সাম্রাজ্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রচার করে যে, ইসলাম প্রচারিত হয়েছে তরবারির জোরে। এ দাবি স্বকপোলকল্পিত এবং বিদ্বেষ-দোষে দুষ্ট। অমুসলিমের হৃদয়ে ইসলাম ও মুসলিমের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এই অপপ্রচার। নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভংগি, পক্ষপাতহীনঅনুসন্ধিতসা এবং বৈজ্ঞানিক নিরিখের মাধ্যমে ইসলামের প্রসারকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, ইসলাম প্রচারিত হয়েছে তার অনন্য শান্তিকামী আদর্শের জন্য এবং তার আদর্শ-বান শান্তিকামীমাহাত্মা সূফী ধর্মপ্রচারকদের জন্য।O. Learly and De Lacyলিখেছেন,"ইতিহাসে এটি সুস্পষ্ট যে,ধর্মান্ধমুসলমানরা বিশ্বের সর্বত্র ঝড়ের বেগে ছুটে গেছেন,ভূখন্ড দখল করেছেন এবংদখলিকৃতভূখন্ডে তরবারির জোরে ইসলাম গ্রহনেজনসমষ্টিকে বাধ্য করেছেন-ঐতিহাসিকদের বারে বারে উচ্চারিত এই
কিংবদন্তি সর্বাপেক্ষা অবিশ্বাস্য ও অসত্য" [ তথ্যসূত্রঃ Islam atthe Crossroads - O. Learly and De Lacy- পৃনং ৮]।

বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের অভিযোগ :সম্প্রতি বিজেপিরপশ্চিমবঙ্গীয় নেতা তথাগত রায় আনন্দবাজার পত্রিকায় ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে যুক্তি দিয়েছেন যে, “ কিন্তু শিরোনামের বিষয়টি সম্বন্ধে আর একজন মার্কিন পন্ডিত, মূলত ইতিহাসবিদ, দার্শনিকও, কি বলেছেন দেখা যেতে পারে। তাঁর নাম উইল ডুরান্ট। তাঁর ও তাঁর স্ত্রী এরিয়েল লিখিত ‘সভ্যতার কাহিনি’তে (১ম খন্ড, ১৬শ পরিচ্ছেদ) পড়ি : “ সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে সম্ভবত সবচাইতে নিষ্ঠুর কাহিনি হচ্ছে মুসলিমদের ভারত জয়......গজনীর মাহমুদ মথুরার মন্দির থেকে মনিমানিক্যখচিত স্বর্ন এবং রৌপ্যমূর্তি সমেত বিশাল পরিমান সনা রুপা ও হিরে-জহরত তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তারপর মন্দির পুড়িয়ে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন......সুলতান মহাম্মদ বিন তুঘলকের (যাঁকে আমরা শুধু এক খামখেয়ালি রাজা বলে জানি) রাজসভার সামনে হিন্দুদেরমৃতদেহের পাহাড় জমে থাকত”। তাঁর পুত্র ফিরুজ শাহ তুঘলকের রাজত্বের ইতিহাস ‘তারিখ-ই-ফিরুজশাহ’ তে আছে, হিন্দুদের জিজিয়া কর দিতে হত এবং মন্দির নির্মানের শাস্তি ছিল গ্রামকে গ্রাম গনহত্যা” [তথ্যসূত্রঃআনন্দবাজার পত্রিকা- সম্পাদক সমীপেষু- কেন সবাই ধর্ম বদলাননি – ১০ই মার্চ, ২০১৫]
ইতিহাসবিদপ্রোফেসর রাজকুমার চক্রবর্তী কর্তৃকতথাগত বাবুর অভিযোগের খন্ডন : বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের ভিত্তিহীন অভিযোগকে খন্ডন করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বারাসত সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রোফেসর রাজকুমার চক্রবর্তী‘ইতিহাসটা ঠিক করে জানা দরকার’ শীর্ষক নিবন্ধে প্রোফেসর রাজকুমার চক্রবর্তী লিখেছেন যে, “ তথাগত রায় তাঁর চিঠিতে (কেন সবাই ধর্ম বদলাননি, ১০-৩)উইল ও এরিয়েলডুরান্ট এর লেখা উদ্ধৃতি দিয়ে ইসলামের ভারতজয়ের নিষ্ঠুর ও কলংকজনককাহিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। ইতিহাস-চর্চার সঙ্গে যুক্ত একজন মানুষ হিসেবে বলি, উইল ডুরান্ট বড় মাপের পন্ডিত হলেও সিরিয়াসইতিহাসবিদ হিসেবে গন্য হন না। কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে কেউ তাঁর বই রেফার করেছেন বলেও শুনি নি। ভারতীয় ইতিহাস ও মধ্যযুগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কোনও ইতিহাসবিদের কাছ থেকেই এ ব্যাপারে প্রামান্যজ্ঞানলাভ করা যেতে পারে” [তথ্যসূত্রঃআনন্দবাজার পত্রিকা- সম্পাদক সমীপেষু- ইতিহাসটা ঠিক করে জানা দরকার- ২৩ই মার্চ, ২০১৫]। 
     ‘ইতিহাসটা ঠিক করে জানা দরকার’ শীর্ষক নিবন্ধে প্রোফেসর রাজকুমার চক্রবর্তী আরও লিখেছেন যে, “ইতিহাসবিদ মহলে বর্তমানে এটা স্বীকৃত সত্য যে দিল্লির মুসলিম শাষকেরা রাজনৈতিক উদ্যোগে গনধর্মান্তকরণের কোন কার্যক্রম গ্রহন করেন নি.........তথাগতবাবুর চিঠিতে ডুরান্টদের উদ্ধৃতিতে তাঁর (মহাম্মদ বিন তুঘলকের)  রাজসভার সামনে  ‘হিন্দুদেরমৃতদেহের পাহাড়’ জমেথাকার কথা বলা হয়েছে। খুন বিভ্রান্তিকর মন্তব্য। আসলে মহাম্মদ বিন তুঘলকেরশাষনামলেদিল্লিতে সাত বছর স্থায়ী ভয়ংকর এক দুর্ভিক্ষ হয়েছিল যাতে বহু মানুষ মারা যান। সুতরাং ‘মৃতদেহের পাহাড়’ মানেই ধর্মীয় গণহত্যা নয়”[তথ্যসূত্রঃআনন্দবাজার পত্রিকা- সম্পাদক সমীপেষু- ইতিহাসটা ঠিক করে জানা দরকার- ২৩ই মার্চ, ২০১৫]। 
ইসলাম যে কোনমতেই বলপূর্বক প্রচারিত হয় নি সে সম্পর্কে প্রোফেসর রাজকুমার চক্রবর্তী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছেন যে, “ধর্মান্তকরণ ও ইসলামের প্রসার প্রসঙ্গে বলা যায়, এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে অনুমাণভিত্তিক অনেক কথা চালু আছে। মনগড়া নানা ব্যাখ্যা অনেককে দিতে দেখি। কিন্তু এটা প্রমানিত সত্য, এ দেশে ইসলামের প্রসার শাষকের তরবারির জোরে হয়নি। ইসলামের প্রসার ঘটেছে প্রধানত নিঃশব্দে, শান্তিপূর্ণ ভাবে, আর এ ব্যাপারে সুফিসন্তদের একটা বিরাট ভূমিকা আছে” [তথ্যসূত্রঃআনন্দবাজার পত্রিকা- সম্পাদক সমীপেষু- ইতিহাসটা ঠিক করে জানা দরকার- ২৩ই মার্চ, ২০১৫]। 

স্বামী বিবেকানন্দরচমকপ্রদ মূল্যায়ন : ইসলাম যে বলপূর্বক প্রচারিত হয় নি সে সম্পর্কে অসাধারণ মূল্যায়ন করেছেন হিন্দু মনিষী স্বামী বিবেকানন্দ। ‘দেবতা ও অসুর’ প্রবন্ধে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছেন যে, “দেখা যাবে ইসলাম যেথায় গিয়েছে, সেথায় আদিম-নিবাসীদের রক্ষা করেছে। সে সব জাত সেথায় বর্তমান। তাদের ভাষা, জাতিয়ত্ব আজও বর্তমান। খ্রিস্টান ধর্ম কোথায় এমন কাজ দেখাতে পারে? স্পেনের আরব, অস্ত্রেলিয়ার এবং আমেরিকার আদিম-নিবাসীরা কোথায়? খ্রিস্টানেরা ইউরোপীয় ইহুদিদের কি দশা এখন করছে? এক দানসংক্রান্তকার্যপ্রনালী ছাড়া ইউরোপের আর কোন কার্যপদ্ধতি, গসপেলের অনুমোদিত নয় –গসপেলেরবির‍্যদ্ধেসমুত্থিত। ইউরোপে যা কিছু উন্নতি হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দ্বারা। আজ যদি খ্রিস্টানির শক্তি থাকত তাহলে ‘পাস্তের’ এবং ‘ককে’র ন্যায় বৈজ্ঞানিক সকলকে জীবন্ত পোড়াত এবং ডারুইন-কল্পদের শুলে দিত.........এর সঙ্গে ইসলামের তুলনা কর। মুসলমান-দেশে যাবতীয় পদ্ধতিইসলামধর্মের উপর সংস্থাপিত এবং ইসলামের ধর্মশিক্ষকেরা সমস্ত রাজকর্মচারীদেরবহুপুজিত এবং অন্য ধর্মের শিক্ষকেরাও সম্মানিত” [তথ্যসূত্রঃ‘দেবতা ও অসুর’ -স্বামী বিবেকানন্দ] 

     ‘দেবতা ও অসুর’ প্রবন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ আরও লিখেছেন যে, “এদিকে আবার আরব মরুভুমে মুসলমানি ধর্মের উদয় হল। বন্যপশুপ্রায় আব এক মহাপুরুষের প্রেরণাবলে অদম্য তেজে, অনাহত বলে পৃথিবীর উপর আঘাত করলে। পশ্চিম পুর্ব দুপ্রান্ত হতে সে তরঙ্গ ইউরোপে প্রবেশ করলে। সে স্রোতমুখে ভারত ও প্রাচীন গ্রিসেরবিদ্যাবুদ্ধি ইউরোপে প্রবেশ করতে লাগল............এদিকে মুর নামক মুসলমান জাতি স্পেন দেশে অতি সুসভ্য রাজ্য স্থাপন করলে, নানাবিদ্যার চর্চা করলে, ইউরোপে প্রথম ইউনিভার্সিটি হল; ইতালি, ফ্রান্স, সুদূর ইংলন্ড হতে বিদ্যার্থী বিদ্যা শিখতে এল; রাজা-রাজড়ার ছেলেরা যুদ্ধবিদ্যা আচার কায়দা সভ্যতা শিখতে এল”[তথ্যসূত্রঃ‘দেবতা ও অসুর’ -স্বামী বিবেকানন্দ] 

আনন্দ বাজার পত্রিকার মূল্যায়ন : বাংলা ভাষার সর্বাধিক জনপ্রিয় দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকায় এ সম্পর্কে লিখা হয়েছে যে, “ দারিদ্র্য ও সামাজিক অত্যাচারের সামনে ইসলামে ধর্মান্তরই এ দেশের প্রধান ধারা। অতীতেও। বর্তমানেও। সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের মেরঠ জেলার মোগা গ্রামের এক দলিত শ্যাম সিংহের ঘটনাটি আবার দেখাইয়া দিল, কী ভাবে সেই ট্র্যাডিশন আজও চলিতেছে...............শ্যাম সিংহের ঘটনাটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইহা দেখাইয়া দেয়, কেন বিগত হাজার বছর ধরিয়া দলিত-অনুসুচিত সম্প্রদায়ের হিন্দুরা জাতিভেদ প্রথার বৈষম্য, বঞ্চনা ও অসম্মান সহ্য করিতে না পারিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন”[তথ্যসূত্রঃআনন্দবাজার পত্রিকা- ১৬ই মার্চ, ২০১৫]

প্রিয় পাঠক ! সুবিখ্যাত ওলী শাইখ মঈনুদ্দিন চিশতিরাদিআল্লাহুআনহু ভারতবর্ষে প্রায় ৯০ লক্ষ লোককে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। তিনি কি কোন অস্ত্রের সাহায্য নিয়েছিলেন ? আলা হাযরাত ইমাম আহমাদরেযারাদিআল্লাহুআনহুর খলিফা শাইখ আব্দুল আলীম সিদ্দিকিরাদিআল্লাহুআনহু ত্রিনিদাদ, টোবাগো প্রভৃতি পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ সমূহে অসংখ্য লোককে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। তিনি কি কোন অস্ত্রের সাহায্য নিয়েছিলেন ?মনিষী অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় কি য যথার্থই না বলেছেন যে, “ আমাদের স্কুল-কলেজে ছাত্রদের যেসব ভ্রম প্রমাদপূর্ন ইতিহাস শেখানো হয় তার চরম ফল আত্মাবমাননা”! তিনি আরও বলেন যে, “ এক বিখ্যাত পুস্তক ব্যবসায়ী তাঁকে (অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়) কে দেশের ইতিহাসের মর্যাদা লংঘন করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্কুল-পাঠ্য ভারত ইতিহাস রচনার কাজে এক লক্ষ টাকা দিতে চাইলে তিনি তা ঘৃন্যভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এইভাবে তিনি স্বেচ্ছাদারিদ্র্য বরণ করে দেশের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। অপরপক্ষে কবি নবীনচন্দ্র সেন ও বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ঐতিহাসিক বিকৃতি করায় তিনি তাদের তীব্র ভাষায় অভিযুক্ত করেন”  [তথ্যসূত্রঃ দেশ – বৈশাখ, ১৩৭৩]




Top