দরসুল হাদিস - ০১ 
❏ হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত।

নবী করীম (ﷺ) বলেছেন: সাত প্রকার লোককে আল্লাহ তায়ালা (কিয়ামতের দিন) তার আরশের ছায়ায় স্থান দান করবেন। সেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর অন্য কোন ছায়া থাকবে না। 
১. ন্যায় পরায়ন নেতা। 
২. ঐ যুবক যে তার যৌবন কাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছেন। 
৩. এমন (মুসলিম) ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে লটকানো থাকে, একবার মসজিদ থেকে বের হলে পুনরায় প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত ব্যাকুল থাকে। 
৪. এমন দু’ব্যক্তি যারা কেবল আল্লাহর মহব্বতে পরস্পর মিলিত হয় এবং পৃথ হয়। 
৫. যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহর ভয়ে অশ্রু ফেলে। 
৬. যে ব্যক্তিকে কোন সম্ভ্রান্ত বংশের সুন্দরী রমনী ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আহবান জানায় আর ঐ ব্যক্তি শুধু আল্লাহর ভয়েই বিরত থাকে। 
৭. যে ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে তার ডান হাত কি দান করলো বাম হাতও জানলো না। (বুখারী-মুসলিম)

হাদীসের পরিচয়ঃ

❏ রাবী’র পরিচয়ঃ 
নাম: তার নাম সম্পর্কে ৩৫টি অভিমত পাওয়া যায়। বিশুদ্ধতম অভিমত হলো ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নাম ছিল। 
১. আবদুস শাসছ
২. আবদু আমর 
৩. আবদুল ওযযা 
ইসলাম গ্রহণ করার পর - 
৪. আব্দুল্লাহ ইবনে সাখর। 
৫. আবদুর রহমান ইবনে সাখর
৬. ওমায়েক ইবনে আমের

উপনাম: আবু হুরায়রা। 
পিতার নাম: সাখর 
পিতার নাম: উম্মিয়া বিনতে সাফীহ। অথবা মাইমুনা।

❏ আবু হুরায়রা নামে প্রসিদ্ধির কারণঃ 
আবু হুরায়রা শব্দের অর্থ বিড়াল ছানার পিতা। (আবু=পিতা; হুরায়রা=বিড়াল ছানা) একদা তিনি তার জামার আস্তিনের নিচে একটা বিড়াল ছানা নিয়ে রাসূল (ﷺ) এর দরবারে হাজির হন। হঠাৎ বিড়ালটি সকলের সামনে বেরিয়ে পড়ে। তখন রাসূল (ﷺ) রসিকতা করে বলে উঠলেন- “হে বিড়ালের পিতা” তখন থেকে তিনি নিজের জন্য এ নামটি পছন্দ করে নেন এবং প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

❏ ইসলাম গ্রহণঃ তিন ৭ম হিজরী মোতবেক ৬২৯ খৃস্টাব্দে খায়বার যুদ্ধের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রখ্যাত সাহাবী তুফায়িল বিন আমর আদ-দাওসীর হাতে ইসলামে দীক্ষিত হন। 
হাদীস বর্ণনাঃ সর্বপেক্ষা অধিক হাদীস বর্ণনাকারী। বর্ণিত হাদীস ৫৩৭৪ টি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম শরীফে ৪১৮টি। 
মৃত্যুঃ ৭৮ বছর বয়সে মদীনার অদূরে কাসবা নামক স্থানে।

❏ গ্রন্থ পরিচিতিঃ 
গ্রন্থ প্রণেতা ইমাম মুসলিম যার পূর্ণ নাম আবুল হোসাইন মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল কুশাইরী আন-নিশাপুরী। খুরাসানের প্রসিদ্ধ শহর নিশাপুওে ২০৪ হিজরী ২৪ শে রজব জন্মগ্রহণ করেন। ১৫ বছর সহ হাদীস সংখ্যা ১২,০০০। ছাড়া ৪,০০০ মাত্র। এ মনীষী ২১৬ হিজরী সনে ৫৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

❏ ব্যাখ্যাঃ এখানে কিয়ামতের এক ভীষণ চিত্রের কথা তুলে মানুষের মনে প্রথমে ভীতি জাগানো হয়েছে। এরপর সেই ভীতি বা শাস্তি থেকে যে শ্রেণীর লোক রক্ষা পাবে তার বর্ণনা দিয়ে মূলত মানুষকে সেইসব গুনে গুনান্বিত হওয়ার জন্য আহবান জানানো হয়েছে।

১. ন্যায় পরায়ন নেতাঃ 

❏ “সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী-মুসলিম) 

❏ রাসূল (ﷺ) বলেন “যে ব্যক্তি মুসলমানদের যাবতীয় ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়ার পর তাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করবে আল্লাহ তার জন্য বেহেশত হারাম করে দেবেন।” (বুখারী-মুসলিম) 

❏ আল কোরআনের বিচারে ন্যায় পরায়ন নেতার বা রাষ্ট্র প্রধানের ৪ দফা কাজ- 
অর্থ: “তারা এমন লোক যাদেরকে আমি যমিনে ক্ষমতা দান করলে নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে বাধা দেবে। আর সব বিষয়ের চুড়ান্ত পরিণতি আল্লাহর হাতে।” (সুরা হজ্জ-৪১) 

❏ অর্থঃ “আমি তাদেরকে মানুষের নেতা বানিয়েছিলাম তারা আমার বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করে পথ প্রদর্শন করে। আমি ওহীর মাধ্যমে তাদেরকে ভালো কাজ করার, নামাজ কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করা আদেশ করেছি, তারা খাটিভাবে আমার ইবাদত করত।” (সুরা আম্বিয়া-৭৩)

২. যৌবন কালঃ ঐ যুবক যে তার যৌবন কাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছে। 
হাদীসঃ
❏ ক. পাচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা (জীবনকাল কোন পথে ব্যয়/ যৌবন কাল কোন পথে ব্যয়) 
❏ খ. পাচটি বিষয়ের পূর্বে পাচটি বিষয় গুরুত্ব দেয়া। 
পূর্বের হাদীস দুটির ব্যাখ্যায় এ বিষয় আলোচিত হয়েছে।

৩.হাদীসঃ নামায মূমিনদের জন্য মেরাজ স্বরুপ। 

৪. পরস্পর মিলিত হওয়া ও পৃথক হওয়াঃ মুসলমানদের প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবং ঈমানের পরিপূর্ণতার জন্যই হওয়া উচিত। কোন কিছুকে ভালবাসলে তা আল্লাহর জন্য এবং পরিত্যাগ করলে তাও আল্লাহর জন্য হতে হবে। 
❏ কোরআনঃ “বলুন আমার নামায, আমার কোরবানী, আমার জীবন, আমার মরন সবই একমাত্র আল্লাহর জন্য। (আন আম-১৩২) 

❏ হাদীস: আবু উমামা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত রাসূল (ﷺ) বলেছেন যে ব্যক্তির কাউকে ভালবাসা, ঘৃণা করা, দান করা ও দান না করা নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই হয়ে থাকে, সে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমানদার। (বুখারী) 
ইসলামের জন্যই যুদ্ধের ময়দানে একজন সাহাবীর হাতে তারই কাফের পিতার মৃত্যুর ঘটনা।

৫. আল্লাহর ভয়ে চোখের অশ্রু ফেলাঃ 
নির্জনে আল্লাহর ভয়ে দু’কারণে অশ্রু বিসর্জনে- 
❏ ক. আল্লাহর আজমত-জালালাত বা শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের জন্য। 
❏ খ. নিজের অপরাধ স্মরণ করে মুক্তিলাভের জন্য। 
রাসূল (ﷺ) বলেছেন- “যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে অশ্রুপাত করেছে তার জাহান্নামে প্রবেশ করা তেমনি অসম্ভব যেমনি অসম্ভব দোহন করা দুধকে পুনরায় ওলানে প্রবেশ করোনো। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার পথে জিহাদ করেছে সে ব্যক্তি আর জাহান্নামের ধোয়া একত্র হবে না।” (তিরমিযী) 
❏ রাসূল (ﷺ) বলেন- “দু’ধরনের চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না। 
১. ঐ চোখ যা আল্লাহর ভয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়। 
২. ঐ চোখ যা আল্লাহর পথে পাহারাদারীতে রাত জাগে।” (বুখারী)

৬. চরিত্রের হেফাজতঃ যৌবনকালে নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের সান্নিধ্য চায়। সৃষ্টিগতভাবে এটা একটা স্বাভাবিক তাড়না। এ সময় কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের সুন্দরী কোন রমণী ব্যভিচারে লিপ্ত হবার প্রস্তাব করলে শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়েই তা থেকে বিরত থাকা যায়। 
এভাবে চরিত্রের হেফাজত করলে তবেই আরশের ছায়ায় স্থান লাভ করা যাবে। 
কোরআনঃ 
❏ অর্থঃ “আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়োনা। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং অসৎ পন্থা।” (বনী ইসরাঈল-৩২) 
❏ অর্থঃ “লজ্জাহীনতার যত পন্থা আছে তার নিকটেও যেওনা, তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক।” (আনআম-১৫২) 
বিবাহের মাধ্যমে বৈধ পন্থায় যৌন চাহিদা মেটানো ইসলামের নির্দেশ। 
❏ অর্থ: এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। (মুমিনুন-৫-৬)

৭. গোপনে দান করাঃ দান করতে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। মুনাফিকুনের ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে- 
❏ “আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করো মৃত্যু আমার আগেই।” 
❏ “তোমরা কিছুতেই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষন না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলিকে আল্লাহর পথে ব্যয় করবে।” (আল ইমরান-৯২) 

❏ হাদীসঃ “আল্লাহ তোমাদের সৌন্দর্য ও সম্পদের দিকে লক্ষ্য করেননা বরং তোমাদের অন্তকরণ ও কাজের দিকে লক্ষ্য করেন।”

رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيدِ مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ وَاللَّهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الْأَمْرَ حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ لَا يَخَافُ إِلَّا اللَّهَ أَوْ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُونَ

অনুবাদ: হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল (ﷺ) এর নিকটে গেলাম তখন তিনি ক্বাবা শরীফের ছায়ায় বসে আরাম করছিলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবেন না এবং দোয়া করবেন না? (আমরাতো মার খেতে খেতে শেষ হয়ে গেলাম)। আমাদের কথা শুনে রাসূল (ﷺ) বললেন, তোমাদের আগে যারা এই পৃথিবীতে দ্বীনের দা‘ওয়াত দিতে এসেছিল তাদেরকে (সমাজ শক্তি-রাষ্ট্র শক্তি) ধরত, তাদের জন্য জমিনে গর্ত খনন করা হত, এরপর সে গর্তে তাদেরকে গেড়ে দিত, এরপর করাত আনা হত, সে করাত তার মাথার উপরে রাখা হত, এরপর করাত চালিয়ে জিবিত মানুষটাকে চিরে দ্বিখ-িত করে ফেলা হত। এর পরেও তাদেরকে একচুলও আল্লাহর দ্বীন থেকে সরানো সম্ভব হয়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে লোহার চিরুনী দিয়ে তাদের শরীরের হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলা হত, এর পরেও তাদেরকে দ্বীন থেকে সারানো সম্ভব হয়নি। (ও খাব্বাব শোন!) আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, এমন এক সময় আসবে যখন সানা থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত মানুষ চলবে, এ মানুষ গুলোর মনের মধ্যে আল্লাহর ভয় ছাড়া আর কোন ভয় থাকবে না। আর মেষ পালের জন্য বাঘের ভয় ছাড়া কোন ভয় থাকবে না। বরং তোমরা বড্ড তাড়াহুড়ো করছ। (সহীহ আল-বুখারী)

রাবী পরিচিতি:
নাম খাব্বাব, পিতা আরাত। তিনি ছিলেন বনু তামিমের সন্তান। অন্য এক গোত্রের আক্রমণে তাঁর গোত্রটি পরাজিত হয়। আক্রমণকারীরা সকল পুরুষদেরকে হত্যা করে এবং নারী ও ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে দাসে পরিণত করে। খাব্বাব (رضي الله عنه) ছিলেন ছোটদের একজন।

হাত বদল হয়ে তিনি পৌঁছেন মক্কার বাজারে। বনু খুজায়া’র উম্মু আন্মার নামের এক মহিলা তাঁকে ক্রয় করে। উম্মু আন্মার তাঁকে কর্মকারের কাজে নিয়োজিত করে। তিনি কয়লার মধ্যে লোহা গলিয়ে ঢাল, তলোয়ার ও বর্শা তৈরির কাজ করতেন। তিনি ছিলেন একজন সৎ ও কর্মঠ তরুণ।
মুহাম্মাদ (ﷺ) নামক এক ব্যক্তি নতুন দ্বীন প্রচার করছেন জানতে পেরে যুবক খাব্বাব (رضي الله عنه) মুহাম্মাদুর রাসূল (ﷺ) এর কাছে গেলেন, তাঁর মুখে আল কুরআনের বাণী শুনে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত খাব্বাব (رضي الله عنه) প্রথম পাঁচ ছয়জনের পরেই ইসলাম গ্রহন করেন ।
হযরত খাব্বাব (رضي الله عنه) তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখলেন না। নিঃসংকোচে অন্যদের কাছে দ্বীনের কথা বলা শুরু করেন। কয়েকদিনের মধ্যে এই খবর পৌঁছলো উম্মু আন্মারের কাছে। উম্মু আন্মার তার ভাই সিবা’ ইবনু আবদিল উয্যা ও আরো কয়েকজনকে নিয়ে খাব্বাব (رضي الله عنه) এর কাছে এসে বলে, ‘তুমি নাকি ধর্মত্যাগী হয়ে বনু হাশিমের এক যুবকের অনুসারী হয়েছ?’ তিনি বললেন, ‘আমি ধর্মত্যাগী হইনি। তবে লা-শারিক আল্লাহ্র ওপর ঈমান এনেছি, মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়েছি এবং সাক্ষ্য দিয়েছি মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহ্র বান্দা ও রাসূল।’ তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই সিবা’ ও তার সঙ্গীরা নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপর। অনবরত কিল-ঘুষি মারতে থাকে, পা দিয়ে পিষতে থাকে।
একদিন খাব্বাব (رضي الله عنه) আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ) এর সান্নিধ্য থেকে তাঁর কর্মস্থলে ফিরে আসেন। সেখানে ছিল একদল লোক। তারা যখন জানতে পেল খাব্বাব রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নিকট থেকে এসেছেন, তারা তাঁকে মারতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে এলে দেখেন তাঁর দেহ ক্ষত-বিক্ষত এবং পোষাক রক্তে-রঞ্জিত।

মক্কার মুশরিক নেতাদের নির্দেশে সিবা’ ইবনু আবদিল উয্যা ও তার সাথীরা খাব্বাব (رضي الله عنه) কে লোহার পোষাক পরিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দিতে থাকে। প্রচন্ড গরমে তিনি কাতর হয়ে পড়তেন, পিপাসায় ছটফট করতেন। এই অবস্থায় তাঁকে বলা হতো, ‘মুহাম্মাদ সম্পর্কে এখন তোমার বক্তব্য কী?’ দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বলতেন, ‘তিনি আল্লাহ্র বান্দা ও রাসূল। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নেওয়ার জন্য তিনি আমাদের নিকট এসেছেন।’ আবারো শুরু হতো মারপিট।

ইসলাম গহণ করার অপরাধে তার মনিব উম্মে আনমারের ভাইয়েরা তাকে অকথ্য নির্যাতন করত। তারা হাপরে কতকগুলো পাথর টুকরো গরম করে সেইগুলো বিছিয়ে এবং উত্তপ্ত আগুন তৈরি করে তার ওপর তাঁকে শুইয়ে দিত এবং একজন বলবান ব্যক্তি তাঁর বুকের ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকত। এই উত্তপ্ত পাথর ও জলন্ত কয়লার আগুনে তাঁর পিঠের গোশত খসে পড়ত, শরীরের রক্ত মাংসগুলো গলে গলে কয়লা ঠান্ডা হয়ে যেত। কয়লার আগুনে ঝলসে গিয়ে তার শরীরে এমন গর্ত হয়েছিল যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই গর্তগুলো পূরণ হয়নি। সেজন্য তিনি সব সময় গায়ের ওপর চাদর জড়িয়ে রাখতেন। মাঝে-মধ্যে উম্মু আন্মার দোকানে এসে হাপরে লোহার পাত গরম করে তাঁর মাথায় ঠেসে ধরত, যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করতেন, জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। এত নির্যাতনের পরেও তিনি ইসলাম ত্যাগ করে কুফরে ফিরে যেতে রাজি হননি।

হযরত ওমর (رضي الله عنه) এর খিলাফতের সময় তিনি খাব্বাব (رضي الله عنه) এর উপর নির্যাতনের বিস্তারিত জানতে চাইলে হযরত খাব্বাব (رضي الله عنه) বলেন, ‘আমার কোমরের প্রতি লক্ষ্য করুন।’ হযরত ওমর (رضي الله عنه) তাঁর কোমর দেখে বলেন, ‘হায় একি অবস্থা!’ তখন খাব্বাব (رضي الله عنه) বলেন, ‘আমাকে জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর শুইয়ে ধরে রাখা হত, ফলে আমার চর্বি এবং রক্ত প্রবাহিত হয়ে আগুন নিভে যেত।

মাত্র ৩৬ বছর বয়সে হযরত খাব্বাব (رضي الله عنه) এর মৃত্যু হয় এবং সাহাবাদের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনিই কুফায় কবরস্থ হন। তাঁর মৃত্যুর পর হযরত আলী (رضي الله عنه) তাঁর কবরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলেন, ‘আল্লাহ খাব্বাবের উপর রহমত করুন। তিনি নিজের ইচ্ছায় মুসলমান হয়েছিলেন, হিযরত করেছিলেন, সমন্ত জিহাদে অংশগহণ করেছিলেন।

প্রেক্ষাপট :
রাসূল (ﷺ) এর উপর সূরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে পৃথিবীতে আল-কুরআনের যাত্রা শুরু হয়। এরপর পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসেবে সূরা ফাতিহা নাযিল হয়। এর কিছুদিন পরে সূরা মুদ্দাুিছর এর প্রথম ৭ আয়াত নাযিল হয়। 
❏ যেখানে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنْذِرْ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ
“হে বস্ত্রাবৃত! উঠ, অতঃপর সতর্ক কর। আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। আর তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র কর। আর অপবিত্রতা বর্জন কর। আর অধিক পাওয়ার আশায় দান করো না। আর তোমার রবের জন্যই ধৈর্যধারণ কর।” (সূরা মুদ্দাুিছর ১-৭)

এ আয়াত নাযিলের পর রাসূল (ﷺ) সর্বপ্রথম মা খাদিজার কছে কালিমার দা‘ওয়াত পেশ করলে তিনি কোন প্রশ্ন ছাড়াই বললেন, আপনি সত্য বলেছেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল।” এরপর আবু বকর (رضي الله عنه) কে দ্বীনের দা‘ওয়াত দিলে তিনিও দা‘ওয়াত কবুল করে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। এভাবে গোপনে তিন বছর ইসলামের দা‘ওয়াত চলতে থাকে।

❏ অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা সূরা হিজর এর ৯৫ নং আয়াতে রাসূল (ﷺ) কে উদ্দেশ্য করে বলেন-
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
“সুতরাং তোমাকে যে আদেশ দেয়া হয়েছে, তা ব্যাপকভাবে প্রচার কর এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।” (সূরা হিজর, ৯৫)

❏ এ আয়াত নাযিলের পর রাসূল (ﷺ) আরবের নিয়ম অনুযায়ী সাফা পাহাড়ের উপরে উঠে কুরাইশদেরকে তাওহীদের দিকে আহবান করলেন। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
صَعِدَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم الصَّفَا ذَاتَ يَوْمٍ فَقَالَ يَا صَبَاحَاهْ فَاجْتَمَعَتْ إِلَيْهِ قُرَيْشٌ قَالُوا مَا لَكَ قَالَ أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَخْبَرْتُكُمْ أَنَّ الْعَدُوَّ يُصَبِّحُكُمْ ، أَوْ يُمَسِّيكُمْ أَمَا كُنْتُمْ تُصَدِّقُونِي قَالُوا بَلَى قَالَ فَإِنِّي نَذِيرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَيْ عَذَابٍ شَدِيدٍ فَقَالَ أَبُو لَهَبٍ تَبًّا لَكَ أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا
“একদিন রাসূল (ﷺ) সাফায় উঠলেন এবং সবাইকে আহবান করলেন, কুরাইশগণ সেখানে একত্রিত হলো এবং বললো, হে মুহাম্মদ (ﷺ) তোমার কি হয়েছে? রাসূল (ﷺ) বললেন, আমি যদি বলি পাহাড়ের বিপরিতে তোমাদের শত্রু লুকিয়ে আছে তোমরা কি বিশ্বাস করবে? তারা সবাই বললো, অবশ্যই বিশ্বাস করব। রাসূল (ﷺ) বললেন, আমি তোমাদেরকে কঠিন আযাব থেকে সতর্ক করছি। এ কথা শুনে আবু লাহাব বলল, ধ্বংস হও তুমি, এ কথা বলার জন্য আমাদেরকে একত্রিত করেছ।” (সহীহ আল-বুখারী)

এরপর থেকে রাসূল (ﷺ) ও সাহাবীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য শত্রুতা শুরু হয়। মক্কায় ইসলামী দা‘ওয়াতের তৃতীয় পর্যায় যখন মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে শুরু করল, তখন কাফিরদের পক্ষ থেকে রাসূল (ﷺ) ও সাহাবীদের উপর যুলুম-নির্যাতনের মাত্রাও চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে থাকল। রাসূল (ﷺ) কে শি’বে আবি তালিবে বন্দি জীবন-যাপন করতে হলো, সুমাইয়া, খুবাইব, আম্মারসহ বেশকিছু সাহাবীকে শহীদ করা হলো। বেলাল, খাব্বাবের মত সাহাবীদের প্রতি যুলুম-নির্যাতনের মাত্রা চরম সীমায় পৌঁছে গেল এ সময় একদিন হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত (رضي الله عنه) রাসূল (ﷺ) এর নিকট গেলেন, রাসূল (ﷺ) তখন ক্বাবা শরীফের ছায়ায় বসেছিলেন। হযরত খাব্বাব (رضي الله عنه) বললেন-
أَلَا تَسْتَنْصِرُ لَنَا أَلَا تَدْعُو اللَّهَ لَنَا يَا رَسُوْلَ الله-
“হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আপনি কি আমাদের জন্য সাহায্য চাইবেন না, আমাদের জন্য দোয়া করবেন না?” হযরত খাব্বাব (رضي الله عنه) এর প্রশ্নের জবাবে রাসূল (ﷺ) উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেন।
Top