• নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি ওয়া নুসাল্লিম আ'লা ইমামুল ক্বাওনাইনি ওয়া আ'লা আলিহি ওয়াস আসহাবিহি আজমায়ি।। আম্মা বা'দঃ-             



আল্লাহ রাববুল আলামীন প্রদত্ত ও তাঁর রাসূল (সাঃ) প্রদর্শিত জীবন বিধানই হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে এর অনুসারীদের জন্য এতে রয়েছে ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন তথা রাষ্ট্রীয় জীবনের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা ও যথার্থ নীতিমালা। এরই মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, আইন ও বিচার। অর্থনীতি প্রত্যেক জাতি বা রাষ্ট্রের জন্যেই অপরিহার্য। 

ইসলামী জীবন বিধানের অনুসারীদের জন্যেও একথা সত্য। তাই ইসলামী অর্থনীতি বলতে ঐ অর্থনীতিকে বোঝায় যার আদর্শ, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মপদ্ধতি এবং পরিণাম ইসলামী আকিদা মোতাবেক নির্ধারিত হয়। এই অর্থনীতির মূলনীতি ও দিক-নির্দেশনা বিধৃত রয়েছে আল-কুরআন ও সুন্নাতে। ইসলামী অর্থনীতিতে মানুষ মূলত সম্পদের মালিক নয়, ব্যবহারকারী মাত্র এই নীতির ভিত্তিতে ইসলামে নির্ধারিত সীমারেখার আলোকে মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ, বিশ্লেষণ, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও ন্যায়ানুগ বণ্টনের নিশ্চয়তা বিধান করাই ইসলামী অর্থনীতি। 

সম্পদ উপার্জনের নির্দেশঃ-

মহান রাববুল আলামীন মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে নিম্নরূপ নির্দেশনা প্রদান করেছেন : 
১. ‘‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের দিবসের কল্যাণ প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে, তার জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের জীবনে সুন্দরতম আদর্শ।’’ ইসলামী নীতি শাস্ত্র ও ইসলামী অর্থনীতি উভয়েরই উৎস এ উসওয়াতুন হাসানা। 
(সূরা আযহাব) 

২. ‘‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অপরের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে বা অবৈধ পন্থায় ভক্ষণ করো না। তবে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসায়িক লেন-দেন করতে পারো। আর তোমরা একে অন্যকে হত্যা করো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি বড় দয়ালু। আর যারা জুলুম সহকারে এভাবে সীমা অতিক্রম করবে তাদেরকে আমি জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করব।
 (সূরা নিসা : ২৯-৩০) 

ধন উপার্জনের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) উল্লেখ করেন :

 ১. ‘‘ইবাদতের সত্তরটি অংশ রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে হালাল রিযিকের সন্ধান।’’ 

২. ‘‘হালাল রুজির সন্ধান করা প্রত্যেক মুসলিম নারী পুরুষের জন্য ফরজ।’’ 

৩. ‘‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তার ধনী হওয়াতে দোষ নেই।’’ 

ইসলামী অর্থনীতি সম্পদের ব্যক্তি মালিকানায় বিশ্বাস করে, তবে সেই মালিকানা নিরংকুশ নয়, ব্যবহারকারী হিসেবে মাত্র। সম্পদের প্রকৃত মলিক আল্লাহ। সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলামী অর্থনীতি ব্যক্তির উদ্যোগকে সম্মান করে, তবে কোনক্রমেই হারাম বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর কোন দ্রব্যের উৎপাদন বা ব্যবসার অনুমতি দেয় না, তা যতই লাভজনক হোক না কেন। অনুরূপভাবে উৎপাদন বা ব্যবসার জন্য এমন কোন পন্থা সমর্থন করে না, যা ধোঁকা, প্রতারণা, বল প্রয়োগ বা অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার পর্যায়ে পড়ে। 
যেমন: মাপে কম দেয়া, দ্রব্যের দোষ-গোপন করে বিক্রি করা, জুয়া বা লটারীর মাধ্যমে মানুষকে ঠকানো। মজুদদারী বা কৃত্রিম পন্থায় বাজার দর প্রভাবিত করে অধিক মুনাফা করা ইসলামী অর্থনীতিতে নিষিদ্ধ।
সুদী কারবার বা কোন হারাম পন্থায় উপার্জনও গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে সকল হারাম পথ যেমন: সুদ, ঘুষ, জুয়া, হারাম ও নাপাক বস্তুর ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতারণা, অশ্লীলতার প্রসার ঘটায়। 
এমন যেকোন উপকরণের উৎপাদন ও ব্যবসা পরিচালনা, ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন, জবর দখল, অধীনস্তদের থেকে উপহার গ্রহণ ইত্যাদিকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। 
কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী সমস্ত সম্পদ- তা যেকোন রূপেই হোক, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই সৃষ্ট এবং তারই মালিকানাধীন, তার উপর মানুষের যে অধিকার জন্মে, তা একমাত্র আল্লাহরই অনুগ্রহে তারই নির্দেশে। 
সম্পদ বণ্টন এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে ইসলামী অর্থনীতিতে স্বাভাবিক আবর্তন ও প্রবাহ এবং প্রয়োজনে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। ইসলামী অর্থনীতি মানবসম্পদ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের বৈধ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে চায়, অপরদিকে চায় অপচয় রোধ, সুষম বণ্টন ও আবর্তনপ্রবাহ নিশ্চিত করে দারিদ্র্যবিমোচন ও অর্থনৈতিক সাম্য স্থাপন করতে। 

সম্পদ বণ্টন এবং ব্যয় এর নীতিমালাঃ-

মহান রাববুল আলামীন সম্পদ বণ্টন এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কোরআনে উল্লেখ করেন : 
১. ‘‘যে রিযিক আমি তোমাদেরকে দিয়েছি, তা থেকে খরচ কর।’’ 
(সুরা বাকারা-৩) 

২. ‘‘হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যে সমস্ত, হালাল ও পাক জিনিস রয়েছে সেগুলো খাও এবং শয়তানের দেখানো পথে চলো না। সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’’ 
(সুরা বাকারা-১৬৮) 

৩. ‘‘অপচয়কারী শয়তানের ভাই’’ 
(সূরা বণী ইসরাইল) 

৪. ‘‘আল্লাহর ঐ সম্পদ হতে তোমরা ব্যয় করো যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন।’
 (সূরা নূর-৩৩) 

৫. ‘‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে অথচ আল্লাহর রাস্তায় তা খরচ করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও।’’
 (সূরা তাওবা)। 

(৬) ‘‘তোমরা যে সম্পদ ব্যয় কর, তা তোমাদের নিজেদের জন্য’’ 
[সুরা বাকারা] 

(৭) ‘‘তাদের (বিত্তবানদের) সম্পদে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতদের হক আছে’
 [সুরা যারিয়াত-১৯]। 

(৮) ‘‘এ সম্পদ যাতে শুধুমাত্র ধনীদের মধ্যে কুক্ষিগত না হয়ে পড়ে’’ 
[সুরা হাশর-৭] 

(৯) ‘‘তারা আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের প্রাণপ্রিয় ধন সম্পদ আত্মীয়-স্বজন, এতীম, মিসকিন, মুসাফির, সাহায্য প্রার্থী ও ক্রীতদাসদের মুক্ত করার জন্য ব্যয় করবে’’ 
[সুরা বাকারা-১৭৭]। 

(১০) ‘‘এ সাদকাগুলো তো আসলে ফকীর মিসকিনদের জন্য আর যারা সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত এবং যাদের মন জয় করা (দ্বীনের জন্য) প্রয়োজন, তাদের জন্য। তাছাড়া দাসমুক্ত করার, ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করার, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের উপকারে ব্যয় করার জন্য এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিধান এবং আল্লাহ সব কিছু জানেন, তিনি বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞ’’ 
[সুরা তাওবা-৬০]। 

ধন বন্টন এবং ব্যয়ের ব্যাপারে আল্লাহর রসূল (সঃ) উল্লেখ করেন: 

(১) ‘‘হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা'আলা মুসলমান ধনী লোকদের ধন-মাল হতে এমন পরিমাণ দান করা ফরয করে দিয়েছেন, যা তা দ্বারা গরীব ফকীর মিসকিনদের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হতে পারে। ফলে ফকীর গরীবরা যে ক্ষুধার্ত কিংবা উলংগ থেকে কষ্ট পায়, তার মূলে ধনী লোকদের সাবধান হওয়া উচিত। নিশ্চয় জেনে রাখ আল্লাহ তা'আলা এই লোকদের খুব শক্তভাবে হিসেব গ্রহণ করবেন এবং তাদেরকে দেবেন কঠিন পীড়াদায়ক আযাব।
[তিবরানী,আসসাগীর ও আল আওসাত] 

(২) হযরত মিকদাম ইবনে মায়াদী কারাব (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূল (সঃ) বলেছেন, মানুষের খাদ্যের মধ্যে সেই খাদ্যই সবচেয়ে উত্তম, যে খাদ্য সে নিজ হস্তে উপার্জন করে। আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত দাউদ (আঃ) আপন হাতের কামাই হতে খাদ্য গ্রহণ করতেন,।
(বুখারী)। 

কুরআনের এবং হাদীসের উপরিউক্ত বর্ণনা অনুযায়ী ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদ বণ্টন ও ব্যয়ের লক্ষ্য হচ্ছেঃ 

(১) আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ রাশির সর্বাধিক উৎপাদন এবং সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। 
(২) প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক উপকরণ ও সেগুলোর প্রয়োজন মেটানোর মধ্যেকার ব্যবধান দূর করার সাথে সাথে মানবজাতির বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, মৈত্রী, সমবেদনা ও সহযোগিতার বন্ধন সৃষ্টি করা। 

(৩) সর্বোপরি মানব জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য-চারিত্রিক উন্নতি সাধনের মাধ্যমে পরকালীন চিরস্থায়ী জীবনে পরম শান্তি ও মুক্তি অর্জনে সহায়তা দান। এক কথায় বলা যায়, শুধুমাত্র বস্তুগত কল্যাণই ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য নয় বরং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে মানব জীবনে বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক তথা সামগ্রিক কল্যাণ সাধনই এর লক্ষ্য। 

মানুষের আর্থিক প্রয়োজনীয়তাঃ-

ইসলামী অর্থনীতিতে মানুষের বস্তুগত কল্যাণ বা আর্থিক প্রয়োজনীয়তাকে ৩(তিন) ভাগে ভাগ করা হয়েছে। 

(১) জরুরিয়াত [Bssic need] -আবশ্যিক প্রয়োজন। যেমন-খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। 

(২) হাজিয়াত [Comfort] অনুগামী প্রয়োজন। যেমন- হালাল রোজগার দ্বারা উন্নত সামগ্রী ভোগ ও ব্যবহার করা। 

(৩) তাহসিনিয়াত [Beautification]-মার্জিত ও সৌন্দর্য উপকরণ। যেমন শোভা বর্ধন, অলংকার, সুন্দর ফার্নিচার, বাগান ইত্যাদি। 

সম্পদ বণ্টন এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে যেসকল বিষয়ে লক্ষ্যণীঃঃ-
  
এছাড়া সম্পদ বন্টন এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রেখে খরচ করতে হবেঃ-

(১) মানুষের অধিকারে যে সব সম্পদ আছে সব কিছু আল্লাহ প্রদত্ত। 
(২) পরকালীন সফলতাকে সামনে রেখে ব্যয় করতে হবে। 
(৩) যেহেতু দৌলত আল্লাহ প্রদত্ত তাই এ সবের ব্যয় আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী হতে হবে। 
(৪) আয়ের উৎস হারাম হতে পারবে না এবং হারাম কাজে অর্থ ব্যয়ও হতে পারবে না।
(৫) মওজুদদারী নিষিদ্ধ। 
(৬) অপব্যয় না করা। 
(৭) ইসলামী রাষ্ট্র দুর্বল ও অসহায় লোকদের অভিভাবক হিসাবে কাজ করবে। 

সর্বোপরি ইসলামী অর্থনীতিতে ধন বণ্টন পদ্ধতি পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী উভয় মতাদর্শ হতে ভিন্ন ধরনের। পুঁজিবাদী অর্থনীতি স্বাধীন ও নিরংকুশ ব্যক্তি মালিকানার প্রবক্তা। সমাজতন্ত্র অর্থনীতি ব্যক্তি মালিকানার আদতেই স্বীকৃতি দেয় না। আর এ দুই প্রান্তিকতার মাঝখানটাই আসল সত্য। অর্থাৎ ইসলাম যে ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করে তা সম্পূর্ণ ও নিরঙ্কুশ নয়। যাতে পৃথিবীতে কোনো ধন বিপর্যয়ের সুযোগ ঘটাতে না পারে। 

পণ্যের উপর সম্পদের শ্রেণীবিভাঃঃ-

ইসলামী অর্থনীতিতে উৎপাদিত পণ্যের উপর সম্পদের অধিকারী হলো ২ শ্রেণীঃ-

প্রাথমিক পর্যায়ের অধিকার-
যারা উৎপাদন কার্যে অংশগ্রহণ করে, তাঁরা উৎপন্ন দ্রব্যের প্রত্যক্ষ হকদার হিসেবে পরিগণিত। 

দ্বিতীয় পর্যায়ের অধিকারঃ- 
যারা প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদন কার্যে অংশ নেয়নি বটে, কিন্তু উৎপাদনকারীরা নিজেদের অর্জিত পণ্যে তাদেরকে হকদার বানিয়ে নিতে আইনগতভাবে বাধ্য। উৎপাদিত পণ্যের বা সম্পদের প্রথম পর্যায়ে মালিক তার উৎপাদনকারীই হয়ে থাকে। 

কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে উৎপাদকের সংজ্ঞা, এর পরিভাষা এবং তাঁদের ধন ও আয় বণ্টন পদ্ধতি ঠিক তেমন নয় যেমন পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনায় রয়েছে, বরং অনেকটা স্বতন্ত্র। 

উৎপাদকসমূহঃ-

ইসলামের দৃষ্টিতে দ্রব্যের প্রকৃত উৎপাদক বা উৎপাদনের উপাদান ৩ (তিনটি)। মুফতি মুহাম্মদ শফি তাঁর ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থ বণ্টন গ্রন্থে উৎপাদনের উপাদান ৩ (তিনটি) উল্লেখ করেছেনঃঃ-

(ক) Capital [পুঁজি] ঃ
 উৎপাদনের ঐ উপকরণ বা উপাদান, যাকে ব্যয় অথবা রূপান্তর করা ব্যতিরেকে উৎপাদন কার্যে ব্যবহার করা সম্ভবপর নয়, তাই একে ভাড়ায় খাটানো যায় না। যেমন-নগদ টাকা, খাদ্য দ্রব্য ইত্যাদি। 

(খ) Land [ভূমি] ঃ 
উৎপাদনের যে উপকরণকে কোনো রকমের রূপান্তর না করেই খাটানো যায়, তাই একে ভাড়া হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন-জমিন, বাসগৃহ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। 

(গ) Labour [শ্রম] ঃ 
মানুষের শারীরিক ও মানবিক উভয় প্রকারের মেহনত। সুতরাং ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন কার্যও এরই অন্তর্ভুক্ত। 
উপরিউক্ত উৎপাদকগণের বা উপাদানের মিলিত শ্রমের ফলে যে সম্পদের সৃষ্টি হয় তা প্রথম তাদের সকলের মধ্যে এরূপভাবে বণ্টন করে দেয়া হয় যে, প্রথম অংশ মুনাফা হিসেবে পুঁজির প্রাপ্য সুদ হিসেবে নয়। দ্বিতীয় অংশ ভূমির জন্য ভাড়া বাবদ, আর তৃতীয় অংশ শ্রমকে মজুরি হিসেবে দেয়া হয়। 

ইসলামী অর্থনীতিতে ২য় পর্যায়ের অধিকারীদের তালিকা অর্জিত সম্পদেঃঃ-

ইসলামী অর্থনীতিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের অধিকার-যারা প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদন কার্যে অংশ নেয়নি বটে, কিন্তু উৎপাদনকারীরা নিজেদের অর্জিত পণ্যে তাদেরকে হকদার বানিয়ে নিতে আইনগতভাবে বাধ্য। আর এই অর্থ বিলি-ব্যবস্থা দৃষ্টিভঙ্গির একটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য এই যে, সমাজের দুর্বল শ্রেণীকে শক্তিশালী এবং বেকার জনশক্তিকে কাজের উপযুক্ত বানাবার মানসে সে দ্বিতীয় পর্যায়ের হকদারের এক বিরাট তালিকা উৎপাদনকারীদের অর্জিত সম্পদে হকদার হিসেবে পেশ করেছে এবং এর একটি আইনানুগ পদ্ধতিও কায়েম করেছে। এ সকল খাত নির্দিষ্ট করে দিয়ে ইসলাম সম্পদকে সমাজের প্রতিটি স্তরে ব্যাপকভাবে আবর্তিত করতে এবং সুদকে হারাম ঘোষণা করে সম্পদ এককেন্দ্রীকরণের উপর যে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রচলন করেছে, একে অধিকতর ব্যাপক করতে চায়, আর এ খাতগুলো হলো নিম্নরূপ ঃ 

১) যাকাতঃ- যাকাত ব্যয়ের খাত ৮টি অর্থাৎ যাকাত যারা পাবেন তারা হলেন যথা-
ক. ফকির, 
খ. মিসকিন, 
গ. যাকাত সংগ্রহে নিয়োজিত কর্মচারী (আমিলুন), ঘ. মন জয় করার জন্য, 
ঙ. দাসমুক্ত করার জন্য, 
চ. ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ করার জন্য, 
ছ. আল্লাহর পথে, 
জ. মুসাফির, 

২) উশর, 
৩) কাফ্ফারাত, 
৪) সদকায়ে ফিতর, 
৫) নাফাকাত, 
৬) ওয়ারাসাত, 
৭) খিরাজ ও জিজিয়া। 

ধন ব্যয়ের মূলনীতিঃ-

এছাড়া ইসলামী অর্থনীতিতে ধন ব্যয়ের কতিপয় মূলনীতি প্রদান করা হয়েছে যা নিম্নরূপ ঃ 

১) ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অর্থ ব্যয়, 
২) পারিবারিক প্রয়োজনে অর্থ ব্যয়, 
৩) প্রতিবেশীদের জন্য অর্থ ব্যয়, 
৪) নিকট আত্মীয়দের জন্য অর্থ ব্যয়, 
৫) ইয়াতিম ও নিঃস্ব পথিকদের জন্য অর্থ ব্যয়, 
৬) সামাজিক প্রয়োজনে অর্থ ব্যয়, 
৭) সর্বসাধারণের প্রয়োজন অর্থ ব্যয়, 
৮) মীরাস ও উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ বণ্টন, 
৯) ওয়াছিয়াত সূত্রে সম্পদ বণ্টন। 


পরিশেষে উপরিউক্ত আলোচনা এবং পর্যালোচনার আলোকে দৃঢ়তার সাথে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইহকালীন কর্মকান্ডের জন্যে পরকালীন মুক্তি বা শাস্তির এমন দ্ব্যর্থহীন ও দৃঢ় ঘোষণা দেয়া হয়নি। বৌদ্ধ ধর্মে দুনিয়াকে জীর্ণ বস্ত্রের মতো ত্যাগের পরামর্শ দেয়া হয়েছে, পক্ষান্তরে ইসলামে কর্মবীর হতে বলা হয়েছে। খৃস্টধর্মে সকল পাপের ভারবহনকারী হবেন যীশু। পরকালে তিনিই হবেন পরম পরিত্রাতা, সুতরাং তার উপর বিশ্বাস ও দায়িত্ব অর্পণ করে দুনিয়ার সকল বৈধ-অবৈধ ভোগ বিলাসে মত্ত হওয়ায় যেমন বাধা নেই, তেমনি বাধ্যবাধকতা নেই উপায় উপার্জনের এবং সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে হালাল হারামের বিধি-বিধান মেনে চলার। হিন্দুধর্মে কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুলিখিত অর্থনৈতিক আচরণবিধি নেই। বরং খৃস্ট, হিন্দু ও ইহুদী-পৃথিবীর এই তিনটি ধর্ম একযোগে পুঁজিবাদকেই বরণ করে নিয়েছে। 
[শাহ মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান-ইসলামী অর্থনীতি]। 
এরই বিপরীতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শ ইসলামে অর্থনৈতিক সুকীর্তি বা হালাল কাজের জন্যে ইহকালীন কল্যাণের সুসংবাদের পাশাপাশি পারলৌকিক জীবনেও আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অপরদিকে যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করবে, গরীব-দুঃখীদের কোনো উপকারে সচেষ্ট হবে না বরং হারাম কাজে অংশ নেবে, তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তির সংবাদ।

যেমন আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন, 
‘‘সেই লোকদের অতি পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও যারা স্বর্ণ-রৌপ্য পুঁজি করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না।’’ 
(সূরা ঃ আত্-তওবা ঃ ৩৪ আয়াত)। 

মুমিন মুসলমান অদৃশ্য বা গায়েবে বিশ্বাস করে বলেই আখেরাতে বিশ্বাস তার ঈমানের অঙ্গ। তাই ইসলামী জীবন বিধান তথা ইসলামী অর্থনীতিতে আখেরাতের কল্যাণ অর্জনের প্রতি এত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের শেষে মোনাজাতেও বান্দাহ আল্লাহর কাছে যুগপৎ দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণই প্রার্থনা করে। 
আখেরাত যে মুসলমানের জীবনের কতখানি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা অনুধাবনের জন্য রাসূলে করীমের (সাঃ) একটি মাত্র উক্তিই যথেষ্ট। 

তিনি বলেন, 
এই দুনিয়া আখেরাতের জন্যে শস্যক্ষেত্রস্বরূপ। 

এর অন্তর্নিহিত অর্থই হচ্ছে এখানে যে যেমন বীজ বুনবে অর্থাৎ কাজ করবে, আখেরাতে সে তেমন শস্য বা প্রতিফল পাবে। আখেরাতের শাস্তি ও পুরস্কার প্রাপ্তি সম্বন্ধে যার মনে এতটুকু ভয় ও আগ্রহ নেই, তার দ্বারা দুনিয়ার যেকোনো অকল্যাণ ও অমঙ্গল সম্ভব। অপরপক্ষে তার দ্বারা হালালকে অর্জন ও হারামকে বর্জন, সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদ এবং আদল ও ইহসানের প্রতিষ্ঠা কোনোটাই সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে তাযকিয়া আত্মপরিশুদ্ধি অর্জন ও তাকওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হলে এবং আখেরাতকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে নিলে, ইহকালের জীবনধারা খোদায়ী বিধান অনুসারে পরিচালিত হতে বাধ্য এবং এই পথেই যুগপৎ দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ অর্জন সম্ভব। তাই ইসলামী জীবন বিধানের আলোকে তথা ইসলামী অর্থনীতির নিয়ম-নীতি অনুসারে যদি প্রত্যেকটি মানুষ, ধন উপার্জন, ধন বণ্টন এবং ধন ব্যয়নীতি মেনে চলে, তাহলে যেকোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে সুবিচার ও সুষম অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা হতে বাধ্য।
ú
Top