মাযহাব- আরবি শব্দ। আক্ষরিক অর্থ মত, পথ। যদিও পরিভাষা ভিন্ন। সেটা পরে বলছি। আবার, ধর্মের আরবি ‘দ্বীন’। কোর’আন বলে- ইন্নাদ্দিনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম। সূরা আল-ইমরান, আয়াত ১৯, প্রথমাংশ। মানে- নিঃসন্দেহে ইসলাম আল্লাহ্র নিকট (একমাত্র) ধর্ম। এখানে দ্বীনের বাংলা এসেছে ধর্ম। অতএব প্রমাণিত মাযহাব ধর্ম না। দ্বীনকে মানার মত ও পথই হচ্ছে মাযহাব। তাই হানাফি মাযহাব মানলে কেউ ইমাম আবু হানিফার উম্মত হয় না। উম্মত এসেছে উম্মাহ থেকে। অর্থ- জাতি। আমরা সবাই মুসলিম জাতি। এ জাতিসত্তার বিকাশ ইসলামকেন্দ্রিক। হানাফি জাতি না, হানাফি গোষ্ঠি হতে পারে। একই ভাবে- মালেকি, হাম্বলি, শাফেই সবাই মিলে হয় মুসলিম জাতি। একই সাগরে যেমন বহু নদী মিলে, বিষয়টা এমন।
দ্বীন ও মাযহাবকে সমার্থক শব্দ বলে অনেকে। সমার্থক মানে ‘সমান অর্থ’। সমান মানে কিন্তু এক না। যেমন- খলিল ও রফিক। আরবি শব্দ। দুটোই সমার্থক শব্দ। অর্থ- বন্ধু। কিন্তু পার্থক্য আছে। রফিক মানে সাধারণ বন্ধু। খলিল মানে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। চলুন কোর’আন দেখি। সূরা আহযাব, আয়াত ৫৬- হে বিশ্বাসীরা তোমরাও তাঁর (নবীর) ওপর সালাত পড়...। সূরা বাকারা, আয়াত ৪৩- এবং সালাত কায়েম রাখো...। খেয়াল করুন, দুখানেই ‘সালাত’ এসছে। কিন্তু দুই সালাতের মানে কি এক? না, এক না। প্রথম সালাতের অর্থ মদিনা-মুনিব (দ) এঁর প্রতি দরূদ শরীফ পড়তে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে নামায প্রতিষ্ঠার কথা এসছে। প্রমাণিত যে একই শব্দের ক্ষেত্রানুসারে ভিন্ন অর্থ হয়।
একটু বিরক্ত করি, বাড়তি বলব। বাংলা দিয়ে আরবিকে সঠিকভাবে বুঝা সুকঠিন। আরবির এক শব্দ বুঝতে বাংলায় একাধিক শব্দ প্রয়োজন। যেমন- ‘খলিল’ অর্থ বন্ধু। কিন্তু বাংলায় বুঝতে দুটি শব্দ লাগে- ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এর কারণ ভাষাবৃক্ষ ও ভাষার ব্যুৎপত্তি। বাংলা হচ্ছে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাপরিবার। ইন্দো-ইউরোপিয়ানের নয়টি ধাপ পেরিয়ে বাংলার জন্ম। এটি খুব নবীন ভাষা। অন্যদিকে, আরবি এসছে আফ্রোশিয়া ভাষাপরিবার থেকে। জন্ম ও বিকাশ সুবাদে আরবি বাংলার থেকে প্রাচীন ও ঋদ্ধ। তাই মাযহাব ও দ্বীনের অর্থ বাংলায় একভাবে ধর্ম হলেও আরবিতে বৈচিত্র্যমণ্ডিত। আবারো বলছি, মাযহাব পুরোপুরি দ্বীনের ওপর নির্ভরশীল। এটি আলাদা কিছু না। হাত থেকে যেমন আঙুল আলাদা না।
সূরা ফাতিহা, আয়াত ৬-৭। বলা হচ্ছে- আমাদের সোজাপথে পরিচালনা করো, তাঁদেরই পথ যাঁদের ওপর তুমি অনুগ্রহ করেছ...। সূরা তওবা, আয়াত ১১, শেষাংশ- এবং আমি নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করি জ্ঞানীদের জন্য। সূরা আন-নাহল, আয়াত ৪৩, শেষাংশ- জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো যদি তোমাদের জ্ঞান না থাকে। এভাবে আরো বহু আয়াতে আছে।
এ আয়াতগুলো বুঝায় যে- আল্লাহ্ জ্ঞানীদের বিস্তারিত ভাবে তাঁর নিদর্শন দেখান, বুঝান। তাঁরা রহমত প্রাপ্ত। সাধারণ মানুষ সোজাপথে চলবে। নিজের মূর্খতা দিয়ে ইসলামকে বুঝতে যাবে না, চেঁচামেচি করবে না। কম জ্ঞানীরা জ্ঞানীদের কাছে জানবে। কারণ কোর’আন-সুন্নাহ থেকে সবাই সমাধান বের করতে পারবে না। সবার যোগ্যতা নেই। ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতা নিশ্চয়ই হার্টের অপারেশন পারবে না। এই যে জেনে নেয়া, জানিয়ে দেয়া- এটাই মাযহাব। যিনি জানান তাঁকে মুজতাহিদ বলে। মুজতাহিদকে মানলে হয় তাকলিদ। তাকলিদ করলে হয় মুকাল্লিদ; অনুসরণ করলে অনুসারী। তাহলে প্রমাণিত কোর’আনে মাযহাব উল্লেখিত।
এবার হাদিসে আসুন। হযরত মুয়াজ বিন জাবাল। তিনি প্রসিদ্ধ সাহাবি। মদিনা-মুনিব (দ) তাঁকে ইয়ামেনে পাঠাতে মনঃস্থ করেন। ইসলাম প্রচারের জন্য। তাঁকে মদিনা-মুনিব (দ) বললেন, তোমার কাছে বিচারের ভার ন্যস্ত হলে কি করবে?
- ফয়সালা করবো কিতাবুল্লাহ (কোর’আন) দ্বারা।
- যদি কোর’আনে না পাও?
- তাহলে আল্লাহ্র রাসূলের সুন্নাহ দিয়ে সমাধান করব?
- সুন্নাহতে না পেলে?
- তাহলে ইজতিহাদের (উদ্ভাবন) মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করব।
মদিনা-মুনিব (দ) তখন বললেন- যাবতীয় প্রশংশা আল্লাহ্র, যিনি তাঁর রাসুলের প্রতিনিধিকে সেই যোগ্যতা (ইজতিহাদ) দিয়েছেন এবং তাঁর বিষয়ে আমি সন্তুষ্ট।
সূত্র- সুনানে আবু দাউদ- ৩৫৯৪, সুনানে তিরমিজি- ১৩২৭, সুনানে দারেমি- ১৬৮, মুসনাদে আহমাদ- ২২০৬১। বুঝা গেল- স্বয়ং রাসুল-অতুল (দ) নিজেই ইজতেহাদ, মাযহাবকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এরপর আর কোনো কথা থাকে না।
তবুও বিরোধিরা মানবে না। বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করবে। তাদের একটা প্রশ্ন- সাহাবারা কি মাযহাব মানত? বলে রাখি, বিরোধিরা হচ্ছে- ওয়াহাবি, সালাফি, আহলে হদস (হাদিস), জামাত-শিবির, ইখওয়ানি, আইএস, বোকোহারাম, জেএমবি, আল-কায়েদা ইত্যাদি। এদের একত্রে, একশব্দে ‘লা-মাযহাবী’ বলতে পারেন।
আসুন কিচ্ছা শেষ করি। মিস্টার ইবনে তাইমিয়া। সে লা-মাযহাবিদের ধরমবাপ, গুরুদের গুরু। তার ফতওয়ার বই ‘মাজমু উল ফাতোয়া’। সে বইয়ের ১৩ খণ্ড ৩৬১ পৃষ্ঠায় লিখেছে-
“কোর’আনের কোন একটি আয়াতের তাফসিরের ব্যাপারে যদি সাহাবাগণ, তাবেয়িগণ এবং ইমামগণের কোনো বানী থাকে; আর অন্য কোনো দল যদি নিজেদের মাযহাবের পক্ষে অন্য কথা দ্বারা ঐ আয়াতের তাফসীর করে, যা সাহাবাগণ এবং তাবেয়িগণের মাযহাবের বিরুদ্ধে চলে যায়, তবে তা হবে মুতাজিলা ও অন্যান্য বেদাতিদের কাজ”।
মূল আরবিতে “মাযাহিবুস সাহাবাহ” অর্থাৎ সরাসরি “মাযাহিব” শব্দ উল্লেখ করেছে। মাযাহিব বহুবচন। একবচনে মাযহাব। অর্থাৎ সেই প্রমাণ দিল- সাহাবাদের যুগেও মাযহাব বিদ্যমান ছিল। একাধিক মাযহাব ছিল।
তবুও বিরোধিরা মানবে না। প্রশ্ন করবে, সাহাবাদের মাযহাব বলতে কি বুঝিয়েছে? সে হয়ত সমস্ত সাহাবাদের একমতকে মাযহাব বলেছে। তাই একটা মাযহাব মানা যাবে। চারটা মাযহাব কেন মানবো? সাহাবাদের যুগে তো একাধিক মাযহবা ছিল না!
তাহলে আসুন ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যাহর কথা জানি। তিনি মিস্টার ইবনে তাইমিয়ার সরাসরি ছাত্র। তিনি লিখেন-
রাসুলুল্লাহ (দ) এঁর সাহাবাদের মধ্যে যাদের ফতোয়া সংরক্ষণ হয়েছে তাঁদের সংখ্যা নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় একশ’ ত্রিশজন। এঁদের মধ্যে সবচে বেশি ফতোয়া দিতেন সাতজন। যথা- উমর ইবনে খাত্তাব, আলি ইবনে আবি তালেব, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা, যায়দ ইবনে সাবেত, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর- রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম।
যাঁদের ফতোয়ার সংখ্যা খুব বেশি নয় আবার খুব কমও নয়, তাঁরা মাধ্যমিক স্তরের। তাদের সংখ্যা হল, তেরজন। এ বিশজন ব্যতীত একশ’ দশজন সাহাবির সকলেই যে ফতোয়া প্রদান করেছেন, তার সংখ্যা খুবই কম। সূত্র- ই’লামুল মুয়াক্বিয়ীন আন রাব্বিল আলামিন, আল্লামা ইবনুল কায়্যিম, খণ্ড ১।
এখন ভাবুন, সাহাবাদের সংখ্যা সোয়া লক্ষ। আর কোথায় একশ তিরিশজন সাহাবি! অবশিষ্ট সাহাবিরা তাহলে কী করেছেন? কীভাবে ইসলাম মেনেছেন? উত্তর- অন্য সাহাবিরা অভিজ্ঞ সাহাবিদের তাকলিদ করেছেন। মানে মুজতাহিদ সাহাবির তাকলদি করেছেন। স্পষ্ট হল প্রায় সকল সাহাবী মুকাল্লিদ ছিলেন।
আসুন আরো জানি। ইমাম আলি ইবনুল মাদিনি। ১৬১-২৩৪ হিজরি আয়ুষ্কাল। তিনি ইমাম বুখারির অন্যতম শিক্ষক। এবং লা-মাযহাবির গুরুদের গুরুরাও তাঁকে মানে। তিনি ‘কিতাবুল ইলাল’ নামে একটি গ্রন্থ লিখেন। সেখানে তিনজন সাহাবির মাযহাব বর্ননা করেছেন। যা সাহাবাদের যুগের। যাঁদের মাযহাবের ওপর আমল ও ফতোয়া প্রচলিত ছিল। তাঁরা হলেন- আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, যায়েদ ইবনে ছাবিত ও আবদুল্লাহ ইবনে আববাস- রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম।
উল্লেখ্য তিনজন বিভিন্ন স্থানে থাকতেন। সেখানকার মানুষ তাঁদের মাযহাব মানত। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ কুফায় থাকতেন। কুফা হচ্ছে ইরাকে। মদিনায় যায়েদ ইবনে সাবেত। মক্কায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস। আমাদের ইমামে আযম আবু হানিফা কুফার বাসিন্দা। তিনি সাহাবি ইবনে মাসউদের অনুরাগী ছিলেন। হানাফি মাযহাবে তাই আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের আমল বেশী পাওয়া যায়। তাই হানাফিদের সাথে সাহাবাদের ইজতিহাদি যোগসূত্র আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদি.। যারা বলে হানাফিদের সাথে পূর্ববর্তীদের কোনো যোগাযোগ নেই তাঁরা মুর্খতার কোন নরকে বাস করে খোদা মালুম!
যাহোক, তাকলিদের পরিভাষা জানাতে চেয়েছিলাম। মনে আছে? এক্কেবারে প্রথমে বলেছি। তাকলিদের একটি পরিভাষা হচ্ছে- প্রশ্নহীন আনুগত্য করা। নিজের অযোগ্যতা স্বীকার করে দ্বিধাহীন ভাবে ইমামকে মানা। ইমামের কাছে দলীল খুঁজলে তাকলিদ হয় না।
আর এক্ষেত্রে আল্লাহ্ নিজেই বলেন- (সূরা আরাফ, আয়াত ৩) হে লোকেরা! সেটার ওপরেই চলো যা তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে... নিশ্চয়ই তোমরা খুব কম বুঝো।
আর কিছু বলার নেই। হেদায়তের মালিক শুধুই আল্লাহ্।
লিখেছেন- কবি মাহ্দী আল গালিব