বিদায় হজ্জের ঘটনার সূত্রপাতঃ শেষ পর্বঃ

দশম হিজরীর অধিকাংশ সময় নবী করীম
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) বিভিন্ন স্থানে প্রচারক পাঠাতে এবং বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিদেরকে গ্রহণ করতে ব্যস্ত রইলেন। অনুগত দেশ ও গোত্রের নিকট হতে কর আদায়ের ব্যবস্থাও তিনি করলেন। এভাবে দশম হিজরী শেষ হয়ে এলো, আবার হজ্জের সময় এসে পড়ল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) এবার হজ্জ করতে যাবেন বলে নিয়ত করলেন। জিলকদ মাসের শেষেই নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) এ অভিপ্রায়ের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দেয়া হল। সাথে সাথে একটা তুমুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হল। দলে দলে মুসলমানরা হযরতের সাথে হজ্জ করার মানসে মক্কায় যাবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) এবার পরিবার বর্গদেরও সাথে নিয়ে চললেন। এই হজ্জ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর জীবনে শেষ হজ্জ। কাজেই তা 'বিদায় হজ্জ' নামে পরিচিত।

জিলকদের ২৫ তারিখ অসংখ্য নর-নারীর,  মহাসমারোহে যাত্রা করলেন। একত্ব ও সাম্যের সে কি মহনীয় চিত্র। (আল্লাহু আকবর)। ধনী-দরিদ্র আমীর-গোলাম সকলেই আজ সমান, সকলেরই আজ একই পোষক, একই বাণী, একই স্বপ্ন, একই আশা, একই ধ্যান, একই ধারণা, একই লক্ষ্য, একই বাসানা।
পথে অনেক মুসলামান এ হজ্জে যোগদান করলেন। প্রায় দু'লক্ষ মুসলমান সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) জিলহজ্জ মাসের পাঁচ তারিখ মক্কা  শরীফ উপনীত হলেন। (মদীনা থেকে)। কা'বা ঘর দেখে নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) দু'হাত তুলে দোয়া মুনাজাত করলেন। ইয়া আল্লাহ! এ গৃহকে চিরকল্যাণ ও চির মহিয়ান কর এবং যারাই এখানে হজ্জ করতে আসেবে তাদের সুখ শান্তি ও মান মর্যাদা বৃদ্ধি কর।

অতঃপর সাহাবীদেরকে নিয়ে সাতবার কাবাঘর তওয়াফ করেন। এভাবে আনুসঙ্গিক কাজকর্ম করতে করতে হজ্জের দিন এল। লক্ষ লক্ষ মুসলমানের "লাব্বাইক" ধ্বনিতে কাবা প্রাঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠল। এত দিন আল্লাহ ও তাঁর দ্বীন যেখানে নির্বাসিত হয়েছিল। আজ সেখানেই উঠেছে আল্লাহর গুণগান, সেখানেই দেখছি মুসলমান, সেখানেই উড়ছে ইসলামের বিজয়ী নিশান। তওয়াফ শেষ করে চললেন আরাফাতের দিকে। আরাফাতের ময়দানে উপস্থিতি হয়ে বিশাল জনতার সম্মুখে যে মুবারক ভাষাণ (খোতবা) দিয়েছিলেন 'বিদায় হজ্জের ভাষণ' নামে বিশ্বখ্যাত।

মুবারক খোতবা শেষে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর মুখমণ্ডল জ্যোতি-দীপ্তে হয়ে উঠেছিল।
কণ্ঠস্বর ক্রমেই করুণ ও ভাবগাম্ভীর হয়ে এলো। ঊর্ধ্ব আকাশের দিকে মুবারক মুখ তুলে তিনি বলতে লাগলেনঃ হে আল্লাহ! হে আমার প্রভু! আমি কি তোমার বাণী  পৌছে দিতে পারলাম? আমি কী আমার কর্তব্য সম্পাদন করতে পেরেছি? লক্ষ কণ্ঠে ধ্বনিত হল, নিশ্চিয়! নিশ্চিয়! তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) কাতরকণ্ঠে পুনরায় বলতে লাগলেনঃ হে আল্লাহ! সাক্ষী থাক, এরা বলেছে আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি।" ভাবের আতিশয্যে নবী করীম
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) নীরব হয়ে রইলেন। জান্নাতের নূর মুবারক মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আর এ সময় কোরআনের শেষ আয়াত নাযিল হল- الۡيَوۡمَ اَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِيۡنَكُمۡ وَاَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِىۡ وَرَضِيۡتُ لَكُمُ الۡاِسۡلَامَ دِيۡنًا*
আজ আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে সম্পূর্ণ করলাম, তোমাদের উপর আমার নেয়ামত পূর্ণ করে দিলাম, আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়েদাঃ ৩)
নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) কতক্ষণ মোরাকাবামগ্ন রইলেন। বিশাল জনতা তখন নীরব। কিছুক্ষণ পরে তিনি মূবারক নয়ন মেলে করুণ স্নেহ মাখা দৃষ্টিতে সেই জন সমুদ্রের প্রতি তাকিয়ে বললেনঃ বিদায়! বন্ধুরা বিদায়!! এতে একটা অজানা বিয়োগ-বেদনা সবাইর হৃদয়ে ছায়াপাত করে গেল।

রফিকে আলার সাথে মিলনঃ
(৬৩৪ খৃঃ/ ১১ শ হিঃ/ বয়স মুবারক ৬৩ বছর)

বিদায় হজ্জের পর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)- যেন কেমন আনমনা হয়ে পড়লেন। এ সময় একাদশ হিজরী সফর মাস। হযরতের বয়স ৬৩ বছর। আরাফাতের ময়াদানে শেষ আয়াত যেদিন নাযিল হল, সে দিনই তিনি বুঝতে পারছিলেন নবীজীর কাজ ফুরিয়েছে; শীর্ঘই এখানে হতে পর্দা করতে হবে।
এ মহা প্রস্থানের মহা মূহুর্ত নবীজীর জীবনে কখন ঘনাবে তাও তিনি জানতেন। আল্লাহ তা'আলা পূর্বেই ছোট একটা সূরার মাধ্যমে তা বলে দিয়েছেন।
اِذَا جَآءَ نَصۡرُ اللّٰهِ وَالۡفَتۡحُۙ‏ وَرَاَيۡتَ النَّاسَ يَدۡخُلُوۡنَ فِىۡ دِيۡنِ اللّٰهِ اَفۡوَاجًاۙ‏
যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং আপনি দলে দলে লোকদেরকে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন।
(সূরা আন নসর)
Top