❏ প্রশ্ন-১৭০: ‘নামুসে আকবর’ দ্বারা উদ্দেশ্য কী এবং ‘নামুস’ শব্দের অর্থ কী?
❏ প্রশ্ন-১৭১: বনী আদম তথা মানব বংশধারা কখন হতে শুরু হলো?
❏ প্রশ্ন-১৭২: হাবীল ও কাবিল এর ঘটনাটি বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-১৭৩: অগ্নিপূজক কাদেরকে বলা হয়?
❏ প্রশ্ন-১৭৪: ناد عليا مظهر العجائب الخ এটা কী?
❏ প্রশ্ন-১৭৫: রাইয়ান, সায়রাব ও রাইহান নামগুলির ব্যাখ্যা-বিশেষণ কী?
❏ প্রশ্ন-১৭৬: شهنشاه ‘শাহিনশাহ’ উপাধি দ্বারা কাউকে ডাকা জায়েয নাকি না-জায়েয?
❏ প্রশ্ন-১৭৭: ذوالكفل যুল-কিফিল কে ছিলেন এবং এর অর্থ কী?
❏ প্রশ্ন-১৭৮: ذوالنون ‘যুন্নুন’ কে ছিলেন এবং তাঁর জীবনকাল কীরূপ ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৭৯: যখন কোন জাতির ওপর আযাব চলে আসে তখন আযাব চলে আসার পর ঈমান আনা ফলদায়ক নয়। তবে হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর জাতির ওপর মেঘরাজি আসার পরেও যখন তারা ঈমান আনলো তখন তাদের ওপর আযাব উঠিয়ে নেওয়া হলো, এর পেছনে রহস্য কী?
❏ প্রশ্ন-১৮০: হযরত নূহ (عليه السلام) কখন হতে রিসালতের পদে অধিষ্ঠিত হন এবং হযরত আদম (عليه السلام)-এর কত বছর পর জন্মগ্রহণ করেন?
❏ প্রশ্ন-১৮১: হযরত আদম (عليه السلام)’র পদার্পনের কত দিন পর এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়?
❏ প্রশ্ন-১৮২: يَا هُوَ শব্দের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কি এবং هو সর্বনামের প্রত্যাবর্তন কোন দিকে? বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-১৮৩: ফাসিক কারা এবং এদের নাম কি?
❏ প্রশ্ন-১৮৪: ক্বিবলা কাকে বলে এবং ক্বিবলাকে ক্বিবলা কেন বলা হয়? তাহ্ক্বিকসহ বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-১৮৫: غيرذوى العقول বা জ্ঞানহীনদের ক্ষেত্রে ذوى العقول বা জ্ঞানবানদের জন্য ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহার করা শুদ্ধ কি-না?
❏ প্রশ্ন-১৮৬: সূরা আ‘রাফে আল্লাহ্ তা‘আলার বাণী,
مَا لَا يَخْلُقُ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ। এখানে ما শব্দ দ্বারা কারা উদ্দেশ্য?
❏ প্রশ্ন-১৮৭: সূরা আ‘রাফে مِنْ دُونِ اللهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ আয়াতে عباد শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য কী?
❏ প্রশ্ন-১৮৮: হযরত ইউসুফ (عليه السلام) ও যুলাইখা বিবির বিবাহের পদ্ধতি ও বাস্তব অবস্থা কিরূপ ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৮৯: শয়তান বিতাড়িত ও অভিশপ্ত হওয়ার পূর্বে ফিরিশতাদের সঙ্গে কোন্ কোন্ বিষয়ে আদিষ্ট ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৯০: ইচ্ছাকৃত হত্যাকারী কি সর্বদা জাহান্নামে থাকবে?
❏ প্রশ্ন-১৯১: সূরা আলে-ইমরানে হযরত ঈসা (عليه السلام)কে হযরত আদম (عليه السلام)-এর সাদৃশ তুলনা করা হয়েছে। এটা কিভাবে শুদ্ধ হবে?
❏ প্রশ্ন-১৯২: হযরত আদম (عليه السلام) এর সন্তানদের মাঝে ঝগড়া-বিবাদের কারণ কি ছিল? এবং তাদের মধ্যে ভাই-বোনের পার্থক্যের নিয়ম কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৯৩: আসহাবে কাহাফের কুকুর জান্নাতে যাবে কিনা? এ ব্যাপারে ওলামাই কিরামের মতামত কি?
❏ প্রশ্ন-১৯৪: বর্তমানে প্রচলিত ফাঁসির শাস্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে কিসাসের হুকুমের অন্তভুর্ক্ত হবে কি-না?
❏ প্রশ্ন-১৯৫: বর্তমানে মানুষ গাছের পরিবর্তে ষ্টীল, লোহা ও পাষ্টিক ইত্যাদি দ্বারা ঘরের সরঞ্জামাদি ও অলংকার তৈরী করছে। এ জাতীয় সরঞ্জাম, খাট ও অলংকার ব্যবহার করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয আছে কিনা?
❏ প্রশ্ন-১৯৬: পুরুষদের জন্য অপ্রয়োজনীয় লোম ক্ষুর দ্বারা পরিষ্কার করা কি আবশ্যক? লোম পরিষ্কার করার পাউডার ব্যবহার করা যাবে কি-না?
❏ প্রশ্ন-১৯৭: আহলে হাদীস ও জামায়াতে ইসলামীর অভিযোগ মাযহাবের তাকলীদ করা শিরিক এটা কি শুদ্ধ?
❏ প্রশ্ন-১৯৮: ইন্জেকশনের মাধ্যমে জন্তু যেমন-গরু, মহিষ ইত্যাদির বংশ বিস্তারের জন্য গর্ভধারণের ব্যবস্থা করা শরয়ী বিধান মতে বৈধ কি-না?
❏ প্রশ্ন-১৯৯: রোগীকে রক্ত প্রদান করার শরয়ী বিধান কি?
❏ প্রশ্ন-২০০: সৈয়্যদা হযরত ফাতেমা (رضى الله تعالي عنها)-এর ফযিলত এবং তাঁর নামের অর্থ কি?
❏ প্রশ্ন-২০১: ‘আহলে বাইত’ কারা উদ্ধৃতিসহ বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-২০২: নিয়াবত্ বা প্রতিনিধিত্ব কাকে বলে? এবং এর দ্বারা উপকারিতা কি?
❏ প্রশ্ন-২০৩: ঔষধ সেবন এবং চিকিৎসা করার বিধান কি? শারীরিক সুস্থ্যতা ও আত্মিক সুস্থ্যতা কাকে বলে এবং উভয়ের সংজ্ঞা কি?
❏ প্রশ্ন-২০৪: রোগের চিকিৎসা ও ঔষধ সেবন করা কি সুন্নাত? যদি কোন রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, তাহলে গোনাহগার হবে কি-না?
❏ প্রশ্ন-২০৫: خَيْرٌ শব্দের তাহ্কীক বা ব্যাখ্যা-বিশেষণ কি?
❏ প্রশ্ন-২০৬: آيات الحفظ বা হিফাযত বা সংরক্ষণের আয়াত কাকে বলে?
❏ প্রশ্ন-২০৮: بارى এবং باديه سماوه এর তাহ্কীক বা ব্যাখ্যা বিশেষণ কি?
❏ প্রশ্ন-২০৯: بلعم بن باعوراء (বল‘আম বিন বাউরা) কে ছিল?
❏ প্রশ্ন-২১০: কখন থেকে চন্দ্র হিসেবে বছরে বার মাস গণনা করা শুরু হয় এবং সূর্য হিসেবে মাস ও হিন্দী মাসের মধ্যে গণনা কিভাবে সাদৃশ্য ও মিলানো হয়?
❏ প্রশ্ন-২১১: বছরে তিন মৌসুম গণনা করা হয়। এটা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়?
❏ প্রশ্ন- ২১২:
(ا) الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ الخ (২) وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا الخ(৩) أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا الخ
উক্ত আয়াতগুলোর তাফসীর ও ব্যাখ্যা-বিশেষণ কি?
❏ প্রশ্ন-২১৩: সুন্নাত কাকে বলে সংজ্ঞাসহ বর্ণনা কর ?
❏ প্রশ্ন-২১৪: فرعون ও هامان এটি কোন শব্দ? এবং নমরূদ কে ছিল?
❏ প্রশ্ন-২১৫: ســبـأ‘ (সাবা) এর তাফসীর ও তাহকীক বর্ণনা কর ?
❏ প্রশ্ন-১৭০: ‘নামুসে আকবর’ দ্বারা উদ্দেশ্য কী এবং ‘নামুস’ শব্দের অর্থ কী?
✍ উত্তর: নামুসে আকবর দ্বারা উদ্দেশ্য ফেরেশতা, রূহ ও শরীয়তে ইলাহী। তদুপরি তা হযরত জিবরাইল (عليه السلام)-এর উপাধি। সুতরাং যখন হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা হেরা গুহায় ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর নিজের ঘরে তাশরীফ নিলেন এবং হযরত খাদিজা (رضى الله تعالي عنه)’র সম্মুখে পুরো ঘটনা খুলে বললেন, তখন হযরত খাদিজা (رضى الله تعالي عنه) তাঁকে তার [খাদিজার (رضى الله تعالي عنه)] চাচাতো ভাই ওরাকা বিন নওফল এর নিকট নিয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন তাওরাত ও ইঞ্জিলের বড় আলেম এবং এতদুভয় আসমানী গ্রন্থের আরবী ভাষায় অনুবাদ করতেন। তিনি বড় বড় ইহুদী ও ঈসায়ী আলেমদের নিকট হতে শেষ নবীর সংবাদ (ভবিষ্যৎ বাণী) শুনেছিলেন এবং তিনি শেষ নবীর যাবতীয় আলামত-নিদর্শন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
হুযূর এর ওপর ওহী অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনা ও অবস্থা সম্পর্কে শুনে ওরাকা বিন নওফল বললেন, হে মুহাম্মদ ! আপনি ধন্য, তিনি ওই নামুসে আকবর (অর্থাৎ জিবরাইল) যিনি মুসা (عليه السلام) ও অন্যান্য নবীগণের নিকট ওহী নিয়ে আসতেন। এখন আপনার নিকট ওহী নিয়ে এসেছে। এখন আপনি হচ্ছেন শেষ নবী।
❏ প্রশ্ন-১৭১: বনী আদম তথা মানব বংশধারা কখন হতে শুরু হলো?
✍ উত্তর: বনী আদম তথা মানবের বংশধারা হযরত আদম (عليه السلام) হতে শুরু হয়। হযরত আদমের (عليه السلام) পূর্বে ছিল জ্বিন, ফেরেশতা ইত্যাদি। যখন হতে হযরত আদমের (عليه السلام) বংশধারা সুবিস্তৃত হল তখন হতে আল্লাহ তা‘আলা হযরত আদমের (عليه السلام) কল্যাণের জন্য নিজেদের মধ্য হতে নবী পাঠাতে লাগলেন। নবীগণ আদম সন্তানকে তাওহিদের পথ নির্দেশনা করতে লাগলেন এবং তাদেরকে নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে বুঝাতে একটি মুহূর্তও ক্ষান্ত হননি।
উষালগ্নে মানবজাতি দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে গেলো। একদল নবীগণের (عليه السلام) আদেশ-উপদেশ মেনে নিলো, তাঁদের আনুগত্য-অনুসরণ করলো এবং তাঁদের নির্দেশনা মতে চলতে লাগলো।
অন্যদল কেবল বিরোধিতা করেনি বরং নিষ্পাপ নবীগণকে হত্যা করার পরিকল্পনা করলো এবং কয়েকজন নবীকে হত্যাও করলো। অন্য আরেকটি দল পাপাচারিতার অদ্ভূত পদ্ধতি আবিষ্কার করলো। কোথাও শুরু করলো অগ্নিপূজা, কোথাও মূর্তির সম্মুখে সিজদা, আবার কোথাও বৃক্ষপূজা ও সূর্যপূজার রমরমা প্রচলন। মোদ্দাকথা নিজেদের খেয়াল-খুশি মত শিরকের যাবতীয় উপায় অবলম্বন করলো।
প্রারম্ভিককালে মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা ও কর্মকান্ড ছিল অতি সহজ-সরল ও সাদাসিধে। সকল বিষয়ে সরলতা ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। তবে যুগের রঙ পাল্টানোর সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পরিবর্তন সাধিত হতে লাগলো এবং বর্তমানে এই পর্যায়ে চলে আসলো যে, এখন মানুষের কথায় কথায় পাওয়া যায় কৃত্রিমতা।
224. নাসে উনওয়ান, পৃষ্ঠা:৭৩৯।
❏ প্রশ্ন-১৭২: হাবীল ও কাবিল এর ঘটনাটি বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: কাবিল ও হাবিল এর মধ্যে যখন নারী নিয়ে বিবাদ হলো তখন আদম (عليه السلام) তা এভাবে নিষ্পত্তি করলেন যে, তোমরা উভয়ে মিনা পর্বতে গিয়ে কুরবানী রেখো এসো, যার কুরবানী কবুল হবে তাকে নারী (স্ত্রী হিসেবে) দেওয়া হবে। উভয়ে মিনা পর্বতে কুরবানী রাখলো। তখন আসমান হতে আগুন এসে হাবিলের কুরবানী নিয়ে গেলো এবং কাবিলের কুরবানী পড়ে রইলো। এতে কাবিলের অন্তরে হাবিলের প্রতি বিদ্বেষ বেড়ে গেলো। যার ফল দাঁড়ালো কাবিল হাবিলকে হত্যা করলো।
225. কাসাসুল আম্বিয়া।
❏ প্রশ্ন-১৭৩: অগ্নিপূজক কাদেরকে বলা হয়?
✍ উত্তর: কাফেররা যেরূপ মূর্তি, বৃক্ষ ইত্যাদির পূজা-অর্চনা করে অনুরূপ আগুনের পূজাও করে। যারা মূর্তিপূজা করে তাদেরকে মূর্তিপূজক এবং যারা আগুন পূজা করে তাদেরকে অগ্নিপূজক বলা হয়।
নমরুদ হযরত ইবরাহিম (عليه السلام)কে কেবল এই অপরাধে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছিল যে, তিনি মূর্তিপূজার বিরোধিতা করতেন এবং তাওহিদের শিক্ষা দিতেন। তবে আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুমে ইবরাহিম (عليه السلام) এর কোন ক্ষতি হয়নি।
❏ প্রশ্ন-১৭৪: ناد عليا مظهر العجائب الخ এটা কী?
✍ উত্তর: ناد عليا হচ্ছে একটি দু‘আ। এই দু‘আটি মনস্কামনা লাভ ও বিপদ দূর করার উদ্দেশ্যে পড়া হয় এবং লিখে তাবিজ আকারেও ব্যবহার করা হয়। আর এই দু‘আটি হচ্ছে,
نادعليًا مظهر العجائب تجدهُ عونا لك فى النوائب كل همٍّ الخ .
‘হযরত আলীকে, যিনি বিরল বস্তুর সূক্ষন্ড জ্ঞানের অধিকারী, ডাকো, তুমি তাকে দুঃখ-কষ্টে সাহায্যকারী পাবে। হে মুহাম্মদ ! আপনার নবুওয়তের ওসিলায় এবং হে হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)! আপনার বরকতে যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট ও ক্লেশ দূর হয়ে যাবে।’
এই দু‘আটি শিয়াদের দৈনন্দিন অভ্যাস ও ওজিফা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এবং সুফিয়ায়ে কেরামও এই দু‘আটি উপকারী ও ফলদায়ক মনে করেন। তবে আহলে হাদিস এই দু‘আটিকে শির্ক মনে করে। তারা বলে, এই দু‘আর কোন মৌলিকত্ব বা দলিল-প্রমাণ নেই।
❏ প্রশ্ন-১৭৫: রাইয়ান, সায়রাব ও রাইহান নামগুলির ব্যাখ্যা-বিশেষণ কী?
✍ উত্তর: রাইয়ান ও সায়রাব হচ্ছে বেহেশতের একটি দরজার নাম। হযরত সাহাল বিন সা’দ (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ বলেন, বেহেশতের আটটি দরজা রয়েছে, তন্মধ্যে একটির নাম হচ্ছে রাইয়ান। তা দিয়ে কেবল রোযাদারগণ প্রবেশ করতে পারবে।
রাইয়ান বিন ওয়ালিদ হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর সময়কালে মিসরের রাজা ছিলেন। যিনি হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর ওপর ঈমান এনেছিলেন এবং তাঁর (عليه السلام) সময়কালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
রায়হানা হচ্ছে জনৈক ইহুদী নারীর নাম, যার স্বামী বনু কুরাইযার যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে সে অসম্মতি জানিয়েছিল। তাকে রাসূলের পবিত্র বিবিগণের মধ্যে অন্তভুর্ক্ত করার ইচ্ছা আল্লাহর ছিল না। তাই পরিশেষে সে দাসীদের মধ্যে থাকতে পছন্দ করলো।
226. ইসলামী মালুমাত, পৃষ্ঠা-৬৩।
❏ প্রশ্ন-১৭৬: شهنشاه ‘শাহিনশাহ’ উপাধি দ্বারা কাউকে ডাকা জায়েয নাকি না-জায়েয?
✍ উত্তর: ‘শাহিনশাহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাজাধিরাজ এবং এটি শাহান শাহ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। এই নামে কাউকে ডাকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ বলেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত ও নিকৃষ্ট নাম হচ্ছে ‘মালাকুল আমলাক’ তথা শাহিনশাহ নামটি।
227. বুখারী শরীফ।
কারণ এই নামটির মূর্তপ্রতীক আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। তিনিই রাজাধিরাজ এবং শাসকের শাসক। له الملك فى السموٰت والارض ‘আসমান ও জমিনে রয়েছে তাঁরই রাজত্ব’।
❏ প্রশ্ন-১৭৭: ذوالكفل যুল-কিফিল কে ছিলেন এবং এর অর্থ কী?
✍ উত্তর: যুল কিফিল শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জামিনদার। এটা একজন নবীর নাম, যিনি হচ্ছেন ইয়াসা ইয়াসির ইবনে আইয়ুবের চাচাতো ভাই। এই নামে তাঁর নামকরণের কারণ হিসাবে বলা হয় যে, বনি ইসরাইল ব্যাপক হারে নিজেদের নবীগণকে হত্যা করতো। তিনি একশত নবীর প্রাণ রক্ষা করেন কিংবা তিনি প্রতিদিন একশত জন মুসল্লির সমপরিমাণ নামায পড়তেন। কতিপয় আলেম বলেন, তিনি ছিলেন হযরত আইয়ুব (عليه السلام) এর পুত্র। তাঁর নাম ছিলো বিশর বিন আইয়ুব এবং উপাধি ছিলো যুল কিফিল। আইয়ুব (عليه السلام) এর পরবর্তীতে তিনি রোম দেশে নবী হয়েছিলেন। ‘আখবারুদ দুওয়াল’ গ্রন্থে এই মর্মে উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত আইয়ুব (عليه السلام) এর পর তিনি রোম দেশে নবী হয়েছিলেন। যখন হযরত যুল কিফিল রোম দেশের রাসূল হলেন তখন ওই জাতির লোকেরা প্রথমে তাঁর ওপর ঈমান আনলো। আল্লাহ তা‘আলা যখন তাদেরকে জিহাদের নির্দেশ দিলেন তখন তারা জিহাদ করতে অস্বীকার করলো এবং বলতে লাগলো, হে বিশর! আমরা জীবনকে ভালোবাসি এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করি। আবার আল্লাহ্ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণও আমরা অপছন্দ করি। সুতরাং যদি আপনি আল্লাহ'র নিকট এই মর্মে প্রার্থনা করেন যে, আমরা মৃত্যু কামনা না করা পর্যন্ত যেন মৃত্যুবরণ না করি, তাহলে আমরা আল্লাহর ইবাদত করবো এবং তার শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবো। তিনি বললেন, তোমরা অতি কঠিন প্রশ্ন করেছো। নামায পড়ে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং দু‘আ করলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তার দু‘আ কবুল করেন এবং বললেন, তুমি জাতির জামিনদার হয়ে যাও। সুতরাং হযরত বিশর বিন আইয়ুব এই জাতির নিকট তাদের প্রশ্ন বা প্রার্থনা গৃহীত হওয়ার কথা খুলে বললেন এবং উপরোলেখিত বিষয়ের জামিনদার হলেন। এই কারণে উপাধি স্বরূপ তাঁর নাম হলো যুল কিফিল এবং তাঁর প্রকৃত নাম হচ্ছে বিশর বিন আইয়ুব। ওই জাতির সন্তান-সন্ততির সংখ্যা ওই পর্যায়ে পৌঁছালো যে, রোম দেশে কোন জায়গায় স্থান সংকুলান হলো না। তখন ওই জাতি মৃত্যু কামনা করলো এবং নির্ধারিত সময়ে মৃত্যুবরণ করতে লাগলো। এটাই হচ্ছে রোম দেশে অধিক জনসংখ্যার কারণ। হযরত বিশর বিন আইয়ুব শাম দেশে ওফাতপ্রাপ্ত হন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তাঁর মাযার শরীফ নাবলুস এর সন্নিকটস্থ ‘কিফিল’ গ্রামে অবস্থিত। তবে মুহাক্কীকগণের মতে এই মতটি সঠিক যে, যুল কিফিল (عليه السلام) ছিলেন ইয়াসা ইবনে আখলুত এর মুনিব। হিযকিল ও বিশর বিন আইয়ুব এর উপাধিও যুলকিফিল, যাদের সময়কাল ছিল তাঁর পূর্বে।
‘মু‘আলিমুত তান্যিল’ গ্রন্থে হযরত আবু মুসা আশ‘আরী (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে,
لم يكن ذوالكفل نبيًا ولكن كان عبدًا صالِحًا.
অর্থাৎ ‘যুল কিফিল নবী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন নেক্কার-পূণ্যবান বান্দা।’ অতএব বুঝা গেলো যে, আউলিয়া-ই কিরাম থেকে অলৌকিক কারামত পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে এটা সাহেবে শরীয়ত হুযূর এর মুজিযা যা আল্লাহ'র কুদরতের বহিঃপ্রকাশ।
❏ প্রশ্ন-১৭৮: ذوالنون ‘যুন্নুন’ কে ছিলেন এবং তাঁর জীবনকাল কীরূপ ছিল?
✍ উত্তর: ذوالنون ‘যুন্নুন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে মাছওয়ালা। এটা হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর উপাধি। হযরত ইউনুস (عليه السلام) ছিলেন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মহান নবী। তাঁর পিতার নাম মাত্তা। কিন্তু আব্দুর রায্যাক বলেন, মাত্তা ছিল তাঁর মাতার নাম।
মুহাক্কিকগণ লিখেছেন, হযরত শাইয়ার যামানায় বনী ইসরাইলের রাজা ছিলো ‘হাযক্বিয়া’। ঘটনাক্রমে মুসিল নিতওয়ার জনগণ স্বীয় রাজার সহায়তায় বনী ইসরাইলের ওপর আক্রমণ করলো, তাদের আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে গেলো এবং ৯৫০ জন ব্যক্তিকে আটক করে নিয়ে গেলো। হাযকিয়া এই ঘটনাটি হযরত শাইয়াকে (عليه السلام) বললো এবং আরয করলো যে, যতক্ষণ পর্যন্ত বন্দীদের মুক্ত করা যাবেনা, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিকট থেকে প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না। কারণ যখন এদিক থেকে সৈন্য যাবে তখন তারা বন্দীদেরকে হত্যা করবে। হযরত শাইয়া (عليه السلام) বললেন, তোমার দেশে ৫ ( পাঁচ) জন নবী আছেন। তন্মধ্যে কাউকে নির্দেশনা সহকারে পাঠাও। তিনি তাদেরকে বুঝিয়ে বন্দীদেরকে মুক্ত করে আনবেন। হাযক্বিয়া বললো, আপনি কাউকে নির্বাচিত করুন। তিনি বললেন, ইউনুস (عليه السلام) খুবই পরিশ্রমী ও আমানতদার এবং আল্লাহর নিকট প্রিয়। অধিক ইবাদতের কারণে তিনি সকল নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তাঁকে পাঠাও। যদি তারা তাঁকে না মানে, তাহলে তিনি মু’জিযার মাধ্যমে তাদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আসবেন। এ সময় হাযক্বিয়া হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে তলব করলো এবং পুরো ঘটনা তাঁকে খুলে বললো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, যদি হযরত শাইয়া (عليه السلام) আল্লাহর হুকুমে নির্বাচিত করেন, তাহলে কোন অসুবিধা নেই, আমি যাবো। অন্যথায় আমার সময়ে ব্যাঘাত ঘটবে। হাযক্বিয়া বললো, আপনার নির্বাচন আল্লাহর হুকুমে নয়, বরং হযরত শাইয়া (عليه السلام) আপনাকে নির্বাচন করেছেন এবং তিনি আদেশ দানের অধিকারী এবং তাঁর আনুগত্য করা ওয়াজিব।
হযরত ইউনুস (عليه السلام) ভারী মনে রওয়ানা হলেন এবং স্বীয় পরিবারবর্গকেও সাথে নিলেন। নিতওয়া হচ্ছে মুসিলের বিপরীতে অবস্থিত এবং তার মধ্যখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে দজলা নদী। সেখানে তিনি গেলেন এবং সম্রাট মাল‘আব ইবনুল এরশাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তোমার নিকট পাঠিয়েছেন যে, তুমি বনী ইসরাইলের বন্দীদের মুক্তি দাও। সে বললো, যদি তোমরা সত্যবাদী হতে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তোমাদের দেশের ওপর চড়াও করতেন না এবং আমরা তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের বন্দী করে আনতাম না। ওই সময় কি আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য করতে অসমর্থ ছিলেন যিনি এখন তোমাকে পাঠিয়েছেন? মোদ্দাকথা, হযরত ইউনুস (عليه السلام) তিন দিন পর্যন্ত তাঁকে অনুরোধ করলেন। তবে সে তাঁর কথা মানেনি।
কেউ কেউ বলেন, ওই লোকটি ছিলো মূর্তিপূজক মুশরিক। হযরত ইউনুস (عليه السلام) তাকে মূর্তিপূজা না করতে বললেন কিন্তু তাঁর কথা সে মানেনি। কারো কারো মতে, তাকে নয় বছর পর্যন্ত বুঝানো হয়েছিল। কারো মতে, ২৩ বছর পর্যন্ত বুঝানো হয়েছিল। তবে দু’জন লোক ছাড়া কেউ ঈমান গ্রহণ করেনি। অবশেষে হযরত ইউনুস (عليه السلام) রাগান্বিত হয়ে আল্লাহর দরবারে এই মর্মে সাহায্য প্রার্থনা করেন যে, হে আল্লাহ্! এসব লোক আমার কথা শুনছে না। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, তাদেরকে ভয়ংকর আযাবের ভয় দেখান। যদি তারা আপনার কথা না শুনে, তাহলে আমি তাদের ওপর আযাব প্রেরণ করবো। সুতরাং হযরত ইউনুস (عليه السلام) কুসা বাজারে ঘুরেফিরে একথা বলতে লাগলেন যে, তোমাদের রাজাকে বলো, সে যদি আমার কথা না মানে, তাহলে আল্লাহ'র আযাব নেমে আসবে।
ওই সব লোকেরা বললো- আযাবের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দাও। হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, আমি তোমাদের নিকট কথা দিচ্ছি চলিশ দিন। যদি এ সময়ের মধ্যে তোমরা আমার কথা মেনে নাও, তাহলে ঠিক আছে। অন্যথায় তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে এ খবর রাজার নিকট পৌঁছে গেলো। বাদশাহ ও মন্ত্রী পরিষদ এ কথায় ঠাট্টা করতে লাগলো। তারা বলতে লাগলো, সে একজন ফকীর ও পাগল। তার বোধশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। হযরত ইউনুস (عليه السلام) আল্লাহর দরবারে নিবেদন করলেন যে, হে আল্লাহ্! আমি ওই সব লোকদের সাথে চলিশ দিনের অঙ্গীকার করেছি। আমার এই অঙ্গীকারকে বাস্তবে পরিণত করুন। নচেৎ আমি অপমানিত হবো এবং নিহত হয়ে যাবে। কারণ ওই সময় এসব লোকদের স্বভাব ছিলো যে ব্যক্তি এরূপ মিথ্যা অঙ্গীকার করতো, তারা তাকে হত্যা করতো। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, তুমি কী কারণে চলিশ দিনের অঙ্গীকার করেছো। ধৈর্যধারণ করা উচিৎ ছিলো। পরিশেষে তাদের কপালে ঈমান জুটবে। এসব লোক দ্বীনের পথ অবলম্বন করবে।
হযরত ইউনুস (عليه السلام) এই জবাব শুনে খুবই মর্মাহত হলেন এবং তাঁর অঙ্গীকারকৃত সময় হতে একটি মাস কেটে গেলো। তখন মূর্তিপূজক সম্প্রদায় হতে দশ-বারোটি গোত্র কী হয়- তা দেখার জন্য পৃথক হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। তিনি সর্বদা এই দু‘আ করতে লাগলেন, হে আল্লাহ্! আমার অঙ্গীকারকে বাস্তবে পরিণত করুন। নচেৎ আমি অপমানিত হবো।
যখন ৩৫ দিন হয়ে গেলো তখন সকাল বেলায় আযাবের আলামত দেখা দিলো। ঘন কালো মেঘ ও তীব্র অগ্নির আকারে লু-হাওয়া শুরু হলো। এবং এর প্রভাব রাজপ্রাসাদের অদূরে পৌঁছালো। তখন মন্ত্রীবর্গ সহকারে বাদশাহ অস্তির হয়ে বেরিয়ে পড়লো। আর বলতে লাগলো এই ছেঁড়াবস্ত্র পরিহিত ফকীরকে অতি দ্রুত খুঁজে আমার নিকট নিয়ে এসো। আমরা তাঁর হাতে তাওবা করবো এবং কয়েদীগণকে তাঁর হাতে সোপর্দ করবো। অনেকে তাঁকে খুঁজলো, কিন্তু কেউ কোথাও তাঁকে খুঁজে পায়নি। বাদশাহ সহ উপায়হীন নর-নারীর সংখ্যা লাখে দাঁড়ালো। নগ্ন মাথা ও খালি পায়ে কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে জঙ্গলে চলে গেলো এবং তাওবার নিয়তে সিজদায় পড়ে আহাজারী করতে লাগলো এবং বলতে লাগলো আমরা ইউনুস (عليه السلام) এর আনীত বিধানের ওপর ঈমান এনেছি। মোদ্দাকথা মহররম মাসের ১০ তারিখ বৃহস্পতিবার তথা চলিশতম দিনে আছরের সময় আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় অনুগ্রহ ও করুণায় তাদের ওপর থেকে ওই আযাব দূর করে দিলেন এবং আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গেলো। বাদশাহ সহ সকল লোক শহরে প্রবেশ করলো এবং হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে খুঁজে নিয়ে আসার জন্য নানা প্রান্তে গোয়েন্দা মোতায়েন করা হল। ওপরন্তু বাদশাহ বললো, যদি কোন ব্যক্তি হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর খবর ও খেঁাজ পায়, তাহলে আমি তাকে একদিন সিংহাসনে বসাব। এ সময়ে তার যে সব ধন-সম্পদের প্রয়োজন হবে তা সে নিতে পারবে। সুতরাং এই লোভে অধিকাংশ লোক বেরিয়ে পড়লো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) চলিশতম দিনের পর ‘নিতওয়া’ অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তখন গ্রামবাসীর নিকট শুনলেন যে, আযাব স্থগিত হয়ে গেছে এবং তারা তোমাকে খুঁজছে।
তিনি মনে করলেন যে, আমি জাতির নিকট মিথ্যুক হয়ে গেলাম। এখন যদি তাদের নিকট যাই, তাহলে তারা আমাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করবে। আর যদি হযরত শিইয়া এর নিকট যাই, তাহলে বনী ইসরাইল এর নিকট বড়ই লজ্জিত হবো। এই ধারণায় হতাশ হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে তিনি উভয় কূল ছেড়ে দিলেন এবং ‘রোম’ অভিমুখে রওয়ানা হলেন। যেহেতু হযরত ইউনুস (عليه السلام) এই দু‘আতে অতি দ্রুত ফলাফল প্রার্থনা করেছেন, তাই ভর্ৎসনা শুরু হলো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) এ বিষয়টি উপলব্ধি করে স্বজাতির নিকট হতে বেরিয়ে পড়লেন যে, বাইরের লোকেরা আযাবে পতিত হবেনা। তবে আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর সাথে শুরু অন্যরূপ ব্যবস্থা। প্রথমে তো সকল বন্ধু-বান্ধব ও চাকর-বাকর চলে গেলো। একজন নারী ও দু’জন বালক ছাড়া কেউ তাঁর সঙ্গী হলো না। তখন তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন একজন পুত্রকে এবং অপর পুত্রকে কাঁধে নিলেন তাঁর স্ত্রী এবং অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে লাগলেন। পথিমধ্যে একটি বৃক্ষের ছায়ায় বিশ্রাম নিলেন এবং প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে জঙ্গলে গেলেন। এই সময় রাজপুত্রের সাওয়ারী ‘মুবরাসাম’ ওই বৃক্ষের নিকট পৌঁছে গেলো। সে দেখলো দু’জন বালকসহ একজন অতি সুন্দরী ও রূপসী যুবতীর মত একজন নারী বসে আছে। তাই সে নিজের ভৃত্যদেরকে আদেশ দিলো যে, এই নারীকে আমার নিকট নিয়ে এসো। এই নারীটি যার পর নাই অক্ষমতা প্রকাশ করতঃ বললো যে, আমি একজন পূণ্যবান লোকের বিবাহিত স্ত্রী এবং তিনি নবী। তবে মদোম্মত্ত ও যৌবনোম্মত্ত রাজপুত্র তার কথা শুনেনি এবং তাকে সাথে নিয়ে গেলো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করতঃ আসার পর স্ত্রীকে পেলেন না। পুত্রদ্বয়কে পেলেন। তারা সংঘটিত ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) মনে করলেন, ভর্ৎসনার কর্মকান্ড শুরু হলো। পুত্রদ্বয়কে সাথে নিয়ে পথ চলতে লাগলেন এবং পথিমধ্যে একটি নদী পড়লো। তখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) একজন পুত্রকে নদীর তীরে রাখলেন এবং অন্য পুত্রকে কাঁধে নিয়ে নদী পার হতে লাগলেন। যখন নদীর মধ্যখানে পৌঁছালেন তখন মুখ ফিরিয়ে নদীর তীরে অপেক্ষমান পুত্রের দিকে তাকালেন এবং এমতাবস্থায় দেখলেন যে, তার দিকে একটি বাঘ ছুটে আসছে। তখন তিনি ভয়ে আবার ফিরে যেতে লাগলেন এবং এমতাবস্থায় তাঁর কাঁধে থাকা পুত্রটি পানিতে পড়ে গেলো এবং কূলে থাকা পুত্রটিকে নিয়ে গেলো বাঘে। হযরত ইউনুস (عليه السلام) একাকী হয়ে রোম সাগরের তীরে পৌঁছালেন এবং সেখানে ছিলো একটি চলমান জাহাজ। হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, আমি একজন দরবেশ লোক। যদি বিনা ভাড়ায় আমাকে বসাও, তাহলে আমিও জাহাজ যোগে যাবো। ব্যবসায়ীরা বললো, আপনি আমাদের অক্ষিযুগলে বসুন। আপনার বরকতে আমাদের বিপদ দূর হয়ে যাবে।
মোদ্দাকথা তিনি জাহাজে উঠলেন এবং জাহাজটি চললো। মধ্য সাগরে হঠাৎ শুরু হলো প্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং জাহাজের চলা থেমে গেলো। কেউ কেউ জাহাজটি চালানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু কারো চেষ্টা ফলোদয় হলোনা। তখন সকলে শলা-পরামর্শ করতে লাগলো। তারা এর কোন কারণ আবিষ্কার করতে পারেনি। জাহাজটির চালক বললো, আমার এই মর্মে অভিজ্ঞতা আছে যে, যখন কোন দাস স্বীয় মনিবের নিকট হতে পালিয়ে এসে জাহাজে উঠে পড়ে তখন এ ধরনের ব্যাপার সংঘটিত হয়। সুতরাং তোমরা জাহাজে এই মর্মে ঘোষণা দাও যে, যে ব্যক্তি স্বীয় মনিবের নিকট হতে পালিয়ে এসেছে সে যেন পরিষ্কার ও স্পষ্টভাবে বলে দেয়। যখন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিলো তখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, আমিই ওই পালানো গোলাম। আমাকে সাগরে নিক্ষেপ করে দাও যাতে জাহাজের আরোহীগণ মুক্তি পায়। লোকেরা বললো, আপনাকে তো কখনো এরূপ অসৎ বলে মনে করা যায় না। অবশেষে লটারী দেওয়া হলো, তখন এতে হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর নাম উঠলো। দ্বিতীয়বার আবার লটারী দেওয়া হলো, তখনো হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর নাম উঠলো। অবশেষে নিরুপায় ও আল্লাহর সিদ্ধান্তে রাজি হয়ে হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে সাগরে নিক্ষেপ করা হলো এবং জাহাজটি রওয়ানা দিলো। ঘটনাক্রমে সাগরে আহারের জন্য অপেক্ষমান একটি মাছ নিক্ষিপ্ত হওয়া মাত্রই হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে গিলে ফেললো। এই সময় আল্লাহর আদেশ পৌঁছালো যে, সাবধান! এই (হযরত ইউনুস) তোমার আহার নয়। বরং তোমার উদরে আমি তাকে বন্দী করছি। তার শরীর যেন আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। মোদ্দাকথা মাছটি হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে নিয়ে রোম সাগর হতে ‘লাতায়েখ’ নামক স্থানে পৌঁছালো এবং সেখান থেকে গেলো দাজলা নদীতে। মাছের উদরে তিনি সর্বদা আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকতেন। এভাবে চলিশ দিন কেটে গেলো। তখন মাছটির ওপর আদেশ দেওয়া হলো যে, এই কয়েদীকে শামী উপকূলে উগরে দাও। মাছটি তৎক্ষণাৎ উগরে দিলো। তাঁর শরীর এরূপ নরম হয়ে গেলো যে, শরীরে মশা-মাছি বসলে তিনি কষ্ট পেতেন এবং এতই দূর্বল হয়ে গিয়েছিলেন যে, হাতে মশা-মাছি তাড়ানোর শক্তি ছিলোনা। ওই সময় আল্লাহ তা‘আলা কদু (লাউ) গাছ সৃষ্টি করলেন। কদু গাছ স্বীয় পাতার মাধ্যমে তাঁর ওপর ছায়া হয়ে রইলো এবং এতে তিনি মশা-মাছি হতে রক্ষা পেলেন যেমন- সূরা সাফ্ফাত এর মধ্যে বর্ণিত রয়েছে।
তাফসীরে মুয়ালিমুত তানযিল গ্রন্থে রয়েছে যে, যখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) মাছের পেট হতে বের হলেন তখন তাঁকে দুধ পান করানোর জন্য একটি হরিণীর ওপর আল্লাহর নির্দেশ আসলো যাতে তিনি শক্তিশালী হন। চলিশ দিন পর হরিণীর আসা বন্ধ হয়ে গেলো। যখন দুধ পানের সময় আসলো এবং হরিণী আসলো না তখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্! আজ আমি ক্ষুধার্ত ও বুভূক্ষ। আল্লাহর পক্ষ হতে বলা হলো যে, তুমি এতটুকু স্বভাব পরিবর্তনকে পছন্দ করছো না আর আমাকে আবেদন করেছিলে যে, আমি যেন নিজের অনুপম স্বভাব পরিত্যাগ করে নিজের এক লাখ বান্দাকে মেরে ফেলি। একথা শুনে হযরত ইউনুস (عليه السلام) তাওবা করলেন এবং আল্লাহর দরবারে আরয করলেন, হে আল্লাহ্! আমি গুনাহগার আমি লজ্জিত এখন আপনার যে আদেশ আসে তা পালন করবো। আদেশ হলো স্বজাতির নিকট গিয়ে বসবাস করো। যখন স্বজাতির অভিমুখে রওয়ানা হলেন তখন পথিমধ্যে নানা পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন যা দ্বারা হযরত ইউনুস (عليه السلام) নিজের ভুল-ত্রুটির ব্যাপারে অবহিত হলেন। যখন তিনি যারপর নাই লজ্জিত হলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা তার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পূর্ণভাবে ক্ষমা করে দিলেন এবং তাঁকে দান করলেন নবুয়তের মহান পদমর্যাদা। আর হযরত শাইয়া (عليه السلام) কর্তৃক তাঁকে প্রদত্ত রিসালতের এলাকা (অধিক্ষেত্র) উঠিয়ে নেওয়া হল এবং তাঁকে স্বতন্ত্র রাসূল করা হল এবং প্রত্যেক দিক হতে করুণা-অনুগ্রহের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হল। যখন তিনি ওই নদীর তীরে পৌঁছলেন যেখানে তিনি দুই পুত্রকে হারিয়ে ফেলেছিলেন তখন দেখলেন যে, গ্রামের লোকেরা দু’জন বালককে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হযরত ইউনুস (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, এই দুই বালক কার? তারা বললো, তারা একজন বুযূর্গ ব্যক্তির পুত্র। একজনকে আমরা বাঘের মুখ থেকে কেড়ে নিয়েছি এবং অন্যজনকে নদীতে ভাসমান অবস্থায় ধোপারা উদ্ধার করে আমাদেরকে দিয়েছে। তাই আমরা তাদেরকে লালন-পালন করি এবং এ অপেক্ষায় আছি যে, ওই বুযূর্গ লোকটি পেলে তাকে সোপর্দ করবো। এতক্ষণে বালকদ্বয় হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে চিনে নিলো। তারা বললো, তিনিই আমাদের পিতা। তখন ওই লোকেরা পুত্রদ্বয়কে তাঁর নিকট সোপর্দ করলো। যখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) পুত্রদ্বয়কে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হলেন এবং ওই বৃক্ষের নিকট গেলেন যেখান থেকে রাজপুত্র তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলো তখন সেখানে অপেক্ষমান কিছু লোক দেখতে পেলেন। হযরত ইউনুস (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা বসে আছো কেন? তারা বললো, আমাদের রাজপুত্র একদিন শিকারের জন্য বের হয়েছিলো এবং তখন জনৈক দরবেশের স্ত্রীকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো। ওই দিন হতে সে পেট ব্যথায় আক্রান্ত। আমাদের রাজা আমাদেরকে এই জন্য নিয়োজিত করেছেন যে, আমরা যেন তাকে দেখা মাত্রই রাজ দরবারে নিয়ে যাই। সেখানে বাদশাহ অপরাধের ক্ষমা চেয়ে নেবেন এবং তার স্ত্রীকে সোপর্দ করবেন। আর ওই নারীটিকে এখনো কেউ স্পর্শ করেনি। এই কথা ও অবস্থা শুনে হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, ওই ফকীর-গরীব লোকটি আমি। তখন বাদশাহর সিপাহীগণ যথাযথ ও পূর্ণ মর্যাদা সহকারে তাঁকে বাদশার নিকট পৌঁছালো। তিনি বাদশার নিকট পৌঁছা মাত্রই রাজপুত্র সুস্থ হয়ে গেলো এবং বাদশাহ তাঁকে তাঁর স্ত্রী সোপর্দ করলো এবং বহু অর্থরাজি ও জিনিসপত্র উৎসর্গ করলো। তিনি যখন ‘মুসিল ও তিনওয়া’ সীমান্তে পৌঁছালেন তখন মানুষকে সংবাদ দেওয়ার জন্য একজন লোক পাঠালেন। যখন এই সংবাদ বাদশার নিকট পৌঁছালো তখন সে মন্ত্রীবর্গ সহকারে উপস্থিত হলো এবং পূর্ণ মর্যাদা সহকারে তাঁকে শহরে নিয়ে গেলো। বাদশাহ অনেক দিন পর্যন্ত তাকে অনুসন্ধান করেছিলো। বাদশাহ যখন মৃত্যুবরণ করলো তখন একজন লোককে খলিফা বানালেন এবং ৭০ (সত্তর) জন অতি আবেদ লোকসহ নিজে ‘সায়হুন’ পাহাড়ে তাশরীফ নিলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত ইবাদতে নিমগ্ন হলেন। ওই স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬০ (ষাট) বছর। সূরা নূন ও সাফ্ফাত এর মধ্যে তাঁর ব্যাপারে আলোচনা রয়েছে।
❏ প্রশ্ন-১৭৯: যখন কোন জাতির ওপর আযাব চলে আসে তখন আযাব চলে আসার পর ঈমান আনা ফলদায়ক নয়। তবে হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর জাতির ওপর মেঘরাজি আসার পরেও যখন তারা ঈমান আনলো তখন তাদের ওপর আযাব উঠিয়ে নেওয়া হলো, এর পেছনে রহস্য কী?
✍ উত্তর: তাবারানী শরীফের একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনওয়া শহরে যখন আযাবের আলামতসমূহ দৃশ্যমান হতে লাগলো এবং হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে খেঁাজার পরও পাওয়া যাচ্ছিলোনা তখন শহরবাসী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নিজেদের জনৈক আলেমের নিকট গেলো যিনি ছিলেন ঈমানদার ও সমকালীন শায়খ এবং তাঁর নিকট তারা আর্তি জানালো। তখন তিনি আদেশ দিলেন, তোমরা এই দু‘আটি পড়ে প্রার্থনা করো,
يا حىّ حين لا حىّ يا حىّ يحى الموتى يا حىّ لا الٰه الّا انت
সুতরাং লোকেরা এই দু‘আটি পড়ে প্রার্থনা করলো এবং আযাব দূর হয়ে গেলো। তবে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও কারামতের অধিকারী ওলী হযরত ফুযাইল বিন আয়ায (رحمه الله تعالي ) বলেন, যে দু‘আটির বরকতে তিনওয়া শহরের আযাব দূর হয়ে গিয়েছিলো সে দু‘আটি ছিলো এটি যে,
اَللهم ان ذنوبنا قد عظُمتْ وجلَّت وانت اعظُم واجلُّ فا فعل بنا ما انت اهلهُ ولا تفعل بنا ما نحنُ اهلهُ .
মোদ্দাকথা আযাব দূর হয়ে যাবার পর হযরত ইউনুস (عليه السلام) যখন শহরের সন্নিকটে আসলেন তখন তিনি শহরে আযাবের কোন চিহ্ন বা নিদর্শন দেখেননি। লোকেরা বললো, আপনি স্বজাতির নিকট চলে যান। তিনি বললেন, আমি কিভাবে স্বজাতির নিকট যাবো? আমি তো তাদেরকে আযাবের সংবাদ দিয়ে শহর হতে বের হয়ে পড়েছি, তবে আযাব আসেনি। তাই এখন এসব লোকেরা আমাকে মিথ্যুক মনে করে হত্যা করে ফেলবে। তিনি নিকষ কালো অন্ধকার মাছের পেটে বন্দী হলেন। তবে ওই পরিস্থিতিতে তিনি এই আয়াতে কারিমার لَا إله الّا اَنْتَ سُبْحَانَكَ اِنِّى كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ . ওজিফা শুরু করে দিলেন। তাই এর বরকতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এই অন্ধকার হতে মুক্তি দিলেন।
❏ প্রশ্ন-১৮০: হযরত নূহ (عليه السلام) কখন হতে রিসালতের পদে অধিষ্ঠিত হন এবং হযরত আদম (عليه السلام)-এর কত বছর পর জন্মগ্রহণ করেন?
✍ উত্তর: হযরত নূহ (عليه السلام), হযরত আদম (عليه السلام)’র ওফাতের ১১২৬ (এক হাজার একশত ছাব্বিশ) বছর পর জন্মগ্রহণ করেন এবং যৌবনে পদার্পণ করা মাত্রই রিসালতের পদে অধিষ্ঠিত হন। অনেক বছর দ্বীন প্রচারের পর মাত্র কয়েক জন লোক তার ওপর ঈমান আনে।
সাড়ে নয়শত বছর পর আল্লাহর দরবার হতে অভিযোগের স্বরে বলা হল, এসব লোক ঈমান আনবে না। এখন তাদের ওপর পাবনের আযাব আসবে। তুমি নিজের জন্য নৌকা বানাও। হযরত জিবরাইল (عليه السلام) ‘ছাল কাঠ বা গাছ নিয়ে আসলেন এবং এগুলো জমিনে লাগানোর জন্য ইঙ্গিত করলেন। বিশ বা চলিশ দিনে এগুলো বড় বৃক্ষে পরিণত হলো। তখন হযরত নূহ (عليه السلام), হযরত জিবরাইল (عليه السلام) এর শিক্ষা মতে নিজের তিন পুত্র এবং অন্য একজন ব্যক্তির সাহায্যে একটি নৌকা বানালেন এবং ভিতরে-বাইরে তৈলবাতি লাগালেন। নৌকাটির দৈর্ঘ্য ছিল এক হাজার গজের চেয়ে বেশি, প্রস্ত ছয়শো গজ এবং উচ্চতা ছিল ত্রিশ গজ। শামসাদ বৃক্ষের কাঠ দিয়ে একটি তাবুত বানিয়ে হযরত আদম (عليه السلام)’র শরীর মুবারকও তাতে রাখলেন এবং প্রজন্ম সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেক প্রাণী ও চতুষ্পদ জন্তুর একেকটি জোড়া নৌকায় উঠানো হল। অবশেষে পাবনের সময় ঘনিয়ে আসলো। একটি অনিঃশেষ উৎস হতে পানি উৎসারিত হতে লাগলো। পুকুর-কূপ ও নদীর পানিও প্রবল তরঙ্গায়িত হতে লাগলো। আকাশ হতে ঝড়-বৃষ্টি বইতে লাগলো এবং চলিশ দিন পর্যন্ত এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলো। জল-স্থল একাকার হয়ে গেলো এবং পর্বত চূড়া সমূহেও পানি উঠে গেলো। ওই জাতির বাদশাহ সাফরুশনাম মৃত্যু ভয়ে পালাতে লাগলো। অবশেষে সে ধ্বংস হয়ে গেলো।
হযরত নূহ (عليه السلام) এর দ্বীনের সাথে বিরোধিতাকারী তার স্ত্রী ওয়া’লা ও পুত্র কেনান নৌকায় আরোহন করতে অস্বীকৃতি জানালো। পরে একটি তরঙ্গ তাদের জীবন সাঙ্গ করে দিলো। নৌকাটি কুফা হতে যাত্রা শুরু করলো এবং হেরেমে মক্কাকে সাতবার প্রদক্ষিণ করলো। নানা দেশ ও ভূখন্ড পাড়ি দিয়ে ঘুরতে লাগলো। অবশেষে পাঁচ মাস পর জুদি পর্বতের চূড়ায় গিয়ে তিনি (عليه السلام) যাত্রা বিরতি করলেন এবং ওই স্থানে এক মাস অবস্থান করেন। বলা হয় যেহেতু প্রলয়ংকারী প্লাবনে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দেখা মিলতো না, তাই হযরত নূহ (عليه السلام) স্বীয় নৌকায় সুকৌশলে এমন দু’টি আলোকিত মোহর স্থাপন করেন যা দ্বারা রাত-দিনের ঘন্টার হিসাব জানা যেত এবং এর হিসাবে নামায-রোযা পালন করতেন।
আরো কিছু চমৎকার ও বিরল বর্ণনা লোকমুখে প্রসিদ্ধ আছে যেমন- নৌকার ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য হযরত নূহ (عليه السلام) আল্লাহর হুকুমে হাতীর পিঠে হাত রাখলেন, তখন এর দ্বারা শুকরের জন্ম হলো যেটি নৌকার ময়লা-আবর্জনা পানাহার করে পরিষ্কার করে দিতো। এরপর নৌকাবাসী লোকেরা ইঁদুরের জ্বালায় অতীষ্ট হয়ে উঠলো। তখন হযরত নূহ (عليه السلام) আল্লাহ'র হুকুমে বাঘের কপালে হাত ফেরালেন এবং বাঘটি হঁাচকি দিলো, তখন তার নাক হতে বের হলো বিড়াল এবং সে ইঁদুর খতম করতে লাগলো ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরূপ একটি রেওয়ায়তে একথা প্রসিদ্ধ রয়েছে যে, যখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেলো তখন তিনি পাবনের সংবাদ সংগ্রহের জন্য কাক-কে পাঠালেন, তবে সে মৃত জীব ও প্রাণী দেখে তাতে নিমগ্ন হয়ে গেলো। এরপর পাঠানো হল কবুতরকে, তখন সে যয়তুন বৃক্ষের কিছু পাতা ছিড়ে আনলো যার দ্বারা বুঝা গেলো যে, পানি গাছের উপরে উঠেছিলো। এর কিছুক্ষণ পর সে ঠেঁাটে কিছু মাটি নিয়ে আসলো যেটি হলো একথার আলামত যে, এখন জমি দৃশ্যমান হয়েছে। অবশেষে সকল নৌকাবাসী লোক আশুরার দিন নৌকা হতে নামলো এবং জুদি পাহাড়ের সন্নিকটে বসতি স্থাপন করলো। যেহেতু তাদের সংখ্যা ছিলো ৮০ (আশি) জন, তাই এই বসতির নামকরণ করা হলো ‘সাওক-আল সামানিন’ অর্থাৎ আশিজন বসতি স্থাপনকারীর বাজার। এরপর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলো মহামারীর। কেবল হযরত নূহ (عليه السلام), তাঁর তিন পুত্র ও পরিবারবর্গ তথা তার বিবিগণ ছাড়া অবশিষ্ট সকল লোক মরে গেলো। তাঁর পুত্রদের নাম হচ্ছে:
(১) সাম,
(২) হাম, ও
(৩) ইয়াফেস।
হযরত নূহ (عليه السلام) গোটা বিশ্বের সকল বসতিকে তিন পুত্রের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। মুলকে শাম, ইরান, খুরাসান ও ইরাক পড়লো সামের ভাগে। আফ্রিকান দেশ সমূহ, হাবশা, সিন্ধা, হিন্দা ও সুদান পড়লো হামের ভাগে এবং চীন ও তুর্কিস্তান পড়লো ইয়াফেস এর ভাগে।
❏ প্রশ্ন-১৮১: হযরত আদম (عليه السلام)’র পদার্পনের কত দিন পর এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়?
✍ উত্তর: প্লাবন বা তুফানের ঘটনাটি সংঘটিত হয় হযরত আদম (عليه السلام)’র পদার্পনের ২২৮২ (দুই হাজার দুই শত বিরাশি) বছর পর। এরপর হযরত নূহ (عليه السلام) তিন শত পঞ্চাশ বছর জীবিত ছিলেন। তাঁর পার্থিব বিদায়ের সময় হযরত জিবরাইল ও আযরাইল (عليه السلام) তাঁর নিকট জীবনকাল সম্পর্কে এই মর্মে জিজ্ঞাসা করেন যে, দুনিয়া কেমন? উত্তরে তিনি বলেন, জীবনকে আমি এমন একটি ঘর হিসেবে পেয়েছি যার দু’টি দরজা রয়েছে। তার একটি দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম, অল্পক্ষণ অবস্থান করলাম, এরপর দ্বিতীয় দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলাম। হযরত নূহ (عليه السلام) বয়স পেয়েছিলেন ১৪৬৬ (এক হাজার ছয়শত ছিষট্টি) বছর। কেউ কেউ অন্যান্য সংখ্যাও উল্লেখ করেন। হযরত নূহ (عليه السلام) এর উপাধি হচ্ছে ‘শায়খুল আন্বিয়া’ ও ‘নাজিউল্লাহ’। তাঁকে দ্বিতীয় আদমও বলা হয়। তাঁর ওপর দশটি সহীফা অবতীর্ণ হয়। তাঁর কবর শরীফ বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত।
❏ প্রশ্ন-১৮২: يَا هُوَ শব্দের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কি এবং هو সর্বনামের প্রত্যাবর্তন কোন দিকে? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: يَا هُوَ এর শাব্দিক অর্থ, হে আল্লাহ্! এটা আল্লাহ্ তা‘আলার জাতি বা সত্তাগত নাম। সুফিয়া-ই কিরাম অধিকাংশ সময় এটির অযিফা পাঠ করে থাকেন। আর هو সর্বনামের মারজা বা প্রত্যাবর্তনস্থল হচ্ছে, আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু।
❏ প্রশ্ন-১৮৩: ফাসিক কারা এবং এদের নাম কি?
✍ উত্তর: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন- সর্প, ইঁদুর ও কাক হলো ফাসিক।
ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণিত আছে, কাক কি খাওয়া যাবে? হযরত ইবনে ওমর (رضى الله تعالي عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফাসিক বলার পর এটি কে খাবে?
228. হায়াতুল হাইওয়ান, মাখযনে মা‘লুমাত, পৃষ্ঠা-৫৪৩।
❏ প্রশ্ন-১৮৪: ক্বিবলা কাকে বলে এবং ক্বিবলাকে ক্বিবলা কেন বলা হয়? তাহ্ক্বিকসহ বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: قِبْلَةٌ শব্দটি فِعْلَةٌ ওযনে, সামনের দিককে বলা হয়। অথবা এমন অবস্থাকে বুঝায় যা কোন বস্তুর সম্মুখ দিক থেকে সৃষ্টি হয়। অথবা শব্দটি مقابلة বা استقبال থেকে নির্গত। নামাযীর সম্মুখে থাকার কারণে এটাকে ক্বিবলা বলা হয়।
❏ প্রশ্ন-১৮৫: غيرذوى العقول বা জ্ঞানহীনদের ক্ষেত্রে ذوى العقول বা জ্ঞানবানদের জন্য ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহার করা শুদ্ধ কি-না? যেমন- সূরা আ‘রাফের ১৯১নং আয়াতে وهم يخلقون এবং ১৯৩নং আয়াতে وان تدعوهم اِلى الهدىٰ এর মধ্যে هُمْ সর্বনামটির প্রত্যাবর্তনস্থল কি? যদি মূর্তি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে ذوى العقول (জ্ঞানবান) এর সর্বনাম غير ذوى العقول (জ্ঞানহীন) এর জন্য ব্যবহার কিভাবে শুদ্ধ হলো?
✍ উত্তর: প্রশ্নোলিখিত উভয় আয়াতের هم সর্বনামটি মূর্তিসমূহের দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়েছে। যা পূর্বের আয়াতে ما শব্দের মর্মে নিহিত রয়েছে। هم সর্বনামটি যদিও ذوى العقول তথা জ্ঞানবানদের জন্য ব্যবহৃত হয়, কিন্তু মুশরিকরা যেহেতু মূর্তিগুলোকে তাদের ইলাহ বানিয়েছিল এবং সেগুলোকে জ্ঞানী মনে করতো। তাই কোরআনে কারীম(ﷺ) ের বর্ণনা পদ্ধতিও তাদের আক্বিদা-বিশ্বাস অনুপাতে তিরস্কার ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়। আল্লামা সৈয়দ মাহমুদ আলূসী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন,
وايراد ضمير العقلاء مع ان الاصنام بما لا يعقل انما هو بحسب اعتقادهم فيها واجرائهم لها مجرى العقلاء .
‘মূর্তি প্রতিমা ذوى العقول না হওয়া সত্ত্বেও ذوى العقول এর সর্বনাম ব্যবহার করা এ জন্যই যে, মূর্তিপূজারীরা তাদের দেব তাদের মূর্তিকে তাদের আক্বিদা মতে ذوى العقول এর স্থলাভিষিক্ত করেছে।’
229. রুহুল মা‘আনী, খন্ড-৯, পৃষ্ঠা-১৪৩; তাফসীরে মাযহারী, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪৪৪।
❏ প্রশ্ন-১৮৬: সূরা আ‘রাফে আল্লাহ্ তা‘আলার বাণী,
مَا لَا يَخْلُقُ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ। এখানে ما শব্দ দ্বারা কারা উদ্দেশ্য? ما শব্দটি ذوى العقول (জ্ঞানবান)-এর জন্য ব্যবহার করা হয়, না غير ذوى العقول (জ্ঞানহীন)-এর জন্য ব্যাখ্যা কর?
✍ উত্তর: উক্ত আয়াতে ما শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য ইবলিস ও প্রতিমা। আর ما শব্দটি অধিকাংশ غير ذوى العقول তথা জ্ঞানহীন ও প্রাণহীনদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
لما قال البغوى آيشركون ما‘ اى ابليس والاصنام . قال القاضى ثناء الله بانى بتى هم‘ ضمير الاصنام . تفسير مظهرى، قال البيضاوى ما‘ اى الاصنام .
‘আল্লামা বাগবী (رحمه الله تعالي ) বলেন, এখানে ما يشركون এর ما দ্বারা ইবলিশ ও মূর্তিদেরকে বুঝানো হয়েছে। আল্লামা ছানাউল্লাহ পানিপথি (رحمه الله تعالي ) বলেন, এখানে هم সর্বনাম দ্বারা দেব-দেবীদের বুঝানো হয়েছে। তাফসীরে মাযহারী। আল্লামা বায়যাবী বলেন, ما দ্বারা মূর্তি বুঝানো হয়েছে।’
230. তাফসীরে বায়যাবী, খন্ড- ৩য়, পৃষ্ঠা-৩৮,200. সূরা আ‘রাফ।
❏ প্রশ্ন-১৮৭: সূরা আ‘রাফে مِنْ دُونِ اللهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ আয়াতে عباد শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য কী? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: عباد শব্দটি عبد -এর বহুবচন। অর্থ- মালিকানাধীন। উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তা‘আলা শিরককে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে মক্কার মুশরিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা যাদের ইবাদত করছ এবং তোমরা যাদেরকে নিজেদের উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছ- এদের ও তোমাদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। তোমাদের মালিক যেমন আল্লাহ তা‘আলা, তেমনি তাদের মালিকও আল্লাহ্ তা‘আলা। মা‘বুদ বা উপাস্য এমন হওয়া উচিত যে, তিনি উপাসনাকারীদের চেয়ে সম্মান ও মর্যাদায় অনেক উত্তম ও উন্নত হবেন।
231. তাফসীরে মাযহারী, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪৪৪
❏ প্রশ্ন-১৮৮: হযরত ইউসুফ (عليه السلام) ও যুলাইখা বিবির বিবাহের পদ্ধতি ও বাস্তব অবস্থা কিরূপ ছিল? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: মুফাস্সিরীনে কিরাম বিশেষতঃ তাফসীরে রূহুল মা‘আনি, তাফসীরে কুরতুবি এবং মু‘আলিমুত্ তানযীলসহ অপরাপর মুফাস্সিরীনে কিরামগণ বলেন, হযরত ইউসুফ (عليه السلام) ও বিবি যুলাইখার মাঝে বিবাহ হয়েছিল কিনা এ বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে যে, হযরত ইউসুফ (عليه السلام) যখন মিসরের বাদশাহর নিকট গেলেন। আজিজে মিসরের স্ত্রীর সঙ্গে প্রকাশিত ঘটনার ব্যাপারে ইউসুফ (عليه السلام) নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিশরের বাদশাহ তাঁকে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ আসনে সমাসীন করেন। অতঃপর আজিজে মিশরের ইন্তিকালের পর হযরত ইউসুফ (عليه السلام)কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন এবং তার স্ত্রী কতেক মুফাস্সিরীনের মতে যুলাইখার সঙ্গে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর বিবাহ হয়। আজিজে মিশর যেহেতু পুরুষত্বহীন ছিলেন, বিধায় যুলাইখা ওই সময় পর্যন্ত কুমারী ছিলেন। অতঃপর যুলাইখার গর্ভে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর তিন সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তাঁদের নাম আফরাইম, মাইশা এবং রহমত।
232. তাফসীরে মু‘আলিমুত্ তান্যীল, পৃষ্ঠা-৪৩২; তাফসীরে কুরতুবী।
❏ প্রশ্ন-১৮৯: শয়তান বিতাড়িত ও অভিশপ্ত হওয়ার পূর্বে ফিরিশতাদের সঙ্গে কোন্ কোন্ বিষয়ে আদিষ্ট ছিল?
✍ উত্তর: মুফাস্সিরীনে কিরাম শয়তান সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকারের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, ইবলিশ ফিরিশতাদের একটি গোত্রের ছিল, যাদেরকে ‘জ্বীন’ বলা হত। তাদেরকে গরম আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, যখন ফিরিশতাদেরকে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। সুরইয়ানী ভাষায় শয়তানের নাম ছিল আযাযিল এবং আরবীতে হারিস। সে ছিল জান্নাতের কোষাধ্যক্ষ এবং দুনিয়ার আকাশের প্রধান। আকাশ ও দুনিয়ার জগতে তার রাজত্ব ছিল। ফিরিশতাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মুজতাহিদ ও জ্ঞানী ছিল। যে কারণে তার মধ্যে গৌরব ও অহংকার সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর হুকুমের কুফরী করার কারণে বিতাড়িত হয়।
তাফসীরে ফাতহুল ক্বাদীর এবং তাফসীরে ইবনে কাসীরে উল্লেখ আছে,
كان من اشد الملائكة اجتهادًا او اكثرهم علمًا . كان من اشرف الملائكة واكرمهم قبيلة وكان خازنا كان له سلطان السماء الدنيا وكان له سلطان الاض الخ .
‘ইবলিশ ফিরিশতাদের চেয়ে বড় গবেষক ও বিজ্ঞানী ছিল, ফিরিশতাকুলের চেয়ে অধিক মর্যাদাবান ও সম্মানী ছিলো, বংশগতভাবেও সে পরম শ্রদ্ধাভাজন ছিল এবং সে ভান্ডার রক্ষক ছিল। তার হাতে দুনিয়া তথা প্রথম আসমানের বাদশাহী ন্যস্ত ছিল এবং তার হাতে পৃথিবীর রাজত্ব ছিল।’
233. তাফসীরে ইবনে কাসীর, খন্ড- ৩ পৃষ্ঠা-৭৭।
❏ প্রশ্ন-১৯০: ইচ্ছাকৃত হত্যাকারী কি সর্বদা জাহান্নামে থাকবে? অথচ হাদীস শরীফে এসেছে, شفاعتى لاهل الكبائر(আমার উম্মতের কবীরা গোনাহকারীদের জন্য আমার সুপারিশ)। এতে বুঝা যায়, হত্যাকারীরা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে না। অতএব, এরা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে, কী থাকবে না? দলিলসহ বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: ইচ্ছাকৃত হত্যাকারীর তাওবা কবুল হবে কিনা এবং ওই ব্যক্তি চিরকাল জাহান্নামে থাকবে কিনা এ বিষয়ে ইমামগণের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতে, যদি ওই ব্যক্তি মু’মিন হয় তাহলে আল্লাহ তা‘আলার মাগফিরাত এবং হুযূর -এর শাফা‘আতের দ্বারা জাহান্নামে শাস্তিভোগ করার পর জান্নাতে যাবে। ঈমানের কারণে চির জাহান্নামী হবে না। কিন্তু এ হুকুম ওই সময় প্রযোজ্য হবে, যখন উক্ত ব্যক্তি হত্যাকে হালাল মনে করে হত্যাকান্ড সংঘটিত না করে থাকে। অন্যথায় হালাল মনে করে হত্যা করার অপরাধে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। সে কারণে জমহুর ওলামায়ে কিরাম উক্ত আয়াতে خالدًا শব্দের ব্যাখ্যা বিস্তারিতভাবে করেছেন- من يقتل متعمدًا ।
234. তাফসীরে ইবনে কাসীর, খন্ড- ১, পৃষ্ঠা:৫৩৭
❏ প্রশ্ন-১৯১: সূরা আলে-ইমরানে ইরশাদ হয়েছে,
إِنَّ مَثَلَ عِيسَى عِنْدَ اللهِ كَمَثَلِ آدَمَ উক্ত আয়াতে হযরত ঈসা (عليه السلام)কে হযরত আদম (عليه السلام)-এর অনুরূপ ও সাদৃশ হিসেবে তুলনা করা হয়েছে। অথচ হযরত আদম (عليه السلام) ছিলেন মাতা-পিতাবিহীন এবং হযরত ঈসা (عليه السلام) হলেন পিতাবিহীন। অতএব এ সাদৃশ্যতা কিভাবে শুদ্ধ হবে? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: হযরত ঈসা (عليه السلام) সাধারণ প্রচলিত নিয়ম ও পদ্ধতি বর্হিভূত পিতা ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এটা ছিল এক আশ্চর্য বিষয়। কিন্তু এর চেয়ে আরো বেশী আশ্চর্যের বিষয় ছিল হযরত আদম (عليه السلام) মা-বাবা উভয় ছাড়াই আল্লাহ তা‘আলার কুদরতী শক্তিতে সৃষ্টি হয়েছিলেন। সুতরাং এখানে এক বিস্ময়কর বিষয়কে তার চেয়েও আরো অধিক বিস্ময়কর বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। দৃষ্টান্ত ও উপমায় উপমান ও উপমেয় সকল দিক দিয়ে একরকম ও সমান হওয়া শর্ত নয়। বরং উপমানে কিছু গুণ উপমেয়-এর মধ্যে পাওয়া যাওয়াই উপমা ও দৃষ্টান্তের জন্য যথেষ্ট। যেমন- কোন মানুষের বীরত্ব ও সাহসিকতার দৃষ্টান্ত বাঘের সাথে করা হয়। অথচ উভয়ের মধ্যে প্রত্যেক দিক দিয়ে সমতা নেই।
235. তাফসীরে খাযেন,200. সূরা বাকারা, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩০১।
❏ প্রশ্ন-১৯২: হযরত আদম (عليه السلام) এর সন্তানদের মাঝে ঝগড়া-বিবাদের কারণ কি ছিল? এবং তাদের মধ্যে ভাই-বোনের পার্থক্যের নিয়ম কি ছিল? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: হযরত আদম (عليه السلام)-এর সন্তানদের মাঝে ঝগড়ার কারণ সম্পর্কে অধিকাংশ মুফাস্সিরীনে কিরামের অভিমত হচ্ছে, হযরত আদম (عليه السلام)-এর যখনই কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করত, এক ছেলে ও এক মেয়ে জোড়া হিসেবে জন্মগ্রহণ করতো। কেননা আদম (عليه السلام) ছিলেন পৃথিবীতে প্রথম মানব এবং তার বংশধারা অবশিষ্ট থাকুক, এটাই ছিল আল্লাহ তা‘আলার ঐকান্তিক ইচ্ছা। তাই আল্লাহ তা‘আলা একটি নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছেন যে, প্রত্যেক জোড়া পরস্পর বিবাহ জায়েয হবে না, বরং এক জোড়া অপর জোড়ার সঙ্গে বিবাহ জায়েয হবে। তাই প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে গর্ভের ভিন্নতা, বংশের ভিন্নতা হিসেবে গণ্য হতো। অনুরূপ হযরত আদম (عليه السلام)-এর ছেলে কাবিলের সাথে একই গর্ভে যে মেয়েটি জন্মেছিল তার নাম আকলিমা এবং সে পরমা সুন্দরী ছিল। পরবর্তী গর্ভে যে ছেলেটি জন্মেছিল তার নাম ছিল হাবিল এবং তার বোনের নাম ছিল লুবাদা। এখন শরীয়তের বিধান মোতাবেক যখন বিবাহের সময় হলো, তাই আকলিমার বিবাহ হাবিলের সঙ্গে হচ্ছে। তখন কাবিল তা অস্বীকার করে বলতে লাগলো, তার জন্ম যেহেতু আমার সঙ্গে হয়েছে বিধায় আমিই তার হকদার। আকলিমা ছিল লুবাদার চেয়ে অধিক সুন্দরী এবং সুশ্রীও। এ ব্যাপারে হযরত আদম (عليه السلام) কাবিলকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেন কিন্তু সে তা মানতে রাজি হয়নি। অতঃপর হযরত আদম (عليه السلام) হাবিল ও কাবিল উভয়কে মানত করার হুকুম দিলেন যে, যার মানত কবুল হবে, তার পক্ষে ফয়সালা দেয়া হবে। দেখা গেল- হাবিলের মানতই কবুল হলো। এতে কাবিল আরো অধিক ক্ষিপ্ত বা ক্রোধান্বিত হলো। পরিশেষে সে হাবিলকে অন্যায়ভাবে হত্যা করল।
236. তাফসীরে তাবারী, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-১৮৮,200. সূরা মায়েদা; তাফসীরে ইবনে কাসীর, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৪১।
❏ প্রশ্ন-১৯৩: আসহাবে কাহাফের কুকুর জান্নাতে যাবে কিনা? এ ব্যাপারে ওলামাই কিরামের মতামত কি?
✍ উত্তর: আসহাবে কাহাফের কুকুর সম্পর্কে কোরআনে কারীম(ﷺ) কোন হুকুম পাওয়া যায়নি। সে সম্পর্কে কোরআন নীরব এবং হাদীস শরীফেও সে বিষয়ে উল্লেখ করেনি। হ্যাঁ! মুফাস্সিরীনে কিরামদের মধ্যে কেউ কেউ এমন কিছু পশুর কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলো জান্নাতে যাবে। আসহাবে কাহাফের কুকুরও উক্ত সূচিক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে।
237. রুহুল বয়ান, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-২২৬; রুহুল মা‘আনী, খন্ড-১৫, পৃষ্ঠা-২২১; وكلبهم باسط :এর আলোচনার অধীনে; তাফসীরে জুমাল, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-১২;200. সূরা কাহাফ, باسط ذراعيه আয়াতের অধীনে।
❏ প্রশ্ন-১৯৪: বর্তমানে প্রচলিত ফাঁসির শাস্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে কিসাসের হুকুমের অন্তভুর্ক্ত হবে কি-না?
✍ উত্তর: শরীয়তে কিসাসের শাস্তি প্রদানের জন্য যে শর্তসমূহ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা নিম্নরূপ। কিসাসের মধ্যে মৌলিক শর্ত তিনটিঃ
১. হত্যাকারী থেকে কিসাস লওয়া। বাস্তবিকপক্ষে হত্যাকৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের ওপর নির্ভর, তারা ইচ্ছে করলে কিসাস নিতে পারে, না হয় দিয়্যত বা রক্তপণ গ্রহণ করতে পারে। আর ইচ্ছে করলে ক্ষমাও করে দিতে পারে।
২. কিসাস লওয়ার সময় হত্যাকৃত ব্যক্তির ওয়ারিশরা উপস্থিত থাকা আবশ্যক।
৩. হানাফিদের মতে একটি শর্ত এটাও যে, কিসাস তরবারি দ্বারা নিতে হবে। বর্তমানে ফাঁসির প্রচলিত নিয়মে উক্ত তিনটি শর্ত পাওয়া যায় না বিধায় শর্ত অনুপস্থিতির কারণে ওটাকে শরয়ী কিসাস না বলে তা‘যির বা শাস্তি বলা যেতে পারে। অবশ্য কিসাস বলা শুদ্ধ হবে না।
قال العلامة علاء الدين الكاسانى استبقاء القصاص تثبتُ باسباب .
আল্লামা আলাউদ্দিন কাসানী (رحمه الله تعالي ) বলেন, قصاص বা বদলা নেয়ার কার্যকারিতা বিভিন্ন প্রদ্ধতিতে হতে পারে।
238. বদায়েউস্ সানায়ে, জেনায়াত অধ্যায়, খন্ড-৭, পৃষ্ঠা- ২৪৩।
হ্যাঁ! অবশ্য হত্যাকারীকে শাস্তি দেয়ার জন্য ফাঁসি কার্যকরী একটি উত্তম কাজ। যদিও কিসাস না হয়। তবুও এটি বাস্তবায়ন করা জায়েয ও বৈধ।
❏ প্রশ্ন-১৯৫: বর্তমানে মানুষ গাছের পরিবর্তে ষ্টীল, লোহা ও পাষ্টিক ইত্যাদি দ্বারা ঘরের সরঞ্জামাদি ও অলংকার তৈরী করছে। এ জাতীয় সরঞ্জাম, খাট ও অলংকার ব্যবহার করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয আছে কিনা? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: শরীয়তের পক্ষ থেকে মহিলাদের জন্য যে কোন প্রকারের সরঞ্জাম ও অলংকার ইত্যাদির ব্যবহার জায়েয রেখেছেন। কিন্তু পুরুষদের জন্য শুধু রৌপ্য ব্যবহার বৈধ করেছেন। এ ছাড়া অন্যান্য পদার্থের তৈরী জিনিস ব্যবহার মাকরূহ বলেছেন। অতএব এ জাতীয় জিনিস ব্যবহার না করাই উচিত। ফাতওয়া হিন্দিয়াতে আছে,
والتختم بالحديد والصفر والنحاس مكروه للرجال والنساء .
অর্থ: লোহা, দস্তা ও তামা নির্মিত আংটি ব্যবহার পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্যই মাকরূহ।
239. ফাতওয়া হিন্দিয়া, দশম অধ্যায়: স্বর্ণ ও রৌপ্য ব্যবহার প্রসঙ্গে, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩৩৫; অনুরূপ বায্যায়্যিাহ আলাল মু‘আমিশিল হিন্দিয়াহ, কারাহিয়া অধ্যায়, সপ্তম পরিচ্ছেদ: পোশাক প্রসঙ্গে, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৬৮।
قال العلامة التمرتاشى ولا يتختم بغيرها، كحجر و ذهب وحديد وصفر ورصاص وزجاج وغيرها بمامر .
‘আল্লামা তামরতাশী বলেন, রৌপ্য ছাড়া অন্যান্য ধাতব নির্মিত আংটি (পুরুষ) ব্যবহার করতে পারবে না। যেমন- পাথর, স্বর্ণ, লোহা, দস্তা, তামা ও শিশা ইত্যাদি যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।’
240. রদ্দুল মুহ্তার, কারাহিয়া অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: পোশাক প্রসঙ্গে, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৬০; বাহরুর রায়েক্ব, কারাহিয়া অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: পোশাক প্রসঙ্গে, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-১৯১; ফাতওয়া হক্কানীয়া, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৪১৯।
❏ প্রশ্ন-১৯৬: পুরুষদের জন্য অপ্রয়োজনীয় লোম ক্ষুর দ্বারা পরিষ্কার করা কি আবশ্যক? লোম পরিষ্কার করার পাউডার ব্যবহার করা যাবে কি-না? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: পুরুষদের জন্য অপ্রয়োজনীয় লোম ক্ষুর দ্বারা পরিষ্কার করা জরুরী বরং সুন্নাত তরিকা। এ ক্ষেত্রে মেডিসিন পাউডার ব্যবহার করার অনুমতিও আছে, যা দ্বারা লোম পরিষ্কার হয়। যা খোলাফে আওলা বা অনুত্তম। হ্যাঁ! মহিলাদের জন্য ব্যবহারের অনুমতি আছে। আল্লামা আবদুল হাই লক্ষ্মৌভী (رحمه الله تعالي ) ‘নফউল মুফতি ওয়াস্ সায়েল’ (نفع المفتى والسائل) গ্রন্থে বলেছেন,
هل يجوز قطع شعر العانة بالمراقض ؟ الاستبشار هو خلاف السنة قال الملا على القارى فى المرقات . قال ابن الملك لو ازال شعرها بغير الحلق لايكون على وجه السنة ، وفيه ان ازالته قد يكون بالنورة وقد ثبت انه عليه السلام استعمل النورة على ماذكره السيوطى فى رسالة نعم لو ازالها بالمقراض لايكون اتباعًا للسنة على وجه الكمال .
লোমনাশক পাউডার বা লোশন দ্বারা নাভীর নীচে পরিষ্কার করা জায়েয আছে কি-না? লোম উপড়ানো সুন্নতের খেলাপ- মোল্লা আলী ক্বারী মিরকাত শরীফে বলেছেন, আল্লামা ইবনে মালেক বলেছেন- নাভীর নীচের লোম যদি মুন্ডানো ব্যতিত অন্যভাবে পরিষ্কার করে তবে তা হবে সুন্নাতের খেলাফ। কেউ যদি লোমনাশক পাউডার বা লোশন দ্বারা পরিষ্কার করে, তবে তা আল্লামা সুয়ূতির মতে, জায়েয। যেহেতু তিনি তার রেছালায় হুযূর এরূপ মেডিসিন দ্বারা লোম ছাপ করেন মর্মে বর্ণনা করেন। হ্যাঁ! সেটা যদি কেচি দ্বারা ছাটা হয়, তবে তা যথাযথ সুন্নাত মোতাবেক হবে না।
241. নফউল মুফতি ওয়াস্ সায়েল, কিতাবুল খতর ওয়াল ইবাহা; ফাতওয়া হিন্দিয়া, কিতাবুল কারাহিয়া ফিল খাতানে ও খেছা, পৃষ্ঠা-৩৫৭, ৩৫৮; অনুরূপ দুর্রুল মুখতার গ্রন্থে উলেখ আছে।
ইমাম ইবনে মাজাহ (رحمه الله تعالي ) তাঁর ‘সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফে’ উক্ত মাসআলার ওপর একটি অধ্যায় باب الاطلاء بالنورة অর্থাৎ- ‘মেডিসিন পাউডার দ্বারা লোম পরিষ্কার করার বিধান কি?’ নামক একটি শিরোনাম কায়েম করেন।
❏ প্রশ্ন-১৯৭: বর্তমানে গাইরে মুকালিদ তথা আহলে হাদীস ও জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা মাযহাব চতুষ্টয় এবং তাদের তাকলীদ ও অনুসরণকে শিরক বলে মাযহারের বিরোধীতা করছে। তাদের এ মনোভাব শুদ্ধ কি-না? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: মাযহাব চতুষ্টয় সম্পর্কে সমস্ত উম্মতের ইজমা বা ঐকমত্য রয়েছে। মাযহাব পরিত্যাগ করা এবং এঁদের বিরোধীতা করা শুদ্ধ হবে না বরং অবশ্যই গোনাহগার হবে। আল-আশবাহ ওয়ান্ নযায়ের গ্রন্থে উল্লেখ আছে,
وما خالف الاربعة فهو مخالف الاجماع .
অর্থাৎ- ‘যারা মাযহাব চতুষ্টয়ের বিরোধতা করল, পক্ষান্তরে তারা ইজমায়ে উম্মতের বিরোধীতা করল।’
242. আল-আশবাহ ওয়ান নযায়ের, পৃষ্ঠা-১৩১, অনুরূপ মোল্লা জিওয়ানও (رحمة الله) বলেছেন। তাফসীরে আহমদী,200. সূরা আলে-ইমরান, পৃষ্ঠা-৩২৬; তাফসীরে মাযহারী,200. সূরা আলে-ইমরান, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৬।
❏ প্রশ্ন-১৯৮: ইন্জেকশনের মাধ্যমে জন্তু যেমন-গরু, মহিষ ইত্যাদির বংশ বিস্তারের জন্য গর্ভধারণের ব্যবস্থা করা শরয়ী বিধান মতে বৈধ কি-না? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: প্রত্যেক বস্তুর স্রষ্টা আল্লাহ্ তা‘আলা। তিনি বিভিন্ন বস্তুকে বিভিন্ন মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন এবং স্তর বিশেষ ও শ্রেণি অনুপাতে অস্তিত্ব দান করেছেন। এসব আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। যেহেতু জীব-জন্তুর মধ্যে বংশীয় দিক ও সম্পর্কের প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরী বিষয় নয়। তাই জন্তুর মধ্যে মা জন্তুই আসল ও মূল এবং বাচ্চাও হালাল-হারাম হওয়ার ব্যাপারে মা জন্তুর অনুসরণে হয়ে থাকে। সুতরাং জন্তুর বংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইনজেকশন ব্যবহার করে গর্ভধারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা কোন খারাপ ও মন্দ কাজ নয়। আল-আশবাহ ওয়ান নযায়ের গ্রন্থের শরায় ইমাম সৈয়দ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আল-হুমুভী আল-মিসরী (رحمه الله تعالي ) বলেন,
والمولود بين الاهلى والوحشى يتبع الام لان الاصل فى التبعيّة الام حتى ان نرى الذئب على الشأة يعنى بالولد .
‘গৃহপালিত ও বন্য গাধার প্রজননে বাচ্চা জন্ম হলে বাচ্চার ওপর মায়ের হুকুম বর্তাবে। কেননা এ ক্ষেত্রে মা-ই আসল। এমনকি যদি নেকড়ে বাঘের প্রজননে ছাগল গর্ভবতী হয়, ওই বাচ্চার ওপর ছাগলের হুকুম বর্তাবে।’
243. গম্যে উয়ূনুল বসায়ের, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৩৭।
এটা মানবজাতির সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ মানব বৃদ্ধিতে পিতাই আসল এবং পিতা থেকেই বংশধারা ও মানব পরিচিতি হয়ে থাকে।
ইমাম আবু বকর আহমদ ইবনে আলী আল-রাযী আল-জাস্সাস (رحمه الله تعالي ) বলেন,
ولو ولدت حمارة وحشية من حمار اهلى أكل ولدها، فكان الولد تابعًا لامه دون ابيه .
‘জঙ্গলী গাধা (গয়াল) যদি পালিত গাধার প্রজননে বাচ্চা দেয় তবে ঐ বাচ্চা খাওয়া জায়েয (মায়ের হুকুমে) বাপের হুকুম এখানে বর্তাবে না।’
244. আহকামুল কোরআন লিল জাস্সাস, সূরা আন-নাখল, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩।
❏ প্রশ্ন-১৯৯: রোগীকে রক্ত প্রদান করার শরয়ী বিধান কি?
✍ উত্তর: কোন দুর্ঘটনা জনিত কারণে কিংবা জটিল-কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার দরুন প্রাণ রক্ষার্থে মানুষের রক্ত দ্বারা উপকৃত হওয়া জায়েয। শায়খ মুহাম্মদ কামিল ইবনে মুস্তফা(ﷺ) আত্-তারাবিলীসি আল-হানাফি (رحمه الله تعالي ) ‘আত্-তাহ্যীব’ গ্রন্থে বলেছেন,
يجوز لعليل شرب البول والدم والميتة للتداوى اذا اخبره طبيب مسلم ان شفائه فيه ولم يجد من المباح ما يقوم مقامهُ .
‘মুমূর্ষ রোগীর জন্য মৃত প্রাণী, প্রস্রাব ও রক্ত ঔষধ হিসেবে খাওয়া জায়েয, যদি মুসলিম অভিজ্ঞ ডাক্তার এতে আরোগ্যের নিশ্চয়তা দেয় এবং এছাড়া বিকল্প হিসেবে হালাল কিছু পাওয়া না যায়।’
245. আল-ফাতওয়া আল-কামিলাহ, কিতাবুল কারাহিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-২৬৭।
ফাতওয়া হিন্দিয়াতে উল্লেখ আছে,
يجوز لعليل شرب البول والدم وأكل الميتة للتداوى اذا اخبره طبيب مسلم ان شفائه فيه ولم يجد من المباح ما يقوم مقامهُ .
‘মুমূর্ষ রোগীর জন্য মৃত প্রাণী, প্রস্রাব ও রক্ত ঔষধ হিসেবে খাওয়া জায়েয, যদি মুসলিম অভিজ্ঞ ডাক্তার এতে আরোগ্যের নিশ্চয়তা দেয় এবং এছাড়া বিকল্প হিসেবে হালাল কিছু পাওয়া না যায়।’
246. ফাতওয়া হিন্দিয়া, অষ্টাদশ অধ্যায়: আত-তাদাভী ওয়াল মু‘আলিজাত, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩৫৫।
❏ প্রশ্ন-২০০: সৈয়্যদা হযরত ফাতেমা (رضى الله تعالي عنها)-এর ফযিলত এবং তাঁর নামের অর্থ কি?
✍ উত্তর: হযরত সৈয়্যদা ফাতেমা বিনতে রাসূলুল্লাহ (رضى الله تعالي عنها)-এর পবিত্র শান ও মান-মর্যাদা সম্পর্কে স্বয়ং হুযূর মোস্তফা(ﷺ) ইরশাদ করেন,
ابنتى فاطمة حور آدمية لم تحض ولم تطمث، وانما سماها فاطمة لان الله تعالى فطمها ومحبيها من النار .
‘হুযূর (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, আমার সাহেবজাদী ফাতেমা (رضى الله تعالي عنها) হচ্ছেন, মানব হুর। সাধারণ মহিলারা রক্তস্রাবের কারণে যে অপবিত্র হয়ে থাকে, তিনি তা হতে পাক-পবিত্র। আল্লাহপাক তাঁর নাম ফাতেমা এ জন্য রেখেছেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সাথে ভালবাসা ও মুহাব্বত স্থাপনকারীদেরকে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি দান করেছেন।’
247. আল-আমান ওয়াল ‘উলা।
উক্ত হাদীসখানা খতীবে বাগদাদী (رحمه الله تعالي ) হযরত ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণনা করেছেন। উক্ত বর্ণনা হতে একথা প্রতীয়মান হয় যে, সৈয়্যদা হযরত ফাতেমা (رضى الله تعالي عنها) মানবীয় হুর।
248. সীরাতে মোস্তফা জানে রহমত, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-২১৪।
❏ প্রশ্ন-২০১: ‘আহলে বাইত’ কারা উদ্ধৃতিসহ বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: হযরত সৈয়্যদাতুনা বতুল ফাতিমাতুয যাহরা (رضى الله تعالي عنه)-এর পবিত্র আওলাদগণ হচ্ছেন ‘আহলে বাইত’। অতঃপর হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه), হযরত আকীল (رضى الله تعالي عنه) এবং হযরত জাফর সাদেক (رضى الله تعالي عنه) ও হযরত আব্বাস (رضى الله تعالي عنه)-এর বংশধরেরা ‘আহলে বাইত’। উম্মুহাতুল মু’মিনীন রিদওয়ানুল্লাহি তা‘আলা আজমাইনরা হচ্ছেন আহলে বাইত।
249. ইরফানে শরীয়ত, খন্ড-১; সীরাতে মুস্তফা জানে রহমত, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-২১৬।
❏ প্রশ্ন-২০২: নিয়াবত্ বা প্রতিনিধিত্ব কাকে বলে? এবং এর দ্বারা উপকারিতা কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: জা-নশীন তথা প্রতিনিধিত্ব ও স্থলাভিষিক্ত দু’প্রকার।
প্রথমতঃ আংশিক ও সীমিতভাবে কোন বিশেষ কাজের কিংবা স্থানের জন্য সাময়িকভাবে কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাউকে নিজের প্রতিনিধি নির্ধারণ করা। যেমন- বাদশাহর পক্ষ হতে যুদ্ধক্ষেত্রে কাউকে প্রধান করে পাঠানো কিংবা কোন জেলা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া অথবা খাজনা, রাজস্ব ও টেক্স আদায় করার জন্য বিশেষ ক্ষমতা অর্পন করা।
দ্বিতীয়ত: ইমাম বা বাদশাহ অন্য কাউকে তাঁর অবর্তমানে প্রতিনিধিত্ব ও সম্পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারীরূপে অসিয়ত করা। অথচ হুযূর তাঁর জীবদ্দশায় কোন প্রতিনিধি নিয়োগ করেন নি। হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) হতে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত আছে যে, যখন তাঁর নিকট আরয করা হলো যে, استخلف علينا ‘আমাদের মধ্যে কাউকে খলিফা নিযুক্ত করে দিন; উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে খলিফা নিযুক্ত করবে না।’ ولكن اترككم ‘আমি তা তোমাদের ওপর ছেড়ে দিলাম।’ (উক্ত হাদিসটি ইমাম আহমদ, ইমাম বাযযার ও ইমাম দারা কুতনী বর্ণনা করেছেন। আর ইমাম বায্যারের রেওয়ায়েত বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত।)
হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) বলেন,
ما استخلف رسول الله صلى الله عليه وسلّم فاستخلف عليكم .
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) খলিফা নিযুক্ত করে যান নি, আমি কীভাবে খলিফা নিযুক্ত করব?’
250. সীরাতুল মুস্তফা, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২২৭।
❏ প্রশ্ন-২০৩: ঔষধ সেবন এবং চিকিৎসা করার বিধান কি? শারীরিক সুস্থ্যতা ও আত্মিক সুস্থ্যতা কাকে বলে এবং উভয়ের সংজ্ঞা কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: ইমাম ইবনে মাজাহ (رحمه الله تعالي ) তাঁর সুনান গ্রন্থে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় নির্ধারণ করেছেন-
باب ما انزل الله داءً الا انزل له شفاءً
অর্থাৎ- ‘আল্লাহ্ তা‘আলা এমন কোন রোগ নাযিল করেন নি, যার চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখেন নি।’
হযরত উসামা বিন সুরাইক (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উপস্থিত ছিলাম যখন বেদুঈন লোক হুযূর সৈয়্যদুল মুরসালীন (ﷺ) থেকে জিজ্ঞেস করছিল। হাদীসের বর্ণনা এই যে,
فقالوٰ يا رسول الله صلّى الله عليه وسلّم هل علينا جناح ان لا نتدوىٰ
‘তারা বললো, হে আল্লাহর রাসুল(ﷺ)! আমরা চিকিৎসা না করার দরুন আমাদের গোনাহ হবে কি? হুযূর বলেন, হে আল্লাহর বান্দা! চিকিৎসা কর। কেননা আল্লাহ্ সুবহানাহু তা‘আলা এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেন নি, যার ঔষধ সৃষ্টি করেন নি। কিন্তু একটি মাত্র রোগ-বাধক্য, যার কোন ঔষধ নেই।’
ঔষধ সেবন ও চিকিৎসা এটা এক মহা গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাবান শিক্ষণীয় বিষয়। কারণ এতে মানুষের শরীর সম্পর্কে আলোচনা করা হয় এবং রোগ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান লাভ করা যায়। চারিত্রিক বা আত্মিক শিক্ষার গুরুত্ব ও মর্যাদার পর হচ্ছে চিকিৎসা বিদ্যার স্থান। কারণ সেখানে আত্মার পরিশুদ্ধতা ও আত্মিক অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা হয়। আত্মা শরীরের চেয়ে অধিকতর উত্তম ও মর্যাদাবান। এ কারণে চারিত্রিক শিক্ষাকে রূহানী ও আত্মিক চিকিৎসা বলা হয়। হুযূর মোস্তফা(ﷺ) -এর শরীয়তে মুখ্য আলোচনা বিষয় হচ্ছে আত্মিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা। হ্যাঁ! অবশ্য কোথাও কোথাও শারীরিক চিকিৎসা সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। কারণ শরীরে যখন কোন ক্ষতি সাধিত হয়, তখন আত্মায়ও ক্ষতির প্রভাব বিস্তার করে। ঠিক একইভাবে আত্মায় কোন রোগ-ব্যাধি হলে, তার প্রভাব শরীরের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তার কারণ হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলা দেহ ও আত্মার মধ্যকার এমন সম্পর্ক স্থাপন করে রেখেছেন যে, পরস্পরের সুখ-শান্তি ও দুঃখ-বেদনার প্রভাব একে অপরের ওপর বিস্তার লাভ করে। এ সম্পর্কের ধরণ ও বাস্তবতার রহস্য উদঘাটন করতে এখনও পর্যন্ত মানবজাতি অপারগ ও অক্ষম। হাজারো বছর ধরে অনেক বড় বড় হেকিম, দার্শনিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে গবেষণা করার পরও তারা এর রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হননি। এ গভীর সম্পর্ক কেবল মৃত্যুর কারণে ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু আত্মা ধ্বংস হয়না এবং দেহও নিশ্চিন্ন হয় না। বরং উভয়ই আপন আপন স্থানে বিদ্যমান থাকে। এখন কথা হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে একত্রিত করে আত্মার সাথে পুনরায় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা, তা আল্লাহ্ তা‘আলার মহান কুদরতী শক্তির সামনে কোন জটিল বিষয় নয়। জনৈক হাকিমের উক্তি- মানুষের মধ্যে দুটি জিনিস বিদ্যমান। একটি হচ্ছে- দেহ, অপরটি হচ্ছে রূহ বা আত্মা। উভয়ের সুস্থ্যতা ও পরিশুদ্ধির প্রতি লক্ষ্য রাখা মানুষের একান্ত প্রয়োজন। যে সকল আলাপচারিতায় আত্মা ও দেহ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে, সেগুলো থেকে বিরত থাকা উচিত। মানুষ আত্মিক পরিশুদ্ধি ও শারীরিক চিকিৎসাসহ উভয় বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করা ব্যতীত সফলতা পাওয়া সম্ভব নয়। আত্মিক পরিশুদ্ধতা ও উৎকর্ষতা যেভাবে প্রয়োজন, তেমনি শারীরিক চিকিৎসাও আবশ্যক। অতএব বুঝা গেল যে, সকল বিদ্যা ও জ্ঞানের মধ্যে দু’টি বিষয় মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশী জরুরী।
অতএব ওই সকল মানুষের জীবন ধন্য, যারা উক্ত দু’বিষয়ের জ্ঞান অর্জনের জন্য নিজের মুল্যবান জীবন ও প্রিয় সময় ব্যয় করেছেন। তা হচ্ছে, চারিত্রিক জ্ঞান এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান। এছাড়া অন্যান্য সকল বিদ্যা যেমন- ভূগোল, প্রকৃতিবিদ্যা, জ্যোর্তিবিজ্ঞান ইত্যাদি মানুষের ঔষধ ও চিকিৎসা সম্পর্কিত নয়, বরং অন্যান্যের সাথে সম্পর্কিত। উক্ত দু’বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করার পর সময় থাকলে প্রয়োজনানুপাতে অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞান লাভ করা যেতে পারে। তা অর্জন করতে না পারলে কোন ক্ষতি নেই। একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদবাক্য আছে, اول خويش بعده درويش ‘প্রথমে নিজের চেষ্টা পরে অন্যের’। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে- وَفِي أَنْفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ ‘নিজ সত্তার মাঝে কেন চিন্তা-গবেষণা করছ না’। মানুষের নিজের হাকীকত ও বাস্তবতা, গঠন, স্বভাব-চরিত্র ও আচার-অভ্যাস সম্পর্কিত যত জ্ঞান অর্জিত হয়, তা ওই দু’বিষয়ের জ্ঞানের বদৌলতে ও মাধ্যমেই অর্জিত হয়। চিকিৎসা বিদ্যার দ্বারা প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবস্থা এবং উপকারিতা ও অপকারিতা, নড়াচড়ার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং এতে কোন প্রকারের ক্ষতি সাধন হলে তা ঠিক করার নিয়ম-নীতি জানা যায়। ঠিক তদ্রুপ চারিত্রিক বিদ্যা দ্বারা আত্মার বাস্তবতা ও প্রভাব এবং এর সুস্থ্যতা ও রুগ্নতা এবং আত্মার ব্যাধির চিকিৎসার বিবরণ জানা যায়। আত্মার হাকীকত ও বাস্তবতা সম্পর্কে যে রকম জানা উচিত, সেরূপ কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু মানুষের চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে যতটুকু জানা গেছে সে পরিমাণ অর্জন করাও আল্লাহ তা‘আলার বড় নি‘য়ামত। কারো মতে, উক্ত জ্ঞানের মাধ্যমে শিরিকের গন্ধ পাওয়া যায়। এটি ভুল ধারণা। কারণ মু’মিনরা ঔষুধের কার্যকারিতাকে সমর্থন করেন, তবে এ আক্বীদা পোষণ করেন যে, এ কার্যকারিতা খোদা প্রদত্ত এবং আল্লাহর হুকুমেই বটে। তাই উক্ত প্রভাবকে অস্বীকার করা সমীচীন নয়। কারণ পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যক্ষভাবে একথা প্রমাণিত এবং হুযূর ও বিভিন্ন হাদীস শরীফে চিকিৎসা ও ঔষধ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
قال يا رسول الله صلّى الله عليه وسلّم ! ما خير ما اُعْطِىَ العبد ؟ قال خُلُقُ حَسَنٌ .
‘লোকজন আরয করল যে, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ‘সর্বোত্তম বস্তু কি যা বান্দাকে দেয়া হয়েছে? হুযূর (ﷺ) ইরশাদ করেন, সৎ চরিত্র।’ সুবহানাল্লাহ!
হুযূর ইরশাদ করেছেন, চারিত্রিক জ্ঞান হচ্ছে যেখানে আত্মার মূল অবস্থা ও প্রভাব এবং এর সুস্থ্যতা ও রুগ্নতা এবং আত্মার অসুস্থতার প্রতিষেধনের বর্ণনা করা হয়। সুবহানাল্লাহ! হুযূর রাসূলে উম্মী উপাধিতে ভূষিত হওয়া সত্ত্বেও এমন রহস্যময় কথা বলে দিয়েছেন যে, যেগুলো সম্পর্কে অনেক বড় বড় হাকিম, দার্শনিকগণ সারা জীবন চিন্তা-ভাবনা, কঠোর সাধনা ও গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করে যাচ্ছেন। এটা একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে, তিনি অদৃশ্য জগতের সংবাদদাতা, নবুওয়তের দলীল এবং বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতার উজ্জ্বল প্রমাণ। উক্ত হাদীস শরীফে প্রথমে উভয় জগতের অাঁকা ও মাওলা সাধারণ মানুষের জন্য দৈহিক চিকিৎসার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন এবং সার্বজনীন নীতিমালার বর্ণনা দিয়েছেন- যা প্রত্যেক শ্রেণির ধনী-দরিদ্র মানুষ, জীব-জন্তু এবং মুসলিম-অমুসলিম সকলের উপকারী জ্ঞান। যা হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান বা শরীরিক শিক্ষা। অতঃপর যখন লোকেরা সর্বোত্তম জ্ঞান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। তিনি উত্তরে বলেন, চারিত্রিক জ্ঞান। মূলতঃ হুযূর মোস্তফা(ﷺ) অত্র হাদীসে উভয় প্রকারের জ্ঞান অর্জন করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেন। অর্থাৎ চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং চারিত্রিক জ্ঞান বা ইলমে তাসাউফ। উক্ত হাদীস দ্বারা একথাও প্রমাণিত হয় যে, ঔষধ সেবন করা জায়েয এবং উক্ত বিষয়ে ঈমান-আক্বীদা মজবুত হওয়ার মাধ্যমও প্রমাণিত হয়েছে; এতে শিরকের গন্ধ আসারও কোন অবকাশ নেই। কেননা হুযূর নির্দেশ দিয়েছেন, যার নিম্নতম স্তর হচ্ছে মুবাহ হওয়া। আর কেউ কেউ চিকিৎসা করাকে মুস্তাহাব বলেছেন।
রোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এবং সাথে তার ঔষধও নাযিল হয়। ঔষুধের দ্বারা আরোগ্য ও মুক্তি লাভ করা সবই আল্লাহ তা‘আলার ভাগ্যলিপির অন্তভুর্ক্ত। এ বিষয়ে কারো এ ধরনের প্রশ্ন করা উচিৎ হবে না যে, হুযূর (ﷺ) ওই সকল লোকের প্রশংসা করতেন না, যারা আল্লাহ'র ওপর ভরসা করে ঔষধ ব্যবহার করতেন না এবং যাদু-টোনা করতেন।
উপরোক্ত প্রশ্ন এখানে সমীচীন না হওয়ার কারণ হচ্ছে, এখানে ঔষধ দ্বারা দাগ দেয়া উদ্দেশ্য, যা আরবে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো দাগানোর চেয়ে না দাগানোই উত্তম ও শ্রেয়। অন্যান্য চিকিৎসা এর সম্পূর্ণ বিপরীত, কারণ এ সকল চিকিৎসার প্রতি হাদীসসমূহে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। স্বয়ং হুযূর চিকিৎসা করেছেন। যদি কেহ হুযূর (ﷺ) -এর অনুসরণের উদ্দেশ্যে চিকিৎসা করে থাকে, তাহলে অবশ্যই সে সওয়াব পাবে। উক্ত হাদীস শরীফ ইমাম আহমদ, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তিরমিযী, হাকিম এবং খোযাইমা বিশুদ্ধ ও সহীহ বলেছেন।
ইমাম মুসলিম হযরত জাবের (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণনা করেন যে, প্রত্যেক রোগের ঔষধ রয়েছে। রোগী যখন উক্ত ঔষধ সেবন করে, তখন আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে আরোগ্য লাভ করে। ঔষধ সেবন করাতে সে আরোগ্য লাভ করেছে, একথা বলা শিরক। যদি একথা মনে করে সেবন করে যে, ঔষুধের একটা গুণ ও কার্যকারিতা রয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি একথা বিশ্বাস করে ঔষধ সেবন করে যে, আল্লাহর হুকুমে ক্রিয়া ও কার্যকারিতা হয়ে থাকে, তাহলে শিরক হবে না। অনুরূপ প্রত্যেক বস্তুর ব্যাপারে এ আক্বীদা-বিশ্বাস রাখা উচিত যে, তার ভাল ও মন্দ আল্লাহর হুকুমেই হয়ে থাকে। যদি কেহ বুঝে শুনে একথা বলে, অমুক বস্তুর দ্বারা উপকৃত হয়েছে, তাহলে এটা শিরক হবে এবং যখন ওই বস্তুকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন উপকারের বস্তু মনে করবে, তাহলে শিরক হবে। অর্থাৎ- ওটাকে (বস্তু) প্রকৃত ফলপ্রদ ও ফলপ্রসূ মনে করা শিরক। যদি বলে আল্লাহ তা‘আলা উক্ত বস্তুর মধ্যে সেই প্রভাব নিহিত রেখেছেন যা দ্বারা নিরাময় লাভ করা যায়, তাহলে শিরক হবে না, বরং তা হবে আল্লাহর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ এবং এটা আল্লাহ তা‘আলার হুকুমেই হয়েছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা পূর্ব থেকেই নিরাময় দানকারী ঔষধকে হুকুম ও অনুমতি দিয়েছেন। অনুরূপ আল্লাহ তা‘আলার মকবুল ও নৈকট্যবান বান্দাদের ইখতিয়ার দেয়া হয় যেমন কোরআন-হাদীস দ্বারা এর অসংখ্য প্রমাণ আছে। এটা শিরক নয় বরং আল্লাহ তা‘আলার কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে অন্য কিছু দৃষ্টিগোচর হলেও মূলতঃ তা আল্লাহর পক্ষ হতে। প্রকৃত কার্য সম্পাদনকারী আল্লাহ তা‘আলার সত্তা। তা অস্বীকার করা মানে পক্ষান্তরে আল্লাহর কুদরতকে অস্বীকার করা। আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেক বস্তুর ওপর পূর্ণ ক্ষমতাবান। এ কারণে হুযূর রহমতে ‘আলম দৈহিক ও আত্মিক চিকিৎসার কথা বলেছেন। দৈহিক চিকিৎসা যদ্বারা দেহের রোগ নিরাময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অনুরূপ আত্মিক রোগের চিকিৎসা, যা দ্বারা আত্মার রোগ মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। যা আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাদের মধ্য হতে বিশেষ বান্দাদেরকে উক্ত চিকিৎসা বিদ্যার জ্ঞান দান করে বিশেষ পদমর্যাদার অধিকারী করেছেন এবং মানুষের আত্মিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিরাময় করার ইখতিয়ার দিয়েছেন। অতএব তাঁরা খোদা প্রদত্ত ক্ষমতা বলে বলিয়ান হয়ে মানুষের আত্মার চিকিৎসা করে রোগ নিরাময়ের মাধ্যমে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের উপযোগী করে তোলেন। উক্ত চিকিৎসা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বোত্তম চিকিৎসা। এঁদেরকে অস্বীকার করা মানে আল্লাহ্ তা‘আলার কুদরত ও জ্ঞানকে অস্বীকার করার নামান্তর। এভাবে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলে প্রত্যেক বিষয়ে আল্লাহর কুদরত বিকশিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
❏ প্রশ্ন-২০৪: রোগের চিকিৎসা ও ঔষধ সেবন করা কি সুন্নাত? যদি কোন রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, তাহলে গোনাহগার হবে কি-না? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: চিকিৎসা একটি প্রকাশ্য উপকরণ বা মাধ্যম এবং সুন্নাত মোতাবিক আমল। কোন অসুস্থ ব্যক্তি বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে গোনাহগার হবে না। ফাতওয়া নাওয়াযিলে উল্লেখ আছে,
ولومرض ولم يعالج حتى مات لم يأثم بخلاف الجائع اذا لم يأ كل حتى مات بالجوع يأثم .
‘যদি কেহ বিনা চিকিৎসায় মারা যায় গোনাহগার হবে না, কিন্তু ক্ষুধার্ত ব্যক্তি যদি না খেয়ে মারা যায় তবে সে গোনাহগার হবে।’
251. ফাতওয়া-ই নাওয়াযিল, কিতাবুল কারাহিয়া, পৃষ্ঠা-২০০।
❏ প্রশ্ন-২০৫: خَيْرٌ শব্দের তাহ্কীক বা ব্যাখ্যা-বিশেষণ কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: خَيْرٌ ‘খাইরুন’ শব্দের অর্থ কল্যাণকর। যে বস্তু সবার নিকট প্রিয় ও পছন্দনীয়। যেমন- জ্ঞান (عقل), ন্যায় পরায়ণতা (عدل) ; বহুবচনে خُيُوْرٌ। ধন-সম্পদ, ঘোড়া, ভদ্রলোক ও ফয়েয-বরকতসম্পন্ন, বহুবচনে اَخْيَارٌ । সুশ্রী, অত্যন্ত ভাল, উত্তম, ভাল, মর্যাদা ও মাহাত্ম্য; মূল গঠন باب ضرب হতে; কাউকে অন্যের ওপর ফযিলত ও প্রাধান্য দেয়া, নির্বাচিত করা, পূণ্যকাজে অগ্রগামী হওয়া; বহুবচনে خِيَارٌ। ক্ষীরা, শশা, পছন্দনীয় ও গ্রহণীয় মাল, পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ, একবচন, বহুবচন- এসব তাহকীকাত বা বিশেষণ ভাষাবিদ ও অভিধান বিশারদগণের। উত্তম, পূণ্য, কল্যাণকর, পছন্দনীয় ভাল কাজ এবং সর্বোত্তম সম্পদ বা মাল- এই পাঁচটি اسم تفضيل তথা তুলনাবাচক আধিক্য অর্থ জ্ঞাপক বিশেষ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। এটির মূল اَخْيَرٌ, ষষ্ঠ অর্থ রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। اَخْيَارٌ، خُرَّةٌ হলো اسم مصدر বা ক্রিয়ামূল বিশেষ্য।
252. কামূসুল কোরআন, পৃষ্ঠা-২২৭।
خير القرون অর্থ সম্পর্কে মুহাক্কিক ওলামায়ে কিরামের অভিমত নিম্নে প্রদত্ত হলো:
قرون এটি قرن -এর বহুবচন। قرن ,এর অর্থ- যামানা, যুগ, কাল ও শতাব্দি। خيرالقرون অর্থ- সর্বোত্তম যুগ, উত্তম সময়কাল। এর দ্বারা উদ্দেশ্য রাসূলুল্লাহ -এর যুগের বংশধারা এবং এর পরবর্তী ধারাবাহিকতায় দুই বংশধারা। হাদীস শরীফে এসেছে,
خير القرون قرنى ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم .
‘সবচেয়ে উত্তম যুগ আমার যুগের বংশ। অতঃপর ওই যুগের পরের যুগ, অতঃপর ওই যুগ যা এর পরে আগত।’
253. ইসলামী বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা- ৩১৫, মাকতাবাতুল ফায়সাল।
خير: ما فيه نفع وصلاح، وهو ضد الشر . فالمال خير والخيل خير، والعلم النافع خير.
وفى التنزيل بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ . (سورة ال عمران)
إِنِّي أَحْبَبْتُ حُبَّ الْخَيْرِ عَنْ ذِكْرِ رَبِّي . (سورة ص)
فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ ‘ اى من زاد على مقدار الفدية تطوعًا فهو خير له عنداللهِ .
الخيرة: بكسر الخاء وفتح الياء بوزن عِنَبَةٌ بمعنى الاختيار، يقال اختار اختيارًا والاسم الخيرة محمد رسول الله صلى الله عليه وسلّم خيرة اللهِ .
254. معجم، جلدثانى، صفحة ১৬৬، المطلع والقاموس
خير ‘খাইর’ এমন বস্তু যা সকলের নিকট প্রিয় ও পছন্দনীয়। যেমন- জ্ঞান, বিবেক, মান-মর্যাদা, ন্যায়পরায়ণতা ও উপকারী বস্তু। যা شر শব্দের বিপরীত, شر অর্থ-মন্দ, খারাপ।
خير দু’প্রকার:-
প্রথমত: خير مطلق সাধারণ ভাল ও কল্যাণকর। যা সব সময় প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট পছন্দনীয় হয়। যেমন, জান্নাত।
দ্বিতীয়তঃ خير مقيد সীমাবদ্ধ ও শর্তযুক্ত ভাল। যা কারো জন্য ভাল হবে এবং অন্যের জন্য মন্দ। যেমন, যায়েদের জন্য সম্পদ ভাল কিন্তু আমরের জন্য মন্দ। সে কারণে আল্লাহ তা‘আলা ধন-সম্পদ সম্পর্কে উভয় গুণ বর্ণনা করেছেন। সুতরাং একস্থানে ইরশাদ করেছেন,
ان ترك خيرًا
অর্থাৎ- ‘যদি কিছু ধন-সম্পদ রেখে যেত’। আবার অন্যত্র ইরশাদ করেছেন,
نسارع لهم فى الخيرات بل لايشعرون
অর্থাৎ- ‘তোমরা কি ধারণা করছ যে, আমি তাদেরকে যে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদের কল্যাণার্থে দিয়ে যাচ্ছি, বরং তারা তা উপলব্ধি করতে পারছে না।’
255. সূরা মু’মিনূন, আয়াত: ৫৬
কোরআনে কারীম(ﷺ)র যেখানে ধন-সম্পদের ক্ষেত্রে خير শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সে সম্পর্কে কতিপয় ওলামায়ে কিরাম বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন যে, উক্ত মাল দ্বারা সে সকল সম্পদ উদ্দেশ্য যা সংখ্যায় অধিক সম্পদ এবং হালাল উপায়ে ও বৈধ পন্থায় উপার্জন করা হয়েছে।
خير ও شر শব্দদ্বয় দু’ভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে।
প্রথমতঃ اسم বা বিশেষ্য হিসেবে যেমন,
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ.
অর্থাৎ- ‘তোমাদের মধ্য হতে এমন একদল উম্মত হওয়া উচিত, যারা সৎ কর্মের প্রতি আহ্বান করবে।’ অর্থাৎ- ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের’ প্রতি।
256. সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৪।
দ্বিতীয়তঃ وصف বা বিশেষণ হিসেবে। তখন اسم تفضيل এর অর্থ প্রদান করে। যেমন,
فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى
অর্থাৎ- ‘নিঃসন্দেহে উত্তম পাথেয় হচ্ছে খোদাভীতি’। এখানে خير শব্দটি افضل অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
257. সূরা বাকারা, আয়াত: ১৯৭।
পবিত্র আয়াত শরীফ نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا অর্থাৎ- ‘আমরা তার চেয়ে উত্তম নিয়ে আসি’।
258. সূরা বাকারা, আয়াত: ১০৬।
এবং وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ অর্থাৎ- ‘রোযা রাখাতে তোমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে’।
259. সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫।
এখানে خير শব্দটি اسم বা বিশেষ্যও হতে পারে অর্থাৎ افعل التفضيل বা সিফতের অর্থেও হতে পারে। خير শব্দটি কখনো شر বা মন্দের বিপরীতে ব্যবহৃত হয়। আবার কখনো ضرر বা কষ্ট ও কঠোরতার মোকাবিলায় আসে। যেমন,
وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ .
‘যদি আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে কোন ধরনের কঠোরতায় নিপতিত করেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী আর কেউ থাকবে না। পক্ষান্তরে তিনি যদি তোমার মঙ্গল কামনা করেন, তবে তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’
260. সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৭।
خَيْرَات অর্থ- পূণ্যসমূহ, কল্যাণ ও সৌন্দর্যসমূহ। এটি خَيْرَةٌ এর বহুবচন। যেমন,
فِيهِنَّ خَيْرَاتٌ حِسَانٌ
(অর্থাৎ- সেখানে সুশ্রী ও পূণ্যবতী রমণীরা রয়েছেন।)
261. সূরা আর্-রহমান, আয়াত: ৭০।
আয়াত সম্পর্কে একদল ওলামা বলেছেন যে, خَيْرَاتٌ মূলতঃ خَيِّرَتٌ ছিল ياء তে তাশদীদের সাথে ছিল, যাকে সহজকরণ করা হয়েছে। কেননা خير শব্দটি যখন اسم تفضيل -এর অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন এর جمع বা বহুবচন আসে না।
خَيِّرَاتٌ বহুবচন, একবচনে خيرة । যার অর্থ- সে সকল মহিলা, যারা কল্যাণের অধিকারী হয়েছে। خِيْرَةٌ ও إِخْتِيَارٌ শব্দদ্বয় خَارَيَخِيْرُ ,এর مصدر বা ক্রিয়ামূল।
262. লুগাতুল কোরআন, মওলানা আবদুর রশীদ নো’মানী, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৩২৭।
❏ প্রশ্ন-২০৬: آيات الحفظ বা হিফাযত বা সংরক্ষণের আয়াত কাকে বলে?
✍ উত্তর: কোরআনে কারিমের যে সমস্ত আয়াতে হেফাযতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। تعويذ বা স্মরণীয় আর হিফাযতের আয়াতগুলো নিম্নরূপ:
১.আয়াতুল কুরসী।
اَللّٰہُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَۚ اَلۡحَیُّ الۡقَیُّوۡمُ ۬ۚ لَا تَاۡخُذُہٗ سِنَۃٌ وَّ لَا نَوۡمٌ ؕ لَہٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یَشۡفَعُ عِنۡدَہٗۤ اِلَّا بِاِذۡنِہٖ ؕ یَعۡلَمُ مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ مَا خَلۡفَہُمۡ ۚ وَ لَا یُحِیۡطُوۡنَ بِشَیۡءٍ مِّنۡ عِلۡمِہٖۤ اِلَّا بِمَا شَآءَ ۚ وَسِعَ کُرۡسِیُّہُ السّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ ۚ وَ لَا یَـُٔوۡدُہٗ حِفۡظُہُمَا ۚ وَ ہُوَ الۡعَلِیُّ الۡعَظِیۡمُ .
২. فَاللهُ خَيْرٌ حَافِظًا وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
‘অতএব আল্লাহ তা’আলা উত্তম হিফাযতকারী এবং তিনিই সর্বাধিক দয়ালু।’
263. সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৬৪
৩. لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللهِ
‘তাঁর পক্ষ থেকে অনুসরণকারী রয়েছে তাদের অগ্র,পশ্চাতে, আল্লাহর হুকুমে তারা ওদের হিফাযত করে।
264. সূরা রা‘দ, আয়াত: ১১
৪. وَحَفِظْنَاهَا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ رَجِيمٍ
‘আমি আকাশকে প্রত্যেক বিতাড়িত শয়তান থেকে নিরাপদ করে দিয়েছি।’
265. সূরা হিজর, আয়াত: ১৭
৫. وَحِفْظًا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ مَارِد
‘এবং তাঁকে সংরক্ষিত করেছি প্রত্যেক বিতাড়িত শয়তান থেকে।’
266. সূরা আস-সাফ্ফাত, আয়াত: ৭
❏ প্রশ্ন-২০৭: آيت الفتح ‘বিজয়ী আয়াত’ কোন আয়াতকে বলে?
✍ উত্তর: آيت الفتح ,কে বিজয় কিংবা মুক্তির আয়াত বলা হয়। যথা:,
وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ.
‘তাঁর নিকট অদৃশ্য জগতের সমস্ত চাবি রয়েছে। এগুলো তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানে না। জলে ও স্থলে যা কিছু আছে, তিনি সবই জানেন। কোন পাতা ঝরলে সেটাও তিনি জানেন। কোন শস্যকণা মৃত্তিকার অন্ধকারে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুষ্ক দ্রব্য পতিত হয় না; কিন্তু তা সব প্রকাশ্য গ্রন্থে লৌহে মাহফুযে সংরক্ষিত রয়েছে।’
267. সূরা আন‘আম, আয়াত: ৫৯
অর্থাৎ- লওহে মাহফুযে উক্ত আয়াতে কারীম (ﷺ)কে অধিকহারে পড়া হতো; বিশেষতঃ নামাযের পর ৪০ বার পড়লে অন্তরের সকল উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যায়।
❏ প্রশ্ন-২০৮: بارى এবং باديه سماوه এর তাহ্কীক বা ব্যাখ্যা বিশেষণ কি?
✍ উত্তর: بَارِىُ এটা আল্লাহ তা‘আলার নিরানব্বই নামের একটি। অর্থ- প্রত্যেক বস্তুর আবিষ্কারক বা স্রষ্টা। এ শব্দটি بَرَأَ থেকে নির্গত। যা সৃষ্টি ও অস্তিত্বদান অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ ইসিম বা নামটি কুরআনে কারীম(ﷺ) হুবহু উল্লেখ আছে। যথা:-
هُوَ اللهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى .
‘তিনিই মহান আল্লাহ্ তা‘আলা, যিনি স্রষ্টা, আবিষ্কারক, আকৃতিদাতা, উত্তম নামসমূহ তাঁরই।
268. সূরা আল-হাশর, আয়াত: ২৪
باديه سما‘ এটা একটি অরণ্য মরুপ্রান্তর। যা দুমাতুল্ জন্দল হতে আইনুত্ তমর পর্যন্ত পৌঁছেছে। উক্ত মরুভূমিতে তরিতরকারি ও শাক-সবজি অধিক পাওয়া যায় এবং সেখানে পানির ঝরণাও আছে। এর নিকটবর্তী কাদেসীয়া মরুদ্যান অবস্থিত।
❏ প্রশ্ন-২০৯: بلعم بن باعوراء (বল‘আম বিন বাউরা) কে ছিল? তার অবস্থার বর্ণনা দাও।
✍ উত্তর: هوالمـستعان বল’আম বিন বাউরা বনি ইসরাইলের একজন আবেদ ও ধর্মনিষ্ঠ সাধক পুরুষের নাম। মুফাস্সিরীনে কিরামের মতানৈক্যের ভিত্তিতে নিম্নোক্ত আয়াতে উক্ত ব্যক্তির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ .
‘হে হাবীব! আপনি তাদেরকে ওই ব্যক্তির অবস্থা শুনিয়ে দিন, যাকে আমি নিজের নিদর্শনসমূহ দান করেছিলাম, অথচ সে তা পরিহার করে বেরিয়ে গেছে। আর তার পেছনে শয়তান লেগে গেছে, ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে পড়েছে।’
269. সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৭৫
মুফাস্সিরীনে কিরামগণ উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মত দিয়েছেন, যার সম্পর্কে উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। যথাঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه), হযরত ইবনে মাসউদ (رضى الله تعالي عنه) এবং হযরত মুজাহিদ (رضى الله تعالي عنه) বলেছেন যে, এতে ‘বল‘আম ইবনে বাউরা’র প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, হযরত মুসা (عليه السلام) এবং বনি ইসরাইলসহ সুয়াবের ময়দানে হার্ওন নদীর তীরে পারীহুন শহরের বিপরীতে যখন অবতরণ করেন, তখন মাওয়াজীও-এর বাদশাহ বলখ বিন সগুর এ সংবাদ শুনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলউমের নিকট দূত পাঠালেন যে, তিনি যেন এসে উক্ত অবতরণকারীদের জন্য বদ-দু‘আ করেন। প্রথমত তিনি অস্বীকৃতি জানান, পরবর্তীতে আসতে রাজি হয়ে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে তার আরোহনের গাধা বসে পড়লে, তারা মারধর করে এটিকে উঠানোর চেষ্টা করলে আল্লাহ তা‘আলা ওটাকে বাকশক্তি দান করেন, ফলে গাধাটি বলতে লাগলো আমি নিজ ইচ্ছায় বসিনি, বরং ফিরিশতারা আমাকে বাধা দিচ্ছে। অতঃপর বল‘আম বলখের কাছে গেলেন এবং এক পাহাড়ে আরোহন করে বনি ইসরাইলের দিকে তাকালেন। তখন অনিচ্ছাকৃতভাবে তার মুখ দিয়ে অভিশাপের পরিবর্তে বনি ইসরাইলের জন্য বরকতের বাক্য বের হয়ে গেল। (উক্ত ঘটনা তাওরাত কিতাবের আদদ-এর ২৩-২৪নং অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ আছে।) বদ-দু‘আর জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কারণে বলউমের সমস্ত কারামত ও বুযূর্গী যা আল্লাহ তা‘আলা তাকে দান করেছিলেন, সব বিলুপ্ত হয়ে গেল।
বনি ইসরাইলকে শুনানো হচ্ছে যে, কেউ আল্লাহর মাকবুল বান্দার বিরোধীতা করলেন, তার পরিণাম হবে এভাবে। বনি ইসরাইলে আল্লাহর দরবারে যাঁর দু‘আ গৃহীত বলে স্বীকৃত বাল‘অম ইবনে বাউরা এমন একজন বড় আলেম ছিল, সে কু-প্রবৃত্তির তাড়নায় স্বার্থের বশীভুত হয়ে হযরত মুসা (عليه السلام)-এর জন্য বদ-দু‘আ করেছিলেন। যে কারণে চলিশ বছর পর্যন্ত অরণ্য বন-জঙ্গলে অনুতপ্ত ও চিন্তান্বিত অবস্থায় ঘুরতে থাক। অবশেষে হযরত ইউসা‘ (عليه السلام)-এর বদ-দু‘আ করার দরূন সে ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়। তার পিতার নাম ছিল বাউর।
বল‘আম বিন বাউরা: তার সম্পর্কে তাফসীরে সাবি, জালালাইন, তাফসীরে রূহুল বয়ান ইত্যাদি গ্রন্থে উল্লেখ আছে। তাঁরা বলেছেন, উক্ত ব্যক্তি তার সময়কালের প্রখ্যাত আলিম, আবেদ, যাহেদ, একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন এবং তাঁর ‘ইসমে আ‘যম’ (اسم اعظم)ও জানা ছিল। তিনি নিজ স্থানে বসে স্বীয় আত্মাধিকতা বলে আল্লাহ তা‘আলার আরশে ‘আযীম পর্যন্ত দেখতে পেতেন। তিনি অনেক বড় মুস্তাজাবুদ দাওয়াত ছিলেন যে, তার দু‘আ মহান আল্লাহর দরবারে অধিক কবুল হতো এবং তার শিষ্যের সংখ্যাও ছিল অনেক।
প্রসিদ্ধ আছে যে, তার দরসে বা পাঠশালায় ছাত্রদের বার হাজার কালির দাওয়াত ছিল। অতএব প্রতীয়মান হয় যে, তার মাদ্রাসায় অসংখ্য হাজারো-লাখো ছাত্ররা লেখা-পড়া করতো।
হযরত মুসা (عليه السلام) যখন জালিম অত্যাচারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে বনি ইসরাইলের মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে রওয়ানা হলেন, তখন বল‘আম বিন বাউরা সম্প্রদায়ের লোকজন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তার (বল‘আম) নিকট আসল এবং বলল যে, হযরত মুসা (عليه السلام) এক বিরাট ও শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করার লক্ষ্যে আসছেন। তাঁর ইচ্ছা যে, আমাদেরকে আমাদের স্থান থেকে বহিষ্কার করে তাঁর সম্প্রদায় বনি ইসরাইলকে তা দিয়ে দিতে। সুতরাং আপনি হযরত মুসা (عليه السلام) এর জন্য এমন বদ-দু‘আ করুন, যাতে তিনি পরাজিত হয়ে ফিরে যান। যেহেতু আপনি ‘মুস্তাজাবুদ্ দাওয়াত’। অতএব আপনার দু‘আ অবশ্যই কবুল হবে। একথা শুনে বল‘আম বিন বাউরা কেঁপে উঠে বলতে লাগলেন, তোমাদের ক্ষতি হোক। আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি! হযরত মুসা (عليه السلام) হলেন আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত রাসূল। তাঁর সৈন্য বাহিনীতে ঈমানদার ও ফিরিশতাগণের জামাআত অন্তভুর্ক্ত রয়েছেন। এমতাবস্থায় আমি তাদের বিপক্ষে কিভাবে বদ-দু‘আ করতে পারি?
কিন্তু তার সম্প্রদায়ের লোকেরা কেঁধে কেঁধে এবং বিনীতভাবে বেশী জোর করলে তিনি বলেন, ইস্তেখারা করার পর যদি অনুমোদন মিলে, তাহলে বদ-দু‘আ করব। ইস্তেখারা করার পর যখন অনুমোদন মিলেনি, তখন তিনি স্পষ্ট ভাষায় জবাব দিলেন যে, আমি যদি বদ-দু‘আ করি তা হলে আমার ইহকাল ও পরকাল ধ্বংস হয়ে যাবে। এতদসত্ত্বেও উক্ত সম্প্রদায় অনেক মূল্যবান হাদিয়া ও উপঢৌকন তার খিদমতে পেশ করে বারবার সীমাহীন চাপ সৃষ্টি করতে লাগলো। পরিশেষে বল‘আম বিন বাউরা’র নিকট এ মহা মূল্যবান হাদিয়া-তোহফার লোভ-লালসা ও আকর্ষণ প্রাধান্য পেলো। এই সম্পদের লোভ-লালসার ভূত তার ওপর সওয়ার হলো এবং ওই মাল-সম্পদের ফাঁদে আটকা পড়লো। ফলে তিনি তার ধার ওপর আরোহন করে বদ-দু‘আ করার জন্য রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে তার ধা বারবার থমকে যায় এবং মুখ ফিরিয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি এটাকে মেরে মেরে সামনের দিকে নিয়ে যেতে থাকেন। পরিশেষে ধাকে আল্লাহ তা‘আলা বাকশক্তি দান করেন। সে বলে উঠলো, আফসোস! বড়ই পরিতাপের বিষয়!! হে বল‘আম বিন বাউরা! তুমি কোথায় ছিলে, এখন কোথায় যাচ্ছ? হে বল‘আম! তোমার ক্ষতি হোক, হে দুর্ভাগা! তুমি কি আল্লাহর নবী এবং মু’মিনদের দলের বিপক্ষে বদ-দু‘আ করবে?
ধার কথা শুনেও বল‘আম বিন বাউরা ফেরত আসেনি। এমনকি ‘হিস্বান’ নামক পাহাড়ের সার্বোচ্চ চুড়ায় আরোহন করে হযরত মুসা (عليه السلام)-এর সৈন্য বাহিনীর প্রতি গভীর দৃষ্টিতে দেখল এবং সম্পদের লোভে বদ-দু‘আ শুরু করে দিল। কিন্তু আল্লাহ'র শান! সে হযরত মুসা (عليه السلام)’র জন্য বদ-দু‘আ করছিল কিন্তু তার মুখ দিয়ে তার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বদ-দু‘আ এসে যায়। এ অবস্থা দেখে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা কয়েক বার তাকে টোকা মারল বা বাঁধা প্রদান করলো যে, হে বল‘আম! আপনি তো উল্টো বদ-দু‘আ করতেছেন। তখন সে বললো, হে আমার গোত্র! আমি কি করব? আমি বলতেছি একটি, আর আমার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে আরেকটি? অতঃপর হঠাৎ তার ওপর আল্লাহর গজব নাযিল হয়ে তার জিহ্বা লটকিয়ে তার বক্ষের ওপর এসে যায়। তখন বল‘আম বিন বাউরা নিজ সম্প্রদায়কে কান্নাজনিত কন্ঠে বলতে লাগলো, হায় আফসোস! হে আমার সম্প্রদায়! আমার দুনিয়া-আখিরাত উভয়ই ধ্বংস এবং বরবাদ হয়ে গেছে। আমার ঈমান চলে যাচ্ছে এবং আমি আল্লাহর গজব ও শাস্তিতে গ্রেফতার হয়ে গেছি। এখন আমার কোন দু‘আ কবুল হবে না। কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রতারণা ও ধোঁকার একটি কৌশল বাত্লিয়ে দিচ্ছি যে, তোমরা হয়তো এমন করলে হযরত মুসা (عليه السلام)-এর সৈন্যরা পরাজয় বরণ করবে। তোমরা সুন্দরী রূপসী রমণীদের উত্তম পোষাক ও অলংকারাদি পরিয়ে সুসজ্জিত করে বনি ইসরাইলের সৈন্যদের মাঝে পাঠিয়ে দাও। যদি তাদের একজনও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে যায়, তাহলে পুরো সৈন্যদল পরাজিত হবে। সুতরাং বল‘আম বিন বাউরা সম্প্রদায় তার নির্দেশনা মতে ষড়যন্ত্রের জাল বেধে অসংখ্য সুশ্রী ও সুন্দরী কুমারী মহিলাকে সুসজ্জিত করে বনি ইসরাইলের সৈন্যদলে পাঠিয়ে দিল।
পরিশেষে বনি ইসরাইলের এক সরদার এক সুন্দরী ও সুশ্রী রমণীর আসক্ত হয়ে গেল। সে উক্ত রমণীকে কোলে নিয়ে হযরত মুসা (عليه السلام)-এর নিকট গেল এবং ফাতওয়া তালাশ করল যে, হে আল্লাহর রাসূল! এই রমণীটি আমার জন্য হালাল কিনা? মুসা (عليه السلام) বললেন, সাবধান! এটা তোমার জন্য হারাম, তাড়াতাড়ি তাকে পৃথক করে দাও। আল্লাহ তা‘আলার কঠিন শাস্তিকে ভয় কর কিন্তু উক্ত সরদারের ওপর যৌন উত্তেজনা এতো বেশী প্রকট হয়েছিল যে, সে আপন নবীর আদেশ অমান্য করে উক্ত রমণীকে তার তাঁবুতে নিয়ে যায় এবং ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে যায়। উক্ত পাপাচারীর দুর্ভাগ্য ও অমঙ্গলের প্রভাবে ফলাফল এটাই হয় যে, বনি ইসরাইলের সৈন্যদলে হঠাৎ পেগ, মহামারী রোগের প্রদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে সত্তর হাজার সৈন্য প্রাণ হারায় এবং সকল সৈন্যবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে হতাশ ও নিষ্ফল ফিরে আসে। ফলে হযরত মুসা (عليه السلام) এর পবিত্র অন্তর অনেক বড় মনোবেদনায় আক্রান্ত হলেন।
270. তাফসরে ‘আজাইবুল কোরআন, কৃত আল্লামা আবদুল মোস্তফা ‘আযমী (رحمة الله), পৃষ্ঠা-১৪১।
বল‘আম বিন বাউরা পাহাড় থেকে অবতরণ করে মহান আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত ও প্রত্যাখ্যাত হল। আমৃত্যু তার জিহ্বা বক্ষের সাথে ঝুলানো ছিল এবং ঈমান হারা হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আল্লাহ তা‘আলা সূরা আ‘রাফে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেন,
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ .
‘হে হাবীব! আপনি তাদেরকে ওই বল‘আম বিন বাউরা-এর অবস্থা জানিয়ে দিন, যাকে আমি নিজের নিদর্শনসমূহ দান করেছিলাম, অথচ সে তো পরিহার করে বেরিয়ে গেছে। আর তার পেছনে শয়তান লেগে গেছে, ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে পড়েছে।"
271. সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৭৫
বর্ণিত আছে যে, কতিপয় আন্বিয়া-ই কিরাম (عليه السلام) আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে আরয করলেন, হে আল্লাহ্! তুমি বল‘আম বিন বাউরাকে এতগুলো নিয়ামত ও কারামত দান করার পর তাকে কেন এতো শাস্তি ও লাঞ্ছনায় নিপতিত করলেন? তখন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করলেন, সে কখনো আমার দেয়া নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেনি। যদি সে আমার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতো তাহলে আমি তার কারামতগুলো ছিনিয়ে নিয়ে তাকে উভয় জগতে এভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করতাম না।"
272. তাফসীরে রূহুল বয়ান, খন্ড-৩০, পৃষ্ঠা-১৩৯
উপরোক্ত ঘটনা থেকে আমাদের কিছু উপদেশ হাসিল হয়েছে।
১. এ ঘটনা থেকে ওই সকল আলিম ও নেতৃবৃন্দের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যে, যারা বিত্তবান ও ক্ষমতাসীনদের থেকে টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদ নিয়ে শরীয়তের বিধান ও ঈমান-আক্বীদা পরিপন্থী কথা বলে থাকেন এবং জেনে-শুনে নিজের দ্বীন-ধর্ম ও ঈমান-আক্বীদার ব্যবসা করে থাকেন যে, এই ব্যবসা মূলতঃ দ্বীন ও ঈমানের পরিবর্তে পার্থিব স্বার্থ হাসিল করা। এটা অত্যন্ত মন্দ ও ঘৃণিত ব্যবসা।
দেখুন! বল‘আম বিন বাউরা কি ছিলেন এবং কি হয়েছে? এরকম হলোই বা কেন? শুধু এ কারণে যে, সে ধন-সম্পদের লোভে পড়ে প্রতারণা ও চালাকি করে সত্য ও হক্বের পরিপন্থী কথা বলেছিল। অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতারণা সম্পর্কে অধিক অবগত আছেন বিধায় আল্লাহ বলেন, وَاللهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ অর্থাৎ- ‘বস্তুতঃ আল্লাহ তা‘আলা হচ্ছেন প্রতারণাকারীদের প্রতিশোধ নিতে সর্বোত্তম কুশলী।’
273. সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৫৪
যেহেতু জেনে শুনে আল্লাহ তা‘আলা প্রেরিত নবীর বিপক্ষে বদ-দু‘আ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। ফলে তার ওপর এ বিপদ পতিত হয়েছিল যে, দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতে অভিশপ্ত, বঞ্চিত, বিতাড়িত ও বহিষ্কৃত হয়ে সারা জীবন কুকুরের ন্যায় বের হওয়া ঝুলন্ত জিহ্বা নিয়ে ঘুরতেছিল এবং পরকালে দোযখের ইন্ধন ও জালানীতে পরিণত হলো। সুতরাং প্রত্যেক মুসলমান বিশেষ করে ওলামা-মাশাইখ ও পীর-বুযূর্গদেরকে পার্থিব ও ধন-সম্পদের লোভ-লালসা থেকে সর্বদা সতর্ক ও সাবধান থাকা উচিত। অবশ্যই কখনো পার্থিব ধন-সম্পদের লোভে দ্বীন-ধর্ম ও ঈমান-আক্বীদার বিষয়ে শৈথিল্য প্রদর্শন মারাত্মক অপরাধ এবং তা পরিহার করা একান্ত প্রয়োজন। অন্যথায় ভালো করে জেনে রাখো যে, আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তির তরবারি ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিশুদ্ধ আক্বিদা পোষণকারীদেরকে এ বিপদ থেকে হিফাযত করুন।
২. সর্বসাধারণের শিক্ষা হাসিল করা উচিত যে, হযরত মুসা (عليه السلام)-এর সৈন্যদল যেখানে মু’মিন ও ফিরিশতারা ছিলেন। একথা স্পষ্ট যে, এই দল অকৃতকার্য হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কারণ তাঁরা এমন আধ্যাত্মিক ও মালাকুতি (ফিরিশতাকুল) বাহিনী ছিলেন যে, তাঁদের সাওয়ারী ঘোড়ার খুরের আঘাতে পাহাড় পর্যন্ত থরথর করে কাঁপতো। কিন্তু মাত্র একজন দুর্ভাগা বদ-নসীবের পাপের কারণে এমন অমঙ্গল চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো যে, ফিরিশতারা সৈন্যদল থেকে আলাদা হয়ে গেলেন এবং মহামারি পেগের আঘাতে পুরো সৈন্যদলের মাঝে এমন বিচ্ছিন্নতা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো যে, সম্পূর্ণ বাহিনী বিশৃংখল হয়ে গেল এবং উক্ত দল হতাশা ও অকৃতকার্য হয়ে পশ্চাৎপদ হয়ে গেল। তাই মুসলমানদের জন্য আবশ্যক যে, তারা যদি কাফির মুশরিকদের মোকাবিলায় জয়যুক্ত ও সফলতা অর্জন করতে চায়, তাহলে সর্বদা অপকর্ম ও পাপচারিতা বর্জন করে হতাশা ও দুর্ভাগা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় ফিরিশতাদের সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে এবং মুসলমানদের প্রভাবপ্রতিপত্ত কাফিরদের অন্তর থেকে বেরিয়ে যাবে। আর মুসলমানেরা কখনো সফলতার মুখ দেখতে পাবে না। বরং তাদের সামরিক শক্তি একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। পুরা জাতি পলায়নকারী কুকুরের ন্যায় কাফির, ফাসিক ও পাপাচারীদের তরবারির খোরাকে পরিণত হয়ে ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অস্থিত্বহীন হয়ে যাবে।
❏ প্রশ্ন-২১০: কখন থেকে চন্দ্র হিসেবে বছরে বার মাস গণনা করা শুরু হয় এবং সূর্য হিসেবে মাস ও হিন্দী মাসের মধ্যে গণনা কিভাবে সাদৃশ্য ও মিলানো হয়? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: هو المستعان চন্দ্র বর্ষ এটি তিনশত চুয়ান্ন দিন এবং আরও দিনের এক তৃতীয়াংশে চন্দ্র বছর হয়। সে হিসেব অনুযায়ী সূর্য বৎসর চন্দ্র বৎসরের চেয়ে এগার দিন এবং দিনের একুশাংশের একভাগের সমপরিমাণ বেশি। উক্ত বর্ষ গণনা আরম্ভ হয় হুযূর সৈয়্যদুল মুরসালীন (ﷺ) -এর হিজরতের তারিখ থেকে।
سَنَةٌ (সানাতুন) এটি আরবি শব্দ, অর্থ-বছর, বহুবচনে سنوات ,سنون আসে এবং আরবিতে বছরকে حَوْلٌ এবং عَامٌ বলা হয়। অন্ধকার যুগেও বছরের হিসেব চন্দ্র হিসেবে বার মাস গণনা করা হতো। যেমনিভাবে ইসলামেও নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্ভবতঃ ইসলামের দু’শো বছর পূর্বে কোন শহরে এ নিয়ম প্রচলিত ছিল এবং প্রত্যেক তৃতীয় বছরে এক মাস বর্ধিত করা হতো, যেমন- হিন্দী লোকদের মাস হয়ে থাকে। যাতে সূর্যের হিসেবের সাথে চন্দ্রের হিসেব মিলে যায়। সে কারণে তাদের হজ্ব প্রত্যেক বছর একই সময়ে হয়ে থাকে এবং তাদের রীতি-নীতি ও আধুনিকতায় কোন পার্থক্য সৃষ্টি হয় না।
উক্ত হিসেবের নিয়ম পদ্ধতি হচ্ছে, কতেক দিন মাসের খুচরা হিসাবের ওপর বাড়িয়ে দেয়া। যার ফলে তিন বছরে পূর্ণ একমাস বেরিয়ে আসে। এ হিসাব বর্তমানেও মিশরীয় আরবদের মধ্যে প্রচলিত আছে। কিন্তু ইসলাম এটাকে অনর্থক বলেছে, শুধুমাত্র চাঁদ দেখানুপাতে চন্দ্র হিসেব চালু রেখেছেন। ইসলামের সকল দল সাধারণত শরয়ী বিধানসমূহের হিসাব-নিকাশ চাঁদ দেখানুপাতে সম্পাদন করে থাকেন। যেমন কোরআন মজিদে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَّةً .
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা যেদিন আসমান-যমিন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকে আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ লওহে মাহফুযে ও গণনায় মাস বারটি লিখে আসছে। তন্মধ্যে সম্মানিত মাস চারটি। এটিই দ্বীন-ধর্মের সঠিক পথ। হে মুসলমানেরা! এর মধ্যে তোমরা নিজেদের সত্তার প্রতি যুলুম-অত্যাচার করো না। আর তোমরা মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করো সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেত ভাবে।’
274. সূরা তাওবা, আয়াত: ৩৬
ইসলামী বর্ষ মুহররম মাস থেকে শুরু হয় এবং পূর্ণ সংখ্যা বার মাস হয়। এটাই পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফ দ্বারাও প্রমাণিত।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরবানীর দিন খুৎবা প্রদানকালে ইরশাদ করেন যে, যামানা বা বছর তার মূল ভিত্তির ওপর এসে পৌঁছেছে। যেমনি আল্লাহ তা‘আলা আসমান-যমিন সৃষ্টি করার দিন ছিল। অর্থাৎ বছর, বার মাসের গণনা হয়েছিল। তন্মধ্যে চার মাস হচ্ছে সম্মানিত।
এর মধ্যে তিন মাস হচ্ছে লাগাতার ও মিলানো যিলকদ, যিলহজ্জ ও মুহরর্ম এবং রজব মাস হচ্ছে জমাদিউস সানি ও শাবান মাসের মাঝখানে।
275. ইসলামী মালুমাত কা মাখ্যান, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৪১৫।
❏ প্রশ্ন-২১১: বছরে তিন মৌসুম গণনা করা হয়। এটা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়?
✍ উত্তর: প্রফেসর আবদুর রহমান মু’মিন তাঁর ‘তাহ্কিকাতি ওয়া আছরিয়াতি তাহ্কিকাত’ গ্রন্থের ১৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, কোরআনে কারীম(ﷺ) হযরত ইউসুফ (عليه السلام) সম্পর্কীয় কাহিনীতে যে দুর্ভিক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা মিসরবাসীর জন্য এক বাস্তব ভয়াল ও বিভীষিকাময় ঘটনা ছিল। পুরাতন মিশরে নীল নদীর পানির উত্তালতার ওপর নির্ভর করে মৌসুম নির্ধারণ করা হত। অনেক সময় নীল নদীতে বন্যা বেড়ে যায়, তখন নদীর উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়ে যেত এবং ক্ষেত ফসলাদি পানির নীচে তলিয়ে যেত। যার কারণে মৌসুম খারাপ হয়ে যেত, ফলে দেশে অভাব-অনটন ও দূর্ভিক্ষ দেখা দিত। যদি নদীতে পানির স্রোত কম হতো, তখন ক্ষেত-ফসলাদিতে পর্যাপ্ত পরিমান সেচের পানি পাওয়া যেত না। ফলে ফসলাদির উৎপাদন কমে যেত এবং খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিত। যদি এভাবে কয়েক বছর যাবত পানির ঘাটতি কিংবা বন্যায় পাবিত হলে দেশে দূর্ভিক্ষ দেখা দিত এবং লোকজনকে অভাব অনটনে কালযাপন করতে হতো। এ কারণে পুরাতন মিসরে পূর্বকালে নীল নদীর স্রোতের হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে মৌসুম নির্ধারণ করা হতো। তাই বছরে তিন মৌসুম গণ্য করা হত।
প্রথম মৌসুম জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উত্তাল ও প্লাবনের মৌসুম বলা হত। দ্বিতীয় মৌসুম অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ছিল। সে সময় ক্ষেত-ফসলাদিতে সেচ দেয়ার পর পানি চলে যেত। উক্ত মৌসুমে বীজ উৎপাদন হত এবং কৃষকরা চাষাবাদ করতো। ফসল পাঁকার পর তা কাটার কাজে ব্যস্ত থাকত। তৃতীয় শুকনো মৌসুম- যা ফেব্রুয়ারি থেকে আগামী জুন পর্যন্ত থাকত।
এভাবে প্রত্যেক বছর মৌসুম পরিবর্তন হতো। মৌসুমের পরিবর্তনের ভিত্তিতে মিসরবাসীরা শামসী (সূর্যের) পঞ্জিকা ও ক্যালেন্ডার তৈরী করতো। নতুন পাশ্চাত্যের ক্যালেন্ডার এ পুরাতন মিসরীয় পঞ্জিকার ওপর নির্ভরশীল। পুরাতন মিসরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবকাঠামোও মৌসুমের পরিবর্তনের অনুপাতে স্থান পেত বা নির্ধারণ করা হতো।
যখন তরকারী, শস্য ফসল অধিক উৎপাদন হতো এবং বিদেশে শস্য-ফসলাদি রপ্তানি করা হতো, তখন সুখে-স্বাচ্ছন্দে জীবন-যাপন করতো। সুখের সময় মিসরী লোকেরা নিজেদের পাল বিশিষ্ট নৌকা নিয়ে লোহিত সাগর ও রোম সাগর পর্যন্ত আনন্দ ভ্রমণ করতো। যখন নীল নদীতে পাবন আসতো এবং শস্যাদি পানিতে ডুবে যেত, তখন সাধারণ মানুষ বিভিন্ন নির্মাণ কাজে মনোনিবেশ করতো।
❏ প্রশ্ন- ২১২:
(ا) الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ الخ (২) وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا الخ(৩) أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا الخ
উক্ত আয়াতগুলোর তাফসীর ও ব্যাখ্যা-বিশেষণ কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: ১. আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা বাকারার তৃতীয় রুকুতে ইরশাদ করেন,
جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ .
‘যে পবিত্রসত্তা! তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ স্বরূপ স্থাপন করেছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য খাদ্যদ্রব্য ও ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের রিযিক হিসেবে। অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে তাঁর সমকক্ষ করো না। বস্তুতঃ তোমরা এসব জান।’
276. সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২২
উক্ত আয়াতে আর্দ অর্থ পৃথিবী, ভূ-পৃষ্ঠ। যমিনের ভূ-পৃষ্ঠ যা দেখতে গোলাকার। কোরআন কারীম(ﷺ)র উক্ত আয়াতে আর্দ (ارض) শব্দ উল্লেখ এসেছে।
‘তাফসীরে মাদারিক’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, উক্ত আয়াতে পৃথিবী কি সমতল না গোলাকার সে বিষয়ে কোন দলিল পেশ করা হয়নি। কারণ বিছানা উভয় অবস্থায় হওয়া সম্ভব। অতএব, যে সকল লোক প্রশ্ন করেন যে, কোরআন মজিদে পৃথিবীকে বিছানা অর্থাৎ সোজাসুজি বিছানো হয়েছে এমন বস্তু বলা হয়েছে, যা জ্যোর্তি বিজ্ঞানীদের গবেষণার সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ অকাট্য দলিল দ্বারা পৃথিবী গোলাকার প্রমাণিত। এটা তাদের অজ্ঞতা ও মুর্খতারই বহিঃপ্রকাশ। কারণ আল্লাহ তা‘আলা শুধু একথাই বলেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীকে তোমাদের চলা-ফেরা, উঠা-বসা ও ঘুমানোর উপযুক্ত করে তৈরী করেছেন, তা গোলাকার হোক কিংবা সমতল এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। অতএব উক্ত প্রশ্ন এবং আয়াতের মর্মের সাথে কোন সম্পর্ক নেই।
২. আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা রা‘দ-এ ইরশাদ করেন-
وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا .
‘তিনিই পৃথিবীকে প্রশস্ত করেছেন এবং এতে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী স্থাপন করেছেন।’
277. সূরা রা‘দ, আয়াত: ৩
مدّ শব্দের অর্থ বিস্তৃত ও প্রশস্ত করা হয়েছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য- ভূ-মন্ডলকে বিস্তৃত করা হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন শ্রেণীর প্রাণী, জীব-জন্তু ও সকল সৃষ্টি জগত অবস্থান করতে পারে। এ আয়াতটিও পৃথিবী গোলাকার হওয়ার বিরোধী নয়।
৩. আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আন্-নাবাতে ইরশাদ করেন,
أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا
‘হে লোকসকল! আমি কি যমিনকে তোমাদের জন্য বিছানা হিসাবে সৃষ্টি করিনি।’
278. সূরা আন্-নাবা, আয়াত: ৬
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, যেভাবে সাত আসমান আছে, তেমনি সাত যমীনও রয়েছে। প্রত্যেক যমিন পরস্পরের মাঝে পাঁচ শত বছরের পথের দূরত্ব বিদ্যমান। এটির মর্ম এমনও হতে পারে যে, এক সৌরমন্ডল সূর্যের এক নিয়ম যা আমাদের সামনে দৃশ্যমান, যার কিরণ বিতরণ করে লক্ষ লক্ষ মাইল আলোকিত করছে। তাছাড়া এ রকম আরো ছয়টি গ্রহ সৌরমন্ডল রয়েছে। যেমন এই সৌরমন্ডলের একটি হচ্ছে এ ভু-মন্ডল, যেখানে আমরা বাস করছি। অনুরূপ অবশিষ্ট ছয় গ্রহের মধ্যে ছয়টিই ভূমন্ডলে।
ইসলামী সাহিত্যে সমুদ্রের ক্ষেত্রে ‘বাহরে মুহীত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বাহার অর্থ-সমুদ্র। আর মুহীত অর্থ-পরিবেষ্টনকারী। এটা এজন্য যে, সমুদ্র সকল মহাদেশ ও দ্বীপসমূহকে যেখানে মানুষ বসবাস করে চতুর্দিক দিয়ে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। অথবা এজন্য যে, সমুদ্র ভূ-পৃষ্ঠকে ঘিরে রেখেছে। ইসলামী শিক্ষায় বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর দূরত্ব শত বছরের পথ। এখানে পাঁচশত বছরের রাস্তা বলে নির্দিষ্ট সংখ্যা উদ্দেশ্য নয়। বরং পরিভাষা অনুযায়ী অধিক দূরত্ব ও দীর্ঘ সময় উদ্দেশ্য। শরয়ী বিধান মতে, পদব্রজে চলার হিসাব মতে দূরত্ব নির্ণয় করা হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, পদব্রজে চলার গতিতে গোটা পৃথিবী অতিক্রম করা অনেক সময়ের প্রয়োজন অথবা এখানে দূরত্ব দ্বারা মর্যাদা উদ্দেশ্য।
সে নিরিখে পদব্রজে যদি গোটা পৃথিবী পরিমাপ করার জন্য একজন মানুষ নির্ধারণ করা হয়, তাহলে তার জন্য পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর ও জল-স্থল এক কথায় সমগ্র পৃথিবীকে পাঁচশত বছরেও পরিমাপ করা সম্ভব হবে না। পবিত্র কা’বা শরীফ পৃথিবীর মধ্যভাগে অবস্থিত। কতিপয় ওলামা বলেছেন যে, বাইতুল মুকাদ্দাসের অবস্থান পৃথিবীর মধ্যভাগে। এ বর্ণনাটি যুক্তির কাছাকাছি। কারণ বর্ণিত উভয় স্থান শুষ্ক প্রান্তরের এমন অংশে অবস্থিত- যা পৃথিবীর সকল মহাদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত। ইসলামী শিক্ষায় একথাও বলা হয়েছে যে, শয়তানের আসন সাগরে অবস্থিত। চিন্তা-ভাবনা করলে একথা সম্পূর্ণ বাস্তব সত্য এবং ঘটনার অনুরূপ বলে মনে হয়।
শয়তানের কাজ হচ্ছে মানুষের মধ্যে পরস্পর শত্রুতামী করানো, মানব সন্তানের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া, যাদু-টোনা ও ঝাড়ফুঁক করা, মিথ্যা-কপটতা এবং পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি বিস্তার লাভ করা। কারণ শয়তানের কর্মকান্ড ও যাতায়াত স্থলভাগেও রয়েছে। তাই সে এ জাতীয় ফিৎনা-ফ্যাসাদ স্থলভাগেও সর্বদা সৃষ্টি করে আসছে।
কিন্তু যখন থেকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্য পানির জাহাজ নির্মাণে উন্নতি সাধন করে সমুদ্রে অধিকহারে যাতায়াত শুরু করে। সেহেতু সাগর হচ্ছে শয়তানের রাজধানী। তাই সমুদ্রে এ ধরনের ফিৎনা-ফ্যাসাদ, হত্যা, লুটপাট ও অরাজকতা স্থলের চেয়ে অধিক ভয়াল ময়দানে পরিণত হয়েছে। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, বর্তমানে পাশ্চাত্যে শয়তানি শিক্ষার যে চর্চা হচ্ছে, পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে তা হচ্ছে না। ইউরোপীয়ানরা স্বভাব-চরিত্র, আধ্যাত্মিক, মাযহাবি, চারিত্রিক ও মানবিক দিক দিয়ে মানব সভ্যতা থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছে। তাদের ধ্যান-ধারণা কার্যক্রম উৎসাহ-উদ্দীপনা এক কথায় প্রতিটা বিষয়ে তাদের ব্যক্তিগত সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ সর্বস্থরে শয়তানি কানুন ও শাসনের প্রচলন প্রাধান্য লাভ করেছে। তাই তাদের রাষ্ট্র ও ধন-দৌলতের প্রতিযোগিতায় ভিন্ন জাতিকে ধ্বংস ও নিশ্চিন্ন করে তাদেরকে অস্থিত্বহীন করে দেয়া, তাদের জন্য বড় অহংকার ও গৌরবের বিষয়। ভিন্ন জাতি ধ্বংস করা এবং তাদের সম্পদ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার আকাঙ্খা উক্ত জাতির প্রকৃতিগত স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তাই তাদের সে আকাঙ্খা স্থলভাগেও পূর্ণ করছে, কিন্তু স্থলভাগের তুলনায় সমুদ্রে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের উপকরণ আরো বেশি শক্তিশালী। সে ভয়াল সমুদ্রের নাম শুনলেই মানবজাতি ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে উঠে। বর্তমানে নিরবে নিস্তব্দে তাদের অনেক উত্তরাধিকারী সহকর্মী তৈরী করা হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে তাদের অত্যাধুনিক জাহাজ এবং ক্রুজ মিশাইল ও ব্যবসায়িক যুদ্ধ জাহাজ বিভিন্ন দিক প্রদক্ষিণ করছে এবং চক্কর দিচ্ছে। গভীর সমুদ্র থেকে অত্যাধুনিক ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র রকেট লাঞ্চার ইত্যাদি অগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করে স্থলবাসীদের ঘর-বাড়ি গুড়িয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেনা ঘাঁটির ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে তা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করছে। নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু হচ্ছে। এ পৈশাচিকতা, যুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচার-নিপীড়ন সামুদ্রিক যুদ্ধে অধিকহারে সংঘটিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত স্থলযুদ্ধ অনেকবার হয়েছে কিন্তু অবর্ণনীয় এ দুর্দশার দৃশ্য একমাত্র সামুদ্রিক যুদ্ধেই ঘটেছে। এমন তো হবেও না কেন? সমুদ্র তো তাদের পীর-মুর্শিদের সিংহাসন স্থল।
উৎসর্গ হোক আমার প্রাণ উভয় জাহানের নবী (ﷺ) -এর অমীয় বাণীর ওপর, যিনি চৌদ্দশত বছর পূর্বে সহজ-সরল ও সাদাসিদে শব্দের মাধ্যমে এ সূক্ষ্ম রহস্যের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন।
اللهم صلِّ عليه فصلِّ عليه ثم صلِّ عليه .
পৃথিবীর কোন প্রান্তে আবে-হায়াত বা জীবন সঞ্জীবনী পানির ঝর্ণাধারা বিদ্যমান থাকার কথা প্রসিদ্ধ আছে। যার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, উক্ত ঝর্ণা থেকে যে কেউ পানি পান করবে সে কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত থাকবে। আরো একটি ‘কোহ-কাফ’-এর নামও অভিধানের কিতাবে লিখা আছে, যা সম্পূর্ণরূপে যমরুদ বা মূল্যবান সবুজ পাথরের বলা হয়ে থাকে এবং যা পৃথিবীর চতুর্দিকে পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছে। এ জাতীয় আরো অনেক কাহিনী মুসলমানদের মাঝে সাধারণত প্রসিদ্ধ আছে কিন্তু এগুলোর কোন শরয়ী অকাট্য দলীল পাওয়া যায়নি।
279. ইসলামী মা’লুমাত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা- ৬০-৬১
❏ প্রশ্ন-২১৩: সুন্নাত কাকে বলে সংজ্ঞাসহ বর্ণনা কর ?
✍ উত্তর: وبالله التوفيق মুহাদ্দিসীন-ই কিরামের পরিভাষায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ), সাহাবা-ই কিরাম ও তাবেঈন-ই কিরামের রীতি-নীতিকে সুন্নাত বলে। সুন্নাতের উক্ত সংজ্ঞায় আসহাব, ত্বাওর ও তরিকা- এই তিনটি শব্দের ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
اصحاب শব্দটি বহুবচন, একবচনে صحابى । সাহাবী ওই ব্যক্তি যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন ও নবী করীম -এর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছেন এবং ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাসের ওপর ইন্তিকাল করেছেন। সোহরত বা সাহচর্যের জন্য নির্দিষ্ট কোন সময়-সীমা নেই, সামান্য হোক বা বেশী। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সাথে সাহাবা-ই কিরামের যেরূপ সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছে, অনুরূপ তাবেঈগণের সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছে সাহাবা-ই কিরামের সঙ্গে। তাবেঈ এমন ব্যক্তি যাঁর সাথে কোন সাহাবীর (رضى الله تعالي عنه) সংশ্রব বা সান্নিধ্য লাভ হয়েছে এবং ইসলামের শর্তও যথাযথ পাওয়া গিয়েছে।
طورطريق শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য قول، فعل، تقرير অর্থাৎ- বাণী, কাজ ও নীরবতা। تقرير দ্বারা কথা-বার্থা ও আলাপ-আলোচনা উদ্দেশ্য নয়; বরং تقرير দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, কাউকে কোন কাজ করতে দেখে কিংবা আদেশ-উপদেশ দিতে শুনে, ভাল-মন্দ কিছুই না বলে নীরব থাকা। এতে প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত কাজ-কর্ম ও আদেশ-উপদেশ ইত্যাদি জায়েয। অতএব সুন্নাত নয় প্রকার:
১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর قول বা বাণী।
২. তাঁর فعل বা পবিত্র কাজ।
৩. তাঁর (ﷺ) কোন কর্ম ও বাণীকে জায়েয বা বৈধতা প্রদান করা। এ ধরনের তিন প্রকার সাহাবা-ই কিরামের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে, অতঃপর ওই ধরনের তিন প্রকার তাবেঈনদের সাথে সম্পর্কের কারণে। এ সবগুলো মিলে নয় প্রকার হলো।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর অনুসরণ ও তাঁর প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ কোরআন মজিদের দলিল দ্বারা প্রমাণিত। যথা:
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ .
‘হে রাসূল! আপনি ওই সকল লোকদের বলেদিন, যদি তোমরা আল্লাহকে বন্ধু হিসেবে পেতে চাও, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদেরকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’
280. সূরা আল-ইমরান, আয়াত: ৩১
সাহাবা-ই কিরাম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন,
اصحابى كا لنجوم بايهم اقتديتم اهتديتم .
‘আমার সাহাবীরা (رضى الله تعالي عنه) আকাশের নক্ষত্রের ন্যায়, তোমরা তাদের মধ্য হতে কারো অনুসরণ-অনুকরণ করলে সঠিক পথ পাবে।’ বাকী রইলো তাবেঈনগণের ফযিলত। আমরা তাঁদের অনুসরণ নিম্নোক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণ করবো।
خير القرون قرنى ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم .
‘কালের মধ্যে সর্বোত্তম কাল হলো আমার কাল। অতঃপর তাঁদের কাল উত্তম, যাঁরা উক্ত কালের লোকদের নিকটতম হবেন। অতঃপর তাঁদের যাঁরা এদের নিকটতম হবেন।’
সারকথা হচ্ছে, আমাদেরকে কোরআন মাজীদ ছাড়াও আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে রাসূল (ﷺ) -এর এবং রাসূল (ﷺ)-এর হুকুমে সাহাবা-ই কিরাম, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনগণের অনুসরণ ও অনুকরণ করা আবশ্যক। সুতরাং তাঁদের قول، فعل،تقرير তথা বাণী, কাজ ও নীরবতারও অনুকরণ করতে হবে। যার অর্থ আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি।
কাশ্শাফ গ্রন্থকার ‘ইস্তিলাহাত’ এ লিখেছেন যে, শরীয়তের পরিভাষায় সুন্নাতের প্রয়োগ নিম্নোক্ত অর্থে হয়ে থাকে-
১. শরীয়ত।
২. রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর কওল, ফেল এবং তাকরীর তথা বাণী, কর্ম ও অনুমোদন।
৩. ওই হুকুম যা শুধু হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত।
৪. সে সকল কাজ যা না করার চেয়ে করাই উত্তম। এখানে ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল ও মুস্তাহাব সবই অন্তভুর্ক্ত।
৫. নফল: যা করাতে সওয়াব রয়েছে এবং না করলে শাস্তি নেই।
৬. امر مشروع তথা শরীয়ত অনুমোদিত হুকুম।
৭. এমন কাজ বা আমলসমূহ যা হুযূর (ﷺ) কিংবা সাহাবা-ই কিরাম (رضى الله تعالي عنه) সর্বদা করেছেন, মাত্র দু’একবার ছাড়া কখনো পরিত্যাগ করেন নি।
এগুলো আদায় না করাতে যদি গুনাহ হয়, তাহলে এগুলোকে সুন্নাতুল্লাহ বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলা হয়। যেমন, আযান, জামাত, ফজরের দুই রাকাআত সুন্নাত, যোহরের ছয় রাকাআত সুন্নাত এবং মাগরিব ও এশার ফরযের পর দুই রাকাআত সুন্নাত। আর যদি আদায় না করাতে গুনাহ না হয়, তাহলে এগুলোকে সুন্নাতে যায়েদা বা সুন্নাতে গাইরে মুয়াক্কাদা বলা হয়।
❏ প্রশ্ন-২১৪: فرعون ও هامان এটি কোন শব্দ? এবং নমরূদ কে ছিল?
✍ উত্তর: ভাষাবিদগণ বলেছেন, فرعون (ফেরাউন) শব্দটি تفرعن শব্দ থেকে নির্গত। অর্থ-অহংকারী, দাম্ভিক। মূলতঃ শব্দটি فُرْوَءَةٌ থেকে উৎকলিত। মিসরীয় পুরাতন অভিধানে যার অর্থ- শাহান্শাহ বা মহান সম্রাট। আরবরা এটা আরবী ভাষার অন্তভুর্ক্ত (معرّب) করতে গিয়ে فرعون ফেরাউন করেছেন। বহুবচনে فراعنه আসে।
ফেরাউন:
ফেরাউন কোন বাদশাহর নাম ছিল না। বরং মিসরীয় বাদশাহগণের উপাধি ছিল। তারা মিশর বিন হা-ম ইবনে নুহ-এর বংশধর ছিল। যেমন হিন্দুস্তানের বাদশাহকে ‘রাজা’ এবং প্রাচীন রোমের বাদশাহগণকে ‘কায়সার’ বলা হতো।
281. হক্কানী মাখ্যনে ইলুম, পৃষ্ঠা- ৫৭০
হামান:
ফেরাউনের উজির বা মন্ত্রীর নাম। যাকে ফেরাউন আল্লাহকে দেখার জন্য উঁচুস্থান নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
وَقَالَ فِرْعَوْنُ يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرِي فَأَوْقِدْ لِي يَا هَامَانُ عَلَى الطِّينِ فَاجْعَلْ لِي صَرْحًا لَعَلِّي أَطَّلِعُ إِلَى إِلَهِ مُوسَى.
‘ফেরাউন বলল, হে পরিষদবর্গ! আমি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন খোদা আছে বলে আমার জানা নেই। অথচ মুসা (عليه السلام) এক খোদা প্রমাণ দিচ্ছে। ফেরাউন তার উজিরকে লক্ষ্য করে বলল, হে হামান! তুমি মাটির ইট পোড়াও, অতঃপর আমার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ কর, যাতে আমি মুসার (عليه السلام) খোদাকে উঁকি মেরে দেখতে পারি।’
282. সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৩৮
নামরুদ:
নামরুদ এক কাফির বাদশাহর নাম। সে হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর সময়কার বাদশাহ ছিল এবং নিজেকে খোদা বলে দাবী করত। যে কেউ তার দরবারে গেলে, তাকে সিজদা করতে হতো। সে হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)কে তার নিকট ডেকে পাঠাল কিন্তু তিনি এসে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং সিজদা সংক্রান্ত বিষয়ে নামরুদকে স্তব্ধ করে দেন। ফলে নমরুদ তাঁর শত্রু হয়ে গেল এবং তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করল কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে অত্যন্ত নিরাপদে রাখেন।
❏ প্রশ্ন-২১৫: ســبـأ‘ (সাবা) এর তাফসীর ও তাহকীক বর্ণনা কর ?
✍ উত্তর: কোরআন মজিদে সূরা সাবা’র দ্বিতীয় রুকুতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,
لَقَدْ كَانَ لِسَبَإٍ فِي مَسْكَنِهِمْ آيَةٌ جَنَّتَانِ عَنْ يَمِينٍ ......... وَهَلْ نُجَازِي إِلَّا الْكَفُورَ .
‘সাবার অধিবাসীদের জন্য তাদের আবাস ভূমিতে ছিল আল্লাহ তা‘আলার কুদরতের এক মহান নিদর্শন- দু’টি উদ্যান, একটি ডান দিকে, অপরটি বামদিকে। আমরা তাদেরকে নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে দেয়া রিযিক খাও এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। পৃথিবীতে অবস্থানের জন্য যিনি এতো স্বাস্থ্যকর শহর এবং আবাসিক গড়েছেন, যিনি পরকালে অপরাধ ও গুনাহ ক্ষমাকারী পালনকর্তা। অতঃপর তারা আমার হুকুমের অবাধ্যতা করল, ফলে আমি বাঁধ ভেঙ্গে তাদের ওপর প্রবল বন্যা দিয়ে গোটা এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছি। আর তাদের বাগানদ্বয়কে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুই বাগানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং সামান্য কুলবৃক্ষ। এটাই ছিল কুফরীর কারণে তাদের প্রতি আমার শাস্তি। আমি অকৃতজ্ঞ ছাড়া কাউকে শাস্তি দিই না।’
283. সূরা সাবা, আয়াত: ১৫-১৭
‘সাবা’ ইয়ামেনের বাদশাহ ইয়াশহাব-এর অপর নাম। অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণের ধারণা মতে, সাবা ইয়াশহাবের সন্তানের নাম। তার সন্তানেরা পুরুষত্বহীন হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর এ সকল বংশধরেরা সাবা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তাদের লোকজন বিভিন্ন স্থানে বসবাস করতো এবং বস্তিসমূহকে আবে মাআরিব’ বলা হতো। উক্ত বস্তিসমূহ সান‘আ শহর থেকে তিন মাইল দূরত্বে অবস্থিত।
হযরত ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করল, কোরআনে উল্লেখিত ‘সাবা’ কোন পুরুষের নাম, না নারীর, না কোন ভূ-খন্ডের নাম? রাসূলুল্লাহ বলেন, সাবা একজন পুরুষের নাম। তার দশজন পুত্র সন্তান ছিল। তন্মধ্যে ছয়জন ইয়ামেনে এবং চারজন সিরিয়া দেশে বসতি স্থাপন করে। ইয়ামেনে বসবাসকারী ছয় পুত্রের নাম: ইযদ্, আশ‘আরী, হিমইয়ার, কেন্দা, মাদজাজ ও আন্মার এবং সিরিয়া দেশে বসবাসকারীদের নাম: লখম, জুযাম, গাস্সান ও আমেলা। প্রত্যেক সন্তানেরা এ নামেই সুবিদিত।
তাদের গোত্রীয় নামও এ নামেই পরিচিত ছিল। হিম্ইয়ারের বংশে ইয়ামেন সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতা পরিচালিত হয়। আন্মারের পুত্র সাদ্দাদ উক্ত সাম্রাজ্যের বাদশাহ নির্বাচিত হন। অতঃপর তার ভাই লোকমান ইবনে আদ বাদশাহ হন। এরপর তার অপর ভাই যুসদ ক্ষমতাসীন হয়। অতঃপর তার সন্তান হারিস ইবনে তুব্বা‘ ক্ষমতাসীন হন, যিনি প্রথম তুব্বা’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তারপর তার সন্তান সা‘আব বাদশাহ হন, তাঁকে যুল-কারনাইনও বলে। অতঃপর পুত্র যুল-মানার আবরাহ, অতঃপর তার পুত্র আফরিক্বশ, অতঃপর তার ভাই যুল-আগার, অতঃপর তার ভাই শারজীল, অতঃপর তার পুত্র আল-হাদ্দাদ বাদশাহ নির্বাচিত হন। অতঃপর তার কন্যা বিলকিছ বাদশাহ হন। সাবার বংশধরের মধ্যে যে ছয়জন বাদশাহ ছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন ঈমানদার, পূন্যবান ও নেককারও ছিলেন। যেমন- তুব্বা’, যুল-কারনাইন। কয়েকজন মূর্তিপূজারী কাফির ছিলেন।
কয়েকজনের রাজত্ব আরব সাম্রাজ্য অতিক্রম করে সুদূর মিসর, সিরিয়া, ইরান ও হিন্দুস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। উক্ত বাদশাহগণের স্মৃতিস্বরূপ গামদান-এর অট্টালিকাসমূহ এখনো তার স্বাক্ষর বহন করছে। এগুলোর মধ্যে ওই বাঁধও প্রাচীনতম স্মৃতি বহন করছে যেমন কারো মতে, সম্রাজ্ঞী বিলকিস বর্ষার পানি আটকানোর জন্য বাঁধ তৈরী করায়েছিলেন। সমস্ত নালার পানি ওই বাঁধে আটকা পড়ে জমা হয়ে যেত। সেখান থেকে ছোট ছোট নালা বের করে ক্ষেত-খামার ও বাগানগুলোতে পানি সরবরাহ করা হতো। রাস্তার উভয় পাশের্ব বাগান ছিল এবং পানির সুবিধার্থে অনেক বসতবাড়ি সেখানে স্থাপিত হয়েছিল। এ শস্য-শ্যামলতা ও সজীবতা অনেক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যার ফলশ্রুতিতে পর্যটকগণ অতি সহজে ও নিরাপদে অনেক দূরত্বের পথ অতিক্রম করতে সক্ষম হতো। উক্ত নিয়ামতকে লোকেরা সাধারণ বিষয় মনে করতে লাগল, যার ফলাফল এটাই হলো যে, আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে বাঁধ ভেঙ্গে পানি সমস্ত বস্তি ও আবাদী বাগানসমূহ বন্যার স্রোতে ভেসে নিয়ে গেল।
সুতরাং কোরআন মজিদে সূরা আন-সাবা’র দ্বিতীয় রুকুতে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
لَقَدْ كَانَ لِسَبَإٍ فِي مَسْكَنِهِمْ آيَةٌ جَنَّتَانِ عَنْ يَمِينٍ ......... وَهَلْ نُجَازِي إِلَّا الْكَفُورَ .
‘সাবার অধিবাসীদের জন্য তাদের আবাস ভূমিতে ছিল আল্লাহ তা‘আলার কুদরতের এক মহান নিদর্শন- দু’টি উদ্যান, একটি ডান দিকে, অপরটি বামদিকে। আমরা তাদেরকে নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে দেয়া রিযিক খাও এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তিনি পৃথিবীতে অবস্থানের জন্য এতো স্বাস্থ্যকর শহর এবং পরকালে অপরাধ ও গুনাহ ক্ষমাকারী পালনকর্তা। অতঃপর তারা আমার হুকুমের অবাধ্যতা করল, ফলে আমি বাঁধ ভেঙ্গে তাদের ওপর প্রবল বন্যা দিয়ে গোটা এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছি। আর তাদের বাগানদ্বয়কে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুই বাগানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং সামান্য কুলবৃক্ষ। এটাই ছিল কুফরীর কারণে তাদের প্রতি আমার শাস্তি। আমি অকৃতজ্ঞ ছাড়া কাউকে শাস্তি দিই না।’
284. সূরা সাবা, আয়াত: ১৫-১৭
আমি সাবা বাসীদের বস্তিসমূহ এবং সিরিয়ার গ্রামবাসীর মধ্যস্থিত এলাকায় উৎপাদনে যে বরকত দিয়েছিলাম এবং অনেক গ্রাম আবাদ করে রেখেছিলাম যা পরস্পর পাশাপাশি হওয়াতে দেখা যেত। উক্ত গ্রামে পর্যটকদের চলাচলের জন্য সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম, যাতে তারা নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে দিবারাত্র চলাফেরা করতে পারে। তখন তারা বলতে লাগল যে, হে আমাদের প্রতিপালক! এতবেশী পাশাপাশি এলাকায় সফর করাতে সফরের স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি আমাদের ঘর-বাড়ী দূরে দূরে করে দাও। সারকথা হচ্ছে, তারা উক্ত নিয়ামতসমূহের মূল্যায়ন না করে তারা নিজেদের ওপর যুলুম করেছে। অতএব আমি তাদেরকে এভাবে বিলীন করে দিয়েছি যে, তাদের ঘটনা কল্প-কাহিনী ও উপাখ্যানে পরিণত করে দিয়েছি। আমি তাদের মধ্যে যারা কৃতজ্ঞ ও ধৈর্য্যশীল বান্দা রয়েছেন, সাবা সম্প্রদায়ের কাহিনীতে তাদের জন্য রয়েছে বড় শিক্ষনীয় বিষয়। শয়তান যে সকল লোকদের সম্পর্কে তার মতামত পেশ করেছিল যে, তারা তার সঙ্গ দেবে, বাস্তবিকই সে তার রায়কে সত্য প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, উক্ত লোক সকল তার সঙ্গ দিয়েছে এবং তাকে অনুসরণ করেছে। কিন্তু ঈমানদারদের এক জামাত যারা তার প্রতারণা ও প্রলোভনে প্রতারিত হয়নি বরং শয়তানের তো তাদের ওপর কোন ক্ষমতাই ছিল না। আমি তার ব্যাপারে একটি কৌশল করে রেখেছিলাম, যার আসল উদ্দেশ্য এটাই ছিল যে, যে সকল লোক পরকালে বিশ্বাসী আমি তাদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করে রাখব। আর যাদের সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে এবং শয়তানের প্ররোচনায় নিপতিত হয়েছে তাদেরকেও পৃথক করব। অতএব, হে রাসূল ! তোমার প্রতিপালক প্রত্যেক বিষয়ের প্রত্যক্ষদর্শী এবং প্রত্যেক বস্তুর অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন। ‘সাবা’ কোরআন মজিদের চৌত্রিশতম সূরার নাম। এটির তাফসীর যে-কোন তাফসীর গ্রন্থ থেকে জেনে নিন।
(আমি শয়তানকে পরকালে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য কৌশল বা ফাঁদ হিসেবে রেখেছি, যাতে তার অনুসারী ও অনানুসারীদের পৃথক করা যায়।)
"تمت بالخير"
সমাপ্ত