শানে রিসালাত
নারায়ে রিসালাত – ইয়া রাসুলাল্লাহ!
===================
মদিনা শহর। মধ্য দুপুর। খাঁখাঁ রোদ্দুর। দুপুর আরামের সময়। ঘরেই থাকে সবাই। আজ ব্যতিক্রম। সবাই বাহিরে। রাস্তায়-মোড়ে দাঁড়িয়ে। তাকিয়ে দূরে-বহুদূরে। ধূধূ মরুপ্রান্তরে। তিঁনি আসছেন! তিঁনি আসছেন! আরো আগেই আসার কথা। দেরী হয়ে গেছে। সবাই উৎকণ্ঠিত। মহাপ্রেমাস্পদের পবিত্র পদচিহ্ন পড়বে পথে পথে আজ মদিনায়। তাঁরই বিরহে ব্যাকুল জনতা বিপুল।
তিঁনি আসছে! তিঁনি আসছেন! আসছেন মদিনা-মুনিব!আসছেন আঁখির আশ্রয় চিরঞ্জীব!আসছেন প্রেমাস্পদ পথের প্রদীপ!
বালকেরা, যেন দিচ্ছে পাহারা- খেজুর গাছে উঠে। চেয়ে দ্যাখে- সেই সুদূরে, তাঁর আসার, কোনো চিহ্ন কী ফুটে! নেই কিছু নেই একেবারি। শুধু মরুধূধূ- বেখেয়াল বালিয়াড়ি। হঠাৎ! আচমকা! কী যেন যায় দেখা! তিনটি বিন্দু যেন মরুর ক্যানভাসে। বিন্দুর উপরে উপরে মেঘ ছায়া হয়ে ছুটে আসে।
এগিয়ে আসছে তাঁরা। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে চেহারা। বালকেরা চেঁচিয়ে উঠে। যেন বেলালের আরশ অবধি আযান ছুটে। তিঁনি এসেছেন! তিনি এসেছেন! মদিনাবাসী! তিঁনি এসেছেন! তিঁনি এসেছেন!
নারীপুরুষ, ফিরে পায় হুঁশ। ছুটে ঘরের ছাদে উঠে। পরম প্রেমাস্পদের দর্শন একটু যেন জুটে! ঐ তিঁনি এলেন! ঐ এলেন! এক রাজসিক সত্তা- যিঁনি সাজেন নি কোনো মুকুটে।
থেমে যায় হৃদয়, সাথে সময়। হৃদয়ের হয়ে চিৎকার করে কণ্ঠনালী, গলা- ইয়া মুহাম্মাদ! ইয়া রাসুলাল্লাহ! ইয়া মুহাম্মাদ! ইয়া রাসুলাল্লাহ!
সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম।
_______
হাদিসটি সহিহ মুসলিমের। খণ্ড ১৯। ৭৭০৭ নং হাদিস। সহিহ হাদিস। সাহাবীগণ “ইয়া রাসুলাল্লাহ” শ্লোগানে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। ঘটনাটা হিজরতের সময়কার। অর্থাৎ- সাহাবীগণও “ইয়া রাসুলাল্লাহ” ডাকতেন। আসুন আরেকটি হাদিস দেখি। এক অন্ধ সাহাবীর গল্প। হাদিসটি অস্বীকারের সুযোগ নেই।
হযরত ওসমান গনি এঁর যুগ। ৩য় খলিফা। এক ব্যক্তি বিপদে পরেছে। এলো খলিফার কাছে। খলিফা ব্যস্ত ছিলেন। সময় দিতে পারছিলেন না। সে ব্যক্তি গেল ওসমান বিন হানিফ এঁর কাছে। যিনি একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী। দুই ওসমানকে এক করিয়েন না আবার। যাহোক, বিন হানিফ ব্যক্তিকে বললে- দু’রাকাত নামায পড়ুন। এরপর রওজার সামনে যান। এবং এ দো’আ করুন-
“ইয়া আল্লাহ্! রাসুল (দ) এঁর বদৌলতে (ওয়াসিলায়) আপনার সাহায্য মাগি, যিনি রহমতের নবী। ইয়া মুহাম্মাদ! আমি আল্লাহ্র দিকে ফিরেছি আপনার বদৌলতে। আপনার মাধ্যমে তার সাহায্য চাই। যাতে আমার প্রয়োজন পূরণ হয়”।
এরপর ওসমান বিন হানিফ সে ব্যক্তিকে খলিফার দরবারে যেতে বলল। তিনি গেলেন। এবার পুরাই উলটা কারবার। খলিফা তাঁকে কাছে বসালেন। আপ্যায়ন করলেন। এও বললেন- আগামীতে সরাসরি তাঁর কাছে যেতে।
সে ব্যক্তি ওসমান বিন হানিফকে ধন্যবাদ দিলেন। তিনি ভেবেছিলেন বিন হানিফ হয়ত খলিফাকে সুপারিশ করেছেন তাঁর জন্য। বিন হানিফ বললেন- সুপারিশ করি নি। যে দো’আ করেছেন- সে দো’আর ফসল পেয়েছেন মাত্র। এক অন্ধ সাহাবীকে খোদ রাসুল-অতুল (দ) এ দো’আ শিক্ষা দিয়েছিলেন। সে অন্ধ সাহাবী দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে চাইত। এ দো’আ করার পর সে দৃষ্টি ফিরে পায়।
সূত্র- মুজাম আল কাবির লিল তিবরানি, ৭ম খণ্ড, হাদিস ৮২৩২। মুজাম আল সাগির লিল তাবরানি, ২য় খণ্ড, হাদিস ৫০৭। আল-তাঘিব ওয়াল তাহযিব, মুস্তাফা আল বাবি, ১ম খণ্ড, ২৭৪ পৃষ্ঠা। মাজমা’আয যাওয়া’ইদ, ২য় খণ্ড, ২৭৯ পৃষ্ঠা।
খেয়াল করুন- মদিনা-মুনিব (দ) নিজে ‘ইয়া মুহাম্মাদ’ বলে সাহায্য চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। এটা প্রমাণিত ‘ইয়া’ যোগ করে রাসুলকে ডাকা যাবে। এখন বলবেন- ‘ইয়া মুহাম্মাদ’ জায়েজ, কিন্তু ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ’ জায়েজ না। আরেকটা যুক্তি হচ্ছে- মদিনা-মুনিব (দ) তখন উপস্থিত ছিলেন। সামনা সামনি ছিলেন। তাই হয়ত ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ/হে আল্লাহ্র রাসুল’ বলে ডাকা যেত। তিঁনি এখন চোখের আড়ালে। সামনে নেই। তাই ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ’ হয়ত বলা যাবে না!
আসুন, ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী এঁর কাছে যাই। যিনি ‘তাফসীরে কাবির’ লিখেছেন। এটি কোর’আনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ। তিনি ১২১০ সালে ইন্তেকাল করেন। ৮০৯ বছর আগের। তাঁকে অস্বীকার কোনো মোল্লা করতে পারবে না। এঁনার কাছে দুটির উত্তরই পাব।
তাফসীরে কাবিরের ৫ম খণ্ড। ৪৭৫ পৃষ্ঠা। ভিন্ন মুদ্রণে পাতা এদিক-সেদিক হয়। পাতাটা বিষয় না। খণ্ডটা খেয়াল রাখুন। সেখানে তিনি একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। প্রথম খলিফা। তিঁনি বিছানায় শুয়ে। কিছু বাদেই ইহধাম ত্যাগ করবেন। তিনি শেষ ইচ্ছে জানালেন- আমার জানাযা রাসুল-অতুল (দ) এঁর রওজার সামনে নিবে। এবং বলবে- আসসালাম আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ, আবু বকর আপনার দরজায় উপস্থিত হয়েছে। তাই করা হল। সে কথা বলার সাথে সাথে রওজার দরজা খুলল নিজে নিজে। পবিত্র রওজা থেকে আওয়াজ এলো- প্রেমিককে প্রেমাস্পদের নিকটে নামাও।
খেয়াল করুন- জানাযা রওজার সামনে নেয়া হয়েছিল। এবং বলা হল “... ইয়া রাসুলাল্লাহ”। তাহলে কী দাঁড়াল? বিষয়টা কী এমন না যে- মদিনা-মুনিব (দ) চোখের আড়াল হবার পরেও “ইয়া রাসুলাল্লাহ” বলা সাহাবাগণের সুন্নাত। তাঁরা তো এটাকে ফালতু বলেন নি! {এখানে আরেকটা বিষয় প্রমাণিত- মদিনা-মুনিব (দ) চোখের আড়াল হবার পরেও জিন্দা, হায়াতুন্নাবী। }
এবার আরেকটা কথা। অনেকেই বলবে- রওজার নিকটে ছিলেন তাঁরা। তাই হয়ত ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ” ডাকা যাবে। দূর থেকে ডাকা যাবে না। আসলে কথা হচ্ছে, শয়তানের শর্তের অভাব নেই। হাত কিন্তু তিনটা। ডান হাত, বাম হাত আর অজুহাত। না মানার অজুহাতের অভাব হবে না। যাহোক, আসুন আরেকটা ঘটনা জানি।
কারবালা শেষ। পাপাত্মা এজিদ বাহিনী ফিরে যাচ্ছে। সাথে বন্দী করেছে আহলে বাইতের, নবীবংশের পবিত্র সদস্যাগণকে। আর একমাত্র জীবিত পুরুষ- ইমাম শাম্মে হুদা জয়নুল আবেদিন আলাইহিস সালামকে। এজিদিরা তাঁকে শহীদ করতে পারে নি। তাঁকে বন্দী করে নিচ্ছিল। সে এক বিশাল ঘটনা। আরেকদিন বলব।
শারীরিক ভাবে অসুস্থ্য ছিলেন ইমাম। এরপর পুরো পরিবার হারানোর শোক। সাথে এজিদিদের অত্যাচার। ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে গেয়ে উঠলেন এক অমর কাসিদা। কাসিদা অর্থ, গীতিকবিতা, শোকগাথা। যার প্রথম লাইন- ইন্নিল তিয়া রিহাস সাবা...।
সেই কবিতার এক লাইন- ইয়া রাহমাতাল্লিল আলামিন, আদ্রিকলি জাইনুল আবেদিন। মানে- হে রহমাতুল্লিল আলামিন, জয়নুল আবেদিনকে সাহায্য করুন।
মদিনা থেকে কারবালা ১২৭৫ কিলোমিটার। ইয়া রামাতুল্লিল আলামিন আর ইয়া রাসুলাল্লাহ একই ভাবার্থ। এতদূর থেকেও ডাকা যায়! সাহায্যও চাওয়া যায়!
তবুও মানবে অনেকে। বলবে- একই ভাবার্থ মানি না, আর তাঁরা কাছাকাছি যুগের। তাঁরা হয় ডাকতে পারবে। এতবছর পর আমরা ডাকতে পারব না। (সময় নিয়ে হাসুন)
তো, এদের উদ্দেশ্যে শেষ দুটি দলীল। প্রথমটা ইবনে কাইয়্যুম জাওজির। সে ওহাবিতন্ত্রের বড় ইমাম। ১৩৫০ সালে মৃত্যু। ৬৬৯ বছর আগে। তার লেখা- জালাউল আফহাম। এখানে একটা ঘটনা লিখেছে। লিখেছে-
জনৈক আবু বকর বিন মুজাহিদ একটি স্বপ্ন দেখলেন। সে দেখল- হযরত শিবলি নামে এক বুজুর্গকে রাসুল-অতুল (দ) এঁর সামনে নেয়া হল। মদিনা-মুনিব (দ) হযরত শিবলির দুচোখের মাঝে চুমু দিলেন। জনৈক আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন- আপনি কেন তাঁকে চুমু দিলেন? মদিনা-মুনিব (দ) বললেন- প্রত্যেক নামায বাদ শিবলি “লাকাদ জা’আকুম রাসুলুম মিন আনফুসিকুম...” পাঠ করে। শেষে সাল্লালাহু আলাইকা “ইয়া রাসুলাল্লাহ” তিনবার পড়ে।
খেয়াল করুন- ইয়া রাসুলাল্লাহ পড়ার কারণে কপালে চুমু নসিব হয়। আর এ কথা আমাদের না। গোঁয়ারগোবিন্দদের গুরুঠাকুরদের। আর কী বলার থাকে?
শেষ কথা। ইবনে কাইয়্যুম জাওজি অনেক আগের। আশপাশের না। তাই ভূতনগরের আরেক গুরুঠাকুরের উক্তি দিচ্ছি। সে মাত্র এক-দেড় শতাব্দী আগের। নাম- আশরাফ থানভি। তার বই- শুকুর আল-নিমাহ বি জিকির রাহমাত আল-রাহমাহ। সেটার আঠারো পৃষ্ঠা। সে বলে- আজ আমার হৃদয়গহীন থেকে দরূদ পড়তে মন চাইছে। আর দরুদটি হচ্ছে- আসসালাতু ওয়াসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ!
আর কিছু কওনের নাই। হেদায়াত শুধু খোদার হাতে। সীলগালা অন্তরে গরিব গালিবের চিৎকার পৌঁছাবে না।
সব কথার এক কথা বলেছেন আ’লা হযরত। আমার ইমাম আহমাদ রেযা খান। তিনি বলেন-
উঠতে ব্যায়েঠতে মাদদ কি ওয়াস্তে
ইয়া রাসুলাল্লাহ পুকারা ফির তুঝকো ক্যেয়া
- উঠতে-বসতে সাহায্যের নিমিত্তে
ইয়া রাসুলাল্লাহ ডাকি, তাতে তোর কী!