রাসূল (ﷺ) অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী
✍ কৃতঃ আল্লামা আজিজুল হক আল কাদেরী (رحمة الله) মুনিয়াতুল মুছলেমীন [১ম খন্ড]

❏ মাসয়ালা: (২৮৩)
وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ
অর্থ: গায়েব বা অদৃশ্যের চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে; তিনি ছাড়া আর কেউই তা জ্ঞাত নয়। 
➥ [আন‘আম: ৫৯]

এ আয়াতে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো থেকে ইলমে গায়েবকে অস্বীকার করা হয়েছে। অর্থাৎ, আল্লাহ ব্যতীত কারো নিকট অদৃশ্যের জ্ঞান নেই। এখানে ইলমে গায়েবকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অন্য থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে। 
এ আয়াতের মর্মার্থ মুফসসিরীনরা দু’ভাবে বর্ণনা করেছেন- 
১.  তাফসিরে কবীরে এসেছে সকল অসীম বস্তুর জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া কারো নিকট নেই। 
২. যে সত্ত্বা সকল সম্ভাবনাময় বস্তুর উপর সাধারণভাবে ক্ষমতাধর তিনি আল্লাহ। অর্থাৎ, ইমাম খাযেন এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, তা দ্বারা উদ্দেশ্য সকল সম্ভাবনাময় বস্তুর উপর একমাত্র তারই ক্ষমতা। 

➠আমার নিকট ঐ ব্যাখ্যাটি উত্তম যা ইমাম শেহাবুদ্দীন আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে ইউসুফ ইবনে মুহাম্মদ যিনি সমীন হালবী নামে প্রসিদ্ধ (মৃত:৭৫৬হি) যিনি তাফসিরে বাহরে মুহীত প্রণেতা ইমাম আবু হায়্যান আন্দালুসীর শিষ্য। তিনি বলেন, এখানে  مفاتيحশব্দটি مفتحএর বহুবচন। যার অর্থ খোলা। অর্থাৎ, তার নিকট ইলমে গায়েব খোলার উপাদান রয়েছে এবং তিনি তার বান্দাহ থেকে যাকে চান ইলমে গায়েব খুলে দেন। তখন তা مفتح মাসদারের বহুবচন হবে। তখন অর্থ দাঁড়াবে মহান আল্লাহর নিকট অদৃশ্য খোলার ব্যবস্থা রয়েছে তিনি তার বান্দাহ থেকে যাকে চান তাকে অদৃশ্য খোলে দেন ।
তখন তো না বোধক হ্যাঁ বোধক হয়ে যায়। যে আয়াত দ্বারা নবী (ﷺ) থেকে ইলমে গায়েবকে অস্বীকার করা হয়, সে আয়াত তার জন্য ইলমে গায়েব প্রমাণের দলীল হয়ে যায়। তখন আয়াতের সার সংক্ষেপ হবে গায়েব খোলার ক্ষমতা আল্লাহর নিকট তিনি যাকে চান খুলে দেন। 
আশ্চর্যের কথা হল, এ আয়াত সকল নবী বিশেষ করে মহানবী (ﷺ) ও আউলিয়া কেরামের জন্য ইলম গায়েবকে প্রমাণ করে। তা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয়; কেননা অন্য স্থানে আল্লাহ রাসূলদেরকে ইলমে গায়েব দেওয়ার কথা বলেছেন; বরং বিভিন্ন হাদিস ও মুফাসসিরীনের মতামত দ্বারা বুঝা যায়, নবী (ﷺ) সাহাবায়ে কেরাম ও অলীদের জন্যও ইলমে গায়েব প্রমাণিত। তাই এ আয়াত দ্বারা যদি গায়েব অস্বীকার করা হয়, তখন দ্বন্দ দেখা দিবে। তাই সুক্ষ্ম দৃষ্টি দিলে পরস্পর বৈপরিত্য দূর হয়ে যাবে এবং একটি আয়াত আরেকটির সমর্থক।
যে সকল আয়াতে ইলমে গায়েবকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে তা দ্বারা ভবিষ্যতের জাতী তথা প্রত্যক্ষ গায়েব উদ্দেশ্য। যা তিনি কাউকে দান করেননি এবং তা অসীম তেমনি যা সকল সম্ভাবনাময় বস্তুকে বেষ্টন করে।
কোরআন ও হাদিস দ্বারা যে সকল ইলমে গায়েব রাসূল ও আল্লাহর অলীদের জন্য প্রমাণিত তা দ্বারা দানকৃত ইলমে গায়েব, অর্থাৎ যে জ্ঞান পরোক্ষ ও অস্বতন্ত্র ও সীমিত। এ পার্থক্য খেয়াল রেখে আয়াতের ব্যাখ্যা করা উচিত। তা-ই ঈমান ও ইসলামের চাহিদা। নতুবা তা হটকারিতার পথ হবে। কেননা; নবী (ﷺ) এর মানক্ষুন্ন করার চিন্তা করা উম্মতের জন্য কখানো উচিত নয়। তার পরিণতি ভয়াবহ।
➠তাফসিরে ইবনে আরবীতে এসেছে, এ আয়াতের অর্থ হল, সকল অদৃশ্যের ভান্ডার তার নিকট রয়েছে। নবী (ﷺ) এর জ্ঞান খোদাপ্রদত্ত্ব। তাই এ আয়াতে নবী (ﷺ) এর ইলমে গায়েবকে অস্বীকার করা হয়নি।

❏ মাসয়ালা: (২৮৪)
قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ. 
অর্থ:হে মুহাম্মদ আপনি ঘোষণা দিয়ে দিন! আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া আমার নিজের ভাল-মন্দ, লাভ-ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়ে আমার কোন অধিকার নেই, আমি যদি অদৃশ্য তত্ত্ব ও খবর জানতাম তবে আমি অনেক কল্যাণ লাভ করতে পারতাম আর কোনো অমঙ্গল ও অকল্যানই আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। আমি শুধু মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদবাহী। 
➥ [আরাফ:১৮৮]

আয়াতে  إِلَّاশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে; যা ইস্তিসনার জন্য ব্যবহার হয়। আরবী গ্রামার মতে তার নিয়মনীতি হল, মুসাল্লামুস সাবুতে তা এভাবে স্পষ্ট করা হয়েছে যে,  ইসতিসনা না বোধককে হ্যাঁ বোধক করে ও হ্যাঁ বোধককে না বোধক করে। অর্থাৎ, ইস্তিসনার শব্দ দ্বারা যদি কোন হ্যাঁ বোধক বাক্যে আসে তখন তাকে না বোধক বানিয়ে দেয় তেমনি তার বিপরীত যদি কোন না বোধক বাক্যের উপর প্রবেশ করে তখন তাকে হ্যাঁ বোধক করে দেবে। এ আয়াতটি না বোধক তাই এখানে ইস্তিসনার শব্দ তাকে হ্যাঁ বোধক করে দেবে।
তাই এ নিয়মনীতির আলোকে অর্থ দেবে যে, আমি আল্লাহর ইচ্ছায় আমি নিজের জানের লাভ-ক্ষতির মালিক হয়।

➠আল্লামা শায়খ আহমদ সাবী বলেন, এ আয়াতে নবী (ﷺ) থেকে লাভ ক্ষতির অস্বীকার অর্থ তিনি তার সৃষ্টিকর্তা নন।
➠মহান আল্লাহর বাণী:
  لَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ 
এখানে নবী (ﷺ) নম্রতা দেখিয়েছেন। 
➠শেখ আহমদ সাবী বলেন, এ আয়াত পূর্বের কথার সাথে মিল নেই; 
➠কেননা এর পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে,
 أن رسول الله صَلّى الله عليه وسلّم لم ينتقل من الدنيا حتى أعلمه الله بجميع المغيبات التى تحصل فى الدنيا و الآخرة فهو يعلمها كما هى عين يقين الخ. 
অর্থ: নিশ্চয় রাসূল (ﷺ) দুনিয়া থেকে যাওয়ার পূর্বে সকল অদৃশ্যের খবর দিয়েছেন যা দুনিয়া ও পরকালে ঘটবে তিনি তা নিশ্চিতভাবে জানতেন। এর উত্তরে আল্লামা সাবী বলেন, তা তিনি নম্রাকারে বলেছেন। তাই আয়াতের ভাব হবে, আমি আল্লাহর আদেশে লাভ-ক্ষতির মালিক হয় এবং তার দানে আমি ইলমে গায়েব জানি।
তাই এখানে অলঙ্কারের শীর্ষ পর্যায়ে গিয়ে খুব সুক্ষ পদ্ধতিতে ইস্তিসনার শব্দ দ্বারা নম্রতার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।

❏ মাসয়ালা: (২৮৫)

وَقَالَ عَلِيٌّ حَدِّثُوا النَّاسَ بِمَا يَعْرِفُونَ أَتُحِبُّونَ أَنْ يُكَذَّبَ اللهُ وَرَسُولُهُ .
➠অর্থ: হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন, তোমরা মানুষের সাথে এ রকম কথা বার্তা বল যা মানুষ বুঝে তোমরা কি পছন্দ কর তা দ্বারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মিথ্যা বলা হয়।

➠এ হাদিসটি ইমাম বুখারী (رحمة الله)-এর ছুলাছিয়াতের অন্তর্ভূক্ত। তার তৃতীয় বর্ণনাকারী একজন সাহাবী। তিনি সাধারণ মুহাদ্দিসীনের বিপরীতে হাদিসের মতন এনেছেন অত:পর সনদ; কেননা তার একটি রাবী মারুফকে ইয়াহইয়া ইবনে মঈন দূর্বল বলেছেন।

তা দ্বারা বুঝা যায়, এমন কাজ যা ভাল তবে তা দ্বারা সাধারণ লোক ফিতনায় পড়ার আশংকা রয়েছে তখন তা থেকে বিরত থাকা উচিত।
অর্থাৎ, এমন কথা যার উপর কূফর ও ঈমান নির্ভর করে না সাধারণ লোক তা বুঝেনা  তা বর্ণনা না করা উচিত। 

➠তাই আরেকটি হাদিসে এসেছে, 
كلموا الناس على قدر عقولهم
অর্থ: মানুষদের সাথে তাদের বুঝ মতে কথা বলা চায়। 

➠তাই বর্ণিত আছে যে,
من لم يعرف أهل زمانه فهوجاهل
অর্থ: যে ব্যক্তি নিজ যুগ সম্পর্কে সচেতন নয় সে অজ্ঞ।
তার কারণ হল, যখন সাধারণ লোকের সামনে এমন অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা হয় যা বুঝার ক্ষমতা তারা রাখে না তখন তারা তাকে ভুল বলবে আর যখন বলা হবে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বলেছেন, তখন আশংকা থাকে যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মিথ্যুক বলবে।

Top