হজ্ব কি ?
হজ কি? কে কখন পালন করবেন- বদলী, অতি বৃদ্ধ ও শিশুর হজের বিধান কী ?

‘হজ’ আরবী শব্দ। অভিধানে এর অর্থ: ইচ্ছা করা, সংকল্প করা, পরিকল্পনা করা। এছাড়া যিয়ারাহ বা সাক্ষাত করা, মহান বন্তুর প্রতি ইচ্ছা করা অর্থেও শব্দটির ব্যবহার রয়েছে। নেহায়া গ্রন্থকারের মতে, হজ অর্থ, যে কোন কিছু করার ইচ্ছা।
পারিভাষিক অর্থে হজ হচ্ছে: ইসলামের একটি অন্যতম ইবাদাত তথা মৌল বুনিয়াদ সম্পন্ন করার জন্য বায়তুল্লাহ যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করা। `শরহে বেকায়াহ’ গ্রন্থকার হজের সংজ্ঞায় বলেছেন, হজ হলো নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থান অথ্যাৎ বায়তুল্লাহ যিয়ারাত করা।
অতএব মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজের মাধ্যমে কোরআন হাদীসের নির্দেশনা অনুযায়ী বায়তুল্লাহ যিয়ারাতের জন্য মক্কা গমনকে হজ বলে।
হজ ফরজ
হজ ফরজ। ইসলামের পাঁচটি রোকন বা স্তম্বের মধ্যে পঞ্চম। কোরআন হাদীসে হজ ফরজ হওয়ার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে (সুরা আল ইমরান: আয়াত-৯৮, বাকারাহ: আয়াত-১৯২)। এছাড়া এতে মুসলমান সর্বসাধারনের ইজমাও রয়েছে। নবী করীম সা. থেকে এ পর্যন্ত হজ ফরজ হিসেবে পালন হয়ে আসছে। ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী হজ অস্বীকার কিংবা একে অন্য নামে আখ্যায়িত করা কুফরীর পর্যায়ে পড়বে।
কাবাঘর যিয়ারাতের মাধ্যমে হজ পালনের নিয়ম আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। ইসলামে হজ ফরয হওয়ার আগে ভিন্ন যুগে বিভিন্ন নিয়ম-রীতিতে হজ পালিত হয়েছে। রাসুলও (সা.) আগে কোরাইশদের রীতি অনুযায়ী হজ পালন করেছেন বলে কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায়। ইসলাম পূর্বযুগে কাবাঘরে যেমন মুর্তি স্থাপন করা হয়েছিল তেমনি হজকে ঘিরেও নানা কুসংস্কার ছিল। এমনকি উলঙ্গ হয়ে কাবাঘর তাওয়াফের প্রচলনও ছিল বলে ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়া যায়।
কখন ফরজ হয়
ইসলামে হজ কখন ফরজ হয় তা নিয়ে ইমামদের মধ্যে কিছুটা মতভেদ আছে। আলেমদের একটি অংশের মতে, রাসুল (সা. ) এর হিজরতের আগেই হজ ফরজ হয়। তবে পরিবেশ না থাকায় তখন সেটা বাস্তবায়ন হয়নি।
অধিকাংশ ইসলামী বিশেষজ্ঞ মতে, হিজরতের পরে হজ ফরজ হয়। হিজরতের পর কখন ফরজ হয় তা নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে। সূরা আল ইমরানে হজ ফরজ হওয়ার বিধান সম্বলিত আয়াত নাজিলের সময় হিসেব করে অনেকে বলেছেন, হজ ফরজ হয়েছে রাসুল সা; এর মদীনা হিজরতের নবম সালের শেষ ভাগে। এই আয়াতটি নবম হিজরিতে নাজিল হয়। তখন রাসুল (সা. ) হজরত আবু বকর (রা. ) কে আমিরুল হজ নিয়োগ করে মক্কায় পাঠান। ইমাম নববী, কাজী আয়ায, কুরতুবী, ইমামুল হারামাইন, ইবনুল জুযী প্রমুখ এই অভিমত দিয়েছেন। পরবর্তী বছর দশম হিজরিতে তিনি নিজে হজ আদায় করেন। এটিই রাসুলের জীবনের একমাত্র হজ যা বিদায় হজ নামে পরিচিত।
আল্লামা রাফেয়ীসহ একদল আলেমের মতে, ৬ষ্ঠ হিজরীতে হজ ফরজ হয়। তাদের যুক্তি এবছর রাসুল (সা.) হজ করতে র ম্ক্কা ওয়ানা হন এবং পথে কুরাইশদের বাধার মুখে পড়ে হুদায়বিয়া নামক স্থানে সন্ধি করে মদীনায় ফিরে যান। ৭ম হিজরিতে তা কাযা আদায় করেন। যারা এ মত সমর্থন করেননি তাদের মতে, এটি হজ ছিলনা। ওমরাহ ছিল।
আল্লামা ওয়াকেদীর মতে, হজ ৫ম হিজরিত ফরজ হয়েছে। হজরত যিযাম বিন ছা’লাবা ৫ম হিজরিতে মদীনা আগমন করে মহানবী (সা.) কে হজ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। এছাড়া ৭ম ও অস্টম হিজরিতেও হজ ফরজ হয়েছে মর্মে মতামত আছে। ৮ম হিজরির রমজান মাসে মক্কা বিজয় হয়। তখন হযরত আত্তাব বিন আসীদ রা. মক্কার গভর্ণর নিয়োগ করা হয় এবং হজ্বেয মাসে তাকেই আমীরুল হজ্ব নিয়োগ দেয়া হয়।
হজ্ব কার ওপর ফরজ
নেসাব পরিমান মালের অধিকারির ওপর যেমন যাকাত ফরজ তেমনি হজে যাওয়ার আর্থিক ও শারীরিকক ক্ষমতা রাখেন এমন প্রাপ্ত বয়স্ক স্বাধীন মুসলমানের ওপর একবার হজ করা ফরজ। নামাজ রোজার মতো সবার ওপর হজ ফরজ নয়।
ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ হজ্ব ফরজ হওয়ার ৮টি শর্তের উল্লেখ করেছেন।
১. মুসলমান হতে হবে। যেহেতু এটা ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদাত
২. স্বাধীন হতে হবে। তাই দাস-দাসীর ওপর হজ্ব ফরজ নয়। এ ব্যাপারে হাদীস রয়েছে। রাসুল ( সা.) বলেছেন, কোন দাস-দাসী যদি হজ্ব করে এবং সেটা যদি সে দশবারও করে তারপর সে যখন মুক্তি পায় তাকে আবার হজ্ব করতে হবে। তবে আমাদের দেশের প্রচলিত কর্মচারি কিংবা চাকররা দাসের পর্যায়ে পড়বেনা।
৩. ব্যক্তি শরীয়তের বিধান প্রয়োগযোগ্য বা প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে। বালক-বালিকার ওপর হজ্ব ফরজ নয়। এ ব্যাপারেও হাদীস রয়েছে। ইবনে আব্বাস রা; এর বর্ণনায় এসেছে, কোন বালক-বালিকা হজ পালন করার পর প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তাকে তাকে পুনরায় হজ্ব করতে হবে।
৪. সুস্থ্য হতে হবে। রুগ্ন ব্যক্তির ওপর হজ্ব ফরজ নয়।
৫. সুস্থ্য মস্তিস্ক সম্পন্ন হতে হবে। যেমন হাদীসে এসেছে, তিন ধরণের লোকের ওপর শরীয়তের বিধান প্রযোজ্য হবেনা -বালক যতক্ষন না প্রাপ্ত বংস্ক হয়, অসুস্থ্য মস্তিস্ক সম্পন্ন যতক্ষন না সে সুস্থ্য জ্ঞানে ফিরে এবং ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষন না সে জাগ্রত হয়।
৬. সামর্থবান হওয়া। হজ্ব করে ফেরা পর্যন্ত পরিবারের ভরন পোষনের ব্যয় নির্বাহ করার মতো অতিরিক্ত টাকা থাকলে এবং সে টাকায় হজ্বের ব্যয় বহন করা গেলে তবেই হজ্ব ফরজ হবে। কারণ পবিত্র কোরআনে পরিস্কারভাবে সামর্থ থাকার কথা বলা হয়েছে।
৭. হজ্বে যাওয়ার রাস্তা নিরাপদ হওয়া। যাত্রাপথে বিপদ হতে পারে এমন ব্যক্তির ওপর হজ্ব ফরজ নয়।
৮. নারীর সাথে তার স্বামী বা মুহরিম (যাদের সথে বিবাহ বৈধ নয়) থাকা। যদি তার ওপর মুসাফিরের হুকুম প্রযোজ্য হয় অথ্যাৎ ৪৮ মাইল বা তার বেশী দূরে হয়।
সম্মিলিতভাবে এসব শর্ত পাওয়া গেলেই হজ্ব ফরজ হবে।
হজ্ব ফরজ হওয়া মাত্র আদায় করতে হবে?
হজ্ব ফরজ হওয়া মাত্র আদায় করতে হবে নাকি দেরিতে অথ্যাৎ সুবিধাজনক সময় আদায় করা যাবে- এ নিয়ে ইসলামী শরীয়ত বিশেষজ্ঞ তথা ইমামদের দুই ধরনের মত রয়েছে।
প্রথম মত হচ্ছে: হজ্ব ফরজ হওয়ার সাথে সাথে আদায় না করে দেরিতে আদায় করার অবকাশ আছে। এই মত দিয়েছেন ইমাম আবু হানিফা, শাফে’ঈ, সুফিয়ান সওরী। তাদের যুক্তি-প্রমাণ হচ্ছে- ইসলামে হজ ফরজ হয়েছে ৬ষ্ঠ কিংবা নবম হিজরিতে। আর রাসুল (সা.) হজ আদায় করেছেন দশম হিজরিতে। এর দ্বারা দেরিতে আদায়ের সুযোগ থাকার প্রমাণ হয়। আরেক যুক্তি হচ্ছে-নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে যেমন এক ওয়াক্তের মধ্যে আগে পরে আদায় করা যায় তেমনি হজ্ব জীবনের যে কোন সময়ে আদায় করা যাবে। এসব ইমামদের আরেকটি যুক্তি হচ্ছে- হজ্ব ফরজ হওয়ার আয়াতে যে নির্দেশসূচক বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে তাতে সাধারণ নির্দেশ বুঝা যায়, যার ফলে তাৎক্ষনিকভাবে পালনীয় বুঝা যায় না। যে হাদীসে বলা হয়েছে- ‘যে হজ পালনের ইচ্ছা করে (ফরজ হওয়ার পর) সে যেন তা দ্রুত সম্পন্ন করে।’ তাতে সাথে সাথে আদায়ের নির্দেশ নয়, দ্রুত হজ পালনে উৎসাহিত করা হয়েছে বলে এই ইমামগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
দ্বিতীয় মত: হজ ফরজ হওয়ার সাথে সাথেই আদায় করতে হবে। ইমাম মালিক, আহমদ, আবু ইউসুফ এই মত দিয়েছেন। তাদের যুক্তি- রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে হজ পালনের ইচ্ছা করে (ফরজ হওয়ার পর) সে যেন তা দ্রুত সম্পন্ন করে।’ তাদের আরেক যুক্তি হচ্ছে- যেহেতু মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা নেই । যে কোন মূহুর্তে মৃত্য হয়ে যেতে পারে। সে জন্য দেরি না করে সাথে সাথে আদায় করতে হবে।
বদলী হজ: একজনের হজ আরেকজনের আদায়
বদলী হজ অথ্যাৎ একজনের হজ আরেকজন আদায় করার বর্ণনা হাদীসে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে প্রথম ব্যক্তির ওপর হজ ফরজ হওয়ার পর তিনি হজ পালন করতে সম্পূর্ণভাবে অক্ষম হলে দ্বিতীয় ব্যক্তির হজের সকল খরচ বহন করে হজ আদায় করাতে পারবেন। এছাড়া কোন ব্যক্তি মৃত্যুকালে ওসিয়ত করে গেলে সেই হজ অন্যকে দিয়ে আদায় করানো উত্তরসূরীদের ওপর ওয়াজিব। যদি ওসিয়ত না করে যান অথচ তার ওপর ফরজ ছিল কিন্তু আদায় করে যেতে পারেনি তাহলে সন্তান -সন্ততির ওপর তার হজ আদায় করানো উত্তম ।
বদলী হজের বিধানের ব্যাপারে কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায়, যদি কোন ব্যক্তির অক্ষমতা মৃত্যূ পর্যন্ত বহাল থাকে তখন ফরজ হজ তার মৃত্যুর পর অন্য কেউ আদায় করবে। কারণ মৃত্যুর পুর্ব পর্যন্ত তার ক্ষমতা ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে।
আর নফল হজের ক্ষেত্রে যে কোন সময় অন্য লোক তা আদায় করতে পারে যদিও ব্যক্তি জীবিত থাকে কিংবা তার ক্ষমতাও থাকে। বদলী হজ করার অনুমতির ব্যাপারে হাদীস:
১. আবু রাজিন আল আকিলি থেকে বর্ণিত। তিনি এসে রাসুল (সা. )কে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার পিতা খুব বৃদ্ধ তিনি হজ ও ওমরা করতে সমর্থ নন। সওয়ারির ওপর উঠেও চলতে পারেননা। রাসুল সা. বললেন, তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ ও ওমরাহ করো। ( তিরমিযি হাদীস নং ৮৫২)
২. হযতর ইবনে আব্বাস রা, বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.)এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন ‘শুবরামার পক্ষ থেকে লাব্বায়িক’। তিনি বলেন, শুবরামা কে? লোকটি বললেন, আমার ভাই বা আত্বীয়। তিনি বলেন, তুমি কী নিজের হজ করেছ? লোকটি বললেন, না। তিনি বললেন, আগে নিজের হজ করো। পরে শুবরামার হজ করো। (আবু দাউদ-১৪২৪)
৩. হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন, একদা খাসআম গোত্রের এক মহিলা জিজ্ঞেস করলো, হে রাসুল্লাহ (সা. )আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হজ ফরজ হয়েছে তা আমার পিতার ওপর বর্তিয়েছে অথচ তিনি অতি বৃদ্ধ ,সওয়ারীর ওপর স্থির হয়ে বসার ক্ষমতা নেই। আমি কী তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করতে পারি? তখন রাসুল স. বললেন, হ্যাঁ। বর্ণনাকারি বলেন, এটি বিদায় হজের ঘটনা। (বোখারী- ১৪১৭)
অতি বৃদ্ধের ওপর হজ ফরজ কিনা?
যেহেতু হজ ফরজ হওয়ার শর্তের মধ্যে সামর্থ থাকার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেহেতু অতি বৃদ্ধ সম্পদশালী মুসলমানের ওপর হজ ফরজ হবে কিনা- প্রশ্ন আসে। এটিকে অনেকে জটিল প্রশ্ন আখ্যায়িত করেছেন। এতে তিন ধরনের মত পাওয়া যায়।
এক. যদি কারো ওপর সামর্থ থাকা অবস্থায় হজ ফরজ হয় এবং সেটা তিনি আদায় না করে থাকেন পরে তিনি অতি বার্ধক্যের কারণে তা আদায়ে অসমর্থ হন অথ্যাৎ হজে যাওয়া ও হজের কার্যাদি সমপন্ন করার শারীরিক ক্ষমতা না রাখেন তাহলে তিনি কারো মাধ্যমে বদলী হজ করাবেন। অথবা ওসিয়ত করে যাবেন। ইমাম আবু হাদীফাসহ অধিকাংশ আলেমের মত এটি। এই মত অনুসারে দাঁড়াতে অক্ষম, খোঁড়া, বৃদ্ধ, যানবাহনে বসতে অসমর্থ- এ ধরনের ব্যক্তির ওপর হজ ফরজ হয়না এবং অন্যের মাধ্যমে আদায় করানোরও কোন প্রয়োজন নেই। কোরআনের আয়াতই তা প্রমাণ করে। কারণ: মূলত: তারা অক্ষম। আয়াতে সামর্থ দ্বারা আর্থিক সামর্থের পাশাপাশি শারীরিক সামর্থও বুঝানো হয়েছে বলে এই ইসলামী বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
দুই. কোরআনের আয়াতের আলোকে কোন কোন মনীষী বলেন, অচল ও অতি বৃদ্ধের ওপর হজ ফরজ নয়। তা আগে ফরজ হোক বা পরে হোক। ফলে বদলী হজ বা অসিয়তের প্রয়োজন নেই।
তিন: ইমাম শাফে’ঈ, আহমদ ও আবু ইউসুফের মতে, খোড়া, অচল, পা কর্তিত ইত্যাদি অবস্থায়ও হজ ফরজ হয়। ফলে তার পক্ষ থেকে বদলী হজ আদায় করা যাবে। অথবা তিনি অসিয়ত করে যাবেন। তাদের প্রমান হচ্ছে- বোখারি ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত একটি হাদীস- হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস বলেন, একদা খাসআম গোত্রের এক মহিলা জিজ্ঞেস করলো, হে রাসুল্লাহ সা. আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হজ ফরজ হয়েছে তা আমার পিতার ওপর বর্তিয়েছে অথচ তিনি অতি বৃদ্ধ, সওয়ারীর ওপর স্থির হয়ে বসার ক্ষমতা নেই। আমি কী তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করতে পারি? তখন রাসুল স. বললেন, হ্যাঁ। বর্ণনাকারি বলেন, এটি বিদায় হজের ঘটনা। (বোখারী- ১৪১৭)
ইমাম আবু হানিফাসহ অন্যান্য আলেমগণও এই হাদীসকে তাদের মতের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, কোরআনের বর্ণনা আর এই হাদীসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ এই মহিলার পিতার ওপর হজ ফরজ হয়েছিল সুস্থাবস্থায়। পরে তিনি অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। এ জন্য তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে। যদি অক্ষম হওয়ার পর ফরজ হতো তাহলে বদলী হজ করার প্রয়োজন পড়তোনা।
নিজের হজ না করে বদলী হজ করা যাবে কিনা?
শুবরামার হাদীস- ‘হযতর ইবনে আব্বাস রা, বর্ণনা করেন, রাসুল সা. এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন ‘ শুবরামার পক্ষ থেকে লাব্বায়িক’। তিনি বলেন, শুবরামা কে? লোককটি বললেন, আমার ভাই বা আত্বীয়। তিনি বলেন, তুমি কী নিজের হজ করেছ? লোকটি বললেন, না। তিনি বললেন, আগে নিজের হজ করো। পরে শুবরামার হজ করো। (আবু দাউদ-১৪২৪)’ থেকে বুঝা যায় নিজের হজ আদায় করার পরই অন্যের পক্ষ থেকে হজ আদায় করতে হবে। এই হাদীসের আলোকে ইমাম শাফে’ঈ ও আহমদ বলেন, নিজের হজ না করে বদলী হজ যায়েজ নয়।
তবে ইমাম আবু হানীফার মতে, নিজের হজ না করেই বদলী হজ করা যায়েজ, তবে উত্তম নয়। তার মতে হাদীসে উত্তমতার কথা বুঝানো হয়েছে আবশ্যকতার কথা নয়।
তাছাড়া বদলী হজের ব্যাপারে অপর দুই হাদীস ‘হজযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস বলেন, একদা খাসআম গোত্রের এক মহিলা জিজ্ঞেস করলো, হে রাসুল্লাহ সা. আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হজ ফরজ হয়েছে তা আমার পিতার ওপর বর্তিয়েছে অথচ তিনি অথচ তিনি অতি বৃদ্ধ সওয়ারীর ওপর স্থির হয়ে বসার ক্ষমতা নেই। আমি কী তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করতে পারি? তখন রাসুল স. বললেন, হ্যাঁ। বর্ণনাকারি বলেন, এটি বিদায় হজের ঘটনা।’
‘আবু রাজিন আল আকিলি থেকে বর্ণিত। তিনি এসে রাসুল সা. কে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার পিতা খুব বৃদ্ধ তিনি হজ ও ওমরা করতে সমর্থ নন। সওয়ারির ওপর উঠেও চলতে পারেননা। রাসুল সা. বললেন, তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ ও ওমরাহ করো।’ এ খাসআম গোত্রের মহিলাকে রাসুল সা. নিজের হজ করেছে কিনা জিজ্ঞেস করেননি। সরাসরি তার পিতার পক্ষ পক্ষ থেকে হজ করতে বলেছেন। আর এটি বিদায় হজের ঘটনা হওয়ায় এটিই সর্বশেষ ঘটনা। আর শুবরামার হাদীসের ঘটনা অনেক আগের। আবু রাজিল আল আকিলির হাদীসেও নিজের হজ করার কথা বলা হয়নি। ইমাম মালেকও এই মত পোষন করেছেন।
পুরুষের পক্ষে নারী ও নারীর পক্ষে পুরুষের হজ
নারী পুরুষ একে অপরের হজ আদায় করতে পারবে। বদলী হজ সংক্রান্ত সব হাদীস থেকেই এটি পরিস্কার। খাসআম গোত্রের মহিলা তার পিতার প্রতিনিধি হয়ে হজ আদায়ের অনুমতি পান। আবার আরেক হাদীসে এসেছে- ‘হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবী সা. এর কাছে এসে বললো, আমার বোন হজ মরার মানত করেছিলেন। কিন্তু তা আদায় করার আগেই তিনি মারা গেছেন। তখন নবী করীম সা. বললেন, যদি তার ওপর কারো ঋণ থাকতো তবে তুমি তা আদায় করতে কিনা? সে বললো, নিশ্চয় আদায় করতাম। তখন তিনি বললেন, তবে আল্লাহর ঋণ আদায় করো। তা অধিক পরিশোধযোগ্য।’
তবে কোন কোন ইমাম বলেন, কোন মহিলা অন্য কোন পুরুষের পক্ষে হজ আদায় জায়েজ নেই। কারণ ইহরাম অবস্থায় মহিলা এমন পোশাক পরিধান করে যা পুরুষের জন্য জায়েজ নেই। এর জবাবে আগের আলেমগণ বলেন, প্রতিনিধি সার্বিকভাবে অসলের অনুরূপ হয়না।
শিশুর হজ
শিশুর হজের ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে।
ইমাম মালেক শাফেঈ আহমদ ও অধিকাংশ আলেমের মতে, শিশুর হজ শুদ্ধ হবে। প্রাপ্ত বয়স্কদের হজ পালনে যেসব বিধি বিধান মানতে হয় শিশুদের বেলায়ও তা প্রযোজ্য হবে। তবে ইসলামে ফরজ হজ আদায়ের জন্য এই হজ যথেষ্ট হবেনা। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর যদি তার হজ করার সামর্থ হয় তাহলে তখন তাকে পুনরায় হজ করতে হবে। হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত মুসলিম শরীফের একটি হাদীস এই মতের পক্ষে দলীল। সেটি হচ্ছে- ‘রাসুল সা.(হজে যাওয়ার পথে) রাওহা নামক স্থানে এক উট আরোহী দলের সাক্ষাত পেলেন। জানতে চাইলেন, তারা কারা। তারা বললো, আমরা মুসলমান। এরপর তারা জিজ্ঞেস করলে, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসুল। এটি শুনে এক মহিলা তার দিকে একটি শিশুকে তুলে বললো, এর কী হজ হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে এর জন্য সে সওয়াব পাবে।
তবে হানাফী মাযহাবের ইমামদের মতে, শিশুর হজ শুদ্ধ নয়। কারণ শিশুর ইহরাম বাঁধাই শুদ্ধ নয়। তারা ইহরামের যোগ্যই নয়। সুতরাং হাদীসে বর্ণিত `হ্যাঁ’ অর্থ তাকে অভ্যাস করানো মাত্র।
ইমাম হাকেম তার মুস্তাদরাক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম স, বলেছেন, কোন শিশু দশবার হজ করে থাকলেও বয়;প্রাপ্ত হওয়ার পর ইসলামের ফরজ হজ তাকে আদায় করতে হবে। মোট কথা শিশুর হজ নফল হিসেবে আদায় হবে। যদি নিজে আদায় করার মতো বুদ্ধি বিবেক না থাকে তবে তার সব কাজ অভিভাবক আদায় করবে।
Top