মুখবন্ধ

আন্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া প্রকাশিত এ পবিত্র ‘শাজরা শরীফ’ সিলসিলায়ে কাদেরিয়া আলিয়াভুক্ত আমাদের সকল পীর ভাই - বোনের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় নির্দেশিকা। সুতরাং সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই এর একটি কপি হাতে রাখা এবং এতে প্রদত্ত নির্দেশানুসারে আমল করা অত্যন্ত জরুরী। এ ‘শাজরা শরীফে’ হুযূর ক্বিবলা নির্দেশিত সিলসিলার (ত্বরীক্বতের) সবক, খতমে গাউসিয়া, গেয়ারভী ও বারভী শরীফের নিয়মাবলীসহ কোরআন ও হাদিস সমর্থিত অযীফা-দো’য়া সংক্ষেপে বিন্যাস করা হয়েছে। এমন কি কাদেরিয়া ত্বরীক্বার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির তাত্ত্বিক বর্ণনাও বিদ্যমান। পীর ভাই-বোনদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সাথে সাথে হুযূর ক্বিবলা মাদ্দাজিল্লুহুল্ আলী প্রদত্ত সবক্ব যথাযথ আদায় করা অবশ্য কর্তব্য। তাই ত্বরীক্বার সবক্ব বিশুদ্ধভাবে আদায়ের লক্ষ্যে ‘শাজরা শরীফের’ সহায়তা নেওয়া অপরিহার্য। সবক্ব ছাড়াও এতে কাদেরিয়া ত্বরীক্বার অতীব মহামূল্যবান কিছু।নিয়মিত কার্যক্রম যেমন-খত্মে গাউসিয়া শরীফ, খত্মে গেয়ারভী শরীফ ইত্যাদি আদায়ের নিয়ম ও পঠিতব্য ‘তস্বীহ’সমূহ বাংলা উচ্চারণসহ সুচারুরূপে উল্লিখিত আছে। পীর ভাই-বোনদের উচিত এ পবিত্র শাজরা শরীফ।অনুসরণের মাধ্যমে এসব তস্বীহ, ক্বাসিদা শরীফ, শাজরা শরীফ, না’ত শরীফ ও মিলাদ শরীফ ইত্যাদি মুখস্থ করে রাখা, যাতে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে অপরাপর পীর ভাইদের নিয়ে নিজেই উল্লিখিত খতমে গাউসিয়া, গেয়ারভী ও বারভী শরীফসহ মিলাদ শরীফের মতো সিল্সিলার নিত্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পাদন করতে পারেন।

আমাদের মাশায়েখ হযরাতের নামে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসা, সিলসিলার ‘খান্ক্বাহ্ শরীফ’ ও বিখ্যাত দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ রয়েছে। সকলের উচিত নিকটস্থ এসব মাদ্রাসা ও খান্ক্বাহ্ শরীফের খিদমতে আন্তরিকভাবে আত্মনিয়োগ করা। বিশেষতঃ চট্টগ্রামের ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া’ ও ঢাকা মুহাম্মদপুরের ‘কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া’ ও দেশের শরীয়ত তথা সুন্নিয়তের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত। এসব মাদ্রাসার সাথে সার্বিক যোগাযোগ রাখা আমাদের সকলের ঈমানী কর্তব্য। এ মাদ্রাসা দু’টির সাথে ত্বরীক্বতের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত দু’টি খান্ক্বাহ্ শরীফ’ চট্টগ্রাম (ষোলশহরস্থ আলমগীর খানকা-ই কাদেরীয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া) ও ঢাকা জেলাসহ বিভিন্ন স্থানে রয়েছে আমাদের আরো অনেক খানকাহ শরীফ, যেখানে নিয়মিত গেয়ারভী শরীফ, গাউসিয়া শরীফসহ হযরাতে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বীনের সকল ওরস মোবারক অনুষ্ঠিত হয়। এই সকল পবিত্র বরকতময় অনুষ্ঠানে শারীরিক, আর্থিক ও সার্বিক সহযোগিতা করা আপনার-আমার ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য।

উলে­খ্য, গাউসে জামান হযরতুলহাজ্ব আল্লামা হাফেজ, ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি উনার মোবারক মহব্বত নামায় (চিঠি) আলমগীর খানকাহ শরীফ সম্পর্কে ফরমাইয়াছেন - ‘‘ইয়ে খানকাহ আল্লাহ তাবারকা ওয়া তায়া’লা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মুহাব্বত ও কুর্ব্ হাছেল করনেকে আড্ডে হেঁ, আউর আউলিয়ায়ে কেরাম রাহমাতুল্লাহে আলাইহিম আজমাঈনকে Address ও Center হেঁ। জিন জিন ভাইয়েঁনে উছেমে হিচ্ছা লিয়া হায়, কোশিশিক হায়, রক্বম দিয়া হায়, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়া’লা কবুল ফরমায়ে। ইয়ে ছাদকায়ে জারিয়া তা কিয়ামত রহেগা ইনশাআল্লাহ।’’

বস্তুত কাদেরিয়া ত্ববরীক্বার পীর ভাই - বোন ‘শাজরা শরীফ’ সংশি­ষ্ট বিষয়াদির উপর পূর্ণাঙ্গ অবগত হওয়ার। একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো এ প্রকাশনা।

পীর ভাই-বোনদের জন্য অতি আনন্দের বিষয় যে, শাজরা শরীফের এবারের সংশোধিত সংস্করণটি শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শ অনুসারে আরো নতুন আঙ্গিকে বর্ণাঢ্য কলেবরে ও সুন্দর সজ্জায় বিন্যাস করা হয়েছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো ‘কাদেরিয়া সিল্সিলার পীর মাশায়েখ পরিচিতি’ নামে সংযোজিত নতুন অধ্যায়টি, এতে সংক্ষেপে আমাদের হুযূর ক্বিবলার জীবনাদর্শ পরিস্ফুটিত হয়েছে। পীর ভাই-বোনেরা এ শাজরা শরীফের প্রত্যেকটি অধ্যায় নিয়মিত পাঠ ও হৃদয়ঙ্গম করে শরীয়ত-ত্বরীক্বতের কাজে আত্মনিয়োগ করলে আমাদের এ প্রয়াস সার্থক হবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে মাশায়েখে কেরামের নেক নজর লাভের তৌফিক দিন।

আলহাজ্ব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন
সেক্রেটারি জেনারেল

➖➖➖➖➖➖
শাহেন শাহে বাগদাদ গাউসুল আ‘জম আবদুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রবর্তিত ত্বরীক্বার নামই সিল্সিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়া। এ পৃথিবীতে পূর্বাপর সকল অলি আল্লাহর উপর গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজনস্বীকৃত। গাউসুল আ‘জম জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু স্বয়ং তাঁর ক্বসীদায়ে গাউসিয়ায় বলেন, “ওয়া কুল্লু অলিয়্যিন্ আলা ক্বদামিওঁ ওয়া ইন্নী, আলা ক্বদামিন্ নবী বাদ্রিল্ কামালী” অর্থাৎ, সকল অলি আল্লাহর কাঁধের উপর আমার ক্বদম্ আর আমার কাঁধের উপর পূর্ণচন্দ্র নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্বদম্ মোবারক। গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-র ঘোষণাকে সে সময়ের সকল আউলিয়ায়ে কেরাম শ্রদ্ধাভরে নতশিরে গ্রহণ করেন এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেন। এমন অলিকুল সম্রাট প্রবর্তিত এ সিল্সিলাহ্ও সঙ্গত কারণে এক শ্রেষ্ঠ ত্বরীক্বা নিঃসন্দেহে। এ ত্বরীক্বা বর্তমানে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ঈমানদার মুসলমানদের মাঝে বিস্তৃতি লাভ করেছে- গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-র খলিফা বা আধ্যাত্মিক প্রতিনিধি পরম্পরায়। এভাবে এ মহান ত্বরীক্বার একটি ধারা পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, হরিপুর জেলার চৌহর শরীফ ও সিরিকোট শরীফ হয়ে আমাদের এ দেশ পর্যন্ত এসে পৌঁছে। একেই আমরা ‘সিল্সিলায়ে কাদেরিয়া আলিয়া’ বলে অভিহিত করছি। চৌহর শরীফের গাউসে দাওঁরা খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এবং সিরিকোট শরীফের গাউসে জামান হযরতুল্ আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হলেন সৌভাগ্যবান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদ্বয়, যাঁরা গাউসুল আ‘জম আবদুল ক্বাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর ত্বরীক্বার মহান প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে আল্লাহর এ মহান রহমতের স্রোতে এ উপমহাদেশের মানুষকেও সিক্ত করেছেন। হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন খ্যাতিমান বুযুর্গ যিনি মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর পিতা গাউসে জামান হযরত ফকির খিজিরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এবং তাঁর পীর ক্বাদেরিয়া ত্বরীক্বার মহান খলিফা হযরত শাহ্ মুহাম্মদ এয়াকুব রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র ফুয়ূজাত ও খেলাফত হাসিল করে শরীয়ত-ত্বরীক্বতের এক বেমেসাল খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন। কৈশোরের প্রথম জীবনে শুধু কোরআন শরীফের তেলাওয়াত ছাড়া অন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন না করেও খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিই ওই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী, অদ্বিতীয় আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব যিনি ৩০ পারা কোরআনে করীম ও ৩০ পারা হাদীসগ্রন্থ বুখারী শরীফের পর- তৃতীয় একটি ৩০ পারা বিশাল দরূদ গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম “মজ্মুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম”। প্রতি পারা ৪৮ পৃষ্ঠাবিশিষ্ট সর্বমোট ১৪৪০ পৃষ্ঠার এ বিশাল দরূদ গ্রন্থে কোরআনে করীমের মতো সর্বমোট ৬,৬৬৬ টি দরূদ শরীফ সন্নিবেশ করা হয়েছে। যে দরূদগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি কোরআন, হাদীস, উসূল, ফিক্বাহ্, তাসাউফ্ ও আক্বিদার আলোকে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামগ্রিক জীবনদর্শন ও মর্যাদা অত্যন্ত উন্নত আরবী ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তাছাড়া প্রতিটি পারায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে নির্ধারিত ভিন্ন ভিন্ন গুণাবলীর সুন্দর সমাহার। এটা এক উম্মী অলি খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর অসংখ্য কারামতের একটি। আর এ মহান অলিআল্লাহর প্রধান খলিফা ছিলেন গাউসে জামান আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আল-ক্বাদেরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি।

হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধর। তাঁর বংশ শাজরা অনুসারে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রথম, হযরত মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হাকে দ্বিতীয়, হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হুকে তৃতীয় এবং ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হুকে চতুর্থ ধরে ২৫ তম স্তরে হযরত সৈয়্যদ গফুর শাহ ওরফে কার্পু শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ও ৩৯তম স্তরে হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর নাম পাওয়া যায়। নবী বংশের অন্যান্য সদস্য তথা আহ্লে বায়তের মতো তাঁর পূর্বপুরুষ ২৫তম আওলাদে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত গফুর শাহ্ ওরফে কাপুর শাহ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিই সর্বপ্রথম দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বর্তমান সিরিকোট অঞ্চলে আসেন এবং বিজয়ী হন। এজন্য তাঁকে ফাতেহ্ সিরিকোট বা সিরিকোট বিজয়ী বলা হয়।
(সূত্রঃ Local Govet. Act, Ref - 15, Hazra 1871, Pakistan)

এভাবে সিরিকোট শরীফে বসবাসকারী আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ৩৮তম বুজুর্গ হযরত সৈয়্যদ সদর শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর ঔরসেই ঊনবিংশ শতাব্দির ষাটের দশকে জন্মগ্রহণ করেন গাউসে জামান, পেশোয়ায়ে আহলে সুন্নাত হযরতুল্ আল্লামা সৈয়্যদ আহ্মদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। অতি অল্প বয়সে কোরআনে হাফেজ হয়ে তিনি ক্বোরআন-হাদীস ফিকাহসহ বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর সুদূর আফ্রিকা সফর করেন। সেখানে অতি অল্প সময়েই তিনি ব্যবসা ও ইসলাম প্রচারে খ্যাতি লাভ করেন। তৎকালীন পাক্ ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে তিনি ‘আফ্রিকাওয়ালা’ নামেও খ্যাত ছিলেন। ব্যবসার চেয়েও তিনি আফ্রিকায় ইসলাম প্রচারে বিরাট অবদান রাখেন। তৎকালীন ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে হুজূর ক্বিবলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে ইসলামের প্রচার প্রসার ঘটে। তাঁর হাতে সেখানকার অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। এসময় পারস্য (ইরান) থেকেও একদল ধর্ম প্রচারক দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছিলেন যারা সেখানে ভ্রান্ত মতবাদ (শিয়া) প্রচারের চেষ্টা চালায়। অবশ্য, হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে শিয়ারা ব্যর্থ হয় এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় সুন্নি মতাদর্শ ও হানাফী মায্হাবের বিস্তৃতি ঘটে।
(সূত্রঃ A short History of Muslims in south Africa, By - Dr . Ibrahim M . Mahdi)

উক্ত ইতিহাস গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ভারতীয় ব্যবসায়ী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ পেশোয়ারীর (সিরিকোটি) অক্লান্ত পরিশ্রমে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপটাউন বন্দরে আফ্রিকার নব দীক্ষিত মুসলমানদের জন্য সর্বপ্রথম প্রার্থনা গৃহ-জামে মসজিদ নির্মিত হয় ১৯১১ সালে।
(সূত্রঃ A short History of Muslims in south Africa, By - Dr . Ibrahim M . Mahdi)

এরপর ১৯১২ সালে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন এবং তাঁর পীর খাজা চৌহরভীর দরবারে শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের এক বে-মেসাল খিদমত আনজাম দেন। পীরের লঙ্গরখানার জন্য লাকড়ির সমস্যা দেখা দেওয়ায় হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি সিরিকোটের পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে প্রায় ১১ মাইল দূরের চৌহর শরীফে নিজ কাঁধে করে দিয়ে আসতেন। এভাবে কোন বিরতি ছাড়া বহু বছর এ কঠিন দায়িত্বটি পালন করেন। একজন খ্যাতনামা ব্যবসায়ী, আলেম, হাফেজ, ক্বারী, অধিকন্তু নবী বংশের মর্যাদা সবকিছু ভুলে তিনি নিজের আমিত্ব বিনাশের এ কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজ মুরশিদের মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টি অর্জন করেন এবং ত্বরীক্বতের আসল পুরস্কার বেলায়ত ও খেলাফত লাভে ধন্য হন। খাজা চৌহরভী হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র ওফাতের তিন বৎসর পূর্বে ১৯২০ সালে হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি পীরের নির্দেশে বার্মার (মায়ানমার) রেঙ্গুন শহরে চলে আসেন এবং দু’যুগের বেশি অবস্থান করে শরীয়ত-ত্বরীক্বতের বিশাল দায়িত্ব পালন করেন। রেঙ্গুনে তিনি বিশেষত বিখ্যাত বাঙালী মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর আধ্যাত্মিকতার আকর্ষণে মসজিদের অনেক মুসল্লি তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেন এবং ক্রমান্বয়ে শ্রদ্ধাভরে তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ শুরু করেন। এ থেকে শুরু হয় তাঁর খেদমতে খল্ক্বের জীবনধারা। শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের পথ নির্দেশনায় কামালিয়াত ও মা’রিফাতের পবিত্র আলোকধারায় বুলন্দ (উঁচু) স্তরে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করেন। অসংখ্য স্থানীয় মানুষকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং স্থানীয় ও প্রবাসী মুসলমানদের কাদেরিয়া ত্বরীক্বায় বাইয়াত করান। চট্টগ্রামে সংবাদপত্র শিল্পের পথিকৃৎ, ‘দৈনিক আজাদী’ প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারসহ অনেক চট্টগ্রামবাসী এ সময় তাঁর (সিরিকোটি) হাতে মুরিদ হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

সিরিকোটি (রঃ) তদানীন্তন রেঙ্গুন হতে সিরিকোট এবং সিরিকোট হতে রেঙ্গুন যাতায়াত করতেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে ডিসেম্বর ১৯৪১ ইংরেজি চট্টগ্রামের মুরিদদের সাথে চিরতরে বার্মা (মায়ানমার) ত্যাগ করে চলে আসেন এবং সিরিকোট শরীফ-বাড়িতে অবস্থান করেন। বার্মা ফেরত তাঁর চট্টগ্রামবাসী মুরিদদের অনুরোধে পরবর্তীতে চট্টগ্রাম আসেন এবং আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসের উপর তলায় অবস্থান করে সিল্সিলার কাজ শুরু করেন। তারপর হতে প্রতি বৎসরই ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত শীতকালে তিনি চট্টগ্রামে আসতেন। মাসাধিককাল অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন গ্রাম-থানার ভাই-বোনদের একান্ত আন্তরিক আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জায়গায় সফর করে হক্ব সিল্সিলার প্রচার-প্রসার ও সিল্সিলাভুক্ত করে তাদের দোজাহানের কামিয়াবীর পথ নির্দেশনা দিতেন। আন্দরকিল্লায় তিনি কোহিনুর ইলেক্ট্রিক প্রেসের দোতলা থেকে সিল্সিলায়ে কাদেরিয়া আলিয়া ও আহলে সুন্নাত ওয়াল্ জামাতের প্রচার-প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র আগমন সংবাদ চট্টগ্রামে দারুন উৎসাহ সৃষ্টি করে এবং লক্ষাধিক মানুষ তাঁর হাতে মুরিদ হয়ে ধন্য হন। হুজুর ক্বিব্লা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ১৯২৫ সালে বার্মার রেঙ্গুনে অবস্থানকালে মায্হাব্ ও মিল্লাতের কর্মকাণ্ড পরিচালনার্থে আন্জুমান-এ-শুরায়ে রহমানিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম এসে এ সংগঠনকে পরিবর্ধিত করে আন্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া নামে নামকরণ করেন। যা আজ শুধু বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বে সুন্নী মুসলমানদের অন্যতম নির্ভরযোগ্য দ্বীনি কল্যাণ ট্রাস্ট হিসেবে স্বীকৃত। এ সময় তিনি নিয়মিত ঢাকা হয়েই চট্টগ্রাম আসতেন এবং ঢাকায়ও কিছুদিন অবস্থান করে কাদেরিয়া ত্বরীক্বার দায়িত্ব পালন করতেন। ঢাকার কায়েৎটুলীস্থ খান্ক্বাহ্-এ কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া এখনো তাঁর সে সময়ের স্মৃতি বহন করছে। চট্টগ্রামে অবস্থানকালে হুজূর ক্বিব্লা প্রত্যন্ত অঞ্চলের ওয়াজ মাহফিলেও অংশ গ্রহণ করতেন। এরূপ ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে মাওলানা এজহার সাহেবের উদ্যোগে ওয়াজ মাহফিলের দাওয়াতে তিনি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার শেখেরখীল নামক গ্রাম সফর করেন। মাহফিলে হুজূর ক্বিবলা প্রচলিত নিয়মানুযায়ী তক্বরীরের প্রারম্ভে কোরআনে করীমের আয়াত ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লূনা আলান্ নবী ইয়া আইয়্যুহাল্ লাযীনা আ-মানূ সাল্লূ আলাইহি ওয়াসাল্লিমূ তাস্লীমা-পাঠ করেন এ উদ্দেশ্যে যে, সমবেত শ্রোতাগণ নবীজির উপর দরূদ-সালাম পড়বেন। কিন্তু দেখা গেল ঘটনা বিপরীত। সমবেত কেউ দরূদ পড়লোনা। আশেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আওলাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুজূর ক্বিব্লা সে ঘটনায় এতো বেশী মর্মাহত ও রাগান্বিত হয়েছিলেন যে, তিনি সে রাতে এবং পরদিন পর্যন্ত কোন পানাহার করেননি। চট্টগ্রাম এসেই পীরভাইদের ডাকলেন এবং দ্বীনের এ দুশমনদের বিরুদ্ধে আদর্শিক প্রতিরোধের আহবান করেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, “ইহাঁ এক মাদ্রাসা হোনা চাহিয়ে।” অর্থাৎ এখানে একটি মাদ্রাসা হওয়া প্রয়োজন। কেমন পরিবেশে মাদ্রাসা হবে তার বর্ণনা দিয়ে বলেন- “এয়সা জাগাহ্ হো, গাঁও ভী নেহীঁ, শহরছে দূর ভী নেহীঁ, মসজিদ হো; তালাব হো, আ-নে যা-নে মেঁ তাক্লীফ না হো’’ অর্থাৎ এমন জায়গা হবে গ্রামও নয় শহর থেকে দূরেও নয়, মসজিদ হবে, পুকুর হবে, আসা-যাওয়ায় কষ্ট হবেনা।’’ তৎকালীন পীরভাইয়েরা কুতুবুল আউলিয়া সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি‘র পছন্দ অনুযায়ী চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে অনেক খোঁজাখুঁজি করে বেশ কিছু জায়গা হুজূর কেবলাকে দেখান। অবশেষে শাহেনশাহে সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি‘কে মরহুম আলহাজ্ব নূরুল ইসলাম সওদাগর আলক্বাদেরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ষোলশহরস্থ নাজিরপাড়ায় বর্তমান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া (মাদ্রাসা)‘র স্থানটি দেখান। কুতুবুল আউলিয়া জায়গাটি দেখার সাথে সাথে অত্যন্ত সন্তুষ্ট চিত্তে বলেন- ‘হাঁ, ইয়েহি হ্যায়’ অর্থাৎ হ্যাঁ এটিই। হুজূরের এই অভিব্যক্তি দেখে উপস্থিত মুরিদগণ বুঝতে পারলেন, এ জায়গাটিই হুজূর কেবলার পরম কাক্সিক্ষত। উল্লেখ্য, জায়গাটির মালিক ছিলেন- কমিশনার মুহাম্মদ কামাল উদ্দীন চৌধুরীর পিতা মরহুম হযরত উদ্দীন চৌধুরী। তিনি খুশী মনে জায়গা দেয়ার জন্য রাজী হলেন।

১৯৫৪ সালের এক শুভক্ষণে সে নির্ধারিত স্থানটিতে এশিয়া খ্যাত সুন্নী মতাদর্শের দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। যা আজো দুশমনে রাসূলদের বিরুদ্ধে আদর্শিক মোকাবেলায় কালজয়ী ভূমিকা পালন করছে। হুজূর ক্বিব্লা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ঘোষণা করেন যে, “ইয়ে জামেয়া কিস্তিয়ে নূহ্ হ্যায়” অর্থাৎ- এই জামেয়া হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম এর কিস্তি তুল্য। নিজ মুরিদদের উদ্দেশ করে আরো বলেন, “মুঝেহ্ দেখ্না হ্যায় তো মাদ্রাসা কো দেখো, মুঝ্ছে মুহাব্বত্ হ্যায় তো মাদ্রাসাকো মুহাব্বত্ করো” অর্থাৎ আমাকে দেখতে চাও তো মাদ্রাসা (জামেয়া)কে দেখ, আমার প্রতি মুহাব্বত থাকলে মাদ্রাসাকে মুহাব্বত কর। হুজূর ক্বিব্লা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র প্রেমিক ভক্তরা এ নির্দেশ যথাযথ পালন করছেন। কাজে জামেয়ার প্রতি মুহাব্বত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর প্রতি মুহাব্বতের নামান্তর- এটি আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

আজ হুজূর ক্বিব্লার ভক্ত মুরিদ ও আমাদের বর্তমান পীর ভাই বোনেরা জামেয়ার জন্য মান্নাত করে যে নগদ ফায়দা হাসিল করছে তা যেনো সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর মুহাব্বতেরই পুরস্কার। চট্টগ্রামের জামেয়া ছাড়াও তিনি তাঁর পীর খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের হরিপুর দারুল উলুম ইসলামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসা দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত পরিচালনা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

হুজূর ক্বিবলা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আসা যাওয়া করেন। ইতোমধ্যে ১৯৪৫ সালে এবং ১৯৫৮ সালে তিনি জাহাজযোগে হজ্বে যান। উল্লেখ্য ১৯৪৫ সনে হজ্বের সময় মদীনা মুনাওয়ারার তৎকালীন খাদেম মাওলানা সৈয়্যদ মনজুর আহমদ হুজূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন।

এ সময় শাহেনশাহে দো-আলম হুজূর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এক রহস্যময় বাতেনী নির্দেশ প্রাপ্ত হন যে, তিনি যেন পরবর্তী হজ্বে আসার সময় তাঁর বড় নাতি সাহেবজাদা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ মাদ্দাজিল্লুহুল আলী‘কে সাথে করে মদীনায়ে পাক নিয়ে আসেন এবং রাহমাতুল্লীল আলামীনের মোলাক্বাত্ করান। ১৯৫৮ সালেই তাঁর জীবনের সেই সুযোগটি আসে এবং হযরত তাহের শাহ্ ’মাদ্দাজিল্লুহুল্ আলী কে সাথে নিয়ে হজ্জ্বে বাইতুল্লাহ্ ও জেয়ারতে মদীনা মুনাওয়ারা সম্পন্ন করেন। এ সময় ময়দানে আরাফাতে ৯ যিল্হজ্ব হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর জ্যেষ্ঠ নাতি তরুণ হাজ্বী তাহের শাহ্ (মা.জি.আ.) কে নিজ হাতে বায়াত করিয়ে সিল্সিলাভুক্ত করেন এবং ছরকারে দো-আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম্ এর কাছে সোপর্দ করেন। তাঁর অসংখ্য কারামত ও আধ্যাত্মিক জীবনের ঘটনাবলী যা আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, রেঙ্গুন, বাংলাদেশ ও মক্কা-মদীনা শরীফে সংঘটিত হয়েছিল তার বিবরণ দেয়া এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। একবাক্যে শুধু এটাই বলা যায় যে, তিনি ছিলেন আউলিয়া সম্রাট তথা গাউসে জামান পদে আসীন। ইমামে আহ্লে সুন্নাত আল্লামা আজিজুল হক শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর ‘দীওয়ানে আজীজ’ গ্রন্থে সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি সম্পর্কে বলেন, “র্দ জমানশ্ নবী নম্ মিস্লে ও পীরে মঁগা” অর্থাৎ ওই জামানায় তাঁর (সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি) তুলনা হয় এমন উঁচু স্তরের পীর আমি পৃথিবীর কোথাও দেখিনি।
(সূত্র. দীওয়ানে আজীজ, কৃত: আল্লামা গাজী শেরে বাংলা (রা.) হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।)

১৩৮০ হিজরির (১৯৬১ ইংরেজি) ১০ যিলক্বদ, বৃহস্পতিবার হুজূর ক্বিব্লা শাহেনশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর শতোর্ধ্ব বছরের ইহজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান।

শাহেন শাহে সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর একমাত্র সাহেবজাদা মাতৃগর্ভের অলি গাউসে জামান হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ১৯১৬ সালে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ঐতিহাসিক দরবার সিরিকোট শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের পূর্বে সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এবং সৈয়্যদ বংশীয় বুজুর্গ আম্মাজান চৌহর শরীফে খাজা চৌহ্রভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র সান্নিধ্যে গেলে তিনি (চৌহ্রভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি) হঠাৎ করে হুজূরের শাহাদাত আঙ্গুলি ধরে নিজ (চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর) পিঠে ঘর্ষণ করতে করতে বলেন, “ইয়ে পাক্ চীজ্ তুম্নে লে লো” অর্থাৎ- এ পবিত্র জিনিসটি তুমি নিয়ে নাও। উল্লেখ্য, সিরিকোটি হুজূরের উক্ত সাহেবজাদা এরপরই জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর নাম রাখা হয় ‘তৈয়্যব্’। যার উর্দু অর্থ হয় ‘পাক্’ বাংলা অর্থ -‘পবিত্র’। সুতরাং ওই ঘটনা ছিল খাজা চৌহ্রভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি কর্তৃক সিরিকোটি হুজূরের ঘরে এক মহান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব গাউসে জামান তৈয়্যব্ শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র জন্মের সুসংবাদ। জন্মের পর থেকেই শিশু তৈয়্যব্ শাহ্’র মধ্যে নানা রকমের আধ্যাত্মিক আচরণ দেখা যায়।

একবার দু’বছরের শিশু তৈয়্যব্ শাহ্ তাঁর শ্রদ্ধেয় আম্মাজানের সাথে চৌহর শরীফ যান। চৌহ্রভী হুজূরের সাথে আলাপ চলছে এমন সময় শিশুসূলভ আচরণ হিসেবে তিনি মাতৃদুগ্ধ পান করতে উদ্যত হন। এ ঘটনা খাজা চৌহ্রভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র দৃষ্টিগোচর হলে তিনি বলেন, “তৈয়্যব্ তুম্ বড়া হো গেয়া, দুধ মাত্ পিউ।” অর্থাৎ- ‘তৈয়্যব’ তুমি বড় হয়ে গেছো এখন থেকে আর দুধ পান করবে না। এ উক্তি শুনা মাত্রই শিশু তৈয়্যব্ শাহ্ শান্ত হয়ে যান এবং সেদিন থেকে আর কোন দিন দুধ পান করেননি। এমন কি তাঁর আম্মাজান অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে দুধ পান করাতে ব্যর্থ হন। বরং এ সম্ভাবনাময় শিশুটি তাঁর আম্মাকে জবাব দিতেন, “বাজী-নে মানা’ কিয়া, দুধ নেহী পিয়োংগা” অর্থাৎ- দুধ খাবোনা কারণ বাজী (চৌহ্রভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি) নিষেধ করেছেন। হুজূর ক্বিব্লা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি মাত্র চার বছর বয়সে পিতা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি কে বলেছিলেন, “বাজী নামাজ মে আপ্ আল্লাহকো দেখ্তা হ্যায়, মুঝেহ্ ভি দেখ্না হ্যায়।” মাত্র সাত বছর বয়সে পিতার সাথে আজমীর শরীফ জেয়ারতের সময় খোদ্ খাজা গরীবে নেওয়ায মঈনুদ্দীন চিশ্তী(রাঃ)‘র সাথে তাঁর জাহেরী মোলাক্বাত ও কথোপকথন হয়। সুতরাং মাতৃগর্ভের এ অলী শৈশব থেকেই এক আধ্যাত্মিক সম্ভাবনাময় আচরণ করে আসছিলেন। অল্প বয়সে হেফ্জ শেষ করেন। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানার্জন করেন প্রখ্যাত হরিপুর রহমানিয়া মাদরাসা থেকে। কালক্রমে হুজূর ক্বিব্লা (রাঃ) শরীয়ত-ত্বরীক্বতের সুযোগ্য নেতৃত্বের যাবতীয় গুণাবলী অর্জন করেন।

১৯৫৮ সাল ছিলো তাঁর পিতা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর এদেশে আখেরি সফর। এ বছরও হুজূর ক্বিব্লা তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি চট্টগ্রামে আসেন। এ সফরেই চট্টগ্রামের রেয়াজুদ্দিন বাজারে মরহুম শেখ আফতাব উদ্দিন আহমদ সাহেবের দোকানে বৃহস্পতিবারের খত্মে গাউসিয়া শরীফ চলাকালে সময়ে হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি উপস্থিত পীরভাইদের সামনে সাহেবজাদা তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে খেলাফত প্রদান করেন এবং খলিফায়ে আ‘জম ঘোষণা করেন। ইতোমধ্যে সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বিভিন্ন প্রসঙ্গে তাঁর বিশিষ্ট মুরিদদের মধ্যে সাহেবজাদা-তৈয়্যব শাহ্’র আধ্যাত্মিক উচ্চ মর্যাদার কথা আলাপ করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, “তৈয়্যব্ মার্দাজাদ্ অলি হ্যাঁয়, তৈয়্যব্ কা মক্বাম্ বহুত্ উঁচা হ্যায়।” ১৯৫৬ সালে হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্ আম্মাজানকে সাথে নিয়ে হজ্বব্রত পালন করেন।

১৯৬১ ইংরেজি ১ শাওয়াল ১৩৮০ হিজরি ঈদুল্ ফিতরের দিন সকালে হুজূর সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি সাহেবজাদা তৈয়্যব শাহ্কে ঈদের জামাতে ইমামতির নির্দেশ দিলে তিনি বিস্মিত হন। কারণ, ইতোপূর্বে জুমা ও ঈদ জামাতের ইমামতি শুধু তাঁর আব্বা হুজূরই (সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি) করতেন। ১ শাওয়াল্ ঈদের জামাতে ইমামতির দায়িত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে হুজূর সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর সাহেবজাদার উপর অর্পিত বিশাল দ্বীনি নেতৃত্বের অভিষেক করান। ঈদের নামাজের পর থেকে অর্থাৎ ১ শাওয়াল্ থেকে ১০ যিল্ক্বদ্ রাত পর্যন্ত দীর্ঘ চল্লিশ দিন সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি একমাত্র লচ্ছি ছাড়া অন্য কোন প্রকারের খাদ্য গ্রহণ করেননি। বলতেন তাঁর চিরবিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এ চল্লিশ দিন তার একান্ত সান্নিধ্যে থাকেন হুজূর ক্বিব্লা তৈয়্যব্ শাহ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। প্রকৃতপক্ষে হুজূর সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হুজুর ক্বিবলা তৈয়্যব শাহ্।রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র হাতে গাউসিয়াতের মহান দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন-এ চল্লিশ দিনে। এভাবে চল্লিশতম দিবস ১০যিলক্বদ্ বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় হুজূর সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি জাহেরী হায়াতের ইতি টানেন এবং পরদিন ১১ যিলক্বদ্ জুমা দিবসে তাঁকে শায়িত করা হয়। হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র ওফাত শরীফের পরপরই তৈয়্যব্ শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হুজূরের চেহ্লাম মোবারকে যোগদানের জন্য চট্টগ্রাম আসেন এবং সিলসিলার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির ওফাতের পর এভাবে হুজূর ক্বিব্লা তৈয়্যব শাহ্ একই দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সফর শুরু করেন। এ সময় তিনি দেখলেন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় সুন্নী মতাদর্শভিত্তিক কোন দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই।

তাই পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার মতো ঢাকার ঐতিহাসিক মুহাম্মদপুরে ১৯৬৮ সনে কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যা বর্তমানে দেশের কেন্দ্রস্থল ঢাকায় সুন্নী মুসলমানদের একমাত্র ‘কামিল’ মাদ্রাসা। ইতোপূর্বে খান্ক্বাহ্ ও হুজুর ক্বিব্লা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর হুজরা শরীফ পরিবর্তন হয়ে প্রথমে ঘাটফরহাদবেগ আলহাজ্ব আবদুল জলিল চৌধুরীর ভবন ও পরে বলুয়ারদীঘি পাড়ের আল্হাজ্ব নূর মুহাম্মদ আল্ কাদেরীর ভবনে ২য় ও ৩য় তলায় স্থানান্তরিত হয়। মূলত বলুয়ারদীঘি পাড় খান্ক্বাহ্-এ-কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া থেকে সারা বাংলার আনাচে কানাচে হুজূর ক্বিব্লা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর মিশন পরিচালনা করেন যা আজো সে স্মৃতি বহন করছে। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি প্রথম বাংলাদেশে আসেন ১৯৭৬সালে। এর পূর্বে ১৯৭৪ সালে সিরিকোট শরীফ থেকে এক ঐতিহাসিক নির্দেশ প্রদান করেন যে, বারই রবিউল্ আউয়াল্ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আয়োজনের সাথে সাথে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ ‘জশ্নে জুলুছ’ বের করার জন্য। এ দায়িত্ব অর্পণ করেন আন্জুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার উপর। ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রামে আনজুমানের ব্যবস্থাপনায় তৎকালীন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ আল্কাদেরীর নেতৃত্বে ১২ রবিউল্ আউয়াল্ শরীফে জশ্নে জুলুছ বের করা হয় এটা কোরবাণীগঞ্জ বলুয়ারদীঘি পাড়স্থ খান্ক্বাহ্-এ-কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া হতে বের হয়ে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া ময়দানে গিয়ে শেষ হয়। এরপর বিশাল মিলাদ মাহফিল শেষে কর্মসূচি সমাপ্ত হয়। এটাই বাংলাদেশে ‘জশ্নে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ উদযাপন-এর প্রথম উদ্যোগ। জশ্নে জুলুছ এর রূপকার হুজুর ক্বিব্লার সরাসরি নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রথম জুলুছ বের করা হয় ১৯৭৭ সালে। পরবর্তীতে ঢাকায় ৯ রবিউল্ আউয়াল্ ও চট্টগ্রামে ১২ রবিউল্ আউয়াল্ আন্জুমানের ব্যবস্থাপনায় ‘জশ্নে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ উদ্যাপিত হয়ে আসছে। ওই সময় হতে একাধারে দশ বছর অর্থাৎ- ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে এই যুগান্তকারী দ্বীনি খিদ্মত আনজাম দিয়ে সর্বজনস্বীকৃত সুন্নীয়তের এক প্রধান কান্ডারী হিসেবে গণ্য হন। দ্বীনী শিক্ষার বিকাশে বিভিন্ন স্থানে মাদরাসা প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর অবদান রয়েছে। তিনি ১৯৭৫ সনে চট্টগ্রাম হালিশহর ইসলামিয়া তৈয়্যবিয়া সুন্নিয়া, ১৯৭৬ সনে চন্দ্রঘোনা তৈয়্যবিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়াসহ অনেকগুলো মাদ্রাসা ও দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত ও সিলসিলার প্রচার প্রসারে তার নির্দেশে বের হচ্ছে মাসিক তরজুমান। সুন্নি দুনিয়ায় এটি হুজুর ক্বিব্লার আর এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে বাতেল ও ইসলাম বিদ্বেষী শক্তির মোকাবেলায় তরজুমান অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। হুজূর ক্বিবলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এটা প্রতিষ্ঠাকালে বলেন- _“ইয়ে তরজুমান বাতিল ফের্ক্বোঁ কে লিয়ে মউত্ হ্যায়।” অর্থাৎ তরজুমান বাতিল র্ফেক্বাসমূহের জন্য মৃত্যু সমতুল্য। হুজুর কেবলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র এ বাণীর যথার্থতা বর্তমানেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এছাড়া ‘মাজ্মুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ পুনঃমুদ্রণ, কাদেরিয়া ত্বরীক্বার পীর-মাশায়েখদের দৈনন্দিন অযীফা সম্বলিত এক বিরল সংকলন ‘আওরাদুল্ কাদেরিয়ার্তু রহমানিয়া’সহ সুন্নী আক্বীদাভিত্তিক নানা বই-পুস্তক, কিতাব প্রকাশের তিনি ব্যবস্থা করেন।

তাঁর পদচারণায় এদেশে কাদেরিয়া ত্বরীক্বা ও সুন্নিয়াত্ এক নতুন জীবন লাভ করে। তাঁর নির্দেশে আজ খত্মে গাউসিয়া, গেয়ারভী ও বারভী শরীফ এবং মিলাদ-ক্বিয়াম শুধু নতুনত্ব অর্জন করেনি বরং পুনর্জীবন লাভ করে ঘরে ঘরে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর কারণে এদেশে আ’লা হযরত শাহ্ আহমদ রেযা খান বেরলভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র বিষয়ে জানা ও চর্চা ব্যাপকতা পেয়েছে। তিনি সিলসিলার কর্মসূচিতে সালাত-সালামসহ আ’লা হযরত প্রণীত মস্লকের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে সামগ্রিক সুন্নী সংস্কৃতিতে এনেছেন বৈচিত্র্য। সৈয়্যদুল্ র্মুসালীন রাহ্মাতুল্লীল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন পবিত্র আওলাদ এবং বে-মেসাল আশেক হিসেবে তিনি আজানের পূর্বেও নবীকে সালাত সালাম দেওয়ার প্রাচীন ঐতিহ্য পুনঃপ্রবর্তন করেন। হুজূর ক্বিব্লা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি চট্টগ্রাম অবস্থানকালে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ছাড়াও প্রতিদিন বাদে ফজর বলুয়ার দীঘিপাড় খান্ক্বাহ্ শরীফে প্রাণবন্ত পরিবেশে পবিত্র কোরআন করীমের আয়াতসমূহের দরস ও তাফ্সীর করতেন অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায়। এতে হুজুর ক্বিব্লার জ্ঞানের গভীরতা এবং খোদায়ী রহস্যের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ পরিদৃষ্ট যেমন হতো তেমনি হুজূর ক্বিব্লার আশেকদের মনে রূহানী খোরাক যোগাত, সিলসিলার উন্নতি (ত্বরক্কি) ও মুরিদের সংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় হুজূর ক্বিব্লা আন্জুমানকে বিস্তৃত পরিসরে খান্কাহ শরীফ প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেন। এতে গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর আধ্যাত্মিক ইশারাও ছিল।

১৯৭৯ সালে হুজূর ক্বিব্লা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ২২ জন পীরভাইসহ যিয়ারতের উদ্দেশে গাউসে পাক হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র মাযার মোবারকে (বাগদাদ শরীফ) উপস্থিত হন। সেখানে অবস্থানকালে একদিন রাত প্রায় ১২টার পর হুজুর ক্বিব্লা আকস্মিকভাবে আন্জুমানের সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি আলহাজ্ব মুহাম্মদ জাকারিয়া সাহেবকে ডেকে বললেন- মাওলানা জালালুদ্দীনকো বুলাইয়ে (জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আলক্বাদেরী)। তিনি অধ্যক্ষকে নিয়ে হুজূর ক্বিবলার সামনে উপস্থিত হলে হুজূর কেবলা রহমাতুল্লাহি আলাইহি সকলের উপস্থিতিতে এরশাদ করলেন-
“আভী আভী হুজূর গাউসে পাক শাহেনশাহে বাগদাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি কি তরফ্ছে অর্ডার হুয়া হ্যায় আলমগীর খানক্বাহ্ শরীফ বানানা হ্যায়, আউর মাজমুয়ায়ে ছালাওয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাপওয়ানা হ্যায়, আউর ইয়ে বাত ভা-য়ূঁকো ছমঝা দিজিয়ে’’।
অর্থাৎঃ এ মাত্র হুজুর গাউছে পাক শাহেনশাহে বাগদাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি‘র পক্ষ থেকে নির্দেশ এসেছে আলমগীর খানক্বাহ্ শরীফ তৈরি করতে হবে এবং মাজমুয়ায়ে ছালাওয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাপাতে হবে; আর এ নির্দেশ ভাইদেরকে বুঝিয়ে দিন। তখন হুজূর কেবলা রহমাতুল্লাহি আলাইহি‘র নির্দেশে বিষয়টি অধ্যক্ষ সাহেব ভাইদেরকে বুঝিয়ে দিলেন। হুজূর কেবলার নির্দেশ মতে পরবর্তীতে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার মাধ্যমে আলমগীর খানকাহ্ এ কাদেরীয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া প্রতিষ্ঠা করা হয়।

উল্লেখ্য, শাহেনশাহে সিরিকোট আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি একদিন দুপুরের খাবার গ্রহণের পর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার তৎকালীন অধ্যক্ষ আল্লামা মুহাম্মদ ওয়াক্বার উদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি‘র বাসভবনে বিশ্রাম করছিলেন। এ সময় তিনি বললেন-
‘ইহাঁ হাম মিছকিনূঁ কেলিয়ে এক ঠিকানা হো’ (এখানে আমরা মিসকিনদের জন্য এক আশ্রয় হওয়া চাই)। সে পবিত্র জবানে উচ্চারিত ‘ঠিকানা’ই বর্তমানের আলমগীর খানকাহ্-এ-ক্বাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া যা সিলসিলায়ে আলিয়া ক্বাদেরিয়ার ফয়েজ প্রার্থীদের প্রাণকেন্দ্র।

মোট কথা, আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত প্রেমিক ও নায়েব, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আদর্শ। “কী মুহাম্মদ ছে ওয়াফা তু-নে তুহাম্ তেরেহে, ইয়ে জাহাঁ চীজ্ হ্যায় কেয়া লওহ ক্বলম্ তেরে হ্যায়।” মহাকবি আল্লামা ইকবালের কবিতার এ চরণ তিনি এত বেশি তুলে ধরতেন যে এক পর্যায়ে এটি সাধারণ লোকদের অন্তরেও গেঁথে গেছে। এর অর্থ- মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাদারী করো তবে আমি খোদাও তোমার হবো, এই দুনিয়াতো সামান্য বিষয়; র্আশ-কুরসিও তোমার হবে। গাউসে জামান তৈয়্যব্ শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন এ শতাব্দীতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে সুন্নিয়াত ও ত্বরিক্বতের এক মহান সংস্কারক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে মাত্র এক দশকে তিনি শরিয়ত ত্বরিক্বতের মরুদ্যানে এতই অভাবনীয় সুফল বয়ে এনেছেন যাতে হুজূর সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর ওই মহান বাণী “তৈয়্যব্ কা মক্বাম বহুত্ উঁচা হ্যায় ” এর যথার্থতা আরো পরিষ্ফুট হয়ে ওঠেছে। ১৯৮৬ সাল হুজুরের এদেশে শেষ সফর। এ বছর স্বদেশে ফেরার পর আনজুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়াকে নির্দেশ দেন গাউসিয়া কমিটি গঠন করায় বর্তমানে ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’র অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে শুধু দেশে নয় বিদেশেও এ সংগঠনের শাখা রয়েছে। এটার মাধ্যমে শরিয়ত-ত্বরিক্বতের গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধা হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরো বেশী হবে ইন্শা আল্লাহ। এভাবে মোর্শেদে বরহক্ব বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেখে গেছেন উজ্জ্বল অবদান। হুজূর ক্বিব্লা (রাঃ) ১৪১৩ হিজরির ১৫ যিল্হজ্ব, ১৯৯৩ ইংরেজির ৭ জুন সোমবার সকাল ৯টায় সিরিকোট শরীফে ওফাত লাভ করেন। পরদিন মঙ্গলবার বর্তমান হুজূর ক্বিব্লা ‘সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্’ মাদ্দাজিল্লুহুল আলী‘র ইমামতিতে নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় এবং আব্বাজান হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। এদিকে ১৯৭৬ সালে হুজুর কেবলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি মাশায়েখ্ হযরাতে কেরামের ইশারায় তাঁর দুই সাহেবজাদা ‘সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্’ মাদ্দাজিল্লুহুল্ আলী এবং পীর সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবের শাহ্ মাদ্দাজিল্লুহুল্ আলী কে খেলাফত প্রদান করে নিজ স্থলাভিষিক্ত করেন। হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এক সময় বলেছিলেন, “তৈয়্যব আউর তাহের কাম সাম্বালেঁগে, সাবের শাহ্ বাঙ্গাল্কা পীর বনেগা।” সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর পর গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ত্বরিক্বতের কাজ যথার্থভাবে সামাল দিয়েছিলেন। বর্তমানে হুজূর ক্বিব্লা তাহের শাহ্ মাদ্দাজিল্লুহুল্ আলীও অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন বর্তমান হুজূর ক্বিব্লা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ মাদ্দাজিল্লুহুল্ আলী নিয়মিত বাংলাদেশ সফরে আসছেন। বিশেষত হুজূর ক্বিবলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর ওফাত (১৯৯৩ ইংরেজি) পরবর্তী তার আবির্ভাব ছিলো পূর্ববর্তী সময় থেকে আলাদা এক রওনকের ধারক হিসেবে।

হুজূর ক্বিব্লার বরকতময় পদচারণায় উত্তরবঙ্গ ও সিলেট অঞ্চলে দ্বীন ও ত্বরিক্বতের এক নবযুগের সূচনা হয়েছে। দক্ষিণ অঞ্চলেও অনুরূপ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। হুজূর ক্বিব্লা যেখানেই পদার্পণ করছেন সেখানেই প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, খান্ক্বাহ্, মসজিদ ইত্যাদি।

ইতোমধ্যে দেশে মাশায়েখে কেরামের নামে অন্তত শতাধিক মাদ্রাসা, সংস্থা ও সংগঠন গড়ে উঠেছে। এ যেন এক দ্বীনী বিপ্লব। এ বিপ্লব অব্যাহত থাকবে ইন্শা আল্লাহ্।

আল্লাহর শোকর যে, উক্ত মাশায়েখ্-হযরাতের উসিলায় আল্লাহ্ আমাদের কাদেরিয়া ত্বরিক্বা নসীব করেছেন। এ ত্বরিক্বাতেই যেন আমাদের মৃত্যু হয়। আ‘লা হযরত শাহ্ আহ্মদ রেজা খান বেরলভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর ভাষায় মুনাজাত করি-“ক্বাদেরী কর ক্বাদেরী রাখ, ক্বাদেরীওঁ মে উঠা; ক্বদ্রে আবদুল্ ক্বাদেরে ক্বুদ্রত নুমাকে ওয়াস্তে” আরো সৌভাগ্য যে, আমাদের ওই পীর মাশায়েখ্গণ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র বংশধর তথা আহলে বায়ত। হাদীস শরীফে আহলে বায়াত্দের নূহ্ আলাইহিস্সালাম এর জাহাজতুল্য, হেদায়তের আদর্শ বলা হয়েছে। বাস্তবেও আজ হযরাতে কেরাম আমাদের ঈমান-আক্বিদা ও আমলের হেফাজতের ক্ষেত্রে নূহ্ আলাইহিস্ সালাম এর জাহাজতুল্য ভূমিকা রাখছেন। যুগের অলিকূল সম্রাটগণ গাউসে জামান এর পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হন। যুগে যুগে এ সর্বোচ্চ মর্যাদার আসন ক্বাদেরিয়া ত্বরিক্বা ও আওলাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামগণের অধীনেই ছিল এবং থাকবে ইন্শাআল্লাহ। খাজা চৌর্হভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর প্রধান খলীফা হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকেও এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, গাউসে জামান পদটি কাদেরিয়া ত্বরিক্বার জন্য বরাদ্দ আছে। এ ত্বরীক্বায় উপযুক্ত প্রতিনিধির অভাব ঘটলেই ঘরের এ মহান নেয়ামত অন্য কোথাও চলে যেতে পারে। খাজা চৌহ্রভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর এ মন্তব্য আমাদের উপরিউক্ত মাশায়েখ এর গাউসে জামান হবার প্রতি একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।

জিনকে হার্ হার্ আদা সুন্নাতে মুস্তফা
এয়সে পীরে তরীক্বত পেহ্ লাখোঁ সালাম ॥

Top