জ্ঞানের এক মহাসাগর আ'লা হযরত (رحمة الله)
🖋(ডা. মাসুম বিল্লাহ সানি)
______________________________________
❏ নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ ফরমান,
ان امة بعيث لهذه الامة على رأس كل مأة سنة من يجدد لها دينها
অর্থাৎ প্রতি একশত বৎসরের শেষপ্রান্তে মহান রব এ উম্মতের জন্যে অবশ্যই মুজাদ্দিদ প্রেরণ করবেন, যে উম্মতের জন্যে আল্লাহর দ্বীনকে সঠিক রাখবে।
— আবু দাউদ শরীফ
▪ চতুর্দশ হিজরির মুজাদ্দিদ আ'লা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খান বেরলভী (রহঃ) [১৪.৬.১৮৫৬ খ্রিঃ বা ১০ সাওয়াল ১২৭২ হিঃ - ২৮.১০.১৯২১ খ্রিঃ বা ২৫ সফর ১৩৪০হিঃ]
❏ তাঁর জীবদ্দশায় তিনি ইসলামী আইন-কানুনের উপর প্রায় সহস্রাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
[usha Sanyal (১৯৯৮)। "Generational Changes in the Leadership of the Ahl-e Sunnat Movement in North India during the Twentieth Century"। Modern Asian Studies। 32 (3): 635]
❏ জ্ঞানের সনদ লাভ
আ’লা হযরত (رحمة الله) প্রাথমিক উর্দ্দু, ফার্সী ভাষার কিতাবাদী অধ্যয়নের পর আরবী ভাষায় ছরফ-নাহু এর কিতাব সমূহ মীর্যা গোলাম ক্কাদীর (رحمة الله) এর সান্নিধ্যে, অতঃপর নিজ পিতা হযরত শাহ্ নক্কী আলী খাঁন (رحمة الله)
এর সান্নিধ্যে জ্ঞানকোষ সমূহের উপর বিদ্যা অর্জন করেন। মাত্র ১৪ বৎসর বয়সেই সমাপ্তী
সনদপত্র লাভ করেন। তার মধ্যে ছিলঃ
(১) ইলমে কুরআন
(২) ইলমে তাফছীর
(৩) ইলমে হাদীছ
(৪) উসূলে হাদীছ
(৫) হানাফী ফিকহের কিতাবাদী
(৬) শাফেঈ ফিক্হের কিতাবাদী
(৭) মালেকী ফিকহের কিতাবাদী
(৮) হাম্বলী ফিকহের কিতাবাদী
(৯) উসূলে ফিক্বহ
(১০) জাদাল-ই মাযহাব
(১১) ইলমে আকাইদ ও কালাম
(১২) ইলমে নাহভ
(১৩) ইলমে ছরফ
(১৪) ইলমে মা’আনী
(১৫) ইলমে বয়ান
(১৬) ইলমে বদী
(১৭) ইলমে মানতিক
(১৮) ইলমে মুনাজারাহ
(১৯) ইলমে কানসাকাহ্ মুদাল্লাসাহ
(২০) ইবতিদায়ী ইলমে তাকছীর
(২১) ইবতেদায়ী ইলমে হাইয়াত
(২২) ইলমে হিছাব
(২৩) ইলমে হিন্দাসাহ্
❏ ইলমে দ্বীনে তাঁর অবদানঃ
আ’লা হযরত (رحمة الله) ৫৫টিরও বেশী আলাদা জ্ঞানের অধিকারী আলিম ছিলেন। এর মধ্যে কুরআন-হাদিস-ফিকাহ-ফতোয়া এসবের সম্মিলিত জ্ঞান ছাড়াও তিনি পারদর্শী ছিলেনঃ
(১) ক্বিরাত
(২) তাজভীদ
(৩) তাসাওফ
(৪) ছুলুক
(৫) ইলমুল আখলাক
(৬) আছমাউর রিজাল
(৭) ছিয়ার
(৮) ইতিহাস
(৯) অভিধান
(১০) আদব (বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে)
(১১) আরিসমাত্বী-কী
(১২) জবর ও মুক্বালাহ
(১৩) হিসাব-ই-সিত্তীনী
(১৪) লগারিথম
(১৫) ইল্মুত্ তাওক্বীত
(১৬) ইলমুল আকর
(১৭) যীজাত
(১৮) মুসাল্লাম-ই-কুরাভী
(১৯) মুসাল্লাস-ই-মুসাত্তাহ্
(২০) হাইআত-ই-জাদীদাহ
(২১) মুরাব্বাআত
(২২) মুন্তাহা ইলমে জুফার
(২৩) ইলমে যাইচাহ্
(২৪) ইলমে ফারাইজ
(২৫) আরবী কবিতা
(২৬) ফার্সী কবিতা
(২৭) হিন্দি কবিতা
(২৮) আরবী গদ্য
(২৯) ফার্সী গদ্য
(৩০) হিন্দী গদ্য
(৩১) পান্ডুলিপি
(৩২) নাস্তালীক লিপি
(৩৩) মুন্তাহা ইলমে হিসাব
(৩৪) মুন্তাহা ইলমে হাইআত
(৩৫) মুন্তাহা ইলমে হিন্দাসাহ্
(৩৬) মুন্তাহা ইলমে তকছীর ও
(৩৭) কুরআন শরীফ লিখন পদ্ধতিসহ প্রভৃতি।
❏ লিখিত বিষয়ভিত্তিক কিতাবঃ
- এছাড়াও হুজুর (ﷺ) ফযীলতসহ জীবন, চরিত্র আক্বাইদের উপর ৬৩টি।
- হাদীস ও উসুলে উপর ১৩টি।
- ইলমে কালাম ও মুনাযারাহ্ বিষয়ে ৩৫টি।
- ফিক্বহ ও উসুলে ফিক্বহ বিষয়ে ৫৯টি।
- বিভিন্ন বাতিল পন্থীদের ভ্রান্ত মতবাদ খন্ডনে ৪০০টির অধিক কিতাব।
❏ কানযুল ঈমানের অনুবাদ দুনিয়ার শ্রেষ্টতম কুরআনের অনুবাদ, যা কোন লাইব্রেরীতে বসে বা অন্য কোন অনুবাদ দেখে বা তাফসীর ও হাদীস বা কোন অভিধান পাঠ করে করা হয়নি বরং মৌখিক ভাবে লিখানো হয়েছে।
[মাহানামা মারিফে রযা, ৮৭ পৃষ্ঠা, করাচী সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর ২০০৮ ইং]
❏ ফতোওয়া প্রদান শুরু এবং “ফতোওয়ায়ে রযবীয়া”র পরিচিতি
আ’লা হযরত (رحمة الله) এর কৃতিত্ব সমূহের মধ্যে অসাধারণ ইলমী কৃতিত্ব হচ্ছে ফতোওয়া প্রদান। যেমনিভাবে-
মাত্র ১৩ বছর ১০ মাস ৪ দিন বয়সে সকল
প্রচলিত জ্ঞানের তাঁর পিতা হযরত নকী আলী খান (رحمة الله) এর থেকে পরিপূর্ণ করে শিক্ষা সনদ গ্রহন করেন। তিনি ১২৮৬-১৩৪০ হিজরী পর্যন্ত লাখো ফতোওয়া লিখেন, কিন্তু আফসোস! সবগুলো সংকলন করা সম্ভব হয়নি, যা সংকলন করা হয়েছে তা “ফতোওয়ায়ে রযবীয়া”য় বিদ্যমান। ফতোওয়ায়ে রযবীয়ার ৩০ খন্ড রয়েছে। এটা সম্ভবত উর্দূ ভাষায় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ফতোওয়ার সংকলন, যাতে প্রায় ২২০০০ পৃষ্ঠা, (৬৮৪৭) প্রশ্নোত্তর, এবং ২০৬টি রিসালা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
(আ’লা হযরত কি ইন্ফিরাদী কৌশিশ, ২-৩ পৃষ্ঠা, সংক্ষেপিত)
মনীষীদের বক্তব্যে আ'লা হযরতের ইলমী খেদমত
❏ হযরত আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ জাফরুদ্দীন বাহারী (رحمة الله) বলেন,
তিনি অধিকাংশ সময় লেখনী ও সংকলনের কাজে ব্যস্ত থাকতেন।
(হায়াতে আ’লা হযরত, ১/৯৮)
❏ সাধারনত ওলামায়ে কিরামগণ শিক্ষা সমাপণের পর লেখনী ও সংকলনের
কাজে কদম রাখেন এবং আ’লা হযরত (رحمة الله) শিক্ষারত অবস্থা হতেই কিতাব লেখনির ধারাবাহিকতা শুরু করেন।
(হায়াতে আ’লা হযরত, ৩/১৪৩-১৪৪)
❏ যার একটি প্রজ্জলিত উদাহরণ হলো যে, তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে দরসে নিজামী অর্থাৎ আলিম কোর্সের নিসাবে অন্তর্ভুক্ত ইলমে নাহুর প্রসিদ্ধ কিতাব “হিদায়াতুননাহু” শুধু পড়ে নেননি বরং ঐ অল্প বয়সেই সেই কিতাবের আরবী ভাষায় ব্যাখ্যাও (শরাহও)
লিখে ফেলেন।
(ফয়যানে আ’লা হযরত, পৃষ্ঠা ৮৬)
❏ আ’লা হযরত (رحمة الله) এর রচনার (লিখনীর) সংখ্যা
আ’লা হযরত (رحمة الله) এর রচনা, ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও পাদটিকার সংখ্যা প্রায় এক হাজার। রচনা ও ব্যাখ্যা গ্রন্থ ছাড়াও তাঁর অনেক প্রবন্ধ, চিঠিপত্র, বাণী সমগ্র ইত্যাদিও রয়েছে, যার
সংখ্যার সঠিক কোন পরিসংখ্যান হয়নি। (ফয়যানে আ’লা হযরত, ৫৬৫-৫৬৬ পৃষ্ঠা)
❏ হযরত আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ জাফরুদ্দীন বাহারী (رحمة الله) বলেন-
১২৮৬ হিজরী থেকে ১৩৪০ হিজরী পর্যন্ত এই ৫৪ বছরের সময়ে কয়েকশ নয় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী আ’লা হযরত (رحمة الله) এর জ্ঞানের আলোতে আলোকিত হয়েছে, এরতো কোন রেজিষ্টার নেই, যাতে ভর্তির সময় সবার নাম লিখে রাখা হতো তবে সম্ভবত এর সংখ্যা হাজার নয় বরং লাখে পৌঁছে যাবে। (হায়াতে আ’লা হযরত, ৩/১৪৫-১৪৬)
❏ সম্ভবত এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো যে,
আ’লা হযরত (رحمة الله) খুবই কম বয়সেই শিক্ষা ও পাঠদানের ধারাবাহিকতা শুরু করে দেন,
সুতরাং আ’লা হযরত (رحمة الله) বলেন: ফকিরের দরস (অর্থাৎ আলিম কোর্স) আল্লাহ তাআলার দয়ায় ১৩ বছর ১০ মাস ৪ দিন বয়সে শেষ হয়েছিলো, এরপর
কয়েকবছর পর্যন্ত ছাত্রদের পড়িয়েছি।
(ফয়যানে আ’লা হযরত, ৯২ পৃষ্ঠা)
❏ তখন ইমামে আহলে সুন্নাতহাদীস শরীফের প্রায় ৩০ টি কিতাবের নাম বলার পর বলেন যে, ৫০ টিরও বেশী হাদীসের কিতাব আমার শিক্ষা, পাঠদান এবং অধ্যয়নে রয়েছে।
(ইজহারুল হক্কুল জলী, ৪০ পৃষ্ঠা)
❏ বিজ্ঞানের মূল তথ্য বলে দিলেন :
একবার প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী প্রফেসর হাকিম আলী (প্রিন্সিপাল ইসলামিয়া কলেজ
লাহোর) নিজের এক চিঠির মাধ্যমে আ’লা হযরত (رحمة الله) কে বিজ্ঞানের মতবাদকে গ্রহন করার দাওয়াত দিলেন এবং এর উপকারীতা সম্পর্কেও বুঝালেন কিন্তু তিনি এর উত্তরে লিখলেন: এভাবে মুসলমান হবে না, কেননা এরূপ করাতে তো ইসলামকেই বিজ্ঞানের উপযোগী করা আবশ্যক হয়ে পড়বে। সুতরাং যতগুলো মাসআলা বিজ্ঞান বিরোধী রয়েছে, সবগুলোতে ইসলামী মাসআলাকে আলোকিত করা হোক, বিজ্ঞানের দলিলাদীকে খন্ডন করা হোক। বিভিন্ন স্থানে বিজ্ঞানের উক্তি দিয়ে ইসলামী মাসআলার প্রমাণ হোক এবং এটা আপনার মতো বুদ্ধিমান বিজ্ঞানীর জন্য আল্লাহ তাআলার দয়ায় কঠিন হতে পারে না।
(ফয়যানে আ’লা হযরত, ৫৬২-৫৬৩ পৃষ্ঠা)
❏ ওস্তাদুল ওলামা, হযরত মাওলানা মুফতী তাকাদ্দুস আলী খাঁন (رحمة الله) হযরত আ'লা এর বিজ্ঞান এবং গণিতের জ্ঞানে অভিজ্ঞতা ও উপযুক্ততা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: আমি আমার ছাত্র বয়সে দেখি যে, যখনই মৌলভী হাকীম আলী সাহেব বেরেলী শরীফ আসতেন তখন মৌলভী সাহেব এবং আ’লা হযরত
মাওলানা আহমদ রযা খাঁন :
বিভিন্ন বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি দিয়ে ‘পৃথিবী
ঘুরছে নাকি ঘুরছে না’ এই বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা করতেন এবং এই মাসআলা নিয়ে
বিশদ দলিলাদী সহকারে যুক্তিতর্ক করতেন। যদিওবা তখন আমার এই যুক্তিতর্ক ও
দলিলাদী বুঝে আসতো না, তারপরও আগ্রহ সহকারে এই উৎসাহপূর্ণ খেলা
দেখতাম। (ফয়যানে আ’লা হযরত, ৫৬৩ পৃষ্ঠা)
❏ ঠিক এভাবেই আ’লা হযরত :
গণিতশাস্ত্রের মাধ্যমে ফিকাহ শাস্ত্রের যে খিদমত করেছেন তাও ইতিহাসে
উদাহরণীয়, যেমনটি কিবলার দিক নির্ণয়, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় বের করা,
নামাযের সময়সুচি, যাকাত এবং ফিতরার জন্য শরয়ী ওজন ও পরিমাপ নির্ধারণ,
মুসাফিরদের জন্য নতুন মাইলের হিসেবে সফরের পরিমাপ নির্ণয় ইত্যাদি অসংখ্য
মাসআলায় তাঁর অসাধারণ গবেষণা ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রে একটি নতুন অধ্যায় বৃদ্ধি
করেছে। (ফয়যানে আ’লা হযরত, পৃষ্ঠা ৫৪৭, সংক্ষেপিত)
ভিন্ন মতাদর্শী আলেমদের বক্তব্যঃ
❏ মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব বলেন-
আমার যদি সুযোগ হতো, তাহলে আমি মৌলভী আহমাদ রেজা খান বেরলভীর পিছনে নামাজ পড়ে নিতাম। (উসওয়ায়ে আকাবির- পৃঃ ১৮)
তিনি আরো বলেন- “তাঁর সাথে আমাদের বিরোধিতার কারণ বাস্তবিক পক্ষে ‘হুব্বে রাসূল’(ﷺ) ই। তিনি আমাদেরকে হুজুর (ﷺ) প্রতি বেয়াদবী প্রদর্শনকারী (গোস্তাখে রাসূল) মনে করতেন। (আশরাফুস্ সাওয়ানিহ্, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-১২৯)
যখন আ’লা হযরত ইহধাম ত্যাগ করেছেন, তখন কোন একজন মাওলানা আশরাফ আলী থানভীকে সংবাদ দিলে শুনামাত্রই তিনি আ’লা হযরতের জন্য মাগফেরাত কামনা করেন। জনৈক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মাওলানা আহমদ রেজা খাঁনতো আপনাকে কাফের মনে করতেন। অথচ আপনি তাঁর মাগফিরাত কামনা করছেন। তিনি বলেন, আহমাদ রেযা আমাকে এজন্যই
কাফের মনে করতেন, যেহেতুআমি তাঁর দৃষ্টিতে গোস্তাখে রাসূল ছিলাম। তিনি
একথা জানার পরও যদি কাফের না বলেন, তিনি নিজে কাফের হয়ে যাবেন।
(দৈনিক রাওয়ালপিন্ডি, ১লা নভেম্বর ১৯৮১)
❏ আবুল আ’লা মওদুদী সাহেব বলেন-
মাওলানা আহমাদ রেজা খাঁন মরহুম মগফুর আমার দৃষ্টিতে একজন অসাধারণ
জ্ঞানী ও দূরদর্শীতার অধিকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি মুসলিম মিল্লাতের একজন
শীর্ষস্থানীয় নেতা। যদিও তাঁর সাথে আমার কতিপয় বিষয়ে বিরোধ রয়েছে তবুও
আমি তাঁর প্রভূতঃ দ্বীনি খেদমতকে স্বীকার করি। (আল মিযান, পৃঃ ১৬, সন-
১৯৭৬ মুম্বাই ও মাকালাতে ইয়াওমে রেজা, ২য় খন্ড, পৃঃ ৫৪০)