বিষয়: আলা হযরতের কালামে এজিদ প্রসঙ্গ: বিভ্রান্তির নিরসন।

লেখকঃ- আবুল কাশেম মোহাম্মদ ফজলুল হক
উপাধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়বিয়া কামিল মাদরাসা

আমার ছবির নিচে স্ক্রিনশট থেকে বানানো পোস্টারে আলা হযরতের যে কালামটি আছে, আমার একজন ফেবু বন্ধু এটি পাঠিয়েছেন। আলা হযরতের এই কালামটির ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন।
এই বাক্যের বাহ্যিকরূপ দ্বারা অনুমিত হয় যে, ইমাম হুসাইন (রা.) -এর শাহাদাতের দায় আলা হযরত পাপিষ্ঠ এজিদের ওপর চাপানো না জায়েজ ও হারাম বলেছেন এবং এই কথার ওপর উল্লাসিত হয়ে 'সুবহানাল্লাহ' উচ্চারণ করেছেন।
বিষয়টি মোটেই এমন নয়। বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে কয়েকটি কারণে:
১. বাক্যটি যেখান থেকে শুরু এবং যেখানে গিয়ে শেষ তার পুরোটা না এনে এখানে অর্ধেক বাক্য উদ্ধৃত করে বাকি অর্ধেক বাদ দেয়া হয়েছে।
২. অর্থের মধ্যে বিকৃতি সাধন করা হয়েছে।
৩. পুরো বাক্যের বাদ পড়া কথাটি এই বাক্যের ﺍﻟﺰﺍﻣﯽ  জওয়াবের চরিত্রটা প্রকাশ করছে, যা ঐ পোস্টারে উল্লেখ করা হয়নি।
৪. এই কথাটা কি উদ্দেশ্যে কাদের জবাবে বলা হয়েছে, তাও এখানে উল্লেখ না করার কারণে।

প্রেক্ষাপট:
এক লা মাযহাবির কিতাব ﻏﻔﺮ ﺍﻟﻤﺒﻴﻦ - এর রেফারেন্স দিয়ে হাফেজ আব্দুল্লাহ নামে একজন প্রশ্ন করেছে যে, ঐ কিতাবে 'কথিত আছে' বলে এক লা মাযহাবি লিখেছে, ইমাম আবু ইউসুফ (রা.) নাকি যাকাত আদায় না করার কৌশলের অংশ হিসেবে বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ওনার সম্পদগুলো নিজের স্ত্রীকে হেবা করে দিতেন এবং স্ত্রীর সম্পদ নিজের নামে হেবা গ্রহণ করতেন। অথচ একথায় শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য কোনো সনদ বা দলিল নেই; কেবল 'কথিত আছে' বলেই হানাফি এই মহান ইমামের প্রতি এমন একটা উদ্ভট কথা আরোপ করা হল। কারণ লা মাযহাবিরা হানাফি মাযহাব ও এই মাযহাবের কোনো ইমামকেই সহ্য করতে পারে না। কখনো কখনো কোনো দলিল ছাড়া, আবার কখনো কখনো দুর্বলতম কোনো দলিলের ছিটেফোঁটা পেলেই তারা হানাফি মাযহাবের ওপর আক্রমণ করে বসে।

জবাবে এজিদ প্রসঙ্গ কেন আসলো:

'কথিত আছে' বলে সারবত্তাহীন একটা কাহিনীর ওপর নির্ভর করে হানাফি মাযহাবের অন্যতম প্রধান ইমামের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগকে খণ্ডন করতে ইমাম আলা হযরত এজিদের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন— যে এজিদকে আহলে হাদিস লা মাযহাবিরা ইমাম হুসাইন (রা.)- এর শাহাদাতের ঘটনায় দায়মুক্ত বলে দাবি করে।
 এবং তারা বলে,ইমামকে শহিদ করার জন্য এজিদ নির্দেশ দিয়েছে বলে কোনো প্রমাণ নেই। অকাট্য প্রমাণ ছাড়া কোনো মুসলমানের বিরুদ্ধে কবিরা গুনাহ, ফিসক, লানত ইত্যাদি নিসবত করা অন্যায়। এ ক্ষেত্রে লা মাযহাবিরা ইমাম গাঁজালি (রা.) -এর একটা ব্যক্তিগত মতকে তাদের স্বপক্ষে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। সে হিসেবে তাদের পুরো বক্তব্যটা এরকম দাঁড়ায়, ইমাম গাঁজালি (রা.)- এর বক্তব্য অনুসারে যেহেতু এজিদ ইমাম হুসাইন (রা.) -কে শহিদ করতে নির্দেশ দিয়েছে মর্মে কোনো মুতাওয়াতির দলিল নেই। সুতরাং মুতাওয়াতির দলিল নেই বিধায় হত্যাকাণ্ডের দায়ভার এজিদের ওপর চাপানো যাবে না।

এজিদকে 'শাহাদাতে হুসাইন' থেকে দায়মুক্তি দেয়ার জন্য আহলে হাদিস যে দলিল ব্যবহার করে, ইমাম আলা হযরত তাদের এই দলিল দিয়েই ইমাম আবু ইউসুফকে তাদের 'কথিত' অভিযোগ থেকে মুক্ত ও পবিত্র প্রমাণ করেছেন।
আর তা এভাবে যে, মুতাওয়াতিরের মতো অকাট্য দলিল না থাকার কারণে তোমাদের মতে এজিদকে 'কতলে হুসাইনে' অভিযুক্ত করে লানত দেয়া যাবে না। অথচ আশ্চর্য হলো, মুতাওয়াতির তো দূরে থাক, দলিলের সামান্য ছিটেফোঁটা ছাড়াই ইমাম ইমাম আবু ইউসুফ (রা.) -এর প্রতি তোমরা একটা অভিযোগ দাঁড় করালে!

আলা হযরত মূলত: এই কথাই বলতে চেয়েছেন এবং এই স্টাইলে ইমাম আবু ইউসুফের পবিত্রতা প্রমাণ করার জন্য প্রথমে আহলে হাদিসওয়ালারা ইমাম গাঁজালির যে বক্তব্যটা দলিল হিসেবে ব্যবহার করে, তা উল্লেখ করেছেন। ভূমিকাস্বরূপ এবং পরে ﺍﻟﺰﺍﻣﯽ ﺟﻮﺍﺏ - সাজিয়েছেন এভাবে,
ﺳﺒﺤﺎﻥ ﺍﻟﻠﮧ! یزید پلید کی طرف تو یہ نسبت ناجائز و حرام ہو کہ اس نے امام مظلوم سیدنا حسین رضی اللہ عنہ کو شہید کرایا اس لئے کہ اس کا حکم دینا اس خبیٹ سے متواتر نہیں اور سیدنا امام ابو یوسف رحمت اللہ علیہ کی طرف ایسی شدید عظیم بات نسبت کرنا حلال ٹھہرے حالانکہ تواتر چھوڑ اصلا کوئی ٹوٹی پہوٹی سند بھی نہیں

অর্থ: "সুবহানাল্লাহ! ইমাম হুসাইন রা, কে শহীদ করার হুকুম এজিদ দিয়েছে এটা মুতাওয়াতির নয় বিধায় এজিদ ইমামে মজলুমকে শহীদ করিয়েছে একথা এজিদের দিকে সম্পর্ক করা না-জায়েজ, ও হারাম হয়ে গেল! আর ইমাম আবু ইউসুফ রা, এর দিকে এত বড় কঠিন কথা জুড়ে দেয়া হালাল মনে করলে— অথচ মুতাওয়াতির তো দূরের কথা, কোন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর দলীল পর্যন্ত নাই!!" ( ফাতাওয়া রেজভিয়া, ১০ ম খন্ড, ১৯৪ পৃষ্ঠা)
তার মানে দলীল না থাকায় ওটা হারাম হলে এটাও হারাম হবে। তাদের দলিলকেই আলা হযরত ইমাম আবু ইউসুফের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে মুক্তির দলিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা ঠিক তার পরেই আলা হযরতের এই কথায় স্পষ্ট,
فقد تمت الحجة بالحجة علي الحجة
দলিলের ওপর দলিল দ্বারা দলিল পরিপূর্ণ হলো।

আহ! সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যদি আলা হযরতের এই কথাটুকু মনযোগ দিয়ে দেখত ও বুঝত! তিনি ﺣﺠﺔ - শব্দটি এখানে তিনবার ব্যবহার করে মূলত: ওনার প্রমাণ উপস্থাপনের মূল পদ্ধতি ও ফলাফলের কথা বলে দিয়েছেন।
তিনবার বলার কারণ তিনপক্ষ। এক পক্ষ লা মাযহাবি, যাদের এজিদকে শাহাদাতে ইমাম হুসাইন থেকে দায়মুক্তি দেয়ার জন্য একটা দলীল প্রয়োজন। দ্বিতীয় পক্ষ ইমাম আবু ইউসুফ, যাকাত না দেয়ার হিলার অভিযোগ থেকে দায়মুক্তির জন্য এখানেও একটা দলিল প্রয়োজন। তৃতীয় পক্ষ ইমাম আলা হযরত অভিযোগকারী আহলে হাদিসের কথিত অভিযোগ থেকে ইমাম আবু ইউসুফকে পবিত্র প্রমাণ করার জন্য তাঁরও একটা দলিল প্রয়োজন।

ব্যস! আমার আলা হযরত এজিদকে দায়মুক্তির জন্য আহলে হাদীস যে দলিল বা যুক্তি উপস্থাপন করে থাকে তাদের সেই দলিলটাকেই হাতে নিয়ে ইমাম আবু ইউসুফ (রা.) এর পবিত্রতার দলিল হিসেবে প্রদান করলেন, কিতাবে যাকে এলযামি জওয়াব বলা হয়। সুতরাং এজিদের ব্যাপারে যে বক্তব্যটা এখনে তুলে ধরা হয়েছে, এটা আলা হযরতের নয়; বরং আহলে হাদিসের চিরায়ত বক্তব্য ও দলিল, যা আলা হযরত উপস্থাপন করেছেন ﺍﻟﺰﺍﻣﯽ ﺟﻮﺍﺏ - এর ভূমিকা হিসেবে। সে কারণেই ﺳﺒﺤﺎﻥ ﺍﻟﻠﮧ - শব্দ ব্যবহার করেছেন আশ্চর্যবোধ প্রকাশ করার জন্য যে, এজিদের ব্যাপারে মুতাওয়াতির নেই বিধায় তার বিরুদ্ধে তোমাদের মতে অভিযোগ করা হারাম, না জায়েয। পক্ষান্তরে একেবারে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র দলিল ছাড়াই সে-ই তোমরাই ইমাম আবু ইউসুফের প্রতি একটা অভিযোগ দাঁড় করালে, আশ্চর্য!!

এজীদকে ইমাম হুসাইন রা, এর শাহাদাতের দায় থেকে মুক্তি দেয়ার খুশির 'সুবহানাল্লাহ' এটি নয়। কারণ খুশিতে 'সুবহানাল্লাহ' বললে এজিদকে অপবিত্র ও খবীস বলে আখ্যা দিতেন না। কোন ব্যক্তির কোন অভিযোগ থেকে দায়মুক্তিতে খুশি হয়ে সুবহানাল্লাহ বলা আবার ঐ ব্যক্তিকেই খবীস ও অপবিত্র বলা সাংঘর্ষিক। সুতরাং আলা হযরত এজিদকে অপবিত্র ও খবীস বলা একথার প্রমাণ বহন করে যে, এই 'সুবহানাল্লাহ' খুশির 'সুবহানাল্লাহ' নয়— এটা আশ্চর্য হয়ে সুবহানাল্লাহ বলা এবং এই আশ্চর্যবোধ তাদের দ্বিমুখী আচরণের কারণে।

আমার ধারণা, যারা এই বক্তব্যটা দিয়েছে তারা 'সুবহানআল্লাহ' শব্দটা ভালো করে খেয়াল করেনি। করলেও তার প্রয়োগ ও ভাব-উদ্দেশ্য বোঝেনি। বাক্যটা কোথা থেকে শুরু এবং কোথায় শেষ তাও ধরতে পারেনি। কথার উদ্দেশ্য যে الزامي جواب তার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। পুরো ফতোয়া যে লা-মাযহাবি এজিদিদের বিরুদ্ধে তাও আঁচ করতে পারেনি। বাক্যের যে অংশ বাদ দেয়া হয়েছে সে অংশ যে পবিত্র কোরআনের ﻭﺍﻧﺘﻢ ﺳﻜﺮﻯ - বাদ দিয়ে পড়ার মতো অর্থের বিকৃতি সাধনকারী তাও তারা বোঝে উঠতে পারেনি। পরের বক্তব্য যেটুকু বাদ দেয়া হয়েছে তা যে পূর্বের ﺍﻟﺰﺍﻣﯽ ﺟﻮﺍﺏ - মূল রহস্য উন্মোচন করে দিয়েছে, তাও ঠাহর করতে পারেনি। ﺣﺠﺔ - শব্দ তিনবার কেন ব্যবহার করেছে তাও বুঝতে পারেনি।

উর্দু কোটেশনের অনুবাদও ঠিকমত করতে পারেনি। আলা হযরতের কালামে 'ہو'- এর অর্থ করেছে 'ہے'- মানে 'ہو' এবং 'ہے'- এর অর্থের পার্থক্য বুঝতে পারেনি। এজিদের নাম উল্লেখ করে তার ব্যাপারে ব্যবহৃত پلید ও خبیث - শব্দ দুটিই যে এজিদের ব্যাপারে আলা হযরতের মৌলিক অবস্থান নির্দেশ করছে তা খেয়াল করতে পারেনি— যে শব্দ দুটি 'সুবহানআল্লাহ'র অর্থ আনন্দবোধক না হয়ে বিস্ময়ের অর্থে নির্ধারণ করে দিয়েছে। এজিদের ব্যাপারে ইমাম গাঁজালির বক্তব্যকে যে তিনি সমর্থন করছেন না, তাও বুঝতে অসমর্থ হয়েছে অনুবাদক। সেকারণেই পরের বাক্যে বলে দিলেন, প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত প্রত্যেকের কথার মাঝেই গ্রহণীয় ও বর্জনীয় আছে।
আরও বলে দিলেন,
لكل جواد كبوة و لكل صارم نبوة و لكل عالم هفوة
প্রত্যেক বাহাদুরের কোন না কোন ব্যর্থতা আছে, প্রত্যেক তলোয়ারই লক্ষ্যচ্যুত হয় এবং প্রত্যেক আলেমেরই কোন না কোন সময় পদস্খলন হয়।
ইশারা করে দিলেন, ইমাম গাজ্জালী রা, এর বক্তব্য আমি সমর্থন করিনি।

Top