নাহমাদুহু লিল্লাহি আযযা ওয়া জাল্লা ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু সিরাজুম মুনির।। আম্মা বা'দঃ-
রমযানের গুরুত্ব:
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “রমযানের আগমনে জান্নাতের দরজাগুলোকে খুলে দেয়া হয়”। রমযানে অধিক পরিমাণে ভাল কাজ করে জান্নাতের নিকটবর্তী হওয়া যায়। রমযানে সিয়াম পালনের মাধ্যমে পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ করিয়ে নেয়ার চমৎকার সুযোগ আসে। আবু হুরায়রা (রা)রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে উদ্ধৃত করেছেন: “যে রমযানে বিশুদ্ধ বিশ্বাসের সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান লাভের আশায় সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন।”
তেমনি তিনি (সা:) বলেছেন: ঈমান সহকারে রমযানে রাতে যে কিয়াম করবে (রাতে সালাত আদায় করবে), তার অতীতের সমস্ত গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেবেন। একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মিম্বরে ওঠার সময় তিনবার আমিন বলেন। পরবর্তীতে তিনি ব্যাখ্যা করেন, জিবরীল (আঃ) এঁর তিনটি প্রার্থনার উত্তরে তিনি আমিন বলেন। তার মধ্যে একটি দুআ ছিল, যার ওপর রমযান আসে এবং চলে যায় অথচ তার গুনাহ মাফ হয় না, সে ক্ষতিগ্রস্ত/লাঞ্চিত হোক। বিশুদ্ধ নিয়তে সিয়াম পালন করলে মন্দের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আত্মিক শক্তি অর্জিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: “রোযা ঢাল স্বরুপ”. একান্তভাবে আলল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য রোযা পালনকারীর জন্য বিশেষ পুরস্কার রয়েছে। একটি হাদীসে কুদসীতে এসেছে আল্লাহ বলেন: “আদম সন্তানের সকল কাজই তার নিজের জন্য, সিয়াম ব্যতীত। এটা শুধুই আমার জন্য, এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।”
রমযানের এইরূপ মর্যাদার প্রধান কারণ হচ্ছে এই মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে, যা স্রষ্টার পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ এবং পৃথিবীতে বিদ্যমান একমাত্র অপরিবর্তিত কিতাব। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন: “রমযান মাস সেই মাস, যে মাসে মানবজাতির জন্য পথনির্দেশ স্বরুপ কুরআন নাযিল করা হয়েছে। এতে রয়েছে সত্য পথ প্রদর্শনের জন্য বিশুদ্ধ শিক্ষা এবং (সত্য থেকে মিথ্যাকে পার্থক্য করার) মানদন্ড।” [সূরা আল বাক্বারাহ, ২:১৮৫]
কুরআন নাযিল মানবজাতির প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সর্ববৃহৎ অনুগ্রহ, যে মানবজাতি এর পূর্ববর্তী ওহী নাযিল হওয়ার পরবর্তী সময় থেকে নিয়ে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল। তাঁর দয়া নিঃসৃত এই অনুপম অনুগ্রহ ছাড়া হেদায়েতের স্তিমিত-প্রায় আলোটুকুও হারিয়ে যেত এবং গোটা মানবসমাজে প্রতিষ্ঠা হত অন্যায়ের রাজত্ব।
সিয়ামের উদ্দেশ্য:
রোযার মূল লক্ষ্য তাকওয়া (আল্লহ-ভীতি এবং তাঁর সম্পর্কে সচেতনতা) অর্জন। যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনুল কারীমে উল্লেখ করেছেন: “যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” [সূরা আল বাক্বারাহ, ২ : ১৮৩]
তাকওয়া সর্বোচ্চ নৈতিক গুণগুলোর একটি, তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে একজন মুসলিম আল্লাহর ক্রোধ এবং নিজের মাঝে একটি ঢাল তৈরী করতে পারে। তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহর সমস্ত আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকা, অর্থাৎ হারাম পরিহার করা, মাকরূহ পরিহার করা এবং এমনকি সন্দেহের অবস্থায় হালালও পরিত্যাগ করা। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা এটাও পরীক্ষা করে দেখেছেন যে রোযা বহুভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। যেমন এ সময় শরীরে সঞ্চিত অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ব্যবহৃত হয়। এভাবে রোযা শরীরকে সবল রাখে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
বর্তমান মুসলিম সংস্কৃতিতে রোযা:
বর্তমান মুসলিম সংস্কৃতিতে রোযা ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা এবং সংযমের পরিবর্তে পরিণত হয়েছে উৎসবের মাসে! রমযানের রাতগুলি পরিণত হয় পার্টি এবং ভোজের রাত্রিতে যা কিনা কোন কোন দেশে ভোর পর্যন্ত চলে। সেখানে রাত পরিবর্তিত হয় দিনে, দিন পরিবর্তিত হয় রাতে (বহু মানুষই রোযার সময়টুকু ঘুমিয়ে কাটায়)। সাধারণতঃ সেহেরীতে মানুষ হালকা খাবারের বদলে পেট ভরে খায়। ফলে রোযা অবস্থায় খুব কম মানুষই প্রকৃত ক্ষুধার তাড়না বোধ করে। আবার ইফতারীতে আরেক দফা ভরপেট খাওয়া চলে, সেই সাথে রয়েছে রকমারী খাবারের আয়োজন। ফলে অনেকেই রমযান শেষে ওজন বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ করে!
মুসলিম চরিত্রে সাওমের কাঙ্খিত প্রভাব: রমযানের শিক্ষাসমূহ
রমযানের সময়কাল অনেকটা বিদ্যালয়ের মত, যে সময়টিতে শেখার মত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। কোন কারণে নামায ছুটে গেলে আমরা তা পরবর্তীতে আদায় করে নিতে পারি, কিংবা রোযাও পরবর্তীতে রাখতে পারি, কিন্তু রমযানের সময়টি সেরকম নয়, এ সময় যদি পার হয়ে যায় এমন অবস্থায় যে আমরা রমযানের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা গুলো নিতে পারলাম না, তবে তা বিরাট ক্ষতি।
প্রথম শিক্ষা: আল্লাহ সম্পর্কে সচেতনতা বা তাকওয়া সৃষ্টি
কুরআনের যে আয়াতে সিয়ামের আদেশ দেয়া হয়েছে, সে আয়াতেই এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে: “হে বিশ্বাসীগণ। তোমাদের জন্য সিয়াম পালনকে নির্ধারণ করা হল যেমনটি তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” [সূরা আল বাক্বারাহ, ২ : ১৮৩]
এই তাকওয়া আল্লাহ সম্পর্কে সচেতনতা, তাঁর উপস্থিতির উপলব্ধি, এবং এটা জানা যে তিনি আমাদের দেখছেন – যা আমাদেরকে ব্যক্তিগত জীবনে উন্নততর মানুষ হতে সাহায্য করবে। এই তাকওয়াকে আলী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন “আল্লাহর প্রতি ভয়, অল্পে সন্তুষ্টি এবং (পরবর্তী জীবনের পানে) যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে”। তাই ভয় তাকওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একদল লোক কেবল আল্লাহকে ভালবাসার কথা বলে থাকে এবং দাবী করে যে আল্লাহকে ভয় করে তাঁর ইবাদত করা ঠিক নয়, বরং তাঁকে শুধুমাত্র ভালবেসে ইবাদত করাটাই ঈমানের উন্নততর শর্ত । কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। কুরআনের পাতায় পাতায় আল্লাহকে ভয় করার কথা বলা হয়েছে। এই ভয়ের অর্থ তাঁর অবাধ্যতার কারণে যে শাস্তি রয়েছে, সেই শাস্তিকে ভয় করা। মানুষ আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য সাধনা করার মাধ্যমে তাকে ভালবাসবে, একই সাথে তাঁর শাস্তির ভয়ও অন্তের পোষণ করতে হবে। এ দুটো অবিচ্ছেদ্য এবং প্রকৃত ঈমানের মৌলিক দুটি উপাদান। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, “যে রোযাদার লাইলাতুল ক্বদর লাভ করবে, তার পূর্ববর্তী পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। এবং যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ঈমান সহকারে রমযানে সিয়াম পালন করবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহ সমূহকেও ক্ষমা করে দেয়া হবে“। এজন্য সিয়াম হতে হবে সঠিক পদ্ধতিতে এবং সঠিক প্রেরণার ভিত্তিতে। যেমনটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “যে রোযা অবস্থায় মিথ্যা বলা এবং মিথ্যার ওপর আচরণ করা থেকে বিরত হল না, তার ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।”
রোযা অবস্থায় আমাদের দিনগুলো রোযা না রাখা অবস্থায় আমাদের দিনগুলোর মত হওয়া উচিৎ নয় – এর মাঝে পার্থক্য থাকা উচিৎ। এই তাকওয়াই মানুষকে সর্বাবস্থায় অন্যায় থেকে বিরত রাখে, যদিও বা কেউ তাকে দেখতে না পায়। তাকওয়ার অসংখ্য উপকারিতা রয়েছে। কুরআনের আলোকে তাকওয়ার কয়েকটি উপকারিতা হচ্ছে:
- সন্তান-সন্ততির কল্যাণ: আল্লাহ পাক বলেন: “দেয়ালের ব্যাপারটি হল এই যে এটা শহরের দুজন এতিম বালকের। এর নিচে এদের কিছু সম্পদ প্রোথিত রয়েছে, আর তাদের বাবা ছিলেন একজন সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি। তাই তোমার রব চাইলেন যে তারা তাদের যৌবনে পৌঁছে যেন এই সম্পদ বের করে আনতে পারে, তাদের রবের পক্ষ থেকে করুণাস্বরুপ (সূরা আল কাহফ, ১৮ : ৮২)
- আসমান এবং জমীন থেকে কল্যাণ: আল্লাহপাক বলেন: “শহরগুলোর লোকেরা যদি কেবল ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, আমরা তাদের জন্য আসমান ও জমীন থেকে কল্যাণের দরজা উন্মুক্ত করে দিতাম।” [সূরা আল আ’রাফ, ৭ : ৯৬]
- আল্লাহর পক্ষ থেকে রিযিক এবং কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন: “যেই তাকওয়া অবলম্বন করবে, আমি তার জন্য পথ বের করে দেব এবং এমন স্থান থেকে তাকে রিযিক দেব যা তার ধারণাতেই ছিল না।” [সূরা আত তালাক্ব, ৬৫ : ২-৩]
- নিরাপত্তা: আল্লাহ পাক বলেন: “এবং আমি তাদেরকে রক্ষা করলাম যারা আমার প্রতি ঈমান এনেছিল ও মুত্তাকী ছিল।”
- সার্বক্ষণিক আল্লাহর সাহায্যের উপস্থিতি:আল্লাহ পাক বলেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন যারা তাকওয়া অবলম্বনকারী এবং সর্বদা ইহসানকারী।” [সূরা আন নাহল, ১৬ :১২৮]
- বিজয়: আল্লাহ পাক বলেন: “যারাই আল্লাহ এবং তার রাসূলের আনুগত্য করে এবং আল্লাহকে ভয়ের যোগ্য হিসেবে জানে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তারাই বিজয়ী।” [সূরা আন নূর, ২৪ : ৫২]
- জীবনের সুন্দর পরিসমাপ্তি: আল্লাহ পাক বলেন: “নিশ্চয়ই তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য রয়েছে সুন্দর পরিণতি।” [সূরা সোয়াদ, ৩৮ : ৪৯]
- জান্নাত: আল্লাহ পাক বলেন: “এই হচ্ছে সেই জান্নাত, যা আমি আমার দাসেদের মধ্য থেকে তাদেরকে দেব, যারা তাকওয়া অবলম্বন করত।” [সূরা মারইয়াম, ১৯ : ৬৩]