♥সিদারাতুল মুনতাহা♥
মি'রাজের ঘটনা প্রকৃতি পর্ব (৬)ِ

*আর যে দর্শনই না আমি আপনাকে দেখিয়েছি তা কেবল মাত্র মানুষের পরীক্ষার জন্য দেখিয়েছি। (সূরা বনি ইসরাইল আয়াত-৬০)                                                                           
সিদরাতুল মুনতাহা পাখি ও পতঙ্গের ন্যায় নূর দ্বারা বেষ্টিত। তার প্রত্যেকটি পাতায় একজন করে ফেরেশতা বসে আছেন। এটি এমন একটি স্থান যার সংজ্ঞা নির্ণয় ও বর্ণনা প্রদান জ্ঞান ও অনুমানের অতীত। এখানে আসার পর নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট বায়তুল মামুর পরিদৃষ্ট হল। তাঁর উপর থেকে পর্দা সরিয়ে দেয়া হল। এ সম্পর্কে হাদিস শরীফে বর্ণনা এসেছে, 'তারপর আমার সামনে বায়তুল মামুর উপস্থিত করা হল। বায়তুল মামুর ঐ মসজিদ খানায়ে কা'বার ঠিক বরাবর উপরে অবস্থিত।

আদম (আঃ) পৃথিবীতে আসার পর তাঁর জন্য বাইতুল মামুরকে ঊর্ধ্বজগত থেকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনা হয়ে ছিল। তারপর তাঁর ইন্তেকালের পর তাকে আবার ঊর্ধ্বকাশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পৃথিবীতে খানায়ে কাবার মর্যাদা, আকাশে বায়তুল মামুরের মর্যাদাও ঠিক তেমনি। ফেরশতারা ঊর্ধ্বকাশে এই ঘরকে তওয়াফ করে এবং তার দিকে ফিরে নামায আদায় করে, যেমন ভাবে দুনিয়ার কা'বা গৃহের তওয়াফ করা হয় এবং তার দিকে ফিরে নামায আদায় করা হয়। দৈনিক সত্তর হাজার ফেরেশতা বাইতুল মামুর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে এসে থাকে। জিয়ারত শেষে ফিরে গেলে আর কোনদিন জিয়ারতে সৌভাগ্য তাদের হয় না। এমনিভাবেই-

দৈনিক তাদের আসাযাওয়া চলছে। বাইতুল মামুর সৃষ্টির সময় থেকেই এই নিয়ম জারী আছে এটা আল্লাহ তা'আলার বৃহত্তর কুদরতের দলীল। আল্লাহ তা'আলা এত অধিক সংখ্যক ফেরেশতা সৃষ্টি করেছন যা কল্পনা করা অসম্ভব। হাদীস শরীফে এসেছে আসমান জমিনে এমন এক বিঘত জায়গাও বাকী নেই যেখানে ফেরেশতারা সিজদ করেননি। আর সাগরবক্ষের এমন এক বিন্দু পানিও নেই, যার উপর আল্লাহ তা'আলা কোন না কোন ফেরেশতা নিয়জিত রাখেন নি। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, আসমানে একটি নহর আছে, যার নাম 'নহরুল হায়াত'। জিব্রাঈল (আঃ) দৈনিক উক্ত নহরে গোসল করে থাকেন। গোসল সেরে বাইরে এসে পাখাগুলো ঝাড়া দেন। তখন তাঁর পাখা থেকে সত্তর -
হাজার পানির ফোঁটা ঝরে পড়ে এবং আল্লাহ তা'আলা প্রতি ফোঁটা থেকে একজন ফেরেশতা সৃষ্টি করেন। এই ফেরেশতারাই দৈনিক বাইতুলমামুরে যিয়ারতের জন্য উপস্থিত হন এবং সেখানে নামায আদায় করেন।

পুনরায় আর কখনও এখানে আসার সুযোগ পান না। হাদীস শরীফে এসেছে, যে সমস্ত ফেরেশতা আরশ বহনকারী, তাদের প্রত্যেকের চেহেরা এবং শরীর ভিন্ন ভিন্ন ধরনের-একের সঙ্গে অপরের সাদৃশ্য নেই এবং তারা এত বিশাল যে তাদের ডানার একটি পালক দ্বারা সমস্ত পৃথিবী আচ্ছাদিত হতে পারে। আরশ বহনকারী ফেরেশতা আটজন। তাদের দেহ এত বিশাল যে, এক কানের লতি থেকে অন্য কানের লতি পর্যন্ত দু'শো বছরের দূরত্ব। আরেক বর্ণনার সাতশো বছরের দূরত্বের কথা বলা হয়েছে। এ সকল বিস্ময়কর সৃষ্টি থেকে খালেক, মালেক বারী তা'আলার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার কোন অবকাশ থাকে না।
তাঁর শক্তি ও শান কত ব্যাপক, কত বিশাল তা আমাদের চিন্তা-চেতনা, বোধ, বুদ্ধি, ও ধারনার বাইরে।

হাদীস শরীফে এসেছে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু!আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন, আমি যখন সপ্তম আকাশে আরোহণ করলাম, তখন হযরত ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ (আঃ) কে বাইতুলমামুরে হেলান দেয়া অবস্থায় দেখতে পেলাম। তাঁর সাথে এক বিরাট জামাত উপবিষ্ট। আমি তাঁকে সালাম প্রদান করলাম। তিনিও!তার উত্তর দিলেন। সেখানে আমি দেখলাম আমার উম্মত দু'ধরনের। একদল সাদা পোশাক পরিহিত। তাদের পোশাকগুলি কাগজের মত মিহি।
ওপর জামাতটি ময়লা পোশাক পরিহিত ছিল। সাদা পোশাক পরিহিত লোকগুলি বায়তুল মামুরে আমার সঙ্গে মিলত হল। আর ময়লা কাপড় পরিহিত লোকেরা রইল পিছনে। আমি সাদা পোশাক পরিহিত লোকদের সঙ্গে নিয়ে বাইতুল মামুরে নামাজ আদায় করলাম। পোশাকের পরিচ্ছন্নতা ও শুভ্রতা সুন্দর আমলের ইঙ্গিতবহ, যেমন 'আপনার লেবাসকে পবিত্র করুন।'

হাদীস শরীফে এসেছে, নবী করিম (সাঃ) এরশাদ করেছেন, আমি ইব্রাহীম (আঃ) এর কাছে এমন একদল লোক দেখতে পেলাম, যারা কাগজের মত সুন্দর!এবং শুভ্র। সেখানে আরেক দল লোক ছিল যাদের দেহেরবর্ণ অন্ধকার ও কৃষ্ণবর্ণ। অতঃপর তারা একটি নহরের কাছে আসল এবং সেখানে গোছল করল। তাতে তাদের কালিমা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেল। এর পর তারা আরেকটি নহরের কাছে এলো এবং পুনরায় সেখানে গোসল করল। তাতে তাদের দেহমন পরিপূর্ণভাবে শুভ্র সুন্দর লোকদের ন্যায় হয়ে গেল।

হুজুর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাদা বর্ণের লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, 'এরা কারা? আর কাল বর্ণের লোকগুলিই বা কারা? নহর দু'টিই বা কিসের, যার পানিতে লোকগুলি গোসল করে? হযরত জিব্রাইল (আঃ) বললেন, সাদা বর্ণের পোশাক পরিহিত লোকগুলি আপন ঈমানকে অন্যায়ের কালিমা দ্বারা কলঙ্কিত করেন নি।

কৃষ্ণবর্ণের লোকগুলি তাদের সৎ কর্মকে অসৎ কর্মের সঙ্গে মিশ্রিত করে ফেলছিল। কিন্তু পরে তারা তওবা করলে আল্লাহ তা'আলা তাদের উপর রহমত বর্ষিণ করেছেন। আর নহরগুলি হচ্ছে-প্রথমটি নহরে রহমত, দ্বিতীয়টি নহরে নিয়ামত। আরেকটি নহর হচ্ছে, শরাবান তাহুরার নহর। কোরআনে পাকে একথা বলা হয়েছে। হুজুর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সওয়ারী আরও উপরে উঠলো। এত উপরে ঊঠলো যে, সেখানে কলমের আওয়াজ শুনা যাচ্ছিল।

কলমের মাধ্যমে ফেরেশতারা আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক নির্ধারিত তকদীর!লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তকদীরে ইলাহি চিরন্তন, কিন্তু তার লিখন ক্রিয়াটি আশাশ্বত। আর লাওহে মাহফুযে সৃষ্টিজজগত সম্পর্কে লিখা হয়েছে আসমান, জমিন সৃষ্টিরও আগে। হাদীস শরীফে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ভবিষ্যৎ যা হবে, কলম তা লিপিবদ্ধ করে শুকিয়ে গিয়েছে। এই হাদিসখানা লওহে মাহফুযের লিখা সম্পর্কিত। নবী করীম (সাঃ) শুনতে পেয়েছিলেন, সেই লিখার আওয়াজ। ফেরেশতারা মূল লিপি থেকে অনুলিপি করেছিলেন। যেমন শবেবরাত ইত্যাদি রজনীতে ভাগ্য লিখা হয়ে থাকে। এগুলির মধ্যে বদল হওয়া বা বাতিলের অবকাশ থাকে। যেমন,

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন,- " আল্লাহ তা'আল যা ইচ্ছে করেন মিটিয়ে দেন এবং যা ইচ্ছে করেন রেখে দেন। এরপর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) এর দৃষ্টিতেতে জান্নাত ও জাহান্নাম উপস্থাপন করা হল। তিনি জান্নাতকে দেখতে পেলেন আল্লাহ তা'আলার রহমতের প্রকাশস্থল রূপে, আর জাহান্নামকে দেখলেন আযাব ও গযবের জায়গা হিসেবে। জান্নাত উন্মুক্ত ছিল। জাহান্নাম ছিল বন্ধ। হুযুর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সালসাবিল নামক নহরে গোসল করলেন, তাতে তাঁর যাহের ও বাতেন হুদুদ বা সীমানার মলিনতা থেকে পাক সাফ হয়ে গেলেন। (মাদারেজুন নবুওয়ত ২য় খন্ড)

চলবে...............

Top