♥নবী প্রেম যার অন্তরে নেই তার অন্তর "বাহারুল মাইয়াত।"
মি'রাজের ঘটনা প্রকৃতি পর্ব (৮)
দীদারে এলাহী (শেষ পর্ব)
প্রত্যেক মাখলুকের জন্য নূর (আলো) ও জুলমতের (অন্ধকার) মাকাম রয়েছে। অনুভূতির এবং মারেফতের এক নির্দিষ্ট আকার রয়েছে। প্রত্যেক মুকাররবীন ফেরেশতা, যারা আল্লাহ তা'আলার আরশের আশেপাশে অবস্থান করেন, তারা সকলেই আল্লাহ তা'আলার কিবরিয়া, জালালত, আযমত ও হায়বতের নূর দ্বারা আচ্ছাদিত। আল্লাহ তা'আলার গুণাবলীই হেজাব বা পর্দা। আর ফেরেশতারা মাহজুব বা আচ্ছাদিত। এসকল ফেরেশতার মর্যাদাও ভিন্ন ভিন্ন। তাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট মাকাম ও পদমর্যাদা রয়েছে। কোন সৃষ্টি নেয়ামত দানকারীর নেয়ামত দর্শন দ্বারা আচ্ছাদিত।
হালপ্রাপ্ত লোক বিভিন্ন হালের দর্শন দ্বারা আচ্ছাদিত। সরঞ্জাম গ্রহণকারী সরঞ্জাম দর্শনের দ্বারা আচ্ছাদিত। কেউ আচ্ছাদিত বৈধ কামনা দ্বারা, কেউ বা অবৈধ কামনা দ্বারা, কেউ কেউ আচ্ছাদিত গুনাহ ও অসুন্দরের পর্দা দ্বারা। কেউ আচ্ছাদিত সম্পদ, সন্তান অথবা অন্যান্য পার্থিব সরঞ্জাম দ্বারা। মানুষের স্বভাব হচ্ছে যে, উঁচু মর্যাদা সম্পর্কে যেমন সচেতন থাকে তেমনি আরও অধিক মর্যাদার অভিলাষী হয়। তাই দেখা যায়, হযরত মূসা (আঃ) যখন আল্লাহ পাকের দরবারে কথোপকথনের মর্যাদা লাভ করেন, তখন দীদারে এলাহীর বাসনা প্রকাশ করলেন। এটা এক প্রকারের আনন্দ যাতে মানুষ আপ্লুত হয়ে যায়। কেননা, নৈকট্যের মাকামে আদবের প্রতি লক্ষ্য কমই থাকে।
কিন্তু আমাদের নবী সাইয়্যেদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম হলেন, তখন তাঁর যাবতীয় হক পূর্ণভাবে আদায় করলেন। যে মাকামে তিনি উন্নীত হয়েছেন, সেখানে শান্ত এবং স্থির থেকেছেন। অতিরিক্ত কোন আগ্রহ প্রকাশ করেননি। তাই তিনি স্বাভাবিকভাবে একে একে মর্যাদার সকল মনযিল স্বাভাবিকভাবেই অতিক্রম করেছেন।
এই অভিযাত্রার সব চেয়ে উঁচু মর্তবা হচ্ছে, দীদারে বারী তা'আলা। এই মাকামে আল্লাহ তা'আলা তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিষ্ঠিত করিয়েছেন। তাঁকে সুস্থির রেখেছেন। এই মর্যাদা সর্বোচ্চ মর্যাদা। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ ফরমান, 'তিনি যা দর্শন করলেন, তাঁর অন্তর সেগুলিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেনি।' দেখা এবং উপলব্ধি করা একটি অপরটির সহায়ক হয়েছে। দর্শন যা পেয়েছে, চোখের দৃষ্টি তা ধারন করেছে, আর চোখ যা দর্শন করেছে অন্তর তাকে অনুভব করেছে, বিশ্বাস করেছে। সবকিছুই সঠিকরূপে গৃহীত হয়েছে। এর মাধ্যমে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের উপর অগ্রাধিকার লাভ করেছেন। সে জন্য সমস্ত আম্বিয়া কেরাম তাঁর উপর গিব্তা ( সৌন্দর্যমন্ডিত ইর্ষা) করতে লাগলেন। তিনি দুনিয়া এবং আখেরাতে সিরাতুল মুস্তাকীমের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেন।
তাঁর এমন প্রতিষ্ঠা লাভের ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কোরআন মজীদে কসম করে বললেন, ' হে সাইয়্যেদে আলম! প্রজ্ঞাপূর্ন কোরআনের শপথ, নিশ্চয় আপনি পায়গাম্বরগণের মধ্যে একজন-যিনি সিরাতুল মুস্তাকীমের উপর রয়েছেন।' 'এটা আল্লাহ তা'আলার অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছে দান করেন। আল্লাহ তা'আলা শ্রেষ্ঠ অনুগ্রহশীল।' এর পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেছেন, 'অতঃপর তিনি তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে অহী প্রেরন করলেন, অহী শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ।
যত প্রকার ইলম, মা'রিফাত, হাকীকত, সুসংবাদ, ইশারা, সংবাদ, নিদর্শন,কারামত, কালামত আছে সব এই অহী সব্দেটির গণ্ডিতে আবদ্ধ। উপরে উল্লেখিত সকল বিষয়ের আধিক্য ও বিশালতা সবই এর ভিতরে রয়েছে। কেননা এখানে ওহী, বলে সেগুলোকে অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। পুর্ণ বিবরণ দেওয়া হয়নি। কারণ এর অন্তর্নিহিত ভাব আল্লাহতালা ও তাঁর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্য কেউ ধারণ করতে পারবে না। সুতারাং অন্যেরা ততটুকুই জানতে পারে, যতটুকু হুজুর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন। কেউ আবার তার পবিত্র রূহের দিকে মুতাওয়াজ্জাহ হয়ে বাতেনী ইলেম হাসিলে সমর্থ হয়েছেন। আউলিয়া কেরাম হুজুর পাক সল্লাল্লাহু আলআইহি ওয়াসাল্লাম এর পুর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগ্যতাকে এবং আভিজাত্যকে অধিকার করে নিয়েছেন। কেবল তাঁরাই এই ধরণের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের যৎকিঞ্চিত নিগুঢ়তত্ত্ব অর্জনে সফল হয়েছেন। ওয়াল্লাহু আ'লাম।
অতঃপর হুজুর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আরশে আযীমে পৌছলেন, আরশ তখন তার জালালী বিস্তারকে সংকুচিত করে আরয করল, আপনিই তো সেই মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাঁকে আল্লাহ তা'আলা তাঁর আহাদিয়াতের জালাল দর্শন করিয়েছেন এবং তার সামাদিয়াতের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানিয়েছেন।
আল্লাহ তা'আলা আমাকে (আকারের দিক থেকে) সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুক পরও আমি চিন্তাক্লিষ্ট ছিলাম যে, কোন পথে কিভাবে আমি আপনার কাজে লাগতে পারি। তাই ভেবে আমি মানসিকভাবে হয়রান পেরেশান ছিলাম। পওয়ারদিগার আমাকে যখন সৃষ্টি করল, তখন আমি তাঁর হায়বত ও জালালিয়তের প্রভাবে কম্পমান ছিলাম। এরপর যখন আমার জন্য লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লেখা হল তখন তাঁর ভয়ে আমি আরও কাপতে লাগলাম। পরে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ লেখা হলে আমার কম্পন থেমে গেল। অস্থিরতা দূর হল। আপনার পবিত্র নামের বরকত আমার মধ্যে উদ্ভাসিত হল। এখন আমআদ উপর পতিত হল আপনার শুভ দৃষ্টি আর কত রকমের অধিকারীই না হলাম আমি।
এক পর্যায়ে উম্মতের অবস্থা আল্লাহ তা'আলার কাছে পেশ করা হল। তখন তিনি আরয করলেন, হে আমার প্রভু আপনিতো অনেক উম্মতকে আযাব দিয়েছেন। কাউকে পাথর বর্ষণ করেছেন,কাউকে মাটিতে প্রোথিত করেছেন,কারও চেহারা বিকৃত করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা বললেন, আমি তাদেরকে রহমত করব, তাদের গুনাহকে আমি নেকীতে রূপান্তরিত করব, যে আমাকে ডাক দিবে, আমি তাকে লাব্বাইক বলবো। যে প্রার্থনা করবে তাকে দান করব। আমার উপর যে নির্ভর করবে, আমি তাকে অভাবহীন করে দেব। দুনিয়ায় আমি তাদের গুনাহসমূহ, আর আখেরাতে আপনাকে তাদের শাফায়াতকারী নিযুক্ত করব।
(চলবে)