ইয়াজিদের নামের পার্শ্বে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’ ব্যবহার-কারী জাকির নায়েকের মিথ্যাচারিতার পোস্ট-মর্টেম
প্রিয় পাঠক! ইসলামের ইতিহাসে ঘৃণিত ব্যক্তিদের কোনো তালিকা তৈরী করা হলে একেবারে উপরের দিকে থাকবে ইয়াজিদ পালিতের নাম।এই খলনায়কটি হল নিমর্মতা, পৈশাচিকতা এবং মানবাধিকার লংঘনের মূর্ত প্রতীক। নির্বিচার গণহত্যার মাধ্যমে বিশ্বমানবতাকে স্তম্ভিত করে দেওয়া এই নরপিশাচটির ফাসিক হওয়া সম্পর্কে উলেমায়ে ইসলাম এবং হাদীস-বিশেষজ্ঞগনের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিবাদ-দ্বন্দ-অনৈক্য সৃস্টিকারী একটি বিশেষ গোষ্ঠী মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এবং তার প্রিয় আহলে বাইতের প্রতি বিদ্বেষ-ঈর্ষা হেতু ইয়াজিদের নারকীয় কর্মকান্ডকে ধামাচাপা দেওয়ার চেস্টা করেএবং তার প্রশংসা করে । সম্প্রতি ঐ বিশেষ গোষ্ঠীর এক টিভি-প্রচারক ইয়াজিদের নামের পার্শ্বে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’ ব্যবহার করেছেন এবং মুসলিমদের হৃদয়ে তীব্র ব্যথা প্রদান করেছেন। সর্বাধিক যন্ত্রনাদায়ক বিষয় হল, এই ইয়াজিদ-প্রেমিক টিভি-প্রচারক তাঁর কাজকে সঠিক প্রমান করার জন্য মিথ্যাচারিতা ও ছলনার আশ্রয় নিতেও কার্পন্য করেন নি। ইহা ফিতনা এবং ইসলামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। এই আর্টিকালে আমরা উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিকের মিথ্যাচারিতা ও ছলনার পূর্নাঙ্গ পোস্ট-মর্টেম করব যেন সরলপ্রান মুসলিম ভাই-বোনগন এই ধর্ম-ব্যবসায়ীদের পাতা ফাঁদে পা না দেন এবং পবিত্র আহলে বাইতের সঙ্গে সুদৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত থাকেন।
ইয়াজিদের নামের পার্শ্বে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’ ব্যবহার-কারীদের মিথ্যাচারিতা নং ১ : উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিক তার কাজকে সঠিক প্রমান করার জন্য যুক্তি প্রদান করে যে, “ সহীহ বুখারীতে একটি হাদীস আছে যেখানে বলা হয়েছে যে যারা কনস্টান্টিনোপল (কুসতুনতুনিয়া) জয় করবেন তাঁরা জান্নাত পাবেন এবং ইয়াজিদ ছিল ঐ বাহিনীর কমান্ডার” [www.youtube.com/watch?v=R1qgyHCb0Jw]। প্রিয় পাঠক! এই ব্যক্তি সহীহ বুখারীর নামে সম্পূর্ন মিথ্যা কথা বলেছে। সহীহ বুখারীতে এমন কোন হাদীস নেই যেখানে বলা হয়েছে “যে যারা কনস্টান্টিনোপল (কুসতুনতুনিয়া) জয় করবেন তাঁরা জান্নাত পাবেন এবং ইয়াজিদ ছিল ঐ বাহিনীর কমান্ডার”। ইহা সহীহ বুখারীর নামে সরলপ্রান মুসলিমগনকে বিভ্রান্ত করার একটি ঘৃন্য প্রচেষ্টা । হাদীসের নামে যারা মিথ্যা কথা বলে তাদের ইসলাম নিয়ে কথা বলার কি অধিকার আছে? হাদীসের নামে জেনেশুনে মিথ্যা কথা বলা কি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ও ইসলামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা নয় ? ইয়াজিদ-প্রেমিকদের প্রতি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জ থাকল যদি সহীহ বুখারী থেকে এমন হাদীস দেখাতে পারেন যেখানে বলা হয়েছে যে “যারা কনস্টান্টিনোপল (কুসতুনতুনিয়া) জয় করবেন তাঁরা জান্নাত পাবেন এবং ইয়াজিদ ছিল ঐ বাহিনীর কমান্ডার”, তাহলে এক লাখ টাকা নগদ পুরস্কার প্রাদান করা হবে ।রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কি বলেন নি, “ যে ব্যক্তি আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলে তার ঠিকানা জাহান্নাম?” [তথ্যসূত্র ; সহীহ বুখারী - খন্ড নং ০১- পৃ নং ৪১ – হাদীস নং ১০৬] ভাই! হাদীসের নামে মিথ্যা কথা বলার জন্য তওবা করে নিন এবং দয়া করে ফির্কা-পারাস্তি থেকে বিরত থাকুন। [ বিশদে জানার জন্য পাঠ করুন আমার নিবন্ধ : “ কুখ্যাত ইয়াজিদ কি ক্ষমাপ্রাপ্ত বা মাগফুর ? সহীহ বুখারীর নামে ইয়াজিদ-প্রেমিকদের মিথ্যাচারিতার পোস্ট-মর্টেম” ]
ইয়াজিদের নামের পার্শ্বে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’ ব্যবহার-কারীদের মিথ্যাচারিতা ও ছলনার পোস্ট-মর্টেম [ পর্ব ০২ ]
লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ এ কে আজাদ
ইয়াজিদের নামের পার্শ্বে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’ ব্যবহার-কারীদের মিথ্যাচারিতা নং 2 : উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিক তার কাজকে সঠিক প্রমান করার জন্য সহীহ বুখারীর সুবিখ্যাত তফসীরকার ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ) এর নামেও সম্পূর্ন মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, “ ইবনে হাজার যেখানে বুখারীর তফসীরে তাকে (ইয়াজিদকে) জান্নাতী বলেছেন, সেখানে আমি কিভাবে তাকে (ইয়াজিদকে) অভিশাপ দিতে পারি”? [www.youtube.com/watch?v=R1qgyHCb0Jw]।
প্রিয় পাঠক! এটিও সম্পূর্ন মিথ্যা এবং বানোয়াট কথা । ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)তাঁর তফসীরে কোথাও ইয়াজিদকে জান্নাতী বলেন নি । আল্লাহু আকবার ! ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ) তো ইয়াজিদের ‘মাগফুর’ বা ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার ধারণাটিকে তাঁর তফসীরে ধূলিসাৎ করেছেন এবং ‘আল ইমতা বিল আরবাঈন’ গ্রন্থের শিরোনামই দিয়েছেন ’ইয়াযীদের প্রতি লা’নত’। সর্বোপরী, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)বর্ণনা করেছেন যে, খলীফা উমর বিন আবদুল আযীয বা দ্বিতীয় উমর ইয়াযীদের প্রশংসা কারীকে কুড়িটি দোররা মারার নির্দেশ দান করে ছিলেন। কিন্তু মিথ্যাচারিতার সওদাগর উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)এর নামে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলে ফেললেন। প্রিয় পাঠক! আসুন, দেখে নিই, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)ইয়াযিদ সম্পর্কে ঠিক কি বলেছেন :
(১) ইমাম ইবনে হাজার ইয়াজিদের ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার ধারণাটিকে ধূলিসাৎ করেছেন : ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)তাঁর তফসীরে ইয়াজিদের ‘মাগফুর’ বা ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার ধারণাটিকে ধূলিসাৎ করেছেন এভাবে , “ ইবনে মুহলাব বলেছেন যে এই হাদীসে আমীর মুয়াবিয়ার কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে কারন তিনি প্রথম নৌ-অভিযান করেছিলেন এবং এই হাদীসে ইয়াযিদের কথাও ইঙ্গিত করা হয়েছে কারন সে প্রথম কাইসারের নগরী আক্রমন করেছিল ( এই তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা কারন ইয়াযিদ প্রথম যুদ্ধে অংশগ্রহন করে নি সে অনেক পরের একটি অভিযানে তার পিতা কর্তৃক শাস্তিস্বরুপ প্রেরিত হয়েছিল- লেখক)কিন্তু ইবনে আল তীন এবং ইবনে আল্ মূনীর এর উত্তর দিয়েছেন এবং বলেছেন যে ইহা অপরিহার্য নয় যে ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে সকলেই এই ক্ষমাপ্রাপ্তির অন্তর্ভুক্ত কারন জ্ঞানীব্যক্তি-বর্গ সকলেই একমত যে, তারাই এই ক্ষমাপ্রাপ্তির অন্তর্ভুক্ত হবে যারা প্রকৃতই তার উপযুক্ত হবে কারন আক্রমনকারীদের মধ্যে যদি কেউ পরে মুরতাদ হয়ে যায় তহলে সে আর ক্ষমাপ্রাপ্তগনের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে না এবং এটা প্রমান যে উক্ত হাদীসে উল্লেখিত ক্ষমাপ্রাপ্তির বিষয়টি শর্তাধীন [ তথ্যসূত্র : ফাতহুল বারী শারাহ সাহীহ বুখারী - ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী – খন্ড নং ৬ – পৃ নং ২০০-২০১ ] প্রিয় পাঠক! দেখলেন তো, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)যে ধারণাটিকে খন্ডন করলেন উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিক ঐ ধারণাটিকেই তাঁর নামে চালিয়ে দিলেন !
(২) ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)তাঁর ‘আল ইমতা বিল আরবাঈন’ গ্রন্থের শিরোনামই দিয়েছেন ’ইয়াযীদের প্রতি লা’নত’ : ইয়াযিদের প্রতি ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)এর ঘৃনা এবং অসন্তোষের অধিক প্রমান আর কি হতে পারে যে তিনি দ্বীধাহীন চিত্তে ঘোষনা করেছেন যে, একমাত্র ’ পথভ্রষ্ট- গোমরাহ’ ব্যক্তিরাই ইয়াযিদের প্রশংসা করে এবং তিনি তাঁর ‘আল ইমতা বিল আরবাঈন’ গ্রন্থের শিরোনামই দিয়েছেন ’ইয়াযীদের প্রতি লা’নত’! ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ লিখেছেন,
“ইয়াযীদকে ভক্তি ও তার প্রশংসা ’পথভ্রষ্ট-গোমরাহ’ ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই করে না যার বিশ্বাস একেবারেই শূন্য। কেননা, ইয়াযীদের এমন সব বৈশিষ্ট্য ছিল যার ভক্ত-অনুরক্ত হলে কুফর তথা অবিশ্বাসের যোগ্য হতে হয় কারন কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা এবং কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঘৃণা করাই হল ঈমানের লক্ষণ।” [ তথ্যসূত্র : ‘আল-’এমতা বিল্ আরবাঈন আল-মাতবাইনাত আস্ সামা’আ’- ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী – পৃষ্ঠা নং ৯৬ - দার আল-কুতুব আল-’এলমিয়্যা, বৈরুত, লেবানন হতে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত]
(৩) ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)এর মতে, ইয়াযীদের প্রশংসা কারীকে কুড়িবার দোররা মারতে হবে : ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ) লিখেছেন, “এয়াহইয়া ইবনে আব্দিল মুলক্ বিন আবি গানিয়্যা যিনি ’নির্ভরযোগ্য’ বর্ণনাকারীদের একজন’, তিনি ’নির্ভরযোগ্য’ বর্ণনাকারী নওফল বিন আবি আকরাব থেকে শুনেছেন: একবার খলীফা উমর ইবনে আবদিল আযীয (২য় উমর)-এর দরবারে মানুষেরা ইয়াযীদ ইবনে মু’আবিয়া সম্পর্কে আলাপ করছিলেন। ওই সময় একজন লোক ইয়াযীদকে ‘আমীরুল মূমীনীন’(ঈমানদারদের শাসক) খেতাবে সম্বোধন করে। এটি শুনে খলীফা ২য় উমর (রাগান্বিত হয়ে) তাকে বলেন, “তুমি ইয়াযীদকে আমীরুল মো’মেনীন ডেকেছ?” অতঃপর তিনি ওই লোকটিকে ২০টি দোররা মারার হুকুম দেন। [ ‘তাহযিবুত্ তাহযিব’- ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী – খন্ড নং ৬ – পৃষ্ঠা নং ৩১৩ ]
*** একটি নির্নায়ক প্রশ্ন : প্রিয় পাঠক! উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিক নিজেকে দাবি করেন “আহলে সহীহ হাদীস” বলে এবং কথায় কথায় বলেন, আমাকে কুরআন এবং সহীহ হাদীস থেকে প্রমান দেখান, আমি মেনে নিব। এখন মিলিয়ন-ডলার প্রশ্ন হল, ইয়াযিদের নামের পার্শ্বে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’ বলার স্বপক্ষে তিনি নিজে কেন কুরআন এবং সহীহ হাদীস থেকে প্রমান দিচ্ছেন না ? তিনি কেন ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ) কে প্রমান হিসেবে উপস্থাপন করছেন, তাও আবার নিখাদ মিথ্যা কথা বলে ? নিজে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নিকট থেকে দলীল দাবি করবেন কুরআন এবং সহীহ হাদীস থেকে আর নিজে মনগড়া দলীল উপস্থাপন করবেন? দ্বিতীয়ত, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)ইয়াযিদ সম্পর্কে যে কথা বলেন নি তা তাঁর নামে চালিয়ে দিলেন আর তিনি যে স্বীয় ‘আল ইমতা বিল আরবাঈন’ গ্রন্থের শিরোনামই দিয়েছেন ’ইয়াযীদের প্রতি লা’নত’ এবং মন্তব্য করেছেন যে “ইয়াযীদকে ভক্তি ও তার প্রশংসা ’পথভ্রষ্ট-গোমরাহ’ ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই করে না, তা সম্পূর্ণ চেপে দিলেন ? উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিক ইহাও সম্পূর্ণ চেপে দিলেন যে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)এর গ্রন্থে বর্নিত আছে যে, শারীয়াতের আদালতে ইয়াজিদের প্রশংসাকারীদের ন্যূনতম শাস্তি হল কুড়িবার দোররা [ ‘তাহযিবুত্ তাহযিব’- ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী – খন্ড নং ৬ – পৃষ্ঠা নং ৩১৩ ] ? মহান আল্লাহ পাক বলেন, “আর তোমরা হককে (সত্য) বাতিলের (মিথ্যা) সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে হককে গোপন করো না” [ আল কুরআন- সুরাহ বাকারাহ – আয়াত নং ৪২ ] ।
প্রিয় পাঠক! ইসলামের ইতিহাসে ঘৃণিত ব্যক্তিদের কোনো তালিকা তৈরী করা হলে একেবারে উপরের দিকে থাকবে ইয়াজিদ পালিতের নাম।এই খলনায়কটি হল নিমর্মতা, পৈশাচিকতা এবং মানবাধিকার লংঘনের মূর্ত প্রতীক। নির্বিচার গণহত্যার মাধ্যমে বিশ্বমানবতাকে স্তম্ভিত করে দেওয়া এই নরপিশাচটির ফাসিক হওয়া সম্পর্কে উলেমায়ে ইসলাম এবং হাদীস-বিশেষজ্ঞগনের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিবাদ-দ্বন্দ-অনৈক্য সৃস্টিকারী একটি বিশেষ গোষ্ঠী মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এবং তার প্রিয় আহলে বাইতের প্রতি বিদ্বেষ-ঈর্ষা হেতু ইয়াজিদের নারকীয় কর্মকান্ডকে ধামাচাপা দেওয়ার চেস্টা করেএবং তার প্রশংসা করে । সম্প্রতি ঐ বিশেষ গোষ্ঠীর এক টিভি-প্রচারক ইয়াজিদের নামের পার্শ্বে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’ ব্যবহার করেছেন এবং মুসলিমদের হৃদয়ে তীব্র ব্যথা প্রদান করেছেন। সর্বাধিক যন্ত্রনাদায়ক বিষয় হল, এই ইয়াজিদ-প্রেমিক টিভি-প্রচারক তাঁর কাজকে সঠিক প্রমান করার জন্য মিথ্যাচারিতা ও ছলনার আশ্রয় নিতেও কার্পন্য করেন নি। ইহা ফিতনা এবং ইসলামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। এই আর্টিকালে আমরা উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিকের মিথ্যাচারিতা ও ছলনার পূর্নাঙ্গ পোস্ট-মর্টেম করব যেন সরলপ্রান মুসলিম ভাই-বোনগন এই ধর্ম-ব্যবসায়ীদের পাতা ফাঁদে পা না দেন এবং পবিত্র আহলে বাইতের সঙ্গে সুদৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত থাকেন।
ইয়াজিদের নামের পার্শ্বে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’ ব্যবহার-কারীদের মিথ্যাচারিতা নং ১ : উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিক তার কাজকে সঠিক প্রমান করার জন্য যুক্তি প্রদান করে যে, “ সহীহ বুখারীতে একটি হাদীস আছে যেখানে বলা হয়েছে যে যারা কনস্টান্টিনোপল (কুসতুনতুনিয়া) জয় করবেন তাঁরা জান্নাত পাবেন এবং ইয়াজিদ ছিল ঐ বাহিনীর কমান্ডার” [www.youtube.com/watch?v=R1qgyHCb0Jw]। প্রিয় পাঠক! এই ব্যক্তি সহীহ বুখারীর নামে সম্পূর্ন মিথ্যা কথা বলেছে। সহীহ বুখারীতে এমন কোন হাদীস নেই যেখানে বলা হয়েছে “যে যারা কনস্টান্টিনোপল (কুসতুনতুনিয়া) জয় করবেন তাঁরা জান্নাত পাবেন এবং ইয়াজিদ ছিল ঐ বাহিনীর কমান্ডার”। ইহা সহীহ বুখারীর নামে সরলপ্রান মুসলিমগনকে বিভ্রান্ত করার একটি ঘৃন্য প্রচেষ্টা । হাদীসের নামে যারা মিথ্যা কথা বলে তাদের ইসলাম নিয়ে কথা বলার কি অধিকার আছে? হাদীসের নামে জেনেশুনে মিথ্যা কথা বলা কি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ও ইসলামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা নয় ? ইয়াজিদ-প্রেমিকদের প্রতি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জ থাকল যদি সহীহ বুখারী থেকে এমন হাদীস দেখাতে পারেন যেখানে বলা হয়েছে যে “যারা কনস্টান্টিনোপল (কুসতুনতুনিয়া) জয় করবেন তাঁরা জান্নাত পাবেন এবং ইয়াজিদ ছিল ঐ বাহিনীর কমান্ডার”, তাহলে এক লাখ টাকা নগদ পুরস্কার প্রাদান করা হবে ।রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কি বলেন নি, “ যে ব্যক্তি আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলে তার ঠিকানা জাহান্নাম?” [তথ্যসূত্র ; সহীহ বুখারী - খন্ড নং ০১- পৃ নং ৪১ – হাদীস নং ১০৬] ভাই! হাদীসের নামে মিথ্যা কথা বলার জন্য তওবা করে নিন এবং দয়া করে ফির্কা-পারাস্তি থেকে বিরত থাকুন। [ বিশদে জানার জন্য পাঠ করুন আমার নিবন্ধ : “ কুখ্যাত ইয়াজিদ কি ক্ষমাপ্রাপ্ত বা মাগফুর ? সহীহ বুখারীর নামে ইয়াজিদ-প্রেমিকদের মিথ্যাচারিতার পোস্ট-মর্টেম” ]
ইয়াজিদের নামের পার্শ্বে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’ ব্যবহার-কারীদের মিথ্যাচারিতা ও ছলনার পোস্ট-মর্টেম [ পর্ব ০২ ]
লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ এ কে আজাদ
ইয়াজিদের নামের পার্শ্বে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’ ব্যবহার-কারীদের মিথ্যাচারিতা নং 2 : উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিক তার কাজকে সঠিক প্রমান করার জন্য সহীহ বুখারীর সুবিখ্যাত তফসীরকার ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ) এর নামেও সম্পূর্ন মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, “ ইবনে হাজার যেখানে বুখারীর তফসীরে তাকে (ইয়াজিদকে) জান্নাতী বলেছেন, সেখানে আমি কিভাবে তাকে (ইয়াজিদকে) অভিশাপ দিতে পারি”? [www.youtube.com/watch?v=R1qgyHCb0Jw]।
প্রিয় পাঠক! এটিও সম্পূর্ন মিথ্যা এবং বানোয়াট কথা । ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)তাঁর তফসীরে কোথাও ইয়াজিদকে জান্নাতী বলেন নি । আল্লাহু আকবার ! ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ) তো ইয়াজিদের ‘মাগফুর’ বা ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার ধারণাটিকে তাঁর তফসীরে ধূলিসাৎ করেছেন এবং ‘আল ইমতা বিল আরবাঈন’ গ্রন্থের শিরোনামই দিয়েছেন ’ইয়াযীদের প্রতি লা’নত’। সর্বোপরী, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)বর্ণনা করেছেন যে, খলীফা উমর বিন আবদুল আযীয বা দ্বিতীয় উমর ইয়াযীদের প্রশংসা কারীকে কুড়িটি দোররা মারার নির্দেশ দান করে ছিলেন। কিন্তু মিথ্যাচারিতার সওদাগর উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)এর নামে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলে ফেললেন। প্রিয় পাঠক! আসুন, দেখে নিই, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)ইয়াযিদ সম্পর্কে ঠিক কি বলেছেন :
(১) ইমাম ইবনে হাজার ইয়াজিদের ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার ধারণাটিকে ধূলিসাৎ করেছেন : ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)তাঁর তফসীরে ইয়াজিদের ‘মাগফুর’ বা ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার ধারণাটিকে ধূলিসাৎ করেছেন এভাবে , “ ইবনে মুহলাব বলেছেন যে এই হাদীসে আমীর মুয়াবিয়ার কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে কারন তিনি প্রথম নৌ-অভিযান করেছিলেন এবং এই হাদীসে ইয়াযিদের কথাও ইঙ্গিত করা হয়েছে কারন সে প্রথম কাইসারের নগরী আক্রমন করেছিল ( এই তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা কারন ইয়াযিদ প্রথম যুদ্ধে অংশগ্রহন করে নি সে অনেক পরের একটি অভিযানে তার পিতা কর্তৃক শাস্তিস্বরুপ প্রেরিত হয়েছিল- লেখক)কিন্তু ইবনে আল তীন এবং ইবনে আল্ মূনীর এর উত্তর দিয়েছেন এবং বলেছেন যে ইহা অপরিহার্য নয় যে ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে সকলেই এই ক্ষমাপ্রাপ্তির অন্তর্ভুক্ত কারন জ্ঞানীব্যক্তি-বর্গ সকলেই একমত যে, তারাই এই ক্ষমাপ্রাপ্তির অন্তর্ভুক্ত হবে যারা প্রকৃতই তার উপযুক্ত হবে কারন আক্রমনকারীদের মধ্যে যদি কেউ পরে মুরতাদ হয়ে যায় তহলে সে আর ক্ষমাপ্রাপ্তগনের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে না এবং এটা প্রমান যে উক্ত হাদীসে উল্লেখিত ক্ষমাপ্রাপ্তির বিষয়টি শর্তাধীন [ তথ্যসূত্র : ফাতহুল বারী শারাহ সাহীহ বুখারী - ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী – খন্ড নং ৬ – পৃ নং ২০০-২০১ ] প্রিয় পাঠক! দেখলেন তো, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)যে ধারণাটিকে খন্ডন করলেন উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিক ঐ ধারণাটিকেই তাঁর নামে চালিয়ে দিলেন !
(২) ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)তাঁর ‘আল ইমতা বিল আরবাঈন’ গ্রন্থের শিরোনামই দিয়েছেন ’ইয়াযীদের প্রতি লা’নত’ : ইয়াযিদের প্রতি ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)এর ঘৃনা এবং অসন্তোষের অধিক প্রমান আর কি হতে পারে যে তিনি দ্বীধাহীন চিত্তে ঘোষনা করেছেন যে, একমাত্র ’ পথভ্রষ্ট- গোমরাহ’ ব্যক্তিরাই ইয়াযিদের প্রশংসা করে এবং তিনি তাঁর ‘আল ইমতা বিল আরবাঈন’ গ্রন্থের শিরোনামই দিয়েছেন ’ইয়াযীদের প্রতি লা’নত’! ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ লিখেছেন,
“ইয়াযীদকে ভক্তি ও তার প্রশংসা ’পথভ্রষ্ট-গোমরাহ’ ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই করে না যার বিশ্বাস একেবারেই শূন্য। কেননা, ইয়াযীদের এমন সব বৈশিষ্ট্য ছিল যার ভক্ত-অনুরক্ত হলে কুফর তথা অবিশ্বাসের যোগ্য হতে হয় কারন কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা এবং কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঘৃণা করাই হল ঈমানের লক্ষণ।” [ তথ্যসূত্র : ‘আল-’এমতা বিল্ আরবাঈন আল-মাতবাইনাত আস্ সামা’আ’- ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী – পৃষ্ঠা নং ৯৬ - দার আল-কুতুব আল-’এলমিয়্যা, বৈরুত, লেবানন হতে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত]
(৩) ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)এর মতে, ইয়াযীদের প্রশংসা কারীকে কুড়িবার দোররা মারতে হবে : ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ) লিখেছেন, “এয়াহইয়া ইবনে আব্দিল মুলক্ বিন আবি গানিয়্যা যিনি ’নির্ভরযোগ্য’ বর্ণনাকারীদের একজন’, তিনি ’নির্ভরযোগ্য’ বর্ণনাকারী নওফল বিন আবি আকরাব থেকে শুনেছেন: একবার খলীফা উমর ইবনে আবদিল আযীয (২য় উমর)-এর দরবারে মানুষেরা ইয়াযীদ ইবনে মু’আবিয়া সম্পর্কে আলাপ করছিলেন। ওই সময় একজন লোক ইয়াযীদকে ‘আমীরুল মূমীনীন’(ঈমানদারদের শাসক) খেতাবে সম্বোধন করে। এটি শুনে খলীফা ২য় উমর (রাগান্বিত হয়ে) তাকে বলেন, “তুমি ইয়াযীদকে আমীরুল মো’মেনীন ডেকেছ?” অতঃপর তিনি ওই লোকটিকে ২০টি দোররা মারার হুকুম দেন। [ ‘তাহযিবুত্ তাহযিব’- ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী – খন্ড নং ৬ – পৃষ্ঠা নং ৩১৩ ]
*** একটি নির্নায়ক প্রশ্ন : প্রিয় পাঠক! উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিক নিজেকে দাবি করেন “আহলে সহীহ হাদীস” বলে এবং কথায় কথায় বলেন, আমাকে কুরআন এবং সহীহ হাদীস থেকে প্রমান দেখান, আমি মেনে নিব। এখন মিলিয়ন-ডলার প্রশ্ন হল, ইয়াযিদের নামের পার্শ্বে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’ বলার স্বপক্ষে তিনি নিজে কেন কুরআন এবং সহীহ হাদীস থেকে প্রমান দিচ্ছেন না ? তিনি কেন ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ) কে প্রমান হিসেবে উপস্থাপন করছেন, তাও আবার নিখাদ মিথ্যা কথা বলে ? নিজে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নিকট থেকে দলীল দাবি করবেন কুরআন এবং সহীহ হাদীস থেকে আর নিজে মনগড়া দলীল উপস্থাপন করবেন? দ্বিতীয়ত, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)ইয়াযিদ সম্পর্কে যে কথা বলেন নি তা তাঁর নামে চালিয়ে দিলেন আর তিনি যে স্বীয় ‘আল ইমতা বিল আরবাঈন’ গ্রন্থের শিরোনামই দিয়েছেন ’ইয়াযীদের প্রতি লা’নত’ এবং মন্তব্য করেছেন যে “ইয়াযীদকে ভক্তি ও তার প্রশংসা ’পথভ্রষ্ট-গোমরাহ’ ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই করে না, তা সম্পূর্ণ চেপে দিলেন ? উক্ত ইয়াজিদ-প্রেমিক ইহাও সম্পূর্ণ চেপে দিলেন যে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ)এর গ্রন্থে বর্নিত আছে যে, শারীয়াতের আদালতে ইয়াজিদের প্রশংসাকারীদের ন্যূনতম শাস্তি হল কুড়িবার দোররা [ ‘তাহযিবুত্ তাহযিব’- ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী – খন্ড নং ৬ – পৃষ্ঠা নং ৩১৩ ] ? মহান আল্লাহ পাক বলেন, “আর তোমরা হককে (সত্য) বাতিলের (মিথ্যা) সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে হককে গোপন করো না” [ আল কুরআন- সুরাহ বাকারাহ – আয়াত নং ৪২ ] ।