আলা হযরত, এক অনন্য নবীপ্রেমিক
মাওলানা মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম আশরাফী
আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন বেরেলভী (রহঃ) সমসাময়িক যুগের এমন এক অদ্বিতীয় নবীপ্রেমিক ছিলেন যার হৃদয় কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল ইশকে মোস্তাফার অমিয় সুধায়। তাঁর গোটা অস্তিত্বকে তিনি নবীপ্রেমে বিলীন করে দিয়েছিলেন। তাই তো তিনি বলেন- “মোরা তন মন ধন সব ফুঁকে দিয়া, ইয়ে জান ভি পেয়ারে জালা যানা।” অর্থাৎ- “আপনি আমার দেহ মন সম্পদ সব জ্বালিয়ে অঙ্গার করেছেন, এখন আমার জীবনটাকেও জ্বালিয়ে শেষ করে দেন।” আলা হযরত তাঁর লিখনীতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান শান ও আযমতকে তুলে ধরতে সর্বোচ্চ সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর দেড় সহস্রাধিক কিতাবে ছিলো শুধুই নবীপ্রেমের রাজত্ব। তাঁর রচিত অসংখ্য নাত শরীফ একদিকে যুগ যুগ ধরে সারা পৃথিবীতে নবীপ্রেমিকদের মনের খোরাক যুগিয়ে এসেছে অপরদিকে নবীদ্রোহীদের হৃদয়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে।
আলা হযরতের নবীপ্রেম কতটা গভীর এবং বাস্তবিক ছিলো তা তাঁর বিখ্যাত নাতে রাসুলের সংকলন “হাদায়েকে বখশিশ” পড়লে সহজেই অনুমান করা যায়। এর প্রতিটি কাসিদা শানে রিসালাতের মানদন্ডে উত্তীর্ণ। ‘মোস্তফা জানে রহমত পে লাখো সালাম’ আজও গোটা পৃথিবীর অগণিত নবীপ্রেমিকের মুখে মুখে এক অপূর্ব দ্যোতনা সৃষ্টি করে। এই বিখ্যাত নাতিয়া কালাম সম্পর্কে দেওবন্দী আলেম ইদ্রিস কান্দুলভী বলেন- “হাশরের দিনে ইমাম আহমদ রেযা খাঁন তাঁর অতুলনীয় এই কাসিদার কারণেই নাজাত পেয়ে যেতে পারেন।” আলা হযরতের নবীপ্রেমের আরো দৃষ্টান্ত দেখা যায় তাঁর কোরআনের অনুবাদ গ্রন্থ “কানযুল ঈমানে”। এই গ্রন্থে কোরআনের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে তিনি সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছেন, যাতে কোন একটি শব্দের দ্বারাও নবীজির মহান শান ও আযমতের সামান্যতম খেলাফ কিছু না হয়।
আলা হযরত নিজে যেমন একাগ্র ছিলেন, তেমনি অন্য কারো বক্তব্যে কিংবা লিখনীতে শানে রেসালাতের খেলাফ কোন উক্তি তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তাই তো সে সময়ে উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় সকল দেওবন্দী ওলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে তিনি জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। প্রিয় নবীর শানে বেয়াদবীপূর্ণ আকীদার কারণে তিনি আশরাফ আলী থানভী, রশিদ আহমেদ গাঙ্গুহী, আবুল কাশেম নানুতবী এবং তাদের অনুসারীদেরকে কাফের ফতোয়া দেন। এসবই তাঁর নবীপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। আলা হযরতের গভীর নবীপ্রেমের দৃষ্টান্ত দেখে তাঁর শত্রুপক্ষের অন্যতম সৈনিক আশরাফ আলী থানভীও তাঁর প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন- “আহমদ রেযা খাঁনের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে- যদিও তিনি আমাকে কাফের ডেকেছেন। কেননা আমি জানি যে, এটা অন্য কোন কারণে নয়- বরং নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর সুগভীর ভালোবাসা থেকেই উৎসারিত।”
আলা হযরতের নবীপ্রেম শুধু তার লিখনীতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, বরং নিজের গোটা জীবনে একনিষ্ঠভাবে প্রিয় নবীর সুন্নাতের উপর আমল করে একজন পরিপূর্ণ নবীপ্রেমিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আজও সারা পৃথিবীতে আলা হযরতের জীবন ও কর্ম আলোচনার মাধ্যমে মানুষের মাঝে নবীপ্রেমের উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।
বিশ্ব মনিষীদের দৃষ্টিতে আলা হযরত
আল্লামা ইব্রাহীম ফারুকী মোজাদ্দেদী, কাবুল- আফগানিস্তানঃ
তিনি বলেন- নিঃসন্দেহে মুফতী আহমদ রেযা খান (রহঃ) একজন মহাপন্ডিত ছিলেন। মুসলমানদের আচার আচরণের নীতি ক্ষেত্রে এবং তরীকতের স্তরগুলো সম্পর্কে তাঁর অন্তদৃষ্টি ছিল। ইসলামী চিন্তা চেতনার ব্যাখ্যা করণ এবং প্রতিফলনের ব্যাপারে তাঁর যোগ্যতা এবং বাতেনী জ্ঞান সম্পর্কে তার অবদান এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মৌলিক নীতিমালার সাথে সঙ্গতি রেখে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। পরিশেষে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, এ আকীদা বিশ^াসের মানুষদের জন্য তাঁর গবেষণা কর্ম আলোক বর্তিকা হয়ে খেদমত আঞ্জাম দিবে।
আল্লামা আতা মোহাম্মদ বানদইয়ালভী, সারগোদা, পাকিস্তানঃ
তিনি মন্তব্য করেন- হযরত বেরেলভী (রহঃ) সহস্রাধিক কিতাব লিখেছেন। তিনি প্রতিটি বিষয় সম্পর্কেই বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করেছেন। কিন্তু তার সার্বক্ষনিক উজ্জ্বল কর্ম হলো কোরআন মজিদের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা মূলক গ্রন্থ “কানযুল ঈমান” -যার তুলনা নেই। এই মহা সৌধসম কর্মের মূল্যায়ন শুধু সেই সকল জ্ঞান বিশারদই করতে পারবেন- যাদের উর্দ্দু ভাষায় লিখিত অন্যান্য অনুবাদ ও ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থের তুলনামূলক গভীর জ্ঞান আছে। (পয়গামাতে ইয়াওমে রেযা, ৪৭)
স্যার জিয়াউদ্দিন, ভাইস চ্যান্সেলর, আলীগড় মুসিলম বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতঃ
তার ভাষ্য হলো- শিষ্ঠাচার ও উন্নত নৈতিকতা সমৃদ্ধ কোন ব্যক্তি যখন কোন শিক্ষকের দ্বারা শিক্ষিত না হয়েই গণিত শাস্ত্রে গভীর অন্তদৃষ্টি ধারণ করেন, তখন তা খোদা প্রদত্ত জন্মগত বৈশিষ্ট্যই বটে। আমার গবেষণাকর্ম ছিল একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান সম্পর্কে। কিন্তু ইমাম সাহেবের পদ্ধতি ও ব্যাখ্যাবলী ছিল স্বতঃস্ফুর্ত- যেন বিষয়টি সম্পর্কে তার গভীর গবেষণা রয়েছে। ভারতে এত প্রসিদ্ধ ব্যক্তি আর নেই। এত উচু মাপের জ্ঞানী ব্যক্তি আমার মতে আর কেউ নেই। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর মাঝে এমন জ্ঞান নিহিত রেখেছেন যা সত্যি বিস্ময়কর। গণিত, ইউক্লিড, অ্যালজেব্রা ও সময় নির্ণয় ইত্যাদির ক্ষেত্রে তাঁর গভীর দৃষ্টি অত্যন্ত বিস্ময়কর। একটি গাণিতিক সমস্যা যা আমি সর্বাতœক চেষ্টা করেও সামাধান করতে পারিনি, তা এই জ্ঞানী ব্যক্তিটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাখ্যা করে দিলেন। (মোহাম্মদ বুরহানুল হক রচিত একরামে ইমাম আহমদ রেযা, লাহোর, পৃষ্টা- ৫৯-৬০)
আল্লামা আলাউদ্দিন সিদ্দিকী, উপাচার্য, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়, পাকিস্তানঃ
তিনি বলেন- বিভিন্ন ধর্মের মাঝে দ্বীন ইসলাম যেমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট মন্ডিত, ঠিক তেমনি মুসলমান চিন্তাবিদদের বিভিন্ন ধারায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। এমন এক সময় ছিল- যখন ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো অবহেলিত ও উপেক্ষিত হচ্ছিল। সেই দুর্যোগময় মহাসংকট সন্ধিক্ষনে ইমাম আহমদ রেযা খাঁনের আগমন। তিনি সংগ্রাম করে সেগুলোকে স্বমর্যাদায় পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেন। আলা হযরত ছিলেন প্রকৃত অর্থেই ইমামে আহলে সুন্নাত। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত- তার শিক্ষা অনুসরণ করা। (আবদুন্নবী কাওকাব প্রণীত মাকালাতে ইয়াওমে রেযা ১১তম খন্ড, ১৯৬৮)
ডঃ হাসান রেযা খাঁন আযমী, পাটনা, ভারতঃ
তিনি মন্তব্য করেন- ফতোয়ায়ে রেযভীয়া আলা হযরতের জ্ঞানদীপ্ত গবেষণাকর্ম। তা অধ্যয়ন করে আমি তাঁর নিম্নলিখিত বিভিন্নমুখী প্রতিভার পরিচয় পেয়েছি।
ক) আইনবিদ হিসাবে তার আলোচনা পর্যালোচনা তাঁর সুদূর প্রসারী ভাবনা, গভীর অন্তদৃষ্টি, জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও তুলনাহীন পান্ডিত্যকে প্রতিফলন করে।
খ) আমি তাঁকে একজন উচু মাপের ইতিহাসবিদ হিসাবে পেয়েছি- যিনি আলোচ্য বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন দেয়ার জন্য বহু ঐতিহাসিক ঘটনা উদ্ধৃত করতে সক্ষম ছিলেন।
গ) আরবী ব্যাকরণ ও অভিধানের পাশাপাশি নাতিয়া পদ্যের পংক্তিতে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ বলেই দৃশ্যমান হচ্ছে।
ঘ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস সমূহের যৌক্তিক ব্যাখ্যা করার সময় তাঁকে হাদীস শাস্ত্রের একজন বিজ্ঞ পন্ডিত বলেই পর্যবেক্ষন করা হচ্ছে।
ঙ) তার বিভিন্ন কর্মে তাঁকে শুধু একজন প্রখ্যাত আইনবিদই নয়, বরং অসাধারণ পদার্থবিদ, জ্যোতিবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, দার্শনিক, ভাষাতত্ববিদ ও ভূগোলবিদ হিসাবে পাওয়া যায়- যেখানে তাঁর বিশেষজ্ঞ মতামত বিষয়াবলীর সুক্ষাতিসুক্ষ্ণ বিশ্লেষণ নিয়ে ব্যাপৃত। (ডঃ হাসান রেযা খাঁ কৃত “ফকীহে ইসলাম” এলাহাবাদ, ১৯৮১)
অধ্যাপক ডঃ মহিউদ্দিন আলাউয়ী, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশরঃ
তিনি বলেন- একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে যে, বিদ্যার প্রতিভা ও কাব্যগুণ কোন ব্যক্তি মাঝে একসাথে সমন্বিত হয় না। কিন্তু আহমদ রেযা খাঁন ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তার কীর্তি এ প্রবাদকে ভুল প্রমাণিত করে। তিনি কেবল একজন স্বীকৃত জ্ঞান বিশারদই ছিলেন না, বরং একজন খ্যাতনামা কবিও ছিলেন। (সাওতুশ শারক কায়রো, ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০)
ডঃ বারবারা ডি ম্যাটকাফ, ইতিহাস বিভাগ, বারকলী বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্টঃ
তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন- ইমাম আহমদ রেযা খাঁন তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই অসাধারণ ছিলেন। গণিত শাস্ত্রে তিনি গভীর অন্তদৃষ্টির একটি ঐশীদান প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি ডঃ জিয়াউদ্দিনের একটি গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন। অথচ এর সমাধানের জন্য ডঃ জিয়াউদ্দিন জার্মান সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। (মা’আরিফে রেযা ১১তম খন্ড, আন্তর্জাতিক সংস্করণ, ১৯৯১)