যাকাত বিষয়ক মাসায়েল পর্ব - ২
(রমাদান অ্যাপ থেকে সংগৃহীত)
১৬. কারো কাছে সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্যদ্রব্য পৃথকভাবে বা সম্মিলিতভাবে নিসাব পরিমাণ ছিল, বছরের মাঝে এ জাতীয় আরো কিছু সম্পদ কোনো সূত্রে পাওয়া গেল এক্ষেত্রে নতুন প্রাপ্ত সম্পদ পুরাতন সম্পদের সঙ্গে যোগ হবে এবং পুরাতন সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে। বছরের মাঝে যা যোগ হয়েছে তার জন্য পৃথক বছর পূর্ণ হওয়া লাগবে না।
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৮৭২,৭০৪০,৭০৪৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩২৫,১০৩২৭
১৭. বছরের শুরু ও শেষে নিসাব পূর্ণ থাকলে যাকাত আদায় করতে হবে। মাঝে নিসাব কমে যাওয়া ধর্তব্য নয়। অবশ্য বছরের মাঝে সম্পূর্ণ সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে ঐ সময় থেকে নতুন করে বছরের হিসাব আরম্ভ হবে এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৪২,৭০৪৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৩০২
যে সব জিনিসের ওপর যাকাত ফরয নয়
১৮. নিজ ও পোষ্য পরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর যাকাত ফরয নয়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/১৯-২০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০২০৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৫
১৯. গৃহের আসবাবপত্র যেমন খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদি এবং গার্হস্থ সামগ্রী যেমন
হাড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদির উপর যাকাত ফরয নয়। তা যত উচ্চমূল্যেরই হোক না কেন। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৯৩,৭১০২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৫৬০; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৫
তবে এক্ষেত্রে মনে রাখাতে হবে য, যেসব বস্ত্তর উপর যাকাত আসে না সেগুলোতে যদি সোনা-রুপা সংযুক্ত থাকে তাহলে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে এই সংযুক্ত সোনা-রুপারও যাকাত ফরয হবে।
২০. পরিধেয় বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে তবুও তাতে যাকাত ফরয হবে না। আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৫
২১. দোকান-পাট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসাপণ্য নয়, তার ওপর যাকাত ফরয নয়। তবে ফার্নিচারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেসব ফার্নিচার রাখা থাকে তা যেহেতু বাণিজ্যদ্রব্য তাই এসবের ওপর যাকাত ফরয হবে।
২২. ঘর-বাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও যাকাত ফরয নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ যে অর্থ পাওয়া যাবে তার ওপর মাসআলা নং ৬ প্রযোজ্য হবে।
২৩. ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর-বাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী যেমন ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ, থালা-বাটি ইত্যাদি ক্রয় করলে তার ওপরও যাকাত ফরয নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থের উপর যাকাত আসবে।
ঋণ ও পাওনা প্রসঙ্গঃ
২৪. কারো ঋণ যদি এত হয় যা বাদ দিলে তার কাছে নিসাব পরিমাণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থাকে না তাহলে তার ওপর যাকাত ফরয নয়।
-মুয়াত্তা মালেক ১০৭; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০০৩, ৭০৮৬, ৭০৮৯, ৭০৯০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৪৭-৫৪৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/৮৩
কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে যে, এই প্রসিদ্ধ মাসআলাটি সকল ঋণের ক্ষেত্রে নয়। ঋণ দুই ধরনের হয়ে থাকে। ক. প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য বাধ্য হয়ে যে ঋণ নেওয়া হয়। খ. ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যে ঋণ নেওয়া হয়।
প্রথম প্রকারের ঋণ সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে যাকাতের নিসাব বাকি থাকে কিনা তার হিসাব করতে হবে। নিসাব থাকলে যাকাত ফরয হবে, অন্যথায় নয়। কিন্তু যে সকল ঋণ উন্নয়নের জন্য নেওয়া হয় যেমন কারখানা বানানো, কিংবা ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বিল্ডিং বানানো অথবা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নিলে যাকাতের হিসাবের সময় সে ঋণ ধর্তব্য হবে না। অর্থাৎ এ ধরনের ঋণের কারণে যাকাত কম দেওয়া যাবে না।
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৮৭
২৫. বিয়ে-শাদিতে মোহরানার যে অংশ বাকি থাকে তা স্বামীর কাছে স্ত্রীর পাওনা। কিন্তু এই পাওনা স্বামীর ওপর যাকাত ফরয হওয়া না হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলে না। অর্থাৎ যাকাতযোগ্য সম্পদের হিসাবের সময় এই ঋণ বাদ দেওয়া যাবে না; বরং সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে। আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬১
উল্লেখ্য যে, বিনা ওযরে মোহরানা আদায়ে বিলম্ব করা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
২৬. অন্যকে যে টাকা কর্জ হিসেবে দেওয়া হয়েছে বা ব্যবসায়ী কোনো পণ্য বাকিতে বিক্রয় করেছে এই পাওনা টাকা পৃথকভাবে বা অন্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে মিলিতভাবে নিসাব পূর্ণ করলে তারও যাকাত দিতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১১১-৭১১৩,৭১২১,৭১২৩,৭১২৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৪৮৪-৪৮৬
২৭. পাওনা উসূল হওয়ার পর ওই টাকার যাকাত আদায় করা ফরয হয়। তার আগে আদায় করা জরুরি নয়, তবে আদায় করলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩৪৭, ১০৩৫৬
২৮. উপরোক্ত ক্ষেত্রে পাওনা উসূল হতে যদি কয়েক বছর সময় অতিবাহিত হয়ে যায় তাহলে উসুল হওয়ার পর বিগত সকল বছরের যাকাত আদায় করা ফরয হয়।
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১১৬,৭১২৯,৭১৩১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩৪৬,১০৩৫৬
২৯. স্বামীর কাছে পাওনা মোহরানা নিসাব পরিমাণ হলেও তা স্ত্রীর হস্তগত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাতে যাকাত ফরয হয় না। হস্তগত হওয়ার পর যদি আগে থেকেই ঐ মহিলার কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ না থাকে তাহলে এখন থেকে বছর গণনা শুরু হবে এবং বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে।
৩০. আর যদি স্ত্রী মোহরানা পাওয়ার আগ থেকেই নিসাব পরিমাণ অর্থ বা সম্পদের মালিক থেকে থাকে তাহলে এই সদ্যপ্রাপ্ত মোহরানা অন্যান্য টাকা-পয়সা বা সম্পদের সাথে যোগ হবে এবং সেই সব পুরানো সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে।
কীভাবে যাকাত দিতে হবেঃ
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা তার অনুগত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন-
وَ الَّذِیْنَ یُؤْتُوْنَ مَاۤ اٰتَوْا وَّ قُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ اَنَّهُمْ اِلٰی رَبِّهِمْ رٰجِعُوْنَۙ۶۰
আর তারা যা কিছু দান করে এভাবে দান করে যে, তাদের হৃদয় ভীতকম্পিত থাকে (একথা ভেবে) যে, তারা তাদের রবের নিকটে ফিরে যাবে।’ -সূরা মুমিনূন : ৬০ এক আয়াতে মু’মিনদের সম্বোধন করে বলেন-
وَ مَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَیْرٍ فَلِاَنْفُسِكُمْ ؕ وَ مَا تُنْفِقُوْنَ اِلَّا ابْتِغَآءَ وَجْهِ اللّٰهِ ؕ وَ مَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَیْرٍ یُّوَفَّ اِلَیْكُمْ وَ اَنْتُمْ لَا تُظْلَمُوْنَ۲۷۲
... এবং তোমরা তো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই ব্যয় করে থাক। যে ধনসম্পদ তোমরা ব্যয় কর তার পুরস্কার তোমাদেরকে পুরোপুরিভাবে প্রদান করা হবে এবং তোমাদের প্রতি অন্যায় করা হবে না। -সূরা বাকারা : ২৭২
অন্য এক আয়াতে ঈমানদারদের সতর্ক করা হয়েছে তারা যেন অসংযত আচরণের মাধ্যমে তাদের দান-সদকাকে ব্যর্থ না করে দেয়। ইরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُبْطِلُوْا صَدَقٰتِكُمْ بِالْمَنِّ وَ الْاَذٰی ۙ كَالَّذِیْ یُنْفِقُ مَالَهٗ رِئَآءَ النَّاسِ وَ لَا یُؤْمِنُ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ ؕ
‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অনুগ্রহ ফলিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-সদকাকে বিনষ্ট করো না। ওই লোকের মতো যে লোক দেখানোর জন্য সম্পদ ব্যয় করে আর ঈমান রাখে না আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের উপর। -সূরা বাকারা : ২৬৪
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
واحسنوا ان الله يحب المحسنين
কুরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিনয়, খোদাভীতি, ইখলাস ও আখলাকে হাসানা হল দান-সদকা আল্লাহর দরবারে মকবুল হওয়ার অভ্যন্তরীণ শর্ত। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়মতো যাকাত আদায় করে দেওয়া কর্তব্য।
৩১. বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যাকাত আদায়ে বিলম্ব করা যায় না। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَ اَنْفِقُوْا مِنْ مَّا رَزَقْنٰكُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَ اَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَیَقُوْلَ رَبِّ لَوْ لَاۤ اَخَّرْتَنِیْۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیْبٍ ۙ فَاَصَّدَّقَ وَ اَكُنْ مِّنَ الصّٰلِحِیْنَ۱۰
আমি তোমাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তোমরা তা থেকে ব্যয় করবে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে। অন্যথায় মৃত্যু এল সে বলবে হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরও কিছু কালের অবকাশ কেন দিলে না! তাহলে আমি সদাকা করতাম এবং সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ -সূরা মুনাফিকূন : ১০
এক্ষেত্রে করণীয় হল, নিসাবের মালিক হওয়ার সময়টি সামনে রাখা এবং ঠিক তার এক বছর পর সেই সময়েই যাকাত আদায় করা। নির্দিষ্ট সময়টি জানা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো মাসের অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত নয়।
৩২. যে দিন এক বছর পূর্ণ হবে সেদিনই যাকাত আদায় করা ফরয হয়। এরপর যখনই যাকাত আদায় করুক সে পরিমাণই আদায় করতে হবে যা সেই দিন ফরয হয়েছিল।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৫৫৯
৩৩. বছর পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে চন্দ্রবর্ষের হিসাব ধর্তব্য, সৌর বর্ষের নয়।
নিয়ত করাঃ
৩৪. যাকাত আদায় হওয়ার জন্য যাকাত প্রদানের নিয়ত করা জরুরি।
আদ্দুররুল মুখতার ২/২৫৮
৩৫. একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই যাকাত প্রদান করতে হবে। জনসমর্থন অর্জনের জন্য, লোকের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য কিংবা অন্য কোনো জাগতিক উদ্দেশ্যে যাকাত দেওয়া হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। -সূরা বাক্বারা ২৬৪
যাকাতের উপযুক্ত খাতে যেমন ফকীর-মিসকীনকে দেওয়ার সময় যাকাতের নিয়ত করতে হবে। এটাই মূল নিয়ম। তবে নিজের সম্পদ থেকে যাকাতের টাকা পৃথক করে রাখলে পৃথক করার সময়ের নিয়তই যথেষ্ট হবে। এখান থেকে ফকীর-মিসকীনকে দেওয়ার সময় নতুন নিয়ত না করলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৮
৩৬. যাকাতের উদ্দেশ্যে টাকা পৃথক করে রাখলেও মালিক তা প্রয়োজনে খরচ করতে পারবে। তবে পরে যাকাত আদায়ের সময় যাকাতের নিয়ত করতে হবে।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩৯১, ১০৩৯২
৩৭. যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে কিছু টাকা দান করা হয়েছে, কিন্তু দান করার সময় দানকারীর মনে যাকাতের নিয়ত ছিল না তো গ্রহীতার কাছে সেই টাকা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যাকাতের নিয়ত করলে যাকাত আদায় হবে। তদ্রূপ যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে কোনো খাদ্যদ্রব্য প্রদান করা হলে গ্রহীতা তা খেয়ে ফেলার বা বিক্রি করে দেওয়ার আগে যাকাতের নিয়ত করলেও যাকাত আদায় হবে। এরপরে যাকাতের নিয়ত করলে যাকাত হিসাবে আদায় হবে না।
-আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৮-২৬৯
৩৮. যাকাতের টাকা আলাদা করে রাখা হয়েছে। কিন্তু ফকীর-মিসকীনকে দেওয়ার আগেই তা চুরি হয়ে গেল বা অন্য কোনোভাবে নষ্ট হয়ে গেল তাহলে যাকাত আদায় হয়নি। পুনরায় যাকাত দিতে হবে।
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৯৩৬,৬৯৩৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৩১-৫৩২; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৭০
৩৯. যে সম্পদের উপর যাকাত ফরয হয়েছে তার চল্লিশ ভাগের একভাগ (২.৫০%) যাকাত দেওয়া ফরয। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা হারে নগদ টাকা কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়-চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও যাকাত আদায় হবে।
-সুনানে নাসায়ী হাদীস ২২৩০-২২৩৩; সুনানে আবু দাউদ হাদীস ১৫৭০-১৫৭২; সুনানে তিরমিযী হাদীস ৬২৩; সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস ১৮০৩ ; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১৩৩-৭১৩৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৫৩৯-১০৫৮১
৪০. যে পরিমাণ যাকাত ফরয হয় স্বেচ্ছায় তার চেয়ে বেশি দিয়ে দিলেও অসুবিধা নেই। এতে যাকাত আদায় এবং বাড়তি দান দু’টোরই ছওয়াব পাওয়া যাবে।
- মুসনাদে আহমদ হাদীস ২০৭৭; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৯০৭
৪১. যাকাত গ্রহণকারীকে একথা জানানোর প্রয়োজন নেই যে, তাকে যাকাত দেওয়া হচ্ছে। যেকোনোভাবে দরিদ্র ব্যক্তিকে যাকাতের মাল দেওয়া হলে মালিক যদি মনে মনে যাকাতের নিয়ত করে তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৮
৪২. অন্যের পক্ষ থেকে যাকাত আদায় করতে হলে তার অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় সে ব্যক্তির পক্ষ থেকে যাকাত আদায় হবে না। আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৯
৪৩. গৃহকর্তা যদি ঘরের লোকদেরকে যাকাত দেওয়ার অনুমতি দিয়ে রাখেন তাহলে তারা যাকাতের নিয়তে কাউকে কিছু দিলে তা যাকাত হিসেবে আদায় হবে। আর যদি পূর্বাগ্রে অনুমতি না দেওয়া থাকে আর ঘরের লোকেরা যাকাত হিসেবে কিছু দান করে তাহলে যাকে দান করা হল সে সেই অর্থ খরচ করার আগেই যদি গৃহকর্তা অনুমতি পাওয়া যায় তাহলেও তা যাকাত হিসেবে আদায় হবে। অন্যথায় যাকাত আদায় হবে না। পুনরায় আদায় করতে হবে।
৪৪. কোনো দরিদ্র ব্যক্তির কাছে কারো কিছু টাকা পাওনা আছে। এখন সে যদি যাকাতের নিয়তে পাওনা মাফ করে দেয় তাহলে যাকাত আদায় হবে না। তাকে যাকাত দিতে হলে নিয়ম হল, প্রথমে তাকে যাকাত প্রদান করা এরপর সেখান থেকে ঋণ উসূল করে নেওয়া। -আদ্দুররুল মুখতার ২/২৭০; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৭১
ঋণগ্রস্তকেই যাকাতের টাকা প্রদান করা উত্তম। কেননা এতে তাকে ঋণের দায় থেকে মুক্ত করা হয়। আর কোনো স্বচ্ছল ব্যক্তি যদি যাকাত থেকে গণ্য করা নিয়ত ছাড়াই ঋণগ্রহীতার ঋণ ক্ষমা করে দেয় তবে তো কথাই নেই। আদ্দুররুল মুখতার ২/২৭১
৪৫. যে দরিদ্র ব্যক্তির কাছে অতি সামান্য মাল আছে, অথবা কিছুই নেই, এমনকি একদিনের খোরাকীও নেই এমন লোক শরীয়তের দৃষ্টিতে গরীব। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
৪৬. যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ অর্থাৎ সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, বাণিজ্যদ্রব্য ইত্যাদি নিসাব পরিমাণ আছে সে শরীয়তের দৃষ্টিতে ধনী। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
৪৭. অনুরূপভাবে যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ নেই, কিন্তু অন্য ধরনের সম্পদ যাতে যাকাত আসে না যেমন ঘরের আসবাবপত্র, পরিধেয় বস্ত্র, জুতা, গার্হস্থ সামগ্রী ইত্যাদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং নিসাব পরিমাণ আছে তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে না।
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১৫৬
এই ব্যক্তির উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।
৪৮. যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদও নিসাব পরিমাণ নেই এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত অন্য ধরনের মাল-সামানাও নিসাব পরিমাণ নেই এই ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৫৩৬
৪৯. যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্থ যে, ঋণ পরিশোধ করার পর তার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে না তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
৫০. কোনো ব্যক্তি নিজ বাড়িতে নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী, কিন্তু সফরে এসে অভাবে পড়ে গেছে বা মাল-সামান চুরি হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে। তবে এ ব্যক্তির জন্য শুধু প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করাই জায়েয, এর বেশি নয়।
(গুগলে প্লেতে যান,
সার্চ করুন ” রমাদান Sunni pedia” আর ডাউনলোড করুন রমাদান অ্যাপটি। জানাবেন আপনার ভালো লাগা না লাগা।)
(রমাদান অ্যাপ থেকে সংগৃহীত)
১৬. কারো কাছে সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্যদ্রব্য পৃথকভাবে বা সম্মিলিতভাবে নিসাব পরিমাণ ছিল, বছরের মাঝে এ জাতীয় আরো কিছু সম্পদ কোনো সূত্রে পাওয়া গেল এক্ষেত্রে নতুন প্রাপ্ত সম্পদ পুরাতন সম্পদের সঙ্গে যোগ হবে এবং পুরাতন সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে। বছরের মাঝে যা যোগ হয়েছে তার জন্য পৃথক বছর পূর্ণ হওয়া লাগবে না।
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৮৭২,৭০৪০,৭০৪৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩২৫,১০৩২৭
১৭. বছরের শুরু ও শেষে নিসাব পূর্ণ থাকলে যাকাত আদায় করতে হবে। মাঝে নিসাব কমে যাওয়া ধর্তব্য নয়। অবশ্য বছরের মাঝে সম্পূর্ণ সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে ঐ সময় থেকে নতুন করে বছরের হিসাব আরম্ভ হবে এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৪২,৭০৪৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৩০২
যে সব জিনিসের ওপর যাকাত ফরয নয়
১৮. নিজ ও পোষ্য পরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর যাকাত ফরয নয়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/১৯-২০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০২০৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৫
১৯. গৃহের আসবাবপত্র যেমন খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদি এবং গার্হস্থ সামগ্রী যেমন
হাড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদির উপর যাকাত ফরয নয়। তা যত উচ্চমূল্যেরই হোক না কেন। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৯৩,৭১০২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৫৬০; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৫
তবে এক্ষেত্রে মনে রাখাতে হবে য, যেসব বস্ত্তর উপর যাকাত আসে না সেগুলোতে যদি সোনা-রুপা সংযুক্ত থাকে তাহলে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে এই সংযুক্ত সোনা-রুপারও যাকাত ফরয হবে।
২০. পরিধেয় বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে তবুও তাতে যাকাত ফরয হবে না। আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৫
২১. দোকান-পাট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসাপণ্য নয়, তার ওপর যাকাত ফরয নয়। তবে ফার্নিচারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেসব ফার্নিচার রাখা থাকে তা যেহেতু বাণিজ্যদ্রব্য তাই এসবের ওপর যাকাত ফরয হবে।
২২. ঘর-বাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও যাকাত ফরয নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ যে অর্থ পাওয়া যাবে তার ওপর মাসআলা নং ৬ প্রযোজ্য হবে।
২৩. ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর-বাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী যেমন ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ, থালা-বাটি ইত্যাদি ক্রয় করলে তার ওপরও যাকাত ফরয নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থের উপর যাকাত আসবে।
ঋণ ও পাওনা প্রসঙ্গঃ
২৪. কারো ঋণ যদি এত হয় যা বাদ দিলে তার কাছে নিসাব পরিমাণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থাকে না তাহলে তার ওপর যাকাত ফরয নয়।
-মুয়াত্তা মালেক ১০৭; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০০৩, ৭০৮৬, ৭০৮৯, ৭০৯০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৪৭-৫৪৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/৮৩
কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে যে, এই প্রসিদ্ধ মাসআলাটি সকল ঋণের ক্ষেত্রে নয়। ঋণ দুই ধরনের হয়ে থাকে। ক. প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য বাধ্য হয়ে যে ঋণ নেওয়া হয়। খ. ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যে ঋণ নেওয়া হয়।
প্রথম প্রকারের ঋণ সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে যাকাতের নিসাব বাকি থাকে কিনা তার হিসাব করতে হবে। নিসাব থাকলে যাকাত ফরয হবে, অন্যথায় নয়। কিন্তু যে সকল ঋণ উন্নয়নের জন্য নেওয়া হয় যেমন কারখানা বানানো, কিংবা ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বিল্ডিং বানানো অথবা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নিলে যাকাতের হিসাবের সময় সে ঋণ ধর্তব্য হবে না। অর্থাৎ এ ধরনের ঋণের কারণে যাকাত কম দেওয়া যাবে না।
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৮৭
২৫. বিয়ে-শাদিতে মোহরানার যে অংশ বাকি থাকে তা স্বামীর কাছে স্ত্রীর পাওনা। কিন্তু এই পাওনা স্বামীর ওপর যাকাত ফরয হওয়া না হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলে না। অর্থাৎ যাকাতযোগ্য সম্পদের হিসাবের সময় এই ঋণ বাদ দেওয়া যাবে না; বরং সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে। আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬১
উল্লেখ্য যে, বিনা ওযরে মোহরানা আদায়ে বিলম্ব করা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
২৬. অন্যকে যে টাকা কর্জ হিসেবে দেওয়া হয়েছে বা ব্যবসায়ী কোনো পণ্য বাকিতে বিক্রয় করেছে এই পাওনা টাকা পৃথকভাবে বা অন্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে মিলিতভাবে নিসাব পূর্ণ করলে তারও যাকাত দিতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১১১-৭১১৩,৭১২১,৭১২৩,৭১২৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৪৮৪-৪৮৬
২৭. পাওনা উসূল হওয়ার পর ওই টাকার যাকাত আদায় করা ফরয হয়। তার আগে আদায় করা জরুরি নয়, তবে আদায় করলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩৪৭, ১০৩৫৬
২৮. উপরোক্ত ক্ষেত্রে পাওনা উসূল হতে যদি কয়েক বছর সময় অতিবাহিত হয়ে যায় তাহলে উসুল হওয়ার পর বিগত সকল বছরের যাকাত আদায় করা ফরয হয়।
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১১৬,৭১২৯,৭১৩১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩৪৬,১০৩৫৬
২৯. স্বামীর কাছে পাওনা মোহরানা নিসাব পরিমাণ হলেও তা স্ত্রীর হস্তগত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাতে যাকাত ফরয হয় না। হস্তগত হওয়ার পর যদি আগে থেকেই ঐ মহিলার কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ না থাকে তাহলে এখন থেকে বছর গণনা শুরু হবে এবং বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে।
৩০. আর যদি স্ত্রী মোহরানা পাওয়ার আগ থেকেই নিসাব পরিমাণ অর্থ বা সম্পদের মালিক থেকে থাকে তাহলে এই সদ্যপ্রাপ্ত মোহরানা অন্যান্য টাকা-পয়সা বা সম্পদের সাথে যোগ হবে এবং সেই সব পুরানো সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে।
কীভাবে যাকাত দিতে হবেঃ
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা তার অনুগত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন-
وَ الَّذِیْنَ یُؤْتُوْنَ مَاۤ اٰتَوْا وَّ قُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ اَنَّهُمْ اِلٰی رَبِّهِمْ رٰجِعُوْنَۙ۶۰
আর তারা যা কিছু দান করে এভাবে দান করে যে, তাদের হৃদয় ভীতকম্পিত থাকে (একথা ভেবে) যে, তারা তাদের রবের নিকটে ফিরে যাবে।’ -সূরা মুমিনূন : ৬০ এক আয়াতে মু’মিনদের সম্বোধন করে বলেন-
وَ مَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَیْرٍ فَلِاَنْفُسِكُمْ ؕ وَ مَا تُنْفِقُوْنَ اِلَّا ابْتِغَآءَ وَجْهِ اللّٰهِ ؕ وَ مَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَیْرٍ یُّوَفَّ اِلَیْكُمْ وَ اَنْتُمْ لَا تُظْلَمُوْنَ۲۷۲
... এবং তোমরা তো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই ব্যয় করে থাক। যে ধনসম্পদ তোমরা ব্যয় কর তার পুরস্কার তোমাদেরকে পুরোপুরিভাবে প্রদান করা হবে এবং তোমাদের প্রতি অন্যায় করা হবে না। -সূরা বাকারা : ২৭২
অন্য এক আয়াতে ঈমানদারদের সতর্ক করা হয়েছে তারা যেন অসংযত আচরণের মাধ্যমে তাদের দান-সদকাকে ব্যর্থ না করে দেয়। ইরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُبْطِلُوْا صَدَقٰتِكُمْ بِالْمَنِّ وَ الْاَذٰی ۙ كَالَّذِیْ یُنْفِقُ مَالَهٗ رِئَآءَ النَّاسِ وَ لَا یُؤْمِنُ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ ؕ
‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অনুগ্রহ ফলিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-সদকাকে বিনষ্ট করো না। ওই লোকের মতো যে লোক দেখানোর জন্য সম্পদ ব্যয় করে আর ঈমান রাখে না আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের উপর। -সূরা বাকারা : ২৬৪
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
واحسنوا ان الله يحب المحسنين
কুরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিনয়, খোদাভীতি, ইখলাস ও আখলাকে হাসানা হল দান-সদকা আল্লাহর দরবারে মকবুল হওয়ার অভ্যন্তরীণ শর্ত। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়মতো যাকাত আদায় করে দেওয়া কর্তব্য।
৩১. বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যাকাত আদায়ে বিলম্ব করা যায় না। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَ اَنْفِقُوْا مِنْ مَّا رَزَقْنٰكُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَ اَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَیَقُوْلَ رَبِّ لَوْ لَاۤ اَخَّرْتَنِیْۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیْبٍ ۙ فَاَصَّدَّقَ وَ اَكُنْ مِّنَ الصّٰلِحِیْنَ۱۰
আমি তোমাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তোমরা তা থেকে ব্যয় করবে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে। অন্যথায় মৃত্যু এল সে বলবে হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরও কিছু কালের অবকাশ কেন দিলে না! তাহলে আমি সদাকা করতাম এবং সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ -সূরা মুনাফিকূন : ১০
এক্ষেত্রে করণীয় হল, নিসাবের মালিক হওয়ার সময়টি সামনে রাখা এবং ঠিক তার এক বছর পর সেই সময়েই যাকাত আদায় করা। নির্দিষ্ট সময়টি জানা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো মাসের অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত নয়।
৩২. যে দিন এক বছর পূর্ণ হবে সেদিনই যাকাত আদায় করা ফরয হয়। এরপর যখনই যাকাত আদায় করুক সে পরিমাণই আদায় করতে হবে যা সেই দিন ফরয হয়েছিল।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৫৫৯
৩৩. বছর পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে চন্দ্রবর্ষের হিসাব ধর্তব্য, সৌর বর্ষের নয়।
নিয়ত করাঃ
৩৪. যাকাত আদায় হওয়ার জন্য যাকাত প্রদানের নিয়ত করা জরুরি।
আদ্দুররুল মুখতার ২/২৫৮
৩৫. একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই যাকাত প্রদান করতে হবে। জনসমর্থন অর্জনের জন্য, লোকের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য কিংবা অন্য কোনো জাগতিক উদ্দেশ্যে যাকাত দেওয়া হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। -সূরা বাক্বারা ২৬৪
যাকাতের উপযুক্ত খাতে যেমন ফকীর-মিসকীনকে দেওয়ার সময় যাকাতের নিয়ত করতে হবে। এটাই মূল নিয়ম। তবে নিজের সম্পদ থেকে যাকাতের টাকা পৃথক করে রাখলে পৃথক করার সময়ের নিয়তই যথেষ্ট হবে। এখান থেকে ফকীর-মিসকীনকে দেওয়ার সময় নতুন নিয়ত না করলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৮
৩৬. যাকাতের উদ্দেশ্যে টাকা পৃথক করে রাখলেও মালিক তা প্রয়োজনে খরচ করতে পারবে। তবে পরে যাকাত আদায়ের সময় যাকাতের নিয়ত করতে হবে।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩৯১, ১০৩৯২
৩৭. যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে কিছু টাকা দান করা হয়েছে, কিন্তু দান করার সময় দানকারীর মনে যাকাতের নিয়ত ছিল না তো গ্রহীতার কাছে সেই টাকা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যাকাতের নিয়ত করলে যাকাত আদায় হবে। তদ্রূপ যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে কোনো খাদ্যদ্রব্য প্রদান করা হলে গ্রহীতা তা খেয়ে ফেলার বা বিক্রি করে দেওয়ার আগে যাকাতের নিয়ত করলেও যাকাত আদায় হবে। এরপরে যাকাতের নিয়ত করলে যাকাত হিসাবে আদায় হবে না।
-আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৮-২৬৯
৩৮. যাকাতের টাকা আলাদা করে রাখা হয়েছে। কিন্তু ফকীর-মিসকীনকে দেওয়ার আগেই তা চুরি হয়ে গেল বা অন্য কোনোভাবে নষ্ট হয়ে গেল তাহলে যাকাত আদায় হয়নি। পুনরায় যাকাত দিতে হবে।
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৯৩৬,৬৯৩৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৩১-৫৩২; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৭০
৩৯. যে সম্পদের উপর যাকাত ফরয হয়েছে তার চল্লিশ ভাগের একভাগ (২.৫০%) যাকাত দেওয়া ফরয। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা হারে নগদ টাকা কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়-চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও যাকাত আদায় হবে।
-সুনানে নাসায়ী হাদীস ২২৩০-২২৩৩; সুনানে আবু দাউদ হাদীস ১৫৭০-১৫৭২; সুনানে তিরমিযী হাদীস ৬২৩; সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস ১৮০৩ ; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১৩৩-৭১৩৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৫৩৯-১০৫৮১
৪০. যে পরিমাণ যাকাত ফরয হয় স্বেচ্ছায় তার চেয়ে বেশি দিয়ে দিলেও অসুবিধা নেই। এতে যাকাত আদায় এবং বাড়তি দান দু’টোরই ছওয়াব পাওয়া যাবে।
- মুসনাদে আহমদ হাদীস ২০৭৭; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৯০৭
৪১. যাকাত গ্রহণকারীকে একথা জানানোর প্রয়োজন নেই যে, তাকে যাকাত দেওয়া হচ্ছে। যেকোনোভাবে দরিদ্র ব্যক্তিকে যাকাতের মাল দেওয়া হলে মালিক যদি মনে মনে যাকাতের নিয়ত করে তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৮
৪২. অন্যের পক্ষ থেকে যাকাত আদায় করতে হলে তার অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় সে ব্যক্তির পক্ষ থেকে যাকাত আদায় হবে না। আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৯
৪৩. গৃহকর্তা যদি ঘরের লোকদেরকে যাকাত দেওয়ার অনুমতি দিয়ে রাখেন তাহলে তারা যাকাতের নিয়তে কাউকে কিছু দিলে তা যাকাত হিসেবে আদায় হবে। আর যদি পূর্বাগ্রে অনুমতি না দেওয়া থাকে আর ঘরের লোকেরা যাকাত হিসেবে কিছু দান করে তাহলে যাকে দান করা হল সে সেই অর্থ খরচ করার আগেই যদি গৃহকর্তা অনুমতি পাওয়া যায় তাহলেও তা যাকাত হিসেবে আদায় হবে। অন্যথায় যাকাত আদায় হবে না। পুনরায় আদায় করতে হবে।
৪৪. কোনো দরিদ্র ব্যক্তির কাছে কারো কিছু টাকা পাওনা আছে। এখন সে যদি যাকাতের নিয়তে পাওনা মাফ করে দেয় তাহলে যাকাত আদায় হবে না। তাকে যাকাত দিতে হলে নিয়ম হল, প্রথমে তাকে যাকাত প্রদান করা এরপর সেখান থেকে ঋণ উসূল করে নেওয়া। -আদ্দুররুল মুখতার ২/২৭০; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৭১
ঋণগ্রস্তকেই যাকাতের টাকা প্রদান করা উত্তম। কেননা এতে তাকে ঋণের দায় থেকে মুক্ত করা হয়। আর কোনো স্বচ্ছল ব্যক্তি যদি যাকাত থেকে গণ্য করা নিয়ত ছাড়াই ঋণগ্রহীতার ঋণ ক্ষমা করে দেয় তবে তো কথাই নেই। আদ্দুররুল মুখতার ২/২৭১
৪৫. যে দরিদ্র ব্যক্তির কাছে অতি সামান্য মাল আছে, অথবা কিছুই নেই, এমনকি একদিনের খোরাকীও নেই এমন লোক শরীয়তের দৃষ্টিতে গরীব। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
৪৬. যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ অর্থাৎ সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, বাণিজ্যদ্রব্য ইত্যাদি নিসাব পরিমাণ আছে সে শরীয়তের দৃষ্টিতে ধনী। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
৪৭. অনুরূপভাবে যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ নেই, কিন্তু অন্য ধরনের সম্পদ যাতে যাকাত আসে না যেমন ঘরের আসবাবপত্র, পরিধেয় বস্ত্র, জুতা, গার্হস্থ সামগ্রী ইত্যাদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং নিসাব পরিমাণ আছে তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে না।
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১৫৬
এই ব্যক্তির উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।
৪৮. যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদও নিসাব পরিমাণ নেই এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত অন্য ধরনের মাল-সামানাও নিসাব পরিমাণ নেই এই ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৫৩৬
৪৯. যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্থ যে, ঋণ পরিশোধ করার পর তার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে না তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
৫০. কোনো ব্যক্তি নিজ বাড়িতে নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী, কিন্তু সফরে এসে অভাবে পড়ে গেছে বা মাল-সামান চুরি হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে। তবে এ ব্যক্তির জন্য শুধু প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করাই জায়েয, এর বেশি নয়।
(গুগলে প্লেতে যান,
সার্চ করুন ” রমাদান Sunni pedia” আর ডাউনলোড করুন রমাদান অ্যাপটি। জানাবেন আপনার ভালো লাগা না লাগা।)