পীর গ্রহণের আবশ্যকতা
“ছেরাজুছ্-ছালেকীন” – আবদুল খালেক এম এ
মোরশেদ গ্রহণের আবশ্যকতাঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
ইয়া আইয়ুহাল্লাযীনা আমানুত্তাকুল্লাহা ওয়াব্তাগু ইলাইহিল ওয়াসীলাতা ওয়াজাহিদু ফী সাবীলিহী লায়াল্লাকুম তুফ্লিহুন।(- সুরা মায়েদা, আয়াত নং ৩৫)
আল্লাহতায়ালা বলেন: হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহতায়ালাকে ভয় কর এবং তাঁহার নিকট পৌঁছিতে ওছিলা (মধ্যস্থ) অনুসন্ধান কর এবং তাঁহার পথে কঠোর পরিশ্রম কর, খুব সম্ভব তোমরা মুক্তি লাভ করিবে।
এই আয়াত শরীফে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হইয়াছে। প্রথমতঃ ঈমান, তারপর পরহেজগারী, তারপর ওছিলা অর্থাৎ কামেল মোরশেদ অনুসন্ধান করা, অবশেষে মোরাকাবা ইত্যাদির প্রতি লক্ষ করা হইয়াছে। ঈমানদারগণের প্রতি আল্লাহতায়ালার আদেশ এই যে তাহারা পরহেজগারী গ্রহণ করিবে। আল্লাহতায়ালার রাস্তায় জিকির মোরাকাবা ইত্যাদির দ্বারা কঠোর পরিশ্রম করিতে থাকিবে। তাহা হইলে আশা করা যায় যে, আখেরাতে তাহাদের নাজাত মিলিবে।
ছালেক (তরিকতপন্থি)নিজকে জাহেল ও গোনাহগার মনে করিবে। তরিকতের মূল বিষয় ছুন্নতের পুরাপুরি পায়রবী করা, বেদয়াত ত্যাগ করা এবং ওজিফাগুলি রীতিমত আদায় করা। জিকির খালেছ আল্লাহ্তায়ার ওয়াস্তে করিবে এবং আল্লাহ্তায়ালার রেজামন্দি ও মুহব্বত লাভের আশা মনে মনে পোষণ করিবে, নেক আমল বেশী হইলেও অতি সামান্য ধারণা করিবে এবং বদ আমল কম হইলেও অতি বেশী মনে করিবে। কেননা কেহই বলিতে পারে না যে, তাহার নেক আমল কবুল হইয়াছে কিনা এবং তাহার গোনাহ্ তওবা করা সত্ত্বেও মাফ হইয়াছে কিনা।
ছালেকগণের (তরিকতপন্থীগণের) আটটি বিষয় লক্ষ্য রাখা দরকারঃ
১)হুশদার্ দম: ছালেক লক্ষ্য রাখিবে যে, প্রতি শ্বাসে সে সজাক বা ঘুমন্ত, অর্থাৎ সে আল্লাহ্তালার জিকিরে মশগুল আছে বা গাফেল হইয়া পড়িয়াছে।
২)নজর্ বর্ কদমঃ ছালেক পথ চলিবার সময় তাহার দৃষ্টি পদনিক্ষেপ স্থান রাখিবে।
৩) ছফর দার্ওতনঃ নফ্ছের বদ খাছ্লত পরিত্যাগ করা এবং ফেরেশ্তার খাছ্লত অর্জন করা অর্থাৎ নফছ্ হইতে অপর বস্তুর মুহব্বত দূর করা এবং আল্লাহর মুহব্বতের জন্য কোশেশ্ করা।
৪) খেল্ওয়াত্ দার্ আন্জুমানঃ ছালেক সর্বদা তাহার কাল্বকে আল্লাহ্তায়ালার সঙ্গে মশগুল রাখিবে। অর্থাৎ ছালেক খাওয়া – পরা, উঠা- বসা, চলা-ফেরা সকল অবস্থায় আল্লাহ্তায়ালার জিকিরে মশগুল থাকিবে। তুমি বাহিরে লোকের সঙ্গে মিলামিশা কর কিন্তু ভিতরে আল্লাহ্তায়ার সঙ্গে থাক। আল্লাহ্তায়ালার জিকির অনবরত করিতে থাক, যে পর্যন্ত তোমার হায়াত আছে, কেননা ক্বাল্বের ছাফাই একমাত্র আল্লাহ্তায়ালার জিকির দ্বারাই হয়ে থাকে।
৫। বাজ গাশ্তঃ কয়েকবার জিকির করিয়া আল্লাহতায়ার দরগায় নেহায়েত আজেজী এনকেছারী সহকারে দোয়া করিবে – এলাহী! তুমি আমার মকছুদ, তোমার রেজা আমার মত্লুব, তোমারই জন্যে দুনিয়া ও আখেরাতকে তরক্ করিয়াছি। তোমার মুহব্বত, মা’রেফাত এবং নেয়ামত আমাকে দান কর এবং তোমার দরবারে পৌঁছিবার পুরাপুরি ক্ষমতা আমাকে দাও।
৬) নেগাহদাশ্তঃ ক্বাল্ব হইতে অছ্অছা, বদ্খেয়াল, কল্পনাজল্পনা প্রভৃতি দূর করা এবং তদ্বিষয়ে সতর্ক থাকা।
৭) ইয়াদ দাশ্তঃ ছালেক তাহার দিলের তাওয়াজ্জু বা রোখ্কে একমাত্র আল্লাহ্তায়ালার দিকে রাখিবে।
৮) অকুফে জমানীঃ ছালেক প্রত্যেক সময় খেয়াল রাখিবে যেন তাহার ক্বালব্ আল্লাহ্তায়ার জিকির হইতে গাফেল হইয়া না পড়ে। অকুফে আদদী: নফী ইছবাত জিকিরের সময় বেজোর সংখ্যার খেয়াল রাখিবে।
অধিকাংশ আলেমগণের মতে কামেল পীরের নিকট বায়য়াত করা সুন্নত। হজরত নবী করিম (সাঃ) এর হাতে সমস্ত ছাহাবাগণ বায়য়াত গ্রহণ করিয়াছিলেন। তারপর হজরত আবুবকর (রাঃ) এর হাতে সমস্ত ছাহাবাগণ বায়য়াত গ্রহণ করিয়াছিলেন। তদনুযায়ী হজরত ওমর(রাঃ), হজরত ওছমান (রাঃ), হজরত আলী (রাঃ) – এর নিকট ক্রমান্বয়ে বাকী ছাহাবা ও তাবেয়ীনগণ বায়য়াত গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইসলামের প্রারম্ভ হইতে বায়য়াত প্রথা উহার অঙ্গস্বরূপ চলিয়া আসিতেছে। ইসলামের শিক্ষা, আমল, হেফাজত, সংশোধন প্রভৃতি যাবতীয় কাজকর্ম বায়াতের ফলে সহজ সাধ্য হইয়া পড়ে। কামেল পীরের সংশ্রবে মানুষ জাহের বাতেন যাবতীয় দোষগুলি সংশোধন করিয়া সদ্গুণ ও কামালত অর্জনে সক্ষম হয়। মানুষ মহাজ্ঞানী এবং মহাবিদ্বান হইলেও কামেল পীরের বিনা ছোহ্বত লাভে এলেম অনুযায়ী আমল করিয়া পরিপক্ক বা কামেল হইতে পারে না। হজরত আবু আলী দাক্কাক (রাঃ) বলিয়াছেন: যদি কোন মেওয়াদার গাছ কোন স্থানে রোপনকারীর বিনা সাহায্যে উৎপন্ন হয়, আর তাহাকে যত্ন না করা হয়, তবে এরূপ গাছের পাতা হইলে ফল হয় না। আর যদি তাহাতে ফল ধরে, তবে বেমজা হয়। সেইরূপ যে মুরীদ কামেল পীরের ছোহবত ও শিক্ষা লাভ করে নাই, তাহার দ্বারাও কোন সুফল আশা করা যায় না।
আমখাছ্ সকলের জন্য শরীয়ত। প্রাথমিক ছালেকের উপর শরীয়তের যেই হুকুম কামেল ছুফির উপরও সেই হুকুম। কতগুলি ভন্ড ফকির ধারণা করে শরীয়ত শুধু সাধারণ লোকদের জন্য, খাছ্ লোকদের জন্য শরীয়তের কোন আবশ্যকতা নাই। তাহারা শুধু আল্লাহ্তায়ালার মা’রেফাতের তালাসে নিযুক্ত থাকিবে। মা’রেফাত হাছেল হইলে শরীয়তের কোনই আবশ্যক রাখে না। তাহারা নামাজ রোজা ইত্যাদির ধার ধারে না। আল্লাহতায়ালা বলেন: মৌত্ পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের এবাদত কর। ইহাতে প্রমাণিত হইল যে, জীবনের কোন স্তরেই এবাদত ছাড়িয়া দিবার অনুমতি নাই।
হাদীছ: তোমাদের ছেলেপেলের বয়স সাত বৎসর হইলে তাহাদিগকে নামাজের জন্য আদেশ কর, আর দশ বৎসর হইলে তাহাদিগকে প্রহার কর। কোনও অবস্থায় শরীয়ত ছাড়িয়া দিবার যো নাই। যাহারা বিশ্বাস করে যে শরীয়ত বাদ দিয়া কামেল হইতে পারে তাহারা জিন্দিক কাফের! কামেল অলীকে প্রাথমিক ছালেক অপেক্ষা বহুগুণ বেশী জিকির মোরাকাবা করিতে হয়।
ছুরত ও হাকীকতের সমষ্টির নাম শরীয়ত: জাহেরী দিকটার নাম ছুরতে শরীয়ত এবং বাতেনী দিকটার নাম হাকীকতে শরীয়ত। চর্ম এবং মজ্জা উভয়ই শরীয়তের অংশ। জাহেরী আলেম চর্ম বা জাহের লইয়াই সন্তুষ্ট এবং বাতেনী আলেম চর্মের বা জাহেরের সঙ্গে বাতেনের সংযোগকে শরীয়ত বুঝে। আলেম তিন প্রকার-এক শ্রেণীর আলেম আছেন তাঁহারা শুধু শরীয়তের জাহেরী দিকটাই দেখেন, বাতেনের দিকটার প্রতি তাঁহারা উদাসীন, তাঁহারা জাহেরী আলেম। তাঁহারাও ভাল, কিন্তু তাঁহারা শরীয়তে কিছুটা অপূর্ণ।
আর এক শ্রেণীর আলেম আছেন, যাঁহারা হাকীকত উপলব্ধি করিতে লাগিয়া যান। তাঁহারা এই হাকীকতকে শরীয়তের হাকীকত বলিয়া মনে করেন না। তাঁহারা ধারণা করেন যে,শরীয়ত চর্ম বা ছুরত এবং হাকীকত উহার পশ্চাতে নিহিত। তাহা সত্ত্বেও তাঁহারা শরীয়তের আমলের এক কেশাগ্রও এদিক ওদিক করেন না এবং শরীয়ত বর্জনকারীকে গোম্রাহ ধারনা করেন। যদিও তাঁহারা বাতেনের দিকটা শরীয়তের পর্যায়ে স্থান দেন না, তবুও তাঁহারা আল্লাহর অলী এবং তাঁহারা প্রথম শ্রেণীর আলেম অপেক্ষা উত্তম। আর এক শ্রেণীর আলেম আছেন যাঁহারা উভয় ছুরত ও হাকীকত যোগে গঠিত দ্বীন্কে শরীয়ত মনে করেন। তাঁহাদের নিকট চর্ম ও মজ্জা বা জাহের ও বাতেন উভয়ের যোগে শরীয়ত গঠিত। তাঁহাদের নিকট শুধু জাহের বাতেন ছাড়া গ্রহণযোগ্য নহে এবং বাতেন ও জাহের ছাড়া নাকেছ বা অপূর্ণ। তাঁহারা বাতেন উপলব্ধি ছাড়া শুধু জাহের অনুসরণকারীকেও ইসলামের অন্তর্গত মনে করেন এবং সাধারণ ঈমানদার ও জাহেরী আলেম নামে অভিহিত করেন।এই শ্রেণীর আলেমগণই প্রকৃত অলী। মোটের উপর,জাহেরী এবং বাতেনী কামালাত এই শ্রেণীর অলী উল্লাহগণের নিকট শরীয়তের কামাল বা পূর্ণতার উপর নির্ভর করে। তাঁহারা আকায়েদ ও আমলের জন্য জাহেরী এলেম ও বাতেনী ছাফাইর জন্য বাতেনী এলেম শিক্ষা করা আবশ্যক মনে করেন। তাঁহারা হাজার হাজার মুশাহেদাকে একটি ছুন্নতের মোকাবেলায় স্থান দেন না। হাল, ওয়াজ্দ, তাজাল্লা, কাশফ ইত্যাদি শরীয়তের আহ্কামের খেলাফ্ হইলে তাঁহারা তাহাদের মূল্য অর্ধ যবও মনে করেন না। তাঁহাদের বেলায়েত আম্বিয়াগণের বেলায়েত। শেষোক্ত দরজার অলিউল্লাহগণ বেলায়েতে মোকামে সর্বশ্রেষ্ঠ।(মকতুবাত শরীফ)।
পূর্বে বলা হইয়াছে যে, এলেম দুই প্রকার, জাহের ও বাতেন। এল্মে জাহের যাথাঃ কোরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ ও ফেকাহ্ শরীফের এলেম, আর এলমে বাতেন তাঁহার আহকাম অনুযায়ী আমল করা। আল্লাহ প্রাপ্তির জন্য এলেম ও আমল উভয়ই আবশ্যক। পয়গাম্বরগণ যে এলেম দুনিয়াতে রাখিয়া গিয়াছেন, উহা এল্মে শরীয়ত ও এল্মে আছরার (মা’রেফাত)। যিনি উভয় প্রকার এলেমের অধিকারী হইয়াছেন তিনিই প্রকৃত ওয়ারিশ। অতএব, যাঁহারা এই প্রকার এলেম হাছেল করিয়া সৌভাগ্যবান হইয়াছেন, তাঁহারাই আল্লাহতায়ালাকে অধিক পরিমাণে ভয় করিতে শিখিয়াছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন: নিশ্চয়ই বান্দাগণের মধ্যে আলেমগণই আল্লাহ্কে ভয় করিয়া থাকেন। এলেম ব্যতীত আমল চলে না, আবার আমল ব্যতীত এলেমের কোনই মূল্য নাই। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বলিয়াছেন: যে ব্যক্তি শুধু এলেম অধিক অর্জন করিল, অথচ আমল বাড়াইল না, তাঁহার আল্লাহতায়ালা হইতে বহু দূরে সরিয়া পড়া ছাড়া আর কিছুই লাভ হইল না। কামেল পীরের সংশ্রবে এলেম ও আমল উভয়ই হাছেল করিয়া আল্লাহতায়ালার মুহব্বত ও মা’রেফত হাছেল করা যায় এবং আছমান, জমীন ও বহু আমলের ভেদ ও নিগূঢ় তত্বের সংবাদ পাওয়া যাইতে পারে।
হজরত মাওলানা রুমী (রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহে) ফরমাইয়াছেন: কথাবার্তা ছাড়, তরীকত পন্থী হও এবং কামেল পীরের কদমের নীচে লুটিয়া পড়। যদি তুমি নিষ্কর্ম কঠিন পাষাণ ও মর্মর পাথর হইয়াও থাক, তথাপি যখন তুমি কামেল পীরের সংশ্রবে যাইবে, তখন তুমি অমূল্য রত্নসদৃশ হইয়া যাইবে। যদি তুমি আল্লাহতায়ালার সহিত মিলন বা নৈকট্য প্রত্যাশা কর, তবে চল এবং অলীগণের ছোহবতে উঠাবসা কর। যেমন পাতাবিহীন বৃক্ষ বায়ুর প্রভাবে প্রভান্বিত হইয়া নানাবিধ ফল ফুলে সুশোভিত হয়, তদ্রুপ নাকেছ তরীকত পন্থীর দিলও কামেল পীরের ছোহ্বতে আল্লাহতায়ালার মুহব্বত ও মা’রেফাতের নূরে আলোকিত হইয়া যায়। অলীগণের সঙ্গে কিছুকাল ছোহবত এখ্তিয়ার করা হাজার বৎসরের রিয়াবিহীন এবাদত অপেক্ষাও উত্তম। কামেল পীরের ছোহবত কিমিয়া সদৃশ। অপদার্থ তাম্র যেমন পরশমণির সংশ্রবে মূল্যবান স্বর্ণ হইয়া যায়, তদ্রুপ নাকেছ ছালেক ও কামেল পীরের ছোহবতে থাকিয়া কামেল অলী হইয়া যায়।
কামেল পীর সৌভাগ্যের স্পর্শমণি। অতএব, পীর কামেলকে ভাল মতে চিনিয়া জানিয়া বায়য়াত গ্রহণ করা আবশ্যক। হজরত সাদী (রহমাতুল্লাহ্ আলাইহে) বলিয়াছেন: বহু মানবরূপধারী শয়তান এই দুনিয়াতে বিদ্যমান আছে, কাজে কাজেই যার তার হাতে হাত দেওয়া সঙ্গত নহে। অতএব, দুর্ভাগ্যবশতঃ যদি এই প্রকার ধোকাবাজ ভন্ড বেদয়াতী পীরের ধোকায় পতিত হও, তাহা হইলে তোমার অমূল্য ধন ঈমানকে হারাইয়া বসিবে এবং দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ই বরবাদ হইয়া যাইবে। হজরত মাওলানা রুমী (রাঃ) ফরমাইয়াছেন: ভন্ড ধোকাবাজ পীরগণ পাখী শিকারীর মত। তাহারা যেরূপ জঙ্গলে ফাঁদ পাতিয়া পাখীর ডাক ডাকিতে থাকে এবং পাখীগণ ধোকায় পড়িয়া তথায় উড়িয়া আসে ও ফাঁদে আটক হইয়া পড়ে তদ্রূপ তুমিও প্রকৃত অলীকে চিনিতে না পারিয়া ভন্ড বেদয়াতীদের মিষ্টি কথায় ভুলিয়া দ্বীন ও ঈমান উভয়কেই হারাইয়া বসিলে। নাদানী বশতঃ ডাকাতকে হাদী (পথ-প্রদর্শক) বলিয়া গ্রহণ করিলে এবং রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) ও আবু জাহেলকে একই দরজায় স্থান দিলে। অত্যন্ত দু্ঃখের বিষয়, তুমি ত এমন মূর্খ যে, ইছা(আঃ) এবং তাহার গাধার মধ্যে প্রভেদ বুঝিতে পার না, তাই তুমি দাজ্জালকে ইমাম মেহদী (আঃ) বলিয়া ধারণা করিয়া বসিলে। সে ত কখনও পীর নয়ই বরং বিপথগামী শয়তান। তাহার নিকট ত্বরীকতের কি খোঁজ খবর থাকিতে পারে? তুমি কি জান, কেন তুমি এমন দৈত্যকে হাদীরূপে (পথ-প্রদর্শক) গ্রহণ করিলে ? ইহার কারণ এই যে, প্রকৃত অলী ও হাদীর লক্ষণগুলি বুঝিতে না পারিয়া আল্লাহর অলীদের প্রতি অভক্তি প্রকাশ করিলে এবং এন্কার করিয়া বসিলে।
অতএব, প্রত্যেক ঈমানদারের একান্ত কর্তব্য যে, পীর গ্রহণ সম্বন্ধে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে এবং প্রকৃত পীরের লক্ষণগুলি ভাল করিয়া জানিয়া লয়, নতুবা ভন্ড দাগাবাজ বেশরাদের পাল্লায় পড়িলে দ্বীন্ ও ঈমান উভয়ই বরবাদ হইয়া যাইবে। আজকাল বহুস্থানে দেখিতে পাওয়া যায় যে, অনেক দাগাবাজ ভন্ড বেশরা শয়তানের চেলাগণ নিজদিগকে পীর মোরশেদ সাজাইয়া সরল প্রাণ লোকদিগকে গোমরাহ্ করিতেছে। তাহাদের শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ ও বাতেল মতামত কোরআন, হাদীছ, ফেকাহ ও বুজুর্গানে দ্বীনের কার্যকলাপ প্রভৃতির সঙ্গে কোথায়ও মিলে না। হাদীছে আছে: আমার চামড়া অর্থাৎ আমার উম্মত হইতে, এমন কতগুলি লোক বাহির হইবে যাহারা দ্বীনকে বরবাদ করিবে। আরও হাদীছে আছে: আখেরী জমানায় আমার উম্মতের মধ্যে এমন বহু দল লোক বাহির হইবে, যাহারা রেঁশমী কাপড় পরিধান ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল জানিবে, হাশরের দিন তাহাদিগকে শূকর ও বানরের আকৃতির দেখা যাইবে। আরও হাদীছে আছে: আখেরী জমানায় একদল মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বাহির হইবে এবং তোমাদের নিকট এমন এমন কথাবার্তা বলিবে, যাহা তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষগণ কখনও শুনে নাই। আরও হাদীছে আছে: অতি নিকটে আরও ত্রিশ জন মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বাহির হইবে, যাহারা নিজদিগকে নবী বলিয়া দাবী করিবে, অথচ আমার পরে আর নবী আসিবে না কারণ আমিই শেষ নবী। আরও হাদীছে আছে: আখেরী জমানায় একদল মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বাহির হইবে, তাহাদের কথাবার্তা পয়গাম্বরগণের ন্যায়, তাহাদের কার্যকলাপ ফেরাউনগণের ন্যায় এবং তাহাদের দিলসমূহ নেকড়ে বাঘের দিল সমূহের ন্যায় হইবে।
দুনিয়া পরকালের শস্যক্ষেত্র। যে ব্যক্তি উহাতে চাষ আবাদ করিল না সে ব্যক্তি মহা ক্ষতিগ্রস্ত হইল। আর যে ব্যক্তি উহাতে চাষ আবাদ করিয়া বিকৃত বীজ পবন করিল, সে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হইল। অতএব যে ব্যক্তি যোগ্যতা থাকা সত্বেও ত্বরীকত শিক্ষা করিল না, সে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হইল। আর, যে ব্যক্তি অনুপযুক্ত পীরের নিকট বায়াত গ্রহণ করিল, সে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হইল।
আল্লাহতায়ালা বলেন: “তোমাদের মধ্যে একদল লোক থাকা অত্যাবশ্যক যাহারা লোকজনকে ভালকাজের দিকে আহবান করে, নেককাজের প্রতি আদেশ করে এবং বদ্কাজ হইতে নিষেধ করে।”
কোরআন পাকে আছে: হে নবী (সাঃ)। আপনি লোকদিগকে বলিয়া দিন, যদি তোমরা আল্লাহ্কে মুহব্বত করিতে চাও তবে আমার (রাসুলের) তাবেদারী কর, আল্লাহতায়ালা তোমাদিগকে মুহব্বত করিবেন এবং তোমাদের গোনাহসমূহ মাফ করিয়া দিবেন এবং আল্লাহতায়ালা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়াময়। ইহাতে স্পষ্টই বুঝা গেল যে, আল্লাহ্তালার মুহব্বত রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)- এর ছুন্নতের পায়রবী ছাড়া আর কোন উপায়ে হাছেল হইতে পারে না। যে কাজ রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) নিজে করিয়াছেন বা করিতে বলিয়াছেন বা যে যে বিষয়ে হ্যাঁ বা না কিছুই বলেন নাই বরং নীরবতা অবলম্বন করিয়াছেন, তাহার নাম সুন্নত এবং তিনি তাহা কোন বিশেষ কারণ ব্যতীত ছড়িতেন না। হজরত আয়েশা (রাঃ) বলিয়াছেন: “ রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) – এর কাজ বৃষ্টিধারার ন্যায় বর্ষিত হইত।” রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বলিয়াছেন: ঐ কাজ সর্বাপেক্ষা উত্তম, যাহা সর্বদা করা যায়, যদি তাহা অল্পও হয়। তিনি যে যে কাজ আরম্ভ করিতেন, তাহা বাধা-বিঘ্নের ভিতর দিয়াও করিতে থাকিতেন। হজরত ছাদী (রাঃ) বলিয়াছেন: যে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)- এর খেলাফ ত্বরীকা অবলম্বন করে, সে ব্যক্তি কখনও মন্জেলে মক্ছুদে (গন্তব্য স্থানে) পৌঁছিবার সৌভাগ্য লাভ করিতে পারিবে না। তিনি অন্যত্র নিজকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেন: হে ছাদী! তুমি এই কথা কখনও ধারণা করিও না যে, রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)- এর পায়রবী ছাড়া তুমি কখনও ছাফাইর পথে চলিতে সক্ষম হইবে। তরীকতের উদ্দেশ্য, ছুন্নতের পায়রবী করা এবং বেদয়াত বর্জন করা।
হাদীছ: এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করিলেন: হুজুর! আমি কি উপায়ে ঈমানদার হইতে পারি? (অন্য রেওয়ায়েতে আছে) কি উপায়ে খাঁটি ঈমানদার হইতে পারি? রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বলিলেন: যখন তোমরা আল্লাহ্তায়ালাকে মুহব্বত কর। আবার জিজ্ঞাসা করা হইল কি উপায়ে আল্লাহ্তায়ালাকে মুহব্বত করিব? তিনি বলিলেন: যখন তোমরা তাঁহার রাসুলকে মুহব্বত কর। আবার জিজ্ঞাসা করা হইল কিভাবে তাঁহার রাসুলকে মুহব্বত করিব? তিনি বলিলেন: যখন তাঁহার তরীকার পায়রবী কর, তাঁহার সুন্নতের উপর চল, তিনি যে বস্তুকে মুহব্বত করেন তাহাকে তুমি মুহব্বত কর এবং তিনি যে বস্তুকে মন্দ জানেন তাহাকে তুমি মন্দ জান।
হাদীছ: আমার পরে আমার উম্মতের কতকলোক আমাকে অত্যধিক মুহব্বত করিবে। এমন কি তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ তাহাদের আওলাদ ও মালের বিনিময়ে আমাকে দেখিতে আগ্রহ প্রকাশ করিবে।
হজরত বায়েজিদ বুস্তামী (রাঃ) – কে কেহ জিজ্ঞাসা করিলেন: অমুক ব্যক্তি বাতাসের উপর দিয়া উড়িয়া বেড়ায়, অমুক ব্যক্তি পানির উপর দিয়া চলিয়া যাইতে পারে এবং অমুক ব্যক্তি একরাত্রে মক্কা শরীফে যাইয়া থাকে। তিনি বলিলেন: শয়তান মরদ্দ হওয়ার পরেও এক মুহূর্তে দুনিয়ার এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত যাইয়া থাকে, পাখীরাও বাতাসে উড়িয়া বেড়ায় এবং মাছগুলিও পানির উপর চলিয়া থাকে, তবে কি তোমরা তাহাদিগকে ফকির বলিবে? যদি তোমরা কাহাকে শরীয়তের খেলাপ কাজ করা সত্ত্বেও বাতাসে উড়িয়া যাইতে দেখ, তবুও তাহাকে বিশ্বাস করিও না, বরং তাহার ঐ কাজগুলিকে এছ্তেদ্রাজ বা শয়তানের ধোকাবাজী বলিয়া মনে করিবে। প্রকৃত অলী কখনও কেরামত দেখাইয়া দরবেশী জাহির করিতে চাহিবেন না। যেরূপ রেয়াজত ও জিকির মোরাকাবা ইত্যাদি দ্বারা দিল পরিষ্কার হইলে কাশ্ফ কেরামত ইত্যাদি প্রকাশ পায়, তদ্রুপ নফ্ছের সাধনা করিলেও এক প্রকার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয় যদ্বারা কতকটা অলৌকিক ঘ্টনা প্রকাশ পায়। কাফের ও বেদায়াতীদের নিকট হইতে এরূপ কোন কিছু প্রকাশ হইলে, উহাকে শয়তানের ভেলকী বলিয়া মনে করিবে।
ফকিরী বা বেলায়েতের মূল আমাদের হজরত নবী করিম (সাঃ)। সর্বপ্রথম ছাহাবাগণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও তাহার আছহাবাগণ সকলেই আমাদের আদি পীর ও মোরশেদ। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বলিয়াছেন: আমার ছাহাবাগণ তারকারাজির ন্যায়, তন্মধ্যে যাহারই পায়রবী করিবে, তোমরা হেদায়েত ও সৎপথ প্রাপ্ত হইবে। আছহাবগণ সকলেই শরীয়ত ও তরীকতের শিক্ষাদাতা ছিলেন। তারপর যুগে যুগে বহু বড় দরজার অলীগণ এই দুনিয়াতে আসিয়াছিলেন। তন্মধ্যে হজরত ছৈয়দ মুহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (রাঃ), হজরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী (রাঃ), হজরত খাজা বাহাউদ্দিন নক্শবন্দ (রাঃ), হজরত শেখ আহমদ ফারুকী ছেরহেন্দী মোজাদ্দেদ আল্ফেছানী (রাঃ), হজরত সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলবী (রাঃ) প্রভৃতি অতি উঁচু দরজার অলী ছিলেন এবং প্রত্যেকেই এক এক তরিকার প্রবর্তক ছিলেন। তাঁহাদের ও অন্যান্য বড় দরজার অলীগণের রীতিনীতি কার্যকলাপ তন্ন তন্ন করিয়া আলোচনা করিয়া দেখিলে কোথায়ও শরীয়ত বা রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) – এর ছুন্নতের বিপরীত এক বিন্দুবিসর্গও দৃষ্টিগোচর হয় না। ভুলবশতঃ শরীয়তের খোলাপ কোন কাজ প্রকাশ হইয়া পড়িলে তৎক্ষণাৎ তাঁহারা তওবা করিয়া ফেলিতেন। প্রকৃত প্রস্তাবে মা’রেফাতের সহিত শরীয়ত বা ছুন্নতের কোনও গরমিল নাই। আজ বহু ভন্ড দাগাবাজ বেশরা ফকিরগণ এই কথা ঘোষণা করিয়া বেড়ায় যে, তাহারা মারফতী দলের লোক শরীয়তের সঙ্গে কোন সংশ্রব রাখে না। মুসলমান! এই প্রকার লোকের ধোকায় পড়িয়া অমূল্য ঈমান হারাইয়া বসিবেন না। ঈমান চলিয়া গেলে, আপনারা দ্বীন্ ও দুনিয়া সবই হারাইবেন। আখেরাতের জন্য শুধু বাকী থাকিবে অন্তত দুঃখ-কষ্ট ও অসহ্য দোজখের আজাব। শরীয়ত ও সুন্নতের বরখেলাপ চলনেওয়ালা পীর ভন্ড, দাগাবাজ এবং শয়তানের চেলা। কোন নামধারী পীর বা ফকীরকে শরীয়তের মাত্র একটি খেলাপ কাজ করিতে দেখিলে তাহাকে তৎক্ষণাৎ বর্জন করুন, সে ফাছেক। হাদীছে আছে: যে ব্যক্তি ফাছেককে তাজিম করিবে সে ইসলাম হইতে খারিজ হইয়া যাইবে।
অতএব, ভাই মুসলমানগণ, আপনারা উক্ত প্রকার দাগাবাজ বেশরা পীর হইতে নিজদিগকে সাবধান রাখিবেন এবং কোশেশ করুন ও দয়াময় আল্লাহ্তায়ালার নিকট মোনাজাত করুন, যেন তিনি সকলকেই পীরে কামেলের পরিচয় পাইবার জন্য জ্ঞান দান করুন।
আল্লাহুম্মা রাব্বা সাইয়িদিনা মুহাম্মাদিন আরিনী ওয়াজহা সাইয়িদিনা মুহাম্মাদিন হালান ওয়া মালা।