তারা ফুঁৎকার দিয়ে আল্লাহ্‌র নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়!
- ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী
=====
চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। চোখের পাতাও ভারী হয়ে আসছিল। কান্না চলে এলো। হ্যাঁ, কান্নাই। আর ধরে রাখতে পারলাম না। এ কান্না নিউজিল্যান্ডে দুটো মসজিদে নিষ্ঠুরভাবে শাহাদাৎ প্রাপ্তদের জন্য। এ কান্না ওই ঘটনার পর ওই দেশের পার্লামেন্টে কুরআন তেলাওয়াতের মধ্যে দিয়ে একটি সেশন শুরু হওয়ার কারণে। এ কান্না দেশে দেশে মানুষকে ভালোবেসে অমুসলিমদের মসজিদ পাহারা দিতে দেখে। তারা বলছেন, 'তোমরা ভেতরে নামায পড়ো, আমরা বাহিরে তোমাদের পাহারা দেবো'। এ কান্না মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা দেখে। এ কান্না উদ্ধারকারী ফায়ার ব্রিগেডের দলের অন্তর ভারী হয়ে আসা দেখে। তারাও মানুষ। তাদেরও কষ্ট হয় অন্যের কষ্ট দেখে। এ কান্না সেদেশের আপামর জনতার শোক প্রকাশ দেখে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর হিজাব পড়ে মুসলমানদের জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিতে দেখে। এ কান্না সেখানকার স্কুল-কলেজ এবং বিভিন্ন সংগঠনের ছেলেমেয়েদের সহমর্মিতা প্রকাশ দেখে। তারা সেখানে গিয়েছেন, ফুল দিয়েছেন এবং এই নিন্দনীয় কাজকে ঘৃণা করেছেন ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যমে। হামলায় শহীদ হোসনে আরা আহমেদের স্বামী ফরিদ আহমেদ এর মধ্যেই বলেছেন, তিনি তাঁর স্ত্রীর হত্যাকারীকে ক্ষমা দিয়েছেন। ঘৃণায় ঘৃণা বাড়ায়, আর ভালোবাসায় শান্তি আনে। সেটাই তারা প্রমাণ করছেন।

এ মানুষগুলো ওইসব ঘৃণ্য সন্ত্রাসী, তাদের দোসর, সমর্থনকারী, নিষ্ঠুর ও ঘৃণ্য অপকর্ম দেখে উল্লাসকারী নিকৃষ্ট পরাজিতদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তারা তাদের বার্তা দিয়েছেন, 'তোমরা পরাজিত, তোমরা কুলাঙ্গার, তোমরা মানবতার শত্রু। তোমাদের স্থান আমাদের হৃদয়ে নাই, দেশেও নাই। কোথাও নাই।' 

আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর পূর্বে। উহুদের ময়দানে কাফের ও মুশরিকেরা মুসলমানদের নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল। তারা সামনে পরাজিত হয়ে পেছন থেকে লুকিয়ে অতর্কিত হামলা করে ৭০ জন সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) কে শহীদ করে ফেলে। সবচেয়ে দুঃখজনক ছিল সাইয়্যেদুস শুহাদা আমীর হামজা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ) 'র শাহাদাৎ। তাঁর পেট চিরে কলিজা চিবিয়ে খেয়েছিল। নাক-কান কেটে উল্লাস করেছিল সেদিনের কাফেরেরা। আল্লাহ্‌র নবী [ﷺ] কে নিঃশেষ করে দেবার উদ্দেশ্যে চারদিক থেকে একের একের পর বর্শা ও তীর ছুঁড়ছিল। একটি বর্শার আঘাতে রাসূল [ﷺ]-এঁর দাঁত মুবারক শহীদ হয়। মুষ্টিকতেক সাহাবা জীবন বাজি রেখে আল্লার রাসূল [ﷺ] কে ঘিরে রেখেছিলেন। কাফেরদের ছোড়া প্রতিটি তীর তাঁরা নিজেদের গায়ে নিয়েছিলেন। কেউ কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিলেন। এমন অবস্থায় রাসূল আরাবী [ﷺ] উহুদের পাদদেশে চলে গেলেন। উহুদ পাহাড় রাসূল [ﷺ] কে আশ্রয় দিল। নিজে ফেটে গিয়ে গুহা তৈরি করে দিল। আর রাসূলের মাথা মুবারক রাখার জন্য পাথরের পাহাড় নরম হয়ে গেল, ঠিক যেন তুলার বালিশ।

এরপর আল্লাহ্‌ পাক কুরআন অবতীর্ণ করে ঘোষণা করলেন, "তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহ্‌র নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁর নূর পরিপূর্ণ করা ছাড়া কিছু করতে অস্বীকার করেছেন। যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।" [সূরা তওবাঃ ৩২]

"তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূরকে পূর্ণতাদানকারী। যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে। তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্যদ্বীন সহকারে প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দ্বীনের উপর তা বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।" [সূরা ছফ-৮-৯]

আল্লাহ্‌ পাক তাঁর রাসূল [ﷺ] এর কাছে ওয়াদা করেছেন, তিনি এ সত্য দীনের বার্তা সর্বত্র পৌঁছে দেবেন। যেখানে সূর্য উদয় হয় এবং যেখানে সূর্য অস্ত যায়, সেখানে। অর্থাৎ এমন কোনও দেশ, ভূমি, জাতি, গোত্র বাকি থাকবে না যেখানে তিনি তাঁর একত্ববাদ এবং রেসালাতের সংবাদ পৌঁছে দেবেন না। এরপর যার ইচ্ছে তা গ্রহণ করবে আর যার ইচ্ছে তা প্রত্যাখ্যান করবে। তবে পৌঁছে দেয়া আল্লাহ্‌র কাজ। আল্লাহ্‌ পাক তাঁর রাসূল [ﷺ] কে দেয়া সেই ওয়াদা পরিপূর্ণ করছেন। আজ দুনিয়ার আনাচেকানাচে ইসলামের শান্তির বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে। যারা ভাগ্যবান তারা তা গ্রহণ করছে আর যারা অভাগা তারা তা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে।

নিউজিল্যান্ডের ঘটনার পর দিকে দিকে ইসলামের প্রতি মানুষের আগ্রহ বরং বাড়ছে। কোথাও কোথাও অনেকেরই ইসলাম গ্রহণের সংবাদ আসছে। তবে আমাদের উচিৎ হবে, প্রতিটি ঘটনাকে কৌশলে মুকাবিলা করা। ঘৃণাকে ঘৃণা দিয়ে নয়, বরং ঘৃণাকে ভালোবাসায় রুপান্তরিত করে সন্ত্রাসীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে যে, তোমরা পরাজিত। তোমরা উচ্ছিষ্ট। তোমাদের মিশন ব্যর্থ। ইসলাম বিজয়ী, মুসলমানেরা বিজয়ী। তোমরা ঘৃণা দিয়ে আল্লাহ্‌র নূরকে নিভিয়ে দিতে চাও, আর আমরা ভালোবাসা দিয়ে তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি সত্যের দিকে। এখন তোমাদের ইচ্ছে, সত্য গ্রহণ করবে নাকি অন্ধকারেই নিমজ্জিত হবে।
Top