মাযার নির্মাণ 01
বর্তমানে কতিপয় মুসলমান ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে যেমহানবী (দ:)-সহ ঈমানদার পুণ্যাত্মাবৃন্দের মাযার-রওযাযেয়ারত করে কেউ তাঁদেরকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করারসময় ওসীলা বা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গ্রহণ করলে বা তাঁদেরস্মৃতিবহ কোনো জিনিসকে বরকত আদায়ের মাধ্যম মনেকরলে শেরক কিংবা বেদআত হবে। ভ্রান্তদের মধ্যে কেউকেউ এমনও দাবি করে যে এই কাজ সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-বৃন্দ করেননি, বিগত শতাব্দীগুলোতেও এগুলো অনুশীলিতহয়নি; আর মাযার-রওযার ওপর স্থাপত্য নির্মাণও শরীয়তেআদিষ্ট হয়নি। তারা রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রওযা শরীফের ওপরনির্মিত সবুজ গুম্বজকে বেদআত আখ্যা দিয়ে থাকে(’সালাফী’গুরু নাসিরুদ্দীন আলবানী এটির প্রবক্তা)। আমরাচূড়ান্তভাবে কুরআন ও হাদীসের আলোকে এতদসংক্রান্তফায়সালা এক্ষণে অনুধাবন করবো:
আল-কুরআনের ১ম ‘নস’(দলিল)
আসহাবে কাহ্ফ (বহিঃদৃশ্য)
আসহাবে কাহ্ফ (অভ্যন্তরীন দৃশ্য)
আসহাবে কাহ্ফ (অভ্যন্তরীন দৃশ্য)
কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে,
এবং এভাবে আমি তাদের (আসহাবে কাহাফ) বিষয় জানিয়েদিলাম, যাতে লোকেরা জ্ঞাত হয় যে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্যএবং কিয়ামতে কোনো সন্দেহ নেই; যখন এই সব লোকতাদের (আসহাবে কাহাফ) ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে বিতর্ককরতে লাগলো, অতঃপর তারা বল্লো, ’তাদের গুহার ওপরকোনো ইমারত নির্মাণ করো! তাদের রব (খোদা)-ই তাদেরবিষয়ে ভাল জানেন। ওই লোকদের মধ্যে যারা (এ বিষয়ে) ক্ষমতাধর ছিল তারা বল্লো, ‘শপথ রইলো, আমরা তাদের(আসহাবে কাহাফের পুণ্যময় স্থানের) ওপর মসজিদ নির্মাণকরবো’।”— সূরা কাহাফ, ২১ আয়াত]
তাফসীরে কবীর
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহ:) এই আয়াতের তাফসীরেলেখেন,
কেউ কেউ (ওদের মধ্যে) বলেন যে গুহার দরজা বন্ধ করেদেয়া হোক, যাতে আসহাবে কাহাফ আড়ালে গোপন থাকতেপারেন। আরও কিছু মানুষ বলেন, গুহার দরজায় একটিমসজিদ নির্মাণ করা হোক। তাঁদের এই বক্তব্য প্রমাণ করে যেএই মানুষগুলো ছিলেন ’আল্লাহর আরেফীন (আল্লাহ-জ্ঞানী), যাঁরা এক আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীতে বিশ্বাস করতেন এবংনামাযও পড়তেন’।— তাফসীরে কবীর, ৫ম খণ্ড, ৪৭৫ পৃষ্ঠ
ইমাম রাযী (রহ:) আরও লেখেন:
এবং আল্লাহর কালাম – ‘(এ বিষয়ে) যারা ক্ষমতাশালী’ বলতে বোঝানো হয়ে থাকতে পারে ‘মুসলমান শাসকবৃন্দ’, অথবা আসহাবে কাহাফ (মো’মেনীন)-এর বন্ধুগণ, কিংবাশহরের নেতৃবৃন্দ। ‘আমরা নিশ্চয় তাদের স্মৃতিস্থানের ওপরেমসজিদ নির্মাণ করবো’ – এই আয়াতটিতে এ কথাই বোঝানোহয়েছে, ‘আমরা যাতে সেখানে আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীকরতে পারি এবং এই মসজিদের সুবাদে আসহাবে কাহাফতথা গুহার সাথীদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করতে পারি’।— তাফসীরে কবীর, ৫ম খণ্ড, ৪৭৫ পৃষ্ঠা
অতএব, যারা মাযার-রওযা ধ্বংস করে এবং আল্লাহরআউলিয়াবৃন্দের প্রতি বিদ্বেষভাব প্রদর্শন করে, তারা কুরআনমজীদের সূরা কাহাফে বর্ণিত উপরোক্ত সুস্পষ্ট আয়াতেরসরাসরি বিরোধিতা করে। অথচ কুরআন মজীদ স্পষ্টভাবেব্যক্ত করে যে আউলিয়া কেরাম (রহ:)-এর মাযার-রওযানির্মাণ ও তাঁদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ বৈধ। এটি কুরআনের‘নস’ (দলিল), যাকে নাকচ করা যায় না; এমন কি কোনোহাদীস দ্বারাও নয়। সুতরাং সীমা লঙ্ঘনকারীরা যতোহাদীসের অপব্যাখ্যা করে এ ব্যাপারে অপপ্রয়োগ করে থাকে, সবগুলোকে ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিতে হবে। অর্থাৎ, ‘সাধারণমানুষের’ কবর নির্মাণ করা যাবে না (তবে একবার নির্মিতহলে তা ভাঙ্গাও অবৈধ)। কিন্তু আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া(রহ:)-এর মাযার-রওযা অবশ্যঅবশ্যই নির্মাণ করা জায়েয বাবৈধ, যেমনটি আমরা দেখতে পাই মদীনা মোনাওয়ারায়মহানবী (দ:) এবং সর্ব-হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রা:) ওউমর ফারূক (রা:)-এর রওযা মোবারক সবুজ গুম্বজের নিচেসুশোভিত আছে। সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-ই এই রওযাগুলোনির্মাণ করেন যা শরীয়তের দলিল। [জরুরি জ্ঞাতব্য: সউদী, বৃটিশ ও মার্কিন তহবিলপুষ্ট ‘পণ্ডিতেরা’ এই সকল পবিত্রস্থানকে মসজিদে নববী থেকে অপসারণের অসৎপরিকল্পনায় মাযার-রওযার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে – নাউযুবিল্লাহ!]
তাফসীরে জালালাইন
তাফসীরে নাসাফী
’তাফসীরে জালালাইন’ শিরোনামের বিশ্বখ্যাত সংক্ষিপ্ত ওসহজে বোধগম্য আল-কুরআনের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থে ইমামজালালউদ্দীন সৈয়ুতী (রহ:) ও আল-মোহাল্লী (রহ:) লেখেন:
(মানুষেরা বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল), অর্থাৎ, বিশ্বাসী ওঅবিশ্বাসীরা (ওই) তরুণ (আসহাবে কাহাফ)-দের বিষয়েবিতর্ক করছিল যে তাঁদের পার্শ্বে কোনো স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করাযায় কি-না। এমতাবস্থায় অবিশ্বাসীরা বলে, তাঁদেরকে ঢেকেদেয়ার জন্যে ইমারত নির্মাণ করা হোক। তাঁদের প্রভু-ই তাঁদেরঅবস্থা সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। কিন্তু যে মানুষেরা ওই তরুণআসহাবে কাহাফের বিষয়ে বেশি প্রভাবশালী ছিলেন, মানেবিশ্বাসীরা, তারা বল্লেন, আমরা তাঁদের পার্শ্বে এবাদতেরউদ্দেশ্যে মসজিদ নির্মাণ করবো। আর এটি গুহার প্রবেশপথেপ্রকৃতই নির্মিত হয়েছিল।— তাফসীর আল-জালালাইন, ১মখণ্ড, ৩৮৯ পৃষ্ঠ
ইমাম নাসাফী (রহ:) নিজ ‘তাফসীরে নাসাফী’ পুস্তকেলেখেন:
যারা (আসহাবে কাহাফের বিষয়ে) প্রভাবশালী ছিলেন, তারামুসলমান এবং শাসকবর্গ; এরা বলেন যে গুহার প্রবেশপথেএকটি মসজিদ নির্মাণ করে দেবেন, যাতে ‘মুসলমানবৃন্দসেখানে এবাদত-বন্দেগী করতে পারেন এবং তা (স্মৃতিচিহ্ন) থেকে বরকত আদায় করতে সক্ষম হন’।— তাফসীর আল-নাসাফী, ৩য় খণ্ড, ১৮ পৃষ্ঠ
ইমাম শেহাবউদ্দীন খাফফাজী (রহ:) লেখেন:
(গুহামুখে মসজিদ নির্মাণ) সালেহীন তথা পুণ্যাত্মাবৃন্দেরমাযার-রওযার পার্শ্বে মসজিদ নির্মাণের প্রামাণিক দলিল, যেমনটি উল্লেখিত হয়েছে ‘তাফসীরে কাশশাফ’ পুস্তকে; আরএই দালানের ভেতরে এবাদত-বন্দেগী করা ’জায়েয’ (বৈধ)।”— ইমাম খাফফাজী কৃত ‘এনায়াতুল কাদী’, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৮৭ পৃষ্ঠা; দারুস্ সাদির, বৈরুত, লেবানন হতে প্রকাশিত
কিতাবুল আসার
হযরত হূদ (আঃ) এর মাযার
ইমাম মোহাম্মদ বিন হাসান শায়বানী (রহ:) বলেন,
হযরত ইমাম আবূ হানিফাহ (রহ:) আমাদের জানিয়েছেন এইবলে যে সালিম আফতাস্ আমাদের (তাঁর কাছে) বর্ণনাকরেন: ‘এমন কোনো নবী নেই যিনি কা’বা শরীফে আল্লাহরএবাদত-বন্দেগী করতে নিজ জাতিকে ছেড়ে আসেন নি; আরএর আশপাশে ৩০০ জন নবী (আ:)-এর মাযার-রওযাবিদ্যমান’।”— ইমাম শায়বানীর ‘কিতাবুল আসার’; লন্ডনেTurath Publishing কর্তৃক প্রকাশিত; ১৫০ পৃষ্ঠ
ইমাম শায়বানী (রহ:) আরও বলেন,
ইমাম আবূ হানিফা (রহ:) আমাদেরকে জানিয়েছেন এই বলেযে হযরত আতা’ বিন সায়েব (রা:) আমাদের (তাঁর কাছে) বর্ণনা করেন, ‘আম্বিয়া সর্ব-হযরত হুদ (আ:), সালেহ (আ:) ওশোয়াইব (আ:)-এর মাযার-রওযা মসজিদে হারামে অবস্থিত’।— ইমাম শায়বানীর ‘কিতাবুল আসার’
তাফসীরে তাবারী
মিরক্বাত শরহে মিশক্বাত
তাফসীরে বাহর আল-মুহীত
ইমাম ইবনে জারির তাবারী (রহ:) নিজ ‘তাফসীরে তাবারী’ পুস্তকে লেখেন:
মুশরিকরা বলেছিল, আমরা গুহার পার্শ্বে একটি ইমারতনির্মাণ করবো এবং আল্লাহর উপাসনা করবো; কিন্তুমুসলমানগণ বলেন, আসহাবে কাহাফের ওপর আমাদের হকবেশি এবং নিশ্চয় আমরা ওখানে ‘মসজিদ নির্মাণ করবো’ যাতে আমরা ওতে আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করতে পারি।— তাফসীরে তাবারী, ১৫:১৪৯
মোল্লা আলী কারী ওপরে উদ্ধৃত আয়াতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাদিয়ে বলেন:
যে ব্যক্তি কোনো সত্যনিষ্ঠ বোযর্গ বান্দার মাযারের সন্নিকটেমসজিদ নির্মাণ করেন, কিংবা ওই মাযারে (মাক্কবারা) এবাদত-বন্দেগী করেন, অথবা উক্ত বোযর্গের রূহমোবারকের অসীলায় (মধ্যস্থতায়) সাহায্য প্রার্থনা করেন, বাতাঁর রেখে যাওয়া কোনো বস্তু থেকে বরকত তথা আশীর্বাদঅন্বেষণ করেন, তিনি যদি (এবাদতে) ওই বোযর্গকে তা’যিমবা তাওয়াজ্জুহ পালন না করেই এগুলো করেন, তবে এতেকোনো দোষ বা ভ্রান্তি নেই। আপনারা কি দেখেননি, মসজিদেহারামের ভেতরে হাতীম নামের জায়গায় হযরত ইসমাঈল(আ:)-এর রওযা শরীফ অবস্থিত? আর সেখানে এবাদত-বন্দেগী পালন করা অন্যান্য স্থানের চেয়েও উত্তম। তবেকবরের কাছে এবাদত-বন্দেগী পালন তখনই নিষিদ্ধ হবে, যদি মৃতের নাজাসাত (ময়লা) দ্বারা মাটি অপবিত্র হয়ে যায়।….হাজর আল-আসওয়াদ (কালো পাথর) ও মিযা’য়াব-এরকাছে হাতীম জায়গাটিতে ’৭০জন নবী (আ:)-এর মাযার-রওযা’ বিদ্যমান।”— মিরক্কাত শরহে মিশক্কাত, ২য় খণ্ড, ২০২পৃষ্ঠা
ইমাম আবূ হাইয়ান আল-আনদালুসী (রহ:) বলেন:
তাঁদের (আসহাবে কাহাফের) পার্শ্বে ইমারত নির্মাণের কথা যেব্যক্তি বলেছিল, সে এক অবিশ্বাসী মহিলা। সে গীর্জা নির্মাণেরকথা-ই বলেছিল, যেখানে কুফরী কাজ করা যেতো। কিন্তুমো’মেন বান্দারা তাকে থামিয়ে দেন এবং ওর পরিবর্তেমসজিদ নির্মাণ করেন।— তাফসীরে বাহর আল-মুহীত, ৭মখণ্ড, ১৫৮ পৃষ্ঠা
ইবনুল জাওযী, যাকে কট্টর হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং‘সালাফী’রাও মানে, তিনি উক্ত আয়াতের (১৮:২১) তাফসীরেবলেন:
ইবনে কুতায়বা (রা:) বর্ণনা করেন যে মুফাসসিরীনবৃন্দ মতপ্রকাশ করেছিলেন, ওখানে যাঁরা মসজিদ নির্মাণ করেন, তাঁরাছিলেন মুসলমান রাজা ও তাঁর মো’মেন সাথীবৃন্দ।”— তাফসীরে যা’য়াদ আল-মাসীর, ৫ম খণ্ড, ১২৪ পৃষ্ঠা
মাযার নির্মাণ 02
সুস্পষ্ট হাদীস শরীফ
মসজিদ আল-খায়ফ (মিনায় অবস্থিত)
মজমাউয্ যাওয়াইদ
হযরত ইবনে উমর (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এরহাদীস, যিনি বলেন:
মসজিদে আল-খায়ফের মধ্যে (’ফী’) ৭০ জন নবী (আ:)-এরমাযার-রওযা (এক সাথে) বিদ্যমান।
ইমাম আল-হায়তামী (রহ:) বলেন যে এটি আল-বাযযারবর্ণনা করেন এবং ”এর সমস্ত রাবী (বর্ণনাকারী)-ইআস্থাভাজন”। মানের দিক থেকে এই হাদীস সহীহ। ইমামআল-হায়তামী (রহ:) নিজ ‘মজমাউয্ যাওয়াইদ’ পুস্তকের ৩য়খণ্ডে ‘বাবু ফী মসজিদিল্ খায়ফ’ অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ #৫৭৬৯নং হাদীসটি উদ্ধৃত করেন, যা’তে বিবৃত হয়:
মসজিদে খায়ফের মধ্যে (’ফী’) ৭০ জন আম্বিয়া (আ:)-এরমাযার-রওযা বিদ্যমান।
হুকুম: শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী(রহ:) এ প্রসঙ্গে বলেন,
এই হাদীসের সনদ সহীহ।— মোখতাসারুল বাযযার, ১:৪৭৬
আল-কুরআন ও হাদীস শরীফের এই সমস্ত ‘নস’ তথাদালিলিক প্রমাণ থেকে পরিস্ফুট হয় যে আম্বিয়া (আ:) ওআউলিয়া (রহ:)-বৃন্দের মাযার-রওযায় ইমারত নির্মাণ করাইসলামে বৈধ ও সওয়াবদায়ক কাজ। সীমা লঙ্ঘনকারীরাবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদেরকে ’মুশরিকীন’ বামূর্তিপূজারী বলে আখ্যা দেয় এই বলে যে মাযার-রওযাগুলোহচ্ছে ‘মূর্তির ঘর’ (নাউযুবিল্লাহ); আর তাই বুযূর্গানে দ্বীনেরমাযার, এমন কি মহানবী (দ:)-এর রওযা শরীফও ধ্বংসকরতে হবে বা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। জান্নাতে বাকীও মু’য়াল্লায় বহু সাহাবা-এ-কেরামে (রা:)-এর মাযার-রওযাএভাবে তারা গুঁড়িয়ে দেবার মতো জঘন্য কাজ করেছে। কিন্তুমুসলমানদের চাপে তারা হুযূর পূর নূর (দ:)-এর রওযা শরীফভাঙ্গতে পারেনি।
আল-কুরআনের ২য় ‘নস’(দলিল)
কবর
|
* মাযার
|
* যিয়ারাত
|
* মাযার নির্মাণ
|
আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কুরআনে এরশাদ ফরমান:
এবং স্মরণ করুন, যখন আমি এ ঘরকে (কা’বা শরীফকে) মানবজাতির জন্যে আশ্রয়স্থল ও নিরাপদ স্থান করেছি; আর(বল্লাম), ‘ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে (মাকামে ইবরাহীমনামের পাথরকে যার ওপর দাঁড়িয়ে তিনি কা’বা ঘর নির্মাণকরেন) নামাযের স্থান হিসেবে গ্রহণ করো’; এবং ইবরাহীম ওইসমাঈলকে তাকিদ দিয়েছি, ‘আমার ঘরকে পুতঃপবিত্রকরো, তাওয়াফকারী, এ’তেকাফকারী এবং রুকু’ ওসেজদাকারীদের জন্যে।” (জ্ঞাতব্য: তাওয়াফের পরেদু’রাকআত নামায ওখানে পড়তে হয়)— সূরা বাকারাহ, ১২৫আয়াত, মুফতী আহমদ এয়ার খানের ’নূরুল এরফান’ বাংলাতাফসীর থেকে সংগৃহীত; অনুবাদক: মওলানা এম, এ, মন্নান, চট্টগ্রাম
আল-কুরআনের অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:
সেটির মধ্যে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি রয়েছে – ইবরাহীমের দাঁড়াবারস্থান (মাকাম-এ-ইব্রাহীম); আর যে ব্যক্তি সেটির অভ্যন্তরেপ্রবেশ করে, সে নিরাপত্তার মধ্যে থাকে; এবং আল্লাহর জন্যেমানবকুলের ওপর ওই ঘরের হজ্জ্ব করা (ফরয), যে ব্যক্তিসেটি পর্যন্ত যেতে পারে। আর যে ব্যক্তি অস্বীকারকারী হয়, তবে আল্লাহ সমগ্র জাহান (জ্বিন ও ইনসান) থেকে বে-পরোয়া।— সূরা আল-এ-ইমরান, ৯৭ আয়াত, মুফতী আহমদএয়ার খান কৃত ‘নূরুল এরফান’ তাফসীর হতে সংগৃহীত
আল্লাহতা’লা তাঁর প্রিয় বন্ধুদের এতো ভালোবাসেন যে ‘এইধরনের নির্দিষ্ট বা চিহ্নিত করা স্থানে’ প্রার্থনা করাকে তিনিহজ্জ্বের প্রথা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এতে যদি বিন্দুপরিমাণ শেরকের (অংশীবাদের বা মূর্তিপূজার) সম্ভাবনাথাকতো, অর্থাৎ, মানুষেরা আম্বিয়া (আ:)-এর মাযার-রওযা ওপদচিহ্নকে ‘আল্লাহ ভিন্ন অন্য উপাস্য দেবতা’ হিসেবে যদিগ্রহণ করা আরম্ভ করতো, তাহলে আল্লাহতা’লা নিজ কুরআনমজীদে তাঁর অবারিত রাজসিক সম্মান তাঁরই প্রিয় বন্ধুদেরপ্রতি দেখাতেন না।
বস্তুতঃ পবিত্র কুরআন মজীদ এই সব স্থানকে‘শআয়েরুল্লাহ’ (আল্লাহকে স্মরণ হয় এমন সম্মানপ্রদর্শনযোগ্য চিহ্ন) হিসেবে সম্বোধন করে; আর আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রহ:)-বৃন্দের মাযার-রওযা (নবীদের কারোকারো রওযা মসজিদে হারামের মধ্যেও বর্তমান) অবশ্যঅবশ্যশআয়েরুল্লাহ’র অন্তর্ভুক্ত। যে কেউ এই মাযার-রওযার ক্ষতিকরলে প্রকৃতপ্রস্তাবে আল্লাহতা’লার সাথেই যুদ্ধে জড়িয়েযাবে, যেমনটি সহীহ বেখারী শরীফে বর্ণিত একটি হাদীসেকুদসীতে ঘোষিত হয়েছে:
যে ব্যক্তি আমার ওলী (বন্ধু)’র প্রতি বৈরীভাবাপন্ন হয়, তাকেআমি আমার সাথে যুদ্ধ করার জন্যে আহ্বান জানাই।— সহীহ বোখারী, হাদীসে কুদসী, ৮ম খণ্ড, ১৩১ পৃষ্ঠা
বিরোধীরা হয়তো ধারণা করতে পারে যে তারা হয়তো মাযার-রওযা ভেঙ্গে কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর সাথে যুদ্ধে জয়ীহচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে আল্লাহতা’লা ওহাবী/’সালাফী’ গোষ্ঠীরনিষ্ঠুর ও বর্বরতা প্রকাশ করে দিয়ে আহল্ আস্ সুন্নাহ’রশিক্ষাকেই সারা বিশ্বে প্রচার-প্রসার করছেন। সীমালঙ্ঘনকারীদের জঘন্য কাজের পরে আহল্ আস্ সুন্নাহ (সুন্নীমুসলমানবৃন্দ) বিশ্বব্যাপী গোমরাহদের বদ আকীদার খণ্ডনকরছেন, এবং আল-হামদু লিল্লাহ, এটি নিশ্চয় আল-ফাতহুলবারী (খোদাতা’লার বিজয় তথা তাঁর পক্ষ হতে বিজয়), যাসীমা লঙ্ঘনকারীরা উপলব্ধি করতে পারছে না। আল্লাহহলেন সবচেয়ে সেরা পরিকল্পনাকারী এবং তিনি তাঁরসালেহীন বা পুণ্যবান বান্দাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীলোকদেরকে জমিনের ওপর তাদের ধ্বংসযজ্ঞ/নৈরাজ্যচালানোর ক্ষণিক সুযোগ দেন; কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতিআল্লাহর লা’নত বা অভিসম্পাত বর্ষিত হয়, যেমনটি আল-কুরআন এরশাদ ফরমায়:
এবং ওই সব লোক, যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকারকে তাপাকাপাকি হবার পর ভঙ্গ করে, এবং যা জুড়ে রাখার জন্যেআল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, সেটি ছিন্ন করে এবং জমিনেফাসাদ ছড়ায়, তাদের অংশ হচ্ছে অভিসম্পাত-ই এবং তাদেরভাগ্যে জুটবে মন্দ আবাস-ঘর।— সূরা রা’দ, ২৫ আয়াত
অতএব, এ ধরনের লা’নতপ্রাপ্ত লোকেরা জমিনের ওপরফাসাদ (বিবাদ-বিসম্বাদ) সৃষ্টি করে এবং পবিত্র স্থানগুলোধ্বংস করে। তারা মনে করে যে তারা সত্যপথে আছে, কিন্তবাস্তবে খারেজী-সম্পর্কিত আল-বোখারীর হাদীসে যেমনপ্রমাণিত, ঠিক তেমনি তারাও খারেজীদের মতোই পথভ্রষ্টহয়েছে।
আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন,
নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু; সুতরাং তোমরাও তাকে শত্রুমনে করো। সে তো আপন দলকে এ জন্যেই আহ্বান করেযেন তারা দোযখীদের অন্তর্ভুক্ত হয়— সূরা ফাতির, ৬ আয়াত
। ইমাম আহমদ আল-সাবী (রহ:) ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী(রহ:)-এর কৃত ‘তাফসীরে জালালাইন’ গ্রন্থের চমৎকারহাশিয়ায় এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন:
এ কথা বলা হয় যে এই আয়াতটি খারেজীদের (ভবিষ্যতেআবির্ভাব) সম্পর্কে নাযেল হয়েছিল, যারা কুরআন-সুন্নাহ’রঅর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পরিবর্তন করেছিল এবং এরইভিত্তিতে মুসলমান হত্যা ও তাঁদের ধন-সম্পত্তি লুঠপাটকে বৈধজ্ঞান করেছিল, যেমনটি আজকাল দেখা যায় তাদেরউত্তরসূরী হেজায অঞ্চলের ওহাবীদের মাঝে। ওহাবীরা ‘একথা মনে করছে তারা (বড় কূটনীতিমূলক) কিছু করেছে।ওহে শুনছো, নিশ্চয় তারাই মিথ্যুক। তাদের ওপর শয়তানবিজয়ী হয়ে গিয়েছে, সুতরাং সে তাদেরকে ভুলিয়েদিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। তারা শয়তানের দল। শুনছো! নিশ্চয় শয়তানের দল-ই ক্ষতিগ্রস্ত’ (আল-কুরআন, ৫৮:১৮-৯)। আমরা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি যাতে তিনিতাদেরকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেন।— হাশিয়া আল-সাবীআ’লাল জালালাইন, ৩:২৫৫
জরুরি জ্ঞাতব্য: ওহাবীরা ধূর্ততার সাথে এই বইটির মধ্যথেকে ‘ওহাবী’ শব্দটি অপসারণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারাহাতে-নাতে ধরা পড়ে যায়। আল্লাহতালা-ই ইসলামী জ্ঞানকেহেফাযত করেন।
মাযার নির্মাণ 03
জরুরি জ্ঞাতব্য: ওহাবীরা ধূর্ততার সাথে এই বইটির মধ্যথেকে ‘ওহাবী’ শব্দটি অপসারণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারাহাতে-নাতে ধরা পড়ে যায়। আল্লাহতালা-ই ইসলামী জ্ঞানকেহেফাযত করেন।
অন্যান্য দলিলসমূহ
দলিল নং – ১
আমরা এবার ‘কবরের আকার-আকৃতি’ বিষয়টির ফয়সালাকরবো।
হযরত আবূ বকর বিন আইয়াশ (রা:) বর্ণনা করেন: হযরতসুফিয়ান আত্ তাম্মার (রা:) আমাকে জানান যে তিনিমহানবী (দ:)-এর রওযা মোবারককে উঁচু ও উত্তল দেখতেপেয়েছেন।— সহীহ বোখারী, ২য় খণ্ড, ২৩তম বই, হাদীস নং৪৭৩
অতএব, মাযার-রওযা ভেঙ্গে ফেলা বা গুঁড়িয়ে দেয়া‘সালাফী’দের দ্বারা ‘নস’ বা শরয়ী দলিলের চরম অপব্যাখ্যাছাড়া কিছুই নয়।
মহান হানাফী মুহাদ্দীস ইমাম মোহাম্মদ ইবনে হাসসানশায়বানী (রহ:) এতদসংক্রান্ত বিষয়ে গোটা একটি অধ্যায়বরাদ্দ করে তার শিরোনাম দেন ‘কবরের ওপর উঁচুস্তূপাকৃতির ও আস্তর’। এই অধ্যায়ে তিনি নিম্নেরহাদীসটি লিপিবদ্ধ করেন:
ইমাম আবূ হানিফা (রহ:) আমাদের কাছে হযরত হাম্মাদ(রহ:)-এর কথা বর্ণনা করেন, তিনি হযরত ইবরাহীম (রা:)-এরকথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন, কেউ একজন আমাকেজানান যে তাঁরা মহানবী (দ:), হযরত আবূ বকর (রা:) ওহযরত উমর (রা:)-এর মাযার-রওযার ওপরে ‘উঁচু স্তূপাকৃতিরফলক যা (চোখে পড়ার মতো) বাইরে প্রসারিত ছিল তাদেখতে পেয়েছিলেন এবং তাতে আরও ছিল সাদাএঁটেলমাটির টুকরো।
ইমাম মোহাম্মদ (রহ:) আরও বলেন
আমরা (আহনা’ফ) এই মতকেই সমর্থন করি; মাযার-রওযাবড় স্তূপাকৃতির ফলক দ্বারা চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু তাবর্গাকৃতির হতে পারবে না। এটি-ই হচ্ছে ’ইমাম আবূ হানিফা(রহ:)-এর সিদ্ধান্ত’।— কিতাবুল আসা’র, ১৪৫ পৃষ্ঠা, Turath Publishing কর্তৃক প্রকাশিত
সীমা লঙ্ঘনকারীরা দাবি করে, সকল মাযার-রওযা-ই গুঁড়িয়েদিতে বা ধ্বংস করতে হবে। এটি সরাসরি সুন্নাহর সাথেসাংঘর্ষিক। কেননা, তারা যে হাদীসটিকে এ ক্ষেত্রেঅপপ্রয়োগ করে, তা মুশরিকীন (অংশীবাদী)-দের সমাধিসম্পর্কে বর্ণিত, মো’মেনীন (বিশ্বাসী মুসলমান)-দের কবরসম্পর্কে নয়। মাযার-রওযা নির্মাণ বৈধ, কারণ রাসূলুল্লাহ(দ:), সর্ব-হযরত আবূ বকর (রা:) ও উমর ফারূক (রা:) এবংঅন্যান্য সাহাবা (রা:)-দের মাযার-রওযা উঁচু স্তূপাকৃতিরফলক দ্বারা নির্মিত হয়েছিল মর্মে দলিল বিদ্যমান। আমরাজানি, ওহাবীরা চিৎকার করে বলবে আমরা কেন ইমামমোহাম্মদ (রহ:)-এর বইয়ের পরবর্তী পৃষ্ঠার উদ্ধৃতি দেই নি, যেখানে তিনি কবরে আস্তর না করার ব্যাপারে বলেছেন। কিন্তুমনে রাখতে হবে যে তিনি তাতে সাধারণ কবরের কথা-ইবলেছিলেন, আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রহ:)-এর মাযার-রওযা সম্পর্কে নয়, যেমনিভাবে ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।আমরা এখানে কিছু ছবি দেখাতে চাই যা’তে দৃশ্যমান হয় যেমুশরিকীন/খৃষ্টানদের সমাধি এমন কি তাদের দ্বারাও (মাটিরসাথে) ‘সমান’ রাখা হয় (অতএব, ইসলামী প্রথানুযায়ীমুসলমানদের কবর মাটির সাথে সমান নয়, বরং উচুঁস্তূপাকৃতির ফলক দ্বারা মাটি থেকে ওপরে হওয়া চাই)। তবেখৃষ্টান সম্প্রদায় মরিয়ম ও যিশুর মূর্তি তাদের মৃতদেরসমাধিতে স্থাপন করে যা ইসলাম ধর্মমতে নিষেধ।[অনুবাদকের নোট: এই ছবিগুলো অনুবাদশেষে পিডিএফআকারে মিডিয়াফায়ার ও স্ক্রাইব্ড সাইটে প্রকাশ করা হবে, ইনশা’আল্লাহ]
মুসলমানদের কবর ও মুশরিকীন (অংশীবাদী)-দের সমাধিরমধ্যকার পার্থক্য বোঝার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছবি
(ক) প্রথম ছবিটিতে দেখা যায় খৃষ্টানদের সমাধিসম্পূর্ণভাবে মাটির সাথে মেশানো তথা মাটির সমান, যা ওহাবীরা আমাদের বিশ্বাস করতে বলে এই মর্মেযে, মুসলমানদের কবরও অনুরূপ হওয়া উচিত।[কিন্তু বেশ কিছু হাদীসে ইহুদী ও খৃষ্টানদের বিপরীতকরতে আমরা আদিষ্ট হয়েছে, যা প্রমাণ করে যেমুসলমানদের কবর পাকা হওয়া উচিত; তবে কোনোমূর্তি ওর ওপরে নির্মাণ করা চলবে না]
(খ) দ্বিতীয় দুটি ছবিতে স্পষ্ট হয় যে খৃষ্টানগণ‘সমাধির ঠিক ওপরে মূর্তি নির্মাণ করেন’। অথচমুসলমান সূফী-দরবেশদের মাযার-রওযার ঠিকওপরে ইমারত (অবকাঠামো) নির্মিত হয় না, বরংতাঁদের মাযার-রওযাগুলো দালান হতে পৃথক, যেটিবিভিন্ন হাদীসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যে হাদীসগুলোএমন কি ওহাবীরাও অপপ্রয়োগ করে থাকে।
পবিত্র রওজা শরীফ
পক্ষান্তরে, নিচের ছবিগুলো ইসলামের অত্যন্ত পবিত্রস্থানসমূহের, যা’তে অন্তর্ভুক্ত মহানবী (দ:), সাইয়েদুনা আবূবকর (রা:) ও সাইয়েদুনা উমর ফারূক (রা:)-এর মোবারকরওযাগুলো, যেগুলো নির্মিত হয়েছিল বহু শতাব্দী আগে।জেরুসালেমে বায়তুল আকসা’র গুম্বজটি মুসলমানদেরজন্যে তৃতীয় সর্বাধিক পবিত্র স্থান। অথচ এতে শুধু রয়েছেমহানবী (দ:)-এর কদম মোবারকের চিহ্ন, যেখান থেকে তিনিমে’রাজে গমন করেন!
বায়তুল মুকাদ্দাসের গম্বুজ
বায়তুল মোকাদ্দসের এই সুপ্রাচীন গুম্বজসম্বলিত ইসলামীইমারতটি এখন হুমকির মুখোমুখি, কারণ ওহাবী মতবাদঅনুযায়ী এ ধরনের ইমারত মন্দ বেদআত (উদ্ভাবন)।
বায়তুল মুকাদ্দাসের এইস্থানে মিরাজের রাসূলুল্লাহ (দ:) ঊর্ধ্বগমন শুরু করেন
মে’রাজের গুম্বজটি এর পাশেই অবস্থিত, যেখান থেকেরাসূলুল্লাহ (দ:) ঊর্ধ্বগমন শুরু করেন। ওহাবী মতে, পবিত্রস্থানে এ ধরনের গুম্বজ নির্মাণ ও একে গুরুত্ব প্রদান মন্দএকটি বেদআত এবং তারা শেরকের ভয়ে এটি বুলডজারদিয়ে ধূলিসাৎ করা সমীচীন মনে করে। ইসলামের শত্রুদেরশুধু ওহাবী মতাবলম্বীদের হাতে ক্ষমতা দেয়াই বাকি, যা দ্বারাওহাবীরা মে’রাজের গুম্বজসহ সকল বিদ্যমান ইসলামীঐতিহ্যবাহী স্থানকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে।
যমযম কূপ
যমযম কুয়ার ওপরে গুম্বজ নির্মিত হয় ইসলামের প্রাথমিকযুগে, খলীফা আল-মনসূরের শাসনামলে (১৪৯ হিজরী)।ওহাবী মতবাদ অনুসারে এটিও মন্দ বেদআত ও শেরেকী কর্মহবার কথা। তাদের কুপ্রথানুযায়ী পৃথিবীতে ঐতিহ্যবাহীআল্লাহর শ’আয়ের তথা স্মারক চিহ্নের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকরা শেরেকের পর্যায়ভুক্ত হবে। অথচ এই ফেরকাহ’রস্ববিরোধিতার চূড়ান্ত নিদর্শনস্বরূপ খোদায়ী আশীর্বাদধন্যযমযম কুয়ার ওপর ওহাবী-সমর্থক সউদী রাজা-বাদশাহবর্গ-ইইমারত নির্মাণ করে দিয়েছে।
এক্ষণে আমরা চিরতরে ওপরে উদ্ধৃত ওহাবীদের অপযুক্তিরমূলোৎপাটন করবো, এমন কি কবরে আস্তর করা, ওর ওপরে’মাকতাব’ স্থাপন, বা কবরের ধারে বসার বিষয়গুলোও এতেঅন্তর্ভুক্ত হবে। হাদীসশাস্ত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে হাদীস জাল করাএবং কোনো রওয়ায়াতের প্রথমাংশ সম্পর্কে স্পষ্ট ব্যাখ্যাকারীবাকি অংশগুলোর গোপনকারী হিসেবে ওহাবীদের কুখ্যাতিআছে। কবর আস্তর না করার পক্ষে হাদীস উদ্ধৃত করার পরেআপনারা কোনো ওহাবীকেই কখনো দেখবেন না ইমামতিরমিযী (রহ:) ও ইমাম হাকিম (রহ:)-এর এতদসংক্রান্তসিদ্ধান্ত বর্ণনা করতে। পক্ষান্তরে, আমাদের সুন্নীপন্থী ইসলাম’আওয়ামুন্ নাস’ তথা সর্বসাধারণের সামনে পুরো চিত্রটুকুতুলে ধরতেই আমাদেরকে আদেশ করে, যাতে তাঁরা বুঝতেসক্ষম হন কেন হযরত হাসান আল-বসরী (রহ:), ইমামশাফেঈ (রহ:) ও ইমাম হাকিম (রহ:)-এর মতো সর্বোচ্চপর্যায়ের মেধাসম্পন্ন মোহাদ্দেসীনবৃন্দ এই সব হাদীসকেআক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেননি।
’কবরে আস্তর না করা, না লেখা বা বসা’ সংক্রান্ত হাদীসটিবর্ণনার পরে ইমাম তিরমিযী (রহ:) বলেন:
এই হাদীসটি হাসান সহীহ এবং এটি বিভিন্ন সনদ বা সূত্রেহযরত জাবের (রা:) হতে বর্ণিত হয়েছে। কিছু উলেমা (কাদা) মাটি দ্বারা কবর আস্তর করার অনুমতি দিয়েছেন; এঁদের মধ্যেরয়েছেন ইমাম হাসান আল-বসরী (আমীরুল মো’মেনেীনফীল্ হাদীস)। অধিকন্তু, ইমাম শাফেঈ (রহ:) কাদামাটি দ্বারাকবর আস্তর করাতে কোনো ক্ষতি দেখতে পাননি।— সুনানেতিরমিযী, কবর আস্তর না করার হাদীস ,১০৫২
ওহাবীরা তবুও অজুহাত দেখাবে যে ইমাম তিরমিযী (রহ:) তো কাদামাটি দিয়ে কবর আস্তর করতে বলেছিলেন, সিমেন্টদিয়ে করতে বলেননি। এমতাবস্থায় এর উত্তর দিয়েছেন ইমামআল-হাকিম (রহ:), যিনি অনুরূপ আহাদীস বর্ণনার পরেবলেন:
এ সকল আসানীদ (সনদ) সহীহ, কিন্তু পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্তমুসলমান জ্ঞান বিশারদগণ এগুলো আমল বা অনুশীলনকরেননি। কবরের ওপরে ফলকে লেখা মুসলমানদের পরবর্তীপ্রজন্ম ‘সালাফ’বৃন্দ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন।— মোস্তাদরাক-এ-হাকিম, ১:৩৭০, হাদীসঃ ১৩৭০
সুতরাং এতজন ইসলামী বিদ্বান এই মত পোষণ করার দরুনপ্রমাণিত হয় যে ওহাবীরা যেভাবে উক্ত হাদীসগুলোকে বুঝেথাকে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো সেই অর্থজ্ঞাপক নয়। মনে রাখাজরুরি যে, এই মহান মোহাদ্দেসীনবৃন্দ ওহাবীদের মনগড়াচিন্তাভাবনা থেকে আরও ভালভাবে হাদীসশাস্ত্র সম্পর্কেজানতেন এবং বুঝতেন।
হযরত আম্বিয়া (আ:)-এর মাযার-রওযা আস্তর করার বৈধতাপ্রমাণকারী রওয়ায়াতটি হযরত আবূ আইয়ুব আনসারী (রা:) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে; তিনি বলেন:
আমি মহানবী (দ:)-এর কাছে এসেছি, পাথরের কাছে নয়— মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, হাদীসঃ ২৩৪৭৬
ইমাম আল-হাকিম (রহ:)-ও এটি বর্ণনা করে এর সনদকেসহীহ বলেছেন; তিনি বলেন,
আয্ যাহাবীও তাঁর (ইমাম আহমদের) তাসহিহ-এর সাথেএকমত হয়েছেন এবং একে সহীহ বলেছেন।— মোস্তাদরাকআল-হাকিম, আয্ যাহাবীর তালখীস সহকারে ৪:৫৬০, হাদীসঃ ৮৫৭১
এই রওয়ায়াত প্রমাণ করে যে নবী পাক (দ:)-এর রওযামোবারক আস্তরকৃত ছিল, নতুবা হযরত আবূ আইয়ুবআনসারী (রা:) স্বৈরশাসক মারওয়ানকে খণ্ডন করার সময়‘পাথর’ শব্দটি ব্যবহার করতেন না। এই আনসার সাহাবী(রা:)-এর রওয়ায়াতটি হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এরআকীদা-বিশ্বাস ও মারওয়ানের মতো স্বৈরশাসকদের ভ্রান্তধারণার পার্থক্যও ফুটিয়ে তোলে (অনুরূপভাবে আমাদেরপবিত্র স্থানগুলোও ওহাবীদের মতো স্বৈরশাসক জবরদখলকরে রেখেছে, যা তাদের ন্যায়পরায়ণতা সাব্যস্ত করে না; কারণ ইতিপূর্বেও মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারাএয়াযীদ, হাজ্জাজ বিন ইউসূফ, মারওয়ানের মতোজালেমদের অধীনে ছিল)। মহানবী (দ:)-এর পবিত্র রওযায়কাউকে মুখ ঘষতে দেখে মারওয়ান হতভম্ব হয়েছিল। সেযখন বুঝতে পারে এই ব্যক্তি-ই সাহাবী হযরত আবূ আইয়ুবআল-আনসারী (রহ:), তখন একেবারেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েযায়।
ওহাবীরা অপর যে বিষয়টির অপব্যবহার করে, তা হলোকবরের ধারে বসা। এ প্রসঙ্গে ইমাম মালেক (রহ:) প্রণীত‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থে একটি চমৎকার হাদীস বর্ণিত হয়েছে, আরএতে ইমাম মালেক (রহ:)-এর নিজেরও একটি চূড়ান্তমীমাংসাকারী সিদ্ধান্ত বিদ্যমান, যা প্রমাণ করে যে রাসূলুল্লাহ(দ:) সার্বিকভাবে মানুষদেরকে কবরের ধারে বসতে নিষেধকরেননি, বরং পেশাব-মলত্যাগ করতে নিষেধ করেছিলেন; কেননা, ’তা আক্ষরিক অর্থেই কবরবাসীর ক্ষতি করে।’ এইসব হাদীসে ব্যবহৃত ‘আ’লা’ (ওপরে) শব্দটি ইচ্ছাকৃতভাবেওহাবীরা ভুল বুঝে থাকে, যাতে তাদের ধোকাবাজীর প্রসারঘটানো যায়।
ইমাম মালেক (রহ:) নিম্নবর্ণিত শিরোনামে গোটা একখানাঅধ্যায় বরাদ্দ করেছেন:
”জানাযার জন্যে থামা এবং কবরস্থানের পাশে বসা” – উক্ত অধ্যায়ে বর্ণিত দ্বিতীয় রওয়ায়াতে বিবৃত হয়:
এয়াহইয়া (রা:) আমার (ইমাম মালেকের) কাছে বর্ণনা করেনমালেক (রা:) হতে, যিনি শুনেছিলেন এই মর্মে যে, হযরতআলী ইবনে আবি তালেব (ক:) কবরে মাথা রেখে পাশে শুয়েথাকতেন। মালেক (রা:) বলেন, ‘আমরা যা দেখেছি, কবরেরধারে পেশাব-মলত্যাগ করার ক্ষেত্রেই কেবল নিষেধ করাহয়েছে’।— মুওয়াত্তা-এ-ইমাম মালেক, ১৬তম বই, অধ্যায়১১, হাদীস ৩৪
মনে রাখা জরুরি, অনেক ইসলামী পণ্ডিতের মতে বোখারীশরীফ হতে ইমাম মালেক (রহ:)-এর ’মুওয়াত্তা’ গ্রন্থটি অধিককর্তৃত্বসম্পন্ন।
কুরআন মজীদে যেমন এরশাদ হয়েছে:
আল্লাহ তা (কুরআন মজীদ) দ্বারা অনেককে গোমরাহ(পথভ্রষ্ট) করেন এবং অনেককে হেদায়াত (পথপ্রদর্শন) করেন।— আল-কুরআন, ২:২৬
যদি কুরআন মজীদ পাঠ করে মানুষেরা গোমরাহ হতে পারে(যেমনটি হয়েছে ওহাবীরা), তাহলে একইভাবে হাদীসশরীফও যথাযথভাবে বিশেষজ্ঞদের অধীনে পাঠগ্রহণ না করেঅধ্যয়নের চেষ্টা করলে তা দ্বারা মানুষজন পথভ্রষ্ট হতে পারে।
এ কারণেই মহান সালাফ আস্ সালেহীন (প্রাথমিক যুগেরপুণ্যাত্মাবৃন্দ) ইমাম সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রহ:) ও ইবনেওহাব (রহ:) কী সুন্দর বলেছেন:
সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রহ:) বলেন,
হাদীসশাস্ত্র পথভ্রষ্টতা, ফকীহমণ্ডলীর মধ্যস্থতা ব্যতিরেকে।
ইবনে ওহাব (রহ:) বলেন,
হাদীসশাস্ত্র গোমরাহী, উলেমাবৃন্দের মধ্যস্থতা ব্যতিরেকে।— উদ্ধৃতিটি ইমাম কাজী আয়ায কৃত ‘তারতীব আল-মাদারিব’ গ্রন্থের ২৮ পৃষ্ঠায় বিদ্যমান
অধিকন্তু, ইমাম আবূ হানিফা (রহ:)-কে একবার বলা হয়, ‘অমুক মসজিদে তমুক এক দল আছে যারা ফেকাহ (ইসলামধর্মশাস্ত্র সম্পর্কিত সূক্ষ্ম জ্ঞান) বিষয়ে আলাপ-আলোচনাকরে।’ তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘তাদের কি কোনো শিক্ষকআছে?’ উত্তরে বলা হয়, ‘না।’ এমতাবস্থায় হযরত ইমাম (রহ:) বলেন, ‘তাহলে তারা কখনোই এটি বুঝতে সক্ষম হবে না।’— ইবনে মুফলিহ রচিত ‘আল-আদাব আশ্ শরিয়াহ ওয়াল্মিনাহ আল-মারিয়া’, ৩ খণ্ডে প্রকাশিত, কায়রোতে পুনর্মুদ্রিতসংস্করণ, মাকতাবা ইবনে তাইমিয়া, কায়রো, ১৩৯৮ হিজরী/১৯৭৮ খৃষ্টাব্দ, ৩:৩৭৪
অতএব, এক্ষণে ওহাবীদের পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে ভাবুন, যাদেরহাদীসশাস্ত্র-বিষয়ক প্রধান হর্তাকর্তা নাসের আদ্ দালালাহমানে আলবানীর এই শাস্ত্রে কোনো এজাযা ও স্তর-ই নেই; ঘুরে ঘুরে ফতোয়াদাতা সাধারণ ‘সালাফী’দের কথা তো বহুদূরেই রইলো!
দলিল নং – ২
মহান হানাফী আলেম মোল্লা আলী কারী তাঁর চমৎকার’মিরকাত শরহে মিশকাত’ গ্রন্থে লেখেন:
সালাফ তথা প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ প্রখ্যাত মাশায়েখ(পীর-বোযর্গ) ও হক্কানী উলেমাবৃন্দের মাযার-রওযা নির্মাণকেমোবাহ, অর্থাৎ, জায়েয (অনুমতিপ্রাপ্ত) বিবেচনা করেছেন, যাতে মানুষেরা তাঁদের যেয়ারত করতে পারেন এবং সেখানে(সহজে) বসতে পারেন।— মিরকাত শরহে মিশকাত, ৪র্থ খণ্ড, ৬৯ পৃষ্ঠা
মহান শাফেঈ আলেম ও সূফী ইমাম আব্দুল ওয়াহহাবশারানী (রহ:) লেখেন:
আমার শিক্ষক আলী (রহ:) ও ভাই আফযালউদ্দীন (রহ:) সাধারণ মানুষের কবরের ওপরে গুম্বজ নির্মাণ ও কফিনেমৃতদের দাফন এবং (সাধারণ মানুষের) কবরের ওপরে চাদরবিছানোকে নিষেধ করতেন। তাঁরা সব সময়-ই বলতেন, গুম্বজ ও চাদর চড়ানোর যোগ্য একমাত্র আম্বিয়া (আ:) ওমহান আউলিয়া (রহ:)-বৃন্দ। অথচ, আমরা মনুষ্য সমাজেরপ্রথার বন্ধনেই রয়েছি আবদ্ধ।— আল-আনওয়ারুলকুদসিয়্যা, ৫৯৩ পৃষ্ঠা