জেলবন্দী বৃদ্ধ
সকাল হয়েছে। জেলখানার দরজা খুলল। ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধকে টানছে দুজন প্রহরী। পেছনে আসছে জল্লাদ। জেলের ফটকে থামল তারা। উৎসুক জনতা দাঁড়িয়ে দেখছে। জল্লাদের হাত উপরে উঠল। শা শব্দে নামল নিচে। আবার উঠল, আবার নামল। গুনেগুনে দশবার। নির্মম চাবুক চিরলো চামড়া। রক্তের ফিনকি ছুটল। বৃদ্ধ নিরুত্তাপ। কী এক অশেষ মনোবল তাঁর। জালিমের কাছে দয়া চাচ্ছে না। কাঁদছে না। হিমালয়ের মত স্থির, অটুট।
এভাবে প্রতিদিন চলছিল। দিন, মাস পেরিয়ে একেএকে চার বছর। ১৪৬০ দিন, ১৪,৬০০ টি চাবুক। জনমনে ক্ষোভ বাড়ছিল। একজন বৃদ্ধকে এভাবে দিনের পর দিন এতটা পাশবিক অত্যাচার- সহ্য অসম্ভব! আবার সে ব্যক্তি যদি হয় মহা বৈপ্লবিক কেউ। বিদ্রোহ দানা বাঁধল। শাসক সমাজ বুঝল বিষয়টা। এ বিদ্রোহ শুরু হলে থামবে না। একটা সুরাহা করতেই হয়।
৭৬৭ সালের ১৪ জুন। বারোশো বাহান্ন বছর আগে। বৃদ্ধার ঘরে ঢুকল জল্লাদ। হাতে চাবুক নেই। আছে একটি বাটি। তাতে খানিকটা তরল। জোর করে গিলালো বৃদ্ধকে। ঢলে পরলেন বৃদ্ধ। সাথে সাথে নিভল কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে ছিনিয়ে আনা জ্ঞানের প্রদীপ। যা সূর্যের থেকেও উজ্জ্বল। সূর্য শুধু পৃথিবী আলোকিত করে। কিন্তু এ বৃদ্ধ যুগযুগান্তরে মানব মানসের খেড়োপাতায় আঁকলেন জ্ঞান-প্রজ্ঞার ঐশী পূর্ণিমা।
এ বৃদ্ধের নাম- নুমান। উপনাম- আবু হানিফা। উপাধি- ইমামে আযম। মানে ইমামদেরও ইমাম।
কখনো ভেবেছেন কেন তাঁকে শহীদ করা হয়েছে? এতটা নির্মম ভাবে। শুধু কাজি বা চিফ অভ জাস্টিসের পদ অস্বীকার করাই কি সব? তিনি কি শুধুই ফিকহ্ শাস্ত্র ও মাযহাবের ইমাম? নাকি ইতিহাস ভিন্ন কিছু বলে। চলুন ঘুরে আসি আরব্যোপন্যাসের বাগদাদী যুগে।
কারবালা ঘটে ৬৬১ সালে। আসে উমাইয়া যুগ। সে সাম্রাজ্য শাসন করে মুসলিম বিশ্ব। টানা ৭৫০ সাল অবধি। ইমামে আযম জন্মান ৮০ হিজরি, ৬৯৯ সালে। এরপর আব্বাসিরা আসে। ৭৫১ সালের দিকে। টিকে কয়েকশ বছর। ইমামে আযম ৭৬৭ সালে চোখের আড়াল হন, ইন্তেকাল করেন। অর্থাৎ তিনি উমাইয়াদের ৫১ বছর, আব্বাসিদের ১৭ বছর পান।
৭৬৩ সাল, আব্বাসি যুগ। আল-মানসুর ক্ষমতায়। সে ডাকল ইমামে আযম কে। প্রস্তাব দিল প্রধান বিচারপতি হতে। ইমামে আযম মানলেন না। বললেন- আমি এ কাজের অযোগ্য। মানসুর ক্ষেপে বলল- আপনি মিথ্যুক। ইমামে আযম জবাবে মুচকি হাসলেন। বললেন- আমি মিথ্যাবাদী হলে আমার কথাই সত্য হল; কারণ- মিথ্যুক কখনো বিচারক হতে পারে না; অতএব আমি যোগ্য না। ব্যস! ইমামকে জেলে ঢুকানো হল। বছরের পর বছর জুলুম চলল। খেতে দিত না। চিকিৎসা ছিল না। অন্ধকার ঘরে রাখত। সে কি বর্বরতা!
শুধু কাজি পদ অস্বীকারের কারণেই কি কারাবাস? যদি তাই হয় তবে এত অত্যাচার কেন? যিনি চিফ অভ জাস্টিস হবার যোগ্যতা রাখেন তাঁকে তো রাজবন্দী বানানোর কথা। রাজবন্দীদের তো নির্যাতন হয় না! তবে কারণ কি?
রহস্য এখানেই। উমাইয়া-আব্বাসিরা সবাই ধোঁয়া তুলশী না। আহলে বাইতের ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে। আহলে বাইত মানে নবীবংশ। যদিও উমাইয়াদের উমর বিন আব্দুল আযিয ব্যতিক্রম ছিলেন। যাহোক, আহ্লে বাইতগণ কখনোই উয়ামাইয়া-আব্বাসিদের মানেন নি। ইমামে আযমের যুগে ছিলেন ইমাম যায়েদ বিন আলী। তিনি আহলে বাইতের ইমাম ছিলেন। তাঁর পিতা শাম্মে হুদা ইমাম জয়নুল আবেদিন আলাইহিস সালাম। যিনি মওলা হুসাইন আলাইহিস সালামের ছেলে। এবং কারবালায় শুধু তিনিই বেঁচে ফিরেছিলেন।
ইমাম যায়েদ ছিলেন বিপ্লবী। উমাইয়াদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ইমামে আযম তাঁর হাতে বায়াত নেন। বায়াত মানে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া। ইমামে আযম সম্মুখ সমরে যান নি। কিন্তু গোপনে অর্থ সাহায্য করতেন। জানা যায়, তিনি একসাথে বারো হাজার দিরহাম দিয়েছিলেন ইমাম যায়েদ কে। যা বর্তমান যুগে কয়েক কোটি হবে। এভাবে প্রতি প্রত্যেক ক্ষেত্রে ইমামে আযম আহলে বাইতের সেবা করতেন। মৌন বিপ্লবী ছিলেন। জানিয়ে রাখি, ইমামে আযম ধনাঢ্য ছিলেন। কাপড়ের ব্যবসা করতেন।
ইমাম যায়েদের ভাই ইমাম বাকের। ইমামে আযম তাঁর হাতেও বায়াত হন। এবং ইমাম বাকেরের ছেলে ইমাম জাফর সাদেকের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। বলতে চাচ্ছি, আহলে বাইতের প্রতি ইমামে আযমের প্রেম ছিল অসীম। এবং এ প্রেম ছিল, আছে চিরকাল তাঁর মাযহাব হানাফিয়াতের মধ্যে।
আল্লাহ বলেন- হে মাহবুব! আপনি বলুন, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে (ইসলাম পেয়েছে) সেটার জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না; শুধু চাই (রাসূলের) নিকটাত্মীয়ের ভালোবাসা (আস-শূরা : ২৩)। নিকটাত্মীয় মানেই আহলে বাইত। ইমামে আযম আল্লাহ্র হুকুমই পালন করেছেন মাত্র। শেষ নিঃশ্বাস দিয়েও ভালোবেসেছেন আহলে বাইতকে।
ইমাম আ’লা হযরত বলেন- সাথীরা তারকা এবং নৌকা সন্তান রাসুলুল্লাহ-রি। জীবন একটা সমুদ্রের মত। অবলম্বন না থাকলে ডুববেন। আহলে বাইত সে অবলম্বন। সে নৌকা যাতে উঠে নিজেকে বাঁচাবেন। আর সাথীরা, সাহাবারা তারকা বা নক্ষত্র। সমুদ্রগামী জাহাজ নক্ষত্র দেখে দেখে পথ চিনে। সাহাবারা বাতিঘর, দিকের দিশারী। আর আহলে বাইত হচ্ছেন নৌকা বা অস্তিত্ব। নৌকা না থাকলে নক্ষত্র থাকলেও এগোতে পারবেন না। ডুবে মরবেন।
ইমামে আযম দুটোই ধরেছিলেন। সাথী ও নৌকা দুটোই। তিনি তাবেয়ি ছিলেন। যে মুমিন মদিনা-মুনিব (দ) এঁর সাক্ষাৎ পায় নি, কিন্তু কোনো সাহাবাদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, তিনি তাবেয়ি। তাঁর সাহাবাপ্রেম নিয়ে আরেকদিন লিখব।
যাহোক, আব্বাসিরা জানত ইমামের আহলের বাইত প্রেমের কথা। এটাও জানত ইমামে আযমের অর্থ আহলে বাইতের বিপ্লব চলমান রাখছে; রাখতে সাহায্য করছে। কিন্তু কোনো প্রমাণ ছিল না। আর এ বিপ্লব আব্বাসিদের জন্য ছিল হুমকি। তাই ইমামে আযমকে বন্দী করা জরুরী হয়ে পরে। কিন্তু বাহানা পাচ্ছিল না।
একটা বাহানা পেল। তাঁকে প্রাধান কাজির হবার প্রস্তাব দিল। ইমাম প্রধান কাজি হলে তাঁর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে। আব্বাসিদের অনুকূলে আইন পাস, বিচার হবে। ইমামে আযমও বুঝেছিলেন এসব। তাই এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। কাজির পদ প্রত্যাখ্যান করলেন। ব্যস! আর পায় কে! রাজহুকুম অমান্যের দায়ে জেলে ঢুকানো হল।
আরেকটা কারণও ছিল। সে যুগে মুতাজিলা মতবাদ বাড়ছিল। আজকের ওহাবি-সালাফি-জামাতি-ইখওয়ানিদের মত সে যুগে মুতাজিলা ছিল বাতিল ফিরকা, সম্প্রদায়। ইতিহাসের বিষফোঁড়া। ইমামে আযম ছিলেন সে মতবাদের প্রধান বাঁধা। তিনি থাকলে মুতাজিলারা প্রতিষ্ঠা পাবে না। ইসলামের মৌলিকত্ব, আকাইদ ধ্বংস হবে না। আজকেও একই অবস্থা। ইমামে আযম ও হানাফিয়াত বা মাযহাব থাকলে ওহাবিতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না। এজন্যই ওহাবিরা মাযহাবের বিপক্ষে আদাজল খেয়ে নেমেছে।
মানসুর নিজেও ছিল মুতাজিলা। তাই ইমামে আযমকে ধ্বংস করতে ছিল বদ্ধপরিকর। সব মিলিয়ে এসব কারণেই ইমামে আযমকে শহীদ করা হয়। তাঁর অপরাধ কাজির পদ অস্বীকার না। আহলে বাইতের প্রেমই ছিল তাঁর অপরাধ। তাঁর শাস্তি ছিল নবীবংশের প্রতি সীমাহীন প্রেমের জন্য।
আহ! আমার ইমামে আযম। আমার আবু হানিফা। তিনি আমাদের মাযহাব, ফিকহ্, হাদিসশাস্ত্র, আকাইদ দিয়ে যান নি শুধু। তিনি আহলে বাইতের প্রেমও শিক্ষা দিয়েছেন। শিখিয়েছেন- সমস্ত কিছু ত্যাগ করেও আহলে বাইতকে ভালোবাসতে। তাঁদের দাসত্ব করতে। আহলে বাইতের প্রেম তাঁকে অমর করেছে।
সময় এসেছে ইমামে আযমকে সঠিকভাবে জানার। ইতিহাসের কালিতে ঢেকে রাখা সত্যকে উদ্ধারের। তাঁর অবদান, গুরুত্ব প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার। জাতি যেন তাঁর প্রাণ পুরুষদের না ভুলে।
ইমামে আযম কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ব না। তিনি একটি মহাকাল ব্যাপী প্রতিষ্ঠান। সত্যের সূতিকাগার। তাই আজও এত শতাব্দী পরে, বাংলা প্রান্তরে গরিব গালিবের অন্তরে একটি সুর বাজে-
ইমামে আযম জ্ঞানের পরম
আলোকে তোমায় ভালোবেসেছি
হৃদয়ে তোমার ছবি এঁকেছি...