আউলিয়া-ই কেরামের মর্যাদা
🖋অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী
عن عمربن الخطاب قال قال النبى صلى الله عليه وسلم اِنَّ مِنْ عِبَادَ الله لَاُنَاسًا مَاهُْم بِأَنْبِيَاءَ ولاشهداء يغبطهم الانبياءُ والشهداءُ يوم القيامةَ بمكَانهمَ من الله تعالى قالوا يارسول الله تخبرنا من هم قال هم قول تابّوا بروح الله على غيرا رحام بينهم ولااموال يتعاطونها والله ان وجوههم لَنُورٌ وانهم على نورٍ لايخافون اذا خاف الناس ولايحزنون اذا حزن الناس وقرء هذه الاية الا ان اولياء الله لاخوف عليهم ولاهم يحزنون (اخرجه ابو داود)
অনুবাদ:
হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করছেন, নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা না নবী না শহীদ কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে তাঁদের বিশেষ মর্যাদার কারণে নবীগণ ও শহীদগণ তাঁদের প্রতি ঈর্ষা করবেন। সাহাবীগণ আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাঁরা কারা? তিনি ইরশাদ করলেন, তাঁরা ওই সকল ব্যক্তি যাঁরা কোন আত্মীয়তার বন্ধন কিংবা কোন লেনদেন জনিত কারণ ছাড়া শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য পরস্পরকে ভালোবাসেন। আল্লাহ্র শপথ তাঁদের চেহারা নূরানী হবে এবং নূরের উপর তাঁরা অবস্থান করবেন। লোকেরা যখন ভীত সন্ত্রস্ত থাকবেন তখন তাঁদের কোন ভয় থাকবে না। লোকেরা যখন দুঃখে ভারাক্রান্ত হবেন তখনও তাঁরা বিমর্ষ হবে না। অতঃপর তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন- الا ان اولياء الله لاخوف عليهم ولاهم يحزنون জেনে রেখো! নিঃসন্দেহে আল্লাহর অলিদের কোন ভয় নেই তাঁরা চিন্তিতও হবে না। [আবু দাঊদ]
রাভী পরিচিতি
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু তাঁর নাম ওমর। উপনাম আবু হাফস, গুণবাচক নাম ফারুক, পিতার নাম খাত্তাব, মাতা হানতামা বিনত হাশিম ইবন মুগীরা। তিনি নবুয়তের ষষ্ঠ মতান্তরে পঞ্চম সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বে চল্লিশ জন পুরুষ এবং এগার জন মহিলা ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র ইন্তেকালের পর তিনি ১৩ হিজরির ২৩ জমাদিউস সানী মোতাবেক ২৪ আগস্ট ৬৩৪ সালে খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২৩ হিজরির ২৩ জিলহজ্ব মোতাবেক ৩ নভেম্বর ৬৪৪ সালে তাঁর খিলাফত সমাপ্ত হয়। তাঁর খিলাফতের মেয়াদকাল ১০ বৎসর ৬ মাস। তিনি ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। তাঁকে সর্বপ্রথম আমিরুল মুমিনীন বলা হত। কেননা আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে খলিফাতুর রাসূল বলা হত। তিনি স্বীয় কন্যা হযরত হাফসা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের সাথে বিবাহ্ দেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৯। হিজরি ২৩ সালের ২৪ যিলহজ্ব বুধবার তিনি মসজিদে নববীতে এশার নামাযের ইমামতি করার জন্য দাঁড়ালে আবু লুলু নামাক ব্যক্তি যিনি মুগীরা ইবন গোবার ক্রীতদাস ছিলেন। তাঁকে তরবারী দ্বারা মারাত্মকভাবে আহত করে। আহত অবস্থায় তিনদিন অতিবাহিত হওয়ার পর ২৭ যিলহজ্ব শনিবার তিনি শাহাদাত বরণ করেন। হযরত সোহাইব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু তাঁর নামাযে জানাযায় ইমামতি করেন। হযরত আয়িশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার অনুমতিক্রমে রওজায়ে নববীর মধ্যে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র বাম পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। ইসলামের প্রচার প্রসার, বিস্তৃতি ও সম্প্রসারণে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ ও বাস্তবায়িত কর্মসমূহ ইসলামের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
[সূত্র: তারীখুল খোলাফা: পৃষ্ঠা ১৩২]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীসে আউলিয়া-ই কেরামের মাহাত্ম ও মর্যাদা আলোকপাত হয়েছে। অলীগণের অবস্থা দেখে নবীগণ ঈর্ষা করবেন, তবে এর দ্বারা কোনভাবেই অলীগণ নবীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এরূপ ধারণা করার কোন অবকাশ নেই। হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি মিরাতুল মানাযীহ গ্রন্থ এর ব্যাখ্যায় বলেন, এর অর্থ হবে নবীগণ অলীগণের মর্যাদা দেখে খুশী হবেন এবং তাঁদের প্রশংসা করবেন, কোন কোন ক্ষেত্রে বড়রা ছোটদের বিশেষ অবস্থার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। নবীগণ সবসময় উম্মতের ভাবনায় লিপ্ত থাকেন এটিই নবীদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রকৃত দলীল। আল্লাহর অলীগণ সাধারণ মানুষের মত নন, ইন্তিকালের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ যেভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় আল্লাহ্র অলীগণ তেমন নন। বরং ইন্তিকালের পরও তাঁরা সাধারণ মানুষের উপকার ও কল্যাণ সাধনে সক্ষম। অলীগণ আল্লাহর প্রেমের আগুনে নিজের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ বিলীন করে দিয়ে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়ে অমরত্ব লাভ করে থাকেন। এমন অনেক অলীআল্লাহ্ আছেন যাদের দেহ মৃত্যুর পরও মাটির নিচে অক্ষত অবস্থায় বিরাজ করছে। এ কারণে তাঁদের মাযার পবিত্র ও সম্মানিত।
আল্লাহর অলীদের মর্যাদা বর্ণনায় অসংখ্য হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে তাঁরা খোদা প্রদত্ত মর্যাদায় মহিমান্বিত। বেলায়তের অধিকারী আল্লাহর প্রিয় বান্দা অলীগণ খোদা প্রদত্ত ক্ষমতায় ক্ষমতাবান ও কর্তৃত্বের অধিকারী। নিম্ন হাদীস শরীফে আল্লাহর পুণ্যাত্মা বান্দাদের যথার্থ মর্যাদা ঘোষিত হয়েছে-
عن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله قال من عادى لى وليا فقد اذنته بالحرب- وماتقرب الى عبدى بشئ احب الى مما افترضت عليه وما يزال عبدى يتقرب الى بالنوافل حتى احبه فاذا احببنه كنت سمعه الذى يسمع به وبصره الذى يبصربه ويده التى يبطش بها ورجله التى يمشى بها- (اخرجه البخاارى)
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ্ তা’আলা (হাদীসে কুদসীতে) বর্ণনা করেন, যে লোক আমার অলীর সঙ্গে শত্র“তা পোষণ করে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিই। ফরজ (ইবাদত) আদায় করার দ্বারা বান্দা যতটুকু আমার নৈকট্য অর্জন করতে পারে- তা আর কোন কিছু দ্বারা পারে না। আমার বান্দা নফল ইবাদতসমূহ আদায়ের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জন করে থাকে। এমনকি এক পর্যায়ে আমি তাকে আমার প্রিয়পাত্র করে নিই। যখন তাকে প্রিয়পাত্র করি তখন আমি তাঁর শ্রবণ শক্তি হয়ে যাই যদ্বারা সে শুনে। আমি তাঁর দৃষ্টিশক্তি হয়ে যাই যদ্বারা সে দেখে তাঁর হাত হয়ে যাই যার মাধ্যমে সে ধরে। তার পা হয়ে যাই যদ্বারা সে চলে।
[সূত্র: সহীহ বোখারী, কিতাবুর রিকাক হাদীস: ৬৫০২]
হযরত কাযী আয়ায রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু শিফা শরীফে উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেন বান্দা যখন নিজকে রাব্বুল আলামীনের ইশক্ব ও মহব্বতের আগুনে পুড়ে পুড়ে নিজের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করে দেয় তখন আল্লাহর নূর দ্বারা তাঁর শরীর নূরানী হয়ে যায়। তখন তিনি আল্লাহর নূরের সাহায্যে দেখেন শুনেন, বলেন। তখন তাঁর চলা-ফেরা, উঠা-বসা, দেখা-শুনা, চলন-কথন প্রতিটি পর্যায়ে অনন্য অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র প্রতিভাত হয়। তখন তাঁর সাক্ষাতে আল্লাহর বান্দাদের অন্তরে পরিশুদ্ধ হয় নৈতিক ও চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জিত হয়। তাঁদের সান্নিধ্যে মানুষ আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন হয়, তাঁদের মহব্বত ও সোহবতে মুক্তিকামী সত্যান্বেষী মানুষগুলো সিরাতুল মুস্তাকীম তথা সঠিক পথের সন্ধান লাভে ধন্য হয়। অলীদের পরিচয় প্রদানে তাঁদের বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
عن اسماء بنت يزيد رضى الله عنها قالت سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول الاانبئكم بخياركم؟ قالوا بلى يا رسول الله! قال خياركم الذين اذا اؤوا ذكر الله- (رواه ابن ماجه)
অর্থ: হযরত আসমা বিনতে ইয়াজিদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব যে, তোমাদের মধ্যে উৎকৃষ্ট ব্যক্তি কে? তাঁরা বলেন, হ্যাঁ ইয়া রাসূলাল্লাহ্! তখন তিনি ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উৎকৃষ্ট যাকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। [ইবনে মাযাহ]
আরো ইরশাদ হয়েছে যে-
عن ابن عباس رضى الله عنه قال سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن اولياء الله؟ فقال الذين اذا رؤوا ذكرالله- (رواه النسائى)
অর্থ: হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অলীআল্লাহ’র পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যাদের দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণে এসে যায়। [নাসায়ী শরীফ]
অলী গাউস কুতুব আবদালদের ওসিলায় যমীনে আল্লাহর রহমত ও বরকত নাযিল হয়, বিপদাপদ দুঃখ সংকটে আল্লাহর বান্দাগণ তাঁদের ওসিলায় পরিত্রাণ লাভ করে থাকে। ইমাম তাবরানী উতবা বিন গাযওয়ান থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
اذا ضل حدكم شيئا او اراد عوثا وهو بارض ليس بها انيس فليقل يا عباد الله اغيثونى يا عباد الله اغيثونى فان لله تعالى عبادا لايراهم-
যখন তোমাদের কারো কোন জিনিস হারিয়ে যায় অথবা কেউ রাস্তা ভুলে যায় এবং এরূপ জায়গায় অবস্থান করে যেখানে কোন সহায়তাকারী নেই তখন তিনি এভাবে ডাকবেন- হে আল্লাহর বান্দাগণ আমাকে সাহায্য করুন, হে আল্লাহর বান্দাগণ আমাকে সাহায্য করুন। কারণ আল্লাহর কিছু বান্দা আছেন তারা তাঁদেরকে দেখে না।
[সূত্র: তাকমীলুল ঈমান কৃত: শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রহ.]
মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রকৃত ওলীদের পরিচিতি জানার ও তাঁদের প্রতি আমাদের অন্তরে ভালোবাসা দান করুন। মুসিলম উম্মাহর এই ক্রান্তিকালে ঈমান আক্বিদা সংরক্ষণের প্রত্যয়ে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার তৌফিক নসীব করুন। আ-মী-ন। বেহুরমাতি সৈয়্যদিল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।