আল্লামা আকবর আলী রেজভী(রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
পরিচয়ঃ আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে তিনি উজ্জল নক্ষত্র ছিলেন। যিনি শরীয়ত ও মারেফাতের অতি উচ্চ মর্যাদাশালী আল্লাহর অলী। তাঁর পারিবারিক সূত্র থেকে কিংবা কোন দালিলিক ভিত্তি থেকে তাঁর জন্মসাল ও তারিখ সম্পর্কে নির্ভর যোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। তাঁর জীবনী প্রকাশে আত্মনিবেদিত দীর্ঘদিন তাঁর সান্নিধ্য পাওয়া মোশাররফ ভুইয়া জানান তাঁর জন্ম হয়েছিল বৈশাখ মাসের এক তারিখ।সর্বশেষ ধারণা করা হয় তিনি হিজরী ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রায় ১২৮০ হিজরী সনে মোজাদ্দেদে জামান, ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী আকবর আলী রেজভী সুন্নী আল ক্বাদেরী মাদ্দা জিল্লুহুল আলী বাংলাদেশের ময়মহনসিংহ জেলার লংঙ্কাখলা গ্রামে শুভাগমন করেন। যিনির পিতা ছিলেন একজন সুযোগ্য আলেম, আল্লামা মাওলানা শহর আলী রেজভী সুন্নী আল ক্বাদেরী এবং মাতার নাম আলিমা আক্তার রেজভী। আল্লামা রেজভী সাহেব হুজুর কেবলা এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের জমিনে আগমন করেন, যখন ইংরেজ শাসন করছিল এই ভারত উপমহাদেশে। মুসলমানদের সমাজে রাসুলে পাকের হাজার হাজার সুন্নাত দাফন করে নতুন নতুন বিদাত চালু করে। এই যুগ সন্ধিক্ষণে তিনি বাতিল ফেরকাদের সাথে মুনাজারা করে হাজার ও মৃত সুন্নাত জিন্দা করেন।
শিক্ষা দীক্ষা: আল্লামা আকবর আলী রেজভী স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় কয়েক বছর পড়া-শুনা করার পর তাঁর পিতা তাঁকে সুদূর দিল্লীতে পাঠিয়ে দেন ইসলামী শিক্ষায় ব্যাপকভাবে শিক্ষিত করে তোলার জন্য। মোশাররফ ভুইয়া জানান আকবর আলী রেজভী প্রথমে দিল্লীর সোবহানিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেন এবং পরে উত্তর প্রদেশের বেরেলীতে মাদ্রাসা-ই মানজুরুল ইসলাম থেকে কামিল পাশ করেন। তিনি তর্কবিতর্ক বিষয়ক বিদ্যা মুনাজারা বিষয়ে গভীর অধ্যায়ন করেন এবং এই শাস্ত্রে তিনি সর্বোচ্চ নাম্বার পান। প্রায় বিশ বছর ধরে ভারত বর্ষের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিলে বক্তৃতা, তর্ক-বিতর্কে (যা বাহাস নামে পরিচিত) তিনি অংশ নেন। তিনি আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খান এর সুযোগ্য ছাত্র ছিলেন। তিনি মারেফাতের জ্ঞান লাভ ও বায়াতে রাসুল গ্রহণ করেন, শাহাজাদায়ে আলা হযরত আলে রহমান, মুফতীয়ে আজম হিঁন্দ মোস্তফা রেজা খাঁন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার পবিত্র হাতে বায়াতে রাসুল গ্রহণ করেন। তিনি মুর্শিদের নিকট কঠোর রিয়াজত ও সাধনা করে অতি উচ্চ স্থানে আসীন হন। তখন উনার মুর্শিদ আল্লামা রেজভী সাহেবকে খেলাফত দান করেন। তিনি অনেক বছর ভারত বর্ষে ইসলাম প্রচার করেন। তারপর, মুর্শিদের হুকুমে বাংলাদেশে এসে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তখন সমসাময়িক বাংলাদেশে কয়েকজন সুন্নী আলেম ছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিল, আল্লামা আবেদ শাহ আল মাদানী, আল্লামা সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা, আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ ছিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলাইহি।
কর্মজীবন: তাবলীগ জামাত তথা ওয়াহাবী মতধারার বিরুদ্ধে সারা জীবনভর যে জেহাদী মনোভাব নিয়ে তিনি কাজ করে গেছেন বেরেলীর শিক্ষা জীবন ছিল তার ভিত্তি।
একসময় দেশে ফিরে এসে তিনি প্রথমে ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ, বোকাইনগরসহ বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। এক পর্যায়ে মাদ্রাসার শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত সংগঠন পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করেন এবং সারাদেশে ওয়াজ মাহফিল করে বেড়ান। সেই সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে তাঁর বিপক্ষ দলের সঙ্গে বাহাস-এ অংশ গ্রহণ করেন।
নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম -কে নিয়ে মিথ্যাচারিতা, নবীর মৌল শিক্ষার বিকৃতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন। গোটাজীবন এ নিয়ে এক মরনপণ লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। ধর্মান্ধ শক্তি তার খুরধার বক্তব্য আর অকাট্য যুক্তির মুখে প্রকাশ্য জনসমুক্ষে যখন বার বার পরাজিত হয়ে আসছিলো তখনি হিংস্রভাবে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বার বার। অস্ত্রের বলে সত্যের শক্তিকে পরাস্ত করার ঘৃণ্য মানসে বিভ্রান্ত শক্তি তাঁর উপর চালিয়েছিল সশস্ত্র হামলা বিভিন্ন সময়। কিন্তু তিনি ছিলেন অকুতোভয় বরাবরই। মহান এই সাধক বাঙালি মুসলমানকে আরবী মুসলমান বানানোর বিকৃত প্রচেষ্টাকে রুখে দেয়ার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর গোটা জীবন। যা অবিস্মরণীয় হয়ে রইবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যুগ যুগ ধরে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে।
হিজরত: মোজাদ্দেদে জামান, ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী আকবর আলী রেজভী সুন্নী আল ক্বাদেরী মাদ্দা জিল্লুহুল আলী হুজুর কেবলা তিনির জন্মস্থান থেকে হিজরত করে নেত্রকোণা জেলাধীন সতরশ্রী গ্রামে এসে বসতি স্থাপন ও ইসলাম প্রচার কেন্দ্র গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তিনির খানাকা স্থাপন করে ইসলাম প্রচার কার্য শুরু করেন।
ইসলাম প্রচার: বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ইসলাম প্রচার করেন। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য স্থান হল কুমিল্লা শহর। তিনি ইসলাম প্রচারের মূল কেন্দ্র হল কুমিল্লা খানকায়ে রেজভীয়া। এখান থেকে তিনি সবচেয়ে বেশি সময় ইসলাম প্রচার করেন। এই কুমিল্লা জেলায় তাঁর কয়েক লক্ষ ভক্ত আশেকান রয়েছে। এক পরিসংখানে দেখা গেছে উনার বাংলাদেশ সহ ভারতবর্ষে প্রায় ১৫,০০,০০০ (পনের লক্ষ) মুরিদান রয়েছে। এছাড়া ও তিনি চট্রগ্রাম, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনী, ব্রাম্মণবাড়িয়া, ঢাকা, সিলেট, হবিগঞ্জ, ময়মহনসিংহ ও নেত্রকোণা সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ভক্ত আশেকান রয়েছে। দেশের বাহিরে ভারত বর্ষেও তাঁর হাজার হাজার ভক্ত আশেকান রয়েছে। তিনি ইসলাম প্রচার কালে বাতেল ফেরকা কর্তৃক ১২ বার আঘাত প্রাপ্ত হয়েছেন। সবচেয়ে আর্শ্চয জনক আঘাত প্রাপ্ত হন, কুমিল্লা জেলার তিতাস নদীতে, কয়েকজন জামাত শিবির কর্মী তিনিকে হাত পা বেঁধে তিতাস নদীতে ফেলে দেন। কয়েক ঘন্টা পরে তিনি নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলেন। তিনি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি এখানে কিভাবে আসলাম। ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনাকে একজন পাগড়ীধারী এক আলেম ব্যক্তি এখানে এনেছেন। পরে তিনি খাজা খিজির কর্তৃক জানতে পারলেন যে, খাজা গরীবে নেওয়াজ, সুলতানুল হিন্দঁ খাজা মাইনউদ্দিন চিশতি উনাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সর্বশেষ তিনি আঘাত প্রাপ্ত হন সিলেটে। একজন তাবলীগের আমীর তিনিকে গাড়ীতে উঠার সময় ছুরি দ্বারা আঘাত করেন। যখন তিনিকে হাসপাতালে নেওয়া হল, ডাক্তার সাহেব বলেন, উনি ২৪ ঘন্টার বেশি সময় বাচঁবেন না। কিন্তু ২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেল, শুধু ২৪ ঘন্টা নয় আজকে ১৪ বছর পার হয়ে গেল, আজ ও তিনি বেঁচে আছেন। পরে ডাক্তার সাহেব জানান, উনি এমন আধ্যাত্মিক ক্ষমতার দ্বারা বেঁচে আছেন, তা কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে কোন দিন সম্ভব নয়। সুবহানাল্লাহ! আল্লামা রেজভী সাহেব হুজুর কেবলা তিনি নিজের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন। এই রকম নজির খুবই কম দেখা যায়।
মুজাদ্দিদগণের তালিকা ও তাদের ভূমিকা
হিজরী প্রথম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ: হযরত উমর বিন আবদুল আজীজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি। জন্ম ১৯ হিজরী, ওফাত ১১২ হিজরী। তিনি তাঁর শতাব্দীর বার বছর পান। খারেজী সম্প্রাদায়ের ষড়যন্ত্র ও ভ্রান্তির মূলোতপাটন করে ইসলামকে পুনঃ রুজ্জীবিত করেন এবং যাবতীয় বাতুলতার অবসান ঘটিয়ে সত্যতে সমুন্নত করেন।
হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর মুজাদ্দিদ: হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাঃ) তাঁর বয়স ৭০ বৎসর ওফাত ২৩০ হিজরী। মুতাজিলা সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত চিন্তাধারা ও বিকিৃত মানসিকতার উচেছদ করেন এবং ‘কুরআন’ সৃষ্ট বিষয়ক ভ্রান্তিপূর্ণ মতবাদের ধুম্রজালকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করেন। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এ শতাব্দিতেই জন্মগ্রহন করেন। কিন্তু তাজদীদে দ¦ীনের খেদমত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) এর সৌভাগ্যে নসীব হয়েছ।
তৃতীয় শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ ইমাম আহমদ নাসায়ী (রহঃ) যিনি জাহ্মিয়া সম্প্রদায়ের বাতিল আক¦ীদা সমূহের মূলোৎপাটন পূর্বক মুজাদ্দিদের উপাধি লাভ করেন। জন্ম ২৭০ হিজরী এবং ওপাত ৩৪০ হিজরী।
চতুর্থ শতাবব্দীর মুজাদ্দিদঃ হযরত ইমাম বায়হাকী (রহঃ) এবং হযরত ইমাম বাকিল্লানী (রহঃ) দু’জন সমসাময়ীক ব্যক্তিত¦ উভয়ে তৃতীয় শতাব্দীর ২০ বৎসর এবং ২৪ বৎসর পেয়েছেন এবং চতুর্থ শতাব্দীর পেয়েছেন যথাক্রমে ৪২ বৎসর এবং ৫৫ বৎসর। তাঁরা রাফেজী সম্প্রদায়ের স্বরূপ উন্মোচন করেন এবং মুসলিম মিল্লাতকে তাদের ভ্রান্ত আক¦ীদা হতে রক্ষা করেন। উপরন্তু তেহ্রান ও লেবাননে ইসলামের ঝান্ডা উড্ডীন করেন।
পঞ্চম শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ ইমাম মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ গাজ্জালী (রঃ) যিনি কদরিয়া সম্প্রদায়ের নাগপাশ থেকে মুসলিম জাতির ঈমান আক্বীদা সংরক্ষন করেন। জন্ম ৪৭০ হিজরী, ওফাত ৫৬০ হিজরী।
ষষ্ঠ শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহঃ) যিনি ফেরকায়ে জহমিয়া এবং গ্রীক দর্শনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষা করেন এবং গ্রীক দার্শনিকদের বাতিল আক্বীদা সমূহকে ইসলামাী দর্শনের অভ্রান্ত ও অখন্ডনীয় যুক্তি নির্ভর তথ্য-তত্ত্ব দ্বারা খন্ডন করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। তিনি পৃথিবী শাশ্বত ও চিরন্তন হওয়ার অমূলক ধারণা ও কুফরী উক্তির খন্ডন করেন।
সপ্তম শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ ইমাম তকী উদ্দিন ইবনে দকী আবদীর (রহঃ)। জন্মঃ ৬৭৫ হিজরী। তিনি হিন্দুস্তানের বহু এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন।
অষ্টম শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ হাফেজ ইবনে হাজ্জাজ আসকালানী (রহঃ)। তিনি ৩৬ বছর বয়সে ৮১৫ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তিনি স্বীয় শতাব্দীর ১৫ বৎসর পেয়েছেন।
নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ ইমাম আল্লামা জালাকুদ্দীন সূয়ূতী (রহঃ)। তিনিও গ্রীক দর্শনের ক্ষতিকর প্রান্তর এবং এ দর্শনের ভ্রান্তির কবল হতে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করেন।
দশম শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ মোল্লা আলী ক¦ারী (রহঃ)। তিনি বাদশা আকবরের দ্বীনে এলাহীর মূলোৎপাটন করেন এবং যাবতীয় বাতিল অপশক্তির প্রতিরোধে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেন।
একাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ হযরত শের আহমদ ফারুকী সেরহিন্দি (রহঃ)। জন্মঃ ৯৭১ হিজরীর ১০ই মহরম, ওফাত ১০৩৪ হিজরীর ২৮ শে সফর। তিনি বাদশাহ জাহাঙ্গীরের শাসন পদ্দ¦তির বিরোধিতা করেন এবং মুসলমানদের সামাজিক কল্যাণ সাধন করেন।
দ্বাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ ইমাম মহিউদ্দিন আওরঙ্গজেব শাহেনশাহে হিন্দ। তাঁর সম্পূর্ণ জীবন ধর্মত্যাগী মুরতাদ খোদাদ্রোহী বাতিল শক্তির মোকাবিলায় অতিবাহিত করেন। জন্মঃ ১০২৮ হিজরী, ওফাত ১১১৭ হিজরী।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ হযরত শাহ্ আব্দুল আজীজ (রহঃ)। জন্মঃ ১১৫৯ হিজরী, ওফাতঃ ১২৩৯ হিজরী।
চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ আ’লা হযরত হাকীমুল উম্মত ইমামে আহলে সুন্নত হযরত শাহ মাওলানা আহমেদ রেযা খান ফাজেলে বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি)। জন্মঃ ১০ই শাওয়াল ১২৭২হিজরী, ওফাতঃ ২ শে সফর ১৩৪০ হিজরী। এ হিসেবে তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর ২৮ বৎসর ২ মাস ২০ দিন পেয়েছেন এবং চতুর্দশ শতাব্দীর ৩৯ বৎসর ১ মাস ২৫ দিন পেয়েছেন।
পঞ্চাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ মোজাদ্দেদে জামান, ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী আকবর আলী রেজভী সুন্নী আল ক্বাদেরী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। জন্মসালঃ ১২৮০ হিজরী, ওফাত শরীফঃ ১৪৩৬ হিজরী। তিনি বাতেল ফেরকার বিরুদ্ধে সারা
জীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বিশেষ করে তাবলীগ জামাত, কাদিয়ানী সম্প্রদায়, জামাতে ইসলামী ও বাতেল ফেরকার ইসলাম বি’দংশী আকিদা থেকে সাধারণ মুসলমানদের রক্ষা করেছেন।
আল্লামা রেজভী সাহেব হুজুর কেবলার গ্রন্থাবলী পর্যালোচনা:
মোজাদ্দেদে জামান, ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী আকবর আলী রেজভী সুন্নী আল ক্বাদেরী মাদ্দা জিল্লুহুল আলী। তিনি প্রায় সাড়ে চারশত কিতাব রচনা করেন। এক একটি কিতাবের পরিধিও ছিল উল্লেখ্যযোগ্য। তাফসীরে রেজভীয়া সুন্নীয়া ক্বাদেরীয়া এবং ঈমানভান্ডার বিশখন্ড তার উজ্জল প্রমাণ।
তাফসীরে রেজভীয়া সুন্নীয়া ক্বাদেরীয়া: কোরআন মাজিদের প্রামানিক অনুবাদ ও তাফসীর। তিনি প্রত্যেকটি আয়াতের পৃথক পৃথক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। যাতে যে কোন বিষয়ে সহজে জ্ঞান লাভ ও গবেষণা করা যায়। তিনি সহজ ও সাবলীল ভাষায় কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী তাফসীরে রেজভীয়া সুন্নীয়া ক্বাদেরীয়া রচনা করেন।
ঈমানভান্ডার বিশখন্ড: তিনির সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থ হল ঈমানভান্ডার বিশখন্ড। এই গ্রন্থে তিনি হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম শান ও মান বিশেষভাবে উল্লেখ্য করেছেন। এই গ্রন্থের মত অতি মহামূল্যবান রচনাবলী খুবই পাওয়া যায়।
আদিল্লাতুচ্ছামা: ইসলামী গান বাজনা বা আধ্যাতিœক ছেমার আয়োজন করা কত রহমত ও বরকতের কাজ তা এই গ্রন্থের মধ্যে বিবরণ রয়েছে। রাসুলে পাকের সময় থেকে আজ পর্যন্ত যত আউলিয়ায়ে কেরাম দুনিয়াতে আগমন করেছেন, সবাই ইসলামী গান বাজনা বা আধ্যাতিœক ছেমার আয়োজন করেছেন। সবাই একে জায়েজ বলে ঘোষণা করেছেন। তার প্রমাণ এই গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে।
দিদারে নূরে খোদা: তিনির দিদারে নূরে খোদা উল্লেখ্যযোগ্য একটি আমলের কিতাব। এই কিতাবে কিভাবে রাসুলে পাকের দীদার লাভ করা যায় এবং ১৬টি নফল নামাজের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রয়েছে।
নির্ভয় বাণী বা মারেফাত ভান্ডার: এই কিতাবে এলমে মারেফাত, এলমে হাকিকত, পীর মুরিদি, অলী গণের শান ও মান আজমত বিশতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে আউলিয়াগণের জন্য কি বিশেষ অফার সমূহ রেখেছেন, তা এই কিতাবে রয়েছে।
আদাবুল আযান: আযান একটি গুরুপ্তপূর্ণ ইবাদত। বর্তমানে আযান নিয়ে ফেতনা ফাসাদ দেখা দিয়েছে। এই আযান সর্ম্পকে সকল ফেতনা ফাসাদকে উপেক্ষা করে একটি পূর্ণাঙ্গ কিতাব রচনা করেন।
কালিমায়ে ঈমান ও কুফর: কোন কোন কথা বার্তার দ্বারা কুফুরী হয়, ঈমান বরবাদ হয়ে যায়, এই সকল বিষয়ে সকল ঈমানদার মুসলমান জানা একান্ত কর্তব্য। এই বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কিতাব রচনা করেন।
জাহেরী ও বাতেনী ঈমানের পরিচয়: ঈমান কি? ঈমান কাকে বলে? ঈমানের জাহেরী ও বাতেনী পরিচয় দিয়েছেন উক্ত কিতাবে। উক্ত কিতাবটি ঈমানের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি কিতাব।
বাহাছ ও মোনাজারা: বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাতেল ফেরকাদের সাথে বাহাছ ও মোনাজারা হয়েছে। সকল বাহাছেই তিনি জয়ী হয়েছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ্য যোগ্য হল ”বদরপুরের বাহাস” এবং নেত্রকোণার শহরের বাহাস। ১৯৭৭ সালে এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখে বদরপুর বাজার মাদ্রাসার প্রাঙ্গণে তাবলীগ জামাতের সাথে মোনাজারা হয়। উক্ত মোনাজারায় তাবলীগ জামাত শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয় এবং উশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, পরে স্থানীয় লোকেরা তাদেরকে হালকা উত্তম মধ্যম দেয়। উক্ত বাহাছের সভাপতি ছিলেন তখনকার চেয়ারম্যান মো: মনিরুল হক ৯নং মাইজখার ইউনিয়ন পরিষদ। ১৯৯৭ সালে নেত্রকোণা সদরে জেলা অফিসে মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলীপুরীর সাথে বাহাছ হয়। উক্ত বাহাছে নুরুল ইসলাম ওলীপুরী ও শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। এছাড়াও ব্রিটিশ আমলে রংপুরে খ্রিস্টান পাদ্রীর সাথে বাহাছ হয়। উক্ত বাহাছে খ্রিস্টান পাদ্রী ও শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয় এবং সে বাংলাদেশ ছেড়ে একবারে চলে যায়। কাদিয়ানিদের সাথে ও বাহাছ হয় তিনি ঐ বাহাছে ও জয়ী লাভ করেন।
মহিউসুন্নাহ: মৃত সুন্নাত জিন্দাকারী। আল্লামা রেজভী সাহেব হুজুর কেবলা অসংখ্য মৃত সুন্নাত জিন্দা করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হল, মসজিদে জুমার দিন দ্বিতীয় আযান দরজায় দিতে হবে, কাঠের তৈরী মিম্বার, কালো রংঙের পাগড়ির ব্যবহার, কালো টুপির ব্যবহার, কবরের পাড়ে আযান, বিবাহ শাদীতে ইসলামী গান বাজনা ও প্রচার করা, আধ্যাতিœক ছেমা, একাধিক মুয়াজ্জিনে আযান প্রদান করা, মসজিদের ভিতরে বিবাহ কার্য সমাধান ইত্যাদি। সর্বোপরি, এই বাংলার জমিনে তাজা রক্তের বিনিময়ে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম উদযাপন করেছেন।
হুজুর কেবলার কেরামত সমূহ:
১) মুরিদের মৃত্যুর সময় সাহায্যে: চান্দিনা উপজেলার মধ্যমতলা গ্রামের নিবাসী জনাব রেজভী মুহাম্মদ মোশারফ হোসেন ভূইয়া উনার ”সিরাজ্বাম মুনিরা” ২৪৯ পৃ: উল্লেখ করেন,”আমার মরহুম আব্বাজান মুর্শিদে বরহক গাজী হযরতুল আল্লামা আকবর আলী রেজভী সুন্নী আল কাদেরী এর হাতে বায়াতে রাসুল গ্রহণ করেন। ইন্তেকালের কিছু আগে আব্বা আম্মাকে বললেন,”মুশারিটা টাঙ্গিয়ে দাও, আমি হুজুরের সাথে কথা বলব।” ঘরে আম্মা এবং একমাত্র বোন ছাড়া আর কেউ ছিল না। আব্বার কথা শুনে আম্মা হকচচিয়ে উঠলেন। প্রকৃত রহস্য কি তা উপলব্ধি করতে আম্মা মশারির বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিলেন। তখন আব্বা আম্মাকে পুনরায় বললেন, তুমি উঁকি দিয়ে কি দেখছো, ঘরে যাও আমি না বলছি হুজুরের সাথে কথা বলব। আম্মা সড়ে গেলেন। আব্বার ইন্তেকালের পরে রেজভী সাহেব হুজুর কেবলা কে ঘটনা বর্ণনা করে জানতে চাইলাম আব্বার সাথে কথা হয়েছে কিনা। উত্তরে হুজুর কেবলা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ কথা হয়েছে। এতে প্রমানিত হল যে, মুরিদের ইহত্যাগের কালে পীর সাহেবের সাথে মুরিদের কথা হয় এবং সাহায্যে করেন। আব্বাকে দাফনের পরে সুন্নাত অনুসারে কবরের উপর খেজুরের ডালা লাগানো হয় এবং ডালা টি প্রায় ৬মাস জীবিত থাকে। এই আশ্চর্য ঘটনাটি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে তা দর্শন করে। পরবর্তীতে কে বা কাহারা তা তুলে ফেললে তা শুকিয়ে যায়।
২) নিঃসন্তানকে সন্তান দান: আমি লেখক ডা: রেজভী শরীফুল ইসলাম একদিন খানকায়ে রেজভীয়া সুন্নীয়া, খিরাসার মোহনপুরে বসা ছিলাম। তখন এক বন্ধা মহিলা এসে আল্লামা রেজভী সাহেব হুজুর কেবলাকে কদমবুছি করে। তারপর, ঐ মহিলা বলল, বাবা আমি নি:সন্তান, আমার কোন সন্তান নেই। আপনি আল্লাহর কাছ থেকে আমাকে একটি সন্তানের ব্যবস্থা করে দিন। তখন মুর্শিদ কেবলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে তার আযলনামা দেখে নিলেন। দেখলেন কোন সন্তান নেই। তোমার তো কোন আযলনামায় সন্তান দেখা যাচ্ছে না। ঐ মহিলা বলল, আমারতো সন্তান না থাকার কারণেই তো আপনার নিকট আসা। তখন মুর্শিদ কেবলা বললেন, যাও, তোমাকে তিনটি সন্তান দান করলাম। তোমার প্রথম সন্তানের নাম হল মুহাম্মদ। ঠিক একবছর পরে ঐ মহিলা কোলে একটি পুত্র সন্তান নিয়ে খানকায় শরীফে এসে হাজির হল। সুবহানাল্লাহ! এভাবে অসংখ্য নি:সন্তানকে সন্তান দান করেছেন তিনি।
৩) মৃত্যুর হাত থেকে জীবন দান: আমাদের খিরাসার মোহনপুরে এক ভাই ছিল, উনার নাম হল আবুল হাসেম রেজভী। উনি ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত। তখন তিনি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি আছে। তখন উনি মুর্শিদ কেবলার শরণাপূর্ণ হলেন। তখন মুর্শিদ কেবলা বলেন, তোমার কোন ভয় নেই। যাও তুমি এই তাবিজ টুকু পানিতে মিশিয়ে খাবে ইনশাআল্লাহ! আল্লাহ তোমার রোগ মুক্তি করে দিবেন। দেখা গেল এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। আজ ও তিনি আমাদের মাঝে প্রায় ১৫ বছর হয়ে গেল, তিনি সুস্থ সবল ভাবে বেচেঁ রয়েছেন। আমাদের আরেক ভাই ছিল নারায়গঞ্জ নিবাসী মো: সামছুল হক রেজভী। উনি হাসপাতালের মধ্যে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। এদিকে মুর্শিদ কেবলা উনার হুজরা মোবারকে বসা ছিলেন। উনি দেখলেন, খাজা খিজির আলাইহি চ্ছালাম উনার দরজায় দাড়ানো। খাজা খিজির আলাইহি চ্ছালাম বলেন, আপনার এক মুরিদ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। আপনি তাকে সাহায্যে করুন। তখন মুর্শিদ কেবলা তার জন্য দোয়া করলেন এবং উনার মেজো ছেলে শাহাজাদায়ে সিরাজুল ইসলাম রেজভী সাহেবকে পাঠিয়ে সুসংবাদ দিলেন যে, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘ হায়াত দান করেছেন। পরে দেখা গেল যে, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন।
৪) কন্যা সন্তানকে পুত্র সন্তানে পরিণত: কুমিল্লা কুতুবনগর খানকায়ে রেজভীয়ার পাশে এক প্রতাপশালী লোক বসবাস করত। তার ছয়টি কন্যা সন্তান ছিল। সপ্তমবার যখন তার স্ত্রী আবার গর্ভবতী হল সে এন্ডোসকপি করে দেখল যে, তার আবার কন্যা সন্তান হবে। সে হতাশ হয়ে আল্লামা রেজভী সাহেব হুজুর কেবলার নিকটে আসেন এবং সব কিছু খুলে বলেন। হুজুর কেবলা বলেন, দেখ আল্লাহর মর্জি মোতাবেক তোমার কন্যা সন্তানই হবে।সে বলল, আপনি একটি ব্যবস্থা করুন, আপনি আল্লাহর দোয়া করুন, যেন আমাকে একটি পুত্র সন্তান দান করেন। আমি ওয়াদা করতেছি যে, আমার পুত্র সন্তান হলে আমি গরু জবাহ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের লোকজনকে খাওয়াবো এবং আমি স্বপরিবারে আপনার হাতে বায়াতে রাসুল গ্রহণ করবো। তখন আল্লামা রেজভী সাহেব হুজুর কেবলা বলেন, যাও আমি দোয়া করছি, তোমার স্ত্রীর গর্ভের যে সন্তান আছে, তা ছেলেতে পরিণত হবে। তবে, সে যে মেয়ে থেকে ছেলে হবে তার মাঝে কিছু মেয়েদের নির্দশন থাকবে। যখন তার স্ত্রী সন্তান প্রসব করল, তখন উপস্থিত লোকেরা দেখতে পেল যে, তার একটি ছেলে হয়েছে। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে যে, কেউ তার মেয়ে লিঙ্গ এর মাঝে ছেলেদের লিঙ্গ লাগিয়ে দিয়েছে। সুবহানাল্লাহ! আমার মুর্শিদ কেবলা যাহা বলেছিলেন তা যেন হুবহু মেলে গেল। এটাই হচ্ছে আল্লাহর অলীদের আল্লাহর কুদরতী ক্ষমতা।
৬) কুতুব নিয়োগ দেওয়ানে ওয়ালাঃ কুমিল্লা জেলাধীন সদর থানার কোটবাড়ী এলাকায় এক পাগলা বসবাস করত। সে কেবল রাস্তায় রাস্তায় ঘুরা ফেরা করত। মানুষের সাথে একদম মিশতো না। একদিন সে বৈদ্যুতিক খুঁটির উপরে উঠে ১১ হাজার ভোল্টেজ তারের মধ্যে হাত দিয়ে কথা বলছে আর হাসতেছে। লোকজন এসে পাগলাকে বলল, হে মিয়া আপনি ঐখানে কি করছেন। আপনিতো মারা যাবেন! পাগলা নিচে নেমে এসে বলল, আমি ঐখানে আকাশ বাণী পড়তে গিয়ে ছিলাম। পাগলার কথার মানি বা কথার অর্থ কেউ বুঝল না। এভাবে তাকে অনেক দিন দেখা গেছে। একদিন আল্লামা রেজভী সাহেব হুজুর কেবলা যখন ঐ এলাকায় তশরীফ আনলেন। তখন দেখা গেল ঐ পাগলা হুজুর কেবলার কদমে পড়ে রয়েছে, আর বলতেছে আপনি একটি কিছু করুন। তখন হুজুর কেবলা একটি কাগজে কিছু লিখলেন এবং তাকে প্রদান করলেন। সে হাসি মুখে কাগজ নিয়ে বের হয়ে গেল কিন্তু তাকে আর কখনো ঐ এলাকায় আর দেখা যায় নি। পরে হুজুর কেবলার মারফত জানা গেল যে, ঐ লোকটি কোন সাধারণ লোক ছিল না, তিনি একজন কুতুব ছিলেন।
৭) কঠিন বিপদের সময় সাহায্যঃ সেই ১৯৭৫- ৭৬ সালের কথা একদিন নেত্রকোণা জেলার ডিসি সাহেব কলমাকান্তার দিকে যাবেন। সে আল্লামা রেজভী সাহেব হুজুর কেবলা কে খুবই শ্রদ্ধা করত। সে কলমাকান্তা যাওয়ার পথে হুজুর কেবলার হুজুরাতে এসে সাক্ষাত করলেন এবং আসার উদ্দেশ্যের কথা জানালেন। হুজুর কেবলা তাকে দোয়া করলেন। তারপর ডিসি সাহেব গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলেন। যখন তিনি কলমাকান্তা পাহাড়ের উপর যাচ্ছিলেন হঠাৎ করে, গাড়ী ব্রেক ফিল হয়ে পাহাড়ের খাদে পড়ে গেল। তখন তিনি দেখলেন যে, আল্লামা রেজভী সাহেব হুজুর কেবলা তিনি কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে তাকে উদ্ধার করছেন। ঐ এলাকা ছিল জনমানব হীন এলাকা। কোন লোক জন ছিল না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যে, গাড়ী দুর্ঘটনার সময় ড্রাইভার মৃত্যুবরণ করেন। পরে ডিসি সাহেব এসে হুজুর কেবলার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এবং ঐ এলাকায় পাকা সড়ক ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেন।
৮) মেঘের উপর কর্তৃত্বঃ একদিন আমি ডাঃ রেজভী শরীফুল ইসলাম রেজভীয়া দরবার শরীফে অবস্থান করছিলাম। তখন আমাদের দরবার শরীফে একটি অনুষ্ঠান হবে, আয়োজন করতেছিলাম। তখন ছিল বর্ষাকাল। আমাদের আয়োজন প্রায় শেষ হওয়ার পথে এবং লোকজন ও আসার সময় হয়ে গেছে। তখন আকাশে এমন কালো মেঘ আর্বিভূত হল। আমি কখনো এরকম মেঘমালা দেখিনি। মনে হল যে, এইমাত্র বৃষ্টি হবে। তখন খাদেম সাহেব হুজুর কেবলার নিকট গিয়ে আরজ করলেন যে, বাবা আমরাতো আয়োজন তো এই পর্যায়ে আসে লোকজন ও আসার সময় গেছে। এখন তো বৃষ্টি যেভাবে আসতেছে, মনে হয় আয়োজন তো পন্ড হয়ে যাবে। তখন হুজুর কেবলা বলেন, দেখ আল্লাহর মর্জি, তিনি ভাল জানেন। তারপর ও খাদেম বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। তখন তিনি হাত উঠিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন। মুহুর্তের মধ্যে আকাশ পরিস্কার হয়ে গেল। কোথায় কোন বৃষ্টির আবাস পাওয়া গেল না। সুবহানাল্লাহ!
৯) অপূর্ব ক্ষমাঃ আল্লামা রেজভী সাহেব হুজুর কেবলা বাংলার জমিনে নিজের শরীরের বহু রক্তের বিনিময়ে ইসলাম প্রচার করেন। এই দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাসে খুবই কমই দেখা যায়। ১৪২৪ হিজরীতে তিনি সিলেটের সীমান্ত এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে গেলেন। ওয়াজ মাহফিল শেষে যখন বাড়ি ফিরছিলেন, তখন গাড়িতে উঠার সময় এক তাবলীগের কর্মী তিনিকে ছুরি দ্বারা আঘাত করেন। ঐ তিনি কাউকে কিছু বলেন না। কিছু দুর যাওয়ার পর খাদেম কে বলেন, দেখ বাবা আমার এই জায়গায় কেমন যেন লাগতেছে। তখন খাদেম দেখলো যে, রক্ত গড়িয়ে পড়তেছে। তখন তাড়াতাড়ি সিলেট সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। ডাক্তার সাহেব বলেন, তিনি ২৪ ঘন্টার বেশি আর বাচঁবেন না। উনাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে হস্তান্তর করা হয়। ঐ ডাক্তার ও একই কথা বলেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, আল্লাহর রহমতে আজকে ১২ বছর তিনি বেচেঁ আছেন। ডাক্তার সাহেব বলেন, উনি কোন আধ্যাতিœক শক্তির ধারা বেঁচে আছেন। ঘটনার কিছুদিন পর এক ব্যক্তিকে খুবই মুমূর্ষ অবস্থায় রেজভীয়া দরবার শরীফে কয়েক জন লোক এসে হাজির হয়। তারা হুজুর কেবলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। হুজুর কেবলা তাদেরকে সোহাগের কোলে আদর করলেন এবং ক্ষমা করে দিলেন। যখন তারা দরবার শরীফ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। তখন হুজুর কেবলা বলেন, এই লোকটি কে তোমরা চিন ? সবাই বলল না। তিনি বলেন, এই লোকটি ঐ ব্যক্তি যে আমাকে সিলেটের জমিনে আঘাত করে ছিল। আজকে সে মুমূর্ষ অবস্থায় আমার কাছে এসেছে। কিন্তু আমি তার জন্য বদদোয়া করিনি বরং মাগফেরাত কামনা করেছি, আল্লাহ তাকে যেন মাফ করে দেন। আমিন ! এই রকম অপূর্ব ক্ষমা খুবই দেখা যায়। যে ব্যক্তি নিজেকে মৃত্যুর দুয়ারে ফেলে দেয়, তাকে হাতের নিকটে পেয়ে ও প্রতিশোদ নিলেন না বরং তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
দুনিয়া থেকে পর্দা গ্রহণের বেলায় কারামাতঃ মোজাদ্দেদে জামান, ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী আকবর আলী রেজভী সুন্নী আল ক্বাদেরী মাদ্দা জিল্লুহুল আলী হুজুর কেবলার দুনিয়া থেকে পর্দা করার আগে জলন্ত কারামত প্রকাশ পেয়েছে। “কারামাতুল আউলিয়াই হাক্কোন” (আকাইদে নছফী, আল্লামা সাদুদ্দিন তাফতাজানি রহঃ) অর্থাৎ অলি আল্লাহরগনের কারামত সত্য।
১) তিনি আগেই বলতেন যে, আমি রবিবারে পর্দা করবো, ঠিকই তিনি রবি বারে পর্দা করেছেন।
২) তিনি পর্দা করার আগের দিন,অর্থাৎ শনিবার দিন, তিনির নাতি মুফতি কুদ্দুস রেজভী, মুহাম্মদ রেজভী, মাওলানা বদরুল আমিন রেজভী, সহ আরো অনেকেই ছিল তাদেরকে ডাকিয়া বলিলেন, তোমরা শোন আগামি কাল ঈদের দিন। আর তোমরা খাসী ও আবাল কুরবানী দিও না। আর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর সুন্নতকে শক্ত ভাবে আকড়ে ধরবে।
৩) তিনি পর্দা করার আধ ঘন্টা আগেই বলে দিলেন যে, আমি আধ ঘন্টার ভিতরে পর্দা করবো, ঠিকই তিনি আধ ঘন্টার ভিতরে পর্দা করলেন।
৪) তিনির গোসল করাইলেন আল্লামা মুফতী উহিদুর রহমান রেজভী ও আল্লামা গাজী মান্নান জিহাদী , মুফতী রমজান আলী রেজভী ও পাশে ছিলেন। যখন বাবা কে গোসল দেওয়া হয় তখন বাবাজান মুখ মোবারক থেকে একটি উফ্ শব্দ বের হল,এবং বুঝা যায় যে তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে রহিল। নিঃসন্দেহে তিনি জিন্দা অলি, তখন বাবাজান কে তাড়াতাড়ি করে গোসল করানো হল। এই ঘটনা গুলো মান্নান জিহাদী কসম করে জানাযার পূর্বে মাইক দিয়ে বলিলেন এবং মুফতী উহিদুর রহমান রেজভী ও মাইক দিয়ে বলিলেন।
৫) আল্লামা গাজী আকবর আলী রেজভী বাবাজান কেবলার জানাযাই উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় সুন্নী আন্দোলনের মহান ইমাম, ইমাম হায়াত আলাইহে রাহমা, তিনি মাইক দিয়ে আলোচনায় বলিলেন- আল্লামা রেজভী সাহ হুজুর কেবলার নিকট আমরা সমগ্র সুন্নি মিল্লাত ঋণী। তিনি যা বলতেন সব কোরআন ও হাদিস থেকে বলিতেন।
৬) আল্লামা গাজী আকবর আলী রেজভী, তিনির জানাযায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন এসে অংশ গ্রহণ করেন। এবং ভারত থেকে ও অনেকেই এসে জানাযায় অংশ গ্রহণ করেন।
৭) তিনির জানাযায় কয়েক লক্ষ মানুষ হয়েছে।
৮) আল্লামা গাজী আকবর আলী রেজভী দুনিয়া পর্দা করার একদিন আগ থেকে, পর্দা করার পর জানাযার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত অনবরত বৃষ্টি আর বৃষ্টি ছিল, যখন তিনার জানাযার সময় হল তখন বৃষ্টি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। এটা কত বর জলন্ত কারামত, বৃষ্টি থাকলে মানুষ গুলো জানাযা করতে পারতো না।
৯) হুজুর কেবলা দুনিয়া পর্দা করলেন ৩০শে আগষ্ট ২০১৫ ইং, রোজ: রবিবার, সকাল ১০ ঘটিকা। ১৫ই ভাদ্র ১৪২২ বঙ্গাব্দ, ১৪ই জিলকদ ১৪৩৬ হিজরী।
১০) তিনির গোসল হচ্ছে রবিবার দিবাগত রাত্রে ৩’টার সময়। তিনির ১ম জানাযা হচ্ছে সোমবার বিকাল ২ টার সময়, ২য় জানাযা ৩ টার সময় ৩য় জানাযা ৩টা ৩০ মিনিটে। প্রথম জানাযা নামাজ পড়ালেন তিনির বড় ছেলে বর্তমান গদ্দীনিষিন পীর কেবলা আল্লামা ছদরুল আমিন রেজভী, দ্বিতীয় জানাযা নামাজ তিনির নাতি মুফতী আবু ছাদেক রেজভী, তৃতীয় জানাযা নামাজ পড়ালেন তিনির মেজু ছেলে আল্লামা ডাঃ সিরাজুল আমিন রেজভী সুন্নী আল ক্বাদেরী।
রওজা শরীফঃ মোজাদ্দেদে জামান, ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী আকবর আলী রেজভী সুন্নী আল ক্বাদেরী মাদ্দা জিল্লুহুল আলী উনাকে রেজভীয়া দরবার শরীফের প্রাঙ্গণে শেষ ইচ্ছাকৃত অনুযায়ী উনার মাজার শরীফ চির শয্যায় শায়িত আছেন।
আল্লাহ পাক আমাদের প্রাণ প্রিয় মুর্শিদ কেবলা মোজাদ্দেদে জামান, ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী আকবর আলী রেজভী সুন্নী আল ক্বাদেরী মাদ্দা জিল্লুহুল আলী বাবাজান কেবলার ফায়েজ তাওয়াজ্জু ও মোহাব্বৎ জিয়ারত আমাদের কে নছীব করুন, আমিন।
বর্তমান সংলাপের মুখোমুখি আল্লামা আকবর আলী রেজভী সাহেব হুজুর কেবলার বড় সন্তান আল্লামা ছদরুল আমিন রেজভী সুন্নী আল ক্বাদেরীঃ
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তিনি চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটটা বা এই দিনটার আগে পরের ঘটনাবলী কিংবা কবে থেকে তিনি অসুস্থ ও কবে ঢাকায় নিলেন একটু শুনতে চাচ্ছি।
উত্তরঃ তাঁর অগণিত ভক্ত ছিল সারা দেশেই। বেশ কিছুদিন বিছানায় থাকা অবস্থায় তিনি সবসময় তাদের নিয়েই চিন্তা করেছেন। বিভিন্ন জায়গায় মিলাদ মাহফিলে বক্তব্য রেখেছেন। শেষের দিনগুলোতে হুইল চেয়ারে বসেও বক্তব্য করেছেন। চলে যাওয়ার দুই দিন আগে তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তাঁর সম্ভাব্য শিক্ষাজীবন সম্বন্ধে বলুন।
উত্তরঃ তাঁর তো সার্টিফিকেট কামিলেতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট গোল্ড মেডেল ছিল। ফালাসিফাতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ছিলেন তৎকালীন ভারতে।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ কোথায় এটা?
উত্তরঃ ‘বেরেলিয়া শরীফ দিল্লি’ থেকে। আস্তে আস্তে ওই সার্টিফিকেটগুলো বিলুপ্ত বা হারিয়ে যায় বা সংরক্ষিত নাই আমাদের কাছে। হয়তো অন্য কারো সংরক্ষণে থাকতে পারে।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তিনি নিজে কখনো বলেন নি যে সম্ভাব্য কোন সময়টায় তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন ?
উত্তরঃ এমনি সবাই আলোচনা করে যে, পৃথিবীতে প্রায় ১৫০ বছর তিনি ছিলেন।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তাঁর বাবা অর্থাৎ আপনার দাদার নাম কি?
উত্তরঃ মরহুম মৌলবি শহর আলী রেজভী।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ মায়ের নাম কি ?
উত্তরঃ আলীমা আক্তার রেজভী।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তাঁরা ক’ ভাই বোন ?
উত্তরঃ তাঁরা ছিলেন ৮ ভাই বোন। বোন ছিলেন একজন। আমার বাবা ছিলেন সপ্তম।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তাঁর জন্ম কোথায়?
উত্তরঃ গৌরিপুর থানার লংকাখোলা গ্রাম, ময়মনসিংহ জেলায়।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ আপনার আম্মার নাম কি?
উত্তরঃ মোছাম্মত রাবেয়া আক্তার রেজভী। তাঁদের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানায়। আমার নানা হচ্ছেন কারী মঈনুদ্দিন ভূইয়া। ১২ ভূইয়ার এক ভূইয়া ছিলেন, তাঁরা জমিদার বংশ।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ আপনার আম্মা চলে গেছেন কত দিন আগে?
উত্তরঃ তিনি চলে গেছেন ১৭ বছর চলতেছে।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ আপনারা ক’ভাই বোন?
উত্তরঃ আমরা তিন ভাই চার বোন। আমাদের এক ভাই অন্য তরিকাপন্থী, সে আমাদের থেকে আলাদা থাকে। আমার আব্বার মতের সাথে তার মত তেমন মিলতো না ।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ আপনার আব্বার শৈশব কৈশোরকালে পড়াশুনা সম্পর্কে কতদূর তথ্য আছে?
উত্তরঃ তিনি মাদ্রাসা লাইনে পড়াশোনা করেছেন। তিনি গৌরিপুর থেকে প্রতিদিন ১৭ মাইল হেঁটে গিয়ে ক্লাস করতেন। আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন। ভারতের বেরেলিয়া শরীফ থেকে কামিল করেছেন। পড়াশুনা শেষ করে এরপর তিনি ফিরে আসেন।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তিনি পেশাগতভাবে কি ছিলেন?
উত্তরঃ পেশাগত ভাবে তিনি ছাত্র জীবন থেকে খুব ভাল বক্তা ছিলেন। ঈশ্বরগঞ্জ, বোকাইনগরসহ বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ইসলামপুরে ২৫ বছর প্রখ্যাত মোহাদ্দেস ছিলেন, হাদিস-কুরআন পড়িয়েছেন।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ আপনি কি তাঁকে শিক্ষকতা করা অবস্থায় দেখেছেন?
উত্তরঃ আমরা ছোট বেলায় যখন দেখেছি তখন তিনি সারা বছর মিলাদ মাহফিল নিয়ে ছিলেন সবসময়। এক বছর আগে থেকেই প্রতিটি কাজে তাঁর ডায়রী করা থাকত এবং তাঁর মাহফিলে সবচেয়ে বেশি মানুষ হতো। লক্ষ লক্ষ মানুষ।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তিনি তরিকার দিকে কিভাবে গেছেন বলে আপনারা জানেন ?
উত্তরঃ বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় মোজাদ্দেদ আলা হযরত আহমেদ রেজা খানের তিন ছেলে। এই তিন ছেলেই ছিলেন প্রখ্যাত মোজাদ্দেদ। মেজ ছেলে হযরত মোস্তফি রেজা খান ছিলেন আমার আব্বার পীর সাব। তাঁদের তরিকা হলো ক্বাদরিয়া তরিকা। এখান থেকে তিনি এই তরিকা গ্রহণ করেছেন। আলা রেজা খানের যারা ভক্ত তাদের রেজভীয়া উপাধি দেয়া হয়। রেজা খান থেকে রেজভীয়া। রেজভী মানে হলো আল্লাহ যাদের উপর রাজি। রেজভী হলো আমাদের উপাধি। ওখান থেকে খেলাফত নিয়ে আমার আব্বা আসলেন।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তিনি কি কি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছেন?
উত্তরঃ তিনি কিশোরগঞ্জ গাফুরিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এরপর আমাদের ‘রেজভীয়া দরবার শরীফ, রেজভীয়া দাখিল মাদ্রাসা ও এতিম খানাও তাঁর প্রতিষ্ঠা। তিনি আরও অনেক প্রতিষ্ঠান করেছেন। হাফিজি উল কারিয়ানা মাদ্রাসা, প্রস্তাবিত আলিম মাদ্রাসা এমপি ভুক্ত দাখিল মদ্রাসাও তাঁর প্রতিষ্ঠা।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তিনি কতগুলো দরবার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন?
উত্তরঃ ৩ হাজারের উপরে হবে সংখ্যা।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ ধর্মীয় সংগঠনের সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা কোথায়?
উত্তরঃ ধর্মীয় সংগঠন বলতে আমরা সুন্নী জামাত কিন্তু পদবীর ক্ষেত্রে তিনি এর চেয়ারম্যান বা অন্য কোন পদেই থাকতেন না, তিনি এর উর্ধ্বে থাকতেন, তাঁর সময়ও ছিলনা। তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতে আলোচনাই বেশি করতেন, যেটা কুরআন বলছে, তোমরা এই পথে সকলে আস, যেটা আল্লাহ ও রাসুলের ত্বরিকত পথে যায়, এটাই তো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি কি উদ্যোগ নিয়েছিলেন? না এটা আগে থেকেই ছিল?
উত্তরঃ আগে থেকে বাংলাদেশে এটা ছিলনা বা কম ছিল, তাঁর উদ্যোগেই এটা প্রকাশ পেয়েছে সারা বাংলাদেশে। এটার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বললেই চলে উনাকে। বর্তমানে প্রফেসার আব্দুল জলিল উনি আমাদের ওস্তাদ এবং আব্বা হুজুরের শিষ্য। আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বর্তমান কেন্দ্রিয় কমিটির সভাপতি আমি।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তাঁর দেশ-বিদেশে পরিভ্রমণ সম্পর্কে আপনাদের কাছে কি তথ্য আছে ?
উত্তরঃ তিনি বাংলাদেশের বাইরে শুধু ভারতে গিয়েছেন, আর অন্য কোথাও যান নাই। বহুবার অনেকেই চেষ্টা করেছে তাঁকে নেয়ার জন্য কিন্তু তিনি যান নাই। কারণ তিনি ছিলেন ওহাবীদের ঘোর শত্রু, তাঁর কোন মাহফিলে ওহাবীরা কোনদিন ছাড় দেয় নাই। বারবার আক্রমণের চেষ্টা করেছে তারা। কোনদিন তিনি হজ্বেও যেতে পারেন নি। তাঁকে হজ্বে যেতে কঠিন বাধা প্রদান করা হবে বলে ওহাবীরা ঘোষনা দিতে থাকে এবং সৌদি সরকারওতো ওহাবী সরকার। যে কারণে তাঁর পক্ষ থেকে হজ্ব করেছি আমরা। আমি নিজে করেছি।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ ওহাবী ধারার বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামগুলো, যেমন একবারতো স্ট্যাব করা হয়েছিল তাঁকে, এটা কোথায় এবং কত বছর আগে ঘটেছিল ?
উত্তরঃ স্ট্যাবটা করা হয়েছিল সিলেটে। এটা প্রায় ১২ বছর আগের ঘটনা। এমনতো বহু জায়গায় তাঁকে আক্রমন করা হয়েছে, কিন্তু কিছু করতে পারে নাই।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ ওহাবী ধারার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই সংগ্রামের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো কি কি?
উত্তরঃ তিনি অনেক বই লিখেছেন। বিশেষ করে বাহাস যেগুলো হতো, এই বাহাসের বইগুলো আছে সারা বাংলাদেশে। কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেটে, বৃহত্তর ময়মনসিংহ সহ
বিভিন্ন জেলায় পাঠকদের কাছে আছে বইগুলো। ডিসি, জেলা প্রশাসকসহ বাহাসকৃত ব্যক্তিরা তাঁর কাছে মর্মান্তিকভাবে পরাজিত হয়েছে। হাজার হাজার বাহাসে তিনি সুন্দরভাবে জয়লাভ করেছেন সরকারিভাবে তাদের লিখিতসহ পরাজয় বরণ করেছে এবং এগুলো ছাপানো আছে। আমাদের সংগ্রহেও বেশ কিছু বই আছে। তাঁর ছবিও সংরক্ষিত আছে। কুরআন শরীফের উপর তিনি অনেক তফসির লিখেছেন। আব্বাজানের খাদেমগণ এগুলো সংরক্ষণ ও বিতরণ করতেন।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ ওহাবী ধারার বিরুদ্ধে আপনার আব্বার যে লড়াই-সংগ্রাম এটি এখন কোন অবস্থায় আছে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তরঃ তিনিতো নবীজীর শানে কোন রকম কেউ বেআদবী করলে পছন্দ করতেন না। এমন প্রতিবাদ করতেন। এখন সারা দেশে তাঁর অনুসারীরা এ বিষয়ে অনেক সোচ্চার, একারণে ওহাবীরা এখন আর তেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। ফলে আগের মতো তারা যে আক্রমণটা করতো এ পরিবেশটা এখন বেশ ঠান্ডা এবং সারাদেশেই এখন তরিকতপন্থীরা আছে, তরীকতপন্থীরাই সুন্নাত ওয়াল জামাতের একটি অংশ। এই তরীকতপন্থীরাই সোচ্চার সারাদেশে।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তিনি চলে যাওয়ার আগে আপনাদের উদ্দেশ্যে কি বলেছেন বা আপনারা তাঁর কাছ থেকে কি কি দিক্ নির্দেশনা পেয়েছেন এবং উত্তরাধিকার হিসেবে কি নিতে পেরেছেন ?
উত্তরঃ আমাদেরকে তিনি দোয়া করে গেছেন আর বলে গেছেন, তোমাদের কোন সমস্যা নাই, তোমরা দয়াল নবীজীর আদর্শ ও সাহাবা কেরামদের আদর্শের উপর থেকো, ইনশাআল্লাহ তোমাদের কোন সমস্যা হবে না। তিনি সবচেয়ে বেশি বলতেন যে, মিথ্যা কথা বলবানা, অন্যের হক নষ্ট করোনা, আর নবীর আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকো। চলে যাওয়ার পূর্বে না খাওয়ার মধ্যেই ছিলেন তিনি ৫/৬ মাস। তাঁকে কিছুই খাওয়ানো যায়নি, কেবল ৪/৫ ফোটা করে পানি ছাড়া, দীর্ঘ প্রায় ৬ মাস। তখন আব্বার কাছে দোয়া চেয়েছি, ‘আপনার মতো যেন, হক-এন্তেজাম পথে থাকতে, প্রচার-প্রসার করতে পারি আপনি সেই দোয়া করবেন দয়া করে’। আব্বার নির্দেশনা এটাই ছিল, আল্লাহ্র রাসুল ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত, ও আউলিয়া কেরামগণের হক-মতবাদগুলো প্রচার, প্রসার করা, লোককে কষ্ট না দেয়া, হক পথে থাকা, মেহমানদের সম্মান করা ও আব্বাজানের আশেকদের খোঁজ খবর রাখা, তাদের খেদমত, আপ্যায়ণ করা, তাহলেই তিনি খুশি থাকবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।
তাঁর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখ যোগ্য দিক খুব গেঁথে আছে অন্তরে যে, তিনি সব সময় খুব কম আহার করতেন, বলতেন যে, কাজ করো বেশি, খাও কম। তিনি অহেতুক কখনো সময় নষ্ট করেননি। এমনকি যখন তিনি শক্ত সমর্থ ছিলেন গাছ লাগাতেন, গাছের গোড়ায় পানি দিতেন, যতœ নিতেন। একসময় প্রায় দেড়শ কাঁঠাল গাছ লাগিয়েছেন তিনি, সেগুলোতে কাঁঠাল হতো। আর যখনই বিশ্রামে আসতেন তখনই কিতাব নিয়ে বসতেন, কিতাব লিখতেন। অন্য সময় সারাদেশে বিভিন্ন মাহফিলে-মাহফিলে যেতেন। দেখা গেছে মানুষকে সহায়তার ক্ষেত্রে অনেকে হয়তো পাঁচ-দশ হাজার টাকা সাহায্য বা টিন কিনে দিত, আর তিনি তাদের বিল্ডিং করে দিতেন। আমাদের আশেপাশে অসংখ্য বিল্ডিং আছে, তিনি করে দিয়েছেন। এমনকি গরীবের বাড়িতে তিনি মাথায় করে টিন নিয়ে যেতেন।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তাঁর উত্তরাধিকারটা বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আপনাদের সামনে কি কর্তব্যটা বেছে নিয়েছেন সামনের দিনগুলোতে ?
উত্তরঃ তিনি চলে যাবার সময়তো সবার সামনে আমাকে গদীনশীন হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন, সবার সম্মুখে বলেছেন, আমার বড় ছেলে এ দায়িত্ব নিবে, আর আমার পরে দায়িত্ব নিবে আমার মেঝ ভাই। এরপর থেকে আমি আছি, কিন্তু তাঁর মতো তো দায়িত্ব পালন করতে পারবো না, একজন বাহক হিসেবে নিয়ে যেতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে পারি কেবল।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তাঁকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে, তাঁর স্মৃতি, কর্ম ও নিদর্শনগুলো রক্ষায় আপনারা কি পরিকল্পনা নিয়েছেন ?
উত্তরঃ এক্ষেত্রে আমরা দুই ভাই-ই তাঁর যে সব এলাকা আছে, যেখানে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি আছে সেখানে বিভিন্ন মাহফিলে যাই এবং আমরা আশাবাদী তরিকত জগতে তিনি যে কাজগুলো করতেন, যদিও আমাদের জ্ঞান সাধনা সেরকম নেই, তবুও তিনি যে রকম কাজ করে গেছেন এবং আমাদেরকে বলে গেছেন ইনশাআল্লাহ আমরা সেই দায়িত্বটা পালন করতে পারবো।
সংলাপ প্রতিনিধিঃ তাঁর মুখ নিঃসৃত বাণী ও তাঁর লেখা, তাঁর পথ নির্দেশনা এই বিষয়গুলোকে সংরক্ষণ করা এবং এগুলো তাঁর ভক্তকুলের কাছে বা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য আপানদের কোন ভাবনা বা পরিকল্পনা আছে কি?
উত্তরঃ জি আছে। বিশেষ করে তাঁর লেখাগুলো আমরা আগামী ওরস বা ১০/১১ ফাল্গুনের আগেই প্রকাশ করবো, ইসলামের গবেষণার উপরে বাবার লিখিত প্রায় ৩ – ৪ শত গ্রন্থমালা আছে, যেগুলো আমরা যথাযথ প্রকাশ ও সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এখন লোকজন আরো বেশি করে এগুলো চাচ্ছে, তাই বেশি করে এগুলো প্রকাশ করতে হবে আমাদের। তাঁর এক-একটা মাহফিলেতো দেড়শো মতো পুলিশই ডিউটি করতো, এতো লোকের সমাগম হতো। তাঁর যে বিকাশ তরিকার উপর, তিনি তো গাউছেল আযম আব্দুর কাদের জিলানীর তরিকার পথে কাজ করতেন, কাদরীয়া তরিকা। আশা করি আমরাও এ তরিকার উপর দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো পালন করতে পারবো।
লেখক:
ডাঃ রেজভী শরীফুল ইসলাম।
তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া।
সংকলক:
স্বাধীন আহমেদ(সগে মাদীনা)।
Home
»
ইমাম ও সলফে সলেহীনদের জীবনী ও কর্ম
» আল্লামা আকবর আলী রেজভী(রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।