ইমাম আলা হযরত (রাঃ) কর্তৃক হযরত মা আয়িশা সিদ্দিকাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা'র শানে অসম্মান করা" মর্মে অভিযোগের ভ্রান্তি নিরসন। পর্ব-২
---------------------------------------------
আল্লাহর নামে শুরু করছি যিনি পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু।।
جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا -
"সত্য আগমন করেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে; নিশ্চয়ই মিথ্যা অপসৃত হওয়ারই ছিলো।"
প্রতিপাদ্যঃ
আমরা আন্তরিকভাবে আশাবাদী যে, লেখাটি ইমাম আহমদ রেজা খান আলাইহির রাহমাহর মতো দীনের একজন মুখলিছ খাদিমের বিরুদ্ধে একটি ভিত্তিহীন অভিযোগের অবসান ঘটাবে। কারণ এটাই স্পষ্ট যে ইমাম আহমদ রেজা খান হিজরী ১৩৪০ সালে ইন্তিকাল করেছিলেন এবং মাওলানা মাহবুব আলী খানের সংকলিত বইটি *হাদাইক ই বখশীশ খণ্ড-৩* নাম দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল হিজরী ১৩৪২ সালে। ইমাম আহমদ রেজা খান এই ভুলের সাথে কোনো ভাবেই জড়িত নন, বরং এটি অন্যরা করেছিলেন - যেমনটি গতকাল স্ফটিক স্বচ্ছের ন্যায় পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে।
পরিচিতিঃ
উল্লেখযোগ্য যে, মাওলানা মাহবুব আলী খান রজভী কাদেরী সাহেব ইমাম আহমদ রেজা খান আলাইহির রাহমা'র ভক্ত ছিলেন। তিনি বোম্বে জামে মসজিদের মতো একটি খ্যাতনামা মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্বে ছিলেন। আরো উল্লেখ্য যে, তিনি একাধারে আলিম ও কবি ছিলেন। বিভিন্ন বই পুস্তক প্রকাশনার কাজেও জড়িত ছিলেন। যে কারণে ওনার অনুরোধের প্রেক্ষিতে বেরিলী শরীফ (দরবারে আলা হজরত) থেকে তাঁকে ইমাম আহমদ রেজা খান আলাইহির রাহমা'র লিখিত কিছু কিতাবের পান্ডুলিপি দেয়া হয়েছিল।
“হাদাইক ই বখশিশ খণ্ড ৩" এই সংকলনটিতে আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খান আলাইহির রাহমা'সহ আরো কবিদের লিখনী ছিল, যাঁর মধ্যে সংকলক মাহবুব আলী খান অন্যতম। এই সংকলনের পৃষ্ঠা ৩৭ এবং ৩৮ পৃষ্ঠায় উম্মে যারা সম্পর্কিত কবিতা ছিল, যা কস্মিনকালেও আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খান লিখেননি। তাই মূলকথা হলো, এ সংক্রান্তে যারা আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খান-কে দায়ী করছেন, তারা হয়তো অজ্ঞতাপ্রসূত বোকার স্বর্গে বাস করে ভ্রান্তি ছড়ানোয় ব্যস্ত। অথবা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের আশায় নিছক অপবাদ আরোপের অপচেষ্টায় রত আছেন।
উম্মে যারা সম্পর্কিত কবিতার মূল প্রতিপাদ্য হাদীস শরীফের রেফারেন্স থেকে উল্লিখিত একজন মহিলা ও তাঁর স্বামী আবু যারা-র সৌন্দর্য, গুণাবলী, ভালবাসার বিষয়ে। যেটি মাহবুব আলী খান এর কবিতায় ছাপার ভুলে হযরত মা আয়িশা সিদ্দিকাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা'র সাথে একীভূত হয়ে গেছে। তাই পরবর্তীতে ভুল ধরা পড়ার পর মাওলানা মাহবুব আলী খান তার 'ইলমী খিয়ানত' অথবা 'অবহেলা'- ইত্যাদির ভুল স্বীকার করে তাওবা করেছেন। এবং তিনি এও বলেছেন যে, হযরত মা আয়িশা সিদ্দিকাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা'র ব্যাপারে তিনি কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এর আকিদা পোষণ করেন এবং পবিত্র আম্মাজান আয়িশা সিদ্দিকাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা'র প্রতি সন্তানসুলভ আত্মসমর্পণ করেছেন।
সেই তাওবাটি ফয়সালায়ে মুকাদ্দামায়ে শারইয়্যাহ কুরআনিয়াহ, মাজলিস-ই-রেজা থেকে প্রকাশিত, লাহোর, ১৯৮৪, পৃষ্ঠা ৮১-তে প্রকাশিত হয়েছিল।
সেই তাওবাটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এর ১১৯ জন শীর্ষ ওলামায়ে কেরামগণ কর্তৃক "তসদিক" বা সত্যায়িত হয়েছিল।
আমরা আজকের লেখার সাথে পাঠক দর্শকদের নিরপেক্ষ বিচারের জন্য তা উপস্থাপন করতে প্রয়াস পাচ্ছি। একজন ভাই গতকালের লেখাটি পড়ে এবং অন্য আরেকজন ভাই তাঁর সমর্থন করে এই দলীল প্রমাণগুলো চেয়েছিলেন, এজন্য তাঁদের আন্তরিক মোবারকবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তবে তাঁদের দাবিপ্রকাশে আরেকটু ধৈর্যধারণ ও দায়িত্বশীল আচরণ প্রদর্শনের পরামর্শ দিচ্ছি।
উম্মে যারা সম্পর্কিত হাদীসঃ
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উম্মে জারা সম্পর্কিত হাদীস শরীফটি সহীহ ও হাসান সূত্রে বর্ণিত। এটি বেশ লম্বা হাদীস। তাই এখানে আমি যেহেতু আলিম নই বরং আলিমদের কদমের ধূলা সমতুলও নই, তাই জ্ঞানের দৈন্যতা ও অক্ষমতা হেতু হাদীস শরীফের উপর বিশদ আলোচনা করতে নিতান্তই শঙ্কিত ও সংকোচ বোধ করছি। তবে মূলকথা হাদিস শরিফটির একদম শেষদিকে এটুকু এসেছেন যে,
উম্মে যারা নামক মহিলা ও তাঁর স্বামী আবু যারা-কে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয়তম বিবি ও উম্মাহকূল জননী হযরত আম্মা আয়িশা সিদ্দিকাহ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে স্নেহাশীসভরা প্রেমময় মধুর কন্ঠে বলেন, "আয়িশা তুমি উম্মে যারা সমতুল্য আর আমি আবু যারার মতো।" এটা আল্লাহর হাবীব কেন তাঁর প্রেয়সী বিবিকে বলেছেন তা আল্লাহ, তাঁর হাবীব ও মা আয়িশাই ভালো জানেন। হয়তোবা ওলামায়ে কেরাম হাদিস শরিফটি নিয়ে গবেষণা করতে পারেন। আমরা এই পোস্টটির সাথে হাদিস শরীফটির স্ক্রিন শট দিচ্ছি আর এখানে রেফারেন্স উল্লেখ করছি। (সহীহ মুসলিম শরীফ, হাদিস নং ৫৯৯৮)
শেষকথাঃ
জ্ঞানের রাজ্যে তর্ক ও যৌক্তিক আলোচনা সমালোচনা থাকবে। যেকোনো লেখার আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে লেখকের লিখনী আরো পরিশুদ্ধ ও পরিশীলিত হয়। জ্ঞানের এরুপ সাধনা মনে উদারতা ও চরিত্রে দৃঢ়তা আনতে সক্ষম। কিন্তু সমালোচনা যেন কোনোক্রমেই বিতর্ক উস্কে দিয়ে ঝগড়াটে উৎসাহিত না করে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাই আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ যে, আমাদের কোনো আলোচনায় বা লেখনীতে আমরা কোনো দীনের খাদেম, আকাবির ওলামায়ে কেরামদের যেন আমাদের দুশমন হিসেবে উপস্থাপন না করি। যত মত তত পথ থাকবেই। কিন্তু তাই বলে আমি আপনার আকাবিরকে আর আপনি আমার আকাবিরদের নিন্দাবাদে দিন কাটালে একদিন নিজেরাই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবো। এরচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, আমি যার ভুল ও নিন্দা করার প্রয়াসী হবো, আগে তো তাঁর লেখনীর পুরো না হলেও অর্ধেক লেখনী হলেও পাঠ করা উচিত। আর যে মহৎ স্বত্বা আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খান আলাইহির রাহমা'কে নিন্দা সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে তাঁর লেখনীর এক দশমাংসও পাঠ করার সুযোগ অবশিষ্ট জীবনেও হবে কিনা সন্দেহ আছে বৈকি! যেখানে সারাবিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইলমী মারকাজসমূহে যুগের শ্রেষ্ঠ স্কলারগণ ইমাম আহমদ রেজা খান এর জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে প্রায় একশত পিএইচডি অর্জন করেছেন সেখানে একজন ব্যক্তির ফেসবুক লাইভ ভিডিওর বক্তব্য তাঁকে খন্ডন করতে যথেষ্ট তো নয়ই, তাঁর উচ্চ মর্যাদার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্ষতি করতেও সমর্থ হবে না। আল্লাহ মাফ করুন, দীনের মুখলিছ খাদিম ও আকাবিরদের সমালোচনা, অশ্রদ্ধা ও নিন্দা নিজের কবুল আমল বরবাদ করে জাহান্নামের আগুনের জ্বালানি হতেই যথেষ্ট। জেনে রাখুন, আকাবিরদের নিন্দায় দিনরাত গুজরান করলে দীন ইসলাম হয়তোবা সাময়িক সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, তবে আল্লাহর দীন আল্লাহ নিজেই হেফাজত করবেন। মালিক ও মুনীব আমাদের সহায় হোন। সঠিক বুঝ দান করুন।
সত্য উদঘাটনে সেবকঃ
মুহাম্মদ শাহীদ রিজভী,
আইনজীবী ও সমাজকর্মী।
ঢাকা, বাংলাদেশ।
১৭ অক্টোবর, ২০১৯.