বাতীল ৭২ ফির্কার ১টি ব্রিটিশ রেজিষ্টার্ড, বাতীল স্ব-ঘোষিত আহলে হাদিস ফির্কা বা ব্রিটিশ ফির্কাঃ আহলে হাদিস আহলে ইসলাম নয়।
আমাদের এ অঞ্চলে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে ‘আহলে হাদীস’ নামে এক নতুন দলের প্রচারণা চলছে।
নিজেদেরকে তারা এ নামে পরিচিত করতেই পছন্দ করে। তবে লোকমুখে তারা ‘সালাফী’ ‘গায়রে মুকাল্লিদ’ ‘লা মাযহাবী’ ইত্যাদি নামেও পরিচিত।
ইসলামের ইতিহাসের হাজার বছরের ঐতিহ্য হচ্ছে—যখন থেকে মুজতাহিদ ইমামগণের মাযহাবের সূচনা হয়েছে, তখন থেকে সাধারণ মানুষেরা বরেণ্য সে ইমামগণের মাযহাবই অনুসরণ করে আসছে।
পবিত্র কুরআন ও হাদীসে যে বিষয়ে অকাট্য ও স্পষ্ট বিধান রয়েছে, সেখানে সরাসরি কুরআন ও হাদীসের সে বিধানই অনুসরণ করা হয়। যেমন, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরজ। এ নিয়ে ভিন্ন কোনো মাযহাব নেই। কিন্তু যে সকল বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই কিংবা একই বিষয়ে একাধিক বিধান বর্ণিত হয়েছে, সেখানেই মুজতাহিদ ইমামগণের মাযহাব মানা হয়। কুরআন ও হাদীসের ওপর তাঁদের ছিল অগাধ পান্ডিত্য। সাগর সেচে মুক্তা আনার মতোই তাঁরা কুরআন ও হাদীসের দ্ব্যর্থবোধক অস্পষ্ট ও অব্যক্ত হাজারও বিষয় চিহ্নিত করেছেন এবং সে সবের সমাধান বের করতে প্রয়াসী হয়েছেন।
দীনি বিষয়ে যাদের জ্ঞান শূন্যের কোঠায় কিংবা অতি সামান্য, তাদের পক্ষে কি সম্ভব — তারা নিজেরা দীনের প্রতিটি বিষয়ে কিংবা যে কোনো একটি বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীস ও শরিয়তের মূলনীতিকে সামনে রেখে গবেষণা করে সমাধান বের করে এনে এর ওপর আমল করবে?
এ যে অসম্ভব — তা কে অস্বীকার করতে পারে?
যদি সবাইকে এ গবেষণার দায়িত্ব দেয়া হতো, তাহলে তো দীনের অনুসরণই অসম্ভব হয়ে পড়ত।
মানুষের স্বাভাবিকতাকে বিবেচনায় রেখে স্বভাবধর্ম ইসলামে তাই নির্দেশ দেয়া হয়েছে—
‘তোমরা যদি না জান, তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো।’
[সুরা নাহল : আয়াত ৪৩।]
জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করে করে ইসলাম অনুসরণের এ ধারা চলে আসছে ইসলামের শুরুলগ্ন থেকে, একেবারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকেই। যে সকল সাহাবিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন এলাকায় দীন শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে পাঠাতেন সেখানকার জনসাধারণ তো তাদের কাছে প্রেরিত সাহাবির নিকট এসেই তাদের জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজে ফিরত। মুজতাহিদ ইমামগণের নিকট এসে এ বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করে এবং পরবর্তীতে পুরো পৃথিবীজুড়ে মুসলমানগণ চার মাযহাবের কোনো একটিকে অনুসরণ করতে থাকে। মাযহাব অনুসরণের মধ্য দিয়ে তারা প্রকৃতপক্ষে কুরআনে কারীমের উপরোক্ত নির্দেশনাটিই পালন করে আসছে।
হাজার বছরের এ ধারাকে ছিন্ন করে আজকের প্রচলিত বাতীল আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের লোকেরা বলতে চাইছে—ইসলাম পালন করার জন্যে কোনো মাযহাব অনুসরণের প্রয়োজন নেই। বরং সরাসরি হাদীস থেকে মাসআলা খুঁজে বের করে আমল করার শ্লোগান নিয়ে তারা নিজেদেরকে বলতে চায় ‘আহলে হাদীস’।
আর শত শত বছর ধরে চলে আসা মাযহাব চারটির কোনো একটিকে না মানার কারণে তাদেরকে বলা হয় ‘লা মাযহাবী’।
‘আহলে হাদীস’—দুই শব্দের এই নামটি অবশ্য নতুন নয়। সহীহ মুসলিম সুনানে তিরমিযীসহ হাদীসের অনেক প্রসিদ্ধ ও পুরনো গ্রন্থে এ শব্দদুটি ব্যবহৃত হয়েছে অসংখ্যবার।
হাদীস বর্ণনা গ্রন্থনা পাঠদান ও হাদীস নিয়ে গবেষণা করেই যাদের রাতদিন কেটে যেত, যারা নিজেদেরকে হাদীসের নানামুখী খেদমতে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন, ‘আহলে হাদীস’ বলে তাদেরকেই বোঝানো হয়েছে। ভিন্ন শব্দে আমরা এ সম্মানিত মনীষীগণকে ‘মুহাদ্দিস’ও বলে থাকি। উঁচু মাপের কেউ হলে ‘হাদীস শাস্ত্রের ইমাম’ কিংবা ‘আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদীস’ও বলি।
পূর্বসূরি এ স্বর্ণমানবদের কালে আরেকটি দল ছিল এমন, যারা হাদীস বর্ণনার পরিবর্তে হাদীস নিয়ে গবেষণা করে সেখান থেকে মানবজীবনের নানামুখী সমস্যার সমাধান আহরণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং এ নিয়েই তাঁরা সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন। তাঁদেরকে আমরা চিনি ‘ফকীহ’ কিংবা ‘মুজতাহিদ’ হিসেবে।
যারা ইতিহাসে মুহাদ্দিস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তাঁদের অনেকেই উঁচুমানের ফকীহও ছিলেন, ছিলেন মুজতাহিদও। আবার যারা ফকীহ বা মুজতাহিদ হিসেবে পরিচিত, তাদেরও অনেকেই উঁচুস্তরের মুহাদ্দিস তথা আহলে হাদীস ছিলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সারা পৃথিবীজুড়ে যে চারটি মাযহাব যুগ যুগ ধরে অনুসৃত হয়ে আসছে, এ চার মাযহাবের চার জন ইমামের প্রত্যেকেই হাদীসের সংকলন তৈরি করেছিলেন।
যেমন, ইমাম আবু হানীফা রহ. এঁর ‘কিতাবুল আছার’, ইমাম মালিক রহ. এঁর ‘মুআত্তা’, ইমাম শাফেয়ী রহ.এঁর ‘কিতাবুল উম্ম’ আর ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.এঁর ‘মুসনাদে আহমদ’।
সে যুগের ফকীহ ও মুজতাহিদগণের সাথে আহলে হাদীস ও মুহাদ্দিসগণের কোনো বিভেদ ও দূরত্ব ছিল না। বরং তাদের অনেকেই ফিকহি মাসায়েলের ক্ষেত্রে ফকীহ হিসেবে খ্যতিমানদের মতই মেনে চলতেন।
একদিনের ঘটনা।
হযরত আ’মাশ রহ. হাদীস শাস্ত্রের এক উঁচু স্তরের মনীষী। তাঁর মজলিসে বসে আছেন ইসলামী ইতিহাসের প্রবাদ পুরুষ ইমাম আজম আবু হানীফা রহ.।
হযরত আ’মাশ রহ. তাঁর কাছে কয়েকটি বিষয়ের সমাধান জানতে চাইলেন। তিনি সে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেন। এরপর হযরত আ’মাশ রহ. ইমাম আজম রহ.কে বললেন, ‘তুমি এ উত্তর কোথায় পেলে?’
জবাবে ইমাম আবু হানীফা রহ. বললেন, ‘আপনিই তো আমাকে ইবরাহীম নাখায়ী রহ.এঁর সূত্রে এ হাদীস শুনিয়েছেন, হযরত শা’বী রহ.এঁর সূত্রে এ হাদীস শুনিয়েছেন…।
জবাব শুনে হযরত আ’মাশ রহ. বললেন, ‘ইয়া মা’শারাল ফুকাহা! আনতুমুল আতিব্বা ওয়া নাহনুস সায়াদালাহ—হে ফকীহগণ! তোমরা হলে চিকিৎসক আর আমরা হলাম ওষুধবিক্রেতা।’
[সূত্রঃ আবুল ওয়ালীদ বাজী মালিকী রহ. কৃত, আততাদীল ওয়াত তাখরীজ, খ. ১, পৃ. ২৮।]
ফকীহ ও মুহাদ্দিস-আহলে হাদীসের মধ্যকার এ সম্মান সম্প্রীতি ও মর্যাদার সম্পর্ক আমাদের গর্বের ইতিহাস। হাজার বছর ধরে এ ধারা অবিচ্ছিন্নভাবেই চলে আসছে। সে যুগে যারা আহলে হাদীস ছিলেন, তারা এমন আপত্তি কখনোই উত্থাপন করেন নি— "উনি ফকীহ, উনি হাদীস কম জানেন"; বরং তাঁদের অধিকাংশ জনই ফিকহী বিষয়ের সমাধান কোনো না কোনো ফকীহ মুজতাহিদের রায় অনুসারেই করতেন।
‘আহলে হাদীস’—এ শব্দদুটির সাথে ফকীহগণের বিরোধিতা কিংবা তাদেরকে এড়িয়ে চলা বা তাদেরকে অনুসরণ না করার কোনো সম্পর্ক ছিল না।
কিন্তু সংকট সৃষ্টি হলো, যখন কেউ কেউ শত শত বছরের অবিচ্ছিন্ন শৃংখল থেকে নিজেদেরকে ছাড়িয়ে নিয়ে চার মাযহাবের কোনোটিই না মানার ঘোষণা দিল এবং নিজেদের পরিচয় হিসেবে তারা ‘আহলে হাদীস’ শব্দটি জুড়ে দিল।
তারা মানুষকে বোঝাতে চাইল—কুরআন-হাদীসের কোথাও তো মাযহাব মানার কথা নেই, তাহলে আমরা মাযহাব মানব কেন? বরং মাযহাবের পেছনে না পড়ে আমরা সরাসরি হাদীস অনুসরণ করি। আমরা আহলে হাদীস—হাদীসের অনুসারী।
বাস্তবতা হচ্ছে, মাযহাব তারাও মানে এবং ইসলামী বিধিবিধানকে খেলনা বানিয়ে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো যখন যেদিকে ইচ্ছা ছুটে চলে।
কুরআন-হাদীসে তো সব বিষয়ের স্পষ্ট সমাধান নেই। তখন হয়তো নিজে ইজতেহাদ করতে হবে কিংবা ইজতেহাদ করতে পারে এমন কারো নিকট থেকে সমাধান জানতে হবে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হযরত মুআজ ইবনে জাবাল রা.কে ইয়েমেনে পাঠাচ্ছিলেন, তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘মুআজ! নতুন কোনো বিষয় সামনে এলে কীভাবে ফয়সালা করবে?’ তিনি উত্তরে বললেন—আল্লাহর কিতাব অনুসারে।
যদি কুরআনে সে বিষয়ে কিছু না থাকে?
আল্লাহর রাসূলের সুন্নত অনুসারে।
যদি সুন্নাহর মাঝেও কিছু না খুঁজে পাও?
আমি তখন ইজতেহাদ করব।
এ জবাব শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম আনন্দে মুআজ রা.এর বুক চাপড়ে দিলেন আর বললেন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, তিনি তাঁর রাসূলের দূতকে এমন উত্তর শিখিয়ে দিলেন যাতে তাঁর রাসূল খুশি হয়ে গেল।
[সূত্রঃ সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৩৫৯৪।]
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হচ্ছে—কুরআন-হাদীসে সমাধান নেই এমন সংকট অনিবার্য। ফলে ইজতেহাদের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। তাই যারা ইজতেহাদের সামর্থ্য রাখে না, অবশ্যই তাদেরকে কোনো মুজতাহিদের অনুসরণ করতে হবে। আর যদি অনুসরণ করতেই হয়, তাহলে পরবর্তী যুগের মুজতাহিদগণকে কেন, পূর্ববর্তী যুগের মুজতাহিদগণকেই অনুসরণ করব।
সব বিচারেই পূর্ববর্তী মুজতাহিদগণ পরবর্তীগণের চেয়ে অধিক যোগ্য অধিক খোদাভীরু ছিলেন।
মাযহাব না মানার শ্লোগান যারা দিয়ে বেড়াচ্ছে তারা যদি এতটুকুতে ক্ষ্যান্ত থাকতেন—তারা চার মাযহাবের কোনোটিকেই অনুসরণ করবেন না বরং হাদীস অনুসারে আমল করবেন, সেটা কোনো মাযহাবের সাথে মিলে যেতে পারে, নাও মিলতে পারে, তাহলেও সমস্যা অতদূর গড়াত না। তারা প্রচার করে বেড়াচ্ছেন—‘যে মাসআলাগুলোতে হানাফী মাযহাবের সাথে তাদের বিরোধ রয়েছে সেখানে হানাফী মাযহাবের অনুসৃত আমল হাদীসের শিক্ষার পরিপন্থী। বরং হাদীস মানতে হলে যারা হানাফী মাযহাবের অনুসারী, তাদেরকেও এসব ক্ষেত্রে নিজেদের মাযহাব ছেড়ে তাদের (অর্থাৎ প্রচলিত আহলে হাদীসদের) পথে চলতে হবে। অন্যথায় তাদের প্রকৃত ইসলাম মানার পরিবর্তে মাযহাব মানা হবে।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
ইতিপূর্বে সংক্ষেপে আমরা এ কথা বলে এসেছি—ফিকহী মাযহাবগুলো কুরআন-হাদীস থেকেই আহরিত, বাইরের কিছু নয়।
কুরআন-হাদীসের ওপর বিস্তর গবেষণা করেই মাযহাবের ইমামগণ মাসআলা উদঘাটন করেছেন।
এমন না হলে কি আর যুগে যুগে মুহাদ্দিসগণ মাযহাব মেনে আসছেন! স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে—তাহলে যারা নিজেদের মত ও আমলের সাথে না মেলার কারণে কুরআন-হাদীসের দলিলপ্রমাণসমৃদ্ধ কোনো আমলকে ভুল বলছেন, তারা কি প্রকারান্তরে একটি হাদীস মেনে আরেকটি হাদীসকে অস্বীকার করছেন না?
যেমন দেখুন, নামাজের ইকামাতের বাক্যগুলো তারা একবার করে বলে। ভালো কথা, হাদীসে একবার করে বলার কথাও আছে, দুইবার করে বলার কথাও আছে। ফলে যারা একবার করে বলেন তারাও হাদীস অনুসরণ করছেন, যারা দুইবার করে বলছেন তারাও হাদীসই অনুসরণ করছেন। চার মাযহাবের কেউ একবার করে বলে, কেউ দুইবার করে বলে। সবার একই কথা, একবার করেও বলা যায়, দুইবার করেও বলা যায়। দুটোই সঠিক। এ মতপার্থক্য সাহাবায়ে কেরামের মাঝেও ছিল। তাঁদের মাঝেই দুই রকম আমলের প্রচলন ছিল।
কিন্তু যদি কেউ বলে, একবার করেই ইকামাতের বাক্যগুলো বলতে হবে, দুইবার করে বললে হাদীসের অনুসরণ করা হবে না—তাহলে এতে কি দুইবার করে এ বাক্যগুলো বলার হাদীসগুলোকে অস্বীকার করা হয় না? যেখানে সাহাবায়ে কেরামের মাঝেই দুই রকম আমলের প্রচলন ছিল সেখানে দুটির একটিকে সঠিক বলে আরেকটিকে ভুল বলার সুযোগ কোথায়?
পরিতাপের বিষয়—আমাদের সমাজে যারা নিজেদেরকে ‘আহলে হাদীস’ বলে পরিচিত করতে চায় তারা এ কাজটিই করে চলছে। ‘তাদের আমলের সাথে অন্যদের যা কিছু মিলবে না সেটাই ভুল, শুধু তাদেরটিই সঠিক। অঘোষিতভাবে তারা যেন এ নীতিই গ্রহণ করেছে।
যে মাসআলাগুলো নিয়ে তারা বিতর্কের সৃষ্টি করে, সেগুলোর অধিকাংশই এমন, যেখানে সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই একাধিক আমলের ধারা চলে আসছে। অথচ তাদের বক্তব্য তাদের অনুসৃত মতটিই আমলযোগ্য, অন্যটি আমলযোগ্য নয়। এমন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তারা পরোক্ষভাবে হাদীসের এক বিশাল ভান্ডারকেই অস্বীকার করে যাচ্ছে।
কিছু বিষয়ে তাদের এমন বক্তব্যও রয়েছে, যা তাদের পূর্বে আর কেউ কোনো যুগে বলে নি। এসব ক্ষেত্রে তাদের হাদীস ও পূর্বসূরিদের আমলের অবিচ্ছিন্ন ধারা অস্বীকারের বিষয়টি তো দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।
ইসলামের চৌদ্দশ বছরের ইতিহাসে নানা নামে নানা ফেতনা ও ভ্রান্ত ফেরকা আত্মপ্রকাশ করেছিল।
এক ফেরকা দাবি করে বসেছিল—আমরা শুধুই কুরআন মানি, হাদীস মানি না। কারণ কুরআন যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় সংরক্ষিত হয়েছে, হাদীস সেভাবে সংরক্ষিত হয় নি। তাদেরই কেউ কেউ হাদীস অস্বীকারের বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে যা বলেছিলেন তা ছিল প্রশাসনিক বিষয়, ধর্মীয় বিধান নয়। তাই আমাদের এ যুগে তাঁর বাণীগুলো মানা আমাদের জন্যে অপরিহার্য নয়।’ ইতিহাসে তারা ‘মুনকিরে হাদীস—হাদীস অস্বীকারকারী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
সত্যপন্থী যুগসচেতন সমকালীন আলেমসমাজ প্রতিটি ফেতনার মতো এ মুনকিরে হাদীসদের ফেতনারও যথাযথ মোকাবেলা করেছেন এবং মুসলমানদের ঈমানকে হেফাজত করেছেন।
বর্তমান সময়ে আহলে হাদীস হিসেবে যারা নিজেদেরকে দাবি করছেন, দাবি করছেন মাযহাব না মেনে সরাসরি হাদীস অনুসরণের, আর এর পাশাপাশি তাদের মতের সাথে না মিললে হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণিত আমলকেও ভিত্তিহীন বলে দিচ্ছেন, জেনে কিংবা না জেনে তারা কি নিজেদেরকে সে মুনকিরে হাদীস—হাদীস অস্বীকারকারীদের দলেই যুক্ত করছেন না?
এখানেই শেষ নয়, তারা হাদীস মানার নাম করে এমন আরো কিছু দর্শন প্রচার করে যাচ্ছেন, যেগুলো উপরোক্ত সংশয়কেই শক্তিশালী করে তোলে।
এমন কয়েকটি বিষয় আমরা সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরছি,
০১. যঈফ ও জাল হাদীসকে এক করে ফেলার দর্শন।
জাল হাদীস আসলে কোনো হাদীসই নয়। জাল হাদীস মানে মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীস। এর বিপরীতে ‘যঈফ হাদীস’ হাদীসের একটি প্রকার। তবে ‘সহীহ হাদীস’ যতটা শক্তিশালী, যঈফ হাদীস সে তুলনায় যথেষ্ট দুর্বল। তাই বলে একে হাদীস হিসেবে অস্বীকার করার উপায় নেই। যুগে যুগে মুহাদ্দিসগণ যঈফ হাদীস সম্পর্কে এ কথাই বলেছেন। কোন কোন শর্তের ভিত্তিতে কোন কোন ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস আমলযোগ্য, কোন কোন ক্ষেত্রে আমলযোগ্য নয়—তাও তাঁরা সচেতনভাবে মুসলিম জনসাধারণকে জানিয়ে দিয়েছেন। অথচ ঢালাওভাবে যঈফ হাদীসকে জাল হাদীসের সাথে মিলিয়ে দেয়ার অর্থই হচ্ছে—সুদীর্ঘকাল ধরে মুহাদ্দিসগণের নিকট শর্তসাপেক্ষে ও ক্ষেত্রবিশেষে গ্রহণযোগ্য অসংখ্য হাদীসকে হাদীস হিসেবে মানতেই অস্বীকার করা!
০২. বুখারী-মুসলিম ছাড়া অন্য কিতাবের হাদীস গ্রহণ করতে অস্বীকৃতির দর্শন।
তাদের অনেককে বলতে শোনা যায়—‘এটি বুখারী শরীফের হাদীস, এটি মানতে হবে; এটি বুখারী-মুসলিমের হাদীস নয়, এটি মানা যাবে না।’
সন্দেহ নেই—সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম হাদীসের দুই অনবদ্য সংকলন। এ হাদীসগ্রন্থদুটি পুরো মুসলিম বিশ্বে ‘সহীহ’ হাদীসের সংকলন হিসেবে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য। এ দুই গ্রন্থের সব হাদীস সহীহ—এ কথা ঠিক, তবে এও অনস্বীকার্য, সহীহ হাদীস মানেই বুখারী-মুসলিমের হাদীস নয়। সকল সহীহ হাদীস এ দুই গ্রন্থে সংকলিত হয় নি। বরং এ দুই গ্রন্থ সংকলিত হওয়ার পূর্বে ও পরে হাদীসের এমন অনেক সংকলন তৈরি হয়েছে, যেগুলো অসংখ্য সহীহ হাদীসে ভরপুর। পরবর্তী যুগের কোনো কোনো মুহাদ্দিস এমন হাদীসের সংকলনও তৈরি করেছেন, যেগুলো বুখারী ও মুসলিম শরীফে অন্তর্ভুক্ত হাদীসের মানে উত্তীর্ণ, কিন্তু হাদীসগুলো দুই কিতাবের কোনোটিতেই সংকলিত হয় নি।
ইমাম মুসলিম রহ. তো স্পষ্টই বলেছেন, ‘আমার নিকট যেসব হাদীস সহীহ, তার সবগুলোই আমি এ কিতাবে সংকলন করি নি।’
[সূত্রঃ সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪০৪।] এমতাবস্থায় শুধু বুখারী-মুসলিম শরীফের হাদীস গ্রহণ করে অন্য হাদীসগ্রন্থকে এড়িয়ে চললে কী পরিমাণ সহীহ ও আমলযোগ্য হাদীস প্রত্যাখ্যাত হয়—তা কি কল্পনা করা যায়!
০৩. নিজেদের বিপক্ষে বা বিরোধীতায় যদি সহীহ হাদীস থাকে তাহলে তাও এড়িয়ে যাওয়ার দর্শন।
যদিও তারা মুখে মুখে শুধু সহীহ হাদীসের কথা বলে বেড়ায়, তা সত্ত্বেও যদি কোনো সহীহ হাদীস তাদের মতের বিপক্ষে যায়, তাহলে তারা তাও এড়িয়ে চলে। এমনকি সেটা বুখারী-মুসলিমের হাদীসই হোক না কেন।
যেমন দেখুন, ‘মুকতাদি ইমামের পেছনে সুরা ফাতেহা পড়বে কি না’—এ প্রসঙ্গে এক হাদীসে বলা হয়েছে, ‘যখন ইমাম কুরআন পাঠ করে তখন তোমরা চুপ থেকো।’
ইমাম মুসলিম রহ. এ হাদীসটি সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘হাদীসটি আমার নিকট সহীহ।’ [হাদীস : ৪০৪]
হানাফী মাযহাবে এ হাদীসের ওপরই আমল করা হয়—ইমামের পেছনে মুকতাদি সুরা ফাতেহা না পড়ে চুপ করে থাকবে। অথচ বর্তমান সময়ের প্রচলিত আহলে হাদীসগণ ইমাম মুসলিম রহ.এঁর স্পষ্ট বক্তব্য থাকার পরও এ হাদীসটিকে যঈফ সাব্যস্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে!
০৪. পূর্বসূরি মুহাদ্দিসগণের ব্যাখ্যা এড়িয়ে চলার দর্শন।
কোন হাদীসের কী মর্ম কী উদ্দেশ্য—এ সম্পর্কে যুগে যুগে উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ অসংখ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করে গেছেন। শুধু ব্যাখ্যাগ্রন্থেই নয়, বরং হাদীসের অনেক মৌলিক গ্রন্থেও সংকলকগণ সংক্ষেপে অনেক হাদীসের মর্ম স্পষ্ট করেছেন।
যেমন, আবু দাউদ শরীফের ৮২২ নং হাদীস—যে সুরা ফাতেহা ও আরও কিছু না পড়বে, তার নামাজ হবে না। এ হাদীস উল্লেখ করার পর ইমাম আবু দাউদ রহ. ইমাম সুফয়ান সাউরী রহ.এর বক্তব্য উল্লেখ করেছেন—‘এ বিধান একাকি নামাজ আদায়কারীর জন্যে।’
যেখানে ইমাম আবু দাউদ রহ. এর মতো বরেণ্য মুহাদ্দিস হাদীসের ব্যাখ্যায় বলছেন—হাদীসটি একাকি নামাজ আদায়কারীর জন্যে প্রযোজ্য, এবং কথাটি তিনি বলেছেন হাদীসশাস্ত্রের আরেক বরেণ্য মনীষী হযরত সুফয়ান সাউরী রহ.এঁর উদ্ধৃতিতে, সেখানে হাজার বছর পর এসে কেউ বলল—মুকতাদির ওপরও সুরা ফাতেহা পড়া ফরজ, অন্যথায় তার নামাজ শুদ্ধ হবে না, তাহলে এতে কি হাদীস মানার নামে স্বীকৃত ও বরেণ্য হাদীসগবেষকদের ব্যাখ্যা অস্বীকার করা হয় না?
০৫. শত শত বছর ধরে চলে আসা কোনো আমলের অবিচ্ছিন্ন ধারা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দর্শন।
কখনও দেখা যায়, শত শত বছর ধরে চলে আসা কোনো আমলের অবিচ্ছিন্ন ধারা থেকে বেরিয়ে তারা নতুন আমল শুরু করে।
উদাহরণস্বরূপ তারাবির নামাজের কথা বলা যায়। মসজিদে নববীতে প্রথম যুগ থেকে শুরু করে প্রতি যুগেই বিশ রাকাত তারাবি পড়া হতো।
এ আমলের ধারা এখনও চলমান। অনুসৃত চার মাযহাব, প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা হাদীস-ফিকহের অসংখ্য সংকলন—কোথাও আট রাকাত তারাবির কথা নেই।
সর্বপ্রথম ১২৮৪ হিজরি সালে ভারতের আকবরাবাদ থেকে একজন আট রাকাত তারাবির কথা বলেন। তার পরে উপমহাদেশে এবং আরবেও কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে আট রাকাত তারাবির কথা বলেছেন। কিন্তু আরব-আজমের আলেমগণ ব্যাপকভাবে আট রাকাত তারাবিকে খণ্ডন করে বিশ রাকাত তারাবিকেই সাব্যস্ত করেছেন।
প্রায় তেরশ বছর ধরে অবিচ্ছিন্ন ও ব্যাপকভাবে চলে আসা আমলের একটি ধারার বিরোধিতা করাও কি তাহলে হাদীসের অনুসরণ?
সাহাবী-তাবেয়ীযুগ থেকে শুরু করে এতকাল কি কেউ তাহলে হাদীস বোঝেন নি!
শেষ কথা, ইসলাম এক শাশ্বত ধর্ম। ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস, পালনীয় বিধানাবলি ইত্যাদি অবিচ্ছিন্ন ধারায় চলে আসছে। কোনো কালেই এতে কোনো বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয় নি। একইভাবে কুরআন ও হাদীসের সংরক্ষণ চর্চা ও গবেষণার ধারাও অবিচ্ছিন্ন। তাই সঠিকভাবে ইসলামকে মানতে হলে পূর্বসূরিদের অবিচ্ছিন্ন ধারায় থেকেই মানতে হবে। নইলে নিজের অজান্তেই এভাবে যে কোনো মুহূর্তে কেউ হাদীস মানার নামে হাদীস অস্বীকারের পর্যায়ে চলে যেতে পারে।
আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফীক দান করুক।
আমীন।
___________
মাজহাবঃ
▆ প্রশ্ন হচ্ছে কার মতের নাম হানাফী মাযহাবঃ হানাফী মাযহাবের নাম হানাফী মাযহাব কেন।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1819140251734745
▆ প্রসঙ্গ : মাযহাব না মানলে বুখারী, মুসলিম মানা যায় না।
https://www.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1680169845631787
▆ মাযহাব মানলে মুশরিক হয় না; যাদের হাত ধরে ইসলাম তাঁরা সকলেই মাযহাবভূক্ত।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1666045127044259
▆ প্রসঙ্গ : সূন্নাহ্ মান্য; হাদিস নয়। সকল হাদিস, সূন্নাহ্ নয়।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1680658558916249
▆ হাদীস মানবো নাকি সুন্নাত।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1823093918006045
▆ প্রসঙ্গ : ফিত্না বা বিশৃঙখলায় আহালূস সূন্নাহ্ হওয়া বা সূন্নাহ্ আঁকড়ে ধরে থাকা।
https://www.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1681169245531847
▆ মাযহাব এত কেন।
https://www.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1743491289299642
▆ প্রসঙ্গ : দ্বীনের বুঝ (ফিক্বাহ্) অর্জনকারীদের অনূসরণ।
https://m.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1681989658783139
▆ চার মাজহাবের কোন একটি কি একক ভাবে স্বয়ং সম্পূর্ণ? বিচার বিশ্লেষণ করে একেক মাসয়ালায় একেক মাজহাব মানা যাবে কি?
https://m.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1813184972330273
▆ "সালাফী" দাবীটি ভূঁয়া (Bogus)।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1686609804987791
▆ প্রসঙ্গঃ বিয়ে; লা মাযহাবী দৃষ্টিভঙ্গী।
ওহাবী লা-মাযহাবীদের কাছে প্রশ্ন- "মাযহাব/গবেষনা অস্বীকার করে নানী, দাদী ও নাতনীকে বিবাহ করবেন? নাকি মাযহাব/গবেষনা স্বীকার করে হারাম হতে নিজকে রক্ষা করবেন?
https://m.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1813357312313039
▆ কাদের উপর তাকলীদ বা মাযহাব ওয়াজিব আর কাদের উপর ওয়াজিব নয়।
https://m.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1813367185645385
▆ লা-মাযহাবীদের অবস্থা।
https://m.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1813387635643340
▆ সাহাবাযুগে তাকলিদ বা মাজহাব বা অনূসরণ ��
প্রশ্নঃ লা মাযহাবী শেখের মুরিদ / মুকাল্লিদেরা বলে থাকে, সাহাবা যুগে তাকলিদ ছিলনা। তাই আমরা ও কারো তাকলিদ করবোনা। মাজহাব মানব না। এটা কি ঠিক ?
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1813421288973308
▆ চার মাযহাবের উপর ইজমা হওয়ার প্রমাণ, ইমাম মাহদী (আঃ) ও হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ) এঁর মাযহাব কী হবে এবং নাজাতপ্রাপ্ত দল কারা?
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1813948172253953
▆ আহলে হাদীস তথা লা মাজহাবীদের কাছে ১০টি প্রশ্ন।
[কোরআন ও সহীহ্ হাদিসের শব্দ, কোন ব্যক্তির শব্দ অগ্রহণীয়।]
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1811851752463595
▆ মাজহাব কি ও কেন? মাজহাব মানার কি কোন প্রয়োজন আছে? সাহাবী যুগে কি কোন মাযহাব ছিলো?
https://m.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1814310098884427
▆ কুরআন-সুন্নাহ থাকতে মাযহাব কেনঃ সরল মূল্যায়ণ।
https://m.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1814458098869627
▆ কুরআন-হাদীসের আমলের ক্ষেত্রে আহলে হাদীস ও হানাফীদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1822773314704772
_________
▆ হযরত শায়েখ আব্দুল কাদীর জিলানী রহঃ এবং গায়রে মুকাল্লিদ সম্প্রদায়।
https://m.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1866138450368258
_________
তারা আসলে খেলাফী (বিরুদ্ধাচরণকারী); নামেই কেবল সালাফী।
আসুন জানি,
- সত্যিকারার্থে আহলে হাদীস কারা?
- সালাফী দাবির সার্থকতা কতটুকু?
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1868433216805448
______________