দারূস সাআদাত গ্রন্থ
আল উকূবাত
ইমাম ইবনে আবিদ দুনইয়া (রহ)
pdf download করুন al uqubat অথবা নিচের ব্লগ থেকে পাঠ করুন-
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
نَحْمَدُه وَنُصَلِّ عَلٰى رَسُوْلِهِ الْكَرِيْمِ
আল উকূবাত
[রিওয়ায়াত ১- ১০০]
أَسْبَابُ الْعُقُوبَاتِ وَأَنْوَاعُهَا
শাস্তি ও বিপর্যয়ের উপকরণ ও প্রকারসমূহ
[মানুষের ধ্বংসের চূড়ান্ত সময়]
[১] আবুল বুখতারী (রহ) বলেন- আমাকে রাসূলের সাহাবী বলেছেন যে, নবী কারীম (সা) ইরশাদ করেছেন-
لَنْ يَهْلِكَ النَّاسُ حَتَّى يَعْذِرُوا مِنْ أَنْفُسِهِمْ
যে পর্যন্ত মানুষ গুনাহর আধিক্যের জন্য শাস্তির উপযোগী না হয়ে যাবে সে পর্যন্ত ধ্বংস হবে না।
[২] হযরত যুবায়র বিন নুফায়র বলেন, যখন কুবরুস বিজিত হলো, তখন মুসলমানরা পরস্পর বসে কাঁদতে লাগল। হযরত আবু দারদা (রা)-ও কাঁদতে ছিলেন। আমি তাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করে বললাম, কি আশ্চর্য আপনি এমন দিনে কাঁদছেন, যেদিন আল্লাহ তাআলা ইসলামকে (মুসলমানদেরকে) বিজয় ও প্রবলতা দান করেছেন এবং শিরক ও মুশরিকদেরকে লাঞ্ছিত করেছেন। তখন তিনি বললেন, হে যুবায়র! ছাড়! (আর জেনে রাখ) যখন মাখলুক আল্লাহর নাফরমানী করে তখন সে আল্লাহর নিকট অনেক মূল্যহীন হয়ে যায়। যদিও তারা শক্তিশালী ও প্রবল পরাক্রান্ত উম্মত হয় না কেন।
নেক লোকও যখন শাস্তিতে নিপতিত হবে
[৩] হযরত উম্মু সালামা (রা) বলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
إِذَا ظَهَرَ السُّوءُ فِي الْأَرْضِ أَنْزَلَ اللَّهُ تَعَالَى بَأْسَهُ بِأَهْلِ الْأَرْضِ» ، قَالَتْ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَإِنْ كَانَ فِيهِمْ صَالِحُونَ؟ قَالَ: «نَعَمْ، وَإِنْ كَانَ فِيهِمْ صَالِحُونَ، يُصِيبُهُمْ مَا أَصَابَ النَّاسَ، ثُمَّ يَرْجِعُونَ إِلَى رَحْمَةِ اللَّهِ
যখন যমীনে মন্দ কাজের প্রাবল্য দেখা দিবে, তখন আল্লাহ তাআলা যমীনে বসবাসকারীদের উপর নিজের আযাব নাযিল করবেন। হযরত উম্মু সালামা (রা) বলেন, আমি আরয করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদিও তাদের মধ্যে নেক লোক থাকে তবুও? তিনি বললেন, হ্যা, যদিও তাদের মধ্যে নেক লোক থাকে না কেন। সাধারণ লোকদের মত তারাও শাস্তিতে নিপতিত হবে। পরে আল্লাহ তাদেরকে তার রহমতের দিকে টেনে নিবেন।
[৪] হযরত হাসান (রহ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
لَا تَزَالُ هَذِهِ الْأُمَّةُ تَحْتَ يَدِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَفِي كَنَفِهِ مَا لَمْ يُمَالِئْ قُرَّاؤُهَا أُمَرَاءَهَا، وَمَا لَمْ يُزَكِّ صُلَحَاؤُهَا فُجَّارَهَا، وَمَا لَمْ يُمَنِّ خِيَارُهَا شِرَارَهَا، فَإِذَا هُمْ فَعَلُوا ذَلِكَ رَفَعَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُمْ يَدَهُ، ثُمَّ سَلَّطَ عَلَيْهِمْ جَبَابِرَتُهُمْ سُوءَ الْعَذَابِ، ثُمَّ ضَرَبَهُمْ بِالْفَاقَةِ وَالْفَقْرِ
এই উম্মত সর্বদা আল্লাহর হিফাযত ও সাহায্যের মধ্যে থাকবে, যে পর্যন্ত এই উম্মতের কারী (দীনি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ) শাসকদের দিকে ধাবিত না হবে। নেক লোকেরা ফাসিক ও পাপাচারীদের ভাল বলতে না থাকবে। ভাল লোকেরা মন্দ লোকদের চাপলুসী বা তোষামোদ না করবে। যখন তারা এমন করবে তখন আল্লাহ তাআলা তাদের মাথার উপর থেকে রহমতের হাত সরিয়ে নিবেন। অতঃপর নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী লোক তাদেরকে কষ্ট ও শাস্তি প্রদান করবে। এরপর তারা দারিদ্র ও নিঃস্বতার শিকার হয়ে যাবে।
যখন কাফির-মুশরিকরা মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে
[৫] হযরত সাওবান (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
يُوشِكُ أَنْ تَدَاعَى عَلَيْكُمُ الْأُمَمُ مِنْ كُلِّ أُفُقٍ، كَمَا تَدَاعَى الْأَكَلَةُ عَلَى قَصْعَتِهَا» ، قَالُوا: مِنْ قِلَّةٍ؟ قَالَ: «أَنْتُمْ يَوْمَئِذٍ كَثِيرٌ، وَلَكِنَّكُمْ غُثَاءٌ كَغُثَاءِ السَّيْلِ، تُنْزَعُ الْمَهَابَةُ مِنْ قُلُوبِ عَدُوِّكُمْ، وَيُجْعَلُ فِي قُلُوبِكُمُ الْوَهْنُ» قَالُوا: وَمَا الْوَهْنُ؟ قَالَ: «حُبُّ الْحَيَاةِ، وَكَرَاهِيَةُ الْمَوْتِ
অচীরেই তোমাদের উপর অন্য জাতির লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়বে যেভাবে ক্ষুধার্থরা খাদ্যের বরতনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাহাবীগন জিজ্ঞাসা করলেন, এই অবস্থা কি আমাদের স্বল্পতার কারণে হবে? তিনি (সা) বললেন, না তোমরা সে সময় সংখ্যায় অনেক থাকবে, তবে তখন তোমরা হবে সে সমস্ত খড়কুটার মত যেগুলোকে পানি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সে সময় দুশমনদের অন্তর হতে তোমাদের ভয়-ভীতি ও প্রভাব প্রতিপত্তি দূর হয়ে যাবে আর তোমাদের অন্তরে ‘ওয়াহান’ ঢেলে দেয়া হবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওয়াহান’ কি? তিনি (সা) বললেন- দুনিয়ার মহব্বত এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা।
[৬] হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ تَمْنَعُ الْعِبَادَ مِنْ سَخَطِ اللَّهِ مَا لَمْ يُؤْثِرُوا صَفْقَةَ دُنْيَاهُمْ عَلَى دِينِهِمْ، فَإِذَا آثَرُوا صَفْقَةَ دُنْيَاهُمْ عَلَى دِينِهِمْ، ثُمَّ قَالُوا: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، رُدَّ عَلَيْهِمْ، وَقَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ: كَذَبْتُمْ
কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বান্দাকে আল্লাহর আযাব ও শাস্তি থেকে রক্ষা করে- যে পর্যন্ত না সে দুনিয়ার বিষয়াদিকে আখিরাতের বিষয়াদির উপর প্রাধান্য না দেয়। কিন্তু যখন বান্দা দুনিয়ার বিষয়সমূহকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দেয় আর বলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। তখন এই কালিমা তার প্রতি রদ করে দেয়া হয় আর আল্লাহ তাআলা বলেন- তুমি মিথ্যাবাদী।
দীন দ্বারা দুনিয়া হসিল করার শাস্তি
[৭] হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
يَخْرُجُ فِي آخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ يَخْتِلُونَ الدُّنْيَا بِالدِّينِ، يَلْبَسُونَ لِلنَّاسِ مُسُوحَ الضَّأْنِ مِنَ اللِّينِ، أَلْسِنَتُهُمْ أَحْلَى مِنَ السُّكَّرِ، وَقُلُوبُهُمْ قُلُوبُ الذِّئَابِ، فَيَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ: أَبِي تَغْتَرُّونَ، وَعَلَيَّ تَجْتَرِئُونَ؟ فَبِي حَلَفْتُ لَأَبْعَثَنَّ عَلَى أُولَئِكَ مِنْهُمْ فِتْنَةً تَدَعُ الْحَلِيمَ مِنْهُمْ حَيْرَانَ
আখিরী যামানায় এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটবে যারা দীনের নামে দুনিয়া হাসিল করবে। লোকদের দেখানোর উদ্দেশ্যে সূফী বেশ ধারণ করবে। তাদের যবান হবে চিনির চেয়েও মিষ্ট অথচ তাদের অন্তর হবে নেকড়ে বাঘের মত। আল্লাহ তাআলা বলেন- তুমি কি আমাকে ধোঁকা প্রদান কর অথবা দুঃসাহস দেখাও? আমার নিজের সত্তার কসম! আমি তাদের প্রতি এমন ফিতনা ছড়িয়ে দিব যা তাদের মধ্যে সহনশীল-বুঝমান লোককেও হয়রান-পেরেশান করে তুলবে।
যখন আলিমরা হবে সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং তাদের মধ্যেই ফিতনা ঘুরপাক খাবে
[৮] হযরত আলী (রা) বলেন-
سَيَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يَبْقَى مِنَ الْإِسْلَامِ إِلَّا اسْمُهُ، وَلَا مِنَ الْقُرْآنِ إِلَّا رَسْمُهُ، مَسَاجِدُهُمْ يَوْمَئِذٍ عَامِرَةٌ وَهِيَ خَرَابٌ مِنَ الْهُدَى، عُلَمَاؤُهُمْ شَرُّ مَنْ تَحْتَ أَدِيمِ السَّمَاءِ، مِنْهُمْ خَرَجَتِ الْفِتْنَةُ، وَفِيهِمْ تَعُودُ
লোকদের উপর এমন এক সময় আসবে, যখন শুধু ইসলামের নামটুকু বাকী থাকবে। কুরআনের শুধু রেওয়ায বাকী থাকবে। মসজিদগুলোকে বাহ্যিকভাবে আবাদ মনে হবে কিন্তু বাস্তবে তা হবে হিদায়াতশূণ্য। আসমানের ছাদের নীচে ঐ সময়ের আলিমরা হবে সবচেয়ে বেশী মন্দ। আর তখন তাদের মধ্য থেকেই ফিতনার উদ্ভব ঘটবে আর তাদের মধ্যেই তা আবর্তিত হবে।
ব্যভিচার ও সুদের কারণে জনপদসমূহের ধ্বংস
[৯] হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন-
إِذَا ظَهَرَ الزِّنَا وَالرِّبَا فِي قَرْيَةٍ أُذِنَ بِهَلَاكِهَا
যখন কোন জনপদে ব্যভিচার ও সুদের বিস্তার ঘটে, তখন সেই জনপদকে ধ্বংস ও বরবাদ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়।
যখন মানুষ অভিশাপের পাত্রে পরিণত হবে
[১০] হযরত হাসান (রহ) বলেন-
إِذَا النَّاسُ أَظْهَرُوا الْعِلْمَ وَضَيَّعُوا الْعَمَلَ، وَتَحَابُّوا بِالْأَلْسُنِ وَتَبَاغَضُوا بِالْقُلُوبِ، وَتَقَاطُعوا فِي الْأَرْحَامِ، لَعَنَهُمُ اللَّهُ عِنْدَ ذَلِكَ، فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبَصَارَهُمْ
যখন মানুষ ইলমের প্রকাশ ও বড়াই করবে আর আমলকে নষ্ট করবে। যবান দ্বারা মহব্বত ও ভালবাসা প্রকাশ করবে আর অন্তরে রাখবে বিদ্বেষ ও শত্রুতা। পিতা-মাতা ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে লা’নত বা অভিশাপের পাত্রে পরিণত করবেন আর তাদেরকে অন্ধ ও বধীর (গাফেল ও উদাসীন) করে দিবেন।
পাঁচটি পাপের ফল
[১১] হযরত ইবনে উমর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট মুহাজিরদের দশজন ব্যক্তি বসা ছিল। তাদের মধ্যে আমি ছিলাম দশম ব্যক্তি। রাসূলুল্লাহ (সা) তার চেহারা মুবারক ঘুরিয়ে আমাদের দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং বললেন-
يَا مَعْشَرَ الْمُهَاجِرِينَ، خَمْسُ خِصَالٍ، وَأَعُوذُ بِاللَّهِ أَنْ تُدْرِكُوهُنَّ: مَا ظَهَرَتِ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ قَطُّ حَتَّى أَعْلَنُوا بِهَا، إِلَّا ابْتُلُوا بِالطَّوَاعِينِ وَالْأَوْجَاعِ الَّتِي لَمْ تَكُنْ فِي أَسْلَافِهِمُ الَّذِينَ مَضَوْا، وَلَا نَقَصَ قَوْمٌ الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ إِلَّا ابْتُلُوا بِالسِّنِينِ وَشِدَّةِ الْمَئُونَةِ وَجَوْرِ السُّلْطَانِ، وَمَا مَنَعَ قَوْمٌ زَكَاةَ أَمْوَالِهِمْ إِلَّا مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنَ السَّمَاءِ، وَلَوْلَا الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوا، وَلَا خَفَرَ قَوْمٌ الْعَهْدَ إِلَّا سَلَّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوَّهُمْ مِنْ غَيْرِهِمْ فَأَخَذُوا بَعْضَ مَا فِي أَيْدِيهِمْ، وَمَا لَمْ تَعْمَلْ أَئِمَّتُهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ وَيَتَخَيَّرُوا فِي كِتَابِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ إِلَّا جَعَلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ بَأْسَهُمْ بَيْنَهُمْ
হে মুহাজির সম্প্রদায়! পাঁচটি স্বভাব এমন যা থেকে আমি আল্লাহর পানাহ চাই যাতে তোমরা তাতে পতিত না হও।
যে সম্প্রদায়ের মধ্যে নির্লজ্জতা ও অশ্লিলতা সাধারণ বিষয় হয়ে যায় এবং মানুষ তা প্রকাশ্যে করতে থাকে তখন তাদের মধ্যে প্লেগ এবং এমনসব রোগ-ব্যাধি প্রকাশ পায় যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে কখনো হয়নি।
আর যে সম্প্রদায় মাপে ও ওজনে কম করবে, তারা দুর্ভিক্ষ, কষ্ট-কাঠিন্য এবং বাদশাহ ও শাসকদের অত্যাচারের শিকার হবে।
আর যে সম্প্রদায় যাকাত প্রদান করা বন্ধ করে দেয় তারা বৃষ্টির রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। যদি জন্তু-জানোয়ার না থাকত তবে একেবারেই বৃষ্টি হত না।
আর যে সম্প্রদায় চুক্তি ভঙ্গ করবে তাদের উপর তাদের দুশমনদেরকে প্রবল করে দেওয়া হয় যারা তাদের মাল সম্পদের উপর কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়।
আর যে সম্প্রদায়ের শাসকবর্গ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের উপর আমল করে না এবং কুরআনের হুকুম-আহকামকে মূল্যায়ন করে না তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নিজেদের মধ্যেই বিবাদ ও শাস্তিত জড়িয়ে দেন।[8]
যখন আল্লাহ তাআলা পরস্পরের অন্তরকে বিগড়ে দিবেন
[১২] হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন- তোমাদের পূর্ববতী সম্প্রদায়ের অবস্থা এমন ছিল যে, যখন তাদের মধ্যে কেউ কোন পাপ কাজ করতে দেখত তখন তাকে সাধারনভাবে নিষেধ করত। কিন্তু পরবর্তী দিনেই আবার সে তার সাথে উঠবস ও পানাহার করত, যেন সে পূর্বের দিন তাকে কোন গুনাহই করতে দেখে নাই। যখন আল্লাহ তাআলা তাদের কতকের এমন অবস্থা দেখলেন, তখন তাদের অন্তরকে পরস্পরের মধ্যে বিগড়ে দিলেন এবং হযরত দাউদ (আ) এবং হযরত ইসা (আ) এর যবানী দ্বারা অভিসম্পাত করলেন এবং ইরশাদ করলেন-
ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ
তার কারণ, তারা ছিল নাফরমান সীমালংঘনকারী।–সূরা বাকারা:৬১
সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে থাক। আর যালিমকে বাঁধা প্রদান কর এবং তাকে ন্যায় ও ইনসাফের দিকে ধাবিত কর। অন্যথায় আল্লাহ তাআলা তোমাদের অন্তরকেও পরস্পরের মধ্যে বিগড়ে দিবেন। আর তোমাদের উপর তেমনভাবে লা’নত করা হবে যেমনিভাবে তাদের উপর লা’নত করা হয়েছিল।
যখন পাপীদের সাথে নেক লোকদেরকেও ধ্বংস করা হয়
[১৩] হযরত ইবরাহিম ইবনে আমর আস সানআনী বলেন-
أَوْحَى اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَى يُوشَعَ بْنِ نُونٍ: إِنِّي مُهْلِكٌ مِنْ قَوْمِكَ أَرْبَعِينَ أَلْفًا مِنْ خِيَارِهِمْ، وَسِتِّينَ أَلْفًا مِنْ شِرَارِهِمْ، قَالَ: يَا رَبِّ، هَؤُلَاءِ الْأَشْرَارُ، فَمَا بَالُ الْأَخْيَارِ؟ قَالَ: إِنَّهُمْ لَمْ يَغْضَبُوا، وَكَانُوا يُؤَاكِلُونَهُمْ وَيُشَارِبُونَهُمْ
আল্লাহ তাআলা হযরত ইউশা ইবনে নূন (আ) এর প্রতি ওহী প্রেরণ করে বলেন- আমি তোমার কওমের ৪০ হাজার নেক লোক এবং ৬০ হাজার পাপী লোকদেরকে ধ্বংস করব। হযরত ইউশা ইবনে নূন (আ) বললেন- হে পরওয়ারদেগার! পাপীদেরকে ধ্বংস করার বিষয়টি তো ঠিক আছে কিন্তু নেক লোকদের অপরাধ কি? আল্লাহ তাআলা বললেন- তারা (পাপীদের পাপের কারণে) তাদের প্রতি রাগান্বিত হয় নাই। আর তারা তাদের সাথেই পানাহার করত।
[১৪] হযরত আবী হাযযান (রহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-
بَعَثَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ مَلَكَيْنِ إِلَى أَهْلِ قَرْيَةٍ أَنْ دَمِّرَا مَنْ فِيهَا. فَوَجَدَا رَجُلًا قَائِمًا يُصَلِّي فِي مَسْجِدٍ، فَتَضَرَّعَ أَحَدُهُمَا إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَقَالَ: رَبَّنَا إِنَّا وَجَدْنَا فِيهَا عَبْدَكَ فُلَانًا قَائِمًا يُصَلِّي فِي مَسْجِدٍ، فَقَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ: دَمِّرَاهَا وَدَمِّرَاهُ مَعَهَا، فَإِنَّهُ مَا تَمَعَّرَ وَجْهُهُ فِي سَاعَةٍ قَطُّ
আল্লাহ তাআলা একটি পল্লিতে দুইজন ফেরেশতাকে এই নির্দেশ দিয়ে প্রেরণ করলেন যে, এই পল্লির লোকদেরকে ধ্বংস ও বরবাদ কর। ফেরেশতারা সেখানে (গিয়ে) একজনকে মসজিদে নামাযরত অবস্থায় পেলেন। ফেরেশতারা আরয করলেন- হে আমার প্রতিপালক! আমরা এই পল্লিতে তোমার একজন বান্দা পেয়েছি- যে মসজিদে নামায পড়ছে। আল্লাহ তাআলা বললেন- ঐ পল্লিকেও ধ্বংস কর আর ঐ নামাযীকেও বরবাদ কর। কেননা তার চেহারা কখনও (পাপ কাজ দেখে) পরিবর্তন হয় নাই।
[১৫] হযরত ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ (রহ) বলেন-
لَمَّا أَصَابَ دَاوُدُ الْخَطِيئَةَ قَالَ: رَبِّ اغْفِرْ لِي، قَالَ: قَدْ غَفَرْتُهَا لَكَ، وَأَلْزَمْتُ عَارَهَا بَنِي إِسْرَائِيلَ، قَالَ: كَيْفَ يَا رَبِّ، وَأَنْتَ الْحَكَمُ الْعَدْلُ لَا تَظْلِمُ أَحَدًا، أَعْمَلُ أَنَا الْخَطِيئَةَ وَتُلْزِمُ عَارَهَا غَيْرِي؟، فَأَوْحَى اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَيْهِ: أَنْ يَا دَاوُدُ، إِنَّكَ لَمَّا اجْتَرَأْتَ عَلَيَّ بِالْمَعْصِيَةِ لَمْ يُعَجِّلُوا عَلَيْكَ بِالنُّكْرَةِ
যখন হযরত দাউদ (আ) এর থেকে ত্রুটি প্রকাশ পেল তখন তিনি বললেন- হে আমার প্রতিপালক! আমাকে মাফ করুন। তখন আল্লাহ তাআলা বললেন- আমি তো তোমাকে মাফ করলাম তবে বনী ইসরাইলের জন্য লাঞ্ছনা নির্ধারণ করে দিলাম। হযরত দাউদ (আ) আরয করলেন, হে পরওয়ারদেগার এটা কিভাবে? আপনি তো হাকীম ও ন্যায়পরায়ণ। আপনি তো কারো প্রতি যুলুম করেন না। অপরাধ করেছি আমি আর তার শাস্তি নির্ধারণ হবে অপর কারো উপর? আল্লাহ তাআলা তার প্রতি ওহী নাযিল করলেন- হে দাউদ! যখন তুমি পাপ কাজের (ত্রুটি-বিচ্যুতির) দুঃসাহস প্রদান করলে, তখন তারা তোমাকে নিষেধ করতে কেন সাহস করল না?
[১৬] হযরত মিসআর (রহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-
بَلَغَنِي أَنَّ مَلَكًا أُمِرَ أَنْ يَخْسِفَ بِقَرْيَةٍ، فَقَالَ: يَا رَبِّ، فِيهَا فُلَانٌ الْعَابِدُ، فَأَوْحَى اللَّهُ تَعَالَى إِلَيْهِ: أَنْ بِهِ فَابْدَأْ، فَإِنَّهُ لَمْ يَتَمَعَّرْ وَجْهُهُ فِي سَاعَةٍ قَطُّ
আমার নিকট এই সংবাদ পৌঁছেছে যে, একজন ফেরেশতা এই নির্দেশপ্রাপ্ত হন যে- অমুক পল্লিকে ধ্বসে দাও। ফেরশেতা আরয করলেন- হে রব! সেখানে আপনার একজন ইবাদতগুযার বান্দা আছে। আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাকে হুকুম করলেন যে, তার থেকেই শাস্তি শুরু কর। কেননা তার চেহারা কখনও (পাপ কাজ দেখে) পরিবর্তন হয় নাই।
ভূমিকম্পের হাদিস
[১৭] হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি একজন লোকসহ হযরত আয়িশা (রা) এর নিকট গেলেন। লোকটি আরয করল, হে উম্মুল মুমিনীন! আমাকে ভূমিকম্পের ব্যাপারে কোন হাদীস বলুন। তিনি বললেন-
إِذَا اسْتَبَاحُوا الزِّنَا، وَشَرِبُوا الْخَمْرَ، وَضَرَبُوا بِالْمَغَانِي، وَغَارَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فِي سَمَائِهِ فَقَالَ لِلْأَرْضِ: تَزَلْزَلِي بِهِمْ. فَإِنْ تَابُوا وَنَزَعُوا، وَإِلَّا هَدَمَهَا عَلَيْهِمْ
মানুষ যখন ব্যভিচারকে বৈধ মনে করে, মদ ও শরাব পান করতে থাকে এবং গান-বাজনায় মত্ত হয়ে যায় তখন আল্লাহ তাআলার মর্যাদাবোধে আঘাত লাগে। অতঃপর তিনি যমীনকে কম্পনর নির্দেশ দেন। যদি মানুষ দ্রুত তওবা করে এবং গুনাহ পরিত্যাগ করে তবে নিরাপদ হয়ে যায়। অন্যথায় আল্লাহ তাদেরকে উলট পালট করে দেন।
বর্ণনাকারী বলেন, আমি তখন জানতে চাইলাম যে, হে উম্মুল মুমিনীন! এটা কি মুমিনদের জন্য আযাব? তিনি বললেন-
بَلْ مَوْعِظَةٌ وَرَحْمَةٌ وَبَرَكَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ، وَنَكَالٌ وَعَذَابٌ وَسَخَطٌ عَلَى الْكَافِرِينَ
না বরং এটা মুমিনদের জন্য নসীহত, রহমত ও বরকতস্বরুপ। আর কাফির ও নাফরমানদের জন্য আযাব ও গযব।
হযরত আনাস (রা) বলেন- নবী (সা) এর ওফাতের পর এমন মনোমুগ্ধকর হাদীস আমি আর শুনিনি।
[১৮] হযরত আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন- একবার রাসূলের যুগে ভূমিকম্প হলে রাসূলুল্লাহ (সা) যমীনে হাত রেখে বললেন-
اسْكُنِي، فَإِنَّهُ لَمْ يَأْنِ لَكِ بَعْدُ
হে যমীন! থেমে যাও! এখনও তোমার সে সময় হয়নি।
তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীদের দিকে মনোনিবেশ করে বললেন-
إِنَّ رَبَّكُمْ يَسْتَعْتِبَكُمْ فَأَعْتِبُوهُ
তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে তওবা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। অতএব তোমরা তাকে রাযী কর।
এরপর হযরত উমর (রা) এর যুগে ভুমিকম্প হলে হযরত উমর (রা) বলেন- হে লোকসকল! এই ভূমিকম্প তোমাদের কোন গুনাহ ও পাপের কারণেই হচ্ছে। সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ! যদি পূণরায় ভূমিকম্প হয় তবে আমি তোমাদেরকে এই যমীনে আর কখনও থাকতে দিব না।
[১৯] হযরত ইবনে উমর (রা) বলেন- একবার হযরত উমর (রা) এর খিলাফতের সময় মদীনায় ভূ-কম্পন হলে তিনি যমীনে হাত রেখে বলেন- مَا لَكِ، مَا لَكِ؟তোমার কি হলো, তোমার কি হলো? সাবধান! যদি এটা কিয়ামতের ভূ-কম্পন হত তবে যমীন তার সংবাদ আমাদেরকে অবশ্যই বলত। আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি-
إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ، فَلَيْسَ مِنْهَا ذِرَاعٌ وَلَا شِبْرٌ إِلَّا وَهُوَ يَنْطِقُ بِالنَّاسِ
যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে তখন যমীনের প্রত্যেক অংশ চাই তা এক বিঘত পরিমাণই হোক না কেন-লোকদের অবস্থার সংবাদ প্রদান করবে।
[২০] হযরত সাফিয়্যা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন- হযরত উমার (রা) এর খিলাফতের যুগে মদীনায় ভুমিকম্প হলে তিনি লোকদেরকে বললেন-
أَيُّهَا النَّاسُ، مَا هَذَا؟ مَا أَسْرَعَ مَا أَحْدَثْتُمْ، لَئِنْ عَادَتْ لَا أُسَاكِنُكُمْ فِيهَا
হে লোক সকল! এটা কি? তোমরা কি (পাপ) কাজ করেছ? যদি পূণরায় এখানে ভূমিকম্প হয় তবে আমি তোমাদেরকে এখানে অবস্থান করতে দিব না।
[২১] হযরত কাব আল আহবার (রা) বলেন-
إِنَّمَا تَزَلْزَلَتِ الْأَرْضُ لِأَنَّهَا خُلِقَتْ عَلَى ظَهْرِ حُوتٍ، فَلَعَلَّ الْحُوتَ إِنْ تَحَرَّكَ، أَوْ تُعْمَلُ عَلَيْهَا الْمَعَاصِي، فَتَرْعَدَ فَرَقًا مِنَ الرَّبِّ تَعَالَى إِذْ يَطَّلِعُ عَلَيْهَا
যমীনে ভূমিকম্প এজন্য হয় যে, এই যমীনকে একটি মাছের পিঠের উপর সৃষ্টি করা হয়েছে। হয়ত যখন সেই মাছ নড়াচড়া করে অথবা যমীনে যখন গুনাহ হয় তখন আল্লাহর ভয়ে যমীন কেঁপে উঠে।
[জ্ঞাতব্যঃ এটি ইসরাইলী বর্ণনা। আলিমগণ এর সমালোচনা করেছেন। সুতরাং তা গ্রহণযোগ্য নয়।]
[২২] হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন- আল্লাহ তাআলা একটি পাহাড় সৃষ্টি করেছেন যার নাম কাফ, যা সারা জগতকে বেষ্টন করে আছে। তার মূল ঐ পর্যন্ত বিস্তৃত যেখান পর্যন্ত যমীন বিস্তৃত। যখন আল্লাহ তাআলা কোন স্থানে ভূমিকম্প ঘটাতে চান, তখন ঐ পাহাড়কে নির্দেশ প্রদান করেন। তখন পাহাড়ের ঐ মূল যা সংশ্লিষ্ট স্থানের সাথে সংযুক্ত থাকে তা হেলতে দুলতে থাকে। এর ফলে ঐ স্থানে ভূমিকম্প হতে থাকে। এই কারণেই সংশ্লিষ্ট স্থানে ভূমিকম্প হতে থাকে অপর কোন স্থানে হয় না।
[জ্ঞাতব্যঃ এটাও ইসরাইলী বর্ণনা। সুতরাং এই বর্ণনাটিও অগ্রহণযোগ্য। আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ) বলেন- “বনী ইসরাইল হতে যেসব রিওয়ায়াতগুলো গ্রহণ করা জায়েয রাখা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ঐ রিওয়ায়াত যেগুলো কমপক্ষে জ্ঞানে ধরে ও বুঝে আসে। ওগুলো নয় যেগুলো স্পষ্টভাবে বিবেক বিরোধী।” দেখুন তাফসীর ইবনে কাসীর, সূরা কাফ]
[২৩] হযরত জাফর ইবনে বুরকান (রহ) বলেন- হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহ) আমাকে লিখেন, হামদ ও সালাতের পর- জেনে রাখ যে, এই ভূমিকম্প এমন জিনিস যার দ্বারা আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন। আমি সব শহরের অধীবাসীদেরকে জানিয়ে দিয়েছি যে, অমুক মাসের অমুক দিন সবাই যেন বের হয়ে আসে। আর যার কাছে দান-সাদকা করার মত কিছু আছে সে যেন কিছু দান-সাদকা করে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى ، وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّى
কামিয়াব ও সফল হল সেই ব্যক্তি- যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করল এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করল এবং সালাত আদায় করল।– সূরা আ’লা-১৪-১৫
এর সাথে সাথে তোমরা এইভাবে দুআ করবে যেভাবে তোমাদের পিতা হযরত আদম (আ) দুআ করেছিলেন-
رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নিজেদের উপর অনেক অবিচার করেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা ও দয়া না করেন তবে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব।– সূরা আ’রাফ:২৩
তোমরা আরো দুআ করবে যেভাবে হযরত নূহ আ (আ) দুআ করেছিলেন-
وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُنْ مِنَ الْخَاسِرِينَ
(হে আল্লাহ!) যদি আপনি আমাকে ক্ষমা ও দয়া না করেন তবে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।– সূরা হুদ:৪৭
তোমরা আরো দুআ করবে যেভাবে হযরত ইউনূস (আ) দুআ করেছেন-
لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
(হে আল্লাহ!) আপনি ব্যতীত কোন মাবুদ নাই। আপনি পবিত্র। আমি নিজেই আমার নিজের প্রতি অবিচার করেছি।– [সূরা আম্বিয়া:৮৭]
যখন আসমান হতে অপমান ও লাঞ্ছনা নাযিল হয়
[২৪] হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন- আমাদের উপর এমন সময় অতিবাহিত হয়েছে যে- কোন ব্যক্তির নিকট তার মুসলমান ভাইয়ের তুলনায় দীনার আর দিরহামের বেশী হক ছিল না। আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি-
إِذَا ضَنَّ النَّاسُ بِالدِّينَارِ وَالدِّرْهَمِ، وَتَبَايَعُوا بِالْعِينَةِ، وَتَرَكُوا الْجِهَادَ، وَأَخَذُوا بِأَكْتَابِ الْبَقَرِ، أَنْزَلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْهِمْ مِنَ السَّمَاءِ ذُلًّا، لَا يَرْفَعُهُ عَنْهُمْ حَتَّى يُرَاجِعُوا دِينَهُمْ
যখন মানুষ দীনার ও দিরহাম তথা টাকা পয়সার ব্যাপারে চরম কৃপণতা প্রদর্শন করবে, ঋণের (ও সুদের) আদান প্রদান করবে, জিহাদ পরিত্যাগ করবে, গাভী ও বাছুড় নিয়ে ক্ষেত-খামারে মশগুল হবে- তখন আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য আসমান হতে অপমান ও লাঞ্ছনা নাযিল করবেন। তাদেরকে আর উঁচু করবেন না, যে পর্যন্ত না তারা দীনে ফিরে আসে।
ফিতনার ভয়াবহতা
[২৫] হযরত হাসান (রহ) বলেন-
إِنَّ الْفِتْنَةَ وَاللَّهِ مَا هِيَ إِلَّا عُقُوبَةٌ مِنَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ تَحِلُّ بِالنَّاسِ
আল্লাহর কসম! ফিতনা তো আল্লাহর ঐ আযাব যা লোকদের উপর নাযিল হয়ে থাকে।
[২৬] হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসার (রা) ও হযরত হুযায়ফা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ إِذَا أَرَادَ بِالْعِبَادِ نِقْمَةً أَمَاتَ الْأَطْفَالَ، وَأَعْقَمَ أَرْحَامَ النِّسَاءِ، فَتَنْزِلُ بِهِمُ النِّقْمَةُ وَلَيْسَ فِيهِمْ مَرْحُومٌ
নিশ্চয়ই যখন আল্লাহ তাআলা বান্দাদেরকে কোন শাস্তি প্রদান করতে চান তখন শিশুদেরকে মৃত্যু দান করেন, নারীদেরকে বন্ধ্যা করে দেন। এরপর লোকদের উপর শাস্তি নাযিল হয়। তখন আর কেউ রহমতের যোগ্য থাকে না।[15]
[২৭] হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
النِّقَمُ كُلُّهَا جَائِرَةٌ
শাস্তি বা আযাবের পুরোটাই ধ্বংস বা বিনাশকারী।
দানিয়াল (আ) এর কান্না ও চিন্তা
[২৮] হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবীল হুযাইল (রহ) বলেন- হযরত দানিয়াল (আ) বুখত নসরের যুলুম ও অন্যায় কাজকর্ম দেখে কাঁদতে লাগলেন এবং বললেন-
بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِينَا، وَبِالْعَارِ الَّذِي أَتَيْنَا سَلَّطْتَ عَلَيْنَا مَنْ لَا يَعْرِفُكَ وَلَا يَرْحَمُنَا
এই সবকিছু আমাদের কৃতকর্মের বিপদ এবং আমাদের দোষ-ত্রুটির কারণে যা আমরা করেছি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের উপর এমন ব্যক্তিকে নিয়োজিত করেছেন, যে না আপনাকে চিনে আর না আমাদের প্রতি দয়া করে।
[২৯] হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবীল হুযাইল (রহ) থেকেই বর্ণিত। তিনি বলেন- বুখত নসর হযরত দানিয়াল (আ) কে বললেন-
مَا الَّذِي سَلَّطَنِي عَلَى قَوْمِكَ
আমি তোমার সম্প্রদায়ের উপর কেন চড়াও হয়েছি (তা বলতে পার কি)?
দানিয়াল (আ) বললেন-
عِظَمُ خَطِيئَتِكَ، وَظُلْمُ قَوْمِي أَنْفُسَهُمْ
একে তো তোমার গুনাহ ও পাপই অনেক বড়। দ্বিতীয়ত আমার সম্প্রদায়ও নিজেদের উপর যুলুম (গুনাহ ও পাপ) করেছে।
বাদশাহদের বাদশাহ
[৩০] হযরত মালিক ইবনে দীনার (রহ) বলেন, আমি হিকমতের কথাসমূহের মধ্যে পড়েছি যে, আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
أَنَا مَلِكُ الْمُلُوكِ، قُلُوبُ الْمُلُوكِ بِيَدِي، فَمَنْ أَطَاعَنِي جَعَلْتُهُمْ عَلَيْهِ رَحْمَةً، وَمَنْ عَصَانِي جَعَلْتُهُمْ عَلَيْهِ نِقْمَةً، وَلَا تَشْغَلُوا أَنْفُسَكُمْ بِسَبِّ الْمُلُوكِ، وَلَكِنْ تُوبُوا إِلَيَّ أُعَطِّفْهُمْ عَلَيْكُمْ
নিশ্চয়ই আমি বাদশাহদের বাদশাহ। বাদশাহদের অন্তর আমার নিয়ন্ত্রণে। অতএব যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করবে আমি তার জন্য তাদেরকে রহমতের কারণ বানিয়ে দেব। আর যে আমার নাফরমানী করবে তার জন্য আমি তাদেরকে শাস্তি ও কষ্টের কারণ বানিয়ে দিব। আর তোমরা বাদশাহদের পরিবর্তে আমার সাথে সম্পর্ক কায়েম কর, তাহলে আমি নিজে তাদেরকে তোমাদের প্রতি দয়ার্দ্র করে দিব।
আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি
[৩১] হযরত হাসান (রহ) বলেন-
إِذَا أَرَادَ اللَّهُ تَعَالَى بِقَوْمٍ خَيْرًا جَعَلَ أَمْرَهُمْ إِلَى حُلَمَائِهِمْ، وَفَيْأَهُمْ عِنْدَ سُمَحَائِهِمْ، وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ شَرًّا جَعَلَ أَمْرَهُمْ إِلَى سُفَهَائِهِمْ، وَفَيْأَهُمْ عِنْدَ بُخَلَائِهِمْ
যখন আল্লাহ তাআলা কোন সম্প্রদায়ের কল্যাণ কামনা করেন, তখন তাদের বিষয়াদি বুঝমান লোকদের হাতে অর্পণ করেন আর ধন-সম্পদ তাদের মধ্যে দানশীলদেরকে দান করেন। আর যখন আল্লাহ তাআলা কোন সম্প্রদায়ের জন্য অকল্যাণের ফয়সালা করেন, তখন তাদের বিষয়াদি মূর্খ ও বেকুফ লোকদের হাতে অর্পণ করেন আর ধন-সম্পদ তাদের মধ্যে কৃপণদের করায়ত্ত করে দেন।
[৩২] হযরত কাতাদাহ (রহ) বলেন- হযরত মূসা বিন ইমরান (আ) আল্লাহর নিকট আরয করলেন-
يَا رَبِّ، أَنْتَ فِي السَّمَاءِ وَنَحْنُ فِي الْأَرْضِ، فَمَا عَلَامَةُ غَضَبِكَ مِنْ رِضَاكَ؟
হে রব! আপনি আসমানে আর আমরা যমীনে। আপনার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির আলামত কি (তা কিভাবে বুঝব)?
আল্লাহ তাআলা বললেন-
إِذَا اسْتَعْمَلْتُ عَلَيْكُمْ خِيَارَكُمْ فَهُوَ عَلَامَةُ رِضَايَ عَلَيْكُمْ، وَإِذَا اسْتَعْمَلْتُ عَلَيْكُمْ شِرَارَكُمْ فَهُوَ عَلَامَةُ سَخَطِي عَلَيْكُمْ
যখন আমি তোমাদের মধ্যে উত্তম লোকদেরকে শাসক মনোনীত করি তখন বুঝবে তা আমার সন্তুষ্টির আলামত। আর যখন আমি তোমাদের মধ্যে নিকৃষ্ট লোকদেরকে শাসক নির্ধারণ করি তখন বুঝবে তা আমার অসন্তুষ্টির আলামত।
[৩৩] হযরত ফুযায়ল ইবনে আয়ায (রহ) বলেন- আল্লাহ তাআলা তার কোন এক নবীর প্রতি ওহী নাযিল করে বললেন-
إِذَا عَصَانِي مَنْ يَعْرِفُنِي سَلَّطْتُ عَلَيْهِ مَنْ لَا يَعْرِفُنِي
যখন এমন কোন ব্যক্তি আমার নাফরমানী করে যে আমাকে চিনে ও জানে। অর্থাৎ যার আমার মা’রিফাত ও নৈকট্য লাভ হয়েছে- তখন আমি তার জন্য এমন ব্যক্তিকে নিয়োজিত করি যে আমাকে চিনে না।
কিয়ামতের আলামত
[৩৪] হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَبْعَثَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ أُمَرَاءَ كَذَبَةً، وَوُزَرَاءَ فَجَرَةً، وَأَعْوَانًا خَوَنَةً، وَعُرَفَاءَ ظَلَمَةً، وَقُرَّاءً فَسَقَةً، سِيمَاهُمْ سِيمَاءُ الرُّهْبَانِ، قُلُوبُهُمْ أَنْتَنُ مِنْ جِيفَةٍ، أَهْوَاؤُهُمْ مُخْتَلِفَةٌ، فَيَفْتَحُ اللَّهُ لَهُمْ فِتْنَةً غَبْرَاءَ مُظْلِمَةً، فَيَتَهَاوَكُونَ فِيهَا كَتَهَاوُكِ الْيَهُودِ. وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَيَنْتَقِضَنَّ عُرَى الْإِسْلَامِ عُرْوَةً عُرْوَةً، حَتَّى لَا يُقَالُ: اللَّهُ اللَّهُ. لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ، أَوْ لَيُسَلِّطَنَّ اللَّهُ عَلَيْكُمْ شِرَارَكُمْ، فَلَيَسُومُونَّكُمْ سُوءَ الْعَذَابِ، ثُمَّ يَدْعُو خِيَارُكُمْ فَلَا يُسْتَجَابُ لَهُمْ. لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ، أَوْ لَيَبْعَثَنَّ اللَّهُ عَلَيْكُمْ مَنْ لَا يَرْحَمُ صَغِيرَكُمْ وَلَا يُوَقِّرُ كَبِيرَكُمْ، وَمَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيُوَقِّرْ كَبِيرَنَا فَلَيْسَ مِنَّا
সেই সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ! সেই সময় পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না- যে পর্যন্ত না মিথ্যুক শাসক, ফাসিক মন্ত্রী, কুচক্রী সাহায্যকারী, যালিম অফিসার বা পরিদর্শক, বদকার (আলেম ও) কারী না হবে। তাদের বিশেষ আলামত হলো তারা হবে বৈরাগীদের মত। তাদের অন্তর মূর্দার থেকেও বেশী দুর্গন্ধযুক্ত হবে। তাদের আসক্তি ও চাহিদা বিভিন্ন ধরণের হবে। আল্লাহ তাআলা তাদের দিকে অন্ধকার ও সংকীর্ণ ধরণের ফিতনা চাপিয়ে দিবেন। এর মধ্যে তারা হয়রান পেরশোন হয়ে যাবে যেমনিভাবে ইহুদিরা হয়রান পেরেশান আছে।
আর কসম সেই সত্তার! যার হাতে আমার প্রাণ! ইসলামের রুকনগুলো একটি একটি করে ফিরে আসবে- যে পর্যন্ত আল্লাহ আল্লাহ বলা না হবে। তোমরা অবশ্যই নেককাজের আদেশ কর আর অসৎ কাজ থেকে নিষেধ কর- অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের উপর নিকৃষ্ট লোকদেরকে চাপিয়ে দিবেন যারা তোমাদেরকে অসহনীয় কষ্ট প্রদান করবে। এরপর তোমাদের নেক লোকেরা দুআ করবে, আর তাদের দুআ কবুল করা হবে না। তোমরা অবশ্যই নেককাজের আদেশ কর আর অসৎ কাজ থেকে নিষেধ কর- অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের উপর এমন লোকদেরকে চাপিয়ে দিবেন, যে তোমাদের ছোটদের প্রতি দয়া করবে না আর বড়দেরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করবে না। আর যে আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া করে না আর বড়দেরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে না সে আমাদের (মুসলমানদের) অন্তর্ভূক্ত নয়।
কয়েকটি গুনাহ ও তার কুফল
[৩৫] হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
مَا طَفَّفَ قَوْمٌ كَيْلًا، وَلَا بَخَسُوا مِيزَانًا، إِلَّا مَنَعَهُمُ اللَّهَ الْقَطْرَ،
وَمَا ظَهَرَ فِي قَوْمٍ الزِّنَا إِلَّا ظَهَرَ فِيهِمُ الْمَوْتُ،
وَمَا ظَهَرَ فِي قَوْمٍ الرِّبَا إِلَّا سَلَّطَ اللَّهُ تَعَالَى عَلَيْهِمُ الْجُنُونَ،
وَمَا ظَهَرَ فِي قَوْمٍ الْقَتْلُ، فَقَتَلَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا، إِلَّا سَلَّطَ اللَّهُ تَعَالَى عَلَيْهِمْ عَدُوَّهُمْ،
وَمَا ظَهَرَ فِي قَوْمٍ عَمَلُ قَوْمِ لُوطٍ إِلَّا وَظَهَرَ فِيهِمُ الْخَسْفُ،
وَمَا تَرَكَ قَوْمٌ الْأَمْرَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْيَ عَنِ الْمُنْكَرِ إِلَّا لَمْ تُرْفَعْ أَعْمَالُهُمْ، وَلَمْ يُسْمَعْ دُعَاؤُهُمْ
যে সম্প্রদায় মাপে কম দেয় ও ওজনে কম করে, আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য বৃষ্টি বন্ধ করে দেন।
আর যে সম্প্রদায়ের মধ্যে অশ্লিলতা ও কুকর্ম বৃদ্ধি পায়, তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেড়ে যায়।
আর যে সম্প্রদায়ের মধ্যে সুদী লেনদেন বেড়ে যায় আল্লাহ তাদের মধ্যে পাগলামী ও মস্তিষ্ক বিকৃতী বৃদ্ধি করে দেন।
আর যে সম্প্রদায়ের মধ্যে হত্যা ও খুন খারাবী বেড়ে যায়, তখন তাদের উপর আল্লাহ তাআলা তাদের দুশমনদেরকে চাপিয়ে দেন।
আর যে সম্প্রদায়ের মধ্যে লূত (আ) এর সম্প্রদায়ের কাজ (পুঃমৈথুন) হতে থাকে, তাদের মধ্যে ভূমিধ্বস হওয়া ব্যাপক হয়ে যায়।
আর যে সম্প্রদায় সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ পরিত্যাগ করে তাদের আমল ও কাজকর্মের উন্নতি হয় না এবং তাদের দুআ কবুল হয় না।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ বিষয়ক হাদিস
[৩৬] হযরত আয়িশা (রা) বলেন- একবার রাসূলুল্লাহ (সা) আমার নিকট এমন অবস্থায় আগমন করলেন যে, তার শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হচ্ছিল। তিনি এসে কোন কথা বললেন না। এরপর তিনি ওযু করলেন এবং বাহিরে বের হলেন। আমি হুজরায় বসা ছিলাম। তিনি মিম্বরে উঠে আল্লাহর হামদ ও সানা পাঠ করে বললেন-
أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ لَكُمْ: مُرُوا بِالْمَعْرُوفِ، وَانْهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ، قَبْلَ أَنْ تَدْعُونِي فَلَا أُجِيَبُكُمْ، وَتَسْأَلُونِي فَمَا أُعْطِيكُمْ، وَتَسْتَنْصِرُونِي فَلَا أَنْصُرُكُمْ
লোকসকল! আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে বলেছেন যে, তোমরা নেককাজের আদেশ কর আর অসৎ কাজ থেকে নিষেধ কর- সেই সময় আসার পূর্বে যখন তোমরা আমার কাছে দুআ করবে আর আমি তোমাদের দুআ কবুল করব না। তোমরা আমার কাছে চাইবে আর আমি দান করব না। তোমরা আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে আর আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব না।
[৩৭] হযরত ফুযায়ল ইবনে আয়ায (রহ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
إِذَا عَظَّمَتْ أُمَّتِي الدُّنْيَا نُزِعَتْ مِنْهَا هَيْبَةُ الْإِسْلَامِ، وَإِذَا تَرَكَتِ الْأَمْرَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْيَ عَنِ الْمُنْكَرِ حُرِمَتْ بَرَكَةَ الْوَحْيِ
যখন আমার উম্মত দুনিয়াকে বড় ভাবতে থাকবে, তখন ইসলামের ভাব-মর্যাদা বের করে নেওয়া হবে। আর যখন সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ পরিত্যাগ কেরবে, তখন ওহীর বরকত থেকে বঞ্চিত হবে।
হযরত আবু ইসহাক (রহ) বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন আমল উত্তম? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য কারো কল্যাণকামী হওয়া। অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হলো, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এর মর্তবা কতটুকু? তিনি বললেন, এটা হলো জিহাদ।
[৩৮] হযরত আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল আযীয উমরী (রহ) বলেন-
إِنَّ مِنْ غَفْلَتِكَ عَنْ نَفْسِكَ إِعْرَاضُكَ عَنِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ بِأَنْ تَرَى مَا يُسْخِطُهُ فَتُجَاوِزُهُ، لَا تَأْمُرُ فِيهِ وَلَا تَنْهَى؛ خَوْفًا مِمَّنْ لَا يَمْلِكُ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا
আল্লাহর প্রতি তোমাদের পরন্মুখতা তোমাদের নফসের গাফলতী ব্যতীত আর কিছু নয় যে, তোমরা তার অসন্তুষ্টি জেনেও এমন লোকের কারণে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ থেকে বিরত থাক, যে লাভ-ক্ষতির মালিক নয়।
তিনি আরো বলেন-
مَنْ تَرَكَ الْأَمْرَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْيَ عَنِ الْمُنْكَرِ مِنْ مَخَافَةِ الْمَخْلُوقِينَ نُزِعَتْ مِنْهُ هَيْبَةُ الطَّاعَةِ، فَلَوْ أَمَرَ وَلَدَهُ أَوْ بَعْضَ مَوَالِيهِ لَاسْتَخَفَّ بِهِ
যে ব্যক্তি সৃষ্টজীবের ভয়ে নেককাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ পরিত্যাগ করে, তবে তার আনুগত্যের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। এর ফলে এমন হয় যে, সে তার সন্তান অথবা অধীনস্থকে কোন কাজের নির্দেশ দিলে তারা তার গুরুত্ব দেয় না।
[৩৯] হযরত কায়েস বিন আবু হাতিম বলেন, একবার হযরত আবু বকর (রা) এই আয়াত পাঠ করেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لَا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ
হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের চিন্তা কর। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও, তবে যে ভ্রান্ত পথে রয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।–সূরা মায়িদা:১০৫
এবং বলেন- লোকেরা এই আয়াতটির যথাযথ অর্থ করতে পারে না। অথচ আমি রাসূলুল্লাহ (সা) বেলতে শুনেছি-
إِنَّ الْقَوْمَ إِذَا رَأَوُا الظَّالِمَ فَلَمْ يَأْخُذُوا عَلَى يَدَيْهِ، أَوِ الْمُنْكَرَ فَلَمْ يُغَيِّرُوهُ، عَمَّهُمُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ بِعِقَابِهِ
যে সম্প্রদায় কোন যালিমের যুলুম দেখেও তার হাতকে বাধা দেয় না অথবা কোন অন্যায় ও পাপ কাজ দেখেও তা প্রতিরোধ করে না, তবে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তার শাস্তিতে নিপতিত করবেন।
[৪০] হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন-
إِذَا خَفِيَتِ الْخَطِيئَةُ لَمْ تَضُرَّ إِلَّا صَاحِبَهَا، فَإِذَا ظَهَرَتْ فَلَمْ تُغَيَّرْ ضَرَّتِ الْعَامَّةَ
যখন গুনাহ গোপনে হয় তখন তার ক্ষতি শুধু তার নিজের পর্যন্তই পৌছে। আর যখন গুনাহ প্রকাশ্যে হয়, তখন তার অনিষ্ট সকল মানুষ পর্যন্ত পৌছে।
যখন শুধু নিজের চিন্তা করতে হবে
[৪১] হযরত আবু উমাইয়া শায়বানী (রহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন- আমি আবু সালাবা খুশানী (রহ) এর কাছে এসে তাকে বললাম, এই আয়াতটির অন্তর্নিহিত মর্ম কি? তিনি বললেন, কোন আয়াতের মর্ম জিজ্ঞাসা করছ? আমি বললাম, আল্লাহর এই বাণীর মর্ম-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لَا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ
হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের চিন্তা কর। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও, তবে যে ভ্রান্ত পথে রয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।–সূরা মায়িদা:১০৫
তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! তুমি এমন লোকের কাছে প্রশ্ন করেছ, যে এই ব্যাপারে অবগত আছে। আমি এই বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছেন-
بَلِ ائْتَمِرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَتَنَاهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ، حَتَّى إِذَا رَأَيْتَ شُحًّا مُطَاعًا، وَهَوًى مُتَّبَعًا، وَدُنْيَا مُؤْثَرَةً، وَإِعْجَابَ كُلِّ ذِي رَأْيٍ بِرَأْيِهِ، فَعَلَيْكَ بِنَفْسِكَ، وَدَعْ عَنْكَ أَمْرَ الْعَوَامِّ؛ فَإِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ أَيَّامَ الصَّبْرِ، صَبْرٌ فِيهِنَّ مِثْلُ قَبْضٍ عَلَى الْجَمْرِ، لِلْعَامِلِ مِنْهُمْ مِثْلُ أَجْرِ خَمْسِينَ رَجُلًا يَعْمَلُونَ عَلَى مِثْلِ عَمَلِهِ
বরং তোমরা সৎকাজের আদেশ করতে থাক আর অন্যায় কর্ম থেকে নিবৃত করতে থাক। শেষে যখন দেখতে পাবে কৃপণতা ও লালসার আনুগত্য করা হচ্ছে, প্রবৃত্তির অনুসরন করা হচ্ছে, দুনিয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, প্রত্যেকেই নিজের মতকে সর্বোত্তম মনে করছে- তখন তুমি নিজেকে নিয়েই থেকো (নিজের চিন্তা কর), সাধারণের চিন্তা ছেড়ে দিও। তোমাদের পরবর্তীতে এমন যুগ আসছে, যে যুগে (দীনের উপর) ধৈর্য ধরে থাকা জ্বলন্ত অঙ্গার হাতে রাখার মত কষ্টদায়ক হবে। ঐ যুগে যে দীনের উপর আমল করবে তার প্রতিদান হবে পঞ্চাশজন লোকের আমলকারীর অনুরূপ।
অপর এক বর্ণনাকারী এই রিওয়ায়াতে আরো উল্লেখ করেছেন যে, বলা হল : ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আমাদের পঞ্চাশ জনের, না তাদের পঞ্চাশ জনের ছওয়াব হবে? তিনি (সা) বললেন, সেই প্রতিদান তোমাদের মত পঞ্চাশ জনের সমান হবে।
[৪২] হযরত সাহল ইবনে আস সায়িদী বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) কে বলেন-
كَيْفَ بِكَ إِذَا بَقِيتَ فِي حُثَالَةٍ مِنَ النَّاسِ قَدْ مَرِجَتْ عُهُودُهُمْ وَأَمَانَاتُهُمْ، فَاخْتَلَفُوا فَصَارُوا هَكَذَا؟
ঐ সময় তোমার অবস্থা কেমন হবে, যখন তুমি নিকৃষ্ট লোকদের মাঝেই অবস্থান করবে, তাদের আমানত ও অঙ্গিকার বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তারা সদম্ভ আচরণকারী হবে?
এটা বলে তিনি তার আঙ্গুলগুলো পরস্পর ফাঁকে ঢুকালেন। তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বলেন, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করলেন-
اعْمَلْ بِمَا تَعْرِفُ، وَدَعْ مَا تُنْكِرُ، وَإِيَّاكَ وَالتَّلَوُّنَ فِي دِينِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَعَلَيْكَ بِخَاصَّةِ نَفْسِكَ، وَدَعْ عَوَامَّهُمْ
নেককাজ করতে থাকবে আর মন্দ কাজ থেকে বাঁচবে। আর আল্লাহর দীনের ব্যাপারে বহুরুপি অবস্থা থেকে বাঁচবে। আর নিজের সংশোধনেরই চিন্তা করবে এবং লোকদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেঁড়ে দেবে।
নেক লোকদের দুর্বলতা ও মন্দ লোকদের আধিপত্য
[৪৩] হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
إِذَا اتُّهِمَ الْأَمِينُ، وَائْتُمِنَ غَيْرُ الْأَمِينِ، وَكُذِّبَ الصَّادِقُ، وَصُدِّقَ الْكَاذِبُ، أَنَاخَ فِيهِمُ الشُّرْفُ الْجُرُفُ» ، قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَمَا الشُّرْفُ الْجُرُفُ؟ قَالَ: «فِتَنٌ كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ»
যখন আমানতদার ব্যক্তিকে অপবাদ দেয়া হবে এবং আমনতদার নয় এমন ব্যক্তির নিকট আমানত রাখা হবে। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলা হবে। তখন তাদের নিকট কালো বৃদ্ধা উটনীসমূহ এসে বসবে। আমরা আরয করলাম, কালো বৃদ্ধা উটনীসমূহ দ্বারা কি উদ্দেশ্য? তিনি (সা) বললেন, অন্ধকার রাতের টুকরার মত ফিতনা।
[৪৪] হযরত উমর (রা) বলেন-
تُوشِكُ الْقُرَى أَنْ تَخْرَبَ وَهِيَ عَامِرَةٌ، قِيلَ: كَيْفَ تَخْرَبُ وَهِيَ عَامِرَةٌ؟ قَالَ: إِذَا عَلَا فُجَّارُهَا أَبْرَارَهَا وَسَارَ الْقَبِيلَ مُنَافِقُوهَا
অচীরেই বসতীসমূহ বিরান হয়ে যাবে। যদিও বাহ্যত তা আবাদ মনে হবে। কেউ জিজ্ঞাসা করল তা কিভাবে? তিনি বললেন, যখন পাপাচারী লোকেরা নেক লোকদের উপর প্রবল হয়ে যাবে। গোত্রের সর্দার হয়ে যাবে সেই বসতীর মুনাফিক লোকেরা।
[৪৫] হযরত হাসান বিন আতিয়্যাহ (রহ) বলেন, নবী কারিম (সা) ইরশাদ করেন-
سَيَظْهَرُ شِرَارُ أُمَّتِي عَلَى خِيَارِهِمْ، حَتَّى يُسْتَحْقَرَ الْمُؤْمِنُ فِيهِمْ كَمَا يُسْتَحْقَرُ الْمُنَافِقُ مِنَّا الْيَوْمَ
অচীরেই আমার উম্মতের মন্দ লোকেরা ভাল লোকদের উপর আধিপত্য বিস্তার করবে। এমনকি একজন মুমিনকে এমনভাবে তুচ্ছজ্ঞান করা হবে, যেমন আজ তোমাদের মধ্যে মুনাফিকদের তুচ্ছজ্ঞান করা হয়।
[৪৬] হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
يَأْتِي زَمَانٌ يَذُوبُ فِيهِ قَلْبُ الْمُؤْمِنِ كَمَا يَذُوبُ الْمِلْحُ فِي الْمَاءِ» ، قَالَ: مِمَّ ذَاكَ؟ قَالَ: «مِنَ الْمُنْكَرِ لَا يَسْتَطِيعُ يُغَيِّرُهُ
এমন এক সময় আসবে যখন মুমিনের অন্তর (অপারগতার কারণে অন্তরের তিক্ততা) এমনভাবে খুলবে যেভাবে লবণ পানিতে মিশে যায়। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এর কারণ কি হবে? তিনি (সা) বললেন, এমন অবস্থা হবে মন্দ (কাজ দেখে সেই) কাজে বাধা দেওয়ার শক্তি না থাকার কারণে।
যখন মানুষ অপরাধীকে অপরাধী বলতে ভয় করবে
[৪৭] হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
إِذَا رَأَيْتَ أُمَّتِي تَهَابُ الظَّالِمَ أَنْ تَقُولَ: إِنَّكَ ظَالِمٌ، فَقَدْ تُوُدِّعَ مِنْهُمْ
যখন দেখবে আমার উম্মত যালিম লোককে যালিম বলতে ভয় করে, তখন তাদেরকে (ফিতনার মধ্যে) ছেড়ে দেয়া হবে।
শক্তি থাকা সত্বেও পাপকাজ দমন না করার শাস্তি
[৪৮] হযরত জারির (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ قَوْمٍ يَكُونُ بَيْنَ ظَهْرَانَيْهِمْ مَنْ يَعْمَلُ مَعَاصِيَ اللَّهِ، فَقَدِرُوا عَلَى أَنْ يَنْهَوْهُ وَلَمْ يَنْهَوْهُ، إِلَّا عَمَّهُمُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ مِنْهُ بِعِقَابٍ»
যেই সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন ব্যক্তি বর্তমান থাকে, যে আল্লাহর নাফরমানীর মধ্যে নিয়োজিত আছে। আর তারা তাকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়েও তা থেকে নিষেধ করে না, তবে আল্লাহ তাআলা তাদের সবাইকে তার শাস্তিতে পাকড়াও করবেন।
[৪৯] হযরত আবু রুকাদ (রহ) বলেন, আমি আমার মণিবের সাথে বের হয়ে হযরত হুযায়ফা (রা) নিকট পৌছলাম। তখন তিনি বললেন-
إِنْ كَانَ الرَّجُلُ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَيَصِيرُ بِهَا مُنَافِقًا، وَإِنِّي لَأَسْمَعُهَا الْيَوْمَ فِي الْمَقْعَدِ الْوَاحِدِ أَرْبَعَ مَرَّاتٍ، لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ وَلَتَحَاضُّنَّ عَلَى الْخَيْرِ، أَوْ لَيُسْحِتَنَّكُمُ اللَّهُ تَعَالَى جَمِيعًا بِعَذَابٍ، أَوْ لَيُؤَمِّرَنَّ عَلَيْكُمْ شِرَارَكُمْ، ثُمَّ يَدْعُو خِيَارُكُمْ فَلَا يُسْتَجَابُ لَهُمْ
রাসূলুল্লাহ (সা) এর যুগে যে কথা একবার বললে মুনাফিক সাব্যস্ত হত, আজ আমি একই মজলিসে সেই ধরণের কথা চারবার শুনি। তোমরা অবশ্যই নেককাজের আদেশ এবং মন্দ কাজে নিষেধ করতে থাক এবং কল্যাণকর কাজে (একে) অপরকে উদ্দীপিত করতে থাক। অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের সবাইকে শাস্তি দিয়ে নিঃশেষ করে দিবেন অথবা নিকৃষ্ট কোন লোককে শাসক বানিয়ে দেবেন। এরপর তোমাদের নেক লোকেরা দুআ করবে আর তাদের দুআ কবুল করা হবে না।
হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ সম্পর্কিত রিওয়ায়াত
[৫০] হযরত মালিক ইবনে দীনার (রহ) বলেন- আমি হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফকে এটা বলতে শুনেছি যে,
اعْلَمُوا أَنَّكُمْ كُلَّمَا أَحْدَثْتُمْ ذَنْبًا أَحْدَثَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ سُلْطَانِكُمْ عُقُوبَةً
জেনে রাখ যে, যখনই তুমি গুনাহ করবে, তখন আল্লাহ তাআলা তোমার শাসক বা উর্দ্ধতন লোকের মাধ্যমে তার শাস্তি প্রদানের অবস্থা সৃষ্টি করবেন।
[৫১] হযরত বিশর ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহ) বলেন-
قِيلَ لِلْحَجَّاجِ: إِنَّكَ تَفْعَلُ وَتَفْعَلُ؟ قَالَ: أَنَا نِقْمَةٌ بُعِثْتُ عَلَى أَهْلِ الْعِرَاقِ
কেউ হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফকে বলল, তুমি এই করেছ এই করেছ অর্থাৎ যুলুম ও বাড়াবাড়ি করেছ। তখন সে বলল- আমি হলাম এক আযাব ও শাস্তি যাকে ইরাকবাসীদের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে।
[৫২] হযরত মালিক ইবনে দীনার (রহ) বলেন- আমি হযরত হাসান বসরী (রহ) কে বলতে শুনেছি-
إِنَّ الْحَجَّاجَ عُقُوبَةٌ مِنَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ لَمْ تَكُ؛ فَلَا تَسْتَقْبِلُوا عُقُوبَةَ اللَّهِ بِالسَّيْفِ، وَلَكِنِ اسْتَقْبِلُوهَا بِتَوْبَةٍ وَتَضَرُّعٍ وَاسْتِكَانَةٍ، وَتُوبُوا تُكْفَوْهُ
হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ আল্লাহর প্রেরিত এক আযাব। সুতরাং তোমরা আল্লাহর এই আযাবের মুকাবিলা তলোয়ার বা অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা করো না। বরং (আল্লাহর নিকট) তওবা-ইস্তিগফার, তাওয়াযু ও বিনয়-নম্রতা দ্বারা তার মুকাবিলা কর এবং (গুনাহ ও পাপ থেকে) তওবা কর। তাহলে নাজাত পাবে।
শাসক আল্লাহর অধীনস্থ
[৫৩] হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা) বলেন-
الْوَالِي. . . اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ. . . الْمَوْلَى عَلَيْهِ. . . اللَّهُ، فَاحْذَرُوا كُرْهَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ
ওয়ালী বা শাসক আল্লাহর অধীনস্থ রক্ষাকারী হয়। অতএব তোমরা আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে বাঁচ। (তাহলে তিনি তোমাদের রক্ষা করবেন)।
[৫৪] হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
لَنْ تَهْلِكَ الرَّعِيَّةُ وَإِنْ كَانَتْ ظَالِمَةً مُسِيئَةً إِذَا كَانَتِ الْوُلَاةُ هَادِيَةً مَهْدِيَّةً، وَلَكِنْ تَهْلِكُ الرَّعِيَّةُ وَإِنْ كَانَتْ هَادِيَةً مَهْدِيَّةً إِذَا كَانَتِ الْوُلَاةُ ظَالِمَةً مُسِيئَةً
জনগণ ধ্বংস হবে না যদিও তারা যালিম ও পাপী হয়- যে পর্যন্ত তাদের শাসক পথপ্রদর্শক ও পথপ্রাপ্ত হয়। আর জনগণ ধ্বংস হবে না যদিও তাদের শাসক যালিম ও পাপী হয়- যে পর্যন্ত তারা পথপ্রদর্শক ও পথপ্রাপ্ত হয়।
যখন গুনাহ প্রকাশ্যে হয়
[৫৫] হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহ) বলেন-
إِنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى لَا يُعَذِّبُ الْعَامَّةَ بِذَنْبِ الْخَاصَّةِ، وَلَكِنْ إِذَا عُمِلَ الْمُنْكَرُ جِهَارًا اسْتَحَقُّوا الْعُقُوبَةَ كُلُّهُمْ
আল্লাহ তাআলা বিশেষ কোন লোকের গুনাহর কারণে সকলকে শাস্তি প্রদান করেন না। তবে গুনাহ যখন প্রকাশ্যে হওয়া শুরু করে তখন সবাইকে শাস্তিতে নিপতিত করেন।
[৫৬] হযরত আদি ইবনে আদি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন- রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَا يُعَذِّبُ الْعَامَّةَ بِعَمَلِ الْخَاصَّةِ حَتَّى تَكُونَ الْعَامَّةُ تَسْتَطِيعُ أَنْ تُغَيِّرَ عَلَى الْخَاصَّةِ، فَإِذَا لَمْ تُغَيِّرِ الْعَامَّةُ عَلَى الْخَاصَّةِ عَذَّبَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ الْعَامَّةَ وَالْخَاصَّةَ
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা কোন বিশেষ লোকের কৃতকর্মের জন্য সকলকে শাস্তি প্রদান করেন না, যে পর্যন্ত না অন্যরা তা প্রতিহত করার শক্তি রাখে। কিন্তু যখন (তারা বাধা দেওয়ার শক্তি থাকা সত্বেও) বাধা প্রদান না করে, তখন আল্লাহ তাআলা সবাইকে শাস্তি প্রদান করেন।
অবস্থা পরিবর্তন
[৫৭] হযরত ইবরাহিম (রহ) বলেন-
أُوحِيَ إِلَى نَبِيٍّ مِنَ الْأَنْبِيَاءِ، أَنْ قُلْ لِقَوْمِكَ: إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِ قَرْيَةٍ، وَلَا أَهْلِ بَيْتٍ، وَلَا رَجُلٍ، يَكُونُونَ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ عَلَى طَاعَةٍ فَيَتَحَوَّلُونَ مِنْهَا إِلَى مَعْصِيَةٍ، إِلَّا تَحَوَّلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ مِمَّا يُحِبُّونَ إِلَى مَا يَكْرَهُونَ، وَلَيْسَ مِنْ أَهْلِ قَرْيَةٍ، وَلَا أَهْلِ بَيْتٍ، وَلَا رَجُلٍ، يَكُونُونَ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ عَلَى مَعْصِيَةٍ فَيَتَحَوَّلُونَ مِنْهَا إِلَى طَاعَةٍ، إِلَّا تَحَوَّلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ مِمَّا يَكْرَهُونَ إِلَى مَا يُحِبُّونَ، وَقُلْ لِقَوْمِكَ يَعْمَلُوا وَلَا يَتَّكِلُوا؛ فَإِنَّهُ لَيْسَ مِنْ خَلْقِي. . . لِلْحِسَابِ إِلَّا حَقَّ عَلَيْهِ الْعَذَابُ
পূর্ববর্তী নবীদের মধ্য থেকে একজন নবীর প্রতি ওহী করা হয় যে- নিজের সম্প্রদায়কে বলে দাও, যারা আল্লাহ তাআলার আনুগত্য পরিত্যাগ করে তার নাফরমানি ও পাপে লিপ্ত হয়- চাই সে পল্লির অধিবাসী হোক অথবা গৃহে বসবাসকারী অথবা সাধারণ কোন ব্যক্তি। তখন আল্লাহ তাদের জন্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অবস্থাকে দুঃখ-কষ্টের অবস্থা দ্বারা পরিবর্তন করে দেন।
আর যারা আল্লাহ তাআলার নাফরমানি ও পাপ কাজ পরিত্যাগ করে তার আনুগত্যে লিপ্ত হয়- চাই সে পল্লির অধিবাসী হোক অথবা গৃহে বসবাসকারী অথবা সাধারণ কোন ব্যক্তি। তখন আল্লাহ তাদের জন্য দুঃখ-কষ্টের অবস্থাকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দ্বারা পরিবর্তন করে দেন।
আর নিজের সম্প্রদায়কে বলে দাও, তারা যেন আমল করতে থাকে আর এর প্রতি নির্ভর না করে। কেননা আমার সৃষ্টির মধ্যে এমন কতক লোক আছে যাদের জন্য আযাব বা শাস্তি নির্ধারিত হয়ে গেছে।
নেককার ও গুনাহগারদের প্রতি উপদেশ
[৫৮] হযরত আমর ইবনে কায়স আল মুলায়ী বলেন-
أَوْحَى اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَى نَبِيٍّ مِنَ الْأَنْبِيَاءِ: إِنَّ قَوْمَكَ اسْتَخَفُّوا بِحَقِّي، وَانْتَهَكُوا مَعَاصِيَّ، فَقُلْ لِلْمُحْسِنِ مِنْهُمْ فَلَا يَتَكَلَّمُ عَلَى إِحْسَانِهِ، لَا أُقَاصَّ عَبْدًا إِلَى الْحِسَابِ، فَأُقِيمُ عَلَيْهِ عَدْلِي، إِلَّا كَانَ لِي عَلَيْهِ الْفَضْلُ، إِنْ شِئْتُ عَذَّبْتُهُ وَإِنْ شِئْتُ رَحِمْتُهُ. وَقُلْ لِلْمُسِيءِ فَلَا يُلْقِي بِيَدِهِ، فَإِنَّهُ لَنْ يَكْثُرَ عَلَيَّ ذَنْبٌ أَنْ أَغْفِرَهُ إِذَا تَابَ مِنْهُ صَاحِبُهُ كَمَا يَنْبَغِي، إِنَّهُ لَيْسَ مِنِّي مَنْ سَحَرَ أَوْ سُحِرَ لَهُ، أَوْ تَكَهَّنَ أَوْ تُكُهِّنَ لَهُ، إِنَّمَا هُوَ أَنَا وَخَلْقِي، فَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِي فَلْيَدْعُنِي، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِغَيْرِي فَلْيَدْعُ غَيْرِي، إِنَّمَا أَنَا وَخَلْقِي، وَخَلْقِي كُلُّهُ لِي
আল্লাহ তাআলা নবীদের মধ্য থেকে এক নবীর প্রতি এই ওহী প্রেরণ করেন- তোমার সম্প্রদায় আমার অধিকারকে মর্যাদা না দিয়ে আমার নাফরমানী করেছে। অতএব তোমার সম্প্রদায়ের নেক লোকদেরকে বলে দাও যে, তারা যেন নিজ নেকীর প্রতি ভরসা না করে। কেননা হিসাবের জন্য তাদেরকে পেশ করা হবে। তাদের উপর আমার আদল ও ইনসাফ কায়েম হবে। আমার অনুগ্রহ দ্বারাই তারা নাজাত পাবে। আমি চাইলে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করব অথবা অনুগ্রহ ও দয়া করব।
আর গুনাহগারদেরকে বলে দাও যে, তারা যেন নিরাশ না হয়। যদি তারা ঠিকভাবে তওবা করে নেয় তবে আমার মাগফিরাতের উপর তাদের গুনাহ কখনো বেশী হবে না। আর তাদেরকে বলে দাও যে, যে ব্যক্তি যাদু করে অথবা তার জন্য যাদুর কোন কাজ করা হয় অথবা গণনা ও জ্যোতিষের কোন কাজ করে অথবা তার জন্য গণনা ও জ্যোতিষের কোন কাজ করা হয়- তবে তার সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নাই। অতএব যে ব্যক্তি আমার প্রতি ইমান রাখে তার উচিত আমার কাছেই চাওয়া। আর যে ব্যক্তি অন্যের প্রতি ইমান রাখে তার উচিত তার কাছেই চাওয়া- যেখানে সকল মাখলুক আমারই অধীন।
আরমিয়া (আ) এর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ
[৫৯] হযরত আব্দুর রহমান ইবনে যিয়াদ বলেন- আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাইলের এক নবী যার নাম হযরত আরমিয়া (আ) ছিল- তার প্রতি ওহি প্রেরণ করেন যে, তুমি তোমার সম্প্রদায়ের সামনে দাড়াও। তারা এমন সম্প্রদায়- যাদের অন্তর আছে কিন্তু তার দ্বারা তারা অনুধাবন করে না। তাদের চোখ আছে কিন্তু তার দ্বারা তারা দেখে না। তাদের কান আছে কিন্তু তার দ্বারা তারা শোনে না। তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, তারা আমার আনুগত্য করে কি পেয়েছে? আর তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর যে, আমার আনুগত্য করে কেউ কি দুর্ভাগা হয়েছে? অথবা কোন ব্যক্তি আমার নাফরমানী করে কি সৌভাগ্যবান হতে পেরেছে? গবাদি পশুর অবস্থা তো এমন যে, যখন তাদের বাড়ের (খাদ্য ও পানীয় রাখা পাত্র) কথা মনে পড়ে তখন তারা সেখানে ফিরে যায়। কিন্তু তারা এমন সম্প্রদায় যে, তারা সেই কাজ পরিত্যাগ করে যার দ্বারা আমি তাদেরকে ইজ্জত ও সম্মান প্রদান করেছিলাম। আর এর পরিবর্তে তারা ভিন্ন স্থানে ইজ্জত তালাশ করে ফিরে।
তাদের বাদশারা এমন যারা আমার নিয়ামতের নাশোকরী করেছে। আর তাদের আলিমরা এমন যে, তারা আমার প্রদত্ত সেইসব জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারা কোন উপকৃত হয়নি যা তারা অর্জন করেছিল। তারা তাদের অন্তরে পঙ্কিলতাকে জমা করেছে। নিজেদের যবানকে মিথ্যার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। অতএব আমার ইজ্জত ও প্রতাপের কসম! তাদের প্রতি আমি এমন সৈন্য মোতায়েন করব যারা তাদের চেহারাকে চিনবে না, তাদের ভাষা বুঝবে না। আর না তারা তাদের ক্রন্দন ও বিলাপের প্রতি রহম করবে। আমি তাদের প্রতি রামসিয়া ঘোড়া চাপিয়ে দিব। তাদের সৈন্যবাহিনীর বহর হবে মেঘমালার মত। তাদের অশ্ববাহিনীর আক্রমণ হবে ঈগল পাখির ছোবলের ন্যায়। তাদের পতাকার শব্দ ধ্বনি শোনা যাবে শকুন পালের উড্ডয়নের ধ্বনির ন্যায়। তারা নগরসমূহকে ধ্বংস করবে এবং পল্লিগুলোকে করবে বিরান। হায় আফসোস! ঈলিয়া (বায়তুল মুকাদ্দাস) ও তার অধিবাসীদের জন্য। হত্যা ও বন্দীত্বের লাঞ্ছনার রশিতে তাদেরকে আবদ্ধ করা হবে। তাদের খুশিকে দুঃখতে, সম্মানকে লাঞ্ছনায় এবং তৃপ্তিকে ক্ষুধা দ্বারা পরিবর্তন করা হবে। তাদের গোশতকে যমীনের জন্য সার এবং তাদের হাড্ডিকে সূর্যের জন্য পাচক বানিয়ে দেওয়া হবে।
তখন নবী বলল, হে রব! আপনি এই উম্মতকে ধ্বংস করবেন এবং এই শহরকে বরবাদ করবেন অথচ তারা আপনার খলিল ইবরাহিম (আ) এর সন্তান। আপনার মনোনীত মূসা (আ) এর উম্মত। আর আপনার নবী দাউদ (আ) এর সম্প্রদায়। যদি এই উম্মত ধ্বংস হয়ে যায় তবে এরপরে আর কোন উম্মত আপনার অপ্রকাশ্য পাকরাও থেকে বাঁচতে পারবে?
আল্লাহ তাআলা তার প্রতি ওহী পাঠালেন যে, আমি ইবরাহিম, মূসা ও দাউদকে আমার আনুগত্যের জন্য সম্মান দান করেছিলাম। যদি তারাও আমার নাফরমানি করত তবে আমিও তাদেরকে নাফরমানদের কাতারে রাখতাম। দীর্ঘ সময় থেকে আমার নাফরমানী হয়ে আসছে। এমনকি এই অবস্থায় পৌছে গেছে যে, লোকেরা পাহারের উপর, গাছের নিচে এবং জঙ্গলেও পাপাচার শুরু করে দিয়েছে। যখন অমি এই অবস্থা দেখলাম, তখন আসমানকে হুকুম করলাম, আর তা লোহার চাদরে (অনাবৃষ্টি) পরিণত হলো। আর যমীনকে হুকুম করলাম, যমীন পাতিলের মত হয়ে গেল। অতএব না আসমান থেকে বর্ষিত হয় আর না যমীন থেকে কিছু উদ্গত হয়। যদি কিছু উদ্গত হয় তবে টিড্ডি ও পঙ্গপাল তার উপর নিয়েজিত হয়ে যায়। যদি এর সুবাদেও কেউ কোন খাদ্য ইত্যাদি ঘরে নিয়ে যায় তবে এর বরকত বের করে দেওয়া হয়। এরপর তারা দুআ করে আর তাদের দুআ কবুল করা হয় না।
বনী ইসরাইলের দুর্গতি
[৬০] হযরত আবু বকর আইয়াশ (রহ) বলেন-
لَمَّا أَذْنَبَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ، سَلَّطَ اللَّهُ عَلَيْهِمُ الرُّومَ، فَسَبَوْا نِسَاءَهُمْ، فَبَكَى عُزَيْرٌ وَقَالَ: وَلَدُ خَلِيلِكَ إِبْرَاهِيمَ، وَوَلَدُ هَارُونَ وَمُوسَى، عَبِيدٌ لِأَهْلِ مَعْصِيَتِكَ
যখন বনী ইসরাইল আল্লাহর নাফরমানি করল, তখন আল্লাহ তাআলা তাদের উপর রোমানদেরকে চাপিয়ে দিলেন যারা তাদের নারীদেরকে বন্দী বানালেন। তখন হযরত উযায়র (আ) ক্রন্দন করতে লাগলেন এবং বললেন, পরওয়ারদেগার! তারা তোমার খলিল ইবরাহিম (আ) এর সন্তান, হারুন ও মূসা (আ) এর সন্তান আর (অথচ) তোমার নাফরমানদের গুলাম।
[৬১] হযরত মুহাম্মদ আব্দুল আযীয (রহ) বলেন- একবার হযরত আ’মাশ (রহ) একজন গণকের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি তাকে বললেন-
انْظُرُوا إِلَى أَبْنَاءِ الْأَنْبِيَاءِ مَا صَيَّرَتْهُمُ الْمَعَاصِي
নবীদেরে সন্তানদেরকে দেখ (বনী ইসরাইলদের কথা স্মরণ কর), গুনাহ ও পাপ তাদের কি অবস্থা করেছিল।
আল্লাহর সহনশীলতা
[৬২] হযরত ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ (রহ) বলেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন- আমি আমার নাম طَوِيلَ الْحِلْمِ অত্যন্ত সহনশীল রেখেছি। আমি শাস্তি প্রদান করি না, যে পর্যন্ত না আমি রাগান্বিত হই। যে পর্যন্ত প্রকাশ্য পাপাচার না হতে থাকে সে পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।
[৬৩] মুহাম্মদ ইবনে যাকওয়ান (রহ) বলেন-
بَعَثَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ نَبِيًّا إِلَى قَوْمِهِ، فَكَانُوا لَا يَسْتَحْيُونَ مِنْ شَيْءٍ، فَأَوْحَى اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَيْهِ: أَنِ امْشِ بَيْنَهُمْ عُرْيَانًا، فَفَعَلَ، فَقَالُوا: إِنَّكَ قَدْ كُنْتَ تَنْهَانَا عَنْ هَذَا؟ قَالَ: فَأَوْحَى اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَيْهِ أَنْ قُلْ لَهُمْ: إِنَّكُمْ لَسْتُمْ شَيْئًا
আল্লাহ তাআলা এক নবীকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেন। যারা কোন কিছুতেই লজ্জা করত না। আল্লাহ তাআলা ঐ নবীর প্রতি ওহী করলেন যে, তাদের মাঝে বিবস্ত্র হয়ে যাও। তিনি তা করলেন। তখন লোকেরা বলল, আপনি তো আমাদেরকে এর থেকে নিষেধ করতেন? আল্লাহ তাআলা নবীর নিকট ওহী পাঠালেন- তাদেরকে বলে দাও যে, তোমরা কিছুই নও।
[জ্ঞাতব্য: এই বর্ণনাটিও ইসরাইলী। নবীদের মর্যাদা সব ধরণের পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত।]
জীবন-জীবিকায় গুনাহর ক্ষতি
[৬৪] হযরত সাওবান (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন-
إِنَّ الْعَبْدَ لَيُحْرَمُ الرِّزْقَ بِالذَّنْبِ يُصِيبُهُ
নিশ্চয়ই বান্দা গুনাহর কারণে রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়।
[৬৫] হযরত হাসান বসরী (রহ) বলেন-
إِذَا رَأَيْتَ فِي وَلَدِكَ مَا تَكْرَهُ، فَاعْتُبْ رَبَّكَ، فَإِنَّمَا هُوَ شَيْءٌ يُرَادُ بِهِ أَنْتَ
যখন তুমি তোমার সন্তানের চাল-চলনে এমন বিষয় দেখ যা তোমার পছন্দ নয়। তখন তুমি তোমার প্রতিপালককে সন্তুষ্ট কর এবং তার অভিমুখি হও। কেননা এর কারণ তুমিই।
[৬৬] হযরত খাত্তাবিল আবিদ (রহ) বলেন-
إِنَّ الْعَبْدَ لَيُذْنِبُ الذَّنْبَ فِيمَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، فَيَجِيءُ إِخْوَانُهُ، فَيَرَوْنَ أَثَرَ ذَلِكَ عَلَيْهِ
বান্দা কোন গুনাহ করে যা শুধু সে আর তার প্রতিপালকই জানে। (অথচ) তার ভাই তার মধ্যে সেই গুনাহর প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়।
[৬৭] হযরত মুতামার বিন সুলায়মান (রহ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন-
إِنَّ الرَّجُلَ لَيُذْنِبُ الذَّنْبَ فِي السِّرِّ، فَيُصْبِحُ وَعَلَيْهِ مَذَلَّتُهُ
কোন ব্যক্তি গোপনে কোন গুনাহ ও পাপ করে। এরপর যখন সকাল হয় তখন তার মধ্যে এর লজ্জা ও অপমানবোধের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়।
গুনাহর দুর্ভাগ্য
[৬৮] হযরত সাহল বিন আসিম (রহ) বলেন যে- বলা হয়ে থাকে যে,
عُقُوبَةُ الذَّنْبِ الذَّنْبُ
(একটি) গুনাহর শাস্তি (অপর একটি) গুনাহর আকারে প্রকাশ পায়।
[৬৯] হযরত আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী বলেন- মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফের ভাই তাকে হিকামের জোর-যুলুমের ব্যাপারে অভিযোগ করে পত্র লিখেন। তখন তিনি জবাবে লিখেন, হে ভাই! তোমার পত্র আমার নিকট পৌঁছেছে। তুমি তোমার অবস্থার কথা লিখেছ। জেনে রাখ যে, যে ব্যক্তি কোন পাপের মধ্যে থাকে তার উচিত নয় আল্লাহর পাকরাও বা শাস্তিতে বিস্ময় প্রকাশ করা। আমার ধারণা তুমি যেই অবস্থার মধ্যে নিপতিত আছে তার কারণ শুধুই গুনাহর দুর্ভাগ্য।
[৭০] হযরত মুহাম্মদ ইবনে ওয়াসে (রহ) বলেন-
الذَّنْبُ عَلَى الذَّنْبِ يُمِيتُ الْقَلْبَ
গুনাহর উপর গুনাহ অন্তরকে মৃত করে দেয়।
আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়
[৭১] হযরত ইবনে যার (রহ) বলেন-
أَيُّهَا النَّاسُ، أَجِلُّوا مَقَامَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ بِالتَّوْبَةِ عَمَّا لَا يَحِلُّ، فَإِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَا يُؤْمَنُ إِذَا عُصِيَ
লোকসকল! যখন আল্লাহর নাফরমানি করা হয় তখন তার শাস্তি থেকে কেবল তওবার মাধ্যমেই রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
যখন আল্লাহ রাগান্বিত হন
[৭২] হযরত আমর বিন যার (রহ) বলেন- তোমরা কি আল্লাহর সহনশীলতার গুণ দেখে তার নাফরমানি করার দুঃসাহস প্রদর্শন কর? তোমরা কি তার গযবকে আহ্বান কর? তোমরা কি আল্লাহর এই ফরমান শোন নাই-
فَلَمَّا آسَفُونَا انْتَقَمْنَا مِنْهُمْ فَأَغْرَقْنَاهُمْ أَجْمَعِينَ
যখন তারা আমাকে রাগান্বিত করল, তখন আমি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করলাম এবং নিমজ্জিত করলাম তাদের সকলকে।– [সূরা আয যুখরুফ:৫৫]
[৭৩] হযরত মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযিদ ইবনে খুনাইস (রহ) বলেন- আমি হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহ) কে এই আয়াত {فَلَمَّا آسَفُونَا} এর তাফসীর করতে শুনেছি যে, এর মতলব হলো
أَغْضَبُونَا
অর্থাৎ যখন তারা আমাকে ক্রোধান্বিত করল।
সন্তান ও বাচ্চাদের আধিপত্য
[৭৪] হযরত মালিক ইবনে দীনার (রহ) বলেন-
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ إِذَا غَضِبَ عَلَى قَوْمٍ سَلَّطَ عَلَيْهِمْ صِبْيَانَهُمْ
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা যখন কোন সম্প্রদায়ের উপর রাগান্বিত হন, তখন তাদের সন্তানদেরকে তাদের উপর চাপিয়ে দেন।
[৭৫] ইমাম আউযায়ী (রহ) বলেন-
إِنَّ أَوَّلَ مَا اسْتَنْكَرَ النَّاسُ مِنْ أَمْرِ دِينِهِمْ لَعِبُ الصِّبْيَانِ فِي الْمَسَاجِدِ
মানুষ তার দীনের ব্যাপারে প্রথম যেই অপছন্দনীয় বিষয় দেখেছে, তা হলো মসজিদের মধ্যে বাচ্চাদের খেলাধূলা।
যখন আলিমগণ মৃত গাধার চেয়েও নিকৃষ্ট হবে
[৭৬] হযরত মাকহুল (রহ) বলেন-
لَا يَأْتِي عَلَى النَّاسِ مَا يُوعَدُونَ حَتَّى يَكُونَ عَالِمُهُمْ فِيهِمْ شَرًّا مِنْ جِيفَةِ حِمَارٍ
লোকদের উপর (ফিতনা ও বিপর্যয়ের) ঐ যুগ সেই পর্যন্ত আসবে না- যার ওয়াদা তাদের সাথে করা হয়েছে, যে পর্যন্ত তাদের আলিমগণ মৃত গাধার চেয়েও নিকৃষ্ট ও মন্দ না হবে।
বিপদ মুসিবত ও রহমত
[৭৭] হযরত কুলসুম বিন জাওশান (রহ) বলেন-
سَمِعْتُ أَنَّ الْبَلَايَا إِذَا نَزَلَتْ شَاهَدَتْهَا الْأَعْمَالُ، فَكَانَتْ لِلْمُؤْمِنِ أَجْرًا تَمْحِيصًا، وَكَانَتْ لِلْكَافِرِ مَحْقًا
আমি শুনেছি যে, যখন বিপদ নাযিল হয় তখন তা হয় আমলের ভিত্তিতে। অতএব বিপদ-মুসিবত মুমিনের জন্য প্রতিদান ও গুনাহ মিটানোর কারণ হয়ে যায়। আর কাফিরের জন্য হয় ধ্বংস ও বরবাদির কারণ।
[৭৮] হযরত দাউদ বিন হিন্দ (রহ) বলেন-
مَا نَزَلَ بَلَاءٌ إِلَّا نَزَلَتْ مَعَهُ رَحْمَةٌ، فَيَكُونُ نَاسٌ فِي الرَّحْمَةِ، وَنَاسٌ فِي الْبَلَاءِ
প্রত্যেক বিপদ মুসিবতের সাথে রহমতও নাযিল হয়ে থাকে। সুতরাং কিছু লোক রহমতের মধ্যে থাকে আর কিছু লোক থাকে বিপদ-মুসিবতে।
মূর্খতা ও আরাম আয়েশের আসক্তি
[৭৯] হযরত উরওয়া তার পিতা (যুবায়র [রা]) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন
غَشِيَتْكُمُ السَّكْرَتَانِ: سَكْرَةُ الْجَهْلِ، وَسَكْرَةُ حُبِّ الْعَيْشِ، فَعِنْدَ ذَلِكَ لَا تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَلَا تَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
দুটি নেশা তোমাদেরকে পর্দাবৃত করে রেখেছে। মূর্খতার নেশা আর আয়েশ ও আরামের মহব্বতের নেশা। এই অবস্থায় তোমরা না নেক কাজের আদেশ করবে আর না মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে।
ব্যঙের উপদ্রব ও পিঁপড়ার আর্জি
[৮০] হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন-
لَمْ يَكُنْ شَيْءٌ أَشَدَّ عَلَى آلِ فِرْعَوْنَ مِنَ الضَّفَادِعِ، كَانَتْ تَجِيءُ إِلَى الْقُدُورِ وَهِيَ تَفُورُ أَوْ تَغْلِي مِنَ اللُّحْمَانِ، فَتُلْقِي نَفْسَهَا فِيهَا، فَأَوْرَثَهَا اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ بَرْدَ الْمَاءِ وَالثَّرَى إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ
ফিরআউন সম্প্রদায়ের জন্য ব্যঙের উপদ্রবের চাইতে কঠিন কোন শাস্তি আর ছিল না। তাদের হাড়িতে গোশত উথলিয়ে উঠত আর অপরদিক হতে ব্যঙের দল এসে তার উপর নিজে নিজে ঝাঁপিয়ে পড়ত। অতএব আল্লাহ তাআলা ব্যঙের জন্য প্রতিদান স্বরুপ কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য ঠান্ডা পানি ও মাটি (বসবাসের জন্য) দান করেন।
[৮১] হযরত হুমায়দ বিন হিলাল বলেন-
لَمَّا كَانَتِ الْمَعْصِيَةُ زَمَنَ نُوحٍ، غَضِبَتِ الْخَلَائِقُ عَلَى بَنِي آدَمَ، حَتَّى الذَّرَّةُ قَالَتْ: يَا رَبِّ، سَلِّطْنِي عَلَيْهِمْ. قَالَ: مَا تَصْنَعِينَ بِهِمْ؟ قَالَتْ: أَدْخُلُ فِي مَسَامِعِهِمْ
নূহ (আ) এর যুগে যখন আল্লাহর নাফরমানি হতে লাগল, তখন সমস্ত সৃষ্টজীব বনী আদমের উপর অসন্তুষ্ট হতে লাগল। এমনকি পিঁপড়াও আল্লাহর নিকট আরয করল, হে রব! আমাকে তাদের উপর চাপিয়ে দাও। আল্লাহ তাআলা বললেন, তুমি কি করবে? পিপীলিকা বলল, আমি তাদের কানের ভিতরে ঢুকে যাব।
নবী বংশের সন্তানের প্রতি ঘৃণার কুফল
[৮২] হাকিম বিন জাবির থেকে বর্ণিত যে, তার পরিচারিকা হযরত হাসান বিন আলী (রা) কে দেখলেন যে, তিনি ওযু করার পর রুমাল নিলেন এবং তার দ্বারা হাত মুখ পরিষ্কার করলেন। তিনি বলেন, এটা দেখে তার প্রতি আমার ঘৃণা সৃষ্টি হলো। যখন রাত হলো তখন আমি শয়ন করলাম। রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমার কলিজায় চুলা (আগুন) জলছে। হযরত সুফিয়ান (রহ) এর তা’বীর করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এর সন্তানের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার কারণে তার কলিজার এই অবস্থা হয়েছে।
অপরকে মন্দ বলার পরিণতী
[৮৩] হযরত মাকহুল (রহ) বলেন-
رَأَيْتُ رَجُلًا يَبْكِي فِي صَلَاتِهِ، فَاتَّهَمْتُهُ بِالرِّيَاءِ، فَحُرِمْتُ الْبُكَاءَ سَنَةً
একবার আমি এক ব্যক্তিকে নামাযে কাঁদতে দেখে তাকে রিয়াকার (লোকদেখানো) বলে ফেললাম। এর পরিণতী হলো এই যে, এক বৎসর পর্যন্ত আমি (আল্লাহর নিকট) ক্রন্দন করা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম।
[৮৪] হযরত ইবরাহিম (রহ) বলেন-
إِنِّي لَآخُذُ نَفْسِي تُحَدِّثُنِي بِالسِّرِّ، فَمَا يَمْنَعُنِي أَنْ أَتَكَلَّمَ إِلَّا مَخَافَةَ أَنْ أُبْتَلَى بِهِ
যখন আমি কারো মধ্যে যথার্থই কোন দোষ দেখি, আর সেই ব্যাপারে ভাল-মন্দ কিছু বলারে বিষয়ে আমাকে এই বিষয়টিই বাঁধা প্রদান করে যে, তাতে আমিই না আবার নিপতিত হয়ে যাই।
[৮৫] হযরত হাসান বসরী (রহ) থেকে বর্ণিত। (পূর্বসূরীগণ) বলতেন-
مَنْ رَمَى أَخَاهُ بِذَنْبٍ قَدْ تَابَ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنْهُ، لَمْ يَمُتْ حَتَّى يُبْتَلَى بِهِ
যে ব্যক্তি তার কোন ভাইকে (মুসলমানকে) এমন কোন দোষ-ত্রুটি বা গুনাহর জন্য তিরষ্কার করে যার থেকে সে তওবা করেছে, তবে সে ঐ পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করবে না, যে পর্যন্ত না সে নিজে ঐ বিপদে পতিত হবে।
আমল ওযীফায় গুনাহর কুফল
[৮৬] হযরত আলী ইবনে ইসহাক বলেন- কিছু লোক হযরত কুরয বিন ওবারাহ (রহ) নিকট আসলে দেখলেন যে, তিনি কাঁদছেন এবং বলছেন- আমার (আসমানের) দরজা বন্ধ হয়ে গেছে এবং পর্দা ফেলে দেওয়া হয়েছে। গতরাত আমি আমার ওযীফা (ইবাদত-বন্দেগী) থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছি, যার কারণ কোন গুনাহই হতে পারে। আর তা কোন গুনাহ তা আমার জানা নাই।
[৮৭] হযরত আলী ইবনে আব্দুল্লাহ রাযী থেকে বর্ণিত। হযরত মুয়াবিয়া (রা) বলেন-
اسْتَغْفِرُوا اللَّهَ مِنَ الذَّنْبِ الَّذِي سُلِّطْتُ بِهِ عَلَيَّ
আল্লাহর নিকট ঐ (জানা অজানা) গুনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর, যার জন্য তোমার উপর বিপদ আপতিত হয়েছে।
[৮৮] হযরত মুতাররিফ ইবনে আব্দুল্লাহ (রহ) বলেন-
مَا نَزَلَ بِي بَلَاءٌ فَاستَعْظَمْتُهُ، فَذَكَرْتُ ذُنُوبِي إِلَّا اسْتَصْغَرْتُهُ
যখনই আমার উপর কোন মুসিবত এসেছে আর আমার নিকট তা ভারি বোধ হয়েছে, তখন আমি আমার গুনাহর কথা মনে করেছি। অতঃপর তা আমার নিকট হালকা হয়ে গেছে।
জুমা ও জামাআতকে তাচ্ছিল্য করার পরিণতী
[৮৯] ইমাম আউযায়ী (রহ) বলেন- আমাদের মাঝে একজন শিকারী ছিল। যে মৎস্য শিকার করত। সে শিকারের জন্য (নামায বাদ দিয়ে) জুমার দিন যেত। জুমার দিনের মহত্ব তাকে তা থেকে বিরত রাখে নি। একদিন সে যথারীতি শিকারে গেল আর তার খচ্চরসহ মাটিতে ধ্বসে গেল। লোকজন তাকে বের করা চেষ্টা করল। দেখল যে, খচ্চর একদম মাটির ভিতরে দেবে গিয়েছে আর তার দমটুকু বাকী ছিল।
[৯০] আব্দুর রাযযাক তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন-
أَنَّ قَوْمًا تَدَافَعُوا الْإِمَامَةَ بَعْدَمَا أُقِيمَتِ الصَّلَاةُ، فَخُسِفَ بِهِمْ
এক সম্প্রদায় নামায দাড়িয়ে যাওয়ার পর ইমামকে হটিয়ে দেয়। অতএব ঐ সম্প্রদায়কে যমীনে ধ্বসিয়ে দেওয়া হয়।
[৯১] হযরত আব্দুল মজীদ বিন আব্দুল আযীয তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। আমার নিকট বর্ণনা পৌছেছে যে, এক সম্প্রদায় সফরে ছিল। তারা যখন কোথাউ (খাদ্য ও বিশ্রামের জন্য) অবতরণ করত, তখন তারা আল্লাহর নিয়ামতের জন্য তার স্মরণ ও প্রশংসা করত না। আর তারা এক ইমাম বা আমিরের অধীনে থাকত না।
(শাস্তিস্বরুপ) তাদেরকে অন্ধ করে দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে, তোমাদেরকে শাস্তি এজন্য প্রদান করা হলো যে, যখন তোমরা কোথাউ অবস্থান করতে তখন না আল্লাহকে স্মরণ করতে আর না আল্লাহর প্রশংসা করতে। আর না তোমরা একজন ইমামের সাথে একতাবদ্ধ থাকতে। অতঃপর তারা আল্লাহর নিকট তওবা করে এবং খুব বিনয় ও নম্রতার সাথে আল্লাহর নিকট আহাজারী করে। তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন।
[৯২] হযরত মুজাহিদ (রহ) বলেন-
أَنَّ قَوْمًا، خَرَجُوا فِي سَفَرٍ حِينَ حَضَرَتِ الْجُمُعَةُ، فَاحْتَرَقَ عَلَيْهِمْ خِبَاؤُهُمْ نَارًا مِنْ غَيْرِ نَارٍ يَرَوْنَهَا
এক সম্প্রদায় এমন সময় সফরে রওয়ানা হয়েছিল, যখন জুমার নামাযের সময় ছিল। অতএব (সফরে) তাদের তাঁবু আগুন দিয়ে জালিয়ে দেওয়া হয়। আর তা এই আগুন ছিল না যা মানুষ দেখে।
গুনাহর কুফলের বিভিন্ন আকার
[৯৩] হযরত মালেক ইবনে দীনার (রহ) বলেন-
إِنَّ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ عُقُوبَاتٍ، فَتَعَاهَدُوهُنَّ مِنْ أَنْفُسِكُمْ فِي الْقُلُوبِ وَالْأَبْدَانِ، وَضَنْكٍ فِي الْمَعِيشَةِ، وَوَهَنٍ فِي الْعِبَادَةِ، وَسَخَطٍ فِي الرِّزْقِ
আল্লাহ তাআলা কিছু শাস্তি নির্ধারণ করে রেখেছেন। অতএব তোমরা তার দিকে লক্ষ্য রাখ (এবং বুঝতে পারলে তওবা ইস্তিগফার কর)। ঐ শাস্তি কখনো মনের উপর, কখনো শরীরে উপর, কখনো জীবন-জীবিকার সংকীর্ণতা আকারে, কখনো ইবাদত বন্দেগীতে অলসতার আকারে, আবার কখনো রিযিকের সংকট আকারে প্রকাশ পেয়ে থাকে।
[৯৪] হযরত মালেক ইবনে দীনার (রহ) বলেন-
يَا حَمَلَةَ الْقُرْآنِ، مَاذَا زَرَعَ الْقُرْآنُ فِي قُلُوبِكُمْ؟ فَإِنَّ الْقُرْآنَ رَبِيعُ الْمُؤْمِنِ، كَمَا أَنَّ الْغَيْثَ رَبِيعُ الْأَرْضِ، فَقَدْ يَنْزِلُ الْغَيْثُ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ فَيُصِيبُ الْحُشَّ، فَتَكُونُ فِيهِ الْحَبَّةُ، فَلَا يَمْنَعُهَا نَتْنُ مَوْضِعِهَا أَنْ تَهْتَزَّ وَتَخْضَرَّ. فَيَا حَمَلَةَ الْقُرْآنِ، مَاذَا زَرَعَ الْقُرْآنُ فِي قُلُوبِكُمْ؟ أَيْنَ أَصْحَابُ سُوَرِهِ؟ أَيْنَ أَصْحَابُ سُوَرِهِ؟ بَيِّنٌ مِمَّا عَمِلْتُمْ فِيهَا
হে কুরআনের বাহকগণ! কুরআন তোমাদের অন্তরে কি বপন করেছে? কুরআন তো মুমিনের জন্য বসন্তকাল ও চিত্তপ্রশান্তি। যেমন বৃষ্টি যমীনের জন্য বসন্তকাল বা সঞ্জীবনী হয়। কখনো এমন হয় যে, আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয় আর তা বাগান ও ক্ষেত-খামারে পৌছে, আর তা থেকে খাদ্যবস্তু জন্ম নেয়। স্থান নোংড়া হওয়ার দ্বারাও (যমীন) তার শস্য-শ্যামল হওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে না। অতএব হে কুরআনের বাহকগণ! কুরআন তোমাদের অন্তরে কি বপন করেছে? কোথায় হে সূরার অধীকারীগণ? কোথায় হে সূরার অধীকারীগণ? অতএব তোমরা যা করতে তা পরিষ্কার ও প্রমাণিত হয়ে যাবে।
[৯৫] হযরত মালেক ইবনে দীনার (রহ) বলেন-
مَا ضُرِبَ عَبْدٌ بِعُقُوبَةٍ أَعْظَمَ عَلَيْهِ مِنْ قَسْوَةِ قَلْبٍ
কোন বান্দাকে কাসওয়াতে কলব বা অন্তরের কঠোরতার চাইতে বড় কোন শাস্তি প্রদান করা হয়নি।
[৯৬] হযরত হাম্মাদ বিন সালামাহ (রহ) বলেন-
لَيْسَتِ اللَّعْنَةُ سَوَادًا يُرَى فِي الْوَجْهِ، إِنَّمَا هِيَ أَلَّا تَخْرُجَ مِنْ ذَنْبٍ إِلَّا وَقَعْتَ فِي ذَنْبٍ
লা’নত এটা নয় যে, তার দ্বারা চেহারা কালো বা মলিন হয়ে যাবে। বরং লা’নত হলো একটি গুনাহ থেকে বের হয়ে আরেকটি গুনাহ-এ নিপতিত হয়ে যাওয়া।
[৯৭] হযরত হুসায়ন ইবনে আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত। কেউ হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়িব (রহ) কে বলল, আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান বলেন-
قَدْ صِرْتُ لَا أَفْرَحُ بِالْحَسَنَةِ أَعْمَلُهَا، وَلَا أَحْزَنُ عَلَى السَّيِّئَةِ أَرْتَكِبُهَا
আমার অন্তর এমন হয়ে গেছে যে, কোন নেককাজ করার দ্বারা অন্তর আনন্দিত হয় না আর কোন গুনাহর কাজ দ্বার অন্তর দুঃখিত হয় না।
হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়িব (রহ) বললেন-
الْآنَ تَأَكَّدَ مَوْتُ قَلْبِهِ
তার অন্তর মূর্দা হয়ে গেছে।
[৯৮] হযরত ওহায়ব বিন ওয়ার্দ (রহ) বলেন যে, হযরত উমর বিন যার (রহ) যিনি ছিলেন আয়িম্মায়ে মুতাকাল্লিমীন বা পূর্বসূরী নসীহত প্রদানকারী। তিনি বলেন- হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা আল্লাহর হিলম বা সহনশীলতা গুণের কারণে নিজেদেরকে ধোঁকা প্রদান করো না। আর তোমরা আল্লাহর অসন্তোষ থেকে বাঁচ। শোন আল্লাহ তাআলা কি বলেছেন-
فَلَمَّا آسَفُونَا انْتَقَمْنَا مِنْهُمْ فَأَغْرَقْنَاهُمْ أَجْمَعِينَ فَجَعَلْنَاهُمْ سَلَفًا وَمَثَلًا لِلْآخِرِينَ
আর যখন তারা আমাকে রাগান্বিত করল, তখন আমি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করলাম আর তাদের সকলকে নিমজ্জিত করলাম। অতঃপর পরবর্তীদের জন্য আমি তাদেরকে করে রাখলাম অতীত ইতিহাস ও দৃষ্টান্ত। -সূরা যুখরুফ:৫৫
গুনাহ প্রসারের কুফল
[৯৯] হযরত খালেদ আর রাবা’য়ী (রহ) বলেন- বনী ইসরাইলের এক ব্যক্তি ছিল, যে (পূববর্তী) কিতাব অধ্যয়ন করেছিল। আর সে এর দ্বারা দুনিযার সম্মান কামনা করত। একটা সময় পর্যন্ত সে এই অবস্থায়ই ছিল। এমনকি বার্ধক্যে উপনীত হয়ে গেল। এক রাতে সে বিছানায় শুয়ে ভাবছিল যে, লোকদের তো জানা নাই যে, আমি দীনের মধ্যে কী সব অন্তর্ভুক্ত করেছি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তো জানেন আমি কি বিদআত বের করেছি। আর আমার মৃত্যুর সময়ও নিকটবর্তী হয়ে গেছে এখন আমি কেন তওবা করব না?
বর্ণনকারী বলেন- সে তওবা করে নিল এবং ইবাদত বন্দেগীতে খুব চেষ্টা-সাধনা করতে লাগল। এমনকি নিজের গলায় শিকল দিয়ে তা মসজিদের একটি স্তম্ভের সাথে বেঁধে রাখল। এরপর বলতে লাগল, আমি এই স্থান থেকে ঐ পর্যন্ত উঠব না, যে পর্যন্ত না আল্লাহ তাআলা আমার তওবা কবুলের কোন নিদর্শন না দেখাবেন। অন্যথায় আমি এখানেই মৃত্যুবরণ করব।
আল্লাহ তাআলা ঐ সময়ের নবীর মাধ্যেমে এই ওহী পাঠালেন যে (তাকে বলে দাও) , যদি তুমি এমন কোন গুনাহ করতে যা তোমার আর আমার মাঝে বিদ্যমান থাকত, তবে তোমার তওবা কবুল করে নিতাম- সেই গুনাহ যত বেশীই হোক না কেন? কিন্তু সেইসব লোকদের কি হবে যাদেরকে তুমি গুমরাহ করেছিলে আর আমি তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছি? অতএব তোমার তওবা কবুল করা হবে না।
দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টি
[১০০] হযরত জাফর বলেন, আমি দুর্ভিক্ষের সময় মালেক ইবনে দীনার (রহ) কে বলতে শুনেছি- আমার নিকট এই সংবাদ পৌছেছে যে-
مَا مِنْ أُمَّةٍ سَقَطَتْ مِنْ عَيْنِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ إِلَّا ضَرَبَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ كِبَارَهَا بِالْجُوعِ
যে উম্মত আল্লাহর নযরে ছোট হয়ে যায়, আল্লাহ তাআলা তাদের বড়দেরকে ক্ষুধার (শাস্তির) মধ্যে নিপতিত করেন।
[১০১] হযরত কাতাদাহ (রহ) বলেন-
إِنَّ دَوَابَّ الْأَرْضِ تَدْعُو عَلَى خَطَّائِي بَنِي آدَمَ إِذَا احْتُبِسَ الْقَطْرُ فِي السَّمَاءِ يَقُولُونَ: هَذَا عَمَلُ عُصَاةِ بَنِي آدَمَ، لَعَنَ اللَّهُ عُصَاةَ بَنِي آدَمَ
যখন আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ হয়ে যায়, তখন যমীনেরে সাপ-বিচ্ছু, পোকা-মাকড়ও বনী আদমের জন্য বদ দুআ করে এবং বলে, এসবকিছু নাফরমান আদম সন্তানের কারণে হয়েছে। আল্লাহ এসব নাফরমানদের প্রতি লানত করুন।