কিতাবঃ বায়াত ও খিলাফতের বিধান (৩য় অধ্যায়)
মূলঃ ইমাম আ'লা হযরত (রহঃ)
Text : ফাতিমাতুজ যুহরা শাকিলা
॥৩॥
بِسمِ اللّٰهِ الرَّحمَنِ الرَّحِیمِ، اَلحَمدُ لِلّٰهِ الوَاحِدِ الأَحَدِ المَنَزِّهِ مِن کُلِّ شِركٍ وَعَدَدٍ، وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلَی النَّبِيِّ الأَوحَدِ وَاَلِهِ وَصَحبِهِ وَتَاِعِیهِم فِي الرُّشدِ مِنَ الأَزلِ إِلَي أَبَدِ الأَبَدِ.
আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম করুনাময় ও দয়ালু। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি এক ও একক, প্রত্যেক অংশীদার এবং সংখ্যা থেকে পবিত্র । পুরিপূর্ণ রহমত ও শান্তি বর্ষিত হােক নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি, যিনি সৃষ্টির মধ্যে একক, তার পবিত্র বংশধর, অসহাব এবং হিদায়তের পথে তার অনুসরণকারীদের প্রতিও (রহমত ও শান্তি অবতীর্ণ হােক) আদি থেকে অনাদিকাল পর্যন্ত।
হক্কানী পীরের বায়আত থাকা সত্ত্বেও অন্য পীরের কাছে বায়আত হওয়ার বিধান।
(নিশ্চয় জেনে রাখুন যে,) বস্তুত বাধ্যকারী সঠিক প্রয়ােজন ছাড়া স্বীয় পীর- মুরশিদ থাকা সত্ত্বেও অন্য পীরের হাতে ‘বায়'আতে ইরাদত´ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা জরুরী। এটাই নির্ভরযােগ্য অভিমত। এটাতেই কল্যাণ নিহিত। অন্যথায় পরিপূর্ণ ক্ষতির সম্ভাবনা বিদ্যমান। কারণ,
১. এলােমেলাে চিন্তা ও ভবঘুরতা বঞ্চিত হওয়ার কারণ। আল্লাহ রাব্বল আলামীনের পানাহ পবিত্র কুরআনে পরিষ্কার ভাষায় ইরশাদ করছে,
ضَرَبَ اللّٰهُ مَثَلاً رَّجُلاً فِیهِ شُرَکَاءُ مُتَشَکِسُونَ وَرَجُلاً سَلَمًا لِّرَجُلٍ هَل یَستَوِیَانِ مَثَلاً ، اَلحَمدُ لِلّٰهِ ، بَل أَکثَرُهُم لاَ یَعلَمُونَ.
আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন, এক ব্যক্তির মালিক অনেক, যারা পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন এবং আর এক ব্যক্তির মালিক কেবল একজন; সুতরাং একজন গােলাম শুধু একজন মনিবের হওয়াই নিরাপদ। এই দু’জনের অবস্থা কি সমান? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর প্রাপ্য। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না।
২. তাছাড়া, হক্কানী, সত্যবাদী পীর নিজ মুরিদের জন্য কিবলা স্বরূপ। আর নামাযে কিবলার দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিলে নামায শুদ্ধ হয় না। যদিও আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেছেন,
فَأَینَمَا تُوَلُّوا فَثَمِّ وَجهُ آللّٰهِ.
তােমরা যেদিকে মুখ করাে না কেন, ওই দিকে আল্লাহর রহমত তােমাদের দিকে রয়েছে।
তারপরও আল্লাহর রহমত অন্বেষণকারীদেরকে কুরআন এ হুকুমও শুনাচ্ছে যে,
وَحَیثُ مَا کُنتُم فَوَلُّوا وُجُوهَکُم شَطرَهُ.
‘তােমরা যেখানে থাক না কেন নিজেদের চেহারা মসজিদে হারামের দিকে করে নাও।
৩. তাছাড়া যে কোন ওয়াফাদার গােলাম তার দুনিয়াবী মালিকের দরজা ছেড়ে অন্যের দরজায় যাওয়াকে অকৃতজ্ঞতা বলে জানে।
ع سر ایخبا سجدہ ایخبا قرار ایخبا
বরং, কৃতজ্ঞ বান্দা মাথা রাখে মনিবের দরজায়, সাজদা করে মনিবের দরজায়, বন্দেগীও তার দরজায় এবং প্রশান্তিও তার দরজায়ই অন্বেষণ করে।
অতএব, পীর-মুরশিদের ইহসানের সাথে পার্থিব ইহসান (দয়া)-এর কোন তুলনাও হয় না। তাই ওই ব্যক্তির জন্য আশ্চর্য হতে হয়, যে নিজ পীর-মুরশিদের প্রতি ভালবাসা ও নিষ্ঠার দাবি করে, অথচ, তিনি জীবিত থাকা সত্ত্বেও এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়।
چو دل بادلبری آرام گیرد زو صل دیگرے کے کام گیرد نہی
صد دستہ ریحاں پیش بلبل نخو اہد خاطر ش جزء نگہت گل
১. আল-কুরআন, সুরা আয-যুমার, ৩৯:২৯
২. আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১১৫
৩. আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১৪৪
“যখন অন্তর একজন প্রেমাস্পদের সাথে সম্পৃক্ত তখন অন্যজনের সাথে মেলামেশা করার প্রয়ােজন কোথায়? বুলবুলের সামনে ফুলের শত গুচ্ছ রাখ না কেন, কিন্তু ফুলের সুবাস ছাড়া তার অন্য কিছু কাম্য নয়।
৪. তাছাড়া, পীরের ফয়েয (আধ্যাত্মিক করুণা) ‘মান ওয়া সালওয়া' (আসমানী খাদ্য বিশেষ) সদৃশ। আর আমরা অবশ্যই এক খাদ্যের উপর ধৈর্যধারণ করতে পারব না —এ কথা বলার পরিণতি অত্যন্ত মন্দ। সুতরাং তুমি ইসরাইলী হয়াে না, মুহম্মদী হও, তােমার নিকট সকাল-সন্ধ্যা রিযক (জীবিকা) আসবে।
৫. তাছাড়া, জন্মদাতা পিতা হচ্ছেন মাটির কায়ার (শরীর)-এর পিতা আর পীর হচ্ছেন অন্তরের পিতা। মনিব হচ্ছেন গােলামের মাটির কায়ার (শরীরের) মুক্তিদাতা আর পীর হচ্ছেন পবিত্র প্রাণ (আত্মার) মুক্তিদাতা। প্রবৃত্তি-পূজারীর অন্তরে ভয় সঞ্চার হওয়ার জন্য এই হাদীস যথেষ্ট যে, “যে ব্যক্তি আপন পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা বলে ডাকে অথবা নিজ মনিব থাকা সত্ত্বেও অন্যকে নিজের মনিব বলে পরিচয় দেয়, তার উপর আল্লাহ তাআলা, ফিরিশতাগণ ও সমস্ত মানুষের অভিশম্পাত। আল্লাহ তাআলা না তার ফরয কবুল করবেন, না নফল।
হাদীসশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ পাঁচজন ইমাম, আমীরুল মু'মিনীন আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু থেকে, তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন,
وَمَنِ ادَّعَی إِلَی غَیرِ أَبِیهِ أَوِ انتَمَی إِلَی غَیرِ مَوَالِیهِ فَعَلَیهِ لَعنَةُ اللّٰهِ وَالمَلاَٸِکَةِ وَالنَّاسِ أَجمَعِینَ لاَ یَقبَلُ اللّٰهُ مِنهُ یَومَ القِیَامَةِ صَرفًا وَلاَ عَدلاً.
‘যে ব্যক্তি নিজ পিতা ছাড়া অন্য ব্যক্তিকে পিতা বলে দাবি করলাে অথবা নিজ মুনীব ছাড়া অন্যকে নিজের মুনীব বানালাে, তার উপর আল্লাহ, ফিরিশতাগণ ও সমস্ত মানুষের লানত। আল্লাহ না তার ফরয কার্যাদি কবুল করবেন, না নফল ।
সুতরাং যে ব্যক্তি ক্রীড়াচ্ছলে এসব কাজ করে বসে, সে কি এ ভয় করে না, আল্লাহ না করুক! প্রকাশ্য কিয়াসের বিধান মতাে এ সহীহ হাদীসে বর্ণিত কঠিন শাস্তির হিসসা পাবে।
১. আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:৬১
১. মুসলিম, আস-সহীহ, কিতাবুল হজ, ১/৪৪২, কদীমী কুতুবখানা, করাচি
২, তিরমিযী, আল-জামি আস-সহীহ, আবওয়াবুল ওসায়া, ২/৩৪, আমিন কোম্পানী, দিল্লি
৩. আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মসনদ, ১/৮১, আল-মাকতাবু ইসলামী, বৈরুত
চির সৌভাগ্যবান-ব্যক্তিগণ আপন পীর-মুরশিদের নির্দেশ সত্ত্বেও নিজ পীরকে ত্যাগ করে অন্য হককানী পীরের খিদমতে আত্মনিয়ােগ করাকেও বৈধ মনে করেননি। আর এ ত্যাগ করাও এমন মহান ছিলাে যে, ঝর্ণার নিকট থেকে গভীর সমুদ্রে ছুড়ে যাওয়া। এতদসত্ত্বেও পীরের আস্তানা ছেড়ে যাওয়াকে সঙ্গত মনে করেননি। আর এ আদব আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ পছন্দ করেছেন। (যেমন-) এক দিন হুযূর পুরনূর সায়্যিদুল আউলিয়া ইমামুল উরাফা হযরত সায়্যিদুনা গাউসূল আ'যম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হযরত আলী ইবনে হায়তী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হির কাছে মেহমান হন। হযরত আলী ইবনে হায়তী তাঁর বিশেষ মুরিদ হযরত আবুল হাসান আলী জাওসকী রাহমতুল্লাহি তা'আলা আলায়হিকে হযরত গাউসূল আ'যম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর খিদমতে নিয়ােজিত থাকার জন্য নির্দেশ দিলেন এবং ইতােপূর্বে এও বলেছিলেন যে, আমি হুযূর গাউসুল আযম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর গােলামদের একজন। হযরত আবুল হাসান আপন পীর-মুরশিদের এ নির্দেশ পেয়ে কাদা আরম্ভ করলেন, কোনভাবেই নিজ পীরের দরবার ত্যাগ করতে চাইলেন না। হুযুর গাউসূল আযম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তাঁকে কাঁদতে দেখে বললেন,
مَا یُحِبُّ إِلاَّ الثُّدي رَضَعَ مِنهُ.
‘সে যে স্তন থেকে দুধ পান করেছে, তা ছাড়া অন্য স্তন কামনা করছে না। আর তাকে নিজ পীরের খিদমতে অবস্থান করতেই নির্দেশ দিলেন।
আরিফ বিল্লাহ ইমাম আবদুল ওয়াহহাব শা’রানী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি মিযানুশ শরীয়্যাতুল কুবরা গ্রন্থে বলেন,
سَمِعتُ سَیِّدِيعَلِيَّ الخَوَّصَ رَحِمَهُ اللّٰهُ یَقُولُ: إِنَّمَا أَمَرَ عُلمَاءُ الشَّرِیعَةِ الطَّالِبَ بِالإِلتِزَامِ مَذهَبُ مُعَیِّنُ وَعُلَمَاءُ الحَقِیقَةِ لِلمُرِیدِ بِالإِلتِزَامِ شَیخُ وَاحِدُ.
‘আমি হযরত আলী খাওয়ায রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হিকে বলতে শুনেছি যে, শরীয়তের আলিমগণ শরীয়তের অনুসারীকে নিদের্শ দিয়েছেন, যেন মযহাব চতুষ্টয় থেকে নির্দিষ্ট একটি মযহাবের তাকলীদকে নিজের জন্য অপরিহার্য করে নেয়। আর তরীকতের আলিমগণ মুরিদকে বলেছেন, যেন একজন পীরকে অপরিহার্য করে নেয়।
১.শাতনুফী, বাহজাতুল আসরা, ذکر أي الحسن علي الحوسقي٫ পৃ. ২০৫
ইমাম নূরউদ্দিন আবুল হাসান আলী ইবনে ইউসূফ লাখমী (কাদ্দাসা সিররাহু) স্বীয় গ্রন্থ বাহজাতুল আসরার ওয়া মা´দানুল আওয়ারে এ সহীহ সনদে আবু হাফস উমর বাযযারের সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
২. আবদুল ওহাব শা'রানী, আল-মিযান আল-কুবরা, অনুচ্ছেদ : فان قلت فاذا انفك قلب السولي عسن التقلید, ১/২৩,
উক্ত বর্ণনার পর ওই লেখক এক স্পষ্ট উদাহরণের মাধ্যমে এ বিষয়টি আরাে ব্যাখ্যা করেছেন।
ইমাম আল্লামা মুহাম্মদ আবদরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি (যিনি ইবনুলহাজ নামে প্রসিদ্ধ) মাদখাল নামক কিতাবে বলেন,
اَلمُرِیدُ یُعَظَّمُ شَیخَهُ وَیَٶثِرُهُ عَلَي غَیرِهِ مِمَّن هُوَ فِي وَقتِهِ لِأَنَّ النَّبِيَّ ﷺ یَقُولُ: مَن رُزِقَ فِي شَٸٍ فَلیَلزِمهُ.
‘মুরীদ স্বীয় পীরকে তা’যীম করবে এবং তাঁকে তাঁর যুগের সমস্ত ওলীর উপর প্রাধান্য দেবে। কারণ, হুযূর নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যাকে যে কারণে রিযক দেওয়া হয়, তার উচিৎ তাকে আকড়ে ধরা।
ওই গ্রন্থে আরাে উল্লেখ আছে যে,
إِنَّ المُرِیدُ لَهُ اتُسَاعُ فِي حُسنِ الظَّنَّ بِهِم وَفِي التِبَاطِهِ عَلَي شَخصٍ وَاحِدٍ یَعُولُ عَلَیهِ فِي أُمُورِهِ وَیَحذِرُ مَن تَقضَي أَوقَاتَهُ لِغَیرِ فَاٸِدَةٍ.
‘মুরিদের জন্য এ-ও অবকাশ রয়েছে যে, সে স্বীয় যুগের সমস্ত শায়খ বা পীরদের প্রতি ভাল ধারণা পােষণ করবে এবং একজন পীরের দামনের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে আর স্বীয় সকল কাজে তার উপরই নির্ভর করবে। অনর্থক সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকবে।
* ফায়েদা : এ হাদীস উক্ত ইমাম (লেখক) মু´দাল (معضلا) হিসেবে বর্ণনা করেছেন । হাদীসটি `হাসান´ পর্যায়ের । ইমাম বায়হাকী শুআবুল ঈমানে ‘হাসান’ সনদে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। আর এ একই হাদীস ইবনে মাজাহতে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়শা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহার সূত্রে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ বচনে বর্ণিত আছে যে,
مَن بُورِكَ لَهُ فِي شَيءٍ فَلیَلزِمهُ.
১. ইবনুল হাজ, আল-মাদখাল, حقیقة أحد العهد, ৩/২২৩ ও ২২৪, দারুল কিতাব আল-আরবী, বৈরুত
২. ইবনুল হাজ, আল-মাদখাল, في رسول المرید الحلوة, ৩/১৬০, দারুল কিতাব আল-আরবী, বৈরুত
যাকে কোন জিনিসে বরকত দেওয়া হয়েছে, তার উচিৎ যেন তা উপরিহার্য। করে নেয়।
এ হাদীস কতই না বিশুদ্ধ ও উত্তম। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি দান করেছেন ও ইহসান করেছেন। আর সালাত ও সালাম তার ওই মহান রসূলের উপর (বর্ষিত হােক) যিনি সবচেয়ে বেশি ইহসানকারী। তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবী এবং যাঁরা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছেন, সকলের উপরও। আল্লাহ তা'আলা অধিক পরিজ্ঞাত। তাঁর জ্ঞান পরিপূর্ণ, তাঁর হুকুম খুব শক্তিশালী।
১. মোল্লা আলী কারী, الأسرار المرفوعة في الأحبار الموضرعة المعروف بالموضوعات الکسیر٫ ২২৫, দারুল কুতুব আল-আলমিয়া, বৈরুত