দাড়ি রাখা, আমাদের ধারণা ও ইসলামিক বিধান
দাড়ি রাখা সম্পর্কে আমাদের একটি ধারনা রয়েছে, সেটা হলো ”দাড়ি রাখা সুন্নাত, অতএব দাড়ি রাখলে ভালো আর না রাখলে তেমন কোনো সমস্যা নেই, একটা সুন্নাত পালন করা হলো না, এই আর কি।” জেনে রাখুন, এটা সম্পূর্ণই একটি ভুল ধারণা।
দাড়ি রাখা কোন অর্থে সুন্নাত আর কোন অর্থে ফরয বা ওয়াজিব, আগে সেটা বুঝার চেষ্টা করুন। ইসলামে শরীয়তের বিধানের প্রধান সূত্র হচ্ছে কুরআন ও রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ অর্থাৎ হাদীস। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যেসকল বিষয়ে আদেশ ও নিষেধসূচক শব্দমালা ব্যবহার করেছেন, তা পালন করা আমাদের জন্য ফরজ। আশা করি বিষয়টি সকলের কাছেই পরিষ্কার অর্থাৎ বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়। এবার আসুন, দাড়ি রাখা কোন অর্থে সুন্নাত আর কোন অর্থে ফরয বা ওয়াজিব, সেটা জানার ও বুঝার চেষ্টা করি।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুরআনে বহু আয়াতে রাসূল ﷺ এর নির্দেশ মেনে চলার জন্য আমাদের বলেছেন। তার মানে হলো, রাসূল ﷺ যে সকল বিষয়ে আমাদেরআদেশ ও নিষেধ করেছেন, তা মেনে চলাও আমাদের জন্য ফরয ওয়াজিব । কুরআনের আয়াতগুলো এখানে দেওয়া হলো-
”রাসূলের আহ্বানকে তোমরা তোমাদের একে অপরকে আহ্বানের মতো গণ্য করো না। আল্লাহ তাদেরকে জানেন, যারা তোমাদের মধ্যে চুপিসারে সরে পড়ে। অতএব যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদেরকে স্পর্শ করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে।” [সূরাহ আন-নুর (২৪):৬৩]
”আর তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসূলের, যাতে তোমাদের উপর রহমত করা হয়।” [সূরাহ আল-ইমরান (৩):১৩২]
”যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো, তাহলে আমাকে (মুহাম্মাদ ﷺ) অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদিগকে ভালোবাসেন।” [সূরাহ আল-ইমরান (৩):৩১]
”হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য কর এবং শোনার পর তা থেকে বিমুখ হয়ো না।” [সূরাহ আল-আনফাল (৪৮):২০]
”আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো কাজের আদেশ করলে কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।” [সূরাহ আল-আহযাব (৩৩):৩৬]
”বলুন আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তার উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্যে সে দায়ী এবং তোমাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্যে তোমরা দায়ী। তোমরা যদি তাঁর আনুগত্য কর, তবে সৎ পথ পাবে। রাসূলের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টরূপে পৌঁছে দেওয়া।” [সূরাহ আন-নূর (২৪):৫৪]
”রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।” [সূরাহ আল-হাশর (৫৯): ৭]
দাড়ি রাখার ব্যাপারে রাসূল ﷺ এর নির্দেশ-
ইবনে উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) সূত্রে নবী ﷺ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, “তোমরা মুশরিকদের বিপরীত করবে। দাড়ি লম্বা রাখবে, গোঁফ ছোট করবে।” (সহিহ বুখারী, নবম খণ্ড, হাদীস নং – ৫৪৭২, ইফা)
তাহলে বুঝা গেলো যে, শারি’আতের বিধানের দ্বিতীয় সূত্র যেহেতু হাদীস, কাজেই সেই অর্থে দাড়ি রাখা সুন্নাত। আর পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা রাসূল ﷺ এর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলার জন্য সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন। কাজেই সেই অর্থে রাসূল ﷺ এর নির্দেশ মেনে চলা আমাদের জন্য ফরয। আরও একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে, রাসূল ﷺ জিবরাঈল (‘আলাইহিসসালাম) এর মাধ্যমে প্রাপ্ত আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নির্দেশ ব্যতিত কোনো কথা বা কাজের নির্দেশ বা নিষেধ করতেন না। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ভালো জানেন।
দাড়ি রাখা সম্পর্কে উলামাগনের কেউ বলেছেন যে, দাড়ি রাখা ফরয। কারণ রাসূল ﷺ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নির্দেশ ব্যতিত কোনো কথা বলতেন না। আর তাই দাড়ি রাখার ব্যাপারে রাসূল ﷺ এর নির্দেশ মানে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলারই নির্দেশ। আবার কেউ বলেছেন যে, দাড়ি রাখা ওয়াজিব, আবার কেউ বলেছেন সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ভালো জানেন।
পবিত্র কুরআনে সরাসরি দাড়ি রাখার কথা বলা হয়নি। তবে হারুন (‘আলাইহিসসালাম) এর ঘটনায় দাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে। কুরআনে দাড়ি সম্পর্কিত আয়াতটি হলো – মূসা (‘আলাইহিসসালাম) তাঁর কওমের নিকট ফিরে এসে যখন দেখলেন তাঁর কওম গোমরা হয়ে গেছে, তখন তিনি হারুন (‘আলাইহিসসালাম)-কে প্রশ্ন করলেন এবং হারুন (‘আলাইহিসসালাম) জবাবে বলেন, “হে আমার মায়ের ছেলে! আমার দাড়ি ধরো না এবং আমার মাথার চুলও টেনো না।” [সূরাহ ত্বোয়া-হা (২০): ৯৪] এখানে বুঝা যাচ্ছে হারুন (‘আলাইহিসসালাম) এর দাড়ি ছিলো আর মূসা (‘আলাইহিসসালাম) তাঁর দাড়ি ধরেছিলেন।
আল্লাহর রাসূল ﷺ দাড়ি রাখার আদেশ করেছেন। এখানে একটি বিষয় জেনে রাখা দরকার, দাড়ির বিধানটি শারি’আতের একটি মৌলিক ও সাধারণ বিধান। একে নিছক আরবীয় রীতি বা বিশেষ স্থান-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করা মারাত্মক ভ্রান্তি।
সব কিছু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন-
আমি প্রত্যেক বস্তু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, যাতে তোমরা হৃদয়ঙ্গম কর। [সূরাহ আয-যারিয়াত (৫১): ৪৯]
পবিত্র তিনি, যিনি জমিন থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদকে, মানুষকে এবং যা তারা জানে না, তার প্রত্যেককে জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন। [সূরাহ ইয়া সীন (৩৬): ৩৬]
আমি (আল্লাহ) তোমাদেরকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছি [সূরাহ আন-নাবা (৭৮): ৮]
উপরের আয়াতত্রয় অনুযায়ী দাড়ির মাধ্যমে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়-
১) দাড়িযুক্ত মানুষ (পুরুষ) ও
২) দাড়িবিহীন মানুষ (মহিলা)
কোনো পুরুষকে যদি বলা হয় আপনি কি মহিলা হতে চান? কোনো বিবেকবান লোকই তা চাইবে না । তাহলে আমরা কেন আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশের বিপরীত কাজ করি অর্থাৎ দাড়ি ক্লিন করে মহিলাদের আকার ধারন করি!
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, “আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই।” [সূরাহ আর-রুম (৩০): ৩০]
এ প্রসঙ্গে শয়তানের একটা উদ্ধত ঘোষণাও আল্লাহ তা’আলা বান্দাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, শয়তান বললো, “আমি অবশ্যই তোমার বান্দাদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট অংশ গ্রহণ করবো। তাদেরকে পথভ্রষ্ট করবো, তাদেরকে আশ্বাস দেবো; তাদেরকে পশুদের কর্ণ ছেদন করতে বলবো এবং তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করতে আদেশ দেবো। যে কেউ আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়। এবং তাদেরকে আদেশ করবো, ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করবে।” [সূরাহ আন-নিসা (৪): ১১৮-১১৯]
আয়াতের এ অংশের আলোচনায় শাববীর আহমদ উসমানী রাহ. বলেছেন, ‘দাড়ি মুণ্ডানোও এ আকৃতি পরিবর্তনের মধ্যে পড়ে।’ [দেখুন: তাফসীরে উসমানী (মূল) পৃ. ১২৫; (অনুবাদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১/৪৪৬)] আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করার প্রসঙ্গে তাফসীরে বয়ানুল কুরআনে বলা হয়েছে, এটা ফাসেকী কাজকর্মের অন্তর্ভুক্ত। যেমন দাড়ি মুণ্ডানো, শরীরে উল্কি আঁকা ইত্যাদি। (তাফসীরে বয়ানুল কুরআন ১/২/১৫৭)
বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, জনৈক অগ্নিপূজক আল্লাহর রাসূল ﷺ-এর নিকট এসেছিল। তার দাড়ি মুণ্ডানো ছিলো ও মোচ লম্বা ছিলো। আল্লাহর রাসূল ﷺ বললেন, “এটা কী?” সে বললো, “এটা আমাদের ধর্মের নিয়ম।” আল্লাহর রাসূল ﷺ বললেন, “কিন্তু আমাদের দ্বীনের বিধান, আমরা মোচ কাটবো ও দাড়ি লম্বা রাখবো।” (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১৩/১১৬-১১৭, হাদীস: ২৬০১৩)
পারস্যের সম্রাট কিসরা ইয়েমেনের শাসকের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে দু’জন দূত পাঠান। এদের দাড়ি ছিলো কামানো আর গোঁফ ছিলো বড় বড়। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে তাদের এই অবয়ব এতই কুৎসিত লেগেছিলো যে, তিনি মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “তোমাদের ধ্বংস হোক, এমনটি তোমাদের কে করতে বলেছে?” তারা উত্তর দিলো, “আমাদের প্রভু কিসরা।” তিনি ﷺ তখন উত্তর দেন, “আমার রব্ব, যিনি পবিত্র ও সম্মানিত, আদেশ করেছেন যেন আমি দাড়ি ছেড়ে দেই এবং গোঁফ ছোট রাখি।” (ইবনে জারির আত তাবারি, ইবন সা’দ ও ইবন বিশরান কর্তৃক নথিকৃত। আলবানি (রহঃ) একে হাসান বলেছেন। দেখুন আল গাযালির ফিক্বহুস সিরাহ ৩৫৯ পৃষ্ঠা)
দাড়ি রাখা যা-ই হোক না কেন, প্রকৃত মুসলিম দাড়ি রাখবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দাড়িতে ভালো লাগুক বা না লাগুক, আমরা আল্লাহ ও রাসূল ﷺ কে ভালবেসে দাড়ি রাখবো। এক মুষ্টির অতিরিক্ত অংশ কাটার সুযোগ শারি’আতে রয়েছে। হাদীসের কিতাবে পাওয়া যায়, আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) ও আবু হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এক মুষ্টির অতিরিক্ত অংশ কেটেছেন। আবু যুরআ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, “আবু হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) তাঁর দাড়ি মুঠ করে ধরতেন। এরপর এক মুষ্টির অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন।” (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ১৩/১১২, হাদীস : ২৫৯৯২; ২৫৯৯৯) কিন্তু কোনো সহীহ বর্ণনায় এক মুষ্টির ভিতরে দাড়ি কাটার কোনো অবকাশ পাওয়া যায় না।
আশা করি, এবার সকলের দাড়ি রাখার বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকবে না। এখন আপনি নিজেই ভেবে দেখুন, আপনি কী করবেন। আল্লাহ ও রাসূল ﷺ এর নির্দেশ মানবেন, নাকি সমাজের মানুষের অন্ধ অনুসরণ করবেন? আল্লাহ্ আমাদের সকলকে কুরআন ও সুন্নাহ মেনে জীবন চলার তৌফিক দান করুন। আমীন।