বিষয়ঃ দ্বীনি দাওয়াতের কার্যক্রমে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর উদারতা। 

✍ কৃতঃ মাসুম বিল্লাহ সানি 

———————————————


 উপক্রমণিকাঃ  


দ্বীনের দাওয়াত মানে হল রবের শাশ্বত দ্বীনের দিকে আহ্বান। তাওহীদ ও রিসালাতের দিকে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান। তখন যুগটা ছিল আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগ। রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর আগমণের পূর্বাবস্থা। মানুষগুলো যেন সব অমানুষে পরিনত হয়েছে। সুরতে মানুষ কিন্তু আখলাকে চতুষ্পদ পশুর চেয়েও হিংস্র। তখন না কোন আদর্শ ছিল, না কোন নীতি। সৃষ্টি স্রষ্টাকে চিনে না। শিরিক-কুফর, যেনা-ব্যভিচার, সমকামীতা, পাপাচার, হত্যা-বিশৃঙ্খলা, আর যাবতীয় অনৈতিকতার বিষবাষ্পে চারদিক সয়লাব। আশরাফুল মাখলুকাত তখন আতরাফুল মাখলুকাত হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার উপক্রম। শুধু প্রত্যাশা একটাই-


কাটিবে কবে ঘোর অমানিশা?

উঠিবে শশী - সোনালী ঊষা!

কে দিবে মোদের মুক্তির দিশা?

স্বর্গ ঠেলিয়া নরক অতলে,

হাঁটু গারিয়া স্তুতি দিলে- 

যেন তব করুণা মিলে।

✍ [মাসুম বিল্লাহ সানি]


 মুক্তির দূত রাসূলুল্লাহ(ﷺ)


"নিশ্চয় আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।" [সূরা আম্বিয়া: ১০৭]


জামানার এমন সংকটময় মুহূর্তে মুক্তির দূত হয়ে তশরীফ নিলেন দাতাকর্ণ(ﷺ)। ফিরে এলো খোদায়ী আইন, প্রতিষ্ঠিত হল যাবতীয় ন্যায়বিচার। দ্বীনের পয়গাম পৌঁছাতে পরম প্রেমাস্পদের অম্লান ভালবাসা, তীক্ষ্ণধী, উদারতা আর যাবতীয় কৌশল ছিল ভূতপূর্ব। তন্মধ্যে  উদারতা ছিল অন্যতম। সেইসাথে কল্যাণকর সব হল মাসনুন, অকল্যাণকর সব হল হারাম। 


অধিগম্য বদ্ধ কপাট,

নতশিরে বিনম্র ললাট!

বিভোর নয়ন আপন করে, 

বিলীন এ ভূবন যার তরে!

নিরাধারে যিনি নিগাবান,

আসঞ্জনে তাঁর মিলে পরিত্রাণ!

✍ [মাসুম বিল্লাহ সানি]


 উদারতার মূর্তপ্রতীকঃ


▪"কেউ যেন কারও ওপর জুলুম না করে।" (মুসলিম)

▪ "দুটি অভ্যাস আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। তা হলোঃ দান ও উদারতা।" (শুয়াবুল ঈমান)

মদিনা মনিব(ﷺ)-এ উম্মহ'র রাহবার। যার উদারতা ছিল সুমহান, শিক্ষা ছিল ব্যাপক। দ্বীনের দাওয়াত কার্যে তিনি যে পরিমাণ অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন, সৃষ্টির শুরু থেকে অদ্যাবধি তা নজিরবিহীন। সত্যে তিনি ছিলেন পর্বতের ন্যায় অটল আর উদারতায় যেন কুসুম কোমল।


▪“নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।” [কালাম ৪]

▪ এজন্যই আল্লাহ পাক বলেন, "তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।" [সূরা আহযাব ২১]

▪“উত্তম চরিত্রকে পরিপূর্ণতা দানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।” [মুসনাদে আহমাদ] 

▪“তাঁর মুখের ভাষা বড়ই সুমিষ্ট, হ্যাঁ! তিনি বড়ই প্রেমময়।” [Holy Bible, 5:16]


তিনি সাহাবাগণকে নম্রতাসুলভ আচরণ প্রদর্শন ও অযথা রাগ-ক্রোধ থেকে সর্বদা বিরত থাকার উপদেশ দিতেন। উম্মাহাতুল মু'মেনীনগণের উক্তিতে তা ফুটে উঠেছেঃ 


"রাসূলুল্লাহ(ﷺ) কঠোর ভাষী ছিলেন না, এমনকি প্রয়োজনেও তিনি কঠোর ভাষা প্রয়োগ করতেন না।" [হযরত আয়েশা (رضي الله عنه)]

"আমি রাসূলুল্লাহ(ﷺ) থেকে অধিক উত্তম কোন ব্যক্তি কখনও দেখিনি।" [হযরত সাফিনা (رضي الله عنه), মুসনাদে আহমদ ১৩:৩৮]


দ্বীনি কার্যক্রমের উদ্দেশ্য-হেকমতঃ


ইসলাম হল মুক্তির ধর্ম। যার মূল উদ্দেশ্য হল তাওহিদ ও রিসালাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। যা হেকমত ছাড়া কখনও সম্ভব ছিল না। ঘোষণা দিলেন রব-


▪ "বলুন- আমার প্রতি এ ওহী করা হয়েছে যে, তোমাদের ইলাহ একমাত্র ইলাহ, সুতরাং তোমরা কি আত্মসমর্পণকারী হবে?" (সূরা আম্বিয়া: ১০৭, ১০৮)

▪ "বলুন, এটাই আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকি। আমি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারা। আর আল্লাহ্‌ কতই না পবিত্র এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।”(সূরা ইউসূফ ১০৮)

▪ “আপনি বলুন, হে মানুষ! নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহ্‌র রাসূল।” (আরাফ, আয়াত: ১৫৮)

▪ “আমার কাছ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছিয়ে দাও।” (সহিহ বুখারী ৩৪৬১)


 নারীদের প্রতি রাসূল(ﷺ)'র উদারতাঃ


আইয়্যামে জাহেলিয়াতের ঐ যুগে নারী হয়ে জন্ম নেয়াটা ছিল সবচেয়ে বড় অভিশাপ। জীবন্ত শিশু কণ্যাকে দাফন করা হত, প্রকাশ্যে নারীদের পণ্যের মত ক্রয়-বিক্রয় ও ধর্ষণ করা হত, পিতা কণ্যার সাথে, ছেলের মায়ের সাথে যেনায় লিপ্ত থাকত। তাদের জন্য সম্মান বলতে কিছু অবশিষ্ট ছিল না। সেই যুগে নারীর সম্মানকে উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিলেন রাসূলুল্লাহ(ﷺ)। ঘোষণা দিলেন,


▪ "এ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সম্পদ হল নেককার স্ত্রী।"

[মুসলিম, আস সাহীহ, কিতাবুর রিদা, হাদীস নং ১৪৬৭; নাসাঈ, আস সুনান, কিতাবুন নিকাহ, হাদীস নং ৩২৩২] 

▪ "আজ এটা এক বিশ্বজনীন সত্য যে, মুহাম্মদ নারীদেরকে উচ্চতর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন।"

(প্রাচ্যের পণ্ডিত গিব, গ্রন্থ- "মুহাম্মদেনিজম")



 শত্রুর প্রতি প্রিয়নবী(ﷺ)'র অনুকম্পাঃ


প্রিয়নবী(ﷺ)-এর অনুগ্রহ ছিল শত্রুপক্ষ, মুসলিম-অমুসলিম সবার ক্ষেত্রেই ব্যাপক বিস্তৃত। সাহাবী আমর আদ-দাউসী(رضي الله عنه) যখন তাঁর সম্প্রদায়ের জন্য অভিসম্পাত দিতে বলেন তখন রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বরং দোয়া করলেন,


"হে আল্লাহ! আপনি আদ-দাউস কওমকে হেদায়াত দান করুন এবং সুপথে নিয়ে আসুন।" [মিশকাত ৫৯৯৬]


যেই বুড়ি রাসূল(ﷺ) চলার পথে কাঁটা গেঁথে রাখত, সেই বুড়ি অসুস্থ হয়ে পরলে তিনি তার সেবা-শুশ্রূষা দ্বারা সুস্থ করে তোলেন। রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর নিকট উহুদের দিন থেকেও মারাত্মক ছিল আকাবার দিন। রক্তাক্ত তায়েফের প্রান্তর। ঐদিন পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাগণ এসে বললেন, 


"আপনি ইচ্ছে করলে দুই পাশের দুই পাহাড়কে একত্রিত করে দেব।" [মিশকাত ৫৮৪৮]


কিন্তু রাসূল(ﷺ) অভিশাপ না দিয়ে বরং দোয়া করলেন যেন তাদের বংশধরগণ ইমানদার ও শিরক বিমুখ হয়।

সুমামা ইয়ামামার অধিপতি। মদিনা মুনিব(ﷺ)-কে ভুল বোঝে হত্যা করতে এসে নিজেই বন্দী হয়। অতঃপর রাসূল(ﷺ)-এর উদারতায় মুগ্ধ হয়ে বলেন, 


"এক সময় যেই মদিনা ছিল আমার নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্টতম স্থান, আজ আপনারই কারণে তার প্রতিটি ধূলিকণাও আমার নিকট উৎকৃষ্টতম।" [মুসলিম ৫/১৫৮]


 যুদ্ধ ক্ষেত্রে উদারতাঃ 


বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন বন্দি হয়। রাসূল(ﷺ) এই বন্দিদের প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিলেন। আবু আজিজ নামের এক যুদ্ধবন্দি তাদের সেই প্রতিদানের বিবৃতি দেন এভাবে, 


"অনুগ্রহপ্রাপ্ত হোক মদিনার সেকল লোক, তাঁরা যখন চলত আমাদের নিয়ে চলত। তাঁরা যখন সামান্য খেজুর নিয়েও আহার সংকটে ছিল, তখনও আমাদের গম-রুটি দ্বারা আহার করিয়েছেন।" [ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুইর]


 সনদ ও সন্ধিচুক্তিতে উদারতাঃ


একদিকে মদিনা সনদের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলার  অবসান-ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত রাখতে সাধিত হয় সন্ধিচুক্তি। সেগুলোর মধ্যে হুদাইবিয়ার সন্ধীচুক্তি অন্যতম। মক্কা হল মদিনা মুনিবের জন্মস্থান অথচ ষষ্ঠ হিজরিতে মুসলমানরা হজ্ব করতে গেলে মক্কার কোরাইশরা তাতে বাধা দেয়। মক্কাবাসী তাঁদেরকে মক্কা শরীফে প্রবেশ করতে দিল না। এ মর্মে তাঁরা হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হন।

যার মধ্যে উল্লেখ্য যে, 

▪ তাঁরা সেখানে ৩দিনের বেশি অবস্থান করবেন না। তিনি তাতে সম্মতি দিলেন। 

▪ অতঃপর সন্ধিপত্র থেকে "মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ" কেটে দিতে বলেন। ফিত্নার আশংকায় তিনি তাতেও রাজি হলেন। এটা প্রিয়নবীর মহানুভবতার পরিচয়।

[মুসনাদে আহমদ ১৮৬৫৮]


 মক্কা বিজয়ের পর উদারতাঃ


মক্কার কাফিরেরা মদিনা মুনিব(ﷺ)-কে চরম লাঞ্চিত করে, রক্তাক্ত করে, হত্যার ষড়যন্ত্র করে নিজ ভূমি থেকে হিজরতে বাধ্য করে। অবশেষে মুসলমানগণ যখন তাদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করল তখন ১০ হাজার সৈনিকের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন। 


জনৈক সাহাবী বললেন,

"আজ হচ্ছে তীব্র লড়াই ও হতাহতের দিন।" 

আক্বা(ﷺ) বললেন, 

"বরং আজ হল অনুকম্পা ও দয়া প্রদর্শনের দিন।" অতঃপর সেসব পরাভূত ভীত-সন্ত্রস্তদের নিকট তাশরীফ নিয়ে বললেন- 

"তোমাদের প্রতি আজ আর কোন অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা সকলেই মুক্ত।" [সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪১২]


 মানবসেবায় প্রিয় নবীর উদারতাঃ 


"আল্লাহ(ﷻ) ততক্ষণ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে যায়।" [মুসলিম ২৬৯৯]


মানবসেবাকে তাঁর জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। 

মদিনার রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সত্ত্বেও তিনি বিলাসবহুল জীবন-যাপন করেন নি। তাঁর কাছে আসা উপহার ও হযরত খাদিজাতুল কুবরা(رضي الله عنه)-থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তি সবটুকুই গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। ক্ষুধায় পেটে পাথর বেঁধেছেন তবুও ওনার নিকট এক পেয়ালা দুধ আসলে সেটা উপস্থিত সকলের মধ্যে বন্টন করে দিতেন। ওফাতের পূর্বে ঘরের রুটি পেট ভরে আহার করার মত সঞ্চয় ছিল না। অথচ, 


"রসুল(ﷺ) জীবনে কখনও কোনো সাহায্যপ্রার্থীকে ‘না’ বলেন নি।" [হযরত জাবির(رضي الله عنه) সূত্রে]

"যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন না।" [সহিহ মুসলিম ২৩১৯]

▪"যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্টসমূহ থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে, কিয়ামতের কষ্টসমূহ থেকে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়ায় ছাড় দিবে, আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে ছাড় দিবেন। আর আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে যায়।" [মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি]

‘বিধবা ও অসহায়কে সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য। সে ওই সালাত আদায়কারীর মতো যার ক্লান্তি নেই এবং ওই সিয়াম পালনকারীর মতো যার সিয়ামে বিরতি নেই।"[মুত্তাফাকুন আলাইহি]


 ব্যক্তি জীবনে নম্রতার শিক্ষাঃ  


মদিনা মুনিব(ﷺ)-এর শুভ্র হাসি, আবেগময় কাজ, বচনভঙ্গি সবই ছিল দ্বীনের দিকে দাওয়াত। 

একদা এক ক্ষুধার্ত ইহুদী ওনার ঘরে আশ্রয় নিল, খাওয়া-দাওয়া করল, রাত্রি যাপন করল। পেট খারাপ হওয়ায় সে বিছানা নোংরা করে পালিয়ে গেল। দুই জাহানের বাদশাহ নবী তার এই অসুস্থতা দেখে খুবই ব্যথিত হলেন আর স্বীয় হস্ত মুবারক দ্বারা তা পরিষ্কার করলেন। সুবহানআল্লাহ কে আছে এমন রাজা-বাদশাহ? তাঁর প্রতিটি বাণী আমাদের জন্য কল্যাণের নহর। যাতে স্নাত হয় তামাম মাখলুকাত, প্রবাহিত হয় আল্লাহর দিকে। 


▪ যে ব্যক্তি নম্রতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। 

[মুসলিম, আস সাহীহ, কিতাবুল বিরির ওয়াস সিলাহ, হাদীস নং ২৫৯২; আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৮০৯; ইবন মাজাহ, আস সুনান, হাদীস নং ৩৬৮৭]


"তোমরা জগদ্বাসীর প্রতি দয়া করো, তাহলে আসমানের অধিপতিও তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।" 

[তিরমিযী ২০০২]


দাম্পত্য জীবনে শিষ্টাচারঃ


▪ তােমাদের মধ্যে তারাই শ্রেষ্ঠ, যারা তােমাদের মধ্যে স্ত্রীদের কাছে শ্রেষ্ঠ। 

[তিরমিযী, আস সুনান, কিতাবুর রিদায়ি, হাদীস নং ১১৬২; ইবন হিব্বান, আস সাহীহ, হাদীস নং ৪৭৯]


▪“যে স্ত্রী এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে যে, তার স্বামী তার উপর সন্তুষ্ট, সে জান্নাতে প্রবেশ করল। 

[মুসলিম, আস সুনান, কিতাবুর রিদা, হাদীস নং ১১৬১; ইবন মাজাহ, আস সুনান, কিতাবুন নিকাহ, হাদীস নং ১৮৫৪]


 সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠায় অনুকরণীয় আদর্শঃ


আল্লাহ(ﷻ) রাসূলের মাধ্যমে দ্বীন ইসলামের নূর বর্ষণ করলেন। পথভ্রষ্টদের দ্বীনের দিকে প্রত্যাবর্তনের জন্য হেকমত আর উদারতার কোনরূপ কমতি ছিল না। সর্বকালে, সকলের তরে এমন এক জীবন বিধান প্রনয়ণ করলেন যাতে সর্বযুগে থাকে সাবলিল সমাধান। স্বীকারোক্তি দেয় সবাই "Islam is the complete Code of life." 

তাইতো প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে শিষ্টাচার-শৃঙ্খলার শিক্ষাঃ


"মাতা-পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে প্রভুর সন্তুষ্টি।" (তিরমিজি ৩/১৭৮)

▪ "পিতার সন্তুষ্টিতে প্রভুর সন্তুষ্টি। পিতার অসন্তুষ্টিতে প্রভুর অসন্তুষ্টি।" 

[তিরমিযী, আস সুনান, কিতাবুল বিরির ওয়াস সিলাহ, হাদীস নং ১৮৯৯; হাকিম, হাদিস নং ৭২৪৯]

সচ্চরিত্রের চেয়ে মিজানে ভারী কিছু নেই। 

[তিরমিযী, আস সুনান, কিতাবুল বিরির ওয়াস সিলাহ, হাদীস নং ২০০২; আবু দাউদ, আস সুনান, আল আদব, হাদীস নং ৪৭৯৯ ]

▪ সে ব্যক্তি মুমিনদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানদার, যার চরিত্র তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল এবং যে পরিবার-পরিজনের সাথে বিনম্র। 

[তিরমিযী, আস সুনান, কিতাবুল ঈমান, হাদীস নং ২৬১২] 

▪ সে ব্যক্তি আমার দলের নয়, যে ছােটদের দয়া করে না এবং বড়দেরকে সম্মান করে না। [তিরমিযী, আবু দাউদ]

▪ “ঈমানদার কখনও ভর্ৎসনাকারী, লা'নতকারী, অশ্লীল বক্তা ও ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী হয় না।' 

[তিরমিযী, আস সুনান, কিতাবুল বিরির ওয়াস সিলাহ, হাদীস নং ১৯৭৭; বুখারী, আল আদবুল মুফরাদ, হাদীস নং ৩১২; ইবন হিব্বান, আস সাহীহ, হাদীস নং ১৯২ ] 


 জীবের প্রতি দয়া ও উদারতাঃ 


"জীবে দয়া করে যেইজন সেইজন সেবিছে ইশ্বর।"

[স্বামী বিবেকানন্দ]

এই কথাটির ভাবার্থ মূলত রাসূল(ﷻ)-এর শিক্ষা। তিনি তো এমন নবী যিনি গাছপালা-পশুপাখি, সকল সচল-অচল প্রাণীর দুঃখ-কষ্ট বুঝতেন। তাইতো প্রতিটি জীবের প্রতি সদাচরণের হুকুম দেনঃ


"তোমরা যদি আমার দয়া পেতে চাও, তাহলে আমার সৃষ্ট (জীবের) প্রতি দয়া কর।"

[হাদিসে কুদসী: তাবারানী: উত্তম-চরিত্র ৪১]

▪"'আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দেবেন, যারা দুনিয়াতে মানুষকে (অন্যায়ভাবে) শাস্তি দেয়।"(মুসলিম ৮/৩২)


▪ নবী (ﷺ) বলেন -“যে ব্যক্তি একটি বৃক্ষ রোপন করল অথবা কোন ফসল উৎপাদন করল, আর উক্ত বৃক্ষের ফল বা ফসল কোন মানুষ বা কোন চতুষ্পদ জন্তু বা কোন হিংস্র জন্তু বা কোন পাখি ভক্ষণ করল তাহলে সে ব্যক্তির জন্য উহা সাদকাহ হিসেবে পরিগণিত হবে”। (সাহীহ আবি ‘আওয়ানা, হাদীছ নম্বর-৩৩২, মুসনাদু আহমাদ, হাদীছ নম্বর-১৫২৩৫ ও কানযুল ‘উম্মাল, হাদীছ নম্বর-৯০৭৭)।


▪ হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন- “একদা একটি কুকুর প্রচন্ড গরমের দিনে একটি কুয়ার পাড়ে পিপাসায় কাতর হয়ে জিহবা বের করে হাঁপাচ্ছিল এবং কুয়ার চারদিকে ঘুরছিল। এ অবস্থা দেখে বানী ইসরাইলের একজন স্ব-ঘোষিত বেশ্যা মহিলা নিজের ওড়না দ্বারা মোজা বেঁধে কুয়াতে নামিয়ে পানি উত্তোলন করে কুকুরটিকে পান করাল। এর ফলে তার সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেয়া হল।” অপর এক বর্ণনায় হাদীছের শেষাংষে আছে- সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন-হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের চতুষ্পদ জন্তুগুলোকে পানি পান করালেও কি সাওয়াব পাব? নবী (ﷺ) উত্তরে বলেন - প্রতিটি জীবকে পানি পান করালেই সাওয়াব পাওয়া যাবে”। (সাহীহুল বুখারি, হাদিছ নম্বর-২৫৫২, ৩৩২১, ও সাহীহ মুসলিম, হাদিছ নম্বর-৫৯৯৭, ৫৯৯৮)। 


▪ নবী (ﷺ) বলেন-“একজন স্ত্রীলোক একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল। অতঃপর অনাহারে বিড়ালটি মারা যায়। এ অপরাধে স্ত্রীলোকটিকে শাস্তি দেয়া হয় এবং জাহান্নামী বলে ঘোষণা দেয়া হয়। সে উহাকে বেধে রেখেছিল, অথচ তাকে আহারও করায়নি, পানও করায়নি। অপরপক্ষে তাকে ছেড়ে দেয়নি, যাতে সে জমিনের লতা-পাতা খেয়ে বাঁচত”। (সাহীহ মুসলিম, হাদীছ নং-৫৯৮৯)।

নবী (ﷺ) এর যুগে ভ্রমণের জন্য একমাত্র যানবাহন ছিল জন্তু। জন্তুকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কষ্ট দেয়াও অমানবিক। তাই নবী (ﷺ) কোন জন্তুর উপর আরোহন করতঃ কারো সাথে কথা বলে বা অন্য কোন প্রয়োজনে সময় নষ্ট করে জন্তুকে কষ্ট না দিতে ফরমান জারি করেন।

▪ তিনি (ﷺ) বলেন-“তোমরা সুস্থ অবস্থায় এ সমস্ত পশুদের উপর আরোহন কর এবং অসুস্থ অবস্থায় এদেরকে ছেড়ে দাও। আর তোমরা সেগুলোকে চেয়ারে পরিণত কর না”। (মুসনাদু আহমাদ, হাদীছ নম্বর-১৫৬৭৯ ও মুস্তাদরাক আল হাকিম, হাদীছ নম্বর-১৬২৫)। 


পশুদেরকে অভুক্ত রাখা এবং তাদেরকে দূর্বল ও কৃশকায় করে তোলাও সমীচীন নয়। এ ব্যাপারে 


▪ সাহল ইবনুল হানযালিয়্যাহ আল আনসারী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীছ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন- “একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একটি উটের নিকট দিয়ে গমন করছিলেন। তিনি দেখলেন - ক্ষুধায় উটটির পেট পিঠের সাথে লেগে গেছে। এ অবস্থা দেখে তিনি (ﷺ) বললেন-এসব নির্বাক পশুদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। এরা কথা বলতে পারে না এবং প্রয়োজন ব্যক্ত করতে পারে না, এরা যখন আরোহী বহনের যোগ্যতা রাখে তখন তাদের পিঠে আরোহন কর এবং অসুস্থ অবস্থায় তাদেরকে ছেড়ে দাও”। (সুনানু আবী দাউদ, হাদিছ নম্বর - ২৫৪৮, ২৫৪৯ ও ২৫৫০)।


কোন জন্তুর দ্বারা তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ নেয়া বৈধ নয়। 


▪ ‘আবদুল্লাহ ইবন জা‘ফার বর্ণিত হাদীছে আছে- “একদা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এক আনসারীর বাগানে গমন করেন। সেখানে তিনি (ﷺ) একটি উট দেখতে পান। উটটি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)কে দেখে চেঁচিয়ে উঠল। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। নবী (ﷺ) উটটির কাছে গিয়ে চোখের পানি মুছে ফেললেন। ফলে সে শান্ত হল। অতঃপর নবী (ﷺ) জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কার উট? মালিক এসে বললেন- আমি এর মালিক হে আল্লাহর রাসূল! রাসূল (ﷺ) বললেন -এ পশুর ব্যাপারে তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না? আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন এ পশুকে তোমার মালিকানায় দিয়েছেন। সে আমার নিকট অভিযোগ দায়ের করেছে যে, তুমি তার কাছ থেকে কাজ নাও ঠিকই কিন্তু তাকে ঠিকমত আহার করাও না”। (সুনানু আবী দাউদ, হাদীছ নম্বর-২৫৫১, সুনানুল বায়হাকী আল কুবরা, হাদীছ নম্বর-১৫৫৯২)। 


▪ অনুরূপ একটি হাদীছ বর্ণনা করে সাহল ইবনুল হানযালিয়্যাহ আল আনসারী (রা.) বলেন- “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোন এক প্রয়োজনে বের হলেন। দিনের প্রথম ভাগে মসজিদের দরজার সামনে বাঁধা একটি উটের সামনে দিয়ে অতিক্রম করলেন। দিনের অপর ভাগে সেই স্থান দিয়ে অতিক্রম করার সময় দেখলেন যে, উটটি একই অবস্থায় বাঁধা আছে। অতঃপর তিনি (ﷺ) বললেন-এই উটের মালিক কোথায়? তাকে খুঁজা হল, কিন্তু পাওয়া গেল না। অতঃপর রাসূল (ﷺ) বললেন-এই সমস্ত জন্তুর ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর সুস্থ্য অবস্থায় এদের পৃষ্ঠে আরোহন কর”। (মুসনাদু আহমাদ, হাদীছ নম্বর-১৭৬২৫)।


 অমুসলিমের অধিকার রক্ষায় উদারতাঃ


দাতাকর্ণ নবী(ﷺ) বলেন,

▪ "যে কোনো অমুসলিম নাগরিকের উপর জুলুম করল, কিয়ামতের দিন আমি তার বাদী হব। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদী হবো, কিয়ামতের দিন আমি তার উপর  বিজয়ী হবো।"

"(আবু দাউদ ৩০৫২)

▪ "যে মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিককে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, তার জন্য জান্নাত হারাম।" (নাসায়ী ৪৭৪৭)

▪ "সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না।" (বুখারী ২৯৯৫)

"যে কোনো অমুসলিমকে উত্যক্ত করলো, সে আমাকেই উত্যক্ত করলো। আর যে আমাকে উত্যক্ত করলো আল্লাহকেই সে উত্যক্ত করলো।"

(অমুসলিমের প্রতি ইসলামের উদারতা, ড. ইউসুফ আল-কারযাভী, পৃ: ২১-২২)।

▪ "কোনো অমুসলিম নাগরিককে যে অত্যাচার করলো বা তার অধিকার ক্ষুণ্ন করলো বা তাকে সাধ্যাতীত পরিশ্রম করালো বা তার অমতে তার থেকে কিছু নিয়ে নিলো, কিয়ামতের দিন আমি হব তার বিপক্ষে অভিযোগ করবো।"

(অমুসলিমের প্রতি ইসলামের উদারতা, ড. ইউসুফ আল-কারযাভী, পৃ: ২১-২২)


রাসূলুল্লাহ(ﷻ)-এর আদর্শে বিমুগ্ধ হয়ে মহাত্মা গান্ধী, মাইকেল হার্ট, ঐতিহাসিক গীবন, আলফ্রেড দ্য ল্যামার্টিন, জন উইলিয়ম ড্রেপার, জর্জ বার্ণার্ড শ', নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সহ অসংখ্য অমুসলিম মনীষীগণ ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। যার বাস্তব চিত্রঃ


"মানুষের মহত্ত্ব পরিমাপের সকল মানদন্ডগুলোকে জড়ো করে আমাদের নিকট জিজ্ঞাসা করো, তাঁর (বিশ্বনবীর) চেয়ে অধিক মহৎ আর কোনো মানুষ আছে কি?" 

"He is The great religious teacher in the East."

🖋 আলফ্রেড দ্য ল্যামার্টিন


‘‘আমি ভবিষ্যতবাণী করছি যে, আগামীতে মুহাম্মদ (ﷻ)-এর ধর্ম ইউরোপের নিকট গ্রহণীয় হবে।’’

🖋 মনীষী বার্নার্ড শ'


"মুহাম্মদ (ﷻ) হলেন সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় বিপ্লবী চেতনা, যা বিমোহিত করেছে বিশ্বজাতিকে নতুন ও দীর্ঘস্থায়ী আদর্শ হিসেবে।" 

🖋ঐতিহাসিক গীবন

 

"আমি আল্লাহর মহিমা বর্ণনা করি এবং পূতঃপবিত্র চরিত্র ও দিব্য প্রেরণাদীপ্ত মুহাম্মদ (ﷻ) কে আর পবিত্র কুরআনকে শ্রদ্ধা নিবেদন করি।"

🖋 মহাবীর নেপোলিয়ান, গ্রন্থঃ অটোবায়োগ্রাফী


"ইসলামের প্রসারের কারণ হিসেবে কাজ করেছে নবীর দৃঢ় সরলতা।"

🖋 মহাত্মা গান্ধী, Young India-1924.


"বিশ্বের সমগ্র ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (ﷻ) ছিলেন সর্বাপেক্ষা সফলকাম।"

🖋 ইনসাইক্লোপিডিয়া রিটেনিকার লেখক


 ‘‘দি হানড্রেড’’ গ্রন্থে বিশ্ব মনীষীদের মধ্যে শীর্ষতম শিখরে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷻ)-এর অবস্থানের স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।"

🖋 মাইকেল হার্ট


প্রিয়নবীর দ্বীনি দাওয়াতে আল্লাহ পাকের সত্যায়নঃ


"আজ আমি তোমাদের জন্য আমার দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামতকে তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করে দিলাম আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা: ৩)


 পরিসমাপ্তিঃ 


মা'আরিফ কে যো আরিফ, 

হুসনে আপ কী ও তারিফ!

কিস্কি হাত হে বল সাকি,

জালওয়া আপকা চল জারি!

ইশক্বে বেখুদি হার উম্মাহ তেরা-

তারিখ মে কেয়া অর যুবা মে কেয়া,

খোদা নে আপকো খোদ আপনা বানালিয়া!

✍ [মাসুম বিল্লাহ সানি]


দ্বীন প্রচারে নবীজী(ﷺ)-এর উদারতা ও অনন্য শিষ্টাচারের প্রভাব ছিল বর্ণনাতীত। যার সমাপনী টানা অসম্ভব। সৃষ্টি জগতে যার কোন দৃষ্টান্ত নেই। অথচ এ উম্মাহ আজ অসাড়তায় মগ্ন, তমসাচ্ছন্ন। উম্মাহর এই দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে হলে একমাত্র উদারতাই পারে সকল সংকীর্ণতা দূর করে সম্ভাব্য এক মুক্তির ঊষা উপহার দিতে। পরিশেষে আ'লা হযরতের ভাষায় ইতি টানলামঃ


"লামইয়াতি নাযীরুকা ফী নাযারিন,

মিছলে তো না শোদ পয়দা জানা!"

✍ [আ'লা হযরত রহঃ]


Top