ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ-রাসূল (ﷺ)-এর নাম মোবারক শুনে দুই বৃদ্ধাঙ্গুলিতে চুমু খাওয়ার বিধানঃ

* এ ব্যাপারে হযরত আদম (عليه السلام) এর আমল

বিখ্যাত মুফাস্সির আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী (রহ) তাঁর উল্লেখযোগ্য তাফসীর তাফসীরে ‘রুহুল বায়ানে’ লিখেন-

وفي قصص الأنبياء وغيرها أن آدم عليه السلام اشتاق إلى لقاء محمد صلى الله عليه وسلم حين كان في الجنة فأوحى الله تعالى إليه هو من صلبك ويظهر فى آخر الزمان فسأل لقاء محمد صلى الله عليه وسلم حين كان في الجنة فأوحى الله تعالى اليه فجعل الله النور المحمدي فى إصبعه المسبحة من يده اليمنى فسبح ذلك النور فلذلك سميت تلك الإصبع مسبحة كما فى الروض الفائق. او اظهر الله تعالى جمال حبيبه فى صفاء ظفري ابهاميه مثل المرآة فقبل آدم ظفري إبهامه ومسح على عينيه فصار أصلا لذريته فلما اخبر جبرائيل النبي صلى الله عليه وسلم بهذه القصة قال عليه السلام (من سمع اسمى فى الاذان فقبل ظفري ابهامه ومسح على عينيه لم يعم ابدا 

-‘‘কাসাসুল আম্বিয়া কিতাবে বর্ণিত আছে যে, হযরত আদম (عليه السلام) জান্নাতে অবস্থানকালে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)‘র সাথে সাক্ষাতের জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করেন। অত:পর আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর নিকট ওহী প্রেরণ করেন যে, হে আদম! তিনি তোমার পৃষ্ঠ হতে শেষ যামানায় প্রকাশ হবেন। তা শুনার পর তিনি জান্নাতে অবস্থানকালে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালেন। বিনিময়ে আল্লাহ তা‘য়ালা ওহী প্রেরণ করলেন, যে নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) তোমার ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুলীর মধ্যে স্থানান্তরিত করেছি, তখন সে অঙ্গ হতে তাসবীহ পাঠ আরম্ভ হলো। এজন্যই এই আঙ্গুলকে তাসবীহ পাঠকারী আঙ্গুল বলা হয়। যেমন ‘রওযাতুল ফায়েক’ কিতাবেও বর্ণিত আছে, অথবা আরেক বর্ণনায় রয়েছে, আল্লাহ তা‘য়ালা আপন হাবীব (ﷺ) এর সৌন্দর্য প্রকাশ করলেন দুই বৃদ্ধাঙ্গুলীর উপর যেভাবে আয়নাতে দেখা যায়। তখন আদম (عليه السلام) দুই বৃদ্ধাঙ্গুলি চুম্বন করে স্বীয় চোখের উপর মালিশ করলেন। এটি দলীল হিসেবে প্রমাণিত হলো যে, তাঁর সন্তানাদীর জন্য। অতঃপর জিবরাঈল (আ) এই ঘটনা হুযুর (ﷺ) কে জানালেন। হুযুর (ﷺ) বললেন, যেই ব্যক্তি আযানের মধ্যে আমার নাম মোবারক শুনে দুই বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন করবে আর চোখে মালিশ করবে, সে কখনো অন্ধ হবে না।’’
🔺(ক.আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী : তাফসীরে রুহুল বয়ান : ৭/২২৯ : সূরা মায়েদা আয়াত : ৫৭ নং এর ব্যাখ্যা, আবদুর রহমান ছাফুরী, নুযাহাতুল মাযালিস, ২/৭৪পৃ.)



মূসা (আ.)-এর যামানায় এর আমল

حَدَّثَنَا عَبْدُ اللهِ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ جَعْفَرٍ، ثنا أَبُو بَكْرٍ الدَّيْنُورِيُّ الْمُفَسِّرُ، ثنا مُحَمَّدُ بْنُ أَيُّوبَ الْعَطَّارُ، ثنا عَبْدُ الْمُنْعِمِ بْنُ إِدْرِيسَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ وَهْبٍ قَالَ: كَانَ فِي بَنِي إِسْرَائِيلَ رَجُلٌ عَصَى اللهَ مِائَتَيْ سَنَةٍ ثُمَّ مَاتَ، فَأَخَذُوا بِرِجْلِهِ فَأَلْقُوهُ عَلَى مِزْبَلَةٍ، فَأَوْحَى اللهُ إِلَى مُوسَى عَلَيْهِ السَّلَامُ أَنِ اخْرُجْ فَصَلِّ عَلَيْهِ. قَالَ: يَا رَبِّ، بَنُو إِسْرَائِيلَ شَهِدُوا أَنَّهُ عَصَاكَ مِائَتَيْ سَنَةٍ، فَأَوْحَى اللهُ إِلَيْهِ: هَكَذَا كَانَ، إِلَّا أَنَّهُ كَانَ كُلَّمَا نَشَرَ التَّوْرَاةَ وَنَظَرَ إِلَى اسْمِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَبَّلَهُ وَوَضَعَهُ عَلَى عَيْنَيْهِ، وَصَلَّى عَلَيْهِ، فَشَكَرْتُ ذَلِكَ لَهُ، وَغَفَرْتُ ذُنُوبَهُ، وَزَوَّجْتُهُ سَبْعِينَ حَوْرَاءَ-    

-‘‘হযরত ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বাহ (রা) বলেন, বনী ইসরাঈলের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিল অত্যন্ত পাপী, যে ২০০ বছর পর্যন্ত আল্লাহর নাফরমানী করেছে। যখন সে মৃত্যুবরণ করে মানুষেরা তাকে এমন স্থানে নিক্ষেপ করল, যেখানে আবর্জনা ফেলা হতো। তখন হযরত মুসা (আ) এর প্রতি ওহী এলো যে, লোকটিকে ওখান থেকে তুলে যেন তার ভালভাবে জানাযার নামায পড়ে তাঁকে দাফন করা হয়। হযরত মুসা (আ) আরজ করলেন, হে আল্লাহ! বনী ইসরাঈল সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, লোকটি ২০০ বছর পর্যন্ত তোমার নাফরমানী করেছিল। ইরশাদ হলো, হ্যাঁ , তবে তার একটি ভাল অভ্যাস ছিল। যখন সে তাওরাত শরীফ তেলাওয়াত করতো, যতবার আমার হাবীব হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) এর নাম মোবারক দেখত তখন সেটা ততবার চুম্বন করে চোখের উপর রাখত এবং তার প্রতি দুরূদ পাঠ করত। এজন্য আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি এবং সত্তর জন হুর স্ত্রী স্বরূপ তাকে দান করেছি।’’
🔺(ক. ইমাম আবু নঈম : হুলিয়াতুল আউলিয়া : ৩/১৪২পৃ. আল্লামা বুরহানুদ্দীন হালভী : সিরাতে হালবিয়্যাহ ১ম খন্ড পৃষ্ঠা-৮৩, আল্লামা শফী উকাড়ভী : জিকরে জামীল : ৩৫৪ পৃষ্ঠা, জালালুদ্দীন সুয়ূতি : খাসায়েসুল কোবরা : ১/৩০, হাদিস : ৬৮, মাকতুত-তাওফিকহিয়্যাহ, বয়রুত, আল্লামা আবদুর রহমান ছাফূরী : নুযহাতুল মাযালিস : ২/১৪২ পৃ., দিয়ার বকরী : আল খামীস ফি আহওয়ালে আনফাসে নাফীস : ১/২৮২ পৃ.)


হযরত খিযির (আ) কর্তৃক রাসূল (ﷺ) এর নাম শুনে চুমু খাওয়ার আমল বর্ণিত

ما أورده أبو العباس أحمد ابن أبي بكر الرداد اليماني المتصوف في كتابه "موجبات الرحمة وعزائم المغفرة" بسند فيه مجاهيل مع انقطاعه، عن الخضر عليه السلام أنه: من قال حين يسمع المؤذن يقول أشهد أن محمد رسول اللَّه: مرحبا بحبيبي وقرة عيني محمد بن عبد اللَّه صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ثم يقبل إبهاميه ويجعلهما على عينيه لم يرمد أبدا، - 

-‘‘ইমাম আবু আব্বাস আহমদ বিন আবি বকর ইয়ামানী (রহ) তাঁর লিখিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ موجبات الرحمة و عزائم المغفرة এর মধ্যে হযরত খিযির (আ) থেকে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মদার রাসূলূল্লাহ’ শোনে বলবে

 مرحبا بحبيبي وقرة عينى محمد بن عبد الله صلى الله عليه وسلم 

🔺(মারহাবা বি হাবিবি ওয়া কুররাতো আইনী মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ (রা)) অতঃপর স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয় চুম্বন করে চোখে লাগাবে, তাহলে তার চোখে কখনও ব্যথা হবে না এবং সে কোন দিন অন্ধ হবে না।’’
🔺(ইমাম সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা : ১/৩৮৩ : হাদিস : ১০২১, আযলূনী : কাশফুল খাফা : ২/২৭০ : হাদিস : ২২৯৬, মোল্লা আলী ক্বারী : মওদ্বুআতুল কবীর : ১০৮ পৃ.)


ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা) এর আমলঃ

حَدِيثِ أَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ أَنَّهُ لَمَّا سَمِعَ قول المؤذن أشهد أن محمد رَسُولُ اللَّه قَالَ هَذَا، وَقَبَّلَ بَاطِنَ الأُنْمُلَتَيْنِ السَّبَّابَتَيْنِ وَمَسَحَ عَيْنَيْهِ، فَقَالَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ فَعَلَ مِثْلَ مَا فَعَلَ خَلِيلِي فَقَدْ حَلَّتْ عَلَيْهِ شَفَاعَتِي- رواه الديلمى المسند الفردوس

-‘‘হযরত আবু বকর (রা) হতে বর্ণিত, তিনি মুয়াযযিনকে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার’ রাসূলুল্লাহ বলতে শোনলেন, তখন তিনিও তা বললেন এবং বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ে চুমু খেয়ে তা চোখে বুলিয়ে নিলেন। তা দেখে রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন : যে ব্যক্তি আমার বন্ধুর ন্যায় আমল করবে, তার জন্য আমার সুপারিশ বৈধ হয়ে গেল।’’ 
🔺(ইমাম আবদুর রহমান সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা : ৩৮৩ : হাদিস : ১০২১, আল্লামা ইমাম আযলূনী : কাশফুল খাফা : ২/২৫৯ : হাদিস : ২২৯৬, আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : আসরারুল মারফূ : ৩১২ পৃষ্ঠা : হাদিস : ৪৫৩, ইমাম তাহতাভী : মারাকিল ফালাহ : ১৬৫ পৃ. : কিতাবুল আযান, শাওকানী : ফাওয়াহিদুল  মওদ্বুআত : ১/৩৯ পৃ., ইসমাঈল হাক্কী : তাফসীরে রুহুল বায়ান : ৭/২২৯ পৃ., তাহের পাটনী : তাযকিরাতুল মওদ্বুআত : ৩৪ পৃ., জালালুদ্দীন সূয়তী : লাআলীল মাসনূ আ : ১৬৮-১৭০ পৃ., আব্দুল হাই লাক্ষনৌভী : আসারুল মারফূ আ: ১৮২ পৃ., নাসিরুদ্দীন আলবানী : সিল..দ্বঈফাহ : ১/১০২ পৃ. হাদিস : ৭৩)


বাতিলপন্থীদের একটি ধোঁকাঃ বাতিলপন্থীদের দাবি হল ইমাম সাখাভী (রহ) হযরত আবু বকর (রা) এর বর্ণিত হাদিসটি সংকলন করে বলেন, لا يصح ‘হাদিসটি সহিহ নয়।’ 
🔺(ইমাম সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা : ১/৩৮৪ : হাদিস : ১০২১)

সমস্ত মুহাদ্দিসগণ একমত যে হাদিসটি ‘সহিহ নয়’ শব্দ দ্বারা হাদিসটি ‘হাসান’ বুঝায়। আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহ) বলেন-

وَقَالَ ابْنُ الْهَمَّامِ: وَقَوْلُ مَنْ يَقُولُ فِي حَدِيثٍ أَنَّهُ لَمْ يَصِحَّ إِنْ سَلِمَ لَمْ يُقْدَحْ ; لِأَنَّ الْحُجَّةَ لَا تَتَوَقَّفُ عَلَى الصِّحَّةِ، بَلِ الْحَسَنُ كَافٍ،– فصل الثانى من باب: ما يجوز من العمل فى الصلاة.

-‘‘ইমাম কামালুদ্দীন মুহাম্মদ বিন হুমাম (রহ) বলেন : কোন হাদিস সম্পর্কে কোন মুহাদ্দিস যদি বলেন যে এ হাদিসটি সহিহ (বিশুদ্ধ) নয়, তাদের কথা সত্য বলে মান্য করা হলেও কোন অসুবিধা নেই, যেহেতু (শরীয়তের) দলীল বা প্রমাণ হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য শুধু (হাদিস) সহিহ বা বিশুদ্ধ হওয়া নির্ভরশীল নয়। সনদ বা সূত্রের দিক দিয়ে ‘হাসান’ হলেও (হাদিসটি শরীয়তের দলীল হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য) যথেষ্ট।’’ 
🔺(আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : মিরকাত : ৩/৭৭পৃ, হাদিস : ১০৮, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)

আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (রহ) তার কিতাবে লিখেন-

وَقَول أَحْمد إِنَّه حَدِيث لَا يَصح أَي لذاته فَلَا يَنْفِي كَونه حسنا لغيره وَالْحسن لغيره يحْتَج بِهِ كَمَا بَين فِي علم الحَدِيث -  (الصواعق المحرقة على أهل الرفض والضلال والزندقة: خاتمة الفصل الاول من الباب: الحادى عشر:২২৮)

-‘‘ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (রহ) বলেন, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ)‘র একটি হাদিস প্রসঙ্গে বক্তব্য হাদিসটি  لا يصحবিশুদ্ধ নয় এর অর্থ হবে সহিহ লিজাতিহী তথা জাতি বা প্রকৃত অর্থে সহিহ নয় উক্ত হাদিসটি (সনদের দিক দিয়ে) হাসান লিজাতিহী বা অন্য সনদে হাসান লিগায়রিহী (জাতিগত সহিহ না হওয়া; সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সহিহ’র কারণে নিজে সহিহ হওয়া।) হওয়াকে মানা (নিষেধ) করে না। আর হাসান লিগায়রিহীও (শরিয়তের) প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। যা ইলমে হাদিস তথা হাদিসশাস্ত্র হতে জানা যায়।’’ 
🔺(ইবনে হাজার মক্কী : আস-সাওয়ায়েকুল মুহরিকা, ২য় খন্ড, পৃ-৫৩৬, মুয়াস্সাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবানন)




আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহ) তাঁর গ্রন্থে ইমাম সাখাভী (رحمة الله)‘র রায় পেশ করে সমাধানের কথা বলেন যে-

قُلْتُ وَإِذَا ثَبَتَ رَفْعُهُ عَلَى الصَّدِّيقِ فَيَكْفِي الْعَمَلُ بِهِ لِقَوْلِهِ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسِنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِين من بعدى-

-‘‘আমার কথা হলো হাদিসটির সনদ যেহেতু হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) পর্যন্ত প্রসারিত (মারফূ হিসেবে প্রমাণিত), সেহেতু আমলের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। কেননা হুযুর (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, 
🔺(  ক. ইমাম আবু দাউদ : আস্-সুনান : হাদিস : ৪৬০৭, হযরত উমর (رضي الله عنه) এর সূত্রে, তিরমিযী : আস্-সুনান : হাদিস : ২৬৭৬, ইবনে মাজাহ : আস্-সুনান : হাদিস : ৪২, ইমাম ইবনুল বার্ : জামিউল বায়ান ওয়াল ইলমে বি ফাদ্বলিহী : ২/৯০ পৃ. ইমাম আহমদ : আল মুসনাদ : ৪/১২৭ পৃষ্ঠা হযরত ইরবায বিন সারিয়া (رضي الله عنه) এর সূত্রে)

তোমরা আমার পর আমার সুন্নাত ও আমার খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আকড়ে ধরো।’’
🔺(মোল্লা আলী ক্বারী : মওদ্বুআতুল কাবীর : ৩১৬ : হাদিস : ৪৫৩, মোল্লা আলী ক্বারী : আসারুল মারফ‘ূআ : ২১০ : হাদিস : ৮২৯, আযলূনী : কাশফুল খাফা : ২/২৭০ : হাদিস : ২২৯৬)


ফকিহগণের দৃষ্টিতে  এই হাদিসের ব্যাপারে আমল

বিশ্ব বিখ্যাত ফকিহ ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (رحمة الله) তাঁর ফতোয়ার কিতাব ফতোয়ায়ে শামীতে باب الاذان লিখেন- 

يُسْتَحَبُّ أَنْ يُقَالَ عِنْدَ سَمَاعِ الْأُولَى مِنْ الشَّهَادَةِ: صَلَّى اللَّهُ عَلَيْك يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَعِنْدَ الثَّانِيَةِ مِنْهَا: قَرَّتْ عَيْنِي بِك يَا رَسُولَ اللَّهِ، ثُمَّ يَقُولُ: اللَّهُمَّ مَتِّعْنِي بِالسَّمْعِ وَالْبَصَرِ بَعْدَ وَضْعِ ظُفْرَيْ الْإِبْهَامَيْنِ عَلَى الْعَيْنَيْنِ فَإِنَّهُ - عَلَيْهِ السَّلَامُ - يَكُونُ قَائِدًا لَهُ إلَى الْجَنَّةِ، كَذَا فِي كَنْزِ الْعِبَادِ. اهـ. قُهُسْتَانِيٌّ، وَنَحْوُهُ فِي الْفَتَاوَى الصُّوفِيَّةِ. وَفِي كِتَابِ الْفِرْدَوْسِ مَنْ قَبَّلَ ظُفْرَيْ إبْهَامِهِ عِنْدَ سَمَاعِ أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ فِي الْأَذَانِ أَنَا قَائِدُهُ وَمُدْخِلُهُ فِي صُفُوفِ الْجَنَّةِ وَتَمَامُهُ فِي حَوَاشِي الْبَحْرِ لِلرَّمْلِيِّ عَنْ الْمَقَاصِدِ الْحَسَنَةِ لِلسَّخَاوِيّ- 

-‘‘মুস্তাহাব হলো আযানের সময় শাহাদাত বলার মধ্যে صلى الله عليك يا رسول الله  বলা এবং দ্বিতীয় শাহাদাত বলার সময় বলবে قرة عينى بك يا رسول الله। অতঃপর নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখে চুমু খেয়ে স্বীয় চোখদ্বয়ের উপর রাখবে এবং  এই দোয়াটি اللهم متعنى بالسمع و البصر পড়বে এর ফলে হুযুর (ﷺ) তাকে নিজের পিছনে পিছনে টেনে বেহেশতে নিয়ে যাবেন। অনুরূপ কানযুল ইবাদ ও কুহস্থানী গ্রন্থে বর্ণিত আছে। ফাতাওয়ায়ে সূফিয়াও তদ্রুপ উল্লেখিত আছে। কিতাবুল ফিরদাউসে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি আযানে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ শুনে স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখ চুম্বন করে, আমি তাকে আমার পিছনে পিছনে টেনে বেহেশতে নিয়ে যাব এবং তাকে বেহেশতীদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত  করবো। এর পরিপূর্ণ আলোচনা বাহারুর রায়েক এর টীকায় ফতোয়ায়ে রমলীতে আছে।’’ 
🔺(ক. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী : ফতোয়ায়ে শামী ১/৩৯৮ পৃষ্ঠা কিতাবুল আযান অধ্যায়, মুফতী আমিমুল ইহসান মুজাদ্দেদী : কাওয়াইদুল ফিক্হ : ১/২৩৩ পৃ., আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী : তাফসীরে রুহুল বায়ান : ৭/২২৯ পৃ.)

দেওবন্দীদেরও শ্রদ্ধীয় আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষনৌভী তার ফিকহের সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ “মাজমুআয়ে ফতোয়ায়ে আব্দুল হাই”-এ লিখেন- 

اعلم أنه يستحب أن يقال عند سماع الاول من الشهادة صلى الله عليك يا رسول الله و عند سماع الثانية قرة عينى بك يا رسول الله ثم قال "اللهم متعنى بالسمع و البصر" بعد وضع ظفر اليدين على العينين فإنه صلى الله عليه و سلم يكون قائدا له الى الجنة كذا في كنز العباد-  

-‘‘জেনে রাখুন! নিশ্চয় মুস্তাহাব হলো আযানে যখন প্রথম শাহাদাত বাক্য বলবে, তখন শ্রোতারা বলবে صلى الله عليك يا رسول الله তারপর যখন দ্বিতীয় শাহাদাত বাক্য বলবে তখন শ্রোতারা বলবে যে قرة عينى بك يا رسول الله অতঃপর বলবে যে, اللهم متعنى بالسمع والبصر তারপর দুই বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখের পৃষ্ঠে চুমু দিয়ে চক্ষুদ্বয়ের উপর মুছে দেবে, যে অনুরূপ করবে নিশ্চয় রাসূল (ﷺ) তাকে বেহেশতের দিকে টেনে নিজের পিছনে নিবেন, এটা ‘কানযুল ইবাদে’ আছে। 
🔺(আব্দুল হাই লাক্ষনৌভি : মাজমূআয়ে ফতোয়ায়ে : ১/১৮৯ : কিতাবুস সালাত অধ্যায়)

হানাফী মাযহাবের অন্যতম প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম তাহতাভী (রহ) তার ফতোয়ার কিতাবে লিখেছেন-

ذكر القهستاني عن كنز العباد أنه يستحب أن يقول عند سماع الأولى من الشهادتين للنبي صلى الله عليه وسلم صلى الله عليك يا رسول الله وعند سماع الثانية قرت عيني بك يا رسول الله اللهم متعني بالسمع والبصر بعد وضع إبهامه على عينيه فإنه صلى الله عليه وسلم يكون قائدا له في الجنة-      

-‘‘ইমাম কুহিস্তানী (رحمة الله) কানযুল ইবাদ কিতাবের উদ্ধিৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন নিশ্চয় মুস্তাহাব হলো আযানে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ শুনবে তখন বলবে صلى الله عليك يا رسول الله আর যখন দ্বিতীয়বার শুনবে তখন বলবে قرة عينى بك يا رسول الله  তারপর এই দোয়া পড়বে اللهم متعنى بالسمع و البصر পড়ার পর নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখে চুমু খেয়ে চক্ষুদ্বয়ে রাখবেন। যে এরূপ করবে তাকে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের পিছনে টেনে টেনে জান্নাতে নিয়ে যাবেন।’’
🔺(ইমাম তাহতাভী : মারাকিল ফালাহ : ১/২০৬ পৃ : কিতাবুল আজান অধ্যায়, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)


আহলে হাদিসদের দৃষ্টিতে এ হাদিসের অবস্থানঃ শুধু তা-ই নয়, আহলে হাদীসের মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)-এর হাদিসটি সম্পর্কে বলেছেন- لا يصح অর্থাৎ, হাদিসটি সহিহ পর্যায়ের নয়। তাই বুঝা গেল, সহিহ নয় মানে ‘হাসান’ অর্থাৎ হাদিসটি জাল বা বানোয়াট নয় যা ইতিপূর্বে আলোকপাত করেছি।
🔺(আলবানী, সিল...দ্বঈফাহ, ১/১০২পৃ. হাদিস নং. ৭৩)



সপ্তম অধ্যায়ঃ সফরের উদ্দেশ্যে আওলিয়ায়ে কেরামের মাযার যিয়ারত প্রসঙ্গঃ

বাতিল পন্থীগণের একটি ধোঁকাঃ ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূল (ﷺ) কবর যিয়ারত নিষেধ করেছিলেন। পরে অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু যখন অনুমতি দিয়েছেন তখন তিনি কাছে দূরে খাস করেননি। যেমন হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত রাসূল (ﷺ)বলেন,

كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا، فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْآخِرَةَ،ـ 

-‘‘তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমরা কবর যিয়ারত কর। কেননা নিশ্চয় তা পরকালের কথা মনে করিয়ে দেয়।"
🔺(আবদুর রায্যাক,আল-মুসান্নাফ, ৩/৫৬৯পৃ. হাদিস : ৬৭০৮, ইমাম তিরমিযী : আস সুনান : কিতাবুজ জানাইয : ২/৩৬১.পৃ, হাদিস ১০৫৪, আবি শায়বাহ, আল-মুসান্নাফ, ৩/২৯পৃ. হাদিস : ১১৮০৪, মুসনাদে বায্যার, ১০/২৭১পৃ. হাদিস : ৪৩৭৩, সুনানে নাসাঈ, ৮/৩১০পৃ. হাদিস : ৫৬৫২, সহিহ ইবনে হিব্বান, ৩/২৬১পৃ. হাদিস : ৯৮১, তাবরানী, মু‘জামুল কাবীর, ২/১৯পৃ. হাদিস : ১১৫২, নাসাঈ, সুনানে কোবরা, ৮/৫৪০পৃ. হাদিস : ১৭৪৮৬, সবাই উপরের হযরত বুরায়দা (رضي الله عنه) এর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আবি শায়বাহ, আল-মুসান্নাফ, ১/২১২পৃ. হাদিস, হাদিস :৩১২,সুনানে ইবনে মাযাহ, ১/৫০১পৃ. হাদিস : ১৫৭১, হাকিম নিশাপুরী, আল-মুস্তাদরাক, ১/৫৩১পৃ. হাদিস : ১৩৮৭, নাসাঈ, সুনানে কোবরা, ৪/১২৯পৃ. হাদিস : ৭১৯৭,উপরের সবাই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) এর সূত্রে। আবি শায়বাহ, আল-মুসান্নাফ, ৩/২৯পৃ.হাদিস :১১৮০৬, মুসনাদে আহমাদ, ২/৩৯৭পৃ. হাদিস : ১২৩৬, উপরের সবাই হযরত আলী (رضي الله عنه) এর সূত্রে। তাবরানী, মু‘জামুল কাবীর, ২/৯৪পৃ. হাদিসঃ ১৪১৯, হযরত ছাওবান (رضي الله عنه) এর সূত্রে। হাকিম নিশাপুরী, আল-মুস্তাদরাক, ১/৫৩২পৃ. হাদিসঃ ১৩৯৩, ও ১/৫৩২পৃ. হাদিসঃ ১৩৯৪, হযরত আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه) এর সূত্রে, ইমাম মুসলিম : কিতাবুজ জানাইয : হাদিসঃ ১০৬)

 বর্তমানে এক শ্রেণীর নামধারী মুসলিম রয়েছেন যারা নিন্মের এ হাদিস দ্বারা সফরের উদ্দেশ্যে আওলিয়াদের মাযার যিয়ারতকে হারাম বলে থাকেন। হাদিসটি হল-

وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " لَا تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلَّا إِلَى ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ: مَسْجِدِ الْحَرَامِ وَالْمَسْجِدِ الْأَقْصَى وَمَسْجِدِي هَذَا

-‘‘তিন মসজিদ ছাড়া অন্য কোন (মসজিদের) দিকে সফর করবে না। এ তিন মসজিদগুলো হলো বায়তুল্লাহ, বায়তুল মুকাদ্দিস ও আমার এ মসজিদ।’’(বুখারী, মুসলিম) 
তারা বুঝাতে চান এ হাদিস থেকে বোঝা যায় এ তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন দিকে সফর করা জায়েয নেই এবং কবর যিয়ারতের সফর এ তিনটির বাইরে বিধায় নাজায়েয। অথচ এ হাদিসের ভাবার্থ হচ্ছে এ তিন মসজিদে নামাযের ছওয়াব বেশী পাওয়া যায়। যেমন মসজিদ বায়তুল্লাহ এক নেকীর ছওয়াব অন্যান্য জায়গায় এক লাখের সমান (বুখারী) এবং বায়তুল মুকাদ্দাস ও মাদীনা পাকের মসজিদে এক নেকীর ছওয়াব পঞ্চাশ হাজারের সমান। (ইবনে মাযাহ) সুতরাং এসব মসজিদসমূহে এ নিয়তে দূর থেকে সফর করে আসা কল্যাণকর ও জায়েয। কিন্তু অন্য কোন মসজিদের দিকে একই নিয়তে সফর করা অনর্থক ও নাজায়েয। নাউযুবিল্লাহ! 

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! কবর যিয়ারত মানুষ কোনো খারাপ উদ্দেশ্য করে না। ইমাম সান‘আনী (رحمة الله) বলেন-

وَمَقْصُودُ زِيَارَةِ الْقُبُورِ الدُّعَاءُ لَهُمْ وَالْإِحْسَانُ إلَيْهِمْ وَتَذَكُّرُ الْآخِرَةِ وَالزُّهْدُ فِي الدُّنْيَا

-‘‘কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্য হলো মৃতদের জন্য দু‘আ করা, তাদের সাথে সদাচরণ করা, পরকালের কথা স্মরণ করা ও দুনিয়ার প্রতি অনীহাবোধ জাগ্রত করা।’’ 
🔺(সানআনী, সবলুস সালাম,  ১/৫০৯পৃ.)

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) মিশ্কাত শরীফের অপর ব্যাখ্যা গ্রন্থ মিরকাতে এ হাদিস প্রসঙ্গে লিখেন-

وَفِي شَرْحِ مُسْلِمٍ لِلنَّوَوِيِّ قَالَ أَبُو مُحَمَّدٍ: يَحْرُمُ شَدُّ الرَّحْلِ إِلَى غَيْرِ الثَّلَاثَةِ وَهُوَ غَلَطٌ، وَفِي الْإِحْيَاءِ: ذَهَبَ بَعْضُ الْعُلَمَاءِ إِلَى الِاسْتِدْلَالِ بِهِ عَلَى الْمَنْعِ مِنَ الرِّحْلَةِ لِزِيَارَةِ الْمَشَاهِدِ وَقُبُورِ الْعُلَمَاءِ وَالصَّالِحِينَ، وَمَا تَبَيَّنَ فِي أَنَّ الْأَمْرَ كَذَلِكَ، بَلِ الزِّيَارَةُ مَأْمُورٌ بِهَا لِخَبَرِ: ( كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ أَلَا فَزُورُوهَا ) . وَالْحَدِيثُ إِنَّمَا وَرَدَ نَهْيًا عَنِ الشَّدِّ لِغَيْرِ الثَّلَاثَةِ مِنَ الْمَسَاجِدِ لِتَمَاثُلِهَا، بَلْ لَا بَلَدَ إِلَّا وَفِيهَا مَسْجِدٌ، فَلَا مَعْنَى لِلرِّحْلَةِ إِلَى مَسْجِدٍ آخَرَ، وَأَمَّا الْمَشَاهِدُ فَلَا تُسَاوِي بَلْ بَرَكَةُ زِيَارَتِهَا عَلَى قَدْرِ دَرَجَاتِهِمْ عِنْدَ اللَّهِ، ثُمَّ لَيْتَ شِعْرِي هَلْ يَمْنَعُ هَذَا الْقَائِلُ مِنْ شَدِّ الرَّحْلِ لِقُبُورِ الْأَنْبِيَاءِ كَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَيَحْيَى، وَالْمَنْعُ مِنْ ذَلِكَ فِي غَايَةِ الْإِحَالَةِ، وَإِذَا جُوِّزَ ذَلِكَ لِقُبُورِ الْأَنْبِيَاءِ وَالْأَوْلِيَاءُ فِي مَعْنَاهُمْ، فَلَا يَبْعُدُ أَنْ يَكُونَ ذَلِكَ مِنْ أَغْرَاضِ الرِّحْلَةِ، كَمَا أَنَّ زِيَارَةَ الْعُلَمَاءِ فِي الْحَيَاةِ

-‘‘ইমাম নববী (رحمة الله) এর শরহে মুসলিমে বর্ণিত আছে-ইমাম আবু মুহাম্মদ (رحمة الله) বলেছেন যে, ওই তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য দিকে সফর করা হারাম। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। ইমাম গাযযালীর ‘ইহ্ইয়াউল উলুমুদ্দীন’ কিতাবে উল্লেখিত আছে “কতেক আলিম বরকতময় স্থানসমূহ ও উলামায়ে কিরামের মাযারে যিয়ারত উপলক্ষে সফর করাকে নিষেধ বলে। কিন্তু আমি যা বিশ্লেষণ করে পেয়েছি, তা এরকম নয় বরং কবর যিয়ারতের নির্দেশ আছে যেমন হাদীসে আছে أَلَا فَزُورُوهَا  (এখন থেকে যিয়ারত কর) ঐ তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের দিকে সফর করার থেকে নিষেধ এজন্য করা হয়েছে যে বাকী সব মসজিদ ফযীলতের দিক দিয়ে একই বরাবর। কিন্তু বরকতময় স্থানসমূহ একই বরাবর নয় বরং মর্তবা অনুযায়ী ওগুলোর বরকত ভিন্ন ভিন্ন। এসব নিষেধকারীরা কি নবীদের মাযার, যেমন হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) হযরত মুসা (عليه السلام) হযরত ইয়াহিয়া (عليه السلام) প্রমুখের মাযার যিয়ারত করা থেকে নিষেধ করতে পারবে কি? নিশ্চয়ই না, কারণ এটা অসম্ভব। আর আল্লাহর ওলীগণের বেলায়ও একই হুকুম প্রযোজ্য। সুতরাং বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে যদি ওনাদের সেখানে সফর করে যাওয়া হয়, যেমনি উলামায়ে কিরামের জীবদ্দশায় তঁাদের কাছে যাওয়া যায়, কি অসুবিধে আছে?।’’
🔺(মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ২/৫৮৯পৃ. হাদিস নং.৬৯৩)

ফাত্ওয়ায়ে শামী প্রথম খন্ডে ‘যিয়ারতে কুবুর’ শীর্ষক আলোচনায় উল্লিখিত আছে-

وَهَلْ تُنْدَبُ الرِّحْلَةُ لَهَا كَمَا اُعْتِيدَ مِنْ الرِّحْلَةِ إلَى زِيَارَةِ خَلِيلِ الرَّحْمَنِ وَأَهْلِهِ وَأَوْلَادِهِ، وَزِيَارَةِ السَّيِّدِ الْبَدَوِيِّ وَغَيْرِهِ مِنْ الْأَكَابِرِ الْكِرَامِ؟ لَمْ أَرَ مَنْ صَرَّحَ بِهِ مِنْ أَئِمَّتِنَا، وَمَنَعَ مِنْهُ بَعْضُ أَئِمَّةِ الشَّافِعِيَّةِ إلَّا لِزِيَارَتِهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - قِيَاسًا عَلَى مَنْعِ الرِّحْلَةِ لِغَيْرِ الْمَسَاجِدِ الثَّلَاثَةِ. وَرَدَّهُ الْغَزَالِيُّ بِوُضُوحِ الْفَرْقِ،

-‘‘কবর যিয়ারত উপলক্ষে সফর করা মুস্তাহাব। যেমন আজকাল হযরত খলিলুর রহমান (رحمة الله) ও হযরত ছৈয়দ বদ্দবী (رحمة الله) এর মাযার যিয়ারতের জন্য সফর করা হয়। আমি এ ক্ষেত্রে আমাদের ইমামদের কারো ব্যাখ্যা দেখিনি। তবে শাফেঈ মাযহাবের কয়েকজন আলিম তিন মসজিদ ব্যতীত ভিন্ন সফর নিষেধ এ হাদীসের উপর অনুমান করে নিষেধ বলেছেন। কিন্তু ইমাম গাযযালী (رحمة الله) এ নিষেধাজ্ঞাকে খন্ডন করেছেন এবং পার্থক্যটা বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন।’’
🔺(ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ২/২৪২পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)


ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (رحمة الله) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় আরও বলেছেন-

وَأَمَّا الْأَوْلِيَاءُ فَإِنَّهُمْ مُتَفَاوِتُونَ فِي الْقُرْبِ مِنْ اللَّهِ - تَعَالَى، وَنَفْعُ الزَّائِرِينَ بِحَسَبِ مَعَارِفِهِمْ وَأَسْرَارِهِمْ.

-‘‘কিন্তু আল্লাহর ওলীগণ আল্লাহর নৈকট্য লাভে ও যিয়ারককারীদের ফায়দা পেীঁছানোর বেলায় নিজেদের প্রসিদ্ধ ও আধ্যাত্নিক শক্তি অনুসারে ভিন্নতর।’’
🔺(ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ২/২৪২পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)

 ইমাম ইবনে কুদামা (رحمة الله) বলেছেন- وَالصَّحِيحُ إبَاحَتُهُ، -‘‘বিশুদ্ধ হল তিন মসজিদ ছাড়াও অন্য কোন স্থানের উদ্দেশ্যে সফর করা বৈধ।’’  
🔺(ইবনে কুদামা, আল-মুগনী, ২/১৯৫পৃ. মাকতুবাতুল কাহেরা, মিশর, প্রকাশ)


কোরআনের আলোকে যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর

হযরত মুসা (আ:) কে নির্দেশ দেয়া হলোঃ

اذْهَبْ إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى

-‘‘ফিরাউনের কাছে যাও, কারণ সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে।’’(সুরা নাযিআহ, আয়াত নং.১৭) তাবলীগের জন্য সফর প্রমাণিত হলো। মহান রব অন্যত্র বলেন-

قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ ثُمَّ انْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ

-‘‘তাদেরকে বলুন, পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং কাফিরদের কি পরিণাম হয়েছে, তা দেখ।’’(সুরা আন‘আম, আয়াত, নং.১১) যেসব দেশে খোদায়ী গজব নাযিল হয়েছে, ওগুলো দেখে সতর্ক হওয়ার জন্য সফর প্রমাণিত হলো। কুরআন করীমে রয়েছে-

وَمَنْ يَخْرُجْ مِنْ بَيْتِهِ مُهَاجِرًا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ

-‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্য নিজ গৃহ থেকে মুহাজির হয়ে বের হলো এবং (পথে) তার মৃত্যু ঘটলো, তার পুরষ্কার আল্লাহর কাছে অবধারিত হয়ে গেল। (সুরা নিসা, আয়াত নং.১০০) হিজরত উপলক্ষে সফর প্রমাণিত হলো। এ রকম কুরআনুল কারীমে আরও বিভিন্ন নির্দেশনা রয়েছে সফরের জন্য।


হাদিসের আলোকে যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর এর প্রমাণঃ

ক. আল্লামা তাবারী (رحمة الله) একটি হাদিসে পাক সনদসহ বর্ণনা করেন হযরত মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহিম (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন-

أَنَّ النَّبِيَّ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - كَانَ يَأْتِي قُبُورَ الشُّهَدَاءِ بِأُحُدٍ عَلَى رَأْسِ كُلِّ حَوْلٍ فَيَقُولُ: السَّلَامُ عَلَيْكُمْ بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ

-‘‘হুযুর আলাইহিস সালাম প্রতি বছর উহুদ যুদ্ধের শহীদদের কবরে তাশরীফ নিয়ে যেতেন অতঃপর বলতেন....।’’  
🔺(ইবনে কাসির, তাফসীরে ইবনে কাসির, ৪/৩৮৯পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন (মতনটি এ কিতাবের), আব্দুর রায্যাক, মুসান্নাফ, ৩/৫৭৩পৃ. আইনী, উমদাতুল ক্বারী, ৮/৭০পৃ., ইমাম তবারী, জামিউল বয়ান ফি তাফসিরীল কোরআন, ১৬/৪২৬পৃ. হাদিস নং. ২০৩৪৫, ইবনে আবিদীন শামী, ফাতোয়ায়ে শামী, ২/২৪২পৃ.)


খ. ইমাম ইবনে কুদামা (رحمة الله) 🔺(ওফাত. ৬২০ হি.) বর্ণনা করেন-

لَانَ النَّبِيَّ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - كَانَ يَأْتِي قُبَاءَ رَاكِبًا وَمَاشِيًا، وَكَانَ يَزُورُ الْقُبُورَ،

-‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো পায়ে হাঁটে, আবার কখনো উটে চড়ে কুবা‘য় আসতেন এবং বিভিন্ন কবর যিয়ারত করতেন।’’  
🔺(ইবনে কুদামা, আল-মুগনী, ২/১৯৫পৃ. মাকতুবাতুল কাহেরা, মিশর, প্রকাশ)

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে আবিদীন শামী (رحمة الله) বলেছেন-

اُسْتُفِيدَ مِنْهُ نَدْبُ الزِّيَارَةِ وَإِنْ بَعُدَ مَحَلُّهَا.

-‘‘ এ হাদিস থেকে কবর দূরে অবস্থিত হলেও যিয়ারত করা যে মুস্তাহাব তা বোঝা যায়।’’ 
🔺(ইবনে আবিদীন শামী, ফাতোয়ায়ে শামী, ২/২৪২পৃ.)

গ. ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله)-এর তাফসিরে দুররুল মানসূরে উল্লেখিত আছে

رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَأْتِي قُبُور الشُّهَدَاء على رَأس كل حول فَيَقُول 🔺(سَلام عَلَيْكُم بِمَا صَبَرْتُمْ فَنعم عُقبى الدَّار) وَأَبُو بكر وَعمر وَعُثْمَان

-‘‘হুযুর আলাইহিস সালাম থেকে প্রমাণিত আছে যে তিনি প্রতি বছর শহীদদের কবরে তশরীফ নিয়ে যেতেন এবং ওদেরকে সালাম দিতেন। হযরত আবু বকর, উমর, উসমান (رضي الله عنه)ও অনুরূপ করতেন।’’ 
🔺(ইমাম সুয়ূতি, তাফসীরে দুরুরুল মানসূর, ৪/৬৪১পৃ.)

এ হাদিসে মাজার বা কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত প্রমাণিত হল। তাই ইমাম ইবনে আবিদীন শামী (رحمة الله) বলেছেন-

وَفِيهِ يُسْتَحَبُّ أَنْ يَزُورَ شُهَدَاءَ جَبَلِ أُحُدٍ

-‘‘শুহাদায়ে জাবালের যিয়ারত করা মুস্তাহাব।’’
🔺(ইবনে আবিদীন শামী, ফাতোয়ায়ে শামী, ২/২৪২পৃ.)

ঘ. হযরত মা ফাতেমা (رضي الله عنه) প্রতি জুমা‘বার তাঁর চাচা হযরত আমির হামযা (رضي الله عنه)-এর মাযার যিয়ারত করতে যেতেন।
🔺(হাকিম নিশাপুরী, আল-মুস্তাদরাক, হাদিস : ১৩৪৫, বায়হাকি,আস্-সুনানিল কোবরা, ৪/৭৮পৃ.)

ঙ. ইমাম ইবনে আসাকির (رحمة الله) বিশুদ্ধ ‘হাসান’ সনদে হযরত আবু দারদা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত বেলাল (رضي الله عنه) শামে অবস্থান কালে এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন যে, রাসুল (ﷺ) তার উদ্দেশ্যে বলেন-

ما هذه الجفوة يا بلال أما ان لك أن تزورني يا بلال

বেলাল! তোমার এ নির্দয় আচরনের কারণ কী! আজও কী আমার জিয়ারতের সময় হয়নি? এরপর তিনি বিষন্ন মনে ও ভিতসন্ত্রস্ত্র অবস্থায় জেগে উঠলেন। তারপর তিনি বাহনে চড়ে মদিনার উদ্দেশ্যে সফরে রওয়ানা হলেন। রওযা শরীফে পৌঁছে তিনি রওযার পাশে কাঁদতে লাগলেন এবং তাঁর চেহাড়া রওযা শরীফের সাথে মললেন।’ 
🔺(আল্লামা ইবনে আসাকীর : তারীখে দামেস্ক : ৭/১৩৭পৃ., যাহাবী, তারীখুল ইসলাম : ৪/২৭৩পৃ, ইবনে হাজার আসকালানী : লিসানূল মিযান : ১/৪৫পৃ, ইমাম যাহাবী : সিয়ারু আ‘লামিন আন্-নুবালা : ৩/২১৮পৃ, দারুল হাদিস, কাহেরা, মিশর, মুফতি আমিমুল ইহসান : ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার : ১/৪১৪পৃ. হাদিস : ১১৭১, ইমাম তকি উদ্দিন সুবকী, শিফাউস সিকাম : ৩৯পৃ. ইবনে হাজর মক্কী, যাওয়াহিরুল মুনাজ্জাম : পৃ-২৭, শাওকানী, নায়লুল আওতার : ৫/১৮০পৃ. ইমাম জাযরী আশ্-শায়বানী: সাদ্দাল গাবাত ফি মা‘রিফাতুল সাহাবা : ১/৪১৫পৃ. দারূল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, ইমাম ইফরিকী, মুখতাসিরে তারিখে দামেস্ক : ৪/১১৮পৃ.)

উক্ত হাদিস সম্পর্কে মুফতি আমিমুল ইহসান (رحمة الله) বলেন,‘‘ইবনে আসাকির গ্রহণযোগ্য সনদে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন’’। 
🔺(মুফতি আমিমুল ইহসান : ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার : ১/৪১৪পৃ. হাদিস : ১১৭১, যা বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন হতে প্রকাশিত)

ইমাম সুবকী (رحمة الله) এবং ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) তাদের গ্রন্থে হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।

চ. আরেকটি হাদিসে পাক দেখুন-

عَنْ نَافِعٍ , عَنِ ابْنِ عُمَرَ , قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:  مَنْ زَارَ قَبْرِي وَجَبَتْ لَهُ شَفَاعَتِي- 

-“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, যে আমার রওযা মোবারক যিয়ারত করবে তার জন্য আমার শাফায়াত অনিবার্য।”
🔺(ক. ইমাম বায়হাকী : শুয়াবুল ঈমান : ৬/৫১.পৃষ্ঠা, হাদিস,৩৮৬২, কাজী আয়াজ আল-মালেকী, আশ্-শিফা শরীফ : ২/৮৩ পৃষ্ঠা, দারেকুতনী, আস-সুনান, ৩/৩৩৪পৃ., হাদিস,২৬৬৫, মুয়াস্সাতুল রিসালা, বয়রুত, লেবানন, বায্যার, আল মুসনাদ, ২/২৪৮ পৃষ্ঠা, হাকিম তিরমিযী, নাওয়ারিদুল উসূল ফি আহাদিসুর রুসুল,২/৬৭পৃষ্ঠা, ইস্পাহানী, তারগীব ওয়াত তারহীব, ২/২৭পৃ. হাদিস,১০৮১,আদি, আল-কামিল, ৮/২৬৯ পৃষ্ঠা, ক্রমিক নং.১৮৩৪, ও ৪/১৯০-১৯১পৃষ্ঠা, সুয়ূতি, জামিউল আহাদিস, ২০/৩৪৮পৃষ্ঠা, হাদিস,২২৩০৪, সুয়ূতি, জামিউস-সগীর : ২/৬০৫ পৃষ্ঠা, হাদিস : ৮৭১৫, ইমাম হায়সামী : মাযমাউদ যাওয়াইদ : ৪/২ পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৫৮৪১, ও কাশফুল আশতার,২/৫৭পৃ.হাদিস :১১৯৮, কুস্তালানী, মাওয়াহেব লাদুন্নীয়া : ২/৫৭১.পৃষ্ঠা, ইমাম তকি উদ্দিন সুবকী : শিফাউস সিকাম ফি যিয়ারাতিল খায়রি আনাম : ১৫ পৃষ্ঠা, মুফতী আমিমুল ইহসান : ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার : ১/৪১৩ পৃ: হাদিস : ১১৭৯, ই.ফা.বা, হতে প্রকাশিত, মুত্তাকী হিন্দী : কানযুল উম্মাল : ১৫/৬৫১ পৃ. হাদিস : ৪২৫৮৩)

 এ হাদিসে নবীজি তাঁর রওযা যিয়ারতের জন্য সফর করার উৎসাহ দিয়েছেন। আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহ) আরো বলেন,

رواه الدارقطني وغيره وصححه جماعة من ائمة الحديث

-‘ইমাম দারেকুতনীসহ অন্যান্য ইমামগণ উক্ত রেওয়ায়েতকে বর্ণনা করেছেন এবং এক জামাত ইমামগণ উক্ত হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।’’ 
🔺(আল্লা মোল্লা আলী ক্বারী : শরহে শিফা : ২/১৫০ পৃ.)

অন্য হাদিসে দেখুন নবীজি (ﷺ) ইলমের জন্য সফর করতে বলেছেন-

عَنْ سَخْبَرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ كَانَ كَفَّارَةً لِمَا مَضَى

-‘‘হযরত সাখবারাহ (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন : যদি কোনো ব্যক্তি ইলম শিক্ষা করে, তবে তা তার পূর্ববর্তী পাপের জন্য ক্ষতিপূরণ (পাপ মোচনকারী) হবে।’’
🔺(ক. ইমাম তিরমিযী : আস-সুনান : কিতাবুল ইলম : ৪/২৯ পৃ. হাদিস : ২৬৪৮, ইমাম দারেমী : আস সুনান : ১/১৪৯ পৃ. হাদিস : ৫৬১, মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ১০/১৩৯পৃ. হাদিস,২৮৬৯৯, ইমাম সূয়তী : জামেউস সগীর : ২/৬২১ হাদিস : ২০৮৭১, ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী : জামিউল আহাদিস : ৭/৬১ পৃ. হাদিস : ২০৮৭১, খতিব তিবরিজী : মিশকাত : কিতাবুল ইলম : ১/ হাদিস : ২২১)


ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) যিয়ারতের উদ্দেশ্যে ইমাম আযম (رحمة الله)‘র মাজার সফরঃ

ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (رحمة الله) লিখেন-

إنِّي لَأَتَبَرَّكُ بِأَبِي حَنِيفَةَ وَأَجِيءُ إلَى قَبْرِهِ، فَإِذَا عَرَضَتْ لِي حَاجَةٌ صَلَّيْت رَكْعَتَيْنِ وَسَأَلْت اللَّهَ تَعَالَى عِنْدَ قَبْرِهِ فَتُقْضَى سَرِيعًا.

-‘‘আমি ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) থেকে বরকত হাসিল করি এবং তার মাজারে আসি। আমার কোন সমস্যা দেখা দিলে, প্রথমে দু’রাকাত নামায পড়ি। অতঃপর তাঁর মাজারে গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তখন সহসা আমার সমাধান হয়ে যায়।’’
🔺(ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ১/৫৫পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)

উপরোক্ত বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় জানা গেল ইমাম শাফেঈ (রহ) নিজের জন্ম ভূমি ফিলিস্তিন থেকে ইমাম আবু হানিফা (রহ) এর মাযার যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে সূদুর বাগদাদ শরীফ আসতেন। তাহলে এ বিজ্ঞ মুজতাহিদ ইমাম শাফেয়ী (রহ) কী হারাম, শিরক কাজ করলেন? অনেকে দাবি করতে পারেন এ হাদিসটির তো ইমাম ইবনে আবিদীন (রহ) কোন সনদ উল্লেখ করেননি। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম খতিবে বাগদাদী (রহ) এ ঘটনাটির সনদসহ উল্লেখ করেন এভাবে-

أَخْبَرَنَا الْقَاضِي أَبُو عَبْد اللَّهِ الْحُسَيْنُ بْن عَلِيّ بْن مُحَمَّد الصيمري قال أنبأنا عمر بن إبراهيم قال نبأنا عَلِيّ بْن ميمون قَالَ: سمعت الشافعي يقول: إني لأتبرك بأبي حنيفة وأجيء إِلَى قبره في كل يوم- يَعْنِي زائرا- فإذا عرضت لي حاجة صليت ركعتين وجئت إِلَى قبره وسألت الله تعالى الحاجة عنده، فما تبعد عني حتى تقضى.

-‘‘ইমাম খতিবে বাগদাদী (রহ) বলেন আমাকে.......তাকে আলী ইবনে মায়মুন (রা) বলেন আমি ইমাম শাফেয়ী (রহ) কে বলতে শুনেছি......।’
🔺(খতিবে বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ, ১/১৩৫পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)


অষ্টম অধ্যায়

★গেয়ারভী শরীফের ইতিহাস★

ইসলামী শরীয়তে সকল কিছুই প্রথমত বৈধ, যে পর্যন্ত তা কোন সুস্পষ্ট দলীল দ্বারা নিষেধ প্রমাণিত না হয়। বৈধ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। এজন্যই ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) ও ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) উভয়ই বলেন-

الْمُخْتَارَ أَنَّ الْأَصْلَ الْإِبَاحَةُ عِنْدَ الْجُمْهُورِ مِنْ الْحَنَفِيَّةِ وَالشَّافِعِيَّةِ

ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আবু হানিফা এবং জমহুর ইমামদের পছন্দনীয় মতামত হল প্রত্যেক কিছুই বৈধ (যে পর্যন্ত না কোন দলীল দ্বারা নিষেধ করা হয়)। 
🔺(ইমাম ইবনে আবেদীন শামী : রদ্দুল মুখতার আলা দুররুল মুখতার: ১/৭৮পৃ কিতাবুত তাহারাত)

তাই বৈধ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। আমাদের সমাজের এক শ্রেণীর কাঠ মোল্লাগণ মাহফিলে এই গেয়ারভী শরীফকে হারাম পর্যন্ত ফাতওয়া দিয়ে বেড়ান। অথচ হযরত সালমান ফারসী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে বলেন-

الْحَلَالُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ فِي كِتَابِهِ وَالْحَرَامُ مَا حَرَّمَ اللَّهُ فِي كِتَابِهِ وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ مِمَّا عَفَا عَنْهُ

-‘‘হালাল হচ্ছে যা আল্লাহ তা‘য়ালা স্বীয় কিতাবে (কুরআনে) হালাল করেছেন; আর হারাম হচ্ছে, স্বীয় কিতাবে (কুরআনে) যা হারাম করেছেন এবং যেটা সম্পর্কে নিরব রয়েছেন সেটা মাফ।’’ 
🔺(খতীব তিবরিযী : মিশকাত : কিতাবুত : কিতাবুদ-ত্বআম: ৩/৯৮পৃ., ইমাম তিরমিযী : আস সুনান: ৪/১৯২পৃ : হাদিস : ১৭২৬, ইমাম ইবনে মাজাহ : আস-সুনান: ২/১১১পৃ হাদিস : ৩৩৯৭)

তাহলে সেই কাঠ মোল্লাদের কাছে জানতে চাওয়া কোরআন, অথবা হাদিসের কোন কিতাবে গিয়ারভী শরীফ পালন নিষিদ্ধ বলা হয়েছে ? কিয়ামত পর্যন্ত তাদের মুখ থেকে কোন জবাব পাওয়া যাবে না। আমরা এটিকে নফল বা মুস্তাহাব হিসেবেই জানি। মুস্তাহাব হওয়ার জন্য শরিয়তে কোন নিষেধ না থাকলে এবং বুযুর্গদের ভাল ধারণাই যথেষ্ট। ইমাম আলাউদ্দিন হাসকাফী (رحمة الله) তাঁর লিখিত বিখ্যাত হানাফী ফিকহের গ্রন্থ ‘‘দুররুল মুখতারের ওজুর মুস্তাহাব অধ্যায়ে লিখেন-

وَمُسْتَحَبُّهُ وَهُوَ مَا فَعَلَهُ النَّبِيُّ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - مَرَّةً وَتَرَكَهُ أُخْرَى، وَمَا أَحَبَّهُ السَّلَفُ

-‘‘মুস্তাহাব ঐ কাজটাকে বলা হয়, যেটা হুযুর(ﷺ ) কোন সময় করেছেন আবার কোন সময় করেননি এবং ঐ কাজটাকেও বলে, যেটা বিগত মুসলমানগণ ভাল মনে করেছেন।’’ 
🔺(ইবনে আবেদীন শামী, ফাতোয়ায়ে শামী, ১/১২৩পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)

গেয়ারভী শরীফে যে সমস্ত আমল ওজীফা রয়েছে সেগুলো বড় পীর গাউসুল আযম আব্দুল কাদের জিলানী (رحمة الله) কুরানের আয়াত এবং বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত হাদিস থেকে একসাথে করেছেন। তাতে ইসলামী শরীয়তে অসুবিধার কিছু নেই। তেমনিভাবে বিরোদ্ধবাদীদেও পীর বুযুর্গরাও বিভিন্ন দোয়া ওজিফা বর্তমানে দিচ্ছেন এবং দিয়ে গেছেন তাহলে সেটা বিদ‘আত, নাজায়েয বলেন না কেন?


★গেয়ারভী শরীফের ভিত্তি ও ইতিকথা ★

হাকীমুল উম্মত মুফতী আহ্মদ ইয়ার খান নঈমী গুজরাটী (رحمة الله) স্বীয় রচিত তাফসির- আহছানুত তাফসীর-(সংক্ষেপে তাফসীরে নঈমী) প্রথম পারা সুরা বাক্বারা ২৭ নম্বর আয়াত পৃষ্ঠা ২৯৭ তে হযরত আদম আলাইহিস সালামের তাওবা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে গেয়ারভী শরীফের ভিত্তি ও ইতিকথা লিপিবদ্ধ করেছেন। সেখানে তিনি প্রসিদ্ধ আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালামগণের গেয়ারভী শরীফ পালনের ইতিকথা বর্ণনা করেছেন। নিম্নে তা উদ্ধৃত করা হলোঃ 

১. হযরত আদম আলাইহিস সালাম কতৃক গেয়ারভী শরীফ পালনঃ 
 হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হযরত বিবি হাওয়া আলাইহিস সালাম বেহেস্ত হতে দুনিয়াতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর আল্লাহর সান্নিধ্য ও স্বর্গসুখ হতে বঞ্চিত হওয়ার কারণে এবং নিজেদেও সামান্য ভুলের অনুশোচনায় তিনশত বৎসর একাধারে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলে এবং তাওবা কারেছিলেন। তাঁদের প্রথম আমল ছিল অনুতাপ ও তাওবা। তাই আল্লাহর নিকট বান্দার তাওবা ও চোখের পানি অতি প্রিয়। তিনশত বৎসর পর আল্লাহর দয়া হলো। হযতর আদম আলাইহিস সালামের অন্তরে আল্লাহ তায়ালা কতিপয় তাওবার দোয়া গোপনে ঢেলে দিলেন। হযতর আদম আলাইহিস সালাম সে সব দোয়া করে অবশেষে আল্লাহর আরশে আল্লাহরই নামের পাশের্ব লিখা নাম “মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ” (ﷺ)- এর উছিলা ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। আল্লাহ্ এতে খুশী হয়ে হযতর আদম আলাইহিস সালাম এর তাওবা কবুল করলেন। 
🔺(এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত ‘‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন’’ ১ম খন্ডের ১০৫-১০৯ পর্যন্ত দেখুন)

ঐ দিনটি ছিল আশুরার দিন- অর্থাৎ মুহররমের ১০ তারিখ রোজ শুক্রবার। এ মহা বিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে হযরত আদম ও হযরত হাওয়া আলাইহিস সালাম ঐ রাতে অর্থাৎ ১১ই রাতে তাওবা কবুল ও বিপদ মুক্তির শুকরিয়া স্বরূপ মুযদালিফার যে বিশেষ ইবাদত করেছিলেন- তারই নাম গেয়ারভী শরীফ।

২.হযরত নূহ আলাইহিসসালাম কতৃক গেয়ারভী শরীফ পালনঃ
 হযরত নূহ্ আলাইহিস সালাম মহা প্লাবনের সময় রজব মাসের ১০ তারিখ থেকে মুহররম মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত ছয় মাস ৭২ জন সঙ্গী নিয়ে কিস্তির মধ্যে ভাসমান ছিলেন। গাছ-গাছালী, পাহাড়-পর্বত সব কিছু ছিল পানির নীচে। অতঃপর আল্লাহর রহমতে ছয়মাস পর তার নৌকা জুদী পাহাড়ের চূড়ায় এসে ঠেকলো। পানি কমে গেলে তিনি দুনিয়ায় নেমে আসেন। ঐ তারিখটিও উপলক্ষে সকলকে নিয়ে ১১ই রাত্রে শুকরিয়া স্বরূপ ইবাদত করেছিলেন। এটা ছিল নূহ নবীর আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।


৩.হযতর ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের গেয়ারভী শরীফঃ 
হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে কোন রকমেই তার ইসলাম প্রচার থেকে বিরত করতে না পেরে এবং সকল বাহাছ-বিতর্কে পরাজিত ও নাস্তনাবুদ হয়ে অবশেষে জালেম বাদশাহ নমরূদ হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করলো। চল্লিশ দিন পর্যন্ত তাকে অগ্নিকুন্ডের মধ্যে রাখা হলো। আল্লাহর অসীম রহমতের আগুনের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলো এবং অগ্নিকুন্ডে ফুল বাগিচার পরিণত হলো। চল্লিশ দিন পর যেদিন হযতর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম আগুন থেকে বের হয়ে আসলেন- সে দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তিনি এই মহামুক্তির শুকরিয়া আদায় করলেন ১১ই রাত্রে। তাই এটা ছিল হযতর ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের গেয়ারভী শরীফ।

৪.হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ 
 হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম আপন প্রিয়তম পুত্র হযতর ইউসুফ আলাইহিস সালামকে হারিয়ে চল্লিশ বৎসর একাধারে কান্নারত ছিলেন। কুরআনে বর্ণিত বহু ঘটনার পর অবশেষে তিনি হারানো পুত্রকে ফিরে পেলেন এবং তার অন্ধ চক্ষু হযতর ইউসুফের জামার বরকতে ফিরে পেলেন। এই দীর্ঘ বিপদ মুক্তির দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তিনি ঐ রাত্রে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। এটা ছিল হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।

৫.হযতর আইউব আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ 
 হযরত আইউব আলাইহিস সালাম আল্লাহর বিশেষ পরীক্ষা স্বরূপ দীর্ঘ আঠার বৎসর রোগমুক্তির দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তিনি এই রোগমুক্তি ও ঈমানী পরীক্ষা পাশের শুকরিয়া স্বরূপ ১১ই রাত্রটি ইবাদতে কাটালেন। এটা ছিল হযতর আইউব আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।

৬.হযরত মুছা আলাইহিসসালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ   
 হযরত মুছা আলাইহিস সালাম ও বণী ইসরাঈলকে মিশরের অধিপতি ফেরাউন বহু কষ্ট দিয়েছিল। নবীর সাথে তার বেয়াদবী যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং তার খোদায়ী দাবীর মেয়াদ ফুরিয়ে যায়, তখন আল্লাহর নির্দেশে হযতর মুছা আলাইহিস সালাম শিশুসহ ১২ লক্ষ বণী ইসরাঈলকে নিয়ে মিশর ত্যাগ করেন। সামনে নীল নদ। আল্লাহর নির্দেশে তার লাঠির আঘাতে নীলনদের পানি দ্বিখন্ডিত হয়ে দু’দিকে পাহাড়ের মত দেয়াল স্বরূপ দাঁড়িয়ে  যায় এবং ১২টি শুকনো রাস্তা হয়ে যায়। প্রত্যেক রাস্তা দিয়ে একলক্ষ লোক তড়িৎ গতিতে অতিক্রক করে নদীর অপর তীরে এশিয়া ভূ-খন্ডে প্রবেশ করে। ফেরাউন তাদের পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে দু’দিকের পাহাড়সম পানির আঘাতে স্বসৈন্যে ডুবে মরে। হযরত মুছা আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গীসহ ১১ই রাত্র শুকরিয়া স্বরূপ আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন থাকেন। এটা ছিল হযতর মুছা আলাইহিস সালামের গেয়ারভী শরীফ। নবী করিম (দ.) মদিনার ইহুদী জাতিকে আশুরার দিনে রোযা পালন করতে দেখেছেন। তাই উম্মতে মুহাম্মদির জন্য আশুরার রোযা রাখা নফল করে দিয়েছেন।

৭. হযতর ইউনুছ আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ 
হযতর ইউনুস আলাইহিস সালাম দীর্ঘ ৪০ দিন পর মাছের পেট থেকে মোসেলের নাইনিওয়া নামক স্তানে মুক্তি পেয়েছিলেন। সেদিনটিও ছিল আশুরার দিন। তাই তিনি ঐ রাত্রে খোদার শুক্রিয়া আদায় করেছিলেন খুব দুর্বল অবস্থায়। কাজেই এটা ছিল হযতর ইউনুছ আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।

৮.হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ 
 হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ১০০তম বৈধ বিবাহের কারণে আল্লাহর ইঙ্গিতে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে সিজদায় পড়ে তাওবা করেন। আল্লাহ তার তাওবা কবুল করে খুশি হয়ে যান। ঐ দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তাই তিনি ঐ রাত্রে শুকরিয়া আদায় করেন। এটা ছিল হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।

৯. হযরত সোলায়মান আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ 
হযতর সোলায়মান আলাইহিস সালাম একবার রাজ্য ও সিংহাসন হারা হয়েছিলেন। চল্লিশ দিন পর জ্বীন জাতি কতর্ৃক লুক্বায়িত তার হারানো আংটি ফেরত পেয়ে রাজ্য ও সিংহাসন উদ্ধার করেন এবং জ্বীন জাতিকে শাস্তি প্রদান করেন। সৌভাগ্যক্রমে ঐ রাত্রেই হারানো নেয়ামতটি ফেরত পাওয়ার শুকরিয়া আদায় করেন। এটা ছিল হযরত সোলায়মান আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।

১০.হযতর ঈসা আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ 
 হযতর ঈসা আলাইহিস সালামকে ইহুদী জাতি কখনও বরদাস্ত করতে পারেনি। ইহুদী রাজা হেরোডেটাস গুপ্তচর মারফত হযতর ইসা আলাইহিস সালামকে গ্রেফতার করার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু আল্লাহ্ পাক ঈসা আলাইহিস সালাম কে জিব্রাইলের মাধ্যমে আকাশে তুলে নেন এবং ঐ গুপ্তচরের আকৃতি পরিবর্তন করে ঈসা আলাইহিস সালামের আকৃতির অনুরূপ করে দেন। অবশেষে ঈসা আলাইহিস সালাম এর শক্রই ধৃত হয়ে শুলে বিদ্ধ হয়। হযতর ঈসা আলাইহিস সালাম এর আকাশে উত্তোলনের দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তিনি মহাবিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে ঐ রাত্রে আকাশে খোদার শুকরিয়া আদায় করেন। এটাই হযতর ঈসা আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।

১১.সাইয়িদুল মুরসালিন  হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) এর গেয়ারভী শরীফঃ 
নবী করিম রাউফুর রাহীম হযতর মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ৬ষ্ঠ হিজরীতে চৌদ্দশত সাহাবায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে ওমরাহ্ করার উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ রওয়ানা দেন। কিন্তু মক্কার অদূরে হোদায়বিয়ার পৌঁছে মক্কার কুরাইশদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। ১৯ দিন পর অবশেষে একটি চুক্তির মাধ্যমে তিনি সে বৎসর ওমরাহ্ না করেই মদিনার পথে ফিরতি যাত্রা করেন। সাহাবায়ে কেরাম এটাকে গ্লানী মনে করে মনক্ষুন্ন হলেও রাসুলে পাকের দির্দেশ নতশীরে মেনে নেন। মদিনার পথে কুরা গামীম নামক স্থানে পৌঁছে নবী করিম (ﷺ) বিশ্রামের জন্য তাবু ফেলেন। ঐখানে সুরা আল ফাতাহ্ এর প্রথম কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়। এতে মনক্ষুন্ন সাহাবায়ে কেরামকে শান্তনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবীবকে লক্ষ্য করে বলেন- “হে রাসুল! আমি আপনার কারণেই হোদায়বিয়ার সন্ধিটিকে একটি মহান বিজয় হিসাবে দান করেছি। আপনার উছিলায়ই আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের গুনাহ্ আল্লাহ্ মাফ করে দিবেন।”


যেদিন এই সুসংবাদবাহী আয়াত নাযিল হয়- সেদিনটিও ছিল মুহররম মাসের ১০ তারিখ। মহা বিজয় ও গুনাহ মাগফিরাতের সুসংবাদ শ্রবণ করে সাহাবায়ে কেরাম হোদায়বিয়ার চুক্তির প্রকৃত রহস্য বুঝতে পারেন। নবী করিম (ﷺ) এবং সাহাবায়ে কেরাম ঐ ১১ই রাত্র আল্লাহ্ তায়ালার শুক্রিয়া আদায় করে কাটিয়ে দেন। এটা ছিল হুযুর (ﷺ) এর গেয়ারভী শরীফ। এ ঘটনাগুলো বিভিন্ন তাফসীরে বিদ্যমান রয়েছে। সময় স্বল্পতার কারণে এখানেই ক্ষান্ত হলাম।
এখানে সর্বমোট ১১ জন নবীর গেয়ারভী শরীফের দলীল পেশ করা হলো। অন্যান্য নবীগণের ঘটনাবলী এবং কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনাও ১০ই মুহররম তারিখে সংঘটিত হয়েছিল। গেয়ারভী শরীফের তাৎপর্যের সাথে সঙ্গতি রেখেই মাত্র ১১টি ঘটনার উল্লেখ করা হলো।

★হযরত গাউসুল আ’যম আবদুল কাদের জিলানী (رضي الله عنه) কিভাবে নবীগণের এই গেয়ারভী শরীফ পেলেন?★

গেয়ারভী শরীফ মূলতঃ খতম ও দোয়া বিশেষ। হযতর গাউসুল আযম (رضي الله عنه) এর ইনতিকাল দিবসকে উপলক্ষ করে প্রতি চন্দ্র মাসের ১১ই তারিখে রাতে বা দিনে গাউসে পাকের পবিত্র রূহে ইছালে ছাওয়াবের উদ্দেশ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলেম উলামা ও পীর মাশায়েখগণ উক্ত গেয়ারভী শরীফ বিশেষ নিয়মে খতমের মাধ্যমে পালন করে থাকেন। হযতর গাউসুল আযম (رضي الله عنه) কিভাবে এই গেয়ারভী শরীফ পেলেন- সে সম্পর্কে “মিলাদে শায়খে বরহক” বা ফাযায়েলে গাউছিয়া” নামক কিতাবে বর্ণিত আছেঃ 

“হযতর গাউসুল আযম আবদুল কাদের জিলানী (رضي الله عنه) (৪৭১-৫৬১) নবী করিম (ﷺ) এর বেলাদত উপলক্ষে প্রতি বৎসর ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখটি নিয়মিতভাবে ও ভক্তি সহকারে পালন করতেন। এক দিন স্বপ্নের মধ্যে নবী করিম (ﷺ) গাউসে পাক্কে বললেন- “আমার ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখকে তুমি যেভাবে সম্মান প্রদর্শন করে আসছো এর বিনিময়ে আমি তোমাকে আম্বিয়ায়ে কেরামের গেয়ারভী শরীফ দান করলাম”- মীলাদে শায়খে বরহক।
হযতর গাউসুল আযমের তরিকাভূক্ত পীর মাশায়েখগণ এবং অন্যান্য তরিকার মাশায়েখগণও গাউসে পাকের অনুসরণে প্রতি চন্দ্র মাসের ১১ তারিখ রাত্রে বা দিনে বিশেষ নিয়মে এই গেয়ারভী শরীফ পালন করে থাকেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত ইহা চালু থাকবে- ইন্শাআল্লাহ।

★গেয়ারভী শরীফের ফযিলত ★ 

ফাযায়েলে গাউছিয়া বা মীলাদে শায়খে বরহক কিতাবে উল্লেখ আছে-

১. যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে প্রতি চাঁদের ১১ তারিখে গেয়ারভী শরীফ পালন করবে, সে অল্পদিনের মধ্যে ধনবান ও স্বচ্ছল হবে এবং তার দরিদ্রতা দূর হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি ইহাকে অস্বীকার করবে, সে দারিদ্রের মধ্যে থাকবে।


২. যেখানে এই গেয়ারভী শরীফ পালিত হয়, সেখানে খোদার রহমত নাযিল হয়। কেননা, হাদীস শরীফে আছে-

 تنزل الرحمة عند ذكر الصالحين

-“তানায্যালুর রাহ্মাতু ইন্দা যিকরিছ ছালেহীন” 
অর্থাৎ আউলিয়াগনের আলোচনা মজ্লিশে খোদার রহমত নাযিল হয়ে থাকে। 
🔺(ক. আল্লামা আযলূনী : কাশফুল খাফা : ২/৬৫ পৃ. হাদিস : ১৭৭০
    খ. খতিবে বাগদাদী : তারিখে বাগদাদ : ৩/২৪৯ পৃ., দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত)

হযরত মু‘য়ায ইবনে জাবাল (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ) হতে বর্ণিত-  

ذِكْرُ الأنْبِياءِ مِنَ العِبادَةِ وذِكْرُ الصَّالِحِينَ كَفَّارَةٌ وَذِكْرُ المَوْتِ صَدَقَةٌ وَذِكْرُ القَبْرِ يُقَرِّبُكُمْ مِنَ الجَنَّةِ

-‘‘রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন : নবীগণের যিকির হলো ইবাদত, সালেহীনদের (ওলীদের) যিকির হলো গুনাহের কাফ্ফারা, মওতের যিকির বা স্মরণ হলো সদকার সমতুল্য, কবরের কথা যিকির বা স্মরণ করলে তা তোমাদেরকে জান্নাতের নিকটবর্তী  করে দেবে।’’
🔺(ক. ইমাম দায়লামী : আল মুসনাদুল ফিরদাউস : ১/৮২ পৃ., ইমাম সূয়তী : জামেউস সগীর : ১/৬৬৫ হাদিস নং : ৪৩৩১, ইমাম দায়লামী “হাসান” বলেছেন,  ইমাম সূয়তী : জামিউল আহাদিস : ১৩/৪০পৃ. হাদিস : ১২৫০২, মুত্তাকী হিন্দী : কানযুল উম্মাল : ১৫/৮৬৪ পৃ. হাদিস : ৪৩৪৩৮,ও ১৫/৯১৮পৃ. হাদিস : ৪৩৫৮৪, আজলুনী, কাশফুল খাফা, ১/৪৮০পৃ. হাদিসঃ ১৩৪৫, শায়খ ইউসুফ নাবহানী, ফতহুল কাবীর, ২/১১৫পৃ. হাদিস, ৬৪৫৯, মানাবী, ফয়যুল কাদীর, ৩/৫৬৪পৃ.)

যে ব্যক্তি এই গেয়ারভী শরীফ পালন করবে, সে খায়র ও বরকত লাভ করবে।

৪. যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে গেয়ারভী শরীফ পালন করবে, সে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাবে। দুঃখ ও চিন্তা মুক্ত হবে এবং সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করবে।

(সমাপ্ত)



Top