"সাক্ষাত করতে যাওয়ার আদাব"
--------------------------------
কার্টেসিঃ মাদ্রাসা আজাদভিল, দক্ষিণ আফ্রিকা।
অনুবাদঃ সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী
কুরআন মাজিদ নির্দেশ দিচ্ছে, "অতঃপর যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ কর, তখন তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এটা আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র দোয়া।" (সূরা নুর, আয়াত নং-৬১)
অতিথি হয়ে আসলে আদাবসমূহঃ
-------------------------------------
১.কারো ঘরে অথবা কক্ষে অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ করবেন না। আপনার ওপর আবশ্যক যে তাদের অনুমতি প্রার্থনা করবেন।
২.অনুমতি প্রার্থনা করার ইসলামী শরিয়তের হুকুম হচ্ছে যে, একজন দরজার খুব কাছে দাঁড়াবে এবং দরজায় নক করবে এবং বলবে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমি কী ভেতরে আসতে পারি?
৩.যদি তার কোন প্রতিউত্তর না আসে তবে অনুরুপভাবে সালাম দিতে হবে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার। তৃতীয়বারের পর আপনি যদি প্রতিউত্তর না পান এবং আপনার যদি মনে হয় যে এটা সাক্ষাতের উপযুক্ত মূহুর্ত না, হতে পারে কোন যৌক্তিক কারণ আছে। তাই আপনি ফিরে আসুন এবং এজন্য মনে কিছু নেবেন না।
৪.যখন আপনি অনুমতি প্রার্থনা করবেন তখন যেকোন এক পার্শ্বে দাঁড়ান। এমনভাবে দাঁড়াবেন না যেন ভেতরের সব দেখা যায়। যাইহোক, যদি মেজবান আপনার সামনেই হয় তবে সালাম দিন ও অনুমতি প্রার্থনা করুন।
৫.এটা একদম অনুচিত যে আপনি ভেতরে উঁকি দেবেন। হুজুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা নিষেধ করেছেন শক্তভাবে।
৬.উচ্চ আওয়াজে সালাম দিন, এমনকি যখন আপনি আপনার ঘরে প্রবেশ করেন এবং আপনি আপনার উপস্থিতি ঘরের বাসিন্দাদের জানান দিন।
৭.যদি কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করে, "কে?" আপনার নাম বলুন। বলবেন না যে "আমি"। কারন ঘরের বাসিন্দা জানে না যে এই আমি কে?
৮.হুজুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন সাহাবিকে উপদেশ দিলেন যে, "আমার সাথে এসে একদিন পর পর দেখা কর (প্রতিদিন না) এতে আমাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধি পায়।"
৯. রাতের বেলা অথবা খাওয়ার সময় কারো সাক্ষাৎ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। আপনি যদি একান্ত বাধ্য হন এসব সময়ে কারো সংগে সাক্ষাৎ করতে যেতে, তাহলে আগে খেয়ে নিন পরে যান। যাইহোক আপনি যদি না খেয়ে গিয়েই থাকেন তবে মেজবানের কাছে মিথ্যা বলবেন না যে আপনি খেয়ে এসেছেন। হুজুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "ক্ষুধা ও মিথ্যা একসাথে নিয়ে উপস্থিত হইও না"। আপনি অন্য কোন অজুহাত দিতে পারেন।
১০.আপনি যদি অন্য কোন শহর বন্দরে কারো সাক্ষাতে যান তবে যাওয়ার আগে তাকে অবগত করুন।
১১. হুজুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শক্তভাবে নিষেধ করেছেন রাতের বেলা কারো ঘরে যেতে। এমনকি সে তার নিজের পরিবারকে অবগত না করে নিজের ঘরেও ফিরতে নিষেধ করেছেন।
১২. যখন আপনি কারো ঘরে প্রবেশ করবেন তখন সালাম দিয়ে প্রবেশ করুন। ঘরের বাসিন্দার প্রথমে এগিয়ে আসা উচিত মুসাফাহা বা মুয়ানাকা করার জন্য। যদি ঘরের মেজবান কোন কারনে এগিয়ে না আসে বা ব্যস্ত হয় তবে তাকে বিরক্ত করবেন না।
১৩. যখন আপনি কোথাও যাবেন আর সেখানে পড়ানো হচ্ছে বা নসিহত চলছে তখন সালাম দেবেন না। ঠিক একইভাবে আপনি যখন মসজিদে প্রবেশ করবেন তখন সালাম দেবেন না যদি মানুষ নামাজ অথবা অন্য কোনপ্রকার জিকিরে ব্যস্ত থাকে। তবে যদি কেউ আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তবে আপনি তাকে সালাম দিন।
১৪. আপনি যখন কারো ঘরে প্রবেশ করবেন তখন সবচাইতে ভাল আসনটিতে বসবেন না, ঘরের মালিকের জন্য নির্ধারিত আসনেও বসবেন না। এটা নির্ভর করে ঘরের মালিকের ওপর যে সে আপনাকে তার আসনে বসাবে নাকি অন্য কোন জায়গায় বসাবে।
১৫.কুরআন মাজিদ এই নির্দেশ দেয় সকল নারী ও পুরুষকে তাদের দৃষ্টি অবনত রাখতে। এই বিষয়ে সবসময় সতর্ক থাকুন। যখন আপনি কারো ঘরে যান তখন চারদিকে তাকাবেন না।
১৬. হুজুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নরম মেজাজের ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন হতে বলেছেন। এই উপদেশ সদা মাথায় রাখুন। আপনি যদি কোথাও যান তবে নম্রভাবে কথা বলুন এবং সম্মান দিয়ে কথা বলুন। অনুমতি ছাড়া কোনকিছু স্পর্শ করবেন না। কোনকিছুর দিকে লোভাতুরভাবে তাকাবেন না যেন মনে হয় যে আপনি খুবই মুগ্ধ এটার ওপর এবং চকিত নয়নে মেজবানের জাকজমকের দিকে তাকাবেন না, যার ফলশ্রুতিতে আপনি হীনমন্যতায় ভোগবেন।
১৭.দীর্ঘসময় বসবেন না, অথবা দীর্ঘসময় কথা বলবেন না, আপনার কাজ শেষ হওয়া মাত্র অনুমতি নিজ ফিরে আসার জন্য। তবে মেজবানের অনুরোধে আপনি থাকতে পারেন আপনার যতক্ষণ ভাল লাগে।
আর যখন আপনার ঘরে কেউ আসবেঃ
-----------------------------------------------------
"আর তোমাদেরকে যদি কেউ দোয়া করে, তাহলে তোমরাও তার জন্য দোয়া কর; তারচেয়ে উত্তম দোয়া অথবা তারই মত ফিরিয়ে বল। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে হিসাব-নিকাশ গ্রহণকারী।"- সূরা নিসা, আয়াত নং ৮৬
যখন কেউ আপনার ঘরে বেড়াতে আসে তখন আপনি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকেন তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে। হুজুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, "মুমিন হচ্ছে সে যে তার মেহমানের সম্মান করে এবং আতিথেয়তা করে।"
মেজবানের আদাবসমূহঃ
-------------------------------------
১. এটা আবশ্যক যে, কেউ যদি আপনাকে সালাম দেয় তাহলে আপনি সালামের জবাব দেবেন। কুরআন মাজিদের আদেশ যে আপনি আরো সুন্দর ভাষায় প্রতিউত্তর দেবেন, আরো সংস্কৃতবান, আরো শক্তিশালী ভাষা হবে যিনি সালাম দিয়েছেন তার থেকে। উদাহরণ স্বরুপঃ কেউ যদি বলে "আসসালামু আলাইকুম" আপনি "ওয়ালাইকুমুস সালাম" এর সাথে "ওয়া রাহমাতুল্লাহ" যোগ করে উত্তর দিন।
২.এই শব্দগুলো যোগ করা যায় সালাম অথবা তার জবাবের সাথে। "ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহু ওয়া মাগফিরাতুহ"। হুজুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিটি বাড়তি শব্দের জন্য আরো দশটি করে নেকির ওয়াদা করেছেন।
৩.আপনি যখন স্বাগত জানাবেন তখন উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানান। মুসাফাহা করুন যদি অনেক দিন পর দেখা হয়। আলিংগন করুন। অতঃপর বসুন তার সাথে সম্মানের সাথে।
৪. কোন অভদ্রের অভদ্রতা আপনার প্রতি অবশ্যই বাজে বিষয় যখন সে আপনার ঘরে আসে, নীতি বলে যে আপনি ভদ্রতার সাথে তা মুকাবেলা করবেন। বদমেজাজীর আচরণ করবেন না। তাদের সাথে আনন্দঘন ব্যবহার করুন। রুচিসম্মত ও সম্মান দিয়ে আচরণ করুন।
৫.আরবদের খুব আকর্ষণীয় একটা বাক্য আছে যা দিয়ে তারা অতিথিদের স্বাগত জানায়, আহলান সাহলান ওয়া মারহাবান। যার মর্মার্থ দাঁড়ায় আপনি নিজের ঘর মনে করুন, আপনি যা চান সব পাবেন এবং আপনাকে স্বাগতম।
৬.স্বাগত জানাতে আপনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিন। আপনি তাদের প্রয়োজন তখনকার আবহাওয়া অনুযায়ী বুঝার চেষ্টা করুন ইত্যাদি। চেষ্টা করুন তাদের প্রয়োজন মেটাতে এমনকি তারা চাওয়ার আগেই।
৭.তাদের খাদ্যাভ্যাস, নাশতা ও গোসলের অভ্যাস জেনে নিতে চেষ্টা করুন। তার শখ ও অভ্যাস অনুযায়ী খাদ্য প্রস্তুত করুন। এটা তার জন্য আরামদায়ক হবে এবং আপনার জন্য অশেষ সওয়াব বয়ে আনবে ইন শা আল্লাহ।
৮.বিদায়ের সময় অতিথির সাথে কিছু দূর হাটুন এবং বিদায় জানান। তাকে আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে দিন, আপনি তাকে আগে বিদায় দেওয়ার চাইতে।
৯.আপনার কাছে যদি কিছু পথখরচ থাকে তবে তা অফার করুন অতিথিকে।
১০.যখনই কেউ হুজুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার কাছ থেকে বিদায় নিত তিনি ঐ ব্যক্তির হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিতেন ভালবাসা ও মায়া থেকে এবং তিনি ঐ ব্যক্তির হাত নিজের হাতে ধরে রাখতেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না সেই ব্যক্তি তার হাত ছাড়িয়ে নেন। যখন কাউকে বিদায় দিতেন তখন তিনি পড়তেন, "আস্তাওদিউ'ল্লাহা দিনাকা আমানাতাকা ওয়া খাওয়াতিমা আমালিক"। "আমি আল্লাহর কাছে সপে দিলাম আপনার দ্বীন, আপনার আমানত এবং আপনার শেষ আমলসমূহকে।"