والارض فعصى فمسخه اللهُ شيطانا رجيما كان ابليس رئيس الملائكة السماء الدنيا.
‘সে ইজতিহাদের দিক দিয়ে ফেরেশতাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলো এবং জ্ঞানের দিক দিয়ে ছিলো তাদের চেয়ে অধিক জ্ঞানের অধিকারী। সে ফেরেশতাদের মধ্যে মর্যাদাশীল চার ফেরেশতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলো এবং গোত্রীয় দিক দিয়ে তাদের চেয়ে সম্মানিত। সে ছিলো জান্নাতসমূহের কোষাধ্যক্ষ। তার হাতে ছিলো পৃথিবীর সন্নিকটস্থ আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব। আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী অবস্থিত সকল কিছুর ওপর চলত তার শাসন ক্ষমতা। অতঃপর সে আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করলো। এরপর আল্লাহ্ শয়তানকে অভিশপ্ত অবস্থায় বিতাড়িত করলেন। ইবলিশ ছিলো পৃথিবীর সন্নিকটস্থ আসমানের ফেরেশতাদের সরদার।’
❏ প্রশ্ন-১৪১ঃ হযরত ইবরাহিম (عليه السلام), ইসমাইল (عليه السلام) এর স্থলে যে দুম্বাটি জবাই করেছিলেন ওই দুম্বাটির গোশত কারা ভক্ষণ করেছিলো?
✍ উত্তরঃ হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) কর্তৃক জবাইকৃত পশুটির গোশতের ব্যাপারে আল্লামা শায়খ আহমদ সাভী (رحمه الله تعالي ) লিখেন, এই পশুটির গোশত ভক্ষণ করেছিলো জীব-জন্তু ও পক্ষীকুল। কারণ তা রান্না করা ছিলো কঠিন, বরং এক প্রকার অসম্ভবই ছিলো। কেননা জান্নাতী গোশতের ওপর আগুনের কোন ধরনের প্রভাব থাকেনা।
وبقىٰ قرناه معلقين على الكعبة الى ان احترق البيت فى زمن ابن الزبير وما بقىٰ من الكبش اكلته السباع والطيور لان النار لا تؤثر فيها وهو من الجنة .
‘ইবনে যুবায়ের (رحمه الله تعالي ) এর শাসনকালে বায়তুল্লাহ শরীফে অগ্নিকান্ড হওয়া পর্যন্ত সময়ে এই পশুর শিং দু’টি কা’বা শরীফের ওপর লটকানো অবস্থায় ছিলো এবং এর অবশিষ্টাংশটুকু জীব-জন্তু ও পক্ষীকুল ভক্ষণ করেছিলো। কারণ আগুন পশুটির ওপর কোন প্রভাব রাখতে পারে না। যেহেতু তা ছিলো জান্নাতী পশু।’
185. তাফসীরে সাভী, খন্ড নং-৪, পৃষ্ঠা নং-৩৪, ।
তাফসীরে জুমল এর ৩য় খন্ড ৫৪৯নং পৃষ্ঠায় সূরা আস্-সাফ্ফাত এর তাফসীরে রয়েছে যে,
وقد بقىٰ قرناهُ معلقين على الكعبة الى ان احترق البيت فى زمن ابن الزبير ومن المعلوم المقرر ان كل ماهو من الجنة لا نؤ ثر فيه النار فلم يطبخ لحم الكبش بل اكلته السباع والطيور.
‘ইবনে যুবায়ের (رحمه الله تعالي )এর শাসনকালে বায়তুল্লাহ শরীফে অগ্নিকান্ড ঘটা পর্যন্ত এই পশুটির শিং দু’টি কা’বা শরীফের ওপর লটকানো অবস্থায় ছিলো। এ কথাটি স্বীকৃত যে, এই পশুটি ছিলো জান্নাতী। আগুন যার ওপর কোন প্রভাব রাখেনা। দুম্বাটির গোশত রান্না করা হয়নি। বরং তা জীব-জন্তু ও পক্ষীকুল ভক্ষণ করেছিলো।’
185. বাদায়ে আল যাহুর, পৃষ্ঠা নং-৮০; সূরা আস্-সাফ্ফাত, হযরত ইসমাইল (আ) এর জবেহের কাহিনী।
❏ প্রশ্ন-১৪২ঃ কে শাসন ক্ষমতার জন্য অধিক যোগ্য হবেন? অনভিজ্ঞ মুত্তাকী ও আলেমে দ্বীন নাকি অভিজ্ঞতা আলেম নন এমন মানুষ?
---
কোন দেশে যদি এমন একজন ব্যক্তি থাকেন যিনি মুত্তাকী, পরহেযগার ও আলেমে দ্বীন, তবে অনভিজ্ঞ। আবার যদি এমন একজন ব্যক্তি থাকেন যিনি মুত্তাকী ও আলেমে দ্বীন নন, তবে শাসনকার্য ও ব্যবস্থাপনা কার্যে ব্যাপক অভিজ্ঞতার অধিকারী- এখন প্রশ্ন হচ্ছে এতদুভয়ের মধ্যে কে শাসন ক্ষমতার জন্য অধিক যোগ্য ও অধিকারী হবেন?
✍ উত্তরঃ কালাম শাস্ত্রের কিতাবাদিতে রয়েছে যে, খিলাফত ও শাসন ক্ষমতার প্রধান হওয়ার জন্য নিষ্পাপ হওয়া শর্ত নয়, অনুরূপ এটাও শর্ত নয় যে, তাকে সমকালীনদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ হতে হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি দক্ষ ও রাষ্ট্রের শাসন কার্যের ব্যাপারে অভিজ্ঞ, সে আলেম ও মুত্তাকী না হলেও তাকে শাসন ক্ষমতার প্রধান বা আমির বানানো জায়েয। তবে যে ব্যক্তি শরীয়তের সীমা লঙ্ঘন করে, তাকে আমির বানানো জায়েয নয়।
186. শরহুল আক্বায়েদ, পৃষ্ঠা নং-১৫৬
‘আল-খিলাফাহ ওয়াল ইমারাহ’ গ্রন্থে রয়েছে যে,
ولا يشترط فى الامام ان يكون افضل من اهل زمانه لان المساوى فى الفضيلة بل المفضول الاقل علما وعملا اى كان اعرف بمصالح الامامة ومفاسدها واقدر على القيام بمواجبها خصوصًا اذا كان المفضول ادفع للشر وابعد عن اثارة الفتنة .
‘নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার জন্য এটা শর্ত নয় যে, তাকে সমকালীনদের মধ্যে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ হতে হবে। কেননা মর্যাদায় সমকক্ষ ব্যক্তি, বরং ইলম ও আমলে কম মর্যাদাবান ব্যক্তিও যিনি রাষ্ট্রের স্বার্থ ও সমৃদ্ধির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন বিশেষতঃ যিনি রাষ্ট্রের স্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধ করতে পারেন এবং ফিতনার আলামত দূর করতে পারেন- এমন ব্যক্তি স্বল্প জ্ঞানী হলেও তাঁকে রাষ্ট্র প্রধান করা জায়েয।’
‘শরহুল মুজাল্লাহ্’ গ্রন্থে রয়েছে যে,
يجوز تقليد الفاسق وتنفذ قضاياه اذالم يجاوز فيها حدالشرع .
‘ফাসিক ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয়তের সীমালঙ্ঘন করবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মেনে চলা এবং তার সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করা জায়েয।’
187. শরহুল আক্বায়েদ, পৃষ্ঠা নং-১৬৪
আমাদের আবেদন! যারা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র মান-মর্যাদায় বেয়াদবী করে এবং অশালীন ও অশ্রাব্য কথাবার্তা বলে, বাংলাদেশের আইনে তাদের মৃত্যুদন্ডের শাস্তি সংসদে পাশ করার জন্য সুপারিশ করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। তাই ক্ষমতাসীনদের নিকট আমাদের জোর আবেদন হচ্ছে, এই আইনটি সংশোধন করতঃ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র মান-মর্যাদায় যারা বেয়াদবী করে তাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের শাস্তির বিধান করা হোক। কারণ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র পবিত্র মান-মর্যাদার ব্যাপারে অনুচিত শব্দ ব্যবহার করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তাই মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হচ্ছে যারা রাসূলুল্লাহ'র শানে বেয়াদবী করে তারা মুরতাদ এবং তাদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব।
ফতোয়ায়ে শামীতে রয়েছে,
اجمع المسلمون ان شاتمه كافر
‘রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কে গালমন্দকারী মুসলমানদের সর্বসম্মত মতে কাফির।’ তার বিধান হচ্ছে মুরতাদের বিধানের অনুরূপ ان حكمه كالمرتد এবং তার ওপর মুরতাদের বিধান প্রয়োগ করা হবে।
188. দুররুল মুখতার, মুরতাদ অধ্যায়, পৃষ্ঠা নং-৩১৮
ফতোয়ায়ে শামীতে একথাও রয়েছে যে,
اجمع المسلمون ان شاتمه كافر وحكمه القتل ومن شك فى عذابه كافر.
‘এটা মুসলমানদের সর্বসম্মত মত যে, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কে গালমন্দ করে সে কাফির এবং যে ব্যক্তি তার (গালমন্দকারী) কুফরীর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে সেও কাফির।’
ফতোয়ায়ে আলমগিরীতে রয়েছে যে,
اهانة النبى صلّى الله عليه وسلّم بالاجماع كفر .
‘ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কে অসম্মান করা সর্বসম্মত মতে কুফরী।’
189.দুররুল মুখতার, মুরতাদ অধ্যায়, খন্ড নং-২, পৃষ্ঠা নং-২৬৩
উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ হতে প্রতীয়মান হয় যে, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র শানে (মান-মর্যাদা) বেয়াদবী করে, সে সর্বসম্মতভাবে কাফির ও মুরতাদ এবং যে ব্যক্তি তার কুফরীর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে সেও কাফির এবং ইসলাম হতে বহিষ্কৃত। আর মুরতাদের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড। সুতরাং রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র প্রতি বেয়াদবী প্রদর্শনকারীদের শাস্তি মৃত্যুদন্ডই।
হাদিস শরীফে বর্ণিত রয়েছে যে,
من بدّل دينه فاقتلوهُ
‘যে ব্যক্তি স্বীয় দ্বীন (ধর্ম) পরিবর্তন করলো, তাকে হত্যা করো।’রাসূলুল্লাহ্(ﷺ)’র ওফাতের পর সাহাবায়ে কেরাম এ বিষয়ের ওপর সর্বসম্মতভাবে ঐকমত্য পোষণ করলেন যে, মুরতাদের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড।"
190. বাদায়েয়ুস সানায়ে, মুরতাদ অধ্যায়।
‘রাসায়েলে ইবনে আবেদীন’ এর মধ্যে রয়েছে যে, মুসলিম উম্মাহ একথার ওপর ঐকমত্য পোষণ করে যে, মুরতাদের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ডই। ‘বাহরুর রায়েক্ব’ গ্রন্থের মুরতাদ অধ্যায়ে রয়েছে যে, যে ব্যক্তি মুহাম্মদ এর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবে কিংবা তাঁকে গালমন্দ করবে, সে কাফির ও মুরতাদ এবং তাকে হত্যা করা ওয়াজিব।
191. বাদায়েয়ুস সানায়ে, মুরতাদ অধ্যায়।
অনুরূপ নবীগণের মধ্যে কোন নবীকে গালমন্দকারী কাফির। ‘উকূদুদ দুররিয়াহ ফি তানকিহিল হামিদ’ গ্রন্থে রয়েছে যে,
سب النبى صلّى الله عليه وسلّم او احد من الانبياء عليهم السلام كفر
‘ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কিংবা নবীগণের (عليهم السلام) কোন একজন নবীকে (عليه السلام) গালমন্দ করা কুফরী।’
ওলামায়ে দেওবন্দের অভিমতঃ এখন ওলামায়ে দেওবন্দ এর মতামত ও ফতোয়া পেশ করছি। তারাও এ বিষয়ে একমত। মুফতী কেফায়াতুল্লাহ সাহেবও ‘কেফায়তুল মুফতী’ নামক গ্রন্থে এই মাসআলাটির ব্যাখ্যা-বিশেষণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কিংবা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنه) এর মহান মর্যাদায় শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণকারী ব্যক্তি কিংবা এরূপ শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণকারী ব্যক্তির প্রতি যে ব্যক্তি অসন্তোষ প্রকাশ করবেনা, সেও কাফির। ফোকাহায়ে কেরাম (رحمه الله تعالي ) এ বিষয়ে একমত যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র পবিত্র মান-মর্যাদার প্রতি শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণকারী ব্যক্তি কাফির।
192. কেফায়াতুল মুফতি, মুরতাদ অধ্যায়, পৃষ্ঠা নং-৭১, খন্ড নং-১।
মুফতী মাহমুদ দেওবন্দী গাঙ্গুহী সংকলিত ‘ফতোয়া মাহমুদিয়া ’ এর মধ্যে রয়েছে যে, যে ব্যক্তি হুযূর (ﷺ) এর পবিত্র মান-মর্যাদায় গালমন্দ করবে এবং অশালীন কথাবার্তা বলবে, সে মুরতাদ এবং ইসলামের পরিসীমা হতে বহিষ্কৃত। তাওবা করা তার জন্য আবশ্যক। আর যদি সে তাওবা না করে, তাহলে তাকে হত্যা করা ওয়াজিব।
193. ফতওয়া মাহমুদিয়া, পৃষ্ঠা নং-১৬২, খন্ড নং-১২
থানভী দেওবন্দী কর্তৃক সংকলিত ‘এমদাদুল ফাতাওয়া’ এর মধ্যে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ও বেয়াদবী করা কুফরী।
194. এমদাদুল ফতওয়া, আকায়েদ অধ্যায়, পৃষ্ঠা নং-৩৯১, খন্ড নং-৫।
‘ফাতাওয়া দারুল উলুম দেওবন্দ’ কিতাবের মুরতাদ অধ্যায়ে রয়েছে যে, নবী করিমকে (ﷺ) গালমন্দ করা কুফরী।
195. এমদাদুল ফতওয়া, পৃষ্ঠা নং-৩৫৯
রাসূলুল্লাহ(ﷺ)’র শানে শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণকারী ব্যক্তি সর্বসম্মত মতে কাফির ও মুরতাদ এবং তাকে হত্যা করা ওয়াজিব।
তবে মতানৈক্য কেবল এ বিষয়ে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)’র শানে শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণকারী ব্যক্তি কি তাওবার কারণে মৃত্যুদন্ড হতে রেহাই পাবে নাকি পাবেনা। ‘ফতোয়ায়ে শামী’ এর মধ্যে রয়েছে যে,
اجمع المسلمون ان شاتمه كافر وحكمه القتل
"রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র শানে বিয়াদবী প্রদর্শনকারী ব্যক্তি কাফির এবং তার বিধান হচ্ছে হত্যা বা মৃত্যুদন্ড।’
‘আল আশবাহ ওয়ান নাযায়ের’ গ্রন্থে রয়েছে যে,
لا تصح ردة السكران الاالردة بسب النبى صلّى الله عليه وسلّم فانه يقتل ولايعفى عنه . كذا فى البزازية كل كافر تاب فتوبته مقبولة فى الدنيا والاخرة الاجماعة الكافر يسب النبى صلّى الله عليه وسلّم وسائر الانبياء يعقب .
‘নবী করিম (ﷺ) কে গালমন্দ করা কুফরী যদিও কেউ মাতাল অবস্থায় গালমন্দ করে থাকুক। আর নবী করিম (ﷺ) কে গালমন্দকারী ব্যক্তির তাওবা কবুল হবে না।’
196. এমদাদুল ফতওয়া, খন্ড-১, পৃষ্ঠা নং-২৮৬।
‘ফতোয়া হিন্দিয়া’ এর মধ্যে রয়েছে যে,
استخفاف النبى صلّى اللهُ عليه وسلّم كفر.
নবী করিম কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা কুফরী।’
‘ফতোয়ায়ে কাযীখান’ এর মধ্যে রয়েছে যে,
اذا عاب الرجل النبى صلّى الله عليه وسلّم فى شئى كان كافرا وتكر فى الاصل ان شتم النبى صلّى الله عليه وسلّم كفر .
রাসূলুল্লাহ কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও গালমন্দ করা কুফরী ও ইরতিদাদ (মুরতাদ হওয়ার কাজ)। কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে হুযূর (ﷺ) এর দোষ-ত্রুটি রটালে কিংবা মর্যাদাহানিকর কোন কথাবার্তা বললে সে কাফির।
সাবধান! মুখ হিফাজত করা ফরয। এই মাসআলাটি ঈমানের মাপকঠি। যেমন তেমন কথা বলা যাবেনা। মুফতী আব্দুল হক দেওবন্দীও যথেষ্ট ব্যাখ্যা,বিশেষণ করেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ’র শানে শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণকারী ব্যক্তি সর্বসম্মত মতে কাফির ও মুরতাদ এবং তার কুফরীর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণকারী ব্যক্তিও কাফির এবং ইসলামের পরিসীমা হতে বহিষ্কৃত। মুরতাদের শাস্তি হচ্ছে হত্যা বা মৃত্যুদন্ড। সুতরাং রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র প্রতি বেয়াদবী প্রদর্শনকারী ব্যক্তির শাস্তি মৃত্যুদন্ডই।
197. ফাতওয়া হক্কানীয়া, খন্ড নং-২, পৃষ্ঠা নং-৩৭৫, মুফতী আব্দুল হক সাহেব, প্রতিষ্ঠাতাঃ জামে দারুল উলুম হক্কানীয়া, আকোড়া খটক, নও শাহরা জেলা, পাকিস্তান।
❏ প্রশ্ন-১৪৩ঃ الاستمناء باليد তথা হাত দ্বারা বীর্যপাত করা অর্থাৎ হাত দ্বারা বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করা, শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এর বিধান কী?
✍ উত্তরঃ কোরআন-হাদিসের বর্ণনা এবং ওলামায়ে কেরাম এর বক্তব্য মতে হস্তমৈথুন প্রবলতর ওজর ব্যতীত হারাম ও না-জায়েয। হস্তমৈথুনকারী ব্যক্তি শাস্তির যোগ্য। যখন কোন ফেতনায় পড়ার আশংকা থাকে, তখন এমতাবস্থায় ‘দু’টি বিপদ থেকে সহজটি বেছে নেওয়া’ নীতির আলোকে অনুমতি থাকতে পারে।
‘রুদ্দুল মুখতার’ গ্রন্থের হুদুদ অধ্যায়ের শাস্তি সম্পর্কীত পরিচ্ছেদে রয়েছে যে, الاستمناء حرام وفيه التعزيرُ বীর্যপাত করা (বাইরে ফেলে দেয়া) হারাম এবং তাতে শাস্তি আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। التعزير لا يسقط بالتوبة كالحد-‘হদ (কোরআন বর্ণিত শাস্তির) এর মত তাওবার মাধ্যমে তাযির (শাস্তি) রহিত হয়ে যায় না।’
198. দুররুল মুখতার, শাস্তি অধ্যায়।
اى بالكف اذا كان لاستجلاب الشهوة اما اذا غلبته الشهوة وليس له زوجة ولا امة ففعل ذلك لتسكينها فالرجاء انه لاوبال عليه . وكذا اختلف فى استمناء الرجل بيده ويسمى الخضخضة وجلد عميرهة . فجمهور الائمة على تحريمه وهو عندهم داخل فيما وراء ذلك، قال ابن الهمام يحرم فان غلبه الشهوة ففعل ارادة تسكينها به، فالرجاء لايعاقب .
‘হস্তমৈথুন যখন প্রবল যৌন উত্তেজনার কারণে করা হয় এবং হস্তমৈথুনকারী ব্যক্তির স্ত্রী বা দাসী না থাকলে সে প্রশান্তি লাভের জন্য এরূপ করে থাকলে আশা করি তার ওপর কোন শাস্তি প্রয়োগ করা হবেনা।’
199. ফতওয়া শামী, হুদুদ অধ্যায়, শাস্তি সম্পর্কীত পরিচ্ছেদ; তাফসীরে রুহুল মা‘আনী,200. সূরা আল-মুমিনুন, পৃষ্ঠা নং-১০, খন্ড নং-১৮; অনুরূপ তাফসীরে মাযহারী,200. সূরা আল-মুমিনুন।
অনুরূপ পুরুষের হস্তমৈথুনের ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। একে ‘খাদ্খাদাহ’ বা নাড়ানো বলা হয়। এর কারণে ওমর (رضى الله تعالي عنه) বেত্রাঘাত করেছেন। জমহুর এর মতে হস্তমৈথুন হারাম এবং তা অন্যান্য হারামের মত হারামের অন্তভুর্ক্ত। ইবনুল হুমাম বলেন, হস্তমৈথুন হারাম। যদি প্রবল যৌন উত্তেজনায় প্রশান্তি লাভের আশায় তা করা হয়, তাহলে আশা করি সে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে না।
❏ প্রশ্ন-১৪৪ঃ এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাত এর ওলামায়ে কেরাম কী বলেন যে, আমাদের দেশে ইসলামী কনফারেন্স, মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স ইত্যাদি নামে বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে যেগুলোর মূল উদ্যোক্তা, সংগঠক, নেতা, কর্মী ও অনুসারীগণ হচ্ছে কলেজ-ইউনির্ভাসিটির বিভিন্ন চিন্তা-দর্শন ও মাযহাবপন্থী ছাত্ররা। এসব সংগঠনে ওয়াহাবী-সুন্নী নির্বিশেষে প্রত্যেক কলেমা উচ্চারণকারী রাফেযী, ওয়াহাবী, নজদী, কাদিয়ানী, মওদূদী বিভিন্ন মতাবলম্বী সদস্য হতে পারে। সুন্নী জনতা কর্তৃক এরূপ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা, এগুলোতে অংশগ্রহণ করা, জান-মাল দিয়ে এসব সংগঠনকে সাহায্য করা, এগুলোর সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করা, বদ-দ্বীন ও মুরতাদদেরকে মুসলমান মনে করে তাদের সঙ্গ দেওয়া, তাদেরকে মুসলমান মনে করা এবং তাদের সাথে মৈত্রী বা মেলামেশার পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং তাদের নিকট হতে উন্নতি ও উপকারের আশা করা, শরীয়তে এগুলোর বিধান কী? বিষয়টি আমাদের ধর্মীয় নেতাগণ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে সহজ-সরল মুসলমানদেরকে গুমরাহী হতে বাঁচিয়ে উভয় জগতের কল্যাণ লাভ করতে পারেন।
✍ উত্তরঃ এ ধরনের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা। এতে অংশগ্রহণ করা হারাম এবং বদ মাযহাবীদের সাথে মেলামেশা ও মৈত্রী স্থাপন করা অগ্নির মত বিপদ। এসব সংগঠনে থাকে ভয়ংকর আগুনের দিকে টেনে টেনে নিয়ে যাবার লোক। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ .
‘যদি শয়তান আপনাকে বিস্মৃত করে বা ভুলিয়ে দেয়, তাহলে স্মরণ হওয়ার পর যালিমদের সাথে বসবেন না।’
200. সূরাঃ আন্-আম, আয়াতঃ ৬৮।
‘তাফসীরে আহমদীয়া’ এর মধ্যে রয়েছে যে,
دخل فيه الكافر والمبتدع والفاسق، القعود مع كلهم ممتنع .
এই আয়াতের আদেশের আওতায় প্রত্যেক কাফের, বিদ‘আতী ও ফাসেক অন্তভুর্ক্ত। তাদের কারো সাথে বসার অনুমতি নেই। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
وَلَا تَرْكَنُوا إِلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ
‘যালিমদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না, পড়লে আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে।’
201. সূরাঃ হুদ, আয়াতঃ ১১৩।
সহীহ মুসলিম শরীফের হাদিসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেন,
اياكم واياهم لايضلونكم ولايفتنونكم
‘তাদের নিকট থেকে দূরে থাকো এবং তাদেরকে তোমাদের নিকট থেকে দূরে রাখো, যাতে তারা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে না পারে এবং তোমাদেরকে বিপর্যয়ের মুখে পতিত না করে।’
মুসলমানদের ঈমান হচ্ছে, আল্লাহ্ ও রাসূল ব্যতীত আমাদের অধিক কল্যাণকামী আর কেউ নেই। তারা যে দিকে আমাদেরকে আহ্বান করেন সুনিশ্চিতভাবে সেদিকে আমাদের কল্যাণ নিহিত থাকে এবং যে সব বিষয় হতে আমাদের বারণ করেন নিঃসন্দেহে তাতে রয়েছে আমাদের সুস্পষ্ট ক্ষতি, অনিষ্ট ও বিপদ। মুসলমানের আকৃতি ধারণ করে যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের বিধানের বিরুদ্ধে মানুষকে আহ্বান করবে, জেনে রেখো; নিঃসন্দেহে তারা ডাকাত, তাদের অপব্যাখ্যায় কখনো কান দেবেনা। তারা ছিনতাইকারী যারা মুসলমানদেরকে স্বীয় জামাত থেকে বের করে ছিনতাই করে নিয়ে যেতে চায়। তারা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কথাবার্তা বলবে। যখন কেউ তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে তাদের দলে ভিড়বে, তখন তার গর্দান কেটে নিবে এবং তার সর্বস্ব লুটে নিবে। বাঘের পশম পরিধান করতঃ বাঘের বেশ ধারণ করে যে আসলো সে তাদের দলে ভিড়ে গেলো।
হুযূর (ﷺ) তোমাদের বারণ করেন। তিনি তোমাদের প্রাণাধিক কল্যাণকামী।
عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ
‘তোমাদের যে কোন বিপদ তার পবিত্র অন্তরে অসহ্য যন্ত্রণা সৃষ্টি করে।’
202. সূরা তাওবা, আয়াতঃ ১৮২।
তিনি অতি দয়ালু। স্বীয় সন্তানের প্রতি তোমরা যেরূপ দয়ালু, আল্লাহ ও তিনি (ﷺ) তোমাদের প্রতি এর চেয়েও অধিক দয়ালু। তিনি (ﷺ) বলেন,
ايَّاكُم وَايَّاهم لايضلونكم ولايفتنونكم
‘তাদের নিকট হতে দূরে থাকো এবং তাদেরকে নিজেদের নিকট হতে দূরে রাখো, যাতে তারা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করে না দেয় এবং তোমাদেরকে বিপর্যয়ের মুখে পতিত না করে।’
ইমাম ইবনে হিব্বান, তাবারানী ও ওকাইলীর হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
لاتواكلوهم ولاتشاربوهم ولاتجالسوهم ولاتناكحوهم واذا مرضوا فلاتعودوهم واذا ماتوا فلاتشهدوهم، ولاتصلوٰ عليهم ولاتصلوٰ معهم .
‘তাদের সাথে খাবার খেয়োনা, পানি পান করোনা, তাদের নিকট বসোনা, তাদের সাথে বিবাহ বন্ধন স্থাপন করোনা, তারা অসুস্থ হলে খবর নিতে যেয়োনা, মারা গেলে তাদের লাশ দেখতে যেয়োনা, তাদের জানাযা পড়োনা এবং তাদের সাথে নামায পড়োনা।
আমিরুল মু’মিনীন হযরত ওমর ফারুক (رضى الله تعالي عنه) মসজিদে নববীতে মাগরিবের নামাযের পর কোন বুভূক্ষ বা ক্ষুধার্ত বা নিজের সাথে খিলাফতের পতাকা বহনকারী মুসাফিরের জন্য খাবার তলব করলেন। যখন সে খাবার খেতে বসলো তখন তার নিকট হতে কোনরূপ বদ মযহাবী কথাবার্তা প্রকাশ পেলো। এমতাবস্থায় তিনি তৎক্ষণাৎ খাবার সরিয়ে নেওয়ার এবং তাকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এরপর তার সম্মুখ দিক হতে খাবার সরিয়ে দেওয়া হল এবং তাকে বের করে দেওয়া হলো। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (رضى الله تعالي عنه) এর নিকট জনৈক ব্যক্তি এসে বললো যে, অমুক ব্যক্তি আপনাকে সালাম বলেছে। তখন তিনি বললেন, لاتقرأ منى السلام فانى سمعتُ انه احدث ‘আমার নিকট হতে তাকে সালাম বলোনা। আমি শুনেছি যে, সে কিছু কুসংস্কার (বিদআত) আবিষ্কার করেছে।’
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) এর শাগরেদ হযরত সাঈদ বিন জুবাইর পথিমধ্যে একজন বদ-মযহাবী (বিদআতী) এর দেখা পেলো, ওই বিদআতী বললো, আমি কিছু বলতে চাই। তখন তিনি বললেন, আমি কিছু শুনতে চাইনা। তখন সে আবার বললো, একটি শব্দ বলতে চাই। তখন তিনি কনিষ্ঠ আঙ্গুলি মাথায় রেখে বললেন, لا نصف كلمته আধা শব্দও নয়। লোকেরা প্রশ্ন করলো এর কারণ কী? কারণ সে ছিল এদের দলভূক্ত।
হযরত আনাস বিন মালেক (رضى الله تعالي عنه) এর শাগরেদ ইমাম মুহাম্মদ বিন সিরীনের নিকট ওই বিদআতী লোকটি আসলো, সে আরয করলো, কুরআনের কিছু আয়াত আমাকে শুনান। তিনি বললেন, আমি শুনাতে চাইনা। সে (বিদআতী) আবার বললো, রাসূলুল্লাহ'র কয়েকটা হাদিস শুনান। তিনি বললেন, আমি শুনাতে চাইনা। সে বার বার জোরাজোরি করলে তিনি বললেন, হয়তো তুমি ওঠে যাও নচেৎ আমি ওঠে যাচ্ছি। পরিশেষে সে হতাশ হয়ে চলে গেলো। লোকেরা বললো, হে ইমাম! আপনার কী অসুবিধা হতো যদি তাকে দু’য়েকটি আয়াত বা হাদিস শুনাতেন? তখন তিনি একথার উত্তরে বললেন, আমি আশংকা করেছি যে, সে ওই আয়াত ও হাদিস সমূহের সাথে নিজের কিছু অপব্যাখ্যা যুক্ত করবে এবং তা আমার অন্তরে গেঁথে যাবে, তখন আমি ধ্বংস হয়ে যাবো। যখন ইমামগণের নিকট এই ভীতি ও আশংকা ছিল তখন সাধারণ জনগণের নিকট এই সাহস কোথায়?
لَا حَولَ وَلَا قوةَ اِلّا بِاللهِ .
এ ধরনের সংগঠন ও জায়গায় অর্থ দেওয়ার বিষয়টি ওই লোকই পছন্দ করবে যার কোন দ্বীন ও জ্ঞান-বুদ্ধি নেই। সে তার উভয় জগত নষ্ট করলো- অর্থও হারালো এবং আখিরাতে শাস্তির উপযুক্তও হলো।
203. ইযাফাতে ইমাম আহমদ রেযা কাদেরী।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَىٰ مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ.
স্মরণ হওয়ার পর যালিমদের সাথে বসবেন না এবং প্রিয় নবীজি (ﷺ) বলেন, ايَّاكُمْ وَ ايَّاهم‘তাদের নিকট হতে দূরে থাকো এবং তাদেরকে নিজেদের নিকট হতে দূরে রাখো।’
204. ইযাফাতে ইমাম আহমদ রেযা কাদেরী।
এখন গভীরভাবে চিন্তা করো, বিশেষভাবে ১২ রবিউল আউয়াল শরীফের বিশিষ্টতার এটাও একটা কারণ যে, যাবতীয় নেয়ামতরাজির বিদ্যমানতা হুযূর এর অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল এবং পুরো সৃষ্টি জগতের বিদ্যমানতা ও নির্ভরশীলতা হুযূর (ﷺ) এর অস্তিত্বের ওপর। সুতরাং যেহেতু দুনিয়া-আখিরাত এর ছোট-বড় এবং শারীরিক-আত্মিক যাবতীয় নেয়ামত রাসূলুল্লাহ'র উসিলায় পাওয়া গেছে। তাই এই দিনটা ঈদের দিনের চেয়েও উত্তম হলো। কারণ তাঁর উসিলায় তো ঈদের দিনটা ঈদের দিন হলো। এ কারণে সোমবারের রোজা রাখার কারণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, فِيْهِ ولِدْتُ‘ ওই দিন আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছি।’
❏ প্রশ্ন-১৪৫ঃ নকশবন্দিয়া খান্দানে খতমে খাজেগান সর্বদা দৈনিক পড়া হয়। কোন কোন সময় সহিংসতা, অস্থিরতা ও যুদ্ধ-বিগ্রহকালে ফজরের নামাযে ইমাম সাহেব মসজিদে কুনুতে নাযেলাও পড়েন এবং ফজরের নামাযের পর মুক্তাদিদের নিয়ে খতমও পড়েন। এই ইমাম সাহেব কোন সিলসিলার সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। যদি কেউ এই মর্মে প্রশ্ন করে যে, তার এই কাজটা শরীয়ত পরিপন্থী। কারণ যে কাজ কোরআন, হাদিস ও ফিকাহে নেই তা শরীয়ত বিরোধী।
✍ উত্তরঃ খতমে খাজেগান হচ্ছে উপরোক্ত দরূদ ও ওজিফার সমন্বয়। এতে শরীয়ত বিরোধী কোন শব্দ অন্তভুর্ক্ত নেই। সুতরাং তা পড়লে কোন অসুবিধা নেই। তবে তা কোন শরয়ী হুকুমের ফাত্ওয়া দেওয়া যাবেনা। বর্জনকারীকে ভর্ৎসনাও করা যাবে না।
কোন ব্যক্তি খুশিতে শরীক হলে ঠিক আছে। আর শরীক না হলে তার ওপর কোন অপবাদ দেওয়া যাবে না। কোন বিষয় বিদআত ও নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য আবশ্যক হচ্ছে ওই বিষয়টা শরয়ী দিক দিয়ে প্রমাণিত হবেনা এবং তা যদি দ্বীনের হুকুম বা বিধান বানিয়ে নেওয়া হয় এবং তা বর্জনকারীকে নিন্দিত বলে সাব্যস্ত করা হয়।
205. মুফতী আব্দুস সাত্তার দেওবন্দী, নায়েবে মুফতী ঃ খায়রুল মাদারিস, মুলতান, পাকিস্তান, খায়রুল ফাতাওয়া, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং-৩৩৯
❏ প্রশ্ন-১৪৬ঃ কোন নামাযের পর খতমে খাজেগানের পাঠকে নিয়মিত অযিফা বানিয়ে নেওয়া কেমন?
✍ উত্তরঃ হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (رحمه الله تعالي ) রচিত ‘যিয়াউল কুলূব’ গ্রন্থে চিশতীয়া ও কাদেরীয়া তরিকার খতমে খাজেগান বিদ্যমান রয়েছে। হযরত শায়খুল হাদিস ও তার কতিপয় খলিফার নিকট রমযানুল মুবারকের ইতিকাফের সময় জোহরের নামাযের পর চিশতীয়া তরিকার খতমে খাজেগান পাঠ করা হয়। খায়রুল মাদারিস মুলতানে দৈনিক আছরের নামাযের পর তা পাঠের অভ্যাস রয়েছে। দীর্ঘ দিন হতে একটি মসজিদে খতমে খাজেগানের পাঠভ্যাস ছিল। কিছু কিছু লোক যারা নিজেদেরকে ওলামায়ে দেওবন্দ বলে দাবী করে তারা একথা বলে এই খতম শরীফ বন্ধ করে দিলো যে, এটা বিদআত। উল্লেখিত মসজিদের অনুরূপ যেখানে এটার পাঠভ্যাস নিয়মিত হয়েছে সেখানে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ এটা বিদআত।
❏ প্রশ্ন-১৪৭ঃ বিয়েতে প্রস্তাবের উত্তরে ‘কবুল’ শব্দের পরিবর্তে আলহামদুলিল্লাহ বলা কেমন? এক পক্ষ হতে প্রস্তাব দেওয়ার পর দ্বিতীয় পক্ষ হতে ‘কবুল’ শব্দের পরিবর্তে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে নাকি হবে না? কতিপয় আলেম বলেন, আলহমাদুলিল্লাহ শব্দটি ‘তামলিকে আইন’ তথা হুবহু মালিকানাকে নির্দেশ করেনা, তাই বিয়ে শুদ্ধ হবে না। আবার কতিপয় আলেম বলেন, যেহেতু আমাদের এলাকার প্রথায় আলহামদুলিল্লাহ শব্দটি ‘কবুল’ শব্দটি বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়, তাই এর দ্বারা বিয়ে শুদ্ধ হওয়া উচিত।
✍ উত্তরঃ বিয়ের নিয়তে ‘কবুল’ শব্দের পরিবর্তে আলহামদুলিল্লাহ বললে বিয়ে শুদ্ধ বা অনুষ্ঠিত হবে কিনা? ফতোয়ায়ে আলমগীরির ১ম খন্ডর ২৭২নং পৃষ্ঠায় রয়েছে যে,
امرأة قالت لرجل تزوجت نفسى منك فقال الرجلُ بخداوند كارى پذيرفتم يصح النكاح ولو لم يقل الرجل ذلك لكنه قال لها شاباش ان لم يقل بطريق الطنزِ يصح النكاح كذا فى الخلاصة .
কোন পুরুষকে লক্ষ্য করে একথা বললে আমি তোমাকে বিয়ে করলাম এবং পুরুষ লোকটি একথা বললে আল্লাহর ফজলে আমি কবুল করলাম, এক্ষেত্রে বিয়ে শুদ্ধ হবে। আর যদি পুরুষ লোকটি একথা না বলে, নারী লোকটিকে লক্ষ্য করে সাবাশ বলে এবং যদি তা ঠাট্টা হিসেবে না বলে, তাহলে এই বিয়ে শুদ্ধ হবে। অনুরূপ বর্ণনা ফতোয়া ‘খোলাসা’ গ্রন্থে পাওয়া যায়।
ইজাব ও কবুল শব্দদ্বয় ‘তামলিকে আইন’ তথা হুবহু মালিকানা বুঝানোর জন্য উদ্ভাবিত হওয়া আবশ্যক নয়। বরং কেবল ইজাব এরকম হওয়া যথেষ্ট। অন্যথায় কবুল বললেও কবুল গ্রহণযোগ্য না হওয়া উচিত। কারণ এতে এই সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক যে, কবুলের জন্য সুস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করতে হবে। কেননা ব্যাপারটি হচ্ছে বিয়ের। হতে পারে সে প্রয়োজনের সময় অস্বীকার করে বসবে যখন সে আটকে যাবে।
❏ প্রশ্ন-১৪৮ঃ হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله عنها ) কর্তৃক তাঁকে (ﷺ) রওজায়ে আকদাসে দাফন করার ব্যাপারে নিষেধ করার কারণ কী ছিল? বুখারী শরীফের ১ম খন্ডর কিতাবুল জানায়েয এর মধ্যে একটি হাদিস রয়েছে যার ওপর শিয়ারা এই মর্মে আপত্তি তোলে যে, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنها) বলেন, আমাকে হুযূর এর সাথে দাফন করবে না। কারণ আমি তাঁকে পবিত্র মনে করিনা। শিয়াদের এই প্রশ্ন কি সঠিক, দলিল সহকারে বর্ণনা কর ?
✍ উত্তরঃ عليه التكلان وهو المستعان আল্লাহর ওপর নির্ভর করছি। তিনিই একমাত্র সাহায্যকারী। প্রশ্নে উল্লেখিত হাদিসটি সঠিকভাবে উদ্ধৃত করা হয়নি। হাদিসটির মূল ও প্রকৃত শব্দ হচ্ছে,
لا تدفنّى معهم وادفنى مع صواحبى بالبقيع لا ازكىٰ به ابدًا .
হাদিসটির অনুবাদও ভুল, বরং বিকৃত। হাদিসটিতে এরূপ কোন বাক্য নেই যার অনুবাদ হচ্ছে, আমি তাকে পবিত্র মনে করিনা। সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ওমাদাতুল ক্বারী’ এর মধ্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, لا ازكىٰ শব্দটি হচ্ছে, যার অর্থ হচ্ছে, لااثنٰى علّى بسببه ‘যাতে এর দ্বারা আমি প্রশংসিত না হই।’
206. ওমদাতুল ক্বারী, খন্ড নং-৮, পৃষ্ঠা নং- ২৩৮।
যার মর্মার্থই উদ্দেশ্য।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنها) বিনয় প্রকাশ করতে একথা বলেছেন। এধরনের শব্দ (صيغه مجهول বা কর্মবাচ্যের রূপ) বিনয় ও নম্রতা প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, যদি আমাকে হুযূর এর রাওজায়ে আকদাসে দাফন করা হয়, তাহলে এই দাফনের কারণে মানুষ এই মর্মে আমার প্রশংসা করবে যে, রাসূলুল্লাহ'র (ﷺ) অন্যান্য বিবিগণের এই মর্যাদা ছিলনা যা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنها) এর জন্য ছিল, তাই হযরত আয়েশাকে (رضى الله تعالي عنها) হুযূরের রাওজায়ে আকদাসে দাফন করা হয় এবং অন্যান্য বিবিগণকে জান্নাতুল বাক্বী বা অন্যান্য জায়গায় দাফন করা হয়। আমি নিজের জন্য এই প্রশংসা চাইনা।
তাই রাওজা পাকে হুযূর (ﷺ), হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضى الله تعالي عنه) ও হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) এর সাথে আমাকে যেন দাফন করা না হয় এবং জান্নাতুল বাক্বীতে হুযূরের (ﷺ) অন্যান্য বিবিগণের সাথে দাফন করা হয়।
قال ابن بطال فيه معنى التواضع كرهت عائشة ان يقال انها مدفونة مع النبى صلّى الله عليه وسلّم فيكون فى ذلك تعظيما لها .
ইবনে বাত্তাল বলেন, এর অর্থ হচ্ছে বিনয়। হযরত আয়েশা (رضى الله تعالي عنها) তাকে রাসূলুল্লাহ'র সাথে দাফন করার কথা বলতে অপছন্দ করেছেন। এরূপ হলে তা তার জন্য সম্মানের কারণ হয়ে যেত।"
207. ওমদাতুল ক্বারী, খন্ড নং-৮, পৃষ্ঠা নং-২২৮।
তদুপরি আইনীতে ‘তাকমালা লি ইবনিল আবাদ’ এর সূত্রে হযরত আয়েশা (رضى الله تعالي عنها)-এর কথা- আমাকে হুযূর , হযরত আবু বকর (رضى الله تعالي عنه) ও হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) এর সাথে দাফন করবে না, এর কারণ হিসেবেও একটি হাদিস বর্ণিত রয়েছে। হুযূর এর রাওজা পাকে যার যার দাফনের বিষয়টি পূর্ব নির্ধারিত ছিল হুযূর স্বয়ং তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।
عن عائشة رضى الله عنها قالت قلتُ للنبى صلّى الله عليه وسلّم انى لا ارانى الا ساكون بعدك فتأذن لى ان ادفن الى جانبك . قال و انى لك ذلك الموضع ما فيه الا قبرى وقبر ابي بكر وعمر وفيه عيسىٰ بن مريم عليه السلام.
হযরত আয়েশা (رضى الله تعالي عنها) হতে বর্ণিত রয়েছে, তিনি বলেনঃ আমি হুযূরকে (ﷺ) বললাম, মনে হয় আমি আপনার পরে মৃত্যুবরণ করব। সুতরাং আপনার পাশে আমাকে দাফন করার জন্য আপনি অনুমতি দিন, আপনি অনুমতি দিন, তখন হুযূর (ﷺ) বললেন, ওই স্থানে আমার কবর, হযরত আবু বকর, হযরত ওমর ও হযরত ঈসা ইবনে মারইয়ামের কবরের জায়গা ছাড়া আর কোন জায়গা নেই।"
208. ‘আইনী শরহে বুখারী, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-২২৮।
এতে বুঝা গেলো যে, যদিও পূর্বে বা শুরুতে হযরত আয়েশার (رضى الله تعالي عنها) নিকট রাওজায়ে মুস্তাফা এর মধ্যে দাফন হওয়ার আকাঙ্খা ছিল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ'র হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে দাফন করতে নিষেধ করেন। মোদ্দাকথা তাকে আমি পবিত্র মনে করিনা, এটা হাদিসটির মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য নয়। বরং তা হচ্ছে সাহাবা বিদ্বেষী ইসলামের কোন শত্রুর মস্তিষ্ক প্রসূত কথা।
❏ প্রশ্ন-১৪৯ঃ কোরআন মজিদ খোলার পূর্বে কিছু লোক তাতে চুমো খায়। এই কাজটি জায়েয বা সঠিক কিনা?
✍ উত্তরঃ আল্লাহই আমাদের সাহায্যকারী। কোরআন মজিদকে চুমো খাওয়া জায়েয।
روى عن عمر رضى الله عنهُ انه كان يأخذ المصحف كل غداة ويقبله الخ .
হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি প্রতিদিন সকালে কোরআন নিতেন এবং তাতে চুমো খেতেন।
209. দুররে মুখতার আলাশ-শামীঃ খন্ড নং ৫, পৃষ্ঠা নং-২৪৬।
❏ প্রশ্ন-১৫০ঃ مُحَدَّثْ মুহাদ্দাস (দাল বর্ণের ওপর তাশদীদ ও যবর সহকারে) শব্দের অর্থ কী?
✍ উত্তরঃ مُحَدَّثْ মুহাদ্দাস (দাল বর্ণের ওপর তাশদীদ ও যবর সহকারে)ঃ মুহাদ্দাস বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যিনি নিজের পরিশুদ্ধ আত্মার কারণে যে ব্যাপারটি যেরূপ অনুমান করেন বাস্তবেও সেরূপ সংঘটিত হয়, যেনো আলমে মালাকুত হতে তার অন্তরে ওই ব্যাপারটি ঢেলে দেওয়া হয়। সাইয়েদ শরীফ কৃত মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘শরহে মাসাবিহ’ এর মধ্যে বলা হয়েছে, মুহাদ্দাস বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যার অনুমান এরূপ সত্য হয় যেনো ঊর্ধ্ব জগত হতে তাকে একথা বলা হয়েছে।
‘মাজমাউল বাহার’ নামক গ্রন্থে মুহাদ্দাস শব্দের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে ‘মুহাদ্দাস বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যার অন্তরে আল্লাহর পক্ষ হতে কোন কথা ঢেলে দেওয়া হয় তখন তিনি নিজের ঈমানী দূরদর্শিতার সুবাদে একথার সংবাদ দেন।’
কারো কারো মতে, মুহাদ্দাস বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যার সাথে ফেরেশতারা কথা বলে।
‘দাল’ বর্ণে তাশদীদ ও যের সহকারে শব্দটির অর্থ হচ্ছে, মুহাদ্দিস বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যিনি হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন, পড়েছেন, শুনে আত্মস্থ করেছেন এবং নানা শহর ও অঞ্চল পরিভ্রমণ করতঃ হাদিস শাস্ত্রের নীতিমালা অর্জন করে হাদিসের সনদ, দোষ-ত্রুটি ও ইতিহাসের প্রায় হাজারো কিতাবাদির মাধ্যমে অসংখ্য প্রাসঙ্গিক মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন।
কারো কারো মতে, মুহাদ্দিস বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যিনি হাদিসের বর্ণনাকারী হওয়া ছাড়াও যুক্তির নিরিখেও হাদিসের বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন।
210. শরহে নুখবাতুল ফিকির।
❏ প্রশ্ন-১৫১ঃ বারো মাসের গণনা প্রথা কখন হতে শুরু হয়?
✍ উত্তরঃ শাহরুন শব্দের অর্থ হল মাস। এর বহুবচন হচ্ছে শুহুর বা আশহুর। মুসলমানদের নিকট মাসের সংখ্যা হচ্ছে বারোটি। তন্মধ্যে চারটি মাস হচ্ছে নিষিদ্ধ মাস তথা শিষ্টাচার ও জননিরাপত্তার মাস। এগুলোতে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ।
কোরআন মজিদে বর্ণিত রয়েছে,
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ .
অর্থাৎ যে দিন আল্লাহ তা‘আলা আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন তখন হতে আল্লাহ'র নিকট মাসের গণনা বা সংখ্যা কিতাবুল্লাহ তথা লওহে মাহফুজে বারো মাস লিপিবদ্ধ আছে। তন্মধ্যে চারটি মাস হচ্ছে শিষ্টাচার ও জননিরাপত্তার মাস। শিষ্টাচার ও জন নিরাপত্তার মাস দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে জিলক্বদ, জিলহজ্ব, মহররম ও রজব।
211. সূরা তাওবা, আয়াতঃ ৩৬।
❏ প্রশ্ন-১৫২ঃ আরববাসীগণ নিজেদের চান্দ্র মাসের কী কী নাম রেখেছিলেন?
✍ উত্তরঃ আরববাসীগণ নিজেদের চান্দ্র মাসের নাম রেখেছিলেনঃ তাতিক, নুফাইল, তালিক, আছাখ, আসাখ, হালাক, তারহিব (রজব), কাসাজ, যাহের, নুত, হরফ ও লাফিস। তাতিক দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে মুহররম এবং নুফাইল দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে সফর। অন্যান্য মাসসমূহ এর ওপর অনুমান করতে হবে। এরপর আরববাসীগণ নিজেদের মাসসমূহের জন্য ওই নাম নির্ধারণ করলেন যা বর্তমানে প্রসিদ্ধ অর্থাৎ মুহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউল উখরা, জুমাদাল উলা, জুমাদাল উখরা, রজব, শা’বান, রমযান, শাওয়াল, জিলক্বদ ও জিলহজ্ব।
মুহররমঃ মুহররম শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নিষিদ্ধ। যেহেতু আইয়ামে জাহেলিয়াতে এই মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ও হারাম ছিল, তাই মাসটির নামকরণ করা হল মুহররম।
সফরঃ সফর শব্দটি ‘সিফির’ শব্দ হতে গঠিত। এর অর্থ হচ্ছে শূন্য। যেহেতু এই মাসটি আসে মুহররমের পর এবং হুযূর এর আবির্ভাবের পূর্বে মুহররম মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ ছিল আর আরবের লোকেরা এ মাসে যুদ্ধ করার জন্য বের হতো এবং তাদের ঘর-বাড়ি খালি অবস্থায় রেখে যেতো, তাই এই মাসটির নামকরণ করা হলো সফর। কেউ কেউ বলেন, এ মাসটির নামকরণ করার সময়টি ছিল হেমন্তকাল। এই ঋতুতে গাছের পত্রপলব হলুদ বর্ণ ধারণ করে। তাই এ মাসটির নামকরণ করা হলো সফর। এমতাবস্থায় সফর শব্দটি গঠিত হবে সাফরুন শব্দ হতে। এর অর্থ হচ্ছে হলুদ বর্ণ। হানাজাতুত তারাব গ্রন্থ প্রণেতা লিখেন, সফর মাসে আরববাসীগণ নিজেদের ঘর বাড়িকে হলুদ বর্ণে বর্ণিল করতো। কেননা তারা এ মাস হতে যুদ্ধে যাবার ইচ্ছা পোষণ করতো।
রবিউল আউয়ালঃ যেহেতু এ মাসটির নামকরণ করার সময়টি ছিল বসন্তকালের প্রারম্ভকাল, তাই মাসটিকে এ নামে নামকরণ করা হলো।
রবিউল আখরঃ ‘খা’ বর্ণে যবর বিশিষ্ট। মনে রেখো, সাধারণ জনগণ যেরূপ ‘রবিউস সানি’ ব্যবহার করে তা সঠিক নয়। কেননা অধিকাংশ আরববাসী ‘রবিউল আখর’ ব্যবহার করে। কারো কারো মতে, ‘ছানি (দ্বিতীয়)’ শব্দটির ব্যবহার ওই স্থানেই করা হয় যেখানে ‘ছালেছ’ (তৃতীয়) শব্দটি পরবর্তীতে থাকে। যেহেতু এ মাসটির নামকরণ করার সময়টি ছিল বসন্তকালের শেষ সময়, তাই এই মাসটির নামকরণ করা হলো রবিউল আখর।
জুমাদাল উলাঃ সাধারণ লোকের মুখে এ মাসটির নাম জুমাদাল আউয়াল বলে শুনা যায়। তা ভুল ও সঠিক নয়, কেননা জুমাদা শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ বাচক শব্দ, কারণ শব্দটির শেষে রয়েছে আলিফে মাকছুরা, তাই এর বিশেষণও আউয়াল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ উলা ব্যবহার করতে হবে। যাতে বিশেষ্য ও বিশেষণের মধ্যে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ বিষয়ক বিধানের সমন্বয় সাধিত হয়। যেহেতু মাসটির নামকরণ করা হয় এমন মৌসুমের শুরুতে যখন পানি জমাটবদ্ধ হয়ে যেতো, তাই মাসটির নামকরণ করা হলো জুমাদাল উলা।
জুমাদাল উখরাঃ আরবগণ জুমাদাল উখরা বা জুমাদাল আখেরাহ ব্যবহার করে। আর জুমাদাস ছানি নামটি যেরূপ প্রসিদ্ধ আছে তা কিন্তু সঠিক নয়। যেহেতু এ মাসটির নামকরণ করা হয় এমন মৌসুমের বিদায়লগ্নে যখন পানি জমাটবদ্ধ হয়ে যেতো, তাই মাসটির নামকরণ করা হলো জুমাদাস ছানি।
রজবঃ ‘রা’ ও ‘জিম’ বর্ণে যবর বিশিষ্ট। এই শব্দটি ‘তারজিব’ শব্দ হতে গঠিত। যার অর্থ হচ্ছে সম্মান ও মহান। যেহেতু আরবের লোকেরা এ মাসটিকে ‘শাহার’ বলতো এবং সম্মান করতো, তাই এ নামে মাসটির নামকরণ করা হলো। হুযূর বলেন, রজব হচ্ছে জান্নাতের একটি হ্রদ যার পানি মধুর চেয়ে সুমিষ্ট এবং বরফের চেয়ে সাদা। যে ব্যক্তি এ মাসে রোযা রাখবে কিয়ামতের দিন তাকে ওই হ্রদ হতে পানি পান করানো হবে।
শা‘বানঃ যেহেতু এ মাসে অপার কল্যাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এবং জগতের যাবতীয় নির্ধারিত বিষয়াবলী আলাদা হয়ে পড়ে, তাই এ নামে মাসটির নামকরণ করা হলো।
রমযানঃ তিনো বর্ণে যবর বিশিষ্ট শব্দটি ‘রামাদুন’ শব্দ হতে গঠিত। এর অর্থ জ্বালানো। এটি باب ضرب এর অন্তভুর্ক্ত। যেহেতু এ মাসটি পাপসমূহ পুড়িয়ে দেয়, তাই এ নামে মাসটির নামকরণ করা হলো কিংবা রমযান শব্দটি নামবাচক বিশেষ্য যা রামাদাউন শব্দ হতে গঠিত। রামাদাউন বলা হয় জ্বলন্ত ভূমিকে। এ মাসে প্রচন্ড গরম পড়ে। তাই এ নামে মাসটির নামকরণ করা হলো।
ওলামায়ে কেরাম বলেন, মাহে রমাদানকে কেবল রমাদান বলা জায়েয নয়। কেননা হাদিস শরীফে রয়েছে যে, মাহে রামাযানকে কেবল রামাযান বলো না। কেননা এটা আল্লাহর নাম। বরং এভাবে বলো, শাহরু রামাযান অর্থাৎ আল্লাহর মাস।
শাওয়ালঃ শাওয়াল শব্দটি ‘শাওলুন’ শব্দ হতে গঠিত, যার অর্থ স্থানান্তরিত হওয়া। যেহেতু এ মাসে আরবের লোকেরা ভ্রমণ ও শিকারে যেতো এবং ঘরবাড়ির বাইরে চলে যেতো, তাই এ নামে মাসটির নামকরণ করা হলো। কিংবা শব্দটি ‘শুলুন’ শব্দ হতে গঠিত যার অর্থ হচ্ছে উটের লেজ তোলা বা উঠানো। এটি باب نصر এর মাসদার। এ মাসে উটের যৌন চাহিদা বেড়ে যায়।
জিলক্বদঃ যেহেতু এ মাসটি পুরোপুরি একটি নিষিদ্ধ মাস, তাই আরবগণ এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ হতে বিরত থাকে। এ কারণে এই নামে মাসটির নামকরণ করা হলো।
জিলহজ্বঃ যেহেতু এ মাসে হজ্ব অনুষ্ঠিত হয়, তাই মাসটির নামকরণ করা হলো জিলহজ্ব।
212. ইসলামী মা’লুমাত, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ১২৪১, মৌলভী মাহবুব আলম।
❏ প্রশ্ন-১৫৩ঃ شاه ‘শাহ’ শব্দটি কোন ভাষার শব্দ এবং তা কোথায় ব্যবহার করা হয়?
✍ উত্তরঃ ‘শাহ’ শব্দটি ফার্সী ভাষার শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে মূল, গোড়া, মালিক, মুনিব, বাদশাহ এবং তা ফকীরদের উপাধি হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। বংশীয় মর্যাদার দিক দিয়ে সাইয়েদগণের জন্যও শব্দটির ব্যবহার সর্বজনবিদিত যেমন, শাহ ওয়ালি উল্লাহ, শাহ আব্দুল আজিজ। পাঞ্জাবে সাইয়েদগণের নামের অংশ হিসেবে শব্দটি ব্যবহার করা হয় যেমন, সাইয়েদ আকবর শাহ, সাইয়েদ ওয়ালি শাহ, সাইয়েদ আসগর শাহ। শাহ সাহেব বা শাহজী ইত্যাদি উঁচু স্তরের দরবেশগণের উপাধি।
❏ প্রশ্ন-১৫৪ঃ শাহাদাত কাকে বলে, এর সংজ্ঞা কী এবং শাহাদাতের সংখ্যা কত?
✍ উত্তরঃ هو المستعان واليه المأب والتكلان . শাহাদাত শব্দের অর্থ হচ্ছে সাক্ষ্য। কোরআন মজিদে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, দু’জন পুরুষের সাক্ষ্যগ্রহণ করো। যদি দু’জন পুরুষ পাওয়া না যায়, তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন নারী।
কোরআন মজিদে সত্য সাক্ষ্য গোপন করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই হুকুম দেওয়া হয়েছে,
وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَنْ يَكْتُمْهَا فَإِنَّهُ آثِمٌ قَلْبُهُ
সাক্ষ্য গোপন করোনা। আর যে ব্যক্তি সাক্ষ্য গোপন করবে, তা হচ্ছে অন্তরের পাপ ও অপবিত্রতা।
213. সূরা বাকারা, আয়াতঃ ২৮৩।
সূরা নিসার ২০তম রুকুতে আদেশ দেওয়া হয়েছে, আল্লাহর ওয়াস্তে সাক্ষ্য দাও যদিও তা তোমার নিজের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে হয়ে থাকুক। সূরা ফুরকানে মিথ্যা সাক্ষ্যদান হতে নিষেধ করা হয়েছে।
হাদিস শরীফে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, আমি কি তোমাদেরকে সর্বোত্তম সাক্ষীর ব্যাপারে সংবাদ দেবোনা। সে হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে সাক্ষ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হওয়ার পূর্বে নিজের সাক্ষ্য প্রদান করে।
শাহাদাত ফরয। তা প্রদান করা সাক্ষীদের জন্য আবশ্যক। তবে কিসাস (মৃত্যুদন্ড) ও হুদুদ (কুরআনে বর্ণিত শাস্তি) এর সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে তা প্রকাশ বা গোপন করার অধিকার সাক্ষীর নিকট রয়েছে। তবে চুরির ক্ষেত্রে সাক্ষ্য প্রদান করা ওয়াজিব। আর এতে একথা বলবে যে, সে মাল নিয়েছিল, একথা বলবেনা যে, সে মাল চুরি করেছিল। ব্যভিচারের ক্ষেত্রে চারজন সাক্ষী প্রয়োজন। ব্যভিচারের বেলায় নারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যান্য হকের বেলায় দু’জন পুরুষ কিংবা একজন পুরুষ ও দু’জন নারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য, হোক তা সম্পত্তির অধিকার কিংবা সম্পত্তি বর্হিভূত অন্যান্য অধিকার যেমন, বিয়ে, তালাক, ওসিয়ত, ওকালা (আমমোক্তার নামা), গোলাম আযাদ, সন্তান জন্মদান ও নারীর সতীত্ব। আর নারীদের যে সব দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে পুরুষকে অবহিত করা যায়না, তাতে কেবল একজন নারীর সাক্ষ্যই যথেষ্ট।
নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়ঃ
(১) অন্ধ।
(২) অধীন দাস।
(৩) যে ব্যক্তি ইতিপূর্বে যিনার (ব্যভিচারের) মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছে, যদিও সে তাওবা করেছে।
(৪) পিতার সাক্ষ্য পুত্রের বেলায়। দাদা-নানার সাক্ষ্য নাতীর বেলায়। পুত্র ও নাতীর সাক্ষ্য পিতা-মাতা এবং দাদা-নানা প্রমূখের বেলায়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একের সাক্ষ্য অপরের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। ভাইয়ের সাক্ষ্য ভাইয়ের বেলায় এবং ভাতিজার সাক্ষ্য চাচার বেলায় গ্রহণযোগ্য নয়।
(৫) এক অংশীদারের সাক্ষ্য অপর অংশীদারের বেলায় বৈধ নয়।
(৬) হিজড়া।
(৭) বিলাপকারী নারী।
(৮) গায়িকা নারী।
(৯) সর্বদা মদ্যপানকারী ব্যক্তি।
(১০) কবুতর, মোরগ ও ভেড়ার খেলবাজ।
(১১) এরূপ কবীরা গুণাহকারী ব্যক্তি যার ওপর হদ (শাস্তি) আবশ্যক।
(১২) গোসলখানায় নগ্ন হয়ে গমনকারী ব্যক্তি।
(১৩) সুদখোর।
(১৪) যে ব্যক্তি পাশা, দাবা ইত্যাদি খেলে।
(১৫) যে ব্যক্তি কোন মাকরূহ ও অপছন্দনীয় কাজ করে যেমন, রাস্তায় হাঁটার সময় কোন কিছু খায় কিংবা জনসাধারণের চলাচলের পথে পেশাব করার জন্য বসে যায়।
(১৬) যে ব্যক্তি পূর্বসুরী বুযূর্গদের প্রকাশ্য গালমন্দ করে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।
খতনা বিহীন ব্যক্তি, নপুংসক, জ্বীন হাজিরকারী ব্যক্তি ও অবৈধ সন্তানের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য।
যদি বিচারকের রায় প্রদানের পূর্বে সাক্ষ্যদাতা নিজের সাক্ষ্য প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে তার সাক্ষ্য রহিত হয়ে যাবে। আর যদি বিচারকের রায় প্রদানের পর সাক্ষী নিজের সাক্ষ্য প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে রায় বা সিদ্ধান্ত বাতিল হবেনা। যদি কারো সম্পদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর সাক্ষ্যদাতা নিজের সাক্ষ্য প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে সে যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিল ওই ব্যক্তির সম্পদের জন্য দায়ী হবে।
শাহাদাত শব্দটি শহীদ হয়ে যাবার অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
هذا ما ظهرلى والعلم عند الله العليم .
❏ প্রশ্ন-১৫৫ঃ হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) এর পিতার নাম কি ছিল? তারুখ তাঁর পিতার নাম এবং আযর তাঁর চাচা,একথা বলা সঠিক কিনা?
✍ উত্তরঃ হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) এর পিতার নাম তারুখ এবং আযর তার উপাধি কিংবা এর বিপরীত। আর একথা বলা যে, আযর ছিল তাঁর চাচা আর তারুখ তাঁর পিতা, কারণ কোন নবীর পিতা মুশরিক ছিলনা। এটা কেবল কৃত্রিম ও বানোয়াট কথা।
সূরা মারইয়ামের তৃতীয় রুকুতে আযরের উল্লেখ ইবরাহিম (عليه السلام) এর প্রশ্নোত্তরের ভিতরে এসেছে যার অনুবাদ হচ্ছেঃ যখন তিনি অর্থাৎ ইবরাহিম (عليه السلام) নিজের পিতা অর্থাৎ আযরকে বললেন, হে পিতা! আপনি কেন এই মূর্তিগুলোর পূজা-অর্চনা করছেন যেগুলো না কোন কিছু শুনে আর না দেখে আর যেগুলো না আপনার কোন উপকারে আসতে পারে। হে পিতা! আমি আল্লাহর পক্ষ হতে এরূপ জ্ঞান অর্জন করেছি যে জ্ঞান আপনার নিকট নেই। তাই আপনি আমাকে অনুসরণ করুন। আমি আপনাকে দ্বীনের সহজ-সরল পথ দেখাবো। হে পিতা! শয়তানের কথায় পড়ে মূর্তিগুলোকে পূজা-অর্চনা করবেন না। কেননা শয়তান আল্লাহর বিদ্রোহী। হে পিতা! আমি এ বিষয়ে ভয় করছি যে, কখনো যেন এরূপ না হয় যে, আচমকা আল্লাহর পক্ষ হতে কোন আযাব আপনার ওপর এসে পড়ে এবং আপনার পরিণাম শয়তানের সঙ্গে জাহান্নামে হয়। হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) এর পিতা বললেন, ইবরাহিম! তুমি কি আমার মাবুদদের নিকট হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছো?
তুমি যদি এরূপ কথাবার্তা হতে ফিরে না এসো, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাকে পাথর মেরে শেষ করে দিবো। আর যদি তুমি কল্যাণ চাও, তাহলে আমার সম্মুখ হতে দূর হও।
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاءٌ مِمَّا تَعْبُدُونَ .
আর একদা ইবরাহিম নিজ পিতা ও স্বজাতির লোকদেরকে বললো, তোমরা যে সব মূর্তির পূজা-অর্চনা করো এগুলোর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
214. সূরা যুহরফ, আয়াতঃ ২৬
❏ প্রশ্ন-১৫৬ঃ হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) কর্তৃক বর্ণিত পুরো দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ চারজন নারী কারা কারা ছিলেন? আছিয়া কে ছিলেন?
✍ উত্তরঃ وهو المستعانআছিয়া হচ্ছেন খোদা দাবীকারী মিসরের প্রসিদ্ধ কাফির ফিরাউনের স্ত্রীর নাম। যিনি ছিলেন খুবই পুতঃপবিত্র, আল্লাহর ইবাদতগুজার এবং হযরত মুসা (عليه السلام)’র শরীয়তের অনুসারী। তিনি হচ্ছেন ওই সব নারীদের অন্যতম যাদের প্রশংসা অসংখ্য হাদিসে এসেছে। তারা হচ্ছেনঃ
(১) হযরত মারইয়াম (عليه السلام)।
(২) হযরত খাদিজা (رضى الله تعالي عنه)।
(৩) হযরত ফাতেমা (رضى الله تعالي عنه)।
(৪) হযরত আছিয়া (عليه السلام)।
হযরত আনাস বিন মালেক (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ বলেন, তোমাদের জন্য সমগ্র দুনিয়ার নারীদের মধ্যে কেবল এই চারজনের মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যথেষ্টঃ মারইয়াম বিনতে ইমরান, খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ এবং ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া।"
215. মিশকাত শরীফ।
কোরআন মজিদের সূরা মারইয়ামের ৪র্থ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَضَرَبَ اللهُ مَثَلًا لِلَّذِينَ آمَنُوا امْرَأَتَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِنْدَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِنْ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ.
‘মুসলমানদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়ার উদাহরণ দিচ্ছেন যে, তার স্ত্রী দু‘আ করলো, হে আমার প্রতিপালক! আমার জন্য বেহেশতে আপনার নিকট একটি ঘর তৈরী করুন এবং আমাকে ফেরাউন ও তার কর্মকান্ড হতে মুক্তি দিন। আর আমাকে যালিমদের নিকট হতে নিষ্কৃতি দিন।’
216. সূরা আত্তাহরীম, আয়াতঃ ১১
❏ প্রশ্ন-১৫৭ঃ আসফ বিন বরখিয়া কে ছিলেন, তার অবস্থা ও কাহিনী বর্ণনা কর?
✍ উত্তরঃ আসফ বিন বরখিয়া হচ্ছে হযরত সুলায়মান ইবনে দাউদ (عليه السلام) এর প্রধানমন্ত্রীর নাম, যিনি ইসমে আযমের সুবাদে কাজ করতেন। তিনি ইসমে আযমের বরকতে ও সুবাদে মুহূর্তের মধ্যে অনেক দূরবর্তী এলাকা হতে রাণী বিলকিসের সিংহাসন হযরত সুলায়মান (عليه السلام) এর দরবারে হাজির করেছিলেন। বিলকিস হচ্ছে সাবা অঞ্চলের রাণীর নাম, যিনি হযরত সুলায়মান (عليه السلام) এর হাতে ইসলামে দীক্ষিত হয়ে তাঁর (عليه السلام) সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তার কাহিনীটি সূরা নমলে বর্ণিত রয়েছে। কোরআন মজিদের নিম্নোক্ত আয়াতে আসফ বিন বরখিয়ার এই কাহিনীটি উল্লেখ রয়েছে।
قَالَ الَّذِي عِنْدَهُ عِلْمٌ مِنَ الْكِتَابِ أَنَا آتِيكَ بِهِ قَبْلَ أَنْ يَرْتَدَّ إِلَيْكَ طَرْفُكَ .
‘জনৈক ব্যক্তি যার নিকট কিতাবের জ্ঞান তথা ইসমে আযম জানা ছিলো সে বললো, হে বাদশা! আপনার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি সিংহাসনটি আপনার দরবারে হাজির করছি।’
217. সূরা নমল, আয়াতঃ ৪০
মাসআলাঃ কেরামতে আউলিয়া অস্বীকারকারীদের উচিত এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং হঠকারিতা ও জিদ হতে ফিরে আসা। وَاللهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়ত দান করেন।’
❏ প্রশ্ন-১৫৮ঃ হযরত মুসা (عليه السلام) এর মাতার নাম কি ছিল?
✍ উত্তরঃ হযরত মুসা (عليه السلام)’র মাতার নাম ছিল ইউজানয, পিতার নাম ইমরান এবং বোনের নাম মারইয়াম। তবে মনে রাখতে হবে তিনি ওই মারইয়াম নন যিনি ছিলেন হযরত ঈসা (عليه السلام) এর মাতা। তিনি জন্মগ্রহণ করেন হযরত মুসা (عليه السلام)’র বোনের হাজারো বছর পর।
218. তফসীরে সাভী, ৩য় খন্ড।
❏ প্রশ্ন-১৫৯ঃ হযরত শুয়াইব (عليه السلام)কে কোন্ জাতির নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছিল?
✍ উত্তরঃ জেনে রাখা উচিত যে, হযরত শুয়াইব (عليه السلام) মাদইয়ান ও আইকা নামক দু’টি জাতির নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। এতদুভয় জাতি তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিলো এবং তাঁর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করতঃ তাঁর সাথে বেয়াদবী ও অসদাচরণ করেছিলো। ফলে আল্লাহর আযাবে তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো।
আসহাবে মাদইয়ানের ওপর এই আযাবটি আসলো যে, فاخذتهم الصيحة. অর্থাৎ হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) এর চিৎকারের ভয়ংকর আওয়াজে জমিন প্রকম্পিত হয়ে ওঠলো এবং মানুষের অন্তর ভয়ে পথহারা হয়ে গেলো এবং সকলে উপুড় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলো।
আর আসহাবে আইকাকে عذاب يوم الظلمة .অন্ধকার দিনের আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেওয়া হলো, যার বর্ণনা তাফসীরে সাভীর ৩য় খন্ডর ১৫০নং পৃষ্ঠায় রয়েছে।
তারা অবাধ্যতা প্রদর্শন করতঃ রাসূলকে বললো, যদি তুমি সত্য নবী হও, তাহলে আসমান হতে কোন অগ্নি টুকরো এসে যদি আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতো!
এরপর মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর ওই ক্রোধপূর্ণ আযাব ওই জাতির ওপর এসে পড়লো যার বর্ণনা হাদিসে এসেছে যে, ওই সব লোকদের ওপর জাহান্নামের একটি দরজা খুলে দেওয়া হলো। যার কারণে পুরো লোকালয়ে তীব্র গরম ও লু হাওয়ার উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়লো এবং বস্তিবাসীদের দম বন্ধ হবার উপক্রম হলো। লোকেরা নিজেদের ঘরের অভ্যন্তরে বসবাস করতে লাগলো এবং নিজেদের ওপর পানি ছিটাতে লাগলো। তবে পানি ও ছায়ার মধ্যে তারা প্রশান্তি পেলো না। গরমের উষ্ণতায় তারা পুড়ে যাচ্ছিলো। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা একটি মেঘ খন্ড পাঠালেন যেটি তাঁবুর ন্যায় পুরো লোকালয়ে ছেয়ে গেলো। এই মেঘ খন্ডর ভিতর ছিলো হিমশীতল প্রশান্তিদায়ক বাতাস। এটা দেখে সকলে ঘর হতে বের হয়ে মেঘ খন্ডর তাঁবুর নীচে জমায়েত হলো। যখন সকল লোক মেঘের নীচে এসে পড়লো, তখন ভূমিকম্প হলো এবং আসমান হতে আগুন বর্ষিত হলো, যাতে সকলে পঙ্গপালের ন্যায় লাফিয়ে লাফিয়ে জ্বলে-পুড়ে গেলো।
তারা নিজেদের অবাধ্যতা প্রদর্শন করে বলেছিলো যে, হে শুয়াইব! তুমি সত্য নবী হলে দেখাও আসমানের কোন অগ্নি টুকরো এসে আমাদেরকে ধ্বংস করে দিক। সুতরাং ওই আযাবটি উক্তরূপে এই অবাধ্য জাতির ওপর এসে পড়লো এবং সকলে জ্বলে-পুড়ে ছাইয়ের স্তূপ বনে গেলো।
219. তাফসীরে সাভী, পৃষ্ঠা নং-১৫০, খন্ড নং-৩, গারায়িবুল কোরআন, পৃষ্ঠা নং-১২৪।
❏ প্রশ্ন-১৬০ঃ আসহাবে আইকা বলা হয় কাদেরকে, আইকা শব্দের অর্থ কী?
✍ উত্তরঃ আইকা শব্দের অর্থ বন। এসব লোকদের আবাস ছিলো সবুজ-শ্যামল বন ও ফলবান বৃক্ষের মধ্যখানে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে হেদায়ত দানের জন্য শুয়াইব (عليه السلام)কে প্রেরণ করেন। তিনি আসহাবে আইকার সম্মুখে যে ওয়াজ করেন তা কোরআন মজিদে এভাবে বর্ণনা করা হয়ঃ الا تتقون ، انى لكم رسول آمين ‘মনে রেখো, আমি তোমাদের প্রতি বিশ্বস্ত প্রেরিত রাসূল। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, খোদাভীরু হও।’
220. সূরা শুয়ারা, রুকু নং-১।
মোদ্দাকথা হলো আসহাবে আইকা হযরত শুয়াইব (عليه السلام)এর সংশোধনমূলক নসিহত শুনে তাঁর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করলো এবং অবাধ্যতা ও অহংবোধ প্রদর্শন করতঃ নিজেদের রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো। তাদের অবাধ্যাচরণের ধরণ এই পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো যে, এক পর্যায়ে তারা রাসূলকে বললো যে, যদি তুমি সত্য নবী হও, তাহলে আসমান হতে কোন আযাবী টুকরো যদি আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতো! এরপর উল্লেখিত শক্তিশালী আযাবটি তাদের ওপর এসে পড়ে।
উক্ত ঘটনা বিস্তারিত জানার জন্য আমার লিখিত ‘মুনিয়াতুল মুসলেমীন’ ২য় খন্ড দেখার অনুরোধ রইল।
❏ প্রশ্ন-১৬১ঃ وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ ...... فَأَصْبَحَ مِنَ الْخَاسِرِينَ (সূরা মায়েদা, পারা নং-৬) আয়াতটির তাফসীর কী?
✍ উত্তরঃ হে হাবিব! ওই সব লোকদেরকে হযরত আদমের দু’পুত্র হাবিল ও কাবিল এর বাস্তব ঘটনা ও কাহিনী পড়ে শোনান। যখন তারা আল্লাহর সমীপে উৎসর্গ নিবেদন করে তখন তাদের মধ্যে একজনের অর্থাৎ হাবিলের উৎসর্গ কবুল হয় এবং অন্যজনের অর্থাৎ কাবিলের উৎসর্গ কবুল হয়নি, তখন কাবিল হিংসার ক্রোধে বলতে লাগলো যে, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করবো। উত্তরে সে বললো, আল্লাহ কেবল পরহেযগারদের উৎসর্গ কবুল করেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আমার দিকে হাত প্রসারিত করো, তবে আমি কিন্তু তোমার দিকে হাত প্রসারিত করবো না, কেননা আমি আল্লাহকে ভয় করি। আমি তো চাই তুমি আমার ও তোমার নিজের উভয়ের পাপের বোঝা বহন করো এবং জাহান্নামীদের সাথে গিয়ে মিলো। আর এটাই হচ্ছে যালিমদের শাস্তি।
একথা বলা সত্ত্বেও তার মন নিজ ভাইকে হত্যার প্রতি প্ররোচিত করলো। অবশেষে তাকে হত্যা করে নিজের আস্তানায় চলে আসলো। এরপর আল্লাহ তা‘আলা একটি কাক পাঠালেন। কাকটি মাটি খুঁড়তে লাগলো যাতে নিজের ভাইয়ের লাশ কিভাবে দাফন করতে হয় তা ওই ঘাতককে দেখিয়ে দেওয়া হয়। কাকটি কর্তৃক মাটি খোঁড়ার বিষয়টি দেখে সে আফসোসের স্বরে বলে ওঠলো, হায় বদ-নসীব! আমি এই কাকটির চেয়ে অধম, যদি আমি এই কাকটির মতোও বুদ্ধিমান হতাম! তাহলে নিজের ভাইয়ের লাশটি দাফন করতে পারতাম।
হাবিল শব্দটি হিব্রু ভাষার শব্দ এবং হযরত আদম (عليه السلام)’র পুত্রের নাম। হাবিল ও কাবিল দু’জন ছিলো ভাই। কাবিল করতো ক্ষেত-খামার এবং হাবিল ছাগল পালন করতো। তারা উভয়ে আল্লাহর সমীপে উৎসর্গ নিবেদন করে। কাবিল তার উৎসর্গের মধ্যে দিলো নিম্নমানের নিকৃষ্ট মাল এবং হাবিল দিলো তার বকরী পালের মধ্য হতে সর্বোত্তমটি। কাবিলের উৎসর্গ নামঞ্জুর হলো। ফলে কাবিলের মধ্যে প্রচন্ড ঘৃণাবোধ সৃষ্টি হলো। এই হিংসার আগুন তার মনে জ্বলতে রইলো। এক পর্যায়ে হযরত আদম (عليه السلام) হজ্বে গেলে সুযোগ পেয়ে সে নিজের ভাইকে হত্যা করলো এবং নিহত ভাইয়ের লাশ কাঁধে নিয়ে ঘুরতে লাগলো। কেননা পৃথিবীর বুকে এটা ছিলো সর্বপ্রথম মৃত্যুর ঘটনা। অবশেষে সে কাকের নিকট হতে দাফনের বিষয়টি জেনে নিলো। সে নিজের কাজ, অবস্থা ও পরিস্থিতির ব্যাপারে খুবই লজ্জিত হলো। কোরআন মজিদে এই কাহিনীটি এসব শব্দে বর্ণনা করা হয়েছে।
❏ প্রশ্ন-১৬২ঃ شهنشاه ‘শাহিনশাহ’ শব্দটির অর্থ কী, তার ব্যবহার জায়েয নাকি না-জায়েয?
✍ উত্তরঃ شهنشاه শাহিনশাহ শব্দটির অর্থ হচ্ছে রাজাধিরাজ। এটি শাহান শাহ শব্দদ্বয়ের সংক্ষিপ্ত রূপ। এ নামটি ধরে কাউকে ডাকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। সুতরাং রাসূলুল্লাহ বলেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট যাবতীয় নাম সমূহের মধ্যে সর্বাধিক অপছন্দনীয় ও নিকৃষ্ট নাম হচ্ছে ‘মালাকুল আমলাক’ অর্থাৎ শাহিনশাহ নামটি। তার কারণ হচ্ছে এই নামটির সঠিক প্রয়োগস্থল কেবল আল্লাহ ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। তিনিই রাজাধিরাজ, শাসকদের শাসক এবং আসমান-জমিনের অধিপতি।
وهو احكم الحاكمين له الملك فى السمٰوٰت والارض .
❏ প্রশ্ন-১৬৩ঃ শীশ শব্দটি কোন ভাষার শব্দ এবং অর্থ কী?
✍ উত্তরঃ এই নামটি সুরইয়ানী ভাষার শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর দান। কারো কারো মতে, এটা অনারবী শব্দ। বনি ইসরাইলের কিতাবসমূহে এর অর্থ পাওয়া যায় বদলা বা বিনিময় অর্থাৎ হাবিলের বিনিময় বা বিকল্প। তিনি হাবিলের হত্যাকান্ডের ৫ ( পাঁচ) বছর পর জন্মগ্রহণ করেন যখন হযরত আদম (عليه السلام) এর বয়স হয়েছিল দু’শ ত্রিশ বছর।
ইবনে কুতাইবা মা’রিফ গ্রন্থে লিখেছেন যে, হযরত শীশ (عليه السلام) ছিলেন হযরত আদম (عليه السلام)’র সন্তানদের মধ্যে সর্বাধিক দয়ালু ও সুন্দর। তিনি ছিলেন হযরত আদম (عليه السلام)-এর অধিক সদৃশ। অন্যান্য সন্তানদের বিপরীতে তিনি এককভাবে বা একা জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
তারীখে তাবারীতে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, বনি আদমের বংশধর তুফানের পর তাঁর উপরেই সমাপ্ত হয়। তাঁর ওপর পঞ্চাশটি সহীফা অবতীর্ণ হয়েছিল। তিনি প্রথমে প্রথমে ইবরানী ভাষায় কথা বলতেন। তাঁর ওপর যে সব সহীফা অবতীর্ণ হয়েছিল সেগুলোতে ছিল বিজ্ঞান, প্রকৌশল, সংগীত, গণিত, জ্যোর্তিবিজ্ঞান ইত্যাদি বিদ্যা ও শাস্ত্র। তাই ইউনানী হেকিমী শাস্ত্রের তাকে প্রথম শিক্ষক বা জনক বলে।
‘যাইনুল কাসাস’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত শীশ (عليه السلام)কে প্রচুর সম্পদ দিয়েছিলেন। তিনি তা দিয়ে ব্যবসা করতেন এবং অধিকাংশ সম্পদ আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য ব্যয় করতেন।
কতিপয় মুহাক্কিক ‘ফুসূসুল হিকম’ গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থে লিখেছেন, যখন হযরত আদম (عليه السلام) মৃত্যু শয্যায় আসীন হলেন তখন তার মনে জান্নাতী ফলের আকাঙ্খা সৃষ্টি হলো। হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) একটি পাত্রে জান্নাতী ফল নিয়ে আসলেন। ওই পাত্রটি ছিল একটি হুরের (জান্নাতী রমণী) মাথার ওপর। হযরত আদম (عليه السلام) ফল খাওয়ার পর দু‘আ করলেন, হে আল্লাহ্! এই হুরটির সাথে শীশের বিয়ে হোক। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দু‘আ কবুল করেন এবং হুরটির সাথে হযরত শীশ (عليه السلام) এর বিয়ে হলো। তিনি বয়স পেয়েছিলেন ৯১৩ বছর। অনুরূপ উল্লেখ রয়েছে ‘আল-আখবারুল আউয়াল’ গ্রন্থের মধ্যে।
হযরত মাওলানা রফিউদ্দিন দেহলভীর মতে হযরত আদমের ইন্তিকাল হতে তিনি ১২৪৩ বছর বয়সে ওফাত লাভ করেন।
কেউ কেউ বলেন, তাঁকে নিজের পিতার কবরে দাফন করা হয়। আবার কারো মতে, তাঁকে বালাবাক্কা অঞ্চলের সুরাইন আমাল গ্রামে দাফন করা হয়। সেখানে মানুষ তাঁর কবর যিয়ারত করার জন্য যায়।
221. ইসলামী মা’লুমাত, পৃষ্ঠা নং-৪৪৩।
❏ প্রশ্ন-১৬৪ঃ ‘শায়খ’ শব্দের ব্যাখ্যা কী এবং ‘শায়খ’ কাকে বলা হয়?
✍ উত্তরঃ شيخ ‘শায়খ’ বলা হয় বৃদ্ধ লোককে। যার বহুবচন হচ্ছেشيوخ ‘শুয়ুখ’ বা اشياخ‘আশয়াখ’। কেউ কেউ বলেন, ‘শায়খ’ বলা হয় পঞ্চাশ বছরের ঊর্ধ্ব বয়স্ক লোককে। আবার কারো কারো মতে, একষট্টি বছরের ঊর্ধ্ব বয়স্ক লোককে ‘শায়খ’ বলা হয়।
‘শায়খে ফানি’ বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যে দৈনন্দিন দূর্বল থেকে দূর্বলতর হচ্ছে। ফিকহে হানাফীর পরিভাষায় ইমাম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) ও ইমাম আবু ইউসুফকে (رحمه الله تعالي ) ‘শায়খাইন’ বলা হয়।
‘আহলে হাদীস’ শায়খ বলে ওই ব্যক্তিকে যার নিকট হতে হাদীস রেওয়ায়ত করা হয়। তাদের পরিভাষায় ইমাম বুখারী (رحمه الله تعالي ) ও ইমাম মুসলিমকে (رحمه الله تعالي ) শায়খাইন বলা হয়। ‘আহলে তাসাউফ’ এর মতে শায়খ হচ্ছেন ওই ব্যক্তি যিনি অন্তর—দৃষ্টির শক্তি বলে দুনিয়া ইত্যাদির জং-ময়লা মুরিদের অন্তর হতে দূর ও পরিষ্কার করে দেন।
দর্শন শাস্ত্রের ইমাম ও শিক্ষক, জাতির নেতা এবং নও মুসলিমকেও শায়খ বলা হয়।
পরিভাষায় কামিল মুকাম্মিল দরবেশকেও শায়খ বলা হয়। কেউ কেউ শায়খ শব্দের সংজ্ঞা দিয়েছেন এরূপ هو من يحى العظام الرميمة অর্থাৎ ‘ওই ব্যক্তিকে শায়খ বলা যায় যিনি মৃত হাড়কে জীবিত করতে পারেন।’
❏ প্রশ্ন-১৬৫ঃ দস্তারবন্দি মাহফিল আয়োজন করার বিধান কী?
✍ উত্তরঃ ভারত ও মধ্য এশিয়ার আলেমদের মধ্যে এই প্রথাটির প্রচলন রয়েছে এবং এটা বিদআত। কোরআন-হাদীস এবং সাহাবাদের জীবনাচারে এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে এটা একটা সার্বজনীন প্রথা যে, যখন কোন ছাত্র ইলমে দ্বীনের ডিগ্রী অর্জন করে তখন তাকে সম্মানিত আলেমদের একটি বিশেষ মজলিসে মর্যাদার পাগড়ি পরিধান করানো হয় যার বদৌলতে সে আনুষ্ঠানিকভাবে আলেমদের জামাতে অন্তভুর্ক্ত হয়। তখন তাকে জ্ঞানের বিকাশ সাধন, ফতোয়া লিখা এবং শরয়ী মাসায়েল অনুযায়ী বিধি-বিধান শুনানোর যোগ্য বলে মনে করা হয়। এই প্রথাটি এক ধরনের বিদআতে হাসনাহ। এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না। ইসলামের বিকাশ কালে এর কোন নজির বা দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়না। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এই কর্ম পদ্ধতির মধ্যে অসংখ্য শরয়ী ও ইলমী স্বার্থ নিহিত রয়েছে যেগুলো লক্ষ্য করে পরবর্তী ওলামায়ে কেরাম এই প্রথার প্রচলন ঘটিয়েছেন।
ما راهُ المؤمنون حسنا فهو عند اللهِ حسنٌ . هو ماظهرلى والعلم عندالله .
‘মু’মিনগণ যা উত্তম মনে করেন তা আল্লাহর নিকটও উত্তম।’ আমার নিকট এরূপ প্রতীয়মান হয়েছে। সঠিক জ্ঞান আল্লাহর নিকট রয়েছে।
222. ইসলামী উলুম কা মাখযান, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩২২।
❏ প্রশ্ন-১৬৬ঃ اُم الولد ‘উম্মুল ওয়ালাদ’ কাকে বলা হয় এবং এর সংজ্ঞা ও বিধান কী?
✍ উত্তরঃ ‘উম্মুল ওয়ালাদ’ বলা হয় ওই দাসীকে যার গর্ভে মনিবের সন্তান ভূমিষ্ট হয়। ওই দাসীকে বিক্রয় ও দান করা বৈধ নয়। তবে তার সাথে সহবাস করা, তার সেবা গ্রহণ করা, তাকে ভাড়া দেওয়া ও বিয়ে দেওয়া বৈধ।
❏ প্রশ্ন-১৬৭ঃ امّ هانىউম্মে হানীর মূল বা প্রকৃত নাম কি? হুযূর তাঁর ঘর হতে কিভাবে মি‘রাজে গেলেন?
✍ উত্তরঃ উম্মে হানী হচ্ছেন হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)’র বোন এবং আবু তালিবের কন্যা। তার প্রকৃত নামের ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। কারো কারো মতে, তার নাম হচ্ছে হিন্দা কিংবা ফাতেমা বা ফাখতাহ। তার স্বামীর নাম হচ্ছে হুবায়রা বিন ওমর আল-মাখযুঈ। সে মুশরিক ছিল। মক্কা বিজয়ের দিন সে পালিয়ে গিয়েছিল, আর ওই সময়েই হযরত উম্মে হানী ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করেন। তার নিকট হতে ৪৬টি হাদীস বর্ণিত আছে। মি‘রাজের রাতে হুযূর (ﷺ) তার ঘরে তাশরীফ নিয়েছিলেন।
❏ প্রশ্ন-১৬৮ঃ হযরত উম্মে সালমা কে ছিলেন? তার ব্যাপারে কিছু আলোচনা কর।
✍ উত্তরঃ উম্মে সালমা ছিলেন হুযূর (ﷺ) এর অন্যতম স্ত্রী। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল হিন্দা। পিতার নাম আবু উমাইয়া এবং মাতার নাম আতেকা বিনতে আমের।
তিনি প্রথমে আবু সালমার বৈবাহিক বন্ধনে ছিলেন। তবে আবু সালমা যখন উহুদ যুদ্ধে শহীদ হলেন তখন হযরত আবু বকর (رضى الله تعالي عنه) তার নিকট বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। এতে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করলেন। এরপর হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) রাসূলুল্লাহ ’র পক্ষে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন তখন উম্মে সালমা বললেন, রাসূলুল্লাহ কে স্বাগতম। তবে আমি বৃদ্ধা। তদুপরি আমার একজন এতিম পুত্রও রয়েছে। আমার স্বভাবে আত্মসম্ভ্রমবোধও প্রবল এবং আমার পৃষ্ঠপোষক বা মুরব্বীও বিদ্যমান নেই।
এই জবাব পেয়ে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার নিকট তাশরীফ নিলেন এবং বললেন, বয়সে আমি তোমার চেয়ে বড়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল হচ্ছেন এতিমদের অভিভাবক। আত্মসম্ভ্রমবোধ আল্লাহ তা‘আলা দূর করে দিবেন। মুরব্বী বা বড়দের উপস্থিতি প্রয়োজন। কেননা আমি এমন কোন ব্যক্তি নই যে আমার ব্যাপারে অসম্মতি জানাবে। তখন উম্মে সালমা স্বীয় নাবালেগ পুত্র ওমরকে বললো, আমাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র সাথে বিয়ে করিয়ে দাও। সে বিয়ে করিয়ে দিলো। হুযূর (ﷺ) তাকে যায়নাব (رضى الله تعالي عنه)-এর ঘরে রাখলেন। কেননা তখন তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং তার ঘরটি খালি ছিল। এই ঘটনাটি ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাসের ২ তারিখে সংঘটিত হয়েছিল। হাদীসের কিতাবাদিতে তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা হচ্ছে ৩৭৪টি। মুত্তাফাক আলাইহি ১৩টি, এককভাবে সহীহ বুখারীতে ১৩টি, এককভাবে সহীহ মুসলিমে ১৩টি এবং অবশিষ্ট হাদীসসমূহ অন্যান্য কিতাবে রয়েছে। তিনি ৫৬ হিজরী মতান্তরে ৬২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। হযরত আবু হুরায়রা (رضى الله تعالي عنه) তার জানাযার নামায পড়ান এবং জান্নাতুল বকীতে তাকে দাফন করা হয়। তখন তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। প্রসিদ্ধ বর্ণনা মতে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)’র অবশিষ্ট সকল স্ত্রীগণের পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
223. তিরমিযী শরীফ।
❏ প্রশ্ন-১৬৯ঃ ‘জাম্উল জামা’ কাকে বলা হয়?
✍ উত্তরঃ جمع الجمع এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বহুবচনের বহুবচন। সুফিয়ায়ে কেরামদের মতে, আল্লাহর মধ্যে সম্পূর্ণভাবে বিলীন হওয়াকে جمع الجمع ‘জামউল জামা’ বলা হয়।
❏ প্রশ্ন-১৭০: ‘নামুসে আকবর’ দ্বারা উদ্দেশ্য কী এবং ‘নামুস’ শব্দের অর্থ কী?
❏ প্রশ্ন-১৭১: বনী আদম তথা মানব বংশধারা কখন হতে শুরু হলো?
❏ প্রশ্ন-১৭২: হাবীল ও কাবিল এর ঘটনাটি বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-১৭৩: অগ্নিপূজক কাদেরকে বলা হয়?
❏ প্রশ্ন-১৭৪: ناد عليا مظهر العجائب الخ এটা কী?
❏ প্রশ্ন-১৭৫: রাইয়ান, সায়রাব ও রাইহান নামগুলির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কী?
❏ প্রশ্ন-১৭৬: شهنشاه ‘শাহিনশাহ’ উপাধি দ্বারা কাউকে ডাকা জায়েয নাকি না-জায়েয?
❏ প্রশ্ন-১৭৭: ذوالكفل যুল-কিফিল কে ছিলেন এবং এর অর্থ কী?
❏ প্রশ্ন-১৭৮: ذوالنون ‘যুন্নুন’ কে ছিলেন এবং তাঁর জীবনকাল কীরূপ ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৭৯: যখন কোন জাতির ওপর আযাব চলে আসে তখন আযাব চলে আসার পর ঈমান আনা ফলদায়ক নয়। তবে হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর জাতির ওপর মেঘরাজি আসার পরেও যখন তারা ঈমান আনলো তখন তাদের ওপর আযাব উঠিয়ে নেওয়া হলো, এর পেছনে রহস্য কী?
❏ প্রশ্ন-১৮০: হযরত নূহ (عليه السلام) কখন হতে রিসালতের পদে অধিষ্ঠিত হন এবং হযরত আদম (عليه السلام)-এর কত বছর পর জন্মগ্রহণ করেন?
❏ প্রশ্ন-১৮১: হযরত আদম (عليه السلام)’র পদার্পনের কত দিন পর এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়?
❏ প্রশ্ন-১৮২: يَا هُوَ শব্দের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কি এবং هو সর্বনামের প্রত্যাবর্তন কোন দিকে? বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-১৮৩: ফাসিক কারা এবং এদের নাম কি?
❏ প্রশ্ন-১৮৪: ক্বিবলা কাকে বলে এবং ক্বিবলাকে ক্বিবলা কেন বলা হয়? তাহ্ক্বিকসহ বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-১৮৫: غيرذوى العقول বা জ্ঞানহীনদের ক্ষেত্রে ذوى العقول বা জ্ঞানবানদের জন্য ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহার করা শুদ্ধ কি-না?
❏ প্রশ্ন-১৮৬: সূরা আ‘রাফে আল্লাহ্ তা‘আলার বাণী,
مَا لَا يَخْلُقُ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ। এখানে ما শব্দ দ্বারা কারা উদ্দেশ্য?
❏ প্রশ্ন-১৮৭: সূরা আ‘রাফে مِنْ دُونِ اللهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ আয়াতে عباد শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য কী?
❏ প্রশ্ন-১৮৮: হযরত ইউসুফ (عليه السلام) ও যুলাইখা বিবির বিবাহের পদ্ধতি ও বাস্তব অবস্থা কিরূপ ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৮৯: শয়তান বিতাড়িত ও অভিশপ্ত হওয়ার পূর্বে ফিরিশতাদের সঙ্গে কোন্ কোন্ বিষয়ে আদিষ্ট ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৯০: ইচ্ছাকৃত হত্যাকারী কি সর্বদা জাহান্নামে থাকবে?
❏ প্রশ্ন-১৯১: সূরা আলে-ইমরানে হযরত ঈসা (عليه السلام)কে হযরত আদম (عليه السلام)-এর সাদৃশ তুলনা করা হয়েছে। এটা কিভাবে শুদ্ধ হবে?
❏ প্রশ্ন-১৯২: হযরত আদম (عليه السلام) এর সন্তানদের মাঝে ঝগড়া-বিবাদের কারণ কি ছিল? এবং তাদের মধ্যে ভাই-বোনের পার্থক্যের নিয়ম কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৯৩: আসহাবে কাহাফের কুকুর জান্নাতে যাবে কিনা? এ ব্যাপারে ওলামাই কিরামের মতামত কি?
❏ প্রশ্ন-১৯৪: বর্তমানে প্রচলিত ফাঁসির শাস্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে কিসাসের হুকুমের অন্তভুর্ক্ত হবে কি-না?
❏ প্রশ্ন-১৯৫: বর্তমানে মানুষ গাছের পরিবর্তে ষ্টীল, লোহা ও পাষ্টিক ইত্যাদি দ্বারা ঘরের সরঞ্জামাদি ও অলংকার তৈরী করছে। এ জাতীয় সরঞ্জাম, খাট ও অলংকার ব্যবহার করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয আছে কিনা?
❏ প্রশ্ন-১৯৬: পুরুষদের জন্য অপ্রয়োজনীয় লোম ক্ষুর দ্বারা পরিষ্কার করা কি আবশ্যক? লোম পরিষ্কার করার পাউডার ব্যবহার করা যাবে কি-না?
❏ প্রশ্ন-১৯৭: আহলে হাদীস ও জামায়াতে ইসলামীর অভিযোগ মাযহাবের তাকলীদ করা শিরিক এটা কি শুদ্ধ?
❏ প্রশ্ন-১৯৮: ইন্জেকশনের মাধ্যমে জন্তু যেমন-গরু, মহিষ ইত্যাদির বংশ বিস্তারের জন্য গর্ভধারণের ব্যবস্থা করা শরয়ী বিধান মতে বৈধ কি-না?
❏ প্রশ্ন-১৯৯: রোগীকে রক্ত প্রদান করার শরয়ী বিধান কি?
❏ প্রশ্ন-২০০: সৈয়্যদা হযরত ফাতেমা (رضى الله تعالي عنها)-এর ফযিলত এবং তাঁর নামের অর্থ কি?
❏ প্রশ্ন-২০১: ‘আহলে বাইত’ কারা উদ্ধৃতিসহ বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-২০২: নিয়াবত্ বা প্রতিনিধিত্ব কাকে বলে? এবং এর দ্বারা উপকারিতা কি?
❏ প্রশ্ন-২০৩: ঔষধ সেবন এবং চিকিৎসা করার বিধান কি? শারীরিক সুস্থ্যতা ও আত্মিক সুস্থ্যতা কাকে বলে এবং উভয়ের সংজ্ঞা কি?
❏ প্রশ্ন-২০৪: রোগের চিকিৎসা ও ঔষধ সেবন করা কি সুন্নাত? যদি কোন রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, তাহলে গোনাহগার হবে কি-না?
❏ প্রশ্ন-২০৫: خَيْرٌ শব্দের তাহ্কীক বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কি?
❏ প্রশ্ন-২০৬: آيات الحفظ বা হিফাযত বা সংরক্ষণের আয়াত কাকে বলে?
❏ প্রশ্ন-২০৮: بارى এবং باديه سماوه এর তাহ্কীক বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কি?
❏ প্রশ্ন-২০৯: بلعم بن باعوراء (বল‘আম বিন বাউরা) কে ছিল?
❏ প্রশ্ন-২১০: কখন থেকে চন্দ্র হিসেবে বছরে বার মাস গণনা করা শুরু হয় এবং সূর্য হিসেবে মাস ও হিন্দী মাসের মধ্যে গণনা কিভাবে সাদৃশ্য ও মিলানো হয়?
❏ প্রশ্ন-২১১: বছরে তিন মৌসুম গণনা করা হয়। এটা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়?
❏ প্রশ্ন- ২১২:
(ا) الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ الخ (২) وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا الخ(৩) أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا الخ
উক্ত আয়াতগুলোর তাফসীর ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কি?
❏ প্রশ্ন-২১৩: সুন্নাত কাকে বলে সংজ্ঞাসহ বর্ণনা কর ?
❏ প্রশ্ন-২১৪: فرعون ও هامان এটি কোন শব্দ? এবং নমরূদ কে ছিল?
❏ প্রশ্ন-২১৫: ســبـأ‘ (সাবা) এর তাফসীর ও তাহকীক বর্ণনা কর ?
❏ প্রশ্ন-১৭০: ‘নামুসে আকবর’ দ্বারা উদ্দেশ্য কী এবং ‘নামুস’ শব্দের অর্থ কী?
✍ উত্তর: নামুসে আকবর দ্বারা উদ্দেশ্য ফেরেশতা, রূহ ও শরীয়তে ইলাহী। তদুপরি তা হযরত জিবরাইল (عليه السلام)-এর উপাধি। সুতরাং যখন হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা হেরা গুহায় ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর নিজের ঘরে তাশরীফ নিলেন এবং হযরত খাদিজা (رضى الله تعالي عنه)’র সম্মুখে পুরো ঘটনা খুলে বললেন, তখন হযরত খাদিজা (رضى الله تعالي عنه) তাঁকে তার [খাদিজার (رضى الله تعالي عنه)] চাচাতো ভাই ওরাকা বিন নওফল এর নিকট নিয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন তাওরাত ও ইঞ্জিলের বড় আলেম এবং এতদুভয় আসমানী গ্রন্থের আরবী ভাষায় অনুবাদ করতেন। তিনি বড় বড় ইহুদী ও ঈসায়ী আলেমদের নিকট হতে শেষ নবীর সংবাদ (ভবিষ্যৎ বাণী) শুনেছিলেন এবং তিনি শেষ নবীর যাবতীয় আলামত-নিদর্শন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
হুযূর এর ওপর ওহী অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনা ও অবস্থা সম্পর্কে শুনে ওরাকা বিন নওফল বললেন, হে মুহাম্মদ ! আপনি ধন্য, তিনি ওই নামুসে আকবর (অর্থাৎ জিবরাইল) যিনি মুসা (عليه السلام) ও অন্যান্য নবীগণের নিকট ওহী নিয়ে আসতেন। এখন আপনার নিকট ওহী নিয়ে এসেছে। এখন আপনি হচ্ছেন শেষ নবী।
❏ প্রশ্ন-১৭১: বনী আদম তথা মানব বংশধারা কখন হতে শুরু হলো?
✍ উত্তর: বনী আদম তথা মানবের বংশধারা হযরত আদম (عليه السلام) হতে শুরু হয়। হযরত আদমের (عليه السلام) পূর্বে ছিল জ্বিন, ফেরেশতা ইত্যাদি। যখন হতে হযরত আদমের (عليه السلام) বংশধারা সুবিস্তৃত হল তখন হতে আল্লাহ তা‘আলা হযরত আদমের (عليه السلام) কল্যাণের জন্য নিজেদের মধ্য হতে নবী পাঠাতে লাগলেন। নবীগণ আদম সন্তানকে তাওহিদের পথ নির্দেশনা করতে লাগলেন এবং তাদেরকে নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে বুঝাতে একটি মুহূর্তও ক্ষান্ত হননি।
উষালগ্নে মানবজাতি দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে গেলো। একদল নবীগণের (عليه السلام) আদেশ-উপদেশ মেনে নিলো, তাঁদের আনুগত্য-অনুসরণ করলো এবং তাঁদের নির্দেশনা মতে চলতে লাগলো।
অন্যদল কেবল বিরোধিতা করেনি বরং নিষ্পাপ নবীগণকে হত্যা করার পরিকল্পনা করলো এবং কয়েকজন নবীকে হত্যাও করলো। অন্য আরেকটি দল পাপাচারিতার অদ্ভূত পদ্ধতি আবিষ্কার করলো। কোথাও শুরু করলো অগ্নিপূজা, কোথাও মূর্তির সম্মুখে সিজদা, আবার কোথাও বৃক্ষপূজা ও সূর্যপূজার রমরমা প্রচলন। মোদ্দাকথা নিজেদের খেয়াল-খুশি মত শিরকের যাবতীয় উপায় অবলম্বন করলো।
প্রারম্ভিককালে মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা ও কর্মকান্ড ছিল অতি সহজ-সরল ও সাদাসিধে। সকল বিষয়ে সরলতা ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। তবে যুগের রঙ পাল্টানোর সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পরিবর্তন সাধিত হতে লাগলো এবং বর্তমানে এই পর্যায়ে চলে আসলো যে, এখন মানুষের কথায় কথায় পাওয়া যায় কৃত্রিমতা।
224. নাসে উনওয়ান, পৃষ্ঠা:৭৩৯।
❏ প্রশ্ন-১৭২: হাবীল ও কাবিল এর ঘটনাটি বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: কাবিল ও হাবিল এর মধ্যে যখন নারী নিয়ে বিবাদ হলো তখন আদম (عليه السلام) তা এভাবে নিষ্পত্তি করলেন যে, তোমরা উভয়ে মিনা পর্বতে গিয়ে কুরবানী রেখো এসো, যার কুরবানী কবুল হবে তাকে নারী (স্ত্রী হিসেবে) দেওয়া হবে। উভয়ে মিনা পর্বতে কুরবানী রাখলো। তখন আসমান হতে আগুন এসে হাবিলের কুরবানী নিয়ে গেলো এবং কাবিলের কুরবানী পড়ে রইলো। এতে কাবিলের অন্তরে হাবিলের প্রতি বিদ্বেষ বেড়ে গেলো। যার ফল দাঁড়ালো কাবিল হাবিলকে হত্যা করলো।
225. কাসাসুল আম্বিয়া।
❏ প্রশ্ন-১৭৩: অগ্নিপূজক কাদেরকে বলা হয়?
✍ উত্তর: কাফেররা যেরূপ মূর্তি, বৃক্ষ ইত্যাদির পূজা-অর্চনা করে অনুরূপ আগুনের পূজাও করে। যারা মূর্তিপূজা করে তাদেরকে মূর্তিপূজক এবং যারা আগুন পূজা করে তাদেরকে অগ্নিপূজক বলা হয়।
নমরুদ হযরত ইবরাহিম (عليه السلام)কে কেবল এই অপরাধে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছিল যে, তিনি মূর্তিপূজার বিরোধিতা করতেন এবং তাওহিদের শিক্ষা দিতেন। তবে আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুমে ইবরাহিম (عليه السلام) এর কোন ক্ষতি হয়নি।
❏ প্রশ্ন-১৭৪: ناد عليا مظهر العجائب الخ এটা কী?
✍ উত্তর: ناد عليا হচ্ছে একটি দু‘আ। এই দু‘আটি মনস্কামনা লাভ ও বিপদ দূর করার উদ্দেশ্যে পড়া হয় এবং লিখে তাবিজ আকারেও ব্যবহার করা হয়। আর এই দু‘আটি হচ্ছে,
نادعليًا مظهر العجائب تجدهُ عونا لك فى النوائب كل همٍّ الخ .
‘হযরত আলীকে, যিনি বিরল বস্তুর সূক্ষন্ড জ্ঞানের অধিকারী, ডাকো, তুমি তাকে দুঃখ-কষ্টে সাহায্যকারী পাবে। হে মুহাম্মদ ! আপনার নবুওয়তের ওসিলায় এবং হে হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)! আপনার বরকতে যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট ও ক্লেশ দূর হয়ে যাবে।’
এই দু‘আটি শিয়াদের দৈনন্দিন অভ্যাস ও ওজিফা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এবং সুফিয়ায়ে কেরামও এই দু‘আটি উপকারী ও ফলদায়ক মনে করেন। তবে আহলে হাদিস এই দু‘আটিকে শির্ক মনে করে। তারা বলে, এই দু‘আর কোন মৌলিকত্ব বা দলিল-প্রমাণ নেই।
❏ প্রশ্ন-১৭৫: রাইয়ান, সায়রাব ও রাইহান নামগুলির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কী?
✍ উত্তর: রাইয়ান ও সায়রাব হচ্ছে বেহেশতের একটি দরজার নাম। হযরত সাহাল বিন সা’দ (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ বলেন, বেহেশতের আটটি দরজা রয়েছে, তন্মধ্যে একটির নাম হচ্ছে রাইয়ান। তা দিয়ে কেবল রোযাদারগণ প্রবেশ করতে পারবে।
রাইয়ান বিন ওয়ালিদ হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর সময়কালে মিসরের রাজা ছিলেন। যিনি হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর ওপর ঈমান এনেছিলেন এবং তাঁর (عليه السلام) সময়কালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
রায়হানা হচ্ছে জনৈক ইহুদী নারীর নাম, যার স্বামী বনু কুরাইযার যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে সে অসম্মতি জানিয়েছিল। তাকে রাসূলের পবিত্র বিবিগণের মধ্যে অন্তভুর্ক্ত করার ইচ্ছা আল্লাহর ছিল না। তাই পরিশেষে সে দাসীদের মধ্যে থাকতে পছন্দ করলো।
226. ইসলামী মালুমাত, পৃষ্ঠা-৬৩।
❏ প্রশ্ন-১৭৬: شهنشاه ‘শাহিনশাহ’ উপাধি দ্বারা কাউকে ডাকা জায়েয নাকি না-জায়েয?
✍ উত্তর: ‘শাহিনশাহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাজাধিরাজ এবং এটি শাহান শাহ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। এই নামে কাউকে ডাকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ বলেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত ও নিকৃষ্ট নাম হচ্ছে ‘মালাকুল আমলাক’ তথা শাহিনশাহ নামটি।
227. বুখারী শরীফ।
কারণ এই নামটির মূর্তপ্রতীক আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। তিনিই রাজাধিরাজ এবং শাসকের শাসক। له الملك فى السموٰت والارض ‘আসমান ও জমিনে রয়েছে তাঁরই রাজত্ব’।
❏ প্রশ্ন-১৭৭: ذوالكفل যুল-কিফিল কে ছিলেন এবং এর অর্থ কী?
✍ উত্তর: যুল কিফিল শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জামিনদার। এটা একজন নবীর নাম, যিনি হচ্ছেন ইয়াসা ইয়াসির ইবনে আইয়ুবের চাচাতো ভাই। এই নামে তাঁর নামকরণের কারণ হিসাবে বলা হয় যে, বনি ইসরাইল ব্যাপক হারে নিজেদের নবীগণকে হত্যা করতো। তিনি একশত নবীর প্রাণ রক্ষা করেন কিংবা তিনি প্রতিদিন একশত জন মুসল্লির সমপরিমাণ নামায পড়তেন। কতিপয় আলেম বলেন, তিনি ছিলেন হযরত আইয়ুব (عليه السلام) এর পুত্র। তাঁর নাম ছিলো বিশর বিন আইয়ুব এবং উপাধি ছিলো যুল কিফিল। আইয়ুব (عليه السلام) এর পরবর্তীতে তিনি রোম দেশে নবী হয়েছিলেন। ‘আখবারুদ দুওয়াল’ গ্রন্থে এই মর্মে উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত আইয়ুব (عليه السلام) এর পর তিনি রোম দেশে নবী হয়েছিলেন। যখন হযরত যুল কিফিল রোম দেশের রাসূল হলেন তখন ওই জাতির লোকেরা প্রথমে তাঁর ওপর ঈমান আনলো। আল্লাহ তা‘আলা যখন তাদেরকে জিহাদের নির্দেশ দিলেন তখন তারা জিহাদ করতে অস্বীকার করলো এবং বলতে লাগলো, হে বিশর! আমরা জীবনকে ভালোবাসি এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করি। আবার আল্লাহ্ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণও আমরা অপছন্দ করি। সুতরাং যদি আপনি আল্লাহ'র নিকট এই মর্মে প্রার্থনা করেন যে, আমরা মৃত্যু কামনা না করা পর্যন্ত যেন মৃত্যুবরণ না করি, তাহলে আমরা আল্লাহর ইবাদত করবো এবং তার শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবো। তিনি বললেন, তোমরা অতি কঠিন প্রশ্ন করেছো। নামায পড়ে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং দু‘আ করলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তার দু‘আ কবুল করেন এবং বললেন, তুমি জাতির জামিনদার হয়ে যাও। সুতরাং হযরত বিশর বিন আইয়ুব এই জাতির নিকট তাদের প্রশ্ন বা প্রার্থনা গৃহীত হওয়ার কথা খুলে বললেন এবং উপরোলেখিত বিষয়ের জামিনদার হলেন। এই কারণে উপাধি স্বরূপ তাঁর নাম হলো যুল কিফিল এবং তাঁর প্রকৃত নাম হচ্ছে বিশর বিন আইয়ুব। ওই জাতির সন্তান-সন্ততির সংখ্যা ওই পর্যায়ে পৌঁছালো যে, রোম দেশে কোন জায়গায় স্থান সংকুলান হলো না। তখন ওই জাতি মৃত্যু কামনা করলো এবং নির্ধারিত সময়ে মৃত্যুবরণ করতে লাগলো। এটাই হচ্ছে রোম দেশে অধিক জনসংখ্যার কারণ। হযরত বিশর বিন আইয়ুব শাম দেশে ওফাতপ্রাপ্ত হন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তাঁর মাযার শরীফ নাবলুস এর সন্নিকটস্থ ‘কিফিল’ গ্রামে অবস্থিত। তবে মুহাক্কীকগণের মতে এই মতটি সঠিক যে, যুল কিফিল (عليه السلام) ছিলেন ইয়াসা ইবনে আখলুত এর মুনিব। হিযকিল ও বিশর বিন আইয়ুব এর উপাধিও যুলকিফিল, যাদের সময়কাল ছিল তাঁর পূর্বে।
‘মু‘আলিমুত তান্যিল’ গ্রন্থে হযরত আবু মুসা আশ‘আরী (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে,
لم يكن ذوالكفل نبيًا ولكن كان عبدًا صالِحًا.
অর্থাৎ ‘যুল কিফিল নবী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন নেক্কার-পূণ্যবান বান্দা।’ অতএব বুঝা গেলো যে, আউলিয়া-ই কিরাম থেকে অলৌকিক কারামত পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে এটা সাহেবে শরীয়ত হুযূর এর মুজিযা যা আল্লাহ'র কুদরতের বহিঃপ্রকাশ।
❏ প্রশ্ন-১৭৮: ذوالنون ‘যুন্নুন’ কে ছিলেন এবং তাঁর জীবনকাল কীরূপ ছিল?
✍ উত্তর: ذوالنون ‘যুন্নুন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে মাছওয়ালা। এটা হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর উপাধি। হযরত ইউনুস (عليه السلام) ছিলেন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মহান নবী। তাঁর পিতার নাম মাত্তা। কিন্তু আব্দুর রায্যাক বলেন, মাত্তা ছিল তাঁর মাতার নাম।
মুহাক্কিকগণ লিখেছেন, হযরত শাইয়ার যামানায় বনী ইসরাইলের রাজা ছিলো ‘হাযক্বিয়া’। ঘটনাক্রমে মুসিল নিতওয়ার জনগণ স্বীয় রাজার সহায়তায় বনী ইসরাইলের ওপর আক্রমণ করলো, তাদের আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে গেলো এবং ৯৫০ জন ব্যক্তিকে আটক করে নিয়ে গেলো। হাযকিয়া এই ঘটনাটি হযরত শাইয়াকে (عليه السلام) বললো এবং আরয করলো যে, যতক্ষণ পর্যন্ত বন্দীদের মুক্ত করা যাবেনা, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিকট থেকে প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না। কারণ যখন এদিক থেকে সৈন্য যাবে তখন তারা বন্দীদেরকে হত্যা করবে। হযরত শাইয়া (عليه السلام) বললেন, তোমার দেশে ৫ ( পাঁচ) জন নবী আছেন। তন্মধ্যে কাউকে নির্দেশনা সহকারে পাঠাও। তিনি তাদেরকে বুঝিয়ে বন্দীদেরকে মুক্ত করে আনবেন। হাযক্বিয়া বললো, আপনি কাউকে নির্বাচিত করুন। তিনি বললেন, ইউনুস (عليه السلام) খুবই পরিশ্রমী ও আমানতদার এবং আল্লাহর নিকট প্রিয়। অধিক ইবাদতের কারণে তিনি সকল নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তাঁকে পাঠাও। যদি তারা তাঁকে না মানে, তাহলে তিনি মু’জিযার মাধ্যমে তাদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আসবেন। এ সময় হাযক্বিয়া হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে তলব করলো এবং পুরো ঘটনা তাঁকে খুলে বললো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, যদি হযরত শাইয়া (عليه السلام) আল্লাহর হুকুমে নির্বাচিত করেন, তাহলে কোন অসুবিধা নেই, আমি যাবো। অন্যথায় আমার সময়ে ব্যাঘাত ঘটবে। হাযক্বিয়া বললো, আপনার নির্বাচন আল্লাহর হুকুমে নয়, বরং হযরত শাইয়া (عليه السلام) আপনাকে নির্বাচন করেছেন এবং তিনি আদেশ দানের অধিকারী এবং তাঁর আনুগত্য করা ওয়াজিব।
হযরত ইউনুস (عليه السلام) ভারী মনে রওয়ানা হলেন এবং স্বীয় পরিবারবর্গকেও সাথে নিলেন। নিতওয়া হচ্ছে মুসিলের বিপরীতে অবস্থিত এবং তার মধ্যখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে দজলা নদী। সেখানে তিনি গেলেন এবং সম্রাট মাল‘আব ইবনুল এরশাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তোমার নিকট পাঠিয়েছেন যে, তুমি বনী ইসরাইলের বন্দীদের মুক্তি দাও। সে বললো, যদি তোমরা সত্যবাদী হতে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তোমাদের দেশের ওপর চড়াও করতেন না এবং আমরা তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের বন্দী করে আনতাম না। ওই সময় কি আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য করতে অসমর্থ ছিলেন যিনি এখন তোমাকে পাঠিয়েছেন? মোদ্দাকথা, হযরত ইউনুস (عليه السلام) তিন দিন পর্যন্ত তাঁকে অনুরোধ করলেন। তবে সে তাঁর কথা মানেনি।
কেউ কেউ বলেন, ওই লোকটি ছিলো মূর্তিপূজক মুশরিক। হযরত ইউনুস (عليه السلام) তাকে মূর্তিপূজা না করতে বললেন কিন্তু তাঁর কথা সে মানেনি। কারো কারো মতে, তাকে নয় বছর পর্যন্ত বুঝানো হয়েছিল। কারো মতে, ২৩ বছর পর্যন্ত বুঝানো হয়েছিল। তবে দু’জন লোক ছাড়া কেউ ঈমান গ্রহণ করেনি। অবশেষে হযরত ইউনুস (عليه السلام) রাগান্বিত হয়ে আল্লাহর দরবারে এই মর্মে সাহায্য প্রার্থনা করেন যে, হে আল্লাহ্! এসব লোক আমার কথা শুনছে না। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, তাদেরকে ভয়ংকর আযাবের ভয় দেখান। যদি তারা আপনার কথা না শুনে, তাহলে আমি তাদের ওপর আযাব প্রেরণ করবো। সুতরাং হযরত ইউনুস (عليه السلام) কুসা বাজারে ঘুরেফিরে একথা বলতে লাগলেন যে, তোমাদের রাজাকে বলো, সে যদি আমার কথা না মানে, তাহলে আল্লাহ'র আযাব নেমে আসবে।
ওই সব লোকেরা বললো- আযাবের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দাও। হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, আমি তোমাদের নিকট কথা দিচ্ছি চলিশ দিন। যদি এ সময়ের মধ্যে তোমরা আমার কথা মেনে নাও, তাহলে ঠিক আছে। অন্যথায় তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে এ খবর রাজার নিকট পৌঁছে গেলো। বাদশাহ ও মন্ত্রী পরিষদ এ কথায় ঠাট্টা করতে লাগলো। তারা বলতে লাগলো, সে একজন ফকীর ও পাগল। তার বোধশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। হযরত ইউনুস (عليه السلام) আল্লাহর দরবারে নিবেদন করলেন যে, হে আল্লাহ্! আমি ওই সব লোকদের সাথে চলিশ দিনের অঙ্গীকার করেছি। আমার এই অঙ্গীকারকে বাস্তবে পরিণত করুন। নচেৎ আমি অপমানিত হবো এবং নিহত হয়ে যাবে। কারণ ওই সময় এসব লোকদের স্বভাব ছিলো যে ব্যক্তি এরূপ মিথ্যা অঙ্গীকার করতো, তারা তাকে হত্যা করতো। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, তুমি কী কারণে চলিশ দিনের অঙ্গীকার করেছো। ধৈর্যধারণ করা উচিৎ ছিলো। পরিশেষে তাদের কপালে ঈমান জুটবে। এসব লোক দ্বীনের পথ অবলম্বন করবে।
হযরত ইউনুস (عليه السلام) এই জবাব শুনে খুবই মর্মাহত হলেন এবং তাঁর অঙ্গীকারকৃত সময় হতে একটি মাস কেটে গেলো। তখন মূর্তিপূজক সম্প্রদায় হতে দশ-বারোটি গোত্র কী হয়- তা দেখার জন্য পৃথক হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। তিনি সর্বদা এই দু‘আ করতে লাগলেন, হে আল্লাহ্! আমার অঙ্গীকারকে বাস্তবে পরিণত করুন। নচেৎ আমি অপমানিত হবো।
যখন ৩৫ দিন হয়ে গেলো তখন সকাল বেলায় আযাবের আলামত দেখা দিলো। ঘন কালো মেঘ ও তীব্র অগ্নির আকারে লু-হাওয়া শুরু হলো। এবং এর প্রভাব রাজপ্রাসাদের অদূরে পৌঁছালো। তখন মন্ত্রীবর্গ সহকারে বাদশাহ অস্তির হয়ে বেরিয়ে পড়লো। আর বলতে লাগলো এই ছেঁড়াবস্ত্র পরিহিত ফকীরকে অতি দ্রুত খুঁজে আমার নিকট নিয়ে এসো। আমরা তাঁর হাতে তাওবা করবো এবং কয়েদীগণকে তাঁর হাতে সোপর্দ করবো। অনেকে তাঁকে খুঁজলো, কিন্তু কেউ কোথাও তাঁকে খুঁজে পায়নি। বাদশাহ সহ উপায়হীন নর-নারীর সংখ্যা লাখে দাঁড়ালো। নগ্ন মাথা ও খালি পায়ে কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে জঙ্গলে চলে গেলো এবং তাওবার নিয়তে সিজদায় পড়ে আহাজারী করতে লাগলো এবং বলতে লাগলো আমরা ইউনুস (عليه السلام) এর আনীত বিধানের ওপর ঈমান এনেছি। মোদ্দাকথা মহররম মাসের ১০ তারিখ বৃহস্পতিবার তথা চলিশতম দিনে আছরের সময় আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় অনুগ্রহ ও করুণায় তাদের ওপর থেকে ওই আযাব দূর করে দিলেন এবং আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গেলো। বাদশাহ সহ সকল লোক শহরে প্রবেশ করলো এবং হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে খুঁজে নিয়ে আসার জন্য নানা প্রান্তে গোয়েন্দা মোতায়েন করা হল। ওপরন্তু বাদশাহ বললো, যদি কোন ব্যক্তি হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর খবর ও খেঁাজ পায়, তাহলে আমি তাকে একদিন সিংহাসনে বসাব। এ সময়ে তার যে সব ধন-সম্পদের প্রয়োজন হবে তা সে নিতে পারবে। সুতরাং এই লোভে অধিকাংশ লোক বেরিয়ে পড়লো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) চলিশতম দিনের পর ‘নিতওয়া’ অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তখন গ্রামবাসীর নিকট শুনলেন যে, আযাব স্থগিত হয়ে গেছে এবং তারা তোমাকে খুঁজছে।
তিনি মনে করলেন যে, আমি জাতির নিকট মিথ্যুক হয়ে গেলাম। এখন যদি তাদের নিকট যাই, তাহলে তারা আমাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করবে। আর যদি হযরত শিইয়া এর নিকট যাই, তাহলে বনী ইসরাইল এর নিকট বড়ই লজ্জিত হবো। এই ধারণায় হতাশ হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে তিনি উভয় কূল ছেড়ে দিলেন এবং ‘রোম’ অভিমুখে রওয়ানা হলেন। যেহেতু হযরত ইউনুস (عليه السلام) এই দু‘আতে অতি দ্রুত ফলাফল প্রার্থনা করেছেন, তাই ভর্ৎসনা শুরু হলো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) এ বিষয়টি উপলব্ধি করে স্বজাতির নিকট হতে বেরিয়ে পড়লেন যে, বাইরের লোকেরা আযাবে পতিত হবেনা। তবে আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর সাথে শুরু অন্যরূপ ব্যবস্থা। প্রথমে তো সকল বন্ধু-বান্ধব ও চাকর-বাকর চলে গেলো। একজন নারী ও দু’জন বালক ছাড়া কেউ তাঁর সঙ্গী হলো না। তখন তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন একজন পুত্রকে এবং অপর পুত্রকে কাঁধে নিলেন তাঁর স্ত্রী এবং অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে লাগলেন। পথিমধ্যে একটি বৃক্ষের ছায়ায় বিশ্রাম নিলেন এবং প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে জঙ্গলে গেলেন। এই সময় রাজপুত্রের সাওয়ারী ‘মুবরাসাম’ ওই বৃক্ষের নিকট পৌঁছে গেলো। সে দেখলো দু’জন বালকসহ একজন অতি সুন্দরী ও রূপসী যুবতীর মত একজন নারী বসে আছে। তাই সে নিজের ভৃত্যদেরকে আদেশ দিলো যে, এই নারীকে আমার নিকট নিয়ে এসো। এই নারীটি যার পর নাই অক্ষমতা প্রকাশ করতঃ বললো যে, আমি একজন পূণ্যবান লোকের বিবাহিত স্ত্রী এবং তিনি নবী। তবে মদোম্মত্ত ও যৌবনোম্মত্ত রাজপুত্র তার কথা শুনেনি এবং তাকে সাথে নিয়ে গেলো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করতঃ আসার পর স্ত্রীকে পেলেন না। পুত্রদ্বয়কে পেলেন। তারা সংঘটিত ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) মনে করলেন, ভর্ৎসনার কর্মকান্ড শুরু হলো। পুত্রদ্বয়কে সাথে নিয়ে পথ চলতে লাগলেন এবং পথিমধ্যে একটি নদী পড়লো। তখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) একজন পুত্রকে নদীর তীরে রাখলেন এবং অন্য পুত্রকে কাঁধে নিয়ে নদী পার হতে লাগলেন। যখন নদীর মধ্যখানে পৌঁছালেন তখন মুখ ফিরিয়ে নদীর তীরে অপেক্ষমান পুত্রের দিকে তাকালেন এবং এমতাবস্থায় দেখলেন যে, তার দিকে একটি বাঘ ছুটে আসছে। তখন তিনি ভয়ে আবার ফিরে যেতে লাগলেন এবং এমতাবস্থায় তাঁর কাঁধে থাকা পুত্রটি পানিতে পড়ে গেলো এবং কূলে থাকা পুত্রটিকে নিয়ে গেলো বাঘে। হযরত ইউনুস (عليه السلام) একাকী হয়ে রোম সাগরের তীরে পৌঁছালেন এবং সেখানে ছিলো একটি চলমান জাহাজ। হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, আমি একজন দরবেশ লোক। যদি বিনা ভাড়ায় আমাকে বসাও, তাহলে আমিও জাহাজ যোগে যাবো। ব্যবসায়ীরা বললো, আপনি আমাদের অক্ষিযুগলে বসুন। আপনার বরকতে আমাদের বিপদ দূর হয়ে যাবে।
মোদ্দাকথা তিনি জাহাজে উঠলেন এবং জাহাজটি চললো। মধ্য সাগরে হঠাৎ শুরু হলো প্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং জাহাজের চলা থেমে গেলো। কেউ কেউ জাহাজটি চালানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু কারো চেষ্টা ফলোদয় হলোনা। তখন সকলে শলা-পরামর্শ করতে লাগলো। তারা এর কোন কারণ আবিষ্কার করতে পারেনি। জাহাজটির চালক বললো, আমার এই মর্মে অভিজ্ঞতা আছে যে, যখন কোন দাস স্বীয় মনিবের নিকট হতে পালিয়ে এসে জাহাজে উঠে পড়ে তখন এ ধরনের ব্যাপার সংঘটিত হয়। সুতরাং তোমরা জাহাজে এই মর্মে ঘোষণা দাও যে, যে ব্যক্তি স্বীয় মনিবের নিকট হতে পালিয়ে এসেছে সে যেন পরিষ্কার ও স্পষ্টভাবে বলে দেয়। যখন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিলো তখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, আমিই ওই পালানো গোলাম। আমাকে সাগরে নিক্ষেপ করে দাও যাতে জাহাজের আরোহীগণ মুক্তি পায়। লোকেরা বললো, আপনাকে তো কখনো এরূপ অসৎ বলে মনে করা যায় না। অবশেষে লটারী দেওয়া হলো, তখন এতে হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর নাম উঠলো। দ্বিতীয়বার আবার লটারী দেওয়া হলো, তখনো হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর নাম উঠলো। অবশেষে নিরুপায় ও আল্লাহর সিদ্ধান্তে রাজি হয়ে হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে সাগরে নিক্ষেপ করা হলো এবং জাহাজটি রওয়ানা দিলো। ঘটনাক্রমে সাগরে আহারের জন্য অপেক্ষমান একটি মাছ নিক্ষিপ্ত হওয়া মাত্রই হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে গিলে ফেললো। এই সময় আল্লাহর আদেশ পৌঁছালো যে, সাবধান! এই (হযরত ইউনুস) তোমার আহার নয়। বরং তোমার উদরে আমি তাকে বন্দী করছি। তার শরীর যেন আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। মোদ্দাকথা মাছটি হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে নিয়ে রোম সাগর হতে ‘লাতায়েখ’ নামক স্থানে পৌঁছালো এবং সেখান থেকে গেলো দাজলা নদীতে। মাছের উদরে তিনি সর্বদা আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকতেন। এভাবে চলিশ দিন কেটে গেলো। তখন মাছটির ওপর আদেশ দেওয়া হলো যে, এই কয়েদীকে শামী উপকূলে উগরে দাও। মাছটি তৎক্ষণাৎ উগরে দিলো। তাঁর শরীর এরূপ নরম হয়ে গেলো যে, শরীরে মশা-মাছি বসলে তিনি কষ্ট পেতেন এবং এতই দূর্বল হয়ে গিয়েছিলেন যে, হাতে মশা-মাছি তাড়ানোর শক্তি ছিলোনা। ওই সময় আল্লাহ তা‘আলা কদু (লাউ) গাছ সৃষ্টি করলেন। কদু গাছ স্বীয় পাতার মাধ্যমে তাঁর ওপর ছায়া হয়ে রইলো এবং এতে তিনি মশা-মাছি হতে রক্ষা পেলেন যেমন- সূরা সাফ্ফাত এর মধ্যে বর্ণিত রয়েছে।
তাফসীরে মুয়ালিমুত তানযিল গ্রন্থে রয়েছে যে, যখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) মাছের পেট হতে বের হলেন তখন তাঁকে দুধ পান করানোর জন্য একটি হরিণীর ওপর আল্লাহর নির্দেশ আসলো যাতে তিনি শক্তিশালী হন। চলিশ দিন পর হরিণীর আসা বন্ধ হয়ে গেলো। যখন দুধ পানের সময় আসলো এবং হরিণী আসলো না তখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্! আজ আমি ক্ষুধার্ত ও বুভূক্ষ। আল্লাহর পক্ষ হতে বলা হলো যে, তুমি এতটুকু স্বভাব পরিবর্তনকে পছন্দ করছো না আর আমাকে আবেদন করেছিলে যে, আমি যেন নিজের অনুপম স্বভাব পরিত্যাগ করে নিজের এক লাখ বান্দাকে মেরে ফেলি। একথা শুনে হযরত ইউনুস (عليه السلام) তাওবা করলেন এবং আল্লাহর দরবারে আরয করলেন, হে আল্লাহ্! আমি গুনাহগার আমি লজ্জিত এখন আপনার যে আদেশ আসে তা পালন করবো। আদেশ হলো স্বজাতির নিকট গিয়ে বসবাস করো। যখন স্বজাতির অভিমুখে রওয়ানা হলেন তখন পথিমধ্যে নানা পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন যা দ্বারা হযরত ইউনুস (عليه السلام) নিজের ভুল-ত্রুটির ব্যাপারে অবহিত হলেন। যখন তিনি যারপর নাই লজ্জিত হলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা তার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পূর্ণভাবে ক্ষমা করে দিলেন এবং তাঁকে দান করলেন নবুয়তের মহান পদমর্যাদা। আর হযরত শাইয়া (عليه السلام) কর্তৃক তাঁকে প্রদত্ত রিসালতের এলাকা (অধিক্ষেত্র) উঠিয়ে নেওয়া হল এবং তাঁকে স্বতন্ত্র রাসূল করা হল এবং প্রত্যেক দিক হতে করুণা-অনুগ্রহের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হল। যখন তিনি ওই নদীর তীরে পৌঁছলেন যেখানে তিনি দুই পুত্রকে হারিয়ে ফেলেছিলেন তখন দেখলেন যে, গ্রামের লোকেরা দু’জন বালককে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হযরত ইউনুস (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, এই দুই বালক কার? তারা বললো, তারা একজন বুযূর্গ ব্যক্তির পুত্র। একজনকে আমরা বাঘের মুখ থেকে কেড়ে নিয়েছি এবং অন্যজনকে নদীতে ভাসমান অবস্থায় ধোপারা উদ্ধার করে আমাদেরকে দিয়েছে। তাই আমরা তাদেরকে লালন-পালন করি এবং এ অপেক্ষায় আছি যে, ওই বুযূর্গ লোকটি পেলে তাকে সোপর্দ করবো। এতক্ষণে বালকদ্বয় হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে চিনে নিলো। তারা বললো, তিনিই আমাদের পিতা। তখন ওই লোকেরা পুত্রদ্বয়কে তাঁর নিকট সোপর্দ করলো। যখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) পুত্রদ্বয়কে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হলেন এবং ওই বৃক্ষের নিকট গেলেন যেখান থেকে রাজপুত্র তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলো তখন সেখানে অপেক্ষমান কিছু লোক দেখতে পেলেন। হযরত ইউনুস (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা বসে আছো কেন? তারা বললো, আমাদের রাজপুত্র একদিন শিকারের জন্য বের হয়েছিলো এবং তখন জনৈক দরবেশের স্ত্রীকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো। ওই দিন হতে সে পেট ব্যথায় আক্রান্ত। আমাদের রাজা আমাদেরকে এই জন্য নিয়োজিত করেছেন যে, আমরা যেন তাকে দেখা মাত্রই রাজ দরবারে নিয়ে যাই। সেখানে বাদশাহ অপরাধের ক্ষমা চেয়ে নেবেন এবং তার স্ত্রীকে সোপর্দ করবেন। আর ওই নারীটিকে এখনো কেউ স্পর্শ করেনি। এই কথা ও অবস্থা শুনে হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, ওই ফকীর-গরীব লোকটি আমি। তখন বাদশাহর সিপাহীগণ যথাযথ ও পূর্ণ মর্যাদা সহকারে তাঁকে বাদশার নিকট পৌঁছালো। তিনি বাদশার নিকট পৌঁছা মাত্রই রাজপুত্র সুস্থ হয়ে গেলো এবং বাদশাহ তাঁকে তাঁর স্ত্রী সোপর্দ করলো এবং বহু অর্থরাজি ও জিনিসপত্র উৎসর্গ করলো। তিনি যখন ‘মুসিল ও তিনওয়া’ সীমান্তে পৌঁছালেন তখন মানুষকে সংবাদ দেওয়ার জন্য একজন লোক পাঠালেন। যখন এই সংবাদ বাদশার নিকট পৌঁছালো তখন সে মন্ত্রীবর্গ সহকারে উপস্থিত হলো এবং পূর্ণ মর্যাদা সহকারে তাঁকে শহরে নিয়ে গেলো। বাদশাহ অনেক দিন পর্যন্ত তাকে অনুসন্ধান করেছিলো। বাদশাহ যখন মৃত্যুবরণ করলো তখন একজন লোককে খলিফা বানালেন এবং ৭০ (সত্তর) জন অতি আবেদ লোকসহ নিজে ‘সায়হুন’ পাহাড়ে তাশরীফ নিলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত ইবাদতে নিমগ্ন হলেন। ওই স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬০ (ষাট) বছর। সূরা নূন ও সাফ্ফাত এর মধ্যে তাঁর ব্যাপারে আলোচনা রয়েছে।
❏ প্রশ্ন-১৭৯: যখন কোন জাতির ওপর আযাব চলে আসে তখন আযাব চলে আসার পর ঈমান আনা ফলদায়ক নয়। তবে হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর জাতির ওপর মেঘরাজি আসার পরেও যখন তারা ঈমান আনলো তখন তাদের ওপর আযাব উঠিয়ে নেওয়া হলো, এর পেছনে রহস্য কী?
✍ উত্তর: তাবারানী শরীফের একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনওয়া শহরে যখন আযাবের আলামতসমূহ দৃশ্যমান হতে লাগলো এবং হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে খেঁাজার পরও পাওয়া যাচ্ছিলোনা তখন শহরবাসী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নিজেদের জনৈক আলেমের নিকট গেলো যিনি ছিলেন ঈমানদার ও সমকালীন শায়খ এবং তাঁর নিকট তারা আর্তি জানালো। তখন তিনি আদেশ দিলেন, তোমরা এই দু‘আটি পড়ে প্রার্থনা করো,
يا حىّ حين لا حىّ يا حىّ يحى الموتى يا حىّ لا الٰه الّا انت
সুতরাং লোকেরা এই দু‘আটি পড়ে প্রার্থনা করলো এবং আযাব দূর হয়ে গেলো। তবে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও কারামতের অধিকারী ওলী হযরত ফুযাইল বিন আয়ায (رحمه الله تعالي ) বলেন, যে দু‘আটির বরকতে তিনওয়া শহরের আযাব দূর হয়ে গিয়েছিলো সে দু‘আটি ছিলো এটি যে,
اَللهم ان ذنوبنا قد عظُمتْ وجلَّت وانت اعظُم واجلُّ فا فعل بنا ما انت اهلهُ ولا تفعل بنا ما نحنُ اهلهُ .
মোদ্দাকথা আযাব দূর হয়ে যাবার পর হযরত ইউনুস (عليه السلام) যখন শহরের সন্নিকটে আসলেন তখন তিনি শহরে আযাবের কোন চিহ্ন বা নিদর্শন দেখেননি। লোকেরা বললো, আপনি স্বজাতির নিকট চলে যান। তিনি বললেন, আমি কিভাবে স্বজাতির নিকট যাবো? আমি তো তাদেরকে আযাবের সংবাদ দিয়ে শহর হতে বের হয়ে পড়েছি, তবে আযাব আসেনি। তাই এখন এসব লোকেরা আমাকে মিথ্যুক মনে করে হত্যা করে ফেলবে। তিনি নিকষ কালো অন্ধকার মাছের পেটে বন্দী হলেন। তবে ওই পরিস্থিতিতে তিনি এই আয়াতে কারিমার لَا إله الّا اَنْتَ سُبْحَانَكَ اِنِّى كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ . ওজিফা শুরু করে দিলেন। তাই এর বরকতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এই অন্ধকার হতে মুক্তি দিলেন।
❏ প্রশ্ন-১৮০: হযরত নূহ (عليه السلام) কখন হতে রিসালতের পদে অধিষ্ঠিত হন এবং হযরত আদম (عليه السلام)-এর কত বছর পর জন্মগ্রহণ করেন?
✍ উত্তর: হযরত নূহ (عليه السلام), হযরত আদম (عليه السلام)’র ওফাতের ১১২৬ (এক হাজার একশত ছাব্বিশ) বছর পর জন্মগ্রহণ করেন এবং যৌবনে পদার্পণ করা মাত্রই রিসালতের পদে অধিষ্ঠিত হন। অনেক বছর দ্বীন প্রচারের পর মাত্র কয়েক জন লোক তার ওপর ঈমান আনে।
সাড়ে নয়শত বছর পর আল্লাহর দরবার হতে অভিযোগের স্বরে বলা হল, এসব লোক ঈমান আনবে না। এখন তাদের ওপর পাবনের আযাব আসবে। তুমি নিজের জন্য নৌকা বানাও। হযরত জিবরাইল (عليه السلام) ‘ছাল কাঠ বা গাছ নিয়ে আসলেন এবং এগুলো জমিনে লাগানোর জন্য ইঙ্গিত করলেন। বিশ বা চলিশ দিনে এগুলো বড় বৃক্ষে পরিণত হলো। তখন হযরত নূহ (عليه السلام), হযরত জিবরাইল (عليه السلام) এর শিক্ষা মতে নিজের তিন পুত্র এবং অন্য একজন ব্যক্তির সাহায্যে একটি নৌকা বানালেন এবং ভিতরে-বাইরে তৈলবাতি লাগালেন। নৌকাটির দৈর্ঘ্য ছিল এক হাজার গজের চেয়ে বেশি, প্রস্ত ছয়শো গজ এবং উচ্চতা ছিল ত্রিশ গজ। শামসাদ বৃক্ষের কাঠ দিয়ে একটি তাবুত বানিয়ে হযরত আদম (عليه السلام)’র শরীর মুবারকও তাতে রাখলেন এবং প্রজন্ম সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেক প্রাণী ও চতুষ্পদ জন্তুর একেকটি জোড়া নৌকায় উঠানো হল। অবশেষে পাবনের সময় ঘনিয়ে আসলো। একটি অনিঃশেষ উৎস হতে পানি উৎসারিত হতে লাগলো। পুকুর-কূপ ও নদীর পানিও প্রবল তরঙ্গায়িত হতে লাগলো। আকাশ হতে ঝড়-বৃষ্টি বইতে লাগলো এবং চলিশ দিন পর্যন্ত এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলো। জল-স্থল একাকার হয়ে গেলো এবং পর্বত চূড়া সমূহেও পানি উঠে গেলো। ওই জাতির বাদশাহ সাফরুশনাম মৃত্যু ভয়ে পালাতে লাগলো। অবশেষে সে ধ্বংস হয়ে গেলো।
হযরত নূহ (عليه السلام) এর দ্বীনের সাথে বিরোধিতাকারী তার স্ত্রী ওয়া’লা ও পুত্র কেনান নৌকায় আরোহন করতে অস্বীকৃতি জানালো। পরে একটি তরঙ্গ তাদের জীবন সাঙ্গ করে দিলো। নৌকাটি কুফা হতে যাত্রা শুরু করলো এবং হেরেমে মক্কাকে সাতবার প্রদক্ষিণ করলো। নানা দেশ ও ভূখন্ড পাড়ি দিয়ে ঘুরতে লাগলো। অবশেষে পাঁচ মাস পর জুদি পর্বতের চূড়ায় গিয়ে তিনি (عليه السلام) যাত্রা বিরতি করলেন এবং ওই স্থানে এক মাস অবস্থান করেন। বলা হয় যেহেতু প্রলয়ংকারী প্লাবনে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দেখা মিলতো না, তাই হযরত নূহ (عليه السلام) স্বীয় নৌকায় সুকৌশলে এমন দু’টি আলোকিত মোহর স্থাপন করেন যা দ্বারা রাত-দিনের ঘন্টার হিসাব জানা যেত এবং এর হিসাবে নামায-রোযা পালন করতেন।
আরো কিছু চমৎকার ও বিরল বর্ণনা লোকমুখে প্রসিদ্ধ আছে যেমন- নৌকার ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য হযরত নূহ (عليه السلام) আল্লাহর হুকুমে হাতীর পিঠে হাত রাখলেন, তখন এর দ্বারা শুকরের জন্ম হলো যেটি নৌকার ময়লা-আবর্জনা পানাহার করে পরিষ্কার করে দিতো। এরপর নৌকাবাসী লোকেরা ইঁদুরের জ্বালায় অতীষ্ট হয়ে উঠলো। তখন হযরত নূহ (عليه السلام) আল্লাহ'র হুকুমে বাঘের কপালে হাত ফেরালেন এবং বাঘটি হঁাচকি দিলো, তখন তার নাক হতে বের হলো বিড়াল এবং সে ইঁদুর খতম করতে লাগলো ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরূপ একটি রেওয়ায়তে একথা প্রসিদ্ধ রয়েছে যে, যখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেলো তখন তিনি পাবনের সংবাদ সংগ্রহের জন্য কাক-কে পাঠালেন, তবে সে মৃত জীব ও প্রাণী দেখে তাতে নিমগ্ন হয়ে গেলো। এরপর পাঠানো হল কবুতরকে, তখন সে যয়তুন বৃক্ষের কিছু পাতা ছিড়ে আনলো যার দ্বারা বুঝা গেলো যে, পানি গাছের উপরে উঠেছিলো। এর কিছুক্ষণ পর সে ঠেঁাটে কিছু মাটি নিয়ে আসলো যেটি হলো একথার আলামত যে, এখন জমি দৃশ্যমান হয়েছে। অবশেষে সকল নৌকাবাসী লোক আশুরার দিন নৌকা হতে নামলো এবং জুদি পাহাড়ের সন্নিকটে বসতি স্থাপন করলো। যেহেতু তাদের সংখ্যা ছিলো ৮০ (আশি) জন, তাই এই বসতির নামকরণ করা হলো ‘সাওক-আল সামানিন’ অর্থাৎ আশিজন বসতি স্থাপনকারীর বাজার। এরপর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলো মহামারীর। কেবল হযরত নূহ (عليه السلام), তাঁর তিন পুত্র ও পরিবারবর্গ তথা তার বিবিগণ ছাড়া অবশিষ্ট সকল লোক মরে গেলো। তাঁর পুত্রদের নাম হচ্ছে:
(১) সাম,
(২) হাম, ও
(৩) ইয়াফেস।
হযরত নূহ (عليه السلام) গোটা বিশ্বের সকল বসতিকে তিন পুত্রের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। মুলকে শাম, ইরান, খুরাসান ও ইরাক পড়লো সামের ভাগে। আফ্রিকান দেশ সমূহ, হাবশা, সিন্ধা, হিন্দা ও সুদান পড়লো হামের ভাগে এবং চীন ও তুর্কিস্তান পড়লো ইয়াফেস এর ভাগে।
❏ প্রশ্ন-১৮১: হযরত আদম (عليه السلام)’র পদার্পনের কত দিন পর এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়?
✍ উত্তর: প্লাবন বা তুফানের ঘটনাটি সংঘটিত হয় হযরত আদম (عليه السلام)’র পদার্পনের ২২৮২ (দুই হাজার দুই শত বিরাশি) বছর পর। এরপর হযরত নূহ (عليه السلام) তিন শত পঞ্চাশ বছর জীবিত ছিলেন। তাঁর পার্থিব বিদায়ের সময় হযরত জিবরাইল ও আযরাইল (عليه السلام) তাঁর নিকট জীবনকাল সম্পর্কে এই মর্মে জিজ্ঞাসা করেন যে, দুনিয়া কেমন? উত্তরে তিনি বলেন, জীবনকে আমি এমন একটি ঘর হিসেবে পেয়েছি যার দু’টি দরজা রয়েছে। তার একটি দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম, অল্পক্ষণ অবস্থান করলাম, এরপর দ্বিতীয় দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলাম। হযরত নূহ (عليه السلام) বয়স পেয়েছিলেন ১৪৬৬ (এক হাজার ছয়শত ছিষট্টি) বছর। কেউ কেউ অন্যান্য সংখ্যাও উল্লেখ করেন। হযরত নূহ (عليه السلام) এর উপাধি হচ্ছে ‘শায়খুল আন্বিয়া’ ও ‘নাজিউল্লাহ’। তাঁকে দ্বিতীয় আদমও বলা হয়। তাঁর ওপর দশটি সহীফা অবতীর্ণ হয়। তাঁর কবর শরীফ বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত।
❏ প্রশ্ন-১৮২: يَا هُوَ শব্দের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কি এবং هو সর্বনামের প্রত্যাবর্তন কোন দিকে? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: يَا هُوَ এর শাব্দিক অর্থ, হে আল্লাহ্! এটা আল্লাহ্ তা‘আলার জাতি বা সত্তাগত নাম। সুফিয়া-ই কিরাম অধিকাংশ সময় এটির অযিফা পাঠ করে থাকেন। আর هو সর্বনামের মারজা বা প্রত্যাবর্তনস্থল হচ্ছে, আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু।
❏ প্রশ্ন-১৮৩: ফাসিক কারা এবং এদের নাম কি?
✍ উত্তর: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন- সর্প, ইঁদুর ও কাক হলো ফাসিক।
ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণিত আছে, কাক কি খাওয়া যাবে? হযরত ইবনে ওমর (رضى الله تعالي عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফাসিক বলার পর এটি কে খাবে?
228. হায়াতুল হাইওয়ান, মাখযনে মা‘লুমাত, পৃষ্ঠা-৫৪৩।
❏ প্রশ্ন-১৮৪: ক্বিবলা কাকে বলে এবং ক্বিবলাকে ক্বিবলা কেন বলা হয়? তাহ্ক্বিকসহ বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: قِبْلَةٌ শব্দটি فِعْلَةٌ ওযনে, সামনের দিককে বলা হয়। অথবা এমন অবস্থাকে বুঝায় যা কোন বস্তুর সম্মুখ দিক থেকে সৃষ্টি হয়। অথবা শব্দটি مقابلة বা استقبال থেকে নির্গত। নামাযীর সম্মুখে থাকার কারণে এটাকে ক্বিবলা বলা হয়।
❏ প্রশ্ন-১৮৫: غيرذوى العقول বা জ্ঞানহীনদের ক্ষেত্রে ذوى العقول বা জ্ঞানবানদের জন্য ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহার করা শুদ্ধ কি-না? যেমন- সূরা আ‘রাফের ১৯১নং আয়াতে وهم يخلقون এবং ১৯৩নং আয়াতে وان تدعوهم اِلى الهدىٰ এর মধ্যে هُمْ সর্বনামটির প্রত্যাবর্তনস্থল কি? যদি মূর্তি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে ذوى العقول (জ্ঞানবান) এর সর্বনাম غير ذوى العقول (জ্ঞানহীন) এর জন্য ব্যবহার কিভাবে শুদ্ধ হলো?
✍ উত্তর: প্রশ্নোলিখিত উভয় আয়াতের هم সর্বনামটি মূর্তিসমূহের দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়েছে। যা পূর্বের আয়াতে ما শব্দের মর্মে নিহিত রয়েছে। هم সর্বনামটি যদিও ذوى العقول তথা জ্ঞানবানদের জন্য ব্যবহৃত হয়, কিন্তু মুশরিকরা যেহেতু মূর্তিগুলোকে তাদের ইলাহ বানিয়েছিল এবং সেগুলোকে জ্ঞানী মনে করতো। তাই কোরআনে কারীম(ﷺ) ের বর্ণনা পদ্ধতিও তাদের আক্বিদা-বিশ্বাস অনুপাতে তিরস্কার ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়। আল্লামা সৈয়দ মাহমুদ আলূসী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন,
وايراد ضمير العقلاء مع ان الاصنام بما لا يعقل انما هو بحسب اعتقادهم فيها واجرائهم لها مجرى العقلاء .
‘মূর্তি প্রতিমা ذوى العقول না হওয়া সত্ত্বেও ذوى العقول এর সর্বনাম ব্যবহার করা এ জন্যই যে, মূর্তিপূজারীরা তাদের দেব তাদের মূর্তিকে তাদের আক্বিদা মতে ذوى العقول এর স্থলাভিষিক্ত করেছে।’
229. রুহুল মা‘আনী, খন্ড-৯, পৃষ্ঠা-১৪৩; তাফসীরে মাযহারী, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪৪৪।
❏ প্রশ্ন-১৮৬: সূরা আ‘রাফে আল্লাহ্ তা‘আলার বাণী,
مَا لَا يَخْلُقُ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ। এখানে ما শব্দ দ্বারা কারা উদ্দেশ্য? ما শব্দটি ذوى العقول (জ্ঞানবান)-এর জন্য ব্যবহার করা হয়, না غير ذوى العقول (জ্ঞানহীন)-এর জন্য ব্যাখ্যা কর?
✍ উত্তর: উক্ত আয়াতে ما শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য ইবলিস ও প্রতিমা। আর ما শব্দটি অধিকাংশ غير ذوى العقول তথা জ্ঞানহীন ও প্রাণহীনদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
لما قال البغوى آيشركون ما‘ اى ابليس والاصنام . قال القاضى ثناء الله بانى بتى هم‘ ضمير الاصنام . تفسير مظهرى، قال البيضاوى ما‘ اى الاصنام .
‘আল্লামা বাগবী (رحمه الله تعالي ) বলেন, এখানে ما يشركون এর ما দ্বারা ইবলিশ ও মূর্তিদেরকে বুঝানো হয়েছে। আল্লামা ছানাউল্লাহ পানিপথি (رحمه الله تعالي ) বলেন, এখানে هم সর্বনাম দ্বারা দেব-দেবীদের বুঝানো হয়েছে। তাফসীরে মাযহারী। আল্লামা বায়যাবী বলেন, ما দ্বারা মূর্তি বুঝানো হয়েছে।’
230. তাফসীরে বায়যাবী, খন্ড- ৩য়, পৃষ্ঠা-৩৮,200. সূরা আ‘রাফ।
❏ প্রশ্ন-১৮৭: সূরা আ‘রাফে مِنْ دُونِ اللهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ আয়াতে عباد শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য কী? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: عباد শব্দটি عبد -এর বহুবচন। অর্থ- মালিকানাধীন। উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তা‘আলা শিরককে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে মক্কার মুশরিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা যাদের ইবাদত করছ এবং তোমরা যাদেরকে নিজেদের উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছ- এদের ও তোমাদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। তোমাদের মালিক যেমন আল্লাহ তা‘আলা, তেমনি তাদের মালিকও আল্লাহ্ তা‘আলা। মা‘বুদ বা উপাস্য এমন হওয়া উচিত যে, তিনি উপাসনাকারীদের চেয়ে সম্মান ও মর্যাদায় অনেক উত্তম ও উন্নত হবেন।
231. তাফসীরে মাযহারী, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪৪৪
❏ প্রশ্ন-১৮৮: হযরত ইউসুফ (عليه السلام) ও যুলাইখা বিবির বিবাহের পদ্ধতি ও বাস্তব অবস্থা কিরূপ ছিল? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: মুফাস্সিরীনে কিরাম বিশেষতঃ তাফসীরে রূহুল মা‘আনি, তাফসীরে কুরতুবি এবং মু‘আলিমুত্ তানযীলসহ অপরাপর মুফাস্সিরীনে কিরামগণ বলেন, হযরত ইউসুফ (عليه السلام) ও বিবি যুলাইখার মাঝে বিবাহ হয়েছিল কিনা এ বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে যে, হযরত ইউসুফ (عليه السلام) যখন মিসরের বাদশাহর নিকট গেলেন। আজিজে মিসরের স্ত্রীর সঙ্গে প্রকাশিত ঘটনার ব্যাপারে ইউসুফ (عليه السلام) নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিশরের বাদশাহ তাঁকে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ আসনে সমাসীন করেন। অতঃপর আজিজে মিশরের ইন্তিকালের পর হযরত ইউসুফ (عليه السلام)কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন এবং তার স্ত্রী কতেক মুফাস্সিরীনের মতে যুলাইখার সঙ্গে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর বিবাহ হয়। আজিজে মিশর যেহেতু পুরুষত্বহীন ছিলেন, বিধায় যুলাইখা ওই সময় পর্যন্ত কুমারী ছিলেন। অতঃপর যুলাইখার গর্ভে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর তিন সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তাঁদের নাম আফরাইম, মাইশা এবং রহমত।
232. তাফসীরে মু‘আলিমুত্ তান্যীল, পৃষ্ঠা-৪৩২; তাফসীরে কুরতুবী।
❏ প্রশ্ন-১৮৯: শয়তান বিতাড়িত ও অভিশপ্ত হওয়ার পূর্বে ফিরিশতাদের সঙ্গে কোন্ কোন্ বিষয়ে আদিষ্ট ছিল?
✍ উত্তর: মুফাস্সিরীনে কিরাম শয়তান সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকারের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, ইবলিশ ফিরিশতাদের একটি গোত্রের ছিল, যাদেরকে ‘জ্বীন’ বলা হত। তাদেরকে গরম আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, যখন ফিরিশতাদেরকে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। সুরইয়ানী ভাষায় শয়তানের নাম ছিল আযাযিল এবং আরবীতে হারিস। সে ছিল জান্নাতের কোষাধ্যক্ষ এবং দুনিয়ার আকাশের প্রধান। আকাশ ও দুনিয়ার জগতে তার রাজত্ব ছিল। ফিরিশতাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মুজতাহিদ ও জ্ঞানী ছিল। যে কারণে তার মধ্যে গৌরব ও অহংকার সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর হুকুমের কুফরী করার কারণে বিতাড়িত হয়।
তাফসীরে ফাতহুল ক্বাদীর এবং তাফসীরে ইবনে কাসীরে উল্লেখ আছে,
كان من اشد الملائكة اجتهادًا او اكثرهم علمًا . كان من اشرف الملائكة واكرمهم قبيلة وكان خازنا كان له سلطان السماء الدنيا وكان له سلطان الاض الخ .
‘ইবলিশ ফিরিশতাদের চেয়ে বড় গবেষক ও বিজ্ঞানী ছিল, ফিরিশতাকুলের চেয়ে অধিক মর্যাদাবান ও সম্মানী ছিলো, বংশগতভাবেও সে পরম শ্রদ্ধাভাজন ছিল এবং সে ভান্ডার রক্ষক ছিল। তার হাতে দুনিয়া তথা প্রথম আসমানের বাদশাহী ন্যস্ত ছিল এবং তার হাতে পৃথিবীর রাজত্ব ছিল।’
233. তাফসীরে ইবনে কাসীর, খন্ড- ৩ পৃষ্ঠা-৭৭।
❏ প্রশ্ন-১৯০: ইচ্ছাকৃত হত্যাকারী কি সর্বদা জাহান্নামে থাকবে? অথচ হাদীস শরীফে এসেছে, شفاعتى لاهل الكبائر(আমার উম্মতের কবীরা গোনাহকারীদের জন্য আমার সুপারিশ)। এতে বুঝা যায়, হত্যাকারীরা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে না। অতএব, এরা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে, কী থাকবে না? দলিলসহ বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: ইচ্ছাকৃত হত্যাকারীর তাওবা কবুল হবে কিনা এবং ওই ব্যক্তি চিরকাল জাহান্নামে থাকবে কিনা এ বিষয়ে ইমামগণের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতে, যদি ওই ব্যক্তি মু’মিন হয় তাহলে আল্লাহ তা‘আলার মাগফিরাত এবং হুযূর -এর শাফা‘আতের দ্বারা জাহান্নামে শাস্তিভোগ করার পর জান্নাতে যাবে। ঈমানের কারণে চির জাহান্নামী হবে না। কিন্তু এ হুকুম ওই সময় প্রযোজ্য হবে, যখন উক্ত ব্যক্তি হত্যাকে হালাল মনে করে হত্যাকান্ড সংঘটিত না করে থাকে। অন্যথায় হালাল মনে করে হত্যা করার অপরাধে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। সে কারণে জমহুর ওলামায়ে কিরাম উক্ত আয়াতে خالدًا শব্দের ব্যাখ্যা বিস্তারিতভাবে করেছেন- من يقتل متعمدًا ।
234. তাফসীরে ইবনে কাসীর, খন্ড- ১, পৃষ্ঠা:৫৩৭
❏ প্রশ্ন-১৯১: সূরা আলে-ইমরানে ইরশাদ হয়েছে,
إِنَّ مَثَلَ عِيسَى عِنْدَ اللهِ كَمَثَلِ آدَمَ উক্ত আয়াতে হযরত ঈসা (عليه السلام)কে হযরত আদম (عليه السلام)-এর অনুরূপ ও সাদৃশ হিসেবে তুলনা করা হয়েছে। অথচ হযরত আদম (عليه السلام) ছিলেন মাতা-পিতাবিহীন এবং হযরত ঈসা (عليه السلام) হলেন পিতাবিহীন। অতএব এ সাদৃশ্যতা কিভাবে শুদ্ধ হবে? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: হযরত ঈসা (عليه السلام) সাধারণ প্রচলিত নিয়ম ও পদ্ধতি বর্হিভূত পিতা ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এটা ছিল এক আশ্চর্য বিষয়। কিন্তু এর চেয়ে আরো বেশী আশ্চর্যের বিষয় ছিল হযরত আদম (عليه السلام) মা-বাবা উভয় ছাড়াই আল্লাহ তা‘আলার কুদরতী শক্তিতে সৃষ্টি হয়েছিলেন। সুতরাং এখানে এক বিস্ময়কর বিষয়কে তার চেয়েও আরো অধিক বিস্ময়কর বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। দৃষ্টান্ত ও উপমায় উপমান ও উপমেয় সকল দিক দিয়ে একরকম ও সমান হওয়া শর্ত নয়। বরং উপমানে কিছু গুণ উপমেয়-এর মধ্যে পাওয়া যাওয়াই উপমা ও দৃষ্টান্তের জন্য যথেষ্ট। যেমন- কোন মানুষের বীরত্ব ও সাহসিকতার দৃষ্টান্ত বাঘের সাথে করা হয়। অথচ উভয়ের মধ্যে প্রত্যেক দিক দিয়ে সমতা নেই।
235. তাফসীরে খাযেন,200. সূরা বাকারা, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩০১।
❏ প্রশ্ন-১৯২: হযরত আদম (عليه السلام) এর সন্তানদের মাঝে ঝগড়া-বিবাদের কারণ কি ছিল? এবং তাদের মধ্যে ভাই-বোনের পার্থক্যের নিয়ম কি ছিল? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: হযরত আদম (عليه السلام)-এর সন্তানদের মাঝে ঝগড়ার কারণ সম্পর্কে অধিকাংশ মুফাস্সিরীনে কিরামের অভিমত হচ্ছে, হযরত আদম (عليه السلام)-এর যখনই কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করত, এক ছেলে ও এক মেয়ে জোড়া হিসেবে জন্মগ্রহণ করতো। কেননা আদম (عليه السلام) ছিলেন পৃথিবীতে প্রথম মানব এবং তার বংশধারা অবশিষ্ট থাকুক, এটাই ছিল আল্লাহ তা‘আলার ঐকান্তিক ইচ্ছা। তাই আল্লাহ তা‘আলা একটি নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছেন যে, প্রত্যেক জোড়া পরস্পর বিবাহ জায়েয হবে না, বরং এক জোড়া অপর জোড়ার সঙ্গে বিবাহ জায়েয হবে। তাই প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে গর্ভের ভিন্নতা, বংশের ভিন্নতা হিসেবে গণ্য হতো। অনুরূপ হযরত আদম (عليه السلام)-এর ছেলে কাবিলের সাথে একই গর্ভে যে মেয়েটি জন্মেছিল তার নাম আকলিমা এবং সে পরমা সুন্দরী ছিল। পরবর্তী গর্ভে যে ছেলেটি জন্মেছিল তার নাম ছিল হাবিল এবং তার বোনের নাম ছিল লুবাদা। এখন শরীয়তের বিধান মোতাবেক যখন বিবাহের সময় হলো, তাই আকলিমার বিবাহ হাবিলের সঙ্গে হচ্ছে। তখন কাবিল তা অস্বীকার করে বলতে লাগলো, তার জন্ম যেহেতু আমার সঙ্গে হয়েছে বিধায় আমিই তার হকদার। আকলিমা ছিল লুবাদার চেয়ে অধিক সুন্দরী এবং সুশ্রীও। এ ব্যাপারে হযরত আদম (عليه السلام) কাবিলকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেন কিন্তু সে তা মানতে রাজি হয়নি। অতঃপর হযরত আদম (عليه السلام) হাবিল ও কাবিল উভয়কে মানত করার হুকুম দিলেন যে, যার মানত কবুল হবে, তার পক্ষে ফয়সালা দেয়া হবে। দেখা গেল- হাবিলের মানতই কবুল হলো। এতে কাবিল আরো অধিক ক্ষিপ্ত বা ক্রোধান্বিত হলো। পরিশেষে সে হাবিলকে অন্যায়ভাবে হত্যা করল।
236. তাফসীরে তাবারী, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-১৮৮,200. সূরা মায়েদা; তাফসীরে ইবনে কাসীর, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৪১।
❏ প্রশ্ন-১৯৩: আসহাবে কাহাফের কুকুর জান্নাতে যাবে কিনা? এ ব্যাপারে ওলামাই কিরামের মতামত কি?
✍ উত্তর: আসহাবে কাহাফের কুকুর সম্পর্কে কোরআনে কারীম(ﷺ) কোন হুকুম পাওয়া যায়নি। সে সম্পর্কে কোরআন নীরব এবং হাদীস শরীফেও সে বিষয়ে উল্লেখ করেনি। হ্যাঁ! মুফাস্সিরীনে কিরামদের মধ্যে কেউ কেউ এমন কিছু পশুর কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলো জান্নাতে যাবে। আসহাবে কাহাফের কুকুরও উক্ত সূচিক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে।
237. রুহুল বয়ান, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-২২৬; রুহুল মা‘আনী, খন্ড-১৫, পৃষ্ঠা-২২১; وكلبهم باسط :এর আলোচনার অধীনে; তাফসীরে জুমাল, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-১২;200. সূরা কাহাফ, باسط ذراعيه আয়াতের অধীনে।
❏ প্রশ্ন-১৯৪: বর্তমানে প্রচলিত ফাঁসির শাস্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে কিসাসের হুকুমের অন্তভুর্ক্ত হবে কি-না?
✍ উত্তর: শরীয়তে কিসাসের শাস্তি প্রদানের জন্য যে শর্তসমূহ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা নিম্নরূপ। কিসাসের মধ্যে মৌলিক শর্ত তিনটিঃ
১. হত্যাকারী থেকে কিসাস লওয়া। বাস্তবিকপক্ষে হত্যাকৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের ওপর নির্ভর, তারা ইচ্ছে করলে কিসাস নিতে পারে, না হয় দিয়্যত বা রক্তপণ গ্রহণ করতে পারে। আর ইচ্ছে করলে ক্ষমাও করে দিতে পারে।
২. কিসাস লওয়ার সময় হত্যাকৃত ব্যক্তির ওয়ারিশরা উপস্থিত থাকা আবশ্যক।
৩. হানাফিদের মতে একটি শর্ত এটাও যে, কিসাস তরবারি দ্বারা নিতে হবে। বর্তমানে ফাঁসির প্রচলিত নিয়মে উক্ত তিনটি শর্ত পাওয়া যায় না বিধায় শর্ত অনুপস্থিতির কারণে ওটাকে শরয়ী কিসাস না বলে তা‘যির বা শাস্তি বলা যেতে পারে। অবশ্য কিসাস বলা শুদ্ধ হবে না।
قال العلامة علاء الدين الكاسانى استبقاء القصاص تثبتُ باسباب .
আল্লামা আলাউদ্দিন কাসানী (رحمه الله تعالي ) বলেন, قصاص বা বদলা নেয়ার কার্যকারিতা বিভিন্ন প্রদ্ধতিতে হতে পারে।
238. বদায়েউস্ সানায়ে, জেনায়াত অধ্যায়, খন্ড-৭, পৃষ্ঠা- ২৪৩।
হ্যাঁ! অবশ্য হত্যাকারীকে শাস্তি দেয়ার জন্য ফাঁসি কার্যকরী একটি উত্তম কাজ। যদিও কিসাস না হয়। তবুও এটি বাস্তবায়ন করা জায়েয ও বৈধ।
❏ প্রশ্ন-১৯৫: বর্তমানে মানুষ গাছের পরিবর্তে ষ্টীল, লোহা ও পাষ্টিক ইত্যাদি দ্বারা ঘরের সরঞ্জামাদি ও অলংকার তৈরী করছে। এ জাতীয় সরঞ্জাম, খাট ও অলংকার ব্যবহার করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয আছে কিনা? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: শরীয়তের পক্ষ থেকে মহিলাদের জন্য যে কোন প্রকারের সরঞ্জাম ও অলংকার ইত্যাদির ব্যবহার জায়েয রেখেছেন। কিন্তু পুরুষদের জন্য শুধু রৌপ্য ব্যবহার বৈধ করেছেন। এ ছাড়া অন্যান্য পদার্থের তৈরী জিনিস ব্যবহার মাকরূহ বলেছেন। অতএব এ জাতীয় জিনিস ব্যবহার না করাই উচিত। ফাতওয়া হিন্দিয়াতে আছে,
والتختم بالحديد والصفر والنحاس مكروه للرجال والنساء .
অর্থ: লোহা, দস্তা ও তামা নির্মিত আংটি ব্যবহার পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্যই মাকরূহ।
239. ফাতওয়া হিন্দিয়া, দশম অধ্যায়: স্বর্ণ ও রৌপ্য ব্যবহার প্রসঙ্গে, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩৩৫; অনুরূপ বায্যায়্যিাহ আলাল মু‘আমিশিল হিন্দিয়াহ, কারাহিয়া অধ্যায়, সপ্তম পরিচ্ছেদ: পোশাক প্রসঙ্গে, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৬৮।
قال العلامة التمرتاشى ولا يتختم بغيرها، كحجر و ذهب وحديد وصفر ورصاص وزجاج وغيرها بمامر .
‘আল্লামা তামরতাশী বলেন, রৌপ্য ছাড়া অন্যান্য ধাতব নির্মিত আংটি (পুরুষ) ব্যবহার করতে পারবে না। যেমন- পাথর, স্বর্ণ, লোহা, দস্তা, তামা ও শিশা ইত্যাদি যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।’
240. রদ্দুল মুহ্তার, কারাহিয়া অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: পোশাক প্রসঙ্গে, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৬০; বাহরুর রায়েক্ব, কারাহিয়া অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: পোশাক প্রসঙ্গে, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-১৯১; ফাতওয়া হক্কানীয়া, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৪১৯।
❏ প্রশ্ন-১৯৬: পুরুষদের জন্য অপ্রয়োজনীয় লোম ক্ষুর দ্বারা পরিষ্কার করা কি আবশ্যক? লোম পরিষ্কার করার পাউডার ব্যবহার করা যাবে কি-না? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: পুরুষদের জন্য অপ্রয়োজনীয় লোম ক্ষুর দ্বারা পরিষ্কার করা জরুরী বরং সুন্নাত তরিকা। এ ক্ষেত্রে মেডিসিন পাউডার ব্যবহার করার অনুমতিও আছে, যা দ্বারা লোম পরিষ্কার হয়। যা খোলাফে আওলা বা অনুত্তম। হ্যাঁ! মহিলাদের জন্য ব্যবহারের অনুমতি আছে। আল্লামা আবদুল হাই লক্ষ্মৌভী (رحمه الله تعالي ) ‘নফউল মুফতি ওয়াস্ সায়েল’ (نفع المفتى والسائل) গ্রন্থে বলেছেন,
هل يجوز قطع شعر العانة بالمراقض ؟ الاستبشار هو خلاف السنة قال الملا على القارى فى المرقات . قال ابن الملك لو ازال شعرها بغير الحلق لايكون على وجه السنة ، وفيه ان ازالته قد يكون بالنورة وقد ثبت انه عليه السلام استعمل النورة على ماذكره السيوطى فى رسالة نعم لو ازالها بالمقراض لايكون اتباعًا للسنة على وجه الكمال .
লোমনাশক পাউডার বা লোশন দ্বারা নাভীর নীচে পরিষ্কার করা জায়েয আছে কি-না? লোম উপড়ানো সুন্নতের খেলাপ- মোল্লা আলী ক্বারী মিরকাত শরীফে বলেছেন, আল্লামা ইবনে মালেক বলেছেন- নাভীর নীচের লোম যদি মুন্ডানো ব্যতিত অন্যভাবে পরিষ্কার করে তবে তা হবে সুন্নাতের খেলাফ। কেউ যদি লোমনাশক পাউডার বা লোশন দ্বারা পরিষ্কার করে, তবে তা আল্লামা সুয়ূতির মতে, জায়েয। যেহেতু তিনি তার রেছালায় হুযূর এরূপ মেডিসিন দ্বারা লোম ছাপ করেন মর্মে বর্ণনা করেন। হ্যাঁ! সেটা যদি কেচি দ্বারা ছাটা হয়, তবে তা যথাযথ সুন্নাত মোতাবেক হবে না।
241. নফউল মুফতি ওয়াস্ সায়েল, কিতাবুল খতর ওয়াল ইবাহা; ফাতওয়া হিন্দিয়া, কিতাবুল কারাহিয়া ফিল খাতানে ও খেছা, পৃষ্ঠা-৩৫৭, ৩৫৮; অনুরূপ দুর্রুল মুখতার গ্রন্থে উলেখ আছে।
ইমাম ইবনে মাজাহ (رحمه الله تعالي ) তাঁর ‘সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফে’ উক্ত মাসআলার ওপর একটি অধ্যায় باب الاطلاء بالنورة অর্থাৎ- ‘মেডিসিন পাউডার দ্বারা লোম পরিষ্কার করার বিধান কি?’ নামক একটি শিরোনাম কায়েম করেন।
❏ প্রশ্ন-১৯৭: বর্তমানে গাইরে মুকালিদ তথা আহলে হাদীস ও জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা মাযহাব চতুষ্টয় এবং তাদের তাকলীদ ও অনুসরণকে শিরক বলে মাযহারের বিরোধীতা করছে। তাদের এ মনোভাব শুদ্ধ কি-না? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: মাযহাব চতুষ্টয় সম্পর্কে সমস্ত উম্মতের ইজমা বা ঐকমত্য রয়েছে। মাযহাব পরিত্যাগ করা এবং এঁদের বিরোধীতা করা শুদ্ধ হবে না বরং অবশ্যই গোনাহগার হবে। আল-আশবাহ ওয়ান্ নযায়ের গ্রন্থে উল্লেখ আছে,
وما خالف الاربعة فهو مخالف الاجماع .
অর্থাৎ- ‘যারা মাযহাব চতুষ্টয়ের বিরোধতা করল, পক্ষান্তরে তারা ইজমায়ে উম্মতের বিরোধীতা করল।’
242. আল-আশবাহ ওয়ান নযায়ের, পৃষ্ঠা-১৩১, অনুরূপ মোল্লা জিওয়ানও (رحمة الله) বলেছেন। তাফসীরে আহমদী,200. সূরা আলে-ইমরান, পৃষ্ঠা-৩২৬; তাফসীরে মাযহারী,200. সূরা আলে-ইমরান, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৬।
❏ প্রশ্ন-১৯৮: ইন্জেকশনের মাধ্যমে জন্তু যেমন-গরু, মহিষ ইত্যাদির বংশ বিস্তারের জন্য গর্ভধারণের ব্যবস্থা করা শরয়ী বিধান মতে বৈধ কি-না? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: প্রত্যেক বস্তুর স্রষ্টা আল্লাহ্ তা‘আলা। তিনি বিভিন্ন বস্তুকে বিভিন্ন মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন এবং স্তর বিশেষ ও শ্রেণি অনুপাতে অস্তিত্ব দান করেছেন। এসব আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। যেহেতু জীব-জন্তুর মধ্যে বংশীয় দিক ও সম্পর্কের প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরী বিষয় নয়। তাই জন্তুর মধ্যে মা জন্তুই আসল ও মূল এবং বাচ্চাও হালাল-হারাম হওয়ার ব্যাপারে মা জন্তুর অনুসরণে হয়ে থাকে। সুতরাং জন্তুর বংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইনজেকশন ব্যবহার করে গর্ভধারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা কোন খারাপ ও মন্দ কাজ নয়। আল-আশবাহ ওয়ান নযায়ের গ্রন্থের শরায় ইমাম সৈয়দ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আল-হুমুভী আল-মিসরী (رحمه الله تعالي ) বলেন,
والمولود بين الاهلى والوحشى يتبع الام لان الاصل فى التبعيّة الام حتى ان نرى الذئب على الشأة يعنى بالولد .
‘গৃহপালিত ও বন্য গাধার প্রজননে বাচ্চা জন্ম হলে বাচ্চার ওপর মায়ের হুকুম বর্তাবে। কেননা এ ক্ষেত্রে মা-ই আসল। এমনকি যদি নেকড়ে বাঘের প্রজননে ছাগল গর্ভবতী হয়, ওই বাচ্চার ওপর ছাগলের হুকুম বর্তাবে।’
243. গম্যে উয়ূনুল বসায়ের, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৩৭।
এটা মানবজাতির সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ মানব বৃদ্ধিতে পিতাই আসল এবং পিতা থেকেই বংশধারা ও মানব পরিচিতি হয়ে থাকে।
ইমাম আবু বকর আহমদ ইবনে আলী আল-রাযী আল-জাস্সাস (رحمه الله تعالي ) বলেন,
ولو ولدت حمارة وحشية من حمار اهلى أكل ولدها، فكان الولد تابعًا لامه دون ابيه .
‘জঙ্গলী গাধা (গয়াল) যদি পালিত গাধার প্রজননে বাচ্চা দেয় তবে ঐ বাচ্চা খাওয়া জায়েয (মায়ের হুকুমে) বাপের হুকুম এখানে বর্তাবে না।’
244. আহকামুল কোরআন লিল জাস্সাস, সূরা আন-নাখল, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩।
❏ প্রশ্ন-১৯৯: রোগীকে রক্ত প্রদান করার শরয়ী বিধান কি?
✍ উত্তর: কোন দুর্ঘটনা জনিত কারণে কিংবা জটিল-কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার দরুন প্রাণ রক্ষার্থে মানুষের রক্ত দ্বারা উপকৃত হওয়া জায়েয। শায়খ মুহাম্মদ কামিল ইবনে মুস্তফা(ﷺ) আত্-তারাবিলীসি আল-হানাফি (رحمه الله تعالي ) ‘আত্-তাহ্যীব’ গ্রন্থে বলেছেন,
يجوز لعليل شرب البول والدم والميتة للتداوى اذا اخبره طبيب مسلم ان شفائه فيه ولم يجد من المباح ما يقوم مقامهُ .
‘মুমূর্ষ রোগীর জন্য মৃত প্রাণী, প্রস্রাব ও রক্ত ঔষধ হিসেবে খাওয়া জায়েয, যদি মুসলিম অভিজ্ঞ ডাক্তার এতে আরোগ্যের নিশ্চয়তা দেয় এবং এছাড়া বিকল্প হিসেবে হালাল কিছু পাওয়া না যায়।’
245. আল-ফাতওয়া আল-কামিলাহ, কিতাবুল কারাহিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-২৬৭।
ফাতওয়া হিন্দিয়াতে উল্লেখ আছে,
يجوز لعليل شرب البول والدم وأكل الميتة للتداوى اذا اخبره طبيب مسلم ان شفائه فيه ولم يجد من المباح ما يقوم مقامهُ .
‘মুমূর্ষ রোগীর জন্য মৃত প্রাণী, প্রস্রাব ও রক্ত ঔষধ হিসেবে খাওয়া জায়েয, যদি মুসলিম অভিজ্ঞ ডাক্তার এতে আরোগ্যের নিশ্চয়তা দেয় এবং এছাড়া বিকল্প হিসেবে হালাল কিছু পাওয়া না যায়।’
246. ফাতওয়া হিন্দিয়া, অষ্টাদশ অধ্যায়: আত-তাদাভী ওয়াল মু‘আলিজাত, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩৫৫।
❏ প্রশ্ন-২০০: সৈয়্যদা হযরত ফাতেমা (رضى الله تعالي عنها)-এর ফযিলত এবং তাঁর নামের অর্থ কি?
✍ উত্তর: হযরত সৈয়্যদা ফাতেমা বিনতে রাসূলুল্লাহ (رضى الله تعالي عنها)-এর পবিত্র শান ও মান-মর্যাদা সম্পর্কে স্বয়ং হুযূর মোস্তফা(ﷺ) ইরশাদ করেন,
ابنتى فاطمة حور آدمية لم تحض ولم تطمث، وانما سماها فاطمة لان الله تعالى فطمها ومحبيها من النار .
‘হুযূর (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, আমার সাহেবজাদী ফাতেমা (رضى الله تعالي عنها) হচ্ছেন, মানব হুর। সাধারণ মহিলারা রক্তস্রাবের কারণে যে অপবিত্র হয়ে থাকে, তিনি তা হতে পাক-পবিত্র। আল্লাহপাক তাঁর নাম ফাতেমা এ জন্য রেখেছেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সাথে ভালবাসা ও মুহাব্বত স্থাপনকারীদেরকে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি দান করেছেন।’
247. আল-আমান ওয়াল ‘উলা।
উক্ত হাদীসখানা খতীবে বাগদাদী (رحمه الله تعالي ) হযরত ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণনা করেছেন। উক্ত বর্ণনা হতে একথা প্রতীয়মান হয় যে, সৈয়্যদা হযরত ফাতেমা (رضى الله تعالي عنها) মানবীয় হুর।
248. সীরাতে মোস্তফা জানে রহমত, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-২১৪।
❏ প্রশ্ন-২০১: ‘আহলে বাইত’ কারা উদ্ধৃতিসহ বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: হযরত সৈয়্যদাতুনা বতুল ফাতিমাতুয যাহরা (رضى الله تعالي عنه)-এর পবিত্র আওলাদগণ হচ্ছেন ‘আহলে বাইত’। অতঃপর হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه), হযরত আকীল (رضى الله تعالي عنه) এবং হযরত জাফর সাদেক (رضى الله تعالي عنه) ও হযরত আব্বাস (رضى الله تعالي عنه)-এর বংশধরেরা ‘আহলে বাইত’। উম্মুহাতুল মু’মিনীন রিদওয়ানুল্লাহি তা‘আলা আজমাইনরা হচ্ছেন আহলে বাইত।
249. ইরফানে শরীয়ত, খন্ড-১; সীরাতে মুস্তফা জানে রহমত, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-২১৬।
❏ প্রশ্ন-২০২: নিয়াবত্ বা প্রতিনিধিত্ব কাকে বলে? এবং এর দ্বারা উপকারিতা কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: জা-নশীন তথা প্রতিনিধিত্ব ও স্থলাভিষিক্ত দু’প্রকার।
প্রথমতঃ আংশিক ও সীমিতভাবে কোন বিশেষ কাজের কিংবা স্থানের জন্য সাময়িকভাবে কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাউকে নিজের প্রতিনিধি নির্ধারণ করা। যেমন- বাদশাহর পক্ষ হতে যুদ্ধক্ষেত্রে কাউকে প্রধান করে পাঠানো কিংবা কোন জেলা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া অথবা খাজনা, রাজস্ব ও টেক্স আদায় করার জন্য বিশেষ ক্ষমতা অর্পন করা।
দ্বিতীয়ত: ইমাম বা বাদশাহ অন্য কাউকে তাঁর অবর্তমানে প্রতিনিধিত্ব ও সম্পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারীরূপে অসিয়ত করা। অথচ হুযূর তাঁর জীবদ্দশায় কোন প্রতিনিধি নিয়োগ করেন নি। হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) হতে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত আছে যে, যখন তাঁর নিকট আরয করা হলো যে, استخلف علينا ‘আমাদের মধ্যে কাউকে খলিফা নিযুক্ত করে দিন; উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে খলিফা নিযুক্ত করবে না।’ ولكن اترككم ‘আমি তা তোমাদের ওপর ছেড়ে দিলাম।’ (উক্ত হাদিসটি ইমাম আহমদ, ইমাম বাযযার ও ইমাম দারা কুতনী বর্ণনা করেছেন। আর ইমাম বায্যারের রেওয়ায়েত বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত।)
হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) বলেন,
ما استخلف رسول الله صلى الله عليه وسلّم فاستخلف عليكم .
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) খলিফা নিযুক্ত করে যান নি, আমি কীভাবে খলিফা নিযুক্ত করব?’
250. সীরাতুল মুস্তফা, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২২৭।
❏ প্রশ্ন-২০৩: ঔষধ সেবন এবং চিকিৎসা করার বিধান কি? শারীরিক সুস্থ্যতা ও আত্মিক সুস্থ্যতা কাকে বলে এবং উভয়ের সংজ্ঞা কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: ইমাম ইবনে মাজাহ (رحمه الله تعالي ) তাঁর সুনান গ্রন্থে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় নির্ধারণ করেছেন-
باب ما انزل الله داءً الا انزل له شفاءً
অর্থাৎ- ‘আল্লাহ্ তা‘আলা এমন কোন রোগ নাযিল করেন নি, যার চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখেন নি।’
হযরত উসামা বিন সুরাইক (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উপস্থিত ছিলাম যখন বেদুঈন লোক হুযূর সৈয়্যদুল মুরসালীন (ﷺ) থেকে জিজ্ঞেস করছিল। হাদীসের বর্ণনা এই যে,
فقالوٰ يا رسول الله صلّى الله عليه وسلّم هل علينا جناح ان لا نتدوىٰ
‘তারা বললো, হে আল্লাহর রাসুল(ﷺ)! আমরা চিকিৎসা না করার দরুন আমাদের গোনাহ হবে কি? হুযূর বলেন, হে আল্লাহর বান্দা! চিকিৎসা কর। কেননা আল্লাহ্ সুবহানাহু তা‘আলা এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেন নি, যার ঔষধ সৃষ্টি করেন নি। কিন্তু একটি মাত্র রোগ-বাধক্য, যার কোন ঔষধ নেই।’
ঔষধ সেবন ও চিকিৎসা এটা এক মহা গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাবান শিক্ষণীয় বিষয়। কারণ এতে মানুষের শরীর সম্পর্কে আলোচনা করা হয় এবং রোগ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান লাভ করা যায়। চারিত্রিক বা আত্মিক শিক্ষার গুরুত্ব ও মর্যাদার পর হচ্ছে চিকিৎসা বিদ্যার স্থান। কারণ সেখানে আত্মার পরিশুদ্ধতা ও আত্মিক অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা হয়। আত্মা শরীরের চেয়ে অধিকতর উত্তম ও মর্যাদাবান। এ কারণে চারিত্রিক শিক্ষাকে রূহানী ও আত্মিক চিকিৎসা বলা হয়। হুযূর মোস্তফা(ﷺ) -এর শরীয়তে মুখ্য আলোচনা বিষয় হচ্ছে আত্মিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা। হ্যাঁ! অবশ্য কোথাও কোথাও শারীরিক চিকিৎসা সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। কারণ শরীরে যখন কোন ক্ষতি সাধিত হয়, তখন আত্মায়ও ক্ষতির প্রভাব বিস্তার করে। ঠিক একইভাবে আত্মায় কোন রোগ-ব্যাধি হলে, তার প্রভাব শরীরের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তার কারণ হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলা দেহ ও আত্মার মধ্যকার এমন সম্পর্ক স্থাপন করে রেখেছেন যে, পরস্পরের সুখ-শান্তি ও দুঃখ-বেদনার প্রভাব একে অপরের ওপর বিস্তার লাভ করে। এ সম্পর্কের ধরণ ও বাস্তবতার রহস্য উদঘাটন করতে এখনও পর্যন্ত মানবজাতি অপারগ ও অক্ষম। হাজারো বছর ধরে অনেক বড় বড় হেকিম, দার্শনিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে গবেষণা করার পরও তারা এর রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হননি। এ গভীর সম্পর্ক কেবল মৃত্যুর কারণে ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু আত্মা ধ্বংস হয়না এবং দেহও নিশ্চিন্ন হয় না। বরং উভয়ই আপন আপন স্থানে বিদ্যমান থাকে। এখন কথা হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে একত্রিত করে আত্মার সাথে পুনরায় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা, তা আল্লাহ্ তা‘আলার মহান কুদরতী শক্তির সামনে কোন জটিল বিষয় নয়। জনৈক হাকিমের উক্তি- মানুষের মধ্যে দুটি জিনিস বিদ্যমান। একটি হচ্ছে- দেহ, অপরটি হচ্ছে রূহ বা আত্মা। উভয়ের সুস্থ্যতা ও পরিশুদ্ধির প্রতি লক্ষ্য রাখা মানুষের একান্ত প্রয়োজন। যে সকল আলাপচারিতায় আত্মা ও দেহ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে, সেগুলো থেকে বিরত থাকা উচিত। মানুষ আত্মিক পরিশুদ্ধি ও শারীরিক চিকিৎসাসহ উভয় বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করা ব্যতীত সফলতা পাওয়া সম্ভব নয়। আত্মিক পরিশুদ্ধতা ও উৎকর্ষতা যেভাবে প্রয়োজন, তেমনি শারীরিক চিকিৎসাও আবশ্যক। অতএব বুঝা গেল যে, সকল বিদ্যা ও জ্ঞানের মধ্যে দু’টি বিষয় মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশী জরুরী।
অতএব ওই সকল মানুষের জীবন ধন্য, যারা উক্ত দু’বিষয়ের জ্ঞান অর্জনের জন্য নিজের মুল্যবান জীবন ও প্রিয় সময় ব্যয় করেছেন। তা হচ্ছে, চারিত্রিক জ্ঞান এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান। এছাড়া অন্যান্য সকল বিদ্যা যেমন- ভূগোল, প্রকৃতিবিদ্যা, জ্যোর্তিবিজ্ঞান ইত্যাদি মানুষের ঔষধ ও চিকিৎসা সম্পর্কিত নয়, বরং অন্যান্যের সাথে সম্পর্কিত। উক্ত দু’বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করার পর সময় থাকলে প্রয়োজনানুপাতে অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞান লাভ করা যেতে পারে। তা অর্জন করতে না পারলে কোন ক্ষতি নেই। একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদবাক্য আছে, اول خويش بعده درويش ‘প্রথমে নিজের চেষ্টা পরে অন্যের’। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে- وَفِي أَنْفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ ‘নিজ সত্তার মাঝে কেন চিন্তা-গবেষণা করছ না’। মানুষের নিজের হাকীকত ও বাস্তবতা, গঠন, স্বভাব-চরিত্র ও আচার-অভ্যাস সম্পর্কিত যত জ্ঞান অর্জিত হয়, তা ওই দু’বিষয়ের জ্ঞানের বদৌলতে ও মাধ্যমেই অর্জিত হয়। চিকিৎসা বিদ্যার দ্বারা প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবস্থা এবং উপকারিতা ও অপকারিতা, নড়াচড়ার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং এতে কোন প্রকারের ক্ষতি সাধন হলে তা ঠিক করার নিয়ম-নীতি জানা যায়। ঠিক তদ্রুপ চারিত্রিক বিদ্যা দ্বারা আত্মার বাস্তবতা ও প্রভাব এবং এর সুস্থ্যতা ও রুগ্নতা এবং আত্মার ব্যাধির চিকিৎসার বিবরণ জানা যায়। আত্মার হাকীকত ও বাস্তবতা সম্পর্কে যে রকম জানা উচিত, সেরূপ কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু মানুষের চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে যতটুকু জানা গেছে সে পরিমাণ অর্জন করাও আল্লাহ তা‘আলার বড় নি‘য়ামত। কারো মতে, উক্ত জ্ঞানের মাধ্যমে শিরিকের গন্ধ পাওয়া যায়। এটি ভুল ধারণা। কারণ মু’মিনরা ঔষুধের কার্যকারিতাকে সমর্থন করেন, তবে এ আক্বীদা পোষণ করেন যে, এ কার্যকারিতা খোদা প্রদত্ত এবং আল্লাহর হুকুমেই বটে। তাই উক্ত প্রভাবকে অস্বীকার করা সমীচীন নয়। কারণ পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যক্ষভাবে একথা প্রমাণিত এবং হুযূর ও বিভিন্ন হাদীস শরীফে চিকিৎসা ও ঔষধ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
قال يا رسول الله صلّى الله عليه وسلّم ! ما خير ما اُعْطِىَ العبد ؟ قال خُلُقُ حَسَنٌ .
‘লোকজন আরয করল যে, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ‘সর্বোত্তম বস্তু কি যা বান্দাকে দেয়া হয়েছে? হুযূর (ﷺ) ইরশাদ করেন, সৎ চরিত্র।’ সুবহানাল্লাহ!
হুযূর ইরশাদ করেছেন, চারিত্রিক জ্ঞান হচ্ছে যেখানে আত্মার মূল অবস্থা ও প্রভাব এবং এর সুস্থ্যতা ও রুগ্নতা এবং আত্মার অসুস্থতার প্রতিষেধনের বর্ণনা করা হয়। সুবহানাল্লাহ! হুযূর রাসূলে উম্মী উপাধিতে ভূষিত হওয়া সত্ত্বেও এমন রহস্যময় কথা বলে দিয়েছেন যে, যেগুলো সম্পর্কে অনেক বড় বড় হাকিম, দার্শনিকগণ সারা জীবন চিন্তা-ভাবনা, কঠোর সাধনা ও গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করে যাচ্ছেন। এটা একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে, তিনি অদৃশ্য জগতের সংবাদদাতা, নবুওয়তের দলীল এবং বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতার উজ্জ্বল প্রমাণ। উক্ত হাদীস শরীফে প্রথমে উভয় জগতের অাঁকা ও মাওলা সাধারণ মানুষের জন্য দৈহিক চিকিৎসার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন এবং সার্বজনীন নীতিমালার বর্ণনা দিয়েছেন- যা প্রত্যেক শ্রেণির ধনী-দরিদ্র মানুষ, জীব-জন্তু এবং মুসলিম-অমুসলিম সকলের উপকারী জ্ঞান। যা হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান বা শরীরিক শিক্ষা। অতঃপর যখন লোকেরা সর্বোত্তম জ্ঞান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। তিনি উত্তরে বলেন, চারিত্রিক জ্ঞান। মূলতঃ হুযূর মোস্তফা(ﷺ) অত্র হাদীসে উভয় প্রকারের জ্ঞান অর্জন করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেন। অর্থাৎ চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং চারিত্রিক জ্ঞান বা ইলমে তাসাউফ। উক্ত হাদীস দ্বারা একথাও প্রমাণিত হয় যে, ঔষধ সেবন করা জায়েয এবং উক্ত বিষয়ে ঈমান-আক্বীদা মজবুত হওয়ার মাধ্যমও প্রমাণিত হয়েছে; এতে শিরকের গন্ধ আসারও কোন অবকাশ নেই। কেননা হুযূর নির্দেশ দিয়েছেন, যার নিম্নতম স্তর হচ্ছে মুবাহ হওয়া। আর কেউ কেউ চিকিৎসা করাকে মুস্তাহাব বলেছেন।
রোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এবং সাথে তার ঔষধও নাযিল হয়। ঔষুধের দ্বারা আরোগ্য ও মুক্তি লাভ করা সবই আল্লাহ তা‘আলার ভাগ্যলিপির অন্তভুর্ক্ত। এ বিষয়ে কারো এ ধরনের প্রশ্ন করা উচিৎ হবে না যে, হুযূর (ﷺ) ওই সকল লোকের প্রশংসা করতেন না, যারা আল্লাহ'র ওপর ভরসা করে ঔষধ ব্যবহার করতেন না এবং যাদু-টোনা করতেন।
উপরোক্ত প্রশ্ন এখানে সমীচীন না হওয়ার কারণ হচ্ছে, এখানে ঔষধ দ্বারা দাগ দেয়া উদ্দেশ্য, যা আরবে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো দাগানোর চেয়ে না দাগানোই উত্তম ও শ্রেয়। অন্যান্য চিকিৎসা এর সম্পূর্ণ বিপরীত, কারণ এ সকল চিকিৎসার প্রতি হাদীসসমূহে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। স্বয়ং হুযূর চিকিৎসা করেছেন। যদি কেহ হুযূর (ﷺ) -এর অনুসরণের উদ্দেশ্যে চিকিৎসা করে থাকে, তাহলে অবশ্যই সে সওয়াব পাবে। উক্ত হাদীস শরীফ ইমাম আহমদ, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তিরমিযী, হাকিম এবং খোযাইমা বিশুদ্ধ ও সহীহ বলেছেন।
ইমাম মুসলিম হযরত জাবের (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণনা করেন যে, প্রত্যেক রোগের ঔষধ রয়েছে। রোগী যখন উক্ত ঔষধ সেবন করে, তখন আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে আরোগ্য লাভ করে। ঔষধ সেবন করাতে সে আরোগ্য লাভ করেছে, একথা বলা শিরক। যদি একথা মনে করে সেবন করে যে, ঔষুধের একটা গুণ ও কার্যকারিতা রয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি একথা বিশ্বাস করে ঔষধ সেবন করে যে, আল্লাহর হুকুমে ক্রিয়া ও কার্যকারিতা হয়ে থাকে, তাহলে শিরক হবে না। অনুরূপ প্রত্যেক বস্তুর ব্যাপারে এ আক্বীদা-বিশ্বাস রাখা উচিত যে, তার ভাল ও মন্দ আল্লাহর হুকুমেই হয়ে থাকে। যদি কেহ বুঝে শুনে একথা বলে, অমুক বস্তুর দ্বারা উপকৃত হয়েছে, তাহলে এটা শিরক হবে এবং যখন ওই বস্তুকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন উপকারের বস্তু মনে করবে, তাহলে শিরক হবে। অর্থাৎ- ওটাকে (বস্তু) প্রকৃত ফলপ্রদ ও ফলপ্রসূ মনে করা শিরক। যদি বলে আল্লাহ তা‘আলা উক্ত বস্তুর মধ্যে সেই প্রভাব নিহিত রেখেছেন যা দ্বারা নিরাময় লাভ করা যায়, তাহলে শিরক হবে না, বরং তা হবে আল্লাহর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ এবং এটা আল্লাহ তা‘আলার হুকুমেই হয়েছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা পূর্ব থেকেই নিরাময় দানকারী ঔষধকে হুকুম ও অনুমতি দিয়েছেন। অনুরূপ আল্লাহ তা‘আলার মকবুল ও নৈকট্যবান বান্দাদের ইখতিয়ার দেয়া হয় যেমন কোরআন-হাদীস দ্বারা এর অসংখ্য প্রমাণ আছে। এটা শিরক নয় বরং আল্লাহ তা‘আলার কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে অন্য কিছু দৃষ্টিগোচর হলেও মূলতঃ তা আল্লাহর পক্ষ হতে। প্রকৃত কার্য সম্পাদনকারী আল্লাহ তা‘আলার সত্তা। তা অস্বীকার করা মানে পক্ষান্তরে আল্লাহর কুদরতকে অস্বীকার করা। আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেক বস্তুর ওপর পূর্ণ ক্ষমতাবান। এ কারণে হুযূর রহমতে ‘আলম দৈহিক ও আত্মিক চিকিৎসার কথা বলেছেন। দৈহিক চিকিৎসা যদ্বারা দেহের রোগ নিরাময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অনুরূপ আত্মিক রোগের চিকিৎসা, যা দ্বারা আত্মার রোগ মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। যা আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাদের মধ্য হতে বিশেষ বান্দাদেরকে উক্ত চিকিৎসা বিদ্যার জ্ঞান দান করে বিশেষ পদমর্যাদার অধিকারী করেছেন এবং মানুষের আত্মিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিরাময় করার ইখতিয়ার দিয়েছেন। অতএব তাঁরা খোদা প্রদত্ত ক্ষমতা বলে বলিয়ান হয়ে মানুষের আত্মার চিকিৎসা করে রোগ নিরাময়ের মাধ্যমে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের উপযোগী করে তোলেন। উক্ত চিকিৎসা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বোত্তম চিকিৎসা। এঁদেরকে অস্বীকার করা মানে আল্লাহ্ তা‘আলার কুদরত ও জ্ঞানকে অস্বীকার করার নামান্তর। এভাবে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলে প্রত্যেক বিষয়ে আল্লাহর কুদরত বিকশিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
❏ প্রশ্ন-২০৪: রোগের চিকিৎসা ও ঔষধ সেবন করা কি সুন্নাত? যদি কোন রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, তাহলে গোনাহগার হবে কি-না? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: চিকিৎসা একটি প্রকাশ্য উপকরণ বা মাধ্যম এবং সুন্নাত মোতাবিক আমল। কোন অসুস্থ ব্যক্তি বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে গোনাহগার হবে না। ফাতওয়া নাওয়াযিলে উল্লেখ আছে,
ولومرض ولم يعالج حتى مات لم يأثم بخلاف الجائع اذا لم يأ كل حتى مات بالجوع يأثم .
‘যদি কেহ বিনা চিকিৎসায় মারা যায় গোনাহগার হবে না, কিন্তু ক্ষুধার্ত ব্যক্তি যদি না খেয়ে মারা যায় তবে সে গোনাহগার হবে।’
251. ফাতওয়া-ই নাওয়াযিল, কিতাবুল কারাহিয়া, পৃষ্ঠা-২০০।
❏ প্রশ্ন-২০৫: خَيْرٌ শব্দের তাহ্কীক বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: خَيْرٌ ‘খাইরুন’ শব্দের অর্থ কল্যাণকর। যে বস্তু সবার নিকট প্রিয় ও পছন্দনীয়। যেমন- জ্ঞান (عقل), ন্যায় পরায়ণতা (عدل) ; বহুবচনে خُيُوْرٌ। ধন-সম্পদ, ঘোড়া, ভদ্রলোক ও ফয়েয-বরকতসম্পন্ন, বহুবচনে اَخْيَارٌ । সুশ্রী, অত্যন্ত ভাল, উত্তম, ভাল, মর্যাদা ও মাহাত্ম্য; মূল গঠন باب ضرب হতে; কাউকে অন্যের ওপর ফযিলত ও প্রাধান্য দেয়া, নির্বাচিত করা, পূণ্যকাজে অগ্রগামী হওয়া; বহুবচনে خِيَارٌ। ক্ষীরা, শশা, পছন্দনীয় ও গ্রহণীয় মাল, পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ, একবচন, বহুবচন- এসব তাহকীকাত বা বিশ্লেষণ ভাষাবিদ ও অভিধান বিশারদগণের। উত্তম, পূণ্য, কল্যাণকর, পছন্দনীয় ভাল কাজ এবং সর্বোত্তম সম্পদ বা মাল- এই পাঁচটি اسم تفضيل তথা তুলনাবাচক আধিক্য অর্থ জ্ঞাপক বিশেষ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। এটির মূল اَخْيَرٌ, ষষ্ঠ অর্থ রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। اَخْيَارٌ، خُرَّةٌ হলো اسم مصدر বা ক্রিয়ামূল বিশেষ্য।
252. কামূসুল কোরআন, পৃষ্ঠা-২২৭।
خير القرون অর্থ সম্পর্কে মুহাক্কিক ওলামায়ে কিরামের অভিমত নিম্নে প্রদত্ত হলো:
قرون এটি قرن -এর বহুবচন। قرن ,এর অর্থ- যামানা, যুগ, কাল ও শতাব্দি। خيرالقرون অর্থ- সর্বোত্তম যুগ, উত্তম সময়কাল। এর দ্বারা উদ্দেশ্য রাসূলুল্লাহ -এর যুগের বংশধারা এবং এর পরবর্তী ধারাবাহিকতায় দুই বংশধারা। হাদীস শরীফে এসেছে,
خير القرون قرنى ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم .
‘সবচেয়ে উত্তম যুগ আমার যুগের বংশ। অতঃপর ওই যুগের পরের যুগ, অতঃপর ওই যুগ যা এর পরে আগত।’
253. ইসলামী বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা- ৩১৫, মাকতাবাতুল ফায়সাল।
خير: ما فيه نفع وصلاح، وهو ضد الشر . فالمال خير والخيل خير، والعلم النافع خير.
وفى التنزيل بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ . (سورة ال عمران)
إِنِّي أَحْبَبْتُ حُبَّ الْخَيْرِ عَنْ ذِكْرِ رَبِّي . (سورة ص)
فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ ‘ اى من زاد على مقدار الفدية تطوعًا فهو خير له عنداللهِ .
الخيرة: بكسر الخاء وفتح الياء بوزن عِنَبَةٌ بمعنى الاختيار، يقال اختار اختيارًا والاسم الخيرة محمد رسول الله صلى الله عليه وسلّم خيرة اللهِ .
254. معجم، جلدثانى، صفحة ১৬৬، المطلع والقاموس
خير ‘খাইর’ এমন বস্তু যা সকলের নিকট প্রিয় ও পছন্দনীয়। যেমন- জ্ঞান, বিবেক, মান-মর্যাদা, ন্যায়পরায়ণতা ও উপকারী বস্তু। যা شر শব্দের বিপরীত, شر অর্থ-মন্দ, খারাপ।
خير দু’প্রকার:-
প্রথমত: خير مطلق সাধারণ ভাল ও কল্যাণকর। যা সব সময় প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট পছন্দনীয় হয়। যেমন, জান্নাত।
দ্বিতীয়তঃ خير مقيد সীমাবদ্ধ ও শর্তযুক্ত ভাল। যা কারো জন্য ভাল হবে এবং অন্যের জন্য মন্দ। যেমন, যায়েদের জন্য সম্পদ ভাল কিন্তু আমরের জন্য মন্দ। সে কারণে আল্লাহ তা‘আলা ধন-সম্পদ সম্পর্কে উভয় গুণ বর্ণনা করেছেন। সুতরাং একস্থানে ইরশাদ করেছেন,
ان ترك خيرًا
অর্থাৎ- ‘যদি কিছু ধন-সম্পদ রেখে যেত’। আবার অন্যত্র ইরশাদ করেছেন,
نسارع لهم فى الخيرات بل لايشعرون
অর্থাৎ- ‘তোমরা কি ধারণা করছ যে, আমি তাদেরকে যে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদের কল্যাণার্থে দিয়ে যাচ্ছি, বরং তারা তা উপলব্ধি করতে পারছে না।’
255. সূরা মু’মিনূন, আয়াত: ৫৬
কোরআনে কারীম(ﷺ)র যেখানে ধন-সম্পদের ক্ষেত্রে خير শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সে সম্পর্কে কতিপয় ওলামায়ে কিরাম বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন যে, উক্ত মাল দ্বারা সে সকল সম্পদ উদ্দেশ্য যা সংখ্যায় অধিক সম্পদ এবং হালাল উপায়ে ও বৈধ পন্থায় উপার্জন করা হয়েছে।
خير ও شر শব্দদ্বয় দু’ভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে।
প্রথমতঃ اسم বা বিশেষ্য হিসেবে যেমন,
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ.
অর্থাৎ- ‘তোমাদের মধ্য হতে এমন একদল উম্মত হওয়া উচিত, যারা সৎ কর্মের প্রতি আহ্বান করবে।’ অর্থাৎ- ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের’ প্রতি।
256. সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৪।
দ্বিতীয়তঃ وصف বা বিশেষণ হিসেবে। তখন اسم تفضيل এর অর্থ প্রদান করে। যেমন,
فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى
অর্থাৎ- ‘নিঃসন্দেহে উত্তম পাথেয় হচ্ছে খোদাভীতি’। এখানে خير শব্দটি افضل অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
257. সূরা বাকারা, আয়াত: ১৯৭।
পবিত্র আয়াত শরীফ نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا অর্থাৎ- ‘আমরা তার চেয়ে উত্তম নিয়ে আসি’।
258. সূরা বাকারা, আয়াত: ১০৬।
এবং وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ অর্থাৎ- ‘রোযা রাখাতে তোমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে’।
259. সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫।
এখানে خير শব্দটি اسم বা বিশেষ্যও হতে পারে অর্থাৎ افعل التفضيل বা সিফতের অর্থেও হতে পারে। خير শব্দটি কখনো شر বা মন্দের বিপরীতে ব্যবহৃত হয়। আবার কখনো ضرر বা কষ্ট ও কঠোরতার মোকাবিলায় আসে। যেমন,
وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ .
‘যদি আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে কোন ধরনের কঠোরতায় নিপতিত করেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী আর কেউ থাকবে না। পক্ষান্তরে তিনি যদি তোমার মঙ্গল কামনা করেন, তবে তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’
260. সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৭।
خَيْرَات অর্থ- পূণ্যসমূহ, কল্যাণ ও সৌন্দর্যসমূহ। এটি خَيْرَةٌ এর বহুবচন। যেমন,
فِيهِنَّ خَيْرَاتٌ حِسَانٌ
(অর্থাৎ- সেখানে সুশ্রী ও পূণ্যবতী রমণীরা রয়েছেন।)
261. সূরা আর্-রহমান, আয়াত: ৭০।
আয়াত সম্পর্কে একদল ওলামা বলেছেন যে, خَيْرَاتٌ মূলতঃ خَيِّرَتٌ ছিল ياء তে তাশদীদের সাথে ছিল, যাকে সহজকরণ করা হয়েছে। কেননা خير শব্দটি যখন اسم تفضيل -এর অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন এর جمع বা বহুবচন আসে না।
خَيِّرَاتٌ বহুবচন, একবচনে خيرة । যার অর্থ- সে সকল মহিলা, যারা কল্যাণের অধিকারী হয়েছে। خِيْرَةٌ ও إِخْتِيَارٌ শব্দদ্বয় خَارَيَخِيْرُ ,এর مصدر বা ক্রিয়ামূল।
262. লুগাতুল কোরআন, মওলানা আবদুর রশীদ নো’মানী, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৩২৭।
❏ প্রশ্ন-২০৬: آيات الحفظ বা হিফাযত বা সংরক্ষণের আয়াত কাকে বলে?
✍ উত্তর: কোরআনে কারিমের যে সমস্ত আয়াতে হেফাযতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। تعويذ বা স্মরণীয় আর হিফাযতের আয়াতগুলো নিম্নরূপ:
১.আয়াতুল কুরসী।
اَللّٰہُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَۚ اَلۡحَیُّ الۡقَیُّوۡمُ ۬ۚ لَا تَاۡخُذُہٗ سِنَۃٌ وَّ لَا نَوۡمٌ ؕ لَہٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یَشۡفَعُ عِنۡدَہٗۤ اِلَّا بِاِذۡنِہٖ ؕ یَعۡلَمُ مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ مَا خَلۡفَہُمۡ ۚ وَ لَا یُحِیۡطُوۡنَ بِشَیۡءٍ مِّنۡ عِلۡمِہٖۤ اِلَّا بِمَا شَآءَ ۚ وَسِعَ کُرۡسِیُّہُ السّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ ۚ وَ لَا یَـُٔوۡدُہٗ حِفۡظُہُمَا ۚ وَ ہُوَ الۡعَلِیُّ الۡعَظِیۡمُ .
২. فَاللهُ خَيْرٌ حَافِظًا وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
‘অতএব আল্লাহ তা’আলা উত্তম হিফাযতকারী এবং তিনিই সর্বাধিক দয়ালু।’
263. সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৬৪
৩. لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللهِ
‘তাঁর পক্ষ থেকে অনুসরণকারী রয়েছে তাদের অগ্র,পশ্চাতে, আল্লাহর হুকুমে তারা ওদের হিফাযত করে।
264. সূরা রা‘দ, আয়াত: ১১
৪. وَحَفِظْنَاهَا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ رَجِيمٍ
‘আমি আকাশকে প্রত্যেক বিতাড়িত শয়তান থেকে নিরাপদ করে দিয়েছি।’
265. সূরা হিজর, আয়াত: ১৭
৫. وَحِفْظًا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ مَارِد
‘এবং তাঁকে সংরক্ষিত করেছি প্রত্যেক বিতাড়িত শয়তান থেকে।’
266. সূরা আস-সাফ্ফাত, আয়াত: ৭
❏ প্রশ্ন-২০৭: آيت الفتح ‘বিজয়ী আয়াত’ কোন আয়াতকে বলে?
✍ উত্তর: آيت الفتح ,কে বিজয় কিংবা মুক্তির আয়াত বলা হয়। যথা:,
وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ.
‘তাঁর নিকট অদৃশ্য জগতের সমস্ত চাবি রয়েছে। এগুলো তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানে না। জলে ও স্থলে যা কিছু আছে, তিনি সবই জানেন। কোন পাতা ঝরলে সেটাও তিনি জানেন। কোন শস্যকণা মৃত্তিকার অন্ধকারে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুষ্ক দ্রব্য পতিত হয় না; কিন্তু তা সব প্রকাশ্য গ্রন্থে লৌহে মাহফুযে সংরক্ষিত রয়েছে।’
267. সূরা আন‘আম, আয়াত: ৫৯
অর্থাৎ- লওহে মাহফুযে উক্ত আয়াতে কারীম (ﷺ)কে অধিকহারে পড়া হতো; বিশেষতঃ নামাযের পর ৪০ বার পড়লে অন্তরের সকল উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যায়।
❏ প্রশ্ন-২০৮: بارى এবং باديه سماوه এর তাহ্কীক বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কি?
✍ উত্তর: بَارِىُ এটা আল্লাহ তা‘আলার নিরানব্বই নামের একটি। অর্থ- প্রত্যেক বস্তুর আবিষ্কারক বা স্রষ্টা। এ শব্দটি بَرَأَ থেকে নির্গত। যা সৃষ্টি ও অস্তিত্বদান অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ ইসিম বা নামটি কুরআনে কারীম(ﷺ) হুবহু উল্লেখ আছে। যথা:-
هُوَ اللهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى .
‘তিনিই মহান আল্লাহ্ তা‘আলা, যিনি স্রষ্টা, আবিষ্কারক, আকৃতিদাতা, উত্তম নামসমূহ তাঁরই।
268. সূরা আল-হাশর, আয়াত: ২৪
باديه سما‘ এটা একটি অরণ্য মরুপ্রান্তর। যা দুমাতুল্ জন্দল হতে আইনুত্ তমর পর্যন্ত পৌঁছেছে। উক্ত মরুভূমিতে তরিতরকারি ও শাক-সবজি অধিক পাওয়া যায় এবং সেখানে পানির ঝরণাও আছে। এর নিকটবর্তী কাদেসীয়া মরুদ্যান অবস্থিত।
❏ প্রশ্ন-২০৯: بلعم بن باعوراء (বল‘আম বিন বাউরা) কে ছিল? তার অবস্থার বর্ণনা দাও।
✍ উত্তর: هوالمـستعان বল’আম বিন বাউরা বনি ইসরাইলের একজন আবেদ ও ধর্মনিষ্ঠ সাধক পুরুষের নাম। মুফাস্সিরীনে কিরামের মতানৈক্যের ভিত্তিতে নিম্নোক্ত আয়াতে উক্ত ব্যক্তির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ .
‘হে হাবীব! আপনি তাদেরকে ওই ব্যক্তির অবস্থা শুনিয়ে দিন, যাকে আমি নিজের নিদর্শনসমূহ দান করেছিলাম, অথচ সে তা পরিহার করে বেরিয়ে গেছে। আর তার পেছনে শয়তান লেগে গেছে, ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে পড়েছে।’
269. সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৭৫
মুফাস্সিরীনে কিরামগণ উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মত দিয়েছেন, যার সম্পর্কে উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। যথাঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه), হযরত ইবনে মাসউদ (رضى الله تعالي عنه) এবং হযরত মুজাহিদ (رضى الله تعالي عنه) বলেছেন যে, এতে ‘বল‘আম ইবনে বাউরা’র প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, হযরত মুসা (عليه السلام) এবং বনি ইসরাইলসহ সুয়াবের ময়দানে হার্ওন নদীর তীরে পারীহুন শহরের বিপরীতে যখন অবতরণ করেন, তখন মাওয়াজীও-এর বাদশাহ বলখ বিন সগুর এ সংবাদ শুনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলউমের নিকট দূত পাঠালেন যে, তিনি যেন এসে উক্ত অবতরণকারীদের জন্য বদ-দু‘আ করেন। প্রথমত তিনি অস্বীকৃতি জানান, পরবর্তীতে আসতে রাজি হয়ে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে তার আরোহনের গাধা বসে পড়লে, তারা মারধর করে এটিকে উঠানোর চেষ্টা করলে আল্লাহ তা‘আলা ওটাকে বাকশক্তি দান করেন, ফলে গাধাটি বলতে লাগলো আমি নিজ ইচ্ছায় বসিনি, বরং ফিরিশতারা আমাকে বাধা দিচ্ছে। অতঃপর বল‘আম বলখের কাছে গেলেন এবং এক পাহাড়ে আরোহন করে বনি ইসরাইলের দিকে তাকালেন। তখন অনিচ্ছাকৃতভাবে তার মুখ দিয়ে অভিশাপের পরিবর্তে বনি ইসরাইলের জন্য বরকতের বাক্য বের হয়ে গেল। (উক্ত ঘটনা তাওরাত কিতাবের আদদ-এর ২৩-২৪নং অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ আছে।) বদ-দু‘আর জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কারণে বলউমের সমস্ত কারামত ও বুযূর্গী যা আল্লাহ তা‘আলা তাকে দান করেছিলেন, সব বিলুপ্ত হয়ে গেল।
বনি ইসরাইলকে শুনানো হচ্ছে যে, কেউ আল্লাহর মাকবুল বান্দার বিরোধীতা করলেন, তার পরিণাম হবে এভাবে। বনি ইসরাইলে আল্লাহর দরবারে যাঁর দু‘আ গৃহীত বলে স্বীকৃত বাল‘অম ইবনে বাউরা এমন একজন বড় আলেম ছিল, সে কু-প্রবৃত্তির তাড়নায় স্বার্থের বশীভুত হয়ে হযরত মুসা (عليه السلام)-এর জন্য বদ-দু‘আ করেছিলেন। যে কারণে চলিশ বছর পর্যন্ত অরণ্য বন-জঙ্গলে অনুতপ্ত ও চিন্তান্বিত অবস্থায় ঘুরতে থাক। অবশেষে হযরত ইউসা‘ (عليه السلام)-এর বদ-দু‘আ করার দরূন সে ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়। তার পিতার নাম ছিল বাউর।
বল‘আম বিন বাউরা: তার সম্পর্কে তাফসীরে সাবি, জালালাইন, তাফসীরে রূহুল বয়ান ইত্যাদি গ্রন্থে উল্লেখ আছে। তাঁরা বলেছেন, উক্ত ব্যক্তি তার সময়কালের প্রখ্যাত আলিম, আবেদ, যাহেদ, একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন এবং তাঁর ‘ইসমে আ‘যম’ (اسم اعظم)ও জানা ছিল। তিনি নিজ স্থানে বসে স্বীয় আত্মাধিকতা বলে আল্লাহ তা‘আলার আরশে ‘আযীম পর্যন্ত দেখতে পেতেন। তিনি অনেক বড় মুস্তাজাবুদ দাওয়াত ছিলেন যে, তার দু‘আ মহান আল্লাহর দরবারে অধিক কবুল হতো এবং তার শিষ্যের সংখ্যাও ছিল অনেক।
প্রসিদ্ধ আছে যে, তার দরসে বা পাঠশালায় ছাত্রদের বার হাজার কালির দাওয়াত ছিল। অতএব প্রতীয়মান হয় যে, তার মাদ্রাসায় অসংখ্য হাজারো-লাখো ছাত্ররা লেখা-পড়া করতো।
হযরত মুসা (عليه السلام) যখন জালিম অত্যাচারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে বনি ইসরাইলের মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে রওয়ানা হলেন, তখন বল‘আম বিন বাউরা সম্প্রদায়ের লোকজন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তার (বল‘আম) নিকট আসল এবং বলল যে, হযরত মুসা (عليه السلام) এক বিরাট ও শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করার লক্ষ্যে আসছেন। তাঁর ইচ্ছা যে, আমাদেরকে আমাদের স্থান থেকে বহিষ্কার করে তাঁর সম্প্রদায় বনি ইসরাইলকে তা দিয়ে দিতে। সুতরাং আপনি হযরত মুসা (عليه السلام) এর জন্য এমন বদ-দু‘আ করুন, যাতে তিনি পরাজিত হয়ে ফিরে যান। যেহেতু আপনি ‘মুস্তাজাবুদ্ দাওয়াত’। অতএব আপনার দু‘আ অবশ্যই কবুল হবে। একথা শুনে বল‘আম বিন বাউরা কেঁপে উঠে বলতে লাগলেন, তোমাদের ক্ষতি হোক। আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি! হযরত মুসা (عليه السلام) হলেন আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত রাসূল। তাঁর সৈন্য বাহিনীতে ঈমানদার ও ফিরিশতাগণের জামাআত অন্তভুর্ক্ত রয়েছেন। এমতাবস্থায় আমি তাদের বিপক্ষে কিভাবে বদ-দু‘আ করতে পারি?
কিন্তু তার সম্প্রদায়ের লোকেরা কেঁধে কেঁধে এবং বিনীতভাবে বেশী জোর করলে তিনি বলেন, ইস্তেখারা করার পর যদি অনুমোদন মিলে, তাহলে বদ-দু‘আ করব। ইস্তেখারা করার পর যখন অনুমোদন মিলেনি, তখন তিনি স্পষ্ট ভাষায় জবাব দিলেন যে, আমি যদি বদ-দু‘আ করি তা হলে আমার ইহকাল ও পরকাল ধ্বংস হয়ে যাবে। এতদসত্ত্বেও উক্ত সম্প্রদায় অনেক মূল্যবান হাদিয়া ও উপঢৌকন তার খিদমতে পেশ করে বারবার সীমাহীন চাপ সৃষ্টি করতে লাগলো। পরিশেষে বল‘আম বিন বাউরা’র নিকট এ মহা মূল্যবান হাদিয়া-তোহফার লোভ-লালসা ও আকর্ষণ প্রাধান্য পেলো। এই সম্পদের লোভ-লালসার ভূত তার ওপর সওয়ার হলো এবং ওই মাল-সম্পদের ফাঁদে আটকা পড়লো। ফলে তিনি তার ধার ওপর আরোহন করে বদ-দু‘আ করার জন্য রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে তার ধা বারবার থমকে যায় এবং মুখ ফিরিয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি এটাকে মেরে মেরে সামনের দিকে নিয়ে যেতে থাকেন। পরিশেষে ধাকে আল্লাহ তা‘আলা বাকশক্তি দান করেন। সে বলে উঠলো, আফসোস! বড়ই পরিতাপের বিষয়!! হে বল‘আম বিন বাউরা! তুমি কোথায় ছিলে, এখন কোথায় যাচ্ছ? হে বল‘আম! তোমার ক্ষতি হোক, হে দুর্ভাগা! তুমি কি আল্লাহর নবী এবং মু’মিনদের দলের বিপক্ষে বদ-দু‘আ করবে?
ধার কথা শুনেও বল‘আম বিন বাউরা ফেরত আসেনি। এমনকি ‘হিস্বান’ নামক পাহাড়ের সার্বোচ্চ চুড়ায় আরোহন করে হযরত মুসা (عليه السلام)-এর সৈন্য বাহিনীর প্রতি গভীর দৃষ্টিতে দেখল এবং সম্পদের লোভে বদ-দু‘আ শুরু করে দিল। কিন্তু আল্লাহ'র শান! সে হযরত মুসা (عليه السلام)’র জন্য বদ-দু‘আ করছিল কিন্তু তার মুখ দিয়ে তার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বদ-দু‘আ এসে যায়। এ অবস্থা দেখে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা কয়েক বার তাকে টোকা মারল বা বাঁধা প্রদান করলো যে, হে বল‘আম! আপনি তো উল্টো বদ-দু‘আ করতেছেন। তখন সে বললো, হে আমার গোত্র! আমি কি করব? আমি বলতেছি একটি, আর আমার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে আরেকটি? অতঃপর হঠাৎ তার ওপর আল্লাহর গজব নাযিল হয়ে তার জিহ্বা লটকিয়ে তার বক্ষের ওপর এসে যায়। তখন বল‘আম বিন বাউরা নিজ সম্প্রদায়কে কান্নাজনিত কন্ঠে বলতে লাগলো, হায় আফসোস! হে আমার সম্প্রদায়! আমার দুনিয়া-আখিরাত উভয়ই ধ্বংস এবং বরবাদ হয়ে গেছে। আমার ঈমান চলে যাচ্ছে এবং আমি আল্লাহর গজব ও শাস্তিতে গ্রেফতার হয়ে গেছি। এখন আমার কোন দু‘আ কবুল হবে না। কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রতারণা ও ধোঁকার একটি কৌশল বাত্লিয়ে দিচ্ছি যে, তোমরা হয়তো এমন করলে হযরত মুসা (عليه السلام)-এর সৈন্যরা পরাজয় বরণ করবে। তোমরা সুন্দরী রূপসী রমণীদের উত্তম পোষাক ও অলংকারাদি পরিয়ে সুসজ্জিত করে বনি ইসরাইলের সৈন্যদের মাঝে পাঠিয়ে দাও। যদি তাদের একজনও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে যায়, তাহলে পুরো সৈন্যদল পরাজিত হবে। সুতরাং বল‘আম বিন বাউরা সম্প্রদায় তার নির্দেশনা মতে ষড়যন্ত্রের জাল বেধে অসংখ্য সুশ্রী ও সুন্দরী কুমারী মহিলাকে সুসজ্জিত করে বনি ইসরাইলের সৈন্যদলে পাঠিয়ে দিল।
পরিশেষে বনি ইসরাইলের এক সরদার এক সুন্দরী ও সুশ্রী রমণীর আসক্ত হয়ে গেল। সে উক্ত রমণীকে কোলে নিয়ে হযরত মুসা (عليه السلام)-এর নিকট গেল এবং ফাতওয়া তালাশ করল যে, হে আল্লাহর রাসূল! এই রমণীটি আমার জন্য হালাল কিনা? মুসা (عليه السلام) বললেন, সাবধান! এটা তোমার জন্য হারাম, তাড়াতাড়ি তাকে পৃথক করে দাও। আল্লাহ তা‘আলার কঠিন শাস্তিকে ভয় কর কিন্তু উক্ত সরদারের ওপর যৌন উত্তেজনা এতো বেশী প্রকট হয়েছিল যে, সে আপন নবীর আদেশ অমান্য করে উক্ত রমণীকে তার তাঁবুতে নিয়ে যায় এবং ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে যায়। উক্ত পাপাচারীর দুর্ভাগ্য ও অমঙ্গলের প্রভাবে ফলাফল এটাই হয় যে, বনি ইসরাইলের সৈন্যদলে হঠাৎ পেগ, মহামারী রোগের প্রদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে সত্তর হাজার সৈন্য প্রাণ হারায় এবং সকল সৈন্যবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে হতাশ ও নিষ্ফল ফিরে আসে। ফলে হযরত মুসা (عليه السلام) এর পবিত্র অন্তর অনেক বড় মনোবেদনায় আক্রান্ত হলেন।
270. তাফসরে ‘আজাইবুল কোরআন, কৃত আল্লামা আবদুল মোস্তফা ‘আযমী (رحمة الله), পৃষ্ঠা-১৪১।
বল‘আম বিন বাউরা পাহাড় থেকে অবতরণ করে মহান আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত ও প্রত্যাখ্যাত হল। আমৃত্যু তার জিহ্বা বক্ষের সাথে ঝুলানো ছিল এবং ঈমান হারা হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আল্লাহ তা‘আলা সূরা আ‘রাফে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেন,
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ .
‘হে হাবীব! আপনি তাদেরকে ওই বল‘আম বিন বাউরা-এর অবস্থা জানিয়ে দিন, যাকে আমি নিজের নিদর্শনসমূহ দান করেছিলাম, অথচ সে তো পরিহার করে বেরিয়ে গেছে। আর তার পেছনে শয়তান লেগে গেছে, ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে পড়েছে।"
271. সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৭৫
বর্ণিত আছে যে, কতিপয় আন্বিয়া-ই কিরাম (عليه السلام) আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে আরয করলেন, হে আল্লাহ্! তুমি বল‘আম বিন বাউরাকে এতগুলো নিয়ামত ও কারামত দান করার পর তাকে কেন এতো শাস্তি ও লাঞ্ছনায় নিপতিত করলেন? তখন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করলেন, সে কখনো আমার দেয়া নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেনি। যদি সে আমার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতো তাহলে আমি তার কারামতগুলো ছিনিয়ে নিয়ে তাকে উভয় জগতে এভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করতাম না।"
272. তাফসীরে রূহুল বয়ান, খন্ড-৩০, পৃষ্ঠা-১৩৯
উপরোক্ত ঘটনা থেকে আমাদের কিছু উপদেশ হাসিল হয়েছে।
১. এ ঘটনা থেকে ওই সকল আলিম ও নেতৃবৃন্দের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যে, যারা বিত্তবান ও ক্ষমতাসীনদের থেকে টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদ নিয়ে শরীয়তের বিধান ও ঈমান-আক্বীদা পরিপন্থী কথা বলে থাকেন এবং জেনে-শুনে নিজের দ্বীন-ধর্ম ও ঈমান-আক্বীদার ব্যবসা করে থাকেন যে, এই ব্যবসা মূলতঃ দ্বীন ও ঈমানের পরিবর্তে পার্থিব স্বার্থ হাসিল করা। এটা অত্যন্ত মন্দ ও ঘৃণিত ব্যবসা।
দেখুন! বল‘আম বিন বাউরা কি ছিলেন এবং কি হয়েছে? এরকম হলোই বা কেন? শুধু এ কারণে যে, সে ধন-সম্পদের লোভে পড়ে প্রতারণা ও চালাকি করে সত্য ও হক্বের পরিপন্থী কথা বলেছিল। অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতারণা সম্পর্কে অধিক অবগত আছেন বিধায় আল্লাহ বলেন, وَاللهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ অর্থাৎ- ‘বস্তুতঃ আল্লাহ তা‘আলা হচ্ছেন প্রতারণাকারীদের প্রতিশোধ নিতে সর্বোত্তম কুশলী।’
273. সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৫৪
যেহেতু জেনে শুনে আল্লাহ তা‘আলা প্রেরিত নবীর বিপক্ষে বদ-দু‘আ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। ফলে তার ওপর এ বিপদ পতিত হয়েছিল যে, দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতে অভিশপ্ত, বঞ্চিত, বিতাড়িত ও বহিষ্কৃত হয়ে সারা জীবন কুকুরের ন্যায় বের হওয়া ঝুলন্ত জিহ্বা নিয়ে ঘুরতেছিল এবং পরকালে দোযখের ইন্ধন ও জালানীতে পরিণত হলো। সুতরাং প্রত্যেক মুসলমান বিশেষ করে ওলামা-মাশাইখ ও পীর-বুযূর্গদেরকে পার্থিব ও ধন-সম্পদের লোভ-লালসা থেকে সর্বদা সতর্ক ও সাবধান থাকা উচিত। অবশ্যই কখনো পার্থিব ধন-সম্পদের লোভে দ্বীন-ধর্ম ও ঈমান-আক্বীদার বিষয়ে শৈথিল্য প্রদর্শন মারাত্মক অপরাধ এবং তা পরিহার করা একান্ত প্রয়োজন। অন্যথায় ভালো করে জেনে রাখো যে, আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তির তরবারি ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিশুদ্ধ আক্বিদা পোষণকারীদেরকে এ বিপদ থেকে হিফাযত করুন।
২. সর্বসাধারণের শিক্ষা হাসিল করা উচিত যে, হযরত মুসা (عليه السلام)-এর সৈন্যদল যেখানে মু’মিন ও ফিরিশতারা ছিলেন। একথা স্পষ্ট যে, এই দল অকৃতকার্য হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কারণ তাঁরা এমন আধ্যাত্মিক ও মালাকুতি (ফিরিশতাকুল) বাহিনী ছিলেন যে, তাঁদের সাওয়ারী ঘোড়ার খুরের আঘাতে পাহাড় পর্যন্ত থরথর করে কাঁপতো। কিন্তু মাত্র একজন দুর্ভাগা বদ-নসীবের পাপের কারণে এমন অমঙ্গল চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো যে, ফিরিশতারা সৈন্যদল থেকে আলাদা হয়ে গেলেন এবং মহামারি পেগের আঘাতে পুরো সৈন্যদলের মাঝে এমন বিচ্ছিন্নতা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো যে, সম্পূর্ণ বাহিনী বিশৃংখল হয়ে গেল এবং উক্ত দল হতাশা ও অকৃতকার্য হয়ে পশ্চাৎপদ হয়ে গেল। তাই মুসলমানদের জন্য আবশ্যক যে, তারা যদি কাফির মুশরিকদের মোকাবিলায় জয়যুক্ত ও সফলতা অর্জন করতে চায়, তাহলে সর্বদা অপকর্ম ও পাপচারিতা বর্জন করে হতাশা ও দুর্ভাগা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় ফিরিশতাদের সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে এবং মুসলমানদের প্রভাবপ্রতিপত্ত কাফিরদের অন্তর থেকে বেরিয়ে যাবে। আর মুসলমানেরা কখনো সফলতার মুখ দেখতে পাবে না। বরং তাদের সামরিক শক্তি একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। পুরা জাতি পলায়নকারী কুকুরের ন্যায় কাফির, ফাসিক ও পাপাচারীদের তরবারির খোরাকে পরিণত হয়ে ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অস্থিত্বহীন হয়ে যাবে।
❏ প্রশ্ন-২১০: কখন থেকে চন্দ্র হিসেবে বছরে বার মাস গণনা করা শুরু হয় এবং সূর্য হিসেবে মাস ও হিন্দী মাসের মধ্যে গণনা কিভাবে সাদৃশ্য ও মিলানো হয়? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: هو المستعان চন্দ্র বর্ষ এটি তিনশত চুয়ান্ন দিন এবং আরও দিনের এক তৃতীয়াংশে চন্দ্র বছর হয়। সে হিসেব অনুযায়ী সূর্য বৎসর চন্দ্র বৎসরের চেয়ে এগার দিন এবং দিনের একুশাংশের একভাগের সমপরিমাণ বেশি। উক্ত বর্ষ গণনা আরম্ভ হয় হুযূর সৈয়্যদুল মুরসালীন (ﷺ) -এর হিজরতের তারিখ থেকে।
سَنَةٌ (সানাতুন) এটি আরবি শব্দ, অর্থ-বছর, বহুবচনে سنوات ,سنون আসে এবং আরবিতে বছরকে حَوْلٌ এবং عَامٌ বলা হয়। অন্ধকার যুগেও বছরের হিসেব চন্দ্র হিসেবে বার মাস গণনা করা হতো। যেমনিভাবে ইসলামেও নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্ভবতঃ ইসলামের দু’শো বছর পূর্বে কোন শহরে এ নিয়ম প্রচলিত ছিল এবং প্রত্যেক তৃতীয় বছরে এক মাস বর্ধিত করা হতো, যেমন- হিন্দী লোকদের মাস হয়ে থাকে। যাতে সূর্যের হিসেবের সাথে চন্দ্রের হিসেব মিলে যায়। সে কারণে তাদের হজ্ব প্রত্যেক বছর একই সময়ে হয়ে থাকে এবং তাদের রীতি-নীতি ও আধুনিকতায় কোন পার্থক্য সৃষ্টি হয় না।
উক্ত হিসেবের নিয়ম পদ্ধতি হচ্ছে, কতেক দিন মাসের খুচরা হিসাবের ওপর বাড়িয়ে দেয়া। যার ফলে তিন বছরে পূর্ণ একমাস বেরিয়ে আসে। এ হিসাব বর্তমানেও মিশরীয় আরবদের মধ্যে প্রচলিত আছে। কিন্তু ইসলাম এটাকে অনর্থক বলেছে, শুধুমাত্র চাঁদ দেখানুপাতে চন্দ্র হিসেব চালু রেখেছেন। ইসলামের সকল দল সাধারণত শরয়ী বিধানসমূহের হিসাব-নিকাশ চাঁদ দেখানুপাতে সম্পাদন করে থাকেন। যেমন কোরআন মজিদে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَّةً .
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা যেদিন আসমান-যমিন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকে আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ লওহে মাহফুযে ও গণনায় মাস বারটি লিখে আসছে। তন্মধ্যে সম্মানিত মাস চারটি। এটিই দ্বীন-ধর্মের সঠিক পথ। হে মুসলমানেরা! এর মধ্যে তোমরা নিজেদের সত্তার প্রতি যুলুম-অত্যাচার করো না। আর তোমরা মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করো সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেত ভাবে।’
274. সূরা তাওবা, আয়াত: ৩৬
ইসলামী বর্ষ মুহররম মাস থেকে শুরু হয় এবং পূর্ণ সংখ্যা বার মাস হয়। এটাই পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফ দ্বারাও প্রমাণিত।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরবানীর দিন খুৎবা প্রদানকালে ইরশাদ করেন যে, যামানা বা বছর তার মূল ভিত্তির ওপর এসে পৌঁছেছে। যেমনি আল্লাহ তা‘আলা আসমান-যমিন সৃষ্টি করার দিন ছিল। অর্থাৎ বছর, বার মাসের গণনা হয়েছিল। তন্মধ্যে চার মাস হচ্ছে সম্মানিত।
এর মধ্যে তিন মাস হচ্ছে লাগাতার ও মিলানো যিলকদ, যিলহজ্জ ও মুহরর্ম এবং রজব মাস হচ্ছে জমাদিউস সানি ও শাবান মাসের মাঝখানে।
275. ইসলামী মালুমাত কা মাখ্যান, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৪১৫।
❏ প্রশ্ন-২১১: বছরে তিন মৌসুম গণনা করা হয়। এটা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়?
✍ উত্তর: প্রফেসর আবদুর রহমান মু’মিন তাঁর ‘তাহ্কিকাতি ওয়া আছরিয়াতি তাহ্কিকাত’ গ্রন্থের ১৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, কোরআনে কারীম(ﷺ) হযরত ইউসুফ (عليه السلام) সম্পর্কীয় কাহিনীতে যে দুর্ভিক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা মিসরবাসীর জন্য এক বাস্তব ভয়াল ও বিভীষিকাময় ঘটনা ছিল। পুরাতন মিশরে নীল নদীর পানির উত্তালতার ওপর নির্ভর করে মৌসুম নির্ধারণ করা হত। অনেক সময় নীল নদীতে বন্যা বেড়ে যায়, তখন নদীর উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়ে যেত এবং ক্ষেত ফসলাদি পানির নীচে তলিয়ে যেত। যার কারণে মৌসুম খারাপ হয়ে যেত, ফলে দেশে অভাব-অনটন ও দূর্ভিক্ষ দেখা দিত। যদি নদীতে পানির স্রোত কম হতো, তখন ক্ষেত-ফসলাদিতে পর্যাপ্ত পরিমান সেচের পানি পাওয়া যেত না। ফলে ফসলাদির উৎপাদন কমে যেত এবং খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিত। যদি এভাবে কয়েক বছর যাবত পানির ঘাটতি কিংবা বন্যায় পাবিত হলে দেশে দূর্ভিক্ষ দেখা দিত এবং লোকজনকে অভাব অনটনে কালযাপন করতে হতো। এ কারণে পুরাতন মিসরে পূর্বকালে নীল নদীর স্রোতের হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে মৌসুম নির্ধারণ করা হতো। তাই বছরে তিন মৌসুম গণ্য করা হত।
প্রথম মৌসুম জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উত্তাল ও প্লাবনের মৌসুম বলা হত। দ্বিতীয় মৌসুম অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ছিল। সে সময় ক্ষেত-ফসলাদিতে সেচ দেয়ার পর পানি চলে যেত। উক্ত মৌসুমে বীজ উৎপাদন হত এবং কৃষকরা চাষাবাদ করতো। ফসল পাঁকার পর তা কাটার কাজে ব্যস্ত থাকত। তৃতীয় শুকনো মৌসুম- যা ফেব্রুয়ারি থেকে আগামী জুন পর্যন্ত থাকত।
এভাবে প্রত্যেক বছর মৌসুম পরিবর্তন হতো। মৌসুমের পরিবর্তনের ভিত্তিতে মিসরবাসীরা শামসী (সূর্যের) পঞ্জিকা ও ক্যালেন্ডার তৈরী করতো। নতুন পাশ্চাত্যের ক্যালেন্ডার এ পুরাতন মিসরীয় পঞ্জিকার ওপর নির্ভরশীল। পুরাতন মিসরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবকাঠামোও মৌসুমের পরিবর্তনের অনুপাতে স্থান পেত বা নির্ধারণ করা হতো।
যখন তরকারী, শস্য ফসল অধিক উৎপাদন হতো এবং বিদেশে শস্য-ফসলাদি রপ্তানি করা হতো, তখন সুখে-স্বাচ্ছন্দে জীবন-যাপন করতো। সুখের সময় মিসরী লোকেরা নিজেদের পাল বিশিষ্ট নৌকা নিয়ে লোহিত সাগর ও রোম সাগর পর্যন্ত আনন্দ ভ্রমণ করতো। যখন নীল নদীতে প্লাবন আসতো এবং শস্যাদি পানিতে ডুবে যেত, তখন সাধারণ মানুষ বিভিন্ন নির্মাণ কাজে মনোনিবেশ করতো।
❏ প্রশ্ন- ২১২:
(ا) الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ الخ (২) وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا الخ(৩) أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا الخ
উক্ত আয়াতগুলোর তাফসীর ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: ১. আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা বাকারার তৃতীয় রুকুতে ইরশাদ করেন,
جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ .
‘যে পবিত্রসত্তা! তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ স্বরূপ স্থাপন করেছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য খাদ্যদ্রব্য ও ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের রিযিক হিসেবে। অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে তাঁর সমকক্ষ করো না। বস্তুতঃ তোমরা এসব জান।’
276. সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২২
উক্ত আয়াতে আর্দ অর্থ পৃথিবী, ভূ-পৃষ্ঠ। যমিনের ভূ-পৃষ্ঠ যা দেখতে গোলাকার। কোরআন কারীম(ﷺ)র উক্ত আয়াতে আর্দ (ارض) শব্দ উল্লেখ এসেছে।
‘তাফসীরে মাদারিক’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, উক্ত আয়াতে পৃথিবী কি সমতল না গোলাকার সে বিষয়ে কোন দলিল পেশ করা হয়নি। কারণ বিছানা উভয় অবস্থায় হওয়া সম্ভব। অতএব, যে সকল লোক প্রশ্ন করেন যে, কোরআন মজিদে পৃথিবীকে বিছানা অর্থাৎ সোজাসুজি বিছানো হয়েছে এমন বস্তু বলা হয়েছে, যা জ্যোর্তি বিজ্ঞানীদের গবেষণার সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ অকাট্য দলিল দ্বারা পৃথিবী গোলাকার প্রমাণিত। এটা তাদের অজ্ঞতা ও মুর্খতারই বহিঃপ্রকাশ। কারণ আল্লাহ তা‘আলা শুধু একথাই বলেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীকে তোমাদের চলা-ফেরা, উঠা-বসা ও ঘুমানোর উপযুক্ত করে তৈরী করেছেন, তা গোলাকার হোক কিংবা সমতল এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। অতএব উক্ত প্রশ্ন এবং আয়াতের মর্মের সাথে কোন সম্পর্ক নেই।
২. আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা রা‘দ-এ ইরশাদ করেন-
وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا .
‘তিনিই পৃথিবীকে প্রশস্ত করেছেন এবং এতে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী স্থাপন করেছেন।’
277. সূরা রা‘দ, আয়াত: ৩
مدّ শব্দের অর্থ বিস্তৃত ও প্রশস্ত করা হয়েছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য- ভূ-মন্ডলকে বিস্তৃত করা হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন শ্রেণীর প্রাণী, জীব-জন্তু ও সকল সৃষ্টি জগত অবস্থান করতে পারে। এ আয়াতটিও পৃথিবী গোলাকার হওয়ার বিরোধী নয়।
৩. আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আন্-নাবাতে ইরশাদ করেন,
أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا
‘হে লোকসকল! আমি কি যমিনকে তোমাদের জন্য বিছানা হিসাবে সৃষ্টি করিনি।’
278. সূরা আন্-নাবা, আয়াত: ৬
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, যেভাবে সাত আসমান আছে, তেমনি সাত যমীনও রয়েছে। প্রত্যেক যমিন পরস্পরের মাঝে পাঁচ শত বছরের পথের দূরত্ব বিদ্যমান। এটির মর্ম এমনও হতে পারে যে, এক সৌরমন্ডল সূর্যের এক নিয়ম যা আমাদের সামনে দৃশ্যমান, যার কিরণ বিতরণ করে লক্ষ লক্ষ মাইল আলোকিত করছে। তাছাড়া এ রকম আরো ছয়টি গ্রহ সৌরমন্ডল রয়েছে। যেমন এই সৌরমন্ডলের একটি হচ্ছে এ ভু-মন্ডল, যেখানে আমরা বাস করছি। অনুরূপ অবশিষ্ট ছয় গ্রহের মধ্যে ছয়টিই ভূমন্ডলে।
ইসলামী সাহিত্যে সমুদ্রের ক্ষেত্রে ‘বাহরে মুহীত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বাহার অর্থ-সমুদ্র। আর মুহীত অর্থ-পরিবেষ্টনকারী। এটা এজন্য যে, সমুদ্র সকল মহাদেশ ও দ্বীপসমূহকে যেখানে মানুষ বসবাস করে চতুর্দিক দিয়ে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। অথবা এজন্য যে, সমুদ্র ভূ-পৃষ্ঠকে ঘিরে রেখেছে। ইসলামী শিক্ষায় বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর দূরত্ব শত বছরের পথ। এখানে পাঁচশত বছরের রাস্তা বলে নির্দিষ্ট সংখ্যা উদ্দেশ্য নয়। বরং পরিভাষা অনুযায়ী অধিক দূরত্ব ও দীর্ঘ সময় উদ্দেশ্য। শরয়ী বিধান মতে, পদব্রজে চলার হিসাব মতে দূরত্ব নির্ণয় করা হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, পদব্রজে চলার গতিতে গোটা পৃথিবী অতিক্রম করা অনেক সময়ের প্রয়োজন অথবা এখানে দূরত্ব দ্বারা মর্যাদা উদ্দেশ্য।
সে নিরিখে পদব্রজে যদি গোটা পৃথিবী পরিমাপ করার জন্য একজন মানুষ নির্ধারণ করা হয়, তাহলে তার জন্য পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর ও জল-স্থল এক কথায় সমগ্র পৃথিবীকে পাঁচশত বছরেও পরিমাপ করা সম্ভব হবে না। পবিত্র কা’বা শরীফ পৃথিবীর মধ্যভাগে অবস্থিত। কতিপয় ওলামা বলেছেন যে, বাইতুল মুকাদ্দাসের অবস্থান পৃথিবীর মধ্যভাগে। এ বর্ণনাটি যুক্তির কাছাকাছি। কারণ বর্ণিত উভয় স্থান শুষ্ক প্রান্তরের এমন অংশে অবস্থিত- যা পৃথিবীর সকল মহাদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত। ইসলামী শিক্ষায় একথাও বলা হয়েছে যে, শয়তানের আসন সাগরে অবস্থিত। চিন্তা-ভাবনা করলে একথা সম্পূর্ণ বাস্তব সত্য এবং ঘটনার অনুরূপ বলে মনে হয়।
শয়তানের কাজ হচ্ছে মানুষের মধ্যে পরস্পর শত্রুতামী করানো, মানব সন্তানের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া, যাদু-টোনা ও ঝাড়ফুঁক করা, মিথ্যা-কপটতা এবং পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি বিস্তার লাভ করা। কারণ শয়তানের কর্মকান্ড ও যাতায়াত স্থলভাগেও রয়েছে। তাই সে এ জাতীয় ফিৎনা-ফ্যাসাদ স্থলভাগেও সর্বদা সৃষ্টি করে আসছে।
কিন্তু যখন থেকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্য পানির জাহাজ নির্মাণে উন্নতি সাধন করে সমুদ্রে অধিকহারে যাতায়াত শুরু করে। সেহেতু সাগর হচ্ছে শয়তানের রাজধানী। তাই সমুদ্রে এ ধরনের ফিৎনা-ফ্যাসাদ, হত্যা, লুটপাট ও অরাজকতা স্থলের চেয়ে অধিক ভয়াল ময়দানে পরিণত হয়েছে। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, বর্তমানে পাশ্চাত্যে শয়তানি শিক্ষার যে চর্চা হচ্ছে, পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে তা হচ্ছে না। ইউরোপীয়ানরা স্বভাব-চরিত্র, আধ্যাত্মিক, মাযহাবি, চারিত্রিক ও মানবিক দিক দিয়ে মানব সভ্যতা থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছে। তাদের ধ্যান-ধারণা কার্যক্রম উৎসাহ-উদ্দীপনা এক কথায় প্রতিটা বিষয়ে তাদের ব্যক্তিগত সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ সর্বস্থরে শয়তানি কানুন ও শাসনের প্রচলন প্রাধান্য লাভ করেছে। তাই তাদের রাষ্ট্র ও ধন-দৌলতের প্রতিযোগিতায় ভিন্ন জাতিকে ধ্বংস ও নিশ্চিন্ন করে তাদেরকে অস্থিত্বহীন করে দেয়া, তাদের জন্য বড় অহংকার ও গৌরবের বিষয়। ভিন্ন জাতি ধ্বংস করা এবং তাদের সম্পদ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার আকাঙ্খা উক্ত জাতির প্রকৃতিগত স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তাই তাদের সে আকাঙ্খা স্থলভাগেও পূর্ণ করছে, কিন্তু স্থলভাগের তুলনায় সমুদ্রে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের উপকরণ আরো বেশি শক্তিশালী। সে ভয়াল সমুদ্রের নাম শুনলেই মানবজাতি ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে উঠে। বর্তমানে নিরবে নিস্তব্দে তাদের অনেক উত্তরাধিকারী সহকর্মী তৈরী করা হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে তাদের অত্যাধুনিক জাহাজ এবং ক্রুজ মিশাইল ও ব্যবসায়িক যুদ্ধ জাহাজ বিভিন্ন দিক প্রদক্ষিণ করছে এবং চক্কর দিচ্ছে। গভীর সমুদ্র থেকে অত্যাধুনিক ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র রকেট লাঞ্চার ইত্যাদি অগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করে স্থলবাসীদের ঘর-বাড়ি গুড়িয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেনা ঘাঁটির ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে তা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করছে। নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু হচ্ছে। এ পৈশাচিকতা, যুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচার-নিপীড়ন সামুদ্রিক যুদ্ধে অধিকহারে সংঘটিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত স্থলযুদ্ধ অনেকবার হয়েছে কিন্তু অবর্ণনীয় এ দুর্দশার দৃশ্য একমাত্র সামুদ্রিক যুদ্ধেই ঘটেছে। এমন তো হবেও না কেন? সমুদ্র তো তাদের পীর-মুর্শিদের সিংহাসন স্থল।
উৎসর্গ হোক আমার প্রাণ উভয় জাহানের নবী (ﷺ) -এর অমীয় বাণীর ওপর, যিনি চৌদ্দশত বছর পূর্বে সহজ-সরল ও সাদাসিদে শব্দের মাধ্যমে এ সূক্ষ্ম রহস্যের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন।
اللهم صلِّ عليه فصلِّ عليه ثم صلِّ عليه .
পৃথিবীর কোন প্রান্তে আবে-হায়াত বা জীবন সঞ্জীবনী পানির ঝর্ণাধারা বিদ্যমান থাকার কথা প্রসিদ্ধ আছে। যার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, উক্ত ঝর্ণা থেকে যে কেউ পানি পান করবে সে কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত থাকবে। আরো একটি ‘কোহ-কাফ’-এর নামও অভিধানের কিতাবে লিখা আছে, যা সম্পূর্ণরূপে যমরুদ বা মূল্যবান সবুজ পাথরের বলা হয়ে থাকে এবং যা পৃথিবীর চতুর্দিকে পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছে। এ জাতীয় আরো অনেক কাহিনী মুসলমানদের মাঝে সাধারণত প্রসিদ্ধ আছে কিন্তু এগুলোর কোন শরয়ী অকাট্য দলীল পাওয়া যায়নি।
279. ইসলামী মা’লুমাত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা- ৬০-৬১
❏ প্রশ্ন-২১৩: সুন্নাত কাকে বলে সংজ্ঞাসহ বর্ণনা কর ?
✍ উত্তর: وبالله التوفيق মুহাদ্দিসীন-ই কিরামের পরিভাষায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ), সাহাবা-ই কিরাম ও তাবেঈন-ই কিরামের রীতি-নীতিকে সুন্নাত বলে। সুন্নাতের উক্ত সংজ্ঞায় আসহাব, ত্বাওর ও তরিকা- এই তিনটি শব্দের ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
اصحاب শব্দটি বহুবচন, একবচনে صحابى । সাহাবী ওই ব্যক্তি যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন ও নবী করীম -এর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছেন এবং ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাসের ওপর ইন্তিকাল করেছেন। সোহরত বা সাহচর্যের জন্য নির্দিষ্ট কোন সময়-সীমা নেই, সামান্য হোক বা বেশী। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সাথে সাহাবা-ই কিরামের যেরূপ সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছে, অনুরূপ তাবেঈগণের সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছে সাহাবা-ই কিরামের সঙ্গে। তাবেঈ এমন ব্যক্তি যাঁর সাথে কোন সাহাবীর (رضى الله تعالي عنه) সংশ্রব বা সান্নিধ্য লাভ হয়েছে এবং ইসলামের শর্তও যথাযথ পাওয়া গিয়েছে।
طورطريق শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য قول، فعل، تقرير অর্থাৎ- বাণী, কাজ ও নীরবতা। تقرير দ্বারা কথা-বার্থা ও আলাপ-আলোচনা উদ্দেশ্য নয়; বরং تقرير দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, কাউকে কোন কাজ করতে দেখে কিংবা আদেশ-উপদেশ দিতে শুনে, ভাল-মন্দ কিছুই না বলে নীরব থাকা। এতে প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত কাজ-কর্ম ও আদেশ-উপদেশ ইত্যাদি জায়েয। অতএব সুন্নাত নয় প্রকার:
১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর قول বা বাণী।
২. তাঁর فعل বা পবিত্র কাজ।
৩. তাঁর (ﷺ) কোন কর্ম ও বাণীকে জায়েয বা বৈধতা প্রদান করা। এ ধরনের তিন প্রকার সাহাবা-ই কিরামের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে, অতঃপর ওই ধরনের তিন প্রকার তাবেঈনদের সাথে সম্পর্কের কারণে। এ সবগুলো মিলে নয় প্রকার হলো।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর অনুসরণ ও তাঁর প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ কোরআন মজিদের দলিল দ্বারা প্রমাণিত। যথা:
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ .
‘হে রাসূল! আপনি ওই সকল লোকদের বলেদিন, যদি তোমরা আল্লাহকে বন্ধু হিসেবে পেতে চাও, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদেরকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’
280. সূরা আল-ইমরান, আয়াত: ৩১
সাহাবা-ই কিরাম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন,
اصحابى كا لنجوم بايهم اقتديتم اهتديتم .
‘আমার সাহাবীরা (رضى الله تعالي عنه) আকাশের নক্ষত্রের ন্যায়, তোমরা তাদের মধ্য হতে কারো অনুসরণ-অনুকরণ করলে সঠিক পথ পাবে।’ বাকী রইলো তাবেঈনগণের ফযিলত। আমরা তাঁদের অনুসরণ নিম্নোক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণ করবো।
خير القرون قرنى ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم .
‘কালের মধ্যে সর্বোত্তম কাল হলো আমার কাল। অতঃপর তাঁদের কাল উত্তম, যাঁরা উক্ত কালের লোকদের নিকটতম হবেন। অতঃপর তাঁদের যাঁরা এদের নিকটতম হবেন।’
সারকথা হচ্ছে, আমাদেরকে কোরআন মাজীদ ছাড়াও আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে রাসূল (ﷺ) -এর এবং রাসূল (ﷺ)-এর হুকুমে সাহাবা-ই কিরাম, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনগণের অনুসরণ ও অনুকরণ করা আবশ্যক। সুতরাং তাঁদের قول، فعل،تقرير তথা বাণী, কাজ ও নীরবতারও অনুকরণ করতে হবে। যার অর্থ আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি।
কাশ্শাফ গ্রন্থকার ‘ইস্তিলাহাত’ এ লিখেছেন যে, শরীয়তের পরিভাষায় সুন্নাতের প্রয়োগ নিম্নোক্ত অর্থে হয়ে থাকে-
১. শরীয়ত।
২. রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর কওল, ফেল এবং তাকরীর তথা বাণী, কর্ম ও অনুমোদন।
৩. ওই হুকুম যা শুধু হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত।
৪. সে সকল কাজ যা না করার চেয়ে করাই উত্তম। এখানে ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল ও মুস্তাহাব সবই অন্তভুর্ক্ত।
৫. নফল: যা করাতে সওয়াব রয়েছে এবং না করলে শাস্তি নেই।
৬. امر مشروع তথা শরীয়ত অনুমোদিত হুকুম।
৭. এমন কাজ বা আমলসমূহ যা হুযূর (ﷺ) কিংবা সাহাবা-ই কিরাম (رضى الله تعالي عنه) সর্বদা করেছেন, মাত্র দু’একবার ছাড়া কখনো পরিত্যাগ করেন নি।
এগুলো আদায় না করাতে যদি গুনাহ হয়, তাহলে এগুলোকে সুন্নাতুল্লাহ বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলা হয়। যেমন, আযান, জামাত, ফজরের দুই রাকাআত সুন্নাত, যোহরের ছয় রাকাআত সুন্নাত এবং মাগরিব ও এশার ফরযের পর দুই রাকাআত সুন্নাত। আর যদি আদায় না করাতে গুনাহ না হয়, তাহলে এগুলোকে সুন্নাতে যায়েদা বা সুন্নাতে গাইরে মুয়াক্কাদা বলা হয়।
❏ প্রশ্ন-২১৪: فرعون ও هامان এটি কোন শব্দ? এবং নমরূদ কে ছিল?
✍ উত্তর: ভাষাবিদগণ বলেছেন, فرعون (ফেরাউন) শব্দটি تفرعن শব্দ থেকে নির্গত। অর্থ-অহংকারী, দাম্ভিক। মূলতঃ শব্দটি فُرْوَءَةٌ থেকে উৎকলিত। মিসরীয় পুরাতন অভিধানে যার অর্থ- শাহান্শাহ বা মহান সম্রাট। আরবরা এটা আরবী ভাষার অন্তভুর্ক্ত (معرّب) করতে গিয়ে فرعون ফেরাউন করেছেন। বহুবচনে فراعنه আসে।
ফেরাউন:
ফেরাউন কোন বাদশাহর নাম ছিল না। বরং মিসরীয় বাদশাহগণের উপাধি ছিল। তারা মিশর বিন হা-ম ইবনে নুহ-এর বংশধর ছিল। যেমন হিন্দুস্তানের বাদশাহকে ‘রাজা’ এবং প্রাচীন রোমের বাদশাহগণকে ‘কায়সার’ বলা হতো।
281. হক্কানী মাখ্যনে ইলুম, পৃষ্ঠা- ৫৭০
হামান:
ফেরাউনের উজির বা মন্ত্রীর নাম। যাকে ফেরাউন আল্লাহকে দেখার জন্য উঁচুস্থান নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
وَقَالَ فِرْعَوْنُ يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرِي فَأَوْقِدْ لِي يَا هَامَانُ عَلَى الطِّينِ فَاجْعَلْ لِي صَرْحًا لَعَلِّي أَطَّلِعُ إِلَى إِلَهِ مُوسَى.
‘ফেরাউন বলল, হে পরিষদবর্গ! আমি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন খোদা আছে বলে আমার জানা নেই। অথচ মুসা (عليه السلام) এক খোদা প্রমাণ দিচ্ছে। ফেরাউন তার উজিরকে লক্ষ্য করে বলল, হে হামান! তুমি মাটির ইট পোড়াও, অতঃপর আমার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ কর, যাতে আমি মুসার (عليه السلام) খোদাকে উঁকি মেরে দেখতে পারি।’
282. সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৩৮
নামরুদ:
নামরুদ এক কাফির বাদশাহর নাম। সে হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর সময়কার বাদশাহ ছিল এবং নিজেকে খোদা বলে দাবী করত। যে কেউ তার দরবারে গেলে, তাকে সিজদা করতে হতো। সে হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)কে তার নিকট ডেকে পাঠাল কিন্তু তিনি এসে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং সিজদা সংক্রান্ত বিষয়ে নামরুদকে স্তব্ধ করে দেন। ফলে নমরুদ তাঁর শত্রু হয়ে গেল এবং তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করল কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে অত্যন্ত নিরাপদে রাখেন।
❏ প্রশ্ন-২১৫: ســبـأ‘ (সাবা) এর তাফসীর ও তাহকীক বর্ণনা কর ?
✍ উত্তর: কোরআন মজিদে সূরা সাবা’র দ্বিতীয় রুকুতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,
لَقَدْ كَانَ لِسَبَإٍ فِي مَسْكَنِهِمْ آيَةٌ جَنَّتَانِ عَنْ يَمِينٍ ......... وَهَلْ نُجَازِي إِلَّا الْكَفُورَ .
‘সাবার অধিবাসীদের জন্য তাদের আবাস ভূমিতে ছিল আল্লাহ তা‘আলার কুদরতের এক মহান নিদর্শন- দু’টি উদ্যান, একটি ডান দিকে, অপরটি বামদিকে। আমরা তাদেরকে নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে দেয়া রিযিক খাও এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। পৃথিবীতে অবস্থানের জন্য যিনি এতো স্বাস্থ্যকর শহর এবং আবাসিক গড়েছেন, যিনি পরকালে অপরাধ ও গুনাহ ক্ষমাকারী পালনকর্তা। অতঃপর তারা আমার হুকুমের অবাধ্যতা করল, ফলে আমি বাঁধ ভেঙ্গে তাদের ওপর প্রবল বন্যা দিয়ে গোটা এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছি। আর তাদের বাগানদ্বয়কে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুই বাগানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং সামান্য কুলবৃক্ষ। এটাই ছিল কুফরীর কারণে তাদের প্রতি আমার শাস্তি। আমি অকৃতজ্ঞ ছাড়া কাউকে শাস্তি দিই না।’
283. সূরা সাবা, আয়াত: ১৫-১৭
‘সাবা’ ইয়ামেনের বাদশাহ ইয়াশহাব-এর অপর নাম। অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণের ধারণা মতে, সাবা ইয়াশহাবের সন্তানের নাম। তার সন্তানেরা পুরুষত্বহীন হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর এ সকল বংশধরেরা সাবা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তাদের লোকজন বিভিন্ন স্থানে বসবাস করতো এবং বস্তিসমূহকে আবে মাআরিব’ বলা হতো। উক্ত বস্তিসমূহ সান‘আ শহর থেকে তিন মাইল দূরত্বে অবস্থিত।
হযরত ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করল, কোরআনে উল্লেখিত ‘সাবা’ কোন পুরুষের নাম, না নারীর, না কোন ভূ-খন্ডের নাম? রাসূলুল্লাহ বলেন, সাবা একজন পুরুষের নাম। তার দশজন পুত্র সন্তান ছিল। তন্মধ্যে ছয়জন ইয়ামেনে এবং চারজন সিরিয়া দেশে বসতি স্থাপন করে। ইয়ামেনে বসবাসকারী ছয় পুত্রের নাম: ইযদ্, আশ‘আরী, হিমইয়ার, কেন্দা, মাদজাজ ও আন্মার এবং সিরিয়া দেশে বসবাসকারীদের নাম: লখম, জুযাম, গাস্সান ও আমেলা। প্রত্যেক সন্তানেরা এ নামেই সুবিদিত।
তাদের গোত্রীয় নামও এ নামেই পরিচিত ছিল। হিম্ইয়ারের বংশে ইয়ামেন সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতা পরিচালিত হয়। আন্মারের পুত্র সাদ্দাদ উক্ত সাম্রাজ্যের বাদশাহ নির্বাচিত হন। অতঃপর তার ভাই লোকমান ইবনে আদ বাদশাহ হন। এরপর তার অপর ভাই যুসদ ক্ষমতাসীন হয়। অতঃপর তার সন্তান হারিস ইবনে তুব্বা‘ ক্ষমতাসীন হন, যিনি প্রথম তুব্বা’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তারপর তার সন্তান সা‘আব বাদশাহ হন, তাঁকে যুল-কারনাইনও বলে। অতঃপর পুত্র যুল-মানার আবরাহ, অতঃপর তার পুত্র আফরিক্বশ, অতঃপর তার ভাই যুল-আগার, অতঃপর তার ভাই শারজীল, অতঃপর তার পুত্র আল-হাদ্দাদ বাদশাহ নির্বাচিত হন। অতঃপর তার কন্যা বিলকিছ বাদশাহ হন। সাবার বংশধরের মধ্যে যে ছয়জন বাদশাহ ছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন ঈমানদার, পূন্যবান ও নেককারও ছিলেন। যেমন- তুব্বা’, যুল-কারনাইন। কয়েকজন মূর্তিপূজারী কাফির ছিলেন।
কয়েকজনের রাজত্ব আরব সাম্রাজ্য অতিক্রম করে সুদূর মিসর, সিরিয়া, ইরান ও হিন্দুস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। উক্ত বাদশাহগণের স্মৃতিস্বরূপ গামদান-এর অট্টালিকাসমূহ এখনো তার স্বাক্ষর বহন করছে। এগুলোর মধ্যে ওই বাঁধও প্রাচীনতম স্মৃতি বহন করছে যেমন কারো মতে, সম্রাজ্ঞী বিলকিস বর্ষার পানি আটকানোর জন্য বাঁধ তৈরী করায়েছিলেন। সমস্ত নালার পানি ওই বাঁধে আটকা পড়ে জমা হয়ে যেত। সেখান থেকে ছোট ছোট নালা বের করে ক্ষেত-খামার ও বাগানগুলোতে পানি সরবরাহ করা হতো। রাস্তার উভয় পাশের্ব বাগান ছিল এবং পানির সুবিধার্থে অনেক বসতবাড়ি সেখানে স্থাপিত হয়েছিল। এ শস্য-শ্যামলতা ও সজীবতা অনেক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যার ফলশ্রুতিতে পর্যটকগণ অতি সহজে ও নিরাপদে অনেক দূরত্বের পথ অতিক্রম করতে সক্ষম হতো। উক্ত নিয়ামতকে লোকেরা সাধারণ বিষয় মনে করতে লাগল, যার ফলাফল এটাই হলো যে, আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে বাঁধ ভেঙ্গে পানি সমস্ত বস্তি ও আবাদী বাগানসমূহ বন্যার স্রোতে ভেসে নিয়ে গেল।
সুতরাং কোরআন মজিদে সূরা আন-সাবা’র দ্বিতীয় রুকুতে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
لَقَدْ كَانَ لِسَبَإٍ فِي مَسْكَنِهِمْ آيَةٌ جَنَّتَانِ عَنْ يَمِينٍ ......... وَهَلْ نُجَازِي إِلَّا الْكَفُورَ .
‘সাবার অধিবাসীদের জন্য তাদের আবাস ভূমিতে ছিল আল্লাহ তা‘আলার কুদরতের এক মহান নিদর্শন- দু’টি উদ্যান, একটি ডান দিকে, অপরটি বামদিকে। আমরা তাদেরকে নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে দেয়া রিযিক খাও এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তিনি পৃথিবীতে অবস্থানের জন্য এতো স্বাস্থ্যকর শহর এবং পরকালে অপরাধ ও গুনাহ ক্ষমাকারী পালনকর্তা। অতঃপর তারা আমার হুকুমের অবাধ্যতা করল, ফলে আমি বাঁধ ভেঙ্গে তাদের ওপর প্রবল বন্যা দিয়ে গোটা এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছি। আর তাদের বাগানদ্বয়কে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুই বাগানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং সামান্য কুলবৃক্ষ। এটাই ছিল কুফরীর কারণে তাদের প্রতি আমার শাস্তি। আমি অকৃতজ্ঞ ছাড়া কাউকে শাস্তি দিই না।’
284. সূরা সাবা, আয়াত: ১৫-১৭
আমি সাবা বাসীদের বস্তিসমূহ এবং সিরিয়ার গ্রামবাসীর মধ্যস্থিত এলাকায় উৎপাদনে যে বরকত দিয়েছিলাম এবং অনেক গ্রাম আবাদ করে রেখেছিলাম যা পরস্পর পাশাপাশি হওয়াতে দেখা যেত। উক্ত গ্রামে পর্যটকদের চলাচলের জন্য সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম, যাতে তারা নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে দিবারাত্র চলাফেরা করতে পারে। তখন তারা বলতে লাগল যে, হে আমাদের প্রতিপালক! এতবেশী পাশাপাশি এলাকায় সফর করাতে সফরের স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি আমাদের ঘর-বাড়ী দূরে দূরে করে দাও। সারকথা হচ্ছে, তারা উক্ত নিয়ামতসমূহের মূল্যায়ন না করে তারা নিজেদের ওপর যুলুম করেছে। অতএব আমি তাদেরকে এভাবে বিলীন করে দিয়েছি যে, তাদের ঘটনা কল্প-কাহিনী ও উপাখ্যানে পরিণত করে দিয়েছি। আমি তাদের মধ্যে যারা কৃতজ্ঞ ও ধৈর্য্যশীল বান্দা রয়েছেন, সাবা সম্প্রদায়ের কাহিনীতে তাদের জন্য রয়েছে বড় শিক্ষনীয় বিষয়। শয়তান যে সকল লোকদের সম্পর্কে তার মতামত পেশ করেছিল যে, তারা তার সঙ্গ দেবে, বাস্তবিকই সে তার রায়কে সত্য প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, উক্ত লোক সকল তার সঙ্গ দিয়েছে এবং তাকে অনুসরণ করেছে। কিন্তু ঈমানদারদের এক জামাত যারা তার প্রতারণা ও প্রলোভনে প্রতারিত হয়নি বরং শয়তানের তো তাদের ওপর কোন ক্ষমতাই ছিল না। আমি তার ব্যাপারে একটি কৌশল করে রেখেছিলাম, যার আসল উদ্দেশ্য এটাই ছিল যে, যে সকল লোক পরকালে বিশ্বাসী আমি তাদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করে রাখব। আর যাদের সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে এবং শয়তানের প্ররোচনায় নিপতিত হয়েছে তাদেরকেও পৃথক করব। অতএব, হে রাসূল ! তোমার প্রতিপালক প্রত্যেক বিষয়ের প্রত্যক্ষদর্শী এবং প্রত্যেক বস্তুর অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন। ‘সাবা’ কোরআন মজিদের চৌত্রিশতম সূরার নাম। এটির তাফসীর যে-কোন তাফসীর গ্রন্থ থেকে জেনে নিন।
(আমি শয়তানকে পরকালে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য কৌশল বা ফাঁদ হিসেবে রেখেছি, যাতে তার অনুসারী ও অনানুসারীদের পৃথক করা যায়।)
"تمت بالخير"
সমাপ্ত