"ফেইসবুকে এটাক" : একটি নতুন সামাজিক ব্যাধীর নাম
-------------------------------
কৃতঃ-সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী
প্রতিষ্ঠাতা,লিবারেল ইসলামিক স্কুল,ঢাকা।
এমনিতেই সমাজ থেকে tolerance বা সহনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা নামক জিনিসটা দিন দিন কমে যাচ্ছে, তার ওপর সোশাল মিডিয়াগুলো যেন সেই অসহনশীলতার আগুনে ঘি ঢালছে। আমরা যে কেউ যে কাউকে সোশাল মিডিয়াতে যা ইচ্ছা তা বলে দিচ্ছি। অথচ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন,
وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا
"(সকল) মানুষের সাথে উত্তম কথা বলবে।"
(সূরা বাক্বারা, আয়াত নং ৮৩)
আল্লাহর হাবিবﷺ সেই সুরেই সুর মিলাচ্ছেন,
أَنَّ النَّبيَّ ﷺ قَالَ: مَنْ كَانَ يُؤمِنُ بِاللَّهِ والْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُحْسِنْ إلى جارِهِ، ومَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ واليومِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ، ومَنْ كانَ يُؤمنُ باللَّهِ واليومِ الآخرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَسْكُتْ
"যে আল্লাহ পাক ও পরকালে বিশ্বাস করে সে যেন তার প্রতিবেশীর সাথে উত্তম ব্যবহার করে, যে আল্লাহ পাক ও পরকালে বিশ্বাস করে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে এবং যে আল্লাহ পাক ও পরকালে বিশ্বাস করে সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা যেন চুপ থাকে।"
(সহিহ মুসলিম)
দেখুন এই ভার্চুয়াল জগতে আমরা সবাই সবার প্রতিবেশী, হোক একজন আমেরিকাতে থাকে অপরজন বাংলাদেশে। তারা উভয়েই এই সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করছে। কত বড় কথা বলেছেন আল্লাহর রাসূল ﷺ! প্রতিবেশীর প্রতি ইহসান করাকে, উত্তম আচার-ব্যবহার করাকে , উত্তম কথা বলাকে স্বয়ং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও পরকালে বিশ্বাসের শর্ত বানিয়েছেন।
অথচ আমরা এমনিতে হয়ত সামনাসামনি চক্ষুলজ্জার কারনেই হোক কিংবা অন্যকিছু, যেই লোকটাকে ফেইসবুক বা অন্য কোন সোশাল মিডিয়াতে যা ইচ্ছা তা বলে দিচ্ছি তা বাস্তবে কোনদিনই বলতাম না। ঔদ্ধত্যপূর্ন কথা, আচরন, গালিগালাজ, অশ্লীল ও কটু কথার বন্যা বইয়ে দিচ্ছি এই সোশাল মিডিয়াতে, কিন্তু বাস্তবে আমরা হয়ত মানুষগুলোর সাথে এত খারাপ ব্যবহার করি না।
It has become a new social phenomenon, which is not a good sign at all.
অথচ, সোশাল মিডিয়াতে কাউকে খারাপ কিছু বলা আর বাস্তবে সামনাসামনি কটু কথা বলার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সামনা সামনি কটু কথা বললে মানুষ যত কষ্ট পায়, সোশাল মিডিয়াতে বললেও তেমনি কষ্ট পায়। বরং সোশাল মিডিয়াতে সে আরো বেশি বেইজ্জত হয়, কারন সেখানে সবাই সবকিছু দেখে ও শুনে।
কটুবাক্য এত খারাপ ও দূষিত যা একখানা হাদিসের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি।
আবু দাউদ ও তিরমিজির সহিহ হাদিসে বর্নিত আছে,
একদা হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) প্রিয় নবী ﷺ এঁর কাছে বসেছিলেন এমন সময় উম্মুল মুমিনিন (নবীজীর অপর স্ত্রী) হজরত সাফিয়াহ বিনতু হুয়াই (রা:) সেখানে আসলেন। আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) বলে ওঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনার জন্য তো এতটুকুই যথেষ্ট যে সাফিয়্যাহ এরকম এরকম (কটু বাক্য বললেন), সাফিয়্যাহ তো বামুন।
সায়্যিদুনা নবী কারিম ﷺ বললেন, "হে আয়েশা! তুমি এমন একটি দূষিত কথা বলেছ, যা সাগরের পানির সাথে মেশালে তা সমস্ত সাগরের পানিকে দূষিত করে ফেলত।"
অথচ তিনি যা বলেছেন তা সত্য ছিল, হজরত সাফিয়া রা: সত্যিই একটু বেটে ছিলেন। তবুও এই রূঢ় সত্যটিকেই প্রিয় নবী কারিম ﷺ বলেছেন দূষিত কথা যা সাগরের সমস্ত পানিকে দূষিত করে দিতে পারে। কারন এই কটুবাক্যটি একজন মানুষের মনে আঘাত করেছে, তার মন ভেঙ্গে দিয়েছে। আর আল্লাহর রাসূলﷺ কা'বা শরীফ তাওয়াফরত অবস্থায় ক্বাবার দিকে ইশারা করে বলেছেন, "সেই মহান স্বত্তার কসম যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ! নিশ্চই একজন মুমিনের (ইজ্জত,) মাল ও সম্পদের সম্মান আল্লাহর কাছে তুমি ক্বাবার সম্মানের চেয়েও বেশি।"
(ইবনে মাজাহ ৩৯৩০, তিরমিজি ২০৩২)
হুজুর নবী কারীম ﷺ আরো বলে,
كل المسلم علي المسلم حرام ماله ودمه وعرضه
"এক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের ইজ্জত, সম্পদ ও রক্ত হারাম।"
কাউকে সোশাল মিডিয়াতে গালি দেয়া, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, অপমান করা মানে তাকে লোকসম্মূখে বেইজ্জত করা যা আমাদের জন্য হারাম।
শুধু মুসলমান ভাই-বোন কেন, ধর্ম মত নির্বিশেষে যেকোন মানুষের উপর হাত ও কথা দিয়ে আঘাত করা সমান অপরাধ। কারন মুসনাদ আহমদ ইবনে হাম্বলের সহিহ হাদিসে এসেছে,
المسلم من سلم الناس من لسانه و يده
"মুসলমান সেই যার হাত ও জিহ্বার (ক্ষতি) থেকে অপর মানুষ নিরাপদে আছে।"
ফেইসবুক ও সোশাল মিডিয়াতে একে অপরকে আক্রমন, নেগেটিভ কথা বলা, কটুবাক্য ও অশ্লীল গালাগালি বিনিময় আমাদের বাস্তব জীবনকেও দূষিত করছে। ভার্চুয়াল জগতে এসব হচ্ছে বলে আমাদের বাস্তব জীবনে এর প্রভাব পড়ছে না বলে যদি কেউ মনে করেন, তবে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
কী দরকার আমাদের বক্তা, নায়ক, গায়ক ও বিভিন্ন সেলিব্রেটিদের পার্সোনাল লাইফের খুটিনাটি ঘেটে বের করে, সেসব নিয়ে বাজে মন্তব্য করার ও নিজেদের মধ্যে বিভেদ আরো বাড়ানোর। আবারো ফিরে যাই প্রথম হাদিসখানার শেষাংশের দিকে
"এবং যে আল্লাহ পাক ও পরকালে বিশ্বাস করে সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা যেন চুপ থাকে।"
আমরা কারো সম্পর্কে কিছু বললে তা যেন উত্তম হয়, আর না হয় যেন চুপ থাকি। আমাদের মুখের জবানের ব্যালেন্স থাকা উচিৎ, কথার ইস্তেকামাত থাকা উচিৎ। কারন হাদিস শরীফে এসেছে,
لا يستقيمُ إيمان عبد حتى يستقيمَ قلبه، ولا يستقيم قلبه حتى يستقيم لسان
"ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার ইমানের ইস্তেকামাত (স্থিরতা) হাসিল হয় না যতক্ষণ না তার অন্তরের ইস্তেকামাত (স্থিরতা) হাসিল হয়। আর ততক্ষণ পর্যন্ত তার অন্তরের ইস্তেকামাত (স্থিরতা) হাসিল হয় না যতক্ষণ না তার জবানের (ভাষার) ইস্তেকামাত (স্থিরতা) হাসিল হয়।" (মুসনাদ আহমদ)
তাই আমাদের ইমানের ইস্তেকামাতের জন্য জবানের ইস্তেকামাত খুব প্রয়োজন। হোক তা ভার্চুয়াল জগতে কিংবা বাস্তব জীবনে। ঔদ্ধত্যপূর্ন কথা, হিংসাত্মক-আক্রমনাত্মক কথা, কটু কথা, গালিগালাজ, মিথ্যা, অপবাদ, গীবত, অশ্লীল কথা সম্পূর্নরুপে পরিত্যাগ করতে হবে। কারন এই জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের অপব্যবহারের কারনেই বেশিরভাগ মানুষ দোজখে যাবে বলে হাদিসে উল্লেখ আছে।
শেষ কথা, যেচে পড়ে ঝগড়া করা, বেশি বেশি তর্ক যেন পরিহার করি। কারন হাদিস শরীফে উল্লেখ রয়েছে, ঝগড়াটে টাইপের মানুষ আল্লাহর খুব অপছন্দের ব্যক্তি। আরো বলা হয়েছে, সত্যের ওপর আছে জেনেও যে ব্যক্তি তর্ক পরিহার করে সে তার বিনিময় পাবে। আমাদের সোশাল মিডিয়ার বেশিরভাগ সমস্যা শুরু হয় অযথা তর্ক থেকে।
আল্লাহ পাক আমাদের ওপর খাস রহমত করুন।