ই'তিকাফ



✏ ইমরান বিন বদরী 

নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম,আম্মা বা’দ

"ই'তিকাফ" শব্দটি আরবী, যার অর্থ অবস্থান করা। ইসলামী শরীয়তে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ তা‘য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দুনিয়াবী সকল কাজ থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ আল্লাহর ইবাদতের জন্য মসজিদে অবস্থান করাকে ই‘তিকাফ বলা হয়। ই’তিকাফ  মুমিনের জীবনে একটি শিক্ষামূলক নিবিড় আত্মিক প্রশিক্ষণ। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও অনেক আগ্রহ সহকারে ই'তিকাফে থাকতেন এবং সাহাবীদেরকেও ই'তিকাফে থাকার জন্য বলতেন।

عَنْ عَائِشَةَ زَوْجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّ النَّبِيَّ كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللهُ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ

অর্থ: উম্মুল মুমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ ১০ দিন ই'তিকাফ করতেন। এভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া পর্যন্ত ই'তিকাফ করেছেন। পরবর্তীতে উম্মুল মুমেনিনবৃন্দ ই'তিকাফ করেছেন।(মুত্তাফাকুন আলাইহ)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের শেষ দশদিন ই’তিকাফ করবে, সে যেন দু’টি হজ্ব এবং দু’টি উমরাহর সাওয়াব লাভ করবে। (বায়হাকী)

বিভিন্ন সহীহ হাদীসের মাধ্যমে ই’তিকাফের মর্যাদা এবং এর অধিক সওয়াবের কথা বর্ননা করা হয়েছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীবৃন্দও অধিক আগ্রহের সাথে ই'তিকাফ করতেন।

 ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য 

মহান আল্লাহ তা’লার একান্ত সান্নিধ্যে যাওয়া।আত্মশুদ্ধির জন্য মহান আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা। একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়ে,বিনয় নম্রতায় নিজেকে আল্লাহর দরবারে সমপর্ণ করা এবং বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে ইবাদত করার সুযোগ লাভ করা। 
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ ح قَالَ سُفْيَانُ وَحَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَمْرٍو عَنْ أَبِي سَلَمَةَ عَنْ أَبِي سَعِيدٍ ح قَالَ وَأَظُنُّ أَنَّ ابْنَ أَبِي لَبِيدٍ حَدَّثَنَا عَنْ أَبِي سَلَمَةَ عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ اعْتَكَفْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم الْعَشْرَ الأَوْسَطَ فَلَمَّا كَانَ صَبِيحَةَ عِشْرِينَ نَقَلْنَا مَتَاعَنَا فَأَتَانَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ كَانَ اعْتَكَفَ فَلْيَرْجِعْ إِلَى مُعْتَكَفِهِ فَإِنِّي رَأَيْتُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ وَرَأَيْتُنِي أَسْجُدُ فِي مَاءٍ وَطِينٍ فَلَمَّا رَجَعَ إِلَى مُعْتَكَفِهِ وَهَاجَتْ السَّمَاءُ فَمُطِرْنَا فَوَالَّذِي بَعَثَهُ بِالْحَقِّ لَقَدْ هَاجَتْ السَّمَاءُ مِنْ آخِرِ ذَلِكَ الْيَوْمِ وَكَانَ الْمَسْجِدُ عَرِيشًا فَلَقَدْ رَأَيْتُ عَلَى أَنْفِهِ وَأَرْنَبَتِهِ أَثَرَ الْمَاءِ وَالطِّينِ

অর্থ: হজরত আবূ সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমরা রমযানের মধ্য দশকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংগে ইতিকাফ করেছিলাম। বিশ তারিখের সকালে (ইতিকাফ শেষ করে চলে আসার উদ্দেশ্যে) আমরা আমাদের আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে এসে বলেন: যে ব্যাক্তি ইতিকাফ করেছে, সে যেন তার ইতিকাফস্থলে ফিরে যায়। কারণ আমি এই রাতে (লাইলাতুল কদর) দেখতে পেয়েছি এবং আমি আরও দেখেছি যে, আমি পানি ও কাদার মধ্যে সিজদা করছি। এরপর যখন তিনি তাঁর ইতিকাফের স্থানে ফিরে গেলেন এবং আকাশে মেঘ দেখা দিলো, তখন আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হলো। সেই সত্তার কসম! যিনি তাঁকে যথাযথ প্রেরণ করেছেন। ওই দিনের শেষভাগে আকাশে মেঘ দেখা দিল। মসজিদ ছিল খেজুর পাতার ছাউনির। আমি তাঁর নাকের অগ্রভাগে পানি ও কাদার চিহ্ন দেখেছিলাম। [ইমাম ইসমাইল বুখারী (রঃ) উনার বিখ্যাত সহীহ বুখারীতে হাদিস শরীফটি উল্লেখ করেছেন, ই,ফা, বা, ১৯৯০ সংস্করণ]

(জরুরি নোট: আকাশে মেঘ নেই বৃষ্টির কোন সম্ভাবনাও নেই, কিন্তু মহানবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- বৃষ্টি হবে; কাদা-পানিতে সিজদা করবো। তাই হলো)

ই‘তিকাফের জন্য শর্ত

(ক) মুসলমান হওয়া;
(খ) জ্ঞান থাকা;
(গ) বড় নাপাকী থেকে পবিত্র থাকা, গোসল ফরয হলে গোসল করে নেয়া;
(ঘ) মসজিদে ই‘তিকাফ করা।

কাজেই কাফির-মুশরিক, অবুঝ শিশু, পাগল ও অপবিত্র লোক এবং হায়েয-নিফাস অবস্থায় নারীদের ই‘তিকাফ শুদ্ধ হবে না।

ই'তিকাফের হুকুম

ই'তিকাফে থাকা সুন্নাতে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম। সমাজের কেউ যদি ই'তিকাফ না করে, তাইলে সমাজের সবাই গুনাহগার হবে। আর যদি একজনও করেন, তাইলে সবার পক্ষে আদায় হয়ে যাবে। যিনি ই’তিকাফ করেন, তাঁকে মু’তাকিফ বলা হয়।

ই'তিকাফে বর্জনীয়

মহান আল্লাহ পাক বলেন:-

وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ

অর্থাৎ, ইতিকাফ অবস্থায় বিবিদের সাথে মিলিত হয়োনা। [সূরা আল বাকারা:১৮৭]

স্ত্রীকে চুম্বন ও স্পর্শ করা, মসজিদ থেকে বের হওয়া, বেচাকেনা, চাষাবাদ করা নিষেধ। অন্যান্য অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকাও। যেমন - অযথা গল্প-গুজব, কথাবার্তা না বলা।

উম্মুল মুমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ : كَانَ النَّبِيُّ -صلى الله عليه وسلم- إِذَا اعْتَكَفَ لاَ يَدْخُلُ الْبَيْتَ إِلاَّ لِحَاجَةِ الإِنْسَانَ

অর্থ: ‘হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, একান্ত (পেশাব-পায়খানার) প্রয়োজন পূরণ ছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ ছেড়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেন না।’ [মুসলিম ২৯৭]

ইমাম বায়হাকী (রহঃ ) উম্মুল মুমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণনা করেন, ইতিকাফ অবস্থায় কোনো রোগী দেখতে যাবেনা; মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও অবস্থান করবেনা; স্ত্রীর সাথে মিলবেনা; প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবেনা। ইতিকাফকারীকে রোজাদার হতে হবে। যে মসজিদে জামাতের সাথে সালাত হয়, সে মসজিদে ইতিকাফ করতে হবে।

ইতিকাফ অবস্থায় অধিক পরিমাণে ইবাদত করা প্রয়োজন। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, নফল ইবাদতে সময় পার করা উত্তম। মসজিদে অহেতুক কথা না বলাই ইতিকাফ্ পালনকারীর জন্যে উত্তম।

আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন যেনো আমাদেরকে সঠিকভাবে ই'তিকাফ পালন করার তাওফীক দান করেন, আমীন।

                                                                            *সমাপ্ত*

Top