ভূমিকা


প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) গাদীরে খুম স্থানটিতে যা এরশাদ করেছিলেন, প্রথমে তার সুনির্দিষ্ট পটভূমি ও প্রসঙ্গ না বুঝে এতদসংক্রান্ত হাদীসটি সম্পর্কে আলোচনা করা অসম্ভব। বস্তুতঃ সামগ্রিক ইসলামী বিধিবিধানের ক্ষেত্রে এটা একটা সার্বিক বা সাধারণ নিয়ম: ক্বুরআনী আয়াতের শানে নুযূল বা কোনো নির্দিষ্ট হাদীসের পটভূমি জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।



উদাহরণস্বরূপ, وَٱقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُم - “তাদেরকে যেখানে পাও হত্যা করো” মর্মে আল-ক্বুরআনের আয়াতটিকে (২:১৯১) প্রাচ্যবিদবর্গ অহরহ প্রয়োগ করেন, যাতে অন্যায়ভাবে প্রদর্শন করা যায় যে ইসলাম ‘সর্বদা’ মানুষ হত্যার পক্ষে ওকালতি করে থাকে। আমরা যদি আয়াতটি নাযেলের সময়কালের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, তাহলে দেখতে পাবো যে এটা সুনির্দিষ্টভাবে মুসলমান ও ক্বুরাইশ মুশরিকদের মধ্যে একটি যুদ্ধ চলাকালে অবতীর্ণ হয়েছিলো। এর দরুন আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, মানুষ হত্যা করার বিধানটি সার্বিক নয়; বরং এই আয়াতটির একটি বিশেষ পরিস্থিতিগত পটভূমি রয়েছে।



অনুরূপভাবে, গাদীরে খুমের হাদীসটিও স্রেফ সেটার পটভূমি বা প্রসঙ্গ অনুসারেই অনুধাবন করা যায়: মুসলমান সৈন্যদের একটি দল কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র তীব্র সমালোচনায় লিপ্ত ছিলো; আর এই সংবাদ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র কানে পৌঁছুলে তিনি গাদীরে খুমের হাদীসটিতে তাঁর এতদসংক্রান্ত বক্তব্য তুলে ধরেন। প্রাচ্যবিদদের মতো শীয়া প্রপাগান্ডাকারীরাও সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিভ্রান্তিকর চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্যে এই হাদীসের পটভূমিকে অপসারণের বা মুছে ফেলার অপচেষ্টায় রত আছে।



প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক গাদীরে খুমে প্রদত্ত ভাষণটি কোনোক্রমেই হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে (রাষ্ট্রীয়) খলীফা মনোনীত করার উদ্দেশ্যে ছিলো না, বরঞ্চ এটা ছিলো তাঁকে কুৎসা হতে রক্ষা করার লক্ষ্যে। কেবল এর পটভূমি মুছে ফেলার মাধ্যমেই এ শাস্ত্রীয় লিপিসংক্রান্ত শীয়া দৃষ্টিকোণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব; এ কারণেই সদাসর্বদা শীয়া মুসলমান ভাইদেরকে হাদীসে গাদীরে খুমের পটভূমি সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিৎ আমাদের।



শীয়াদের কাছে গাদীরে খুমের গুরুত্ব



শীয়াবর্গ দাবি করেন যে, গাদীরে খুম স্থানটিতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)‘কে ঐশীভাবে তাঁরই (রাষ্ট্রীয়) খলীফা/উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন। শীয়া ভাইদের সাথে এই ঘটনাটি আলোচনা করার আগে আমাদেরকে ওই বাহাস-আলোচনার স্থিতি-মাপ নির্ধারণ করা দরকার। আরেক কথায়, আমাদেরকে এর সাথে সম্পৃক্ত দায় স্পষ্ট করা প্রয়োজন:



১/ শীয়া সম্প্রদায় যদি গাদীরে খুমের ব্যাপারে তাঁদের ভাষ্য প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক ঐশীভাবে (রাষ্ট্রীয়) খলীফা নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং শীয়া সম্প্রদায় সঠিক পথের ওপর রয়েছে।



(২) কিন্তু যদি সুন্নী জামাআত, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে (রাষ্ট্রীয়) খলীফা/উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেছিলেন মর্মে শীয়াদের এই ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আমাদের শীয়া ভাইদের এ কথা মেনে নিতে ইচ্ছুক হতে হবে যে কখনোই হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক (রাষ্ট্রীয়) উত্তরাধিকারী/খলীফা মনোনীত হননি, আর তাই গোটা শীয়া দলটি-ই অবৈধ তথা ভ্রান্ত।



এ বিষয়টি প্রথমেই খোলাসা করার কারণ হলো, শীয়া প্রপাগান্ডাকারীদের এক রহস্যময় দক্ষতা আছে বিতর্ক হারতে বসলে গোলপোষ্ট নির্দিষ্ট স্থান হতে সরাবার। তাঁরা এক প্রসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গে লাফাতে থাকেন; গাদীরে খুমের বিতর্ক হারলে তাঁরা দরজার ঘটনা (হযরত মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ও হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে নিয়ে বানোয়াট গল্প), কিংবা বনূ সাক্বিফা’র বাগানবাড়ি (হযরত আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র খলীফা হওয়ার বিষয়), অথবা ফাদাক বাগান (হযরত মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’র ওয়ারিশী দাবি), বা কে জানে আরো কতো ঘটনার অবতারণা করবেন!



শীয়া মতবাদের গোটা ভিত্তিস্তম্ভ-ই গাদীরে খুম ঘটনার ওপর নির্ভরশীল। কেননা ধরে নেয়া হয় যে এখানেই প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে তাঁর খলীফা/উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। শীয়াদের দাবিকৃত এই ঘটনা যদি (ইতিহাসে) না ঘটে থাকে, তাহলে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কখনোই হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে নিয়োগ করেননি এবং শীয়াদেরকে তাঁদের সমস্ত দাবি-ই পরিত্যাগ করতে হবে; যেমন - তাঁদের এরকম একটি ধারণা হলো হযরত আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) খোদাতা’লা কর্তৃক নিয়োগকৃত হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র খেলাফত গ্রাস করেছিলেন - নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক!



সত্য বটে, গাদীরে খুমের ঘটনাটি শীয়া নমুনার জন্যে এতোখানি মুখ্য, শীয়া ধর্মীয় দর্শনের জন্যে এতোখানি গুরুত্বপূর্ণ যে, শীয়া জনগোষ্ঠী একটি বাৎসরিক উৎসব পালন করেন যার নাম ‘ঈদে গাদীর।’



শীয়াপন্থী আমানা-ডট-ওর্গ ওয়েবসাইট-টি বলে, “শীয়া মুসলমানদের দ্বারা ঈদে গাদীর মহা আনন্দের সাথে পালিত হয়, যা’তে ঈমানদারবৃন্দের প্রতি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র রেখে যাওয়া শেষ নির্দেশনাগুলোকে তাঁরা স্মরণ করেন। ঈদে গাদীর হচ্ছে বিশ্বব্যাপী শীয়া মুসলমানদের পালিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব দিবসগুলোর একটি। কেননা এটাই সেই দিন, যখন আমাদের প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর শেষ হজ্জ্ব পালনশেষে ফেরার পথে গাদীরে খুমে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র খেলাফত সম্পর্কে ঘোষণা দেন।” [http://www.amaana.org/gadhir/gadhir1.htm]



শীয়াদের ধারণাকৃত গাদীরে খুমের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তাঁরা হযরত আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর খেলাফতকে অস্বীকার করেন; মুসলমানবৃন্দের মূলস্রোত হতে বিভক্ত হয়ে পড়েন এবং হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খোদা-নিযুক্ত প্রথম খলীফা হিসেবে ঘোষণা করেন। শীয়াপন্থী ‘আল-ইসলাম-ডট-ওর্গ’ ওয়েবসাইট-টি গাদীরে খুমকে একটি ‘যুগান্তকারী ঘটনা’ এবং হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ইমামতের ভিত্তি হিসেবে উদ্ধৃত করে।



গাদীরে খুমের প্রকৃত গুরুত্ব ও তাৎপর্য শীয়া গোষ্ঠীর কাছে দৃঢ়ভাবে এখানে তুলে ধরার কারণ হচ্ছে এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে যে, শীয়া প্রপাগান্ডার অস্ত্র ভাণ্ডারে যাকে সবচেয়ে মোক্ষম ‘অস্ত্র’ হিসেবে ধারণা করা হয়, সেটা আসলে অত্যন্ত দুর্বল। বস্তুতঃ এটাই যদি হয় শীয়াবাদের মূলভিত্তি, তাহলে শীয়া একটি নড়বড়ে মতবাদ। শীয়াপন্থীরা বলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে গাদীরে খুমে (খলীফা) নিয়োগ করেছিলেন, কিন্তু সাধারণ যুক্তি ও বিচার-বিবেচনা অন্য কথা বলে।



শীয়াদের দাবি অনুযায়ী যা ঘটেছিলো -



শীয়া ওয়েবসাইট ‘আল-ইসলাম-ডট-ওর্গ বলে:



“হাজ্জ্বাতুল ওয়াদা’আ’ (বিদায়ী হজ্জ্ব) সমাপন করে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা (শরীফাইন) ত্যাগ করছিলেন, যখন তিনি এবং অনেক মানুষ গাদীরে খুম নামের একটি স্থানে পৌঁছেন (যেটা আল-জুহফাহ শহরের কাছে)। এটা এমনই এক জায়গা ছিলো, যেখানে বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ (হজ্জ্বশেষে) নিজ নিজ বাড়ির পথে যাত্রার আগে একে অপরের সাথে (বিদায়ী) কুশলাদি বিনিময় করতেন।



ওই স্থানেই নিম্নের আয়াতটি অবতীর্ণ হয়:



يَـٰأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَٱللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ ٱلنَّاسِ



অর্থ: হে রাসূল! পৌঁছিয়ে দিন যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে আপনার প্রতি আপনারই রব্বের কাছ থেকে; এবং যদি এমন না হয় তবে আপনি তাঁর কোনো সংবাদ-ই পৌঁছালেন না। আর আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবেন মানুষ থেকে। [আল-ক্বুরআন ৫:৬৭; নূরুল এরফান]



ওপরোক্ত আয়াতের শেষ বাক্যটি ইঙ্গিত করে যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ঐশীবাণী পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন; কিন্তু এ আয়াতে আল্লাহতা’লা তাঁকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হবার জন্যে বলেন। কেননা তিনি-ই তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন।



অতঃপর মূল বাক্যটি ব্যক্ত হয়, যা স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয় মুসলিম উম্মাহ’র ইমাম/অধিকর্তা হিসেবে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র স্পষ্ট পদমর্যাদা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র হাত (মোবারক) ওপরে তুলে ধরেন এবং ঘোষণা করেন:



فَقَالَ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ



অর্থাৎ, আমি যার মওলা, আলীও তার মওলা।



প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই নিচের ক্বুরআনী আয়াতটি অবতীর্ণ হয়:



 ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلإِسْلٰمَ دِيناً



অর্থ: আজ আমি (আল্লাহ) তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্যে ইসলামকে মনোনীত করলাম। [আল-ক্বুরআন, ৫:৩; নূরুল এরফান]



উপরিল্লিখিত আয়াতটি স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে যে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর বেসাল পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বের বিষয়টি খোলাসা না করা পর্যন্ত দ্বীন-ইসলাম পূর্ণতাপ্রাপ্ত ছিলো না; আর তা পূর্ণতা পেয়েছে তাঁরই পরবর্তী উত্তরাধিকারীর ঘোষণার মাধ্যমে।” [http://www.al-islam.org/ghadir/incident.htm]



অর্থবোধক নয় যে কারণে -



শীয়াপন্থী গোষ্ঠীর দাবি হলো, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মক্কায় বিদায়ী হজ্জ্ব সমাপন করে আরাফাত পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে বিদায়ী ধর্মোপদেশ/খুতবা দান করেন এবং পরে গাদীরে খুমে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খলীফা নিযুক্ত করেন। আমরা এক্ষণে এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করবো: গাদীরে খুম স্থানটি মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারার মাঝামাঝি অবস্থিত, যা আল-জুহফাহ শহরের কাছে, যেমনটি আল-ইসলাম-ডট-ওর্গ ওয়েবসাইটটিতে উল্লেখিত হয়েছে। এটা মরুভূমির মাঝখানে পানীয় জলের একখানা কুয়ো। শীয়া এই অপযুক্তির চূড়ান্ত খণ্ডন হলো এ বাস্তবতা যে, গাদীরে খুম মক্কা মোয়াযযমা হতে আনুমানিক ২৫০ কিরোমিটার দূরে অবস্থিত। এই অতি সহজ বাস্তবতা শীয়াবাদের পুরো যুক্তিকে ভেঙ্গে খানখান করে দেয়।



আমরা জানি, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মক্কায় বিদায়ী হজ্জ্বের সময় তাঁর শেষ খুতবাটি দিয়েছিলেন।এটা ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানবৃন্দের সামনে, যাঁরা বিভিন্ন শহর হতে হজ্জ্ব করতে এসেছিলেন। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যদি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কেই নিজের (পরবর্তী) উত্তরাধিকারী নিয়োগ করতে চাইতেন, তাহলে (হজ্জ্বে উপস্থিত) সকল মুসলমানের সামনে বিদায়ী ভাষণের সময় তা ঘোষণা না করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ বা ব্যাখ্যাই নেই। গোটা উম্মাহ তাঁর শেষ ভাষণ শোনার জন্যে সেখানে ছিলেন উপস্থিত; তাই উত্তরাধিকারী নিয়োগ করার সেটাই ছিলো সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ও সুযোগ।



হুজূরে পূর নূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ও মুসলমান সাধারণ তাঁদের হজ্জ্ব সুসম্পন্ন করার পরে নিজ নিজ শহরের দিকে ফিরে যান। মদীনাবাসীবৃন্দ মদীনায় ফেরেন; তায়েফবাসী ফিরে যান তায়েফ নগরীতে; ইয়েমেনবাসী প্রত্যাবর্তন করেন ইয়েমেনদেশে; কুফাবাসী ফেরত যান কুফায়; সিরিয়াবাসী ফেরেন সিরিয়ায়; আর মক্কাবাসী থেকে যান মক্কায়।



আরব উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলীয় শহরগুলোতে বসবাসকারী মানুষের দলটি-ই কেবল (ফেরার পথে) গাদীরে খুম অতিক্রম করেন। এঁদের মধ্যে (বেশির ভাগ) ছিলেন মদীনাবাসী এবং বাকিরা সংখ্যালঘু মুসলমান, যাঁরা ছিলেন সিরিয়ার মতো স্থানে বসবাসকারী। অতএব, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যখন গাদীরে খুমে থামেন এবং (শীয়াদের) ধারণাকৃত ঘটনাটি ঘটে, তখন মুসলমানবৃন্দের বিশাল একটি অংশ যাঁরা মক্কা মোয়াযযমা, তায়েফ, ইয়েমেন প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করছিলেন, তাঁরা সেখানে ‘উপস্থিত’ ছিলেন না। হজ্জ্বের শেষে মক্কাবাসী মক্কায় থেকে যান; তায়েফবাসী তায়েফ নগরীতে ফেরত যান; কুফাবাসী কুফায় প্রত্যাবর্তন করেন, আর ইয়েমেনবাসী ইয়েমেনে ফেরেন। স্রেফ মদীনাগামী দলটি কিংবা ওই শহর অতিক্রমকারী হাজ্বীবৃন্দ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সাথে গাদীরে খুমে গমন করেন।



অতএব, শীয়াপন্থীদের দাবির ঠিক উল্টো, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সমগ্র মুসলিম উম্মাহ’র সামনে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খলীফা নিয়োগ করেননি; বরঞ্চ গাদীরে খুমে যা ঘটেছিলো তা মুষ্টিমেয় কিছু মুসলমানের সামনেই ঘটেছিলো, যাঁরা মদীনায় কিংবা তারও উত্তরে (সিরিয়া ও আশপাশে) ফিরে যাচ্ছিলেন।



আমরা এবার দেখবো একটি শীয়া ওয়েবসাইট কী দাবি করেছে। দ্য সাক্বালাইন মুসলিম এসোসিয়েশান বলে:



“যিলহজ্জ্ব মাসের ১৮ তারিখ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বিদায়ী হজ্জ্ব সম্পন্ন করার পর মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তাঁর সাথী হয়েছিলেন গোটা মুসলিম কাফেলা, যার সংখ্যা এক লক্ষাধিক। তাঁরা যাত্রা-বিরতি করেন গাদীরে খুম নামের স্থানে, যা মরু-প্রান্তরে হলেও মক্কা ও মদীনার মাঝে এক কৌশলগত অবস্থানে ছিলো (আল-জুহফাহ শহরের কাছে)। ওই দিনগুলোতে গাদীরে খুম (হাজ্বীদের জন্যে) যাত্রা আরম্ভ করার জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিলো, যেখান থেকে পার্শ্ববর্তী রাজ্য/প্রদেশগুলোর হাজ্বী সাহেবান নিজ নিজ বাড়ির পথে ফিরতি যাত্রা করতেন।" [http://www.utm.thaqalayn.org/files/ghadeer.pdf]



শীয়া ওয়েবসাইট-টি দাবি করছে যে গাদীরে খুম “(হাজ্বীদের জন্যে) যাত্রা আরম্ভ করার জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিলো, যেখান থেকে পার্শ্ববর্তী রাজ্য/প্রদেশগুলোর হাজ্বী সাহেবান নিজ নিজ বাড়ির পথে ফিরতি যাত্রা করতেন।" যে কোনো ম্যাপ/গোলকের দিকে স্রেফ একবার তাকালেই বোঝা যাবে কী ধরনের উদ্ভট ধারণা এটা! নিচের ম্যাপটি আল-ইসলাম-ডট-ওর্গ নামের শীয়া ওয়েবসাইট থেকে সরবরাহ করা হয়েছে (চিত্র-১):




মক্কা মোয়াযযমা, তায়েফ, ইয়েমেন প্রভৃতি রাজ্যের মুসলমানবৃন্দ নিজ নিজ শহরের বাড়িতে ফেরার পথে কেন ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত গাদীরে খুমে যাত্রা করবেন, তার কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে কি? আমরা আশা করি পাঠকমণ্ডলী এই উদ্ভট দাবির অসারতা সম্পর্কে বুঝতে পারবেন।



বোঝার জন্যে একটি মিসাল তথা তুলনা দেয়া যাক। ধরুন, উত্তর আমেরিকার ইসলামী সোসাইটির (বিদায়ী) সভাপতি স্যান ফ্রানসিসকো’তে বসবাস করেন এবং তিনি তাঁর উত্তরাধিকারীকে ওই সোসাইটির সকল সদস্যের সামনে মনোনীত করতে চান। প্রতি বছর উক্ত সোসাইটি তার সবচেয়ে বড় সভা শিকাগো’তে আয়োজন করে থাকে, যা’তে সারা আমেরিকার সকল শহর/নগর হতে হাজার হাজার সদস্য সেখানে উপস্থিত হন। তাঁরা আগমন করেন স্যান ফ্রানসিসকো, অস্টিন, এটলান্টা, মিলওয়াকী, ওয়াশিংটন ডিসি প্রভৃতি নগর হতে। তাঁদের ফ্লাইট দেখতে অনেকটা এরকম হবে (চিত্র-২):




শিকাগো’তে উক্ত সোসাইটির বাৎসরিক সভায় সমস্ত সদস্য উপস্থিত হলে সভাপতির জন্যে ওইখানে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করা কি সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হবে না? সভাশেষে সবাই বিভিন্ন শহরে অবস্থিত নিজ নিজ বাড়ির দিকে যাত্রা করেন; আর (সাবেক) সভাপতিও স্যান ফ্রানসিসকো’তে অবস্থিত তাঁর বাড়ির দিকে রওয়ানা হন। পথে তিনি শেয়েন শহরে যাত্রা-বিরতি করেন। এমতাবস্থায় সোসাইটির অন্য সব সদস্য তাঁদের শহরগুলোর ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত শেয়েন শহর ঘুরে যাওয়াটা কি আদৌ যুক্তিসঙ্গত? এর তো কোনো মানেই হয় না, যা নিচের চিত্রের মতো দেখাবে (চিত্র-৩):




যুক্তিসঙ্গত চিন্তাধারার কেউ এটা গ্রহণ করতে পারেন না। শিকাগো’তে অনুষ্ঠিত বাৎসরিক সভায় সভাপতি কর্তৃক উত্তরাধিকারী মনোনীত করার বিপরীতে শেয়েনে তা করাটা নিরর্থক হবে। ওয়াশিংটন ডিসি’তে বসবাসকারী কেউ শেয়েনের উদ্দেশ্যে পশ্চিম দিকে যাত্রা করবেন না, বরং তিনি বিপরীত দিকে অবস্থিত তাঁর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। যে সদস্য শিকাগো’তে বসবাস করেন, তিনি নিশ্চয় সভাশেষে সভাপতির সাথে শেয়েনে যাবেন না, বরং বসবাসস্থল শিকাগো’তেই থেকে যাবেন। প্রকৃতপক্ষে ওই সোসাইটির সদস্যদের ফিরতি যাত্রা অনেকটা এরকম দেখাবে (চিত্র-৪):



ওপরের এ দৃষ্টান্তে স্যান ফ্রানসিসকো’কে ধরা যাক মদীনার স্থলে, শিকাগো’কে মক্কার স্থলে, আর শেয়েন’কে গাদীরে খুমের স্থলে। এটা স্পষ্ট যে, শেয়েন অতিক্রমকারী মানুষ স্রেফ তাঁরাই হবেন, যাঁরা স্যান ফ্রানসিসকো বা পশ্চিম (মানে ক্যালিফোর্নিয়ার) তীরে বসবাস করেন। অতএব, উক্ত সোসাইটির সভাপতির পক্ষে শেয়েনে তাঁর মনোনয়ন দানের ভাষণ প্রদান করাটা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হবে না। কেননা সেখানে অন্যান্য নগরীর মুসলমান সমদ্যবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন না। বরঞ্চ শিকাগো, যেখানে সভাটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেখানেই ওই ভাষণ দেয়াটা তাঁর জন্যে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত হবে। অনুরূপভাবে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কেও উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে হলে মক্কায় তাঁর বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণে তা করতে হতো, মদীনায় ফেরার পথে অপরিচিত (তথা যাত্রায় সবার অব্যবহৃত) কোনো স্থানে নয়।



মুসলমানবৃন্দ যখন হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন, আমরা ধরে নিতে পারি, তাঁরা নিম্নের পথগুলো গ্রহণ করতেন (চিত্র-৫):




এখন যখন হাজ্বী সাহেবান সকল শহর/নগর হতে মক্কা মোয়াযযমায় সমবেত হয়েছেন, তখন এটা কি সবচেয়ে উপযুক্ত সময় নয় প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র পক্ষ হতে আপন উত্তরাধিকারী ঘোষণা করার? শীয়া প্রপাগান্ডাকারীরা আমাদের বিশ্বাস করাতে চান যে তায়েফ ও ইয়েমেন প্রত্যাবর্তনকারী হাজ্বী সাহেবান যাওয়া-আসায় (আপ-ডাউন) অতিরিক্ত ৫০০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে গাদীরে খুমের জলাশয়ে যেতেন এবং এরপর বাড়ি ফিরতেন। শীয়াপন্থীদের বক্তব্য অনুসারেই গাদীরে খুম ছিলো একটি জলাধার এবং ভ্রমণকারীদের জন্যে একটি বিশ্রামের স্থান। তবে তাঁরা যা বলতে ব্যর্থ হয়েছেন তা হলো, এটা ছিলো ওই রাস্তা অতিক্রমকারীদেরই বিশ্রামস্থল; একদম বিপরীত দিকে গমনকারীদের বিশ্রামস্থল মোটেও এটা নয়! শীয়াপন্থীরা আমাদেরকে বিশ্বাস করাতে চান যে হাজ্বী সাহেবানের ফিরতি যাত্রা হতো অনেকটা এ রকম (চিত্র-৬):




এ দাবি স্রেফ অর্বাচীনতা ছাড়া কিছু নয়। হজ্জ্বশেষে প্রত্যেকেই নিজ নিজ শহরে ফেরত গিয়েছেন, আর মক্কাবাসী মুসলমান মক্কায় স্থিত হয়েছেন। কেননা তাঁরা মক্কা নগরীতে বসবাস করতেন। এমতাবস্থায় তাঁরা কেন অব্যবহৃত একটি স্থানের জলাশয়ে গমন করতে যাবেন? মুসলমানবৃন্দ তদানীন্তনকালে পায়দলে চলতেন বিবেচনা করলে গাদীরে খুম অভিমুখি ২৫০ কিলোমিটার ও ফিরতি যাত্রায় সমপরিমাণ দূরত্ব অতিক্রমের দরুন বেশ কিছু অতিরিক্ত সপ্তাহ লেগে যাওয়ার কথা। এটা কি যুক্তি ও বিচার-বিবেচনার পরিপন্থী নয়? নিশ্চয় অর্থবহ চিত্রটি নিচে পাওয়া যাবে (চিত্র-৭):




অতএব, আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সকল মুসলমানের সামনে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খলীফা নিযুক্ত করেছিলেন মর্মে শীয়াদের দাবি একেবারেই অবান্তর, কেননা তিনি তাঁর বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণে এই বিষয়টি মোটেও উত্থাপন করেননি। আর গাদীরে খুমের ঘটনার ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত হলো, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খলীফা মনোনীত করার সম্ভাবনা এই স্থানটিতে একদম নেই। বরঞ্চ গাদীরে খুম সম্পর্কে মুসলিম মূলস্রোতের ভাষ্যই অধিকতর অর্থবোধক (তথা গ্রহণযোগ্য)।



গাদীরে খুমে যা ঘটেছিলো -


কেউই গাদীরে খুমের ঘটনা অস্বীকার করেন না। তবে আমরা যা অস্বীকার করি, তা উক্ত ঘটনার ব্যাপারে শীয়াপন্থীদের অতিরঞ্জন। প্রথমতঃ ওই স্থানে উপস্থিত মুসলমানদের সংখ্যা সম্পর্কে শীয়া গোষ্ঠী অতিরঞ্জন করেন; তাঁরা অহরহ দাবি করেন ওই সংখ্যা শত-সহস্র। আমরা ইতোমধ্যে দেখিয়েছি যে, স্রেফ মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী মুসলমানবৃন্দ-ই গাদীরে খুমে উপস্থিত ছিলেন; যার মানে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না মক্কাবাসীবৃন্দ, বা তায়েফ, ইয়েমেন প্রভৃতি রাজ্যের মুসলমানবৃন্দ। বস্তুতঃ শীয়াপন্থীরা ঘনঘন দাবি করে থাকেন যে ১ লক্ষ মানুষ গাদীরে খুমে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এটা অতিরঞ্জন ছাড়া কিছু নয়। বরঞ্চ এই সংখ্যক হাজ্বী সাহেবান মক্কায় বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণের সময় উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা এসেছিলেন বিভিন্ন শহর হতে। ওতে মদীনায় প্রত্যাবর্তনকারী মুসলমানই কেবল উপস্থিত ছিলেন না (যাঁরা ওই ১ লাখের একটি অংশমাত্র)। বাস্তবতা হলো, শীয়াপন্থী গোষ্ঠী যে সংখ্যাই বলুন না কেন, তা মুসলমানদের একাংশই হবে; কেননা এতে অন্তর্ভুক্ত হবেন না মক্কা, তায়েফ, ইয়েমেন প্রভৃতি প্রদেশে বসবাসকারী মুসলমান জনগোষ্ঠী।



গাদীরে খুমের পটভূমিকে বিবেচনায় নেয়া জরুরি। এর পরিপ্রেক্ষিত ছিলো এই যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) নির্দিষ্ট এমন কিছু ব্যক্তির প্রতি জবাব দিচ্ছিলেন, যাঁরা ছিলেন হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সমালোচনামুখর। এর পটভূমি হলো, কিছু মাস আগে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে ৩০০ জনের এক বাহিনীসহ ইয়েমেন দেশে সেনা অভিযানে প্রেরণ করেন। এটা নাজাফ-ডট-ওর্গ শীর্ষক শীয়া ওয়েবসাইটে উল্লেখিত হয়েছে এভাবে: “আলী (রা:)’কে ইয়েমেনের সামরিক অভিযানে অধিনায়ক নিয়োগ করা হয়।” [http://www.najaf.org/english/book/20/4.htm]



হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র পরিচালনাধীন সৈন্যবাহিনী ইয়েমেনে অত্যন্ত সফল হয়েছিলো এবং মুসলমানবৃন্দ প্রচুর গনীমতের মালামাল লাভ করেছিলেন। এই গনীমত (বণ্টন) নিয়ে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সাথে তাঁর সৈন্যদের মতবিরোধ দেখা দেয়। ইবনে ক্বাসীর নিজ “আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া’ পুস্তকে লেখেন:



“গনীমতের পাঁচ ভাগের এক ভাগ রাষ্ট্রীয় অংশের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ শণজাত বস্ত্র ছিলো, যা গোটা সেনাবাহিনীর চাহিদা মেটাতে সক্ষম ছিলো। কিন্তু হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) সিদ্ধান্ত নেন তা স্পর্শ না করে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র কাছে হস্তান্তর করতে হবে।”



ইয়েমেন বিজয়ের পরে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাঁর বাহিনীর সহ-অধিনায়ককে সেখানকার দায়িত্ব দিয়ে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সাথে সাক্ষাৎ করার জন্যে মক্কায় হজ্জ্বে গমন করেন। ‘আল-বেদায়া’ গ্রন্থে  আমরা পড়ি:



“তবে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র অনুপস্থিতিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সহ-সেনা অধিনায়ককে প্রভাবিত করে ওই শণজাত বস্ত্র হতে প্রত্যেক সৈন্যের জন্যে একটি নতুন জামা ধার দেয়া হয়। এই জামাকাপড় পরিবর্তন খুবই প্রয়োজনীয় ছিলো, কেননা সৈন্যরা প্রায় তিন মাস বাড়ির বাইরে ছিলেন।” (মানে বস্ত্রের অভাব দেখা দিয়েছিলো)



অতঃপর ইয়েমেনে অবস্থিত সৈন্যবাহিনী প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সাথে হজ্জ্ব সমাপনের উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করে। আল-বেদায়া পু্স্তকে লেখা হয়:



“সৈন্যরা (মক্কা) নগরীতে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছুলে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাঁদের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সওয়ারে চড়ে এগিয়ে যান, কিন্তু (তাঁদের জামাকাপড়ে) পরিবর্তন দেখে তিনি আশ্চর্য হন। সহ-অধিনায়ক তাঁকে বলেন, ‘আমি তাদেরকে বস্ত্রগুলো দিয়েছি যাতে তারা মানুষের মাঝে (মানে ভদ্রলোকের সমাজে) প্রবেশ করলে গ্রহণযোগ্য হয়।’ সৈন্যরা জানতেন যে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সম্মানে মক্কায় অবস্থানকারী সবাই সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পরবেন; আর তাই তাঁরাও নিজেদের সেরা বস্ত্রাবরণে তাতে (মানে ধর্মীয় সমাবেশে) উপস্থিত হতে উদগ্রীব ছিলেন। কিন্তু হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) অনুভব করেন তিনি এ রকম স্বাধীনতা তাঁদেরকে দিতে পারেন না এবং এ কারণে তিনি তাঁদেরকে তাঁদের পুরোনো জামাকাপড় পরার আদেশ দেন, আর নতুন জামাগুলো গনীমতে ফেরত দিতে বলেন। এই বিষয়ে গোটা বাহিনীর মাঝে বড় ধরনের ক্ষোভের সঞ্চার হয়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এই ব্যাপারে জানার পর বলেন, ‘হে মানব সকল, আলীকে দোষারোপ কোরো না; কেননা সে আল্লাহর পথে (ন্যায়ের পক্ষে) এতোই বিবেকবান যে তাকে দোষারোপ করা চলে না।’ কিন্তু হুজুর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর এই কথা যথেষ্ট হয়নি; কিছু মানুষ হয়তো এ কথা মেনে নেন। কিন্তু (বাকিদের) ক্ষোভ এতে মিটে যায়নি।



“(হজ্জ্বশেষে) মদীনায় ফেরার পথে সৈন্যরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ব্যাপারে তিক্ততাভরে অভিযোগ করেন, যার দরুন তাঁর চেহারা মোবারকের রং পরিবর্তিত হয়। তিনি বলেন:



أَلَسْتُمْ تَعْلَمُونَ أَنِّي أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ قَالُوا بَلَى قَالَ أَلَسْتُمْ تَعْلَمُونَ أَنِّي أَوْلَى بِكُلِّ مُؤْمِنٍ مِنْ نَفْسِهِ قَالُوا بَلَى قَالَ فَأَخَذَ بِيَدِ عَلِيٍّ فَقَالَ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ     



অর্থাৎ, ‘আমি কি তোমাদের জীবনের চেয়ে আওলা’ (শ্রেয়তর, অধিকতর মূল্যবান) নই?’ আসহাবে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম যখন উত্তরে বলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, জি, (আপনি শ্রেয়তর)’, তখন তিনি বলেন, ‘তাহলে আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা।’ যাত্রার পরবর্তী পর্যায়ে গাদীরে খুমে বিশ্রামের জন্যে থামলে তিনি সবাইকে সমবেত করেন এবং হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র হাত উঁচিয়ে ধরে ওই একই কথা (আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা) পুনর্ব্যক্ত করেন। অতঃপর এ দুআ যোগ করেন:


اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ ، وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ



অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ! আপনিও তাকে ভালোবাসুন, যে আলীকে ভালোবাসে; আর তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পােষণ করে।’ এরই ফলশ্রুতিতে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র বিরুদ্ধে গজগজ স্তব্ধ হয়ে যায়।” [ইবনে ক্বাসীর কৃত ‘আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া; লিঙ্ক - https://www.rokomari.com/book/67805/al-bidaya-one-nihaya--islamer-itihas---adi-onto---1-10-part-]



হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র অধীনস্থ সৈন্যরা বস্ত্রের পরিবর্তন নিয়েই কেবল ক্ষুব্ধ ছিলেন না, বরং তাঁরা সামগ্রিকভাবে গনীমতের মালামাল বণ্টন নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের বদৌলতে মুসলমানবৃন্দ অনেক উট লাভ করেন (গনীমত হিসেবে), কিন্তু তিনি সবাইকে সেগুলোর মালিকানা/দখল নিতে বারণ করেন। আল-বায়হাক্বী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বর্ণনা করেন হযরত আবূ সাঈদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এ মর্মে যে, হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাঁদেরকে ওই উটগুলোতে চড়তেও নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি যখন মক্কার উদ্দেশ্যে ইয়েমেন ত্যাগ করেন, তখন তাঁর সহ-অধিনায়ক মানুষের দাবির মুখে আত্মসমর্পণ করেন এবং সৈন্যদেরকে উটগুলোতে চড়ার অনুমতি দেন। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) এটা দেখার পর রাগান্বিত হন এবং সহ-অধিনায়ককে দোষারোপ করেন। হযরত আবূ সাঈদ (রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু) বলেন: “আমরা মদীনা প্রত্যাবর্তনকালে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র কাছে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) হতে আমাদের প্রত্যক্ষকৃত কঠোরতা সম্পর্কে উল্লেখ করি। তিনি (উত্তরে) বলেন: ‘থামো...আল্লাহর কসম, আমি জেনেছি সে আল্লাহরই ওয়াস্তে (বা খাতিরে) ভালো কাজ করেছে’।” [বঙ্গানুবাদকের নোট: জ্বেহাদে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদবৃন্দের জন্যে তাঁদের অধিনায়ককে মেনে চলা অবশ্য কর্তব্য। নিজেদের নফস/কুপ্রবৃত্তিকে বিলীন করা বাধ্যতামূলক। কোনো রকম আরাম-আয়েশ এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। তরীক্বতের পথ চলার বেলায়ও মুরীদকে তাঁর মুর্শীদের ইচ্ছার মাঝে বিলীন হতে হয়। আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করতে হয়। এই আত্মদমনকে হাদীসের ভাষায় সর্ববৃহৎ জ্বেহাদ বলা হয়েছে]


ইবনে ইসহাক্বের রচিত ‘সীরাহ রাসূল-আল্লাহ’ শীর্ষক বইয়েও অনুরূপ একটি ঘটনার বিবরণ পাই, যেখানে লিপিবদ্ধ আছে:



“মহানবী (সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ইয়েমেন হতে মক্কা শরীফে আগমন করলে তিনি ত্বরা করে হজুরের (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কাছে যান; আর এ সময় তিনি তাঁরই এক সাথীর কাছে অধীনস্থ সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অর্পণ করে আসেন, যিনি হযরত ইমাম (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’এর আয়ত্তাধীন গনীমতের মধ্যে সমস্ত শণবস্ত্র প্রত্যেক সৈন্যের কাছে বণ্টন করেন। সেনাবাহিনী (মক্কার কাছে) পৌঁছুলে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাঁদের সাথে সাক্ষাতের জন্যে সওয়ারে চড়ে এগিয়ে যান এবং গিয়ে দেখেন তাঁরা সবাই ওই শণবস্ত্র পরিহিত। তিনি তাঁদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তাঁর সহ-অধিনায়ক বলেন তিনি বস্ত্র দিয়েছেন যাতে সৈন্যরা মানুষের সাথে মেশার সময় গ্রহণযোগ্য হন। হযরত ইমাম (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সামনে উপস্থিত হবার আগে ওই বস্ত্র খুলে ফেলার জন্যে সহ-অধিনায়ককে আদেশ করেন। তাঁরা তাঁর আদেশ পালন করেন এবং গনীমতের মালে বস্ত্র ফেরত দেন। (কিন্তু) সৈন্যবাহিনী এ আচরণে ক্ষুব্ধ হন....তাঁরা যখন ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে অভিযোগ করেন, তখন তিনি তাঁদের উদ্দেশ্যে বলার জন্যে উঠে দাঁড়ান এবং বর্ণনাকারী শুনতে পান তাঁর এ বক্তব্য: ‘আলীকে দোষারোপ কোরো না; কেননা সে আল্লাহর পথে (ন্যায়ের পক্ষে) এতোই বিবেকবান যে তাকে দোষারোপ করা চলে না’।” [ইবনে ইসহাক্ব কৃত ‘সীরাহ রাসূল-আল্লাহ’, ৬৫০ পৃষ্ঠা, পিডিএফ ডাউনলোড লিঙ্ক: https://www.thereligionofpeace.com/pages/muhammad/Guillaume--Life%20of%20Muhammad.pdf]



ইবনে ক্বাসীর বর্ণনা করেন যে (ইয়েমেনে প্রেরিত) সৈন্যরা হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সমালোচনা আরম্ভ করেন; কেননা তিনি তাঁদেরকে তাঁদের লাভকৃত উটে চড়তে বাধা দিয়েছিলেন এবং নতুন বস্ত্র ফেরত নিয়েছিলেন। এই ব্যক্তিবৃন্দ-ই মদীনা হতে গাদীরে খুমে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সাথে যাত্রা করেছিলেন, আর এঁদেরই প্রতি বিখ্যাত হাদীসে গাদীরে খুমের ভাষণটি দেয়া হয়েছিলো।



বস্তুতঃ ‘তারীখুল ইসলাম’ বইটিতে গাদীরে খুমের ঘটনাটির শিরোনাম ‘হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সান্ত্বনা।’ তাতে লেখা হয়:



‘হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সান্ত্বনা’



হজ্জ্বের সময় হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কিছু অনুসারী যাঁরা ইয়েমেন অভিযানে তাঁর সাথী হয়েছিলেন, তাঁরা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলােইহে ওয়া সাল্লাম)’র কাছে (তাঁর বিরুদ্ধে) অভিযোগ করেন। ইয়েমেনে গমনকারী এই সৈনিকদের কিছু ভুল বুঝাবুঝি অনাস্থার জন্ম দিয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) গাদীরে খুমে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রশংসা করে সাহাবা-এ-কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’কে বলেন:



مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ



অর্থ: “আমি যার মওলা/বন্ধু, আলী-ও তার মওলা/বন্ধু।” এই ভাষণের পরে হযরত উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হযরত ইমাম (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “আজ হতে আপনি আমার অতি বিশিষ্ট এক বন্ধু।” অতঃপর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মদীনা মোনাওয়ারায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং তাঁর পুত্র ইবরাহীম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বেসালপ্রাপ্ত হন। [তারীখ আল-ইসলাম, ১ম খণ্ড, ২৪১ পৃষ্ঠা; লিঙ্ক: https://www.alkitab.com/10226.html] 


গাদীরে খুম-সম্পর্কিত হাদীস


হাদীসে গাদীরে খুমের সারসংক্ষেপ: হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সেনাবাহিনী গনীমত হতে শণবস্ত্র ও উট দিতে অস্বীকার করায় তাঁর প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন; আর তাঁরা এ বিষয়টির ব্যাপারেও খুশি ছিলেন না যে তিনি স্বয়ং খুমস্ তথা গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ হতে বিশেষ একটি অংশ (মঞ্জুরি) প্রাপ্ত হয়েছিলেন। নিশ্চয় খুমস্ হতে অতিরিক্ত অংশের এ সুবিধা গ্রহণের জন্যে তাঁকে দোষারোপ করা যায় না, যে অধিকারটুকু ক্বুরআন মজীদেই প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র পরিবার সদস্যদের প্রতি দান করা হয়েছে। তথাপি সৈনিকবৃন্দের দৃষ্টিতে ছিলো রোষানল, তাই হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) যখন খুমস্ হতে এক জারিয়া দাসীকে নিজের জন্যে গ্রহণ করেন তখন তাঁরা বিশেষভাবে মনে কষ্ট পান। বস্ত্র ও উট অস্বীকার করে নিজের জন্যে দাসী নারী গ্রহণের দায়ে তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে ভ্রান্তভাবে কপটতার অভিযোগ উত্থাপন করেন। এই অমূলক সমালোচনার কারণেই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর পক্ষ সমর্থন করতে গাদীরে খুমের হাদীসটি ব্যক্ত করেন।



জনৈক ShiaChat সদস্য বলেন: “তোমরা সৌদি (মানে জাযিরাতুল আরবের) বিকৃত যৌনতায় বিশ্বাসী লোকেরা তোমাদের নিজস্ব বিলাসিতায় কারো সম্পর্কে যা কল্পনা করতে চাও করো গিয়ে, কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে এখানে কথা বলার দুঃসাহস দেখিও না.....ওই অভিযোগ (মানে ইমামে আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু কর্তৃক জারিয়া দাসীর সাথে সহবাস করার বিষয়টি) একটি নির্লজ্জ উমাইয়া প্রপাগান্ডা, যাতে আমাদের মওলা (আলাইহিস্ সালাম)’কে মন্দ হিসেবে প্রতিপন্ন করা যায়।”



প্রথমতঃ  সহীহ বুখারী হাদীসগ্রন্থে গাদীরে খুম-বিষয়ক হাদীসটি হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)‘কে মন্দ হিসেবে প্রতীয়মান করার উদ্দেশ্যে লিপিবদ্ধ হয়নি। বস্তুতঃ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরত ইমাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর কাজটির পক্ষে সমর্থন জানান। এখানে উল্লেখ্য যে, এমন কী হুজূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) নিজেও এক জারিয়া দাসীকে গ্রহণ করেছিলেন যা সুন্নী ও শীয়া হাদীসগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। সেই অতীত যুগে দাসত্ব এক সাংস্কৃতিক রীতি হিসেবে প্রচলিত ছিলো, আর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মুসলমানদের প্রতি দাসীদেরকে তাঁদের (আচরণে) স্ত্রীর মর্যাদা দেয়ার জন্যে তাকিদ দিয়েছিলেন। অন্যান্য সময়ে তিনি দাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে বিয়ে করার উৎসাহ দান করতেন। এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে লেখা অনেক দীর্ঘ প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং পাঠকমণ্ডলী ইন্টারনেটে সেগুলো খুঁজে পড়তে পারেন।



দ্বিতীয়তঃ এ বিষয়টিও এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) কর্তৃক জারিয়া দাসী গ্রহণকে অনৈতিক বিবেচনা করার কারণে কিন্তু হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর সমালোচনা করেননি। বরঞ্চ তিনি সমালোচনামুখর হয়েছিলেন এ কারণে যে, হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) খুমস্ থেকে অংশ নিলেও তাঁর সৈন্যদের তিনি তা হতে অংশ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) খুমস্ থেকে জারিয়া দাসী গ্রহণ করেন, নাকি শণবস্ত্র বা উট নেন, সে ব্যাপারটি হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কাছে ধর্তব্য ছিলো না।



তৃতীয়তঃ হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) কর্তৃক জারিয়া দাসী গ্রহণের বাস্তবতা শীয়া হাদীসগ্রন্থেও বিবৃত হয়েছে। এমতাবস্থায় শীয়াপন্থীদের এতো উষ্মা প্রকাশ করা কেন উচিৎ হবে, যখন অনুরূপ একটি বর্ণনা সুন্নী হাদীসগ্রন্থে বিবৃত হয়েছে? এটা কপটতা নয় কি? সুন্নী হাদীসে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) কর্তৃক জারিয়া দাসী গ্রহণের প্রতি হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যেমন রাগান্বিত হয়েছিলেন, ঠিক তেমনি শীয়া হাদীসেও জারিয়া দাসী গ্রহণের দরুন তাঁর প্রতি হযরত মা ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। ওই (শীয়া) হাদীসটি শীয়া মতবাদের একজন পূর্বসূরীর বর্ণিত; যাঁর নাম ইবনে বাবাভীহ আল-ক্বুম্মী। এটা একটা প্রসিদ্ধ শীয়া ওয়েবসাইটে বিদ্যমান। এয়া-যাহরা-ডট-ওর্গ বিবৃত করে:



মাজলিসী ‘বিহারুল আনওয়ার’ ৪৩/১৪৭



عن أبي ذر رحمة الله عليه قال : كنت أنا وجعفر بن أبي طالب مهاجرين إلى بلاد الحبشة فاهديت لجعفر جارية قيمتها أربعة آلاف درهم ، فلما قدمنا المدينة أهداها لعلي عليه السلام تخدمه ، فجعلها علي في منزل فاطمة .

فدخلت فاطمة عليها السلام يوما فنظرت إلى رأس علي عليه السلام في حجر الجارية فقالت : يا أبا الحسن فعلتها ، فقال : لا والله يا بنت محمد ما فعلت شيئا فما الذي تريدين ؟ قالت تأذن لي في المصير إلى منزل أبي رسول الله صلى الله عليه واله فقال لها : قد أذنت لك .

فتجللت بجلالها ، وتبرقعت ببرقعها



অনুবাদ: হযরত আবূ যর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন আল-মাজলিসী; তাঁর থেকে আল-ক্বুম্মী। হযরত আবূ যর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: আমি হযরত জা’ফর তাইয়্যার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর সাথে হাবশী দেশে (মানে আবিসিনিয়ায়) হিজরত করি। চার হাজার (৪০০০) দিরহাম মূল্যের এক জারিয়া দাসীকে হযরত জা’ফর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর প্রতি উপহারস্বরূপ দেয়া হয়। আমরা যখন মদীনায় আগমন করি, তখন তাকে (দাসীকে) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কাছে উপহারস্বরূপ প্রদান করি, যাতে সে তাঁর খেদমত করতে পারে। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাকে হযরত ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র ঘরেই রাখেন। একদিন হযরত ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) ঘরে প্রবেশ করে দেখেন হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র শির মোবারক ওই জারিয়া দাসীর কোলে। তিনি জিজ্ঞেস করেন: “হে (ইমাম) হাসানের বাবা! তুমি কি তার সাথে (সহবাস) করেছো?” ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) উত্তর দেন: “হে নবী নন্দিনী! আমি কিছুই করিনি; এমতাবস্থায় তুমি কী চাও?” হযরত ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: “তুমি কি আমায় আমার বাবার বাড়ি যাবার অনুমতি দেবে?” তিনি উত্তর দেন: “আমি অনুমতি দেবো।” অতঃপর হযরত ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) নিজের জিলবাব পরে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র কাছে যান। [সূত্র: ইবনে বাবাভীহ আল-ক্বুম্মী প্রণীত ‘এলাল আল-শারাএ’, ১৬৩ পৃষ্ঠা; আরো বর্ণিত হয়েছে ‘বিহার আল-আনওয়ার’, ৪৩-৪৪ পৃষ্ঠা, ‘আলী (ক:)’র সাথে তাঁর জীবন কেমন ছিলো’ অধ্যায়; http://www.yazahra.net/ara/html/4/behar43/al5.html বঙ্গানুবাদকের নোট: শীয়া ওয়েবসাইট-টি যথারীতি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই লেখায় প্রদত্ত কোনো রেফারেন্স যাতে না পাওয়া যায় সে উদ্দেশ্যেই হবে]



চতুর্থতঃ - যা এ বিতর্কের অবসান ঘটাবে চূড়ান্তভাবে - তা হলো এই বাস্তবতা যে, এ ঘটনাটি শীয়া ধর্মীয় মতবাদের উৎসগুলোতেও উল্লেখিত হয়েছে। চিরায়ত শীয়া ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ শায়খ মুফীদ লেখেন:



(ইতিপূর্বে) আমীরুল মো’মেনীন (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) বন্দীদের মধ্য হতে একজন জারিয়া দাসীকে পছন্দ করেন। এমতাবস্থায় হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র কাছে প্রেরণ করেন। তিনি (হযরত খালেদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: “রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে যাও সেনাবাহিনী সেখানে পৌঁছুবার আগেই। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) খুমস্ (গনীমতের রাষ্ট্রীয় অংশ) হতে নিজের জন্যে জারিয়া দাসী বেছে নিয়ে যে আত্মসম্মানের হানি করেছেন, সে সম্পর্কে তাঁকে জানাও..।”



হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সামনে হাজির হন। তাঁর সাথে ছিলো হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর একটি চিঠি যা দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো। তিনি হুজূরের (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কাছে তা পড়া আরম্ভ করেন। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র চেহারা মোবারকে পরিবর্তন দেখা দেয়।



হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! আপনি যদি মানুষকে এভাবে (করার) অনুমতি দেন, তাহলে তাদের গনীমত অদৃশ্য হয়ে যাবে।”



প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বলেন, “হে বোরায়দা, তোমার জন্যে আফসোস। তুমি তো কপটতা সংঘটন করেছো। আমি যে গনীমতের অংশের হক্কদার, তা হতে আলী ইবনে আবী তালেব-ও অংশ পাওয়ার হক্কদার। বোরায়দা, আমি তোমাকে সতর্ক করছি এ মর্মে যে তুমি আলীর প্রতি বৈরীভাব পোষণ করলে আল্লাহও তোমাকে অপছন্দ করবেন।”



হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন: ওই সময় আমার ইচ্ছে হয় যেনো জমিন দু ভাগে বিভক্ত হয়ে যাক এবং আমি ওর অভ্যন্তরে গ্রাস হয়ে যাই। অতঃপর আমি বলি, “আমি আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর রুদ্ররোষ হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি। এয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), আমায় ক্ষমা করুন। আমি আর কখনোই হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহূ)’র প্রতি শত্রুতাভাব পোষণ করবো না এবং তাঁর সম্পর্কে শুধু ভালো বলবো।”



প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁকে ক্ষমা করে দেন। [শায়খ মুফীদ প্রণীত ‘কিতা’ব আল-ইরশা’দ’, ১১১-১১২ পৃষ্ঠা; লিঙ্ক: https://www.shia-maktab.info/index.php/en/library/books/english?format=raw&task=download&fid=93]



হাদীসে গাদীরে খুম বর্ণিত হয়েছে সহীহ বুখারী পুস্তকে (৫ম খণ্ড, বই নং ৫৯, হাদীস নং ৬৩৭):



حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، حَدَّثَنَا رَوْحُ بْنُ عُبَادَةَ، حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ سُوَيْدِ بْنِ مَنْجُوفٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ بَعَثَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَلِيًّا إِلَى خَالِدٍ لِيَقْبِضَ الْخُمُسَ وَكُنْتُ أُبْغِضُ عَلِيًّا، وَقَدِ اغْتَسَلَ، فَقُلْتُ لِخَالِدٍ أَلاَ تَرَى إِلَى هَذَا فَلَمَّا قَدِمْنَا عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ذَكَرْتُ ذَلِكَ لَهُ فَقَالَ ‏"‏ يَا بُرَيْدَةُ أَتُبْغِضُ عَلِيًّا ‏"‏‏.‏ فَقُلْتُ نَعَمْ‏.‏ قَالَ ‏"‏ لاَ تُبْغِضْهُ فَإِنَّ لَهُ فِي الْخُمُسِ أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ ‏"‏‏.

     

অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে (গনীমতের) খুমুস্ (তথা রাষ্ট্রীয় অংশ) আনতে হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কাছে প্রেরণ করেন, আর আমি তাঁর প্রতি বৈরিতা রাখতাম। (ওই সময়) তিনি গোসল করেছিলেন (খুমুস হতে গৃহীত জারিয়া দাসীর সাথে সহবাস করার পর)। আমি হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে বলি: ‘আপনি কি এটা (মানে হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুর কাজটি) দেখতে পাচ্ছেন না?’ আমরা যখন হুজূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর সামনে হাজির হই, তখন বিষয়টি তাঁর কাছে পেশ করি। তিনি উত্তরে বলেন, “হে বোরায়দা, তুমি কি আলীর প্রতি শত্রুতাভাব পোষণ করো?” আমি উত্তরে বলি: ‘জি।’ তিনি বলেন: “বৈরিতা রেখো না, কেননা সে খুমস্ হতে অধিকতর পাওয়ার হক্কদার।”



এটাই হলো সহিহাইনে (বুখারী ও মুসলিম হাদীসগ্রন্থ দুটোয়) বর্ণিত গাদীরে খুমের হাদীস। এতে ‘মওলা’ শব্দটির কোনো উল্লেখ-ই নেই। ইবনে তাইমিয়া বলেন: “مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ - ‘আমি যার মওলা, আলীও তার মওলা’ মর্মে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর বাণীটি সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে নেই। কিন্তু এটা সেসব বিবরণের একটা, যেটা এমন আলেম-উলেমার দ্বারা বর্ণিত হয়েছে যাঁদের নির্ভরযোগ্যতা/বিশ্বস্ততা সম্পর্কে মানুষেরা ভিন্নমত পোষণ করেছেন।”



অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে শীয়া গোষ্ঠী খামোখা হৈচৈ সৃষ্টি করেছেন। গাদীরে খুমের হাদীসটি খলীফা মনোনীত করা হতে একদম পৃথক একটি বিষয়। শীয়া আলেম এস,এইচ,এম, জাফরী লেখেন:



প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক গাদীরে খুমে প্রদত্ত ভাষণের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ব্যাখ্যা সুন্নীবৃন্দ এভাবে দেন যে, কিছু মানুষ হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র বিরুদ্ধে গজগজ করছিলেন তাঁর নেতৃত্বাধীন ইয়েমেন অভিযানে প্রাপ্ত গনীমতের মালামাল বণ্টনে তাঁরই কঠোরতার ব্যাপারে; ওই অভিযানশেষে তিনি এবং তাঁর অধীনস্থ সহযোদ্ধাবৃন্দ সরাসরি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সাথে একত্রে হজ্জ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফে গমন করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁরই মেয়ের জামাইয়ের প্রতি পোষণকৃত হিংসা-বিদ্বেষ দূর করার জন্যে এভাবে ভাষণ দান করেন (গাদীরে খুমে)। [The Origins and Early Development of Shi'a Islam, এস,এইচ,এম, জাফরী, ২১ পৃষ্ঠা; লিঙ্ক: https://samensterk.files.wordpress.com/2010/11/shm-jafri-the-origins-early-development-of-shiaa-islam.pdf]       


পটভূমিকে ধামাচাপা দেয়ার শীয়া অপচেষ্টা



সুন্নী মুসলমানবৃন্দ বলেন, ইয়েমেনে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ও তাঁর সৈন্যদের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার দরুন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) গাদীরে খুমে তাঁর সেই ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। শীয়া গোষ্ঠী এটাকে দুটোর যে কোনো একটা পন্থায় ব্যাখ্যা করে থাকেন। প্রথম পন্থাটি হলো ইয়েমেনের ঘটনাকে একেবারেই অস্বীকার করা এ দাবির ভিত্তিতে যে, এটা স্রেফ ‘উমাইয়া প্রপাগান্ডা’ যে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) এরকম জারিয়্যা দাসী গ্রহণ করেছিলেন। নিশ্চয় এ দাবিকে তাৎক্ষণিকভাবে খণ্ডন করা যায় এই পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে যে, এসব বিবরণ শীয়া উৎসগুলোর মধ্যেও বিদ্যমান যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত শায়খ মুফিদ সাহেবের ‘কিতাব আল-ইরশাদ’ও। এমতাবস্থায় শীয়া প্রপাগান্ডাকারীরা ডিগবাজি দিয়ে আরেকটি ব্যাখ্যার শরণাপন্ন হন, যেমনটি ‘তা’য়ের-আল-ক্বুদস্’ নিচে প্রদান করেছেন; আর তা হলো এ কথা স্বীকার করা যে ইয়েমেনের ঘটনা ঘটেছিলো সত্য, তবে সেটার সাথে গাদীরে খুমের কোনো সংশ্লিষ্টতাই ছিলো না।



তা’য়ের-আল-ক্বুদস্, ShiaOfAhlAlBayt ওয়েবসাইটের এডমিন, বলেন:



এই ঘটনা (ইমামে আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুর সৈন্যদের তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হওয়ার উপাখ্যান) বর্ণনাকারী হাদীসগুলো.... গাদীরে খুমের ঘটনার সাথে মোটেও সম্পৃক্ত নয়।



(সৈন্যদের রাগান্বিত হওয়ার) গোটা উপাখ্যানটি মদীনায় অবস্থিত মসজিদে নববীতে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র হুজরাহ শরীফের চারপাশে বাস্তবে রূপায়িত হয় এবং তা সেখানেই শেষ হয়; ফলে সে ঘটনার সাথে গাদীরে খুমের ঘটনার কোনো সম্পর্ক-ই নেই! ওহাবী/নওয়া’সিব লোকেরা ইতিহাসের পরবর্তী সময়ে সংঘটিত গাদীরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে যাকে উপস্থাপন করতে চায়, সে বিষয়টিকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ইতোমধ্যেই খোলাসা করেছেন। [বঙ্গানুবাদকের নোট: সৌদি ওহাবীদের সাথে ইরানী শীয়াদের পাল্টাপাল্টি এ দোষারোপের আওতায় আমরা ঐতিহ্যবাহী সুন্নী সর্বসাধারণ পড়ি না।]



....গাদীরের ঘটনা সংঘটিত হয় ১৮ই যিলহজ্জ্ব; অথচ ইতিহাসবিদবৃন্দের মতে, ইয়েমেনের ঘটনা ঘটেছিলো রবীউল আখের (সানী) কিংবা জমাদাল উলা’ (জমাদিউল আউয়াল) মাসে। এই দুটো ঘটনাকে মিশ্রণের কোনো যুক্তি বা সম্ভাবনাও নেই, কেননা একটি ঘটেছিলো মক্কায় হজ্জ্বশেষে ফেরার পথে; পক্ষান্তরে অপরটি ইয়েমেনে ইতিপূর্বে ঘটেছিলো এবং তা মদীনার মসজিদে নববীতে তৎক্ষণাৎ সমাধান হয়ে গিয়েছিলো, যা এমন কী প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র হজ্জ্বযাত্রারও আগের ঘটনা! [তা’য়ের-আল-ক্বুদস্ এডমিনের বক্তব্য এখানে সমাপ্ত]



বস্তুতঃ দুটো ঘটনাই (ইয়েমেন ও গাদীরে খুম) মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র যাহেরী/প্রকাশ্য হায়াতে জিন্দেগীর শেষ বছরে সংঘটিত হয়েছিলো। শীয়া চিরায়ত ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ শায়খ মুফিদ সাহেবের মতানুসারে, ইয়েমেনে সেনা অভিযানের পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো যিলক্বদ (ইসলামী ১১তম) মাসের শেষ পাঁচ দিনে এবং গাদীরে খুমের ঘটনা ঠিক ওর পরপরই যিলহজ্জ্ব (১২তম) মাসে সংঘটিত হয়েছিলো। তা’য়ের-আল-ক্বুদস্ এখানে ধোকাপূর্ণভাবে যা দাবি করেছেন তা হলো, ইয়েমেনে সেনা অভিযান রবীউস্ সানী (৪র্থ) মাসে বা জমাদিউল আউয়াল (ইসলামী ৫ম) মাসে সংঘটিত হয়েছিলো; অথচ গাদীরে খুমের ঘটনা ছিলো ১২তম (যিলহজ্জ্ব) মাসের। আসলে এটা শীয়াদের তৈরি একটা ভয়ানক অর্ধসত্য! ইয়েমেনে অভিযান বেশ অনেক মাস স্থায়ী হয়েছিলো যা ১১তম (যিলক্বদ) মাসে পড়েছিলো! অতএব, কিছু মাস আগে ইয়েমেন অভিযান শুরু হলেও সেটা নিশ্চিতভাবে ১১তম (যিলক্বদ) মাসের শেষ পাঁচ দিনের আগ পর্যন্ত সমাপ্ত হয়নি, যার পরপরই হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ও তাঁর সৈন্যবাহিনী মক্কায় অনুষ্ঠিত হজ্জ্বে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সাথে যোগ দেন।



ইয়েমেনের ঘটনার সমাধান মদীনায় করা হয়েছিলো মর্মে তা’য়ের-আল-ক্বুদস্’এর দাবিটি সম্পর্কে বলবো, এটা তাঁর মারাত্মক ভ্রান্তি। ইয়েমেনে (খুমস্-সম্পর্কিত) মতবিরোধের ঘটনার পর হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) মক্কাতে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সওয়ারে চড়ে রওয়ানা হন; তিনি মদীনায় গমনের জন্যে রওয়ানা হননি। তিনি এবং তাঁর সৈন্যবাহিনী হুজূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে হজ্জ্ব করেন এবং ওই সময়েই তাঁর সৈন্যবৃন্দ তাঁর বিরুদ্ধে গজগজ করছিলেন, যার ফলে গাদীরে খুমের ঘোষণার সূত্রপাত হয়।



'তা’য়ের-আল-ক্বুদস্’ (এডমিন) হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ও তাঁর সৈন্যদের মধ্যে মতপার্থক্যকে গাদীরে খুমের কিছু দিন আগেকার ঘটনা দাবি করে এটাকে ‘ওহাবী/নওয়া’সিব’ প্রপাগান্ডা বলে উল্লেখ করেন। আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করতে চাই তিনি শায়খ মুফীদকেও ‘নওয়া’সিব’দের একজন বিবেচনা করেন কি না? শায়খ মুফিদ তাঁর ‘কিতা’ব আল-ইরশা’দ’ শীর্ষক বইয়ে ইয়েমেনে সংঘটিত মতবিরোধ সম্পর্কে ’মহানবী (দ:)’র বিদায়ী হজ্জ্ব ও গাদীরে খুমের ঘোষণা’ অধ্যায়ে লেখেন:



রাসূলুল্লাহ (তাঁর ও তাঁর পরিবারসদস্যদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক) হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে খুমস্-এর এক-পঞ্চমাংশ স্বর্ণ ও রৌপ্য এবং বর্ম ও অন্যান্য জিনিস সংগ্রহ করতে ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন...অতঃপর প্রিয়নবী (তাঁর ও তাঁর পরিবারসদস্যদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক) হজ্জ্বে গমনের এবং মহান আল্লাহতা’লা (এতদসংক্রান্ত) যা বিধান করেছেন তা পালনের সিদ্ধান্ত নেন....।



রাসূল (তাঁর ও তাঁর পরিবারসদস্যদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক) যিলক্বদ মাসের পাঁচ দিন বাকি থাকতে হাজ্বীদের সাথে হজ্জ্বযাত্রা করেন। তিনি আমিরুল মো’মেনীন (হযরত আলী)’কে চিঠি লিখেছিলেন ইয়েমেন হতে হজ্জ্বে গমনের ব্যাপারে...।



এদিকে আমিরুল মো’মেনীন (হযরত আলী) ইয়েমেন অভিযানে অংশগ্রহণকারী তাঁর সৈন্যদেরকে সাথে নিয়ে রওয়ানা হন। তাঁর সাথে ছিলো নজরান এলাকার মানুষদের কাছ থেকে সংগৃহীত বর্ম। হুজূর পাক (তাঁর ও তাঁর পরিবারসদস্যদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক) যখন মদীনা হতে মক্কাগামী রাস্তা ধরে মক্কার নিকটবর্তী হচ্ছিলেন, তখন আমিরুল মো’মেনেীন (হযরত আলী)-ও ইয়েমেন হতে মক্কাগামী রাস্তা ধরে মক্কার কাছে চলে এসেছিলেন। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) সৈন্যবাহিনী হতে এগিয়ে যান রাসূল (তাঁর ও তাঁর পরিবারসদস্যদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক)’এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে; আর তিনি সৈন্যদের মধ্যে কাউকে (সহ-অধিনায়কের) দায়িত্ব দিয়ে যান। তিনি মহানবী (দ:)’র সামনে হাজির হন, যখন রাসূল (দ:) মক্কার দিকে তাকিয়েছিলেন। হযরত আলী (ক:) তাঁকে সালাম জানান এবং তিনি যা যা করেছেন আর (খুমস্-এর) যা কিছু সংগ্রহ করেছেন, তার সমস্ত বৃত্তান্ত তাঁর সামনে তুলে ধরেন; তিনি রাসূল (দ:)’কে আরো জানান যে তিনি তাঁর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীর আগে ত্বরা করে চলে এসেছেন। প্রিয়নবী (তাঁর ও তাঁর পরিবারসদস্যদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক) এতে খুশি হন এবং তাঁর সাক্ষাতে আনন্দিত হন...।



আমিরুল মো’মেনীন (তাঁর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে বিদায় নিয়ে নিজ সেনাবাহিনীর কাছে ফেরত যান। তিনি কাছেই তাঁদের সাক্ষাৎ পান, কিন্তু দেখতে পান তাঁরা ওই বর্মগুলো পরিধান করে আছেন। তিনি তাঁদেরকে এর জন্যে ভর্ৎসনা করেন।



তাঁর নিযুক্ত সহ-অধিনায়ককে তিনি বলেন, “লজ্জা তোমার প্রতি! প্রিয়নবী (তাঁর ও তাঁর পরিবারসদস্যদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক)’র কাছে বর্ম হস্তান্তরের আগে এগুলো সৈন্যদেরকে দেয়ার পেছনে তোমার কারণ কী? আমি তো তোমায় এর অনুমতি দেইনি!”



সহ-অধিনায়ক উত্তর দেন, “তারা আমাকে অনুরোধ জানায় এগুলো দ্বারা তাদেরকে সুশোভিত হতে দিতে, যাতে তারা (হজ্জ্বের জন্যে) পবিত্র হতে পারে; এরপর তারা এগুলো আমাকে ফেরত দেবে বলেছিলো।”



আমিরুল মো’মেনীন (ক:) তাঁদের কাছ থেকে সব বর্ম খুলে নেন এবং বস্তায় ভরেন। এতে তাঁরা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। তাঁরা যখন মক্কায় আগমন করেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগের সংখ্যা অগণিত হয়ে দাঁড়ায়। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আদেশ করেন মানুষের কাছে এ আহ্বান জানাতে: “আলী ইবনে আবী তালিবের বিরুদ্ধে তোমাদের জিহ্বাকে সংযত করো! সে মহান আল্লাহর খাতিরে অত্যন্ত কঠোর; সে এমন নয়, যে ধর্মের ক্ষেত্রে ধোকা দেয়...।”



প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হজ্জ্বব্রত পালনশেষে পশু ক্বুরবানীতে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে নিজের সাথে শরীকদার করেন। অতঃপর মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হন। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ও মুসলমানবৃন্দ তাঁর সাথে যাত্রা করেন। তিনি গাদীরে খুম নামের একটি স্থানে উপনীত হন...। [শায়খ মুফীদ প্রণীত ’কিতা’ব আল-ইরশা’দ’,  ১১৬-১২০ পৃষ্ঠা; লিঙ্ক: https://www.shia-maktab.info/index.php/en/library/books/english?format=raw&task=download&fid=93]



হযরতে আলী (ক:)’র প্রতি কারা ক্ষুব্ধ ছিলেন?



শীয়া প্রপাগান্ডাকারীরা এরপর দাবি করেন সর্ব-হযরত খালিদ ও বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)-ই কেবল হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন।



ShiaOfAhlAlBayt ওয়েবসাইটের এডমিন তা’য়ের-আল-ক্বুদস্ বলেন:



“হাদীসগুলোর কোনোটাই হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র ব্যাপারে অভিযোগকারী বা ‘বোগয’ তথা শত্রুতার ইন্ধনদাতা হিসেবে খালিদ বিন ওয়ালীদ ও বোরায়দা (তিরমিযীতে বারা’আ বলা হয়েছে) ছাড়া তৃতীয় কারো নাম উল্লেখ করে না, যেমনটি এই ঘটনায় বর্ণিত হয়।”



তা’য়ের-আল-ক্বুদস এডমিনের এটা আরেকটা নির্লজ্জ মিথ্যাচার। বস্তুতঃ হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সমস্ত (অথবা অন্তত বেশির ভাগ) সৈন্য-ই তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন; স্রেফ একজন বা দুইজন নন। শায়খ মুফীদ লেখেন:



আমিরুল মো’মেনীন (ক:) তাঁদের কাছ থেকে সব বর্ম খুলে নেন এবং বস্তায় ভরেন। এতে তাঁরা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। তাঁরা যখন মক্কায় আগমন করেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগের সংখ্যা অগণিত হয়ে দাঁড়ায়। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আদেশ করেন মানুষের কাছে এ আহ্বান জানাতে: “আলী ইবনে আবী তালিবের বিরুদ্ধে তোমাদের জিহ্বাকে সংযত করো! সে মহান আল্লাহর খাতিরে অত্যন্ত কঠোর; সে এমন নয়, যে ধর্মের ক্ষেত্রে ধোকা দেয়...।” [শায়খ মুফীদ প্রণীত ’কিতা’ব আল-ইরশা’দ’,  ১১৬-১২০ পৃষ্ঠা; লিঙ্ক: https://www.shia-maktab.info/index.php/en/library/books/english?format=raw&task=download&fid=93]



হযরতে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো ছিলো ‘অগণিত’ এবং ‘মানুষেরা’ তাঁর প্রতি ছিলেন অসন্তুষ্ট (একজন বা দু জন নন); আর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মানুষের প্রতি যে আহ্বান জানান, তা ছিলো সার্বিক। এটা স্পষ্ট যে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সৈন্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন এ কারণে যে, খুমস্-এর বর্মগুলো পরার অনুমতি তিনি তাঁদেরকে দেননি। অতএব, একজন বা দু জনের ওপর এই দোষ চাপানো যথোচিৎ হবে না। বরঞ্চ সত্য হলো এই যে, ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)‘র ওই আচরণের কারণে তাঁর সৈন্যরা অসন্তুষ্ট হন, আর তাই এর দোষ নির্দিষ্ট কারো ঘাড়ে চাপানো হতে আমরা আল্লাহর দরবারে মুক্তি চাই (আমীন) - বিশেষ করে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) স্বয়ং যেখানে হযরত বোরায়দা ও অন্যান্যদের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তবে মোদ্দা কথা হলো, অনেক মানুষ হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি রাগান্বিত হওয়ার কারণে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে গাদীরে খুমের ঘোষণা দিতে হয়, যাতে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রতি দোষারোপ বন্ধ হয়ে যায়। এটা কোনোক্রমেই তাঁকে উত্তরাধিকারী খলীফা নিয়োগের ঘোষণা ছিলো না।



বানোয়াট সংস্করণ 



একটি সার্বিক শীয়া কৌশল হচ্ছে সাধারণ সুন্নীদের কাছে প্রথমে বিবৃত করা যে গাদীরে খুম-বিষয়ক হাদীসটি বুখারী শরীফ ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদীসগ্রন্থগুলোতে বিদ্যমান (বেশির ভাগ সময় লম্বা রেফারেন্স দ্বারা সুন্নীদের মনে অনুকূল ধারণা সৃষ্টি করে); অতঃপর তাঁরা অপরিচিত ও অনির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সংস্করণ উদ্ধৃত করেন, যা গাদীরে খুমকে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলী মূলতঃ যেভাবে প্রতিফলিত করে তার থেকে একদম ভিন্নভাবে ফুটিয়ে তোলে। মানুষকে বোকা বানাবার এই কৌশলকে বলা হয় “acceptance by association"  মানে সংশ্লিষ্টকরণের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি।



বস্তুতঃ গাদীরে খুম-সংক্রান্ত হাদীসের স্রেফ দুটো সংস্করণ রয়েছে যেগুলোকে সহীহ/বিশুদ্ধ বিবেচনা করা হয় এবং তাও শুধু কিছু আলেম-উলেমার দৃষ্টিতেই। বিতর্কের খাতিরে আমরা সেগুলোকে সহীহ হিসেবে গ্রহণ করছি। তবে ওই দুটো বর্ণনা সহিহাইন (বুখারী ও মুসলিম) গ্রন্থ দুটোয় নেই; বরং সেগুলোকে পাওয়া যায় অন্যান্য কিতাবের পৃথক পৃথক বিবরণে। হাদীসশাস্ত্রের শিক্ষার্থীমাত্রই জানেন, আহাদীসের বিভিন্ন শ্রেণিকরণ রয়েছে; গাদীরে খুম-বিষয়ক হাদীসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিশুদ্ধ বিবরণটি রয়েছে সহীহ বুখারী হাদীসের গ্রন্থে, যা ওপরে আমরা উদ্ধৃত করেছি। অন্য দুটো সংস্করণ নিম্নরূপ:



১/ প্রথম সংস্করণটি - مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ - অর্থ: ‘আমি যার মওলা, আলীও তার মওলা।’



২/ দ্বিতীয় সংস্করণটি - اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ ، وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ - অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনিও তাকে ভালোবাসুন, যে আলীকে ভালোবাসে; আর তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পােষণ করে।’



প্রথম সংস্করণটি সাধারণভাবে গৃহীত; দ্বিতীয়টি দুর্বলতর, তবে কিছু আলেম-উলেমা এটাকে সহীহ বিবেচনা করেন। অন্যান্য সংস্করণগুলো সহীহ হাদীসের কিতাবে নেই এবং মওদূ তথা জাল/বানোয়াট। সাধারণতঃ শীয়া গোষ্ঠী তাঁদের যুক্তি এই দুটো হাদীসের ওপর ভিত্তি করেই অবতারণা করে থাকেন। কিন্তু তাঁদের রদ করা হলে নিঃসন্দেহে তাঁরা বেশির ভাগ সময়ই কিছু অপরিচিত সূত্র হতে অতিরিক্ত সংস্করণ উপস্থাপন করেন, যেখানে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে তাঁরই ‘ওয়াসী’, খলীফা, ইমাম ইত্যাদি বলে সম্বোধন করেছিলেন। এগুলোর সবই বানোয়াট, আর ঐতিহাসিকভাবে শীয়া সম্প্রদায় হলো জাল হাদীস রচনাকারী। তাঁরা গাদীরে খুম সম্পর্কে অপরিচিত রেফারেন্স-এর এক লম্বা তালিকা তৈরিতে উস্তাদ, কেননা গাদীরে খুমের ব্যাপারে অসংখ্য জালিয়াতির জন্যে তাঁরাই দায়ী।



আমরা সহীহ বুখারীতে নিহিত গাদীরে খুমের সংস্করণটি ইতোমধ্যেই দেখেছি; আরো লক্ষ্য করেছি কীভাবে ‘মওলা’ শব্দটি তাতে নিহিত নেই। তবে এই ‘মওলা’ শব্দটি নিচের হাদীসের সংস্করণে পাওয়া যায়:



عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ غَزَوْتُ مَعَ عَلِيٍّ الْيَمَنَ فَرَأَيْتُ مِنْهُ جَفْوَةً فَلَمَّا قَدِمْتُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَكَرْتُ عَلِيًّا فَتَنَقَّصْتُهُ فَرَأَيْتُ وَجْهَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَغَيَّرُ فَقَالَ يَا بُرَيْدَةُ أَلَسْتُ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ قُلْتُ بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ.



হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, আমি হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সাথে ইয়েমেন অভিযানে যাই এবং তাঁর তরফ থেকে শীতলতা প্রত্যক্ষ করি; তাই আমি (ফেরার পরে) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে এসে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কথা উল্লেখ করে তাঁর সমালোচনা করি; এমতাবস্থায় প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র চেহারা মোবারক বদলে যেতে দেখি। আর তিনি বলেন: “ওহে বোরায়দা, আমি কি ঈমানদারদের তাদের নিজেদের চেয়েও কাছে নই?” আমি (উত্তরে) বলি: জি, এয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। অতঃপর তিনি বলেন: “আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা।” [মুসনদে ইমামে আহমদ ৫ম খণ্ড, ৩৪৭ পৃষ্ঠা #২২৯৯৫, যার সনদ সহীহ ও রাবী/বর্ণনাকারীবৃন্দ সিক্বা/আস্থভাজন (সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিমের বিশ্বস্ত); সুনানে নাসাঈ ৫ম খণ্ড, ৪৫ পৃষ্ঠা #৮১৪৫; মুস্তাদরাকে হাকিম ৩য় খণ্ড, ১১৯ পৃষ্ঠা #৪৫৭৮; আবূ নুয়াইম, ইবনে জারীর ও অন্যান্যরা]



সামান্য ভিন্নতর আরেকটি সংস্করণ নিম্নরূপ:



قَالَ حَدَّثَنِي بُرَيْدَةُ قَالَ بَعَثَنِي اَلْنَّبِيُّ صَلَّىَ اَللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَعَ عَلِيٍّ إِلَى الْيَمَنَ فَرَأيْتُ مِنْهُ جَفْوَةً فَلَمَّا رَجَعْتُ شَكَوْتُهُ إِلَىْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلْيْهِ وَسَلَّمَ فَرَفَعَ رَأسَهُ إِلَيَّ قَالَ يَا بُرَيْدَةُ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ.



হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আমাকে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সাথে ইয়েমেন অভিযানে প্রেরণ করেন এবং আমি তাঁর (হযরত আলীর) তরফ থেকে শীতলতা লক্ষ্য করি; আমি যখন প্রত্যাবর্তন করি, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করি। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আপন শির মোবারক (তাঁর দিকে) উঠিয়ে বলেন: “আমি যার মওলা, এই আলী-ও তারই মওলা।” [সুনান আল-কুবরা’, ৫ম খণ্ড, ১৩০ পৃষ্ঠা, #৮৪৬৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ’তেও অনুরূপ বর্ণনা বিদ্যমান (৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩৭৪ পৃষ্ঠা)]



অন্যান্য বর্ণনায় হুজূর পাক বলেন - اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ ، وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ - অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনিও তাকে ভালোবাসুন, যে আলীকে ভালোবাসে; আর তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পােষণ করে।’ কিছু আলেম এই হাদীসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সন্দিহান হলেও আমরা (তর্কে খাতিরে) এই দ্বিতীয় সংস্করণটিকে সহীহ হিসেবে গ্রহণ করবো।



হাদীসে গাদীরে খুমের স্রেফ দুটো সংস্করণকেই সহীহ বিবেচনা করা যায়, আর তাই আমরা ওই দুটোকে নিয়েই আলোকপাত করবো। শীয়া প্রপাগান্ডাকারীবর্গ অহরহই অচেনা ও অনির্ভরযোগ্য উৎস হতে বিভিন্ন হাদীসের সংস্করণ পেশ করে থাকেন; কিন্তু সেগুলো বিতর্কের বৈধ পদ্ধতি নয়। কেননা বেশির ভাগ সময়েই এগুলোকে যাচাই করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়; উপরন্তু, বেশির ভাগ সময়ে এগুলোর কোনো অস্তিত্ব-ও খুঁজে পাওয়া যায় না; কিংবা এগুলোকে নাটকীয় অপ্রাসঙ্গিকতায় তুলে ধরা হয়। যা অদ্ভুত ও কিছুটা হাস্যকর তা হলো, সুন্নী মুসলমানবৃন্দ প্রায়ই শীয়াদের নির্ভরযোগ্য ‘আল-কাফী’ হাদীসগ্রন্থ হতে উদ্ধৃতি দেন, অথচ শীয়া গোষ্ঠী তা তর্কের ভিত্তিস্বরূপ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। যদি  শীয়াদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদীসগ্রন্থের প্রতি এটাই তাঁদের মনোভাব হয়, তাহলে শীয়াবর্গ কেন অচেনা ও অনির্ভরযোগ্য উৎস হতে গৃহীত বিবরণসমূহ আমাদের দ্বারা গ্রহণের আশা করেন? যাহোক, ন্যায়নিষ্ঠার খাতিরে আমরা এখানে যে দুটো সংস্করণ সম্পর্কে আলোচনা করবো, তা হলো: ১/ এই আলী-ও তার মওলা... এবং ২/ (হে আল্লাহ) তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করুন, যে তার প্রতি শত্রুতাভাব পােষণ করে।
Top